অন্তখণ্ডঃ তৃতীয় তরঙ্গ
অন্তখণ্ড
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
তৃতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় উমাকান্ত প্রভু কনিষ্ঠ তনয়।
জয় শশীভূষণ সুধন্যচাঁদ জয়।।
(উপেন্দ্র সুরেন্দ্র শ্রীগুরুচাঁদ আত্মজ।
জয় ভগবতী শ্রীশ্রীপতিচাঁদ ভজ।।
জয় আদিত্য সতীশ প্রমথ মন্মথ।
জয় শ্রীশচিপতি মতুয়াগণ নাথ।।)
জয় জয় ওঢ়াকাঁদি শ্রীধাম সুন্দর।
যথা মহাপ্রভু হইলেন অবতার।।
হরি বংশে যত মাতা ঠাকুরানীগণ।
কায়মন বাক্যে বন্দি সবার চরণ।।
তারক যাহার দেহ মহানন্দ প্রাণ।
হরিবর করাঙ্কিত হরি লীলা গান।।
লালচাঁদ মালাকারের উপখ্যান
পয়ার
রাজপাট বাসী লালচাঁদ মালাকার।
হরিচাঁদ পদে নিষ্ঠা ভকতি তাহার।।
বৈশাখ মাসের শেষ হইয়াছে আম্র।
সুখ দৃশ্য ফলভরে শাখা সব নম্র।।
এক গাছে আম তার বড় মিষ্ট হয়।
‘বার্ষিক’ সে আম্র দেন প্রভুর সেবায়।।
প্রথম পাকিলে আম ঠাকুরকে এনে।
ঠাকুরের সেবা করে আনন্দিত মনে।।
কোনবার ওঢ়াকাঁদি দেন পাথাইয়া।
কোনবার দেন আম কিনিয়া আনিয়া।।
মাঝে মাঝে মহাপ্রভু যান সে বাটীতে।
এবার হ’য়েছে মন ঠাকুরকে নিতে।।
আসিয়া প্রভুর সঙ্গে কথা নাহি কয়।
জেনে মন নারায়ণ তার বাড়ী যায়।।
একদা সকালে প্রভু বসিয়া নির্জনে।
একমাত্র তারক বসিয়া প্রভুর স্থানে।।
হরিচাঁদ কহিলেন তারকের ঠাই।
চলরে তারক মোরা রাজপাট যাই।।
রাজপাট লালচাঁদ ক’ট করিয়াছে।
আমাকে খাওয়াবে আম সে খা’বে পাছে।।
গতহাতে ফতেপুরে আম কিনিয়াছে।
আর কত আম তার গাছে পাকিয়াছে।।
ঝাকা ভরি রাখিয়াছে তুলিয়া ঘরেতে।
আমি গেলে সেই আম মোরে দিবে খেতে।।
যাব কিনা যাব তাই ভাবি মনে মনে।
আমারে নিবে সে বেটা আসে বা না কেনে।।
তারক কহেন প্রভু যে ইচ্ছা তোমার।
ইচ্ছাময় তব ইচ্ছা, সে ইচ্ছা সবার।।
শুনিলাম শ্রীমুখেতে লালচাঁদ কথা।
আমার হ’য়েছে ইচ্ছা যাইবারে তথা।।
তাহা শুনি প্রভু কহে মনে হ’য়ে সুখী।
ক্ষণে থাক দেখি লালচাঁদ আসে নাকি।।
হেনকালে লালচাঁদ হইল উদয়।
পূর্বাকাশে রবি চারি দণ্ডের সময়।।
মাথে লম্বা চুল তার মুখে গোপ দাড়ি।
সন্ন্যাসীরা থাকে যেন বিশ্বেশ্বর বাড়ী।।
ঠিক যেন বন হ’তে পরমহংসেরা।
সুগন্ধেতে কাশী আমোদিত করে তারা।।
তেমতি বসিল এসে প্রভুর সম্মুখে।
ঠাকুর পরম সুখী লালচাঁদ দেখে।।
পরমহংস তাহারা উলঙ্গ থাকয়।
লালচাঁদ তেন কিন্তু উলঙ্গ সে নয়।।
ছিন্নবস্ত্র দিয়া মাত্র পরিয়াছে লেংটি।
তার এক কোণা দিছে তাগা সঙ্গে আটি।।
নিতম্ব বাহির ঠিক উলঙ্গের প্রায়।
দূর হতে দেখিলে উলঙ্গ বোধ হয়।।
বরণ তাহার ঘোর কাল স্থুলাকার।
কাল অঙ্গ মধ্যে আলো করে দীপ্তকার।।
ঠাকুরের মুখ তাকাইয়া লালচাঁদ।
বদনে ঈষৎ হাসি অন্তরে আহলাদ।।
তাহা দেখি তারক ভেবেছে মনে মনে।
এই বুঝি লালচাঁদ বুঝি অনুমানে।।
পূর্বে ছিল কপিল বশিষ্ঠ বেদব্যাস।
পরাশর কাত্যায়ন কণ্ব দিগবাস।।
মরীচি অঙ্গিরা শতাতপ সতানন্দ।
গৌতম বাল্মিকী অত্রি সিদ্ধমুনি বৃন্দ।।
আজন্ম কাননবাসী মহাযোগে যোগী।
ইনি কোন মহাজন এল কিবা লাগি।।
যতি হংসী গৃহী বনচারী কি সন্ন্যাসী।
প্রভু সঙ্গে লীলারঙ্গে মর্তলোকবাসী।।
ইতি উতি ভাবি বসিলেন সেইখানে।
ঠাকুরের বামে লালচাঁদের দক্ষিণে।।
এক হালসী কইমাছ আনিয়া ছিলেন।
ঠাকুরের সম্মুখেতে রেখে বসিলেন।।
ঠাকুর কহেন কি করিবি লালচাঁদ।
আম খেতে দিবি তোর মনে আছে সাধ।।
গাছে আছে আম আর কেনবা কিনিলি।
হাটে গিয়া বুঝি আম দেখে ভুলে গেলি।।
কেনা আম গাছে আম আমে আমদানী।
দুগ্ধ আমদানী কত বল তাই শুনি।।
ঠাকুর বলেন আর শুনাবি কি তাই।
দুগ্ধ আমদানী দোয়া আছে দুটি গাই।।
যারে লালচাঁদ, কল্য আমি যাইব।
মধ্যাহ্নে তোমার বাড়ী ভোজন করিব।।
মৎস্য দিকে লালচাঁদ চাহে বারে বারে।
প্রভু বলে মাছ কিছু দিবি নাকি মোরে।।
ঠাকুর কহেন তবে মন জেনে তারে।
উপরের চারি কই দিয়া যা আমারে।।
বড় চারি কই ছিল উপরেতে গাঁথা।
তাহা দিয়া লালচাঁদ নোয়াইল মাথা।।
অন্তঃপুর মধ্যে গিয়া প্রণাম করিয়া।
লালচাঁদ চলিলেন ঠাকুরে দেখিয়া।।
প্রভু বলে নিমন্ত্রণ করিলা আমাকে।
আদরের বস্তু এই চেননা তারকে।।
লালচাঁদ কইমাছ গলায় ধরিয়া।
করযোড় করি চেয়ে রহে দাঁড়াইয়া।।
প্রভু বলে তারক করহ দরশন।
লালচাঁদ তোমাকে করেন নিমন্ত্রণ।।
লালচাঁদ নিম্নত্রিল কথা নাহি কয়।
মৎস্য হালসী হাটে গলে ল’য়া দাঁড়ায়।।
করিতেছে লালচাঁদ বড়ই বিনয়।
করযোড় তারক করিল সে সময়।।
তারপর লালচাঁদ বিদায় হইল।
বাহির বাটীতে আসি ঠাকুর বসিল।।
তারকে লইয়া প্রভু বসিলেন তথা।
বলিতে লাগিল সব মোহন্তের কথা।।
বেলা অপরাহ্ণ হ’ল সন্ধ্যার অগ্রেতে।
তারক চলিল প্রাঙ্গণেতে ঝাড়ু দিতে।।
রাত্রি হ’ল ঠাকুর বসিল বাটী মধ্যে।
ভক্তগণ বসিলেন ঠাকুর সান্নিধ্যে।।
ভোজন হইলে পরে স্বীয় স্বীয় স্থানে।
বঞ্চিলেন নিশি সবে হরষিত মনে।।
প্রভাতে উঠিয়া প্রভু তারকেরে কয়।
চল চল লালচাঁদ বাটী যেতে হয়।।
গিয়াছে ভোলা কুকুর সংবাদ দিয়াছে।
আমরা যাইব সে সংবাদ জানায়েছে।।
বলিতে বলিতে এল কাঙ্গালী বেপারী।
মৃত্যুঞ্জয় আসিলেন বলে হরি হরি।।
ঠাকুর বলেন সবে চল রাজপাট।
পথ বড় কম নয় সবে চল ঝাট।।
যাই যাই যাই বলে হইতেছে কথা।
হেনকালে লালচাঁদ পুত্র এল তথা।।
প্রভু বলে নিতে এল লালচাঁদ ছেলে।
শুভযাত্রা করে সবে হরি হরি বলে।।
যাইতে ভক্তের বাসে উল্লাসিত কত।
তিন দিন পর্যন্ত চাহেন প্রভু পথ।।
প্রভু হরিচাঁদ শ্রীরামচন্দ্র চৌধুরী।
মৃত্যুঞ্জয় গোস্বামী ও কাঙ্গালী বেপারী।।
এইরূপে যাত্রা করিলেন ছয়জন।
রচিল তারকচন্দ্র প্রভুর গমন।।
ভোলা কুকুরের বিবরণ
পয়ার
ভোলা নামে কুকুর প্রভুর বাড়ী রয়।
দৈবে কোথা হ’তে এসে রয়েছে তথায়।।
ঠাকুরের মন জানি সে ভোলা কুকুর।
সাথে সাথে যায় যথা গমন প্রভুর।।
ভক্তগণ যায় যদি প্রভুর বাটীতে।
প্রিয় ভক্ত গেলে আসে তার নিকটেতে।।
স্কন্ধ পরে হাতা দিয়া মুখ দিয়া মুখে।
অনিমিষ নেত্রে মুখ তাকাইয়া দেখে।।
