পৃষ্ঠাঃ ৫২১-৫৪০
চতুরের শিরোমণি করে ছলা কলা।
কথা শুনে আর কিছু নাহি যায় বলা।।
নীরব গোপাল সাধু নীরব সকল।
গোপালের চক্ষে বারি করে টলমল।।
কোন কথা নাহি বলে সাধুজী বসিল।
দুই দিন ওড়াকান্দি বসিয়া কাটিল।।
মহাজ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস সুজন।
গোপালের পক্ষে বটে সেই একজন।।
তার কাছে মনোব্যাথা খুলিয়া বলিল।
কোন ভাবে দেশে তার আয়োজন হ’ল।।
কেন্দে কেন্দে বলে শেষে “বিশ্বাস ম’শায়!
লক্ষ্মীখালী বাবা যদি এবে নাহি যায়।।
কত যে বেদনা হ’বে সকলের প্রাণে।
তোমাকে সে ভাব আমি বুঝা’ব কেমনে?
বাবা যদি নাহি যায় আমি কি বাঁচিব?
কোন মুখে দেশে গিয়ে কোন কথা ক’ব?”
এতেক বলিয়া সাধু কান্দে কতক্ষণ।
যজ্ঞেশ্বর বলে “সাধু! সুস্থ কর মন।।
আমি দেখি চেষ্টা করে প্রভু কিবা কয়।
সুফল ফলিবে বলে মোর মনে হয়।।”
এদিকে গোপালে ডাকি প্রভু সর্বদায়।
বলে “গোপাল! আর কেন র’য়েছ হেথায়।।
শুধু শুধু এইখানে বসে না থাকিও।
দিন ক’ত পরে মোরে টাকা দিয়ে যেও।।”
তথাপি গোপাল নাহি ছাড়ে ওড়াকান্দি।
দিবারাত্রি যায় তার শুধু কান্দি কান্দি।।
হেনকালে একদিন কিছু রাত্রি হ’লে।
প্রভুর নিকটে গিয়া যজ্ঞেশ্বর বলে।।
“এক কার্যে কর্তা! আমি বুঝি না সন্ধান।
গোপাল গোঁসাই হেথা পড়ে থাকে কেন?
বারে বারে গৃহে যেতে তারে বলা হয়।
চুপ করে বসে থাকে ঘরে নাহি যায়।।
দিবানিশি দুই চোখে ঝরিতেছে জল।
বুঝি না এসব কান্না দিবে কোন ফল?
আমি বলি এক কথা বলে দিন তারে।
সুখী হ’য়ে ঘরে গিয়ে আসুক সে ফিরে।।”
কথা শুনে বলে তবে প্রভু দয়াময়।
“শুন হে আমার কথা বিশ্বাস ম’শায়।।
যত কিছু বল তুমি সব মানিলাম।
তোমার সঙ্গেতে তর্কে আমি হারিলাম।।
কোন কাজ হবে তাতে বল মোরে তাই।
মনের সঙ্গে বটে পারা যাওয়া চাই।।
মন যদি নাহি বলে কি করিবে তুমি।
মনের বিরুদ্ধে কাজ নাহি করি আমি।।
কথা কাটাকাটি করে কিবা হ’বে ফল।
তুমি বল দেশে ফিরে যাউক গোপাল।।”
এত যদি বলিলেন প্রভু ভাবময়।
নিরুত্তর যজ্ঞেশ্বর চুপ করে রয়।।
তবে ত’ গোপাল ছাড়ে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস।
ধূলিসাৎ হ’ল তার যত কিছু আশ।।
পরদিন প্রাতেঃ উঠি বিদায় মাগিল।
“কোন দুঃখ মনে তুমি কর না গোপাল।
এক ডুবে কেবা পায় সাগরের তল?
এবে বাড়ী যাও ফিরে সরল অন্তরে।
দেখা যাক হরিচাঁদ কি দিয়ে কি করে?”
প্রভুর বচনে তার নয়ন ঝরিল।
সঙ্গী সাথী সহ সাধু দেশেতে ফিরিল।।
এদিকে মিশেছে আসি সব ভক্তগণ।
প্রভুর কারণে সব উচাটন মন।।
কিছুই সংবাদ নাই ওড়াকান্দি হ’তে।
সকলে চাহিয়া শুধু রহে আশা পথে।।
হেনকালে সঙ্গীসহ আসিল গোপাল।
মলিন বদন তার চক্ষে বহে জল।।
ভক্ত সবে তারে ঘিরি বসিয়া রহিল।
সাহস করিয়া কেহ কিছু না কহিল।।
ক্ষণপরে চক্ষু মুছে কহিল গোপাল।
“কি আর বলিব মোর মন্দ যে কপাল।।
মম কর্ম দোষে প্রভু নাহি এল হেথা।
কোন মুখে বল আমি বলি সেই কথা।।
যদি না আসিল প্রভু কাঙ্গালের সখা।
বল কোন লাগি আর প্রাণ যা’বে রাখা?”
বিলাপ করিয়া সাধু পড়িল ধরায়।
শত শত ভক্ত কান্দে পড়িয়া ধূলায়।।
সে কি যে করুণ দৃশ্য কি দিব তুলনা।
এত কান্না কাঁদে নাই ব্রজের ললনা।।
এত কাঁদা কাঁদে নাই পতি হারা সতী।
রাজ্য হারা কাঁদে নাই এমন ভূপতি।।
পুত্র হারা মাতা কভু এত কাঁদে নাই।
ভাই হারা হয়ে এত কাঁদে নাই ভাই।।
নরনারী একাকার বাহ্যজ্ঞান হারা।
দলে দলে শবাকারে পড়ে আছে তারা।।
কে কা’রে তুলিবে ধরে সবে হতজ্ঞান।
সে কান্নায় গলে’ যায় কঠিন পাষাণ।।
কেন্দে কেন্দে সবে শুধু করে হায়! হায়!
কেন রে পাষাণ প্রাণ আর দেহে রয়?
কোন চক্রী খেলে চক্রী কেবা তাহা জানে?
ওড়াকান্দি কিবা হল বলিব এখনে।।
গোপাল কান্দিয়া তবে দেশে ফিরে গেল।
ভকতের দুঃখে প্রভু আপনি গলিল।।
কিছু পরে ডেকে বলে সেই যজ্ঞেশ্বরে।
“যজ্ঞেশ্বর! সে গোপাল গেছে নাকি ফিরে।।
কি জানি কি যজ্ঞেশ্বর এ হ’ল কেমন।
লক্ষ্মীখালী যেতে এবে চায় মোর মন।।
শীঘ্র করি ডেকে আন কুঞ্জ বিহারীরে।
এখনি চলিয়া যাক সোজা পথ ধরে।।
কোনখানে গোপালেরে যদি দেখা পায়।
ফিরা’য়ে আনুক তারে থাকুক যেথায়।।
আর এক কাজ তুমি কর মহাশয়।
শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ভক্ত যত এই দেশে রয়।।
সংবাদ পাঠাও তুমি সবার গোচরে।
লক্ষ্মীখালী যা’ব আমি নিয়ে সকলেরে।।”
এত যদি নিজ মুখে প্রভুজী বলিল।
দয়া দেখে যজ্ঞেশ্বর কতই কাঁদিল।।
তখনি কুঞ্জেরে ডেকে আনিল সেখানে।
প্রণাম করিল কুঞ্জ প্রভুর চরণে।।
প্রভু কয় “যাও কুঞ্জ! এখনি ছুটিয়া।
গোপাল সাধুরে আন’ এখানে ধরিয়া।।
বড় ব্যাথা পেয়ে ফিরে গিয়াছে গোপাল।
দেখ দেখি পাও নাকি তাহার নাগাল।।
যেথা দেখা পাও তারে সঙ্গেতে আনিবে।
লক্ষ্মীখালী যা’ব আমি নিশ্চয় জানিবে।।”
শ্রীগোপালের ভক্ত বটে কুঞ্জ একজন।
পূর্ব হ’তে জানে সেই সব বিবরণ।।
মনে মনে তা’তে দুঃখ ছিল বটে তার।
প্রভুর বাক্যেতে কেটে গেল অন্ধকার।।
আনন্দে চলিল কুঞ্জ ছুটিয়া ছুটিয়া।
একজন সঙ্গী সাথে নিল জুটাইয়া।।
ইতিপূর্বে লক্ষ্মীখালী কুঞ্জ যায় নাই।
পথে পথে জিজ্ঞাসায় দেরী হ’ল তাই।।
যে কালে সাধুজী গৃহে উপস্থিত হ’ল।
তার কিছু পরে কুঞ্জ লক্ষ্মীখালী গেল।।
দূর হ’তে শোনে যেন মহা গণ্ডগোল।
আকাশ ভেদিয়া ওঠে ক্রন্দনের রোল।।
মনে মনে ভাবে কুঞ্জ এ বাড়ী নিশ্চয়।
মানুষ মরেছে বলে কাঁদাকাটি হয়।।
কিন্তু যবে উপস্থিত হ’ল সেইখানে।
বড়ই আশ্চর্য কুঞ্জ মানিলেন মনে।।
কুঞ্জকে দেখিয়া সাধু আসিল ছুটিয়া।
আপনার করে তারে লইল ধরিয়া।।
বসিতে আসন দিল বহু যত্ন করি।
কুঞ্জ না বসিতে চায় আসন উপরি।।
ক্রমে ক্রমে কুঞ্জ বলে সব সমাচার।
শুনিয়া দ্বিগুণ সাধু কান্দিল এবার।।
সকলে ডাকিয়া কেন্দে বলিছে গোপাল।
“শুনেছে তোদের কান্না পরম দয়াল।।
তোরা ব্যথা পাবি বলে দেখ সাথে সাথে।
আপনি পাঠা’ল লোক অভাগারে নিতে।।
