পঞ্চম অংশ
চন্দ্রকান্তের গুরু ভক্তি
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।।
নলিয়ারচর গ্রাম খুলনা জেলায়।
তেরখাদা থানা মধ্যে সেই গ্রাম হয়।।
সেই গ্রামে বাস করে চন্দ্রকান্ত নাম।
তারকের প্রীয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।।
কি ভাবেতে তারকের সঙ্গেতে মিলন।
তার কিছু তত্ব কথা শুন দিয়া মন।।
কালিয়া থানার মধ্যে চালনা গ্রামেতে।
কবিগান হবে সেথা শুনিয়া কর্ণেতে।।
কবিগান শুনিবার করিল গমন।
পথে যেতে কত কিছু ভাবে মনে মন।।
কবিগান গাবে সেথা তারক গোঁসাই।
নাম শুনে ভাল লাগে চোখে দেখি তাই।।
এই ভাবে কত কিছু ভাবিতে ভাবিতে।
উদয় হইল গিয়া চালনা গ্রামেতে।।
বিপক্ষের সরকার আনন্দ নামেতে।
দূর্গাপুর তার বাড়ী বিখ্যাত কবিতে।।
দুই দল উঠিলেন কবির খেলায়।
শত শত শ্রোতাগণ হয়েছে উদয়।।
দুই দল সমকক্ষ গান করিতেছে।
গান শুনে শ্রোতাগণে আনন্দে ভেসেছে।।
আনন্দ নামেতে সেই সরকার ছিল।
গান করি সে আনন্দ বাহিরেতে এল।।
তারক উঠিল যবে কবির খেলায়।
হেন কালে দিনমণি অস্তাচলে যায়।।
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসিল গগনে।
তারক গাহিছে গান শ্রোতাগণ শোনে।।
হেন কালে মশকেরা দলে দলে এল।
মশার কামড়ে সবে অস্থির হইল।।
হাতের চাপড়ে সবে মশা মারিতেছে।
চট পট আসরেতে শব্দ হইতেছে।।
তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন।
নাড়াচাড়া কর সবে কিসের কারণ।।
আসেরেতে যত লোক কহিল তখন।
মশার কামড়ে মোরা কি করি এখন।।
তাই শুনে সে তারক উচ্চস্বরে কয়।
শুন শুন মশাগণ থেক না হেথায়।।
হরিচাঁদের দোহাই শুন মশাগণ।
এ আসরে কোন দিন এস না কখন।।
তাই শুনে সেই মশা কোথায় লুকাল।
শ্রোতাগণ তাই দেখে আশ্চর্য্য হইল।।
তার পরে সে তারক ধরে ধুয়া গান।
ধুয়া গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।।
প্রমের তরঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
তার মধ্যে শ্রোতাগণ বেড়ায় ভাসিয়া।।
কেহ এসে পড়িলেন তারকের পায়।
নয়ন জলেতে ভেসে গড়াগড়ি যায়।।
কেহ কেহ বলিতেছে তারকের জয়।
কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়।।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
হরি বলে নাচে কেহ দুবাহু তুলিয়া।।
এই ভাবে বহুপরে গান ক্ষান্ত হল।
যার যার গৃহে সবে গমন করিল।।
শুধু একা বসে আছে চন্দ্রকান্ত হীরা।
জ্ঞানহারা প্রায় তার বহে অশ্রুধারা।।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।
অন্ধাকার রাত্রি দেখে রহিল তথায়।।
চাদোয়ার তলে সে যে শয়ন করিল।
একটি মশায় তারে কামড় নাই দিল।।
সেই হতে সেই মাঠে মশা নাহি হয়।
প্রত্যক্ষ দেখিছি আমি থাকিয়া তথায়।।
তারকের গুণ কথা বলি কি ভাষায়।
স্মরণ করিলে হয় প্রেমের উদয়।।
তারপর চন্দ্রকান্ত প্রভাতে জাগিয়া।
ছল ছল আখি দু’টি কান্দিয়া কান্দিয়া।।
তারক যে বাড়ি ছিল সে বাড়ীতে গিয়ে।
তারকের পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়ে।।
আজ হতে তব পায়ে নিলাম শরণ।
দয়া করে চল বাবা আমার ভবন।।
তারক বলেছে বাছা কোথা বাড়ী ঘর।
চন্দ্রকান্ত বলে বাড়ী ললিয়ার চর।।
চন্দ্রকান্ত নাম মম হীরা বংশ হয়।
যুধিষ্ঠির পুত্র আমি দিনু পরিচয়।।
তারক বলেছে তবে মনে যদি চায়।
কিছু দিন পরে যাব তোমার আলয়।।
কবির বায়না মোর আছে কত ঠাই।
এর মধ্যে যেতে মোর সময় তো নাই।।
বৈশাখ মাসেতে যাব তোমার বাড়ী।
এত বলি সে তারক দিল ধার্য্য করি।।
তাই শুনি চন্দ্রকান্ত প্রণাম করিল।
পদধুলি লয়ে শিরে গৃহেতে আসিল।।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
আশা পথ পানে থাকে সতত চাহিয়া।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
বৈশাখ মাসেতে সেই তারক আসিল।।
সঙ্গে ভক্ত আসিলেন আর কয়জন।
কাঙ্গালী বেপারী আর সূর্য্যনারায়ণ।।
ব্রাহ্মণ সে জগদিশ পবিত্র ছিঁড়িয়া।
তারকেরে গুরু করি আসিল মিশিয়া।।
যাদব মল্লিক আর শ্রী যাদব ঢালী।
শ্রী নবীন রাধাক্ষেপা আর বনমালী।।
হরি হরি বলে সবে বাড়ীতে উঠিল।
দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত চরণে পড়িল।।
পরিবারসহ এসে চরণে লুটায়।
মেয়েরা আসিয়া সেথা উলুধ্বনি দেয়।।
প্রণাম করিয়া সবে চরণ ধোঁয়ায়ে।
বসিবারে দিল সবে আসন পাতিয়ে।।
তারপর চন্দ্রকান্ত মনেতে ভাবিয়া।
এ পাড়ায় ও পাড়ায় বেড়ায় ঘুরিয়া।।
ডাব খাওয়াবে বলে গাছারু সন্ধানে।
কাহারে না পেয়ে শেষে দুঃখ পায় মনে।।
তাই জেনে কহিলেন তারক গোঁসাই।
শুন বলি চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই।।
বৃথা কেন ঘোরা ফেরা কর মহাশয়।
দাও নিয়ে চলে যাও গাছের গোড়ায়।।
হরিচাঁদ গুরচাঁদ স্মরণ করিয়া।
শিকড়েতে কোপ দাও নয়ন মুদিয়া।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়।