কোন কোন ভক্তের সাথে বসি খায়।
নির্বিকার ভক্ত হ’লে কিছু নাহি কয়।।
একদিন তারক আহারে বসেছিল।
সঙ্গেতে কুকুর ভোলা খাইতে লাগিল।।
তারক বলেনা কিছু দেখিয়া ঠাকুর।
ডেকে বলে তাড়াইয়া দেওরে কুকুর।।
তখনে তারক কুকুরের মাথা ধরে।
তখনে উঠিল ভোলা চলে গেল দূরে।।
তাহাতে তারক বড় পাইলেন স্বাদ।
খাইলেন কুকুর সে ভোলার প্রসাদ।।
একদিন অনেক মতুয়া ভাদ্রমাসে।
প্রভু দরশনে গেল ওঢ়াকাঁদি বাসে।।
ভক্তের নিকটে ভোলা ঘুরিয়া বেড়ায়।
কারু কাছে গিয়া তার নিকটেতে রয়।।
কারু স্কন্ধে হাতা দিয়া ক্ষণকাল রয়।
হাতা নাড়ে মুখ নাড়ে লাঙ্গুল ঘুরায়।।
এক এক বার গিয়া কাহার নিকটে।
গণ্ডুস্থল চাটে কারু পদাঙ্গুল চাটে।।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বসতি মল্লকাঁদি।
তিনি যান সেদিন শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
বেলছেন দিন গেল রবি ডুবে যায়।
লোক সংখ্যা হ’ল বেশী বাড়ী যেতে হয়।।
ঠাকুর আছেন ঘরে না হন বাহির।
কহিতে নারিনু কিছু জীবন অস্থির।।
ক্ষণেক ভ্রমণ করি মনেতে ভাবিয়া।
সেই ভোলা কুকুরকে ধরিলেন গিয়া।।
স্কন্ধ পরে হাতাদিয়া চাটিবারে যায়।
হেনকালে রামকৃষ্ণ কুকুরকে কয়।।
আলাপ করত ভালো আমরা কি করি।
তাহা ত দেখনা তুমি অই দুঃখে মরি।।
যাহ ভোলা একবার প্রভুর গোচরে।
বল’গে অনেক লোক বাড়ীর বাহিরে।।
ভোলা গেল রামকৃষ্ণ যায় পাশে পাশে।
ভোলা গেল যেই গৃহে প্রভু শোয়া আছে।।
যবে ভোলা কুত্ত গেল পদের নিকটে।
মহাপ্রভু তৎক্ষণাৎ শয্যা হ’তে উঠে।।
প্রভু বলে আসি আমি সবে বল গিয়া।
আসিতেছি কিছুক্ষণ থাকুক বসিয়া।।
তাহা শুনি ভোলা কুত্ত আসিয়া বাহিরে।
আসিতেছে ঠাকুর দেখাল লেজ নেড়ে।।
কিছুক্ষণ পরে এল প্রভু দয়াময়।
মনোকথা কহি সবে করিল বিদায়।।
ভোলা কুত্ত পরিচ্ছেদ হ’য়ে গেল সাঙ্গ।
রচিল তারকচন্দ্র কুকুরের রঙ্গ।।
মহাপ্রভুর লালচাঁদের বাটীতে গমন
পয়ার
এইরূপে যাত্রা করিলেন ছয়জন।
মহাপ্রভু বলিলেন অগ্রে যাও একজন।।
তথা যেতে পথে মোর আছে বড় ভয়।
সাপে নাহি ছাড়ে মোরে আসিয়া জড়ায়।।
তাহা শুনি কাঙ্গালী চলিল আগে আগে।
চলিলেন মহাপ্রভু তার পিছু ভাগে।।
বরইহাট গ্রাম গিয়া হইল উদয়।
ভক্তদের বাটী গিয়া উঠিল সবায়।।
ভক্ত কহে মহাপ্রভু নিবেদন করি।
বাল্যভোজ নিতে হ’বে তোমার এ বাড়ী।।
মহাপ্রভু বলে যদি বাড়ী মোর হয়।
কি আছে বাল্য সেবার শ্রীঘ্র ল’য়ে আয়।।
অমনি ভক্ত যায় জাল বাহিবারে।
ঠাকুর বলেন মোরা মাছ খাব না রে।।
তাহা শুনি ভক্ত কহে আছে শুধু ভাত।
কেমনে হইবে প্রভু প্রভু জগন্নাথ।।
ঠাকুর কহেন কেন শুধু ভাত খা’ব।
সুধা হ’তে সুধা আমি ভোজন করিব।।
কি দিব কি দিব ভক্ত কহে অবিরত।
মহাপ্রভু বলে তোর ঘরে আছে ঘৃত।।
তাহা শুনি ভকত হইয়া উল্লাসিত।
নারীকে কহিছে ঘরে আছে নাকি ঘৃত।।
তাহার রমণী কহে ঘৃত আছে ঘরে।
প্রভু হরিচাঁদ কহে শুন ভাল ক’রে।।
দধি আছে আরো আছে সুরভী দোহন।
ঘরে আছে কল্যকার মথিত মাখন।।
ঠাকুরের পদে পড়ি কহে তার নারী।
কি দিয়া হইবে প্রভু ভোজন তোমারি।।
প্রভু কহে ভকতের রমণীর কাছে।
কুষ্মাণ্ডের শাক, আগা ভাতে দে’য়া আছে।।
দেহ মাগো তাহাতে ভোজন হ’বে ভারি।
মধ্যাহ্নে হইবে সেবা লালচাঁদ বাড়ী।।
তাহা শুনি বসিতে করিয়া দিল ঠাই।
সভক্তি শাল্যন্ন ভোজে বসিল গোঁসাই।।
মাখিয়া ঠাকুর দিয়াছেন বদনেতে।
তারক প্রসাদ নিব বলে হাত পেতে।।
শাক ভাত মাখন করিয়া একত্তরে।
এক মুষ্টি দেন প্রভু তারকের করে।।
তারক যখন দিল বদনে তুলিয়া।
দোম এঁটে উঠে তার তালুকায় গিয়া।।
উঠিল বিষম কাশ ভাত উঘাড়িয়া।
ঠাকুরের পাতে পড়ে ভাত শাক গিয়া।।
কতক মাটিতে কত মহাপ্রভু পাতে।
কতক পড়িল মহাপ্রভুর বক্ষেতে।।
বক্ষে যাহা পড়েছিল বাম হাত দিয়া।
ধরিয়া দিলেন প্রভু বদনে তুলিয়া।।
লালচাঁদ এসেছিল ঠাকুরকে নিতে।
আগুলিল এসে সেই ভক্তের বাটীতে।।
তিনিও সেবায় ব’সে ছিলেন সেখানে।
কথা নাহি কয় তবু বলিল তখনে।।
তিনি কন প্রসাদ পাইতে ইচ্ছা আছে।
যেমন নিয়াছ প্রভু ভাল দেওয়া দিছে।।
অমনি তারক কেঁদে পড়িল ধরায়।
প্রভু কন ওঠ তোর নাহি কোন ভয়।।
তারক ভোজন করে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
যাত্রা করিলেন সেই বাড়ী সেবা নিয়া।।
এইরূপে প্রভু সঙ্গে ভক্তের বিহার।
গেল দিন কহে দীন রায় সরকার।।
মহাপ্রভুর লালচাঁদের ভবনে উপস্থিত
পয়ার
তথা হ’তে ভোজন করিয়া ত্বরান্বিত।
লালচাঁদ ভবনেতে প্রভু উপনীত।।
পশ্চিম দুয়ারী ঘর পূবের পোতায়।
বসিলেন প্রভু সেই ঘরের পিঁড়ায়।।
ভক্তগণ কেহ কেহ বসেছে পিঁড়ায়।
কেহ কেহ বসিলেন তাহার নীচায়।।
ইতিপূর্বে এই লীলা প্রথম সময়।
পাগল বলিয়া খ্যাতি যা’দের ধরায়।।
পূর্ব পূর্ব মহাজন তা’দের বারতা।
স্বয়ং প্রভু কহিছেন সেই সব কথা।।
মহাপ্রভু কহে কথা শুনিতে মধুর।
মধুর হ’তে মধুর অতি সুমধুর।।
এইরূপে ইষ্ট গোষ্ঠ কৃষ্ণ কথালাপ।
আর যত এইদানি পাগল প্রস্তাব।।
প্রভু হরিচাঁদ কহে লালচাঁদ ঠাই।
তোর বাড়ী বেত আছে শুনিয়াছি তাই।।
লালচাঁদ কহে প্রভু ভাল বেত আছে।
লতিয়া উঠিছে বেত বড় বড় গাছে।।
অই সব বড় আম গাছ দেখা যায়।
বেত বেয়ে উঠিয়াছে গাছের আগায়।।
বসিয়া দু’জনে হইতেছে দেখাদেখি।
থলি থলি বেত ফল রহিয়াছে পাকি।।
এই বেত হ’তে দু’টি বেত দেহ মোরে।
আর এক ইচ্ছা বেত ফল খাইবারে।।
লালচাঁদ বলে বেত পাকিয়াছে ভারি।
টান দিলে বেত ফল যাইবেক পড়ি।।
ফলধরা বেত বড় ভাল নাহি হয়।
অফলা পুরান বেত দিব মহাশয়।।
ঠাকুর বলেন আগে বেত ফল আন।
তাহা শুনি মৃত্যুঞ্জয় করিল প্রয়াণ।।
ঠাকুর কহেন অই বেত বড় ভাল।
বেশী নহে মাত্র দু’টি বেত গিয়া তুল।।
দু’টি বেত তুলিয়া আনহ মম ঠাই।
বেত তোলা শেষ কথা আগে ফল চাই।।
মৃত্যুঞ্জয় দু’টি বেত কাটিল কেবল।
একটি নিস্ফল তার একটি সফল।।
ফল ধরা গাছ কাটি বলে মৃত্যুঞ্জয়।
তব ফল লাগিবেক প্রভুর সেবায়।।
সুপক্ক হ’য়েছে ফল পড়িও না তবু।
