মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৩৬১-৩৮০

মম পিতা হরিচাঁদ মানবের তরে
এসেছিল এ জগতে নরদেহ ধরে
।।
বিশ্ববাসী মানবের যাতে শুভ হয়

সেই ধর্ম্ম নীতি কথা বলেছে সদায়
।।
মানব গোষ্ঠীর তাতে সুমঙ্গল হবে

নরজাতি দিনে দিনে সে-ধর্ম্ম জানিবে
।।
সেই নীতি শিরে করি আমি কাজ করি

আমার ভরসা মাত্র দয়াল শ্রীহরি
।।
জগত-বান্ধব ছিল হরি দয়াময়

-বিশ্ব তারণ-কথা তাঁরে শোভা পায়
।।
মোর মধ্যে সেই শক্তি কিছু মাত্র নাই

পিতার আদেশ মাত্র বহিয়া বেড়াই
।।
তিরোধন পূর্ব্বে তিনি ডাকিয়া নিকটে

আমাকে বলিল কথা অতি অকপটে
।।
দলিত পীড়িত যত বিদ্যাহীন নর

মতাদুঃখে কাটে কাল পৃথিবী-ভিতর
।।
তাদের দুঃখের বোঝা বিদ্যা বুদ্ধি দানে

দূর করে দিতে আজ্ঞা করে ততক্ষণে
।।
অগ্রভাগে বঙ্গবাসী নমঃশূদ্র গণে

উদ্ধার করিতে বলে আনন্দিত মনে
।।
নিপীড়িত জাতি মধ্যে এজাতি প্রধান

অগ্রভাগে করি তাই তাদের কল্যাণ
।।
নমঃশূদ্র সে আদর্শ করিলে গ্রহণ

তাঁদের ধরিয়া ধন্য হবে অন্য জন
।।
তাহার প্রমাণ আজি দেখ হে সবাই

অবশ্য ঘটিছে সব মিথ্যা বলি নাই
।।
আমার পিতার ভক্ত মতুয়া যাহারা

দেশে দেশে কোন কর্ম্ম করিয়াছে তাহারা?
আর বলি শোন কথা কথার চূড়ান্ত

নমঃশূদ্র দেখ আজি কত ভাগ্যবন্ত
।।
অস্পৃশ্য চন্ডাল বলি গালি দিত যারা

শিষ্যরূপে আজি দেখ পদানত তারা
।।
মতুয়ার গণ চলে আজি দেশে দেশে

এক বস্ত্র ধারী বটে বেহালেল বেশে
।।
নির্ব্বাণ-আগ্নেয়গিরি যথা ঘুমে রয়

সেই মত মতুয়ারা ঘুরিয়া বেড়ায়
।।
কার্য্যকালে মহোল্লাসে অগ্নি সম জ্বলে
।।
পাপী তাপী তর্কবাদী ডুবায় সকলে
।।
শক্তি দেখি ভক্তি দেখি যত জীব কুল

মতুয়ারে গুরু করে হইয়া আকুল
।।
চন্ডালত্ব ঘুচাইয়ে দিল ব্রহ্ম-পদ

তাই বুঝি মতুয়ারে ভেবেছে আপদ
।।
চিরকাল পরপদ-ধূলি মাখ অঙ্গে

তোমরা কিসের তুল্য মতুয়ার সঙ্গে?
তোমাদের মান দিতে তাঁরা হল দোষী

গোবরের পোকা যেন গোবরেতে খুশী
।।
আরো বলি শোন কথা নমঃশূদ্রগণ

অনর্থক ক্রোধ সবে কর কি কারণ?
নমঃ জাতি নাম ভাল নমস্য সবার

নমস্কার পেতে লাগে কোন ব্যবহার?
ধর্ম্ম আর বিদ্যাবলে চিত্ত শুদ্ধ হয়

চিত্ত-শুদ্ধ জনে সবে ভকতি জানায়
।।
তোমার জাতির মধ্যে সেই গুণ কই?
গুণ যদি নাহি থাকে কিসে বড় হই?
মতুয়ার দ্বেষ কত কর মনে মনে

ভেবে দেখ সব কর শুধু অকারণে
।।
এক সঙ্গে তারা সবে করিছে আহার

তার মধ্যে দোষ বাপু বল কি তাহার?
শ্রীক্ষেত্র পুরুষোত্তমে ব্রাহ্মণ যবন

এক সঙ্গে করে থাকে প্রসাদ গ্রহণ
।।
সীমাবদ্ধ স্থানে যদি এত গুণ রয়

মতুয়ার গুণে তাহা হল সর্ব্বময়
।।
শাস্ত্রের দোহাই সবে দেও সর্ব্বদায়

তত্ত্ব তার কোন জনে মান না কোথায়
।।

পুরাণের বাক্য বলি শান সবে বসি
নারদের ঠাঁই প্রভু যাহা বলে আসি
।।
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে নচে যোগিণাং হৃদয়ে

মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ
।।
যেই খানে হরি নাম গুনগান হয়

আপনি বৈকুন্ঠনাথ উদয় তথায়
।।
যেখানে উদয় হয় কমল লোচন

ক্ষেত্র হতে হীন তারে বলে কোন জন
।।
প্রেমানন্দে মতুয়ারা নাম গান গায়

অন্ন কোথা শ্রীনাথের প্রসাদান্ন খায়
।।
প্রসাধের মধ্যে যেবা আনে ভিন্ন ভেদ

তার পক্ষে প্রসাদ তো নরকের ক্লেদ
।।
শ্রীক্ষেত্রের ভাব আজি প্রতি ঘরে ঘরে

আমার পিতার ভক্ত মতুয়ারা করে
।।
এসব দেখিয়া তবু আছ দৃষ্টি হীন

কয়লা ছাড়িতে কভু পারেনা মলিন
।।
ছেড়ে দাও গন্ডগোল আঁখি মেলে চাও

সাধুর তরঙ্গে ডুবে প্রাণ ভরে খাও
।।
অভিমান বশে সবে হয়ে আছ অন্ধ

অন্ধকারে বসে পায় পেচকে আনন্দ
।।
হিংসা হিংসি দ্বেষা দ্বেষী ভুলে যাও তাই

একতা বিহনে দেখ উদ্ধার ত নাই
।।
আর কথা বলি যাহা শোন মন দিয়া

নরনারী বিদ্যাশিক্ষা কর এক হইয়া
।।
মাতা ভাল নাহি হলে পুত্র ভাল নয়

মার গুনে ছ ভাল লোকে তাই কয়
।।
এই যে ডক্টর মীড বসিয়া এখানে

তোমাদের জন্যে চিন্তা করে সর্ব্বক্ষণে
।।
নারীর শিক্ষার তরে এই মহামতি

ওড়াকান্দি বিদ্যালয় করেছে সম্প্রতি
।।
ইহার সঙ্গিনী যিনি মিস টাক নাম

নারীর উন্নতি লাগি চেস্টা অবিরাম
।।
কত ঋণী নমঃশূদ্র ইহাদের ঠাঁই

সে সব বলিব কিবা গুণে সীমা নাই
।।
বহু কথা একা আমি বলিয়াছি হেথা

এবে সবে শোন তবে সাহসের কথা
।।
বসিবার পূর্বে পুনঃ বলি আরবার

ধর্ম্ম আর বিদ্যা বিনে নাহিক উদ্ধার
।।
পবিত্র চরিত্র জানি সর্ব্ব নীতি সার

ধর্ম্মে কর্ম্মে সর্বখানে মান সদাচার
।।
এত বলি দয়াময় বসিল আসনে

আকাশ ভরিয়া গেল জয় জয় গানে
।।
অতঃপর উঠিলেন মীড মহামতি

অনেক বলিল কথা করিয়া যুকতি
।।
সার মর্ম্ম তার কিছু ত্রিপদীর ছন্দে

বলিব সবার ঠাঁই মনের আনন্দে
।।

কহে মীড বাস্তবিক
আজিকার দিনে

কেন হেন মনে হল
ভার মোর মনে
।।
বৈদেশিক আমি ঠিক
ভিন্ন জাতি ভাষা

দীনজনে কৃপা দানে
মনে মোর আশা
।।
আমি বঙ্গে মনোরঙ্গে
ভ্রমিয়া বেড়াই

যাঁরে চাহি তাঁরে নাহি
খুঁজিয়া ত পাই
।।
মনে মনে সর্ব্ব ক্ষণে
করি অন্বেষণ

তবু দেখা প্রাণ সখা
না দেয় কখন
।।

 

 

