মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

আদিখণ্ডঃ ষষ্ঠ তরঙ্গ

আদি খণ্ড
ষষ্ট তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রীগোলকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়

জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়
।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।
 
ভক্তগণের মহাসংকীর্তনোচ্ছাস
পয়ার
এইভাবে হরিচাঁদ করে ঠাকুরালী।
প্রভু-সঙ্গে ভক্ত সদা থাকে মেলা মেলি।।
ঐশ্বর্য্য প্রকাশি, প্রভু আসিলেন বাসে।
লক্ষ্মীমাতা পদসেবা করিল হরিষে।।
রন্ধন করিয়া ভক্তগণে ডাক দিল
ভক্তগণে হরি বলে ভোজনে বসিল।।
ঠাকুরানী ডাক দিয়া রামচাঁদে বলে।
তিন চারি মাস বাপ কোথায় বেড়া’লে।।
তোমরা বেড়াও সদা ব’লে হরি বোল।
কোথায় পাইলে বল এ দ্রব্য সকল।।
রামচাঁদ বলে তুমি শুন লক্ষ্মীমাতা।
তোমার কৃপায় পাই আর পা’ব কোথা।।
প্রভু বলে রামচাঁদ বল তোর মাকে।
সর্ব ফল ফলে এক কৃষ্ণকল্প বৃক্ষে।।
শূন্যে রহে কল্প বৃক্ষ ঈশ্বর ইচ্ছায়।
কল্পবৃক্ষ কৃষ্ণভক্তে কল্পনা করয়।।
কৃষ্ণপ্রেম রসিকের রসময় দেহে।
সে দেহের ছায়া সেই কল্পবৃক্ষে চাহে।।
মাতা বলে অর্থে আর নাহি প্রয়োজন।
জন্মে জন্মে চাই তব যুগল চরণ।।
শুনি সব ভক্তগনে বলে  হরিবোল।
অর্থত্যাগী প্রেমন্মত্ত ভাবের পাগল।।
প্রেম অনুরাগে সব ভকত জুটিল।
‘মতুয়া’ বলিয়া দেশে ঘোষণা হইল।।
মঙ্গল নাটুয়া বিশে পূর্ব পারিষদ।
ওঢ়াকাঁদিবাসী পারিষদ রামচাঁদ।।
ভজরাম চৌধুরীর ছোট ভাই যেই।
ঠাকুরের ঐকান্তিক পারিষদ সেই।।
কুবের বৈরাগী রামকুমার ভকত।
প্রভুর ভকত সেই হয়েছে ব্যকত।।
গোবিন্দ মতুয়া আর স্বরূপ চৌধুরী।
প্রেমাবেশে ভাবে মেতে বলে হরি হরি।।
চূড়ামণি বুধই বৈরাগী দুই ভাই।
হরিচাঁদ পেয়ে আনন্দের সীমা নাই।।
জগবন্ধু বলে ডাক ছাড়িত যখন।
সুমেরুর চূড়া যেন হইত পতন।।
মঙ্গল যখন হরি কীর্তন করিত।
সম্মুখেতে মহাপ্রভু বসিয়া থাকিত।।
মঙ্গলের নাসা অগ্রে কফ বাহিরিত
প্রেমে অশ্রুপূর্ণ হয়ে বক্ষ ভেসে যেত।।
ক্ষণে দিত গড়াগড়ি ক্ষণে উঠে বসে।
ক্ষণে নেচে ভেসে যেত প্রেমসিন্ধু রসে।।
ক্ষণে বীর অবতার ক্ষণেক বিমর্ষ।
উত্তরাক্ষ রুদিত বিকট ভঙ্গি হাস্য।।
গাইতে গাইতে শ্লেষ্মা উঠিত মুখেতে।
ঘন মুখ ফিরাইত ডান বাম ভিতে।।
উর্দ্ধ অধঃ মুখ ঝাকি করতালি  দেয়।
বালকেতে অগ্নিদন্ড যেমন ঘুরায়।।
তাতে মাত্র দেখা যায় অগ্নির মণ্ডল।
দণ্ড না দেখায় অগ্নি দেখায় কেবল।।
তেমনি মঙ্গল যবে ঘুরাইত মুখ।
এক মঙ্গলের দেখাইত শত মুখ।।
বড় প্রেম উথলিয়া পড়িত গোবিন্দ।
কক্ষবাদ্য করি হেলি দুলিয়া আনন্দ।।
পিছেতে প্রভুকে রাখি বিমুখ হইয়া।
প্রভুর মুখেতে মুখ থাকিত চাহিয়া।।
প্রেমে ঝাঁকাঝাঁকি নাকে শ্লেষ্মা উঠিয়া।
প্রভু অঙ্গে পড়িত যে ছুটিয়া ছুটিয়া।।
নাকে মুখে চোখে যাহা যেখানে পড়িত।
যত্ন করি প্রভু তাহা অঙ্গেতে মাখিত।।
কক্ষবাদ্য করি রামকুমার ভকত।
কীর্তন মধ্যেতে হেলে দুলিয়া পড়িত।।
এইরূপে ভক্তবৃন্দ হয়ে একতর।
দিক নাই কে পড়িত কাহার উপর।।
মহাভাবে চিত্তানন্দ হৃদয় আহ্লাদ।
গম্ভীর প্রকৃতি যেন প্রভু হরিচাঁদ।।
ভক্তগণে প্রেমন্মত্ত হইত যখন।
বিকৃতি আকার প্রভু হইত তখন।।
ক্ষণে কৃষ্ণবর্ণ ক্ষণে গৌরাঙ্গ বরণ।
রক্তজবা তুল্য হ’ত যুগল লোচন।।
ক্ষণে দূর্বাদল শ্যাম ক্ষণে পাটল।
ক্ষণে নীলোৎপল বর্ণ নয়ন যুগল।।
ভক্তগণে হুঙ্কারিত বলে হরিচাঁদ।
সে ধ্বনি শ্রবণে যেন মত্ত সিংহনাদ।।