তোমাকে করিবে সেবা স্বয়ং মহাপ্রভু।।
মৃত্যুঞ্জয় কাঙ্গালী তারক তিনজন।
বেত টানি বাহির করিল ততক্ষণ।।
বেত ফল তুলি, ধরি লইল বাটীতে।
ঝাড়া দিল থলি ধরি পাত্র উপরেতে।।
এক ঝাড়া দিলে সব ফল পড়ি যায়।
অর্ধ অর্ধ খোসা মাত্র রহিল বোটায়।।
অবশিষ্ট অর্ধ খোসা বাছিয়া ফেলিয়া।
ঠাকুর সম্মুখে দিল কাসন্দ মাখিয়া।।
একমুষ্টি ধরি প্রভু দিলেন বদনে।
বলে মৃত্যুঞ্জয় ভাল খাওয়ালি এখনে।।
কোথা লাগে আম আর কোথা লাগে দুধ।
বেত ফল মিঠা যেন বিদুরের খুদ।।
আম ফল খাইতেছি দুই তিন দিন।
হঠাতে এ বেত ফল খাই বৈবাধীন।। (দৈবাধীন)
বিদুরের বাড়ী কৃষ্ণ খান একদিন।
সেই একদিন আর এই একদিন।।
প্রভু বলে দু’টি বেত কাটিলে যতনে।
একটা আনিলে ওটা গাছে রল কেনে।।
সেই বেত বাহির করিল তিনজনে।
মৃত্যুঞ্জয় কহিলেন কাঙ্গালীর স্থানে।।
ভাল ভাল বেত কত আছে এই গাছে।
দুটি বেত লই কেন কত বেত আছে।।
প্রভু আজ্ঞা দু’টি বেত আর এক ল’ব।
তাতে কি প্রভুর কাছে অপরাধী হ’ব।।
লাগিবে প্রভুর কার্যে মন্দ হবে কিসে।
তাই ভেবে আর এক বেত কাটে শেষে।।
বেত কাটি তিন জনে ধরি টান পাড়ে।
থাকমনে বেত পাড়া পাতা নাহি লড়ে।।
যারে দেখে তারে ডাকে হাট উঠাইয়া।
এক এক জন করি বেত টানে গিয়া।।
এক এক জন করি ধরিতে ধরিতে।
চৌদ্দ জনে বেত টানে না পারে নামাতে।।
নাহি ছিঁড়ে নাহি পড়ে না লড়ে না সরে।
আমের গাছের ডাল কড়মড় করে।।
রামচাঁদ চৌধুরীর বুদ্ধি বিচক্ষণ।
বলে বৃথা পরিশ্রম কর কি কারণ।।
চৌদ্দ জনে বেত টানি কিছুই না হয়।
এ হেন আশ্চর্য কেবা দেখেছে কোথায়।।
দুই বেত তুলিবারে প্রভু দেন বলি।
সে আজ্ঞা লঙ্ঘন ক’রে কেন বেত তুলি।।
চৌদ্দ জনে টানি বেত নাহিক বিরাম।
নিশ্চয় জানিও এই ঠাকুরের কাম।।
কেন মিছা টানাটানি পরিশ্রম কর।
চল গিয়া প্রভুকে জানাই সমাচার।।
কে যাবে কে যাবে সবে ভাবে মনে মনে।
সবে কহে তারকে পাঠাও প্রভু স্থানে।।
তারক দাঁড়ায় গিয়া প্রভুর সম্মুখে।
মৃত্যুঞ্জয় কিছুদূরে দাঁড়াইয়া থাকে।।
প্রভু কন একা কেন আসিলে তারক।
এক বেত ল’য়ে বুঝি হাসাইলে লোক।।
দু’টি বেত নিব আর নাহি আবশ্যক।
তিন বেত কাটিয়াছি কহিল তারক।।
ঠাকুর কহেন কেন এ কার্য করিলে।
সামান্য একটি কথা মানিতে নারিলে।।
যেমন লোভের বশ করিয়াছ তাই।
চৌদ্দ জনে হার কেন এক বেত ঠাই।।
ছোট এক বাক্য তাহা না পার মানিতে।
ধন্যবাদ দেই আমি সে বিন্ধ্য পর্বতে।।
এখন উঠিতে পারে রাখে কোন জনে।
উঠিতে না পারে মাত্র এক বাক্য মেনে।।
বাক্য না মানিতে পার কাপুরুষ হও।
সিংহের শাবক হ’য়ে ছাগ রীতি লও।।
তাহা শুনি তারক জুড়িল দুই হাত।
অপরাধ ক্ষমা কর অনাথের নাথ।।
কালীনগরের কর্তা বেত কাটিয়াছে।
অপরাধ করিয়াছি স্বীকার ক’রেছে।।
গুরুকার্য করি মোরা মনের হরিষে।
প্রভু কার্যে বেত নিব দোষ হবে কিসে।।
লঙ্কাদগ্ধে বন ভাঙ্গে বস্ত্র হরে হনু।
রাম কার্য রাম করে সমর্পিত তনু।।
এত বেত লালচাঁদ কি কার্যে লাগাবে।
আমরা লইলে বেত গুরুকার্য হ’বে।।
ইহা বলি এই বেত কেটেছেন তিনি।
ঠাকুর বলেন যাও সব আমি জানি।।
ধর গিয়া সেই বেত সেই তিন জনে।
চৌদ্দ জনে টান বেত কিসের কারণে।।
বেত ধরি টান দিল সেই তিন জন।
অমনি বাহির বেত হইল তখন।।
তিন জনে ছাঁটিয়া করিল পরিষ্কার।
তিন বেত প্রায় দুই বোঝা দু’জনার।।
এদিকে সকলে করে মাধ্যাহ্নিক ক্রিয়া।
স্নানাদি ভোজন করে হরিবোল দিয়া।।
প্রভু হরিচাঁদ স্নান করে প্রথমেতে।
অমৃত খাইনু হরি বলে আনন্দেতে।।
পরে অন্ন ভোজনে বসেন হর্ষ মনে।
ঘৃতপক্ক ডাল বড়া শাকাদি ব্যঞ্জনে।।
অমৃত অম্বল দধি দুগ্ধ আম্রসহ।
খাইলেন ভক্তসব বড়ই উৎসাহ।।
পায়স পিষ্টক আদি সেবা খাজা গজা।
ক্ষীর চুষি, ক্ষীরের লড্ডুক, সর ভাজা।।
ঠাকুরের বামদিকে আমপোরা ঝাকা।
প্রভু কন এত আম রাখ কেন একা।।
লালচাঁদ বলে এই আমগুলি চুকা।
মূলে টক দেখিতে সুন্দর যায় দেখা।।
প্রভু কহে মিঠা আম আর নহে চাই।
এ আম খেয়েছি আন ওই আম খাই।।
ভাল ভাল আম খেয়ে কি করিনু কাজ।
ভোজনের শেষ চুকা তাই খাব আজ।।
চুকা আম খাই নাই ওই আম খাব।
অই আম খেয়ে মন মালিন্য ঘুচা’ব।।
লালচাঁদ দেন আম্র ভকতি প্রচুর।
প্রভু ক’ন কই চুকা অতিব মধুর।।
মধুর হ’তে মধুর সুমধুর আম।
শ্রীমুখের মধুবাক্য তাই পরিণাম।।
যে গাছের চুকা আম্র খাইল ঠাকুর।
সে গাছের আম হ’ল সে হ’তে মধুর।।
ভক্তবৃন্দ সেবা কার্যে ছিল যতজনে।
তৃপ্ত হ’ল চুকা আম্রে মধু আস্বাদনে।।
সে কার্য করি হরি যাত্রা করিলেন।
লালচাঁদ বেত ল’য়ে সঙ্গে চলিলেন।।
অগ্রে অগ্রে ভোলা নামে কুক্কুর ধাইল।
ওঢ়াকাঁদি গোলোকের ঠাই উত্তরিল।।
পথ হ’তে আগুলিল গোস্বামী গোলোক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।।
শ্রীমত্তারকের বিবাহ
পয়ার।
তারকের বিবাহ করিতে ইচ্ছা নাই।
বিবাহ করিতে হবে কহেন গোঁসাই।।
অনেকে অনেক কহে বিয়া করিবারে।
আজীবন তারকের প্রতিজ্ঞা অন্তরে।।
বিবাহ করিতে প্রভু বল কি কারণ।
না করিব বিবাহ করেছি এই পণ।।
প্রভু কন যদি এই ভবে আসিলাম।
ভাবি মনে এক খেলা খেলিয়া গেলাম।।
চতুর্বিধ ধর্ম মধ্যে প্রধান গার্হস্থ্য।
গৃহস্থ ধার্মিক কর্ম অতি সুপ্রশস্ত।।
লোকে কহে ভ্রমি বারো ঘরে বসি তের।
এবার গৃহস্থ ধর্ম যোগে যত পার।।
তারক বলেন হরি বিবাহ করিব।
গৃহিণী গ্রহণ কৈলে পাশ-বদ্ধ হ’ব।।
অর্থ লোভে নারী লোভে কামাসক্ত হ’য়ে।
তব নাম প্রেম সব যাইব ভুলিয়ে।।
প্রভু কন মম বাক্যে বিবাহ করিলে।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হ’বে মম বাক্য বলে।।
আমারে আদর করি করে পাপ কর্ম।
আমার ইচ্ছায় সেই হয় মহাধর্ম।।
মোরে অনাদর করি করে মহাধর্ম।
আমার ইচ্ছায় সেই হয় পাপকর্ম।।
এ বড় নিগূঢ় তত্ত্ব প্রভু মুখ বাক্য।
তদ্রুপ আমার বাক্য হৃদে কর ঐক্য।।
যদি অর্থ নারী লোভে মোরে ভুলে যাবি।
তবু মম দয়া বলে আমাকে পাইবি।।
তারক কহিছে মোর অর্থ কিছু নাই।
কেনা বেচা করি দিন আনি দিন খাই।।
প্রভু হরিচাঁদ কহে তাতে কেন ভাব।