দাও নিয়ে চলিলেন গাছের গোড়ায়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ তারকে স্মরিয়া।
শিকড়তে কোপ দিল নয়ন মুদিয়া।।
এক কোপে তিন খনি শিকড় কাটিল।
তিন ছড়া নারিকেল মাটিতে পড়িল।।
তাই দেখে সবে মিলে মানিল বিস্ময়।
তারকের পদে পড়ে কান্দিযা ভাসায়।।
কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে ধরণী লুটায়।
কেহ কারে বক্ষে ধরি আলিঙ্গন দেয়।।
কেহ এসে তারকের চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।।
তোমার চরণে বাবা এই ভিক্ষা চাই।
জীবনে মরণে যেন ভুলিয়া না যাই।।
পুরুষ রমণী যারা ছিল সেই খানে।
কেন্দে কেন্দে অচৈতন্য হল সর্বজনে।
তাই দেখে সে তারক সবাকে সান্তায়।
চেতনা করায় সবে হস্ত দিয়া গায়।।
তারপর চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া কান্দিয়া।
সেই ডাব খেতে দেয় কাটিয়া কাটিয়া।।
সু-মিষ্ট ডাবের জল খাইল সকলে।
আনন্দেতে সবে তরা হরি হরি বলে।।
কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়।
কেহ বলে হরিভক্তগণ জয় জয়।।
কেহ বলে তারক চান্দের জয় জয়
কেহ উঠে দাড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়।
মেয়ে লোক যত ছিল করে উলুধ্বনি।
হরি হরি বলে যত ধনীমানী জ্ঞানী।।
তারপর সবে মিলে সুস্থির হইল।
মেয়েরা সকলে মিলে রন্ধন করিল।।
ব্যাস্ত হয়ে করিলেন ভোজনের ঠাই।
ভোজনে বসিল গিয়ে সাধুরা সবাই।।
ধূপ ধুনা নিয়ে এল রামমণি যিনি।
সেই নারী হলে চন্দ্রকান্তের রমণী।।
রামমণির চক্ষু জলে ভাসিতে লাগিল।
তারকের পদে পরে কান্দিয়া কহিল।।
ওগো বাবা কর ক্ষমা অবলা বলিয়া।
ভক্তি নাই জ্ঞান নাই পুজিব কি দিয়া।।
তারক বলেছে মাগো মন খাটি চাই।
হরিচান্দের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।।
এই ভাবে ভক্তি করি ভোজন করায়।
একজন দাঁড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়।।
সাধু সাবধান বলে কেহ ভীর দিল।
এই ভাবে আনন্দেতে ভোজন করিল।।
তারপর আচমন করিয়া সবাই।
হরিকথা কহিলেন বসি এক ঠাই।।
তারপর সবে মিলে কীর্তনে মাতিল।
হরিগুণ গান করি সে নীশি বঞ্চিল।।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়।
চন্দ্রকান্ত পড়িলেন তারকের পায়ে।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই।
মনের বাসনা আজি চরণে জানাই।।
মন্দির করেছি আমি মোর কথা লও।
তুমি আজ নিজ হাতে ঘট পেতে দাও।।
তাই শুনি সে তারক কহিল তখন।
তোমার বাসনা আমি করিব পূরণ।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত নব বস্ত্র এনে।
ভক্তি ভাবে অর্পিলেন তারক চরণে।।
তারপর শ্রী তারক ঘট পেতে দিল।
পূজার পদ্ধিতি সব তারে জানাইল।।
রামমণি চন্দ্রকান্ত আসিয়া বসিল।
হরি নাম মন্ত্র গিয়া দীক্ষা কে করিল।।
তাই দেখে সবে মিলে হরিধ্বনি দিল।
তারপর শ্রী তারক বাহিরে আসিল।।
বাহিরে আসিয়া তিনি বলিল তখন।
একটি বেলের চারা আন হে এখন।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত ঘুরিয়ে বেড়ায়।
মন্দির পিছনে গিয়ে দেখি বারে পায়।।
একটি বেলের চারা তথায় রয়েছে।
সেই চারা এনে দিল তারকের কাছে।।
নিজ হাতে সেই চারা করিল রোপন।
কহিলেন এই গাছ করিও যতন।।
এই গাছ বড় হলে ফল যদি হয়।
সেই ফল লাগাইও ঠাকুর সেবায়।।
তারপর সবে মিলে করিয়া ভোজন।
চন্দ্রকান্তে ডাক দিয়া কহিল তখন।।
শুন বাবা চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই।
বিদায় কর হে মোরে জয় পুর যাই।।
চন্দ্রকান্ত বলে বাবা তোমাকে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
মহোৎসব করিতে মনে মোর চায়।
তুমি দিন করে দিলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।
তারক বলেছে বাছা মঙ্গল হইবে।
পহেলা বৈশাখে তুমি উৎসব করিবে।।
এই কথা যখনেতে তারক কহিল।
সকলে তারক পদে প্রণাম করিল।।
তারপর বলে কয়ে হইল বিদায়।
ভক্তগণ সঙ্গে করে জয় পুর যায়।।
সেই হতে চন্দ্রকান্ত বছরে বছরে।
পহেলা বৈশাখে তিনি সাধু সেবা করে।।
এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন শ্রীতারক এসে দেখা দিল।।
দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত প্রণমিল পায়।
রামমণি তিনি এসে চরণ ধোঁয়ায়।।
চরণ ধোঁয়ায়ে সে বসিবারে দিল।
ধূপ ধুনা দিয়ে তিনি প্রণাম করিল।।
পাক করিবারে পরে করে আয়োজন।
হেন কালে চন্দ্রকান্ত ভাবে মনে মন।।
কি দিব কি দিব বলে মনেতে ভাবিয়া।
বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে উতরিল গিয়া।
কাঠাল গাছেতে তিনি উঠিলেন গিয়ে।
পাকিয়াছে কিনা তাই দেখেছে টিপিয়ে।।
পাকে নাই সে কাঠাল দেখিলেন তাই।
মন দুখে ফিরে এল ছাড়ে শুধু হাই।।
কিছু পরে শ্রী তারক কহিল তখন।
চন্দ্রকান্ত ডেকে বলে মধুর বচন।।
কাক ডাকিতেছে বাছা কাঠালের গাছে।
যাও বাছা দেখি গিয়ে কাঠাল পেকেছে।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত চলিল তথায়।
