২য় অংশ
অশ্বিনীর কবি গাওয়ার আদেশ
একদিন শ্রীতারক গান গাহিবারে।
দল বল সহ গেল কালিয়া বাজারে।।
বিপক্ষের সরকার আনন্দ নামেতে।
দূর্গাপুর বাড়ী ছিল বিখ্যাত কবিতে।।
দৈবের কারণে তিনি আসিল না সেথা।
আসরেতে বসে আছে শত শত শ্রোতা।।
তাই জেনে বলিতেছে তারক গোঁসাই।
শুন বলি ও অশ্বিনী তোমাকে জানাই।।
তুমি আজি বিপক্ষের সরকার হও।
আমার সঙ্গেতে তুমি কবিগান গাও।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী কেন্দে কেন্দে কয়।
আমা দ্বারা এই কাজ সম্ভব না হয়।।
তারক বলেছে বাছা শোন তোরে কই।
আশীর্বাদ দিনু আমি তুই হবি জয়ী।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী আসরেতে গেল।
বিপক্ষের কবি সেজে গাহিতে লাগিল।।
অশ্বিনীর শুনে সবে কাব্য অলোচনা।
নিশ্চয় পুরাণ কবি করিল ধারণা।।
পাঁচালী করিয়া সাঙ্গ ধরে ধুয়া গান।
ধুয়া গানে হরে নিল শ্রোতাগণের প্রাণ।।
অশ্বিনীর কন্ঠ ধ্বনি অতি সুমধুর।
শ্রোতাগণে বলে সুরে মধুর মধুর।।
গান শুনে আত্মহারা কেহ কেহ কয়।
এতদিন এই কবি ছিল বা কোথায়।।
গানেতে হরিয়া নিল সবাকার প্রাণ।
গান শুনে কত জনে হারাইল জ্ঞান।।
কেহ কেহ সেই গানে আখি জলে ভাসে।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশে বাতাসে।।
গান শুনে কেঁদে ওঠে তারকের মন।
আশীর্বাদ দেয় তারে করি আলিঙ্গন।।
সে আসরে গান করে হইল বিদায়।
বিদায় হইল সবে আনন্দ হৃদয়।।
তাহা হতে চলিলেন চালনা গ্রামেতে।
কবিগান করিবেন সেই আসোরেতে।।
সেখানেতে করিলেন কাব্য আলোচনা।
অশ্বিনীর গুণগান কহে সর্বজনা।।
তাই শুনে তারকের আনন্দ বাড়িল।
ধন্য ধন্য বলি তারে আশীর্বাদ দিল।।
সেই খানে গান শেষে বিদায় হইয়া।
জয়পুর চলিলেন অশ্বিনীকে নিয়া।।
অশ্বিনীকে বলিলেন তারক গোঁসাই।
শুন শুন রে অশ্বিনী তোমাকে জানাই।।
বাড়ী গিয়ে দল করি কবিগান গাও।
হরিচাঁদ লীলাগীতি তুমি লিখে দাও।।
হরিচাঁদ পোষা পাখি তুমি বাছাধন।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী প্রণমিয়া পায়।
ছল ছল আখি দু’টি কেন্দে কেন্দে কয়।।
আমি অতি মূঢ়মতি কোন গুণ নাই।
কেমনে পারিব আমি তোমাকে জানাই।।
তারক বলেছে বাছা ভয় কি লাগিয়া।
গুরুচাঁদ দিয়াছেন আশীষ করিয়া।।
ভয় নাই চলি যাও কর কবিগান।
আমি আজি করিলাম আশীর্বাদ দান।।
তাই শুনে প্রণমিল তারকের পায়।
ছল ছল আখি দু’টি কেঁদে কেঁদে কয়।।
তোমার আদেশ আমি করিব পালন।
সূক্ষ্মরূপে মম দেহে থাকিও তখন।।
চিন্তামণি পদে গিয়া প্রণাম করিয়া।
জলে ভরা আখি দু’টি কহিছে কাঁন্দিয়া।।
এতদিন ছিনু মাগো তোমাদের ঠাই।
বিদায় করহ মাতা গঙ্গাচর্ণা যাই।।
চিন্তামণি বলিলেন শুন বাছাধন।
ভক্তিপথে থাকে যেন সদা তব মন।।
এই ভাবে বলে কয়ে করিল গমন।
গৃহে এসে সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।।
কবিগান করিবারে বলেছে গোঁসাই।
কেমনে করিব দল মনে ভাবে তাই।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ মনেতে ভাবিয়া।
দল করি কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।।
তিন বর্ষ কবিগান গাহিলেন মাত্র।
আসরেতে গান গায় ঝরে দু’টি নেত্র।।
মাঝে মাঝে আসরেতে সম্বিত হারায়।
কবিগান ছেড়ে দিয়ে হরিগুণ গায়।।
হরিচাঁদ লীলা গান রচনা করিয়া।
ভাবের আবেশে সদা বেড়াত গাহিয়া।।
নিজের রচনা পদ নিজে সুরকার।
নিজে গেয়ে নিজে শোনে চোখে বহে ধার।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
কাঁদিয়া বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
অশ্বিনীর সংসার জীবন
কবিগান ছেড়ে দিয়ে হরিগুণ গায়।
সংসারের অনটন কষ্টে দিন যায়।।
মা বাপের দুঃখ দেখে আনন্দ মনেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
এইভাবে সংসারের চলিতে লাগিল।
হরি সংগীতের গান লিখিয়া চলিল।।
নিজের হাতের লেখা মোটে ভাল নয়।
পাঠশালে শিখেছিলেন বর্ণ পরিচয়।।
ভদ্রকান্ত নামে ছিল খুড়তাত ছেলে।
অশ্বিনীকে ডাকিতেন দাদা দাদা বলে।।
তাহার হাতের লেখা অতীব সুন্দর।
তারে দিয়ে লেখাইত পাণ্ডুলিপি তার।।
এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
হরি লীলাগান সদা লিখিতে লাগিল।।
একদিন বলে তারে তার পিসিমাতা।
বিবাহ করিতে হবে শুন মোর কথা।।
পাড়া প্রতিবেশী সবে আত্মীয় স্বজন।
সকলের ইচ্ছা তুমি কর হে পূরণ।।
অশ্বিনী বলেছে আমি বিয়া না করিব।
বিবাহ করিলে আমি পাশ বব্ধ হ’ব।
মায়াজালে বন্দী হয়ে সংসারেতে র’ব।।
মধুমাখা হরিনাম ভুলিয়া যাইব।
তাই শুনি তার পিতা বলেছে বচন।।
সার কথা আমি তোমা বলিব এখন।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ এ ভব সংসারে।।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।
বুঝেও বোঝনা কেন হয়েছ দুর্বল।।
আমার কথায় তুমি বিবাহ করিলে।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি যাই বলে।।
পিতার আদেশ শুনি অশ্বিনী তখন।
বিবাহ করিতে তার হইলেন মন।।
কাননচক নিবাসী সঞ্জয় মন্ডল।
সত্যবাদী জ্ঞানীগুণী হৃদয় সরল।।
তার জ্যেষ্ঠা কন্যা হয় মালঞ্চ নামেতে।
অশ্বিনীর পরিণয় হল তার সাথে।।