সবলোক মত্ত হয়ে দিত হরিধ্বনি।
তাহাতে হইত যেন কম্পিতা মেদিনী।।
কেহ না জানিত দিবা কি ভাবেতে গেল।
না জানিত যামিনী কিভাবে গত হল।।
প্রেমানন্দ সদানন্দ আনন্দে বিভোল।
ভণে শ্রীতারকচন্দ্র বল হরি বল।।
 
প্রভুর নতুন বাটী বসতি।
পয়ার
একদা প্রভুর জ্যেষ্ঠ নামে কৃষ্ণদাস।
ঠাকুরকে কহে দেকে শুন হরিদাস।।
আমরা সকলে থাকিলাম এক বাড়ী
তুমি বা একাকী কেন থাক সবে ছাড়ি।।
এস সবে একত্রেতে সুখে করি বাস।
তাহা শুনি মহাপ্রভু যেতে কৈল আশ।।
এ সময় জমিদার এসে ওঢ়াকাঁদি।
পূর্ববাড়ী যাইবারে করে কাঁদাকাঁদি।।
না হইল পঞ্চভাই তাহাতে স্বীকার।
কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরে গেল জমিদার।।
আমভিটা ত্যাজি প্রভু পোদ্দার বাটিতে।
পাঁচ ভাই বসতি করিল একসাথে।।
নড়াইলবাসী বাবু নাম রামরত্ন
জমিদার বসাইল করি বহু যত্ন।।
রামরত্ন হরনাথ আর সীতানাথ।
এ তিনের নাম নিলে হয় সুপ্রভাত।।
তেলীহাটী  পরগনে ইহারা মালেক।
আমিরাবাত ওঢ়াকাঁদি জমিদার এক।।
এই ওঢ়াকাঁদি প্রভু করেন বসতি।
সমাদরে জমিদার করিলেন স্থিতি।।
ভকত ভবনে প্রভু যাতায়াত করে।
ভক্ত সঙ্গে থাকে রঙ্গে আনন্দ অন্তরে।।
ওঢ়াকাঁদি আর ঘৃতকাঁদি মাচকাঁদি।
কুমারিয়া চন্দ্রদ্বীপ আর আড়োকাঁদি।।
ইত্যাদি অনেক গ্রাম চতুঃপার্শ্বে রয়।
ভক্তি করি যে ডাকে তাহার বাড়ী যায়।।
ভক্তবৃন্দ পান করে কৃষ্ণ প্রেমরস
হাসে কাঁদে নাচে গায় অন্তরে উল্লাস।।
দুই পুত্র তিন কন্যা ল’য়ে ঠাকুরানী।
সুখের সাগরে ভাসে লোচন নন্দিনী।।
ভকত ভবনে ফিরে প্রভু হরিচাঁদ।
বাঞ্ছাপূর্ণ করে হরি যার যেই সাধ।।
যেখানে যেখানে আছে প্রভুর ভকত।
ক্রমে এসে এক ঠাই হয়েন একত্র।।
এইভাবে ওঢ়াকাঁদি কালাতিবাহিত।
ভক্তগণে আসে যায় হয়ে হরষিত।।
কোন কোন প্রভু ভক্তগণে লয়ে।
পুষ্করিণী তীরে গিয়ে থাকেন বসিয়ে।।
পরিধান একবস্ত্র অর্ধাংশ গলায়।
শীত গ্রীষ্মে সমভাব ছেড়া কন্থা গায়।
শয্যাহীন দূর্বাসনে থাকিত বসিয়া।
একে একে ভক্ত সব মিলিত আসিয়া।।
কখন বসিত প্রভু তৃণাসন করি।
ভক্তগণ বসিয়া বলিত হরি হরি।।
ভাব যেন দীন হীন পথের কাঙ্গাল।
ডাকিতেন কোথা কৃষ্ণ যশোদা দুলাল।।
হা কৃষ্ণ গোকুলচন্দ্র করুণানিধান।
ভক্তভাব প্রকাশিত নিজে ভগবান।।
কভু হরি, বলি হরি হইত বিস্মৃতি।
কখনও বদনে হ’ত সূর্যসম জ্যোতি।।
এইভাবে ওঢ়াকাঁদি লীলা প্রকাশয়।
ঐশ্বর্য্যয়ের মধ্যে শুধু মাধুর্য লুকায়।।
গার্হস্থ্য প্রশস্ত ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
দীননাথ হরি অবতীর্ণ অবনীতে।।
ভক্তগণ অনুক্ষণ নাহি ছাড়ে সঙ্গ।
ক্রমে ক্রমে বাড়িতেছে লীলার প্রসঙ্গ।।
কিছুদিন একবাড়ী সুখে করি বাস।
শ্রীবৈষ্ণবদাস আর শ্রীস্বরূপদাস।।
দুই ভাই পদ্মবিলা করিল বসতি।
তিন ভাই থাকিলেন ওঢ়াকাঁদি স্থিতি।।
ওঢ়াকাঁদি বাস না করিত বহুদিন।
একমাস মধ্যে মাত্র দুই এক দিন।
আর সদা থাকিতেন ভক্তের আলয়।
যেখানে সেখানে থাকি হরিগুণ গায়।।
মুহূর্তেক প্রভু যদি কোথা বসিতেন।
ব্যাধিযুক্ত রোগযুক্ত লোক আসিতেন।।
যারা হ’ত রোগমুক্ত মানসা করিয়া।
মানসিক মুদ্রা সব দিতেন আনিয়া।।
সেই মুদ্রা ভক্তগণ লইয়া সাদরে।
আনিয়া দিতেন লক্ষ্মীমাতার গোচরে।।
অল্পদিন রহে প্রভু নিজ ভদ্রাসনে।
অধিকাংশ রহে প্রভু ভক্তের ভবনে।।
অল্প সময় থাকে অন্য ভক্ত ঘরে।
সদা ব্যস্ত যাইতে সে রাউৎখামারে।।
হরিচাঁদ চরিত্র পবিত্র সুধাভাণ্ড।
কবি কহে শ্রবণেতে খণ্ডে যম দণ্ড।।
 
রোগের ব্যবস্থা।
পয়ার
