আদিগীতিঃ ৪র্থ অংশ
মহাপ্রভু গুরুচাঁদের বিবাহ
জন্মিলেন উমাকান্ত প্রভুর কনিষ্ঠ।
সুকমল তনুখানি দেখিতে সুহৃষ্ট।।
বিচক্ষণ বুদ্ধি ধরে বাল্য কালাবধি।
দুই পুত্র করে লাভ হরি গুণ নিধি।।
একদিন শান্তিমাতা বলে প্রভু ঠাই।
মম নিবেদন প্রভু চরণে জানাই।।
গুরুচাঁদে বিয়ে দিতে মনন আমার।
নাহি জানি কিবা ইচ্ছা হয় আপনার।।
এত শুনি মহাপ্রভু সম্মত করয়।
বলে তুমি শুনে দেখ পুত্র কিবা কয়।।
শান্তিমাতা গুরুচাঁদে সে কথা জানায়।
এ প্রস্তাবে গুরুচাঁদ সম্মত না হয়।।
শান্তিমাতা কহে পুনঃ হরিচাঁদ ঠাই।
হরিচাঁদ বলে সেতো ভাল বলে নাই।।
নির্বোধের পরিচয় দিয়েছে নন্দন।
বারেক ডাকিয়া দাও আমার সদন।।
এত শুনি শান্তিমাতা পুত্রকে ডাকিল।
পিতৃস্থানে গুরুচাঁদ এসে দাঁড়াইল।।
গুরুচাঁদে হরিচাঁদ বলেন তখন।
আমার সংকল্পে বাঁধা দাও কি কারণ।।
গুরুচাঁদ বলে পিতা সংসারে ডুবিলে।
মায়াবদ্ধ হয়ে যাব আপনাকে ভুলে।।
আপনার পাদপদ্ম হ’ব বিস্মরণ।
সেই কথা মনে মনে ভাবি অনুক্ষণ।।
সেই হেতু বলিয়েছি মায়েরে আমার।
বুঝিয়ে করুণ যাহা ভাল আপনার।।
হরিচাঁদ বলে বাপ শুনহ এখন।
তা হ’লে যে হয় কাপুরুষের লক্ষণ।।
সংসার করিলে তুমি আমাকে পাবে না।
কেন বাপ কর তুমি এ মিথ্যা ভাবনা।।
সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম গৃহস্থেই করে।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় সুখে কাল হরে।।
গৃহধর্ম রক্ষা করি সত্য ভাষী হয়।
বানপ্রস্থ পরমহংস তার তুল্য নয়।।
গৃহস্থের গৃহ ধর্ম করা সুবিহিত।
তা না হ’লে হতে হয় স্বধর্ম বর্জিত।।
আশঙ্কাতে নাহি যদি সংসার করিবে।
হীনবীর্য বলে তব কলঙ্ক রটিবে।।
সংসারী হইবে বটে লিপ্ত না হইবে।
আত্মসুখ ভুলে বাহ্য সুখে না মজিবে।।
তোমা তরে এ সংসার সৃজন আমার।
তোমা বিনে কেবা নিবে বল এ ভার।।
সংসারী করিতে তোমা আমার মনন।
বৃথা আনাগোনা বাপ কর না কখন।।
এত শুনি গুরুচাঁদ সম্মত করিল।
মাতা পিতা উভয়েতে আশ্বস্ত হইল।।
অপরে শ্রীহরিচাঁদ পাত্রী দেখে এল।
শুভ দিনে গুরুচাঁদ বিবাহ করিল।।
কমলা জিনিয়া রূপ দেবী সত্যভামা।
রামকৃষ্ণ সুতা হ’ন গুরুচাঁদ বামা।।
গিরিরাজ সুতা পূর্বে দক্ষের নন্দিনী।
এ যুগে শ্রীগুরুচাঁদের হ’ন অর্ধাঙ্গিনী।।
শিশুকাল হ’তে মাতা সুমিষ্ট ভাষিণী।
প্রকাশ হইত যেন কোকিলের ধ্বনি।।
শৈল সুতা উপনীতা রামকৃষ্ণ ঘরে।
কন্যারূপে রহে মাতা গৃহ আলো করে।।
রামকৃষ্ণ সত্য বটে সেই গিরিরাজ।
তাহার পূর্বেতে যিনি হ’ন দক্ষরাজ।।
রামকৃষ্ণ রূপে এল এ লীলা প্রসঙ্গে।
সাতবেড়ে করে বাস অতি মনরঙ্গে।।
হরিচাঁদ আগমন তাহার ভবনে।
কন্যা দেখিবারে হেরি ভাবে মনে মনে।।
রামকৃষ্ণ বলে অদ্য মম সুপ্রভাত।
অধীনের বাসে এল প্রভু জগন্নাথ।।
প্রভু বলে এন তব কন্যা দেখিবারে।
রামকৃষ্ণ বলে প্রভু বৈস কৃপা ক’রে।।
বসিলেন হরিচাঁদ রামকৃষ্ণ ঘরে।।
ভক্তিচিত্তে রামকৃষ্ণ পদ পূজা করে।
(এক লাইন জ্ঞাপ)
প্রভু বলে এক কন্যা আছে তব ঘরে।
ডাকিয়া আনাও ভাই দেখিব মায়েরে।।
তনয়াকে রামকৃষ্ণ ডাকিয়ে আনায়।
ভক্তিভরে প্রণমিল মহাপ্রভু পায়।।
হরিচাঁদ নিজ ক্রোড়ে করেন ধারণ।
বলে মাগো কতদিন রবে এ ভবন।।
এই বাক্য হরিচাঁদ যখনে বলিল।
মায়ের বদন খানি আনন্দে ভরিল।।
তাই হেরি হরিচাঁদ বলে রামকৃষ্ণে।
নিজ গৃহে যেতে মাতা হ’য়েছে সতৃষ্ণে।।
এত শুনি রামকৃষ্ণ আনন্দে মাতিল।
অন্ধকার হতে যেন আলোতে পশিল।।
অবিলম্বে করা হ’ল মাঙ্গলিক কার্য।
বিবাহের দিন পরে করিলেন ধার্য।।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ গৃহেতে আইল।
শুভলগ্নে গুরুচাঁদ বিবাহ করিল।।
দক্ষালয়ে হ’য়েছিল পার্বতীর বিয়ে।
শিব সনে চাতুরী করেছিল ত্রয়ে।।
তেমনি করিতে চায় যত ত্রয়োগণ।
গুরুচাঁদ বলে দূরে থাক মাতৃগণ।।
বিধিমত কর্ম বিনে আমি নহে জানি।
চাতুরী না কর এবে যতেক জননী।।
ভয় ভীতে বামাগণ দূরে গিয়ে রয়।
লোচনের গৃহিণীর কাছে কেহ কয়।।
সামান্য নহে তো মাগো তোমার জামাই।
জামাতার বাক্য মোরা লজ্জিত সবাই।।
রামকৃষ্ণ নারী কহে কর আয়োজন।
সত্বরে করাতে হবে জামাতা ভোজন।।
সব নারী ব্যস্তচিত্তে তাহাই করিল।
অত্যানন্দে ভোজ ক্রিয়া সমাধা হইল।।
পরে সবে শুভ শয্যা করিল সত্বর।
রামকৃষ্ণ গৃহে হয় আনন্দ অপার।।
সস্ত্রীক শ্রীগুরুচাঁদ গৃহে চলি যায়।
প্রেমানন্দে রামাগণ দিল জয় জয়।।
নিজধামে উপনীত হ’ল গুরুচাঁদ।
ভক্তিভরে বন্দিলেন হরিচাঁদ পদ।।
মাতৃপদে প্রণমিলে মনের হরিষে।
পুত্রবধূ পেয়ে লক্ষ্মী প্রেম নীরে ভাসে।।
হরিজায়া হরজায়া এল এক ঘরে।
বিচরণ কহে বন্দি উভয় মায়েরে।।
গোলকচাঁদের উপর গুরুচাঁদের বিরক্তি ও হরিচাঁদ কর্তৃক প্রবোধ দান
একদিন শুন এক অপূর্ব কথন।
শ্রীধামে গোলকচাঁদ দিল দরশন।।
পৌষ মাসের দিনে ক্ষেতে পাকাধান্য।
বড়ই সুফল ভাবে ফ’লেছে আমান্য।।
গোলোকের প্রতি হরি বলেন বচন।
ধান্য পাকিয়াছে ক্ষেতে শুন বাছাধন।।
কৃষাণ নাহিক মেলে এদেশে এখন।
গুরুচাঁদ সঙ্গে করি করহ কর্তন।।
প্রভুর এতেক বাণী শুনিয়ে গোলক।
গুরুচাঁদে নিল সঙ্গে হৃদয় পুলক।।
উপনীত ধান্য ক্ষেতে কাটিবারে ধান।
প্রথমেতে শ্রীগোলক করে ধুমপান।।
এক দুই আটি কেটে করে ধুম পান।
গুরুচাঁদ বলে কাটা না হইবে ধান।।
পুনরায় এক আটি করিল কর্তন।
পুনঃ এসে ধুম পানে গোলক মগন।।
তাহা হেরে গুরুচাঁদ করে ছটফটি।
গোলক কাটিল ধান্য মাত্র দুই মুষ্টি।।
নেহারিয়া গুরুচাঁদ অধৈর্য হইয়া।
কাঁচি ফেলে গৃহে চলে ক্রোধযুক্ত হিয়া।।
উপনীত হ’ন হরিচাঁদের স্বকাশে।
গোলোকে নিন্দিয়া কত কন রুঢ় ভাষে।।
ভাল লোক দিয়েছেন ধান্য কাটিবারে।
এক মুষ্টি কাটে আর ধুমপান করে।।
এত বার যেই জন করে ধুম পান।
সেই ব্যক্তি কেমনেতে কাটিবে এ ধান।।
এসব বিরক্তি আমি সহিতে নারিব।
অন্য লোক দিয়া ধান বাড়িতে আনিব।।
এত শুনে গুরুচাঁদে কহে হরিচাঁদ।
কেন তাহে অন্তরেতে ভাবিছ বিষাদ।।
একটা পাগল মাত্র বিরক্ত ক’রেছে।
তাতে কেন এত জ্বালা তোমার হ’য়েছে।।
এমন পাগল কত শত শত আসি।
বিরক্তি করিবে তোমা সম্মুখেতে বসি।।
তখনেতে কি করিবে কহ দেখি বাপ।
কেমনে সহিবে তুমি সেই সব তাপ।।
তাতে যদি কর ক্রোধ কেহ না আসিবে।
কেমনে পতিত জমি আবাদ করিবে।।
বিশ্ববাসী সবাকার তুমি হবে গতি।
ভকত বলিবে তোমা অগতির গতি।।
গোলোকের বিরক্তিতে কেন দুঃখ চিতে।
ভূলোক বিরক্তি বল সহিবে কি মতে।।
এত শুনি গুরুচাঁদ ক্রোধ সম্বরিল।
পুনরায় ধান্যক্ষেত্রে উপনীত হ’ল।।
দেখিলেন গোলোকের নাহি পূর্বভাব।
মহাবেগে কাটে ধান্য বিপরীত ভাব।।
মুহূর্তেক কাটে ধান্য দশ বিশ আটি।
পলকে বাধিছে পুনঃ করি পরিপাটী।।
অনুমান দশজন লাগিত কৃষাণ।
একাকী গোলক তাহা কৈল সমাধান।।
নেহারিয়া গুরুচাঁদ বুঝিল তখন।
একাকী কাটিতে ধান্য গোলোকের মন।।
আমাকে যে কাটিবারে দিবে না এ ধান।
তামাক সেবন মোরে পরীক্ষার ভান।।
পাগলের মর্ম আমি এবে বুঝিলাম।
পাগলের পরীক্ষায় আমি ঠকিলাম।।
এত ভাবি গুরুচাঁদ তামাক সাজিয়ে।
গোলোকের হস্তে দিল হরিষ হইয়ে।।
তখনেতে কাটা হয়েছে সব ধান।
আনন্দে গোলক চাঁদ করে ধুম পান।।
এ বড় আশ্চর্য লীলা বড় চমৎকার।
কা’কে দিয়ে কিবা খেলে বোঝে সাধ্য কার।।
ধান্য কাটা করি শেষ পুলক অন্তরে।
উপনীত হইলেন প্রভুর গোচরে।।
উভয়ের মনে আর নাহিক বিষাদ।
নিশিযোগে শ্রীগোলক লভিল প্রসাদ।।
হরিচাঁদ উভয়েরে বলে মহাতত্ত্ব।