কাকেতে ঠোকর মারে কাঠালের গায়।।
গাছে উঠে সে কাঠাল আনিল পাড়িয়া।
কিভাবে কি হয়ে গেল না পায় ভাবিয়া।।
কিছু আগে দেখিলাম হস্তেতে টিপিয়া।
অতিশয় শক্ত ছিল দেখেছি আসিয়া।।
অল্প সময়ের মধ্যে নরম হিইল।
তারকের গুণে বুঝি কাঠাল পাকিল।।
তাই ভেবে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়।
গৃহে এলো সে কাঠাল করিয়া মাথায়।।
আখি জলে ভেসে ভেসে কাঠাল ভাঙ্গিয়া।
তারকেরে খেতে দিল কান্দিয়া কান্দিয়া।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ স্মরণ করিয়া।
তারক কাঠাল খায় পরাণ ভরিয়া।।
এইভাবে চন্দ্রকান্ত ভকতি করিত।
মাঝে মাঝে শ্রী তারক তথায় আসিত।।
এই ভাবে কত খেলা খেলিল তারক।
কলমেতে কি লিখিব আমি অপারক।।
চন্দ্রকান্ত শ্রীতারক লীলা সাঙ্গ পরে।
কি ঘটনা হল সেথা বলিব সবারে।।
মহানন্দ নামে চন্দ্রকান্তের তনয়।
পিতার আদর্শ মেনে চলিত সদায়।।
পহেলা বৈশাখ হলে সাধু সেবা দেয়।
দলে দলে মতুয়ারা আসিত তথায়।।
তারক যে বেল গাছ রোপন করিল।
সেই গাছ বড় হয়ে ফল ধরেছিল।।
সেই ফল লাগাইতে ঠাকুর সেবায়।
প্রতিবর্ষ বৈশাখেতে মহোৎসব হয়।।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটনা।
হরিভক্ত কাছে আমি করিব বর্ণনা।।
দলে দলে মতুয়ারা তথায় আসিল।
বেল গাছ ছায়াতলে কীর্তন করিল।।
সেই বেল ভোগে দিতে ভুল হয়ে গেছে।
গাছ হতে পাকা বেল মাটিতে পড়েছে।।
শত শত হরিভক্ত সেই খানে ছিল।
কারো গায় না পড়িল মাটিতে পড়িল।।
তাই দেখে হরিভক্ত মানিল বিস্ময়।
মহানন্দ হীরা কান্দে পড়িয়া ধরায়।।
কেন্দ কেন্দে কহিলেন ভক্তগণ ঠাই।
ভূল হয়ে গেছে মোর সবাকে জানাই।।
সেই বেল নিয়ে শেষে ভোগেতে লাগায়।
কেহ কেহ হরি বলে নাচিয়া বেড়ায়।।
এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে।
হরিভক্ত কান্দে কেহ পড়ে ধরাসনে।।
এইভাবে কীর্তনেতে সকলে মাতিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে কীর্তন থামিল।।
এই ভাবে সাধু সেবা হইত তথায়।
তারক চাঁদের গুণ কি লিখি ভাষায়।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচান্দ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।।
তারকের পরশে কাটা গাছ বাড়ে
হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়।
কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।।
হরি হতে নাম বড় এ ভব সংসারে।
নাম হতে ভক্ত বড় জানাই সবারে।।
হরিভক্ত গুণ কথা কহন না যায়।
হরিভক্ত দরশনে প্রেমের উদয়।।
তার কিছু তত্ত্ব কথা কহিব এখন।
ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।।
হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই।
লীলামৃত গ্রন্থখানি যার দ্বারা পাই।।
কবিগান করে তিনি দেশ দেশান্তর।
হরিচাঁদ গুণ কথা করেন প্রচার।।
একদিন চলিলেন খুলনা জেলায়।
রামপাল থানা মধ্যে হলেন উদয়।।
দল বল সঙ্গে করে হাটিতে হাটিতে।
উদয় হইল গিয়ে হুকড়া গ্রামেতে।।
পথিমধ্যে চারিজন লোক বসা ছিল।
তারকে হেরিয়া তারা কান্দিয়া কহিল।।
এই দেশে আমাদের চেনা জানা নাই।
বিপদে পরিয়া মোরা তোমাকে জানাই।।
আমাদের বাড়ী হয় ঘৃতকান্দি গায়।
করাতির কাজে মোরা এসেছি হেথায়।।
হরিচাঁদ ভক্ত তুমি তারক গোঁসাই।
তুমি বিনে এ বিপদে আর কেহ নাই।।
রূপচাঁন্দ নামে এই গ্রামে একজন।
তার বাড়ী কাজ করি শুন বিবরণ।।
দশদিন এই বাড়ী কাজ করিতেছি।
একগাছ ছেও দিয়ে বিপদে পড়েছি।।
কথাছিল দশ ফুট ছেও দিতে হবে।
ঠিকমত গাছখানি চেরাই করিবে।।
ঠিকমত মাপ দিয়ে কাটা হয়ে গেল।
হেন কালে রূপচাঁন্দ তথায় আসিল।।
নিজ হাতে রূপচাঁন্দ মাপিয়া দেখিল।
চারি ইঞ্চি গাছখানি কম পড়ে গেল।।
নিজে রাও মেপে দিখে চারি ইঞ্চি কম।
বারে বারে মাপিলাম হয় ব্যাতিক্রম।।
তাই দেখে রূপচাঁন্দ গালাগালি দিয়া।
আমাদের অস্ত্র গুলি রাখে ঘরে নিয়া।।
আমাদের টাকা কড়ি কিছু নাহি দেয়।
তাই মোরা বসে আছি হয়ে নিরুপায়।।
তাই শুনে সে তারক তাহাদের নিয়ে।
কাটা গাছ যথা আছে উত্তরিল গিয়ে।।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
সেই গাছে হাত দিয়া কহিছে কান্দিয়া।।
শুন শুন গাছ তুমি মোর কথা লও।
চারি ইঞ্চি বেড়ে তুমি ঠিক মত হও।।
বলা মাত্র সেই গাছ বাড়িতে লাগিল।
চারি ইঞ্চি বেড়ে গাছ ঠিকমত হল।।
এত বলি শ্রীতারক তাদের কহিল।
মাপকাঠি আন দেখি কত কম পল।।
তাই শুনে করাতিরা মাপ কাঠি নিয়ে।
ঠিকমত গাছখানি দেখিল মাপিয়ে।।
দেখিলেন সকলেতে গাছ কম নাই।
তারকের পদে পড়ে কেন্দে ছাড়ে হাই।।
তারক বলেছে সব সুস্থ্য কর মন।
মালিকেরে ডেকে আন গিয়ে একজন।।
তাই শুনে একজন গমন করিল।
দ্রুত গতি গিয়ে তারে ডাকিয়ে আনিল।।
রূপচাঁন্দে ডেকে বলে তারক গোঁসাই।
কিবা অপরাধ করে ইহারা সবাই।।
চারি ইঞ্চি কম গাছ ইহারা কেটেছে।
তব মাপ মনে হয় ভুল হয়ে গেছে।।
