মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৪০১-৪২০

জল মধ্যে যদি কোন জীব আসি পড়ে।
কুম্ভীর পরমানন্দে তারে গিয়ে ধরে।।
এমন যে বনপতি ব্যাঘ্র মহাশয়।
কুম্ভীরের সঙ্গে তার কত রণ হয়।।
মানব রচিত বিশ্ব ফেলিয়া পিছনে।
প্রকৃতি রয়েছে সেথা বসি নিজমনে।।
সভ্যতার কুটিলতা, জ্ঞানের মুখোস।
সুখের কপট হাসি বিষ-ভরা রোষ।।
প্রকৃতির বনরাজ্যে কিছু তার নাই।
সত্য যাহা সবে তাহা বহিছে সদাই।।
কুম্ভীরের সঙ্গে ব্যাঘ্র নাহি করে ছলা।
ভাণ করে নাহি ধরে হরিণের গলা।।
মৃগ জানে ব্যাঘ্র কভু করিবেনা দয়া।
ব্যাঘ্র জানে কুম্ভীরের বুকে নাহি মায়া।।
যার যার পরিচয় তাহা অকপটে।
বনরাজ্যবাসী সবে দিয়া থাকে বটে।।
সভ্যতার গর্বে মত্ত মানব সমাজে।।
মিল নাই কোনখানে কথা আর কাজে।।
সেই সব কথা বলে আর কার্য্য নাই।
এবে শুন কি করিল অশ্বিনী গোসাই।।
পশর নদীর বুকে পশিল তরণী।
ক্রোশেক বিস্তুত হবে কলেবর খানি।।
পর্ব্বত সমান ঢেউ গর্জ্জে সর্ব্বদায়।
দেখিলে তান্ডব লীলা মনে লাগে ভয়।।
সাবধানে দাড়ীগণে তরী বেয়ে গেল।
মঙ্গলা নদীতে আসি উপনীত হল।।
কল কল ছোটে জল তরী বেয়ে যায়।
অশ্বিনী গোঁসাই গান ধরে এসময়।।
নিজের রচিত গান ভাবরসে পোরা।
উথলে স্বরের গতি যেনরে ফোয়ারা।।
গান শুনি মুগ্ধ হল সব ভক্তগণ।
অবিরল নেত্রজল করিছে মোচন।।
পদমাত্র এইখানে উল্লেখ করিব।
পরে পরে আর বহু কথা আমি কব।।
‘‘গুরুচাঁদ! এমন চাঁদ কে ভবে আনিল
প্রেমরসে জগত মাতাল।।
না জানি কি মোহিনী জানে,
কুলজার মনপ্রাণ ধরিয়ে টানে,
কিবা বাল্য বৃদ্ধ শুনে বাধ্য,
তাঁর রূপ দেখে পাগল হল।।’’
এই ভাবে ধীরে ধীরে তরী বেয়ে যায়।
হুড়কা গ্রামেতে আসি হইল উদয়
।।
রূপচাঁদ গোস্বামীজী সঙ্গেতে আছিল।
দয়া করি দয়াময় তাঁর গৃহে গেল।।
রূপচাঁদ গোস্বামীর ভকতি অপার।
কিছুপরে লেখা হবে কীর্ত্তি কথা তাঁর।।
এক রাত্রি দয়াময় রহে তাঁর বাড়ী।
তথা হতে প্রাতেঃ তবে তরী দিল ছাড়ি।।
রূপচাঁদ গোস্বামীর ধর্ম্মপত্নী যিনি।
সতীলহ্মী ফুলমালা নাম তাঁর জানি।।
আপন কন্যার প্রায় প্রভুকে সেবিল।
তাঁর ভক্তিগুণে প্রভু বহু প্রীত হল।।
তথা হতে আসিলেন বড়দিয়া গ্রাম।
জ্ঞানী ভক্ত আছে সেথা নাম কোনারাম।।
গোপালের পদাশ্রয়ে ভাবেতে মাতিল।
গোপালের গুণে তারে ঠাকুর চিনিল।।
তাঁর সাধ্বী পত্নী যার নাম আহলাদিনী।
পরম পবিত্রা সতী গুণেতে বাখানি।।
নিজ পিতা সম মানে শ্রীগোপাল চান্দে।
গোপাল, গোপাল বলি দেবী সদা কান্দে।।
দয়া করি দয়াময় সেই গৃহে গেল।
সতী মাতা আহলাদিনী বহুত কান্দিল।।
এ সময়ে এক কন্যা মাতাজীর কোলে।
কন্যা দেখি গুরুচাঁদ দয়া করি বলে।।

‘‘এক পুত্র এই ঘরে আসিবে এবার।
বিদ্বান হইবে পুত্র বলিলাম সার।।’’
পতি পত্নী একমনে প্রভুকে সেবিল।
আহলাদী দেবীর গুণে প্রভু বাধ্য হল।।
কেনারামে ডাকি প্রভু বলিল তখন

‘‘শোন কেনারাম তুমি আমার বচন।।
গোপালের সঙ্গ তুমি কভু ছাড়িও না।
গোপালে অমান্য করি যেন বাড়িওনা।।’’
করেজোড়ে কেনারাম করিল স্বীকার।
‘‘জীবনে মরণে প্রভু গোপাল আমার।।’’
তারপরে যাহা হলে সেই পরিচয়।
বলিবারে ইচ্ছা আছে অপর অধ্যায়।।
তথা হতে তরী ছাড়ি বাগেরহাট আসে।
প্রভু বলে ‘‘চল এবে যাই নিজ দেশে।।’’
কাথলী নিবাসী সাধু নিবারণ নাম।
তার কান্না দেখি বলে প্রভু গুণধাম।।
‘‘সরল সহজ লোক এই নিবারণ।
চল তার গৃহে আমি করিব গমন।।’’
কাথলী গ্রামেতে আসি দয়াল ঠাকুর।
ভাব দেখি প্রাণে শান্তি পাইল প্রচুর।।
একদিন দেরী করি তথা হতে যায়।
ক্রমে ক্রমে উপনীত সে তালতলায়।।
মহেশের গৃহে গিয়া দিল দরশন।
মহেশ পাইল মনে শান্তি অবর্ণন।।
যাদবের বাড়ী পরে প্রভুজী চলিল।
ভক্তিভরে যে যাদব চরণ বন্দিল।।
তথা হতে ধীরে ধীরে চলে ধামপানে।
মতুয়ারা মত্ত হল হরি নাম গানে।।
ক্রমে তরী লাগে ঘাটে প্রভাত বেলায়।
নরনারী সবে আমি জয়ধ্বনি দেয়।।
দুইদিন ওড়াকান্দী রহিল গোপাল।
তাঁরে ডাকে বলিলেন পরম দয়াল।।
‘‘গৃহে যাও হে গোপাল এলে বহুদিন।
বহুকষ্টে দেহ তব হইয়াছে ক্ষীণ।।
কিছুদিন গৃহে থাকি এস পুনরায়।
ওড়াকান্দী যাতায়াত কর সর্ব্বদায়।।’’
প্রভুর বচনে সাধু গৃহেতে ফিরিল।
হরি গুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।

লাটমন্ত্রীর গোপালগঞ্জ পরিদর্শণ


চৌধুরী নবাব আলি নামেতে সুজন।
লাটের মন্ত্রীত্বে বটে ছিল সেই জন।।
বগুড়া নবাব বংশে জনম তাঁহার।
বহু মান করিলেন বঙ্গের ভিতর।।
লাটের মন্ত্রীত্বে যবে ছিল মহাশয়।
গোপালঞ্জেতে আসি হলেন উদয়।।
তাঁর আগমনে হয় সভার শোভন।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ পায় নিমন্ত্রণ।।
সাঙ্গো পাঙ্গো দেশ মধ্যে প্রধান যাহারা।
প্রভুর সংগেরত তবে চলির তাঁহারা।।
ভীষ্মদেব দাস আর শ্রীবিধু চৌধুরী।
মহাজ্ঞঅনী যঞ্জেশ্বর চলে সঙ্গে তারি।।
গোপালগঞ্জেতে আসি উদয় হইল।
লাট-মন্ত্রী সঙ্গে পরে সাক্ষাৎ করিল।

প্রভুকে দিখিয়া বলে সেই মন্ত্রীবর।
‘‘বড়কর্ত্তা আপনাকে করি নমস্কার।।
আপনার পুত্র যিনি শ্রীশশিভূষণ।
পূ্র্ব্বে তাঁর সঙ্গে মোর আছে আলাপন।।
সুধীর সুশান্ত বটে সেই মহাশয়।
একবার হলে দেখা ভোলা নাহি যায়।।
তাঁহার কুশলবার্ত্তা জানিবারে চাই।
কেমন আছেন তিনি মোরে কন তাই।।

 

এই প্রশ্ন করে যদি মন্ত্রী মহাশয়।
নীরবে পিতার বুকে অগ্নি জ্বলে হায়।।
আপনারে স্মবরিয়া প্রভু বলে হাসি।
‘‘মন্ত্রীবর! পরলোকে চলে গেছে শশী।।’’
ধীরে ধীরে প্রভু করে বাক্য উচ্চারণ।
বাক্য শুনি মন্ত্রী হল দুঃখে নিমগন।।
পিতার মুখেতে শুনি পুত্রের মরণ।
মন্ত্রী যেন বাক্য-হারা হইল তখন।।
নীরব লাটের মন্ত্রী নীরব সকল।
নীরবে কান্দিল যেন সেই গৃহতল।।
কিছু পরে লাট-মন্ত্রী প্রভু পানে চায়।
বলে ‘‘বড় দুঃখ প্রাণে হল মহাশয়।।
শশীবাবু সঙ্গে কিসে হল পরিচয়।
সেইবার্ত্তা বড়কর্ত্তা জানাই তোমায়।।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখনে হইল।
হিন্দু সবে দলে দলে তাতে যোগ দিল।।
ঢাকার নবাব যিনি সলিমুল্লা নাম।
মহাজ্ঞানী বিচক্ষণ সেই গুণধাম।।
মুসলমানের পক্ষে এই আন্দোলন।
কর্ত্তব্য কি অকর্ত্তব্য তাতে যোগদান।।
সেই পরামর্শ লাগি তাঁর কাছে যাই।
তার গৃহে তব পুত্রে আমি দেখা পাই।।
একসঙ্গে পরামর্শ করিনু আমরা।
মোরা নাহি মানি লব আন্দোলন-ধারা।।
নমঃশূদ্র আর মোরা যত মুসলমান।
ঠিক হল মোরা নাহি দিব যোগদান।।
আমি জানি সেই মতে দেশে আসি শশী।
নমঃশূদ্র মুসলমানে করে মিশামিশি।।
আপনার কার্য্যধারা পাই পরিচয়।
সেই ইতিহাস আজি বলি মহাশয়।।
বড় গুণবাণ ছিল তোমার নন্দন।
বড় দুঃখ পাই শুনি তাঁহার মরণ।।
অবশ্য খোদার ইচ্ছা সদা বলবান