দিনে দিনে মনে প্রাণ
হতেছি হতাশ

এ সময় দয়াময়
দিলেন আশ্বাস
।।
কিবা নাম শুনিলাম
গ্রাম ওড়াকান্দী

শুনি কানে সেই ক্ষণে
মন হল বন্ধী
।।
আসিলাম দেখিলাম
বুঝিলাম মনে

খুঁজি যারে হেথাকারে
রয়েছে গোপনে
।।
দীন গৃহে ঢেকে রহে
আপন সৌরভ

অন্ধ জাতি ছন্ন মতি
জানেনা গৌরব
।।
দেখা মাত্রে প্রেম সূত্রে
বাঁধিয়াছে মোরে

শক্তি নাই কোথা যাই
ছাড়িয়া তাহারে
।।
তাতে বলি মহাবলী
নমঃশূদ্রগণ

জান মনে এই জনে
পরম রতন
।।
হেন রত্ন বিনা যত্ন
আসেনা কোথায়

ভুল করে যেন তারে
ছেড় না হেলায়
।।
কি জঞ্জাল হে চন্ডাল
বলিত যাহারে

কৃপা করে নিজ করে
উদ্ধারে তাহারে

মোরে বাধ্য করে সাধ্য
হেন নাহি কার

মোরে বান্ধে গুরুচাঁন্দে
মহিমা তাহার
।।
ওঠ জাড়ি কিবা লাগি
রয়েছে আঁধারে

দীপ্ত রবি সম ছবি
তোমাদের ঘরে
।।
বলে যাহা কর তাহা
মন ঠিক কর

ডেকে যায় এ সময়
তাঁর পথ ধর
।।
মতিমান দেবীচান
গুণেতে বাখানি

কুল শ্রেষ্ঠ ইষ্ট নিষ্ঠ
তারে আমি জানি
।।
একত্রতা বান্ধবতা
তার সাথে মোর

হেথা আসি মিশামিশি
প্রেমেতে বিভোর
।।
দলে দলে সর্ব্ব স্থলে
জাগ নমঃশূদ্র

কেন হায় এ ধরায়
রবে সবে ক্ষুদ্র
।।
নমঃ জাতি প্রতি প্রীতি
মোর সদা আছে

চিরদিন মোর ঋণ
আছে নমঃকাছে
।।
বলি তাই শোন ভাই
ওঠ সবে জেগে

সিংহ প্রায় যেতে হয়
বীর অনুরাগে
।।

কর হুষ কি মানুষ
আসিয়াছে ঘরে

ধর তারে নিষ্ঠা ভরে
অন্তরে বাহিরে
।।
এ সুযোগ যোগাযোগ
বড়ই আশ্চর্য্য

মনোমত অবিরত
কর সবে কার্য
।।
যে কান্ডারী দয়া করি
ধরিয়াছে হাল

অন্যজনে কোন গুণে
পায়না নাগাল
।।
এ সৌভাগ্য পেতে যোগ্য
নহে অন্য কেহ

কেন জানি গুণমনি
করেছে এ স্নেহ
।।
উপদেশ করি শেষ
মহতী সভায়

কর সবে উচ্চ রবে
গুরুচাঁদ জয়
।।
ভাবেবে করিল মীড বাক্য সমাপন

জয় গুরুচাঁদ ধ্বনি করে সভাজন
।।
প্রভু কহে জয় মীড দীনের বান্ধব

সঙ্গে সঙ্গে সভা জনে করে সেই রব
।।
সভা সাঙ্গ করি প্রভু বানিয়ারী রয়

পরদিন উপনীত বড় বাড়ী গাঁয়
।।
শ্রীরাম চরণ নামে অতি ধনবান

তার গৃহে মহাপ্রভু করিল প্রয়াণ
।।
বহু কথা আলোচনা হইল তথায়

তদন্তে পুলিশ সাহেব সেইখানে যায়
।।
বৈদক্রমে প্রভু সঙ্গে হল দেখাদেখি

প্রভুর সঙ্গেতে তেহ করে মাখমাখি
।।
বিনয়ে প্রভুর তেঁহ করিল সম্মান

ভাব দেখি ভক্ত গণে নেচে ওঠে প্রাণ
।।
যেইখানে যায় প্রভু ন ভাব আনে

আনন্দের ঢেউ সদা নাচে সেই খানে
।।
প্রত্যহের রীতি নীতি জীবে ভুলে যায়

আনন্দে পাথরে পড়ি হাবুডুবু খায়
।।
মানবের আচরণে দেখি ব্যবহার

রাজ্য মধ্যে রাজা যবে করেন বিহার
।।
ছুটি পায় কয়েদীরা কাটে কর্ম্ম বন্ধ

জয় মহারাজ বলি করে যে আনন্দ
।।
সামান্য কারার দ্বারমুক্ত হয়ে যায়

সংসার করার বুকে আসি বন্ধু হয়
।।
গুরুচাঁদ আগমনে ভব কারা খোলে

পাপী তাপী, দুঃখী সদা নাচে কুতুহলে
।।
ইহা দেখি মনে হয় তারকের গান

মানুষের আগমনে বহে প্রেম বান
।।
যে যে খানে দয়াময় করিল গমন

জাতির উন্নতি কথা কহে সর্ব্বক্ষণ
।।
সেই বাণী কানে শুনি জাতি জেগে ওঠে

গুরুচাঁদ কৃপা গুণে এত সব ঘটে
।।
ভ্রমণ করিয়া শেষ প্রভু আসে ঘরে

জয় ধ্বনি করে সবে আনন্দ অন্তরে
।।
ঘরে ঘরে ঘুরে প্রভু প্রেম-বাতি জ্বলে

সেজে অন্ধ মহানন্দ চক্ষু নাহি মেলে
।।

 

ভক্তালয় ভ্রমণ
(দ্বিতীয় পর্ব)


চাঁদকাঠি ভ্রমণ


বরিশাল জিলা মধ্যে চাঁদকাঠি গ্রাম

গোপাল বিশ্বাস নামে ভক্ত গুণধাম
।।

শ্রীউমাচরণ হয় তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই
বইবুনে গ্রামে তিনি থাকে ভিন্ন ঠাঁই
।।
এই বই বুনে ঘাটে গোলক পাগল

হাঁড়ি ভেঙ্গে ঘাটে বসে বলে হরি বোল
।।
বইবুনে ছাড়ি পরে গোপাল বিশ্বাস

চাঁদকাঠি গ্রামে আসি করিলেন বাস
।।
দুই পুত্র গোপালের সবে ইহাজানে

গোপাল বিশ্বাস ধন্য ছিল ধনে মানে
।।
ধন্য শ্রীগোপাল সাধু বাস লহ্মীখালী

গোপালে গোপালে পরে হল কোলাকুলী
।।
গোপাল বিশ্বাস পরে নিজ পুত্র সনে

সাধুর কন্যার বিবাহ দিল হৃষ্ট মনে
।।
এ সব পরের কথা পশ্চাতে বলিব

এবে শুন পূর্ব্ব কথা সংক্ষেপে কহিব
।।
গোপাল বিশ্বাস সদা ওড়াকান্দী যায়

দৃঢ় নিষ্ঠা আছে তার ঠাকুরের পায়
।।
এক দিন সে গোপাল করে নিবেদন

দয়া করি চল প্রভু আমার ভবন
।।
অগ্রভাগে প্রভু তাতে নাহন স্বীকার

গোপালের চক্ষে বারি ঝরে ঝর ঝর
।।
ভক্তের ক্রন্দন দেখি প্রভু দয়া করে

চলহে গোপাল তবে যাই তব ঘরে
।।
পরে দিন স্থির করি দিলেন ঠাকুর

গোপালের মনে শান্তি আসিল প্রচুর
।।
দিন মত সে গোপাল উপস্থিত হল

পরদিন প্রাতেঃ কব ঠাকুর কহিল
।।
কৃষ্ণপুর বাসী ভক্ত শ্রীবিপিন বালা

তারিণীর ভাই সেই বড় দেল-খোলা
।।
ঠাকুর তাহারে কহে শুনহে বিপিন

কল্য যাব চাঁদকাঠী করিয়াছি দিন
।।
তোমরা যতেক ভক্ত আছে কৃষ্ণপুরে

আমার সঙ্গেতে যেতে হবে তথাকারে
।।
যে-আজ্ঞা বলিয়া তবে বিপিন ছুটিল

অল্পক্ষণে নিজ দেশে উপস্থিত হল
।।
চাঁদকাঠি হতে যেই নৌকা এসেছিল

সেই নৌকা পরে প্রভু আপনি উঠিল
।।
বিপিন দেশেতে গিয়া করে পরচার

চাঁদকাঠি চলিয়াছে প্রভুজী সুন্দর
।।
মনে যদি বলে তবে এসো হে ছুটিয়া

দিন গেল এই দিন পাবে না ফিরিয়া
।।
বিপিনের ভীর শুনি ষষ্ঠীবাবু আসে

লহ্মীকান্ত সোনাতন এল দীন বেশে
।।
উমাচরণ রাজকুমার দুই জন

এক সঙ্গে জুটি সবে করিল গমন
।।
এ দিকেতে প্রভু চলি গেল পাটগাতী

মন্ডল বাড়ীতে উঠে অতি হৃষ্ট মতি
।।
প্রভু আগমনে তবে সেই মন্ডলেরা

ত্রস্ত ব্যস্ত সবে যেন হল জ্ঞান-হারা
।।
বহুৎ সম্মান করি কুলেতে উঠায়

খাদ্য দ্রব্য আয়োজন বহু করে তায়
।।
কৃষ্ণপুরবাসী সবে হইয়া সত্বর

উপস্থিত জোয়ারিয়া অভয়ের ঘর
।।
অভয়াচরণ নাম উপাধি শিকদার

মতুয়ার গণে দিল উত্তর আহার
।।
মতুয়ারা তথা হৈতে যবে যাত্রা করে

দুটী মাছ আনি দিল ঠাকুরের তরে
।।
প্রচন্ড কবজী মাছ নধর গঠন

মতুয়ারা তাহা নিয়া করিল গমন
।।
মিত্র ডাঙ্গা বাসী সাধু শ্রীহাদান রায়

ঠাকুরের পদে তাঁর নিষ্ঠা অতিশয়
।।
সেই বাড়ী মতুয়ারা উপস্থিত হ

বহু যত্নে সে হাদান শুশ্রূষা করিল
।।
হাদানের বৃদ্ধা মাতা অতি ভক্তিমতী

মনোদুঃখে বলিতেছে মতো গণ প্রতি
।।

এতই অভাগী আমি ভক্তি শক্তি নাই
কর্ম্মদোষে গুরুচাঁদে দেখা নাহি পাই
।।
এতেক বলিয়া বুড়ী কান্দিল প্রচুর

কান্না তার দেখিলেন দয়াল ঠাকুর
।।
মতুয়ারা বলে মাগো! নাহি কান্দআর

মনের বাসনা পূর্ণ হইবে তোমার
।।
তথা হতে টুঙ্গীপাড়া হল উপস্থিত

শ্রীতপস্বী বালা গৃহে হল অধিষ্ঠিত
।।
হেন কালে পাটগাতী বাসী একজন

সেই বাটী উপস্থিত হইল তখন
।।
সে বলে এখানে বসে রহিয়াছে সবে

পাটগাতী হতে প্রভু এখনি উঠিবে
।।
কথা শুনি কয়জনে শ্রীঘ্রগতি ধায়

মনে ভাবে কোথা দেখা পাব দয়াময়
।।
এদিকে ঠাকুর তবে পাটগাতী ছাড়ি

কিছুপরে ধরিলেন মধুমতী পাড়ি
।।
মাশীখালী গ্রামে ঘর শ্রীবদন রায়

তস্য গৃহে উপস্থিত প্রভু দয়াময়
।।
কিছু পরে কৃষ্ণপুবাসী ভকতেরা

উপস্থিত সেই বাড়ী চক্ষে জল ধারা
।।
দয়া করি দয়াময় কহিল ডাকিয়া

কি বিপিন! ষষ্ঠিবাবু! এসেঝ ছুটিয়া?”
তাহার কান্দিয়া বলে ওগো কৃপাময়

তোমার ইচ্ছামতে ভবে সর্ব্ব কর্ম্ম হয়
।।
রজনী বঞ্চিল প্রভু বদনের বাড়ী

ভক্তগণে বলে হরি সারারাত্রি ভরি
।।
যামিনী বিদায় হল প্রভাত আসিল

প্রভু বলে আর কেন শ্রীঘ্র শ্রীঘ্র চল
।।
নামেতে অভয়চন্দ্র নাওটানা বাড়ী

প্রভুর চরণে তলে পড়িলেন গড়ি
।।
প্রভু কয় কি অভয় কি ভাব অন্তরে?
শ্রীঘ্র করি রাঁধ ভাত যাব তব ঘরে
।।
আনন্দে অভয় তবে ছুটিয়া চলিল

