মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ১৬১-১৮০

পণ্ডিত প্রধান, হয়েছে খৃষ্টান
করিয়া ইংরাজী শিক্ষা

শ্রী মধুসূদন, নামে সেইজন 
খৃষ্ট ধর্ম্মে নিল দীক্ষা
।।
শ্রী কৃষ্ণ মোহন, পাদ্রী একজন 
জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিল

খৃষ্ট ধর্ম্ম মূল, বুঝি পরে স্থুল 
জাতি ছেড়ে ধর্ম্ম নিল
।।
শিক্ষিত যাহারা, প্রায়শঃ তাহারা 
খৃষ্ট ধর্ম্মে মজিয়াছে

অশিক্ষা - আঁধারে, আছে যেবা পড়ে 
তারে ধর্ম্ম দে'য়া মিছে
।।
মোর জাতি তায়, যদি শিক্ষা পায় 
কেবা জানে ভবিষ্যৎ

শিক্ষিত হইলে, তাহারা সকলে 
নি'তে পারে তব মত
।।
আদি প্রয়োজন, বলে মোর মন 
শিক্ষাহীনে শিক্ষা দান

তারা শিক্ষা পেলে, মন প্রাণ ঢেলে 
রাখিবে তোমারি মান
।।
উচ্চ বিদ্যালয়, নাহিক কোথায় 
কোন নমঃশূদ্র গ্রামে

বর্ণ হিন্দু যারা, মোদেরে তাহারা 
নাহি লয় কোন ক্রমে
।।
মোরা শিক্ষা পাই, তাহারা সবাই 
কভু না আশায় করে

তারা মনে ভাবে, কৃষি জীবি সবে 
পড়ে থাক অন্ধকারে
।।
তার পরিচয়, সম্প্রতি হেথায় 
মোরা সবে দেখিয়াছি

বহু অপমানে, দুঃখ পেয়ে মনে 
চুপ করে বসে আছি
।।
প্রভুজী তখনে, অতি দুঃখ মনে 
মীডেরে কহিল কথা

যেভাবে ফুকরা, যত ব্রাহ্মণেরা 
দিয়েছিল ঘোর ব্যথা
।।
শুনি সে কাহিনী, মীড মহা গুণী 
বড়ই বেদনা পায়
 
করি হাহাকার, বলে বারে বার 
এ কত বড় অন্যায়
।।
প্রভু বলে শোন, ও হে মহাজন 
অন্যায় এটুকু কিবা

হীন-পশু-প্রায়, মোদেরে সবায় 
ঘৃণা করে রাত্রি দিবা
।।
জল দিলে ছুঁয়ে, ঢেলে ফেলে ভুঁয়ে 
করেতে করেনা স্পর্শ

কিন্তু অর্থ দিলে, নেয় কুতূহলে 
মনে পায় বড় হর্ষ
।।
জাতি গেছে জলে, তাই ওরা জ্বলে 
জলে ডুবে জল খায়

যদি থাকে পৈতা, স্বর্গে উঠা মৈ টা 
লাগা - থাকে তার পায়
।।
হোক্ ব্যভিচারী, হলে পৈতা ধারী 
সমাজে তাহার মান্য

পূত নমঃশূদ্র, তাহা হ'তে ক্ষুদ্র 
এই মত করে গণ্য
।।
অবশ্য ভারতে, আছিল পূর্ব্বেতে 
পবিত্র মানব কত

গুণশালী তারা, হিংসা-দ্বেষ-হারা 
শাস্ত্র রচে অগণিত
।।
কালক্রমে সব, পরম - বিভব 
ভুলিয়াছে হিন্দু জাতি

দিনে দিনে ক্ষীণ, এবে পরাধীন
ঘিরিছে আঁধার রাতি
।।

 

 

যা 'হোক তা 'হোক, বৃথা করি শোক 
আমাদের কথা বলি

কিভাবে সবার, হইবে উদ্ধার
কোন পথে মোরা চলি ?
নমঃশূদ্র যদি, ও হে গুণনিধি 
শিক্ষা পায় নিজ ঘরে

তোমার বচন, বুঝিবে তখন 
খৃষ্টান হইতে পারে
।।
আর বলি কথা, কত বড় ব্যথা 
রোগ শোক আছে কত

বিনা চিকিৎসায়, কত মরে যায়
নর নারী সংখ্যাতীত
।।
এ দুঃখী জাতিকে,কেহ নাহি দেখে
মরমে মরিয়া রয়

তব করুণায়, কোন সদুপায় 
এ জাতির যদি হয়
।।
সেই ভরসায়, তোমাকে হেথায় 
আমরা এনেছি ডাকি

করহে কল্যাণ, ও হে মতিমান 
মোদের এ দেশে থাকি “
।।
প্রভুজীর বাণী, করুণ কাহিণী 
হরিল মীডের মন

ক্ষণিক ভাবিয়া, প্রভুকে চাহিয়া 
মীড কহে সু বচন
।।
'শুন বড় কর্ত্তা, মোর যেই বার্ত্তা 
পরাণ খুলিয়া কই

যদি জমি পাই, কোন কথা নাই 
এ দেশে আমরা রই
।।
আমার উদ্দেশ্য, তোমাকে অবশ্য 
সব বলিয়াছি খুলে

এ দেশে থাকিব, ইস্কুল গড়িব 
মিশিব তোমার দলে
।।
শুন সমাচার, আমি যে ডাক্তার
করিব ডাক্তার খানা

বিনামূল্যে সবে, ঔষধি পাইবে 
অযতনে মরিবে না
।।
তব উপদেশ, আমি সবিশেষ
হৃদয় করেছি পূর্ণ

উচ্চ বর্ণ যত, হবে মাথা নত 
অহংকার হবে চূর্ণ
।।
তোমাতে আমাতে, অদ্য দিন হ'তে 
মিশামিশি হল প্রাণে

এক যোগে মোরা, হাতে হাত-ধরা 
কাজ করি এক মনে
।।
মোরে দিয়া যদি, হয় কোন বিধি 
অবশ্য করিব তাহা

তব কার্য ফেলে, কভু কোন কালে 
নাহি করি অন্য যাহা
।।
তব জাতি যবে, উন্নত হইবে 
মোর কার্য তোমা দিব

তোমাদিয়া ভার, সাগরের পার 
আমি তবে চলে যাব
।।
শুনি এই বাণী, প্রভুজী তখনি 
শ্রী শশি ভূষণে কয়

সাহেব যা ' বলে, সকলি শুনিলে 
বল কি করি উপায় ?
যাহা চাহে জমি, সব দিব আমি 
তাহাতে আনন্দ অতি

স্বজাতির গণে, ডাক জনে জনে 
জানিব তা'দের মতি
।।
আজিকে এখনে, বিহিত সন্মানে 
সাহেবে বিদায় কর

স্বজাতি সকলে, ডাকি এক দলে 
কাজে হও অগ্রসর
।।

 

এমত কহিয়া, সাহেবে ডাকিয়া 
প্রভু কহে হিত -বাণী

বহুত বিনয়, করিলেন তায় 
কর-পদ্মে কর টানি
।।
যীশু দিল কথা, করি একাগ্রতা 
ওড়াকান্দী-বাসী হবে

উপস্থিত জন, আনন্দে মগন 
ধন্য ধন্য করে সবে
।।
প্রভু বলে তাঁয়, শুন মহাশয় 
এক নিবেদন আছে

আমি অতঃপর, এই সমাচার 
জানা'ব স্ব-জাতি কাছে
।।
মীড কহে হাসি, নমঃকুলে আসি 
খেলিছ দয়ার খেলা

যাহা ইচ্ছা হয়, কর মহাশয় 
মোরে হবে শুধু- বলা
।। 
বহুপুণ্য ফলে, নমঃশূদ্র কুলে 
তোমা পেল কর্ণধার

মনে মনে আজি, যাই সব বুঝি 
এ জাতি করিবে পার
।।
এত কাল ধরি, হেথা সেথা ঘুরি 
মনের মানুষ খুঁজি

মনে হয় মোরে, যীশু দয়া করে 
মানুষ মিলা'ল আজি
।।
করি নমস্কার, শ্রী হরি - কুমার
আজিকে বিদায় চাই

কর অনুমতি, নিয়ে সঙ্গী সাথী 
সে ফরিদপুরে যাই
।।
কিছুকাল পরে,আসি হেথাকারে 
জমিজমা সব দেখি

থাকিব এখানে, আনন্দিত মনে 
নিজ ধর্ম্ম মন রাখি '
।।
এতেক বলিয়া, করেতে ধরিয়া 
প্রভুরে সন্মান করে

দেখি সেই ভাব, নরনারী সব
'ধন্য ' কহে উচ্চৈঃস্বরে
।।
হুলুধ্বনি করে, নারী সবাকারে 
নর কহে হরিধ্বনি

গোপালের দয়া, শিরোপরে নিয়া 
মহানন্দে ভণে ' বাণী
।।

 

ডক্টর মীডের ওড়াকান্দী স্থিতি 
সম্বন্ধে স্বজাতি সভায় আলোচনা 

মীড সহ ঠাকুরের হ'ল পরামর্শ
জানিয়া স্বজাতি সবে মনে বড় হর্ষ
।।
গ্রামে গ্রামে সমাচার পলকেতে যায়
 
নেতৃবৃন্দ ওড়াকান্দী হইল উদয়
।।
জিকাবাড়ী বালাবংশ প্রভুর মাতুল

মহামান্য নমঃকুলে সম্পদ অতুল
।।
চৌধুরী প্রধান বংশ ওড়াকান্দী বাস

ঠাকুরের পদে রাখে অটল বিশ্বাস
।।
শ্রী বিধুভূষণ হ'ন সেই বংশ পতি
 
ছুটিয়া প্রভুর কাছে আসে শীঘ্র গতি
।।
দাস বংশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই কমলাকান্ত

তাঁর ভ্রাতা ভীষ্ম দেব অতীব সুশান্ত
।।
সূচীডাঙ্গা,মল্লকান্দি, রাউৎখামার

ঘোনাপাড়া,ঘৃতকান্দী,আড়কান্দী আর
।।
তারাইল, খাগাইল, তিলছড়া গ্রাম

এই রূপ যত গ্রাম কত কব নাম
।।
প্রধান প্রধান সবে উপনীত হ'

সবারে দেখিয়া প্রভু আনন্দে কহিল
।। 
ভাই বন্ধু যতজন আসিয়াছ হেথা

মন দিয়া সবে আজি শুন মোর কথা
।।

 

দরিদ্র জাতির ঘরে সবে জন্মিয়াছি
শিক্ষা বিনা বড় হ'য়ে ঘৃণিত রয়েছি
।।
দেহে বল এ জাতির কম কিছু নাই