লোক আসে প্রভুস্থানে হ’য়ে রোগযুক্ত।
সংকীর্তনে গড়ি দিলে হয় রোগমুক্ত।।
রোগ জানাইয়া সবে বলিত কাতরে।
রোগমুক্ত হ’ত প্রভু দিলে আজ্ঞা করে।।
প্রভু বলিতেন যদি রোগমুক্তি চাও।
যে রোগের বৃদ্ধি যাতে তাই গিয়া খাও।।
তিন সন্ধ্যা ধুলি মাখ তুলসীর তলা।
জ্বর হ’লে পথ্য দেন তেঁতুলের গোলা।।
বেদনা অজীর্ণ বমি কিংবা অম্ল পিত্তে।
তেঁতুল গুলিয়া খায় পিতলের পাত্রে।
মহারোগে অঙ্গে মাখে গোময় গোমূত্র।
কেহ বা আরোগ্য হয় প্রভু আজ্ঞামাত্র।।
রোগ জানাইয়া যায় মানসা করিয়ে।
মানসিক টাকা দেয় রোগমুক্ত হ’য়ে।।
মানসা করিত লোকে যার যেই শক্তি।
একান্ত মনেতে যার যেইরূপ ভক্তি।।
মুদ্রাপানে প্রভু নাহি চাহিয়া ফিরিয়া।
উঠে যাইতেন প্রভু সে মুদ্রা ফেলিয়া।।
ভক্তে জিজ্ঞাসিত প্রভু কোথা রাখি ধন।
প্রভু বলে যার ধন তাহার সদন।।
ভক্তগণ এইসব ইঙ্গিত বুঝিয়া।
লক্ষ্মীর নিকট ধন দিতেন আনিয়া।।
পৌষেতে আমন ধান্য কাটিয়া কাটিয়া।
মোচন করিয়া ভক্ত দিত পাঠাইয়া।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত নানাবিধ তরকারি।
পায়স পিষ্টক চিনি সন্দেশ মিছরী।।
কমলা কদলী কুল দাড়িম্ব সুন্দর।
আম জাম নারিকেল খাদ্য মনোহর।।
ভক্তগণে দ্রব্য আনে প্রভুর সেবায়।
লক্ষ্মীর নিকটে সব আনন্দে যোগায়।।
কালেতে যখন যে নূতন দ্রব্য পেত।
ভক্তগণে এনে তা ওঢ়াকাঁদি দিত।।
কেহ কেহ লয়ে যেত আপন বাসরে।
নিজগৃহে লইয়া প্রভুর সেবা করে।।
নূতন আমন ধান্য হইলে বিপুল।
আগ্ ধান্য রাখে কেহ আতপ তণ্ডুল।।
প্রভুভক্ত সুচরিত যেন শুধু মধু।
কবি কহে কর্ণ ভরি পিও সব সাধু।।
 
রাম কুমারের অঙ্গে কাল সর্পঘাত।
পয়ার
এইভাবে হইতেছে কালের হরণ।
একদিন শুন সবে দৈব নির্বন্ধন।।
প্রভু প্রিয় ভক্ত রামকুমার ভকত।
তার বাড়ী যান প্রভু ভক্ত সঙ্গে কত।।
তৃতীয় প্রহর রাত্রি নাম সংকীর্তন।
কীর্তনান্তে করিলেন গৃহেতে গমন।।
সকল ভকতগণ বিদায় করিয়া।
গৃহে যান প্রভু রামকুমারে লইয়া।।
গোবিন্দ মতুয়া সঙ্গে হইয়া মিলন।
কীর্তনের ভাব অঙ্গে আছে তিন জন।।
গোবিন্দ পিছেতে ধায় মধ্যেতে কুমার।
সকলের অগ্রেতে ঠাকুর অগ্রসর।।
গোবিন্দ নিকটবর্তী প্রভু কিছু দূরে।
হেনকালে সর্পঘাত করিল কুমারে।।
থর থর করি গাত্র কাঁপিতে লাগিল।
বলে প্রভু কাল সাপে আমারে কাটিল।।
প্রভু বলে কি সর্প তা জানিলে কেমনে।
গোক্ষুর কি কাল সাপ দেখেছ নয়নে।।
কুমার বলিল জ্যোস্নায় দেখা যায়।
অই সেই সর্প মোরে দংশে চ’লে যায়।।
ঠাকুর বলেন তার বুকে দিয়া কর।
গাত্র যেন কাঁপে তোর বুক ধড়ফড়।।
সর্পের দংশনে তোর কেন হল ভয়।
দেখ সাপ ধরে আনি কেমনে দংশায়।।
দাঁড়া তুই আমি সেই সর্প ধরে আনি।
যার বিষ চুমুকিয়া লবে সেই ফণী।।
কহিছে রামকুমার তাহা না পারিব।
পুনঃ সাপ দেখে শঙ্কায় মরিব।।
ঠাকুর কহিছে তুই আয় মম কাছে।
দেখি তোর কোনখানে সাপে দংশিয়াছে।।
দেখাইয়া দিল ঘা ভকত মহাশয়।
দেখে দংশিয়াছে বাম পায়ের পাতায়।।
দক্ষিণ পদ অঙ্গুলি ঠাকুর তখনে।
সর্পকাটা ঘায় ছোঁয়াইল ততক্ষণে।।
সর্প কোথা বিষ কোথা কেনরে ভাবিস।
সর্পের নিকটে থাকে মানুষের বিষ।।
ব্রহ্মার কুমার দক্ষ মানুষ অবতার।
সবে জানে ষাটি কন্যা জন্মিল তাহার।।
মানুষ কশ্যপ মুনি তের কন্যা লয়।
যুগ ধর্ম অষ্ট কন্যা করে পরিণয়।।
একাদশ কন্যা তার রুদ্রে বিয়া করে।
সাতাইশ কন্যা দিল নিশাকর করে।।
নবরূপ প্রজাপতি জাতিতে মানুষ।
তার কন্যা বিয়ে করে অনাদি পুরুষ।।
দক্ষপুরে সতী ত্যাগ করিল জীবন।