এমন দয়াল তোরা পাবি নাক আর।
পরম দয়াল বাবা গুরুচাঁদ আমার।।”
সাধুর বচন শুনে যত ভকতেরা।
উভরায় পুনরায় কাঁদে সবে তারা।।
হতাশে বিষাদে বটে পূর্বে কেন্দেছিল।
এখন সংবাদ পেয়ে আনন্দে কান্দিল।।
একদিন বটে সাধু গৃহেতে রহিল।
কুঞ্জের সঙ্গেতে পরে ওড়াকান্দি গেল।।
ওড়াকান্দি গিয়া পড়ে প্রভুজীর পায়।
দুই চোখে গোপালের অশ্রুধারা বয়।।
প্রভু বলে “আর নাহি কান্দ অকারণ।”
এইভাবে প্রভু বোঝে ভকতের মন।।
শ্রীগুরু চরিত কথা নাশে ভব ভয়।
অলঙ্ঘ্য প্রভুর বাণী মহানন্দ কয়।।
লক্ষ্মীখালী ও অন্যান্য ভক্তালয়ে গমন
গুরুচাঁদ আজ্ঞা করে, গোপালে আনিল ঘরে,
ভক্ত কুঞ্জ ঘৃতকান্দি বাসী।
এসে পরে ওড়াকান্দি, গোপাল উঠিল কান্দি,
প্রভু তবে বলিলেন হাসি।।
“কান্দ কেন অকারণ, কিসে বিষাদিত মন,
দুঃখে কেন কর তুমি ভয়।
ভক্তাধীন যেই জন, এই ভাবে বোঝে মন,
এই কথা জানিও নিশ্চয়।।”
অতঃপর দয়াময়, সকলে ডাকিয়া কয়,
“চল সবে যাই লক্ষ্মীখালী”।
সবে আনন্দিত তা’তে, নানা দিগ দেশ হ’তে,
এল সবে হয়ে কুতূহলী।।
মাধবেন্দ্র, যজ্ঞেশ্বর, থাকে ওড়াকান্দি ‘পর,
কুঞ্জ, মধু আছে ঘৃতকান্দি।
পাগল সে বিচরণ, বিপিন আর সনাতন,
ষষ্ঠীবাবু ঠিক যেন নন্দী।।
কেদার, কানাই দুই, কা’র সাথে কা’রে থুই,
অশ্বিনী গোঁসাই চলে সাথে।
কবিবর হরিবর, দুর্গাপুরে যার ঘর,
মধ্যপথে উঠিল তরীতে।।
পাটিকের বাড়ী ঘর, নামেতে রাজকুমার,
অক্ষয় মৃধার নাম জানি।
বেথুড়িয়া গ্রামে বাস, নামে প্রসন্ন বিশ্বাস,
সঙ্গে করে নিল গুণমণি।।
চলিল গোপাল রায়, বাড়ী মল্লকান্দি গাঁয়,
মান্যবান মহাধনী তিনি।
মল্লকান্দি বাসী যারা, সকলে মতুয়া তারা,
গ্রামভরা সবে বটে ধনী।।
এই মত কত জন, জ্ঞানে গুণে মহাজন,
লক্ষ্মীখালী করিলেন যাত্রা।
যত লোক বেশী হয়, গোপাল আনন্দ পায়,
আনন্দের নাহি যেন মাত্রা।।
প্রভুর তরণী ছাড়ে, দাঁড়িগণে টানে জোরে,
মাধবেন্দ্র বসিলেন হা’লে।
আসি টুঙ্গীপাড়া গাঁয়, দয়া করি দয়াময়,
তপস্বীর গৃহ’পরে চলে।।
কিছু কাল রহি সেথা, কতই মধুর কথা,
প্রভু সুখে করে আলাপন।
শ্রীদেবেন্দ্র বালা নাম, হরিভক্ত গুণধাম,
প্রভু সঙ্গে চলিল তখন।।
তথা হ’তে ছাড়ে তরী, সবে বলে হরি হরি,
মধুমতী নদী ধরি যায়।
গোস্বামী বিপিন যিনি, সুখে বাস করে তিনি,
নামে গ্রাম কেনুয়াভাঙ্গায়।।
বহু স্তুতি প্রভুজীরে, গোস্বামী করিল ধীরে,
গৃহে তার বহু আয়োজন।
তার ছিল ভক্ত যত, সবে হ’ল সমাগত,
বহু সংখ্যা লোক সংঘটন।।
প্রভু কয় “যেতে পারি, দিবে তুমি কত কড়ি,
ত্বরা করি বল তা’ আমারে।”
গোস্বামী কান্দিয়া কয়, “যত নিতে ইচ্ছা হয়,
দিব তা’তে কে ঠেকা’বে মোরে?
পুত্র পৌত্র কেহ নাই, তা’তে আমি সর্বদাই,
একা ঘরে আছি বড় সুখে।
তোমার দয়ার গুণে, বাধা নাই কোন খানে,
তা’তে আনি হেন কথা মুখে।।”
প্রভুজী উঠিয়া তীরে, চলিলেন ধীরে ধীরে,
দেখিলেন চাহি চারিধারে।
গৃহাবধি নদী হ’তে, বহু কলা গাছ পুঁতে,
রাজপথ সমপথ করে।।
গৃহ মধ্যে শ্বেতাসন, সাজা’য়েছে মহাজন,
তদুপরি প্রভুরে বসা’ল।
তাহার রমণী যিনি, সতীলক্ষ্মী বলে জানি,
ঘন ঘন হুলুধ্বনি দিল।।
প্রেমানন্দে মহোৎসব, করিল ভকত সব,
আনন্দের সিমা কিছু নাই।
গোস্বামী মহৎ অতি, এনে দিল শীঘ্র গতি,
শত টাকা শ্রীপ্রভুর ঠাই।।
প্রভুর নিকটে কয়, “পরে পরে দয়াময়,
ভক্তগণ হ’তে দিব টাকা।
বিলাতে প্রমথরঞ্জন, আমাদের হৃষ্ট মন,
তার ছবি এ হৃদয়ে আঁকা।।”
প্রভু বিপিনেরে কয়, “চল লক্ষ্মীখালী গায়,
এক সঙ্গে যাব সব জনে।”
প্রভুর বচন শুনি, চলিল বিপিন জ্ঞানী,
লক্ষ্মীখালী অতি হৃষ্ট মনে।।
প্রভুর তরণী তলে, মধুমতী নদী জলে,
হেনকালে তারাচাঁদ রায়।
আঁধার মাণিক ঘর, খুলনা জিলার পর,
সাধু ভক্ত সেই মহাশয়।।
আসিয়া নৌকার ধারে, বাহুড়ি তরণী ধরে,
দাড়ী যারা তারা ওঠে রেগে।
তারাচাঁদ হেসে কয়, “রাগ কেন মহাশয়,
সময়েতে সব-করা লাগে।।”
প্রভু তা’তে বলে ডাকি, “কে হে তারাচাঁদ নাকি?
চল যাই তোমার আঙ্গিণে।”
দাড়ীরা অবাক হয়, “এই তারাচাঁদ রায়,
আগে চিনি নাই মহাজনে।।”
আঁধার মাণিক এসে, তারাচাঁদের আবাসে,
সুখে প্রভু বঞ্চিলেন নিশি।
শ্রীনাথ মাতার ঘরে, প্রভু আসিলেন ঘুরে,
সম্মান দেখায় দেশবাসী।।
তথা হ’তে ছাড়ি তরী, ভৈরবের বক্ষ ধরি,
ক্রমে তরী মিস্ত্রীডাঙ্গা এল।
গণেশ মণ্ডল তায়, প্রেমানন্দে ঘাটে যায়,
করজোড়ে প্রভুকে বন্দিল।।
মহোৎসব আয়োজন, করিলেন সেই জন,
বহু শত লোক সংখ্যা হৈল।
বিলাতের চাঁদা বলে, টাকা দিল প্রভু স্থলে,
ধন্য ধন্য প্রভু তারে কৈল।।
নাম তার সোনারাম, বেতকাটা গ্রামে ধাম,
গোপালের মাতুল সেজন।
তিনি এসে কেন্দে কয়, দয়া করে দয়াময়,
তার গৃহে করিল গমন।।
স-গোষ্ঠী স-পরিবারে, প্রভুকে বন্দনা করে,
রাধাকান্ত, নিবারণ, রতি।
মহেন্দ্র উপেন্দ্র তায়, কয় ভাই সর্বদায়,
সাধু সেবা করে ইতি উতি।।
বিরজা মোহিনী দেবী, ভক্তিমতি পুণ্য ছবি,
“প্রভাতীর মাতা” পরিচয়।
প্রভুকে দর্শন করি, কত যে আনন্দ তারি,
মুখে তাহা বলা নাহি যায়।।
সোনারাম নিবারণ, রতি মিলে তিনজন,
টাকা দিল প্রভুর শ্রীকরে।
কান্দে আর টাকা দেয়, বলে ওগো দয়াময়,
পাই তোমা গোপালের জোরে।।
আমাদের ভক্তি নাই, শুভ কাজ করি নাই,
দয়া করে “শুভ” চিনাইলে।
এ বংশে আছেন যত, আসিবেন পরে যত,
সবে তুমি রেখ পদতলে।।”
শুনিয়া বিনয় বাণী, তুষ্ট প্রভু গুণমণি,
বলে “আর না করিব দেরী।
মন গেছে লক্ষ্মীখালী, কিবা আর কথা বলি,
মন মোর ব্যস্ত হ’ল ভারী।।”
ইহার কারণ যাহা, প্রত্যক্ষ বলিব তাহা,
ভাগ্যবতী কাঞ্চন জননী।
বিরলে বসিয়া মাতা, স্মরিয়া প্রভুর কথা,
অশ্রুজল ফেলে তাই জানি।।
যাবৎ না দেখা পান, পূর্ণব্রহ্ম গুরুচান,
নহে মাতা পরাণেতে সুখী।
সতীর ভক্তির টানে, প্রভু সুস্থ নহে মনে,
“চল” “চল” বলে থাকি থাকি।।
পাল্কী মধ্যে প্রভু যায়, ভক্তেরা বহিয়া লয়,
কিবা প্রেমানন্দ হ’ল মনে।
শত শত নর নারী, সবে বলে হরি! হরি!
