পৃষ্ঠাঃ ২৪১-২৬০
স্বাজাতি প্রধান গণে সুধাইব জনে জনে
এই কার্যে কে কে অগ্রসর?
তারা যদি নাহি দেয় স্বজাতির এই দায়
একা আমি করিব উদ্ধার।
ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে আর কি থাকিতে পারে
তালতলা বাসী একজন।
প্রভু পদে পড়ি কয় ‘দয়া কর’ দয়াময়।
পদতলে এই নিবেদন।।
মাতৃ-শ্রাদ্ধ বাসরেতে স্বজাতির আসরেতে
আপনারে নিতে মোর হবে।”
প্রভু বলে ‘যেতে পারি যদি মনে নিষ্ঠা করি
টাকা মোরে দিতে পার সবে।।
স্বজাতি উদ্ধার হবে ধরাতলে কীর্তি রবে
চন্ডালত্ব হইবে মোচন।
এই কাজে দিলে টাকা চিরদিন রবে লেখা
তাঁন নাম গাবে সর্ব্ব জন।”
প্রভু-মুখে বাণী শুনি বলে প্রভু গুণমনি।
দয়া করি চল একবার।
যাহা চাও দিব টাকা এই কথা নহে ফাঁকা
তাই আমি করিনু স্বীকার।।”
তালতলী সভা হবে সবে মিলে টাকা দিবে
প্রভু যাবে আপনি সভায়।
চন্ডালত্ব গালি দূরে করিবেন শ্রীঠাকুর
এই শব্দ দেশে দেশে যায়।।
দিন উপনীত হল ঠাকুরে আনিতে গেল
নিত্যানন্দ, যাদব বিশ্বাস।
পূর্ণচন্দ্র, বিচরণ, একা সাথে চারিজন
উপনীত ঠাকুরের পাশে।।
ঠাকুর ডাকিয়া কয় আমি যাব নিজ নায়
তোমরা চল হে অগ্রভাগে।
বেশীক্ষণ না রহিব অল্প দুটী কথা কব
টাকা টাকা শুধু মনে জাগে।।
চন্ডালত্ব না ঘুচিলে শান্তি নাহি কোনকালে
চোখে মোর ঘুম নাহি আসে।
তাতে আমি টাকা চাই স্বর্থ-বিত্ত কিছু নাই
টাকা দাও সরল বিশ্বাসে।।
যারা গেছে তারা কয় শুন প্রভু দয়াময়
টাকা দিতে নাহি হবে বাধা।
ষাট মণ হবে ব্যয় প্রহলাদের মাতুদয়
মণ প্রতি টাকা দিব আধা।।
বিশেষতঃ শুভ কার্য আপনার মনোধার্য
নমঃশূদ্র হইবে উদ্ধার।
টাকা দিবে আনন্দেতে তাই আসি তোমা নিতে
টাকা দিবে সন্দেহ কি তোর?
এত যদি তারা কয় চলিলেন দয়াময়
তালতলা উপনীত হল।
যাদবের বাড়ীয় যায় তথা হতে দয়াময়
মহেশের বাড়ীতে উঠিল।।
পরে যায় সভা-স্থান আগুয়ান
গুরুচাঁদে করে অভর্থনা।
হুলুধ্বনি জয়ধ্বনি কেহ করে হরি ধ্বনি
আনন্দের নাহিক সীমানা।।
অতঃপরে যত্ন করে সুদৃশ্য আসন পরে
বসাইল শ্রীগুরুচাঁদেররে।
উপস্থিত যত জন সবে করে আলাপন
কেহ কেহ ভাবে আঁখি-নীরে।।
এইরূপে কিছুক্ষণ আলাপন সম্ভাষণ
করে সবে গুরুচাঁদ-সাথে।
এক ব্যক্তি ধীরে ধীরে প্রভুকে জিজ্ঞাসা করে
করজোড় করি দুই হাতে।।
দেশে দেশে জনে জনে বলিতেছে নিশি দিনে
তালতলা আসিছে ঠাকুর।
টাকা নিবে সভা হতে চন্ডালত্ব ঘুচে যাবে
আয়োজন হতেছে প্রচুর।।
কি কারণে জনে জন করে এই আলাপন
সেই তত্ত্ব জানিবারে চাই।
তত্ত্ব শুন তব মুখে আমরা সকলে সুখে
নিজ নিজ দেশে চলে যাই।
তাই সভা জনে ডাকি গুরুচাঁদ কমলাখি
কহে শোন নমঃশূদ্র গণ।
চন্ডাল বলিয়া কয় অন্য যত সম্প্রদায়
গ্রন্থ-মধ্যে করেছে লিখন।।
এই গালি অকারণ তারা করে উচ্চারণ
হিংসা বশে লিখিল পুস্তকে।
প্রমাণ দেখায়ে তায় এ গালি ঘুচাতে হয়
অভিশাপ জাতির সম্তকে।।
সেন্সার রিপোর্ট কয় সেই-গ্রন্থ-পরিচয়
তার মধ্যে আছে সব লেখা।
কি কারণে কিবা লেখে তাহা সেই গ্রন্থ দেখে
ঠিক ভাবে যাবে সব দেখা।।
সেই বই কিনিবারে মীড অনুরোধ করে
দাম তার পঁয়ত্রিশ টাকা।
তালতলা বাসী সবে আমাকে সে-টাকা দিবে
বলিয়াছে এই কথা পাকা।।
তাই হেথা আসিলাম সকলেরে বলিলাম
টাকা চাহি কোন কার্য তরে।
সময় নাহিক হাতে ঘুম নাহি দিনে রাতে
শ্রীঘ্র করি দেরে টাকা দেরে।।
এত বলি টাকা চায় প্রহলাদে বিশ্বাস তায়
কূট পরামর্শ পেল কাণে।
দুষ্ট জন তারে কয় একি শুধু তব দায়
এই টাকা একা দিবে কেনে?
বারে বারে প্রভু তাই বলে আন টাকা চাই
টাকা আন বিলম্ব না সহে।
কূট-পরামর্শ মত প্রহলাদের মাথা নত
চুপ থাকে কথা নাহি কহে।।
প্রভু কহে কিবা ভাব আসিলাম গৃহ তব
টাকা দিবে করেছ স্বীকার।
বাড়ী এনে ভাবো কিসে এখনে ভাবনা মিছে
ভাবাভাবি শুধু ভাব-সার।।
প্রভুর বচন শুনে প্রহলাদ রাখিল এনে
পাঁচ টাকা প্রভুর গোচরে।
পাঁচ টাকা এনে দিয়ে প্রভু পদে প্রাণদিয়ে
দাঁড়াইয়া রহে চুপ করে।।
প্রভু কয়-কি মশায় বাকী টাকা দিতে হয়
পাঁচ টাকা আন কি কারণে?
পঁয়ত্রিশ টাকা চাই তার কমে নেয়া নাই
দরাদরি করোনা এখন।।
পরামর্শ যাহা পায় এহলাদ তাহাই কয়
বলে বর্ত্তা করি নিবেদন।
সকলের কাজ এই আমি পাঁচ টাকা দেই
বাকী টাকা দিক অন্যজন।।
বিচার করহ তুমি এই কার্যে একা আমি
সব ভার কেন বা বহিব?
একা ভার নিতে হলে এইখানে সবে বলে
আপনার বহিতে সম্ভব।।
এই কথা যবে বলে, অগ্নি সম উঠে জ্বলে
সংহার-মূরতি গুরুচাঁদ।
পঞ্চ মুদ্রা ফেলে দূরে অঙ্গ কাঁপে থরে থরে
ডেকে বলে “শোনরে প্রহলাদ!
বাক্য দিয়ে বাক্য-ঠেলা ধ্বংস হবে তালতলা
ফেলা টাকা এনে তুই ফেলা
টাকা আন টাকা চাই তা না হলে রক্ষা নাই
মোর বাক্য করিস না রে-হেলা।।
প্রহলাদ না কথা কয় উঠিলেন দয়াময়
ক্রোধ বরে চাহিলেন নায়।
সঙ্গে যারা এসেছিল সকলি নৌকায় গেল
দুষ্টে ভাবে গেল মহা দয়।।
আসিয়া তরণী পরে প্রভু বলে ক্রোধভরে
এই গ্র্রামে সকলি চন্ডাল।
চাঁড়ালে ছুঁয়েছে তোরে তুই যাবি কোথাকারে
টাকা ফেল তালতলা খাল।
এই ইচ্ছা ছিল মোর গঙ্গা বারি হবে তোর
ব্রাহ্মণে করিবে স্নান দান?
চাঁড়াল-চাঁড়াল রয় ব্রাহ্মণ না হতে চায়
তুই হলি নরক সমান।।
গঙ্গা তুল্য হবি যদি আমি বলি সেই বিধি
চন্ডালের সারা রে ব্রাহ্মণ।
হতে পারে এ উপায় তাতে টাকা দিতে হয়
তুই টাকা ফেলরে এখন।।
টাকা দেরে টাকা দেরে এই বলে বজ্রস্বরে
প্রভু মোর হুঙ্কার ছাড়িল।
পদাঘাত করে নায় প্রলয়ের শব্দ হয়
মহা ঢেউ জলেতে উঠিল।
তরঙ্গে তরঙ্গে-জল ভরে গেল সারাখাল
মহারোল উঠে চারিভিতে।
ঘূর্ণিপাক উঠে জলে জল তাই উঠে ফুলে
দুলে দুলে নাচে আচম্বিতে।।
প্রভুর নৌকার লোকে প্রলয়ের ভাব দেখে
শীঘ্র গতি বাড়ি পরে যায়।
কি ভাবে বসিয়া থাক খাল-পারে এসে দেখ
ভীত চিত্তে এই কথা কয়।।
ঘন ঘন বহে শ্বাস কথা-বলা অবকাশ
নাহি যেন তাহাদের মুকে।
এই ভাব দেখে সবে কেবা কোন কথা কবে
খাল-পারে এসে সবে দেখে।।
যেই খাল ছিল মরা তরঙ্গে তরঙ্গ ভরা
ঢেউ নাচে মত্ত গরজনে।
সংহারের এই ক্ষেত্রে আরক্ত-সংহার-নেত্রে
গুরুচাঁদ চাহে বারি পানে।।
গুরুচাঁদ পদতলে প্রলয়-নর্ত্তন জলে
অনন্তের ফণা যেন নড়ে।
কল কল নাচে জল বিশ্ব করে টলমল
ধ্বংস যেন প্রলয়ের ঝাড়ে।।
এই ভাব সবে দেখে কথা কারো নাহি মুখে
মহাভয়ে ভীত হৈন মন।
যাবদ বিশ্বস যিনি এই ভাব দেখি তিনি
মনে ভাবে কি করি এখন?