অল্পপরে নিজ গৃহে উপস্থিত হল
।।
সুসংবাদ দিল যবে আপনার ঘরে

নর নারী সবে কান্দে ব্যাকুল অন্তরে
।।
অভয় বলিল সবে স্থির কর মন

শ্রীগুরু স্মরিয়া সবে করহ বন্ধন
।।
আমাদের দেখ বটে কোন গুণ নাই

দয়া করে আসে প্রভু তাই তাঁরে পাই
।।
তাঁর দয়া মনে করে ভাব গো তাঁহারে

রাঁধ গে সকল-কিছু তাঁরে চিন্তা করে
।।
মাতাগণে ব্যস্ত হয়ে করিছে রন্ধন

প্রভুকে স্মরিয়া সদা ঝরিছে নয়ন
।।
হেনকালে প্রভু আসি ঘাটেতে উদয়

নারীগণে হুলুধ্বিনি করিছে সদায়
।।
তাহাদের ভাব দেখি সুখী দয়াময়

রজনী রঞ্চিল তথা হইয়া সদয়
।।
আহারাদি আয়োজন হৈল বহুমতে

সন্ধ্যাকালে মতুয়ারা মাতিল নামেতে
।।
এই ভাবে রাত্রি শেষে প্রভাত সময়

সাঙ্গ পাঙ্গ লয়ে প্রভু চাঁদকাঠি যায়
।।
বহু ধনবান ছিল গোপাল বিশ্বাস

মহাতেজে করিলেন সেই দেশে বাস
।।
প্রভু আগমন জিন্য পুরী ধন্য হয়

বহু ভক্তি দেখাইল সেই মহাশয়
।।
প্রভু আগমন বার্ত্তা চারিদিকে ধায়

দলে দলে ভক্ত আসি জুটিল তথায়
।।
শ্রীনীলকমল বালা ডাকিতিয়া বাড়ী

প্রভুর চরণে তাঁর নিষ্ঠা ছিল ভারী
।।
তার ইচ্ছা ঠাকুরকে নিবে নিজ ঘরে

করজোড়ে সেই ভাবে দরবার করে
।।
গোপাল বিশ্বাস তাহে ভাবে মনে মন

অপরের বাড়ী প্রভু যাবে কি কারণ?

এত ভাবি এক বুদ্ধি করে মহাশয়
সকলেরে ডাকি কথা রটনা করয়
।।
ঠাকুরে এনেছি মোরা আপন-নৌকায়

প্রভুকে পাঠাব তাতে কহি পুনরায়
।।
কেহ যদি নিজগৃহে প্রভুকে লইবে

নিজ নিজ নৌকা তারা জোগাড় করিবে
।।
একথা শুনিল যবে নীলকমল বালা

গোপালের পদে পড়ি কহে সেই বেলা
।।
কাঙ্গাল দেখিয়া মোরে হইলে বিমুখ

এ কারণে মনে বড় পাইতেছি দুঃখ
।।
দয়াকরে আজ্ঞা কর নিয়ে চলি তরী

মম গৃহে যায় যদি অকুল কান্ডারী
।।
এই মত বহু কথা বলে সেই জন

তাহাতে ভিজেনা তবু গোপালের মন
।।
সে নীলকমল তবে নিরাশ হইয়া

বদন রায়ের পদে পড়িল আসিয়া
।।
বদনের শিষ্য বটে সেই মহাজন

করিব উপায় বলে ভাবিয়া বদন
।।
নৌকা দিল আর লোকে দিল কত জন

বলে এতে ঠাকুরকে কর আনয়ন
।।
বল পেয়ে তারা সবে তরণী ছুটাল

অন্তর্য্যামী দয়াময় সব টের পেল
।।
গোপালের বাড়ী হতে লইয়া বিদায়

নড়াগ্রামে উপস্থিত হল দয়াময়
।।
সেইখানে দেখা হয় বিপিনের সাথে

অতঃপর দুই নৌকা চলে এক পথে
।।
বেগবতী মধুমতী তরঙ্গেতে ভরা

পাড়ি দিতে শঙ্কা করে সাথী সঙ্গী যারা
।।
মহাপ্রভু বলে তোরা কেন বসে রলি?
সিংহ-শিশু হয়ে শেষে শৃগাল সাজালি
।।
এই বাক্য বলে যদি প্রভু দয়াময়

সঙ্গী সাথী দেহে যেন মহাবল পায়
।।

জয় হরিচাঁদ জয় গুরুচাঁদ জয়
ধ্বনি করে তরঙ্গেতে তরণী ভাসায়
।।
পর্ব্বত প্রমাণ ঢেউ আসিছে ছুটিয়া

ঠাকুরের তরী অগ্রে পড়িছে লুটিয়া
।।
নৌকা স্পর্শ মাত্র তারা সবে শান্ত হয়

ঠাকুরের তরী তাহে চলে নিরালায়
।।
উচ্চ-ফণা ফণী যথা ধরে মহারোষে

সাপুড়িয়া দেখে শির নত করে শেষে
।।
সেই মত ঢেউগুলি তোলে উচ্চশির

ঠাকুরের নৌকা দেখে হয় যায় স্থির
।।
পরপারে এসে লাগে ঠাকুরের তরী

বিপিনের নৌকা দূরে তরঙ্গ-উপরি
।।
মনে হয় নৌকা বুঝি ডোবে সেই ক্ষণে

বাহকেরা বাহে নৌকা শঙ্কাকুল মনে
।।
ক্ষণে ক্ষণে ডাক দেয় বাবা গুরুচাঁন

দয়া করে রক্ষা কর আমাদের প্রাণ
।।
হেনকালে বজ্রকন্ঠে কহিল ঠাকুর

বিপিন বিপিন তুই আর কত দূর
।।
বিপিন শুনিল ধ্বনি নদীর মাঝারে

দেখিল তরঙ্গ থেমে গেছে একেবারে
।।
দুই ঢেউ জলমাত্র উঠেছিল নায়

প্রভুর ডাকের পরে সব থেমে যায়
।।
কূলেতে পৌছিল যবে বিপিনের নাও

প্রভু বলে কি বিপিন কোন পথে যাও?
পাছে পাছে না থাকিলে দেখ কিবা ফল

ফাঁক পেয়ে ঢেউ দেখ তুলিয়াছে জল
।।
ভাত যদি ছাড় তবু সাথ ছেড় না রে

সাথী ছাড়া হলে রক্ষা নাহি এ সংসারে
।।
প্রভুর বচনে তারা ভাবিছে হৃদয়

এমন দয়াল বন্ধু আছে কে কোথায়?
দয়া করে নিজ হাতে ডোবাটেনে তোলে

দুঃখী তাপী পাপী সব লয় নিজ কোলে
।।

এতেক ভাবিয়া চক্ষে বহে প্রেম বারি
প্রভু কয় নৌকা সবে খোল ত্বরা করি
।।
হেন কালে বদনের যত লোক জন

প্রভুর নৌকার পাশে উদয় তখন
।।
জিজ্ঞাসা করিল তারা এই নৌকা কার?
প্রভুর সঙ্গীরা কহে ওড়াকান্দী ঘর
।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আছে নৌকা পরে

তোমরা কাহারা তাহা বল ঠিক করে
।।
তারা কহে এই নৌকা যাইবে কোথায়?
প্রভুর সঙ্গীরা কহে ডাকাতিয়া গাঁয়
।।
এতেক বচন শনি তাহারা সকলে

প্রভুর নৌকার কাছে আসে দ্রুত চলে
।।
তারা বলে মোরা আসি লইতে ঠাকুরে

ঠাকুর বলিল তবে বাও জোর করে
।।
বলামাত্র জোরে তবে তরণী বাহিল

ডাকাতিয়া গ্রামে আসি উপস্থিত হল
।।
সে নীলকমল তবে আনন্দিত মনে

পাদ্যঅর্ঘ্য আনি দিল প্রভুর সদনে
।।
প্রেমানন্দে নাম গান সবে সেথা করে

রজনী বঞ্চিল সবে সেই ভাব ধরে
।।
রজনী প্রভাতে প্রভু ডাকাতিয়া হতে

উপনীত হল সেই কানারচরেতে
।।
অশ্বিনী ঠাকুর বলি কহে পরিচয়

তার গৃহে গুরুচাঁদ উপনীত হয়
।।
আহারাদি শেষ করে চলিলেন পুনঃ

পরে পরে কোথা গেল ক্রমে ক্রমে শুন
।।
অশ্বিনী গোঁসাই ধন্য গঙ্গাচর্ণা গ্রামে

শ্রীহরি সঙ্গীত রচে হরিগুরু নামে
।।
পিককন্ঠ গোস্বামীজী মহাভাবময়

যথা যান গুরুচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে যায়
।।
প্রেম মাখা সুরে তেঁহ সদা রাত্র দিনে

সঙ্গীতের ডালি দেয় শ্রীগুরু-চরণে
।।
তাঁর গৃহে উপনীত হন দয়াময়

প্রেমানন্দে অশ্বিনীর চোখে ধারা বয়
।।
দেশবাসী অশ্বিনীরে বহু ভালবাসে

গুরুচাঁদে দেখিবারে তাঁর গৃহে আসে
।।
ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইয়া তবে দয়াময়

রাজনগরেতে আসি হলেন উদয়
।।
নামেতে প্রহলাদচন্দ্র হালদার গুণী

তাঁর গৃহে উপস্থিত নিজ গুণমণি
।।
মহাসংকীর্ত্তন হল সেই গৃহ পরে

বাহ্যজ্ঞান হারা হল যত নারী নরে
।।
কি এক ভাবের ঢেউ উঠিল কীর্ত্তনে

মোর শক্তি নাহি তাহা করিতে বর্ণনে
।।
দেশকাল পাত্রাপাত্র কোন জ্ঞান নাই

নেচে নেচে হরি বলে সবে ছাড়ে হাই
।।
মাতিয়াছে মতুয়ারা কীর্ত্তন মাঝারে

দূরে থাকি দয়াময় কৃপানেত্রে হেরে
।।
প্রভুর পলক পড়ে মতুয়ার গায়

বিদ্যুতের স্পর্শে যেন প্রাণে নাড়া দেয়
।।
ধন মান জাতি কুল মনে নাহি থাকে

এক লক্ষ্যে সবে মিলে হরি বলে ডাকে
।।
প্রথমতঃ দূরে যারা চুপ বসে ছিল

নামের প্লাবন শেষে তাদের ডুবাল
।।
ক্রমে ক্রমে নর নারী নাহি ভেদ জ্ঞান

জ্ঞান হারা ধূলি পরে গড়াগড়ি যান
।।
এমত প্রহর কাল কীর্ত্তন হইল

শ্রীগুরু আদেশে পরে সকলে থামিল
।।
নেশা ছেড়ে গেলে প্রাণে বিরহ আসিল

শর-বদ্ধ পাখী সম তাহারা কান্দিল
।।
কান্না দেখি গুরুচাঁদ কথা নাহি কয়

ইঙ্গিতে নিবৃত্ত করে ভক্ত সমুদয়
।।
মহাধনী পোদ্দারেরা সবে বড়বাড়ী

শশী বাবু কন্যা বিয়া দিল সেই বাড়ী
।।

সেই বাড়ী হতে আসি লোক একজন
কাতরে প্রভুকে তবে করে আমন্ত্রণ
।।
স্বীকার করিল প্রভু সেই গৃহে যেতে