তাই ভাবি দুঃখে নাহি হও মুহ্যমান।।’’
মন্ত্রীর বচন শুনি প্রভু হাসি কয়।
‘‘মোর কথা শুন তবে মন্ত্রী মহাশয়।।
আমি জানি তিনি মোরে বাসে সদা ভাল।
ভালবেসে যাহা দেয় তাই মোর ভাল।।
মঙ্গলময় কেন বল মনে ভাবি মোরা?
মঙ্গলময়ের ইচ্ছা সুমঙ্গলময়।।
পুত্রের মরণে আছে মঙ্গল নিশ্চয়
।।
তাতে মোর মনে শোক কিছু হয় নাই।
যে-কার্য্যে এসেছি মোরা বলি শোন তাই।।
একেত দরিদ্র এই নমঃশূদ্র জাতি।
বিদ্যাহীন বলে আছে হয়ে হীনমতি।।
আমাদের মত আছে তব সম্প্রদায়।
বিদ্যা বিনা ইহাদের হবে না উপায়।।
আর বলি রাজকার্য্য দিলে ইহাদের।
তোমার আমার জাতি উঠিবে উপরে
।।
অবশ্য তোমার মধ্যে আছে বহুজন।
ধনী, মানী, জ্ঞানী, গুণী কত মহাজন।।
তবু বলি অধিকাংশ মুসলমান ভাই।
আমাদের মত তারা বিদ্যা পায় নাই।।
আপনি লাটের মন্ত্রী বহু শক্তি হাতে।
বিদ্যা-বিহীনের গতি কর কোনমতে।।’’
প্রভুর বচন শুনি মন্ত্রী মহোদয়।
বলে ‘‘ধন্য বড়কর্ত্তা ধন্য মহাশয়।

তোমার উদার নীতি শুনিলাম কানে।
বড়ই উদার দেখি তোমার হৃদয়।
তোমার মতন কথা কেহ নাহি কয়।।
সবে চায় নমঃশূদ্রে আর মুসলমানে।
বিবাদ বাধায়ে দিয়ে মরিবে পরাণে।।

 

 

তোমার বাক্যতে মোর বড় আশা হল।
এতদিনে বুঝিলাম সুদিন আসিল।।
আমি বলি তব ঠাঁই কথা মিথ্যা নয়।
যাহা পারি সব আমি করিব নিশ্চয়।।’’
পুনরায় মন্ত্রীবর ধন্যবাদ দিল।
অতঃপর মহাপ্রভু বিদায় মাগিল।।
কি ধন্য প্রভুর খেলা কেবা মর্ম্ম জানে।
যেখানে যা লাগে প্রভু করে তা সেখানে
।।
সঙ্গীসহ গুরুচাঁদ গৃহেতে ফিরিল।
কিছুদিন পরে দেখ মহা ঝড় হল।।
বাহিরেতে ঝড় হল গাছপালা ভাঙ্গে।
স্বরাজের আন্দোলন উঠে সঙ্গ সঙ্গে।।
সেই সব কথা এবে করিব বর্ণন।
হৃদয়ে স্মরণ করি শ্রীগুরু চরণ।।
দয়া করি গুরু মোর বস হৃদিপটে।
তব কৃপা বিনে মোর সাধ্য নাহি মোটে।।

 

১৩২৬ সালের মহাঝড়


তেরশ ছাব্বিশ সালে মনোদ শারদ কালে।
দিকে দিকে বেজে ওঠে আগমনী সুর।
বঙ্গবাসী নর নারী আশা-রসে প্রাণ ভরি।
ব্যথা-ভরা বুক হতে দুঃখ করে দূর।।
আসিবেন শৈল-সুতা আপনি জগত মাতা
জনে জনে সেই কথা কহিছে আনন্দে।
হাসিলে শেফালী ফুল ছুটে আসে অলিকুল
উড়ে পড়ে করে ভুল ফুলের সুগন্ধে।।
বরষা কাঁদিয়া গেল আকাশ সুনীল হল।
প্রকৃতির কালোমুখে ফুটে হাসি রেখা।
ধানের পাতার গায় পরশ বুলায়ে যায়
শারদ রানীর হাসি বায়ু-তলে ঢাকা।।
আশার মোহন ছবি শারদ গগনে রবি
হাসি হাসি নিত্য আসি কহে কত কথা।
মনের নিরাল কোণে স্বপ্নে কিংবা জাগরণে
বিরহী প্রিয়ের বুকে বেজে ওঠে ব্যাথা।।
স্বপনের রাজ্য খানি কল্পলোক হতে আনি
শারদ রজনী যেন রাখিল ধরায়।।
কন্ঠে কন্ঠে বাজে গান দিকে দিকে নাচে প্রাণ
আত্মভোলা নরনারী দিকে দিকে ধায়।
আহা রে! মানবকুল! কেন নাহি বোঝে মূল
আশা-করা কত ভুল নশ্বর জীবনে।
আশা যে ছলনাময়ী আশা, আশা দেয় কই?
মোরা শুধু-ভুলে রই আশার ছলনে।।
তাহা হলে বল কেনে তের শ ছাব্বিশ সনে
শারদ আকাশ কেন কালো মেঘে ঢাকে।
বঙ্গোপসাগর বুকে বল দেখি কোন ফাঁকে
প্রলয়ের নাদে কেন ঘুর্ণীবায়ু ডাকে?
কালো হল নীলাকাশ প্রলয়ের ক্রুদ্ধ শ্বাস
মহারোষে ছোটে কেন বঙ্গভূমি পরে?
মরে নারী মরে নর ভাঙ্গে বৃক্ষ পড়ে ঘর
হাহাকার ওঠে কেন প্রতি ঘরে ঘরে।।
আমি বলিয়াছি তাই শুনহে মানব ভাই।
বুঝে দেখ কিছু নাই তব অধিকারে।
ক্রীয়া পুত্তলিকা প্রায় গড়ায়ে রেখেছে হায়
জগতের স্বামী যিনি আছে বিশ্ব ভরে
আশ্বিনের অগ্রভাগে ষষ্ঠীর দুদিন আগে
বিন্দু বিন্দু বারিপাত আরম্ভ হইল।
যত যত হয় কাল বাতাসেতে কোলাহল
অশান্ত বারির ধারা আঝোরে নামিল।।
মুখে হাসি গেল মুছে জনে জনে তাই পুঁছে
একি কান্ড লন্ড ভন্ড উঠিল বাতাসে?
ক্রমে যেন বাড়ে রোষ বায়ু করে ফোঁস ফোঁস
অসংখ্য নাগের বংশ যেন নেমে আসে।।

 

বুধের সকাল হতে চারিদিকে আচম্বিতে
আকাশে অশনি নাদে অতি ভয়ঙ্কর।
কাঁপিল নদীর জল কাঁপিল গৃহের তল
বৃক্ষ আদি ঘরবাড়ী কাঁপে থর থর।।
সুতীহ্ম শরের প্রায় বারিধারা লাগে গায়
অকস্মাৎ নদীজলে বহিল উজান

তরণী ডুবিল কত গণনায় সংখ্যাতীত
হত ভাগ্য দাঁড়ি কত তাজিল পরাণ।।
বন্যা এল নদী জলে দুকুল ছাপিয়ে চলে
জলে জলে মাঠ ঘাট হল একাকার।
সূর্য্য নাহি দেখা দিল কোথা দিয়ে দিন গেল
কালদূত সম কাল গাঢ় অন্ধকার।।
রাত্রি যত বেশী হয় তত জোরে বায়ু ধায়
প্রলয়ের কাল নৃত্য উঠে চারি ভিতে।
লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ পড়ে প্রলয়ের সেই ঝড়ে
ইষ্টক নির্ম্মিত গৃহ পারে না সহিতে।।
পশু পাখী সংখ্যাতীত প্রলয়েতে হল কত
মর্ম্মভেদী দৃশ্য কত জাগে চারিদিকে।
শিশু পুত্র বুকে ধরি মরে কত শত নারী
পতি-পত্নী এক সাথে জড়াজড়ি বুকে।।
সে কি যে প্রলয় কান্ড বিধাতার গুরুদন্ড
সারা বঙ্গ লন্ড ভন্ড কয়েক ঘন্টায়।
লোহার সিন্দুক ঘরে রাখিল বৃক্ষের পরে
কার চাল কার ঘরে চেনা হল দায়।।
ধান্যসহ গোলা উড়ে গেল দেশ দেশান্তরে
বায়ু-রথে সুখে চড়ে নদী হল পার।
তরণী চড়িয়া গাছে শাখায় বুলিয়া আছে
ক্ষুদ্র শিশু তার মাঝে করিছে চিৎকার।

তাল গাছ উড়ে জোরে তেঁতুলের বুক চিরে
কীলকের মত রহে বুকে বদ্ধ তার।
ভেদিয়া ধরণী বক্ষঃ প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ
উর্দ্ধ-মূল করি রহে শিরে বহি ভার।।
এত বড় অত্যাচার বঙ্গদেশে পূর্ব্বে আর
হয় নাই দেখে নাই কভু বঙ্গবাসী।
উদার মহান যত জীবসেবা পুণ্যব্রত
দেশে দেশে অবিরত করিলেন আসি।।
গুরুচাঁদ এ সময় দেশের এ দুর্দ্দশায়
গলিলেন করুণায় আপনার মনে।
অন্নহীন দীন গণে ডাকি আনি নিজ স্থানে
অকাতরে অন্ন দেয় প্রতি জনে জনে।।
সরকার বাহাদুর প্রজা যত ব্যথাতুর
করিবারে দুঃখ দূর ব্যবস্থা করিল।
দেশে দেশে কেন্দ্র করি দান দিল দেশ ভরি
বাল বৃদ্ধ নর নারী প্রাণেতে বাঁচিল।।
রামকৃষ্ণ মিশনারী সন্ন্যাসীর বেশধারী
দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করি দরিদ্রে বাঁচায়।
দীনের দরদী বন্ধু মহামনা কৃপাসিন্ধু
আর্ত্তত্রাণে এল ছুড়ে স্যার পি,সি রায়।।
রসায়ন শাস্ত্র-গুরু দানে যেন কল্পতরু
দার পরিগ্রহ নাহি করিল জীবনে।
সেবাব্রতে আত্মত্যাগ করিলেন মহাভাগ
বিশ্ববাসী এই যাগ রাখিবে স্মরণে।।
প্রকৃতির এ-খায়ালে দেশ গেল রসাতলে
দীন গ্রন্থকার বলে শুন জীবকুল।
এ জগতে যাহা হয় সব করে ইচ্ছাময়
সৃষ্টি ধ্বংস তাঁর ইচ্ছা এই জান মূল।।

 

নন-কো-অপারেশনবা অসহযোগ আন্দোলন


সতের শত সাতান্ন অব্দে পলাশীর রণে।
স্বাধীনতা-সূর্য্য অস্ত ভারত গগনে।।
ভারত বিজয়ে হল আদিতে পত্তন।
ক্লাইভের সঙ্গে হায়! সিরাজের রণ।।

 

ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে বণিকের জাতি
পুণ্যভূমি এ ভারতে সাজিল নৃপতি।।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীবণিকের সঙ্ঘ।
বাণ্যিজ্য, রাজত্ব দুই নিয়ে করে রঙ্গ।।
শাসন শোষণ দুই চলে এই হাতে।
অরাজক হল রাজ্য বহু বিধ মতে।।
এই ভাবে শতবর্ষ গত হয়ে যায়।
ভারতসাবীর মনে অশান্তি উদয়।।
আঠাশ ছাপান্ন অব্দে আগুন জ্বলিল।
উত্যক্ত ভারতবাসী বিদ্রোহ করিল।।
সমস্ত ভারত ব্যাপী ঘোর আন্দোলন।
নর নারী শিশু হত্যা হল অগনণ।।
বজ্রহস্তে ইংরাজেরা বিদ্রোহ দমিল।
বিদ্রোহী পলায় কেত, কেহ যুদ্ধে মল।।
‘‘সিপাহী বিদ্রোহ’’ নামে এই আন্দোলন।
জগতের ইতিহাসে করেছে লিখন।।
ইংল্যান্ড-ইশ্বরী রাণী নাম ভিক্ট্রোরিয়া।
জানিলেন সব কথা গৃহেতে বসিয়া।।
মন্ত্রী সঙ্গে দয়াবতী করিল মন্ত্রণা।
ভারত কহেছে বটে অশেষ যন্ত্রণা।।
বণিকের হাতে রাজ্য আর না রাখিব।
আপনার হাতে এবে রাজদন্ড নিব
।।
সেই মতে নিজ হাতে রাণী রাজ্য লয়।
‘‘রাণীর মহান বাণী’’ ঘোষণা করয়।।
রাণীর ঘোষণা মধ্যে রহিল প্রচার।
রাজকার্য্যে অধিকার থাকিবে প্রজার।

ধর্ম্মকর্ম্মে স্বাধীনাতা থাকিবে সবার।
ধর্ম্মে হস্তক্ষেপ রাণী না কিরবে কার।।
আঠার শ একষট্টি অব্দে রাণীর আজ্ঞায়।
আইন সভার সৃষ্টি এ ভারতে হয়।।
বাঙ্গালা বোম্বাই আর মাদ্রাজ প্রদেশে।
পাঞ্জাবে, সীমান্তে তাই সেই সভা বসে।।
ইংরাজী শিক্ষার হল বহুল প্রচার।
শিখিল ভারতবাসী পাশ্চাত্য আচার।।
ভারতের চিন্তারাজ্যে অদ্রদূত যাঁরা।
এর পরে মনে মনে ভাবিলেন তারা।।
জাতীয় সমিতি যদি না থাকে ভারতে।
সব আন্দোলন ব্যর্থ হবে ভবিষ্যতে।।
রাষ্ট্রীয় সমিতি তাই করিতে গঠন।
ভারতের প্রধানেরা করিল মনন।।
কটন সাহায্য কার্য্যে করিল তখন।
তার ফলে আঠার শত পাঁচাশী সালে।
জাতীয় রাষ্ট্রীয় সভা বোম্বাইতে মেলে।।
সংক্ষেপে ‘‘কংগ্রেস’’ নামে হল পরিচিত।
ভারতের মান্য যত মনীষি-রচিত।।
নামেতে উমেশ চন্দ্র সেরা ব্যারিষ্টার।
ব্যানার্জ্জি উপাধি তাঁর কলিকাতা ঘর।।
‘‘ডব্লিউ, সি, ব্যানার্জ্জি’’ বলিসবে তারে জানে।
প্রথমে বসিল সভাপতির আসনে।।
সেই হতে অদ্যবধি সেই যে কংগ্রেস।
‘‘জাতীয় সমিতি’’ নামে সেবিতেছে দেশ।।
জাতীয় সমিতি গড়ি করে আন্দোলন।
স্বাধীনতা দাবী তারা করিছে এখন।।
আঠার শনিরানব্বই আব্দেতে আবার।
ভারসতাবসীরা পেল কিছু অধিকার।।
আইন সভায় সভ্য হইল অধিক।
বহু সঙ্ঘ নিজ সভ্য করে দেয় ঠিক।।
ঊনিশ শনয় অব্দে আর অগ্রসর।
‘‘মার্লি-মিন্টো’’ নামে হল নব সংস্কার।।
লাটের সভায় সভ্য হয় নির্ব্বাচন
।।
প্রতিনিধি নামে মাত্র মূল শক্তি নাই।
স্বায়ত্ত শাসন নীতি ইথে নাহি পাই।।

 

 

এই ভাবে ক্রমে দিন হল অগ্রসর।
নামিল বিশ্বের বুকে রণ ভয়ঙ্কর।।
ঊনিশ শচৌদ্দ অব্দে সমর বাধিল।
সেই সব কথা পূর্ব্বে লিখিত হইল।।
এই যুদ্ধে ভারতের যত নর নারী।
রাজার সাহার্য্য করে দৃঢ় নিষ্ঠা করি।।
রক্ত দিল বিত্ত দিল জোগাল সৈনিক।
বাঙ্গালী মাদ্রাজী গেল আর কত শিখ।।
রাজশক্তি পরিচয় দিল ভারতবাসী।
বিরাতে ইংরাজ জাতি তাতে মহাসুখী।।
চেমসফোর্ড রড়লাট ছিলেন ভারতে।
সেক্রেটারী মন্টেগু ছিলেন বিলাতে
।।
ভারতবাসীর এই মহত্ব দেখিয়া।
রাজার পক্ষেতে বাণী দিলেন বলিয়া
।।
‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যত উপনিবেশ আছে।
স্বায়ত্ত শাসন প্রথা সর্ব্বত্র রয়েছে।।
সেই প্রথা প্রবর্ত্তিত হইবে ভারতে।
ক্রমে ক্রমে নিব মোরা তারে সেই পথে।।’’
মহা সমরের কালে এক মহাজন।
ইংরাজে সাহায্য করে অতি দৃঢ় মন।।
নামেতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
করজোড়ে মহাত্মের সবিনয়ে বন্দি।।
পবিত্র চরিত্র অতি ধর্ম্মিক সুজন।
‘‘মহাত্মা’’ বলিলে তাঁরে চেনে সর্ব্বজন।।
বাল্যকাল হতে তাঁর স্বভাব সুন্দর।
প্রতি কার্য্যে ছিল তাঁর সত্য ব্যবহার।।
এক মাত্র ধর্ম্ম তাঁর সত্যকে প্রতিষ্ঠা।
সত্যকে ঈশ্বর মানে এত তাঁর নিষ্ঠা।।
ব্যারিষ্টারী পড়িলেন লন্ডন সহরে।
আমিষ ভোজন সেথা কভু নাহি করে।
ব্যারিষ্টারী পাশ করি আসিলেন দেশে।
হাইকোর্টে যোগদান করে অবশেষে।।
ব্যবসায় পথে দেখি বিথ্যার আচার।
ব্যারিষ্টারী কার্য্য ক্রমে করে পরিহার।।
সত্যকে মেনেছে যেবা বাক্যে, মনে প্রাণে।
তাঁরে অস্বীকার কেবা করে কোনখানে?
দক্ষিণ আফ্রিকা হতে এল আমন্ত্রণ।
বহু কষ্টে সহে সেথা ভারতীয় গণ।।
সেই আমন্ত্রণে তবে সেই মহাশয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা আসি উপনীত হয়।।
সত্যের পথেতে দেখ বহু দৃঃখ রয়।
হাসি মুখে সব দুঃখ সহে মহাশয়।।
সত্যের পূজারী যাঁরা আছে ধরা পরে।
সত্য ভিন্ন অন্য কিছু মান্য নাহি করে।।
যতই উদ্ধত হোক মানবীয় শক্তি।
সত্যের পূজারী তাঁহে নাহি রাখে ভক্তি।।
অকপটে বিনা ভয়ে কহে সমুদয়।
কপটীর প্রাণে তাহা সত্য নাহি হয়।।
উদ্ধত শাসন দন্ড তাই নেমে আসে।
তাহা দেখি সত্যাচারী বসে বসে হাসে।।
অহিংসা সত্যের ভিত্তি মনে করি সার।
সর্ব্ব কার্য্যে করে গান্ধী সেই ব্যবহার।।
পথ দেখাইল তাঁরে ঋষি টলষ্টয়।
তাঁর নীতি মেনে গান্ধী তাতে দীক্ষা লয়।।
দক্ষিণ আফ্রিকা যবে করে আন্দোলন।
বহু দুঃখ পেল সেথা সেই মহাজন।।
শ্বেতাঙ্গ সমাজ সেথা দোর্দ্দন্ড প্রতাপ।
কোন ভাবে গান্ধীজীরে নাহি করে মাপ।।
প্রত্যক্ষে পরোক্ষ কত করে অসম্মান।
তবু ধীর সত্য বীর ক্রুদ্ধ নহি হন।।
বিনা প্রতিবাদে যত অপমান সয়।
শ্বেতাঙ্গ সমাজ তাতে আরো ক্রুদ্ধ হয়।।
একদা রুখিয়া তারা অনেকে আসিল।
বিনা দোষে গান্ধীজীর দাঁর ভেঙ্গে দিল।।

 

 

সূর্য্যকে ঢাকিতে বল কেবা কবে পারে?
গান্ধীজীর কীর্ত্তি গেল দেশ দেশান্তরে।।
ইংরেজ প্রধান বর্গ তাঁহারে চিনিল

আফ্রিকার সমস্যার সমাধান হল।।
অহিংসা নীতির পথে একটি বিগ্রহ।
প্রতিবাদ নির্ব্বিবাদপূর্ণ সত্যাগ্রহ।।
মান যশ দন্ডভয় করি অবহেলা।
সত্যকে বহিয়া শিরে দৃঢ়পদে-চলা।।
অক্রোধ পরমানন্দনিতাই যেমন।
সেই মতে সেই পথে সঙ্কল্প সাধন।।
সত্য লাগি যে বিরোগী এত কষ্ট সয়।
বিজয়লহ্মীর দানে বিজয়ী সে হয়।।
এতকাল রাজনীতি বিশারদ গণ।
অহিংসা নীতির কথা বলেনি কখন।।
‘‘শঠে শাঠ্যৎ সমাচরেৎ’’ এই শ্রেষ্ঠ নীতি।
ছলা, কলা, হিংসা দ্বেষ সেই পথে গতি।।
মিথ্যা ছাড়া রাজনীতি চলে না কখন।
ধর্ম্মপথে লাগে বটে সাধন ভজন।।
কিন্তু গান্ধী নব সন্ধী দেখাল জগতে