যত অর্থ লাগে তাহা আমি তোরে দিব।।
বিবাহ করিতে প্রভু কন বার বার।
তারক বলেন যেই ইচ্ছা আপনার।।
আসিলেন মৃত্যুঞ্জয় সূর্যনারায়ণ।
প্রভু দু’জনারে কহে সব বিবরণ।।
তোমরা দু’জনে যাও সম্বন্ধ করিতে।
একেবারে চলে যাও ভাঙ্গুড়া গ্রামেতে।।
অগ্রে যাও গঙ্গারামপুর গ্রাম মাঝ।
যে মেয়ে শুনিবে কথা ক’র সেই কাজ।।
তারক চলিল দু’জনারে সঙ্গে ল’য়ে।
গঙ্গারামপুর গ্রামে উত্তরিল গিয়ে।।
সনাতন পাটনি সে দেখিতে পাইল।
সমাদর করি তার বাটী ল’য়ে গেল।।
বলে দয়া করি হেথা করুণ ভোজন।
সনাতন করিল পাকের আয়োজন।।
সেই গ্রামে শ্রীগোবিন্দ নামে ভট্টাচার্য।
তার বাটী হইতেছে তুলটাদি কার্য।।
একমাস পুঁথি হ’ল অদ্য উদযাপন।
এই বাড়ী পুঁথি হবে কহে সনাতন।।
সেই বাড়ী চলিলেন পুঁথি শুনিবারে।
চারি জন এক ঠাই বসে একত্তরে।।
পুঁথি কহে কথক বসিয়া ব্যাসাসনে।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ বসে সেই খানে।।
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস স্বচক্ষে দেখে তাই।
সেই পাঠ সাঙ্গ হ’লে আর দেখা নাই।।
মধ্যাহ্ন ভোজন করি ভাঙ্গুড়া আইল।
কৃষ্ণমোহনের বাড়ী উপনীত হ’ল।।
বলিলেন মৃত্যুঞ্জয় কৃষ্ণমোহনেরে।
এক মেয়ে চাহি মোরা এ ছেলের তরে।।
কহেন কৃষ্ণমোহন আছে এক মেয়ে।
ছেলের লবে না মন সে মেয়ে দেখিয়ে।।
কৃষ্ণ বর্ণা মেয়ে তত শ্রীমতিও নয়।
সে মেয়ে লন যদি তবে দেওয়া যায়।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে মোরা শ্রীমতি না চাই।
কথা যদি শুনে তবে মেয়ে ল’য়ে যাই।।
আসিবার কালে ব’লে দিলেন ঠাকুর।
মেয়ে দেখিবারে যাও গঙ্গারামপুর।।
মেয়ে দেখি তথা হ’তে ভাঙ্গুড়া যাইও।
যেই মেয়ে কথা শুনে সে মেয়ে আনিও।।
কৃষ্ণমোহন বলে আমি সাথে সাথে যা’ব।
কি লইয়া যা’বে তথা সম্বন্ধের ভাব।।
বাতাসা লইতে হ’বে সে বাড়ী যাইতে।
তারক বলিল কপর্দক নাই সাথে।।
সোয়াসের বাতাসা লাগিবে পাঁচ আনা।
অবাক হইয়া বসি র’ল তিনজনা।।
হেনকালে একজন জিজ্ঞাসে তথায়।
তারক কাহার নাম আছে কি হেথায়।।
করিতে কবির দল বায়না কারণ।
বহু পথ পরিশ্রমে করেছি ভ্রমণ।।
গোবরা কাছারী হ’তে আমি আসিয়াছি।
জয়পুর গিয়া এই সংবাদ শুনিয়াছি।।
বিবাহের সম্বন্ধ করিতে তিনজন।
এইগ্রামে তারা নাকি ক’রেছে গমন।।
ভাঙ্গুড়া গ্রামের কথা শুনিলাম তথা।
এই যায় এই যায় শুনিলাম কথা।।
অনেকের ঠাই শুনি জিজ্ঞাসা করিলে।
এই যায় এই গেল অনেকেই বলে।।
আহারাদি করিলাম মনোখালী গ্রাম।
এই মাত্র তথা হ’তে আমি আসিলাম।।
যাওয়া মাত্র বায়নার টাকা ল’য়ে হাতে।
সেই লোক বিদায় করিল তরান্বিতে।।
সেই টাকা ভাঙ্গাইয়া বাতাসা কিনিয়া।
চলিলেন চারজন একত্র হইয়া।।
শ্যামচাঁদ কাঁড়ারের বাড়ী উতরিল।
মেয়েটি দেখিব বলে আলোচনা হ’ল।।
মেয়েটি লইয়া শ্যাম আসিল বাহিরে।
মেয়েকে বলিল দণ্ডবৎ করিবারে।।
মৃত্যুঞ্জয় চরণে করিল প্রণিপাত।
পদধূলি নিল শ্রীচরণে দিয়া হাত।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে মা মাথার বস্ত্র ফেল।
শুনিয়া মাথার বস্ত্র অমনি ফেলিল।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে মাতা মেল দু’নয়ন।
অমনি নয়ন করিলেন উন্মিলন।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে মাতা চুল ছেড়ে দেও।
চুলের বন্ধন ছাড়ি ঘরে চলে যাও।।
অমনি দাঁড়ায়ে চুল বন্ধন ছাড়িল।
দণ্ডবৎ করি পরে গৃহে চলে গেল।।
সীতা যেন গবাক্ষে দেখিল রামরূপ।
তারকে নিরখি সতী হইল তদ্রুপ।।
অমনি সম্বন্ধ ঠিক করিল ত্বরায়।
সেই দিন রহিলেন শ্যামের আলয়।।
জিজ্ঞাসিল মৃত্যুঞ্জয় কি লইবা পণ।
শ্যাম বলে লইব না এই মোর পণ।।
গয়াধামে যাব আমি ভেবেছিনু মনে।
এ ছেলেকে কন্যা যদি দিতে পারি দানে।।
মেয়ে দিব এই মম আকাঙ্খা কেবল।
ঘরে বসে পাই তবে গয়া গঙ্গা ফল।।
যে হইতে মাতা জন্মে আমার ভবনে।
সেই হ’তে এই আশা সদা মোর মনে।।
ঈশ্বর মনের আশা করুণ পূরণ।
বিনা পণে কন্যাধনে করিব অর্পণ।।
সম্বন্ধ নির্ণয় করি প্রভুকে বলিল।
প্রভু বলে যার তার যুগে যুগে র’ল।।
প্রভু বলে শ্যাম যদি নাহি লয় পণ।
তথাপি বত্রিশ টাকা করিও প্রেরণ।।
তারক ভেবেছে মনে উপায় কি হবে।
গৃহে নাস্তি কপর্দক কিবা পাঠাইবে।।
মহাপ্রভু বলে ব’সে কি ভাবিস একা।
বৈশাখ মাসেতে বিয়া আমি দিব টাকা।।
মাঘ মাসে হ’ল সেই কার্য নিরূপণ।
চারি মাসে হ’ল সে টাকার সংস্থাপন।।
তিন তারিখেতে তিন ভাগে টাকা দিল।
পণ নয় সাহায্য বলিয়া পাঠাইল।।
বৈশাখ মাসের শেষ আটাশে তারিখ।
বিবাহের সেই দিন হ’য়ে গেল ঠিক।।
বিবাহের দিন একদিন অগ্রে তার।
বায়না কুন্দসী গ্রামে কবি গাওয়ার।।
সেই দিন গ্রামী লোকে ফলাহার দিতে।
এক মন দধির বায়না ছিল তাতে।।
এদিকেতে স্বজাতীর একত্র ভোজন।
বাজারের নেয়ে মাঝি খা’বে সর্বজন।।
বসিলেন সর্বজন ফলাহার জন্য।
পঞ্চাশ পঞ্চান্ন জন লোক হ’ল গণ্য।।
জলপানে পরিপূর্ণ আহার হইল।
সিকি দধি মাত্র তার খরচে লাগিল।।
সেই দই চিনি খই সঙ্গেতে করিয়া।
বরযাত্রা করিলেন নৌকায় উঠিয়া।।
পথে গিয়া সেই দধি সবে মিলে খায়।
চিনি চিঁড়ে দই খই যেন তেন রয়।।
ভাঙ্গুড়া গ্রামেতে গিয়া বাসাবাড়ী করি।
সেই সব দ্রব্য খাওয়াইল সেই বাড়ী।।
এ জাতির বিবাহ পদ্ধতি ব্যবহার।
কন্যা কর্তা বাড়ী কেহ না পায় আহার।।
কন্যা গৃহীতার তথা খেতে দিতে হয়।
যে না পারে না খাওয়ায়, পারিলে খাওয়ায়।।
(যে পারে সে খাওয়ায়, না পারিলে নয়।।)
সেই গ্রামে ভোজ দিতে কৈল আয়োজন।
ভোজ দিতে তণ্ডুল লাগিবেক দুই মণ।।
আর এক মণ লাগে সিধা পত্র দিতে।
চারি মণ দধি লাগে ভোজ ভোজনেতে।।
নিয়াছিল তারক তণ্ডুল চারি মণ।
এক মণ দধি তার আছে অর্ধ মণ।।
তিন মণ চাউল পাকের জন্য দিল।
দুই মণ পাক হ’ল এক মণ র’ল।।
অন্ন দেখি গ্রামবাসী সব লোকে কয়।
এই অন্নে হইবেক হেন মনে হয়।।
দুগ্ধ ক্রয় ক’রেছে পায়স রাঁধিবারে।
পায়স হইল পাক পাকশালা ঘরে।।