এইভাবে সংসারের দিন কেটে যায়।
সংসারের কর্ম করে হরিগুণ গায়।।
কিছুদিন পরে সেই শুভ লগনেতে।
এক কন্যা জনমিল তাহার গর্ভেতে।।
তাই দেখে তার পিতা আনন্দ হৃদয়।
কোলে করে সেই কন্যা হরিগুণ গায়।।
বিমলা রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।
সন্তষ্ট হইল সবে সে নাম শুনিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী খাটে সংসারেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
অশ্বিনীর কাকা হয় নিজ বংশধর।।
অশ্বিনীকে ভালবাসে সেই মহাশয়।
তাহার জমিতে নিয়ে মজুরী খাটায়।।
বাল্যকালে সে অশ্বিনী পোদ্দার বাটিতে।
গরু চরাইত সদা বিশুদ্ধ মনেতে।।
অশ্বিনীর গুণ কথা মনেতে জানিয়া।
তাই তারে ভালবাসে নিকটে পাইয়া।।
অশ্বিনীকে বলিতেন শুন বাছাধন।
আমার জমিতে বসে করিও কীর্ত্তন।।
হরিনাম করিবারে মোর নাই মানা।
কিষাণের দাম আমি দিব ষোল আনা।।
কর্ম না করিলে আমি মূল্য তোমা দিব।
তোমার মুখেতে আমি ঐ নাম শুনিব।।
এক বন্দে দুই বিঘা জমি পরিমাণ।
সে জমিতে বসে করে হরি গুণগান।।
প্রতিদিন সে জমিতে অশ্বিনীকে নিয়ে।
হরি গুণগান করে জমিতে বসিয়ে।।
এইভাবে দুই মাস গত হয়ে গেল।
এক গাছ বল কভু মারা নাহি হল।।
আর যত জমি ছিল কিষাণ লইয়া।
আগাছার বল যত দিল নিড়াইয়া।।
সবে বলে কি দেখেছে পোদ্দার মশায়।
অই জমি ফাল যাবে জানিও নিশ্চয়।।
কর্ম না করিয়া যদি ফসল পাইবে।
তবে কেন মানুষেতে না খেয়ে খাটিবে।।
এইভাবে কত জনে কত কি বলিল।
যে যেমন বোঝে তাই কহিতে লাগিল।।
জলে মগ্ন হয়ে জমি বন পচে গেল।
তাহাতেই সেই ধান সতেজ হইল।।
শেষকালে দেখা গেল অন্য জমি হতে।
দ্বিগুণ ফলিল ধান নামের গুণেতে।।
হরিভক্ত মুখে শুনে হরি গুণগান।
দ্বিগুণ ফসল ফলে জগতে প্রমাণ।।
যারা যারা অশ্বিনীকে ঠাট্টা করেছিল।
তারা এসে অশ্বিনীর চরণে পড়িল।।
কেঁদে কেঁদে তারা সবে কহিছেন বাণী।
তুমি আজি ক্ষমা কর ওহে গুণমণি।।
অশ্বিনী বলেছে আমি কিছুই না জানি।
যার কাজ সেই করে হরি গুণমণি।।
পতিত তারিতে হরি এল এ জগতে।
হরিনামে পাপ তাপ সকলে নাশিতে।।
তাই শুনি তারা সবে হরি হরি বলে।
সেই দিন হতে তারা হরিভক্ত হলে।।
এইভাবে কেটে যায় সংসার জীবন।
সংসার করিতে তার নাহি লয় মন।।
দাম্পত্য জীবনে তার মোটে শান্তি নাই।
দুই ভাবে দু’টি প্রাণ মিলিয়াছে তাই।।
সংসার বিরাগী হয়ে ঘুরিয়ে বেড়ায়।
হরিচান্দ গুণগান গাহিত সদায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
জ্বর হয়ে তার পিতা ভূগিতে লাগিল।।
একদিন অশ্বিনীকে ডেকে এনে কয়।
শুন শুন রে অশ্বিনী বলি যে তোমায়।।
আনারস খেতে ইচ্ছা মনে জাগিতেছে।
এনে দাও আনারস বলি তব কাছে।।
পিতৃ বাক্য শুনি কানে অশ্বিনী তখন।
ভক্তি গদগদ চিত্ত ঝর দু’নয়ন।।
পিতৃভক্ত সে অশ্বিনী করিল গমন।
কোথা পাবে আনারস ভাবে মনে মন।।
অকালেতে আনারস কোথা গিয়ে পাই।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতেছে তাই।।
কভু যদি আনারস মিলাতে না পারি।
জীবন ত্যাজিব আমি বলে হরি হরি।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ রাখিয়া অন্তরে।
পথ বেয়ে চলে রত্ন আখি দু’টি ঝরে।।
অন্তরে জানিয়া তাহা হরি দয়াময়।
আনারস বাগানেতে তখনে জন্মায়।।
বড় বেড়ে রাস্তা গিয়া অশ্বিনী হাটিছে।
পাকা আনারস ঘ্রাণ নাকেতে লেগেছে।।
যেই দিকে ঘ্রাণ আসে সেই দিকে যায়।
গিয়ে সেই বাগানেতে দেখিবারে পায়।।
বড় এক আনারস গাছে পাকিয়াছে।
তাই দেখে সে অশ্বিনী মনেতে ভেবেছে।।
মালিকের কাছে গিয়ে কহিল তখন।।
শুন শুন মহাশয় আমার বচন।।
কয়দিন মোর পিতা জ্বরে ভূগিতেছে।
মোর কাছে আনারস খেতে চাহিয়াছে।।
কোনখানে আনারস খুঁজিয়া না পাই।
তোমার বাগানে গিয়ে দেখিলাম তাই।।
বড় এক আনারস পেকে রহিয়াছে।
এই আনারস আমি চাই তব কাছে।।
কত মূল্য দিব আমি বল হে আমায়।
এই আনারস আমি খাওয়াব পিতায়।।
মালিক বলেছে আমি ভাবিয়া নাই পাই।
মোর গাছে আনারস কভু দেখি নাই।।
রোজ রোজ আমি সেই বাগানেতে যাই।
পাকা ফল গাছে আছে দেখিতে না পাই।।
ফল যদি গাছে থাকে তোমা আমি দিব।
আনারস মূল্য আমি কিছু নাহি লব।।
তখনেতে দুই জনে বাগানেতে যায়।
বড় এক আনারস দেখিাবরে পায়।।
মালিক বলেছে সেই অশ্বিনীর ঠাই।
ফল নিয়ে চল বাবা তব সঙ্গে যাই।।
আনারস সঙ্গে নিয়ে চলে দুইজন।
অশ্বিনীর বাড়ী গিয়ে দিল দরশন।।
অশ্বিনীর পিতা সেই আনারস খেয়ে।
আর্শীবাদ দেয় তারে দু’বাহু তুলিয়ে।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
জীবের কল্যাণ যেন তোমা দ্বারা হয়।।
সকলেরে বলে কয়ে কার্ত্তিক সুজন।
হরি হরি হরি বলি ত্যাজিল জীবন।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী কেঁদে ছাড়ে হাই।
পরিবার সহ তারা কান্দিছে সবাই।।
পাড়া প্রতি সবে এসে সান্তনা করিয়া।
শব দাহ করিলেন সকলে মিলিয়া।।
একাদশ দিনে করে শ্রাদ্ধাদি অর্পন।
ভিক্ষা করি করালেন স্বজাতি ভোজন।।
সংসারে থাকিয়া সদা হরি হরি বলে।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখ জলে।।