বিদ্যাহীন বলে মনে সাহস না পাই
।।
এই দুর্ব্বলতা যাহা জানে অন্য জাতি

ছলে বলে সুকৌশলে ঘটায় দুর্গতি
।।
তাই যদি শিক্ষা নিতে মোরা কোথা যাই

দূর করে দেয় মোরা স্থান নাহি পাই
।।
কিন্তু দেখ বিধাতার বিধান সুন্দর

চিরদিন কোথা নাহি থাকে অন্ধকার
।।
আজি অন্ধকারে যেবা কালি সে আলোকে

আলোকের জীব কাল অন্ধকারে থাকে
।।
ভিন্ন দেশি রাজা বটে জাতিতে ইংরাজ

কিন্তু ন্যায় দণ্ড হাতে করে সব কাজ
।।
জাতি-গর্ব্ব ধন-গর্ব্ব তাঁর কাছে নাই
 
'প্রজা পাবে সম দৃষ্টি 'রাজা বলে তাই
।।
মোদের দুঃখের কথা রাজার নিকটে

কেহ বলে নাই তাহা কভু অকপটে
।।
রাজ-পুরোহিত যারা পাদ্রী নামধারী

খৃষ্ট -ধর্ম্ম দেয় লোকে দেশে দেশে ঘুরি!
এই জেলা পরে তার মধ্যেতে প্রধান!
মীড নামে পুরোহিত অতি মতিমান
।।
এ জাতির দুঃখ বার্ত্তা তাঁরে জানায়েছি

দুঃখ দূর করি দিবে ভরসা পেয়েছি
।। 
এই গ্রামে ঘর বাড়ী সে করিতে চায়

তার লাগি জমাজমি কিছু দিতে হয়
।।
সেই যে সাহেব তবে সেই জমি পরে

উচ্চ বিদ্যালয় দিবে চিরস্থায়ী করে
।।
আমি বলিয়াছি তবে সাহেবের কাছে

স্বজাতির কাছে শুনি জমি দিব পাছে
।।
এ-কারণ সকলেরে আহ্বান করেছি

জাতিকে উঠা'ব বলে সাহেবে ধরেছি
।।
কিবা মত কিবা মন বল অকপটে

ভাল মন্দ সবে মিলি করি একজোটে”
।। 
এত যদি মহাপ্রভু বলিলেন কথা

ক্ষণকাল সবে রহে নোয়াইয়া মাথা
।।
অতঃপর ধীরে ধীরে সবে কথা কয়

কেহ বলে ঠিক নহে কেহ দেয় সায়
।।
এই ভাবে মত মধ্যে দ্বি-ভাব হইল

শ্রী বিধু চৌধুরী তবে কহিতে লাগিল
।।
পরম তেজস্বী জ্ঞানী শ্রীবিধু চৌধুরী

ঠাকুরের পদে তার নিষ্ঠা ছিল ভারী
।।
কর্ত্তব্য বলিয়া যাহা করিতেন মনে

অকপটে সেই কথা বলে সর্ব্বস্থানে
।।
কর জোড় করি বিধু দাঁড়াইয়া কয়

শুন প্রভু এ ব্যাপারে যাহা মনে হয়
।।
তব আজ্ঞা শিরোধার্য অবশ্য করিব

মানিবার পূর্ব্বে তাহা বুঝিয়া মানিব
।।
রাজ পুরোহিত বটে পাদ্রীর সমাজ

দীন -পক্ষে এই দেশে করে কত কাজ
।।
কিন্তু আমি যাহা জানি সব বলিতেছি

কার্য মধ্যে স্বার্থ আছে প্রমাণ পেয়েছি
।।
স্ব-ধর্ম্ম ত্যজিয়া যেবা যীশুখৃষ্ট ভজে

তার লাগি চেষ্টা করে পাদ্রীর সমাজে
।।
উপকার ছলে করে ধর্ম্ম - পরচার

খৃষ্ট -ধর্ম্মে নিতে চায় জগত সংসার
।।
এই লাগি মোর মনে বড় ভয় লাগে

বিহিত করিব চিন্তা কার্য-পূর্ব্ব-ভাগে
।।
যদ্যপি খৃষ্টান আসে আমাদের দেশে

বসতি করিবে তারা প্রতিবেশী বেশে
।।
অজ্ঞান নরের দেখ শুদ্ধ - বুদ্ধি নাই

অজ্ঞানে ছলিয়া নিবে মনে ভয় পাই
।।
ভয় হয় কালে কালে অপূর্ব্ব ঘটনা

হিন্দু ধর্ম্মে এই দেশে কেহ থাকিবে না
।।

 

 

ধর্ম্ম ছেড়ে বড় হ'তে আমি নাহি চাই
ধর্ম্ম রেখে বড় হব মনে বাঞ্ছা তাই”
।।
'শ্রী বিধুভূষণ যদি বলে এই কথা

বহু জনে সায় দিল করিয়া একতা
।।
কেহ বলে এই ঠিক্ কথা হইয়াছে

কভু না যাইব মোরা খৃষ্টানের কাছে
।।
যে আচারে খৃষ্টানেরা করে সব কাজ

হিন্দু মোরা তাই দেখে পাই বড় লাজ
।।
শ্রাদ্ধ শান্তি, পূজা আদি কিছু মাত্র নাই

বিলাসিতা মাঝে ডুবে রয়েছে সবাই
।।
আচার ব্যভারে যেন তারা মুসলমান

হিন্দু - রক্তে সহ্য নাহি হবে সে বিধান
।। 
বহু পুরুষের ধর্ম্ম মানিতেছি সব

কি জন্য ছাড়িব মোরা এ-হেন গৌরব
।।
কালচক্রে দুঃখে আছি তা'তে সন্দ নাই

বিধি দিলে দিন মোরা পাইব সবাই
।।
কাজ নাই ধর্ম্ম ছেড়ে বড় হইবারে

ধর্ম্ম ছেড়ে বড় হয়ে কিবা কাজ করে?
এই মত কথা সবে বলাবলি করে

সবে এক - মত যেন সভার ভিতরে
।।
কথা শুনি ভাব দেখি গুরুচাঁদ হাসে

সভাজন প্রতি কয় সু-মধুর ভাষে
।।
হস্ত উত্তোলন করি প্রভু বলে কথা

দৃষ্টি মাত্র সভাজনে নোয়াইল মাথা
।।
'প্রভু বলে বন্ধুবর্গ সবে কথা লও

আমি যাহা বলি শুন পরে কথা কও
।।
যে-কথা বলেছে বিধু সত্য এক দিকে
 
সত্য কিন্তু সর্ব্বব্যাপী জানে সব লোকে
।। 
খৃষ্টানে খৃষ্টান করে সেই তার ধর্ম্ম

ব্রাহ্মণ সকলে বলে ব্রাহ্মণের মর্ম্ম
।।
যার যার ধর্ম্ম সে করে পরচার

আমি দোষ নাহি দেখি ইহার ভিতর
।।
ধর্ম্মেতে স্বাধীন মত জানিবে সকল

ধর্ম্মেতে রাখিলে নিষ্ঠা সেই মহাবল
।।
এক ধর্ম্ম ভিন্ন দুই ধর্ম্ম দেখ কোথা

হিন্দু-ধর্ম্ম খৃষ্ট-ধর্ম্ম বলা শুধু বৃথা
।।
এক মূল তত্ত্ব রহে সর্ব্ব-ধর্ম্ম-মাঝে

প্রণালী পৃথক শুধু রীতি নীতি কাজে
।।
তাই বলি কার ধর্ম্ম কেবা ছেড়ে দেয়

ধর্ম্ম-নিষ্ঠ লোক কম দেখি এ ধরায়
।। 
দলাদলি করি করে ধর্ম্মের ছলনা

ধর্ম্ম পক্ষে নাই কিছু পুরুষ ললনা
।।
যে-জন ধার্ম্মিক ভবে তাঁর চিন্তা নাই

তাঁর পক্ষে নাই ধর্ম্ম ছাড়ার বালাই
।।
ধর্ম্ম ছেড়ে বড় হ'তে কেবা কারে কয়
 
ধর্ম্মেতে থাকিলে মন সবে বড় হয়
।।
এই ধর্ম্মতত্ত্ব দেখ বড়ই কঠিন

মুখে'ধর্ম্ম' 'ধর্ম্ম' করে যত অর্ব্বাচীন
।।
আরো দেখ ধর্ম্ম-চিন্তা অতীব সুসার

কেমনে পালিব ধর্ম্ম অন্ন-চিন্তা যার
।। 
এই দেশে উচ্চ বর্ণ যত জাতি আছে

'অভাব' না যায় কভু তাহাদের কাছে
।।
শিক্ষাগুণে অর্থশালী আছে ঘরে ঘরে

অভাব না জানে তারা কোন দিন তরে
।।
সত্য বটে মুষ্টিমেয় সংখ্যাতে তাহারা

কিন্তু শিক্ষা গুণে দেখ এই দেশে 'সেরা'
।।
এই শিক্ষা সবে তারা কোথায় পাইল

ইংরাজে দিয়াছে শিক্ষা সেখানে লভিল
।।
আদিপর্ব্বে তারা যবে শিক্ষা নিয়াছিল

কিছু কিছু লোক তা'তে খৃষ্টান হইল
।।
কিজন্য খৃষ্টান তারা সাজে তাই বলি

ধর্ম্ম তরে কদাচিৎ অধিকাংশ কলি
।।
সজ্জন ধীমান যারা তারা দেখ বুঝে

এই শিক্ষা লাগাইব মোরা কোন্ কাজে
।।

 

জড়ত্ব সমাজ - দেহে বাঁধিয়াছে বাসা
কাল ঘুমে ঘিরিয়াছে অতি সর্ব্বনাশা
।।
ইংরাজ কর্ম্মী'ষ্ঠ জাতি রজঃ-ধর্ম্ম-ধারী

অলস -তামস -পুর্ণ -কর্ম্মে ব্যভিচারী
।।
ইংরাজের শিক্ষা তাই রজস প্রধান

সে শিক্ষা লভিলে জাতি-জাগিবে পরাণ
।।
এই চিন্তা মণীষীরা মনে করি ধ্যান

ইংরাজের শিক্ষা নিতে গড়ে প্রতিষ্ঠান
।।
তাই বর্ণ হিন্দু যত সেই শিক্ষা গুণে

এই দেশে শ্রেষ্ঠ সবে ধনে কিংবা জ্ঞানে
।।
পরিণাম ভাবি তারা মিথ্যা ভয়ে ভীত

নিজ সমাজেতে শিক্ষা রাখিল বেষ্টিত
।।
কাল গুণে যারা সবে দরিদ্র কাঙ্গাল

তারা নাহি পেল শিক্ষা - ফলের নাগাল
।।
সেই হেতু অনুন্নত যারা বঙ্গ দেশে

কাল ঘুমে অচেতন কাঙ্গালের বেশে
।।
এক কথা সভা মাঝে বলিয়াছ সবে

কালের বিধানে দিন আপনি আসিবে
।।
কিন্তু এক প্রশ্ন আমি করি সভা ঠাঁই

কালাভাগে ভাগ কিছু আছে নাকি ভাই?
যে কালে আপনাপনি ঘটিবে সকল

কোথায় নিশানা তার পাবে তাই বল
।।
আজও কাল,কালও কাল, কাল -পরিচয়

নিজে বুঝিবারে লোকে আজ কাল কয়
।।
কাল বুকে নাহি সীমা নাহি কোন রেখা

কালাকাল, আছে শুধু নর -শাস্ত্রে লেখা
।।
যে -কাল ঘটিবে সব সেত নহে দূর

কাল আছে সর্ব্বক্ষণে নিজে ভরপুর
।।
আজ -কাল ভাগাভাগি নরে করিয়াছে

ভাগাভাগি নাহি কিছু কাল গতি কাছে
।।
কালেতে হইবে সব বলিলে বচন

কাল -পর্ব্বে আছে নাকি এখন-তখন
।।
কালে কিছু নাহি করে নরে সব করে

আজি কালি করি তারা বৃথা কাল হরে
।।
আর যদি বল হবে বিধির বিধানে

বিধি কবে ইচ্ছা করে কেবা তাহা জানে?
তুমি আমি ভাবি বুঝি কাল আসে নাই

এলো কিনা এলো শুধু বিধি জানে তাই
।।
আজ যে সাহেব আসে শোনে দুঃখ বার্ত্তা

মনে ভাব এর মূলে সাহেব কি কর্ত্তা?
বিধি যদি ইচ্ছা নাহি করে থাকে মনে

বিদেশী সাহেব হেথা আসিল কেমনে?
ইথে বুঝি বিধাতার ইচ্ছা হইয়াছে

তাঁহার ইঙ্গিতে তাই পাদ্রী আসিয়াছে
।।
আর ভয় দিল সবা শ্রী বিধুভূষণ!
সকলে খৃষ্টান -করা পাদ্রীর মনন
।।
সে উদ্দেশ্য সত্য বলে আমি মানিলাম