গ্রামবাসী এসে লোক বসাইয়া দিল।
দুই প্রাঙ্গণেতে লোক ভোজনে বসিল।।
ডাইল লাবড়া ভাজা ব্যঞ্জন অম্বল।
আহারান্তে সবে বলে উত্তম সকল।।
হয় নাই কভু কোথা এমন ভোজন।
পায়সান্ন দিতে জন্যে করে আয়োজন।।
হেনকালে একজন গোয়ালা আসিল।
দুই মণ দধি কাঁধে ল’য়ে দাঁড়াইল।।
সে বলে আমার এই দধি টুকু লও।
দয়া করি এই দধি খরচে লাগাও।।
এ দধির বায়না ব্রাহ্মণ বাড়ী ছিল।
উদ্বৃত্ত হয়েছে দধি ফেরত করিল।।
অমনি তারক বলে দেও দেও দেও।
সত্বর স্বজাতিগণে এ দধি খাওয়াও।।
সঙ্গে দধি বাটী হ’তে আনা অর্ধ মণ।
সে গ্রামে খরচ গেল দধি দুই মণ।।
দধি ভোজ শেষ হ’লে পায়স ভোজন।
সবে বলে হেন ভাল না খাই কখন।।
বিবাহের পরে জয়পুর আসা হ’ল।
সঙ্গেতে ফেরত দধি অর্ধ মণ ছিল।।
চাউল দু’মণ ফিরে আর জলপান।
তার অর্ধ দধি বাল্য ভোজনে লাগান।।
পাক পরশয়ের জন্য দধি নাহি হ’বে।
দুগ্ধ কিনিলেন ভোজে পরমান্ন দিবে।।
আর আর দ্রব্য সহ হ’য়েছে রন্ধন।
সব লোক বসিলেন করিতে ভোজন।।
খাইলে ভাজা ব্যঞ্জনাদি মৎস্য ঝোল।
ভোজনের শেষে সবে খাইল অম্বল।।
হেনকালে এক জন গোয়ালা আসিল।
এক মণ দধি ল’য়ে উপনীত হ’ল।।
গোপ বলে কুণ্ডু বাড়ী ছিল দধি বায়না।
সব দধি নিল তারা এক মণ নেয় না।।
এই দধি খেতে দিব আমার গরজ।
যাহা ইচ্ছা মূল্য দিও হউক খরচ।।
তারক বলিল এই ঠাকুরের কাম।
আন দধি দিব আমি দুই টাকা দাম।।
পূর্বে এক মণ আর এই এক মণ।
চারি টাকা মূল্য এনে দিলেন তখন।।
ছাতরায় বাসা ছিল রায়চাঁদ ঘোষ।
চারি টাকা মূল্য পেয়ে হইল সন্তোষ।।
ভাঙ্গুড়ার গোয়ালের দুই মণ দই।
চারি টাকা পাইয়া সন্তুষ্ট হ’ল সেই।।
শ্রীহরি-চরিত্র সুধা ভকত আখ্যান।
রচিল তারকচন্দ্র হরি-রস-গান।।
সূর্যনারায়ণের সর্পাঘাত
পয়ার
এবে শুন স্বামী হীরামন গুণ কথা।
লেখা আছে ডুমুরিয়া পূর্বের বারতা।।
স্বামী হীরামন যবে ডুমুরিয়া গেল।
সূর্য নারায়ণ যে তামাক সেজে দিল।।
কলিকা ঢালিয়া পরে মৃত্তিকা উপরে।
বলে এই তামাক রাখ যতন করে।।
তামাক যতন করে গৃহেতে রাখিস।
সাপে কামড়ালে, খেলে সেরে যাবে বিষ।।
সেই যে তামাকটুকু যতন করিয়া।
ঝাঁপিয়া ভিতরে রাখে পুটলী বাঁধিয়া।।
সাতাশে তারিখ চৈত্র মাস বুধবার।
বেদগ্রামে যাইবেন গান গাইবার।।
বাটী গিয়া বলে মোরে শীঘ্র দেও খেতে।
গান গাইবারে হ’বে বেদগ্রামে যেতে।।
ইহা বলি ব্যস্ত হ’য়ে হইল উতলা।
জাগ দেওয়া তিল ছিল ভেঙ্গে দিল পালা।।
পালা ভাঙ্গি উঠানেতে দিল ছড়াইয়া।
তার মধ্যে সর্প ছিল দংশিল আসিয়া।।
দেখিল গোক্ষুর সাপ গেল দৌড়াইয়ে।
বিষের জ্বালায় চক্ষু গেল লাল হ’য়ে।।
তাহার অগ্রজ ভ্রাতা সে উমাচরণ।
ব্যস্ত হ’য়ে বলে ওঝা আন একজন।।
নোয়া ভাই তাহার যে রামচাঁদ ছিল।
ইতিপূর্বে সর্পাঘাতে সে জন মরিল।।
ইনিও মরিল বুঝি সাপের দংশনে।
শীঘ্র আন ওঝা নহে বাঁচা নাহি প্রাণে।।
গোলোক ওঝা আনিতে ধাইয়া চলিল।
দেখে সূর্যনারায়ণ নিষেধ করিল।।
যে তামাক দিয়াছিল পাগল গোঁসাই।
খাইলে সারিবে বিষ আন তাই খাই।।
ঝাঁপি হ’তে তামাক বাহির করে দিল।
তামাক গালেতে দিয়া জল খাওয়াল।।
নেশা হ’য়ে সেইভাবে দণ্ড চারি ছিল।
অমনি সাপের বিষ নির্বিষ হইল।।
স্নান করি আহার করিল ততক্ষণ।
বেদগ্রামে কবিগানে করিল গমন।।
তামাক দিলেন মুখে নির্বিষ বলিয়ে।
গোক্ষুরের খর বিষ গেল নিশ হ’য়ে।।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ভক্তের আখ্যান।
রচিল তারক ভক্ত চরিত্র সুগান।।
প্রেম প্লাবন ও বিনা রতিতে কর্ণের জন্ম
পয়ার
বহিল প্রেমের বন্যা ওঢ়াকাঁদি হ’তে।
দ্বিজ মুচি শৌচাশুচি ডুবে গেল তাতে।।
আইল প্রেমের বন্যা বীজ হ’ল নাশ।
তাহা দেখি পঞ্চ জনের বাড়িল উল্লাস।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চারি জাতি।
রেচক পূরক কুম্ভকাদি নেতি ধৌতি।।
শাক্ত শৈব গাণপত্য বৈষ্ণব তাপন।
সবে করে সম পুত প্রণয় প্লাবন।।
কল্ কল্ শব্দ ওঢ়াকাঁদি গোলাঘাটে।
হতাশ নিঃশ্বাসে সদা সে তুফান উঠে।।
ক্ষত্র-বংশ জাত রাম ভরত ত্যজি দেশ।
পাদপদ্ম ভৃঙ্গ বিশ্বনাথ দরবেশ।।
দেশে কি বিদেশ বেগে চলিল তুফান।
যবন পাবনকারী হরিপ্রেম বাণ।।
রাউৎখামার আর গ্রাম মল্লকাঁদি।
হরি দরশনে সবে যায় ওঢ়াকাঁদি।।
নারিকেলবাড়ী মাতে সহ সাহাপুর।
সুরগ্রাম বারখাদিয়া গান্দিয়াসুর।।
হরমোহন বাড়ই গোপাল বিশ্বাস।
ঠাকুরে ঈশ্বর বলি করিল প্রকাশ।।
গোপাল নেপাল তারা দু’টি সহোদর।
গোলোক গোঁসাই জয় গায় নিরন্তর।।
ঘোষালকাঁদি নিবাসী মহিমাচরণ।
সকলে মাতিয়া করে নাম সংকীর্তন।।
ঠাকুর দেখিয়া তারা প্রেমেতে মাতিয়া।
নয়ন মুদিয়া রাখে হৃদয় ধরিয়া।।
মল্লকাঁদি গ্রামবাসী মাতিল সকল।
সকালে বিকালে বলে জয় হরিবোল।।
সেই সব মহাভাব অগ্রে লেখা আছে।
হীরামন যেইরূপ মাতিয়া উঠিছে।।
সেই সময়েতে যত মহাভাব হয়।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনেতে আগে লেখা যায়।।
শ্রীনিতাই চৈতন্য অদ্বৈত তিন ভাই।
তাহাদের প্রেমভক্তি তুলনাই নাই।।
নিত্যানন্দ পুত্র যিনি মৃত্যুঞ্জয় নাম।
চৈতন্যের দুটি পুত্র অতি গুণধাম।।
রামকৃষ্ণ জ্যেষ্ঠ ছোট রামনারায়ণ।
হরিচাঁদ গতপ্রাণ তারা দুই জন।।
এক মন এক ভাব নাহি ব্যতিক্রম।
ঠাকুরের ভক্ত বৃন্দাবনের নিয়ম।।
রামদেব মহাদেব অদ্বৈতের পুত্র।
ঠাকুরের ভক্ত হয় পরম পবিত্র।।
এই বাড়ী সবে মিলে হ’ল হরিভক্ত।
মৃত্যুঞ্জয় সঙ্গে মত্ত সকলে থাকিত।।
রামকৃষ্ণ নির্জনেতে যখন থাকিত।
আরোপে ঠাকুররূপ নিরীক্ষে দেখিত।।
ওঢ়াকাঁদি যে ভাবেতে ঠাকুর থাকিত।
বাটীতে থাকিয়া রামকৃষ্ণ তা জানিত।।
রামনারায়ণ করে ঠাকুরের ধ্যান।
একদিনে ঠাকুর বলেন তার স্থান।।
শোন বাছা তোরে নিতে পারিবে না যম।
সপ্তবর্ষ অনিদ্রিত কর এ নিয়ম।।
তাহা শুনি নিদ্রা ত্যজে মনে হ’য়ে হর্ষ।
মহাযোগী নিদ্রা নাহি যান সপ্তবর্ষ।।
হেন হেন মহাজন এই বংশে রয়।
এই বংশে রামতনু সাধু অতিশয়।।
জনমিয়া নারীসঙ্গ না করেন তিনি।
বিবাহ করেছে মাত্র স্পর্শে না রমণী।।