তাই শুনে রূপচাঁন্দ কি যেন ভাবিয়া।
মাপ কাঠি দিয়ে গাছ দেখিল মাপিয়া।।
বারে বারে মেপে দেখে ঠিক মত হয়।
তারকের কাছে এসে পদে ক্ষমা চায়।।
মনে হয় আগে আমি ভুল মাপিয়াছি।
সকলের কাছে আমি ক্ষমা চাহিয়াছি।।
তাই শুনে শ্রীতারক কহিল তখন।
শুন সবে মন দিয়া আমার বচন।।
দয়া ছাড়া ধর্ম নাই এভব সংসারে।
ক্ষমা যদি চায় কেহ ক্ষমা কর তারে।।
তাই শুনে রূপচাঁন্দ কহিল তখন।
শুন ভাই করাতিরা আমার বচন।।
মোর এই গাছ খানি করহে চেরাই।
তোমাদের টাকাকড়ি সব দিব ভাই।।
তারকেরে কহিলেন করিয়া বিনয়।
মম গৃহে চল তুমি ওগো মহাশয়।।
তারক বলেছে আমি দেরি না করিব।
এই গ্রামে আমি আজ কবিগান গাব।।
এত বলি শ্রীতারক গমন করিল।
রূপচাঁন্দ তারকের পদে প্রণমিল।।
তারকের পদে যেই পরশ করিল।
কি যেন কি আকর্ষণে প্রেম সঞ্চারিল।।
সেই হতে গৃহে গিয়ে ভাবিতে লাগিল।
তারকের ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
কবিগান হবে সেথা দক্ষিণ পাড়ায়।
মন বড় উচাটন চলিল তথায়।।
তারকের গান শুনে ঝরে আখি জল।
মহাভাব উথলিল বলে হরি বল।।
সবে দেখে রূপচাঁন্দ দুর্জয় মানুষ।
গান শুনে কান্দিতেছে হইয়া বেহুষ।।
ধরা ধরি করে সবে সান্তনা করিল।
তীর বেগে ছুটে গিয়ে চরণে পড়িল।।
তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাষায়।
অপরাধ করিয়াছি রেখ রাঙ্গা পায়।।
তোমাকে চিনিতে মোর সাধ্য কিছু নাই।
আমার মনের কথা তোমাকে জনাই।।
তোমার পরশে কাটাগাছ বেড়ে যায়।
আমা হতে সেই কথা হইল প্রত্যয়।।
আগে আমি না জানিয়া ভুল করিয়াছি।
আজ হতে তব পায় শরণ নিয়েছি।।
দস্যু মন ছিল মোর আসিয়া সংসারে।
তোমার পরশে আজ সব গেল দুরে।।
এত বলি রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল।
তারক ধরিয়া তাকে সান্তনা করিল।।
সান্তনা করিয়া বলে শুন বাছাধন।
মোর প্রতি সদা যেন থাকে তব মন।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদে স্মরণ করিবে।
হাতে কাম মুখে নাম সত্য পথে রবে।।
হেন কথা রূপচাঁন্দ যখন শুনিল।
তারকের চরণেতে প্রণাম করিল।।
পদ ধুলি অঙ্গে মেখে গুহেতে চলির।
গান শেষে শ্রীতারক বিদায় হইল।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
রূপচাঁন্দ মনে প্রাণে ভাবিত হৃদয়।।
আর কবে হেরিব সে মানুষ রতন।
দিবানিশি সদা করে মন উচাটন।।
সংসার বন্ধন হতে কবে মুক্ত হব।
তারকের পদে গিয়ে আত্ম সমর্পিব।।
একদিন রূপচাঁন্দ প্রভাতে জাগিয়া।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।।
জয়পুর যাব বলে করিল গমন।
ভাবে গদগদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
চারিদিন পরে গিয়ে হইল উদয়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা করি নিবেদন।
কৃপা করে অধমের কর হে গ্রহণ।।
তারক ধরিয়া তবে রূপচাঁন্দে কয়।
হরিনাম মহামন্ত্র দিলাম তোমায়।।
হাতে কাম মুখে দাম্পত্য কথা কবে।
পবিত্র চরিত্র রেখে সংসার করিবে।।
তারপর শ্রীতারক কত শিক্ষা দিল।
ভোজন করিয়া সবে নিশি কাটাইল।।
পর দিন তথা হতে ভোজন করিয়া।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা রূপচান্দে নিয়া।।
রূপচাঁদ কাছে গিয়ে দিল দরশন।।
গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিল।
হাসি মুখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।।
শুন বলি রসরাজ তোমাকে জানাই।
রূপচান্দ হবে পরে রমণী গোঁসাই।।
তাই শুনে রুপচান্দ চরণে পড়িল।
গুরুচাঁদ পদ ধরি কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
চিরদিন তব পদে থাকে যেন মন।।
আমি অতি মুঢ়মতি কোন গুণ নাই।
তব পদ আমি যেন ভুলিয়া না যাই।।
অহংকারে মত্ত হয়ে কত কি করেছি।
গুরু পদ পরশেতে কি যেন হয়েছি।।
পরশ পরশে যেন লৌহ সোনা হয়।
সে মত হয়েছে মোর পাষাণ হৃদয়।।
এইভাবে রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল।
গুরুচাঁদ ধরে তুলে সান্তনা করিল।।
গুরুচাঁদ বলে শুন ওগে বাছা ধন।
ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।।
হাতে কাম মুখে নাম মন খাটি চাই।
পরনারী মাতৃরূপ দেখিবে সদাই।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম পালন করিবে।
চরিত্র পবিত্র রেখে সত্য কথা কবে।।
এইভাবে গুরুচান্দ কত বুঝাইল।
দু’জনারে ল’য়ে শেষে বাড়ী মধ্যে গেল।।
সত্য ভাষা চরণেতে প্রণাম করিয়া।
যার যার দেশে সবে গেলেন চলিয়া।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
তারকচাঁদের তিরধান ও সূক্ষ্মদেহে দর্শণ
হরি-গুরুচাঁদ বন্ধি যুগল চরণ।
তারকের লীলা গীতি করিব বর্ণন।।
হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই।
যাহার মস্তকে থাকে ক্ষীরোদের সাই।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পুরুষ রতন।
শোক তাপ দুরে যায় করিলে স্মরণ।।
প্রশস্থ গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করিত।