আমাদিগে 'ভুলাইবে কিসে বুঝিলাম
।।
যে -বিপদ আসে নাই তারে কেন ডরি?
মরনের ভয় দেখে কেন ভয়ে মরি
।।
বীর ধর্ম্মে নাহি কিছু ভয়ের আশ্রয়

কাপুরুষের মৃত্যু -পূর্ব্বে শত-মৃত্যু হয়
।।

“ Cowards die many times 
before their deaths “
---Shakespeare

ভয় না আসিতে ভয়ে করিতেছ ভয়
ভীত -জন হয়ে রহে ভূতের আশ্রয়
।।
আর কথা বলি সবে শুন ভাল মনে

মোদের খৃষ্টান পাদ্রী করিবে কেমনে?
শিক্ষা লাগি খৃষ্টানের চেয়েছি সাহায্য

শিক্ষা নিয়ে নিজ-ধর্ম্ম করিব কি ত্যজ্য?
পর -ধর্ম্ম নমঃশূদ্রে নিবে কি লাগিয়া?
নমঃশূদ্রে ধর্ম্ম গেছে হরিচাঁদ দিয়া
।।

 

 

সত্য অবতার ছিল শ্রী হরি ঠাকুর
এসেছিল উদ্ধারিতে অনাথ আতুর
।।
অনাথ আতুর অন্য-ধর্ম্মে কদাচন

আপাততঃ এই বঙ্গে নাহি প্রয়োজন
।।
ক্রমে ক্রমে আসিবেক যুগ' ধরাতলে

হরিচাঁদ ধর্ম্মমতে মাতিবে সকলে
।।
এসব কল্পনা নহে জেন সত্য-বাণী

হরি-ধর্ম্ম উদ্ধারিবে যত নর - প্রাণী
।।
অধিক কহিব কত নহে বেশী দূরে

শ্রী হরির পুত্র যবে আমি এ সংসারে
।।
সত্য সত্য বলি আমি সবাকার ঠাঁই

খৃষ্টানে আমারে গ্রাসে হেন শক্তি নাই
।।
শ্রী হরির পুত্র আমি তাঁর কৃপা বলে

নিশ্চয় সাহেবে টানি নিব মোর দলে
।। 
খৃষ্টান না হ'ব আমি জানিও নিশ্চয়

সাহেবে মতুয়া করি দেখা'ব সবায়”
।।
মহাতেজে এই কথা প্রভু যবে বলে

জয় ধ্বনি করে সবে সেই সভাস্থলে
।।
অগ্রণী হইয়া তবে শ্রী বিধু চৌধুরী

বজ্র কণ্ঠে বলে উঠে “কারে শঙ্কা করি?
কাণ্ডারী যদ্যপি বলে কোন ভয় নাই

ত্রিজগতে মোরা আর কাহাকে ডরাই?
যথা আজ্ঞা করে প্রভু তাহা মানি সার

বুঝিলাম এ জাতির শঙ্কা নাহি আর
।।
যে হোক সে হোক তা'তে ভয় নাহি করি

শঙ্কাহারী নিজে যবে সেজেছে কাণ্ডারী
।।
শুন নমঃশূদ্র ভাই এই করি পণ

অবশ্য করিবে সবে প্রতিজ্ঞা পালন
।।
যেই পথে গুরুচাঁদ চালাইবে সবে

দ্বিধা শূন্য মনে সবে অবশ্য চলিবে
।।
এই কথা বিধু যবে উচ্চারণ করে

সবে সমর্থন করে আনন্দ অন্তরে
।।
এক যোগে সবে বলে গুরুচাঁদ কাছে

আমাদের দ্বন্দ্ব যত সব ঘুচিয়াছে
।।
দয়া করে আমাদের ভার লহ হাতে

অভয় পেয়েছি মোরা আজিকে তোমাতে “
।।
প্রভু বলে “শুন সবে স্ব -জাতির গণ

আমি সব স্থান দিব পাদ্রীর কারণ
।।
আপন করিয়া তাঁরে রাখিব নিকটে

দেখি পাদ্রী ধরা দেয় নাকি অকপটে
।।
কিন্তু এক কথা মম আছে সবা ঠাঁই

সৎ কর্ম্মে দান কিন্তু পাছে করা চাই
।।
স্কুল যবে এই দেশে সাহেব করিবে

সাধ্য মত টাকা কড়ি সবজনে দিবে”
।।
প্রভুর বাক্যেতে সবে স্বীকার হইল

হরি -গুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল
।।

 

১৯০৫ খৃষ্টাব্দ বা বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন

মরা গাঙে বান ডেকেছে,
জয় মা! বলে ভাসাও তরী
 
-- রবীন্দ্রনাথ

ঊনিশ শ ' পাঁচ অব্দ চির -স্মরণীয়
বাঙ্গালীর পক্ষে বটে অতি বরণীয়
।।
শুধুই বাঙ্গালী কেন ভারতের বুকে

সর্ব্বজনে এই সাল মনে করে রাখে
।।
জাতীয় জীবনে ঢেউ প্রথমে উঠিল

'মরা গাঙে বান ডেকেছে 'বাঙ্গালী গাহিল
।।
স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে

অতি -ধন্য দিন সেই বাঙ্গালীর কাছে
।।
আদি অন্ত সে বৃত্তান্ত বলিবারে চাই

দয়া করে কহ কথা গোপাল গোঁসাই
।।
তব কৃপা বলে গুরু!মো 'সম পাতকী

শ্রী গুরুচরিত কথা ক্রমে যায় লিখি
।।
তুমিও লিখাও তারে অন্তরে বসিয়া

তোমার গুরুর গুণ যেতেছ গাহিয়া
।।

কেবা তিনি কেন তিনি আসিলেন ধরা
সেই তত্ত্ব তুমি জান নাহি জানি মোরা
।। 
তব ইচ্ছা যাহা তুমি করহে প্রকাশ

দয়া করে মোর হৃদে কর তুমি বাস
।।
পদাশ্রিত দাস আমি পদে দেহ স্থান

করিতে পারি গো যেন গুরু-গুণ গান
।।
কার্জ্জন নামেতে এল রাজ প্রতিনিধি

সেই জনে বঙ্গ ভঙ্গ করিলেন বিধি
।।
ভারতের রাজধানী কলিকাতা ছিল

বঙ্গ -বুকে থাকি বঙ্গ ছেদন করিল
।।
পূর্ব্ব ও পশ্চিম বঙ্গ নামে করে ভাগ

উত্তেজিত বঙ্গ বাসী বলে 'সবে জাগ '
।।
এক দেশ এক ভাষা মনে এক আশা

বিভাগ করিলে কার্য হবে সর্ব্ব -নাশা
।।
বাঙ্গালী একই জাতি এক হয়ে র'বে
 
হেন শক্তি নাহি তারে পৃথক করিবে
।।
সারা বঙ্গ জুড়ি বহে আন্দোলন ধারা

জনে জনে ঘরে ঘরে ভাবে মাতোয়ারা
।।
ব্যানার্জী সুরেন্দ্রনাথ অগ্রণী হইল

তার আবাহনে জাতি দৃঢ় সাড়া দিল
।।
মাতৃ-পূজা-ব্রত-মন্ত্রে দীক্ষিত সকল

বাঙ্গালী স্বাধীন হবে বুকে বাঁধ বল
।।
'স্বদেশী 'বলিয়া খ্যাত তাহারা লভিল

মাতৃ-পূজা বেদী তলে অনেকে মরিল
।।
ক্ষুদিরাম অরবিন্দ বারীন প্রফুল্ল

উল্লাসে ' উল্লাস ' কর অন্যে নহে তুল্য
।।
কেহ গেল দ্বীপান্তরে কেহ নিল ফাঁসী

আন্দোলনে ঝাঁপ দিল সারা বঙ্গ বাসী
।।
অম্বিকাচরণ নামে সে ফরিদপুরে

ওকালতী ব্যবসায় সেথা বাস করে
।।
এই আন্দোলন মাঝে ঝাঁপ দিল তেঁহ

সেই বলে 'পিছে পড়ে থাক না'ক কেহ '
।।
বাঙ্গালী সাজিল রণে প্রকাশ্যে গোপনে

বোমা মারে লুঠ করে ধন কেড়ে আনে
।।
লাটের গাড়ীর নীচে বোমা রেখে দেয়

অপরাধে ক্ষুদিরাম ফাঁসী-কাষ্ঠে যায়
।।
আলীপুর-বোমা-কেস বিখ্যাত ভারতে

অরবিন্দ অপরাধী আছিলেন তা'তে
।।
দেশবন্ধু চিত্ত বীর এই মামলাতে

রাখিল অক্ষয় কীর্ত্তি বাক্ পটু তাতে
।।
অরবিন্দ মুক্ত হল বাকী কতজনে

দীপান্তর শাস্তি হল রাজার আইনে
।।
এই ভাবে আন্দোলন কয়েক বছরে

চলিল ভারত ব্যাপী বিবিধ প্রকারে
।।
এই বার্ত্তা রাজদ্বারে ক্রমে পঁহুছিল

শ্রী পঞ্চম জর্জ্জ তবে সিংহাসন পেল
।।
তেঁহ আজ্ঞা মতে হল দিল্লী দরবার

বঙ্গ ভঙ্গ বিধানের হল সুবিচার
।।
বঙ্গ ভঙ্গ রদ হল খুশী বঙ্গ বাসী

ছিন্ন বঙ্গ যুক্ত হল এক সঙ্গে মিশি
।।
রাজদ্রোহ -কার্য যারা করে নানা মতে

শাস্তি পে'ল তারা সবে বিচারক হাতে
।।
রাজভক্ত ছিল যারা করিল সাহায্য
 
পুরস্কার পে'ল কত সবে হল পূজ্য
।।
এই আন্দোলন কালে ঘটে যে ঘটনা

নমঃশূদ্র জাতি পক্ষে করিব বর্ণনা
।।
অম্বিকাচরণ নাম লিখিয়াছি পূর্ব্বে

নেতা বলে জেলাবাসী মান্য করে সর্ব্বে
।।
নমঃশূদ্র জাতি চিনে সেই মহাশয়

শক্তিশালী জাতি বলে জানে পরিচয়
।।
মনের কল্পনা তাঁর যাহা দেখা যায়

মনে মনে চিন্তা করে সেই মহাশয়
।।
এই আন্দোলনে যদি এই জাতি নামে

সৈন্য বিভাগেতে কার্য করিতে সক্ষমে
।।

 