ভাবের পাগল তাহে হইল উন্মত্ত।।
মহাভাবে শ্রীগোলক নিশি পোহাইল।।
হরিগুরুচাঁদ প্রীতি হরি হরি বল।।
হরিচাঁদের ভক্ত গৃহে ভ্রমণ ও নিবারণ ঠাকুরের জন্মকথা
একদা শ্রীমহা মহাপ্রভু হরিচাঁদ।
তালতলা উপনীত ল’য়ে পারিষদ।।
তথা হ’তে ভক্ত গৃহে করিয়ে ভ্রমণ।
মল্লকাঁদি গ্রামে গিয়ে দেন দরশন।।
তথা হতে চলিলেন রাউৎখামার।
বহু ভক্তাশ্রম ভ্রমে আনন্দ অপার।।
সব গৃহে মহাপ্রভু করিয়ে ভ্রমণ।
সর্বশেষ বালাদের গৃহেতে গমন।।
হেনকালে এল তথা অক্রুর বিশ্বাস।
নিশ্চিন্তপুরেতে হয় তাহার আবাস।।
হরি নাম করে সদা অনুরাগ ভরে।
ক্ষণে ক্ষণে নৃত্য করে বাহু উর্দ্ধ ক’রে।।
একদা শুনহ এক অপূর্ব কথন।
জয়চাঁদ নামে ছিল ভক্ত একজন।।
রাউৎখামার বাসী অতি শিষ্টাচারী।
বাণিজ্য করে বলে বলিত বেপারী।।
বালাদের সঙ্গে ছিল বড়ই প্রণয়।
অধিক্ষণ থাকিতেন তাদের আলয়।।
গুরুচাঁদ ঢালী সনে কখন ভ্রময়।
পুত্রসম মনে মনে ভাবিত তাহায়।।
অষ্টজন পুত্র কন্যা জন্মেছিল তার।
শৈশব কালেতে তারা ত্যাজে কলেবর।।
অষ্টজন পুত্র কন্যা ম’রেছে অকালে।
সে কারণে জয়চাঁদ দহে দুঃখানলে।।
অক্রুর বিশ্বাস আসিতেন ওই গৃহে।
দেখে জয়চাঁদ থাকে অতি নিরুৎসাহে।।
অক্রুর বিশ্বাস বলে তোমাকে শুধাই।
মনক্ষুন্ন ভাবে কেন হেরিবারে পাই।।
জয়চাঁদ নারী দেবী নাম সূর্যমণি।
অক্রুর বিশ্বাস বলে সকাতর বাণী।।
শুন তবে খুল্লতাত দুঃখের বারতা।
মোদের জনম বুঝি বয়ে গেল বৃথা।।
পুত্র কন্যা অষ্ট জন না রৈল আমার।
একে একে সর্বজন শৈশবে সংহার।।
কি লাগিয়ে বল কাকা ভবে বেঁচে রই।
মনোদুঃখে ইচ্ছা হয় গলে ফাঁস লই।।
শ্রীঅক্রুর চন্দ্র বলে শুনহ বচন।
ভাবের কাঙ্গাল এবে হও দুইজন।।
হরিচাঁদ বলে সদা ডাক অনিবার।
বাঞ্ছা পূর্ণ করিবেন দয়ার আঁধার।।
সে অবধি স্বামী স্ত্রী তাহাই করিল।
নিজ বাস ত্যাজি সদা কাঁদিতে লাগিল।।
পথে পথে কেঁদে কেঁদে করেন ভ্রমণ।
জয়চাঁদ একদিন করিল দর্শন।।
হরিদাসপুরে গিয়ে রহে একঘরে।
নিশিযোগে জয়চাঁদ নদীর কিনারে।।
আকুল হইয়ে কাঁদে হরিচাঁদ বলি।
ধুলাতে পড়িয়ে ক্ষণে গায়ে মাখে ধুলি।।
হেনকালে হরিচাঁদ দিল দরশন।
সুযুপ্ত অবস্থা যেন হেন লয় মন।।
ব’লেছেন হরিচাঁদ শুন বাছাধন।
তোমার লাগিয়ে রাখিয়েছি দুইজন।।
একটি কুমারী আর একটি কুমার।
গৃহে যাও মেনে এবে বচন আমার।।
পুত্রটির নাম তুমি রেখ নিবারণ।
সেই পুত্র হ’তে দুঃখ হবে নিবারণ।।
জাগ্রত হইয়ে জয় ভাবে মনে মন।
কি দেখিনু কি হইনু না বুঝি কারণ।।
প্রভুর আশ্বাসবাণী কহে রমণীরে।
বিশ্বাসে হরিষ হ’য়ে এল নিজ ঘরে।।
অক্রুর বিশ্বাস ছিল বান্ধব আমার।
হরিচাঁদ দেখা দিল কৃপাতে তাহার।।
এত ভাবি দুইজনে কাঁদিতে লাগিল।
ক্রমে ক্রমে প্রভুবাক্যে সুফল ফলিল।।
তারামণি নাম্নী কন্যা পুত্র নিবারণ।
দোঁহাকে পাইয়ে দুঃখ হয় নিবারণ।।
হেন সত্যবাদী সেই অক্রুর বিশ্বাস।
উপনীত হ’ন তিনি মহাপ্রভু পাশ।।
হরিচাঁদপদে যিনি করে নিবেদন।
নিশ্চিন্তপুরেতে প্রভু করুণ গমন।।
সেই বাক্যে মহাপ্রভু সম্মত হইল।
শ্রীঅক্রুরে দয়াময় কহিতে লাগিল।।
কন্যা দেখিবার হেতু আমার মনন।
ভাল কন্যা কোথাও কি আছে বাছাধন।।
অক্রুর বলেছে কন্যা আছে দয়াময়।
অষ্ট কন্যা দেখাইব যেই কন্যা হয়।।
মহাপ্রভু বলে তবে চল মহাশয়।
কন্যা যদি দিতে পার বড় ভাল হয়।।
উমাচরণের বিয়ে দিতেই হইবে।
এ যাত্রা এসেছি বাপ শুধু তাই ভেবে।।
এত বলি স্ব স্ব ব্যস্ত অক্রুর হইল।
নিশ্চিন্তপুরেতে প্রভু উদয় হইল।।
অষ্ট কন্যা দেখিলেন প্রভু দয়াময়।
রাবণ মজুমদার এক মহাশয়।।
তাহার নন্দিনী বটে মনোনীত হ’ল।
পাত্রীকর্তা গৃহে নাই অক্রুর বলিল।।
হরিচাঁদ বলে তবে গৃহে যাই এবে।
তার ঠাই কথা বলে সংবাদ পাঠাবে।।
নহে আমি গুরুচাঁদে দিব পাঠাইয়া।
যাহা হয় ক’র তুমি তাহাকে লইয়া।।
এইমত কথা বার্তা বলি দয়াময়।
অক্রুরের গৃহে বসি ভোজন করয়।।
অক্রুরের নারী সতী সভক্তি অন্তরে।
করিল প্রভুর সেবা রাখি নিজ ঘরে।।
সেই সঙ্গে ভক্তগণ সেবা সমাধিল।
হরিধ্বনি দিয়া সবে রওনা করিল।।
রামাগণে হুলুধ্বনি করে ঘনে ঘন।
হরিধ্বনি করে পুন যত ভক্তগণ।।
আপন ভবনে প্রভু উদয় হইল।
হরিচাঁদ প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
উমাচরণ ঠাকুরের বিবাহ
মহাপ্রভু হরিচাঁদ নিজ বাসে গিয়ে।
জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদে দিলেন পাঠিয়ে।।
রাউৎখামার বাসী গুরুচাঁদ ঢালী।
গুরুচাঁদ সঙ্গে চলে হ’য়ে কুতূহলী।।
নিজ সহোদরসম ভাসে গুরুচাঁদ।
গুরুচাঁদ ঢালী পায় পরম আহ্লাদ।।
দুই গুরুচাঁদ চলে আনন্দ হৃদয়।
নিশ্চিন্তপুরেতে গিয়ে হ’লেন উদয়।।
অক্রুর বিশ্বাস হেরি পরম আনন্দে।
সমাদরে লইলেন দুই গুরুচাঁদে।।
প্রভু গুরুচাঁদ কহে অক্রুরের প্রতি।
কিবা ধার্য করিয়েছ বল হে সম্প্রতি।।
অক্রুর বিশ্বাস বলে কন্যা দেখে লও।
যাহা করিয়েছি দেখে শুনিবারে চাও।।
দেখা শুনা সব হবে বাকী কিছু নাই।
গুরুচাঁদ বলে তবে হোক আগে তাই।।
এত শুনি কন্যা আনি দেখান হইল।
কন্যা হেরি গুরুচাঁদ সন্তোষ হইল।।
রাবণে ডাকিয়ে কহে প্রভু গুরুচাঁদ।
কন্যা হেরি লভিয়েছি পরম আহ্লাদ।।
এবে যাহা করিবার বলুন আপনি।
রাবণ বলেছে বাপ শুন মম বাণী।।
বড়ই সৌভাগ্য আমি গণি যে আমার।
হরিপুত্র হবে পতি আমার কন্যার।।
এতে আর বলিবার কিবা আছে বাণী।
বড় সৌভাগ্যশালিনী আমার নন্দিনী।।
অন্য কথা নাই যদি নেন দয়াময়।
অতএব চল্ বাপ আমার আলয়।।
গুরুচাঁদ বলে এত আপনার ঘর।
ভিন্নভেদ নাহি কিছু ইহার ভিতর।।
রাবণ সন্তোষ হ’ল শুনে সেই বাণী।
বলে বাপ গেল তাপ তাও আমি জানি।।
যেন হেরি তেন পুত্র তুমি বাছাধন।
তব বাক্যে মম হৃদি হইল রঞ্জন।।
হেনভাবে মহানন্দ উভয় লভিল।
পরে বিবাহের দিন নিধার্য হইল।।
হরিচাঁদ পাশে গিয়ে কহে গুরুচাঁদ।
রাবণ মজুমদার পাইল আহ্লাদ।।
বিবাহের আয়োজন প্রস্তুত হয়েছে।
উমাচরণেরে কন্যা অর্পণ করেছে।।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ শুনে সুখি হ’ল।
গুরুচাঁদ ঢালী যিনি শ্রীধামেতে র’ল।।
মহাধুমধাম করে আয়োজন তার।
উভয় পক্ষেতে হয় আনন্দ অপার।।
এইভাবে উমাকান্ত বিবাহ করিল।
হরিগুরু মনপ্রীতে হরি হরি বল।।
অক্রুর বিশ্বাসের শ্রীধামে গমন ও মহাপ্রভুর সঙ্গে বাক্যালাপ
বিবাহের পর এক দিবসে বসিয়া।
অক্রুরের এক ভাব উদিল আসিয়া।।
ওঢ়াকাঁদি যেতে প্রাণ করে উচাটন।
নয়নেতে জলধারা হ’তেছে পতন।।
তিষ্ঠিতে না পারে কোথা হ’য়েছে এমন।
মন মধ্যে যেন ভাব কেমন কেমন।।
চলি যায় হরি ব’লে হেরিবারে হরি।
শ্রীহরি বলিতে দেহ উঠিছে শিহরি।।
এইভাবে পথিমাঝে করেছে গমন।
সোজাসুজি চলি যায় ভাবে নিমগন।।
সকল আইল যেন আছে একদিকে।
উত্তর-দক্ষিণ মাত্র হেরে মনোসুখে।।
অত্যাশ্চর্য ভাব হেরি ঝোরে দু’নয়ন।
মম তরে হরি করে এ আল পতন।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলি ছাড়ে হাই।
এক লক্ষ্যে চলে যায় ঘুরা ফেরা নাই।।
ঘৃতকাঁদি নামে গ্রাম তাহার দক্ষিণে।
উপনীত হইলেন অতি শুভক্ষণে।।
তথা হেরিবারে পায় প্রভু হরিচাঁদে।
মহান মুরতি হেরে মনের আহ্লাদে।।
ভক্তিভরে প্রণমিল হরিচাঁদ পায়।
হরিচাঁদ বলে বাপ চলেছে কোথায়।।
তব বাটী যাব ভেবে চলিয়েছি একা।
ভাল হ’ল তব সনে পথে হ’ল দেখা।।
এবে আর নাহি যাব তোমার ভবন।
চল যাই ওঢ়াকাঁদি আমরা এখন।।
তব সনে হরিকথা করি আলোচনা।