নাম ধ্বনি উঠিল গগনে।।
ধীরে ধীরে পাল্কী চলে, শতে শতে দলে দলে,
নর প্রাণী সঙ্গে সঙ্গে যায়।
সে কি যে তরঙ্গ দোলা, মুখে কিসে যায় বলা,
অনুমানে বোঝা বড় দায়।।
ক্রমে লক্ষ্মীখালী বাসে, প্রভুর বাহিনী আসে,
সঙ্গে প্রভু আনন্দ মূরতি।
তুলিলেন যত্ন করে, ভক্তিপ্রেম অশ্রুনীরে,
কাঞ্চন জননী দেবী সতী।।
শ্রীহরি মন্দির ঘরে, বসাইল শ্রীপ্রভুরে,
পালঙ্ক উপরে শয্যা দিয়া।
গোপাল-কাঞ্চন দোঁহে, করজোড় করি রহে,
অশ্রুবারি পড়িছে ঝরিয়া।।
গোপালের মনোসাধ, পূর্ণব্রহ্ম গুরুচাঁদ,
মন্দিরেতে হ’বে অধিষ্ঠান।
বাঞ্ছাপূর্ণ হ’ল তার, তাই শত অশ্রুধার,
বক্ষে পড়ে সৃষ্টি করে বান।।
কাঞ্চন জননী পরে, নারীগণে সঙ্গে করে,
পূজা উপাচার সব আনে।
আনে ধূপ, আনে দ্বীপ, কুম্কুমের এক ঢীপ,
মিশা’য়ে দিল তা’ চন্দনে।।
পঞ্চ প্রদীপের বাতি, যেন মুকুতার পাঁতি,
ধান্য দূর্বা পদ্ম শতদল।
কুসুমের মালা করে, সাজা’ল তা থরে থরে,
কর্পূর-বাসিত আনে জল।।
সাজা’ল বরণ ডালা, যেন রে চন্দ্র মেখলা,
হীরা-গলা ভাতি দেখি তায়।
আহার্য আনিল যত, মুখেতে বলিব কত,
ফল মাত্রে বাকী নাহি রয়।।
আঙ্গুর বেদানা এল, আম, জাম, আতাফল,
বাদাম, পেয়ারা, আনারস।
পক্ক রম্ভা, পক্ক বেল, কটি সুমিষ্ট আপেল,
খণ্ড ইক্ষু ভরা মধুরস।।
সপেটা’ কাবুলী পেস্তা, দামে ভারী নহে সস্তা,
আখরোট আনিলেন কিছু।
বাংলার প্রধান ফল, কাঁচা ডাব ভরা জল,
দুই চারি ছড়া ছিল লিচু।।
কাঞ্চন জননী সতী, হ’য়ে দেবী একমতি,
নিজ হস্তে করিল প্রস্তুত।
পিষ্টকাদি ক্ষীর সাজ, রসভাজা পাটীসাজ,
চন্দ্রপুলি মিষ্টরস যুত।।
দুধ দিয়া পায়সান্ন, করিল প্রভুর জন্য,
ক্ষীর করে আনন্দিত চিতে।
কাঁচা মিষ্ট দু’ প্রকার, দধি করে চমৎকার,
সন্দেশ করিল নিজ হাতে।।
প্রভুর অগ্রেতে আনি, রাখিতেছে সে জননী,
করুণ নয়নে প্রভু চাহে।
ভক্তাধীন ভগবান, ভক্তপ্রতি চেয়ে র’ণ,
মুখে কোন কথা নাহি কহে।।
সকল আনিয়া পরে, করে দেবী উচ্চৈঃস্বরে,
হুলুধ্বনি মঙ্গল আরতি।
কেহ করে শঙ্খধ্বনি, স্বহস্তে সাজায়ে আনি,
জননী নাচায় পঞ্চবাতি।।
ঘণ্টা ধ্বনি করে পরে, ধরিয়া আপন করে,
দূর্বাপুষ্প দিল প্রভু পদে।
গৃহে কি বাহিরে সবে, ‘জয়’ দিল উচ্চরবে,
জননী পূজিল গুরুচাঁদে।।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ কর্তৃক লক্ষ্মীখালীতে কালীপূজা
“তারিণী দুর্গ সংসার সাগরস্যাচলোদ্ভবে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জাহি।।”
---- অর্গলা স্তোস্ত্রম (শ্রীশ্রীচণ্ডী)
পরদিন প্রাতঃকালে গোপালেরে ডাকি।
বলিছেন গুরুচাঁদ প্রভু কমলাখি।।
“মোর মনে এক ইচ্ছা হয়েছে গোপাল।
আয়োজন কর তাই সকাল সকাল।।
অদ্য দেখ অমাবস্যা অতি শুভ তিথি।
ঘরে ঘরে কালী পূজা হ’বে এই রাতি।।
আমরাও কালীপূজা করিব আজিকে।
আমাদের পূজা মাতা নিবেন পুলকে।।”
প্রভুর বচনে সবে পাইল আনন্দ।
কাঞ্চন জননী তা’তে তুলিলেন দ্বন্দ্ব।।
মাতা কয় “এই কার্য মনে নাহি লয়।
মতো’ বাড়ী অন্য পূজা কবে কোথা’ হয়?
অবশ্য প্রভুর বাক্য মান্য রাখি তার।
তবু এক ভাব মনে উঠেছে আমার।।
ইচ্ছাময় যাহা ইচ্ছা করিবারে পারে।
তাঁর ইচ্ছা মাঝে কেহ বাধা দিতে নারে।।
ভক্তের ভকতি শুধু প্রভুর উপরে।
প্রভু-ছাড়া ভক্ত নাহি চেনে আর কা’রে।।
সত্য বটে রামচন্দ্র পূজিল অম্বিকে।
কিন্তু ভক্ত হনুমান কোনভাবে থাকে।।
অম্বিকা দূর কথা নিজে কৃষ্ণধন।
হরিতে পারে না সেই হনুমান-মন।।
“শ্রীনাথো জানকীনাথো অভেদ পরমাত্মনি।
জীবন সর্ব্বস্ব মম শ্রীরাম কমললোচনঃ।।”
কালীপূজা করিবারে প্রভু করে মন।
সবে মিলি করি মোরা তার আয়োজন।।
কিন্তু কালীপূজা মোরা কিছুতে না করি।
আমরা পূজিব মাত্র গুরুচাঁদ হরি।।”
জননীর কথা শুনে দ্বিগুণ আনন্দ।
কাটিলা জননী তবে ভক্ত-মন-সন্দ।।
সবে মিলে আয়োজন করে দিন ভরি।
ইতোমধ্যে প্রভু এল আড়ংঘাটা ঘুরি।।
মণ্ডল শ্রীকালীচরণ নাম মহাশয়।
“ঠাকুর” বলিয়া তারে বহুজনে কয়।।
দয়া করি প্রভু তবে গেল তার বাড়ী।
পাদ্য অর্ঘ দিল আর দিল টাকা কড়ি।।
সন্ধ্যার পূর্বেতে প্রভু ফিরে লক্ষ্মীখালী।
কথা আছে পূজিবেন জগদম্বা কালী।।
সন্ধ্যাকালে হ’ল মহা নাম সংকীর্তন।
আনন্দে মতুয়া সব করিল নর্তন।।
পঞ্চ সহস্রাধিক হবে লোক পরিমাণ।
নেচে নেচে সবে তারা করে নাম গান।।
এদিকে দয়াল প্রভু মন্দিরে বসিল।
আলোকে ঝলকে যেন যামিনী হাসিল।।
সংকীর্তন হ’ল ক্ষান্ত বসে ভক্তগণ।
আরম্ভ করিল প্রভু পুরাণ কথন।।
নারী সবে বসিলেন মন্দির চত্বরে।
বসিলেন নর সবে ক্রমে পরস্পরে।।
কালীপূজা কথা প্রভু বলিছেন সুখে।
ঠিক যেন পঞ্চানন বলে পঞ্চ মুখে।।
শক্তিপূজা তত্ত্ব প্রভু করি নিরূপণ।
ডাক দিয়া বলে সবে “শুন ভক্তগণ।।
আদ্যাশক্তি মহামায়া জগত জননী।
খরখড়গ হস্তে যার অসুর নাশিনী।।
শক্তির আধার তিনি মনে জান’ সার।
হরিভক্তে রক্ষা মাতা করে অনিবার।।
শক্তিরূপে আছে মাতা সর্ব জীব দেহে।
কুণ্ডলিনী বলি তারে নর প্রাণী কহে।।
নিদ্রিতা আছেন মাতা আপন স্বভাবে।
জীবগণে রক্ষা করে তবে কোন ভাবে?
মাতার সেবিকা আছে ‘ভক্তি’ নামে নারী।
মাতারে জাগাতে মাত্র শক্তি আছে তারি।।
ভক্তিকে আশ্রয় যবে করে নর প্রাণী।
কুণ্ডলিনী শক্তি সেথা জাগেন আপনি।।
বাহিরে অসুর কোথা অসুর ভিতরে।
অসুর নাশিনী নাম কেন মাতা ধরে?
জীব-চক্রে সর্বদায় চলিতেছে রণ।
সুরাসুর দ্বন্দ্ব যাহা শোন বিবরণ।।
অশুভ মানবে ক্ষয় করিছে সদায়।
শুভ-শক্তি তাই তারে বাধা দিতে চায়।।
পরস্পর পরস্পরে বলে শুধু মন্দ।
মানব জীবনে এই সুরাসুর দ্বন্দ্ব।।
পুরাণে লিখেছে যত দেবতা নিচয়।
অসুর নাশিতে তারা পূজে চণ্ডিকায়।।
যোগনিদ্রামগ্ন মাতা দেবের ক্রন্দনে।
জাগিয়া অসুর নাশ করে মহারণে।।
মানব জীবনে আমি দেখি সেই ভাব।
রূপক করিয়া লেখা করিব স্বভাব।।
কুণ্ডলিনী শক্তি আছে মানবের দেহে।
নিদ্রিতা রয়েছে মাতা সবে তাই কহে।।
আধি ব্যাধি জরা-মৃত্যু সবার কারণ।
কুণ্ডলিনী শক্তি নাহি হয় জাগরণ।।
ভক্তিগুণে এই শক্তি জাগরূক হয়।
কুণ্ডলিনী জাগে যদি নাহি থাকে ভয়।।
সূর্য দরশনে যথা আঁধার পলায়।
অশুভ শক্তির নাশ সেই ভাবে হয়।।
ভক্তি যদি রাখ তবে শক্তি পাবে বুকে।
ভক্তিমানে রক্ষা করে আপনি অম্বিকে।”
করিলেন প্রভু আর বহু আলাপন।
গ্রন্থ বৃদ্ধি ভয়ে নাহি করিনু লিখন।।
প্রভু যবে করিলেন বাক্য সমাপন।
কাঞ্চন জননী পূজা করিল তখন।।
মঙ্গলা আরতি করে ধূপ দীপ জ্বালি।
চরণে চন্দন দিল ‘শিব’ ‘শিব’ বলি।।
চরণ বরণ করে দূর্বাদল দিল।
ধান্য দূর্বা এক সঙ্গে শিরেতে রাখিল।।
অবিরাম নারীগণে দিল হুলুধ্বনি।
কংশ, কাশ, ঝাঁঝ সঙ্গে বাজিল অমনি।।
নয়নের জলে দেবী বয়ান ভাষায়।
‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে আর কিছু নাহি কয়।।
পূজা সারি মহাদেবী প্রণাম করিল।
সঙ্গে সঙ্গে নরনারী মাটিতে পড়িল।।
পূজা অন্তে প্রভু ডেকে কহে গোপালেরে।
“এই পূজা ক’রো তুমি প্রত্যেক বছরে।।”
তদবধি লক্ষ্মীখালী কালীপূজা দিনে।
“ঠাকুর উৎসব” করে মিলি ভক্তগণে।।
তারপর দিনে হ’ল সভার শোভন।
এবে শুন বলি কিছু সেই বিবরণ।।
পর দিন হ’ল বটে সভা আয়োজন।
বাগেরহাটবাসী ছাত্র ছিল যতজন।।
পুরাণ বাজারে থাকি করে পড়াশুনা।
“হরি-গুরুচাঁদ” নামে করে উপাসনা।।
গোপালের বহু দয়া তাহাদের প্রতি।
মাঝে মাঝে সেইখানে করেন বসতি।।
দীন গ্রন্থকার ছাত্র ছিল একজন।
“দাদা” বলে ডাকে তারে সব ছাত্রগণ।।
ভক্তিমান সবে তারা তারে ভক্তি করে।
ভাগ্যহীন গ্রন্থকার ম’ল অহংকারে।।
কত যে মধুর স্মৃতি জাগে আজি মনে।
হায়! হায়! ভাই সব! আজি কোনখানে।।
কোথা ভাই শিবানন্দ! ভক্তিরসে পোরা।
অনুক্ষণ চোখে যার ছিল প্রেমধারা।।
গোপালচাঁদের প্রিয় ছিলে তুমি ভাই।
সেবা ধর্মে তব সম আর দেখি নাই।।
অকালে কালের কোলে পড়িলে ঝরিয়া।
আর কি তোমারে ভাই পাইব ফিরিয়া।।
ক্ষণিকের তরে এলে ক্ষণিক-অতিথি।
রেখে গেছে বুকে মোর মর্মভেদী স্মৃতি।।
শিবানন্দ যজ্ঞেশ্বর অতুল সুজন।
শ্রীযুত কুবের চন্দ্র সঙ্গী একজন।।
বড়ই তেজস্বী এই কুবের সুজন।
পবিত্র চরিত্রে তেহ আছে সর্বক্ষণ।।
বহু কষ্টে অধ্যয়ন করিল জীবনে।
শিক্ষক রূপেতে ছাত্র শিখায় এখনে।।
নিজ হাতে গড়িয়াছে কয়টি স্কুল।
সত্য ছাড়া মিথ্যা নাহি বলে একচুল।।
গোপালের কৃপা সদা আছে তার প্রতি।
দীন গ্রন্থকার সদা ছিল তার সাথী।।
পাঠকালে শ্রীগোপাল সাহায্য করিল।
মতুয়ারা বহুজনে বহু অর্থ দিল।।
এক শক্তি দেখি আমি মতুয়া ভিতরে।
মতুয়া মারিলে মারে জনমের তরে।।
একবার এই দলে যদি কেহ আসে।
দল-ছাড়া হ’লে কোন দলে নাহি মেশে।।
কতবার কতজনে আসে আর যায়।
ঘুরে ঘুরে কোথা গিয়ে শান্তি নাহি পায়।।
এইরূপ দেখি কত ঘটে সর্বদায়।
ফিরে ঘুরে এসে বসে আপন জাগা’য়।।
তাহার প্রমাণ এই দীন গ্রন্থকার।
শ্রীযুত কুবের বাবু একজন আর।।
গ্রন্থ-বৃদ্ধি ভয়ে আর অধিক না ক’ব।
মোট কথা ধন্য দেখি মতুয়ারা সব।।
লক্ষণ শরৎ ছিল ভাই দুইজন।
জগবন্ধু রায় আর শ্রীকান্ত সুজন।।
একসঙ্গে মিশি তবে এই ছাত্রগণ।
ছাপা’য়ে আনিল এক সু-অভিনন্দন।।
বহুলোক উপস্থিত হইল সভায়।
প্রথমে উঠিল ধ্বনি “গুরুচাঁদ জয়”।।
অভিনন্দন পাঠ করি প্রভু হস্তে দেয়।
গ্রহণ করিল তাহা গুরু দয়াময়।।
প্রভুর সঙ্গেতে জ্ঞানী ছিল যতজন।
বক্তৃতা করিল সবে অতি হৃষ্ট মন।।
নমশূদ্র জাতি কথা করে আলোচনা।
কার গুণে এ জাতির মিলিল নিশানা।।
ওড়াকান্দি কোন ধর্ম কিসে অবতার?