‘‘অহিংসা নীতির গতি’’ চলে সর্ব্ব পথে।।
কিবা ধর্ম্ম, কিবা কর্ম্ম, কিবা রাজনীতি।
অহিংসা নীতির আছে সবখানে গতি।।
অস্ত্র বলে দেহ বলে জয় নাহি হয়।
অহিংসা অস্ত্রেতে বিশ্ব জয় করা যায়।।
দক্ষিণ আফ্রিকা খন্ডে সেই নীতি ফলিল।
বিশ্ববাসী নর নারী বিস্ময় মানিল।।
হেনকালে মহাযুদ্ধে নামিল ইংরাজ।
বিশ্বময় পড়ে রব সাজ সাজ সাজ
।।
পরাধীন ভারতের বহু অধিকার।
যুদ্ধ শেষে দিবে বলি করে অঙ্গীকার।।
মন্টেগুর বাণী যাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি।
আনন্দে ভারতবাসী ওঠে তাই নাচি।।
সত্যের পূজারী গান্ধী ভাবিলেন মনে।
ইংরাজে সাহায্য যদি করি এই রণে।।
যুদ্ধ শেষে ভালবেসে ইংরাজ তখন।
ভারতবাসীকে দিবে স্বাধীনতা ধন।।
তার লাগি সেই ত্যাগী যুদ্ধের সময়।
বহু ভাবে ইংরাজের সাহায্য করয়।।
তাঁর কার্য্যে ইংরাজেরা প্রীত অতিশয়।
তারা বলে ‘‘ধন্য ধন্য গান্ধী মহাশয়।।’’
ঊনিশশ আঠার অব্দে যুদ্ধ শেষ হলো।
বলদর্পী জার্মানীর দর্প ভেঙ্গে গেল।।
‘‘ভার্সাই নগরে সন্ধি করে সবে মিশে।
জুড়াল ধরার অঙ্গ শান্তির বাতাসে।।
ভারতের কি করিবে ইংরাজ এখন?
এভাবে ভারতে আগে এক আন্দোলন।।
উনিশশ ঊনিশ অব্দে ভারত আইন।
পার্লিমেন্টে হল পাশ দেখি একদিন।।
যুদ্ধকালে যত কিছু কথা বলা হল।
কার্য্যকালে প্রায় কিছু দেয়া নাহি গেল
।।
দ্বৈত-নীতি প্রচলিত হইল প্রদেশে।
সেই নীতি বার্ত্তা কিছু বলিব বিশেষে।।
নির্ব্বাচিত মনোনীত সভ্য দু প্রকার।
আইন সভায় যাবে ব্যবস্থা তাহার।।
শাসন ব্যবস্থা ভাগ দুই ভাগে করে।
মন্ত্রী এক ভাগে রহে সদস্যে অপরে।।
যেই ভাগ মন্ত্রীগণে করিবে চালনা।
‘‘হস্তান্তর ভাগ বলি তাহার ঘোষণা।।
সংরক্ষিত ভাগ লাট রাখে নিজ খাসে।
মনোনীত সদস্যেরা সেই ভাগে বসে।।
মন্ত্রীকে সদস্য চলে লাটের ইচ্ছায়।
আইন সভার কাছে দায়ী নাহি রয়।।
সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর একটি নিয়ম।
স্বায়ত্ব শাসনে যাহা পূর্ণ ব্যতিক্রম।।

 

স্বৈর তন্ত্র বলি যাহা নীতি শাস্ত্রে কয়।
লাট-হস্তে সেই শক্তি সব রাখি দেয়।।
স্বৈর তন্ত্র কথা কিছু সংক্ষেপে বলিব।
মূল সূত্র ধরি পরে যা হয় বলিব।।
আৈইন সভার মত হোক বা না হোক।
জন স্বার্থ তাতে ঠিক রোক বানা রোক।।
লাট যদি মনে করে এ আইন হলে।
নির্ব্বিঘ্নে শাসন-যন্ত্র ঠিক ভাবে চলে।।
আপনার শক্তি বলে লাট মহোদয়।
যে কোন আইন পাশ নিজে করি লয়।।
প্রকৃত প্রস্তাবে শক্তি ইংরাজের হাতে।
ব্যথিত ভারতবাসী সুখী নহে তাতে।।
অবশ্য প্রত্যেক কার্যে আছে দুই দিক।
কোন কার্য্য সবে নাহি বলে কভু ঠিক।।
সে সব বিচার কিছু এখানে না করি।
গ্রন্থের ভাবের ভাবে চলি পথ ধরি।।
‘‘ভারত আইন’’ দেখি নিরাশ হইয়া।
আন্দোলন করে সব নেতারা জুটিয়া।।
আন্দোলন দমনের হল প্রয়োজন।
‘‘রাউলাট আইন’’ তবে করে প্রচলন।।
বেগবতী স্রোতস্বতী যদি বাধা পায়।
বাধা-প্রাপ্তে বেগ যথা দ্বিগুণিত হয়।।
আন্দালন ধারা চলে অতি দৃঢ় বেগে।
গান্ধীর আদর্শ মানে গাঢ় অনুরাগে।।
হেনকালে হল এক দুরন্ত ঘটনা

ইংরাজ শাসনে ঘোর কলঙ্ক নিশানা।।
পাঞ্চাব প্রদেশে লাট ছিল ওডায়ার।
বড়ই উদ্ধত ছিল প্রকৃতি তাহার।।
পরোয়ানা জারী করে দেশেরে ভিতরে।
সভা সমিতির কার্য্য সব বন্ধ করে।।
এ সময়ে সত্য-বীর গান্ধী মহাশয়।
অহিংসা নীতির তত্ত্ব ভারতে জানায়।।
সত্যকে বরণ করি সহিবারে দুঃখ।
ভারতের নর নারী সকলে উন্মুখ।

গান্ধী কহে ‘‘সত্য যদি মানিবারে চাও।
অন্যায্য আদেশ নাহি মাথা পেতে লও।।’’
তাই যবে পাঞ্জাবের লাট মহোদয়।
সভা সমিতির কার্য্য বন্ধ করে দেয়।।
সে আদেশ লঙ্ঘিবারে সবে করে মন।
দুঃখ হোক কিংবা তাতে হোক না মরণ।।
অমৃতসহর মধ্যে জালিয়ানা বাগ।
ইংরাজ শাসনে পল কলঙ্কের দাগ।

নর নারী শিশু করি অসংখ্য সংখ্যায়।
সভাক্ষেত্রে এল সবে ভাবের বন্যায়।।
যখনে সভার কার্য্য আরম্ভ হইল।
ইংরাজের সৈন্য আসি সেথা হানা দিল।।
চারিদিকে ঘেরা বাগ একটী দুয়ার।
পাতিল ‘‘মেশিন গান’’ তাহার উপর।।
আজ্ঞা পেয়ে সৈনিকরা দাগিল কামনা।
সেই দৃশ্য মনে হলে আজো কান্দে প্রাণ।।
নিরস্ত্র জনতা বব্ধ বাগের ভিতরে।
কত শত গুলি আসে মৃত্যুরূপ ধরে।।
নর নারী শিশু সেথা ত্যজিল জীবন।
রক্তযজ্ঞে সভা তবে হল সমাপন।।
বিদ্যুতের মত বার্ত্তা গেল ঘরে ঘরে।
স্তন্তিত ভারতবাসী এই অত্যাচারে।।
গান্ধী বলে ‘‘কেহ নাহি হও উত্তেজিত।
শক্তি-শূণ্য জাতি মোরা তাহাতে বিজিত।।
বাঁচিবার অধিকার বটে কিছু নাই।
মরিবার অধিকার সাথে আছে ভাই।।
ইংরাজের নীতি সঙ্গে যোগ নাহি দিব।
অসহযোগের নীতি সকলে মানিব।।
কত জন শ্বেতকায় এই দেশে রয়?
সর্ব্বস্থানে দেশবাসী সহযোগ দেয়।।

 

ইংরাজ রাজত্ব তাই চলে সুস্থভাবে।
দেশবাসী ছাড়া রাজ্য কেমনে চলিবে?
আর দেখ অস্ত্র শূন্য এ ভারতবাসী।
বিশেষতঃ অস্ত্রে আমি নাহিক বিশ্বাসী।।
তথাপি তর্কের লাগি করি আলাপন।
অস্ত্র দিয়ে নাহি হবে স্বকার্য্য সাধন।।
অস্ত্রগুণে বহুগুণে বলীয়ান তারা।
সেই পথে চেষ্টা অর্থ মিছামিছি মরা।।
সেই অস্ত্রে কভু নাহি আসিবে বিজয়।
অসহযোগের অস্ত্র পরম সহায়।।
এই কথা দৃঢ় করে বলিবারে পারি।
কথা যদি শোনে ভারতের নর নারী।।
স্বরাজ আনিতে পারি আমি একদিনে।
একথা নহেক মিথ্যা জানিও পরাণে।।
কি পথে সম্ভব তাহা বলিতেছি তাই।
অসহযোগের পথে ভিন্ন পথ নাই।।
বিদেশী যতেক কিছু করহে বর্জ্জন।
সকলের স্বদেশী দ্রব্য করগো গ্রহণ।।
ইংরাজের আদালত স্কুল পাঠশালা।
ইংরাজের দাস্যবৃত্তি সব দূরে ফেলা।।
ইংরাজের বস্ত্র ছাড় ইংরাজের নীতি।
স্বদেশী সাজিলে রক্ষা পাবে এই জাতি।।’’
গান্ধীজীর এই ভীর গেল ঘরে ঘরে।
দলে দলে ঘর ছেড়ে আসিল বাহিরে।।
এক সাথে যোগ দিল হিন্দু মুসলমান।
কি কারণে বলি শুন তাহার প্রমাণ
।।
ইসলাম ধর্মে ের গুরু উপাধি খলিফা

রাজত্ব ও ধর্ম্ম কার্য্য তাঁর দুই দফা।।
তুরস্ক রাজ্যেতে তেঁহ ছিল নরপতি।
সকল ইসলাম তাঁরে জানায় প্রণতি।।
জন্মিল কামাল পাশা তুরস্ক মাঝারে।
সূহ্ম রাজনীতি বুদ্ধি সে মহাত্ম ধরে।।
তিনি দেখে ইউরোপে যত রাজ্য আছে।
রাজনীতি হতে ধর্ম্ম দুরে রাখিয়াছে।।
মধ্য যুগে স্বৈরাচারী যেই প্রথা ছিল।
সেই প্রথা লোপ করে গণতন্ত্র এল।।
গণতন্ত্রে তারা সবে মহাসুখে রয়।
শৌর্য্যে, বীর্য্যে কোন রূপে কভু হীন নয়।।
অথচ তুরস্ক দেশে ধর্ম্ম আচ্ছাদনে।
জগতেরতালে পা ফেলেনা সমানে।।
দুর্ব্বলতা দিনে দিনে ঘিরেছে তাহারে।
কুচক্রী ইউরোপবাসী ভাবিল অন্তরে।।
ইউরোপ খন্ডে রাজা সকলি খৃষ্টান।
তুরস্ক এখানে মাত্র আছে মুসলমান।।
ক্রমে ক্রমে তুরস্কেরে করে দাও পার।
এশিয়া ভূখন্ডে রাজ্য ঠিক হোক তার।।
অনুমানে বুঝি বটে এই সব ভাব।
জ্বলন্ত প্রমাণ নিয়ে বল কিবা লাভ?
তবু শোন প্রতিবেশী গ্রীক জাতি যারা।
অকস্মাৎ তুরস্কেরে আক্রমিল তারা।