সংহারের কর্তা যিনি আপনি ক্ষেলাপি তিনি
কিসে হবে ক্রোধ সম্বরণ?
মূর্খে তাঁরে নাহি চিনে এ কান্ড করিল কেনে
ধ্বংস সব হবে বিলক্ষণ।।
রক্ষা নাহি রক্ষা নাই কিবা করি ভাবি তাই
ক্ষ্যাপা-ভোলা শান্ত হবে কিসে?
টাকা আন টাকা আন কারো নাহি রবে প্রাণ
যাবি মারা গুরুচাঁদ-রোষে।।
তখন ছুটিয়া যায়, টাকা আনি হাতে দেয়
টাকা পেয়ে ছুটিল যাদব।।
বিচরণ সাথে ধায় গ্রামবাসী লোকে তায়
খাল পারে উপনীত সব।।
যাবদ উঠিয়া নায় পড়িল প্রবুর পায়
টাকা রাখে চরণের কাছে।
বলে প্রভু কর ক্ষমা আমরা চিনি না তোমা
মূর্খ ধ্বংসে ফল কিবা আছে?
যাদবের কথা শুনি সাধকের-শিরোমণি
তালতলা খালে ডাকি কয়।
কথা কয় মহাকাল কাঁপে তালতলা খাল
ধ্বংস যেন নেমেছে ধরায়।।
কিরে খাল হলি ঠেকা এনে দিলি সব টাকা
তাই তোরে করিলাম রক্ষা।
যে কাজ করিলি তুই আশীর্ব্বাদ দিনু মুই
ধন্য হবি গঙ্গায় অপেক্ষা।।
চন্ডাল বরেরা আর তোর এই খাল-পার
ব্রাহ্মণে করিবে নিত্য-স্নান।
হরি-ভক্ত সাধু যারা তোর জলে সবে তারা
করিবেন জল কেলি দান।।
এত বলি দয়াময় যাদবেরে ডাকি কয়
কুলে যাও যাদব সুমতি।
তোমাদের ভক্তি গুণে কিছু নাহি রাখি মনে
বড় প্রীত হৈনু তব প্রতি।।
প্রভু হাসি কথা বলে্ এদিকে দেখে সকলে
বারি শান্ত হৈল অকস্মাৎ।
দেখিয়া আশ্চর্য্য কান্ড সাধু কি অসাধু ভন্ড
ভূমে পড়ি করে দন্ডবৎ।।
প্রলয়ের যে-নর্ত্তন দেখে নরনারী গণ
স্বপ্নবৎ হইল বিলীন।
রুদ্র যবে শান্ত হয় বিশম সুন্দর কয়
কোথা কিছু রহেনা মলিন।।
প্রভুর অমোঘ বাণী পরে পূর্ণ হল জানি
তালতলা খাল আজি ধন্য।
হরিভক্ত মতুয়ায় ওড়াকান্দী ধামে যায়
প্রভু বাক্য করে তারা মান্য।।
তালতলা খালে নায় তার সুধা-বারি খায়
স্নান দান করে তার জলে।
হরিভক্ত পরশনে তীর্থ প্রায় দরশনে
প্রভু বাক্য এই মত ফলে।।
চন্ডাল গালি মোচন প্রসঙ্গে বিবধা-বিবাহ
তালতলা হতে প্রভু মনের হরিষে।
টাকা নিয়ে শীঘ্রগতি ওড়াকান্দী আসে।।
মীডেরে ডাকিয়া টাকা দিল তাঁর হাতে।
টাকা পেয়ে মীড লিখে রিপোর্ট আনিতে।।
সপ্তাহের মধ্যে তবে রিপোর্ট আসিল।
নমঃশূদ্র জাতি বলি নাহি পরিচয়।
চন্ডাল বলিয়া তাতে লেখা দেখা যায়।।
রিপোর্টে লিখেছে কথা অতি কদাকার।
নমঃশূদ্র নাহি মানে আচার বিচার।।
বিদ্যাহীন দাঙ্গাবাজ আর কত গালি।
রিপোর্টে লিখিয়া দিল নমঃকূলে কালি।।
বিধবা প্রসঙ্গে লিখে কথা কদাচার।
তারা নাকি কভু নাহি মানে সদাচার।।
রিপোর্ট পড়িয়া মীড ক্রদ্ধ কলেবর।
মহাক্রোধে অঙ্গ তাঁর কাঁপে থরথর।।
মীড বলে ‘এ রিপোর্ট লেখায়েছে যারা।
মানুষ্য নামের যোগ্য নহে কবু তারা।।
বহুদিন বঙ্গদেশে আমি আসিয়াছি।
ইতি উনি সব জাতি আমি দেখিয়াছি।।
সকলের ইতিহাস আমি জানি ভাল।
সকলের মধ্যে আমি দেখিয়াছি কালো।।
বিশেষতঃ এই ভাবে নারীর সম্মানে।
আঘাত করিতে মাত্র বন্য-পশু জানে।।
এত হিংসা এই দেশে আশ্চর্য্য ব্যাপার।
হিংসা বশে পারে এরা খুন করিবার।।
এতকাল নমঃশূদ্র দেখিলাম চোখে।
রিপোর্ট দেখিয়া আজ কথা নাই মুখে।।
হীন মনা হলে লেখে এমন রিপোর্ট।
উচিত পাঠানো তারে আন্দামান পোর্ট।।
দোষ দিয়া ঢাকিয়াছে সত্য পরিচয়।
দোষ যেন রহে মাত্র নমঃশূদ্র-কায়।।
অন্য সবে সাধু শুদ্ধ দোষ গন্ধ নাই।
যে-লেখে এমন কথা তার মুখে ছাই।।
বহুভাষে দুঃখ করি সেই মহাশয়।
উপনীত হইলেন ঠাকুর-আলয়।।
প্রভুর নিকটে বসি মনোদুঃখে কয়।
“বড় ব্যথা পাইয়াছি শুন মহাশয়।।
বড়ই জঘন্য কথা রিপোর্টেতে লেখা।
বিষম-দায়ের হাতে পড়িয়াছি ঠেকা।।
নিজ মুখে উচ্চারণ করিতে না পারি।
আভাসেতে কিছু কিছু ব্যাখ্যা আমি করি।।
রীতি নীতি এ জাতির কিছু লেখা নাই।
দোষ লিখে সব খানে রখেছে সাফাই।।
বিবাহাদি শ্রাদ্ধকর্ম্ম, পূজাদি পার্ব্বণ।
কিছুই উল্লেখ নাই হিংসার কারণ।।
বিধবা নারীর কথা লিখিয়াছে যাহা।
মম কন্ঠে উচ্চারণ নাহি হবে তাহা।।
যত কাল এই দেশে লোক-গণা হয়।
রিপোর্ট লিখিয়া হেন কটু কথা কয়।।
বিদ্যাহীন জাতি নাহি রাখে সমাচার।
‘চন্ডাল’ সেজেছে তাই ব্রাহ্মণ-কুমার।।
এ সব কাটিতে গেলে শুন দিয়া মন।
জাতি মধ্যে আন তুমি ঘোর আন্দোলন।।
সকল শুনিয়া প্রভু মীডেরে সুধায়।
কোন ভাবে আন্দোলন করি মহাশয়।।
মীড কহে ‘বড় কর্তা অন্য কিছু নয়।
আপাততঃ এক কাজ কর মহাশয়।।
বিধবা রমণী যত আছে সমাজেতে।
তাহাদিগে বিয়া দাও হিন্দু শাস্ত্র মতে।।
প্রমাণ লিখেছে জান ঈশ্বর পন্ডিত।
বিধবা-বিবাহ হয় সাস্ত্রেতে বিহিত।।
এই কার্য অবিলম্বে কর মহাশয়।
আমি দেখি চেষ্টা করে কিভাবে কি হয়।।
এই কথা বলি মীড নিজে বাসে গেল।
শ্রীবিধু ভূষণে প্রভু তখনি ডাকিল।।
শ্রীবিধু ভূষণ আসি করে দন্ডবৎ।
প্রভু বলে “দেখ বিধু আর নাহি পথ।।
এইমাত্র মীড এসে যাহা বলে গেল।
মনে হয় নমঃজাতি ডুবিয়া মরিল।।”
আদ্যোপান্ত সব কথা প্রভু তারে কয়।
শেষে বলে “বিবাহের কি হবে উপায়?।।
বিদ্যাহীন জাতি দেখ মনে বল নাই।
এ কার্য করিতে যেন বল থাকা চাই।।
এমন সাহসী লোক পাইব কোথায়?
বল বিধু এ বিপদে কি করি উপায়?।।”
প্রভুর নিকট শুনি সব বিবরণ।
কিছু কাল স্তব্ধ রহে সেই মহাজন।।
প্রভু পানে চাহি পরে কহিতে লাগিল।
তেজেদীপ্ত হুতাশন যেন রে জ্বলিল।।
“কিবাছলা কলা কর কর্তা মহাশয়।
তোমার অসাধ্য কিবা আছে এ ধরায়?
তুমি যদি ইচ্ছা কর এখনি এখানে।
সাগরে বহাতে পার বিস্তৃত-যোজনে।।
কতকাল এই ভাবে ফাঁকি দিবে আল।
তোমাকে বুঝিতে পারি শক্তি কি আমার।।
বিধবার বিখা দিবে করেছ মনন।
আজ্ঞামাত্র সেই কার্য হইবে এখন।।
সামাজিক লোক যারা মতো ধর্ম্মে নাই।
এ প্রস্তাব তুমি নাহি কর সেই ঠাঁই।।
পরম বান্ধব আছে মতুয়া সকল।
নিশ্চয় এ কার্য্য তারা করিবে সকল।।
কয় দিন পরে হেথা বারুণী সময়ে।
মতো সবে এই আজ্ঞা দিবে তুমি দিয়ে।।
দেখিবে সহজে কার্য্য হবে সমাপন।
এর লাগি প্রভু কেন কর ক্ষুন্ন মন।।
ভক্ত বীর চৌধুরীর দৃঢ় বাক্য শুনি।
ধন্য ধন্য করে তারে প্রভু গুণমণি।।
“এই জন্য বিধু সদা ডাকি যে কোমায়।
শুনিলে তোমার কথা পরাণ জুড়ায়।।
জ্ঞানী গুণী তুমি বিধু সাঘনে প্রশস্ত।
তোমাকে করেছি আমি তাই ডান হস্ত।।
পরামর্শ দিলে যাহা অতীব উত্তম।
ঘাট বুঝে নৌকা-রাখা মাঝির নিয়ম।।
মতো ভিন্ন বুন্ধ নাই অতি ন্যায্য কথা।
তাঁরা রাখে ভক্তি শ্রদ্ধা আর সরলতা।।
হরিচাঁদ এসেছিল তরাতে এ জাতি।
সেই কাজে মতো সব আছে তাঁর সাথী।।
জাতির মঙ্গল তরে কোন কাজ হলে।
মতোরা করিতে পারে স্বার্থ-চিন্তা ফেলে।।
সেই ভাল তাই করি ভাল পরামিশে।
দেখি তারা কিবা বলে বারুণীতে এসে।।”
কথা শুনি চৌধুরীজী বিদায় হইল।
এবে শুন বারুনীতে কি কার্য ঘটিল?