বলিল বক্তারা সবে করিয়া বিস্তার।।
সকলের বলা শেষে প্রভু বলে কথা।
অপূর্ব কাহিনী সব মধুর বারতা।।
প্রভু বলে “শোন সবে নমশূদ্রগণ!
ধর্ম শক্তি বিনা জাতি জাগে না কখন।।
এতকাল নমশূদ্র বল কোথা ছিল?
বল দেখি কার গুণে এ জাতি জাগিল।।
মম পিতা হরিচাঁদ ক্ষীরোদ ঈশ্বর।
ওড়াকান্দি এসে হ’ল পূর্ণ অবতার।।
দয়া করে এ জাতিকে দিল পদছায়া।
নমশূদ্র উদ্ধারিল করে বহু দয়া।।
যে যে কথা মোর কাছে তিনি বলে গেছে।
সেই কথা বলি আমি সকলের কাছে।।
বিদ্যা ছাড়া এ জাতির দুঃখ নাহি যা’বে।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালা কর তাই সবে।।
ধনহীন জনে দেখ নাহি কোন মান।
সৎপথে কর সবে ধনের সন্ধান।।
“বাণিজ্যে বসতেলক্ষ্মীঃ” শাস্ত্রে তাই কয়।
বর্তমানে সবখানে পাই পরিচয়।।
বাণিজ্য কারণে সব দেশে দেশে যাও।
যথা তথা হ’তে আন যত ধন পাও।।
কৃষিকার্যে কভু কেহ করিও না হেলা।
মদ গাঁজা খেয়োনারে ছাড় জুয়া খেলা।।
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে ‘‘মা’র গুণে ভাল হয় ছা’ও’।।
পবিত্র চরিত্র থাক সব নরনারী।
মিথ্যা কথা বলিও না করিও না চুরি।।
ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু সব হ’বে নষ্ট।
ধন মান সব যা’বে হবে মহাকষ্ট।।
দেবতা-মন্দির সবে গড়’ ঘরে ঘরে।
নিত্য পূজা কর সেথা সরল অন্তরে।।
এইখানে আমি বলি এক সমাচার।
দেবতা-মন্দিরে পূজা করিবে কাহার?
বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।
ক্ষত্র গণে রামচন্দ্র রক্ষা করেছিল।
রামকে ঈশ্বর বলি ক্ষত্রিয় মানিল।।
খ্রিষ্ট আসি জনমিল খ্রিষ্টানের ঘরে।
যতেক খ্রিষ্টান তারা তাঁর পূজা করে।।
এইরূপ খ্রিষ্ট কৃষ্ণ কিংবা মুহম্মদ।
বিভিন্ন জাতির তারা পরম সম্পদ।।
তোমাদের এই কুলে হরি অবতার।
দয়া করে নমশূদ্র করিল উদ্ধার।।
তাঁর পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।
নিজ ঘরে ভগবান ফেলে কোথা যাও?
বাল্যকালে পুত্র কন্যা বিয়া দিবে।
পথঘাট ঘর দ্বার পবিত্র রাখিবে।।
একা একা যথা তথা নারী নাহি যাবে!
পতি ভিন্ন অন্য নর স্পর্শ না করিবে।।
অলসতা ত্যাগ করে কর্মী সাজা চাই।
অলসের ঘরে অন্ন নাহি থাকে ভাই।।
বিবাহ শ্রাদ্ধেতে সবে কর ব্যয় হ্রাস।
শক্তির চালনা সবে রাখ বার মাস।।
আত্মরক্ষা শক্তি সবে অবশ্য রাখিবে।
অগ্রভাগে কভু কা’রে আঘাত না দিবে।।
বিদ্যার কারণে দান দানের প্রধান।
বিদ্যাহীন নর দেখ পশুর সমান।।
ঘরে ঘরে এম.এ. বি.এ. হোক ছেলেমেয়ে।
চাকুরী করুক সবে আনন্দিত হ’য়ে।।
কিন্তু মোরা নাহি হ’ব গোলামের জাতি।
চিরকাল হাল গরু রাখ, সবে সাথী।।
হাল গরু ছাড়া কিন্তু বুদ্ধি সর্বনাশ।
সকলের রক্ষা কর্তা হাল-চষা চাষ।।
কৃষিকার্য ছিল পূর্বে আর্য ব্যবসায়।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ সবে ভুলে গেছে হায়।।
তাহারা যাদের প্রজা সে ইংরাজ জাতি।
হাল গরু আছে তাঁর যিনি লক্ষ পতি।।
বিদ্বান হইলে চাষা ফল পাবে বেশী।
করজোড়ে ক’বে কথা সকলেই আসি।।
তবে যে চাকুরী করা লাগে কি কারণ?
শোন সবে বলিতেছি সেই বিবরণ।।
দেশের শাসন যন্ত্র যে যে ভাবে চলে।
কিছু নাহি বোঝা যায় চাকুরী না পেলে।।
তা’তে বলি রাজকার্যে ভাগী থাকা চাই।
সকলে চাকুরী লবে তাহা বলি নাই।।
শক্তি না থাকিলে কেহ করে না সম্মান।
শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান।।
‘নমশূদ্র বীর জাতি’ হোক পরিচয়।
বিলাস ব্যাসনে তাহা সম্ভব না হয়।।
সহজ জীবন পথে চলিবে সকলে।
দুর্বলতা থাকে কিন্তু বিলাসিতা কোলে।।
“গড়া-সিদ্ধ চাল খাও চাটায়ে শয়ন।
সে বীর্যে জন্মিবে যত তেজস্বী নন্দন”।।
অধিক বক্তৃতা আমি কি করিব আর?
“যথা ধর্ম তথা জয়” এই জান সার।।”
প্রভুর বচন শুনি যাহারা সভায়।
বারে বারে বলে সবে “গুরুচাঁদ কী জয়।।”
তিমির বসনে ধরা ঢাকে নিজ অঙ্গ।
হেনকালে হ’ল সেই মহা সভা ভঙ্গ।।
প্রেমানন্দে প্রভু সেথা রজনী বঞ্চিল।
পরদিন শুভ প্রাতে বিদায় মাগিল।।
বিদায় মাগিয়া প্রভু চলিল পশ্চিমে।
কোথা কোথা যায় প্রভু বলি ক্রমে ক্রমে।।
শ্রীগুরু চরিত কথা সুধা-হতে সুধা।
পিও সবে বিশ্ববাসী যাবে ভব ক্ষুধা।।
বিভিন্ন ভক্তালয়ে ভ্রমণ
লক্ষ্মীখালী ছাড়ি পরে, তরণী চলিল ধীরে,
ভোলা নদী ধরি তরী ধায়।
মাদুর পাল্টার মাঝ, উপাধিতে কবিরাজ,
সেই গৃহে মহাপ্রভু যায়।।
শ্রীমধুসূদন নামে, কর্তা যিনি সেই ধামে,
করজোড়ে প্রভুকে বন্দিল।
শ্যাম সখী দুই ভাই, মনে কোন দ্বিধা নাই,
বিলাতের চাঁদা আনি দিল।।
তথা হ’তে তরী চলে, কিছুকাল গত হ’লে,
দিগরাজবাসী নিবারণ।
উপাধিতে হালদার, বহু জমি জমা তার,
চারি ভাই সবে একমন।।
গোপালেরে গুরু বলে, তাহা সবে মান্য করে,
পূর্বে তাহা করেছি লিখন।
কান্দিয়া প্রভুকে লয়, সেই চারি মহাশয়,
প্রভু তা’তে হ’ল তুষ্ট মন।।
প্রভু আগ্মনে তারা, হ’ল যেন জ্ঞানহারা,
বাহ্যস্মৃতি যেন কিছু নাই।
বহু মাছ পুকুরেতে, পুষেছিল যতনেতে,
জানি যাহা তাহা লিখে যাই।।
বড় কর্তা নিবারণ, বলে “তোরা সবে শোন,
জাল দিয়ে মাছ ধর এসে।
হেন দিন পাবি নারে, সব মাছ মেরে দেরে,
চুপ করে থাকিস নারে বসে।।”
বড়কর্তা আজ্ঞা দিল, সকলে নামিল জলে,
বহু মাছ লাগিল ধরিতে।
মাধবেন্দ্র দেখে তাই, বলে “কিবা কর ভাই,
এত মাছ তোল কোন মতে?”