ভক্ত গণে সবে বলে চল মোর সাথে
।।
আমার কুটুম্ব এরা মহা ধনবান

এই দেশে আছে জানি তাদের সম্মান
।।
কুটুম্বেরে বাড়ী যাব কুটুম্ব আচারে

চল সবে জামা জুতা পরিধান করে
।।
সর্ব্ব নীতি-দাতা জানি গুরুচাঁদ প্রভু

কার কাছে কোন কাজে ঠকিবে না কভু
।।
আপন আদর্শে গড়ে মতুয়া সমাজ

তাই সর্ব্বনীতি জানে মতুয়ারা আজ
।।
সে সব বৃত্তান্ত পরে করিব বর্ণন

এবে শুন শুভ বার্ত্তা প্রভুর বচন
।।
পোদ্দারের বাড়ী পরে গেল দয়াময়

মহাসমারোহ হয় পোদ্দার-আলয়
।।
সমাজের কথা বহু হয় আলাপন

কোন ভাবে এ জাতির হবে জাগরণ
।।
বহু বাক্যভাষী হয় বিহারী পোদ্দার

শ্রীরাস বিহারী হয় অন্য নাম তাঁর
।।
চারি দিকে যত সব প্রধানেরা ছিল

পোদ্দার বাড়ীতে আসি উপস্থিত হল
।।
তেঁহ সঙ্গে গুরুচাঁদ বহুনীতি কয়

শুনিয়া সকল লোক মানিল বিষ্ময়
।।
বেদাঙ্গ, পূরাণ কহে, গীতাধর্ম্ম কয়

স্মৃতি, শ্রুতি, ভাগবত যত শাস্ত্র রয়
।।
সদ্ভাব শতকগ্রন্থ করিব রচনা

ইতিহাসে বধ কাব্য করে আলোচনা
।।
ইতিহাসে কোন রাজা কি কি কার করে?
বর্ণে বর্ণে প্রভু কহে তাদের গোচরে
।।
অশোকের কথা বলে বিবিধ প্রকারে

আকবর, জাহাঙ্গীর মোগলের ঘরে
।।
শাজাহান বাদশার কীর্ত্তিকথা যত

তাজমহল হর্ম্ম্য যাহা পৃথিবী-বিখ্যাত
।।
আধুনিক যুগে যত বড় বড় নেতা

গুরুচাঁদ বলিলেন তাঁহাদের কথা
।।
সে সব কাহিনী শুনি বিস্মিত সকলে

তারা ভাবে প্রভু ইহা কি করিয়া বলে?
ইহার কারণ কিছু শুন বলি ভাই

লোকাচার ধর্ম্মাচার দুইধারা পাই
।।
লোকাচার গুরুচাঁদ বালক বয়সে

বিদ্যাশিক্ষা করিলেন পাঠশালে বসে
।।
পরে স্বীয় গৃহে করে শাস্ত্র অধ্যয়ন

ভাগবত পুরাণাদি করিল পঠন
।।
ইহ পরে রঘুনাথ পন্ডিত আসিল

প্রভুর আজ্ঞাতে তেঁহ ওড়াকান্দী রল
।।
তাঁর সাথে আলাপনে প্রভু পায় সুখ

শাস্ত্র আলাপনে উভে বড়ই উন্মুখ
।।
বহু বহু পুস্তকাদি রঘুনাথ পড়ে

সকল শোনেন প্রভু বসি কিছু দূরে
।।
এই ভাবে রঘুনাথ নিত্য আসে যায়

যতেক সুন্দর গ্রন্থ প্রভুকে শুনায়
।।
পরে যবে বড়বাবু শ্রীশশীভূষণ

পাঠ শেষ করি গৃহে করে আগমন
।।
প্রভু তারে কাছে ডাকি বলে ক্ষণে ক্ষণে

সংবাদ পত্রিকা তুমি পড় মোর স্থাণে
।।
ইতিহাস, পত্রিকাদি পড়িতেন শশী

গুরুচাঁদ শুনিতেন একমনে বসি
।।
শুনিবার, জানিবার ইচ্ছাই প্রবল

আলোচনা করে প্রভু হাসে খল খল
।।
শাস্ত্র গ্রন্থ যত কেন ইউক কঠিন

সিদ্ধান্ত জিজ্ঞাসা নাহি করে কোনদিন
।।
এক মনে বসে শোনে আসন উপর

শ্রুতমাত্র জানা সব যেন শ্রুতি ধর
।।

 

এ সব কেনবা নাহি হবে তাই বল
মহা প্রভু গুরুচাঁদ নিজে মহাকাল
।।
আগম নিগম কথা পঞ্চমুখে যাঁর

নরাকারে অবতীর্ণ হলেন এবার
।।
কেবা তারে কি শিখায় সব তার জানা

মানবীয় ধর্ম্মে শুধু করে আলোচনা
।।
খৃষ্ঠানের ধর্ম্মকথা মীড তারে কয়

ভক্ত সঙ্গে প্রভু তারে মিমাংসা করয়
।।
কোন গুণে খৃষ্ঠ হল জগতে পূজিত

প্রকৃত মিমাংসা প্রভু তাহার করিত
।।
মীড নাহি জানে কভু সে সব বন্ধান

উঘারিয়া বলে তাহা প্রভু গুরুচান
।।
সময়ে সময়ে প্রভু তাহারে কহিত

প্রভুর বচন শুনি মীড স্তব্ধ হত
।।
কিছু কিছু সে প্রমাণ প্রভু বলে সেথা

শুনিয়া বিস্মিত সবে নোয়াইল মাথা
।।
এই ভাবে একত্রিত সেখানে কাটায়

প্রভুর বচনে সবে মহা শান্তি পায়
।।
রজনী প্রভাতে প্রভু সাঙ্গ পাঙ্গ লয়ে

টুঙ্গীপাড়া পানে চলে অতি ব্যস্ত হয়ে
।।
বিপিন কবজী মাছ রেখেছে তথায়

অভয়ের প্রেম-ভক্তি যার সঙ্গে রয়
।।
কি ধন্য প্রভুর খেলা দেখি সর্ব্বদায়

এক কার্য্য উপলক্ষ্যে বহু কার্য্য হয়
।।
তপস্বী নৈষ্ঠিক ভক্ত আশা করে মনে

প্রভু যদি দয়া করে নামে তার স্থানে
।।
অভয় পাঠায় মাছ প্রভু সেবায়

আশা আর ভক্তি মেশে টুঙ্গীপাড়া গাঁয়
।।
এক কার্য্যে দুই কাজ তৃতীয় টীবাকী

হাদান রায়ের মাতা যাহা বলে ডাকি
।।
ভক্তের ভাবনা সিদ্ধ করে ভাবময়

শ্রীঘ্রগতি টুঙ্গীপাড়া হলেন উদয়
।।
তপস্বীর মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ হয়

অভয়ের মাছ লাগে প্রভুর সেবায়
।।
হাদান বসিয়া কান্দে কথা নাহি কয়

তারে কাছে ডাকি তবে বলে দয়াময়
।।
শুনহে হাদান তুমি বাড়ী চলে যাও

তোমার দেশের পথে যাবে মোর নাও
।।
এ বাক্য শুনিয়া সবে বুঝিল তখনে

অন্তর্য্যামী গুরুচাঁদ সব কথা জানে
।।
পরে মিত্রডাঙ্গা আসি উঠে দয়াময়

হাদানের জননীর বাঞ্ছা পূর্ণ হয়
।।
তথা হতে যাত্রা করি নিজ গৃহে আসে

আনন্দে ভকত দলে প্রেমানন্দে ভাসে
।।
যে যে দেশে গুরুচাঁদ করিলেন গতি

সর্ব্বখানে সর্ব্বলোক আনন্দিত অতি
।।
পরম পবিত্র কথা গুরুচাঁদ কয়

তাহা শুনি দলে দলে তাঁর ভক্ত হয়
।।
জীবেরে তরিতে প্রভু কত কষ্ট সয়

তবু দেখ মহানন্দ অন্ধ সেজে রয়
।।

 

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের লহ্মীখালী গমন


তেরশ তেইশ সালে গ্রন্থের মুদ্রণ

গ্রন্থ পেয়ে ভক্তগণে অতিহৃষ্ঠ মন
।।
গোপাল সাধুর দানে গ্রন্থ ছাপা হয়

এই কার্য্যে গোপালের সত্য পরিচয়
।।
এ সময়ে গোপালের পাঁচটি সন্তান

দুই পুত্র তিন কন্যা সবে বর্ত্তমান
।।
প্রভুর কৃপায় ধন্য সংসার তাঁহার

হরশীত কাশীনাথ পুত্র দুটি তাঁর
।।
জ্যেষ্ঠা কন্যা নাম তার জানি সহচরী

দ্বিতীয়া কন্যার নাম মাণিক্য সুন্দরী
।।

 

কনিষ্ঠা সাবিত্রী জানি ভগ্নী তিনজন
এক গৃহে রহে পঞ্চ ফুলের মতন
।।
নারী শিক্ষা দিতে প্রভু ব্যস্ত সর্ব্বদায়

ওড়াকান্দী তাতে হল নারী শিক্ষালয়
।।
মীডের সঙ্গিনী ধনি নাম মিস টাক

পরম পবিত্রা দেবী নাহি কোন জাঁক
।।
মিস টমসন হন সাহায্যকারিণী

বিধবা আশ্রম গড়ে মিলে দুই ধনি
।।
বিধবা রমণী যত হারায়েছে পতি

সহজে বিপথে যায় জীবনের গতি
।।
অলস মনের কোনে পাপ বাঁধে বাসা
স্বখাত সলিলে ডোবে নাহি পেয়ে আশা
।।
বিশেষতঃ বাঙ্গালীর ঘরে যে বিধবা