গোপালচাঁদের বাঞ্ছা গুরু-গীতি শোনে।
মহানন্দ আজ্ঞানান্ধ গাহিবে কেমনে?
শ্রীশ্রীবারুণী উৎসবে বিধবা বিবাহের আলোচনা
“কন্মন্যেবাধিকাররোস্তে মা ফলেষু কদাচন-গীতা”
মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী ফাল্গুনী বাসরে।
মহাপূণ্য তিনি নাম ‘বারুণী’ সংসারে।।
এই পুণ্য তিথি দিনে সফলাডাঙ্গায়।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ অবতীর্ণ হয়।।
তাঁর আগমনে ধন্য হইল জগৎ।
দুরাত্মার মহাকষ্ট শান্তি পায় সৎ।।
ভক্তগণে এই দিনে বহু মান্য করে।
এর চেয়ে শুভ দিন জানেনা সংসারে।।
প্রতি বর্ষে মহাহর্ষে তাই ভক্তগণ।
এইদিনে ওড়াকান্দি করে আগমন।।
ধরিয়া নিশান ডঙ্কা কংস করতাল।
শিঙ্গা-ভেরী বাদ্য করে বলে হরিবল।।
দলে দলে শত শত ভক্ত লক্ষ লক্ষ।
ছুটিতে শ্রীধাম পানে সবে এক লক্ষ্য।।
শ্রীধামের কাছে যবে আগুসার হয়।
আনন্দে ভক্তের প্রাণ দেহে নাহি রয়।।
বারি যথা নদী বক্ষে বলি ধীরে ধীরে।
অবশেষে উপনীত আসিয়া সাগরে।।
নদী যবে শেষ হয় সাগরের বুকে।
বারি চলে নেচে নেচে পরম পুলকে।।
ভক্তের চরিত্র দেখি সেই ব্যবহার।
ধাম দরশনে নাই আনন্দের পার।।
তাই বলি আসে যবে ধাম সন্নিকটে।
দেহ ছেড়ে ভক্ত-প্রাণ আগে আগে ছোটে।।
উঠিয়া ধামের পরে জ্ঞান-হারা হয়।
কি করিবে কিবা করে ঠিক নাহি পায়।।
আবর্তে পড়িয়া তৃণ যেই দশা পায়।
কীর্ত্তনের মাঝে ভক্ত ঘুরে চক্র-প্রায়।।
গড়াগড়ি জড়াজড়ি করে প্রেমানন্দে।
আনন্দ সাগরে পড়ি প্রাণ খুলে কান্দে।।
মনে করে এই দিন সর্ব্বদিন-সার।
মানব জীবনে নাহি তুলনা ইহার।।
সারা বছরের ধূলা-ক্লেদ-গ্লানি যত।
প্রেম-জলে ধুয়ে ফেলে হয় শুদ্ধ পুত।।
সেই ভাবে পড়ে গিয়ে ঠাকুরের পায়।
মধুর মূরতি দেখি সর্ব্ব-শান্তি পায়।।
এই ভাবে মহোৎসব হয় বারুণীর।
অসীম নরের কেন্দ্র নাহি যার তীর।।
এই ভাবে বারুণীর তিথি উদযাপন।
বর্ষে বর্ষে করে আসি সব ভক্তগণ।।
দিন দিন বাড়ে ঢেউ বাড়ে জনসঙ্ঘ।
পূণ্যতিথি বারুণীর মধুময়-সঙ্গ।।
প্রথম জীবনকালে প্রভু হরিচাঁদ।
এ-দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি পাইল আহলাদ।।
ভবিষ্যৎ দরশন পিতার কৃপায়।
করিলেন গুরুচাঁদ বালক সময়।।
স্বপ্ন আজি সত্য হল সদ্য সে-দর্শন।
আদিকান্ডি ধর্ম্মক্ষেত্রে হইল কর্ষণ।।
বর্ষণ তাহাতে হল প্রেম-ভক্তি-বীজ।
ভক্তপ্রাণে বংশ-বৃদ্ধি নিষ্ঠা-মনোসিজ।।
এই মহাবারুণীর সময় হইল।
দেশে দেশে ভক্তদল নাচিয়া উঠিল।।
কেহ ছোটে প্রদব্রজে কেহ ছোটে নায়।
আসিল বারুণী তোরা কে কে যাবি আয়।।
এই ভাবে দেশেদেশে পড়ে গেল সাড়া।
কোন কথা মুখে নাই শ্রীবারুণী ছাড়া।।
বছরের কার্য শেষ হিসাব-নিকাশ।
ভক্ত ছোটে ওড়াকান্দী করিতে প্রকাশ।।
হিসাব দেখিয়া প্রভু করে দেবে ঠিক।
পরবর্ষ যাবে ধরে সেই সে নিরিখ।।
কোন কোন ভক্ত আসি হইল উদয়।
আমি কিছু বলিতেছি সেই পরিচয়।।
শ্রীগুরু-গোপালচন্দ্র করুণা সাগর।
দয়া করি রেখ পদে আমি যে পামর।।
শ্রীশ্রীবারুণীতে আগত ভক্তের পরিচয়
যশোর জেলার মধ্যে জয়পুর গ্রাম।
আসিল তারক চন্দ্র কবির সর্ব্বোত্তম।।
রস-রাজ রস-সিন্ধু রসের আগার।
আমি দীন কি বলিব মহিমা তাঁহার।।
নয়নে গলিত-ধারা বদনে হুতাশ।
বলে ‘কোথা হরি চাঁদ কোথা কৃত্তিবাস।।
গুরুচাঁদ রূপে প্রভু এসেছ ধরায়।
গেল দিন এ দীনের কি হবে উপায়?
আত্ম-খেদ করে সাধু চক্ষে বহে ধারা।
ধাম প্রতি ছেোটে যেন গাভী বৎস-হারা।।
বহু ভক্ত পিছে তাঁর বলে হরি বল।
কেন নাচে কেহ গায় কার চক্ষে জল।।
চলিতে তারক যেন ঢলি ঢলি পড়ে।
যাদব ধরেছে তাঁরে নিজ বক্ষ পরে।।
তারকের ভাব দেখি যাদব পাগল।
ভক্ত গণে কেন্দে কেন্দে বলে “হরি বল”।।
যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।
তারকের পিছে চলে করে গালাগালি।।
শ্রীরাম স্মরণে বহে উভ চক্ষে জল।
থেকে থেকে কেন্দে কেন্দে বলে হরিবল।।”
তারকের সঙ্গে আসে ভক্ত বহুতর।
নমঃশূদ্র তেলী মালী কামার কুমার।।
মহাভাবে মত্ত সাধু চলে ধাম-পানে।
পথি মধ্যে হল দেখা হরি পাল সনে।।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র যেন হল প্রকত্তর।
দুই ধারা এক হল প্রবল আকার।।
উঠিল নামের ঢেউ আকাশ ভেদিয়া।
চলিতেছে দুই ধারা ধারা ডুবাইয়া।।
পূর্ব্বেতে উঠিল মহা নামের কল্লোল।
নারিকেল বাড়ী উঠে সোর শব্দ গোল।।
হুঙ্কারে কাঁটিল যেন আকাশ পাতাল।
দলে দলে ছুটে ভক্ত সাজিয়া মাতাল।।
ভাবাকুল বলে প্রভু হরিবর এল।
কবিবর মনোহর সঙ্গেতে জুটিল।।
বেহালের বেশে আসে অশ্বিনী গোঁসাই।
কেন্দে কেন্দে হরি বলে ঘন ছাড়ে হাই।।
কবিবর হরিবর দুর্গাপুরে ঘর।
খুড়তুত ভাই তাঁর কবি মনোহর।।
উভযে সুকবি ধন্য করে কবি গান।
শ্রীতারক চাঁদের শিষ্য দুই মতিমান।।
শ্রীতারক, মহানন্দ দুই মহাজন।
এক সাথে নাম গান একত্রে ভ্রমণ।।
মহানন্দে দেখি মন উতলা হইল।
পদে আত্মসমর্পণ হরিবর কৈল।।
সেই হরিবর এল নারিকেল বাড়ী।
মহানন্দ চরণেতে পড়িল আছাড়ি।।”
হুঙ্কার ছাড়িয়া ডাকে সে ছোট পাগল।
“এল হরি আয় সবে গেল ভবগোল।।”
হুঙ্কারে যতেক ভক্ত আসিয়া জুটিল।
ধাম প্রতি মহানন্দ তবে যাত্রা কৈল।।
নামের তুফানে আর প্রেমের বন্যায়।
কুল নারী ঘর চাড়ি পথেতে দাঁড়ায়।।
কেন্দে কেন্দে সে পাগলে বলে করজোড়ে।
‘দয়া-করে চল বাবা আমাদের ঘরে।।
দয়ার সাগর সেই স্বামী মহানন্দ।
তার ঘরে গিয়ে তারে দিল প্রেমানন্দ।।
এই রূপে ঘরে ঘরে যেতেছে গোঁসাই।
ভক্ত গণে বলে হরি বিরামাদি নাই।।
থাকিয়া থাকিয়া প্রভু ছাড়িছে হুঙ্কার।
“আয়রে কলির জীব দিন নাহি আর।”
এই ভাবে আসে ছুটে স্বামী মহানন্দ।
হৃদি-পুষ্প পরিপূর্ণ প্রেম-মকরন্দ।।
পূর্ব্বেতে উঠিয়া বন্যা চলে মহাবেগে।
অগ্রে চলে মহানন্দ বীর অনুরাগে।।
দক্ষিণে বাজিল শিঙ্গা ডঙ্কার নিক্কণ।
সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে স্বামী শ্রীদেবী চরণ।।
যোজন-বিস্তৃত-শাখা মহাবৃক্ষ প্রায়।
মহাতেজা দেবীচাঁদ দাড়াইয়া রয়।।