শব শিরে করি শিব করিল রোদন।।
নয়ন জলেতে সেই বিষ বাহিরিল।
সমুদ্র মন্থনকালে সে বিষ  উঠিল।।
জাতি সর্প অনন্ত বাসুকী যারে কয়।
মানুষ কশ্যপ মুনি তার পিতা হয়।।
বাসুকী বন্ধন দড়ি তখনে হইল।
সমুদ্র মন্থনকালে বিষ উগারিল।।
বিষে বিষ মিশিল খাইল শূলপাণি।
পার্বতীর দুগ্ধপানে নির্বিষ অমনি।
বিষহরি বিষ হরি নিল সে সময়ে।
জটাচার্ব্ব বংশে জরৎকারু করে বিয়ে।।
সেই পদ্মা বিষকর্ত্রী তার কাছে বিষ।
বিষ মানুষের নারী ভয় কি করিস।।
মহতের কোপে হয় বিষ উপার্জন।
সাপে কি করিতে পারে করিয়া দংশন।।
বিষ খাইয়াছে সর্প তোমাকে দংশিয়া।
মরিবে ও সর্প কল্য দেখিও আসিয়া।।
শেষে গিয়া বসিলেন প্রভুর শ্রীধামে।
যামিনী প্রভাত হ’ল কৃষ্ণকথা প্রেমে।।
প্রাতঃকৃত্য করি হরি কথার আলাপ।
বলে চল দেখে আসি কামড়ানে সাপ।।
ঠাকুরের সঙ্গেতে গিয়ে ভক্ত  মহাশয়
দেখে গিয়া সেইখানে সর্প মরে রয়।।
ঠাকুর বলেন সর্প বিষ খাইয়াছে
তোর অঙ্গবিষে সর্প মরে রয়েছে।।
যখন করিল কৃষ্ণ কালীয়া দমন।
কৃষ্ণ অঙ্গে রাগে নাগে করিল দংশন।।
কালীয়ের ফণা ভাঙ্গি করিল দমন।
শিরে দিল পদচিহ্ন কালীয় দমন।
সেই হ’তে  গরুড়ের ভয় তার গেল।
বিনতানন্দন তারে কিছু না বলিল।।
গরুড়ে আরূঢ় হইতেন ভগবান।
সে গরুড় মনিপত্নী বিনতাসন্তান।
কৃষ্ণভক্ত গরুড়ের সহায় সংসারে।
সাপের কামড়ে কোথা কৃষ্ণভক্ত মরে।।
কংস যবে পুতনাকে ব্রজে পাঠাইল
পুতনা রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখাইল।।
কংস দিল আজ্ঞা করে সাপুড়িয়াগণে।
কালকূট বিষ পুতনাকে দেও এনে।।
আজ্ঞা পেয়ে সাপুড়িয়া কালফণী ধরে।
দন্তভেঙ্গে সাপুড়িয়া বিষ বের করে।।
যে কালে সর্পের গলা চাপিয়া ধরিল।
এ সময় কালসর্প কাঁদিতে লাগিল।।
তবু দন্ত ভেঙ্গে বিষ করিল বাহির।
কাঁদিয়া সে ফণীবর হইল অস্থির।।
দূত বলে ওরে সর্প কাঁদ কি লাগিয়া।
দন্তভঙ্গ এইটুকু বেদনা পাইয়া।।
রাজকার্য তোমা হ’তে সাহায্য হইবে।
ঔষধ লাগায়ে দিলে বেদনা ঘুচিবে।।
সর্প বলে ওরে দূত মনে দেখ ভেবে।
সামান্য বেদনা পেয়ে সর্প কাঁদে কবে।।
তবে যে কেঁদেছি আমি চক্ষে বহে বারি।
এই ব্যাথা হ’তে মম ব্যাথা আছে ভারি।।
এই বিষ পুতনা মাখিয়া যা’বে স্তনে।
বিষমাখা দুগ্ধ খাওয়াবে ভগবানে।।
যে মুখে যশোদা দেয় ক্ষীর-সর-ননী।
সেই মুখে বিষ দিবে কংস নৃপমণি।।
এতদিন বিষ ধরি আমি বিষধর।
এ বিষ করিবে পান হরি বিষহর।।
তাহা বলে নাহি কাঁদি ভাঙ্গিবে দশন।
কৃষ্ণমুখে বিষ দিবে কাঁদি সে কারণ।।
সাধন ভজন কিছু করিবারে নারি।
আরো মম বিষ পান করিবেন হরি।।
এজন্য আমাকে সৃজিলেন জগদীশ।
অমল কমল মুখে দিবি মম বিষ।।
ভাবিয়া দেখিনু মম জনম বিফল।
এই মনোদুঃখে মম চক্ষে পড়ে জল।।
আমারে ধরিলি আমি কোন অপরাধী।
জগদীশ খা’বে বিষ এই দুঃখে কাঁদি।।
সেই সর্প অইদুঃখে করিল বিলাপ।
তোমারে দংশিল এই কোন দেশী সাপ।।
নিজে কৃষ্ণে কষ্ট পেলে কষ্ট নাহি তায়।
ভক্তে কষ্ট পেলে তার কষ্ট অতিশয়।।
ক্রুরজাতি সর্প ওর পাপ উপজিল।
বিনা অপরাধে তোরে দংশি ম’রে গেল।।
সর্পের দংশনে কভু সজ্জন  মরে না।
সজ্জনের কোপ হ’লে সর্পই বাঁচে না।।
যে কালেতে কালীদহে কালীয়ের বিষ।
সেই বিষ উর্দ্ধগামী যোজন পঁচিশ।।
পক্ষী উড়ে কালীদহ পার  হ’তে নারে
কালীয়ের বিষে পুড়ে পক্ষী যেত মরে।।
সেই কালীদহ তীরে কদম্বের বৃক্ষ।
অদ্যপি বাঁচিয়া আছে কে বা তার পক্ষ।।
গরুড় যে কালে স্বর্গে ইন্দ্রজয়ী হয়।
চন্দ্র আসি জননীরে দাসত্ব ঘুচায়।।
গরুড়ের মুখ হ’তে সুধা বিন্দু পড়ে।