গঞ্জনায় সর্ব্বদায় কাটে রত্রি দিবা
।।
স্বজন বান্ধব সবে ভাবে গলগ্রহ

তিরস্কার পুরস্কার পায় অহরহ
।।
পুত্রকন্যা হীনা হলে আর রক্ষা নাই

অভাগীরে গালি দেয় জুটিয়া সবাই
।।
এর ফলে যাহা ফলে তাহা বিষয়ে

আমি কি বলিব তার আছে পরিচয়
।।
বিধবা জীবনে তাই দুঃখে নাই অন্ত

পতিহারা হলে নারী হয় সর্ব্বস্বান্ত
।।
এসব দেখিয়া প্রভু বড় ব্যথা পায়

দয়া করে বিধবার করিল উপায়
।।
মিস টাক আসি বলে প্রভুজীর ঠাঁই

বড়কর্তা এক কার্য্য করিবারে চাই
।।
অনাথা বিধবা যত আছে এই দেশে

তাদেরে শিখাব শিল্প আমি সবিশেষে
।।
জীবিকা নির্ব্বাহ তাতে অবশ্য হইবে

বিধবা জীবনে দুঃখ আর না রহিবে
।।
বিধবা আশ্রম তাই করিবারে চাই

আপনার আজ্ঞা বিনে সাহস না পাই
।।
মিসটাক যদি বলে এই মত কথা

প্রভু বলে ধন্য তুমি অবলার মাতা
।।
তব গুণে পতিহীনা পাবে বটে গতি

তার মধ্যে এক কথা বলিব সম্প্রতি
।।
শুধু পতিহীনা নয় নারীমাত্রে সব

তোমার আশ্রমে এনে বাড়াও গৌরব
।।
মিস টাক বলে তাতে কোন বাধা নাই

সব নারী নিব আমি যত জনে পাই
।।
এইভাবে ওড়াকান্দী নারী বিদ্যালয়

গড়িলেন মিস টাক প্রভু কৃপায়
।।
সেই দিনে যেই বীজ হয়েছে রোপণ

অদ্য সেই বৃক্ষে ফল হল অগনণ
।।
নারী ট্রেণিং স্কুল আজ হল ওড়াকান্দী

আদি সূত্রে গুরুচাঁদ করিলেন সন্ধী
।।
ওড়াকান্দী শিক্ষালয়ে পড়ে সহচরী

এ কার্য্যে গোপাল ইচ্ছা করিলেন ভারী
।।
সিংহ শিশু শিলা পরে ওঠে ধীরে ধীরে

গোপাল ঘনিষ্ঠ হয় লহরে লহরে
।।
গুরুবাক্য প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠা আছে যাঁর

সে কেন রহিবে পড়ে যেখানে আঁধার?
গ্রন্থ ছাপা হলে ভাবে গোপাল গোঁসাই

আমার অদৃষ্ঠে বুঝি তাহা প্রাপ্তি নাই
।।
ভক্তিগুণে ভক্তগণে প্রভুকে লইয়া

মনোসাধে পূজে পদ নিজ গৃহে নিয়া
।।
এতে ত কাঙ্গাল আমি তাতে ভক্তিহীন

মোর ভাগ্যে হবে কিরে সেই শুভ দিন?”
এত ভাবি সাধুজীর মুখে হাসি নাই

নিরালায় বসে সাধু সদা ছাড়ে হাই
।।
মনোগত কথা আর কবে কার কাছে

মুখ দেখে বোঝে দুঃখ হেন কেবা আছে?
অন্তর্য্যামী বিনে আর কেহ বন্ধু নাই

মনে মনে কেন্দে বলে গোপাল গোঁসাই
।।

পরম দয়াল প্রভু কিবা কব আর
অন্তর্য্যামী জানো তুমি সব সমাচার
।।
আমার পাগল মন করেছে দুরাশা

চাঁদের ধরিতে যথা বোমনের আশা
।।
অসম্ভব কথা বলে যতেক বাতুল

আমার এ আশা করা বুঝিলাম ভুল
।।
কিন্তু প্রভু একি দায় মন নাহি মানে

মনের জ্বালায় প্রভু যাব কোনখানে
।।
মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরিতেছি আমি

দয়া করে রক্ষা কর প্রভু অন্তর্য্যামী
।।
শান্তিধামে আছ সুখে শান্তিময় প্রভু

দুঃখধামে তোরা নিতে চাহিনাক কভু
।।
কুব ফেটে মন কান্দে তাতে দুঃখ নাই

হইক তোমার শান্তি এই মাত্র চাই
।।
মনে মনে গোপালের হল অভিপ্রায়

মন পোড়ে তবু মুখে কিছু নাহি কয়
।।
ভকতের ব্যথা হেরি দুঃখী দয়াময়

বাক্যচ্ছলে গোপালের কাছে ডাকি লয়
।।
হে গোপাল বাদাবনে আমি যেতে চাই

উপযুক্ত সঙ্গী সাথী বল কারে পাই?
তোমার বাড়ীর কাছে নাকি বাদাবন

তোমার গৃহেতে আমি করিব গমন
।।
অন্ধ যদি অকস্মাৎ চোখে দৃষ্টি পায়

ধরে না আনন্দ ঢেউ তাহার হৃদয়
।।
তদোধিক সুখরাশি পাইল গোপাল

অবিরল চোখে তার ঝরিতেছে জল
।।
কেন্দে কয় দয়াময় যোগ্য নহি আমি

মম গৃহে কেনা গুণে যাবে অন্তর্যাআমমি?
কোনক্রমে বাদাবনে আমি দুঃখে রই

দুঃখ মাঝে গেলে প্রভু আমি দুঃখী হই
।।
শান্তিধামে থাক প্রভু ওহে শান্তিময়

বাদাবনে দুঃখ দিতে মোর ইচ্ছা নয়
।।
বিশেষতঃ লোণা দেশে জল লবনাক্ত

দুরন্ত লোণার ডাকে আমরা উতাক্ত
।।
তোমার সোনার দেহে তাকি সহ্য পায়?
কাজ নাই দয়াময় গিয়ে সে বাদায়
।।
ভবারাধ্য ভক্তাধীন বাধ্য ভক্তিগুণে

হেসে কয় গোপালের এই কথা শুনে
।।
ভয় নাই হে গোপাল ভাব তুমি মিছে

লবণ সমুদ্রে মোর যাতায়াত আছে
।।
পানীয় জলের জন্য কোন চিন্তা নাই

মধুমতী হতে জল সাথে নিতে চাই
।।
মন স্থির কর তুমি চিন্তা কর বৃথা

আমি যাহা বলি তুমি শোন সেই কথা
।।
আজি তুমি চলি যাও আপনার দেশে

পুনরায় যাত্রা করে এসো হেথা শেষে
।।
সপ্তাহ পরেতে তুমি হবে উপস্থিত

তোমার গৃহেতে যাব বলিনু নিশ্চিত
।।
দয়ালের কথা শুনি গোপাল কান্দিল

দেশে যেতে মন করে চরণ বন্দিল
।।
বিদায় মাগিয়া চলে সাধু ভাগ্যবান

জনে জনে ডেকে তবে বলে গুরুচান
।।
কে কে তোরা যাবি আয় গোপালের বাড়ী

গোপাল বেন্ধেছে মোরে দিয়ে ভক্তি-দড়ি
।।
মনে মনে কত টান টানিয়াছে মোরে

চল তোরা কে কে যাবি গোপালের ঘরে
।।
প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিল বহু জন

প্রস্তাব শুনিয়া সবে আনন্দিত মন
।।
বিধু যাবে, মধু যাবে যাবে যজ্ঞেশ্বর

যষ্ঠী যাবে বিচরণ আরত কেদার
।।
মাধবেন্দ্র মাঝি হবে হাল নিয়ে হাতে

কানাই বলাই যাবে প্রভুজীর সাথে
।।
দুর্গাপুর থাকি বার্ত্তা পায় হরিবর

শ্রুতমাত্র উপনীত প্রভুর গোচর
।।

অশ্বিনী গোঁসাই গাবে প্রেম গীতি গাঁথা
আর কত মতো যাবে করি একত্রতা
।।
এইভাবে জনে জনে হইল প্রস্তুত

সাঙ্গোপাঙ্গো স্থির করে নিজ হরি-সূত
।।
পানসী তরণী কাছে প্রভুজীর ঘাটে

ঠিক হল প্রভু যাবে সেই নায়ে উঠে
।।
আয়োজনে দিনে দিনে সময় আসিল

আপনি গোপাল সাধু শ্রীধামে পৌছিল
।।
এবে শুন ঘরে গিয়ে সাধুজী কি করে

দেশে গিয়ে শুভ বার্ত্তা জানায় সত্বরে
।।
যেই শোনে সেই বলে ধন্য মহাশয়

তোমার গুণেতে মোরা বাধ্য অতিশয়
।।
পতিতপাবনে তুমি আনিবে এ দেশে

দেশ ধন্য হবে মোরা ধন্য হবে শেষে
।।
গোপালের পত্নীদেবী কাঞ্চন জননী

আনন্দে কান্দিল দেবী সুসংবাদ শুনি
।।
পতিপদে পড়ি সতী কান্দে অনিবার

বলে প্রভু হেন ভাগ্য হবে কি আমার?
কোন গুণে বল নাথ আসিবে দয়াল?
কি সাধনা দিবে মোরে এ হেন কপাল?
সাধন ভজনহীনা আমি তুচ্ছ নারী

জগন্নাথ আসিবেন কিসে আশা করি?
যা কিছু ভরসা মোর তোমার চরণ

তব গুণে দেখা যদি দেয় নারায়ন
।।
অবলা আমি যে নাথ কিছুই জানি না

কি ভাবে পূজিব তাঁর কিছু নাহি জানা
।।
শুন নাথ এক কথা মোর মনে হয়

পেয়ে ধন পুনঃ তারে কিসে হারা হয়?
যে-ধরেন যে-যতন তাহা নাহি হলে

অযতনে মহাধন ছেড়ে যায় চলে
।।
পাওয়া কি না পাওয়া বল কার ভাল বলি?
মহাদায় সর্ব্বদায় কোন পথে চলি?
প্রাণ চায় ময়াময় দেখিব নয়নে

মনে ভয় পাছে হায় হারাই রতনে
।।
কিবা কই কিবা করি কিছু নাহি বুঝি

অকুল সাগরে নাথ তুমি হও মাঝি
।।
জীবন তরণী মোর করিয়াছি দান

তুমি মম দেহ মন তুমি মোর প্রাণ
।।
যে ভাবে চালাবে মোরে চলি সেই পথে

আমার সকল ভার রেখেছি তোমাতে
।।
এত বলি কান্দে সতী পতি-পদ ধরি

কথা শুনি গোপালের চক্ষে ছরে বারি
।।
সান্তনা করিয়া কথা বলে তার প্রতি

আমার বচন ধর যা বলি সম্প্রতি
।।
সত্যই বলেছ তুমি মোরা দীন হীন

শ্রী-গুরু-চরণ চিন্তা নাহি কোন দিন
।।
আমাদের গুণে নয় প্রভু নিজ গুণে

আসিতে চেয়েছে এই ঘোর বাদাবনে
।।
কি দিয়া পূজিব তাঁরে মোদের কি আছে?
কোন দ্রব্য মূল্যবান বল তাঁর কাছে?
সোনা চুণী মণি মুক্তা অথবা মাণিক