‘বলরে হরি, বলরে হরি, হরিবল।
বলে হরি চক্ষে বারি ঝরে অবিরল।।
হরিবলে হেলে দুলে ছাড়িল হুঙ্কার।
মধুমতী নাচে রঙ্গে কাঁপিল সংসার।।
হুঙ্কারের ধ্বনি কর্ণে শুনিল গোপাল।
বলে “তোরা ওড়াকান্দী কে কে যাবি চল।।”
মাধব জুটিল সাথে জুটিল শ্রীনাথ।
লহ্মীখালী বেতকাটা হ’ল একসাথ।।
বানিয়ারী আসি সবে উপনীত হল।
দেবীচাঁদ বলে “শীঘ্র ওড়াকান্দী চল।।
ধন্যগ্রাম লহ্মীখালী খুলনা জিলায়।
মহাসাধু শ্রীগোপাল যেথা জন্ম লয়।।
দেবীচাঁদ গোস্বামীর কৃপা হৈল তাঁরে।
তাঁর গুণে মুক্তি পেল কোটী নারী নরে।।
কি ভাবে গোপাল পেল শ্রীগুরু দর্শণ।
সে সব রহস্য পরে করিব কীর্তন।।
এবে যাহা বলিতেছি এমন সময়।
শ্রীগোপাল ওড়াকান্দী কিছু কিছু যায়।।
দেবীচাঁদ-সঙ্গে চলে ভকত-তাঁহার।
এতোধিক পরিচয় নাহি কিছু আর।।
গোপাল, মাধব, আর মন্ডল শ্রীনাথ।
দেবীচাঁদ এক সাথে করে প্রণিপাত।।
গোপাল মাধব দোঁহে সম্পর্কেতে ভাই।
মামাত পিসাত ভাই সবে জানে তাই।।
গোপাল আসিল আর আসিল বিপিন।
কেনুভাঙ্গা বাস যাঁর ভক্তিতে প্রবীণ।।
বরিশাল জিলা মধ্যে কেনু ভাঙ্গা নাম।
সেই গ্রামে জন্ম নিল সেই গুণ ধাম।।
দেবীচাঁদ দেখি মন পাগল হইল।
দেহ মন গুরু পদে সকলি সঁপিল।।
গৌরাঙ্গ বরণ সাধু আঁখি ছল ছল।
প্রণমি গুরুর পদে বলে ‘হরিবল’।।
রাজনগরেতে বাস ভকত নেপাল।
গণেশ আসিল সাথে বলে হরি বল।।
টুঙ্গীপাড়া গ্রামে সাধু শ্রীতপস্বীরাম।
প্রচন্ড শরীর তাঁর রূপে অনুপম।।
হরি বলে বাণীয়ারী হল উপস্থিত।
তাহাকে দেখিয়া দেবী অতি হরিষিত।।
সামর্থগাতীর গ্রামে যত ভক্ত ছিল।
বানিয়ারী গ্রামে আসি উপস্থিত হল।।
এমত আসিল ভক্ত অসংখ্য সংখ্যায়।
শুভক্ষণে যাত্রা করি ধাম প্রতি ধায়।।
অগ্রে চলে গোস্বামীজী পবিত্র মূরতি।
নিশান উড়ায়ে চলে ভকত-সংহতি।।
অবিরাম হরিনাম ডঙ্কা শিঙ্গা রোল।
অযূত কণ্ঠেতে ভক্ত বলে ‘হরি বোল।”
শঙ্খ-কন্ঠ ভগীরথ যেমতি প্রকারে।
পতিত-পাবনী-গঙ্গা আনিল সংসারে।।
অগ্রে চলে ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া।
পশ্চাতে চলির গঙ্গা ধরা ডুবাইয়া।।
মহা রোলে সে কল্লোল ধাইয়া ছুটিল।
পাহাড়, নগর, বন সকলি ডুবিল।।
সেইমত অগ্রে ধায় গোস্বামী সুন্দর।
নামের বন্যঅয় ভক্ত ডুবায় সংসার।।
মালীখালী গ্রামে বাস শ্রীবদন রায়।
ভক্ত সেঙ্গ মনোরঙ্গে ওড়াকান্দী যায়।।
বাসুড়িয়া গ্রামে ঘর রাইচাঁদ নাম।
ওড়াকান্দী ধাম প্রতি চলে গুণধাম।।
রাইচরণের কথা বলি কিছু হেথা।
তারকচাঁদের খেলা অপূর্ব্ব বারতা।।
পিতৃহীন রাইচাঁদ ভাই দুইজন।
বহুকষ্টে তার মাতা করিল পালন।।
নিরুপায় জননীর অন্য চিন্তা নাই।
শুধুভাবে কোনভাবে এদের বাঁচাই।।
সদা কান্দে সেই নারী হরিচাঁদ বলে।
বসন তিতিয়া যায় নয়নের জলে।।
নারীর কান্নায় প্রভু তারে দয়া কৈল।
বাসুড়িয়া শ্রীতারক উপস্থিত হইল।।
একবাড়ী শ্রীতারক করে নাম গান।
সেই নারী আসি হেথা হল অধিষ্ঠান।।
তারকে দেখিয়া নারী হল জ্ঞানহারা।
অবিরল নেত্রে তার বহে জলধারা।।
এইভাবে কিছুকাল একদৃষ্টে চায়।
ক্ষণপরে পড়িল সে গোস্বামীর পায়।।
তার পুত্র রাইচাঁদ বালক তখন।
গোস্বামীর পদতটে করিল শয়ন।।
গোস্বামী ধরিয়া তারে শিরে দিল হাত।
বলে ‘রাই ভয় নাই দিনু আশীর্ব্বাদ।।
রাহা হবি প্রজা পাবি হরিভক্তগণে।
ভক্তি যেন থাকে সদা শ্রীহরি-চরণে।।
এই কথা গোস্বামীজী তারে যবে কয়।
উঠিয়া পালায় রাই ধরা নাহি দেয়।।
তাহা দেখি শ্রীতারক হলেন গম্ভীর।
সবে দেখে ঝরে তার দুই চক্ষে নীর।।
ভক্তগণে জিজ্ঞাসিল গোস্বামীর ঠাঁই।
“কি কারণে কাঁদে প্রভু গুনিবারে চাই।।”
তারক বলেন, ‘তাহা বলিবার নয়।
বিবিধ ইচ্ছাতে দেখি সবকর্ম্ম হয়।।
যে ঘটনা ঘটিয়াছে মম অগোচরে।
বুঝিলাম তাঁর ইচ্ছা প্রবল সংসারে।।”
এত বলি শ্রীতারক চুপ করি রয়।
পথে আসি গূঢ়-কথা ভকতে জানায়।।
“মম বাক্য কভু নাহি হইবে লঙ্ঘন।
ধনী হবে সাধু হবে সে রাইচরণ।।
কিন্তু পরে পলাইবে হরি-ধর্ম্ম ছাড়ি।
এ-তত্ত্ব বুঝিনু আমি আশীর্ব্বাদ করি।।
যাহা দিয়া ফেলিয়াছি ফিরাতে না পারি।
তাই দুঃখে ফেলিলাম দুটি অশ্রুবারি।।”
যাহা যাহা শ্রীতারক বলিলেন কথা।
কালে কালে সেই সব ফলিল সর্ব্বথা।।
রাইচাঁদ ওড়াকান্দী মতুয়া হইল।
প্রেমে মত্ত মহাভাবে ভাবুক সাজিল।।
ধন হল শিষ্য পেল বাড়ির প্রতিষ্ঠা।
ক্রমে ওড়াকান্দী পরে হল নিষ্ঠা-ভ্রষ্টা।।
বৈরাগী আচারে করে জীবন যাপন।
তারকচাঁদের বাণী হইল পূরণ।।
ওড়াকাদন্দী প্রতি নিষ্ঠা ছিল সে সময়।
সেইকালে বারুণীতে ভক্তিসহ যায়।।
পাতলা নিবাসী সাধু নাম ধনঞ্জয়।
মতুয়ার সঙ্গে মিশে ধাম প্রতি ধায়।।
মহেশ বিশ্বাস আর যাদব বিশ্বাস।
পাগল সে বিচরণ তালতলা বাস।।
শ্রীচন্ডী বৈরাগী ধন্য শ্রীগোপাল রায়।
হরিবলে বাহু তুলে ওড়াকান্দী ধায়।।
মাধবেন্দ্র বাবুরাম, আসিল বিপিন।
শত শত ভক্ত কত আসে সংখ্যা হীন।।
রমণী গোঁসাই নামে হুড়কাতে বাস।
পারশুলা গ্রামে ঘর শ্রীহরি বিশ্বাস।।
কাথলিয়াবাসী সাধু নিবারণ চন্দ্র।
চাঁদকাঠি গ্রামে ভক্ত শ্রীগোপাল চন্দ্র।।
উমাচরণ, বিপিন, কৃষ্ণপুরবাসী।
দূরদেশ হতে ভক্ত উপস্থিত আসি।।
তেরখাদা গ্রামে ঘর তিনকড়ি নাম।
শ্রীহরির ভক্ত হল জাতিতে ইসলাম।।
মালঞ্চ নামিনী ধনি আসিল কান্দিয়া।
গুরুচাঁদে ভক্তি করে মনপ্রাণ দিয়া।।
ওড়াকান্দী মাচকান্দী রাউৎ খামার।
নড়াইল তারাইল কত বলি আর।।
সব গ্রামে আছে ভক্ত দৃঢ় অনুরাগে।
সর্বকার্যে ছুটে তারা সকলের আগে।।
এই ভাবে সর্বদিকে হতে ভক্তগণ।
শ্রীমহাবারুণী-তীর্থে করে আগমন।।
শ্রীতারক হরিপাল পশ্চিমের দিকে।
পূর্বে াতে শ্রীমহানন্দ প্রেমানন্দে থাকে।।
দক্ষিণ হইতে এল স্বামী দেবীচন্দ্র।
দিবানিশি সমভাব প্রেমে নাহি ভঙ্গ।।
ধামে আসি সবে মিশি করে হরি নাম।
শ্রীগুরু শ্রীপদে শেষে করিল প্রণাম।।
নামগানে প্রেমানন্দে দুই দিন যায়।
প্রতিবর্ষ বারুণীতে এই ভাব হয়।।
তেরশ সতের সালে যে-বারুণী হয়।
এবে শুন মহাপ্রভু তাতে কিবা কয়?