তাহাতে অমর বৃক্ষ এখনো না মরে।।
সুধার গুণেতে বাঁচে কদম্বের দ্রুম
যাহার শরীরে আছে কৃষ্ণভক্তি প্রেম।।
কৃষ্ণপ্রেম মহারস সুধা যেবা খায়।
সে কেন মরিবে সর্প বিষের জ্বালায়।।
কি ছার সে স্বর্গ সুধা যথা প্রেমসুধা
প্রেমসুধা খাইলে নিবৃত্তি ভব ক্ষুধা।।
তার নিদর্শন দেখ মরিয়াছে সর্প।
হরি বল দূরে গেল শমনের দর্প।।
শমনের দর্প সর্প মাররে সকলে।
খাণ্ডাও বিষয় বিষ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে।
মুখে খাও কৃষ্ণরস হাতে কর কাজ।
কহিছে তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
 
ভক্তগণের উদার ভাব।
দীর্ঘ-ত্রিপদী
রাউৎখামার গ্রামে,        শ্রীরামসুন্দর নামে,
প্রভুর এক ভকত মহান।
ভক্তগণ ল’য়ে সাথ,        তার ঘরে যাতায়াত,
সদা করে হরিগুণ গান।।
একদিন সবে মেলি,       নাচে গায় বাহু তুলি,
গোবিন্দ মতুয়া সঙ্গে রয়।
কোলেতে বালক ছিল,    এক ঘরে শোয়াইল,
এক কন্যা সে ঘরে আছয়।।
ভগবান প্রেমরসে,         নাচে গায় কাঁদে হাসে,
ভাববেগে মত্ত মাতোয়াল।
গাইয়া যশোদা উক্তি,     কেহ বা করয় ভক্তি,
ননী খাও বাপরে গোপাল।।
কেহ নিজ স্তন ধরে,       একজন বলে আরে,
গ্রীবা ধরে বলে বাপধন।
শুকায়েছে চন্দ্রমুখ,        দেখে মুখ ফাটে বুক,
কোলে বসি পান করে স্তন।।
আর জন কহে বাণী,      শুনগো যশোদারাণী,
তোর কৃষ্ণ খেল তোর স্তন।
আমার বলাই সঙ্গে,       গোচারণে গিয়া রঙ্গে,
গোবর্দ্ধনে চরা’ল গোধন।।
একজন কেঁদে কহে,      এত কি পরাণে সহে,
তোর কৃষ্ণ চোর-শিরোমণি।
কল্য গেল মোর ঘরে,     না জানি কেমন করে,
ভাণ্ডভেঙ্গে খেয়ে এল ননী।।
কেহ কেহ কেঁদে কহে,    তোর কৃষ্ণ কালীদহে,
ডুবিয়াছে গিয়া দৈব দোষে।
বিষজল করি পান,        আছে কি ত্যজেছে প্রাণ,
কিংবা কালীনাগে গ্রাসে।।
ফলে স্বপনের ফল,        ব্রতের ফল বিফল,
কর্মফলে হারালি কানাই।
ডাক মা কাত্যায়নীরে,    চল কালীদহ তীরে,
কানায়েরে পাই কি না পাই।।
বলরামে লও সঙ্গে,       বলা বাজাউক শিঙ্গে,
তাতে যদি পাই কৃষ্ণধনে।
তবে সে পাইবে ত্রাণ,      নতুবা ত্যাজিব প্রাণ,
কালীদহে বিষজল পানে।।
কেহ ধরি কার হাত,       শিরে হানি করাঘাত,
আছাড়িয়া লোটায় ধরণী।
মঙ্গল কহিছে ডেকে,     বলাই দাদার ডাকে,
পাইলাম তোর নীলমণি।।
ঠাকুর কহিছে ডাকি,      আমি না কিছুই দেখি,
কোথা কৃষ্ণ রাখালাদিগণ।
গান ক’রে হরি বলে,      করেছিস গোষ্ঠলীলে,
এই কি তোদের বৃন্দাবন।।
কি বলিতে কি বলিস,               কি কহিতে কি কহিস,
এ তোদের প্রেমের প্রলাপ।
আমি যে কি দেখিলাম,   নিজে যে কি হইলাম,
ভয় বেশী করিতে আলাপ।।
আমি মৃগ গোচারণে,      চরাইতে গেনু বনে,
খেতে যাই মলয়ার পত্র।
কল্যকার একজনে,        আমারে বিধিল বাণে,
বলে আমি শ্রীকৃষ্ণের পুত্র।।
সে বনে এসেছে সীতে,    বিপ্রলম্ব জাল পেতে,
জাল হাতে মোরে বাঁধে তথা
এ বনে নাহিক ফল,       এ বনে নাহিক খল,
সুনির্মল পত্র ভক্তি লতা।।
প্রেমতরু ফলদানে,        ফলভোগী ভক্তগণে,
ফলে ফল ভক্তি লতিকায়।
শ্রীআনন্দ তরুবরে,         আশাপত্র শোভা করে,
সে পত্র হরিণে লুঠে খায়।।
ইহাবলি কৃপাডোরে,       হাতে গলে বাঁধে মোরে,
বলে হারে কোথায় পালাবি।
করি যজ্ঞ জীবোদ্ধার,      হরিনাম মন্ত্র তার,
সহজাগ্নি শূন্যে যায় হবি।।
যজ্ঞকর্তা শ্রীগৌরাঙ্গ,      হোতা গোলক ত্রিভঙ্গ,
যজ্ঞেশ্বরী সেই রাধারাণী।
তোমারে আহুতি নিতে,   রহিয়াছে হাত পেতে,