মাঝে মাঝে সে অশ্বিনী ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচান্দ পোষা পাখি হরিগুণ গায়।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচান্দ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
অশ্বিনীর ত্যাগের কথা
গুরুচাঁদ পোষা পাখি অশ্বিনী গোঁসাই।
হরিনাম ভিন্ন তার অন্য গতি নাই।।
সংসারেতে বাস করে সংসারী সাজিয়া।
সুখ দুঃখ সমজ্ঞান মনেতে ভাবিয়া।।
ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়।
দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে পরীক্ষা করয়।।
সংসারের দৈন্য দশা ক্রমেতে বাড়িল।
তবু নাহি হরিনাম ভুলিয়া রহিল।।
লহ্মীখালী বাস করে গোপাল সাধু।
দিবানিশি পান করে হরিনাম মধু।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অন্তরে ভাবিয়া।
দক্ষিণ দেশ মাতাল হরি নাম দিয়া।।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিলেন মন।
কয়জন ভক্ত সঙ্গে করিলেন গমন।।
ভাবে গদগদ চিত্ত বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত অশ্বিনীর বাড়ী।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী গলে বস্ত্র দিয়া।
ছল ছল আখি দু’টি কহিছে কান্দিয়া।।
শুন শুন ওরে ভাই আমার বচন।
অধমের নিবেদন করহে গ্রহণ।।
ঠাকুরের ঘর বাড়ী মোর কিছু নয়।
দিন গত আমি আছি তাহার আলয়।।
এইভাবে ভক্তি করি বসিবারে দিল।
হরিধ্বনি করি সবে আসনে বসিল।।
অশ্বিনীর চক্ষুজলে বক্ষ ভেসে যায়।
সকলের পদধুলি লইল মাথায়।।
তাই দেখে সে গোপাল কান্দিয়া কান্দিয়া।
অশ্বিনীর চরণেতে পড়িল ঢলিয়া।।
হরিভক্ত ছিল যত গোপালের সাথে।
গড়াগড়ি যায় সবে পড়িয়া মাটিতে।।
হরি হরি বলে সবে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে প্রেম সম্বরিল।।
তারপর সবে মিলে করিছে কীর্ত্তন।
তাই দেখে সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।।
ঘরেতে তণ্ডুল নাহি কি হবে উপায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
ধামা হাতে চলিলেন গ্রামের ভিতর।
বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করি আসিল সত্বর।।
কোন মতে ডাল ভাত রন্ধন হইল।
হরি বলে ভক্তগণে ভোজন করিল।।
অশ্বিনীর দৈন্য দশা গোপাল জানিয়া।
অশ্বিনীর হস্ত ধরে কহিছে কান্দিয়া।।
চল ভাই ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ ঠাই।
তার কাছে গিয়ে মোরা সকল জানাই।।
অশ্বিনী বলেছে ভাই তোমাকে শুধাই।
মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।।
ভক্তিহীন জ্ঞানহীন জগতে আসিয়ে।
সেবা করাইতে নারি হরিভক্ত পেয়ে।।
এই কথা বলে রত্ন কান্দিতে লাগিল।
গোপাল চরণ ধরে আবেগে কহিল।।
শুন শুন শুন ভাই তোমাকে জানাই।
তোমা সম হরিভক্ত এ জগতে নাই।।
প্রেমরসে তনু মাখা হরিভক্ত তুমি।
তোমার তুলনা দিতে নাহি জানি আমি।।
এইভাবে প্রেমালাপ হইতে লাগিল।
হরি কথা রসরঙ্গে সে নিশি কাটিল।।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়।
হাত মুখ ধুয়ে সবে পান্তা ভাত খায়।।
পান্তা সেবা করি শেষে মিলিয়া সকলে।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা হরি হরি বলে।।
পথে যেতে সকলেতে হরিগুণ গায়।
অশ্বিনীর চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।।
ঘৃতকান্দি গিয়ে সবে মনের আবেগে।
হরি হরি বলে সবে চলে দ্রুতবেগে।।
অশ্বিনী অনেক পিছে পড়িয়া রহিল।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লাগিল।।
সকলেতে লইয়াছে নানাবিধ দ্রব্য।
মোর কাছে কিছু নাই কোথা বা কি পাব।
মাঠ মধ্যে গিয়ে তিনি ভাবিতে লাগিল।
দুই হাতে দুই ঢেলা ধারণ করিল।।
এই মাটি লযে আমি শ্রীধামেতে যাব।
তাতে কিবা আমি ভারী অপরাধী হবো।।
মাটি গলে মাটি হবে শ্রীধামেতে রবে।
এইটুকু উপকার মোর দ্বারা হবে।।
আগে আগে সবে যারা শ্রীধামে উঠিল।
গুরুচাঁদ পদে গিয়ে প্রণাম করিল।।
হরি বলে গুরুচাঁদ আশীর্বাদ দিল।
সকলে মঙ্গলে থাক মুখেতে বলিল।।
যেবা যাহা নিয়েছিল রাখিল তথায়।
গুরুচাঁদ চরণেতে সকল জানায়।।
গদিঘর পিছনেতে অশ্বিনী বসিয়া।
নয়নের জলে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
প্রেমভরে স্তুতি করে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
আমি বড় অভাজন কোন কিছু নাই।
কি দিয়া বাসিব ভাল চরণে জানাই।।
ওদিকেতে গদিঘরে গুরুচাঁদ কয়।
তোমরা আসিলে সবে অশ্বিনী কোথায়।।
তোমরা আনিলে যাহা দেখিবারে পাই।
অশ্বিনী আনিবে যাহা আগে খাব তাই।।
একজন বলে এসে গুরুচাঁদ কাছে।
ঘরের বাহিরে বসে অশ্বিনী রয়েছে।।
দুই দলা ঢেলা মাটি দুই হাতে ধরি।
বসে বসে কাঁদিতেছে বলে হরি হরি।।
তাই শুনে গুরুচাঁদ বাহিরেতে যায়।
দুই খন্ড মিছরি হাতে দেখিবার পায়।।
তাই নিয়ে গুরুচাঁদ মুখেতে পুরিল।
কড়মড় শব্দ করি খাইতে লাগিল।।
অশ্বিনী পড়িল ঢলে গুরুচাঁদ পায়।
কেঁদে কেঁদে চরণেতে গড়াগড়ি যায়।।
অশ্চর্য্য দেখিয়া সবে কাঁদিতে লাগিল।
কেঁদে কেঁদে গুরুচাঁদ চরণে পড়িল।।
কেহ কেহ কেঁদে বলে ওগো দয়াময়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।
শান্ত হযে সবে মিলে গদি ঘরে চল।।
এই কথা বলে প্রভু গদিতে বসিল।