ইহাদিগে' ভিড়াইয়া হ'ব শক্তিশালী
অবশ্য বিদ্রোহ হবে মহাবলে বলী
।। 
এত ভাবি আলোচনা করে মহাশয়

কোথা গেলে নমঃশূদ্র হাত করা যায়
।।
ক্রমে ক্রমে শুনিলেন গুরুচাঁদ-কথা

নমঃকূলে সে শ্রেষ্ঠ নমঃশূদ্র - নেতা
।। 
তিনি যদি সায় দেয় জাতি সায় দিবে

একস্থানে বসে কার্য সমাধা হইবে
।।
কিন্তু সবিশেষ জানা নাহি তাঁর সাথে

সোজাসুজি এ প্রস্তাব করি কিবা মতে
নমঃশূদ্র শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ওড়াকান্দী গ্রাম

জিনিতে হইবে তারে না করি বিশ্রাম
।।
ওড়াকান্দী সন্নিকটে ঘৃত কান্দী গাঁয়

কায়স্থ ব্রাহ্মণ কিছু বসতি তথায়
।।
তাহাদের সহযোগে সভা মিলাইয়া

নমঃশূদ্র গণে নিবে দলে ভিড়াইয়া
।।
এই মত চিন্তা করি করে আয়োজন

ঘৃতকান্দী গ্রামে এক সভা আমন্ত্রণ
।।
নিমন্ত্রণ করে আনে নমঃশূদ্র গণে

বুঝা 'ল অনেক সবে বিবিধ বিধানে
।।
দেশমাতা স্বর্গ হ'তে হয় গরীয়ান
 
তার লাগি দিতে হয় অনায়াসে প্রাণ
।। 
মাতৃ সেবা যেবা নাহি করা প্রাণপণে

কুলাঙ্গার ব্যাখ্যা তার শাস্ত্রের বিধানে
।।
অতএব দেশ লাগি সবে এক হও

এক-ভাবে এক-মনে এক-কথা কও
।। 
এই ভাবে বহুক্ষণ অম্বিকাচরণ

বক্তৃতা করিল শুনে সবে সভাজন
।।
বক্তৃতা শুনিয়া সবে মোহিত হইল

স্বদেশী সাজিব মোরা “এমত কহিল
।।
ভাবের তরঙ্গে যত নমঃশূদ্র গণ

স্বদেশী সাজিতে সবে করিল মনন
।।
মনে মনে উল্লাসিত অম্বিকাচরণ

ডেকে বলে 'শুন ভাই নমঃশূদ্র গণ
।।
আমি জানি এই দেশে তোমাদের নেতা

ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ অসীম ক্ষমতা
।।
আমি দেশে যাই চলে দেরী না করিব

কিছুকাল পরে পুনঃ মিলিত হইব
।।
ইতিমধ্যে সবে মিলি এই কাজ কর

ওড়াকান্দী গিয়ে সবে গুরুচাঁদে ধর
।।
একত্রে সকলে গিয়ে জানাও তাঁহারে

স্বদেশী সাজিলে সবে কোন নীতি ধরে
।।
তোমরা বলিলে তিনি বুঝিবেন প্রাণে

স্বদেশী সাজিতে দ্বিধা নাহি হবে মনে
।।
এত বলি সভা ত্যাগ করি মহাশয়

নিজ দেশে চলিলেন দ্রুত অতিশয়
।।
সভাতে আছিল যত নমঃশূদ্র গণ

হস্তেতে পতাকা সবে করিল গ্রহণ
।।
স্বদেশীর গান গাহি চলিয়াছে পথে

দেশ ডুবে যায় যেন বহু জনস্রোতে
।।
দলে দলে ওড়াকান্দী সবে উপনীত

হস্তেতে পতাকা বহে কন্ঠে বহু গীত
।। 
লোক সমাবেশ হ'ল কয়েক হাজার

মনে হয় ওড়াকান্দী মিলেছে বাজার
।।
বিস্তৃত প্রাঙ্গণ 'পরে গদিখানা ঘর

মহাপ্রভু বসিয়াছে আসন -উপর
।। 
হেনকালে মহা কলরব শোনা যায়

প্রভু বলে 'দেখ দেখি কিসে শব্দ হয়
।।
বলিতে বলিতে সবে উপনীত হ'
 
প্রভু জোরে হেঁকে বলে “ছাড় গণ্ডগোল “
।।
প্রভু জোরে হাঁক দিল বজ্রধ্বনি -প্রায়

মুহূর্ত্তে সে জনসঙ্ঘ স্তব্ধ হ'য়ে যায়
।।
শিক্ষক অন্তরে গেলে যথা বালকেরা

গোলমাল করে ঘরে সবে সাজি সেরা
।।

 

দেশ কাল ভুলি তারা বালক স্বভাবে
হট্টগোল করে যথা অতি উচ্চ রবে
।।
শিক্ষক প্রবেশি ' যবে গৃহের ভিতরে

হাঁক দিয়া বেত্র নিয়া আস্ফালন করে
।।
মুহূর্ত্তে বালক বৃন্দ কলরব ছাড়ি

স্থানুবৎ বৈসে সবে দিয়ে সারি সারি
।।
অথবা কৌরব সভা মাঝে যদুবীর

দুষ্টের দমন হেতু তুলি নিজ - শির
।।
অট্টহাস্য করি করে কৌরব মোহিত

তেজঃ দেখি দুষ্টগণে মনে অতি ভীত
।।
উত্তাল -তরঙ্গ -মত্ত যথা সিন্দু পানে

উদ্যত শাসন -অস্ত্র রাম যবে টানে
।।
ভয়াকুল সিন্দু পতি করজোড় করি

অনুতাপে রাম পদে পড়িল আছাড়ি
।।
তেমতি শ্রী গুরুচাঁদ বজ্রধ্বনি কৈল

মূক -প্রায় জনসঙ্ঘ স্তব্ধ হৈয়া রেল
।।
অতঃপর মহাপ্রভু কহিলেন ডাকি

ক্রোধেতে কম্পিত দেহ রক্ত বর্ণ আঁখি
।। 
তোমরা কাহারা বাপু! কি চাও এখানে

চীৎকার কর কেন আমার উঠানে?
হাতেতে নিশান দেখি নিশান ত ভাল
।।
দলে দলে গান গেয়ে কিবা চাও বল “

ক্রোধ -মূর্ত্তি দেখি কেহ কথা নাহি কয়
।।
কথাঞ্চিৎ শান্ত হ'য়ে বলে দয়াময়

বুঝিয়াছি তোমাদের যতেক কল্পনা

স্বদেশী সেজেছ সবে করিয়া জল্পনা
।। 
স্বদেশী সেজছ ভাল আমি ত' বিদেশী
।। 
স্বদেশী সাথে মোর নাহি মিশামিশি
।।
তবে কেন আসিয়াছ বিদেশীর কাছে ?
সকলে স্বদেশী হও আমি থাকি পাছে
।।
দেশ কারে বলে বাপু, মাটি কি মানুষ

কোন দিনে কেহ তাহা করিয়াছে হুষ?
বাক্য -বীর এক এক জনে হেথা আসে

বলে যায় লক্ষ কথা চক্ষের নিমেষে
।।
নির্ব্বোধ সরল জাতি মূল নাহি বোঝে

যে যাহা বলিয়া যায় তাই শুনে মজে
।।
যাহা শুনে মনে ভাবে তাই বুঝি ভালো

চিরকাল এই ভাবে জনম কাটিল
।।
এই কথা মনে নাহি ভাবে কোন দিন

কি কারণে এ জাতির দশা এত হীন
কি বলি দুঃখের কথা বুক ফেটে যায়

শত্রু কি বান্ধব এরা চেনে না'ক হায়
।।
'দেশ ' 'দেশ ' বলি যারা আজি ঘুরিতেছে

কিছু বাপু বোঝ কেন এ ভাবে ধরেছে
।।
সুদিনে মোদের যারা করিয়াছে ঘৃণা

আজ কেন আসে তারা কিছুই বোঝ না
।।
স্বার্থরক্ষা এরা সবে জানে ভাল করে

তোমাদের কাছে আসে স্বার্থের খাতিরে
।।
শিক্ষিত বিদ্বান যারা ধনী জমিদার

'স্বদেশী 'স্বদেশী ' বলে করে চীৎকার
।।
অশিক্ষিত আমি বাপু অর্থ কড়ি নাই

স্বদেশীর অর্থ আমি বুঝি না 'ক তাই
।।
আমাদের শশী কিছু পড়া পড়িয়াছে

তোমরা সকলে বাপু যাও তার কাছে
।।
আমি যে বিদেশী তাহা জানি আমি মনে

এদেশে এসেছি শুধু বাবার কারণে
।।
এত বড় 'দাবা -দেশ 'আগে নাহি জানি

আসিয়া বেকুপ হয়ে বসে জের টানি
।।
যাও যাও দেখ গিয়া শশী কোথা আছে

সব কথা বল গিয়া শশী বাবু কাছে
।।
এই মত প্রভু যদি বলিল বচন

অন্তরাল হ'তে আসে শ্রী শশিভূষণ
।।
ইঙ্গিতে বলিল সবে আসিতে বাহিরে

আজ্ঞা মতে গেল সবে জমির উপরে
।।

 

শ্রী শশি ভূষণে সবে ঘিরিয়া দাঁড়া'
তাঁর কাছে সবে তবে কহিতে লাগিল
।।
বড় বাবু মন খুলে বলিবারে চাই