আত্মাধিক আত্ম করি আনি।।
আমি তারে ব’লে ক’য়ে, আসিয়াছি ছাড়াইয়ে,
ছুটিয়া না যাব রক্ষাং কুরু।
করি যত কাঁদাকাঁদি,       হারায়েছি বাঁধাবাঁধি,
আর না লুঠিব পত্র তরু।।
নাম সংকীর্তন ক্ষান্ত,      প্রলাপের হ’ল অন্ত,
রাত্রি পোহাইল এই দিকে।
হরি হরি হরি বলে,        যাত্রা করে সবে মিলে,
গোবিন্দ উঠিল সেই ঝোঁকে।।
গোবিন্দ মতুয়া ছেলে,     যে বিছানে রেখেছিলে,
তথা ছিল গৃহস্থের মেয়ে।
প্রেম প্রলাপের ঝোঁকে,    নিজপুত্র তথা রেখে,
চলিলেন সেই মেয়ে লয়ে।।
আসিয়া কতক দূরে,       কহে মৃদু মধু স্বরে,
গোবিন্দকে দয়াল ঠাকুর।
দেখ দেখি দৃষ্টিকরে,       কি আনিলে কোলে করে,
হাটিয়া আসিলে এতদূর।।
শুনিয়া প্রভুর বাক্য,        বালিকার প্রতিলক্ষ্য,
কারে বলে আনিয়াছি কায়।
কি আনিতে কারে আনি, এযে কাহার নন্দিনী,
এ বালিকা মম পুত্র নয়।।
সবে করে পরিহাস্য,       ভাবাবেশে এ ঔদাস্য,
যস্য কন্যা তস্যস্থানে লৈয়া।
কন্যা রাখিয়া নন্দনে,      লইয়া ঠাকুর স্থানে,
সংকীর্তনে মিলিল আসিয়া।।
এইভাবে করে লীলা,      ভক্তগণ সঙ্গে লইয়া,
করে দীন দয়াল আমার।
হরিচাঁদ লীলাসুধা,         পানে নাশে ভব ক্ষুধা,
কহে দীন রায় সরকার।।
 
রাজমাতার প্রভু-মাতার নিকট অনুনয়।
পয়ার
ঠাকুরের ঠাকুরালী হ’তেছে প্রকাশ।
তিন ভাই করিছেন ওঢ়াকাঁদি বাস।।
প্রভুমাতা অন্নপূর্ণা মাতা ঠাকুরাণী।
জ্যেষ্ঠপুত্র কৃষ্ণদাস সাধু শিরোমণি।।
তাহার ভক্তিতে বাধ্য হইলেন মাতা।
শ্রীকৃষ্ণদাসের প্রতি হইল মমতা।।
ক্রমে সবে পৃথক হইয়া করে বাস
অন্নপূর্ণা মাকে সেবা করে কৃষ্ণদাস।।
কৃষ্ণদাস একান্নে র’য়েছে অন্নপূর্ণা।
এ দিকেতে জমিদার ক’রেছে ভাবনা।।
পার্বতীচরণ মফঃস্বলে আসে যায়।
কখন সফলডাঙ্গা কাছারীতে রয়।।
ঠাকুরের ঠাকুরত্ব প্রকাশ জানিয়া।
পার্বতী কহেন সূর্যমণি স্থানে গিয়া।।
বড় কর্তা শুন বার্তা কহি মূল সূত্র।
বড় ঠাকুরালী করে যশোমন্ত পুত্র।।
কার্য দেখে জ্ঞান হয় স্বয়ং অবতার।
বার কি আশ্রয় নহে লীলা বুঝা  ভার।।
মুখের কথায় মহাব্যাধি দূর হয়।
কতলোক সারিতেছে বলা নাহি যায়।।
পালাক্রান্ত রোগাক্রান্ত লোক যত ছিল।
হরিনামে পাপ তাপ রোগ বিনাশিল।।
নন্দসুত মিশ্র পুত্র হ’ল নদীয়ায়।
তেমতি হয়েছে যশোমন্তের তনয়।।
শব্দে শুনি রামকান্ত দিয়াছিল বর।
যশোমন্ত পুত্র হবে বাসুদেবেশ্বর।।
অনুরাগী সাধু রামকান্ত মহাভাগ।
শালগ্রামে প্রণমিলে হ’ত অষ্টভাগ।।
কার্য দেখে বিশ্বাস হতেছে মোর তাই।
করেছি অধর্ম দাদা আর রক্ষা নাই।।
ওঢ়াকাঁদি বসতি ক’রেছে তিন ভাই।
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্ধৈত গোঁসাই।।
দাদাগো এমন প্রজা গিয়াছে ছাড়িয়া।
অপযশ হইয়াছে জগৎ জুড়িয়া।।
অধর্ম হ’য়েছে বড় নষ্ট পরকাল।
পাপের নাহিক সীমা ভেঙ্গেছে কপাল।।
সময় সময় প্রাণ কাঁদে তাই ভেবে।
আমাদের জমিদারী বুঝি না থাকিবে।।
দুই ভাই এইরূপ কথোপকথন।
এই কথা রাজমাতা করিল শ্রবণ।।
বৃদ্ধা ঠাকুরাণী কহে কি কহ কি কহ।
বিস্তারিয়া সব কথা আমাকে বলহ।।
বিশেষ বৃত্তান্ত তবে শুনি ঠাকুরাণী।
কহিলেন কি করেছ ওরে সূর্যমণি।।
মহৎ হউক কিংবা হউক দরিদ্র
কিংবা সে ঠাকুর হোক কিংবা হোক ক্ষুদ্র।।
রাজা হ’য়ে প্রজার করিলে অত্যাচার।
প্রজাদ্রোহী রাজার যে রাজ্য রাখা ভার।।
তোমরা থাকহ বাপ আমি একা যাই।
বলিব সে কৃষ্ণদাস হরিদাস ঠাই।।
আমি ব্রাহ্মণের কন্যা যাইব তথায়।
তারা যদি না শুনে বলিব তার মায়।।
এত বলি ঠাকুরাণী করিল গমন