শান্ত হয়ে সবে গিয়ে প্রণাম করিল।।
প্রণাম করিয়া সবে চারিদিকে বসে।
অশ্বিনী পিছনে বসে আখি জলে ভাসে।।
কাঁদিয়া গোপাল বলে গুরুচাঁদ ঠাই।
শুন শুন শুন প্রভু তোমাকে জানাই।।
অশ্বিনী দাদার কথা জানাই চরণে।
ভিক্ষা করে খেতে দেয় হরি ভক্তগণে।।
করজোড়ে ওগো প্রভু তোমাকে জানাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
তাই শুনি গুরুচাঁদ হাসি হাসি কয়।
অশ্বিনীকে ডেকে আন দিব যাহা চায়।।
তাই শুনি অশ্বিনীকে ডাকিয়া আনিল।
করোজোড়ে সে অশ্বিনী আসিয়া দাঁড়ায়।।
গুরুচাঁদ ডেকে বলে শুন হে অশ্বিনী।
মোর কাছে কিবা চাও বল তাই শুনি।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কেঁদে কেঁদে কয়।
এক নিবেদন করি তব রাঙ্গা পায়।।
অভাবের তাড়নায় ভিক্ষা লাগি যাই।
তাও যেন নাহি দেয় এই বর চাই।।
অন্য কিছু নাহি চাই চরণে জানাই।।
অন্তিত কালেতে যেন শ্রীচরণ পাই।
প্রেম ভক্তি কিছু নাই ওগো দয়াময়।
দয়া করে অধমের রেখ রাঙ্গা পায়।।
অশ্বিনীর কথা শুনে গুরুচাঁদ কয়।
শুন শুন ও গোপাল বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীর কথা কিছু শুনিলে এখন।
আমি তারে কি করিব বল বাছাধন।।
হরিকল্প তরুমূলে বাসনা যে করে।
মনের বাসনা পূর্ব আমি করি তারে।।
শুনিয়া গোপাল বড় বিস্ময় মানিল।
মনের বেদনা তার মনে রয়ে গেল।।
অশ্বিনীর কাছে গিয়ে সে গোপাল কয়।
শুন শুন ওগো দাদা বলি যে তোমায়।।
তোমার মনের কথা আমি জানি নাই।
তোমা সম হরিভক্ত খুঁজিয়া না পাই।।
করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা কর মোরে।
চরণ ধরিয়া তারে সান্তনা করায়।।
তারপর সবে মিলে গুরুচাঁদ কয়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
যে যাহার মন কথা গুরুচাঁদ বলি।
পরদিন সবে মিলে দেশে গেল চলি।।
এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
অশ্বিনীর পরীক্ষা
দেশে গিয়ে সে গোপাল ভাবে মনে মন।
অশ্বিনীর সেই কথা জাগে সর্বক্ষণ।।
পরীক্ষা করিতে যাব গঙ্গাচন্না গায়।
কেমন ত্যাগের ধর্ম বুঝাব তোমায়।।
দশজন হরিভক্ত সঙ্গেতে করিয়া।
যাত্রা করে সবে মিলে শ্রীহরি স্মরিয়া।।
পথে যেতে হরি কথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
এইভাবে পথে যেতে ভাবিতে লাগিল।
সন্ধ্যাবেলা গঙ্গাচন্না উপনীত হল।।
হরি হরি বলে সবে উঠিল বাড়ীতে।
দেখিয়া অশ্বিনী এসে লাগিল কাঁদিতে।।
হরিভক্ত চরণেতে কেঁদে কেঁদে কয়।
তোমাদের বাড়ী ঘর মোর কিছু নয়।।
জল পাত্র এনে শেষে পা ধোয়াতে যায়।
সকলে পড়িল এসে অশ্বিনীর পায়।।
সে গোপালে ধরে তোলে অশ্বিনী সুজন।
গোপালকে বুকে ধরে করে অলিঙ্গন।
এইভাবে প্রেমাবেশে ধরাধরি করে।
হস্তপদ ধুয়ে সবে বসিলেন ঘরে।।
খেজুরের পাতা দিয়া বিছানা করেছে।
তাহা বিছাইয়া শেষে বসিতে দিয়াছে।।
ঘরেতে তন্ডুল নাস্তি অশ্বিনী জানিয়া।
গ্রামেতে চলিল তিনি ধামা হাতে নিয়া।।
এদিকেতে ঘরে বসে বলে একজন।
গোপাল সাধুকে ডেকে কহিল তখন।।
উপরেতে চেয়ে দেখ তারা দেখা যায়।
ঘরেতে ছাউনি নাই জানাই তোমায়।।
ঝড় বৃষ্টি আসে যদি কি হবে উপায়।
অন্য বাড়ী যাই মোরা থাকিতে সময়।।
তাই শুনি সে গোপাল করিতেছে মানা।
ও কথা বলনা ভাই বৃষ্টিত হবেনা।।
অন্য কথা দিয়া আর কার্য্য কিছু নাই।
এস মোরা সবে মিলে হরি গুণ গাই।।
গোপালের কথা শুনে নামেতে মাতিল।
হরি গুনগানে তারা প্রমত্ত হইল।।
ওদিকেতে সে অশ্বিনী ঘুরিয়া বেড়ায়।
যে বাড়ীতে যায় তারা ভিক্ষা নাহি দেয়।।
গ্রাম ভরি সব বাড়ী ঘুরিতে লাগিল।
এক মুঠি ভিক্ষা তাকে কেহ নাহি দিল।।
নিরূপায় হয়ে রত্ন কাঁদিতে লাগিল।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
কেদে বলে ওগো প্রভু চরণে জানাই।
যাহা চাহিয়াছি আমি দিলে আজি তাই।।
যেমন মানুষ আমি তেমন পেয়েছি।
হরিভক্ত সেবা বাদ তাহা কি চেয়েছি।।
তব ভক্ত ঘরে বসে হরিনাম করে।
কেমনে হইবে সেবা কহ আজ মোরে।।
হরি ভক্তগণ যদি থাকে অনাহারে।
নামের কলঙ্গ হবে এভব সংসারে।।
আমার জীবনে যত দুঃখ কষ্ট হয়।
তাতে আমি ভাবিনাক ওগো দয়াময়।।
এত ভাবি সে অশ্বিনী কেদে ছাড়ে হাই।
তুমি যাতে সুখে থাক এই ভিক্ষা চাই।।
কিছু দুরে ছিল এক কমদের গাছ।
সেই গাছ বুকে ধরে কাদিতেছে আজ।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি ধাদিল নয়ন।
চারিদিকে হইতেছে মেঘের গর্জন।।
মেঘের গর্জন শুনে গোপাল ভেবেছে।
মনে মনে গুরুচাদে চরণে বলেছে।।
শুন শুন গুরুচাঁদ জানাই তোমায়।
ঝড় বৃষ্টি হলে পরে দাড়াব কোথায়।।
কাঙ্গালের বন্ধু তুমি করুনা নিদান।
তব ভক্ত রক্ষা কর করে কৃপা দান।।
গোপালের চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ জানিবারে পায়।।
ভক্তের বিপদ জেনে শ্রীহরি নন্দন।
শ্রীনাথ পাগলে ডেকে কহিল তখন।।
ছাতা এনে দাও তুমি অতি শ্রীঘ্র করি।
ভক্তের বিপদ আমি সহিতে না পারি।।
তখনি শ্রীনাথ ছাতা আনিয়া যোগায়।
গদি ঘরে বসে প্রভু ছাতা মাথে দেয়।।
চারিদিকে ঝড় বৃষ্টি হল অতিশয়।
অশ্বিনীর বাড়ী মেধ্য কিছু নাহি হয়।।
দুই রাশি আড়ে দিঘি হবে অনুমান।