ভক্তগণের সহিত প্রভুর আলাপন ও বিধবা-বিবাহ প্রস্তাব
“গার্হস্থঞ্চ সমাশ্রিত্য সর্ব্ব জীবনন্তি জন্তুবঃ
তাদৃশং নৈব পশ্যামি হান্যমাশ্রমমুত্তমম-
........দদ্মপুরাণম।
“শুন সব ভক্তগণ করিয়াছ আগমন
হরি-লীলাভূমি ওড়াকান্দি।
শ্রীমহা বারুণী দিনে তাঁহারে স্মরণে এনে
প্রেম ডোরে রাখ তারে বান্ধি।।
হরিচাঁদ রসময় আসিলেন এ ধরায়
উদ্ধারিতে পতিত মানব।
তাঁর ভাব-ধারা নিয়ে তাঁর ভাবে ভাব দিয়ে
চলিতেছে ভক্তগণ সব।।
শ্রীহরির যেই ধর্ম্ম শুন সবে তার মর্ম্ম
মূল ভিত্তি গার্হস্থ্য জীবন।
সন্ন্যাসীর ধর্ম্ম যাহা এই ধর্ম্ম নহে তাহা
শুন বলি তাহার কারণ।।
গৃহী থাকে গৃহ বাসে গৃহীর নিকটে আসে
সাধু সন্ত সন্ন্যাসী সুজন।
গৃহী উপার্জ্জয় ধন সেই ধনে সর্ব্বজন
করিতেছে জীবন ধারণ।।
অধিকাংশ জীব দলে গৃহ ধর্ম্ম-মতে চলে
তাই চলে সৃজনের খেলা।
গৃহী যদি রক্ষা পায় তাতে জীব রক্ষা হয়
গৃহী জনে নাহি কর হেলা।।
আর বলি গূঢ় কথা মনু ইলা পিতামাতা
আদি কালে সৃষ্টির প্রভাতে।
সৃষ্টির প্রসার কল্পে আসে তাঁরা কল্পে কল্পে
তাই সৃষ্টি-রক্ষা-এ-জগতে।।
আদি গৃহী ছিল তারা গৃহ ধর্ম্মে সৃষ্টি-ধারা
চলিতেছে আদি যুগ হতে।
তাই সৃষ্টি মূল-ভিত্তি গৃহ ধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ-নীতি
অন্য নীতি ছিল না জগতে।।
ক্রমে বংশ বৃদ্ধি হয় গৃহ কলুষিত তায়
দুঃখ এল মানব জীবনে।
সেই দুঃখ নাশিবারে বারে বারে অবতারে
হরি-নামে জীবের কারণে।।
এত বার যতবার হরি হল অবতার
পূর্ণ শিক্ষা গৃহী নাহি পেল।
হরিচাঁদ রূপে তাই নামিল ক্ষীরোদশায়ী
গৃহীরূপে গৃহস্থ সাজিল।।
কিছুদিন খেলা করি চলিয়া গিয়াছে হরি
আজ্ঞা করি দিয়াছেন মোরে।
“গৃহী যাতে বড় হয় কর তুমি সে উপায়
সদুপায় দেখাবে সবারে।”
সেই আজ্ঞা শিরে ধরে তোমাদের ঘরে ঘরে
কহিতেছে তাঁর যত নীতি।
যে জন পিছনে আছে অগ্রে বলি তার কাছে
তাই ধরি নমঃশূদ্র জাতি।।
নমঃশূদ্র মধ্যস্থলে তার দুই ধারে চলে
দুই ভাবে দুইটা সমাজ।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ করি উচ্চবর্ণ যারে ধরি
উচ্চে থাকি করে উচ্চকাজ।।
উন্নত বলিয়া তারা মহা অহঙ্কারে-ভরা
ধরা নাহি দেয় কোন কালে।
অবনত বলি কহে অপর যাহারা রহে
দুঃখে সদা ভাসে অশ্রুজলে।।
দুয়ের মিলন লাগি নমঃশূদ্র উঠে জাগি
তাই তারে ধরি অগ্রভাগে।
নমঃশূদ্র শক্তি পেলে নিশ্চয় এ ভূমন্ডলে
সবে ধন্য হয়ে হবে স্বার্থ-ত্যাগে।।
এবে শুনি বলি কথা মনে পাই বড় ব্যথা
মাথা হেঁট হল অপমান।
উচ্চ জাতি হিংসা করে জানিয়াছে রাজ-দ্বারে
রীতি নীতি নমঃ নাহি মানে।।
বহুত কলঙ্ক কথা ভরিয়া লিখেছে পাতা
‘সেন্সাস রিপোর্ট’ বলে যারে।
ব্রাহ্মণের রীতি নীতি পালে নমঃশূদ্র জাতি
লেখা নাই তাহার ভিতরে।।
অধম চন্ডাল বলি সে গ্রন্থে দিয়াছে তুলি
মিথ্যা করি আরো লিখে কত।
আছেন ডক্টর মীড যিনি রাজ পুরোহিত
পর উপকারে সদা রত।।
এই দুঃখ বলি তাঁরে মীড তাই বলে মোরে
সেন্সাসের কাগজ আনিতে।
কাগজ আনিয়া দেখি মিথ্যা সব রাখে লিখি
অপমান করে হেন মতে।।
এই কার্য্যে যাহা পাই ইংরাজের দোষ নাই
কর্ম্মচারী কায়স্থ ব্রাহ্মণ।
যে রিপোর্ট দিল তারা ইংরাজ আসিল যারা
অবিকল করিল লিখন।।
বিমর্ষ তাহাতে মীড ক্রোধান্বিত থোচিত
পরামর্শ দিয়াছে তিনি।
“কলঙ্ক ঘুচাতে হলে তোমাদের নমঃকুলে
আন্দোলন কর গুণমণি।।
যদি নিজ ইষ্ট চাও বিধবার বিয়ে দাও
সেই বার্ত্তা কহ রাজ-দ্বারে।
দরখাস্ত করি কও তোমরা চন্ডাল নও
ইহা শুধু বলে হিংসা করে।।
রাজা নহে পক্ষপাতি সমভাব প্রজা-পতি
সুবিচার করিবে অবশ্য।
আমি সাক্ষ্য দিব জোরে নমঃভাল কাজ করে
কভু তারা নহেক অস্পৃশ্য।।”
মীড কথা বলে যাহা আমি দেখি সব তাহা
এ জাতির মঙ্গল-কারণ।
বিধবার বিভা দিব নমঃকূল তরাইব
এই আমি করেছি মনন।।
এই কার্য করিবারে বলিতেছি সবাকারে
কে কে আছে হতে অগ্রসর?
এই কার্য যে করিবে নিশ্চয় জানিও সবে
নাম যাবে রাজার গোচর।।”
এই কথা করি শেষ গুরুচাঁদ পরমেশ
ভক্তে চাহি করিছে অপেক্ষা।
চক্র ধরি চক্রধর মনে ইচ্ছা হল তাঁর
ভক্তগণে করিতে পরীক্ষা।।
অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গ ভক্ত মধ্যে যে প্রসঙ্গ
বিপদ তরঙ্গে যায় চেনা।
সুখে সুখে ভক্ত-থারা ভক্ত কিসে? ভাব-রাখা
লাভ খাবে নাহি লবে দেনা।।
পড়ি ঘোর সমস্যায় ঠাকুরের পরীক্ষায়
ভক্ত সবে রহে বসে চুপ।
মনে মনে আলোচনা করিতেছে জনা জনা
এই খেলা কোন লীলা-রূপ?
ভক্তি যাঁর বল তাঁর ভক্তি তাঁরে করে পার
দেহে বল মনে বল থাকে।
করি-কি-না-করি ভাব সুখের পায়রা সব
সুখে হলে কথা বটে রাখে।।
মুক্তিকামী ভক্ত যারা মুক্তি পেতে ভাব-ধরা
নিজে মুক্তি পেলে সব হল।
যারা কিছু নাহি চায় প্রভু কিসে শান্তি পায়
এই ভাব ধরে তাঁরা মল।।
ভক্ত এই দুই ভাবে স্বার্থে আর অনুরাগে
যার যার ভাবে সেই রয়।
এই ভাব কেন হয় জানে শুধু ইচ্ছাময়
সব ঘটে তাঁহারি ইচ্ছায়।।
ভক্তি বলে শক্তিমান মহাসাধু দেবীচান
গলবস্ত্রে উঠিয়া দাঁড়ায়।
বলে প্রভু আমি দীন আমা হতে কোন দিন
তব কার্য হবে কি সাধন?