পথে যেতে ঠাকুরাণী ভাবে মনে মন।।
ধরিয়া প্রজার ধার শোধ নাহি দেয়।
এই অপরাধ করে মম পুত্রদ্বয়।।
প্রজা হ’য়ে রাজার করিল অপমান।
এই অপরাধে তারা ত্যাজে বাসস্থান।।
কহিব এ সব কথা ঠাকুর গোচরে।
দেখি অপরাধ ক্ষমা করে কি না করে।।
ঠাকুরাণী উত্তরিল এসে ওঢ়াকাঁদি
মহাপ্রভু সে দিন ছিলেন মল্লকাঁদি।।
যথোচিত বলিলেন কৃষ্ণদাস ঠাই।
পূর্ব ভদ্রাসনে চল এই ভিক্ষা চাই।।
কৃষ্ণদাস ব্রাহ্মণীর চরণ ধরিয়া।
কহিলেন বহুমত বিনয় করিয়া।।
না গো মাতা পূর্ববাটী আমরা যাব না।
কি দোষে ছাড়িব ভিটা ভাবিয়া দেখনা।।
পুণ্যাত্মা মহান বাবু রামরত্ন রায়।
ভালোবাসি দিয়াছেন মোদের আশ্রয়।।
দুই ভাই করিয়াছে পদ্মবিলা ঘর।
আমরা এখানে আছি তিন সহোদর।।
এখনে এ ঘর বাড়ী ত্যাজিব কেমনে
কেমনে যাইব মোরা পূর্ব ভদ্রাসনে।।
ব’লনা এমন বাণী করি তাই মানা।
তোমার এ বাক্য রাখা কিছুতে হবে না।।
এত শুনি ঠাকুরাণী ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
উপস্থিতা হৈলা মাতা অন্নপূর্ণা পাশ।।
কহিছে ব্রাহ্মণ কন্যা অন্নপূর্ণা ঠাই।
শুনগো মা তব ঠাই এই ভিক্ষা চাই।।
অপরাধ করিয়াছে মম পুত্রদ্বয়।
দোষ ক্ষমা করি চল নিজালয়।।
মাতা অন্নপূর্ণা বলে কি কথা বলহ।
এ কথা বলিলে হয় অনর্থ কলহ।।
দ্বিজকন্যা কহে অতি মিনতি করিয়া।
তব পুত্রগণ আসে বসতি ছাড়িয়া।।
তব পুত্রে মম পুত্র করে অপমান।
সেই রাগে তাদের ছাড়াল বাসস্থান।।
ধারিয়া প্রজার ধার নাহি করে শোধ।
পুত্র অপরাধী তাই করি অনুরোধ।।
এই তুচ্ছ অপরাধ মোরে কর ক্ষমা।
তব নিজ আশ্রমে এখনে চলগো মা।।
কহিছেন প্রভুমাতা হ’য়ে অসন্তোষ।
তোমার পুত্রের এইভাব, তুচ্ছ দোষ।।
এ হ’তে কি বড় অপরাধ আছে এ ধরায়।
এ দোষ ধরিতে ধরা স্বীকার না হয়।।
বিশ্বাস ঘাতকী দোষ শাস্ত্রে আছে দেখি।
মহাপাপী যেইজন বিশ্বাস  ঘাতকী।।
অত্যাচারে ভিটাছাড়ি মনে হ’য়ে দুঃখী।
শেষে ঋণ শোধ দিলে পাপ হ’ত নাকি।।
কহিলেন দ্বিজকন্যা কটু না বলিও।
কর বা না কর ক্ষমা যা ইচ্ছা করিও।।
জন্মিয়াছি ব্রহ্মবংশে ব্রাহ্মণের কন্যে।
করিলাম অনুরোধ নিন্দহ কি জন্যে।।
বাক্য যদি নাহি মান আমি ফিরে যাই।
আমি মন্যু করিলে তাতে কি ভয় নাই।।
কহিছেন প্রভুমাতা মন্যু আর কিসে।
রাজকোপে দেশ ছাড়া কত কষ্ট শেষে।।
এক্ষণেতে মন্যু কর কিংবা দেও শাপ।
তাতে কোন তাপ নাই করি নাই পাপ।।
যে হউক সে হউক তবে আমি বলি এই।
তুমি বা কি শাপ দিবে আমি শাপ দেই।।
যেমন আমার পুত্র হ’ল দেশান্তরী।
হউক তোমার পুত্র কড়ার ভিখারী।।
মম পুত্রগণে পায় দেশ ছেড়ে ক্লেশ।
তেমন তোমার পুত্র ছাড়া হোক দেশ।।
এতশুনি রাজমাতা গেলেন ফিরিয়া।
অশ্রুপূর্ণা নেত্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া।।
কালক্রমে সেই শাপ আসিয়া ফলিল।
সেই ঠাকুরাণীর দুই পৌত্র যে ছিল।।
দু’জনার নাম হ’ল বিনোদ বিহারী।
ঋণদায়ী হইয়া গেল সে জমিদারী।।
ঘৃতকাঁদি আসিলেন হ’য়ে দেশান্তরী।
একাকী আছেন মাত্র সব গেছে মরি।।
অবশ্য মহৎ বাক্য নহে ব্যভিচারী।
অধর্মের প্রাদুর্ভাব দিন দুই চারি।।
যথা ধর্ম তথা জয় চরাচরে ব্যাপ্ত।
অতলে ভূতলে আর আছে স্বর্গ সপ্ত।।
অধর্ম কারণে রাজপুত্র দুই জন।
রাজ্যভ্রষ্ট তাহাও দেখিল সর্বজন।।
কালক্রমে ধর্মাধর্মে ফলে ফলাফল।
কহিছে তারকচন্দ্র হরি হরি বল।।
 
ভক্তগণের মতুয়া খ্যাতি বিবরণ।
পয়ার
ওঢ়াকাঁদি রাউৎখামার মল্লকাঁদি।
ভ্রমণ করেন হরিচাঁদ গুণনিধি।।
সঙ্গে ভক্তগণ ফিরে পরম আনন্দে।