ঝড় বৃষ্টি না হইল রহেছে প্রমাণ।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কভু দেখি নাই।।
এই যুগে দেখে শুনে মানিলাম তাই।।
অশ্বিনীর কান্না শুনে গুরুচাঁদ কয়।
ওগো বাবা হরিচাঁদ চলিয়ে তোমায়।।
সেই যাহা চেয়েছিল আমি দিনু তাই।
এবে আমি কি করিব চরণে জানাই।।
তব ভক্তগণ সব অনাহারে আছে।
অশ্বিনীর ঘরে বসে হরিনাম নিছে।।
ওগো বাবা হরিচাঁদ কি হবে উপায়।
তোমার নামের বুঝি কলঙ্ক রটায়।।
কৃপা করে কৃপাসিন্ধু দয়াময় হরি।
তোমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি।।
এত ভাবি গুরুচাঁদ ছাড়ে আখিজল।
অন্তরে জানিল তাহা পরম দয়াল।।
ভক্তের লাগিয়া আজি দয়াময় হরি।
শূণ্যেতে ভাসিল এক ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে চরি।।
রঘুনাথপুর গ্রাম দিকজয় নাম।
চাউলের কেনা বেচা করে গুণধাম।।
চিতলমারী হাটেতে করেছে গমন।
গঙ্গাচন্না খালমুখে আসিল যখন।।
মধুমতি হতে খাল গঙ্গাচন্না এল।
গোড়া খালে সেই নৌকা চরায় ঠেকিল।।
জলে নেমে ভাগিগন ঠেলাঠেলি করে।
তবু সেই নৌকাখানি কিছুতে না নড়ে।।
কুলে নেমে দিকজয় করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকারে রাত্রি চারিদিকে চায়।
কিছু দুরে আলোময় দেখিবারে পায়।।
দ্রুতগতি গিয়ে দেখে আশ্চর্য্য কাহিনী।
ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে বসা আছে হরি গুনমণী।।
হরিচাঁদ বলে শুন ওরে দিকজয়।
নৌকা নিয়ে চলে যাও গঙ্গাচন্না গায়।।
অশ্বিনী নামেতে মোর ভক্ত একজন।
বিপদে পড়িয়া সে যে করেছে রোদন।।
মোর ভক্ত অনাহারে আছে তার ঘর।
শুন শুন দিকজয় বলি যে তোমারে।।
চাউল তাহারে দিয়ে এস শীঘ্রগতি।
তারপর হেটে যেও ওহে মহামতি।।
এই বাক্য বলে হরি অদৃশ্য হইল।
দিশেহারা দিকজয় মাটিতে পড়িল।।
আখি জলে ভেসে ভেসে দিকজয় বলে।
অভাগারে দেখাদিয়ে কেন লুকাইলে।।
আমি বড় অপরাধী এই দুনিয়ায়।
নিজ গুনে দেখা দিলে ওগো দয়াময়।।
কাদিতে কাদিতে গেল নৌকার নিকটে।
ভাগিদের কাছে গিয়ে কহে করপুটে।।
জল হতে নৌকা পরে সকলেতে যাও।
হরিচাঁদ নাম নিযে তরী খুলে দাও।।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে যেতে হতে ভাই।
তাহা নাহি হলে পরে আর রক্ষা নাই।।
তাই শুনে সবে মিলে নৌকায় উঠিল।
হরিচাঁদ নাম নিয়ে তরুনী বাহিল।।
দ্রুতবেগে চলে তরী সেই খাল বেয়ে।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে পড়িল ঠেকিয়ে।।
তাই দেখে দিকজয় ডেকে কয় কথা।
অশ্বিনী নামেতে কেউ আছে নাকি হেথা।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কাঁদিয়া উঠিল।
হরি বলে হাই ছেড়ে কহিতে লাগিল।।
ওগো বাবা গুরুচাঁদ কি খেলা তোমার।
তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।।
কয়জন অনাহারে আছে মম ঘরে।
এখন আসিলে কেবা দুঃখ সহিবারে।।
তাই ভেবে সে অশ্বিনী ছাড়িতেছে হাই।
দিকজয় বলে কেবা কাঁদিতেছ ভাই।।
অশ্বিনী বলে আমি বড় অভাজন।
অশ্বিনী আমার নাম তুমি কোন জন।।
তাই শুনি দিকজয় চরণে পড়িল।
কেদে কেদে দিকজয় কহিতে লাগিল।।
হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত মহাজন।
আমাকে পাঠালে হরি তোমার কারণ।।
হরিভক্ত অনাহারে তব ঘরে আছে।
দেখা দিয়ে হরি আজি আমাকে বলেছে।।
চাউলের নৌকা নিয়ে এসেছিরে ভাই।
যে চাউল দরকার আমি দিব তাই।।
এক কথা বলে সে যে কাদিতে লাগিল।
কান্না শুনে আলো জ্বেলে সকলে আসিল।।
আদি অন্ত সব কথা সকলে শুনিয়া।
গড়াগড়ি যায় সবে মাটিতে পড়িয়া।।
কেহ কেহ কেদে কেদে হল অচেতন।
লেখা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
বহুক্ষণ পরে শেষে সে কান্না থামিল।
দিকজয় নৌকা হতে চাউল আনিল।।
সে চাউল দিয়ে শেষে রন্ধন হইল।
প্রেমভরে ভক্তগন ভোজন করিল।।
সারানিশি কেদ কেদে করিল কির্ত্তণ।
ভাষা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
অনেক হইল বেলা বাহ্যজ্ঞান নাই।
হরি বলে কেদে কেদে ছাড়িতেছে হাই।।
এইভাবে ভাবাবেষে মধ্যাহ্ন হইল।
গ্রামবাসী সবে এসে রন্ধন করিল।।
তারপর সকলেতে ভোজন করিয়া।
যার যার দেশে সবে গেল চলিয়া।।
বেলা গেল দিকজয় নৌকায় উঠিণ।
হরি বলে নৌকা বেয়ে হাটে চলে গেল।।
চর্তুগুণ লভ্য হলো সেই হাটে গিয়ে।
হির বলে দিকজল বেড়ায় নাচিয়ে।।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কে দেখেছে বল।
সেই হতে দিকজয় মতুয়া হইল।।
এ দীন বিনোদ বলে পাচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানা হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাইসব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
নাম হতে ভক্ত বড়
জগতে আসিল এক হরি বোলা পাখি।
হরিনাম উচ্চারণে ঝরে দু’টি আখি।।
নামে প্রেমে মত্ত হয়ে মহাভাবে রয়।
দিবানিশি হরি গুণ গাহিয়া বেড়ায়।।
একদিন সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিল গমন।।
প্রতি বুধবারে তিনি ওড়াকান্দি যায়।
এইভাবে যাতায়াত করে মথাশয়।।
বুধবারে চলেছেন ওড়াকান্দি পথে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।
মুখে হরি হরি গুণ গাহিতে গাহিতে।
উদয় হইল গিয়ে গোপালগঞ্জতে।।