ঘুচাইব আজ তব মনের বেদনা।।
এত বলি অগ্রে চলে হরি দয়াময়।
পিছেতে অক্রুর চলে হৃদি ভাবময়।।
কিছুক্ষণ হেন ভাবে ক’রেছে গমন।
প্রভু বলে অগ্রে তুমি চল বাছাধন।।
অক্রুর চলিল অগ্রে পিছে হরি চলে।
অক্রুরের হৃদিমাঝে আনন্দ উথলে।।
কিছুদূর গিয়ে দেখে নাহি হরিধন।
একাই চলেছে পথে বিস্মিত তখন।।
কোথা গেল হরিচাঁদ ভাবিয়া না পায়।
বিস্মিত অন্তরে পুনঃ চারিদিকে চায়।।
কিবা হ’ল কি করিত ভাবিয়া আকুল।
অক্রুর সাজিল যেন প্রকৃত বাতুল।।
দু’নয়নে ঝরঝর ঝরে মাত্র বারি।
বলে হায় কোথা গেল মুকুন্দ মুরারি।।
ব্যকুলিত চিত্তে হ’ল শ্রীধামেতে উদয়।
দেখিলেন হরিচাঁদ রয়েছে নিদ্রায়।।
বড়ই বিস্ময় চিত্তে ভাবে ভক্তবীর।
এ কি খেলা খেল প্রভু কে করিবে স্থির।।
পথিমাঝে হেরিলাম সাধনের ধনে।
কিছু পথ এল প্রভু অধীনের সনে।।
পলক মধ্যেতে কেমনেতে এল ঘরে।
নিদ্রায় বিভোর হেরি শয্যার উপরে।।
একি অপরূপ খেলা বুঝিতে না পারি।
এত বলি অবিশ্রান্ত ভাবে ঝরে বারি।।
প্রভুপার্শ্বে আছে বসি আকুল হৃদয়।
নিদ্রা ত্যাজি উঠিলেন হরি দয়াময়।।
অক্রুরের পানে চাহি ব’লেছে তখন।
কিহে বাপু ওঢ়াকাঁদি এসেছ কখন।।
কোথা হতে এলে কহ কিবা প্রয়োজন।
ব্যাকুলতা ভাব কেন হয় প্রদর্শন।।
এত শুনি শ্রীঅক্রুর ক’রেছে উত্তর।
নাহি জান কেন মম ব্যাকুল অন্তর।।
এখন এসেছি আমি নাহি জান তাই।
কিবা প্রয়োজন তাহা জানা শুনা নাই।।
ঘৃতকাঁদি দক্ষিণে কে দেয় দরশন।
কেবা বল বলেছিল এহেন বচন।।
নিশ্চিন্তপুরেতে যেতে বাসনা অন্তরে।
ভাল হল হ’ল দেখা পথের মাঝারে।।
এবে আর নাহি যাব চল ওঢ়াকাঁদি।
অগ্রভাগে কে হাঁটিল কহ গুণনিধি।।
পরক্ষণে পিছনেতে গিয়ে হয় লুকি।
কেন বল কর তুমি হেন বুজরুকি।।
হরিচাঁদ বলে তুমি উন্মাদ হয়েছ।
অক্রুর বলেছে বটে তুমিই করেছ।।
হরিচাঁদ বলে তারে দেখ ঠিক করি।
অক্রুর বলেছে যশোমন্ত সুত হরি।।
হরিচাঁদ বলে কেন কহ এত ভুল।
অক্রুর বলেছে মম হরি সর্বমূল।।
হরিচাঁদ বলে আমি কিছুই না জানি।
অক্রুর বলেছে তুমি হও চক্রপাণি।।
হরিচাঁদ বলে অদ্য যাইনি বাইরে।
অক্রুর ব’লেছে তুমি অন্তরে বাহিরে।।
হরিচাঁদ বলে মোর পেরে ওঠা দায়।
অক্রুর ব’লেছে তাই হৃদে না জুয়ায়।।
হরিচাঁদ বলে তব সরল হৃদয়।
অক্রুর ব’লেছে তুমি নিজেই সদয়।।
মনের কল্পনা তব হেরি সর্বময়।
অক্রুর ব’লেছে তব নাম ইচ্ছাময়।।
হরিচাঁদ বলে তুমি হও সুচতুর।
অক্রুর ব’লেছে তব লীলা যে মধুর।।
চতুরের শিরোমণি তুমি দয়াময়।
চতুরালী কেন কর বল এ সময়।।
জানিয়ে অন্তর বার্তা চলা কি কারণ।
দেখা দিলে দ্বৈতরূপ করিয়ে ধারণ।।
হরিচাঁদ বলে ক্ষান্ত দাও ভক্তবর।
অক্রুর ব’লেছে যেবা বাসনা তোমার।।
এইভাবে হরি সনে বাদ অনুবাদ।
পুনঃ কহে অক্রুরের প্রতি হরি চাঁদ।।
শুন কহি ওহে বাপ স্বরূপ বচন।
তোমার সঙ্গেতে আমি আছি অনুক্ষণ।।
ভক্তঠাই বিকায়েছি এ দেহ আমার।
ভক্ত মম ধন মান সকল আঁধার।।
থাকি আমি ভকতের অন্তর বাহিরে।
ভক্তের সেবায় সেবি ভাসি প্রেম নীরে।।
ভক্ত মম মাতা পিতা ভক্ত মম গুরু।
ভকত রেখেছে নাম বাঞ্ছাকল্পতরু।।
সে কথায় কাজ নেই বাছারে আমার।
এবে তুমি চলে যাও রাউৎখামার।।
তুমি যাহা কর তাহা আমিই করিব।
খেলিবার যাহা কিছু আমিই খেলিব।।
প্রভু বাক্যে মহা সাধু বিদায় লইল।
হরিগুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
প্রভুর বাক্যে অক্রুরের রাউৎখামার ভ্রমণ
রাউখামার ঘর জয়চাঁদ নাম তার
তস্য পুত্র নাম নিবারণ।
ভ্রাতুষ্পুত্র সনাতন হরিভক্তি পরায়ণ
হরিনাম করে অনুক্ষণ।।
কনিষ্ঠ ছিলেন যিনি করিতেন মহাজনী
বড় ভাল বাসিত কীর্তন।
অতিসুমধুর স্বরে রামায়ণ গান করে
আসরেতে করিত নর্তন।।
শ্রীগোলক কীর্তনিয়া ধনঞ্জয় তথা গিয়া
গুরুবলি শিক্ষা করে গান।
গোলকের আশীর্বাদে পরম আনন্দে হৃদে
যশস্বী হইল নানা স্থান।।
একদিন সনাতন ভাবিল মনে মন
লুট দিয়ে শুনিব কীর্তন।
ধনঞ্জয় বলে দাদা তাহে কিছু আছে বাঁধা
বাটী আছে ভাই নিবারণ।।
নিবারণ নামে যিনি অতি সুগায়ক তিনি
হরিভক্ত স্বভাবে সুন্দর।
কীর্তন করিতে যবে মত্ত হরি-প্রেমার্ণবে
পুলকিত হইত অন্তর।।
প্রেমেতে পূর্ণিত কায় বয়ান বাহিয়ে যায়
প্রেম বারি বহে শতধারে।
বিমোহিত হ’ত প্রাণ হারাইত বাহ্যজ্ঞান
পরিতেন ধরা বক্ষ পরে।।
বাণিজ্য করিয়ে এল সবে বলে হ’ল ভাল
লুট দিয়ে ভাবিয়েছি মনে।
সনাতন বলে এবে নিমন্ত্রণ কর সবে
যেন তারা আসে সর্বজনে।।
এত শুনি কোন জন করে দিয়ে নিমন্ত্রণ
রাত্রিকালে এল বহুলোক।
বালা বংশধরগণ এল তারা জনে জন
সবাকার হৃদয় পুলক।।
শ্রীহরিচরণ বালা আর শ্রীফটিক বালা
অশ্বিনী তারিণী দুই ভাই।
বালা বংশে ষষ্ঠীচন্দ্র কীর্তনে যাহার আনন্দ
হরি বলি ছাড়িতেন হাই।।
এল বালকের গণ ওই বংশে যত জন
আর আর এল বহুজন।
সূর্য নারায়ণ ঢালী এল গুরুচাঁদ ঢালী
শ্রীদ্বারিকানাথ আর জন।।
এই মত গ্রাম বাসী মিলিল একত্রে আসি
মল্লিক বৈরাগী বৃন্দাবন।
হরিলুট দিয়া সবে মহানন্দ উৎসবে
আরম্ভিল নাম সংকীর্তন।।
শ্রীসনাতনের ঘরে সবে হরিনাম করে
কবি রসরাজ পদ যাহা।
গাহে মহাসংকীর্তন প্রেমবার উদ্দীপন
কেহ বলে মরি আহা আহা।।
ধনঞ্জয় হৃষ্টচিতে বসিয়েছে বারেন্দাতে
শুনিতেছে মধুর কীর্তন।
গানের স্বরেতে স্বর দিতেছে মধুর স্বর
বিন্দু বিন্দু ঝরে দু নয়ন।।
কেহ গায় বাহু তুলে কেহ ভাসে আখিজলে
কেহ পড়ে শয্যার উপর।
ষষ্ঠী বালা যেই জন প্রেমাবিস্ট তনুমন
হরি বলে ক’রেছে হুঙ্কার।।
শুনে হরি সংকীর্তন গ্রামবাসী বহুজন
এল সেই সনাতন ঘরে।
কেহ ঘরে কি বাহিরে কেহ বা চৌকি উপরে
প্রেমভরে হরিনাম করে।।
ক্ষণে ক্ষণে নিবারণ হয়ে আছে অচেতন
পুনঃ জেগে ব’লে হরিবোল।
শ্রীদ্বারিকানাথ যিনি নীরবে রয়েছেন তিনি
হৃদি মাঝে বহিছে হিল্লোল।।
ষষ্ঠী বালা হরি বলে ভাসে নয়ন জলে
বাবা বলে ধরে নিবারণে।
হরি বালা পদতলে ক্ষণে গিয়ে পড়ে ঢলে
ক্ষণে গিয়ে ধরে সনাতনে।।
উঠেছে প্রেম তরঙ্গ প্রেমদশা নহে ভঙ্গ
বামাগণে দিল জয় জয়।
অক্রুর বিশ্বাস যিনি হরিভক্ত চূড়ামণি
তিনি এসে কীর্তনে উদয়।।
বাড়িল প্রেম বন্যা দ্বারদেশে যত কন্যা
পুনঃ পুনঃ দিল হুলুধ্বনি।
কেহ বসি বারেন্দাতে ভাসিতেছে প্রেমস্রোতে
নয়নেতে বহে তরঙ্গিণী।।
সনাতন হেরে তাই বলে রে প্রাণের ভাই
একবার মোরে দেরে কোল।
এত বলি আগুন হ’য়ে নিবারণে ধরে গিয়ে
প্রেমাবেশে বলে হরিবোল।।
বংশের তিলক ভাই এতদিন চিনি নাই
অদ্য তাই জাগে মোর মনে।
ধন্য ভাই জন্মেছিল সাধুর চরণ পেলি
আমরা বঞ্চিত প্রেমধনে।।
হেরে কীর্তনের ভাব অক্রুরের মহাভাব
লম্ফ দিয়ে প্রবেশিল ঘরে।
প্রেমস্বরে হরি বলি দুই বাহু উর্দ্ধ করি
উঠে নিবারণ বক্ষ পরে।।
নাচে আর হরি বলে ভাসে দু’নয়ন জলে
তথা ছিল শ্রীযাদব ঢালী।
ওই দৃশ্য নেহারিয়ে কাঁদিতেছে আকুলিয়ে
হরি বলে হাতে দিয়ে তালি।।
পুনঃ কহে সনাতন ওহে ভাই নিবারণ
হরিবরে তুই জন্মেছিলি।
হরিপ্রেমে মগ্ন হিয়া গুরুপদে মন দিয়া
সৎপথে জীবন কাটালি।।
এইভাবে হয় নাম স্রোত বয় অবিরাম
শ্রীঅক্রুর নাচে বহুক্ষণ।
বাইরের লোক যারা অনেকে ব’লেছে তারা
প্রাণে মারা যাবে নিবারণ।।
বাহিরের ধ্বনি শুনি শ্রীঅক্রুর গুণমণি
বলে সবে না বল এমন।
খেলে হরি দয়াময় আমার কি আছে দায়
দেখ চেয়ে যেমন তেমন।।
হরিনামে মাতোয়ারা কেন যাবে প্রাণে মারা
হেরি ওই আঁখি মেলি চায়।
এত বলি গুণমণি লম্ফ দিয়ে তখনই