কহিতেছে নিবারণ, “শুন বলি মহাজন,
হেন দিন আর নাহি পাব।
প্রভুর সেবার তরে, সব মাছ দিব ধরে,
দিন পেয়ে কেন ছেড়ে দিব।।”
মাধবেন্দ্র বলে “ভক্ত! কথা বলিয়াছ শক্ত,
কিন্তু আমি এক কথা বলি।
সব যদি দাও ধরে, উপায় কি হবে পরে,
আসে যবে মতুয়া সকলি।।
হরিভক্ত সেবা তরে, রাখ কিছু যত্ন করে,
এক দিনে সব মার কেন?
ভক্ত পেলে হরি পায়, ভক্তে খেলে হরি খায়,
এই তত্ত্ব সত্য বলে জান।।”
মাধবেন্দ্র যাহা বলে, তাহাতে সুফল ফলে,
মাছ ধরা হল পরে বন্ধ।
মহোৎসব হ’ল ভারী, সবে বলে হরি হরি,
প্রভু সেথা পাইল আনন্দ।।
পরে নিবারণ গুণী, বিলাতের চাঁদা আনি,
প্রভুর শ্রীকরে করে দান।
তথা হ’তে ছেড়ে তরী, কিছুদূর অগ্রসরী,
বুড়বুড়ে গ্রামে প্রভু যান।।
মহাসাধু ইষ্ট-নিষ্ঠ, গোপালের শিস্য শ্রেষ্ঠ,
নামে সাধু শ্রীপূর্ণ চরণ।
লেংটি করে বহির্বাস, চলে সাধু বারমাস,
গুরু-পদে আত্মসমর্পণ।।
‘ওঃ হরি’ ‘ওঃ হরি’ বলে, চোখে ধারা বেয়ে চলে,
ছলাকলা কিছু নাহি জানে।
গোপালের বাক্য বিনা, কিছু করিতে জানে না,
তার চিন্তা শয়নে স্বপনে।।
নিতান্ত দরিদ্র ছিল, গোপালের দয়া পে’ল,
দিনে দিনে লক্ষ্মী এল ঘরে।
দয়া করি দয়াময়, সেই গৃহ পরে যায়,
আহারাদি তথা প্রভু করে।।
পূর্ণ চাঁদ সাধু পাকা, আনিয়া পঞ্চাশ টাকা,
চাঁদা দিল প্রভুর চরণে।
সবে ডেকে প্রভু কয়, “দেখ দেখ মহাশয়,
লেংটি-পরা সর্বনীতি জানে।।”
তথা হ’তে দয়াময়, কাইনমারিতে যায়,
মহিম মণ্ডল যেথা রয়।
মহাধনী মহাশয়, “গোপালের পদাশ্রয়,
আছি মোরা” সেই কথা কয়।।
কিছু কিছু পরিচয়, এখানে বলিতে হয়,
গুরুচাঁদ যাহা শিক্ষা দিল।
পূর্বে নমশূদ্র মাঝে, যদিও এক সমাজে,
ইতি উতি ভিন্নভাব ছিল।।
নানা ভাবে পরিচয়, দিত তারা সর্বদায়,
কেহ ‘ধানী’ কেহ বা ‘শেফালী’।
ভিত্তিহীন এই ভেদ, সমাজের অঙ্গচ্ছেদ,
দেখিত না কেহ চক্ষু মেলি।।
প্রভু গুরুচাঁদ তায়, ডাক দিয়া সবে কয়,
“ওরে অন্ধ! কি করেছ বসে?
আপনার অঙ্গ কেটে, যেতে তুমি চাও হেটে,
এই বুদ্ধি জোটাইলে শেষে।।
নমশূদ্র দুই নয়, এক জাতি সর্বদায়,
একদেহ এক মন প্রাণ।
দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে কে রে? রেখেছে পৃথক করে,
ভেঙ্গে ফেল ভেদের পাষাণ।।”
প্রভুর আদেশ পেয়ে, মতোরা চলিল ধেয়ে,
শ্রীগোপাল পথ দেখাইল।
মহিমের ভ্রাতুষ্পুত্র, শুন বলি সেই সূত্র,
এক কন্যা তারে বিয়া দিল।।
‘ধানী’ বলি পরিচয়, মহিম মণ্ডল কয়,
প্রভু বলে “আর নাহি বল।
নমশূদ্র এক সবে, কেন দুই কথা ক’বে,
এক মনে এক ভাবে চল।।”
মহিম মণ্ডল একা, দিল একশত টাকা,
প্রভু তাহে বহু তুষ্ট হ’ল।
তরী ছাড়ি পুনরায়, উত্তর মুখেতে ধায়,
রমণীর গৃহেতে পৌছিল।।
বসতি হুকুড়া গ্রাম, রমণী গোঁসাই নাম,
শক্তিমন্ত সাধু অতিশয়।
ভক্তিগুণে গুরু চান, তাহার গৃহেতে যান,
এক রাত্রি রহিল তথায়।।
বিলাতের চাঁদা বলে, আনিয়া প্রভুর স্থলে,
রমণী গোঁসাই দিল টাকা।
তথা হতে দয়াময়, রোমজাইপুর যায়,
গ্রামখানি ছায়াতলে ঢাকা।।
শ্রীগুরু চরণ রায়, পূর্বেতে তাপালি কয়,
প্রভু বলে “ইহা ভাল নয়।”
“তাপালি” উপাধি ফেলে, বলে “রায়” কুতূহলে,
যেই মত প্রভু আজ্ঞা দেয়।।
ভ্রাতার নন্দন তার, পঞ্চানন নাম যার,
কেহ কেহ বলে পঞ্চানন।
হ’য়ে নামেতে বিভোল, উপাধি পায় পাগল,
“পাগল দা” বলে সর্বজন।।
তার কীর্তি আছে যাহা, পশ্চাতে বলিব তাহা,
এবে বলি মূলসূত্র ধরে।
প্রভু সেই বাড়ী যায়, বিলাতের চাঁদা দেয়,
খুড়া ভাইপো এসে একত্তরে।।
পাগলের গৃহ কাছে, একটি ভকত আছে,
তার নাম জানি ধনপতি।
প্রভুর অপূর্ব খেলা, করিল আশ্চর্য লীলা,
সেই গৃহে জগতের পতি।।
পাগলের বাড়ী হ’তে, ভকতগণের সাথে,
প্রভু যাত্রা করে বড়দিয়া।
ধনপতি মনে ভাবে, প্রভুকে গৃহেতে নিবে,
বিলাতের চাঁদা দিবে দিয়া।।
সেই ভাবে বাড়ী যায়, ফিরে এসে দেখে হায়,
প্রভু চলে গেছে নদী পারে।
দারুণ বেদনা পেয়ে, মাটিতে পড়িল শুয়ে,
অঝোরে নয়নে অশ্রু ঝরে।।
সহজ সরল হ’লে, অনায়াসে হরি মে’লে,
প্রমাণ হইল তাহা সেথা।
ধনপতি পড়ে কান্দে, সেই কথা গুরুচান্দে,
কেহ আসি জানায় বারতা।
প্রভু কয় “নাহি ভয়, যাব আমি সুনিশ্চয়,
সুস্থ্য হ’তে বল গিয়া তারে।”
সেই সমাচার পেয়ে, ধনপতি এল ধেয়ে,
উপস্থিত হ’ল নদী ধারে।।
বড়দিয়া কেনারাম, প্রভু গেল তার ধাম,
বিলাতের চাঁদা তেহ দিল।
প্রভু তবে পুনরায়, রোমজাইপুর যায়,
ধনপতির বাসনা পুরিল।।
তথা হ’তে বাঁশতলী, চলিলেন তরী খুলি,
শ্রীমন্ত বিশ্বাস বলি নাম।
মাধবের এক কন্যা, ‘প্রভাতী’ নামেতে ধন্যা,
বিয়া সেথা দিল গুণধাম।।
ভক্তিগুণে দয়াময়, একরাত্রি তথা রয়,
পরদিনে গেল খেগড়া ঘাট।
প্রসন্ন বলিয়া নাম, সেইখানে তার ধাম,
তরী আসি লাগে তার ঘাট।।
প্রসন্নের ছোট ভাই, জয়চাঁদ জানি তাই,
গোপালচাঁদের পদানত।
ঠাকুরদাস, রজনী, দুই ভাই আছে জানি,
হরিনাম করে অবিরত।।
একরাত্রি থেকে সেথা, গুরুচাঁদ বিশ্বপিতা,
চৌমোহনা নামে গ্রামে গেল।
শুদ্ধ শান্ত ভক্তিমন্ত, নাম তার লক্ষ্মীকান্ত,
জমিজমা পূর্বে বহু ছিল।।
দয়া করি দয়াময়, তাহার গৃহেতে যায়,
বসে প্রভু গৃহের ভিতরে।
সোনার মোহর দিয়া, প্রণাম করিল গিয়া,
লক্ষ্মীকান্ত অতি ভক্তিভরে।।
তা’তে প্রভু ডেকে কয়, “এই ব্যক্তি মহাশয়,
রাজ-ব্যবহার বটে জানে।
এ ভাবে সম্মান মোরে, অন্য কেহ কোথাকারে,
করে নাই এই বাদাবনে।।”
এ ভাবে দক্ষিণ দেশ, ভ্রমণ হইল শেষ,
ওড়াকান্দি প্রতি প্রভু চলে।
সঙ্গে তার সর্বদায়, গোপাল সাধুজী রয়,
বক্ষ সদা ভাসে অশ্রুজলে।।
কাথলীর নিবারণ, ভক্ত সাধু একজন,
তার গৃহে চলিল ঠাকুর।
সেই দেশে যত ছাত্র, ঠাকুরে দেখিয়া মাত্র,
আনন্দে হইল ভরপুর।।
তারা সবে সভা ক’রে, যথাযোগ্য ব্যবহারে,
শ্রীঠাকুরে জানাল প্রণতি।
সেই সভা করি শেষ, গুরুচাঁদ হৃষীকেশ,
চলিলেন মাটিয়ার গাতি।।
সাধু সেথা মৃত্যুঞ্জয়, প্রভু তার গৃহে যায়,
তথা হ’তে পৌছিল কেন্দুয়া।
ঈশান নামেতে রয়, সেথা এক মহাশয়,
হরিভক্ত সেই যে মতুয়া।।
প্রভু তার গৃহে গেল, কিছু কাল কাটাইল,
পরে গেল গাওলার গাঁয়।
রামচাঁদ জলধর, ভজন, অনন্ত আর,
সেই গৃহে মহাপ্রভু যায়।।
মথুর বিশ্বাস নাম, হাড়ীদহে যার ধাম,
নিবারণ হ’ল যার গুরু।
কেন্দে এসে পড়ে পায়, প্রভু কৃপা করে তায়,
ঘরে পেল বাঞ্ছাকল্পতরু।।
ধন্য সাধু ধনঞ্জয়, বাস ছিল পাতলায়,
এ সময় তিনি বেঁচে নাই।