নামে রুচি জীবে দয়া সবে শিক্ষা দিত।।
বিবাহ করিল তিনি ঠাকুরের মতে।
এক কন্যা জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।।
চিন্তামণি নামে ভার্যা পতি পরায়ণা।
পতি পদ ভিন্ন সতী কিছুই জানেনা।।
তারকের আজ্ঞা মতে সতত চলিত।
স্বভক্তি অন্তরে সতী চরণ সেবিত।।
এক কন্যা সেই গর্ভে যখন জন্মিল।
শংকরী বলিয়া নাম তাহার রাখিল।।
পুত্রের বাসনা তার নাহি ছিল মনে।
তারকের কথা মতে চলে তার সনে।।
কন্যাটিকে যত্ন করি পূর্ণ অভিলাষ।
আর না করিল সতী স্বামী সহবাস।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
ক্রমে ক্রমে সেই কন্যা বাড়ীতে লাগিল।।
শংকরী কে বিয়ে দিয়ে রাখিল বাড়ীতে।
এক পুত্র জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।।
সে পুত্রের নাম রাখে শৈলেন্দ্র বলিয়া।
তারক রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।।
পুত্র পেয়ে শংকরীর ভরে ওঠে বুক।
কোলে করে সেই পুত্র কত পায় সুখ।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
দিনে দিনে সেই পুত্র বাড়িতে লাগিল।।
তারকেরে দাদু বলে ডাকিত যখন।
কোলে করে তারকের আনন্দিত মন।।
মুখে চুমু দিয়ে তারে ভালবাসা দিত।
ভালবাসা পেয়ে শিশু আনন্দে হাসিত।।
তাই দেখে সাবাকার আনন্দিত মন।
সুখের সাগরে ভাসে তারক সুজন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
শংকরী ডাকিয়া তার পিতাকে কহিল।
আমার ছেলের লাগি জুতা কিনে দাও।
বার বার বলি আমি দিব দিব কও।।
তারক বলেছে মাগো পরবাসে যাই।
দেশে দেশে আমি শুধু কবিগান গাই।।
আসিবার কালে মাগো মনেতে থাকে না।
কিনিব কিনিব বলে কিনিতে পারিনা।।
শংকরী বলেছে বাবা শুন মোর কথা।
মরে গিয়ে দিবে নাকি মোর পুত্রে জুতা।।
তারক বলেছে মাগো হতে পারে তাই।
জুতা কিনে দিব আমি কোন চিন্তা নাই।।
তারপর কতদিন গত গয়ে গেল।
সেই জুতা কোন দিন কিনিয়ে না দিল।।
তারপর দেশে দেশে ঘুরিতে লাগিল।
ঠাকুরের যুগধর্ম পালন করিল।।
গীতি কাব্য লিখিলেন মহাসংকীর্তন।
শুনিলে জীবের হয় শমন দমন।।
হরি লীলামৃত গ্রন্থ মধুর আখ্যান।
ভক্তগণে শোনে তাহা অমৃত সমান।।
এই ভাবে হরিনাম প্রচার করিয়া।
শুভক্ষেণে চলিলেন জগত ছাড়িয়া।।
একদিন ঘুম হতে প্রভাতে জাগিয়া।
হরিনাম করিতেছে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
সবে দেখে হরিনাম করিতে করিতে।
প্রাণ পাখী উড়ে গেল দেখিতে দেখিতে।।
আত্ম পরিজন সবে কান্দিয়া ভাষায়।
ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে গেছে দেখিবারে পায়।।
তেরশ একুশ সালে ফাল্গুন মাসেতে।
শিব চতুর্দশী তিথি চড়িপুষ্প রথে।।
চলিলেন রসরাজ ঠাকুরের পাশে।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়িতেছে আকাশে বাতাসে।।
নর নারী যারা ছিল কান্দিয়া ভাসায়।
আকাশে সাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
গ্রাম বাসি যারা ছিল করে হায় হায়।
এহেন দরদী মোরা পাইব কোথায়।।
সোনার মানুষ গেল জগত ছাড়িয়া।
কেমনে বাঁচিব মোরা শোক পাশরিয়া।।
এই ভাবে কতজন কান্দিয়া ভাসায়।
শংকরী মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা আখি মেলে চাও।
কোন দেশে যাবে তুমি মোরে কয়ে যাও।।
চিন্তামণি কান্দিতেছে চরণে পড়িয়া।
কেন তুমি ছেড়ে গেলে দাসীকে ফেলিয়া।।
সতী নারী পতি বিনে কিছু নাহি চায়।
কি বুছিয়া ছেড়ে গেলে ফেলিয়া আমায়।।
অভাগিনীর মিনতী চরণে জানায়।
আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়।।
কৃপা করে নিও স্বামী তোমার নিকটে।
কেন্দে কেন্দে চিন্তামণি কহে করপুটে।।
তাই শুনে গ্রাম বাসি সবাকে বুঝায়ে।
শব দাহ করিলেন শ্মশানেতে নিয়ে।।
হরিবলে চিতা জ্বেলে করিল দাহন।
চন্দনের বিন্দু বিন্দু হয় বরিষণ।।
চন্দনের বৃষ্টি হয় দেখিল সকলে।
আশ্চর্য্য মানিয়া সবে হরি হরি বলে।।
কেহ কেহ হরি বলে কান্দিয়া ভাষায়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
এই ভাবে দাহ কার্য্য সমাধা হইল।
শোক পাশরিয়া সবে গৃহেতে আসিল।।
তারপর সামাজিক প্রথা অনুসারে।
শ্রাদ্ধ কার্য্য করিলেন দশদিন পরে।।
তারপর কি হইল শুন দিয়ে মন।
ঘটনা প্রবাহ আমি করিব বর্নণ।।
দিঘলিয়া গ্রাম বাসি জগদীশ নাম।
তারকের প্রিয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।।
বাড়ী শ্রেণী ভুক্ত সেই ব্রাহ্মণ নন্দন।
পৈতা ফেলে করিলেন আত্মসমর্পণ।।
মাদারীপুরেতে গেল সেই মহাশয়।
দৈব যোগে তারকের সনে দেখা হয়।।
দেখিয়া সে জগদীশ প্রণাম করিল।
কোথায় চলেছে বাবা মোর কাছে বল।।
তারক বলেছে বাছা বলি তব ঠাই।
হরিবলে আজি আমি ব্রহ্মপুত্রে যাই।।
একজোড়া জুতা কিন আনিয়াছি আমি।
সঙ্গে করে এই জুতা লয়ে যাও তুমি।।
মোর নাতি শৈলেন্দ্রেরে এই জুতা দিও।
কবে ফিরি ঠাই নাই তাহাকে কহিও।।
জুতা নিয়ে জগদীশ গৃহেতে আসিল।