বসিলেন আনন্দ হৃদয়।।
বলিতে বলিতে কথা নিবারণ তোলে মাথা
সনাতন বলে কি বলিস।
যার হয় ভাবোদয় সে কি প্রাণে মারা যায়
তোরা তার মর্ম না জানিস।।
এতেক বচন শুনে সবিস্ময় সর্বজনে
কাহারো বা ঝরে দু’নয়ন।
কেঁদে কহে ধনঞ্জয় ভাই যেন বেঁচে রয়
হরিভক্ত পদে নিবেদন।।
কেহ করে হরিধ্বনি হুলুধ্বনি দেয় ধনী
ভাবের তরঙ্গ যে থামিল।
বহু কথা অন্তে সবে প্রেমানন্দে উৎসবে
হরি বলি লুট বিলাইল।।
হরিচাঁদ লীলাখণ্ড যেন অমৃতের ভাণ্ড
পান কর মনের আনন্দে।
শ্রীঅক্রুর প্রিয় ভক্ত রাউৎখামারে ব্যক্ত
হরি বল হরি প্রেমানন্দে।।
হীরামনের বাহ্যলীলা
এবে শুন হীরামন ঠাকুরের লীলা।
নানা স্থানে নানা ভাবে খেলে নানা খেলা।।
মধুর ভাবেতে ব্যক্ত লীলামৃত মাঝে।
লিখেছেন সুধাসম কবি রসরাজে।।
সেই অনুক্রমে কিছু করিব বর্ণন।
পাতলা গ্রামেতে উপনীত হীরামন।।
বাল্যক নামেতে ভক্ত বড়ই সুজন।
তার গৃহে বসিলেন এই হীরামন।।
পাগল হেরিয়ে সেই বাল্যক জননী।
তামাক সাজিয়ে এনে দিল সেই ধনী।।
পাগলের হাতে সেই হুকা যবে দিল।
হুকা ধরি হীরামন আঘাত করিল।।
আঘাত খাইয়ে বুড়ি ত্যাজিল জীবন।
হীরামন ঘরে গিয়ে বসিল তখন।।
গ্রাম্য লোক ধেয়ে এল শুনে সেই কথা।
সবে বলে কই সে পাগল গেল কোথা।।
মানুষ মারিল তারে ধর এইক্ষণ।
পুলিশ আনিয়ে তারে করহ বন্ধন।।
থানায় যাইয়ে শীঘ্র কর এজাহার।
কেহ বলে ধর তারে কেহ বলে মার।।
এই মত বলাবলি করে সব লোক।
এহেন কালেতে গৃহে আইল বাল্যক।।
সবে বলে তুমি ভাল পাগল পেয়েছ।
উপযুক্ত প্রতিফল আজ লভিয়েছ।।
হুকার আঘাতে তব মাকে মারিয়েছে।
তোমার গৃহের মাঝে বসিয়ে র’য়েছে।।
থানায় যাইয়া এবে এজাহার দাও।
পুলিশে ধরিয়ে দেহ ভাল যদি চাও।।
বাল্যক বলেছে বেশ ক’রেছে গোঁসাই।
মাতা গেল স্বর্গবাসে জেনে রাখ ভাই।।
এত শুনি সব লোক অবাক হইল।
নানাভাবে কটুবাণী কতই বলিল।।
নানাভাবে কটু কহি হইল বিদায়।
পাগলের নিকটেতে কেহ নাহি যায়।।
মাঠেতে মরেছে গাভী বৎস্য কাঁদে তথা।
পাগলের আঘাতে গৃহেতে ম’ল মাতা।।
শ্রীরাইচরণ নামেতে হয় কবিরাজ।
তিনি ভাবে পাগল কি খেলা খেলে আজ।।
পাগলের নিকটেতে যাওরে বাল্যক।
বাল্যক ব’লেছে আমি হই অপারগ।।
তুমি গিয়ে বল মোর পাগলের ঠাই।
গৃহেতে মরিল মাতা মাঠে মৈল গাই।।
এত শুনি গেল রাই পাগলের পাশে।
বিনয় বচনে কহে সকরুণ ভাষে।।
মরিয়েছে বৃদ্ধ মাতা তাহে নহে দুঃখ।
মাঠেতে মরিল গাভী ফেটে যায় বুক।।
বাছুরী কাঁদিয়ে ফেরে হাম্বা হাম্বা ক’রে।
শুনিয়ে কাতর ধ্বনি হৃদয় বিদরে।।
পাগল বলেছে রাই মম বাক্য ধর।
মায়ের কর্ণগোচরে শঙ্খধ্বনি কর।।
হুলুধ্বনি করুণ সে যতেক রমণী।
বৃদ্ধ মাতা সচেতন হইবে এখনি।।
আমাকে দেখিয়ে দাও গাভী আছে কোথা।
এখনে যাইব আমি শুন মোর কথা।।
এত বলি গাভীপার্শ্বে হীরামন গিয়ে।
বলে মাগো ওঠ এবে কেন গো শুইয়ে।।
শিশু ভগ্নি চেয়ে দেখ গোঙ্গাইয়ে মরে।
দুধ না খাইয়ে বল বাঁচে কি প্রকারে।।
এবে উঠে দুধ খেতে দে মা ভগিনীরে।
এত বলি পদাঘাত মারিল সজোরে।।
হাম্বা রব করি গাভী উঠিয়া দাঁড়ায়।
বাছুরের অঙ্গ চাটে হরিষ হৃদয়।।
বৎস্য ছেড়ে হীরামনে চাটিতে লাগিল।
দু’নয়নে বারিধারা বাহিত হইল।।
এদিকেতে রাই গিয়ে মায়ের গোচরে।
কর্ণমূলে মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি করে।।
গ্রাম্য লোকে ধ্বনি শুনে বলেছে হাসিয়ে।
শোনরে হতেছে বাল্যকের মা’র বিয়ে।।
এমত অযুক্তি বাণী বলে কত জনে।
মৃত মাতা পেল প্রাণ পাগলের গুণে।।
তাহা শুনি সর্বলোক অবাক হইল।
মরা বুড়ি প্রাণ পেল গাভীও বাঁচিল।।
কেহ বলে দেখ ভাই পাগল কোথায়।
সামান্য মানুষ কভু এ পাগল নয়।।
না বুঝিয়ে বাল্যকেরে অনেক নিন্দেছি।
বাল্যকের কাছে অপরাধী যে হয়েছি।।
বাল্যকের ঠাই সবে মাগে পরিহার।
বাল্যক বলেছে কিছু না জানি তাহার।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত পাগল গোঁসাই।
কখনে কি করে তাহা বুঝিয়ে না পাই।।
আমার নিকট কারো অপরাধ নাই।
দেখ কোথা গেল মোর পাগল গোঁসাই।।
এত শুনি সব লোক খুঁজিতে লাগিল।
বহু অন্বেষণ করি কেহ না পাইল।।
তথা হ’তে হীরামন লুক্কায়িত হ’ল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
আইচপাড়া গ্রামে পাগলের আশ্চর্য লীলা
তথা হ’তে হীরামন লোক চক্ষে অদর্শন
হইলেন পলক মধ্যেতে।
হরিচাঁদ হৃদে ধরে চলি যায় বায়ুভরে
উপনীত ধবোল বিলেতে।।
রামদাস ও লক্ষণ সহোদর দুইজন
জল মধ্যে নিগড়ায় ধান।
হরিষতে দুই ভাই কার্য করে সেই ঠাই
ছয় হস্ত বারি পরিমাণ।।
হাঁড়ির উপরে বসে কার্য করে অতি হর্ষে
দক্ষিণ দিকেতে শব্দ হয়।
শ্রাবণ মাসের দিনে বাতাস বহে দক্ষিণে
ওই শব্দ শুনিবারে পায়।।
ওগো আমি মরিলাম জল মধ্যে ডুবিলাম
কেবা আছে বাঁচাও আমায়।
বিলম্ব না কর আর রক্ষা কর এইবার
এবে বুঝি মম প্রাণ যায়।।
শুনিয়ে কাতর বাণী রামদাস হয় যিনি
ডেকে বলে লক্ষণের ঠাই।
কে যে কাতর স্বরে ডাকিতেছে বারে বারে
কর্ণ পেতে শোন ওরে ভাই।।
এত বলি দুই ভাই বলে কোথা চল যাই
ত্বরা করি উঠিল নৌকায়।
দ্রুত বেগে যায় বেয়ে পাগলকে নিরখিয়ে
ধরিবারে অতিব্যস্ত হয়।।
হীরামন অকাতরে বলিতেছে বারে বারে
একবার তুলে লহ মোরে।
হাবুডুবু খেয়ে মরি লহ তুলে কৃপা করি
যাব আমি যুধিষ্ঠির ঘরে।।
বিশ্বাসের নাম শুনে তুলে সেই হীরামনে
তরী বেয়ে চলিল সত্বরে।
বিশ্বাসের ঘাটে গিয়ে উপনীত দুই ভায়ে
নামাইতে প্রাণে আশা করে।।
হীরামন মনরঙ্গে সে তরীর গুরো ভেঙ্গে
তীর পরে নামিল যখন।
তারা নামে পিছে পিছে বিশ্বাসও বাটীতে আছে
পাগলকে চিনিল তখন।।
পিছে যদি এল দু’টো ধরিল চুলের মুঠো
মারে ভূষ লক্ষণের বুকে।
কোচ ধরি কোপ মারে লক্ষণের গাত্র পরে
অচেতন করে তারে রুকে।।
রামদাস হেরে তাই পড়ে সহোদর ভাই
ভয়ে ভীত করে পলায়ন।
দোঁহাকার মহাব্যাধি ছিল বহুদিনাবধি
সে ব্যাধি হইল মোচন।।
শ্রীযুধিষ্ঠির বিশ্বাস জীবনের নাহি আশ
হয়েছে ভয়ানক জ্বর।
দুইদিন কবিরাজ বলিয়ে গিয়েছে আজ
সুচিকিৎসা না চলিবে আর।।
বাঁচিবে না যুধিষ্ঠির সকলে করেছে স্থির
এদিকেতে এল হীরামন।
বসিয়েছে গৃহ মাঝ কি যেন কি করে আজ
সব লোক ভাবে মনে মন।।
যুধিষ্ঠিরের রমণী সাধনা নামিনী ধনী
উপনীত হীরামন পাশে।
অতি ভক্তিযুক্ত হয়ে গলেতে বসন লয়ে
বলিতেছে সকরুণ ভাষে।।
বিধবা হইলে আমি তাতে কি সন্তোষ তুমি
কহ দেখি আমার সদন।
বলিতে বলিতে বাণী হইয়ে আকুল প্রাণী
সকাতরে করেছে রোদন।।
এত শুনি সে পাগল বলে পাগলামি বোল
হারে মাগি কি করি এখন।
তোর ঘরে আমি যাই সময়েতে দুটো খাই
তোর যদি ঘটে দুর্ঘটন।।
এত বলি হীরামন উঠিলেন ততক্ষণ
উপনীত যুধিষ্ঠির পাশ।
বলিতেছে রোগী রোষী তুই হস বড় দোষী
হতে পারে এ জীবন নাশ।।
মরিতে যে হয় তোরে তবে তোর জ্বর সারে
তুই হলি সম্মানিত ব্যক্তি।
তোরে না মারিবে এবে মনের লাঘব হবে
এত বলি করে নানা উক্তি।।
পুনরায় হীরামন বীর রসেতে মগন
পদ দ্বারা ঝাড়িতে লাগিল।
পাগলের কৃপাবলে হরি হরি হরি বলে
যুধিষ্ঠির নয়ন মেলিল।।
চেতনা হইল পরে পাগলেরে দৃষ্টি করে
বলে মোর আর ভয় নাই।
এই যমদূতে হেরে যমদুত যায় দূরে
ঘুরে গেল আমার বালাই।।
পাগল ব’লেছে বাণী শুন গো সাধনা ধনী
দধি পান্তা দাও ওরে খেতে।
শুনিয়া সাধনা দেবী পাগলের পদ ভাবি
পান্তাভাত আনে তখনেতে।।
খাইলেন যুধিষ্ঠির হইল দেহ সুস্থির
আর হয় শক্তি সঞ্চার।