বিপন্ন জাতির তরে সে কামাল পাশা।
করিল অদ্ভুত রণ ছেড়ে সব আশা।।
দেশপ্রীতি শ্রেষ্ঠ বলে হইল প্রমাণ।
রাখিল কামালপাশা জাতির সম্মান।।
দেশরক্ষা করি বীর ভাবে মনে মন।
পাশ্চাত্য আদর্শে দেশ করিব গঠন।।
ধর্ম্ম নীতি আচ্ছাদনে খলিফা রহিল।
কামালেরে বাধা দিতে সঙ্কল্প করিল।।
কিন্তু দেখ বীরত্বের মহিমা অপার।
দেশবাসী সবে বাধ্য হইল তাঁহার।।
কামাল কহিল মোরা খলিফা না চাই।
নিজেদের বাহুবলে রাজত্ব চালাই।।
দেশবাসী সবে জুটিপ্রতিনিধি দিব।
তারা মিশি যাহা বলে সে কার্য্য করিব।।

তুরস্কের অধিবাসী যত নবীনেরা।
কামালের এই বাক্যে সায় দিল তারা।।
দেশ মধ্যে তারা হল সংখ্যাতে প্রধান।
খলিফাছাড়িল রাজ্য রাখিল সম্মান।।
তুর্কী ছাড়া অন্য দেশে যত মুসলমান।
তারা বলে ‘‘এই কার্য্যে বড় অকল্যাণ।।
ধর্ম্মের প্রধান যিনি খলিফাউপাধি।
তাঁরে সিংহাসনচ্যুত বড়ই অবিধি।।
খোদার রসুল যিনি নবী মহম্মদ।
তিনি নিজে করিলেন ‘‘খলিফার পদ’’
।।
তাঁর আজ্ঞা কেবা নাড়ে এত শক্তি কার?
এই কার্য্যে চাহি তোরা উচিত বিচার।।
ভারতের মুসলমান ছিল যত জন।
‘‘খেলাফত’’ নামে তারা করে আন্দোলন।।
তাহাদের সঙ্গে যোগ মহাত্মাজী দিল।
তাঁর কার্য্যে মুসলমান সন্তুষ্ট হইল।।
তাই যবে দিল ভীর গান্ধী মহাশয়।
দলে দলে নর নারী তাতে যোগ দেয়।।
মহম্মদ, সৌকত নামে আলী ভ্রাতৃ দ্বয়।
গান্ধীর আহবানে দোঁহে দৃঢ় সাড়া দেয়।।
জিন্না যিনি সাজিয়াছে আজ লীগপতি।
সেই আন্দোলনে ছিল এক সেনাপতি।।
পাঞ্জাব প্রদেশ বাসী লালা লাজপত।
আন্দোলনে দিল যোগ সখা সাথী সাথ।
দুই ভাই প্যাটেলেরা গুজরাট বাসী।
সেনাপতি রূপে যুদ্ধে দাঁড়াইল আসি।।
রাজগোপালাচারী মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ।
মনে প্রাণে মানিলেন সেই আন্দোলন।।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ আর সীতারামিয়া।
আবুল কামাল আজাদ আসিল ধাইয়া।।
মতিলাল নেহেরুর বুদ্ধি বিচক্ষণ।
পুত্রসহ আন্দোলন করে মহাজন।

শ্রীজহরলাল যার উপাধি পন্ডিত।
বর্ত্তমান ভারতে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রাবিৎ।

শ্রীমতিলালের তিনি একমাত্র পুত্র।
যেম্নি বাপ তেম্নি বেটা এই তার সূত্র।।
বঙ্গ দেশে উঠে ঢেউ প্রচন্ড আকারে।
ঢেউ ছোটে মহা বেগে প্রতি ঘরে ঘরে।।
শ্রীচিত্তরঞ্জন দাস ছিল ব্যারিষ্টার।
আন্দোলনে যোগ দিয়ে ছাড়িল সংসার।।
‘‘দেশবন্ধু’’ বলে আখ্যা সবে দিল তাঁরে।
সর্ব্বস্ব দেশেরে লাগি দিল দান করে।।
রাজনীতি বুদ্ধি কিংবা বাক পটুতায়।
‘‘দেশবন্ধু’’ তুল্য আর দেখা নাহি যায়।।
কি মোহিনী শক্তি যেন ছিল বাক্যে তাঁর।
জাহাত বিপুল সাড়া অন্তরে সবার।।
তাঁর প্রিয় শিষ্য বসু শ্রীসুভাষ চন্দ্র।
আন্দোলনে ছাঁপ দিয়ে পাইল আনন্দ।।
‘‘সিভিল সার্ভিস’’ পড়ি ম্যাজিষ্ট্রেট হল।
মাতৃ-পূজা দেবী তলে তাহা বিসর্জ্জিল।।
‘‘দেশপ্রিয়’’ আখ্যা পেল যতীন্ত্র মোহন।
হাইকোর্টে ব্যারিষ্টার তিনি একজন।।
ইস্কুল কলেজ ছাড়ে ছাত্র দলে দলে।
‘‘স্বাধীনতা চাহি মোরা’’ এই কথা বলে।।
কিন্তু রাজকার্য্যে যারা নিয়োজিত ছিল।
চাকুরী ছাড়িয়া প্রায় কেহ না আসিল।।
কতক উকীল বটে আসিল বাহিরে।
অধিকাংশ আদালতে যাতায়াত করে।।
কিছু কিছু মুসলমান বটে যোগ দিল।
অধিকাংশ আন্দোলনে কভু না ভিড়িল।।
অসহযোগের নীতি সকলে না মানে।
তাতে শ্লথ গতি পরে এল আন্দোলনে।।
ঊনিশ শপাঁচ অব্দে আন্দোলন হয়।
নমঃশূদ্রগণ তাতে যোগ নাহি দেয়।।

অশিক্ষা-আন্ধারে জাতি কিছু নাহি জানে।
কিবা সে করিতে পারে গিয়ে আন্দোলনে।।
শ্রীগুরু চাঁদের আজ্ঞা মানে তাঁর জাতি।
আন্দোলনে যোগ দিতে নহে কার মতি।।
এই আন্দোলন কালে তাই পুনরায়।
স্বদেশী নেতারা জুটি গুরুচাঁদে কয়।।
জাতি সহ আন্দোলনে যোগ দিতে কহে।
প্রভু কহে ‘‘মাপ চাই আজ তাহা নহে।।’’
কিকারণে প্রবু কহে এহেন বচন?
সেই ইতিহাস এবে করিব বর্ণন।।
কাঙ্গাল অবোধ জনে দেখাইতে পথ।
নাশিতে অসুর শক্তি রক্ষিবারে সৎ।

নরাকারে এল যিনি এই ধরা পরে।
হরি হরি বল তাই তাঁর চিন্তা করে।।

 

অসহযোগ আন্দোলন ও অনুন্নত সমাজ


শুভক্ষণে বারশত অষ্টাদশ সালে।
অবতীর্ণ হরিচাঁদ নমঃশূদ্র কুলে।।
দলিত পীড়িত যারা ব্যথিত অন্তরে।
সামাজিক অত্যাচারে ধর্ম্মত্যাগ করে।।
মোহে অন্ধ ব্রাহ্মণাদি উচ্চ হিন্দু যত।
নিজ অস্ত্রে নিজ দেহ করে নিজে ক্ষত।।
উভয়েরে রক্ষা করি বাঁচাতে হিন্দুরে।
আসিলেন দয়াল হরি নমঃশূদ্র ঘরে।।
তাঁর সেই ব্রত ধরি তাঁর পুত্র যিনি।
‘‘গুরচাঁদ’’ নামে খ্যাত হইল অবনী।।
অনুন্নত হিন্দু যত আছে বঙ্গ দেশে।
ধর্ম্ম সূত্রে সবে মিলে তাঁর কাছে আসে।।
অনুন্নত সমাজে সূহ্ম পরিচয়।
গুরুচাঁদ বিনা অন্যে নাহি জানে হায়।

অনুন্নত সমাজের যত কিছু আশা।
তাহাদের মনে জাগে যত কিছু ভাষা।।
তাঁর মর্ম্ম গুরুচাঁদ জানে ভাল মতে।
এখানে পার্থক্য তাঁর বর্ণ হিন্দু হতে।।
বর্ণহিন্দু নাহি জানে সব সমাচার।
সেই জন্যে মাঝে মাঝে ভুল হয় তার।।
‘‘দেশসেবা’’ ‘‘দেশমাতা’’ তাহা যাহা বুঝে।
সেই অর্থ নাহি বুঝে দলিত সমাজে।।
বিশেষতঃ অবিশ্বাস উচ্চবর্ণ প্রতি।
দলিত সমাজ বুকে আজে আছে সাথী।।
তাই যবে কোন কাজে তারা ডাক দেয়।
পীড়িত জাতির প্রাণে সন্দেহ ঘনায়।।
তাই তারা এতকাল উচ্চবর্ণ সাথে।
ভয় পায় কোন কাজে যোগদান দিতে।।
তাই তারা নিজেদের মনোমত তালে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে সবে এক সাথে চলে।।
অবশ্য এসব ভাব বিংশ বর্ষ আগে।
অনুন্নত সমাজের বুকে ছিল জেগে।।
সেই দেশ সেই কাল আজি বটে নাই।
অনেক প্রভেদ আজি দেখিতেছি তাই।।
অদ্য হতে শতবর্ষ গত হলে পরে।
যদি কেহ এই গ্রন্থ বসে পাঠ করে।।
হতে পারে এই প্রশ্ন হৃদয়ে উদয়।
এই নীতি কথা কিসে বলে মহাশয়?
দেশ মাতৃকার সেবা শ্রেষ্ঠ নাহি মানে।
তাঁরে মান্য করে লোকে বল কোন গুণে?
অথবা বিভিন্ন এক ভাবের উদয়।
হতে পারে পাঠকের উন্নত হৃদয়।

অনুন্নত জাতি যারা দিত পরিচয়।
গন্ডীবদ্ধ বুদ্ধি লয়ে রহিত সদায়।।
শতবর্ষ পরে মোর এই মনে হয়।
‘‘স্বাধীন ভারতবর্ষ’’ হইবে নিশ্চয়।।

 