পর দিন জুতা নিয়ে জয়পুর গেল।।
তিন দিন আগে সেই তারক গোঁসাই।
শুনিলেন ছেড়ে গেছে এ জগতে নাই।।
তাই শুনে জগদীশ মাটিতে পড়িল।
চেতনা পাইয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।।
গত কাল জুতা কিনে মোর কাছে দিল।
মাদারীপুরেতে বসে আমাকে কহিল।।
কবে আমি দেশে ফিরি তার ঠিক নাই।
বুঝিলাম শেষ দেখা দিলেন গোঁসাই।।
তাই শুনে সবে মিলে কান্দিয়া ভাসায়।
মাটিতে পড়িয়া সবে গড়াগড়ি যায়।।
হেন দশা হল সেথা কহন না যায়।
গ্রাম বাসী সবে এসে করে হায় হায়।।
শংকরী কান্দিয়া বলে সকলের ঠাই।
বাবা যাহা বলে ছিল করে গেল তাই।।
শুন বাবা বলি তোমা হৃদয়ের কথা।
কাহারে বুঝাব আমি পিতৃহারা ব্যাথা।।
চিন্তামণি কান্দিতেছে হা নাথ বলিয়া।
কি খেলা খেলিলে তুমি জগত ছাড়িয়া।।
তোমার বিরহ ব্যাথা সহিব কেমনে।
বলে যাও ওগো স্বামী জানাই চরণে।।
এই ভাবে কেন্দে কেন্দে সবে শান্ত হল।
সেই জুতা যত্ন করি মন্দিরে রাখিল।।
যত্ন করি সেই জুতা সেবা ভক্তি করে।
এইখনে সেই জুতা আছে সে মন্দিরে।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা ডুবে গেল।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
কঙ্কালে সাধনা
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্নণ।।
সাধনা ভাই সব কোলা গ্রামে ছিল।
সবে মিলে ভিটা ছেড়ে জয়পুরে এল।।
পশ্চিম পাড়ায় এসে বসত করিত।
ভ্রাতৃ অন্নে একসনে সাধনা থাকিত।।
শ্রীতারক যখনেতে ত্যাজিল জীবন।
কি যেন কি হয়ে গেল সাধনার মন।।
বিরহ আগুণে পুড়ে মন ঠিক নাই।
তারক তারক বলে সদা ছাড়ে হাই।।
হাহুতাসে কান্দে সদা তারক বলিয়া।
পাগলিনী প্রায় শেষে বেড়াত কান্দিয়া।।
অল্প দিন পরে শেষে ত্যাজিল জীবন।
তারকের পিছে পিছে করিল গমন।।
শোক পাশরিয়া সবে সমাধি করিল।
অবিলম্বে শতকাজ সকল হইল।।
বাড়ী পরে রাখিলেন যতন করিয়া।
ধুপ দ্বীপ দেখাইত সকলে মিলিয়া।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
তারপর কি হইল লিখিব ভাষায়।।
ভারত বিভাগ হয়ে দুই খন্ড হল।
পাকিস্তান ছেড়ে কেহ ভারতে চলিল।।
সাধনার ভাই সব এমন সময়।
ভিটা বাড়ী বিক্রি করি ভারতেতে যায়।।
মুসলমান কিনিল সেই বাড়ী ঘর।
তাহারা বসতি করে সেই বাড়ী পর।।
সাধনার সমাধিটি বাড়ীর পাশেতে।
তুলসীর বৃক্ষ ছিল তাহার পরেতে।।
মিয়ারা কবর ভাবি সেখানে না যায়।
জঙ্গলেতে পরিণত হইল তথায়।।
এই ভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
তারপর কি হইল লিখিব ভাষায়।।
তেরশত আশি সাল হবে অনুমান।
আশ্চর্য্য ঘটনা এক হয়েছে প্রমাণ।।
রাজেন্দ্র নামেতে ছিল জয়পুর বাসি।
তারক চাঁদের নামে হইল উদাসি।।
সাধনাকে মনে মনে মা বলে ডাকিত।
ধ্যানে জ্ঞানে মনে প্রাণে ভকতি করিত।।
একদিন নিশি যোগে স্বপনে দেখিল।
সাধনা আসিয়া তারে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
আমার সমাধি পরে ভক্তি যেন রয়।।
সকালে বিকালে তুই সেই খানে যাবি।
পরিস্কার করে সেথা ভকতি করিবি।।
সন্ধ্যা বেলা ধুপ দ্বীপ সেখানে দেখাবি।
আমার কৃপায় তুই মঙ্গলে থাকিবি।।
এই ভাবে তিন দিন স্বপনে কহিল।
পরদিন ভোর বেলা তথায় চলিল।।
সমাধির পরে যেই আবর্জনা ছিল।
নিজ হাতে পরিস্কার তখনে করিল।।
ছল ছল আখি দু’টি প্রণাম করিয়া।
পুনরায় আসিলেন গৃহেতে ফিরিয়া।।
সন্ধ্যা বেলা সে রাজেন্দ্র ধুপ ধুনা নিয়ে।
আরতি করিল সেথা কান্দিয়ে কান্দিয়ে।।
একদিন এক মিয়া তাড়াইয়া দেয়।
তার পর সে রাজেন্দ্র সেখানে না যায়।।
এই ভাবে কিছুদিন গত হয়ে যায়।
উদ্দেশ্যে প্রণাম করি কান্দিয়া বেড়ায়।।
মা সাধনা মা সাধনা বলিয়া কান্দিত।
পাগলের মত প্রায় ঘুরিয়া বেড়াত।।
আর দিন স্বপনেতে কহিল সাধনা।
আমার জন্যেতে বাছা দুঃখ করিও না।।
সমাধি হইতে মোরে তুলিয়া আনিবে।
তোমার বাড়ীতে এনে যতনে রাখিবে।।
পরদিন কহিলেন রমণীর কাছে।
স্বপনেতে মা সাধনা আমাকে বলেছে।।
সমাধি হইতে মোরে তুলিয়া আনিবে।
আজি নিশি যাব তথা তুমি সঙ্গে যাবে।।
তাই শুনি তার নারী স্বীকার করিল।
নিশি যোগে দুই জনে তথায় চলিল।।
কোদাল সঙ্গেতে আর ঝুড়িটি লইল।
আধ আধ অন্ধকারে খুড়িতে লাগিল।।
উরু সম গর্ত করে খুজিয়া না পায়।
তাই দেখে তার নারী ক্রোধ ভরে কয়।।
তোমার এ পাগলামী কেমনে বুঝাই।
কেহ না দেখিতে চল ঘরে ফিরে যাই।।
তারপর দুইজনে ঘরে ফিরে এল।
ঘরে গিয়ে সে রাজেন্দ্র কান্দিতে লাগিল।।
ঘরের পিছন থেকে কহিল সাধনা।
শুন শুন বাছাধন আর কান্দিওনা।।
যেখানে কাটিলে মাটি তাহার দক্ষিণে।
বিঘাত প্রমাণ দুরে আছি সেই খানে।।
এই কথা দুই জন যখনে শুনিল।
কান্দিতে কান্দিতে তারা তথায় চলিল।।
কোদাল ধরিয়া মাটি কাটিল যখন।
সাধনার অস্থি গুলি পাইল তখন।।
যত্ন করি অস্থি গুলি ঝুড়িতে করিয়া।
মহানন্দে আসিলেন ঘরেতে ফিরিয়া।।
বাড়ী পরে অস্থি গুলি সমাধি করিল।
তারপর ঘর করি মাথাটি রাখিল।।
আসন পাতিয়া মাথা রাখিল যতনে।