কয়জন হরিভক্ত আসিয়া মিশিল।
তাহারাও ওড়াকন্দি যাইবে বলিল।।
একসঙ্গে চারিজন করিল গমন।
উলপুর খেয়াঘাটে দিল দরশন।।
খেয়াপার হয়ে শেষে ও পারেতে গেল।
হরি হরি বলে সবে হাটিতে লাগিল।।
কিছু দুর গিয়ে তারা দেখিবারে পায়।
করোজোড়ে এক মেয়ে আসিয়া দাড়ায়।।
অশ্বিনীর চরনেতে প্রণাম কিরল।
জলে ভরা অখি দু’টি কান্দিতে লাগিল।।
কেদ কেদে কহিলেন অশ্বিনীর ঠাই।
কোথায় চলেছ তুমি শুনিবারে চাই।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো তোমাকে জানাই।
হরি বলে আজি মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে কেদে মিনতি করিয়া।
তথা গেলে কিবা হয় কহ বিস্তারিয়া।।
অশ্বিনী বলেছে ওড়াকান্দি যেবা যায়।
সকল মনের বাঞ্ছা তার পূর্ণ হয়।।
মিনতী কহিছে আমি বড় অভাগিনী।
শুন তুমি হরি ভক্ত আমার কাহিনী।।
বহুদিন গত হল বিবাহ হয়েছে।
কিন্তু এক ব্যাথা মোর মনেতে রয়েছে।।
বন্ধ্যা বলে ভাল কেউ বাসেনা আমায়।
দিবানিশি কেদে ফিরি সেই বেদনায়।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো বাঞ্ছা পূর্ণ হবে।
স্বামীকে সঙ্গেতে করি ওড়াকান্দি যাবে।।
ওড়াকান্দি হরি এসে অবতীর্ণ হলো।
লীলা সাঙ্গ করে তিনি ক্ষীরদেতে গেল।।
তার পুত্র গুরুচাঁদ বর্তমান আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
এই কথা বলে রত্ন গমন করিল।
আশা পেয়ে সেই নারী গৃহেতে চলিল।।
শ্রীউপেন্দ্রনাথ নাম কায়স্থ জাতিতে।
ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সে উচ্চ পদেতে।।
বিত্তশালী মহামান্য অর্থের বড়াই।
অর্থ আছে পুত্র কন্যা তার ঘরে নাই।।
স্বামীর চরণে গিয়ে মিনতী কহিল।
মোরে নিয়ে ওগো স্বামী ওড়াকন্দি চল।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ ওড়াকন্দি আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
উপেন্দ্র বলেছে সেই মিনতীর ঠাই।
নারী জাতি বলে তব জ্ঞান কান্ড নাই।।
নমঃশুদ্র ঘরে কেন ঠাকুর জন্মিবে।
দেখিয়া আমার মনে ভক্তি না আসিবে।।
তোমা লয়ে আমি কবু যেতে না পারিব।
পুত্র কন্যা না হউক এইভাবে রব।।
বড় বড় ডাক্তার কত দেখায়েছি।
আমাদের ভাগ্যে নাই মনেতে জেনেছি।।
শনিয়া স্বামীর বাণী মিনতী তখন।
ছলছল আখি দু’টি ঝরে দু’নয়ন।।
মৌন হয়ে থাকে সদা কথা নাহি কয়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
মনের বেদনা তার মনেতে রহিল।।
একদিন তার স্বামী সেভাবে দেখিয়া।
মিনতীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া।।
কহিলেন শুন তুমি আমার বচন।
ওড়াকান্দি যেতে হবে করেছি মনন।।
কার কাছে শুনিয়াছ ঠাকুরের কথা।
সেই মহাজন কেবা কানকি বারতা।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি পুরুষ রতন।
অজানুলম্বিত ভুজ আকর্ন লোচন।।
সে মানুষ স্বপনেতে কহিলেন কথা।
আমার ভক্তের কথা না হবে অন্যথা।।
যে তোমারে বলিয়াছে তারে কোথা পাই।
তারে লয়ে চল মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে আমি তার দেখা পাব।
আমাদের সঙ্গে যেতে তাহাকে কহিব।।
মিনতীর অন্তরেতে ভক্তির উদয়।
মনে মনে ভাবিতেছে কি করি উপায়।।
সেই হরি ভক্ত দেখা কোথা গিয়ে পাব।
আমার মনের কথা তাহাকে জানাব।।
কবে সেই বুধবার মনেতে ভাবিয়া।
এইভাবে দিনগুলি রাখিছে গণিয়া।।
যেইদিন বুধবার মনেতে জানিল।
অনাহারে সে মিনতী রাস্তায় দাড়াল।।
ছল ছল দু’টি আখি পথ পানে চায়।
এই আসে এই আসে ভাবিছে হৃদয়।।
একটার পরে শেষে দেখিতে পাইল।
অশ্বিনী আসিয়া সেথা উদয় হইল।।
অমনি মিনতী গিয়ে চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাদিতে লাগিল।।
কেদে কেদে সে মিনতী লাগিল বলিতে।
স্বামীর হয়েছে মন ওড়াকন্দি যেতে।।
আমাদের লয়ে তুমি ওড়াকন্দি চল।
অশ্বিনী বলেছে মাগো হইবে মঙ্গল।।
তাই শুনি সে মিনতী দু’টি হাতে ধরি।
বাড়ী মধ্যে নিয়ে গেল অতি যত্ন করি।।
যত্ন করি সে মিনতী ধোয়াল চরণ।
তারপরে ভক্তির ভরে করাল ভোজন।।
ভোজনান্তে আচমন করিল গোঁসাই।
বলে মাগো চল শীঘ্র ওড়াকন্দি যাই।।
উপেন্দ্র মিনতী দোহে করিয়া ভোজন।
একসঙ্গে সবে মিলে করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
অগ্রভাগে চলিতেছে অশ্বিনী সুজন।
পিছনেতে চলে তারা আনন্দিত মন।।
এইভাবে চলে তারা বলে হরি হরি।
উদয় হইল গিয়ে ওড়াকন্দি বাড়ি।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো শুন দিয়া মন।
কামনা সাগরে স্নান কর দুইজন।।
তাই শুনি দুইজনে কামনা করিয়া।
কামনা সাগরে স্নান করিলেন গিয়া।।
তারপর চলিলেন গুরুচাঁদ কাছে।
গদিঘরে গুরুচাঁদ বসিয়া রহেছে।।
চারিদিকে ভক্তগন মাঝে গুরুচাঁদ।
তারাগণ মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।।
কিবা শোভা হইতেছে প্রেমানন্দময়।
ভক্তগনে হরি বলে আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়িল।
গুরুচাঁদ পদ ধরি কাঁদিতে লাগিল।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিল তখন।
বন্ধা নারী গর্ভে কভু হবে না নন্দন।।
হেন বাক্য গুরুচাঁদ যখনেতে কয়।
উপেন্দ্র পড়িল গিয়া গুরুচাঁদ পায়।।