পরে সেই শয্যা ছেড়ে পাদাকায় ভর করে
প্রাঙ্গণেতে ভ্রমে তারপর।।
যুধিষ্ঠির কিছুক্ষণ করিছে পদচারণ
হেনকালে শুন বিবরণ।
নবীন কার্ত্তিক আসি দোঁহে কাঁদরী-নিবাসী
তথা কারে দিল দরশন।।
শ্রীনবীন যেই জন ভৃত্য রূপে সেই জন
ছিল এই যুধিষ্ঠির ঘরে।
তস্য ভ্রাতা শ্রীকার্ত্তিক রোগ হয় অত্যাধিক
উদরেতে আর নাহি ধরে।।
প্লীহা ও যকৃত আদি বাড়ে রোগ নিরবধি
কোন মতে আরোগ্য না হয়।
অব্যহতি পাবে ভেবে অত্যান্ত মনের ক্ষোভে
ধরে গিয়ে পাগলের পায়।।
লোহার গাতিতে ঘর শ্রীউমেশ নাম তার
খান বংশে জনম যে হয়।
সেও এসে সেই ক্ষণে করিল পদধারণ
হ’য়ে অতি কাতর হৃদয়।।
হীরামন তৎক্ষণাৎ করিলেন পদাঘাত
তাতে রোগ আরোগ্য হইল।
হেনকালে একজন এসে ধরে শ্রীচরণ
কাশীনাথ নাম তার ছিল।।
খড়মখালীতে ঘর খুন করি এক নর
ওই স্থানে রহে পলাইত।
পাগল জানিতে পারে অতিশয় ক্রোধ ভরে
তথা হ’তে হন অন্তর্হিত।।
সেই বাটী করে ঘর শ্রীউগ্র ও শ্রী ঈশ্বর
তারা পেল অতিশয় ভয়।
তাদের গো-গৃহে গিয়ে বার হস্ত বাঁশ পেয়ে
দুই খণ্ড করি হাতে লয়।।
অতীব ক্রোধিত হ’য়ে দ্রুত বেগে এল ধেয়ে
সজোরেতে করিল প্রহার।
আঘাত খাইয়ে পরে পড়ে কাশী ভূমি পরে
সবে ভাবে হইল সংহার।।
পাগল ক্রোধিত হ’য়ে বড় এক ঘরে গিয়ে
রহে যেন বীর অবতার।।
ভূমেতে পড়িল কাশী সব লোকে ভয়ে বাসি
নরনারী করে হাহাকার।।
প্রতিবেশী ছিল যত ধেয়ে এল অতি দ্রুত
সবে দেখে মরেছে মানুষ।
তারা কয় কি হইল পাগল কোথায় গেল
দেখে শুনে হইল বিহুশ।।
কর গিয়ে এজাহার পাগল ছেঁড় না আর
পুলিশেরে দেহ ধরাইয়ে।
কোথাকার সে গোঁসাই কিছুতেই নিস্তার নাই
কোথা যায় মানুষ মারিয়ে।।
গিয়ে যুধিষ্ঠির পাশ কেহ কহে কটু ভাষ
এজাহার করাই উচিৎ।
যুধিষ্ঠির বসে ভাবে দেখ তাহা মনে হবে
যাহা হয় কর সুবিহিত।।
নাহি বল কটু ভাষ যাও সবে নিজ বাস
নহে সবে থাক চুপ করে।
(এক বা দুই লাইন জ্ঞাপ)
মারিয়েছে এ পাগল কেন কর গণ্ডগোল
যাহা হয় হবে সে আমার।।
যুধিষ্ঠির অর্দ্ধাঙ্গিনী পাগলের ভক্তা তিনি
কহে গিয়ে পাগলের পাশ।
দুটো যে মরিয়ে র’ল কি করা উচিৎ বল
জ্বালাইয়া দিব নাকি রাশ।। (লাশ)
পাগল ব’লেছে হারে মরি শুধু তোর তরে
তবে তুই জল নিয়ে আয়।
ছুঁয়ে দিব সেই জল ঘুচে যাবে রে জঞ্জাল
ছিটাইয়া দিব সর্ব গায়।।
সেই জল এনে দিল পাগল ছুইয়ে দিল
সাধনা লইল সেই জল।
ছিটাইল সযতনে প্রাণ পেয়ে দুইজনে
আঁখি মেলে বলে হরিবল।।
হেরিয়ে আশ্চর্য কর্ম বুঝিতে না পারে মর্ম
সকাতরে কহে কোন জন।
ধর তার শ্রীচরণ ধন্য হবে এ জীবন
ভাবের পাগল হীরামন।।
এই মত সর্ব জ্জন হ’য়ে ব্যাকুলিত মন
অন্বেষণ করিতে লাগিল।
কেহ বলে এই ঘরে ছিল ত আড়ার পরে
এত বলি চৌদিকে ঘেরিল।।
পাগল গৃহেতে নাই কেহ গিয়ে দেখে তাই
সে বলেছে কোথা লুকাইল।
করে বহু অন্বেষণ নাহি পায় দরশন
তাহে সবে বিস্ময় মানিল।।
যুধিষ্ঠির পাশে গিয়ে সবাই আকুল হিয়ে
সকাতর বলেছে বচন।
যুধিষ্ঠির বলে এবে অন্বেষণে নাহি পাবে
নিজ গৃহে কর হে গমন।।
মানুষের কৃপা হ’লে আপনি আসিয়ে মিলে
অন্বেষীয়ে পাওয়া না যায়।
যেদিন করুণা হবে নিজে এসে ধরা দেবে
নিজে খুঁজে কেবা তারে পায়।।
শুনে সবে সে বচন হ’য়ে বিষাদিত মন
চলি যায় নিজ নিজ ঘর।
পাগলের ঘাত খেয়ে পুনশ্চ জীবন পেয়ে
হইল অক্ষয় কলেবর।।
সাধু যদি কৃপা করে কর্মপাশ যায় দূরে
বিশুদ্ধ ভকতি সেই পায়।
তার হয় ভাবোদয় যদি হয় ভাগ্যোদয়
এড়াইতে পারে মায়া পাশ।
পবিত্র স্বভাবধারী মুখে বলে হরি হরি
শেষ হয় প্রেমরাজ্যে বাস।।
সাধুদ্বেষী যেবা হয় শুন তার পরিচয়
ব্যাধিযুক্ত হবে সেই নর।
রৌরক নরকে মজে শাস্তি দেয় যমরাজে
মাথে করে দণ্ডের প্রহার।।
করিলেও মহা পুণ্য পাপ মধ্যে হয় গণ্য
ডোবে সদা মোহের বিকারে।
নাহি পায় অব্যাহতি ভুঞ্জয় নানা দুর্গতি
মুণ্ডে বাজ ঠেকাতে না পারে।।
হরিনাম সার করি ভবনদী দাও পাড়ি
যম ভয় হবে নিবারণ।
ত্যাজিয়ে সংসার মায়া লভয় গুরুর দয়া
হরিপদে দেও তনু মন।।
পাগলের ভবানীপুর গমন
পুনঃ একদিন এল সেই হীরামন।
উপনীত যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ভবন।।
যুধিষ্ঠির বিশ্বাসের প্রতি ডেকে কয়।
ভবানীপুরেতে যাব ওহে মহাশয়।।
মম সঙ্গে ভৃত্য তব দেহ ত একজন।
বেড়াইয়ে এসে পুনঃ দিব দরশন।।
যুধিষ্ঠির সেই বাক্যে স্বীকার করিল।
শ্রী নবীন পাগলের সঙ্গেতে চলিল।।
ভবানীপুরেতে আছে গরুমারা ট্যাক।
দৈব গরু মেরেছিল বাঘ আসি এক।।
সেই স্থানে আছে ভয় জানে সর্বজন।
সেই পথ দিয়ে চলিলেন দুইজন।।
ভবানীপুরেতে ভ্রমে অনেকের ঘরে।
বাঘের ভয়ের কথা সদা মনে করে।।
নবীনের অন্তরেতে সদা সেই ভয়।
সন্ধ্যা ঘোর হ’ল তবু পাগল না যায়।।
নবীন ভেবেছে মনে হইল রজনী।
কি যেন কি ঘটে পথে কভু নাহি জানি।।
বিনয় বচন কহে পাগলের ঠাই।
চল প্রভু এবে মোরা গৃহে চলে যাই।।
পাগল বলেছে মোরা যাইব এখন।
ক্ষণকাল থাক বাপু হ’য়ে সুস্থ মন।।
এত বলি অন্য গৃহ ভ্রমণ করিল।
নিবিড় আঁধার ক্রমে তথায় হইল।।
আতঙ্ক বাড়িল অতি নবীনের মনে।
পাগল বলেছে তারে মধুর বচনে।।
অন্ধকার দেখে বুঝি প্রাণে হ’ল ভয়।
তবে আর বিলম্ব যে উচিৎ না হয়।।
এত বলি দোঁহে মিলি চলিলেন পথে।
নবীন পারে না পথ নির্ভয়ে চলিতে।।
পাগল ব’লেছে তোর এত কেন ডর।
তবে তুই মম কাঁধ ভালো ক’রে ধর।।
চেয়ে দেখ উর্দ্ধদিকে কিবা দেখা যায়।
তাহা শুনি শ্রী নবীন উর্দ্ধপানে চায়।।
মুহূর্তেক পরে কহে সেই হীরামন।
এইবার শ্রী নবীন দেখ রে এখন।।
নিম্নে চাহি সে নবীন করে দরশন।
নিহারিয়ে নবীনের সবিস্ময় মন।।
পরে সে আশ্চর্য কাণ্ড সবাকে বলিল।
শুনিয়ে সকল লোক আশ্চর্য গণিল।।
নবীন ব’লেছে ভাই কি বলিব বল।
মনে হয় দুই তিন পদ বাড়াইল।।
এর মাঝে বাড়ি এসে হইনু উদয়।
হেন শক্তি মানুষের অসম্ভব হয়।।
কেহ বলে অপ্রমিত শক্তি ইনি ধরে।
মনে বলে ভাবে যাহা পারে করিবারে।।
জলে স্থলে সমভাব বিমান বিহারী।
বানর লক্ষণ যেন অনেকে নেহারী।।
শ্রীনবীন কেঁদে কয় যুধিষ্ঠির পাশে।
পাগল চিনিতে নারি মম কর্মদোষে।।
সারিল অসাধ্য ব্যাধি মারিয়ে আমায়।
তথাপি চিনিতে নারি হায় হায় হায়।।
পাগল বলিয়ে তবু সদা করি জ্ঞান।
অদ্য হেরি এই মর্ম হ’য়েছি অজ্ঞান।।
এইমত সবিনয় করি কাঁদে কত।
বলে আমি অদ্য হয়ে আছি জ্ঞানহত।।
পাগলের এই লীলা অতীব আশ্চর্য।
কবি কহে পান কর এ লীলা মাধুর্য।।
হীরামনের গোপীনাথপুরে ক্ষুদ ভক্ষণ
গোপীনাথপুরে বাস শ্রীরাম সুন্দর।
আনন্দা নামিনী হয় নন্দিনী তাহার।।
ঈশ্বর মণ্ডল হয় তাহার নন্দন।
ভগিনীকে ভ্রাতা সম ভাবে অনুক্ষণ।।
বিধবা হইয়ে ধনী থাকে পিত্রালয়।
পাগলেরে ভক্তি করিতেন অতিশয়।।
তস্য খুল্লতাত হয় শ্রীগৌরী চরণ।
খুড়িমাকে সে আনন্দা বলেছে বচন।।
শুন কাকী মন কথা তোমা আমি কই।
আসিতেছে হীরামন তুমি ভাজ খই।।
আনন্দার বাক্য শুনি কহে কাকী মাতা।
কোথাকার সে পাগল কে শুনে সে কথা।।
এইমত কহে মাগো অযোগ্য বচন।
আনন্দার অন্তরেতে পাইল বেদন।।
পৌষ মাসের দিন রসের সময়।
রস জ্বালাইতে কাকী ঘুরিয়ে বেড়ায়।।
পরে সেই রস জ্বালি স্নান সমাপিল।
পরে গিয়ে সেই খৈ তৈয়ার করিল।।
আনন্দার ভ্রাতৃবধূ নাম তার বামা।
পুকুর ঘাটেতে চলে কক্ষে করি ধামা।।
বস্ত্র পরিষ্কার করে পুকুরের জলে।
হীরামন উপনীত হ’ল সেই স্থলে।।
বামা প্রতি হীরামন বলেছে বচন।
কাহার রমণী তুই ওরে বাছাধন।।