কর্ত্তার নিকটে গেলে সাহস না পাই
।।
যে কথা বলিছে আজি অম্বিকা চরণ

তা 'তে বুঝি স্বদেশীতে ভালই মরণ
।।
প্রাণে বলে বেঁচে থেকে কিবা কাজ হবে

স্বদেশী রাজত্ব হ'লে সব দুঃখ যাবে
।। 
মনে ভাল ব'লে সব স্বদেশী সেজেছি

কি হ'ল কেমন হবে জানিতে এসেছি
।।
যাহা কিছু করি মোরা জানাই কর্ত্তারে

সেই হেতু আসিয়াছি তাঁহার গোচরে
।।
ভাল করি মন্দ করি তাঁহাকে জানাই

জানি সবে তিনি ছাড়া বন্ধু কেহ নাই
।।
আপনার কাছে যেতে বলিলেন তিনি

দয়া করি তাই তুমি আসিলে আপনি
।।
বুঝাও মোদেরে সব ব'সে মোরা শুনি

পশ্চাতে করিব কার্য যাহা ভাল গণি
।।
স্বদেশীরা করে কার্য নাহি রাখে স্বার্থ

দেশের লাগিয়া ছাড়ে ধন, মান, অর্থ
।।
বড়ই উদার তাঁরা মহৎ পরাণ

আমাদের সাথে বসি করে জলপান
।।
কর্ত্তার কথায় মনে লাগে যে সন্দেহ

বড় কাজ করে ছোট হয় নাকি কেহ
।।
জ্ঞান হীন সবে মোরা ভাব নাহি বুঝি

কর্ত্তার নিকটে তাই আসি সোজাসুজি
।।
হরি পুত্র গুরুচাঁদে সবে মান্য করি

তিনি যান্ যেই পথে সেই পথ -ধরি
।। 
কিন্তু কি বলিব বাবু স্বদেশী সে -জন

আমাদের মন প্রাণ করেছে হরণ
।।
কিবা জানি কেন মন পাগল হইল

বাধ্য হ'য়ে করি তাহা সে যাহা বলিল
।।
ভাবিলাম কত ভাল স্বদেশীর কাজ

কাস্তে ফেলে সবে হাতে ধরিলাম সাজ
।।
উল্লাসে ছুটিয়া তাই আসি ওড়াকান্দী

স্বদেশী সাজে তাই গুরুচাঁদে বন্দি
।।
কিন্তু ক্রোধে কর্ত্তা যবে বলিল বচন

সে উল্লাস যেন আর নাহিক এখন
।।
এ যেন সিন্ধুর বুকে তরঙ্গের খেলা

দুই দিকে দুই সিন্ধু মধ্যে মোরা ভেলা
।।
একের তরঙ্গ ঘাতে বহু দূরে যাই

দ্বিতীয়ের ঘাতে পুনঃ ফিরে আসি তাই
।।
মনে হয় স্বদেশীরা বলেছে মধুর

পুনঃ দেখি কর্ত্তা বলে মধুর মধুর
।।
দো'টানায় প'ড়ে মোরা কূল নাহি পাই

হাবুডুবু বড় বাবু খেতেছি সবাই
।।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আদি গুরু এদেশে আপনি

যে আজ্ঞা করিবে মোরা সবে ল'ব মানি
।।
সুযুক্তি বিধান চাহি মোরা তব ঠাঁই

যা 'বলিবে তা 'করিব ইথে ভুল নাই”
।।
এত যদি বলে কথা দেশ বাসী ভাই

শ্রী শশি ভূষণ বলে “এই আমি চাই
।।
স্থির চিত্তে শুন তবে বান্ধব সকল

স্বদেশীতে হবে ভাল কিংবা অমঙ্গল”
।।
এত বলি শশী বাবু বহুৎ প্রকারে

স্বদেশীর ব্যাখ্যা করে সভার ভিতরে
।।
আদি অন্ত সে বৃত্তান্ত করেছি লিখন

'ল যথা শশী বাবুর জীবনী বর্ণন
।।
সারগর্ভ সে বক্তৃতা শ্রী শশী করিল

স্বদেশীর ধাঁধাঁ সবে বুঝিতে পারিল
।।
সার -মর্ম্ম অল্প কিছু বর্ণন করিব
।।
অপর বিষয় কিছু লিখিতে ধরিব
।।
দেশ নহে মাটি শুধু দেশ --দেশবাসী

এই তত্ত্ব আলোচনা করিলেন শশী
।।

 

যে -কর্ম্মে দেশের সবে সুখে কাল কাটে
সেই কর্ম্মে দেশ সেবা শ্রেষ্ঠ হয় বটে
।।
স্বার্থ রক্ষী পুজিবাদী যদি কোন দল

বাঁচা 'তে নিজের স্বার্থ পা 'তে কোন ছল
।।
দীন দুঃখী দেশে যারা তাহাদের পানে

ভুলিয়াও কোন দিন দৃষ্টি নাহি হানে
।।
বিপদে পড়িলে আসে দরদী সাজিয়া

ভুলি যায় দীন দুঃখী দরদ দেখিয়া
।।
একে ত শিক্ষার সঙ্গে নাহি জানা শোনা

দারিদ্র বহিতে বক্র মেরুদণ্ড -খানা
।।
চিরকাল তিরস্কার পুরস্কার যার

ক্ষণিকের মিষ্ট -কথা প্রীতি পদ তার
।।
জীবনে সুখের সঙ্গে নাহি পরিচয়

সুখের মধুর -কথা যদি কেহ কয়
।।
সুখেচ্ছু -তাপিত -প্রাণ মুহূর্ত্তে গলিয়া

বক্তার চরণ তলে পড়ে যে ঢলিয়া
।।
স্বদেশীর আন্দোলনে এই মর্ম্ম-কথা

করিলেন শশী বাবু উচ্চারণ তথা
।।
এত যে দরদ দেয় বিপদের কালে

বিপদ কাটিয়া গেলে সব যায় ভুলে
।।
চাটুবাক্যে শিক্ষিতেরা অতিশয় পটু

অবশ্য উচিৎ কথা শোনা যায় কটু
।।
বিপদের কালে ধরে চাটুকার -বৃত্তি

মরে দীন চাটুকারে 'লভে মহাকীর্ত্তি
।। 
এই মত সত্য যত সরল ভাষায়

শ্রী শশী ভূষণ বলে স্বজাতি-সভায়
।।
শশীর বচনে সবে পায় দিব্য-দৃষ্টি

সবে বলে করিয়াছি একি অনাসৃষ্টি
।।
আজি হইতে বুঝিলাম এই তত্ত্ব-সার

পতিত বান্ধব গুরুচাঁদ কর্ণধার '
।।
মহারোলে জয়ধ্বনি সকলে করিল

প্রভুর নিকটে গিয়া নীরবে বসিল
।।
হেসে হেসে প্রভু বলে কি গো স্বদেশীরা

কাটিতে পারিল শশী তোমাদের জেরা ?
করজোড়ে প্রধানেরা বলিছে বিনয়ে

'ভুল করিয়াছি মোরা বাক্যে মুগ্ধ হয়ে
।।
মূল -তত্ত্ব যত কিছু বুঝিতে না পারি

যে যা বলে সেই সাথে সবে ছুটে মরি
।।
অপার করুণা তব দয়া ধন্য বলি

উদ্ধার করিবে সব স্ব -জাতি মণ্ডলী
।।
এই আশির্বাদ চাহি বাঞ্ছা কল্পতরু

অবোধ -অজ্ঞান -জনে সদা কৃপাং কুরু “
।।
এত যদি প্রধানেরা বিনয়ে বলিল
 
স্থির হয়ে মহাপ্রভু কহিতে লাগিল
।।
শুনহে স্বজাতি বন্ধু বলি সার কথা

অকারণে হুড়াহুড়ি করিতেছে বৃথা
।।
আপনার সাধ্য বুঝি করিবেক কর্ম্ম

গৃহী-জন-পক্ষে জেন এই শ্রেষ্ঠ -ধর্ম্ম
।।
পাঠ্য পুস্তকেতে আছে এক প্রস্তাবনা

অসাধ্য করিলে কর্ম্ম পায় সে লাঞ্ছনা
।।
ইহুদি দেশেতে ঘটে যাহা বলি এবে

মেষ পাল রাখিতেছে রাখালেরা সবে
।।
শূন্যেতে ঈগল পক্ষী শক্তিতে প্রধান

নিম্ন -দৃষ্টি রাখি করে শিকার সন্ধান
।।
মেষ শাবকেরা চরে মাতার নিকটে

লোভেতে ঈগল পক্ষী নিম্ন দিকে ছোটে
।।
অকস্মাৎ পদ নখে সাপুটি ধরিয়া

মেষ শাবকেরে লয়ে চলিল উড়িয়া
।।
হতবাক্ রাখালেরা শূন্য পানে চায়

শক্তি বলে সে -ঈগল মেষ লয়ে যায়
।।
দুষ্ট-বুদ্ধি দাঁড় কাক্ আসি হেন কালে

উড়িয়া বসিল গিয়া বট বৃক্ষ-ডালে
।।
প্রতক্ষ্যে দেখিল চক্ষে ঈগলের কাজ

দাঁড় কাক মনে ভাবে শুভ দিন আজ
।।

 

অই বেটা ডানা দুটো ভর দিয়া চলে
মুহূর্ত্তে মেষের বাচ্চা নিল অবহেলে
।।
আমারও তো দুই ডানা পায় আছে নখ

আমি কেন মিটা' ব না শিকারের শখ
।।
কাল শিখিয়াছি নীতি বসিয়া ও গোহালে

পণ্ডিত মশাই যাহা বলে পাঠশালে
।।
বালকেরা পড়িয়াছে শুনিয়াছি তাই

কাল যাহা শিখিয়াছি কাজেতে খাটাই
।।
তারা পড়ে বড় ক'রে ক'রে চেঁচামেচি

সব কটা কথা আমি মনে রাখিয়াছি
।।
দশ জনে পারে যাহা আমি তাহা পারি

পারি কিনা পারি হবে পরখ তাহারি
।।
ঈগলে পারিল যাহা মোর কি অসাধ্য?
কবি জনে ছড়া গাহে আমি কব গদ্য?
ওর দুই পাখা আছে আরো দুই পাও

তাহা ত আমারও আছে আর কিবা চাও ?
আহা কি নধর কান্তি বাচ্চাগুলি চলে

উপোসি 'থাকিব আমি বসে বৃক্ষ-ডালে
'কা চিন্তা মরণে রণে ' ঝাঁপ দিয়া পড়ি

আপাতঃ একটাকে নখে লয়ে উড়ি “
।।
এত ভাব ততক্ষণে মূর্খ দাঁড়কাক

উড়িয়া মিটাতে গেল শিকারের শখ
।।
শাবকের পৃষ্ঠো পরে যখনি পড়িল

কম্বলের মত লোমে পদ আটকিল
।।
হায়! হায়! একি দায় উড়া দূরে থাক্

চরণ ছাড়াতে নারে মূর্খ দাঁড় কাক
।।
ছট্ ফট্ করি পাখা লাগিল নাড়িতে

মেষ -শিশু ভীত হ'ল পাখার বাড়িতে
।।
হেন কালে রাখালেরা দৃষ্টিপাত করে

ছুটে গিয়া দাঁড় কাকে লয়ে এল ধ'রে
।।
শিকারী শিকার হল রাখালের হাতে

হাত ছোট আম বড় লোকে বলে তা'তে
।।
সকলের পক্ষে সব কাজ ঠিক নহে

যার কাজ তার সাজে লোকে তাই কহে
।।
স্বদেশী সাজিতে সবে হয়েছে উন্মত্ত

কেহ কি জান কি সেই স্বদেশীর তত্ত্ব
।।
দেশ যারা চেনে জানে দেশের খবর

স্বদেশী সাজুক তারা হয়ে একত্তর
।।
আমরা দরিদ্র সবে ঘরে নাহি অন্ন

দেনা -দায়ে বাঁধা সবে চির-অবসন্ন
।। 
বিভাগ হউক দেশ অথবা জুড়ুক

যা 'আছে রাজার মনে সে ভাবে করুক
।।
ভাগ হই জুড়ে রই তা'তে মোদের কি ?
কোন ভাবে মোদের কপালে নাহি ঘি
।।
বড়-জনে বড়-কথা বলে সর্ব্ব ঠাঁই