ঠাকুরানী মনে করে পুত্রের কামনা।
সাধু বলে স্ত্রী ক্রিয়া করিতে পারিব না।।
ঠাকুরানী ওঢ়াকাঁদি যাইয়া বলিল।
একটি পুত্রের মম কামনা রহিল।।
ঠাকুর বলেন আমি পারি না বলিতে।
যে লোকের মন নাই স্ত্রীসঙ্গ করিতে।।
স্ত্রীসঙ্গ করিতে যার নাহি লয় মন।
তাহাকে কেমনে বলি হেন কুবচন।।
তবে যদি সাধ কর পুত্র কামনায়।
থাকগে নির্জনে রামতনুর সেবায়।।
নিদ্রা না যাইয়া যদি থাকিবারে পার।
এক পুত্র হ’বে তব দিলাম এ বর।।
পঞ্চ বর্ষ নিশিদিনে অনিদ্রিতা র’য়ে।
তনুর চরণ পার্শ্বে রাত্রিতে বসিয়ে।।
পতি প্রতি রতি মতি প্রীতি অতিশয়।
পুত্রেষ্টি যজ্ঞের ফল তাতে পাওয়া যায়।।
শুনিয়াছি শতানন্দ অস্তিকের জন্ম।
পুত্র পাবে কর যদি সেইরূপ কর্ম।।
তবে তব পুত্র হবে বিনা সঙ্গমেতে।
বাঞ্ছাপূর্ণ হবে তব সেই পুত্র হ’তে।।
একদিন রামতনু গেল ওঢ়াকাঁদি।
ঠাকুর বলেন রামতনু শুন বিধি।।
তব নারী করে এক পুত্র আকিঞ্চন।
আমি কহিয়াছি এক নিগুঢ় কারণ।।
পঞ্চ বৎসরের মধ্যে নিদ্রা নাহি যাবে।
বিনা সঙ্গমেতে এক সন্তান জন্মিবে।।
পঞ্চবর্ষ পূর্ণ হ’লে কনিষ্ঠ অঙ্গুলি।
নাভি পদ্মে স্পর্শ কর কর্ণ কর্ণ বলি।।
তা হ’লে ঠাকুরানীর বাঞ্ছা হবে পূর্ণ।
সেই পুত্র হ’লে তার নাম রেখ কর্ণ।।
রামতনু শস্যাদির শীল রাখিতেন।
মাঠে গিয়া ফুঁক দিয়া শিঙ্গা বাজাতেন।।
একা গিয়া ধান কিংবা তিলের ডাঙ্গায়।
শীল যেন নাহি পড়ে বলিত তথায়।।
আমার মহান মধ্যে ধান আর তিল।
এর মধ্যে ইন্দ্রবেদ না ফেলিও শীল।।
এতবলি শিঙ্গা ধরি ধ্বনি দিত তায়।
পড়িত না শীল হরিচাঁদের আজ্ঞায়।।
হেন সাধু ঠাকুরের আজ্ঞামাত্র রাখে।
পাদ পার্শ্বে নারী বসা সাধু শুয়ে থাকে।।
পঞ্চবর্ষ পরিপূর্ণ হইল যখনে।
নাভিতে অমৃতাঙ্গুলি স্পর্শিল তখনে।।
সেই হ’তে ভাগ্যবতী পুত্রবতী হ’ল।
বিনা রমণেতে এক পুত্র জনমিল।।
সেইত পুত্রের নাম রাখে কর্ণধর।
রচিল তারকচন্দ্র কবি সরকার।।
দেবী তীর্থমণির উপাখ্যান
পয়ার
রামকৃষ্ণ চারি পুত্র জ্যেষ্ঠ মহানন্দ।
শ্রীকুঞ্জবিহারী রাসবিহারী আনন্দ।।
রামকৃষ্ণ অনুজ শ্রীরামনারায়ণ।
তার হ’ল পঞ্চপুত্র হরি পরায়ণ।।
নামে মত্ত বালা বংশ কৃষ্ণপুর গ্রামে।
সাধু কোটিশ্বর আর ধনঞ্জয় নামে।।
মতুয়া হইল সবে বলে হরি বলা।
স্বজাতি সমাজে বাদ র’ল যত বালা।।
তাহারা বলেন মোরা শঙ্কা করি কায়।
হরিনাম ত্যজিব কি স্বজাতির ভয়।।
হরিবলে কেন হীনবীর্য হ’য়ে রব।
সমাজিতে ত্যজ্য করে হরিবোলা হ’ব।।
মাতিয়াছি মহাপ্রভু হরিচাঁদ নামে।
নমঃশূদ্র তুচ্ছ কথা ডরি না সে যমে।।
বাবা হরিচাঁদের করুণা যদি হয়।
বালাবংশ কুলমান কিছুই না চায়।।
হরি প্রেম বন্যা এসে কূল গেছে ভেসে।
জাতি মোরা হরিবোলা আর জাতি কিসে।।
সাধুর ভগিনী ধনী তীর্থমণি কয়।
তিনি কন হরিবোলা কারে করে ভয়।।
মাতিল পুরুষ নারী ভয় নাই মনে।
অভক্তের ভয় কিসে মানিনে শমনে।।
অন্যে বলে জাতিনাশা আরো দর্প করে।
পাষণ্ডীরা ম’তোদিগে যায় মারিবারে।।
তাহা শুনি তীর্থমণি রাগে হুতাশন।
বলে আমি দলিব সে পাষণ্ডীর গণ।।
একদিন বেকি দাও করেতে করিয়া।
বলে যে আসিবি তারে ফেলিব কাটিয়া।।
ক্রোধিতা হইল দেবী যেন উগ্রচণ্ডা।
বেকি দাও হাতে নিল যেন খর খাণ্ডা।।
তাহা দেখে ভয় পেল যত পাষণ্ডীরা।
ভীত হ’য়ে উত্তর না করিল তাহারা।।
মেয়ের স্বভাব নাই’ হ’য়ে হরিবোলা।
সে কারণে লোকে বলে তীর্থরাম বালা।।
আর শুন তাহার চরিত্র গুণধাম।
হরিপ্রেম রসে মেতে বলে হরিনাম।।
বিবাহিতা হ’য়েছিল বোড়াশী গ্রামেতে।
তার পতি মরিল সে অল্প বয়সেতে।।
রূপবতী অতিশয় যৌবন সময়।
ঠাকুর যাইত তথা সময় সময়।।
ঠাকুরে করিত তীর্থ পিতৃ সম্বোধন।
ঠাকুর জানিত তারে কন্যার মতন।।
ক্ষণে তীর্থ ক্ষণে মা! মা! বলিয়া ডাকিত।
মাঝে মাঝে বোড়াশী যাতায়াত করিত।।
একদিন তীর্থমণি পাকশাল ঘরে।
ঠাকুরকে মনে করি ভাসে অশ্রুনীরে।।
পায়স পিষ্টক রাঁধি পাকশালে বসি।
মনে ভাবে বাবা যদি আসিত বোড়াশী।।
স্বহস্তে তুলিয়া দিতাম শ্রীচন্দ্র বদনে।
এত ভাবি অশ্রুধারা বহিছে নয়নে।।
দিবা অবসান প্রায় এমন সময়।
সকলে খাইল তীর্থ কিছু নাহি খায়।।
বদন বিশ্বাস বলে বধূমার ঠাই।
খাও গিয়া, বধূ বলে ক্ষুধা লাগে নাই।।
মীরাবাঈ রাঁধিতেন খিচুড়ির ভাত।
প্রীত হ’য়ে খেত গিয়ে প্রভু জগন্নাথ।।
সেই মত মহাপ্রভু তীর্থমণি ঘরে।
চলিলেন ভক্তি অন্ন খাইবার তরে।।
তীর্থমণি গৃহে প্রভু গেলেন যখন।
জল আনি তীর্থমণি ধোয়ায় চরণ।।
কেশ মুক্ত করি পাদ পদ্ম মুছাইয়ে।
করিছেন পদ সেবা আসনে বসায়ে।।
পায়স পিষ্টক আদি ব্যঞ্জন শাল্যন্ন।
অগ্রে তুলে রেখেছিল ঠাকুরের জন্য।।
ঠাকুরের সেবা পরে প্রসাদান্ন যাহা।
তীর্থমণি যতনে ভোজন কৈল তাহা।।
তাহা দেখে সবে বলে বদনের কাছে।
দেখগে এখনে বৌর ক্ষুধা লাগিয়াছে।।
কেহ গিয়া জানাইল বদনের ঠাই।
দেখগে বধূর ঘরে নাগর কানাই।।
ইতি উতি বদন করে’ছে অনুমান।
ভাবে বধূ হ’তে বুঝি গেল কুলমান।।
বদন বিশ্বাস বলে ঠাকুরকে রুষি।
দেখ প্রভু আর তুমি এসনা বোড়াশী।।
চিরদিন জানি ম’তোদের ব্যবহার।
মানা করি মোর বাড়ী আসিওনা আর।।
শ্রীহরি গমন কৈল ওঢ়াকাঁদি যেতে।
কেঁদে কেঁদে তীর্থমণি আগুলিল পথে।।
মহাপ্রভু নিজধামে করিলে গমন।
বাবা! বাবা! বলে তীর্থ করিত ক্রন্দন।।
দিবানিশি অই চিন্তা মুদে দ্বি-নয়ন।
কিছুদিন পরে সিদ্ধ আরোপ সাধন।।
আরোপে প্রভুর রূপ যখনে দেখিত।
নয়ন মেলিলে রূপ দেখিবারে পেত।।
মহাপ্রভু থাকিতেন ওঢ়াকাঁদি বসি।
লোকে দেখে প্রভু যেন আছেন বোড়াশী।।
ষোড়শ হাজার একশত অষ্ট নারী।
প্রতি ঘরে এক কৃষ্ণ বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।
যখন করিত তীর্থ দেখিবারে মন।
বাঞ্ছা-কল্পতরু হরি দিত দরশন।।
গৃহকার্য যখন করিত তীর্থমণি।
বাবা বলে ডাকিত যেমন উন্মাদিনী।।
সবে বলে বধূ গেল পাগল হইয়ে।
শিকল লাগায়ে পায় রাখিত বাঁধিয়ে।।
বদন বলিল আমি চিরদিন জানি।
সাধ্বী সতী পুত্র বধূ অব্যভিচারিণী।।