যদি মোরে দয়া হয় তব ইচ্ছা সাথে রয়
কার্য করি করে প্রাণপণ।
বিধবা বিবাহ তুচ্ছ যদি ধূমকেতু-পুচ্ছ
আনিবারে আজ্ঞা কর মোরে।
দয়া যদি শিরে পাই শুভ ইচ্ছা সাথে চাই
অবশ্য আনিতে পারি ধরে।।
নাহি মোর বলাবল নাহি চাহি ফলাফল
বলাবল সব মোর তুমি।
এই ভিক্ষা রাঙ্গা পায় যাতে তব শান্তি হয়
সদা যেন তাই করি আমি।।
এই ভাবে নিবেদন করিলেন মহাজন
নয়নের জলে বক্ষঃ ভাসে।
আনন্দে শ্রী গুরুচাঁদ বলে ধন্য দেবীচাঁদ।
বিপদে করিলে রক্ষা এসে।।
তুমি ধন্য কার্য ধন্য নাম হবে জগন্মন্য
ধর্ম্ম পূণ্য লাভ হবে সব।
দধীচির মত তুমি মান্য হবে বঙ্গভূমি
আনন্দে করহে উৎসব।।
প্রভুর এ ভাব দেখি পরস্পর দেখাদেখি
করিতেছে ভক্ত গণ সবে।
জনে জনে অতঃপর বলে সবে জুড়ি কর
আজ্ঞামত কার্য প্রভু হবে।।
প্রভু সবে বলে ডাকি আরা কথা আছে বাকী
এই কার্য্য বহু না করিবে।
উদ্দেশ্য পূরণ হলে এই কার্য্য কোন কালে
করা নাহি যুক্তি-যুক্ত হবে।।
অনাচারী ব্যাভিচারী আছে যত নরনারী
এই কর্ম্মে পাইবে সুযোগ।
স্বামী-ভক্তি হবে ক্ষুন্ন লালসা-পূরণ-জন্য
অনাচারে হবে মহাভোগ।।
মতুয়ার নীতি এই বিধবার বিয়ে নেই
বাল্য বিবাহের কর বন্ধ।
বিধবা পবিত্র ভাবে জীবনে বাঁচিয়া রবে
পর জন্মে দূর হবে মন্দ।।
বাল্য বিবাহের ফলে বিষময় ফল ফলে
অকালে হারায় কত প্রাণ।
কালে যদি বিয়া হয় জেন তাতে সুনিশ্চয়
বংশে হবে অশেষ কল্যাণ।।
চলে যদি এই ভাবে পতি-হারা কম হবে
সতীধর্ম্ম থাকিবে সুদৃঢ়।
এক নারী ব্রাহ্মচারী বলেছে দয়াল হরি
দুই নারী বিয়া করে মুঢ়।।
‘এক সতী এক পতী’ এই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম-নীতি
প্রাণে প্রাণে পূর্ণ বিনিময়।
এক বারে দিলে যাহা কোন ভাবে বল তাহা
ফিরাইয়া আনে পুনরায়।।
তবে যে বিবাহ দিতে বলিলাম কোন মতে
সেই কথা বলিয়াছি আগে।
জাতির মঙ্গল তরে মীড যে বলিল মোরে
বিধবার বিয়ে দেয়া লাগে।।
কিছু কিছু বিয়া দাও নরনারী যদি পাও
জোর করে না করিও কার্য্য।
ইচ্ছা করে যারা যারা এই কার্য্যে দিবে সাড়া
বর কন্যা কর তাই ধার্য্য।।
প্রভু-আজ্ঞা করে শেষ ভক্তগণ নিজ দেশ
বিদায় মাগিয়ে সবে গেল।
ভক্তগণে সঙ্গে করি, মুখে বলে হরি হরি
দেবীচাঁদ গৃহেতে ফিরিল।।
আসিয়া বানেরী গাঁয় স্বামী দেবীচাঁদ কয়
“শোন কথা গোপাল’ বিপিন।
নেপাল তপস্বীরাম আর যত গুণধাম
সবে আসিয়াছ বহু দিন।।
যার যার দেশে যাও বিধবার বিয়ে দাও
এই কার্য্যে সবে দেও মন।
প্রভু বলিয়াছে যাহা নিশ্চয় আমরা তাহা
প্রাণপণে করিব পালন।।”
গোস্বামীর বাণী শুনি জোর করি নিজ পাণি
শ্রীগোপাল বলিলেন তাঁরে।
“বাবা আমি চাই ভিক্ষা আপনার বাক্য রক্ষা
হয় যেন এ অভাগা হতে।
পথ যদি ভুলে যাই শ্রীচরণে এ দোহাই
দয়া করে টেনে রেখ পথে।।”
এই কথা বলি তাঁয় ভুমে গড়াগড়ি যায়
ভাব দেখি দেবীর আনন্দ।
বলে “শোন হে গোপাল ছেড়ে দেও ফলাফল
তাঁর কাজে নাহি কোন সন্দ।।”
বিদায় হইল সবে প্রেমানন্দ-উৎসবে
দেশে দেশে আসি করে আয়োজন।
গোপালের মত নিয়া শ্রীনাথ করিল বিয়া
আর বিয়া করে কতজন।।
ফরিদপুর, খুলনা বরিশাল এক খানা
ত্রিশ জনে বিবাহ করিল।
সামাজিক ব্যক্তি যত সবে যেন ব্রজাহত
বলাবলি করিতে লাগিল।।
“মতুয়ার এ কি কান্ড ক্রিয়া কর্ম্ম লন্ড ভন্ড
জাতি ধর্ম্ম আর নাহি থাকে।
বিধবার দিল বিয়ে কার কাছে বুদ্ধি নিয়ে
হেন কর্ম্ম করে ঝাঁকে ঝাঁকে।।
মতুয়ারে বাদ দাও সমাজেতে নাহি নাও
খৃষ্টানের মত ব্যবহার।
কর তারে হুকা বন্ধ নাপিত ব্রাহ্মণ বন্ধ
এক সঙ্গে করো না আহার।।
বিবাহের কিছু পরে গোপালের সঙ্গে করে
দেবীচাঁদ গেল ওড়াকান্দী।
প্রণমি প্রভুর পায় সকলি খুলিয়া কয়
করজোড়ে দুই হস্ত বান্ধি।।
দেবী কয় “এ গোপাল ওড়াকান্দী অল্পকাল
যাতায়াত করে অনুরাগে।
আপনার আজ্ঞা পেয়ে শীঘ্র নিজ দেশে গিয়ে
বিয়া দিল সকলে আগে।।”
এই কথা দেবী কয় গোপালের পানে চায়
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ যিনি।
কোমল-করুণ-দৃষ্টি করে যেন মধু বৃষ্টি
আত্মহারা গোপাল অমনি।।
ক্ষণমাত্র দৃষ্টি করে গোপাল লুটায়ে পড়ে
চক্ষে তাঁর বহে প্রেম-বান।
প্রভু কয় দেবীচান্দে এ দেখি পড়িল কেন্দে
এ মানুষ হতে ভাগ্যবান।।
কি নাম বলিলে শুনি শ্রীগোপাল গুণমণি
এ ত মোর নন্দের গোপাল।
এই হয় মোর মনে এই ভাগ্যবান জনে
ওড়াকান্দী এল বহুকাল।।”
ভক্ত আর ভগবানে কিবা কহে কেবা জানে
এই মাত্র বুঝি অনুমানে।
সাধনাতে শ্রীগোপাল মত্ত থাকি এত কাল
‘কৃপাসিদ্ধি’ পেল কৃপাগুণে।।
এই শুভ সমাচার করিবার সুপ্রচার
মীডেরে ডাকিয়া প্রভু বলে।
‘শুন হে ডক্টর মীড আজ্ঞা তব যথোচিত
পালন করেছি সবে মিলে।।
এই যে দেবীচরণ অতিশয় মহাজন
তাঁর শিষ্য নামেতে গোপাল।
আরো আছে বহুজন সবে হয়ে একমন
এক সাথে যারা দিল তাল।।”
আনন্দে সাহেব কয় ‘শুন কর্তা মহাশয়
আমি নিব ইহাদের ছবি।
নাম ছবি এক সাথে আমি পাঠাব বিলাতে
কার্যোদ্ধারে এই হল চাবী।।
আমি বলি সুনিশ্চয় আর কিছু নাহি ভয়
কলঙ্ক করিব আমি দুর।
আমি জানি ভলমতে এ জাতির ভার হতে
নিজে তুমি নিয়েছ ঠাকুর।।
এই ভাবে বিয়া হয় প্রভু দেবীচাঁদে কয়
আর নাহি করে প্রয়োজন।
যাহা বলে এই ভাল এ জাতি উদ্ধার হল
আর বিয়া দিব কি কারণ?
নিজ হাতে নিয়ে ভার নমঃশূদ্রকে উদ্ধার
করিলেন দয়ার ঠাকুর।
কবি কহে শুন ভাই এস ছুটে ভয় নাই
যত আছে অনাথ আতুর।।
নমঃশূদ্র আন্দোলন ও চন্ডাল গালি মোচন
অতঃপর আর দিনে মীড আসি কয়।
যাহা বলি কর তাই কর্ত্তা মহাশয়।।
দেশে দেশে আছে যত প্রধান প্রধান।
সবারে ডাকিয়া তুমি কর আজ্ঞা দান।।
সবে যেন নিজ দেশে করে আন্দোলন।
যাহাতে চন্ডাল গালি হয় বিমোচন।।
মীডের বচনে প্রভু সুখী অতিশয়।
দেশে দেশে জনে জনে সংবাদ পাঠায়।।
এই ভাবে দেশে দেশে হল আন্দোলন।
কিভাবে কোথায় হল করিব বর্ণন।।
আদি জেলা যশোহর করে আন্দোলন।
পিয়ারী চরণ ঢালী নামে একজন।।
নড়াইল আদালতে ছিল চাপড়াশী।
কালী শঙ্কর সুকুল তার প্রতিবেশী।।
নমঃশূদ্র জাতি তত্ত্ব জানিবার তরে।
জিজ্ঞাসা করিল ঢালী তাঁহার গোচরে।।
তিনি বলিলেন তাহা মের জানা নাই।
জিজ্ঞাসা করিতে পার তারকের ঠাঁই।।
তাঁর কাছে গেলে হতে পারি নিরূপণ।
পিয়ারীচরণ এল তারকের ঠাঁই।
বলে এক কথা মোরে বলহে গোঁসাই।।
নমঃশূদ্র জাতিতত্ত্ব কোন শা্স্ত্রে আছে।
অবশ্য বলুন তাহা আমাদের কাছে।।
শ্রীতারক বলে শুন ঢালী মহাশয়।
সেই কথা গুরুচাঁদ বলেছে আমায়।।
‘শক্তি সঙ্গম তন্ত্রের বিধানে বিধান।
নমঃশূদ্র জাতিতত্ত্ব তাহাতে প্রমাণ।।
গোপীনাথপুরবাসী দ্বারিক মোক্তার।
পিয়ারীর কাছে জানে এই সমাচার।।
তন্ত্র বই আনিবারে বহু চেষ্টা হল।
কিন্তু সেই গ্রন্থ পরে কোথা না মিলিলি।।
নিরাশ হইয়া পড়ে দ্বারিক সুজন।
প্রভু ঠাঁই ওড়াকান্দী করে আগমণ।।
প্রভু বলে “মহাশয়, এক কার্য্য কর।
আলোচনা সবে মিলে কর পরস্পর।।
নানা জেলা হতে সব কর দরখস্ত।
যাহাতে চন্ডালগালি হয় বরখাস্ত।।
এ কার্য্যে সাহায্য পাব মীডের নিকটে।
বলেছি সকল কথা তারে অকপটে।।”
প্রভুর বচনে তবে দ্বারিক মোক্তার।
দেশে দেশে পাঠাইল এই সমাচার।।
আসামে মোক্তার ছিল নামে কুসীরাম।
এই কার্য্যে চেষ্টা তেঁহ করে অবিরাম।।
খুলনা জিলায় বাবু শ্রীরাইচরণ।
পরেশ হালদার বলি ছিল অন্য জন।।
ঢাকা ত্রিপুরাতে ছিল প্রধান যাহারা।
সকলে মিলিয়া কার্য্য করিল তাহারা।।
যশোর ফরিদপুরে নমঃশূদ্রগণ।
গ্রামে গ্রামে করে সবে এই আন্দোলন।।
বোমভাগ গ্রামে ঘর ঈশ্বর পন্ডিত।
বহু কার্য্যে স্বজাতির যিনি করে হিত।।
ভবানীপুরেতে ঘর রামনারায়ন।
আটেরহাটেতে বাস শ্রীগুরুচরণ।।
ধুসাহাটী বাসী হয় হরি নারায়ণ।
খামার গ্রামেতে ঘর শ্রীউমাচরণ।।
সবে মিলি এক ঠাঁই করে আলেচনা।
“ওড়াকান্দী বড়কর্তা করেছে কামনা।।
দরখাস্ত কর সবে রাজার নিকট।
গ্লানি দুর হবে তাতে জব্দ হবে শঠ।।
যেই আজ্ঞা বড় কর্তা করিয়াছে সবে।
চল মোরা সবে কাজ করি সেই ভাবে।।”
এই ভাবে দেশে দেশে করে আন্দোলন।
পরে দরখাস্ত করে নমঃশূদ্র গণ।।
এদিকে প্রভুর গৃহে ওড়াকান্দী গাঁয়।
দেশবাসী সবে আসি উপনীত হয়।।
শ্রীবিধু চৌধুরী আর ভীষ্মদেব দাস।
শ্রীচন্ডী বৈরাগী ধন্য তালতলা বাস।।
আর বহুজন এল ওড়াকান্দী বাড়ী।
দরখস্ত সহি সবে করে তাড়াতাড়ি।।
সেন্সাসের বড় কর্তা ছিল পাঞ্চাবেতে।
নামেতে মিষ্টার গেট কার্য্য তাঁর হাতে।।
যত যত দরখস্ত গেল বঙ্গ হতে।
গুরুচাঁদে “নেতা” বলি উল্লেখ তাহাতে।।
শ্রীহরি ঠাকুর হল মহান পুরুষ।
তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ উন্নত মানুষ।।
যেই ঘরে হেন লোক জন্ম ধরিয়াছে।
সেই জাতি এ জগতে হীন রবে কিসে?