তার পুত্র নারায়ণ, করে বটে আয়োজন,
সেথা গেল জগত-গোঁসাই।।
পাতলা ছাড়িয়া পরে, সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে করে,
ধাম প্রতি গুরুচাঁদ ধায়।
ধামে যবে উপস্থিত, গাহিল মঙ্গল গীত,
প্রীত মনে যত মতুয়ায়।।
সঙ্গী যারা পরে পরে, বিদায় গ্রহণ করে,
সর্বশেষে চলিল গোপাল।
শ্রীগুরুচাঁদের তরী, ঘুরে গেল দেশ ভরি,
মহানন্দ পেল না নাগাল।।
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদের ১৩৩৪ সালের ভ্রমণ
পারশুলাবাসী সাধু শ্রীহরি মোহন।
শ্রীহরিবরের শিস্য জানি সেই জন।।
ভারীদেহ ভারীদেল বড় ঘর বাড়ী।
ঠাকুর বলিয়া ক্রমে সব দিল ছাড়ি।।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা ছিল অতিশয়।
তার ভক্তিগুণে প্রভু তার বাড়ী যায়।।
তেরশ’ চৌত্রিশ সালে সময় হইল।
হরি মোহনের বাড়ী মহাপ্রভু গেল।।
এবে শুন সঙ্গে গেল কোন কোন জন।
ক্রমে ক্রমে বলিতেছি সেই বিবরণ।।
ষষ্ঠীবাবু বলি নাম অতি মহাশয়।
পাটকেলবাড়ী ধাম জানি পরিচয়।।
কৃষ্ণপুরবাসী ভক্ত সনাতন গোঁসাই।
বিপিন, কেদার, শ্যাম, বলাই, কানাই।।
মাধবেন্দ্র, বিচরণ, নারায়ণ বালা।
আপনি গোপাল রায় সঙ্গে করে মেলা।।
দুর্গা, রাই, বনমালী এই কয় জন।
ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে করিল গমন।।
ওড়াকান্দি হ’তে যাত্রা করিয়া ঠাকুর।
উপনীত হইলেন গোপীনাথপুর।।
দুর্গাচরণের বাড়ী গেল দয়াময়।
হেনকালে মাধবেন্দ্র দুঃসংবাদ পায়।।
পুত্রের অসুখ তার হইয়াছে বেশী।
এ সংবাদ বলে সেথা কোন লোক আসি।।
শ্রুতমাত্র শ্রীঠাকুর মাধবেন্দ্র কয়।
“শীঘ্র করি গৃহে তুমি যাহ মহাশয়।।”
দ্রুতগতি মাধবেন্দ্র গৃহেতে ফিরিল।
কমেছে পুত্রের ব্যাধি আসিয়া দেখিল।।
গোপীনাথপুর হ’তে প্রভু দয়াময়।
সূচীডাঙ্গা গ্রামে আসি হইল উদয়।।
বিজয় ডাক্তার সেথা বহু ভাগ্যবান।
তার গৃহে দয়াময় হ’ল অধিষ্ঠান।।
কমিল পুত্রের ব্যাধি তা’তে মাধবেন্দ্র।
সেই বাড়ী এসে ধরে ঠাকুরের সঙ্গ।।
হৃদয় ডাক্তার যার বড়দিয়া বাস।
জাতিতে মাহিষ্য তিনি উপাধিতে দাস।।
পতি পত্নী দুই জনে পুত্র কন্যা নাই।
প্রভুকে মানিল দোঁহে জগত গোঁসাই।।
বড়দিয়া বন্দরেতে তরণী ভিড়িল।
হৃদয় ডাক্তার আসি প্রভুকে বন্দিল।।
হৃদয়ের সাধ্বী পত্নী অতি ভক্তিমতী।
গুরুচান্দে মান্য করে জগতের পতি।।
বাৎসল্য স্নেহরসে ভক্তি মিশাইয়া।
পূজিলেন গুরুচাঁদে পরাণ ভরিয়া।।
কত শক্তি ধরে দেবী শুন মহাশয়।
একা একা সব দিকে আপনি সামলায়।।
মতুয়ার জন্য রান্না করে একধারে।
তারি মধ্যে আসে সদা ঠাকুরের ধারে।।
আপনার হাতে মুখে খাদ্য তুলি দেয়।
ভক্তিগুণে বাধ্য হ’য়ে প্রভু তাহা খায়।।
জননীর মত স্নেহে প্রভুকে খাওয়ায়।
সোনার অঙ্গুরী দিয়ে প্রণমিল পায়।।
হৃদয় ডাক্তার দিল গরদের জোড়।
প্রণামী পঞ্চাশ টাকা প্রেমে হ’য়ে ভোর।।
প্রণামী চল্লিশ দিল তার সতী নারী।
ভক্তিগুণে দয়াময় তুষ্ট হ’ল ভারী।
পরদিন সুপ্রভাতে বিদায় হইয়া।
ভাউড়ীর চরে প্রভু উপস্থিত গিয়া।।
সেথা হ’তে শ্যামলাল ডাকি প্রভু কয়।
“হেথা হ’তে আমি বটে যা’ব পদুমায়।।
অগ্রভাগে সমাচার বল গিয়া তুমি।
পর পর সেই খানে আসিতেছি আমি।।”
সংবাদ পাইয়া সবে গ্রাম পদুমায়।
বহু মতে আয়োজন করিল তথায়।।
এ সময় যাদব মল্লিক বেঁচে নাই।
তারে মনে করে প্রভু সেথা গেল তাই।।
তথা হ’তে লোহারগাতী যাদবের বাড়ী।
যাদব প্রভুকে ডাকে বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।
শ্রীউমাচরণ নামে খামার বসতি।
বিশ্বাস উপাধি তার বুদ্ধিমান অতি।।
বহু যত্নে গুরুচান্দে তার গৃহে লয়।
মহানন্দে মহোৎসব সেই বাড়ী হয়।।
কুড়ি ডঙ্কা এক সঙ্গে বাজাইল সবে।
ঠাকুরের আগমনে বিরাট উৎসবে।।
কোন ভাবে দয়াময় কা’রে দয়া করে।
সামান্য মানবে তাহা বুঝিতে না পারে।।
বৈরাগী ভিক্ষুক মাত্রে প্রভু করে রোষ।
ভিক্ষা দে’য়া বলে প্রভু গুরুতর দোষ।।
মতুয়ার বাড়ী দেখি সেই নীতি চলে।
মতুয়ারা ভিক্ষা নাহি দেয় কোনকালে।।
খামারের এই বাড়ী প্রভু যবে এল।
দুটি পুত্র সহ এক নারী সেথা গেল।।
অতি দীনা সেই নারী ভাবে বোঝা যায়।
ঠাকুরের কাছে গিয়ে কেন্দে কেন্দে কয়।।
বড়ই অভাগী আমি ভিক্ষা করে খাই।
দয়া করে দেখ মোরে ঠাকুর গোঁসাই।।
নারীকে দেখিয়া প্রভু এক টাকা দিল।
বলে “যা’রে আজ হ’তে দুঃখ ঘুচে গেল।।”
এবে সেই নারী আর তার দুই পুত্র।
আছে ভালো অভাবের চিহ্ন নাই মাত্র।।
তথা হ’তে নদী পারে গ্রাম মির্জাপুর।
সেই গ্রামে উপনীত দয়াল ঠাকুর।।
কালিয়ায় যাদবের বাড়ী ঘুরে এসে।
লোহারগাতীতে প্রভু আসিলেন শেষে।।
রাম নারায়ণ ঢালী অতি মহাশয়।
তার গৃহে আহারাদি করে দয়াময়।।
যাদবের ভ্রাতা বলে মহাপ্রভু ঠাই।
“এক কথা দয়াময় বলিতে যে চাই।।
কালিয়ার বৈদ্যজাতি বড়ই সম্ভ্রান্ত।
ধনে জনে কোন দিকে নাহি কোন অন্ত।।
এই ইচ্ছা তারা সবে করেছে প্রকাশ।
আপনাকে নিতে চায় তাহাদের পাশে।।
পাঁচ শত টাকা চাঁদা তারা দিতে চায়।
একবার দয়া করে চলুন তথায়।।”
প্রভু কয় “নয়, নয়, এসময়ে নয়।
রাজা রাজড়ার বাড়ী আর দেরী নয়।।
কাঙ্গাল জাতির জন্যে আমি আসিয়াছি।
কাঙ্গালের সুখে দুঃখে সব তা’তে আছি।।
আমি নাহি যাব রাজা রাজড়ার বাড়ী।
আমারে পাইলে তারা নাহি দিবে ছাড়ি।।
রাজবেশে আসিবেন রাজার ঠাকুর।
তার লীলা হ’বে আর মধুর মধুর।।”
প্রভুর ভকত তিনকড়ি মুসলমান।
তেরখাদা বাস করে সেই মতিমান।।
মালঞ্চ নামিনী নারী ভক্তা অন্যজন।
ওড়াকান্দি যাতায়াত করে সর্বক্ষণ।।
তারা আসি প্রভু পদে করে দরবার।
“দয়া করে তেরখাদা চলুন এবার।।”
প্রভু কয় “দেখা যাক প্রভু কিবা করে।
তাঁহার ইচ্ছাই পূর্ণ হয় এ সংসারে।।”
তারা বুঝে’ প্রভু বুঝি দিল অনুমতি।
গৃহে গিয়ে আয়োজন করে শীঘ্রগতি।।
এদিকে প্রভুজী কহে যাদবের ঠাই।
“মাধবেন্দ্রে আন ডেকে যাদব গোঁসাই।।
তেরখাদা যেতে আমি ইচ্ছা নাহি করি।
নানা কারণেতে শঙ্কা মনে আছে ভারী।।
উপায় বাহির সবে করহে এখন।
কোন ভাবে কোন পথে করিবে গমন।।”
সকলে করিল ঠিক গাঢ় নিশাকালে।
চুপে চুপে যাবে চলে তেরখাদা ফেলে।।
সেই মত চলে কাজ নিশীথ সময়।
চুপে চুপে ঠাকুরের তরী বেয়ে যায়।।
মালঞ্চের বাড়ী ভরে জ্বলিতেছে আলো।
নৌকা দেখে তারা বলে “কারা হেথা এল?”
জবাব না দিয়া তরী জোরে বেয়ে যায়।
তারা বলে “ও মালঞ্চ! শীঘ্র চলে আয়!