চেহারায় বাহিরায় সতীত্বের জ্যোতি।
তবে কেন বধূ হেন হ’ল ছন্নমতি।।
বাবা! বাবা! বাবা! বলে ডাক ছেড়ে উঠে।
ঝাড়া দিলে লোহার শিকল যেত কেটে।।
বদনের দর্প, দর্পহারী কৈল চুর।
এর মধ্যে তীর্থমণি এল কৃষ্ণপুর।।
ভ্রাতৃ অন্ন ভুক্তা অতি নির্ভয়া হৃদয়া।
মহাভাব অনুরাগে তেজময়ী কায়া।।
তীর্থমণি বালার সুকীর্তি চমৎকার।
কহে কবি রসরাজ রায় সরকার।।
শ্রীমদ্রসিক সরকারের উপাখ্যান
পয়ার
প্রভু জগন্নাথ এল ওঢ়াকাঁদি গ্রাম।
ভকত ভনে সদা ভ্রমণ বিশ্রাম।।
বাল্যাদি পৌগণ্ডলীলা সফলাডাঙ্গায়।
কৈশোরে হইল ভক্ত মিলন তথায়।।
ওঢ়াকাঁদি আমভিটা যখন যুবত্ব।
ভক্তসঙ্গে দিবানিশি হরিনামে মত্ত।।
মত্ত রাউৎখামার আদি মল্লকাঁদি।
হেনকালে প্রভুর বসতি ওঢ়াকাঁদি।।
ওঢ়াকাঁদি যবে হল লীলার প্রচার।
সবে কহে ওঢ়াকাঁদি উড়িয়ানগর।।
ওঢ়াকাঁদি ঘৃতকাঁদি আর মাচকাঁদি।
আড়োকাঁদি তিলছড়া আর আড়ুকাঁদি।।
রামদিয়া ফুকুরা নড়া’ল সাধুহাটি।
নারিকেল বাড়ী পরগণে তেলিহাটি।।
সাধুহাটি মাতিল রসিক সরকার।
অলৌকিক কীর্তি তার অতি চমৎকার।।
কলেজেতে পড়িতেন সেই মহামতি।
বয়স তখন প্রায় হ’বে দ্বাবিংশতি।।
প্রথম মুন্সেফ হইল বিচারপতি।
তিন দিন চাকরি করিল মহামতি।।
মানসে বিমর্ষ কার্য পরিত্যাগ করি।
ছুটি নেয়া ছলে চলে আসিলেন বাড়ী।।
কায়স্থ কুলেতে উপাধ্যায় সরকার।
তাহার পিতার নাম হয় গঙ্গাধর।।
পিতা হ’ন অসন্তোষ চাকুরী ছাড়ায়।
মহাদুঃখী তার খুল্লতাত মহাশয়।।
খুড়া শ্রীকৃষ্ণমোহন বলে বার বার।
চাকুরী করনা বাপ এ কোন বিচার।।
তিনি জানা’লেন সেই রসিকের মায়।
রসিকের মাতা গিয়া ঠাকুরে জানায়।।
রসিকের কি হ’য়েছে নাহি শুনে কথা।
চাকরী না করে রহে হেট করি মাথা।।
যদি কিছু বলি কহে না করিও ত্যক্ত।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ আমি তার ভক্ত।।
চল প্রভু সাধুহাটি সরকার বাড়ী।
তব বাক্যে যদি বাছা করেন চাকুরী।।
মহাপ্রভু উত্তরিল সাধুহাটি গ্রাম।
রসিক প্রভুর পদে করিল প্রণাম।।
ঠাকুর বলেন বাছা বলত’ আমায়।
চাকুরী করনা কেন বলে তব মায়।।
রসিক বলেন পদে নিবেদন করি।
আর না করিব আমি পাপের কাছারী।।
আমা হতে হবে না সূক্ষ্ম সুবিচার।
অপরাধী হ’ব ল’য়ে বিচারের ভার।।
কোন অসতের বাক্যে সতেরে মারিব।
নির্দোষীকে দোষী, দোষী নির্দোষী করিব।।
দারোগার বংশ নাই অত্যাচার জন্য।
বিচারে মুন্সেফী কার্য সেইরূপ গণ্য।।
তাই বুঝে ছুটি লই আর নাহি যাই।
ধন দিয়া কি করিব তোমা যদি পাই।।
পিতা মাতা খুড়া বলে চাকুরী করিতে।
ধন কি নিধন-কালে যাইবে সঙ্গেতে।।
পড়ে র’বে ধন জন কি দালান কোঠা।
চুল গাছ সঙ্গে নিতে পারে কোন বেটা।।
কেবা মাতা কেবা পিতা কিসের চাকুরী।
কিবা রাজ্য কিবা ভার্যা দিন দুই চারি।।
আপনি বলেন যদি চাকুরী করিতে।
পাপ পুণ্য নাহি জানি যাই চাকুরীতে।।
ঠাকুরের সঙ্গে ছিল মহেশ ব্যাপারী।
বলিলেন রসিকেরে দণ্ডবৎ করি।।
রসিক বলিল মোরে প্রণমিলে কেনে।
প্রণামের স্থান আছে দেখনা নয়নে।।
যশোমন্ত সুত হরিচাঁদ জগন্নাথ।
বর্তমানে সে চরণ কর প্রণিপাত।।
মহেশ বলিল হেন স্থান যে দেখায়।
তার পদে দণ্ডবৎ আগে হ’তে হয়।।
ঠাকুর বলেন শুন রসিকের মাতা।
তোমার এ ছেলে না শুনিবে কারু কথা।।
তোমার গর্ভেতে জন্ম এ মহাপুরুষ।
অনুমানে বুঝি হবে ত্রেতার মানুষ।।
রসিক গেলেন জয়পুর রাজধানী।
ভেটিতে গেলেন জয়পুর নরমণি।।
ধর্ম শাস্ত্র আলাপ রাজার সঙ্গে করে।
রাজা করে সবিনয় রসিকের তরে।।
পড়েছি বিপদে বড় গৌরাঙ্গ লইয়া।
পণ্ডিতেরা নাহি মানে স্বয়ং বলিয়া।।
রসিক বলেন আমি বিচার করিব।
গৌরাঙ্গকে স্বয়ং বলিয়া মানাইব।।
সভা হ’ল নবদ্বীপ পণ্ডিতের দলে।
শাক্ত শৈব বৈষ্ণবেরা এল দলে দলে।।
শান্তিপুর উলাকাশী নদীয়া দ্রাবিড়।
যেখানে যেখানে ছিল পণ্ডিত সুধীর।।
সপ্তাহ পর্যন্ত সভা হয় প্রতি মাস।
এইরূপে বিচার হইল ছয় মাস।।
বনবাসী পরমহংস এসেছিল যারা।
সুবিচারে পরাজয় হইলেন তারা।।
ছয় মাস পরে সভা শেষ সুবিচার।
স্বয়ং বলিয়া তারা করিল স্বীকার।।
পরমহংসরা বলে কাল্কে আসিব।
গৌরাঙ্গে স্বয়ং বলে স্বীকার করিব।।
আর যত প্রতিপক্ষ স্বীকার করিল।
স্বীকার করিয়া তারা ভকত হইল।।
পরমহংসরা আর না আসিল ফিরে।
এ দিকেতে জয়ডঙ্কা বাজে জয়পুরে।।
বৈষ্ণবেরা সবে জয় জয় ধ্বনি করে।
জয় গৌর স্বয়ং গৌর বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
সবে মিলে বলেন গৌরাঙ্গ জয় জয়।
জয় শ্রীগৌরাঙ্গ জয় রসিকের জয়।।
জয়পুরে রাজা করে জয় জয় ধ্বনি।
রামাগণে বামাস্বরে করে হুলুধ্বনি।।
জয়পুর জয় পূর্ণ জয় জয় জয়।
পুষ্প ফেলে মারে কেহ রসিকের গায়।।
বৈষ্ণবেরা রসিকের করিছে কল্যাণ।
রসিকের কণ্ঠে করে পুষ্পমাল্য দান।।
কোন কোন বৃদ্ধা নারী মনের পুলকে।
ধান্য দূর্বা দিতেছেন রসিক মস্তকে।।
রসিক বলেন মম সাধ্য কিছু নয়।
যার কার্য সেই করে তাঁর জয় জয়।।
সেই শ্রীগৌরাঙ্গ মোর এল ওঢ়াকাঁদি।
নমঃশূদ্র কুলে অবতার গুণনিধি।।
যশোমন্ত রূপে জীবে ভক্তি শিখাইল।
জয় হরিচাঁদ জয় সবে মিলে বল।।
গৌরাঙ্গ স্বয়ং বলি মীমাংসা হইল।
রসিকের সভাজয় তারক রচিল।।
নিঃস্বার্থ অর্থ দান
পয়ার
চাকুরী করিয়া ত্যাগ রসিক আসিল।
হরিচাঁদ চিন্তা করি গৃহেতে রহিল।।
তিলছড়া গ্রামে তাঁর সম্পত্তি যা ছিল।
মালেকের রাজকর বাকী পড়ে গেল।।
বিষয় বিক্রয় হয়, না রহে সম্পত্তি।
জমিদার সঙ্গে নাহি হইল নিষ্পত্তি।।
মালেকের টাকা বাকী সাড়ে সাত শত।
তার মধ্যে অভাব হইল দুই শত।।
সপ্তাহ মধ্যেতে অই টাকা হবে দিতে।
দুই শত টাকা না পারিল মিলাইতে।।
রসিক বিপদাপন্ন তুচ্ছ অর্থ দায়।
প্রভু হরিচাঁদ তাহা জানিল হৃদয়।।
গোলোকে বলেন প্রভু হ’য়ে অবসন্ন।
রসিক বিপদাপন্ন তুচ্ছ অর্থ জন্য।।
গুরুচরণকে বল একথা আমার।
টাকা দিয়া দায়মুক্ত করহ তাহার।।
পাগল বলিল বড় কর্তার নিকটে।
রসিকেরে টাকা দিয়া বাঁচাও সংকটে।।
গুরুচাঁদ চলিল দু’শত টাকা ল’য়ে।