এমত প্রকারে থাকে বহুতর যুক্তি।
সকলে প্রার্থণা করে নমঃশুদ্র-মুক্তি।।
ওড়াকান্দী হতে যেই দরখাস্ত গেল।
“ইহাতে সম্মত আমি” মীড লিখি দিল।।
দরখাস্ত পঁহুছিল গেটের নিকট।
গেট ভাবে দরখাস্ত নাহবে কপট।।
তত্ত্ব জানিবারে তেঁহ সাব্যস্ত করিল।
ন্যায়রত্ন মহেশের নিকটে লিখিল।।
ন্যায়রত্ন বঙ্গদেশে প্রধান পন্ডিত।
জাতিমালা গ্রন্থ হ’ল তাহার রচিত।।
সরকারী কার্য্যে তার ছিল বহুমান।
তার যুক্তি শ্রেষ্ঠ যুক্তি অকাট্য প্রমাণ।।
এই কার্য্যে ছিল তেঁহ রাজকর্ম্মচারী।
বয়সে প্রচীণ তাহে বেতনাদী ভারী।।
মর্ম্ম জানিবারে গেট তাহারে লিখিল।
পত্র পেয়ে ন্যায়রত্ন অবাধে কহিল।।
“বঙ্গদেশে নমঃশূদ্র বলে জাতি নাই।
“চন্ডাল” সকলে তারা প্রমাণেতে পাই।।
বড়ই অসভ্য জাতি বিদ্যা শিক্ষা নাই।
চন্ডাল বলিয়া ব্যাখ্যা করিলাম তাই।।
জবাব পাইয়া গেট ভাবে মনে মন।
ন্যায়রত্ন এই ব্যাখ্যা করে কি কারণ?
পুনরায় দরখস্ত করিল বাহির।
ডক্টর মীডের সহি দেখিল সুধির।।
মনে ভাবে “মীড যদি তত্ত্ব নাহি জানে।
দরখস্ত পরে সহি করিল কেমনে?
অবশ্য লিখিব আমি মীডের নিকটে।
মূলতত্ত্ব মোরে তিনি লিখিবেন বটে।।
এত বলি অবিলম্বে সেই মহাশয়।
মীডের লিখিল পত্র যাহা যাহা হয়।।
পত্র পড়ি মীড প্রাণে পাইল আঘাত।
অবিলম্বে উপনীত প্রভুর সাক্ষাৎ।।
সবিশেষে সমাচার প্রভুকে কহিল।
প্রভু বলে “শোন মীড উপায় কি বল?”
মীড বলে “ভাবিয়াছি আমি সদুপায়।
আমি স্বাক্ষী দিব দেখি তাতে কিবা হয়।।
বঙ্গদেশে মিশনারী যে যেখানে আছে।
অবশ্য লিখিব আমি সকলের কাছে।।
আমাদের সাক্ষ্যে দেখি কিবা ফলে ফল।
রাজ-পুরোহিত মোরা সেই মাত্র বল।।”
এত বলি মীড লেখে মিশনারী ঠাঁই।
নমঃশূদ্র পক্ষে আমি সাক্ষ্য দিতে চাই।।
তোমরা সকলে তাতে সাহায্য করিবে।
নমঃশূদ্র হীন নহে এ কথা লিখিবে।।
সেই ভাবে লিখে তাহা দিবে মম ঠাঁই।
মীডের লিখন পেয়ে যত মিশনারী।
আনন্দে লিখিয়া দিল এক এক করি।।
সকলের লেখা যবে আসিয়া পড়িল।
আপনার পত্র মীড তখনে লিখিল।।
প্রভুর নিকটে জানে যত সমাচার।
একে একে লেখে মীড চিঠির ভিতর।।
সর্ব্বশেষ নিজ সাক্ষ্য পশ্চাতে লিখিল।
রাজ-দ্বারে এ জাতির দলিল হইল।।
প্রথমে লিখিল মীড “আমি মিশনারী।
ধর্ম্ম প্রচারিতে সদা বঙ্গদেশে ঘুরি।।
এ দেশেরে যত জাতি চিনি সকলেরে।
খৃষ্টধর্ম্মী আছে জাতি সবার ভিতরে।।
কোন জাতি কি আচারে জীবন কাটায়।
সকলের তত্ত্ব আমি জানি মহাশয়।।
ব্রাহ্মণের ঘরে যদি কেহ মারা যায়।
একাদশ দিনে বটে তার শ্রাদ্ধ হয়।।
গয়াতীর্থ পর করে পুনঃ পিন্ড দান।
এই অধিকার নহে সবার সমান।।
“অন্ন পিন্ড” দিতে পারে শুধুই ব্রাহ্মণ।
অন্ন পিন্ড শূদ্রে দিতে পারে না কখন।।
ব্রাহ্মণের গলে থাকে যজ্ঞ-উপবীত।
তার বিয়া নাহি হয় অন্যের সহিত।।
ব্রাহ্মণের কন্যা ভিন্ন বিয়া নাহি করে।
পূজা পার্ব্বণাদি হয় ব্রাহ্মণের ঘরে।।
নমঃশূদ্র বলি যারে লিখিয়াছি আমি।
কিসে যে ‘চন্ডাল’ হল জানে অন্তর্য্যামী।।
আচার বিচার সব ব্রাহ্মণের মত।
শুধু মাত্র গলে নাই যজ্ঞ-উপবীত।।
আর এক ব্যবহার আছে বটে ভিন্ন।
কৃষি কর্ম্ম করে তারা সকলের জন্য।।
এই কার্য়্যে জানি আমি অতীব পবিত্র।
কৃষক সবার বন্ধু নহে কর ভৃত্য।।
আমি বলি এই জাতি নিশ্চয় ব্রাহ্মণ।
হীন হয়ে আছে শুধু হিংসার কারণ।।
এ জাতির ঘরে আছে এই মত লোক।
ধনে মানে ধন্য তারা জীবের পালক।।
বিশেষতঃ গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী গ্রামে।
বহু শিষ্য আছে তাঁর সারা বঙ্গভূমে।।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য আর নবশাখ।
তেলী মালী নমঃশূদ্র আছে লাখে লাখ।।
তাঁর পিতা হরিচাঁদে বলে অবতার।
এই দেশে এক ধর্ম্ম করেছে প্রচার।।
রাজকর্ম্মে অধিকার পেয়েছে এ জাতি।
বলিলাম সব আমি তোমাকে সংপ্রতি।।
আর এক কথা মোর হইয়াছে মনে।
এই জাতি পিছে নহে নারীর সম্মানে।।
বিধবা বিবাহ প্রথা এরা মান্য করে।
ব্যাভিচারী নহে তারা এ জাতির ঘরে।।
এসব কারণে আমি বলিনু নিশ্চয়।
নমঃশূদ্র কোন কালে চন্ডাল না হয়।।
আদিকালে এরা সবে ছিল যে ব্রাহ্মণ।
ক্ষুদ্র কিংবা শুদ্র এরা না হবে কখন।।
এই আমি লিখিলাম যাহা সত্য কথা।
‘চন্ডাল’ কাটিয়া দিতে করো না অন্যথা।।
শুধু আমি নাহি আর যত মিশনারী।
তাঁহাদের লেখা দিনু একসঙ্গে করি।।
সকল পড়িয়া তুমি করিবে বিচার।
‘চন্ডাল’ কোটিতে আমি বলি আরবার।।
এইভাবে পত্র গেল গেটের অফিসে।
পত্র পেয়ে আসে সব গেটের বিশ্বাসে।।
নমঃশূদ্র নহে ক্ষুদ্র নহকে চন্ডাল।
এরা সবে এক-জাতি ব্রাহ্মণের দল।।
‘চন্ডাল’ কাটিতে তাই করিল মনন।
মীডে লিখি জানাইল সেই বিবরণ।।
সঙ্গে সঙ্গে লিখিবেন প্রভুজীর ঠাঁই।
“আপনার দরখস্তে যাহা যাহা পাই।।
আরো যাহা সাক্ষ্য মোরে দিয়াছেন মীড।
তাতে দেখি ‘নমঃশূদ্র’ লেখাই উচিত।।
পুনরায় হবে যবে লোকের গানা।
“নমঃশূদ্র লেখা হবে নিশ্চয় ঘটনা।।
এইভাবে চন্ডালত্ব গালি মুছে গেল।
পুনঃ লোক গণনায় নমঃশূদ্র হল।।
এসব ঘটিল শুধু প্রভু-কৃপাগুণে।
নমঃশুদ্রে বন্ধুরূপে গুরুচাঁদে পাই।
গোপালের দয়া বলে তার গুণে গাই।।
জেলে নিকৃষ্ট কার্য হইতে নিষ্কৃতি
বিদ্যাহীন নমঃশূদ্র ছিল জ্ঞানহীন।
উচ্চবর্ণে হিংসা করে তারে রাত্রিদিন।।
রাজকর্ম্মচারী যত ইংরাজ আসিত।
বর্ণ হিন্দু নিকটেতে জিজ্ঞাসা করিত।।
নিজ স্বার্থ তারা সবে রাখিত ঘিরিয়া।
বিদ্যাহীন জনে কহে ‘অস্পৃশ্য’ বলিয়া।।
সেইভাবে নমঃশূদ্রে দিত পরিচয়।
ইংরাজে মানিত যাহা উচ্চবর্ণে কয়।।
ইহার কারণ এই শুন সবে বলি।
বিদ্যাহীন নমঃশূদ্র আছিল সকলি।।
মনে কোথা পাবে বল বিদ্যা কোথা নাই।
ভীরু কাপুরুষ-সম আছিল সবাই।।
অন্যায় বহিত শিরে বিনা প্রতিবাদে।
মুখে নয় বুকে কয় গভীর বিষাদে।।
স্বার্থ বাদী বলদর্পী পাইয়া সুযোগ।
যত পায় তত চায় রাখে অনুযোগ।।
নমঃশূদ্র জেলে গেলে হইয়া কয়েদী।
নিকৃষ্ট কর্ম্মেতে তারে রাখে নিরবধি।।
অসহ্য যন্ত্রণা কত সহে দিনে দিনে।
মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হয় গিয়ে গঙ্গাস্নানে।।
যবে গুরুচাঁদ আসি অবতীর্ণ হল।
কৃপাদানে এ জাতিকে উদ্ধার করিল।।
‘চন্ডাল’ উপাধি দূর করিল ঠাকুর।