স্বাধীন দেশের লোকে স্বাধীন পরাণে।
স্বাধীনের মত কথা কবে সর্ব্বক্ষণে।।
অধীনতা পাষাণের কেমন পেষণ?
স্বাধীন দেশেরে লোকে বুঝেনা কখন।।
বৃদ্ধ ভাবে শিশু শুধু করে বসে খেলা।
অর্থহীন ভাবে হয় তার পথে চলা।।
কিন্তু হায় ভুলে যায় সেই বুদ্ধিমান।
বৃদ্ধের আদিম ছবি শিশুর পরাণ।।
শিশু জন্ম নিল বলে বৃদ্ধ এল পরে।
শুশু বৃদ্ধ, মূল্য এক ভেদ শুধু স্তুরে।।
তাই বলি অনাগত হে পাঠক মোর।
শুধু নিন্দাবাদে যেন করিওনা সোর।।
তোমাদের কালে যাহা সহজে সম্ভব।
আমাদের কালে ছিল অতি অসম্ভব।।
তার জন্যে দায়ী মোরা নহিত কখন।
কালগতি দায়ী বটে আছে সর্ব্বক্ষণ।।
তাই বলি এ অধ্যায়ে গুরুচাঁদ নীতি।
না জাগাতে পারে বটে তব প্রাণে প্রীতি।।
কিন্তু তাহা সত্য ছিল আমাদের কালে।
আমাদের রক্ষা হল সেই নীতি বলে।।
তাই বলি অবহেলা করিও না তাঁরে।
সত্য নীতি পাবে তুমি মানিলে বিচারে।।
থাক খাক সে কথার এইখানে শেষ।
যা হবার হবে পরে তাতে নাহি ক্লেশ।।
এবে সবে বলি শুন এই বিবরণ।
কি কারণে গুরুচাঁদ করিল বারণ।।
আন্দোলনে যোগ দিতে নিষেধ করিল।
আজ্ঞা মানি অনুন্নত নির্লিপ্ত রহিল।।
‘‘দেশবন্ধু’’ আখ্যাধারী সে চিত্তরঞ্জন।
শ্রীবীরেন্দ্র শাসমল আর একজন।।
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে করে আলোচনা।
‘‘অনুন্নত জাতি ডাকে সাড়াই দিল না।।
ইহার কারণ মোরা বুঝিতে না পারি।
তাহাদিগে দলে নিতে কি উপায় করি?’’
মহাত্মা গান্ধীজী বলে তাঁহাদের ঠাঁই।
‘‘তাঁহাদের মধ্যে নেতা কেহ কিগো নাই?
নেতা যদি থাকে সবে তাঁরে গিয়ে ধর।
তাঁরে দলে আনশীঘ্র যেইভাবে পার।।’’
দেশবন্ধু বলে ‘‘আছে এক মহাজন।
ওড়াকান্দীবাসী নাম শ্রীগুরুচরণ।।
ঠাকুর উপাধীধারী জানি নমঃশূদ্র।
কুলে শীলে ধনেমানে তিনি অতি ভদ্র।।
তাঁহার পিতার নাম শ্রীহরি ঠাকুর।
‘‘ধর্ম্মগুরু’’ বলি ছিল প্রতিষ্ঠা প্রচুর।।
বহুলোক তাঁর বাধ্য আছে বলে জানি।
তাঁরে যদি দলে পাই ভয় নাহি গনি’’
।।
মহাত্মা বলেন ‘‘শুন দেশবন্ধু দাস।
সেই ব্যক্তি শক্তিধারী আমার বিশ্বাস।।
তাঁহার নিকটে আগে পত্র লিখি দাও।
কোনজন্য আন্দোলন সকলি জানাও।।
কি উত্তর করে তিনি আমারে জানাও।
কিংবা শীঘ্র করে তুমি ওড়াকান্দী যাও।।’’
সেই আজ্ঞামতে তবে সে চিত্তরঞ্জন।
গুরুচাঁদ ঠাঁই পত্র করিল লিখন।।
বহু কথা তার মধ্যে লিখিলেন তিনি।
অল্প কিছু বলি যাহা লোক মুখে শুনি।।
পত্রে লেখে ‘‘নিবেদন করি মহাশয়।
আপনার সাথে পূর্ব্বে নাহি পরিচয়।।
আপনার গুণকীর্ত্তি বহু শুনিয়াছি।
আপনার গুণসঙ্গে পরিচিত আছি।।
এবে বলি এই পত্র লিখি কি কারণে?
আলোচনা করিয়াছি গান্ধীজীর সনে।।
কি উদ্দেশ্যে আন্দোলন করিতেছি মোরা।
আপনাকে লিখিতেছি সেই সব ধারা।।

পরাধীন এ ভারতে সবে সহি দুঃখ।
স্বাধীনতা কিনা কভু নাহি হবে সুখ।।
স্বাধীন যতেক জাতি আছে ভুমন্ডলে।
বিদ্যা, বুদ্ধি, ধনে, জনে, উন্নত সকলে।।
স্বাধীন হইলে দেশ দুঃখ নাহি রবে।
স্বাধীন ভারতে সবে মহাসুখী হবে।।
অসহযোগের পথে আসিবে সুদিন।
দুরে নহে নিকটেতে সেই শুভদিন।।
অনুন্নত জাতি মধ্যে আপনি প্রবীণ।
শ্রেষ্ঠ নেতা বলি মান্য আছে চিরদিন।।
স্বাধীনতা যজ্ঞে তাই করি আমন্ত্রণ।
জাতি নিয়ে এই পথে আসুন এখন।।’’
পত্র যবে ওড়াকান্দী হইল উদয়।
প্রভু বলে ‘‘পত্র পড়ি শানাও আমায়।।’’
পত্র শুনি কিছুকাল স্তব্ধ হয়ে রয়।
কিছুক্ষণ পরে তবে বলে দয়াময়।।
‘‘কাগজ কলম কালী আনহ সত্বর।
এই পত্রে দিব আমি যোগ্য প্রত্যুত্তর।।’’
কাগজ কলম কালী আনিল যখনে।
প্রভু বলে ‘‘যাহা বলি সব রাখ মনে।।
বলা শেষ হলে পরে লিখিব সকল।
দেরীতে জবাব দিলে কিবা হবে ফল”?
এতবলি দয়াময় বলিতে লাগিল।
উপস্থিত সবে তাহা নীরবে শুনিল।।
প্রভু কয় ‘‘মহাশয়’’ করি নিবেদন।
পত্রযোগে পাইয়াছি তব আমন্ত্রণ।।
আমন্ত্রণ পেলে বটে মান্য দিতে হয়।
কিন্তু বর্ত্তমান ক্ষেত্রে আমি অতি নিরুপায়।।
বহু জীবনের ভার যারে দেছে বিধি।
অকস্মাৎ কার্য্য তার বড়ই অবিধি।

বহুমতে বহুভাবে দেখিনু ভাবিয়া।
নিমন্ত্রণে যেতে নাহি বলে মোর হিয়া।।

অবস্থা সকল আমি বলিব খুলিয়া।
দোষগুণ বলিবেন বিচার করিয়া।।
অনুন্নত বলি যত কাটে বেহালের বেশে।
কোনভাবে দিন কাটে বেহালের বেশে।।
বিলাসিতা বলি তারা কিছু নাহি জানে।
কোন ক্রমে কায় ক্লেশে বাঁচিছে পরাণে।।
বিদ্যাশিক্ষা বেশী কিছু তারা শিখে নাই।
রাজকার্য্যে অধিকার তাতে নাহি পাই।।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা কভু নাহি ছুটে।
স্বাধীনতা কি পদার্থ বোঝে নাক মোটে।।
রাজনীতি সঙ্গে যার যোগাযোগ নাই।
অসহযোগের প্রশ্ন তার কিবা ভাই?
সত্যকথা দেশবন্ধু! করি নিবেদন।
এই পথে স্বাধীনতা আসেনা কখন।।
সমাজের অঙ্গে আছে যত দুর্ব্বলতা।
আগে তাহা দূর করা আবশ্যক কথা।।
এই যে দলিত জাতি যত বঙ্গদেশে।
ইহাদের দুঃখ কেহ দেখে নাকি এসে?
কিবা খায়? কোথা পায়? কোন কার্য্য করে?
সন্ধান রাখেনা কেহ কোনদিন তরে।।
দিনে দিনে এরা সবে হয়েছে হতাশ।
উচ্চবর্ণ হিন্দুগণে করেনা বিশ্বাস।।
আর এক মহাদুঃখ ইহাদের মনে।
উচ্চ হিন্দু ইহাদিগে ‘‘অস্পৃশ্য’’ বাখানে।।
কি কব দুঃখের কথা তোমার গোচরে।
দেবতার ভাগ হিন্দু করেছে মন্দিরে।।
অস্পৃশ্য বলিয়া যারা পাইয়াছে আখ্যা।
মন্দিরে ঢুকিলে তার নাহি থাকে রক্ষা।।
পশু হতে এই মত হীন ব্যবহার।
অস্পৃশ্য জাতিরা সহে দেশের ভিতর।।
মাতৃপূজা যজ্ঞ যদি করে আয়োজন।
একেলার পক্ষে তাহা সম্ভব কখন?

মাতৃপূজা দেবীতলে সকলে মিশিবে।
যারে দিলে দূর করে সে কিসে আসিবে?
রাজা করে রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজন।
কাঙ্গালের স্থান সেথা মিলেনা কখন।।
রাজা থাকে সিংহাসনে দীন থাকে দূরে।
কোলাকুলি মেশামিশি হবে কি প্রকারে?
অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদ্যা কিংবা মানে।
উচ্চ হিন্দু জুড়ে বসে আছে সবখানে।।
সাহিত্যে, বিজ্ঞানে কিংবা শিল্প সাধনায়।
বাংলায় উন্নত হিন্দু শীর্ষস্থানে রয়।।
এই সব গুণে হীন অনুন্নত জাতি।
তাহারা কেমনে হবে তোমাদের সাথী?
আর কথা স্পষ্ট করে লিখি মহাশয়।
অসহযোগের পথে কতজনে ধায়?
একভাই কর্ম্মচারী অপরে উকিল।
ব্যবসায়ী অন্য জনে মূলে রাখে মিল।।
উকিল ছেড়েছে কর্ম্ম স্বদেশী সাজিয়া।
কর্ম্মচারী ভাই আছে আসনে বসিয়া।।
ব্যবসায়ীভাই রহে দোকান পাতিয়া।
বহুলাভ করে তিনি খদ্দর বেচিয়া।।
মোট কথা অন্ন চিন্তা করা নাহি লাগে।
উকিল স্বদেশী সেজে ধন্য হয় ত্যাগে।।
তোমাদের পক্ষে নাই সে সব বালাই।
কোন ক্রমে কায়ক্লেশে সংসার চালাই।।
স্বদেশী সাজিয়া যদি করি আন্দোলন।
অন্ন-বস্ত্র তাতে ঘরে আসেনা কখন।।
ইংরাজের সাথে যোগ আমাদের কই?
হাল গরু নিয়ে মোরা পাড়াগায়ে রই।।
চাকুরী করি না মোরা কাছারী না যাই।
অসহযোগের প্রশ্ন আমাদের নাই।।
উচ্চ হিন্দু কর্মচারী যত সঙ্গে আছে।
এই মত কথা কন তাহাদের কাছে।।
আমাদের কাছে ইহা বলা হবে বৃথা।
অবশেষে বলি আমি গুটি কত কথা
।।
এক পথে সকলেরে নিতে যদি মন।
আমার এ বাক্যগুলি করুণ গ্রহণ।।
দলিত পীড়িত যত পিছে পড়ে আছে।
শুদ্ধ বুদ্ধি নিয়ে যান তাহাদের কাছে।।
প্রকৃত দরদ যদি জেগে থাকে মনে।
কুলেতে উঠান সবে হাতে ধরে টেনে।।
অস্পৃশ্যতা মহাপাপকরুন রটনা।
প্রকৃত দরদ দিয়ে জাগান চেতনা।।
শিক্ষা, দীক্ষা অর্থ কিংবা সম্মানাদি দানে।
অনুন্নত জনে দিন সরল পরাণে।