নাম সংকীর্তন গান হ’তেছে স্বচ্ছন্দে।।
নিজ গ্রামে শ্রীধামের পশ্চিম অংশেতে।
উপনীত হইলেন দাসের বাটীতে।।
একে একে বহুভক্ত আসিয়া মিলিল।
সভা করি ভক্তগণ সকলে বসিল।।
হরি কথা কৃষ্ণ কথা নামপদ গায়।
মধ্যবর্তী মহাপ্রভু বসিয়া সভায়।।
একে একে গ্রামের অনেক লোক আসি।
সভা করি বসিলেন যত গ্রামবাসী।।
পূর্বদিকে মহাপ্রভু পশ্চিমাভিমুখে।
গ্রামীলোক দক্ষিণে প্রভু বামদিকে।।
পশ্চিম দিকেতে বসি ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।
ভক্তগণ প্রেমাবেশে করে ঢলা ঢলি।।
কিছুদূর উত্তরে বসিয়া বামাগণ।
হুলুধ্বনি দিতেছে শুনিয়া সংকীর্তন।।
হেনকালে তিন জন ব্রাহ্মণ আসিল
সভামধ্যে আসিয়া তাহারা দণ্ডাইল।।
সবে বলে বসুন বিছানা আছে অই।
তারা বলে হরিচাঁদ প্রভু তিনি কই।।
ভক্তগণ বলে যদি নাহি চিন কই।
জগতের ঠাকুর বসিয়া তিনি অই।।
একদৃষ্টে তাহারা প্রভুর পানে চায়
তপস্বী বৈরাগী ওঠে হেনকালে কয়।।
দেখিলে ঠাকুর ওরে ঠাকুর তনয়।
ঠাকুর দেখিলে ওরে প্রণমিতে হয়।।
তিন বিপ্রের একজন মধ্যমবয়স।
আর দু’টি বয়সেতে পৌগণ্ডের শেষ।।
এই দুই ব্রাহ্মণ তাহার একজন।
ঠাকুরে প্রণাম করে শুনি সে বচন।।
একটি প্রণামে দাঁড়াইয়া আর জন।
কৈশোর প্রথমাবস্থা সেই যে ব্রাহ্মণ।।
চাহিয়া ঠাকুরপানে নেত্র তার স্থির।
সেই ব্রাহ্মণের ছিল অসুস্থ শরীর।
তপস্বী বৈরাগী তবে উঠে সভা হ’তে।
ব্যাধিযুক্ত ব্রাহ্মণেরে লাগিল কহিতে।।
ঠাকুর দেখিতে এলে প্রণমিতে হয়।
দেখিলেত ঐ বিপ্র প্রণমিল পায়।।
এখন পর্যন্ত কেন দাঁড়াইয়া রও।
ঠাকুর দেখিয়া কেন প্রণাম না হও।।
এতেক বলিয়া ব্রাহ্মণের গ্রীবা ধরি।
মত্ত মাতালের প্রায় বলে হরি হরি।
গ্রীবা ধরি চাপ মারি ভূমিতে ফেলায়।
বলে বাবা দেরে সেবা ঠাকুরের পায়।।
চাপ পেয়ে যেই দ্বিজ প্রণাম করিল
মঙ্গল দাড়া’য়ে বলে হরি হরি বল।।
হরিচাঁদ পদ হতে পদরজঃ এনে।
ব্রাহ্মণের মস্তকেতে দেয় টেনে টেনে।।
এইমত তিনবার ধুলি দিয়া গায়।
অঙ্গেতে যে ব্যাধি ছিল তাহা সেরে যায়।।
ব্যাধিমুক্ত হ’য়ে দ্বিজ সভাজনে কয়।
অবতীর্ণ সামান্য মানুষ ইনি নয়।।
ক্ষণেক থাকিয়া তবে দ্বিজেরা চলিল
সভাসদ বিপ্র যত রাগান্বিত হ’ল।।
গ্রামবাসী বহিরঙ্গ লোক যত ছিল।
তাহাদের অতিশয় রাগ উপজিল।।
ব্রাহ্মণে লইয়া করে বিরোধাচরণ।
ইহাদিগে কৃষ্ণভক্ত বলে কোন জন।।
কি পেয়েছে কি হ’য়েছে ঠাকুরালী করে।
ঠাকুর বলয় যশোমন্তের কুমারে।।
অবৈধ সকল কাজ বিধি নাহি মানে।
সমাজের বাধ্য নয় এই কয় জনে।।
শুন সবে প্রতিজ্ঞা করিনু আজ হ’তে।
ইহাদের সঙ্গে না করিব সমাজিতে।।
নাহি মানে দেব দ্বিজ আলাহিদা পথ
ইহারা হ’য়েছে এক হরিবোলা মত।
আহারাদি না করিব ইহাদের সঙ্গ।
অদ্য হ’তে গ্রাম্যভাব করিলাম ভঙ্গ।।
সে হইতে গ্রামবাসী হৈল ভিন্নদল।
সে অবধি হরিবোলা পৃথক সকল।।
বিবাদীরা বলে ওরা হ’য়েছে  পাগল।
কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নাহি বলে হরিবোল।
হরিবোলা দেখে উপহাস করে কত।
সবে বলে ও বেটারা হরিবোলা ম’তো।।
কেহ বলে জাতিনাশা সকল মতুয়া।
দেশ ভরি শব্দ হ’ল মতুয়া মতুয়া।।
অন্য কেহ যদি হয় হরিনামে রত।
সবে করে উপহাস অই বেটা ম’তো।।
অন্য অন্য গ্রাম আড়োকাঁদি ওঢ়াকাঁদি
সে হইতে হ’য়ে গেল ‘মতুয়া’ উপাধি।।
তাহা শুনি ডেকে বলে প্রভু হরিচাঁন।
ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা ‘মতুয়া’ আখ্যান।।
মতুয়া উপাধি খ্যাত জগতের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free