সকাল সন্ধ্যায় পুজা করে এক মনে।।
এখনও সেই মাথা আসনেতে রয়।
শত শত মানুষেতে দেখিবারে যায়।।
অধম বিনোদ বলে আর কিবা চাও ।
সাধনা তারক প্রীতে হরিগুণ গাও।।
সূক্ষ্ম দেহে তারক
হরি-গুরুচাঁদ বন্দি যুগল চরণ।
আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।।
তারকচাঁদের গুণ কহন না যায়।
স্মরণ করিলে হয় প্রেমের উদয়।।
এমন সোনার ছবি জগতে আসিল।
হরিনাম প্রচারিয়া নিজদেশে গেল।।
সূক্ষ্মরূপে ঘুরিতেছে জগত ভরিয়া।
ভক্তি করে ডাকে যেবা দেখেন আসিয়া।।
তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন।
মন দিয়া শুন সবে করিব বর্ণন।।
শ্রী উপেন্দ্র নামে ছিল পাল মহাশয়।
রায়পুর বাড়ী ছিল শুন পরিচয়।।
লোহাগড়া থানা মধ্যে সেই গ্রাম হয়।
চৌদ্দশত ছয় সালে ঘটনা তথায়।।
সরল স্বভাব নিয়ে উপেন্দ্র চলিত।
মনে প্রাণে তারকেরে সে ভালবাসিত।।
মনে মনে হরিনাম করিত সদায়।
এই ভাবে চলিতেন পাল মহাশয়।।
ছেলে মেয়ে ছিল তার সোনার সংসার।
সংসারেতে অনটন নাহি ছিল তার।।
এক মেয়ে বিয়ে দিল কুন্দশী গ্রামেতে।
মাঝে মাঝে যাইতেন জামাই বাড়ীতে।।
সরল সহজ মনে বেড়াইত ঘুরে।
তারপর কি হইল বলিব সবারে।।
একদিন তার ছেলে লোহাগড়া গেল।
একটি নতুন ছাতা কিনিয়া আনিল।।
একশত বিশ টাকা ছাতাটির মূল্য।
ছাতাটিকে দেখে সবে আনন্দিত হলো।।
একদিন সে উপেন্দ্র ছাতাটিকে নিয়ে।
জামাই বাড়ীতে গেল আনন্দিত হয়ে।।
কুন্দশী গ্রামেতে ছিল জামাতার বাড়ী।
আনন্দেতে পথে চলে বলে হরি হরি।।
যখনেতে জয়পুর গ্রাম মধ্যে যায়।
তারকের ছবিখানি জাগিল হৃদয়।।
তারকের বাড়ী পার্শ্ব দিয়া সেই পথ।
সেই পথে সে উপেন্দ্র করে যাতায়াত।।
হাটিতে হাটিতে গেল তারকের বাড়ী।
মন্দিরে প্রণাম করে বলে হরি হরি।।
তারপর চলিলেন কুন্দশী গ্রামেতে।
আনন্দে উদয় হল জামাই বাড়ীতে।।
তথায় মধ্যাহ্ন ভোজ করি সমাপন।
অল্প বেলা করিলেন গৃহেতে গমন।।
হাটিতে হাটিতে যবে জয়পুর গেল।
তারকের মন্দিরেতে প্রণাম করিল।।
ছাতাটাকে তথা রেখে প্রণাম করিয়া।
পুনরায় করে যাত্রা করে ছাতা নিয়া।।
হাটিতে হাটিতে গেল কলাগাছি গ্রামে।
এমন সময় এল অন্ধকার নেমে।।
জলের পিপাসা হল এমন সময়।
রাস্তার পাশেতে এক কল দেখা যায়।।
রাস্তার পাশেতে সেই ছাতাটিকে রেখে।
টিউবলে জয় খায় মনের পুলকে।।
জল খেয়ে সে উপেন্দ্র গৃহ পানে ধায়।
মনের ভুলে ছাতাটিকে রাখিয়া তথায়।।
বাড়ী গিয়ে সে উপেন্দ্র হাত মুখ ধুয়ে।
গল্প কথা কহিলেন নাতি পুতি নিয়ে।।
তারপর রাত্রি বেলা ভোজন করিল।
হেন কালে তার ছেলে কহিতে লাগিল।।
ছাতা নিয়ে গেলে তুমি কুন্দশী গায়।
ছাতাটিকে দেখিনাত রাখিলে কোথায়।।
তাই শুনে সে উপেন্দ্র ভাবিল হৃদয়।
ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখে কোথাও না পায়।।
মনে মনে সে উপেন্দ্র ভাবিয়া না পায়।
ছাতা বুঝি রাখিয়াছি জয়পুর গায়।।
যখনেতে করি আমি মন্দিরে প্রণাম।
ছাতাটিকে তথা রেখে গৃহে আসিলাম।।
তাই ভেবে সে উপেন্দ্র কান্দিতে লাগিল।
কেন্দে কেন্দে তারকের কাছে নিবেদিল।।
তোমার মন্দিরে বাবা ছাতা রেখে আসি।
ছাতাটি হারিয়ে গেলে গলে দিব রসি।।
এই ভাবে কেন্দে কেন্দে করিল শয়ন।
গভীর নিদ্রায় সে যে হল নিমগন।।
প্রভাত হইল নিশি আধ অন্ধকারে।
কেহনা জাগিল সবে আছে ঘুম ঘোরে।।
তারক আসিয়া ডাকে দরজার ঠাই।
শুন শুন ও উপেন্দ্র তোমাকে জানাই।।
মোরে দোষী করে তুমি মরিতে চাইলে।
সেই জন্যে দু’টি কথা আমি যাই বলে।।
ছাতা রাখিয়াছ তুমি কলা গাছি গাঁয়।
ভুল করে চলে এলে রাখিয়া তথায়।।
সারানিশি তথা আমি প্রহরি হইয়া।
ছাতাটিকে রক্ষা করি সেখানে বসিয়া।।
এখন প্রভাত হলো শুন বাছাধন।
ছাতাটিকে নিয়ে এস করিয়া যতন।।
তাই শুনে সে উপেন্দ্র অতি ব্যস্ত হয়ে।
বাহিরে আসিল তিনি দরজা খুলিয়ে।।
বাহিরে আসিয়া দেখে আর কেহ নাই।
কোথায় লুকাল মোর তারক গোঁসাই।।
কান্দিতে কান্দিতে সে যে কালাগাছি গেল।
সেই খানে সেই ছাতা দেখিতে পাইল।।
ছাতাটিকে বুকে ধরে গড়াগড়ি যায়।
তারক তারক বলে কান্দিয়া ভাষায়।।
চারিদিকে হতে সবে আসিল তথায়।
শুনিয়া সকল কথা কান্দিয়া ভাষায়।।
কান্দিয়া বেনোদ বলে বেলা বেশী নাই।
তারক চাঁদের প্রীতে হরি বল ভাই।।
হরিচাঁদের নামের তরী
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।।
তাহার গুণের কথা কি লিখি কলমে।
বিনা বায় নৌকা চলে হরিচাঁদ নামে।।
অন্ধজনে চক্ষু পায় কালা কানে শোনে।
মহাব্যাধি মুক্তি পায় তাহার স্মরনে।।
তাহার নামের গুণে শমন পালায়।
অপুত্রকে পুত্র পায় তাহার কৃপায়।।
তেরশ ঊননব্বই সালে বারুণীতে।
দলে দলে হরি বোলা আসিল ধামেতে।।
বারুণীর স্নান মেলা করি সমাপন।
যার যার দেশে সবে করিল গমন।।
সে বৎসর দুর্যোগ হল অতিশয়।
ঝড় বৃষ্টি অনুক্ষণ বহিত সদায়।।
বোলতলী খোয়াঘাটে মতুয়ার গণ।
পার হইতেছে সবে আনন্দিত মন।।
পুবন বাতাস বহে অতি ঘোরতর।
হরি হরি বলে সবে হইতেছে পার।।