ঠাকুরের নৌকা দেখ ঐ গেল চলে।
আয়োজন করে তোর এ হ’ল কপালে।।”
মালঞ্চ ছুটিয়া চলে নদী তীর ধরে।
তিনকড়ি সাথে সাথে ছোটে জোরে জোরে।।
ডাকাডাকি করে কিন্তু তরী না ভিড়ায়।
প্রাতঃকালে বান্ধে তরী হাড়িদহ গাঁয়।।
রজনী বিশ্বাস সেথা ভক্ত মহাজন।
তার গৃহে মহাপ্রভু করেন গমন।।
মালঞ্চ আসিয়া সেথা পড়িল কান্দিয়া।
সান্তনা করিয়া প্রভু দিল ফিরাইয়া।।
শিয়লী গ্রামেতে পরে হইল উদয়।
শিরোমণি নামে ভক্ত সেই দেশে রয়।।
তার ঘাটে যেতে খাল কচুড়ীতে ভরা।
কোন ভাবে নৌকা নিবে ভাবিছে মতো’রা।।
জনে জনে হাতে ধরি কচুড়ি ফেলায়।
অল্পকাল মধ্যে খাল পরিষ্কার হয়।।
“জিয়ানী” সে শিরোমণি অজ্ঞ লোকে কয়।
সবে নমশূদ্র তার “জিয়ানী” কোথায়?
পত্নী তার ভাগ্যবতী সাধ্বী অতিশয়।
তার পাক খেয়ে প্রভু বহু খুশী হয়।।
আহারান্তে হ’ল সেথা সভা আয়োজন।
বহু দেশ হ’তে আসে নমশূদ্রগণ।।
সভাজনে ডাক দিয়া বলে দয়াময়।
“নমশূদ্র ভাগে ভাগে মোটে ভাল নয়।।
“জিয়ানী” কি “ধানী” কিংবা অন্য পরিচয়।
নমশূদ্র পক্ষে তাহা মন্দ অতিশয়।।
একমাত্র নমশূদ্র সত্য পরিচয়।
অন্য কোন নাম কেহ বল না কোথায়?”
কালী চরণের বাড়ী কাগদিয়া গ্রাম।
তার বাড়ী চলিলেন প্রভু গুণধাম।।
ভুজনীয়া বাস করে নামেতে প্রসন্ন।
প্রভুকে গৃহেতে নিয়া হ’ল বটে ধন্য।।
শ্রীপুর গ্রামেতে প্রভু বহু বাড়ী গেল।
অতপর নদী পথে তরণী ছাড়িল।।
একে’ ত ভাঁটার স্রোত আরো দাঁড় টানে।
তীর বেগে ছোটে তরী দক্ষিণের পানে।।
শিয়ালী নিবাসী দুটি লোক সেই কালে।
ডাকাডাকি করে তরী ভিড়াইতে বলে।।
সঙ্গীলোক ভিড়াইতে নাহি চাহে তরী।
তাহা দেখি দুজনে পড়িল সাঁতারি।।
শব্দ শুনে প্রভু বলে ‘কিসে শব্দ হয়।’
দাঁড়ি মাঝি যারা ছিল তারা সবে কয়।।
“দুই ব্যক্তি আপনারে নিতে চায় কুলে।
পরাণ ত্যজিবে তারা কুলে নাহি গেলে।।
তাই বলে দুই জনে পড়িয়াছে জলে।
ঠেকা’তে পারিনি মোরা কোন কথা বলে।।”
প্রভু কয় “শীঘ্র করি তরণী ভিড়াও।
আমারে যে নিতে চায় তাহারে দেখাও।।”
তরণী ভিড়িল তারা নিকটে আসিল।
প্রভুর চরণে পড়ে কান্দিতে লাগিল।।
প্রভু কয় “কান্দ কেন, শীঘ্র বাড়ী যাও।
ডা’ল ভাত যাহা হয় মোরে খেতে দাও।।”
তখনি ছুটিয়া তারা গৃহ মধ্যে যায়।
কিছু পরে তীরে ওঠে নিজে দয়াময়।।
নদী হতে চারি পাঁচ রশি দূরে বাড়ী।
কিছু কিছু জল কাঁদা আছে রাস্তা ভরি।।
কেদার মিস্ত্রীরে ডাকি বলে দয়াময়।
“কোলে করে নিতে তুমি পার কি আমায়?”
কেদার স্বীকার করে প্রভুরে ভাবিয়া।
দুই রশি পথ গেল কোলেতে করিয়া।।
হেনকালে ডাকে প্রভু সে নীল রতনে।
বলে “মোরে কোলে তুই নেরে কিছুক্ষণে।।”
প্রভুকে করিয়া কোলে নীলরতন যায়।
দুই দশ নল যেতে ঘর্ম ছোটে গায়।।
প্রভু কয় “কিরে নীলে বিয়ে কর নাই।
খাসে ঘোর কাজ কর আমি জানি তাই।।
ব্রহ্মচারী সেজে নাকি হয়েছ গোঁসাই।
গায়ে কেন শক্তি নাই বল দেখি তাই।।”
কেদারর আসিয়া পরে প্রভুকে ধরিল।
সরাসরি বাড়ী পরে সভাতে আনিল।।
সভা করি গুরুচাঁদ বহু কথা কয়।
সভা অন্তে ধীরে ধীরে তরণীতে যায়।।
তরণী পৌছিল ক্রমে হাট ঝলমায়।
সেইদিনে হাটবার বুঝি গণনায়।।
যত লোক হাটে ছিল তারা ডেকে বলে।
কাহার তরণী এই কোন পথে চলে?
“শ্রী গুরুচাঁদের তরী” দাঁড়ি মাঝি কয়।
“ভিড়াও এখানে তরী ওহে মহাশয়।।”
এইরূপে ডাকাডাকি করিছে সকলে।
ক্ষণেক ভিড়াও তরী মহাপ্রভু বলে।।
ঝুঁকিয়া আসিল সবে তরণীর কাছে।
এক দুই টাকা দিয়ে প্রণাম করিছে।।
ঠাকুরে দেখিয়া হ’ল আনন্দ প্রচুর।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে চলিল ঠাকুর।।
গুরুচরণের বাড়ী হাটবাড়ী গাঁয়।
সেই বাড়ী মহাপ্রভু হইল উদয়।।
রাত্রিকালে তরণীতে রহিল দয়াল।
তীরেতে উঠিল পরে হইলে সকাল।।
একজোড়া বস্ত্র আর টাকা দিল দশ।
ভক্তিগুণে গুরুচাঁদ রহে সদা বশ।।
আর আর বাড়ী গিয়া প্রভু দয়াময়।
অবশেষে পারশুলা হইল উদয়।।
প্রচুর হইল সেথা নাম সংকীর্তন।
মতুয়ারা প্রেমানন্দে হইল মগন।।
প্রণামী পঞ্চাশ টাকা দিল সেই হরি।
একদিন থেকে প্রভু ছাড়িলেন তরী।।
খলিসাডাঙ্গায় বাড়ী নাম পুটীরাম।
তার গৃহে সভা করে প্রভু গুণধাম।।
জাতীয় উন্নতি কথা ধর্ম সংরক্ষণ।
বহু আলোচ্য করে পতিত পাবন।।
তথা হ’তে উপনীত হ’ল চালনায়।
দুর্যোধন বিশ্বাসের গৃহেতে উদয়।।
ইতিপূর্বে শ্রীগোপাল গৃহ হ’তে এল।
প্রভুকে লইবে গৃহে এই ভাব ছিল।।
হুড়কা হইতে আসে রমণী গোঁসাই।
তিনি বটে মনে মনে ইচ্ছা করে তাই।।
নকুল গোস্বামী এল লক্ষ্মীকাটী হ’তে।
বরাবর রহিয়াছে প্রভুজীর সাথে।।
চালনা হইতে প্রভু উঠিল সত্বর।
তিন সাধু তিন দিকে করে দরবার।।
প্রভু কহে “এ সময় কোথা নাহি যা’ব।
অবশ্য অবশ্য আমি গৃহেতে পৌছিব।।”
গোপাল রমণী দোঁহে কান্দিছে দাঁড়ায়ে।
প্রভু কয় “দুই জনে কান্দ’ কি লাগিয়ে।।
এইবারে আমি কোথা নাহি যা’ব আর।
গৃহে যেতে চাই তাই সত্বর সত্বর।।”
গোপাল রমণী দোঁহে ফিরে গেল ছাড়ি।
চালনা হইতে প্রভু তরী দিল ছাড়ি।।
লবণ গোলায় সাধু বিহারী সদ্দার।
রমণীর শ্রেষ্ঠ শিস্য পরিচয় তার।।
সেই গৃহে মহাপ্রভু হইল উদয়।
বিহারীর আনন্দেতে সীমা নাহি রয়।।
সেই গৃহ হ’তে প্রভু অন্য গৃহে যায়।
“পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয়” বলি দেয় পরিচয়।।
দুইজন ভক্তে দিল চারশত টাকা।
প্রভু বলে “এই রূপ কম যায় দেখা।।”
হেথায় কানাই সাধু পড়িলেন রোগে।
সেই কথা বলে কেহ মহাপ্রভু আগে।।
প্রভু বলে “তারে হেথা রাখিও না আর।
পাঠাইয়া দাও তারে আপনার ঘর।।”
হরি বিশ্বাসের এক নৌকা সঙ্গে ছিল।
সবে মিলে কানাইকে সেই সঙ্গে দিল।।
কিছুকাল পরে তারা বলিল ডাকিয়া।
“তোমাদের লোক আর পারি না বহিয়া।।
লোক যদি নাহি লও দিব ফেলাইয়া।”
কথা শুনি প্রভু যেন উঠিল জ্বলিয়া।।
হরিকে তাড়না করে দিল তাড়াইয়া।
নিজ তরণীতে নিল রোগীরে তুলিয়া।।
খুলনা আসিতে রোগ গেল পালাইয়া।
ব্যয় দিয়া তারে প্রভু দিল পাঠাইয়া।।
নকুল গোস্বামী সদা সঙ্গে সঙ্গে রয়।
দয়া করি গেল প্রভু লক্ষ্মীকাটী গাঁয়।।
তিন দিন মহাপ্রভু লক্ষ্মীকাটী রয়।
কাছে কাছে নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়ায়।।
ইচ্ছামতী লক্ষ্মণের বাড়ী প্রভু গেল।
নাআম সংকীর্তন সেথা প্রচুর হইল।।
সেথা হ’তে গেল প্রভু নেপালের বাড়ী।
এবে শোন কি বলিল “জুঙ্গুশিয়া বুড়ী”।।
জুঙ্গুশিয়া গ্রামে এক নিষ্ঠাবতী নারী।
সবে তারে ডাকে বলে “জুঙ্গুশিয়া বুড়ী”।।
অনন্ত নামেতে ভক্ত জুঙ্গুশিয়া গাঁয়।
তার গৃহে চলেছেন প্রভু দয়াময়।।
পথে দেখা হ’ল সেই নারীর সহিতে।
ঠাকুরের নৌকা দেখে লাগিল কহিতে।।
একটি ধামায় কিছু ছিল তরকারী।
তাহা দেখাইয়া পরে বলে সেই বুড়ী।।
“আমার বাড়ীতে নিয়ে চল ঠাকুরেরে।
তরকারী পাক করে দিব আমি তারে।।”
অনন্ত তাহাতে কিছু করে প্রতিবাদ।
বুড়ী কয় “অনন্তরে! কেন কর বাদ?