দাঁড় কাক হয়ে কেন শিকারেত যাই
।।
মনে ভাবি সব কথা বলিয়াছে শশী
 
কাজ নাই আমাদের ওই দলে মিশি
।।
আরো শুন বলি কথা কিছু মিথ্যা নয়

দরিদ্র ধনীতে পথে কিবা ভাব হয়
।।
এক সঙ্গে দুই জন চলে যদি পথে
 
ধনী দেয় নিজ বোঝা দরিদ্রের মাথে
।।
বোঝার বাহন করি তারে লয়ে যায়

বাড়ীর চাকর বলি দেয় পরিচয়
।।
দায় ঠেকে দীনজনে করে তোষামোদ

দায় গেলে তারে লয়ে করয় আমোদ
।।
উপহাসে পরিতোষ করে দীন জনে

ধনী কি দরিদ্র বন্ধু-হয় কোন দিনে
সমানে সমান হলে হয়ে থাকে ঐক্য

অসমে বিষমে লেখা নাহি কেহ সখ্য
।।
দরিদ্র কাঙ্গাল জাতি বন্ধু কেহ নাই

রাজার বিরুদ্ধে কেন তবে মোরা যাই
।।
দেশ-মাতা দেশ-মাতা আজ যারা বলে

গ্রামে গ্রামে এসে কথা বলে দলে দলে
।।

 

এতদিন পরে বুঝি মনে পড়িয়াছে
গ্রাম -ঘরে দেশ -ভাই বুঝি কিছু আছে
।।
মহাসুখে রাজ ভোগে লভিয়াছ সুখ
 
সেদিন পড়েনি মনে কঙ্গালের মুখ
।।
হঠাৎ দরদ কেন জাগিয়া উঠিল

হঠাৎ -দরদী -বন্ধু নহে কিন্তু ভাল
।।
পড়ে দায় পাড়া গাঁয়ে করে হাঁটাহাটি

এই ভাব ভাই সব নাহি হবে খাঁটি
।।
কি জানি স্বার্থের বিঘ্ন ঘটিয়াছে কত

তাই গাঁয়ে যাতায়াত করে অবিরত
।।
কপট বান্ধব সব দৃঢ় জেনো মনে
 
কিছুতে মিশ 'না কেহ তাহাদের সনে
।।
ওরা যাহা বলে আমি সব তাহা বুঝি

তথাপি ওদের কার্যে নাহি হ'ব রাজি
।। 
বিদ্যা, জ্ঞানে,ধনে,মানে বড় ওরা সব

জমিদারী মহাজনী অতুল বিভব
।।
ক্ষতি বৃদ্ধি দেশে যাহা ওরা তাহা জানে

ধনহীন অজ্ঞে তাহা বুঝিবে কেমনে ?
এরা যবে ধনী হবে মানি হবে সবে

দেশ চিনে দেশ -সেবা তখনি করিবে
।।
আজ শুধু চায় এরা আত্মার উন্নতি

যে -সাহায্য করে তা'তে ভক্তি তার প্রতি
।।
বিশেষ ইংরেজ রাজা সাম্যের সাধক

সমদৃষ্টি সবা 'পরে বিপন্ন - পালক
।। 
এ ভাব রাজার আছে তাই মোরা আছি!
না হে এ -হেন দেশে কোন ভাবে বাঁচি ?
দেশ দেশ করে যারা সবে দেশ -মান্য

আমাদিগে ' দেশ মধ্যে করে নাকি গণ্য
।।
কত অত্যাচার করে জমিদার গণ

কেহ কি তাহাতে বাঁধা দিয়াছে কখন ?
ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা বলে ব্রাহ্মণ কায়স্থ

কেহ কি ক'রেছে তার হৃদয় প্রশস্ত
।।
পশু হতে হীন ভাবে দেখে মো 'সবারে

ভাই হ'লে এই ভাব করে কি প্রকারে ?
তাই বলি স্বদেশীতে কাজ কিছু নাই

তা'তে দেশে স্থান মোরা পাই বা না পাই
।।
যেদিন বুঝিব সত্য আমাদের দেশ

প্রাণ দিয়া ঘুচাইব জননীর ক্লেশ
।।
আরো বলি শুন সবে ভবিষ্য -ঘটনা

এই হীন-দৃষ্টি দেশে কভু চলিবে না
।।
পতিত তাড়িতে এসেছিল মোর পিতা

কভু ব্যর্থ হবে নাহি তার কোন কথা
।।
আজ যারা পদতলে কাঁদিছে পড়িয়া

হরিচাঁদ -পরশেতে উঠিবে জাগিয়া
।।
অব্যর্থ অমোঘ শক্তি দিয়াছেন তিনি

জাগিবে জগতে যত পতিত -পারণী
।।
সেদিন নাহিক দূরে বছর পঞ্চাশে

ভাই ভাই হয়ে সবে রহিবে এ দেশে
।।
অপক্ক থাকিলে ফল চাহিলে পাকাতে

পণ্ডশ্রম হবে ভাই কার্য নষ্ট তা'তে
।। 
অপেক্ষা করিয়া রহ সবে এই ক্ষণ

আত্মোন্নতি করি সবে মিলি সর্ব্ব জন
।।
স্বদেশীর মূল -গুরু ব্যানার্জ্জী সুরেন্দ্র

চারিদিকে ঘুরে সবে তারে করি কেন্দ্র
।।
অম্বিকাচরণে জানি শিষ্য বলি তার

গুরু হতে শিষ্য কিবা বেশী ক'বে আর ?
সুরেন্দ্র ব্যানার্জ্জী পত্র দিয়াছেন মোরে

স্বদেশীতে নমঃশুদ্র মাতা'বার তরে
।।
ইহার উত্তর আমি দিয়াছি তখন

আমি বলিয়াছি লেখে শ্রী শশিভূষণ
।।
এ -জাতি দরিদ্র আজি লিখিয়াছি তাই

বিলাস ব্যসন কিছু এই ঘরে নাই
।।
বিলাতী কাপড় মাত্র এরা কিনেতেছে

অন্যান্য বিলাতী দ্রব্য কভু নাহি যাচে
।।

 

ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য শিক্ষিত যাহারা
বিলাতী ভাবের ভাবে মত্ত সবে তারা
।।
বস্ত্র কেনে অস্ত্র কেনে শাস্ত্র কেনে কত

তেল কেনে ফল কেনে জল শত শত
।।
চুড়ি কেনে ছুরি কেনে আরো কত ছাই

এ-জাতির ঘরে নাহি এ সব বালাই
।।
স্বদেশী সাজিতে হলে তারাই সাজুক

পাঞ্চজন্য -শঙ্খ দেশে বাজেত বাজুক
।।
নিপীড়িত জাতি যত আছে বঙ্গ দেশে

চিরদিন কাটে দিন দরিদ্রের বেশে
।।
রাষ্ট্র ক্ষেত্রে অর্থ ক্ষেত্রে অধিকার নাই

সব অধিকার নি 'ছে উচ্চ বর্ণ ভাই
।।
কোন কালে এতদিন উচ্চ বর্ণ সবে

অনুন্নত জনে নাহি দেখে ভ্রাতৃভাবে
।।
দাস -প্রায় তা সভায় রেখেছে পিছনে

তাই ঘোর অবিশ্বাস তাহাদের মনে
।।
একেবারে অন্ধ তারা আজি নহে আর

মন হতে গেছে কেটে কিছু অন্ধকার
।।
যদি উচ্চবর্ণ আজি তাহাদের চায়

সেই পথে আছে মাত্র একটি উপায়
।।
সরল উদার ভাবে ভাই বলি বুকে

টানিতে হইবে মনে - নহে মুখে মুখে
।।
সম্পদে বিপদে সুখ সমভাবে বাঁটি

ভাই হয়ে ভাই বলে দিতে হবে খাঁটি
।।
এই কার্য আমি দেখি আগে প্রয়োজন

নচেৎ হইবে সব ব্যর্থ আন্দোলন
।।
এই ভাবে পত্র লিখি দিয়াছে পাঠা'য়ে

পুনরায় পত্র দি'ছে সেই পত্র পেয়ে
।।
ওড়াকান্দী আসিবারে তিনি কৈল মন

দেখা যাক্ কিবা হয় ভবিষ্য - ঘটন
।।
এই মাত্র এই ক্ষণ বলি সবা 'ঠাঁই

স্বদেশী স্বদেশী করে কোন কার্য নাই
।।
দীন দুঃখী যত ভাই আছ এক দেশে

এক ভাবে চল ফেরো থাক এক বেশে
।।
জয় যদি হয় কিছু হউক সবার

পরাজয় হ'লে ভাগ সবে নি'ব তার
।।
এক সাথে মরি বাঁচি এক সাথে বসি

এক সাথে সবে কাঁদি এক সাথে হাসি
।।
এক সাথে সবে-মরা তা'তে বড় সুখ
 
ভাগে ভাগে মারা গেলে পাব বড় দুঃখ
।।
তাই বলি ভাই ভাই হও একত্তর

এক গান গা'রে তোরা এক ভাব ধর্
।।
এক করিবারে সবে হরিচাঁদ এল

তাঁরে ভুলে গেলে কিন্তু সকল বিফল
।।
আমাদের ভাই বন্ধু আর কেহ নাই

ভাই ভাই সব ভাই হ'রে এক ঠাঁই
।।
হয়ত স্বর্গে যাব না হয় নরকে

শত্রু কিন্তু মরে ভাই চক্ষের পলকে
।।
যুথ বাঁধি করি-দল চলে এক সাথে

যুথ -ভ্রষ্ট নাহি হয় কভু কোন মতে
।।
অগ্রণী হইয়া যেবা চলে যুথ -আগে

পিছে পিছে চলে সব দৃঢ় অনুরাগে
।।
অগ্র-করী কর্ম্ম দোষে পড়িলে নিগড়ে

পিছু -হটা করী দল যায় কিরে ছেড়ে ?
সাথে সাথে নিগড়েতে সবে বদ্ধ হয়
 
এক সাথে শোয় বসে এক সাথে খায়
।।
করী দল হতে এই শিক্ষা লহ ভাই

এক সাথে শোয়া-বসা-চলা-ফেরা চাই
।। 
এক মনে এক প্রাণে চল এক পথে

নিশ্চয় জাগিবে জাতি ভুল নাহি তা'তে
।।
এত বলি মহা প্রভু নীরব হইল

সভাবাসী সবে মিশি জয় ধ্বনী দিল
।।
সবাকারে সবে বলে 'সবে মোরা ধন্য

তারিতে পতিত জনে হরি অবতীর্ণ
।।

 

সেই হরি বংশে এল হরি পুত্র রূপে
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ পিতার স্বরূপে
।।
দীন জনে দয়া করে রাজ রাজেশ্বর