পশ্চিম কুলেতে এক নৌকা খানি ছিল।
হেন কালে এক দল তথায় আসিল।।
বরিশাল জেলা হতে সে দল আসিল।
বহু লোক দলে তারা নৌকায় উঠিল।।
নৌকার বোঝাই দেখে মাঝি ডেকে কয়।
এত লোক নিয়ে হবে পার করা দায়।।
একেত বাতাস ভারি ভীষণ তুফান।
মাঝ পথে ডুবে যাবে এই তরী খান।।
কিছু লোক নেমে গিয়ে কুলেতে দাঁড়াও।
পুনরায় মোর নায় পার হয়ে যাও।।
নৌকার মাঝির কথা কেহ ত শোনে না।
নৌকা হতে কেহ আর কুলেতে নামে না।।
তাই দেখে মাঝি বেটা দাড় বৈঠা খুলে।
পারিব না পারে যেতে আসিলেন কুলে।।
ডেকে বলে মাঝি বেটা মোর কথা লও।
পার যদি হরি নামে পার হয়ে যাও।।
তাই শুনে দলপতি হরিধ্বনি দিয়া।
তাহাদের সকলেরে কহিছে ডাকিয়া।।
শুনিয়াছি হরি নামে পারেতে ঠেকে না।
হরিনামে ডংঙ্কা মার বিপদ হবে না।।
তাই শুনে সবে মিলে হরিধ্বনি দিল।
যত ছিল জয় ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল।।
দলপতি মনু সাধু আগা নায় গিয়া।
হরি নাম করিতেছে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
বাজনার তালে তালে নৌকা খানি চলে।
স্বচক্ষে দেখিল সবে থাকি দুই কুলে।।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান।
দুই কুলে থাকি করে হরি গুণগান।।
ছুটিল প্রেমের বন্যা উভয়ে কিনারে।
হরি হরি বলে সবে ভাসে আখি নীরে।।
উজানেতে নৌকা চলে দাঁড়ি মাঝি নাই।
তাই দেখে দুই কুলে কান্দিছে সবাই।।
নৌকার ভিতরে যত হরি বোলা ছিল।
হরি হরি বলে সবে নাচিতে লাগিল।।
নাচিতে নাচিতে তরী বেগে চলিতেছে।
মনে হয় তরীখানি জীবন পেয়েছে।।
হরি নামে শীলা ভাসে অগাধ সলিলে।
আজ সেই হরি নামে এই তরী চলে।।
হরি বলে কেহ কেহ ঝাঁপ দিল জলে।
নৌকাখানি ধরিবারে সাতারিয়া চলে।।
এই ভাবে তরীখানি কুলেতে ভিড়িল।
শত শত হরিভক্ত আসিয়া মিলিল।।
দলপতি মনু সাধু তাহাকে ধরিয়া।
নাচিতে লাগিল সবে স্কন্ধেতে করিয়া।।
ধরাধরি করি সবে বাজারে চলিল।
বাজারেতে গিয়ে সবে কীর্তনে মাতিল।।
হরিনামে মহাশব্দ উঠিল গগনে।
হরি নামে মাতোয়ারা পড়ে ধরাসনে।।
কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়।
প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়ে বেড়ায়।।
কেহ কেহ নাচিতেছে দুই বাহু তুলি।
কেহ হরি হরি বলে গায় মাখে ধুলি।।
কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে হল অচেতন।
ভাষা দিয়ে কি লিখিব আমি অভাজন।।
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে সকলে মিলিয়া।
চাউল ডাউল আনে যোগাড় করিয়া।।
ভক্তি ভাবে সবে কিলে করিল রন্ধন।
মতুয়াগণেরে সবে করাল ভোজন।।
এই ভাবে সাত দিন মহানন্দ হয়।
যে দেখেছে তার মনে সে ভাব উদয়।।
হরি হতে নাম বড় ব্যাক্ত এ জগতে।
বোলতলী খেয়া ঘাটে দেখিনু চক্ষেতে।।
তাই বলি ভাই সব আর কিবা চাও।
হরিনামে তরী করে ভব পারে যাও।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
ভায়াবহ বন্যা
চৌদ্দশত সাত সালে দুরন্ত এ বন্যা।
ভয়ংকরী রূপে এল পাহাড়ীয়া কন্যা।।
উন্মাদিনী সম ধায় কল কল ধনী।
ত্রাসিত মানব কুল গ্রাসিল মেদিনী।।
উন্মত্ত যৌবন লয়ে ফুলাইয়া বুক।
ভাসাইয়া জন প্রাণী দেখিছে কৌতুক।।
দয়া নাই মায়া নাই পাষাণীর মেয়ে।
ধ্বংস করিবারে এল নদী খাল বেয়ে।।
গ্রাসিল ক্ষেতের শস্য আর বাড়ী ঘর।
সলিল সমাধি হলো আর কত নর।।
চারিদিকে হাহাকার কেন্দে ছাড়ে হাই।
বাঁচিবার ভরসায় বৃক্ষে নিল ঠাই।।
সে খানেও বাঁচিল না বিধির লিখন।
বিষধর সর্প এসে করিল দংশন।।
গো মহিষ ম’ল কত কে করে গণনা।
বন্য পশু ম’ল কত সাধ্য নাই জানা।।
এই ভাবে কত জন হারাল জীবন।
ভাষা দিয়ে কি লিখিব আমি অভাজন।।
কলার ভেলায় কেহ ভাসিয়ে বেড়ায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
কত শিশু জল স্রোতে ভাসিয়া বেড়ায়।
অকালেতে ম’ল তারা কি লিখি ভাষায়।।
শিশু ছেলে লয়ে কোলে কত নারী নর।
অতি কষ্টে ওঠে গিয়ে ছাদের উপর।।
কেহ কেহ দোতলায় নিয়াছে আশ্রয়।
মাচা করে আছে কত বাঁচিবার দায়।।
নাদায় ভরিয়া শিশু ছেড়ে দেয় জলে।
ভাসিতে ভাসিতে যায় কোন দেশে চলে।।
ঘরের চালেতে বসে বিড়াল কুকুর।
অনাহারে কান্দিতেছে মিলাইয়া সুর।।
মৃত প্রাণী ভেসে যায় হংসের আকার।
এদৃশ্য যায় না দেখা লিখিব কি আর।।
স্বামী হারা বিরহিনী কান্দিয়া বেড়ায়।
নারী হারা নর কত করে হায় হায়।।
সর্বস্য হারায়ে কেহ কেদে ছাড়ে হাই।
কি করিবে কোথা যাবে কোন ঠাই নাই।।
দিনাজপুর মালদা ঐ মুর্শিদাবাদ।
ভয়াবহ জল রাশি ঘটা’ল প্রমাদ।।
নদীয়ার জেলা সহ আর বর্ধমান।
উত্তর চব্বিশ পরগণা ভাসমান।।
বাকুড়া হুগলী আর বীরভূম সহ।
এই কয় জেলা হল বন্যা ভায়বহ।।
দুরান্ত রাক্ষসী বন্যা কোথা হতে এল।
মানুষের সব কিছু কেড়ে লয়ে গেল।।
বয়সে প্রাচীন দেশে আছে যারা যারা।
এতবড় বন্যা কেহ দেখে নাই তারা।।
এ দীন বিনোদ বলে ঈশ্বরের লীলা।
ভাঙ্গা গড়া যত কিছু তার সব খেলা।।
সমাপ্ত