গোলোক পাগল টাকা সঙ্গে নিল ব’য়ে।।
টাকা দিয়া এল সেই রসিকের ঠাই।
দেখিয়া আশ্চর্য কার্য বিস্মিত সবাই।।
রসিক বলেন মহাপ্রভু অন্তর্যামী।
তাঁর কৃপাবলে এ বিপদমুক্ত আমি।।
ক্ষণমাত্র করিলেন প্রেম আলাপন।
টাকা দিয়ে গৃহেতে আসিল দুইজন।।
এই টাকা নেয়া দেয়া অর্থ বোঝা ভার।
দিলেও না নিলেও না চাহিল না আর।।
গোলোক নাথের মন বুঝিল গোলোক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।।
ভক্ত রামকুমার আখ্যান
পয়ার
সাধুহাটি যুধিষ্ঠির বিশ্বাস হ’ল মত্ত।
পরিবার-সহ হ’ল হরিচাঁদ ভক্ত।।
তাহার ভগিনী হয় আনন্দা নামিনী।
প্রভু বলে ভক্তা মধ্যে তারে আমি গণি।।
নড়াইল গ্রামে ভক্ত শ্রীরামকুমার।
ভবানী নামিনী হয় ভগিনী তাহার।।
একদিন ঠাকুরকে আনিব বলিয়া।
ভাই বুনে পরামর্শ করিল বসিয়া।।
রাত্রিভরে সে ভবানী বধূগণে ল’য়ে।
ভক্তিরসে নানা মিষ্টি তৈয়ার করিয়ে।।
ব্রহ্ম মুহূর্তের কালে যাত্রা করিলেন।
তরী রামকুমার বাহিয়া চলিলেন।।
দু’দণ্ড আড়ই দণ্ড পথ পরিমাণ।
দণ্ডেকের মধ্যেতে তথায় চলি যান।।
ঘোর ঘোর ভোরকালে কেহ না গা তুলে।
হেনকালে ওঢ়াকাঁদি গিয়া পহুঁছিলে।।
ছড়া ঝাটি জল আনা গৃহাদি মার্জন।
রান্নাঘর পরিষ্কার প্রাঙ্গণ লেপন।।
গাত্রোত্থান করিয়া উঠিলা ঠাকুরানী।
(একলাইন গ্যাপ)
মন জানি অন্তর্যামী সত্ত্বর উঠিল।
ভগবান ভবানীর নৌকায় বসিল।।
ভবানী উঠিল রামকুমার উঠিল।
ব’ঠে ধরি ধীরে তরী বাহিয়া চলিল।।
অর্ধ পথে যেতে যেতে হ’ল ঘোর মেঘ।
দক্ষিণে বাতাস বহে অতিশয় বেগ।।
প্রভু রামকুমারে বলেন কি করিবি।
এই বাতাসেতে নৌকা কেমনে বাহিবি।।
কুমার বলেন প্রভু মেঘে নাহি ডরি।
আপনি আছেন নায় এই শঙ্কা করি।।
মহাপ্রভু বলে তবে না হও বিমুখ।
দিলাম উহারে ভার যা ইচ্ছা করুক।।
তরণী বাহিয়া যায় শ্রীরামকুমার।
চতুর্দিকে মেঘ দিনে ঘোর অন্ধকার।।
অবিরলধারে ঘন মেঘ বৃষ্টি হয়।
বৃষ্টিবিন্দু নাহি পড়ে ঠাকুরের নায়।।
নিরাপদে উদয় হইল নড়াইল।
আনন্দে প্রভুকে ল’য়ে সেবা করাইল।।
পায়স পিষ্টক আদি লাড্ডুক শাল্যন্ন।
ডাল বড়া ভাজা শাক শুক্তাদি ব্যঞ্জন।।
সেবাদি শুশ্রূষা ইষ্ট গোষ্ঠ দিবা ভরি।
সন্ধ্যা সমাগম ক্রমে হইল শর্বরী।।
প্রভুকে নিজ বাসরে রাখিল কুমার।
গেল দিন কহে দীন কবি সরকার।।
ভক্ত মহেশ ও নরহরি শালগ্রাম
পয়ার
নড়া’ল কানাই আর ভক্ত সনাতন।
শ্যামাচরণ বিশ্বাস ভুক্ত বহুজন।।
ভকত ভবনে যান প্রভু জগন্নাথ।
সনাতন শ্যামের বাটীতে যাতায়াত।।
ফলসী নিজামকাঁদি আর তালতলা।
মত্ত মাতালের প্রায় হ’ল হরিবোলা।।
হরিশ্চন্দ্র মহেশ কনিষ্ঠ ভজরাম।
তিন ভাই হরিভক্ত সুন্দর সুঠাম।।
শ্রীউমাচরণ চণ্ডী বৈরাগী ঠাকুর।
হরিনাম করে তারা মধুর মধুর।।
নেহাল বেহাল হ’ল আর গঙ্গাধর।
হরিচাঁদে মানে তারা স্বয়ং ঈশ্বর।।
মহেশ প্রভুকে ল’য়ে নিজ বাড়ী যান।
নেহাল জমিতে গিয়া নিগড়ায় ধান।।
ঠাকুর কহিছে তুই আয়রে নেহাল।
নেহাল দাঁড়ায় যেন সুদাম কাঙ্গাল।।
নিড়ানিয়া ঘাস ছিল আইলের পরে।
তার এক তৃণ সাধু দশনেতে ধরে।।
আর এক গোছা সাধু ধরে স্কন্ধ পরে।
গলে জড়া’য়া ধরি কহে যোগাড় করে।।
অই ভাবে উঠিলেন ঠাকুরের নায়।
দণ্ডবৎ হইয়া পড়িল রাঙ্গা পায়।।
ঠাকুর উঠিল এসে মহেশের বাড়ী।
গড়াগড়ি যায় সবে প্রভু পদে পড়ি।।
উমাচরণের বাড়ী যান হরিশ্চন্দ্র।
যেন সবে হাতে পেল আকাশের চন্দ্র।।
দক্ষিণ দেশের ভক্ত ওঢ়াকাঁদি যায়।
পথে যেতে তিষ্ঠেন নিজামকাঁদি গায়।।
উমাচরণ বাড়ই মহেশ ব্যাপারী।
বারুণীর অগ্রে মহোৎসব এই বাড়ী।।
মতুয়ারা নাহি করে স্বজাতিকে গ্রাহ্য।
লৌকিক সামাজিকতা করেছেন ত্যজ্য।।
সামাজিক পুরোহিত হইয়েছে বন্ধ।
মহেশ বলেন সামাজির ভাগ্য মন্দ।।
মহেশের ভাইঝির মৃত্যু হ’য়েছিল।
পুরোহিত আনিবারে মহেশ চলিল।।
গ্রাম্যলোকে পুরোহিতে দিলে না আসিতে।
পুরোহিত নাহি এল সে শ্রাদ্ধ করিতে।।
পুরোহিত, নিবাসী নিজামকাঁদি গ্রাম।
স্বভক্তি অন্তরে দ্বিজ পূজে শালগ্রাম।।
পিছুভাগে দাঁড়াইল সে মহেশ গিয়া।
দ্বিজ গেল পূজামন্ত্র সকল ভুলিয়া।।
ঠাকুর বলেন একি হইল বালাই।
বিগ্রহ পূজিতে মন্ত্র হারাইয়া যাই।।
নরসিংহ শালগ্রাম পূজেন ব্রাহ্মণ।
মন্ত্রভুলে যাই কেন ভাবে মনে মন।।
ভাবিলেন অমঙ্গল হইবেক ভারি।
পিছুদিক চেয়ে দেখে মহেশ ব্যাপারী।।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখে মহেশ পানেতে।
নরসিংহ শালগ্রাম মহেশের মাথে।।
মূর্তিমন্ত নরসিংহ শালগ্রাম শিরে।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ তাহার ভিতরে।।
ব্রাহ্মণ বলেন আর নাহিক বিলম্ব।
চল যাই আগে গিয়া করি তব কর্ম।।
অমনি উঠিল দ্বিজ মহেশের নায়।
সমাধা করিল শ্রাদ্ধ আসিয়া ত্বরায়।।
মহেশ ঠাকুরে বলে স্বজাতি সমাজে।
মম বামপদ তুল্য কেহ নাহি বুঝে।।
উমাচরণের বড় আর্তি ঠাকুরেতে।
তার পুত্র যাদব পরম নিষ্ঠা তাতে।।
কয় ভাই এক আত্মা একযোগ প্রাণ।
হরিচাঁদে আত্ম স্বার্থ করিয়াছে দান।।
গোলোকচাঁদের পদে ছিল দৃঢ় ভক্তি।
মহানন্দ পাগলকে আত্মা দিয়া আর্তি।।
যতলোক ওঢ়াকাঁদি বারুণীতে যায়।
যাতায়াতে উমাচরণের বাড়ী রয়।।
সকলকে বলে সাধু হইয়া কাতর।
এই নিমন্ত্রণ র’ল বৎসর বৎসর।।
যত লোক ওঢ়াকাঁদি যান এই পথে।
ময়ালয় তিষ্ঠিবেন আসিতে যাইতে।।
এই দেশ জলা ছিল না ফলিত ধান।
মতুয়ারা আসাতে এ দেশের কল্যাণ।।
এদানি ফলেছে ধান তোমরা না খেলে।
এ দেশেতে সুফলেতে ধান্য নাহি ফলে।।
গৃহস্থের গৃহে যদি সাধুতে না খায়।
সে গৃহের আর বৃদ্ধি কখন না হয়।।
এক বর্ষ তোমরা না এলে এই বাড়ী।
ধান্য না হইলে মোরা মন্বন্তরে মরি।।
আসিও থাকিও সবে খাইও যাইও।
গৃহস্থের শ্রীবৃদ্ধি হইবারে দিও।।
পিতা পুত্র পরিজন সবে একমন।
আত্মা দিয়া সবে করে সাধুর সেবন।।
এইভাবে সাধু সেবে সবার পুলক।
হরিচাঁদ ভক্ত এরা ভুবন তারক।।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।
প্রেমানন্দে হরি হরি বলে সর্বলোক।।