করুণ স্বরেতে বলে কি বলিব আমি।
সকল জানিতে পার কহ দেখি তুমি।।
হীরামন বলে আমি পারি তা বলিতে।
তুই হোস্ আমাদের ঈশ্বর বর্ণিতে।।
বড় ভয় হয় বুঝি তোর হৃদিমাঝ।
মহতীর কর্ম এক করে রাখ আজ।।
মৃত্তিকা গুলিয়ে মোর মাথা ধুইয়ে দে।
পুত্রেস্টি যজ্ঞের ফল এবে করে নে।।
ভয়ে ভীতে সেই ধনী তাহাই করিল।
সযতনে পাগলের মাথা ধোয়াইল।।
পাগল নামিল গিয়ে পুকুরের জলে।
বামাকে চাহিয়ে পুনঃ হীরামন বলে।।
শৈবাল হ’য়েছে দেখ পুকুরের জলে।
জানিস কি এ শৈবাল জন্মে কোন কালে।।
নিত্যানন্দ শিরে মাথা কাঁদা মেরেছিল।
সেইদিন এ শৈবাল জনম লভিল।।
বুঝিতে নারিবি তাহা ব’লে কিবা হ’বে।
মোর লাগি খুদ অন্ন রাঁধ গিয়ে এবে।।
এমত শুনিয়ে ধনী গৃহেতে চলিল।
আনন্দার নিকটেতে সকল বলিল।।
শুনে বলে বধূ তুমি কর গিয়ে তাই।
আসিতেছে আমাদের পাগল গোঁসাই।।
এত শুনি যায় বধূ খুদ রাঁধিবারে।
স্নান করি হীরামন আইলেন ঘরে।।
হেরিয়ে আনন্দময়ী পতিত চরণে।
গৃহ মাঝে নিয়ে পরে বসায়ে যতনে।।
ভক্তি ভরে সে আনন্দা খই এনে দিল।
ক্রোধভরে হীরামন গালি যে পাড়িল।।
তোর কাকীমার এই আস্বাদ জিনিষ।
বল দেখি কেন তুই মোরে খেতে দিস্।।
খুদ রাঁধিবারে তুই বলিলি কাহারে।
কেন তুই সেই খুদ না দিস আমারে।।
এত বলি সেই খই দূরেতে ফেলায়।
ক্রোধ চিত্তে হীরামন উঠে যেতে চায়।।
সে আনন্দাময়ী কেঁদে ধরিল চরণ।
বলে আমি খুদ এনে দিতেছি এখন।।
পদে ধরি হীরামনে আনন্দা রাখিল।
পরে খুদ অন্ন এনে পাগলেরে দিল।।
খুদ অন্ন খাইলেন পরম হরিষে।
তথা হতে অন্তর্হিত হন অবশেষে।।
পাগলের লীলাখেলা আশ্চর্য কথন।
গুরুচাঁদ পদ ভাবি কহে বিচরণ।।
পাগলের পুকুরিয়া হ’তে অন্তর্ধান
সদা বীর করুণা রসেতে মাখা তনু।
দেহ বলে পবনের পুত্র সেই হনু।।
একদিন উপনীত পুকুরিয়া গায়।
জল মধ্যে হীরামন সাতারিয়ে যায়।।
ডুমুরিয়া যাইবার ক’রেছে মনন।
এক যবনের সনে পথে দরশন।।
তাহার বসতি হয় পুকুরিয়া গায়।
তার নারী মৃতবৎ হয় কলেরায়।।
কোন মতে প্রতিকার নাহি হয় তার।
অনুক্ষণ আঁখিজল ঝরে সে মিয়াঁর।।
পথিমধ্যে সেই মিয়াঁ পেয়ে হীরামনে।
কত অনুনয় করে কাতর বচনে।।
বড় দায় ঠেকিয়েছি শুন হে গোঁসাই।
এতক্ষণ বুঝি মোর নারী বেঁচে নাই।।
কলেরায় মৃতবৎ হইয়ে র’য়েছে।
মনে হয় এতক্ষণ আছে কিনা আছে।।
আপনার যেতে হবে ধরি রাঙ্গা পায়।
দয়া করি উঠুন হে আমার নৌকায়।।
এমত বলিয়ে মিয়াঁ কাঁদিতে লাগিল।
কৃপা করি তার গৃহে গোঁসাই চলিল।।
গৃহে গিয়ে মারে লাথি সে রোগীর শিরে।
মিয়াঁ ভাবে সর্বনাশ গেল বুঝি মরে।।
ক্রোধে মিয়াঁ উচ্চৈঃস্বরে সবাকে শুধায়।
ধর ধর পাগলেরে জাতি মেরে যায়।।
এত শুনি বহু মিয়াঁ করে আগমন।
পাগলেরে ধরিবারে ধায় সর্বজন।।
নৌকা বেয়ে ধরিবারে যায় হীরামনে।
জলে চলে হীরামন পবন গমনে।।
ধরিতে নারিল যত যবন সন্তান।
মিয়াঁর রমণী কাঁদে পেয়ে প্রাণদান।।
কি হেরিনু ওরে আল্লা ভাবিয়ে না পাই।
কোথা গেলরে বাজান পাগল গোঁসাই।।
কেবা তারে এনে দিবে দয়া যে করিয়া।
এমত বলিয়ে কাঁদে আকুল হইয়া।।
সব মিয়াঁ দেখিলেন নারী মরে নাই।
এক মিয়াঁ কেঁদে বলে আর মিয়াঁ ঠাই।।
ওরে মিয়াঁ ভাই মোরা অন্যায় ক’রেছি।
পাগল বলিয়ে যেন কারে হারায়েছি।।
পুনরায় চল সবে ওরে মিয়াঁ ভাই।
গৃহেতে আনিব মোরা পাগল গোঁসাই।।
এত বলি সব মিয়াঁ ধাইয়া চলিল।
নদীর কিনারে তারা পাগলে দেখিল।।
ধরিবারে সব মিয়াঁ ভাবে মনে মন।
লম্ফ দিয়ে নদী মধ্যে পৈল হীরামন।।
হংসাকারে ভেসে যায় মধুমতী জলে।
সব মিয়াঁ দেখে বসে সে নদীর কূলে।।
কেহ বলে ওরে আল্লা এ কোন মানুষ।
দেখে শুনে আমরা যে হইনু বিহুশ।।
সামান্য মশায় না ত হইবে এজন।
নিশ্চয় হইবে জানি কোন মহাজন।।
আল্লার নফর ইনি বুঝিনু এখন।
কেহ বলে ও যে সে পাগল হীরামন।।
এক মিয়াঁ ডেকে বলে ওরে মিয়াঁ ভাই।
অগ্রে কেন বলিলি না আমাদের ঠাই।।
তা হ’লে কি মোরা তারে দিতাম ছাড়িয়া।
তার পদ তলে দেহ দিতাম ঢালিয়া।।
এইমত সব মিয়াঁ কাতর বচনে।
আপন গৃহেতে চলে প্রতি জনে জনে।।
ক্রমে তাহা অনেকেই শুনিতে পাইল।
বহুজন তাহে যেন বিস্ময় মানিল।।
এদিকেতে হীরামন তীরেতে উঠিল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
পাগলের ডুমুরিয়া গমন
ডুমুরিয়া বাসী ভক্ত সূর্য নারায়ণ।
বড়ই সরল চিত্ত হরি পরায়ণ।।
সিকদার বংশে হয় জনম তাহার।
কবি রসরাজ দলে ছিলেন দোঁহার।।
হীরামন পদে ভক্তি সুদৃঢ় ভাবেতে।
হীরামন গুণ গায় দিন কিবা রাতে।।
মাঝে মাঝে হীরামন সেই গৃহে আসি।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেন কোথা সূর্যমাসী।।
গৃহে যদি না থাকিত সূর্য নারায়ণ।
অন্য গৃহে যাইতেন সেই হীরামন।।
যে দিবসে সূর্য মাসী থাকিতেন ঘরে।
হীরামন থাকিতেন অত্যানন্দ ভরে।।
এই দিন গৃহে আছে সূর্য নারায়ণ।
পূর্বদিক হ’তে আইলেন হীরামন।।
আসামাত্র পাগলামি করে হীরামন।
বাহির হইতে নারে যত রামাগণ।।
সেই গৃহে ছিল এক রাখাল বালক।
তাকে তাড়া করে যেন জলন্ত পাবক।।
ভয় পেয়ে সে রাখাল পালাইয়া যায়।
বাড়ি ছাড়া প্রায় সবে পাগলের ভয়।।
গোলক নামেতে সূর্য নারায়ণ ভ্রাতা।
সূর্যকে চাহিয়ে তিনি বলে রুঢ় কথা।।
তোমা সনে আমি আর কভু না থাকিব।
বিভাগ করিয়া দাও পৃথক হইব।।
তোমার পাগল নিয়ে তুমি সুখে রও।
পাগলের এ বিরক্তি তুমি সুখি হও।।
সহ্য না হইবে কভু এই পাগলামি।
নিশ্চয় পৃথক অন্ন খাইব যে আমি।।
রাখাল আসিতে নারে গোয়ালের কাছে।
মরিবে পরের ছেলে ভয় পেয়ে পিছে।।
তুমি ভাই পাগলেরে রাখ সযতনে।
দিবানিশি পুষ্প দান কর গে চরণে।।
আমি তাই পারিব না জানিও নিশ্চয়।
এ সব বিরক্তি মম সহ্য নাহি হয়।।
এত শুনি হীরামন করিল গমন।
ভ্রাতা প্রতি সূর্য বলে শোন্ অভাজন।।
যে জনারে পদে ধরে গৃহে নিতে নারে।
করুণা করিয়ে তিনি আসে তোর দ্বারে।।
ভক্তি করে কতজন কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে।
নিজ গৃহে নয় কেহ চরণ ধরিয়ে।।
নিজগুণে যার গৃহে করে পদার্পণ।
কোটিযজ্ঞফল প্রাপ্ত হয় সেই জন।।
এহেন রতন তুই হেলায় হারালি।
পাগল বলিয়ে তারে উপেক্ষা করিলি।।
এত বলি আঁখিজল করে ছল ছল।
কেঁদে বলে কোথা গেল আমার দয়াল।।
বহু অপরাধী আমি সে রাঙ্গা চরণে।
তব মুখে সাধু নিন্দা শুনিনু শ্রবণে।।
আর তাহে তুই হোস মোর নিজ ভ্রাতা।
তাহে যেন স্কন্ধচ্যুত হ’ল মম মাথা।।
শোন্ মূর্খ যেই স্থানে সাধু নিন্দা হয়।
অশান্তির কেন্দ্রস্থল জানিবি নিশ্চয়।।
দুঃখ ভোগ করে যেই আজীবন ভরি।
তাহাদের প্রতি বাম সদা রহে হরি।।
সাধুহিংসা অপরাধে মুণ্ডে বাজ পড়ে।
চিরকাল ভুঞ্জে দুঃখ যমে দণ্ড করে।।
হায় হায় কি করিলি আরে রে গোলক।
নিজ হাতে জ্বেলে দিলি জলন্ত পাবক।।
বাক্যবাণ বিদ্ধ হ’ল আমার শরীর।
কোন মতে নাহি পারি হইতে সুস্থির।।
এভাবেতে কাঁদে সেই সূর্যনারায়ণ।
অবিশ্রান্ত ভাবে তার ঝরে দু’নয়ন।।
পুনঃ বলে পৃথকান্ন হ’তে পার এবে।
বিভাগ করিয়ে রহ যেবা যাহা পাবে।।
আক্ষেপোক্তি করি কাঁদে দহে কলেবর।
পাগল গোঁসাই বলি করে হাহাকার।।
বহুক্ষণ পরে ক্রমে সুস্থির হইল।
হরি-গুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
পাগলের রায়পুর গমন
রায়পুর করে বাস মতুয়া গোবিন্দ।
হরিনাম নিতে তার পরম আনন্দ।।
হরিচাঁদ মূর্তিখানি ভাবয় হৃদয়।
দিবানিশি হরি নাম গাহে সর্বদায়।।