মিনতী উপেন্দ্র দোহে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে গুরুচাঁদ বলিয়া উঠিল।।
তোমাদের ঘরে কভু পুত্র কন্যা নাই।
স্বচোক্ষেতে আমি তাহা দেখিবারে পাই।।
হেন বাক্য শুনে তারা কেঁদে ছাড়ে হােই।
ঘরেতে যাবনা ফিরে কহিলাম তাই।।
তোমার চরণে আজি জীবন ত্যাজিব।
মানব জীবন ধরে কিবা ফল পাব।।
গুরুচাঁদ বলে ভাল ঠেকাইলি দায়।
আমা দ্বারা কোন কিছু না হবে উপায়।।
মোর পিতা হরি চাঁদ বলিত বচন।
আমা হতে নাম বড় সংসার ভুবন।।
নাম হতে ভক্ত বড় এই দুনিয়ায়।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে ভক্তের দ্বারায়।।
এইখানে আছে কত হরি ভক্তগন।
ধর গিয়া ইহাদের যুগল চরণ।।
তাই শুনে দুইজনে ভক্ত কাছে যায়।
যার কাছে যায় সেই ভয়েতে পালায়।।
এক একে গদি ঘর শূণ্য হয়ে গেছে।
একপাশে সে অশ্বিনী দাঁড়াইয়া আছে।।
মনে মনে সে অশ্বিনী গুরচাঁদে কয়।
অধমের প্রতি বুঝি কঠিন হৃদয়।।
অধম এনেছে ডেকে এই দুইজন।
তব কৃপা হল নাক ইহার কারণ।।
জলে ভরা আখি দু’টি দাঁড়াইয়া আছে।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়েছে।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
তুমি ছাড়া এ জগতে আর কেহ নাই।।
এইভাবে দুইজনে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে অশ্বিনীর দয়া উপজিল।।
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিল অশ্বিনী।
এই বর্ষ মধ্যে তুই হইবি গর্ভিনী।।
সেই গর্ভে ছেলে হবে দেখিবারে পাই।
এখানে থাকিয়া মাগো আর কার্য্য নাই।।
অধমের কথা যদি সত্য না হইবে।
শ্রীধামেতে এ অশ্বিনী আর না আসিবে।।
গুরুচাঁদ পরণেতে প্রণাম করিয়া।
দুজনারে লয়ে দেশে আসিল চলিয়া।।
সেই দিন ঘরে এসে রিতুবতী হল।
সেই হতে মিনতীর গর্ভ দেখা দিল।।
তাহা জেনে সে উপেন্দ্র ভাবিতে লাগিল।
ভক্তির উদয় হল প্রেমেতে মাতিল।।
হৃদয় চঞ্চল হয়ে মনে মনে কয়।
অশ্বিনীর দেখা আমি পাইব কোথায়।।
মিনতীকে বক্ষে ধরি কেঁদে কেঁদে কয়।
শুন শুন ওগো প্রিয়ে বলিযে তোমায়।।
মানুষ চিনিয়া তুমি আনিলে বাড়ীতে।
আমা হতে ধন্য তুমি আসিয়া জগতে।।
আমি মোর মন প্রাণ কেমন হয়েছে।
সে মানুষ কোথা থাকে যাব তার কাছে।।
বলেছিল ওড়াকান্দি আসিব না আর।
আমি গিয়ে দেই তারে এই সমাচার।।
মিনতী কহিছে জানি তাহার বারতা।
গঙ্গাচন্না বাস করে শুনিয়াছি কথা।।
উপেন্দ্র চলিল সেই মানুষ খুজিতে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।।
কোথা সেই গঙ্গাচন্না ভাবে মনে মন।
গোপালগঞ্জে এসে দিল দরশন।।
তথা হতে টাবুরিয়া নৌকা করে নিল।
গঙ্গাচন্না যাব বলে তাহাকে বলিল।।
সে বলিল মোর বাড়ী পাটগাতী হয়।
গঙ্গাচন্না চেনা আছে শুন মহাশয়।।
উপেন্দ্র বলেছে বড় ভালই হইল।
মোরে লয়ে ওগো মাঝি গঙ্গাচন্না চল।।
যত টাকা চাও তুমি তত টাকা দিব।
গঙ্গাচন্না গিয়ে আমি ফিরিয়া আসিব।।
টাবুরিয়া বলে আমি নৌকা বেয়ে খাই।
টাকা দিলে যেথা যাবে বেয়ে নিব ভাই।।
এত বলি সেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।
ভাটি পেয়ে সেই নৌকা বেগেতে চলিল।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে চলিতে লাগিল।।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াইল।
নৌকা হতে সে উপেন্দ্র মাটিতে নামিয়া।।
অশ্বিনীর পদে পড়ে কহিছে কাঁদিয়া।
ওগো বাবা নিবেদন করি শ্রীচরণে।
তোমা সম হরিভক্ত নাহি এ ভুবনে।।
তোমার মুখের কথা সত্য হইয়াছে।
সাত মাস মিনতীর গর্ভ দেখা দিছে।।
উলপুর যেতে হবে চরণে জানাই।
তুমি বিনে আমাদের আর কেহ নাই।।
অশ্বিনী বলেছে আমি এখনে না যাব।
উত্তর মুখেতে আমি কভু না ফিরিব।।
তব ঘরে ছেলে হলে যাইব সেদিনে।
প্রতিজ্ঞা করেছি আমি তোমার কারণে।।
উপেন্দ্র শুনয়া তাহার চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
অশ্বিনী চলেছে তুমি ঘরে চলি যাও।
মিনতীকে সঙ্গে করে গুর গুণ গাও।।
তাই শুনে সে উপেন্দ্র ঘরে ফিরে গেল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
মিনতীর পুত্রের জন্ম
হরিচাঁদ লীলা কথা, বর্ণিবারে পারে কেতা
হরি হতে বড় হরিনাম’’
নাম হতে বড় ভক্ত, এ জগতে আছে ব্যাক্ত
ব্যাক্ত আছে এ মরত ধাম।
অধমের এ মিনতী, লিখি আজি ভক্তিগীতি
সে কেমল শ্রীহরি কৃপায়।
হরি ভক্ত কৃপা করে অশির্বাদ কর মোরে
মনবাঞ্ছা যেন পূর্ণ হয়।।
অশ্বিনীর কথা ধরে, মিনতী আসিয়া ঘরে
ভক্তি করি অশ্বিনীর পায়।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিত নয়ন জলে
অশ্বিনীকে রাখিয়া হৃদয়।।
এইভাবে দিন গেল, দশমাস গত হল্
শুভক্ষণে জন্মিল নন্দন।
পুত্র মুখ চক্ষে হেরি, শিশুপুত্র কোলে করি
অশ্বিনীকে করিছে স্মরণ।।
বলে বাবা কোথা তুমি, বড় অভিাগিনী আমি
তোমার যে মুখের কথায়।
এল পুত্র মোর ঘরে, তুমি বাবা কৃপা করে
দেখে যাও আসিয়া হেথায়।।
এইভাবে সে মিনতী, করে কত স্তবস্ততি
প্রতিবেশী আসিল সবাই।
কেহ করে উলধ্বনি, কেহ করে জয়ধ্বনি
আনন্দের সীমা নাই।
প্রতেবেশী ছিল যারা, আনন্দেতে আত্মহারা
কেহ কেহ করে শঙ্খধ্বনি।
কেহ কেহ হরি বলে, নাচে দুই বাহু তুলে