কিসে তুষ্ট রহে হরি বল দেখি ঠিক?
কুবের ভান্ডারী যাঁয় লহ্মী সেবাদাসী

কোন ধনে কিবা দিয়ে তাঁরে কর খুশী?
কোন ধনে তুষ্ট নহে প্রভু জনার্দ্দন

হরি শুধু চাহে তাঁর ভকতের মন
।।
ভক্তি সূত্রে মনোপুষ্পে গাঁথ প্রেম হার

অশ্রুর চন্দন দেও তাহার উপর
।।
কর জোড়ে কর পূর্ণ আপন অঞ্চলি

রাখ অর্ঘ্য পদে তাঁর হরি হরি বলি
।।
তাতে তুষ্ট জগদিষ্ট হইবে নিশ্চয়

দীনের নৈষ্ঠিক পূজা-অন্য কিছু নয়
।।
আর এক কথা দেবী আসিল স্মরণে

বাবা বলে ভাব তাঁরে আপনার মনে

 

জগতের রীতি এই জান সবিশেষ
পিতার সম্মুখে কন্যা নাহি ধরে বেশ
।।
কাঙ্গালিনী কি দুঃখিনী কিবা আসে যায়?
পিতাকে পূজিতে তাতে কিবা বাধা রয়?
কন্যা-গৃহে পিতা যদি করে আগমণ

তাঁর লাগি কন্যা কিবা করে আয়োজন?
দুঃখিনী কি রাজরাণী পিতা সব জানে

পিতাকে আনিতে কন্যা ভয় পাবে কেনে?
তাই বলি মনে প্রাণে তাঁর কন্যা হও

সগোষ্ঠী সকলে মিলে পথে চেয়ে রও
।।
কমল কারনে দেখ লহ্মীর বসতি

নারায়ণ থাকে সদা লহ্মীর সংহতি
।।
নয়নের জলে সিক্ত রাখ নিজ মন

কমল রূপেতে ভক্তি ফুটিবে তখন
।।
এই ভাবে যদি দেবী পার গো থাকিতে

আর যদি দিবারাত্র পারগো ডাকিতে
।।
দীনের বান্ধব তবে করিবেন দায়

নিজগুণে দিতে পারে স্নিগ্ধ পদ-ছায়া
।।
বারে বারে বলি তাই শুন মোর প্রিয়া

চোখে রাখ প্রেমবারি তাঁহারে ভাবিয়া
।।
এত যদি বলিলেন শ্রীগোপাল সাধু

উঠিল কাঞ্চন দেবী যে পূর্ণ বিধু
।।
বলে নাথি আশীর্ব্বাদ কর অভাগীরে

প্রভুর চরণে যেন রহে এ অন্তরে
।।
সপ্তাহ পর্যান্ত সাধু গৃহেতে রহিল

দেশে ভক্তগণে সংবাদ পাঠাল
।।
শুনিয়া সকল ভক্ত আনন্দে উতলা

দিবানিশি ক্ষ্যান্ত নাই শুধু হরি-বলা
।।
নিদ্রা জাগরণে সবে বলে হরি বল

গুরুচাঁদে মনে করে চক্ষে বহে জল
।।
ঘর দ্বার পরিস্কার করে ভক্ত গণে

প্রাণান্ত করিছে শ্রম আনন্দিত মনে
।।
এদিকে কাঞ্চন দেবী নারীগণ সঙ্গে

ধান্য ভানি চাল করে অতি মনোরঙ্গে
।।
মৃত্তিকা নির্ম্মিত মাঠে যেই চাল রাখে

আচ্ছাদন দিয়া তার মুখ রাখে ঢেকে
।।
যেখানে যে কাজ করে অন্য কথা নাই

গুরুচাঁদবলে সবে সদা ছাড়ে হাই
।।
একমনে এক প্রাণে সবে কাজ করে

কি পুরুষ কিবা নারী অন্দরে বাহিরে
।।
কাঞ্চন জননী দেবী সর্ব্বখানে রয়

নিজ হাতে ব্যবস্থাদি করিছে সদায়
।।
চোখে তাঁর নাহি ঘুম দিবা কি রজনী

সব কাজে ব্যস্ত মাতা যেন পাগলিনী
।।
এদিকে গোপাল সাধু সঙ্গীর সহিতে

যাত্রা করে ওড়াকান্দী শ্রী গুরু আনিতে
।।
ভক্ত আর ভগবান কোন ভাব করে

কিছু নাহি বুঝি তাহা মোরা ক্ষুদ্র নরে
।।
লহ্মীখালী আয়োজন চলে নানা মতে

এদিকেতে মহাপ্রভু ব্যস্ত অতি চিতে
।।
এরে ডাকে তারে ডাকে বলে বারে বার

লহ্মীখালী মোর সাথে চলহে এবার
।।
এভাবে চলিছে খেলা উত্তরে দক্ষিণে

লহ্মীখালী যেতে প্রভু ব্যস্ত কত মনে
।।
সপ্তাহ অতীত প্রায় এহেন সময়

শ্রীগোপাল ওড়াকান্দী হলেন উদয়
।।
প্রভুর চরণ বন্দি বসে মৃত্তিকায়

গোপালে দেখিয়া প্রভু মহানন্দময়
।।
কুশলাদি বারে বারে জিজ্ঞাসে তাঁহারে

সংবাদ পাঠাল প্রভু সবার গোচরে
।।
দলে দলে ভক্তসবে উপস্থিত হল

তৃতীয় দিবসে প্রভু তরীতে উঠিল
।।
সঙ্গে বলে বিচরণ আর যজ্ঞেশ্বর

শ্রীবিধু চৌধুরী চলে তরুণীর পর
।।

মাধবেন্দ্র বসিলেন তরণীর হালে
কেদার মিস্ত্ররী সহ যষ্ঠিবাবু চলে
।।
অশ্বিনী গোঁসাই চলে আর হরিবর

ইতি উতি কতজন চলিল বিস্তার
।।
তরণী চলিল রঙ্গে উঠে জয়ধ্বনি

পতাকায় লেখা গুরুচাঁদের তরণী
।।
টুঙ্গীপাড়া বাসী সাধু শ্রীতপস্বীরাম

তাঁর গৃহে নামিলেন প্রভু গুণধাম
।।
তথায় থাকিয়া নিশি পরদিন প্রাতেঃ
উপস্থিত কেনুভাঙ্গা সবে হৃষ্ট চিতে
।।
বিপিন গোস্বামী যিনি কেনুভাঙ্গা রয়

উঠিলেন দয়াময় তাঁহার আলয়
।।
প্রেমানন্দে কলরোল উঠি সেই বাড়ী

কীর্ত্তনেতে মতুয়ারা যায় গড়াগড়ি
।।
তথা হতে তরী খুলি চলিল দক্ষিণে

বিপিন চলিল সাথে ভ্রমণ কারণে
।।
আন্ধারমাণিক গ্রামে তারাচাঁদ রায়

প্রভুর নৈষ্ঠিক ভক্ত সেই মহাশয়
।।
সরল সহজ সাধু দেল-খোলা তাঁর

শ্রীগুরুচাঁদের কৃপা তাঁহার উপর
।।
তার গৃহে দয়াময় করিল গমন

মহোৎসবে মতুয়ারা করিল ভোজন
।।
কিছু কাল রহি সেথা তরণী ছাড়িল

অল্পপরে বাগেরহাট শহরে আসিল
।।
সেদিন হাটের বার লোকে লোকারণ্য

অসংখ্য লোকের সংখ্যা হল সেই জন্য
।।
মতুয়ারা করিতেছে সুধাময় নাম

ডঙ্কা শিঙ্গা ধ্বনি তাতে হয় অবিরাম
।।
ধ্বনি শুনি যত লোক হাটে এসেছিল

সকলে ছুটিয়া তারা ঘাটে দাঁড়াইল
।।
কাতারে কাতারে নর দাড়াইয়া রয়

নদী মধ্যে কল কল তরী চলে যায়
।।
সকলে জিজ্ঞাসা করে তরণী কাহার?
ভক্তে ডাকি বলে ওড়াকান্দীর কর্ত্তার
।।
অমনি ব্যকুল চিত্তে ধায় নর নারী

ইচ্ছা করে দেখে তারা রূপের মাধুরী
।।
উচ্চকন্ঠে ডেকে বলে তরণী ভিড়াও

কেমন ঠাকুর তাহা মোদের দেখাও
।।
হইল অপূর্ব্ব দৃশ্য তটিনীর তীরে

প্রভু কয় কাজ নাই বারে তোমরা জোরে
।।
জোরে জোরে ভকতেরা তরী বেয়ে যায়

হতাশায় নরনারী কুলে বসে রয়
।।
ক্রমে ক্রমে মিস্ত্রীডাঙ্গা উপস্থিত হল

গণেশ মন্ডল আসি প্রভুকে বন্দিল
।।
ধনবান মান্যবান সেই মহাশয়

তালুকদারী তেজারতি দেশ মধ্যে রয়
।।
তাহার বিনয়ে প্রভু সন্তুষ্ট হইল

দয়া করি তার গৃহে রজনী বঞ্চিল
।।
বহু কথা আলোচনা হল সেই বাড়ী

কথা শুনি সে গণেশ সুখী হল ভারী
।।
প্রভুর বচন তার মুগ্ধ হল মন

সামাজিক ব্যক্তি বটে তিনি একজন
।।
মনে মনে ভাবে তবে সেই মহাশয়

এমন মানুষ আমি দেখিনি কোথায়
।।
সেই হতে সামাজিক ক্রিয়া ছেড়ে দিল

গোপালের পদাশ্রয়ে মতুয়া হইল
।।
তথা হতে চলিলেন বেতকাটা গ্রাম

গোপালের মামা তাঁর সোনারাম নাম
।।
দেশ-মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ বটে সেই জন

সামাজিক ভাবাপন্ন ছিলেন তখন
।।
মাধব ভাইপো তাঁর গোপালের সাথী

অন্য তিন লহ্মীকান্ত, রাধাকান্ত রতি
।।
প্রভু আগমনে তাঁরা ভাই চারিজন

বিভেদ ভুলিয়া সবে হল একমন
।।

 

সোনারাম দেখিলেন প্রভুর চরণ
এক দিনে এক সঙ্গে ভুলে গেল মন
।।
গৃহবাসী সবে আসি মতুয়া হইল