ধন্য ধন্য করে সবে দূর হতে দূর।।
কতজনে দিল তাঁরে ত্রাণকর্ত্তা বলি।
কতজনে দিল তাঁরে ভক্তির অঞ্জলি।।
কয়েদীরা জেল হতে আসিয়া বাহিরে।
ধন্য ধন্য ধ্বনি শোনে দেশ-দেশান্তরে।।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানে স্বজাতির ঠাঁই।
গিয়াছে চন্ডাল গালি আর ভয় নাই।।
চন্ডাল বলিয়া যদি বলে কোন জন।
জরিমানা হবে তার নাহিক খন্ডন।।
এই কীর্ত্তি করিয়াছে শ্রীগুরুচরণ।
উপাধী ঠাকরি যাঁর বিখ্যাত ভুবন।।
কয়েদীরা বলিতেছে স্বজাতির ঠাঁই।
এক কার্য্য বাকী কিন্তু আছে শোন ভাই।।
নমঃশূদ্র জেলে গেলে হীন কার্য্য দেয়।
এর প্রতীকার করা উপযুক্ত হয়।।
ক্রমে ক্রমে এই কথা প্রভুজী জানিল।
মীডেরে ডাকিয়া তবে কহিতে লাগিল।।
সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁরে বিশেষে জানায়।
শুনিয়া বলিল মীড “নাই কোন ভয়।।
ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের কুঠিতে যাইয়া।
এসব বৃত্তান্ত আমি আসিব বলিয়া।।
ইতিমধ্যে দরখস্ত সাহেবের ঠাঁই।
আমি লিখি তুমি তাতে করে দেহ সই।।”
সেই ভাবে দরখস্ত হইল যখন।
ম্যাজিষ্ট্রেট দিল আজ্ঞা শুন সর্ব্বজন।।
“হীন কার্য্য নমঃশূদ্রে জেলের ভিতরে।
যেজন করাবে তার শাস্তি হবে পরে।।”
এই নীতি ক্রমে ক্রমে সর্ব্ব জেলা যায়।
হীন কার্ম্মে নমঃশূদ্র অব্যাহতি পায়।।
পতিতপাবন রূপে গুরুচাঁদ এল।
তাঁরে ছুঁয়ে মরাদেহে পরাণ জাগিল।।
প্রেমোন্মাদ গোস্বামী মহানন্দের তিরোধান
ফরিদপুর জিলা নারিকেল বাড়ী গ্রামে।
জন্ম নিল ভক্তশ্রেষ্ঠ শ্রীগোলক নামে।।
প্রভুর কৃপায় বহু আশ্চর্য্য করিল।
হরিচাঁদ অন্তর্দ্ধানে জীয়ন্তে মরিল।।
কিছুকাল দেহ ধরি রহে ধরা পরে।
দেহরক্ষা করিলেন গিয়ে জয়পুরে।।
তস্য ভাতুস্পুত্র যাঁর নাম মহানন্দ।
পরম উদার স্বামী সদা প্রেমানন্দ।।
গোলকের কৃপা হল তাঁহার উপর।
গোলকের শক্তি মহানন্দে করে ভর।।
পেয়ে শক্তি মহানন্দ ঘুরে দেশে দেশে।
জুড়াল ধরার জীব প্রেমের বাতাসে।।
যেভাবে গোলক করে হরিচাঁদ ভক্তি।
সেই ভাবে গুরুচাঁদে তাঁর অনুরক্তি।।
তার সঙ্গে তারকের হল মেশামিশি।
দুজনে বিলায় প্রেম নানা দিশিদিশি।।
যশোহরে প্রায়কালে ভ্রমণ করয়।
তেলী মালী কুন্তুকারে হরিনাম দেয়।।
তাঁরে দেখি বহু লোক মতুয়া হইল।
কান্দি কান্দি ওড়কান্দী সকলে আসিল।।
এই সব লীলা খেলা মহানন্দ করে।
লেখা আছে “লীলামৃত” গ্রন্থের ভিতরে।।
সে সব লিখিতে গেলে গ্রন্থ বেড়ে যায়।
উল্লেখ করিনু মাত্র সাধুর সভায়।।
এই ভাবে তের শত চৌদ্দ সাল এল।
গো্স্বামীজী মহানন্দ নিজলোকে গেল।।
রূপের পাগল যাঁরা প্রেমের কাঙ্গাল।
বিষয় বাসনা ছাড়ি হয়েছে বেহাল।।
কর্ম্মকান্ড মনে প্রাণে না করে গ্রহণ।
তাঁরা শুধু বাসে ভাল প্রেম-আস্বাদন।।
ধর্ম্ম-কর্ম্ম-সম্মিলন প্রভুজী করিল।
দুই সারি ভক্ত তাহে বিদায় মাগিল।।
মুক্তিকামী স্বার্থবাদী যাঁরা যাঁরা ছিল।
কেহ দল ছাড়ে কেহ দেহ ছেড়ে গেল।।
বদন চন্দ্র রায় আর রাই চরণ।
ভিন্নভাবে চলে তারা স্বার্থের কারণ।।
শ্রীরাম ভরত আর স্বামী মহানন্দ।
ব্রহ্ম-বংশে মহাসাধু শ্রীঅক্ষয় চন্দ্র।।
ইহ সবে প্রেমে জানে সর্ব্ব-সিদ্ধি-সার।
কেহ দেহ ছাড়ে কেহ ছাড়িল সংসার।।
কর্ম্ম দায়ে বদ্ধ নহে স্বামী মহানন্দ।
এদিকেতে প্রভু আনে কর্ম্মের প্রসঙ্গ।।
তাই দেহ চাড়িবারে মনে কৈল আঁশ।
রোগ যুক্ত হয়ে গৃহে করিলেন বাস।।
ক্রমে রোগ বৃদ্ধি হল জীবন সংশয়।
প্রেমোন্মাদ ভাবুকের দুঃখ নাহি তায়।।
অবিরাম হরিনাম প্রেমের আলাপ।
মধুময় মধুমাস চৈত্র শেষ হয়।
দেহ ছাড়ি গোস্বামীজী পরপারে যায়।
পড়িল শোকের ছায়া প্রতি ঘরে ঘরে।
ভক্তগণে অনুক্ষণে হায় হায় করে।।
সবারে সান্তনা দিল প্রভু দয়াময়।
বলে জান জন্ম মৃত্যু প্রভুর ইচ্ছায়।।
যার যতটুকু কার্য্য হয় প্রয়োজন।
সে-টুকু করায় তারে সেই নিরঞ্জন।।
তোমার আমার ইচ্ছা কিছু ইচ্ছা নয়।
ইচ্ছা তাহা ইচ্ছা যাহা করে ইচ্ছাময়।।
তিনিই বিধির বিধি সর্ব্বময় বিভু।
অ-বশ্য হইয়া বশ্য অখিলের প্রভু।।
বেদ শ্রুতি স্মৃতি আদি সকল পুরানে।
করজোড়ে স্থির চিত্তে এই বাণী ভণে।।
“অবশ্য সর্ব্ববশ্যাত্মা সর্বদা সর্ব্ব বিত্তমঃ।
তস্য ধাতা ন চৈবান্তি স বৈ সর্ব্বময়ো বিভুঃ।।
...........পদ্মপূরাণম
মৃত্যু কোন তত্ত্ব বল শুধু দেহ ছাড়া।
কর্ম্মক্ষয়ে মৃত্যু আসি দেহে দেয় সাড়া।।
পুরানে লিখেছে তাহা শুন দিয়া মন।
মৃত্যু কারে বলে আর মৃত্যুর লহ্মণ।।
“তৈলক্ষয়াদ যথা দীপো নির্ব্বাণমধিগচ্ছতি।
কর্ম্মক্ষয়াত্তমা জন্তুঃ শরীরান্নাশমিচ্ছতি।।
তৈল ক্ষয়ে দীপ-ক্ষয় আলো নাহি জ্বলে।
কর্ম্মক্ষয়ে দেহী মরে এই ভূ-মন্ডলে।।
এতএব শোক করা অজ্ঞানের কথা।
যা করে সকলি করে আপনি বিধাতা।।
প্রভুর নিকটে শুনি মধুময় বাণী।
সাত্বনা পাইল যত ভকত পরানী।।
মহোল্লাসে মহোৎসব আয়োজন হৈল।
ভক্তগণে অবিরাম নাম গান কৈল।।
সেই বংশে মাধবেন্দ্র অতীব সুজন।
তেহ বহু চেষ্টা কৈল উৎসব কারণ।।
গোস্বামী শ্রী মহানন্দ লীলা সাঙ্গ কৈল।
ভক্তগণে এক মনে হরি হিরি বল।
‘নমঃ কুলপতি” শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ
সেন্সাস বহিতে নমঃশূদ্র লেখা হয়।।
অষ্পৃশ্য চন্ডাল গালি ঘুচাল ঠাকুর।
আর এক কান্ড হয় চিরস্মরণীয়।
রাজা বলে ‘বঙ্গ-ভঙ্গ রদ করি দিও।।
দুই বঙ্গ হল এক বাঙ্গালীর সুখ।
রাজধানী গেল দিল্লী এই যাহা দুঃখ।।
যুক্ত বঙ্গে লাট লর্ড কারমাইকেল।
পরম পন্ডিত তিনি খোলা ছিল দেল।।
বহু গুণে বিভূষিত আছিলেন তিনি।
বাঙ্গালী ভোলেনি আজো তাঁর মূর্ত্তি খানি।
ফরিদপুরেতে তেঁহ করে আগমন।
তাঁর দরশনে প্রভু পেল নিমন্ত্রণ।।
প্রভুর দক্ষিণ-হস্ত সে ডক্টর মীড।
তাঁকে ডাকি বলে মীড করহে বিহিত।।
স্থির হল এক সাথে মিলি কয়জন।
“ডেপুটেশনের” কথা হইল তখন।।
লাটের লঞ্চেতে যাবে প্রতিনিধিগণ।
নিবেদন করিবেন সব বিবরণ।।
মুখপাত্র হবে মীড নমঃশূদ্র পক্ষে।
লাট সঙ্গে কথা হবে পদ্মানদী বক্ষে।।
সেইভাবে ক্রমে তবে হল আয়োজন।
নমঃশূদ্র গণে প্রভু বলিল তখন।।
‘রাজ প্রতিনিধি লাট আসিবে জেলায়।
নিমন্ত্রণ করিয়াছে যাইতে তথায়।।