নিশ্চয় পতিত জনে করিবে উদ্ধার
।।
আজি হতে মোরা সবে তার বাক্য লয়ে

চলিব জীবন পথে এক দৃষ্টি চেয়ে
।।
কেহ বলে ওরে ভাই চিন্তা নাহি আর

নিজ হাতে ভার নিল শ্রী হরি কুমার
।।
কেহ বলে 'ওরে ভাই ভার নিল বটে
 
ভার কিন্তু দিতে হবে সবে অকপটে
।।
মুখে মুখে ভার দিলে কিবা কাজ হবে

মরিলে ত মর সবে আজি এক ভাবে'
।।
কেহ বলে ' কাটাকাটি কর কেন কথা

কাজ-ছাড়া যত কথা সব কথা বৃথা
।।
মুখে যদি নাহি বল তা'তে ক্ষতি নাই
 
মনে মনে প্রাণপণে কাজ করা চাই
।।
অপূর্ব্ব ভাবের ভাব হইল উদয়

মহাভাবে সভাশুদ্ধ ভূমিতে লোটায়
।।
অন্ধেরে দেখা'তে পথ দুঃখী-জনে আশা

ব্যথিতের ব্যথা নিতে মূকে দিতে ভাষা
।।
প্রাণ হীনে দিতে প্রাণ মৃতে দিতে সাড়া

ওড়াকান্দী অবতীর্ণ হরি -মনচোরা
।।
চরণ পরশে তাঁর সবে ধন্য হ'

কর্ম্ম দোষে দূরে থেকে মহানন্দ ম '
।।

 

ডক্টর মীডের ওড়াকান্দী পুনরাগমন 
ও স্থিতি 

কথাবার্ত্তা স্থির করি মীড চলি গেল

স্বজাতি -প্রধানে ডাকি প্রভুজী বলিল
।।
স্বজাতি সভায় সব হ'ল নিরূপণ

রাখিতে হইবে মীডে করিয়া যতন
।।
অতঃপর হ'ল দেশে স্বদেশি প্রচার

ইতিপূর্ব্বে করিয়াছি বর্ণনা তাহার
।।
প্রভুর চেষ্টায় সবে ভুলে আন্দোলন

প্রভু পুনঃ স্বজাতিকে করে আবাহন
।।
স্বজাতি প্রধান সবে উপস্থিত হ '

সাহেবে আনিতে সবে মনস্থ করিল
।।
সংবাদ পাঠালো সবে সাহেবের ঠাঁই

ওড়াকান্দী সাহেবের শীঘ্র আসা চাই
।।
আন্দোলন বার্ত্তা কিছু জানা'ল ইঙ্গিতে

প্রভু বাক্য সাহেব না পারিল লঙ্ঘিতে

প্রভুর নিকটে পুনঃ সংবাদ পাঠা '

শীঘ্র ওড়াকান্দী যাবে পত্রেতে লিখিল
।।
পূর্ব্বভাগে পাঠাইল অক্ষয় সুজনে

দেখিবে সে জমাজমি নিবে কোন্ খানে
।।
প্রভুর গৃহের কাছে পশ্চিমের দিকে

প্রভুর একটি ভিটা শূন্য পড়ি থাকে
।।
প্রভু বলে ' আপাততঃ থাক এই স্থানে

পরে আর দিব স্থান কিছু অন্য খানে
।।
স্থান দেখি সে অক্ষয় পুনঃ চলি গেল

সমস্ত বৃত্তান্ত তবে সাহেবে জানাল
।।
শুনিয়া সাহেব বলে হয়ে খুশি মন

বুঝিলাম গুরুচাঁদ অতি সৎজন
।।
অতএব বিলম্বেতে আর কার্য নাই

যত শীঘ্র পারি চল ওড়াকান্দী যাই
।।
শুনহে অক্ষয় আমি মনে যাহা ভাবি

নিত্য যেন আমি দেখি ওড়াকান্দী-ছবি
।। 
আমি ভাবি হেন ভাব কেন হয় মনে

দিবারাত্রি মোরে যেন সেথা কেন টানে
।।
গুরুচাঁদে ভাবি মনে বড় সুখ পাই

ইহার কারণ আমি বুঝিয়া না পাই
।।
জান ত ইংরাজ মোরা শহরেতে বাস

পাড়াগাঁয়ে যেতে মনে পাই বড় ত্রাস
।।

 

ওড়াকান্দী বিলাঞ্চল সুযোগাদি নাই
বহু কষ্ট হতে পারে মনে ভাবি তাই
।।
কিন্তু তবু কেহ যেন বসিয়া অন্তরে

ওড়াকান্দী যেতে মোরে সদা আজ্ঞা করে
।।
গুরুচাঁদ নাহি হবে সামান্য মানুষ

দেবতুল্য রূপ দেখি পরম পুরুষ
।।
নিশ্চয় যীশুজী মোরে যাইবারে কয়

চল চল শীঘ্র চল বৃথা কাল ক্ষয়'
।।
মাস-কাল মধ্যে মীড ওড়াকান্দী এল

প্রভুর ভিটার পরে তাঁবু বানাইল
।।
সমাদরে প্রভু তাঁরে বসাল সেখানে

দেশবাসী সুখী হ'ল মীড আগমনে
।।
প্রথমে মীডের হাতে প্রভু দিল হাত

রাজশক্তি ধরিবারে এই সূত্রপাত
।।
পতিত তরাতে এল পতিত পাবন

হরি-গুরুচাঁদ “ধ্বনি কর সর্ব্বজন
।।

 

বন্দনা

প্রণমি চরণে মাগো শ্রী হরি - রঞ্জিনী
শান্তিময়ী শান্তিদেবী ক্ষীরোদ - বাসিনী
।।
ত্রিলোক-পূজিতা দেবী পতিত পাবনী

সর্ব্ব শক্তিময়ী মাগো শক্তি প্রদায়িনী
।।
কৃপা কণা দানে ধন্য করিলে তারকে

হীরামন,মৃত্যুঞ্জয়,লোচন, গোলকে
।।
তোমার প্রসাদে মাগো হরি - ভক্ত গণ

প্রেম সুধা পানে মত্ত থাকে অনুক্ষণ
।।
সর্ব্বজীবে প্রাণ রূপে তুমি বিরাজিতা

জ্ঞান বুদ্ধি প্রেম ভক্তি তোমাতে আশ্রিতা
।।
তব করুণায় মাগো,জীবে তাহা পায়

কর্ম্ম দোষে এ অভাগা নাহি পেল হায়
।।
বিদ্যা রূপে জীব দেহে তুমি বীণাপাণি

প্রেম রূপে সত্যভামা জগৎ-জননী
।।
এ জগতে দেখি হায় মাতার স্বভাব

বরাভয় হাতে করি রহে শান্ত-ভাব
।।
কু-পুত্রের প্রতি মাতা নাহি করে রোষ

করুণায় করে ক্ষয় কু-পুত্রের দোষ
।।
রাতুল চরণে তাই এই নিবেদন

দয়া করি দয়াময়ী!দেহ গো চরণ
।।
পতি তব হরিচাঁদ ক্ষীরোদের নাথ

জীব কুলে দয়া করি এলে তাঁর সাথ
।।
কতই করুণা মাগো জীবেরে করিলে

পুত্র রূপে মহেশ্বর জগতে আনিলে
।।
তাঁর গুণ গাহি মনে এমত বাসনা

দয়া করি দেহ শক্তি কমল আসনা
।।
তব আগমন হৃদে আসুক আনন্দ

পদে পড়ি কাঁদে তোর পাপী মহানন্দ
।।

 

বর্ণানুক্রমিক বন্দনা

অনাদি অনন্ত দেব অনন্ত শায়িন্ 
আদ্যাশক্তি লক্ষ্মী রূপে শ্রী পদে আসীন্
।।
ইচ্ছাময় ইচ্ছারূপে সৃষ্টির বিকার

ঈক্ষণে ঈশ্বর ভাবে শকতি প্রচার
।। 
উর্ম্মিমালা রূপে যুগ ক্ষীরোদ সাগরে

ঊষা সন্ধ্যা কালাকাল নাহি তার নীরে
।।
ঋতু কাল ভেদাভেদ কিছু মনে নাই

৯কার বিকার শূন্য ধ্যান তত্ত্বে পাই
।।
এক সত্তা একাকার একক সকল

ঐশী শক্তি সেই বৃক্ষে ক্ষুদ্র এক ফল
।।
ওম্ ধ্বনি আদি নাথ অনাহত শব্দ

ঔরস - ঔষধি - রসে সৃজন আরদ্ধ
।।

 

 

 

 

কমল-কোরক-কান্তি কমলার কান্ত
খড়গতি খগপতি বহে যাঁরে শান্ত
।।
গগনে গরজি'ঘন গাহে যাঁর গান

ঘটন - কারণ যিনি বিভু ভগবান
।।
ঙ কার নাদ যাঁর প্রণব প্রকাশে

চঞ্চলা চরণ বন্দে ' চাহি অনিমেষে

জগত জন্মিল যাঁর জলদ জঠরে
।।
ঝর ঝর ঝরে ধারা ধরা রাণী শিরে

ঞ কার প্রকাশে যাঁর অস্তিত্ব বিকার
।।
টল টল টলে ধরা শুনিয়া টঙ্কার
।।
ঠমকি ঠমকি চলে শব্দ অনুপম

ডমরু বাজিয়া উঠে সমেতে বিষম
।।
ঢল ঢল সিন্ধু - বারি চরণ ধোয়ায়

ণত্ব - তত্ত্বাশ্রয়ী যিনি স্তত্বাহীন প্রায়
।।
তারক-তরণী -রূপে তরঙ্গ মাঝারে

থৈ থৈ সৃষ্টি লীলা ক্ষীরোদ সাগরে
।। 
স্থিতি সৃষ্টি প্রলয়াদি কারণ যে জন

নমঃ পদে নরগণ লহ রে শরণ
।।
পূর্ণানন্দ পূর্ণরূপ পূরণ-পূরণ

ফণীন্দ্র বিস্তারি ফণা করিছে ব্যঞ্জন
।। 
বরা ভয় দাতা যিনি বিধাতার বিধি

ভয় হারী ভবার্ণবে আপনি ভবাদি
।।
মনোময় মনোচোর মধুর মূরতি

যুগপতি যোগেশ্বর যোগে যাঁর প্রীতি
।।
রসমুর্ত্তি রসোজ্জল রসের আঁধার

লহরে লহরে চলে প্রেম-পারাবার
।।
বদন আকাশ যাঁর বারিধি বসন

শব্দ রূপে বিশ্ব সদা করিছে শাসন
।।
ষড়ৈর্শ্বয শালী যিনি নরের আকারে

সহস্র ফণায় পূজে অনন্ত যাঁহারে
।।
হরিচাঁদ রূপে সে এল ওড়াকান্দী

ক্ষম অপরাধ প্রভু কর জোড়ে বন্দী
।।
বিশ্বাস ভকতি হীন অতি দুরাচার

এ মরু হৃদয় সিক্ত হল না আমার
।।
গুরুদত্ত কৃপা বীজ কতই পড়িল

ভক্তিরস বিনে সব অঙ্কুরে শুকা'
।।
ধন, মান,যশঃ করি ঘুরি নিশিদিনে

সংসার - মরুর মাঝে মরিনু পরাণে
।।
দিনে দিনে সর্ব্বহারা কাঙ্গালের বেশে

কতই সহি যে জ্বালা আসিয়া বিদেশে
।।
আলোময় এ জগতে একা সেজে অন্ধ

নিরানন্দে বসে কান্দে দীন মহানন্দ
।।

 