গোপালেরে বাবা বলি জামিন রাখিল
।।
তাহার শরিক যত ছিল বাড়ী পরে

মতুয়াহইল সবে মাধবেরে ধরে
।।
রজনী নামেতে ছিল জ্যেষ্ঠতাত ভাই

অন্য ঘরে নিবারণ সবে জানে তাই
।।
শ্রীগুরুচাঁদের রূপ দেখিয়া নয়নে

মাধবের সাথী হয়ে পড়িল চরণে
।।
ক্রমে ক্রমে হালদার বাড়ী যত লোক

সকলে মতুয়াল হইয়া পুলক
।।
বিশেষে রজনী ধন্য হল কালে কালে

মন প্রাণ সমর্পিল শ্রীগুরু গোপালে
।।
বড়ই করুণ ছিল তাঁহার হৃদয়

যেই যাকে তার গৃহে অধিষ্ঠান হয়
।।
যেথা যায় গুণ গায় সর্ব্বদা প্রভুর

উপাধি হইল তাঁর দয়াল ঠাকুর
।।
গোপালের পদে নিষ্ঠা ছিল তার ভারী

দিবারাত্র মুখে সদা বলে হরি হরি
।।
গোপালের রূপ চিন্তা সদা ছিল তাঁর

দয়াময় দয়া করি দির পুরস্কার
।।
পথে যবে সে রজনী করিত ভ্রমণ

গোপালের অনুরূপ দেখাতে তখন
।।
এমনি সাদৃশ্য ছিল অঙ্গেতে তাঁহার

কতজনে করে ভুল দেখে বারে বার
।।
নিবারণ নামে যিনি পরম নৈষ্ঠিক

দেখে রূপ দিল ডুব ছাড়ে না নিরিখ
।।
অনাচারী, ব্যাভিচারি দেখিতে না পারে

বাজে কথা বাজে কাজ নাই তাঁর ধারে
।।
পুরাতন বাড়ী ছাড়ি যেই মহাজন

মরা নদী কুলে বাড়ী করেছে এখন
।।
ওড়াকান্দী লহ্মীখালী যত মতো যায়

মেঝ কর্ত্তা নিবারণ সবে খেতে দেয়
।।
গোপালচাঁদের যেন দোয়ালিয়া বাড়ী

সতীলহ্মী পত্নী তার ভক্তিমতী নারী
।।
মাধবের পত্নী নাম শ্রীবীরজা দেবী

সরলা-স্বভাবা অতি ভক্তিমতী ছবি
।।
প্রভাতী নামেতে কন্যা দেবী গর্ভে ধরে

প্রভাতীর মাতা বলি সবে ডাকে তাঁরে
।।
কাঞ্চন দেবীর তিনি সদা অন্তরঙ্গ

সুললিত গানে তাঁর নামে প্রেমগঙ্গা
।।
তিনিও কাঞ্চনদেবী যবে করে গান

একমনে শুনে তাহা প্রভু গুরুচাঁন
।।
গোপাল সাধুর দল বারুনীতে যায়

দলপতি নিবারণ আগে আগে ধায়
।।
এই হালদার-বাড়ী এল দয়াময়

গোপালের দয়া বলে এই কার্য্য হয়
।।
জ্ঞানবান সোনারামে বলে দয়াময়

এক কথা বলি শোন হালদার মশায়
।।
এই যে গোপাল সাধু তব ভাগিনেয়

কোন দিন তাঁরে তুমি ভাবিওনা হেয়
।।
এঁরে মান্য কর যদি আমি বলে যাই

দিনে দিনে হবে ভাল কোন ভয় নাই
।।
কান্দিয়া বলিল তবে সেই সোনারাম

দয়াময় তব আজ্ঞা আমি মানিলাম
।।
সেই হতে এক ভাবে হালদার যত

ওড়াকান্দী নামে সদা শির করে নত
।।
তথা হতে দয়াময় উঠিয়া নৌকায়

দক্ষিণ বাহিনী হয়ে লহ্মীখালী যায়
।।
দুরন্ত ঘোলার নদী ভোলা নামে খ্যাত

হাঙ্গর কুম্ভীর তাতে ছিল শত শত
।।
অতি ভয়ঙ্কর ছিল তার গতি-ধারা

থর থর কাঁপে হিয়া দেখিলে চেহারা
।।

দর্পহারী দিনে দিনে দর্প চূর্ণ করে
বান ডেকে ভোলা নদী ক্রমে গেল মরে
।।
প্রভু যবে লহ্মীখালী করিল গমন

একেবারে মরে নাই জীবন্ত তখন
।।
তাই দেখি প্রভু বলে কিবা ভয়ঙ্কর

ভোলার ঘোলার চোটে চোখে অন্ধকার
।।
ধীরে ধীরে তরী চলে নাচে নদী-জল

মতুয়ারা তালে তালে বলে হরিবল
।।
ক্রমে ক্রমে তরী আসি ঘাটেতে ভিড়িল

নৌকা দরশনে ভক্তে আনন্দ বাড়িল
।।
গৃহ হতে ঘাট হবে দূর দশ রশি

নর নারী উপনীত সবে ঘাটে আসি
।।
ঘাট হতে গৃহাবধি করিয়াছে পথ

কিবা সে পথের শোবা বড়ই মহৎ
।।
রক্তবর্ণ শালু বস্ত্রে সারা পথ ঢাকা

মাঝে মাঝে পূর্ণ কুম্ভ হইয়াছে রাখা
।।
কদলী বৃক্ষের সারি শোভে দুই ধারে

সর্ব্বত্র ফুলের মালা দোলে থরে থরে
।।
ঢোল ঢাক, করতাল ডঙ্কা শিঙ্গা লয়ে

আসিল মতুয়ারগণ আনন্দে মাতিয়ে
।।
ঝাঁকে ঝাঁকে হুলুধ্বনি করে নারীদলে

তুলিয়া গ্রমের ঢেউ ভক্তে হরিবলে
।।
পড়িল বিপুল সাড়া দেশের ভিতরে

দলে দলে নরনারী ছোটে তথাকারে
।।
সাধ্বী সতী গুণময়ী কাঞ্চন জননী

ত্বরিতে চলিল ঘাটে লইয়া সঙ্গিনী
।।
চোখে তাঁর বহে জল বন্ধ দুই কর

ভাবাবেশে শুদ্ধা দেহে কাঁপে থর থর
।।
খাল-পারে উপনীতা হইলা যখন

নৌকা হতে গুরুচাঁদ করে দরশন
।।
আঁখি নীরে ভাসে দেবী ভাতেবে বিহ্বলা

কিবা সে বরাঙ্গ কান্দি রূপেতে উজলা
।।
নামিলেন জগদম্বা যেন ধরা পরে

আপন রূপের স্রোতে দিক আলো করে
।।
দেবী কান্দে সঙ্গে সঙ্গে কান্দিছে সঙ্গিনী

ঠিক যেন ব্রজপুরে গোপের গোপিনী
।।
ভাব দেখি গুরুচাঁদ মহাশান্তি পায়

সঙ্গিগণে ডাকি তবে বলে দয়াময়
।।
মাতা ঠাকুরাণী কুলে দাঁড়াইয়া রয়

চল সবে কুলে যাই দেরী নাহি সয়
।।
এতেক বলিয়া প্রভু কুলেতে আসিল

সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গী সব কুলে উত্তরিল
।।
হরিধ্বনি গুলুধ্বনি পড়ে অবিরত

ধীরে ধীরে চলিলেন জগতের নাথ
।।
যেই ক্ষণে গৃহ পরে হইল উদয়

উঠিল প্রেমের ঢেউ ভক্তের হৃদয়
।।
মহাভাবে মতুয়ারা করিছে কীর্ত্তন

মনে হয় গৃহ করে আনন্দে নর্ত্তন
।।
পালঙ্ক উপরে পাতি সুশ্বেত বিছানা

মনোসাধে সাজায়েছে যতেক ললনা
।।
প্রভু আসি বসিলেন তাহার উপরে

হইল অপূর্ব্ব শোভা ঘরের ভিতরে
।।
দীর্ঘ তালবৃন্ত পাখা করেতে ধরিয়া

করিছে ব্যঞ্জন ভক্ত আনন্দে মাতিয়া
।।
গোপালের চক্ষে সদা ঝরিতেছে জল

নয়ন-আসরে ভাবে নরনারী দল
।।
কে যেন হৃদয়ে আসি কান্দায় সবারে

কান্দিছে ভকত সবে লহরে লহরে
।।
গোপালের পরিবারে ছিল যত জন

পতি পত্নী পুত্রকন্যা সবে একমন
।।
সকলের চোখে জল দেখিয়া ঠাকুর

আনন্দে হৃদয়-পদ্ম সদা ভরপুর
।।
ভক্তাধীন ভগবান প্রীত তাহে অতি

এবে শুন কি ঘটনা ঘটিল সংপ্রতি

 

 

প্রভুর আগমনে লহ্মীমাতার আবির্ভাব


প্রভুর আগমন জন্য কাঞ্চন জননী

মাঠে ভরিযত্নে চাল রাখিলেন তিনি
।।
আট মণ রাখে চাল যতন করিয়া

মুখেতে ঢাকনি ঢাকা এক পাত্র দিয়া
।।
ভক্ত সঙ্গে মহাপ্রভু করে আগমন

পাত্রির ঢাকনি মাতা খুলিল তখন
।।
রন্ধন কারণে চাল দিতেছে মাপিয়া

ভক্তগণে মহানন্দে নিতেছে বহিয়া
।।
মাপ শেষে দেখা গেল চাল দশমণ

সবে কয় নাহি বুঝি ইহার কারণ
।।
মাপা-চাল কোন ভাবে এত বৃদ্ধি পায়?
গণনাতে ভুল বুঝি হয়েছে নিশ্চয়
।।
দারুণ সংশয় চিত্তে সবে বাক্য-হত