সকলে সরল এরা কুটিলতা নাই।
খাঁটি প্রাণে ইহাদিগে ভাই বলা চাই।।
ভাবিয়া দেখুন মনে দুই কোটি লোক।
চিরকাল বহিতেছে অবহেলা-শোক।।
বেদনার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিবারাতি।
এরা কিসে হতে পারে উচ্চবর্ণ সাথী?
সাজিয়া দরদী বন্ধু হইবে ডাকিতে।
চেতনা জাগিলে এরা পারে সাড়া দিতে।।
মহাত্মা গান্ধীকে তাই জানাই বারতা।
ভাবিয়া দেখেন যেন তিনি মোর কথা।।
আন্দোলনে যত শক্তি হইতেছে ব্যয়।
দলিত জাতির কাজে দেয়া ভাল হয়।।
ভারত পল্লীর দেশ পল্লীতে পরাণ।
শহর ছাড়িয়া সবে পল্লীগ্রামে যান।।
পল্লী যদি জাগে তবে জাগিবে ভারত।
অবশ্য সুগম হবে স্বাধীনতা পথ।।
আমি তাই আমন্ত্রণ করি আপনারে।
আসুন শহর ছেড়ে পল্লীর মাঝারে।
’’
এই ভাবে পত্র লিখি পাঠাইয়া দিল।
যথাকালে দেশবন্ধু সেই পত্র পেল।।

পুনরায় মহাত্মার নিকটেতে যায়।
আমূল সকল কথা তাঁহারে জানায়।।
মহাত্মা বলে ‘‘সত্য এই সব কথা।
ইহা ভিন্ন আন্দোলন সব হবে বৃথা।।
প্রকৃত তত্ত্বের বাণী শুনিলাম আজ।
এরপরে এই ভাবে কর সবে কাজ।।
আর এক কথা আমি বলি মহাশয়।
ওড়াকান্দী একবার চলুন ত্বরায়।।’’
দেশে ফিরে দেশবন্ধু ভাবিলেন মনে।
ওড়াকান্দী যাইবে সাঙ্গোপাঙ্গ সনে।।
বিধির বিধানে তাহা পূর্ণ নাহি হয়।
রাজদ্রোহ অপরাধে কারাগারে যায়।।
আন্দোলন ধারা ক্রমে ভিন্ন পথে গেল।
আইন সভায় সভ্য দেশবন্ধু হল।।
নীতিক্ষেত্রে মহাত্মার সঙ্গে মতান্তর।
করিলেন দেশবন্ধু অতি ঘোরতর।।
ক্রমে ক্রমে মহাত্মাজী বুঝিয়া অন্তরে।
অনুন্নত জাগাইতে বহু কার্য্য করে।।
সেই নীতি আজ তাঁর কার্য্যের প্রধান।
এই কার্য্যে তিনি বটে বহু শান্তি পান।।
ওড়াকান্দী দেখিবারে তাঁর ইচ্ছা ছিল।
কার্য্যান্তরে সেই ইচ্ছা পূর্ণ নাহি হল।।
কাঙ্গালের বন্ধু মোর প্রভু গুরুচাঁদ।
তাঁরে পেয়ে কাঙ্গালের কতই আহলাদ।।
দিনে দিনে দীন জনে পাইল উদ্ধার।
মহানন্দ দেখে শুধু চোখে অন্ধকার
।।

 

ডক্টর মীডের ওড়াকান্দী হইতে চির বিদায় গ্রহণ

তেরশআঠাশ সালে মার্গশীর্ষ গত হলে
শীত ঋতু ধীরে ধীরে করে আগমন।
সাধক, সন্ন্যাসী, ধীর মহামতি মীড বীর,
বঙ্গ হতে করিলেন বিদায় গ্রহণ।।
হেথা কার্য্য শেষ হয় ফিরে নিজ দেশে যায়,
ওড়াকান্দী পরে স্মৃতি রহিল বাঁচিয়া।
তাঁহার জীবন কথা সংক্ষেপে বলিব হেথা
শুনিবেন ভক্তগণে আগ্রহ করিয়া।।
আঠার শছিষট্টি সালে মধুর শরৎ কালে
এডিলেড শহরেতে জন্ম হল তাঁর।
পিতা তার পুরোহিত মহামতি শুদ্ধ চিত
মধুর মূরতি তার শুদ্ধ ব্যবহার।।
একাদশ বর্ষকালে পিতা তারে দীক্ষা দিলে
সেই হতে প্রাণে তাঁর এল নবনল।
শিক্ষাতে অগ্রহণী ছিল রাজবৃত্তি লাভ হল
অস্ত্র ও ভৈষজ্য বিদ্যায় ফলে সেই ফল।।
দীনের লাগিয়া প্রাণে ব্যথা তাঁর সর্ব্বক্ষণে
জাগাতে পতিত জনে করিল মনন

মাতৃ-আজ্ঞা অনুসারে আসিল ভারত পরে
পতিত-তারণ বৃত্তি করিল গ্রহণ।।
কিভাবে আসিয়া বঙ্গে মিশে গুরুচাঁদ সঙ্গে
পূর্ব্ব ভাগে সেই সব করেছি বর্ণন।
এবে বলি কোন ভাবে মীড চলিলেন তবে
করিল জীবন তরে বিদায় গ্রহণ।।
কিছুকাল পূর্ব্ব হতে পত্নী তরে নানামতে
বলে ‘‘পতি নিজ দেশে চলহে এখন।
তাঁর তাড়নাতে তাই মীড ভাবে ‘‘দেশে যাই’’
সেই ভাবে পরে করে বিদায় গ্রহণ।।
পত্নী সহ গেল চলি সবে মিষ্ট কথা বলি
সকলের প্রাণে বাজে বিদায়ের সুর।
বিদায় সভায় কর ‘‘কহিলাম সুনিশ্চয়
ওড়াকান্দী স্মৃতি প্রাণে রবে ভরপুর।।’’
মীড নিজদেশে গিয়ে মনে বহুসুখী হয়ে,
ওড়াকান্দী ভালবাসে তার স্মৃতি প্রাণে ভাবে
ওড়াকান্দী দেখে যেন শয়নে স্বপনে।।

প্রভুজীর কাছে এসে বিদায় মাগিতে শেষে
বাক্য রুদ্ধ হল তাঁর নয়নেতে বারি।
অঞ্চল সিন্ধু নড়ে প্রভুর নয়ন ঝরে
দুই প্রভু করে করে রহিলেন ধরি।।
যাত্রার কিঞ্চিৎ আগে মীড গাঢ় অনুরাগে
মরমের কৃতজ্ঞতা জানাল প্রভুরে।
পত্র লিখি নিজ হাতে সব কথা লিখি তাতে
প্রভু হস্তে দিয়া গেল আপনার করে।।
অনুবাদ করি তাই এইখানে দিতে চাই
ইংরাজী ভাষায় মীড লিখিলেন যাহা।
মীডের ধারণা কিবা কোন ভাবে ঋণী কেবা
বর্ণনা করিব সুখে এবে আমি তাহা।।

 

ডক্টর মীডের পত্র

From Dr. Mead, orakandi, East Bangal.

Begin about to leave India for good I am glad to leave on record my gratitude to Babu Guru Charan Thakur of Orakandi for all that he has done for me. I came to live at Orakandi as begin the most influential centre of Namasudra life in this district. Guru Charan ability and of wide-spread influence. In the various actibities of my missionary life he has made possible manythings that without his backing cloud not have been carried through. With a liberality of thought, a courage and a foresightedness uncommon among men of the older orthodox school he has sought the uplift of the great Namasudra caste. They owe a great deal to him. so do I.

 

Orakandi                 C.S. Mead

Faridpur                  Dec. 1921.

 

‘‘বিদায়ের পূর্ব্ব ভাগে লিখি গাড় অনুরাগে
চিরতরে এই দেশে যেতেছি ছাড়িয়া।
প্রীতি আর কৃতজ্ঞতা এক সাথে দুই কথা
গুরুচাঁদ প্রতি আমি রাখিনু লিখিয়া।।
নমঃশূদ্র শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ওড়াকান্দী গ্রাম ধন্য
হেথা এতদিন আমি করিলাম বাস।
ধনে ধর্ম্মে মহাবলী অসীম প্রতাপশালী
একমাত্র গুরুচাঁদ আমার বিশ্বাস।।
মিশনারী পুরোহিতে বহু স্থানে বহুপথে
সাহায্য করেছে নিজে শ্রীগুরুচরণ।
বহু বিঘ্ন বিপদেতে গুরুচাঁদ নিজ হাতে
মিশনারী গণে সদা করেছে রক্ষণ।।
তাঁহার সাহায্য ভিন্ন কিছু নাহি হত পূর্ণ
হেন উপকারী বন্ধু সেই মহাশয়।
অমিত তেজস্বী নর দুর-দৃষ্টি খরতর
প্রাচীনপন্থীর মধ্যে দেখা নাহি যায়।।
নমঃশূদ্র উদ্ধারিতে চেষ্টা তাঁর সর্ব্ব পথে
ইদার মহৎ প্রাণ পবিত্র মানব।
আমি ঋণী অবিরত ক্ষুদ্র কি মহৎ যত
তাঁর কাছে মহাঋণী নমঃশূদ্র সব।।’’
বিদেশী চিনিল তাঁরে তাই তাঁরে মান্য করে
তাঁর কাছে ঋণী বলি করিল স্বীকার।
অল্প-বুদ্ধি ভবে যারা কিছুই চেনে না তারা
দুষ্টু বুদ্ধি মহানন্দ একজন তার।।

 

 

 

 

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের পাতলা গ্রামে গমন


পাতলা নিবাসী সাধু নামে ধনঞ্জয়।
ঠাকুরের পদে তার নিষ্ঠা অতিশয়।।
এবে শুন কি ভাবেতে মতুয়াহইল।
বিপদ বান্ধব হয়ে সাহায্য করিল।।
বহু ধনবান বটে সেই মহাশয়।
দেশমধ্যে মান্য তাতে আছে অতিশয়।।
দৈবেতে কঠিন ব্যাধি দেহে হল তার।
রস পৈত্তিকের ক্ষত অতি কদাকার।।
বৈদ্য ডাকে ওঝা ডাকে ডাকিল ডাক্তার।
কোন পথে কোন মতে মিলে না উদ্দার।।
বড়ই দুঃখিত হয়ে থাকে নিরানন্দে।
সকলের অগোচরে একা বসে কান্দে।।
কি যে সে অমৃত ভবে হরিচাঁদ আন।
ভব-ব্যাধি যায় দুরে সে অমৃত পানে।