তাহার অগ্রজ হয় দুই সহোদর।
জ্যেষ্ঠ হয় তারাচাঁদ মধ্যম ঈশ্বর।।
সবার কনিষ্ঠ হয় মতুয়া গোবিন্দ।
তিন ভ্রাতা করে বাস হৃদয় আনন্দ।।
গুরু হয় হীরামন বানর প্রধান।
পাগলের পদে করে আত্মস্বার্থদান।।
সেই গৃহে আইলেন পাগল হীরামন।
গোবিন্দ গোবিন্দ বলি ডাকে ঘনে ঘন।।
গোবিন্দ ছিলেন ঘরে হইল বাহির।
পাগলে হেরিয়ে করিলেন নতশির।।
পূবের পোতার ঘরে বৈসে দুইজনে।
হরিকথা বলিতেছে আনন্দিত মনে।।
তিন দিবা সেই ভাবে রহে দুইজনে।
(লাইন জ্ঞাপ)
ভয়ে কেহ দোঁহা পাশে কভু নাহি যায়।।
এহেন সময় নীলমণি তথা এল।
ঈশ্বরের পানে চাহি কহিতে লাগিল।।
কাহারে দেয়েছ স্থান থেক সাবধান।
মারা ধরা বকাবকি করে মতিমান।।
ঈশ্বর বাছার বলে ছাড় গণ্ডগোল।
সে ভাবের কোন কিছু না করে পাগল।।
তিন দিন গৃহ মাঝে বসি দুই জন।
দোঁহে মিলি আছে মহাভাবে নিমগন।।
মিছামিছি কেন তুমি কহ হেন ভাষ।
সাধু হিংসা না করিও আমাদের পাশ।।
নীলমণি কহে পুনঃ শুনহ বচন।
ডুমুরিয়া করে বাস সূর্যনারায়ণ।।
এ পাগল গিয়েছিল তাহাদের ঘরে।
অসহ্য ভাবেতে তথা উপদ্রব করে।।
দেখ যেন তোমাদের না করে তেমন।
সে কারণ তোমাদিকে ব’লেছি এমন।।
এইমত বলাবলি করে দুইজন।
রাম রাম বলি বের হৈল হীরামন।।
সঙ্গে সঙ্গে শ্রীগোবিন্দ করিল গমন।
শুধুমাত্র বলিলেন আরে দুরাত্মন।।
চলিলেন দুগোঁসাই আইচ পাড়ায়।
উপনীত যুধিষ্ঠির বিশ্বাস আলয়।।
যে গৃহে সেই দিবা স্বজাতি ভোজন।
বিপুল ভাবেতে হইয়েছে আয়োজন।।
বহুলোক সমাগম হ’য়েছে তথায়।
সেই স্থানে দু’গোঁসাই হইল উদয়।।
যেই স্থানে রান্না কার্য করিতেছে সবে।
হীরামন তথা যায় মনে উৎসবে।।
নবকৃষ্ণ নামে ব্যক্তি মহামান্যমান।
সমাজের কর্তা তিনি আছে সেই স্থান।।
যাকে যাহা বলে কার্য করে সেই মত।
সকলেই কার্য করে হয়ে অনুগত।।
পাগলে দেখিয়ে তিনি বলেছে তখন।
ইহাকে দিও না স্থান শুন সর্বজন।।
সকল জাতির অন্ন যথা তথা খায়।
এ পাগল এই স্থানে শোভা নাহি পায়।।
কোথা হতে কি লাগিয়ে এল এ পাগল।
সমাজের মাঝে কিন্তু হবে গণ্ডগোল।।
হেনকালে যুধিষ্ঠির বলেছে বচন।
আপনার এই বাক্য শোভে না কখন।।
হেথা রৈলে আপনার জাতিনাশ হবে।
আমি এ পাগল নিয়ে রাখিতেছি তবে।।
পাগলের চিন্তা কভু নাহি আপনার।
আমার উপরে রইল পাগলের ভার।।
তবু কহে নবকৃষ্ণ বিদ্রুপ বচন।
ক্রোধান্বিত হইলেন তাহে হীরামন।।
কদীর পত্র উপরে বমন করিল।
রাশিকৃত বমনান্ন সকলে হেরিল।।
হীরামন বলে অন্ন দাও তো বাছিয়া।
কোন কোন জাতির অন্ন বেড়াই খাইয়া।।
কোনটা মুচির অন্ন কোনটা ঋষির।
বাছিয়া বাছিয়া সবে করে দাও স্থির।।
অন্নে উঠে ধুম্ররাশি হেরে সর্বজন।
যুধিষ্ঠির শিরে যেন অমনি পতন।।
নবকৃষ্ণে কহিতেছে সেই যুধিষ্ঠির।
একে এক অন্ন বেছে করে দাও স্থির।।
শুধুমাত্র সমাজের কর্তা সাজিয়েছে।
মানুষ চিনিতে শক্তি কই লভিয়েছে।।
এইমত বারে বারে বলে যুধিষ্ঠির।
ভয়ে ভীত সর্বজন হইল অস্থির।।
নবকৃষ্ণ বলে গিয়ে পাগলের ঠাই।
অপরাধ ক্ষমা কর শুনহ গোঁসাই।।
না চিনিয়া আপনাকে নিন্দা করিয়েছি।
শ্রীচরণে অপরাধী তাতেই হয়েছি।।
মায়াগণ্ডি মাঝে আমি আছি অনুক্ষণ।
চিনিতে শকতি নাই মানুষ রতন।।
অজ্ঞান আঁধারে ডুবে আছি অনুক্ষণ।
বিহুশ হইয়ে আছি অন্ধের মতন।।
ভ্রমের অতল পঙ্কে হয়ে নিমজ্জিত।
মানুষ চিনিতে শক্তি না হ’লে কিঞ্চিত।।
নিন্দিয়েছি মনে মনে করি অহংকার।
সমূলেতে দর্প চূর্ণ হ’য়েছে আমার।।
দয়া কর দয়াময় অভাগার প্রতি।
অভয় প্রদানে কর অজ্ঞানের গতি।।
সর্ব জীবে সব দয়া যাহার হৃদয়।
ঈশ্বর সদৃশ ব্যক্তি সেই জন হয়।।
তোমাকেই বর্তমান হেরিলাম তাই।
ক্ষমা কর হে দয়াল অন্য গতি নাই।।
এত বলি নবকৃষ্ণ কেঁদে পড়ে পায়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
তখনেতে হীরামন সে কদন্ন খেয়ে।
গোবিন্দ হস্ত ধরি চলিলেন ধেয়ে।।
সব লোকে বলে কোথা পাগল গোঁসাই।
কোথা গেল কোথা গেল রব মাত্র তাই।।
চারিদিকে সব লোকে করে অন্বেষণ।
খুঁজিয়ে না পেয়ে সবিস্ময় মন।।
কেহ কেহ নবকৃষ্ণে বলে মন্দ বাণী।
ওই বেটা তাড়াইল হেন গুণমণি।।
উদ্বমন অন্ন যদি পাগল না খে’ত।
অন্নভাবে মাতুব্বর বহু দুঃখ পেত।।
কৃপার সাগর সে পাগল হীরামন।
কৃপাকরি ত্যজ্য অন্ন করিল গ্রহণ।।
পাগল অদ্ভুত লীলা করিয়ে প্রকাশ।
অদৃশ্য হইল ক্রমে ছড়িয়ে আবাস।।
হেন অপরূপ লীলা নহিলে না হ’বে।
হীরামন প্রীতে হরি বল ভক্ত সবে।।
পাগলের ইলিশ মৎস্য ভক্ষণ
পুনঃ একদিন সেই ভাবের পাগল।
ডুমুরিয়া হ’তে চলে বলে হরিবোল।।
নড়াগাতী হাটে গিয়ে হ’লেন উদয়।
রায়পুর যাবে বলে ঘুরিয়ে বেড়ায়।।
ঈশ্বর বাছাড় যায় সাচেদাহ হাটে।
পাগলের চিন্তা যেন জাগে হৃদিপটে।।
গিয়ে দেখে বহু মাছ সে হাটে এসেছে।
মৎস্য হেরি পাগলেরে স্মরণ পড়েছে।।
মনে ভাবে এই মৎস্য পাগলে খাওয়াব।
পাগল খাইলে মৎস্য আনন্দ পাইব।।
কৃপা করি আসে যদি মোদের ভবন।
তবে অন্তরের আশা হইবে পূরণ।।
যদি নাকি এই মৎস্য না করে ভক্ষণ।
নিশ্চয় ভীবনে গিয়ে ত্যজিব জীবন।।
মনে মনে এইমত ভাবনা করিয়ে।
ডাকিতেছে মনে মনে আকুল হইয়ে।।
এদিকেতে হীরামন অন্তর জানিয়ে।
নড়াগাতী হাট মাঝে বেড়ায় ঘুরিয়ে।।
উমেশচন্দ্র বৈরাগী আর নীলমণি।
নড়াগাতী হাটে ছিল দুই মহাজ্ঞানী।।
এ দোঁহাকে হীরামন করিয়ে দর্শন।
দোঁহে প্রতি বলে তিনি মধুর বচন।।
রায়পুর যাব আমি গোবিন্দের ঘরে।
তোরা দোঁহে নেরে আজ মোরে সঙ্গে করে।।
ঈশ্বর কিনিছে মাছ সাচেদাহ হাটে।
আমাকে খাওয়াতে তার বাঞ্ছা হৃদিপটে।।
সেই মাছ খেতে হ’বে যাইয়ে তথায়।
তোরা দোঁহে সেই ঘাটে নামাস আমায়।।
দোঁহে বলে মম সঙ্গে পারিব না নিতে।
হীরামন বলে কোন ভয় নাই চিতে।।
তাহারা ব’লেছে তুমি দেখ অন্য নাও।
মোদের কি ক্ষতি হবে যাও বা না যাও।।
বহুবার বলি মোষে উঠিল না নায়।
পরম উল্লাসে হীরামন হেটে যায়।।
নৌকা ছাড়া উপনীত গোবিন্দের ঘরে।
শ্রীগোবিন্দ বসাইল অতি ভক্তি ভরে।।
ক্ষণকাল পরে দোঁহে সে ঘাটে উদয়।
পাগল এসেছে তথা শুনিল উভয়।।
হাট হ’তে গৃহে এসে বাছার ঈশ্বর।
পাগলে হেরিয়ে তার প্রফুল্ল অন্তর।।
পদধৌত করিবারে ঘাটেতে চলিল।
ঈশ্বরের প্রতি দোঁহে বলিতে লাগিল।।
পাগল এসেছে নাকি তোমাদের ঘরে।
ঈশ্বর ব’লেছে তিনি এল দয়া করে।।
তারা বলে এ পাগল কখন এসেছে।
তিনি বলেন সূর্য অস্ত যখন হয়েছে।।
দোঁহে বলে কি যে আশ্চর্য ব্যাপার।
বিশ্বাস করিতে নারি হেন ব্যাপার।।
তোমাদের এ পাগল সামান্য ত’ নয়।
ইহা কি মানুষ পারে কহ মহাশয়।।
মোরা ছিনু নড়াগাতী হাটেতে যখন।
আমা দোঁহে বলে কত অমৃত বচন।।
তোমাদের বাটী নাকি আসে অবিরত।
তাহাই বলিয়ে মোরে বলে নানা মত।।
ঈশ্বর আমার লাগি মাছ কিনিয়েছে।
আমাকে সেবিতে তার বাসনা হ’য়েছে।।
সে কথা না করি গ্রাহ্য পাগল ভাবিয়া।
কেমনে আইল তাই না পাই বুঝিয়া।।
ঈশ্বর ব’লেছে ভাই শুন সমাচার।
পাগলে চিনিতে শক্তি না হয় আমার।।
গিয়েছিনু সাচেদাহ হাটে আমি ভাই।
এনেছি ইলিশ মাছ সত্য বটে তাই।।
সাচেদাহ হাটে আমি উদিনু যখন।
ডালাপূর্ণ মৎস্য নিয়ে এল একজন।।
বলে ভাই কৃপা করি ডালাখানা ধর।
নামাইয়া দেখিলাম মৎস্য বড় বড়।।
মৎস্য হেরে পাগলের কথা পড়ে মনে।
মনমত মৎস্য কিনে লইনু তখনে।।
পাগলে খাওয়াব মৎস্য ভাবিনু তখন।।
অন্তর্যামী এ পাগল বুঝি লয় মন।।
তাই এসে কৃপা করে অধীনের ঘরে।
পাগলে চিনিতে শক্তি কেবা বল ধরে।।