ওড়াকান্দী গ্রামে ডক্টর মীডের প্রথম সভা

 

ওড়াকান্দী গ্রামে মীড বসতি করিল
নমঃশূদ্র সবে তাহে আনন্দিত হৈল
।।
ঠাকুরের ভিটা পরে তাবু খাটাইয়া

রহিল ডক্টর মীড আনন্দিত হইয়া
।।
অবিরত ঠাকুরের কাছে আসে যায়

প্রেমানন্দে আলাপনে সময় কাটায়
।।
রীতি-নীতি-চলা-ফেরা-আচার-পদ্ধতি

গুরুচাঁদ নিকটেতে জানিলা সম্প্রতি
।।
এই ভাবে কিছু কাল যবে গত হয়

গুরুচাঁদ প্রতি তবে মীড ডাকি কয়
।।
শুন শুন বড় কর্ত্তা আমার মনন

সভা ডাকিবারে চেষ্টা করিব এখন
।।
দেখিব শুনিব সব জাতির বারতা

চেষ্টা করে দূর করিবারে চাই ব্যথা'
।।
এ-হেন প্রস্তাব যদি সাহেব করিল

মহানন্দে গুরুচাঁদ করতালি দিল
।।
প্রভু বলে “শুন মীড আমার বচন

তোমার প্রস্তাব শুনি আনন্দিত মন
।।

দিন ধার্য করি দেহ সভার কারণ
আমি ডাকি আনি মোর স্বজাতির গণ
।।
বিদ্যাহীন জাতি মোর সভা নাহি চিনে

তোমার চেষ্টায় জ্ঞান হবে দিনে দিনে
।।
অতঃপর সভা লাগি দিন ধার্য হল

ঘরে ঘরে মহাপ্রভু সে বার্তা পাঠাল
।।
ঠাকুরের বাটী পরে সভা আয়োজন

জনে জনে নমঃশূদ্র করে আগমন
।।
প্রভুর ভক্ত যত 'মতুয়া ' উপাধি

প্রভু আজ্ঞা শিরোধার্য করে নিরবধি
।।
প্রধান ভকতগণে প্রভু বার্ত্তা দিল

আজ্ঞা পেয়ে প্রধানেরা উপনীত হ'
।।
আইল তারকচন্দ্র রসের সাগর

'কবি -রসরাজ ' বলি উপাধি যাহার
।।
প্রেমে ডগমগ তনু দুই চক্ষে ধারা

উর্দ্ধশ্বাসে ধামে ছুটে বাহ্য-স্মৃতি হারা
।।
'হরিচাঁদ গুরুচাঁদ 'ধ্বনি সদা মুখে

ঝলকে ঝলকে বারি বহে তার চোখে
।।
গলে বস্ত্র করজোড়ে উঠিলেন ধামে

বসন তিতিয়া গেছে শরীরের ঘামে
।।
শ্রী নাট মন্দিরে যথা প্রভু সমাসীন

ভূমিতে লুটায় যেন দীন হতে দীন
।।
তারকে দেখিয়া প্রভু বড়ই আনন্দ

মহা হর্ষে বলে কথা প্রভু গুরুচন্দ্র
।।
উঠহে তারক তুমি সাধুর প্রধান

শুভ সমাচার কহ জুড়াই পরাণ”
।।
আজ্ঞা মাত্র সে তারক উঠিয়া দাঁড়াল

ঝর ঝর দুই চক্ষে বহিতেছে জল
।।
প্রভু বলে “হে তারক মঙ্গল - ত সব?”
কান্দিয়া তারক তাতে করে উচ্চ রব
।।
অশ্রুজলে ভেসে বলে “মঙ্গল আলয়

তোমার স্মরণে অমঙ্গল দূর হয়
।।
দরশনে সর্ব্বশান্তি সকলি মঙ্গল

বাক্যসুধা পানে মরা -দেহে আসে বল”
।।
করুণা বিস্তার করি রাখিয়া সমুখে

তার তলে আপনারে রাখিয়াছ ঢেকে
।।
তাই এই দৃষ্টি আমি ফিরাই যেখানে

কৃপা দেখি দয়াময় তোমাকে দেখিনে
।।
এত কৃপা করিতেছে নাহি যার পার

তোমার কৃপাই ধন্য! কি বলিব আর
।।
কৃপাসিন্ধু মধ্যে প্রভু হাবু - ডুবু খাই

সকলি মঙ্গল প্রভু! অমঙ্গল নাই”
।।
এ-হেন বচন সাধু বলিয়া তখন

প্রভু আজ্ঞা ক্রমে করে আসন গ্রহণ
।।
আসিল দেবী চরণ সাধক প্রধান

বাণীয়ারী গ্রামে যিনি করে অধিষ্ঠান
।।
ঐকান্তিক নিষ্ঠা তাঁর গুরুচাঁদ পদে

'জয় জগন্নাথ ' বলি শ্রী চরণ বন্দে
।।
তেজঃপূর্ণ বপু তার প্রেমে ডগমগ

সর্ব্বকর্ম্মে ছিল তেঁহ সদা সুপারগ
।।
বহু দেশে ভ্রমে তিনি নাম প্রচারিতে

তাঁর যশোগাঁথা তাই উঠি চারিভিতে
।।
বরিশাল, যশোহর, খুলনা জেলায়

ঘরে ঘরে হরিনাম প্রচার করয়
।।
প্রভু-আজ্ঞা পেয়ে তেঁহ ধাইয়া আইল

ওড়াকান্দী ধামে আসি দরশন দিল
।।
গুরুচাঁদ -রূপ দেখি কম্পিত শরীর

ঘন শ্বাস বহে চক্ষে ঝড়ে প্রেম-নীর
।।
বাবা গুরুচাঁদ “বলি হুঙ্কার ছাড়িল

আকাশ চিরিয়া যেন বজ্র বাহিরিল
।।
চমকি চাহিয়া দেখে উপস্থিত জন

প্রেমে-মত্ত সিংহ যেন করিছে গর্জ্জন
।।

 

 

 

 

 

 

 

প্রেমানন্দে মহানন্দ আইল ধাইয়া
গুরুচাঁদে করে ভক্তি মন প্রাণ দিয়া
।।
দীর্ঘ শ্মশ্রু দীর্ঘ কেশ মতুয়ার গণ

হরি হরি বলি সবে করে আগমন
।।
প্রভু পদে প্রণমিয়া সবে বসি রহে

আজ্ঞা বিনা কোন জনে কথা নাহি কহে
।।
ওড়াকান্দী,ঘৃতকান্দী, মাচকান্দী হ'তে
 
নমঃশূদ্র সবে আসে নানাবিধ পথে
।।
সহস্র প্রমাণ হ,ল লোক সমাগম
 
সকলে নিস্তব্ধ, মানি 'সভার নিয়ম
।।
হেনকালে মীড আসি ঘাটেতে উদয়

প্রভুর নিকটে তবে সংবাদ পাঠায়
।।
শ্রুতমাত্র মহাপ্রভু সভাজনে বলে

সাহেব আসিলে মান দেখাব সকলে
।।
নমস্কার “শব্দ করি কর জোড় হও

বৃথা আলাপন ছাড়ি চুপ করে রও
।।
শ্রী বিধু ভূষণে ডাকি বলে দয়াময়

চল বিধু চল সবে ঘাটে যেতে হয়
।।
মন্ত্রীবর যজ্ঞেশ্বর রামতনু সাধু

সহকারী রূপে তবে সাথে চলে বিধু

আর আর মহাজন যতেক আছিল

সাহেবে আনিতে সবে ঘাট প্রতি গেল
।। 
এদিকে ডক্টর মীড নামিয়াছে কূলে

তাহা দেখি সবে দ্রুত সেই দিকে চলে
।।
প্রভু যবে সাহেবের নিকটে আসিল

নমস্কার বড় কর্ত্তা! “ সাহেব কহিল
।।
নমস্কার উচ্চারণ করে গুরুচন্দ্র

হাতে হাত ধরি দোঁহে করে করমর্দ্দ
।।
শ্রী বিধুভূষণ তবে বাহুরি আইল 
মহাপ্রভু সাহেবেরে পরিচয় দিল

এই গ্রামে বাস করে চৌধুরী উপাধি
 
ধনে, জনে, কুলে, শীলে, মান্য নিরবধি
।।
চৌধুরী বংশেতে এই বংশের প্রধান

শ্রী বিধুভূষণ নাম অতি গুণবান
।।
'বে ত ' সাহেব হস্ত প্রসারণ করি

শ্রী বিধুভূষণে হস্ত দেয় অগ্রসরি
।।
এই ভাবে ভীষ্ম দেব আর যজ্ঞেশ্বরে

ক্রমে ক্রমে মহাপ্রভু পরিচয় করে
।।
অতঃপরে সভাপ্রতি চলিলেন সবে

সকলে বসিয়া যেথা রয়েছে নীরবে
।।
অগ্রে মহাপ্রভু চলে মীড চলে পিছে

সাঙ্গ পাঙ্গ পিছে পিছে ছুটিয়া চলেছে
।।
পুত্তলিকা -প্রায় সবে রয়েছে বসিয়া

সাহেব আশ্চর্য হ'ল সে ভাব দেখিয়া
।।
যেই মাত্র গৃহ মধ্যে সকল পশিল

একসাথে সব লোকে উঠিয়া দাঁড়াল
।।
'নমস্কার ' শব্দ উঠে চারিদিক হ'তে

'নমস্কার ' শব্দ মীড বলে আচম্বিতে
।।
চারিদিকে ধীরে ধীরে মীড দৃষ্টি করে

অভূত-অপূর্ব্ব শোভা দেখে চারিধারে
।।
এক দিকে দাঁড়ায়েছে মতুয়ার গণ

সেই দিকে মীড দৃষ্টি করে ঘনে ঘন
।।
দীর্ঘ শ্মশ্রু দীর্ঘ কেশ গলে দোলে মালা

পরিধানে এক বস্ত্র স্কন্ধ দেশে তোলা
।।
সুদৃশ্য চেয়ারে মীডে প্রভু বসাইল

মীড পত্নী তস্য পার্শ্বে উপবিষ্টা হ'
।।
বাম পার্শ্ব ভাগে প্রভু আপনি বসিল

দেখিয়া সকল লোকে জয় ধ্বনি দিল
।।
অন্য অন্য প্রধানেরা বসে চারিভিতে

বসিল সভার লোক আনন্দিত চিতে
।।
অতঃপর সভাজনে প্রভু ডাকি কয়

শুনহে স্বজাতি সবে মম অভিপ্রায়
।।
হেথা বসিয়াছে দেখ মীড মহাপতি

পাদ্রী রূপে বঙ্গ দেশে করিছে বসতি
।।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free