একবার সে অমৃত যেবা করে পান।
আধি ব্যাধি সব তার হয় অবসান।।
অমৃত বহিয়া ফেরে মতুয়ারা সব।
ঘরে ঘরে করে ‘‘ফেরী’’ করে ‘‘হরি’’ রব।।
যাদব বিশ্বাস যিনি তালতলা ঘর।
তিনি বটে করিতেন শ্রীনাম প্রচার।।
পাতলা গ্রামেতে গেল সেই মহাশয়।
ভক্ত গৃহে প্রেমানন্দে নাম গান গায়।।
উঠিছে নামের ধ্বনি ভেদিয়া গগন।
মনে হয় কাঁপিতেছে আকাশ, পবন।।
যত দূরে যায় ধ্বনি সকলেরে টানে।
টানে টানে আনে টানে নাম যেইখানে।।
মতুয়ারা অবিরাম করিতেছে নাম।
লম্ফ ঝম্ফ করে সবে নাহিক বিশ্রাম।।
নামের মোহিনী শক্তি ধনঞ্জয়ে টানে।
ধীরে ধীরে উপনীত হইল সেখানে।।
বংশদন্ড যষ্টি করি চলে মহাশয়।
শক্তি নাই যেন সদা ঢলে পড়ে যায়।।
এই ভাবে উপনীত মতুয়া-আসরে।
বহু কষ্টে বসিলেন একা কিছু দুরে।।
নামের তরঙ্গ থামে কিছুক্ষণ পরে।
ভুমে পড়ি মতুয়ারা কাঁদাকাঁদি করে।।
সে যে কি বিরহ ব্যথা নাহি যায় বলা।
অকারণে মনপ্রাণ করে যে উতলা।।
কি যেন কি ছিল আগে এখানে তা নাই।
কোথা যাব? কি করিব? কিসে তাঁরে পাই?
ধন জন মান মনে হয় বৃথা।
শুধু ভাল লাগে তাঁরে না-পাওয়ার ব্যথা।।
ছোয়াচে রোগের মত সদা চরে ধেয়ে।
যারে ছোঁয়া তারে থোয় পাগলা সাজায়ে।।
এসব দেখিয়া মনে ভাবে ধনঞ্জয়।
কোন গুণে মানুষের এইভাব হয়?
শুধু শুধু কেন কান্দে এই সব লোক?
কি দুঃখে কান্দিছে সবে পেয়ে কোন শোক?
শোকের কান্নার মধ্যে আছে রকমারী।
এ কান্না যে কোন কান্না বুঝিতে না পারি।।
এত কথা মনে ভাবি সেই মহাশয়।
উপস্থিত একজনে ডাক দিয়া কয়।।
‘‘বল দেখি মহাশয় এ কোন কারণ?
যার জন্যে এরা সবে কান্দিল এখন?
কেন কান্দে? কে কান্দায়? কেন্দে কিবা হয়?
সেই সব কথা কিছু শোনাও আমায়।।’’
এই কথা ধনঞ্জয় বলিল যখন।
ধীরে ধীরে বলে তাঁরে সে ব্যক্তি তখন।।
‘‘যে কথা জিজ্ঞাসা তুমি করিলে আমারে।
সকল বলিব আমি তোমার গোচরে।।
পতিতের দুঃখ দেখি পতিতের কুলে।
আসিল মানুষ এক হরি! হরি! বলে।।

 

নমঃকুলে জন্ম নিল সফলানগরে।
ওড়াকান্দী গিয়া পরে পূর্ণ লীলা করে।

নাম ছিল হরিচাঁদ বেহালের বেশ।
দয়া করে পতিতের দুঃখ কৈল শেষ।।
কি যে সে আনিয়াছিল কিছু বুঝি নাই।
তাঁর নামে কান্না আসে বুঝি মাত্র তাই।।
একবার তাঁর কথা করিলে স্মরণ।
অকারণে ঝরে ভাই বিশুদ্ধ নয়ন।।
নরদেহে সেইজন আজি বটে নাই।
তাঁর সব গুণ মোরা তাঁর পুত্রে পাই।।
শ্রীগুরুচরণ নাম অপরূপ কান্তি।
‘‘গুরুচাঁদ’’ বলে ডাকে ভক্তে পায় শান্তি।।
পিতাপুত্রে একসূত্রে বন্ধেছে জগত।
নাম নিলে নামগুণে পাপী হয় সৎ।

এই যত লোক তুমি দেখেছ হেথায়।
শ্রীগুরুচাঁদের প্রেমে সকলে কান্দায়।।
সে কান্দায় তাই কান্দে কান্না হল সার।
কেন্দে যে কি হবে নাহি জানি সমাচার।।
তবে যাহা দেখি চোখ তাই মাত্র বলি।
কান্দিলে কান্নার মত মুছে যায় কালী।।
আর যাহা হয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
এইখানে দেখ তুমি আছে বিদ্যমান।।
অই যে সভার মধ্যে একটি মানুষ।
কীর্ত্তন করিয়া যাঁর নাহি ছিল হুষ।।
যাদব বিশ্বাস নাম বাড়ী তালতলা।
উনি বটে একজন খাঁটি ‘‘হরিবোলা’’
।।
এতদিন কেন্দে কেন্দে অই মহাশয়।
যা কিছু পেয়েছে বলি কিছু পরিচয়।।
মুখের কথায় ব্যাধি সারিবারে পারে।
বহু দুষ্ট সৎ হল ওঁর পদ ধরে।

যেইখানে মহাশয় করেন গমন।
তাঁরে দেখে কেন্দে সারা নর নারীগণ।।
এই মত শত শত আছে এই দলে।
কথায় কি কাজ দিবে মন না কহিলে।।
এক কথা বলি আমি শুন মহাশয়।
এই ভাব বাজারের সাথে তুল্য হয়।।
দূরে থেকে শোনা যায় শুধু গন্ডগোল।
মনে হয় জুটে গেছে রাজ্যের পাগল।।
কিন্তু যদি বাজারের মধ্যে কেহ যায়।
কোন দৃশ্য সেইখানে দেখিবার পায়?
সকলে কাজের কথা বলে নানাভাবে।
প্রয়োজন মত কথা বলিতেছে সবে।।
তাই বলি যদি চাও বুঝিতে এ ভাব।
লও নাম দাও ছেড়ে পূর্ব্বে স্বভাব।।
একমনে ধর দিয়ে যাদবের পায়।
যাদব বলিলে রোগ সারিবে নিশ্চয়।।
দেহের সামান্য রোগ আমি বলি নাই।
ভবরোগ যাবে সেরে বলিয়াছি তাই।।’’
এই কথা সেই ব্যক্তি যখনে বলিল।
লাঠি ফেলে ধনঞ্জয় তখনে চলিল।।
সাব্যস্ত হইল মন মোহ গেল কেটে

পড়িলেন যাদবের চরণেতে লুটে।।
যাদব ডাকিয়া বলে ‘‘এই কোন জন?
আমার চরণে তুমি পড় কি কারণ?
ধনঞ্জয় কেন্দে বলে ‘‘তুমি মোর পিতা।
তোমার চরণে আমি রাখিলাম মাথা।।
দয়া করে রক্ষা কর ব্যাধি কর দূর।
ব্যাধির যন্ত্রণা আমি সহেছি প্রচুর
।।
সাথে সাথে দুর কর ভবরোগ মোর।
বিষয়-বাসনা বিষে রয়েছি বিভোর।।’’
কান্দিয়া কান্দিয়া কথা কহে ধনঞ্জয়।
কান্না দেখি যাদবের প্রাণে দয়া হয়।।
বলে ‘‘ভয় নাই! তুমি ওঠ ধনঞ্জয়।
রোগে বিধি বলিতেছি শোন মহাশয়।।

 

গোরোচনা মাটী দিয়ে মাখনিজ গায়।
দূর না করিও তাহা যাবাৎ শুকায়।

শুকাইয়া গেলে তাহা ধুয়ে ফেল জলে।
তিল তেল মাখপরে অতি কুতুহলে।।’’
ধনঞ্জয় কেন্দে বলে ‘‘ওহে দয়াময়।
দয়া করি চল তবে আমার আলয়।।’’
যাদব বলিল ‘‘তাহা অদ্য নাহি হবে।।
ব্যাধি মুক্ত হলে তবে পরে যাওয়া যাবে।।’’
এই ভাবে ধনঞ্জয় মতুয়া হইল।
এবে শুন কোন ভাবে ঠাকুরকে নিল।।
যাদবের বিধিমতে রোগ কম হল।
কিন্তু একেবারে রোগ ছেড়ে নাহি গেল।।
একদিন তালতলা গেল ধনঞ্জয়।
প্রণাম করিয়া বেল যাদবের পায়।।
দয়া করি ওড়াকান্দী মোর সাথে চল।
আমার ব্যাধির কথা ঠাকুরকে বল।।’’
তাহা শুনি সে যাদব তার সঙ্গে গেল।
অল্পক্ষণে ওড়াকান্দী উপস্থিত হল।।
ঠাকুরের কাছে তার দিল পরিচয়।
দয়া করি প্রভু তারে ডাক দিয়া কয়।।
‘‘এতকাল কোন লোভে বল ধনঞ্জয়।
মহা দুঃখ পেলে থেকে সংসার করায়।।’’
কেন্দে বলে ধনঞ্জয় ‘‘দয়াল আমার।
সকলি হতেছে ভবে দয়ায় তোমার।।
তব দয়া বিনে প্রভু কিছু সাধ্য নাই।
দয়া বলে ওড়াকান্দী আসিয়াছি তাই।।
বিপদ বান্ধব হল ব্যাধি রূপে আসি।
বিপদের পথ ধরে চরণেতে মিশি।।
আর কিবা কব প্রভু এই মাত্র সাধ।
জনমে জনমে যেন পাই রাঙ্গা পদ।।
এই ভাবে ধনঞ্জয় কহিতেছে কথা।
দূর করে দিল প্রভু তার মনোব্যথা।।
যাদব বিশ্বাস কহে করিয়া মিনতি।
‘‘প্রবু দয়া কর আজি ধনঞ্জয় প্রতি।।
দারুণ ব্যাধির জ্বালা বহিতেছে দেহে।
ব্যথা পায় তবু তেঁহ কথা নাহি কহে।।’’
প্রভু কয় ‘‘ধনঞ্জয় রোগের কারণে।
বল দেখি গিয়াছিলে কোন কোনখানে?’’
ধনঞ্জয় বলে ‘‘প্রভু বাকী রখি নাই।
ওঝা বৈদ্য কবিরাজ দেখেছে সবাই।।
বঙ্গদেশে শ্রেষ্ঠ স্থান কলিকাতা জানি।
তথায় দেখেছে কত শাস্ত্রী শিরোমণি।।
দ্বারিক সেনের কাছে ব্যবস্থা নিয়েছি।
প্রধান ডাক্তার সবে রোগ দেখায়েছি
।।
কোন ফল হয় নাই শুধু অর্থ গেল।
মনোদুঃখে আছি প্রভু উপায় কি বল?’’
প্রভু কয় ‘‘যাদবের ব্যবস্থা মানিও।
সঙ্গে যাহা বলি আমি তাহাও করিও।।
নারী স্পর্শ নাহি আর করিও কখন।
শূণ্য গায়ে মৃত্তিকায় করিবে শয়ন।।
দেড় বর্ষ এই ভাবে ময়ন করিবে।
নির্দ্দোষ হইয়া ব্যাধি তাহাতে সারিবে।।’’
সেই মত কার্য্য করেসেই মহাশয়।
দারুণ ব্যাধির হাতে তবে মুক্ত পায়।।
ব্যাধি সেরে গেলে পরে সেই মহাজন।
প্রভুকে লইতে গৃহে করিল মনন।।
আগ্রহ যাদব তাতে করিল প্রচুর।
দয়া করি পাতলায় গেলেন ঠাকুর।।
তেরশআটাশ সনে গেল একবার।
ধনঞ্জয় ইচ্ছা করে নিতে পূনর্ব্বার।।
তাহাতে ঠাকুর বলে ‘‘আর নাহি যাব।
একবার গিয়েছিত? আর কোন ভাব?’’
যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।
যাদব বিশ্বাস আদি জুটিয়া সকলি।।

 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free