সামান্য নহে ত কভু পাগল আমার।
নিশ্চয় জানিও তিনি রুদ্র অবতার।।
কোথা থেকে মৎস্য কিনি কোথা থেকে জানে।
এহেন মানুষে বল চেনে কোন জনে।।
সবার অন্তর বার্তা পারে বুঝিবারে।
জেনে শুনে তবু কেহ চিনিতে না পারে।।
এত শুনি দোঁহে মিলি বিস্মিত হইল।
ধন্য ধন্য বলি শেষে গৃহেতে চলিল।।
এদিকেতে সেই মৎস্য করিল রন্ধন।
রন্ধন করিছে আর করিছে ক্রন্দন।।
ভক্তিভরে সে ধনী রান্না সমাপিল।
দুই সাধু এক ঠাই ভোজনে বসিল।।
ভক্তিভরে ভুঞ্জাইল গোবিন্দের নারী।
অবিরত দু’নয়নে বহে প্রেমবারি।।
সেবা করে মনোনীত দুই মহাজন।
বলে অদ্য বড় ভাল হইল ভোজন।।
হীরামন বলে অদ্য হ’ব হনুমান।
যত দিবি তত খাব আন্ আন্ আন্।।
গোবিন্দ বলেছে তবে ত্বরা এনে দাও।
যাহা কিছু আনিয়াছ সব দিয়ে যাও।।
যত দেয় তত খায় কুলাতে না পারে।
গোবিন্দের নারী কহে পতি সমিভ্যারে।।
কি করিব বল নাথ পারি না কুলা’তে।
সীতা পরাজিতা হয় হনুকে ভুঞ্জাতে।।
শ্রীগোবিন্দ হীরামনে ব’লেছে তখন।
উচ্ছিষ্ট অন্ন যে ত্ব মস্তকে স্থাপন।।
হীরামন বলে তব আর কি করিব।
তবে আমি ওঢ়াকাঁদি এখনে যাইব।।
খেলিব নতুন খেলা গিয়ে ওঢ়াকাঁদি।
আমা তরে মাগো নহে কর কাঁদাকাঁদি।।
এত বলি হীরামন জলে ঝাঁপ দিল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
হরিচাঁদের সঙ্গে হীরামনের কথোপকথনান্তে মহাপ্রভুস্থান
তথা হ’তে হীরামন শ্রীধামে উদয়।
উদিত হইল যথা হরি দয়াময়।।
বলে ওহে দয়াময় ভকত বৎসল।
গোলকেরে সব লোকে ব’লেছে পাগল।।
অসীম শকতি তারে দিলে দয়াময়।
তার চেয়ে ছোট করে রেখেছ আমায়।।
অপার ক্ষমতাপন্ন হ’ল যে গোলক।
তব প্রেমদানে মত্ত করিল ভূলোক।।
গোলকের হুহুঙ্কারে নড়ে যে গোলক।
গোলক হ’য়েছে যেন জ্বলন্ত পাবক।।
গোলকের হৃদি মাঝে বিপুল ভকতি।
তাই বুঝি দিলে তারে এহেন শকতি।।
তেমনি ভকত তব নহে হীরামন।
তাই বুঝি ছোট রাখ তাহার সদন।।
এত যদি বলে বাণী সেই হীরামন।
মৃদুভাবে মহাপ্রভু ব’লেছে তখন।।
কোন্ খানে বল তোর অভাব রেখেছি।
সবাকার পাশে তোরে শ্রেষ্ঠই করেছি।।
পারাপারে তরণীর নাহি প্রয়োজন।
আপনার তরী বেয়ে করিস ভ্রমণ।।
আহারে শয়নে তো কোন দুঃখ নাই।
যাহা চাস্ তাই পাস্ সর্বলোক ঠাই।।
কোন স্থানে কি অভাব রেখেছি রে তোর।
সর্বত্যাগী সর্বভোগী তুই রে বর্বর।।
বসন লাগিত দশ হস্ত পরিমিত।
তাহাও লাগেনা তোর ক’রেছি বর্জিত।।
গৃহধর্ম করিতে যে লাগিত যে ঘর।
কুঁড়ে ঘরও লাগে না কিসে তোর ডর।।
সংসার করিতে হ’লে কতই খাটিতি।
তবে এ অভাব সব পূরণ করিতি।।
তার কোন দরকার না করে কখন।
তবু কেন হেন ভাষ বলিস এখন।।
চুপ করে থাক্ গিয়ে ওরে বাছাধন।
তোর বাঞ্ছা পূর্ণ করি আমি অনুক্ষণ।।
এত শুনি হীরামন নিরস্ত হইল।
ধীরে ধীরে অন্তঃপুরে গমন করিল।।
বহু ভকত ওঢ়াকাঁদি এসেছে সেদিনে।
বিগর্হিত কর্ম এক করে দুইজনে।।
একটি পুরুষ আর একটি রমণী।
গোপনে ক’রেছে ইহা থাকিয়া যামিনী।।
হীরামন সে দোঁহারে কেশেতে ধরিয়া।
হরিচাঁদ পাদপদ্মে ফেলিল রুষিয়া।।
নেহারিয়ে হরিচাঁদ ব’লেছে বচন।
একি কর্ম করেছিস ওরে হীরামন।।
তোর মত কেবা বল আছে এ ধরায়।
হস্তীর বোঝা কি কভু গর্দ্দভে কুলায়।।
তোর মনোনীত কর্ম কে পারে বুঝিতে।
কেবা আছে হেন জন বল এ জগতে।।
যে দেশের নর তুই যারে সেই দেশে।
কেন আর অকারণে থাকিস বিদেশে।।
এমত বলিয়ে প্রভু বিদায় করিল।
হীরামন যেন রুদ্র মূরতি ধরিল।।
মারুতির সম হীরা করি বীর দাপ।
রাম রাম বলে বীর জলে দিল ঝাঁপ।।
প্রভু বলে হীরামন সত্য কি চলিলি।
পুনরায় কোন কথা মোরে না বলিলি।।
প্রভু বাক্য যেন নাহি শুনিল শ্রবণে।
হীরামন চলি যায় আপনার মনে।।
অবিলম্বে উপনীত রাউৎ খামার।
রমণীর ঠাই কহে সব সমাচার।।
যেতে যদি থাকে সাধ আমার সঙ্গেতে।
প্রভাতে করিব যাত্রা জানিও মনেতে।।
শ্রীঅম্বিকা দেবী হয় হীরার রমণী।
পতির সঙ্গেতে যেতে বাঞ্ছে সেই ধনী।।
ফিরিবে না কোন মতে মনে বাসনা।
হীরামন বুঝিলেন নারীর ধারণা।।
অগাধ সলিল দেখে নাহি ফিরে যদি।
তবে ত করিবে দয়া রাম গুণনিধি।।
এর পূর্বে ভয় পেয়ে যদি ফিরে যায়।
তবে আর না পারিবে মোর কি দায়।।
কোন মনে যদি নাহি সঙ্গ না ছাড়িবে।
অবশ্য সঙ্গেতে তারে লইতে হইবে।।
এত ভাবি হীরামন পিছে ফিরে চায়।
হীরার রমণী যেন পাইলেন ভয়।।
পারিব না সঙ্গে যেতে মনে হেন লয়।
এত ভাবি সেই ধনী পিছাইয়া রয়।।
বলে নাথ তব সনে যেতে না পারিব।
হীরামন বলে তবে কি আর করিব।।
এইভাবে শ্রীঅম্বিকা রহে পিছাইয়া।
বীরবেশে হীরামন চলিল ধাইয়া।।
হীরার রমণী যবে গৃহেতে ফিরিল।
কি যেন মনের ভাব হৃদয়ে জাগিল।।
স্বামীর বিরহানলে কাঁদিতে লাগিল।
সে অনলে যেন তার হৃদয় দহিল।।
গৃহে না তিষ্ঠিতে পারে হইল এমন।
পতিপানে চেয়ে ধনী করিছে রোদন।।
সবে বলে মম স্বামী রুদ্র অবতার।
চিনিতে নারিনু আমি নারী হ’য়ে তার।।
কত না দিয়েছি দুঃখ স্বামীর মরমে।
ভুতদৃষ্টি ভেবে ঘরে না দিতেছি স্থান।
স্মরিয়ে সে সব কথা বাহিরায় প্রাণ।।
যখনে আনিয়ে শাস্তি দিলাম অপার।
কত না সহিল দুঃখ সে নাথ আমার।।
হায় হায় মম সম নাহি রে পাপিনী।
কি লাগিয়ে বেঁচে বল রহিব ধরণী।।
এত বলি কাঁদে ধনী আকুল হৃদয়।
ভূমিতে পড়িয়ে ক্ষণে করে হায় হায়।।
কেহ বলে এ ভাবেতে কেন কাঁদিস।
কি দেখিয়ে কি ভাবিয়ে এ মত করিস।।
কেঁদে কহে সবা ঠাই হীরার রমণী।
চলে গেল নাথ মোর করে কাঙ্গালিনী।।
জনমের মত স্বামী হইল বিদায়।
শেষ কথা চলে গেল ফেলিয়ে আমায়।।
আমাকেও বলেছিল সঙ্গেতে যাইতে।
নারিনু যাইতে আমি হইনু গৃহেতে।।
অগাধ সলিল মাঝে পৌছিল যখন।
আতঙ্কেতে উড়ে যায় আমার জীবন।।
পারিব না বলে আমি যবে ফিরিলাম।
নাথ বলে তবে আমি একা চলিলাম।।
এত বলি মূর্ছা হ’য়ে পড়িল ধরণী।
হায় হায় করি কাঁদে যতেক রমণী।।
কেহ বলে পোড়ামুখী কেন বা ফিরিলি।
কেন নাহি জলমধ্যে ডুবিয়া মরিলি।।
ক্রমে সবে এ সংবাদ জানিতে পারিল।।
পুরুষ রমণী কেঁদে আকুল হইল।।
শ্রীচৈতন্য বালা কহে করিয়া বিলাপ।
দেশত্যাগী হ’য়ে আজ চলে গেলি বাপ।।
কত না দিয়েছি দুঃখ বর্ণনা না যায়।
তাতে মহাপাপ আমি ক’রেছি সঞ্চয়।।
যাও বাপ যথা গিয়ে শান্তি পাও প্রাণে।
আমিও কহিনু বাপ যাও সেই স্থানে।।
এত বলি শ্রীচৈতন্য আকুল হইল।
হীরা হীরা বলি বালা কাঁদিতে লাগিল।।
মর্মান্তিক বেদনায় শ্রীগুরু চরণ।
অন্তরে বিদগ্ধ হ’য়ে করেছে রোদন।।
কোথারে প্রাণের ভাই ওরে হীরামন।
আর না হেরিব তোর ও চাঁদ বদন।।
এই বংশে জন্ম নিয়ে বংশ উদ্ধারিলি।
যাবার সময় মোরে না বলিয়ে গেলি।।
এইভাবে কাঁদে যত বালারা সকলে।
সকলের বক্ষ ভাসে নয়নের জলে।।
শোকের সাগরে সবে যেন ডুবে রয়।
কেবা কারে ধ’রে তোলে কে কারে সান্তায়।।
কেঁদে কেঁদে সব বালা ব’লেছে তখন।
চিনিতে নারিনু তুই এ হেন রতন।।
গ্রাহ্য নাহি করিয়েছি তোর মহাভাব।
অত্যাচার করিয়েছি ভেবে অন্য ভাব।।
বর্তমান হেরে তবু গ্রাহ্য করি নাই।
হায় হায় কোথা গেলি রে প্রাণের ভাই।।
আর না আসিবি ফিরি না পাইব দেখা।
কেহ বলে কোথা গেলে হীরামন কাকা।।
অধৈর্য হইয়ে কাঁদে রমণীর গণ।
আছাড়ি পাছাড়ি খায় শ্রীবংশীবদন।।
শ্রীগুরুচরণ বালা বলে ওরে ভাই।
বল দেখি কোথা গিয়ে তার দেখা পাই।।
বংশী কহে ওরে দাদা আর না পাইব।
সে বিহনে কেমনেতে জীবন রাখিব।।
এইভাবে হীরামন দেশত্যাগী হ’ল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।