তোমার একার ভক্ত নহেত ঠাকুর।
আমারও ভক্ত তিনি কিসে কত দূর?”
সরল সহজ প্রাণ সেথা জয়ী হ’ল।
তার বাড়ী দয়াময় দয়া করি গেল।।
তথা হ’তে চলিলেন বাবুপুর গাঁয়।
সৃষ্টিধর নামে সাধু সেই গ্রামে রয়।।
অল্প সংখ্যা হিন্দু সেথা মুসলমান বেশী।
প্রভুরে সম্মান তারা জানাইল আসি।।
সভা করিবারে তারা করে নিবেদন।
কিছুই উত্তর প্রভু না করে তখন।।
রাত্রিকালে পাল্কী যোগে প্রভু তথা হ’তে।
আসিয়া পৌছিল প্রভু নিজ তরণীতে।।
তথা হ’তে ‘বহরের’ সঙ্গে তরী বায়।
রাত্রি শেষে বড়দিয়া উপস্থিত হয়।।
এক জেলে সেইখানে অগ্নি নে’য়া ছলে।
প্রভুর নৌকায় দিল বহু মাছ ঢেলে।।
সবে মিলে পৌছিলেন গোপালের বাড়ী।
প্রভু বলে “ওড়াকান্দি চল তাড়াতাড়ি।।”
ভক্তগণে ইচ্ছা করে সেখানে থাকিতে।
মহাক্রোধে প্রভু তবে লাগে গালি দিতে।।
কেদার কহিছে “বাবা! হাট ঝাড়া বিলে।
কুচুড়ী রয়েছে সেথা ভরা কুলে কুলে।।”
হেনকালে এক ব্যক্তি সেই পথে যায়।
তাহারে জিজ্ঞাসা করে প্রভু দয়াময়।।
“হাটঝাড়া বিলে বাপু কুচুড়ী কেমন?”
সে বলে “কুচুড়ী কর্তা নাহিক এখন।।”
হাসিয়া বলেন প্রভু “কুচুড়ী যে তোরা।
তোদের বুদ্ধির সঙ্গে যায় না’ক পারা।।”
সেই গ্রামে প্রভু তবে রজনী বঞ্চিল।
গ্রামবাসী সবে তা’তে মহাসুখী হৈল।।
প্রভাতে তরণী খুলি পূর্ব দিকে ধায়।
প্রভু বলে “পুনরায় চলিলে কোথায়?
যাহা ইচ্ছা কর আর কথা নাহি কব।
যতদূর নেও আমি তত দূরে যা’ব।।”
এত বলি রাগ করি প্রভু বসে রয়।
নারিকেলবাড়ী আসি তরণী ঘনায়।।
মাধবেন্দ্র পদে পড়ি কাঁদাকাঁদি করে।
দয়া করে দয়াময় উঠিলেন তীরে।।
বহু আয়োজন সেথা মাধবেন্দ্র করে।
পরিপূর্ণ মহোৎসব হ’ল তার ঘরে।।
মহোৎসব অন্তে প্রভু তরীতে উঠিল।
শ্রীধামের প্রতি তরী বেগেতে ছুটিল।।
“জয় গুরুচাঁদ” ধ্বনি ভক্তগণে কয়।
ধীরে ধীরে তরী আসি শ্রীধামে ভিড়ায়।।
এস্তে ব্যস্তে ভক্তগণে দ্রব্য সমুদয়।
কুলে তুলি গৃহমধ্যে সব লয়ে যায়।।
দূর দেশ হ’তে যত ভক্ত সঙ্গে ছিল।
সকলেরে ডেকে প্রভু বিদায় করিল।।
মাধবেন্দ্র ধাম ‘পরে রহিল বসিয়া।
গুরুচাঁদে সেবা করে প্রেমেতে মজিয়া।।
শ্রীগুরু চরিত গাঁথা সুধা হ’তে সুধা।
মহানন্দ ভণে খেলে যাবে ভবক্ষুধা।।
মহাত্মা সুধন্যকুমারের জীবন কথা
প্রভুর মধ্যম পুত্র সুধন্য ঠাকুর।
হরিভক্ত সুবিনয়ী মহিমা প্রচুর।।
বার শত অষ্টাত্তর সালে জন্ম নিল।
শ্রীহরির স্পর্শ পেয়ে ভক্তিমান হ’ল।।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম পিতা মানে মহাশয়।
“বিনয়ের অবতার” সবে তারে কয়।।
বৃদ্ধ কি বালক কিংবা যুবক যুবতী।
দেখা হ’লে অগ্রভাগে করিতেন নতি।।
পূর্ব হ’তে নমস্কার করে সর্বজনে।
সুমিষ্ট আলাপ করে সকলের সনে।।
ভাবুক রচক বটে ছিল মহাশয়।
গ্রন্থ মধ্যে পাই মোরা সেই পরিচয়।।
“সদ্বাক্য সংগ্রহ” নামে নীতি পূর্ণ গ্রন্থ।
মানব জীবন পথে বান্ধব একান্ত।।
“হরি সংকীর্তন” নামে গীতিকা লহরী।
ভক্তি-সিন্ধু মাঝে যেন শুদ্ধ শান্ত বারি।।
আর কত গ্রন্থ বটে করিল লিখন।
তার জীবকালে নাহি হয়েছে মুদ্রণ।।
সংসারের ক্ষেত্রে তার জ্ঞান অতিশয়।
সমস্ত হিসাবপত্র স্মৃতিপটে রয়।।
প্রধান মতুয়াবর্গে ডাকি নিজ কাছে।
তত্ত্ব-আলাপন অন্তে আশীর্বাদ যাচে।।
রাজার নন্দন বটে বেশেতে কাঙ্গাল।
শ্রীহরি বলিয়া চোখে সদা ঝরে জল।।
তিন ভ্রাতা পূর্বে তার দেহ ছাড়ি যায়।
কোমল অন্তরে তা’তে বহু ব্যাথা পায়।।
তের শত পঁয়ত্রিশ সাল পরিচয়।
রথযাত্রা যে দিবসে সমাপন হয়।।
পূর্বে হ’তে কিছুকাল রোগ ছিল দেহে।
নীরবে সকল ব্যাথা মনোমধ্যে বহে।।
রথযাত্রা শুভকার্য নির্বাহ হইল।
অপরাহ্ণে শ্রীসুধন্য দেহে ছেড়ে গেল।।
পাষাণ সাজিয়া প্রভু চুপ করে রহে।
সত্যভামা দেবী প্রতি উপদেশ কহে।।
এইভাবে চারি পুত্র পরপারে যায়।
অচল অটল প্রভু উচ্চশিরে রয়।।
দিবারাতি দিন গণে’ প্রভু ঘনে ঘন।
কবে ফিরে আসিবেন প্রমথরঞ্জন।।
জীবনের শেষ আশা রাখে তার পরে।
বর্ষ পরে সে প্রমথ এল ফিরে ঘরে।।
তার পূর্বে এ ভারতে কিবা কাণ্ড হয়।
শুন সবে বলিতেছি সেই পরিচয়।।
অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতি
(গোল টেবিল বৈঠক)
অসহযোগের পক্ষে কংগ্রেসের যুদ্ধ।
সৈনিক জুটিল তার নরনারী শুদ্ধ।।
মহাত্মা গান্ধীর বাণী শুন দিয়া মন।
তিনি বলে “হতে পারে স্বরাজ অর্জন।।
আমি যাহা বলি তাহা সবে যদি শোনে।
স্বরাজ আনিতে আমি পারি একদিনে।।”
ক্রমে ক্রমে আন্দোলন বাড়িয়া চলিল।
রাজার আইনে বহু জেলে ধরে নিল।।
“আইন অমান্য” নীতি কংগ্রেস ধরিল।
“মানি না তোমার নীতি” রাজারে কহিল।।
পুলিশের অত্যাচার তা’তে হ’ল ভারী।
বহু লোক হতাহত হ’ল ফলে তারি।।
“লবণ আইন ভঙ্গ” করিলেন গান্ধী।
অভিযান করিলেন শহর সে ডাণ্ডী।।
বড়লাট আইরুন ছিল মহাশয়।
গান্ধীজীর সাথে তার কথাবার্তা হয়।।
তেজ বাহাদুর সপ্রু আর জয়কার।
দুইজনে চেষ্টা বহু করে মীমাংসার।।
স্থির হ’ল বিলাতেতে “গোল টেবিলেতে”।
হইবে মীমাংসা সভা মিশি এক সাথে।।
আদি কাণ্ডে কংগ্রেসের যত নেতৃগণ।
গোল টেবিলের ক্ষেত্রে করে না গমন।।
কংগ্রেসের দাবী পূর্ণ যখনে হইল।
গোল টেবিলেতে তারা তবে যোগ দিল।।
পূর্ব পূর্ব বারে যত “গোল টেবিল” হয়।
কংগ্রেসের যোগ ছাড়া সব বৃথা যায়।।
তেরশ ছত্রিশ সালে রাজার আজ্ঞায়।
কংগ্রেসের দাবী কিছু পূর্ণ করা হয়।।
তা’তে রাজী মহাত্মাজী সাঙ্গোপাঙ্গ লয়ে।
“গোল টেবিলের” স্থলে চলিলেন ধেয়ে।।
ভারতের অনুন্নত সমাজ যাহারা।
তিন জন প্রতিনিধি পাইলেন তারা।।
ডক্টর আম্বেদকর বোম্বায়েতে বাস।
কর্মগুণে মহাশয় লভিয়াছে যশ।।
জীবনের আদি ভাগে বহু কষ্ট পায়।
এবে মহাশক্তিশালী বটে বিধির কৃপায়।।
ভারতের বড়লাট শাসন ব্যাপারে।
মন্ত্রণা সভায় সভ্য মনোনীত করে।।
“এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল” ইংরেজিতে কয়।
ডক্টর আম্বেদকর সদস্য তথায়।।
এম.সি. রাজা বলি অন্য একজন।
মাদ্রাজ হইতে চলে শ্রীনিবাসন।।
মুসলমান পক্ষ হ’তে চলে বহুজন।
মহম্মদ আলী জিন্নাহ বোম্বেতে ভবন।।
গজনবী, আগাখান, ফজলুল হক।
আর কত গেল সাথে ছিল যার সখ।।
কংগ্রেসের মধ্যে গেল মহাশয় গান্ধী।
ইতিপূর্বে জেলে তিনি ছিল বটে বন্ধী।।
পণ্ডিত মালব্য চলে বারাণসি হ’তে।
নারী পক্ষে সরোজিনী চলে সাথে সাথে।।
এইভাবে বহুজন চলিল বিলাতে।
“গোল টেবিলের” ধারে বসে শান্ত চিতে।।
প্রধানমন্ত্রীর নাম সবে ভালো জানে।
র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড ইংলণ্ডেতে ভণে।।