কেহ কেহ করে হরিধ্বনি।
উপেন্দ্র ছিল না ঘরে, শহরে চাকুরী করে
একজন সংবাদ জানায়।
যখনে জানিতে পারে, পুত্র এল মোর ঘরে
আনন্দেতে আত্মহারা হয়।
একমাস ছুটি নিয়ে, আসিল ঘরে ফিরিয়ে
পুত্র মুখ করি দরশন।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিয়া নয়ন জলে
কোলে করে আপন নন্দন।।
কোলেতে সোনার চাঁদ, মিটাইল পুত্র স্বাদ
অশ্বিনীর গায় গুণগান।
ধন্য ধন্য শ্রী অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরমণি
আশীর্বাদ কর মোরে দান।
জানিলাম ধরাতলে, হরিভক্ত কৃপা হলে
সব কিছু হয় দুনিয়ায়।
অপুত্রকে পুত্র পায়, বোবা লোকে কথা কয়
অন্ধ জনে চক্ষু পায়।।
এত ভাবি সে উপেন, গঙ্গাচন্না চলিলেন
অশ্বিনীকে আনিবারে গেল।
হরি হরি হরি বলে, ভাসি দুই আখি জলে
গঙ্গাচন্না হইল উদয়।।
অশ্বিনীর পড়ি পায়, কেঁদে গড়াগড়ি যায়
বলে বাবা চল মম ঘরে।
তোমার হয়েছে ভাই, তোমা নিতে আসি তাই
একবার দেখে এস তারে।
এই কথা শুনি কানে, আনন্দ পাইয়া মনে
বলে বাবা চল শ্রীঘ্র যাই।
রাখিতে ভক্তের মান্য, হরিচাঁদ অবতীর্ণ
তাই দেখে পরান জুড়াই।।
মুখে হরি হরি বলে, দুই জনে দ্রুত চলে
উলপুর হইল উদয়।
ছোট্ট শিশু কোলে করি, মুখে বলি হরি হরি
আনন্দেতে নাচিয়া বেড়ায়।।
আনন্দতে আত্মহারা, প্রেম রসে তনু পোরা
সে ছেলের হস্ত দিয়া গায়।
হাসি মাখা বদনেতে, ছলছল নয়নেতে
হরি বলে আশীর্বাদ দেয়।।
মিনতী চরণ ধরি, কেদে যায় গড়াগড়ি
বলে বাবা বলি যে তোমায়।
আমার মনের ব্যাথা, ঘুচাইলে ওগো পিতা
পুত্র পাই তোমার কথায়।।
ভক্তি নাই জ্ঞান নাই, বিভাবে পুজিব তাই
তব যুগল চরণ খান।
নিজ গুনে কৃপা করে, আশীর্বাদ কর মোরে
জুড়াইব এ তাপিত প্রাণ।।
মিনতীর শুনে বাণী, কহিলেন সে অশ্বিনী
শুন মাগো তোমাকে জানাই।
ছয় মাস হলে পরে, তব পুত্র কোলে করে
যেতে হবে গুরুচাঁদ ঠাই।।
গুরুচাঁদ গুণমনী, আশীর্বাদ দিবে তিনি
তাহলেই মঙ্গল হইবে।
আমি এবে যাই ঘরে, আবার আসিব পরে
দিবানিশি হরি গুণ গাবে।।
এত বলি সে অশ্বিনী, গঙ্গাচন্না চলে তিনি
হরি হরি মুখেতে বলিয়া।
এইভাবে দিন গেল, ছয় মাস গত হলো
উলপুর আসিল চলিয়া।।
মিনতী চোখেতে হেরি, পদে যায় গড়াগড়ি
কেদ কেদে চরণ দোয়ায়।
উপেন্দ্র বাড়ীতে ছিল, তিনি এসে পদে পল
পদধূলী লইল মাথায়।।
তারপর সে মিনতী, রন্ধন করিয়া সতী
অশ্বিনীকে ভোজন করাল।
তারপর সবে মিলে, মুখে হরি হরি বলে
ওড়াকান্দি গমন করিল।।
মিনতীর পুত্র কোলে, অশ্বিনীর পিছে চলে
উপেন্দ্র সে চলে সাথে সাথে।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিছে নয়ন জলে
এইভাবে লাগিল হাটিতে।।
অশ্বিনী প্রেমের সুরে, সদা হরিনাম করে
প্রেম রসে মাখা তনু মন।
এইভাবে কাদি কাদি, উতরিল ওড়াকান্দি
গদি ঘরে উঠিল তখন।।
সাজায়ে ভক্তের মেলা, গুরুচাঁদ করে খেলা
মাঝাখানে সবে গুরুচাঁদ।
চারিদিকে ভক্তসব, করোজো কের স্তব
ঠিক যেন আকাশের চাঁদ।।
গুরুচাঁদ শ্রীচরণে, রাখিয়া সে পুত্র ধনে
মিনতী কেদে কেদে কয়।।
আমি বড় অপরাধী, তুমি মোর গুণনিধি
মম পুত্র রেখ রাঙ্গা পায়।।
হও তুমি দয়াবান, পুত্রে কর প্রাণ দান
দীর্ঘজীবি হয়ে যেন রয়।
গুরুচাঁদ দেখে চেয়ে, আসিয়াছে সেই মেয়ে
বন্ধা বলে ছিল এ ধরায়।।
আমি দিনু ফিরাইয়ে, অশ্বিনীর কথা নিয়ে
পুত্র পেল অশ্বিনী কৃপায়।
সেই পুত্র কোলে, গুরুচাঁদ কেদে বলে
ভক্তগন ডেকে ডেকে কয়।।
হরি হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
এ জগতে রহিল প্রমাণ।।
সেই ছেলে বুকে ধরে, আশীর্বাদ করে শিরে
মুখে করে হরি গুণগান।।
তাই দেখে ভক্তগণে, পড়িলেন শ্রীচরণে
কেদে কেদে চরণ ধোয়ায়।
গুরুচাঁদ ডেকে বলে, ধর মাতা তব ছেলে
কোলে কর তোমার তনয়।।
পুত্র নিয়ে সে মিনতী, ভক্তগণ পদে নতী
করিতেছে কাদিয়া কাদিয়া।।
ভক্তগনে হরি বলে, নাচে দুই বাহু তুলে
কেহ কাঁদে গড়াগড়ি দিয়া।।
প্রেমনিধি হয়ে ক্ষান্ত, গুরুচাঁদ হলে শান্ত
ভক্তগনে ডেকে ডেকে কয়।
গুণ গুণ ভক্তগণ, করি এই নিবেদন
পদধুলি দাওহে আমায়।।
তাই শুনে ভক্তগণ, করে সবে পলায়ন
গদিঘর শূণ্য হয়ে গেল।
শুধু আছে সে অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরোমণি
হেন দৃশ্য দেখিবারে পেল।।
গুরুচাঁদ চোখে জল, করিতেছে টলমল
মুখে শুধু বলে হরি বল।।
অশ্বিনী কহিছে বাবা, পদধুলি কত নিবা
কেন তুমি হয়েছ দুর্বল।।
তুমি যদি সুখে রও, পদধুলি কত চাও
দরকার যত তব লও।
তোমা করি আশীর্বাদ, পোরে যেন মনসাদ
তুমি যাতে সুখী হয়ে রও।।
তুমি প্রভু থাক সুখে, আমি যেন কাদি দুখে
তব কাছে এই ভাক্ষি চাই।
হরিনাম করি সার, ভব নদী হব পার
মাঝি রূপে তোমা যেন পাই।।
গুরুচাঁদ বলে হরি, অশ্বিনীকে বুকে ধরি
কেদে কেদে গড়াগড়ি যায়।
কেহ দেয় হুলুধ্বনি, কেহ দেয় হরিধ্বনি
সবে এসে পড়িল ধরায়।।
বহু পরে হল শান্ত, প্রেমনিধি হলে ক্ষান্ত
ভক্তি করি গুরুচাঁদ পায়।
হরি হরি হরি বলে, যার যার ঘরে চলে
আনন্দেতে হরি গুণ গায়।।
হরি হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
এই যুগে দেখিবারে পাই।
কান্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
হরি হরি বল সবে ভাই।।