কোন যুক্তি কার নাহি হয় মনোমত
।।
সংশয় নাশিতে কেহ করিল প্রস্তাব

নিশ্চয় বুঝিতে হবে এই কোন ভাব
।।
সব চাল আন হেথা মেপে দেখি ফিরে

রাখ-চাল বেশী আজ হল কি প্রকারে?
সবে তাতে দিল সায় চাল আনা হল

আপন হস্তেতে চাল ভক্তে মেপে দিল
।।
সেই চাল সেই মাঠ সেই সমুদয়

ঠিক ঠিক দশমণ মাপে দেখা যায়
।।
সেই চাল পুনরায় মাঠেতে রাখিল

মাঠ ভরি দুই মন চাল বৃদ্ধি হল
।।
ঘটনা দেখিয়া সবে কথা নাহি কয়

অবিরল নেত্র জল পড়িছে ধরায়
।।
প্রেমে গদ গদ তনু সবে ডাকি কয়

লহ্মী আভির্ভূতা হেথা বুঝিনু নিশ্চয়
।।
কাঞ্চন জননী সব দেখিয়া নয়নে

আত্ম-হারা হয়ে পড়ে প্রভুর চরণে
।।
প্রভু কয় ওগো মাতা থাক চুপ করি

সকল কর্ম্মের কর্ত্তা একমাত্র হরি
।।
হরি যেথা আসে লহ্মী আসে তার সাথে

সর্ব্বঘট হয় পূর্ণ লহ্মীর দয়াতে
।।
কান্নাকাটি ছেড়ে মাতা পাকশালে যাও

অন্নপূর্ণা সেজে অন্ন আমারে খাওয়াও
।।
প্রভুর আজ্ঞাতে দেবী ত্রস্তগতি ধায়

অবিলম্বে উপনীত সে পাক শালায়
।।
ভক্তের কারণে পাক বাহিরেতে হয়

প্রভুর কারণে পাক রন্ধন শালায়
।।
এস্তে ব্যস্ত মাতা গেল রন্ধন শালায়

সুগন্ধে পূরিত গৃহ বুঝিবারে পায়
।।
আশ্চর্য্য মানিয়া মাতা যায় অগ্রসরি

দেখে পাকশালা মধ্যে আছে এক নারী
।।
জননীর বাঞ্ছা মনে স্বহস্তে রাঁধিয়া

করিবে প্রভুর সেবা মন প্রাণ দিয়া
।।
অচেনা রমণী তাহে বিনা আদেশেতে

কোন কার্য্যে পাক করে কার আজ্ঞামতে?
অন্তরে ক্রোধিতা মাতা নারী পানে চায়

ইচ্ছা করে রূঢ় কথা বলিবে তাঁহায়
।।
হেন কালে সেই নারী চাহে মাতা পানে

ফুটিল মধুর হাসি তাঁহার আননে
।।
ক্ষণিক চাহিয়া নারী করুণ নয়নে

পার্শ্ব-দ্বারা দিয়া দ্রুত পড়িল উঠানে
।।
মাতা কয় ওগো বাছা কোথা ছুটে যাও

ঘরে কেন এলে তুমি তাই মোরে কও
।।
বলিতে বলিতে মাতা আসিল বাহিরে

চারিদিকে চাহে কিন্তু দেখেনা কাহারে
।।
ডাকাডাকি করে মাতা ভক্ত নারী গণে

বলে তোরা বল দেখি কে এল এখানে?
শূণ্য ছিল রান্না ঘর কেহ ঘরে নাই

অচেনা রমনী সেথা আমি দেখা পাই
।।

আমারে দেখিয়া নারী গেল পালাইয়া
এই পথে সবে তো দেখ না খুঁজিয়া
।।
হেনকালে ডেকে বলে এক ভক্ত নারী

কি যে কথা বল মাগো বুঝিতে না পারী
।।
তুমি বলো তুমি নাহি ছিলে রান্না ঘরে

এই মাত্র তবে আমি দেখিনু কাহারে?
এই মাত্র তুমি নিজে পাকশালে ছিলে

আমাকে ডাকিয়া তুমি কাছে টেনে নিলে
।।
নিজহস্তে পাক কর অন্নাদি ব্যঞ্জন

সে সব কেমনে মাতা হলে বিস্মরণ?
অন্নাদি ব্যঞ্জন সব রন্ধন করিয়া

আপনার হাতে তাহা রেখেছ ঢাকিয়া
।।
এবে কিবা বল মাগো কিছু নাহি বুঝি

মন-ভোলা দশা মাগো হল কে আজি?”
কথা শুনি মা-জননী দ্রুত গতি ধায়

নারীগণে বলে তোরা মোর সাথে আয়
।।
তরাসে চলিল পুনঃ রন্ধন শালায়

দেখে অন্ন ব্যঞ্জনাদি সারি সারি রয়
।।
সারি সারি আছে সব পাত্র দিয়ে ঢাকা

নিখুঁত প্রকারে আছে সব দ্রব্য রাখা
।।
সৌরভে গৃহের বায়ু আছে ভরপুর

সঙ্গে যারা সবে বলে মধুরমধুর
।।
স্বচক্ষেতে সব দ্রব্য দেখিল জননী

পরে কেন্দে বলে হায় আগে নাহি জানি
।।
দয়া করে দয়াময়ী এসেছিল ঘরে

স্বচক্ষে দেখিু তবু নাহি চিনি তাঁরে
।।
গুরুচাঁদ বাবা মোর স্বয়ং নারায়ন

তাঁর সেবা লাগি মাতা করে আগমন
।।
ভকতি বিহীনা আমি নয়নে না দেখি

অবোধ দেখিয়া মাতা মোরে দিল ফাঁকি
।।
আপনার হাতে মাতা করিল রন্ধন

দয়াময় গুরুচাঁদ করিবে ভোজন
।।
বামনের আশা যথা চাঁদে ধরিবারে

পঙ্গুর যেমতি আশা লঙ্ঘিতে গিরিরে
।।
সেই মত আশা আমি করেছিনু হায়

মোর রান্না খাবে আজি প্রভু দয়াময়
।।
যাঁর সেবা করে লহ্মী নামিয়া ধরায়

সামান্য মানবী আমি করি সে আশায়
।।
আহারে কতই ভুল এসেছে হৃদয়

মানুষ ভেবেছি যাঁরে লহ্মী সদা চায়
।।
এভাবে বিলাপ করে কাঞ্চন জননী

সঙ্গে সঙ্গে কান্দে তাঁর যতেক সঙ্গিনী
।।
এ হেন সময়ে সেথা আসিল গোপাল

দেখিল কাঞ্চন দেবী ভাবেতে বিহবল
।।
পতিরে দেখিয়া সতী পড়ে তার পায়

ক্রমে ক্রমে সব কথা তাঁহারে জানায়
।।
শুনিয়া গোপাল বলে ধন্য এ জীবন

ধন্য সতী ভাগ্যবতী তুমি একজন
।।
সতী নারী ঘরে যায় ধন্য সে সংসারে

সতীরে তুষিতে দেখ দেবে বাঞ্চা করে
।।
নিজ চোখে দেখিয়াছ জগত জননী

তব স্বামী পরিচয়ে আমি ধন্য মানি
।।
পতির মুখেতে শুনি এ হেন বচন

কাঞ্চন জননী বলে কান্দিয়া তখন
।।
প্রাণনাথ এ প্রশংসা নহে যোগ্য মোর

দয়া করে বান্ধ পদে দিয়ে কৃপা ডোর
।।
আমি দাসী দিবানিশি বিক্রীত ও পদে

আমারে প্রশংসা করে ফেলনা বিপদে
।।
আমি নাথ যাহা জানি করি নিবেদন

প্রশংসার ভাগী ভবে হয় কোন জন?
গৃহস্থের ঘরে দেখ থাকে দাস দাসী

প্রভুর আজ্ঞায় কাজ করে দিবা নিশি
।।
আজ্ঞাবাহী ভৃত্য তারা আজ্ঞা নিয়ে ফেরে

প্রভু যাহা ইচ্ছা করে সেই কর্ম্ম করে
।।

কর্ম্মফল যাহা কিছু প্রভু সব পায়
ভূত্যের কর্ত্তত্ব কর্ম্মফলে কবে হয়?
আমি দাসী তব ঘরে প্রভু তুমি মোর

তোমার কৃপার বলে মোর সব জোর
।।
তব আজ্ঞা শিরে নিয়ে আমি কাজ করি

তাতেও কতই ভুল-ভেবে দুঃখে মরি
।।
পরম দয়াল তুমি তাই কর ক্ষমা

দয়া করে কোন দোষ নাহি রাখ জমা
।।
দেহ মন আত্মা প্রভু সকলি তোমার

ফলাফল কোন কিছু নাহিত আমার
।।
আমার সম্বল শুধু ও রাঙ্গা চরণ

সম্বলে বঞ্চিত প্রভু করোনা কখন
।।
তোমার সাধন বলে এসেছে ঠাকুর

তারিল জগতে যত অনাথ আতুর
।।
কাঙ্গালিনী তার মধ্যে আমি একজন

তোমার দয়ায় ধন্য হল এ জীবন
।।
তোমার সাধন-বৃক্ষে ফলিয়াছে ফল

মোরা সবে তাই পেয়ে জনম সফল
।।
আমার প্রশংসা প্রভু করিওনা আর

যা কিছু হয়েছে হবে সকলি তোমার
।।
কর্ত্তা তুমি ফলে তব পূর্ণ অধিকার

তোমার কৃপায় ধন্য জীবন আমার
।।
এই নিবেদন করি রাতুল চরণে

অন্য কিছু নাহি চাহি তব পদ বিনে
।।
এত বলি কান্দি সতী ধরণী লোটায়

আঁখি জলে ভেসে তবে শ্রীগোপাল কয়
।।
সতী নারী মানবের পরম সম্পদ

সতীর গুণেতে পতি পায় মুক্তিপদ
।।
সতীশূল্য গৃহ দেখ স্মশানের প্রায়

সতীর গুণেতে লহ্মী গৃহে বান্ধা রয়
।।
যেই ঘরে নাহি সতী তাহাত অরণ্য

সেই জন্যে বলিয়াছি সতী তুমি ধন্য
।।
এইভাবে ভাবালাপ করিতেছে দোঁহে

হেনকালে এক ভক্ত সেথা আসি কহে
।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ করেছে স্মরণ

শুনিয়া গোপাল করে ত্বরিতে গমন
।।
কাঞ্চন জননী তাহে পিছে পিছে ধায়

গুরুচাঁদ সম্মুখেতে হইল উদয়
।।
উভয়ের চক্ষে বহে দ্রুত বারিধারা

গুরুচাঁদ দরশনে প্রেমে মাতোয়ারা
।।
অন্তর্য্যামী প্রভু সব বুঝিলেন মনে

গোপালে চাহিয়া প্রভু বলিছে তখনে
।।
শুনহে গোপাল আমি বলি তব ঠাঁই

সতী রমনীর গুণের সীমা কভু নাই
।।
ধর্ম্মর আবাস-গৃহ সতীর হৃদয়

যেথা সতী সেথা ধর্ম্ম জানিও নিশ্চয়
।।
সাবিত্রী পরমা সতী শুনিয়াছ কথা

মৃতপতি বাঁচাইল অপূর্ব্ব বারতা
।।
মহাভারতের মধ্যে এসব কাহিনী

অন্য এক সতী নারী আছে আমি জানি
।।
পুরানে বর্ণিত তাহা অতীব মধুর

শোন সবে সেই কথা বলিব প্রচুর
।।
এত বলি গুরুচাঁদ কহিল প্রবন্ধ

শ্রীগুরু-চরণ ভাবি ভণে মহানন্দ
।।

 

পতিব্রতা সুকলাদেবীর উপখ্যান


কৃকল নামেতে বৈশ্য বারাণসী পুরে

সুকলা নামেতে সাধ্বী ছিল তাঁর ঘরে
।।
ধর্ম্মজ্ঞ, দেবজ্ঞ, বটে সেই মহাশয়

পুণ্যকর্ম্মে তেঁহ বাধ্য ছিল সর্ব্বদায়
।।
পরম পবিত্রা সতী সুকলা রমণী

পতিপদ পূজে সতী দিবস রজনী
।।
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free