মধ্যখণ্ডঃ পঞ্চম তরঙ্গ
মধ্যখণ্ড
পঞ্চম তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
ভক্ত স্বরূপ রায়ের বাটীতে প্রভুর গমন
পয়ার
পাইকডাঙ্গা নিবাসী শ্রীস্বরূপ রায়।
বড়ই সম্পত্তিশালী মান্য অতিশয়।।
দেল দোল দুর্গোৎসব ব্রত পূজা আদি।
বার মাসে বার ক্রিয়া করে নিরবধি।।
রাজসিকভাবে সব করিতেন রায়।
নিযুক্ত ছিলেন সদা অতিথি সেবায়।।
বহু দিন পরে তার হ’ল বেয়ারাম।।
ঔষধ সেবন করি না হ’ল আরাম।।
ঠাকুরের লীলাগুণ শুনে লোক ঠাই।
রায় বলে ঠাকুরের কাছে আমি যাই।।
হরিচাঁদ বলিয়া চলিল কাঁদি কাঁদি।
উপনীত হইল শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
প্রভুর সম্মুখে গিয়া রহে দাঁড়াইয়া।
মহাপ্রভু বলে তুমি এলে কি লাগিয়া।।
তুমি হও বড় লোক রাজতুল্য ব্যক্তি।
তোমাকে বসিতে দিতে নাহি মম শক্তি।।
রায় কহে বড় লোক আমি কিসে হই।
দয়া হ’লে শ্রীচরণে দাস হ’য়ে রই।।
বসিতে চাহে না রায় বলেছে কাঁদিয়া।
ঠাকুরের পদ ধরি পড়ে লোটাইয়া।।
প্রভু বলে গৌরব এখন গেছে ঘুচে।
শ্রেষ্ঠত্ব ঘুচা’তে তোরে রোগে ধরিয়াছে।।
যাও যাও ওরে বাছা রোগ তোর নাই।
এইরূপ মন খাটি সর্বক্ষণ চাই।।
ঠাকুরে প্রণাম করি চলিল বাটীতে।
দেহ মন সমর্পিল হরির পদেতে।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত সেই হ’তে হয়।
খেতে শুতে নিরবধি হরিগুণ গায়।।
সেই হ’তে ঘুচে গেল কর্ম রাজসিক।
ভক্তির উদয় হ’ল বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক।।
পূজাদি বৈদিক ক্রিয়া সব ছেড়ে দেয়।
সব সমর্পণ করে ঠাকুরের পায়।।
কতদিনে মনে করে কবে হেন হ’ব।
প্রভুকে বাটীতে এনে সব সমর্পিব।।
একদিন গিয়া ঠাকুরের কাছে কয়।
চল প্রভু একদিন দাসের আলয়।।
ঠাকুর বলেন আমি যাইবারে পারি।
তব গৃহে আছেন বিধবা এক নারী।।
সেই ধনী আছে জানি তব এক অন্নে।
যাইবারে নারি আমি সেই নারীর জন্যে।।
রূপবতী সেই নারী জানি ভালমতে।
শ্বেত রোগ আছে সেই নারীর অঙ্গেতে।।
তব গৃহে আছে বটে তুমি দেখ নাই।
বস্ত্রদ্বারা গুপ্ত করে ঢেকে রাখে তাই।।
সে নারীকে যদি তুই মা বলে ডাকিস।
তা’হলে আমাকে বাছা লইতে পারিস।।
আমি গেলে মা বলিয়া ডাকিতে হইবে।
ডাকামাত্র তার শ্বেত রোগ সেরে যাবে।।
হইয়াছ হরিভক্ত হ’লে রিপুজয়।
এইটুকু বাকী আছে তা’ হলেই হয়।।
ঠাকুরের পদে রায় পড়িল কাঁদিয়া।
এ হেন করুণা-সিন্ধু পেলেম আসিয়া।।
কোন দিন যাবেন তা’ দেন ঠিক করি।
সেই দিন যেতে হবে এ দাসের বাড়ী।।
ঠাকুর দিলেন তার দিন ধার্য করি।
আজ্ঞামাত্র আয়োজন করিল তাহারি।।
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে যত ভক্তগণ।
সব ঠাই একে বারে হ’ল নিমন্ত্রণ।।
ঠাকুর করিল যাত্রা পাইকডাঙ্গায়।
যাত্রাকালে সঙ্গে ভক্ত দেড় শত হয়।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ গোস্বামী গোলোক।
আগে যায় হীরামন হইয়া পুলক।।
উপনীত হয় গিয়া গ্রাম ফুকুরায়।
অধিকারী উপাধি ঈশ্বর দেখে তায়।।
ঠাকুরের পিতৃগুরু ঈশ্বর অধিকারী।
পথ আগুলিল গিয়া করযোড় করি।।
ছেঁড়া কাঁথা দিয়া গলে দন্তে তৃণ ল’য়ে।
মুখে নাহি স্ফুরে বাক্য রহে দণ্ডাইয়ে।।
চক্ষের জলেতে বক্ষ ভাসিয়া চলিল।
দেখিয়া প্রভুর মনে দয়া উপজিল।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে ভক্তগণ ঠাই।
বলত ঠাকুর বাড়ী যাই কি না যাই।।
হইয়া গুরু ঠাকুর এ হেন দীনতা।
চক্ষে জল দন্তে তৃণ গলে ছেঁড়া কাঁথা।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ বলে যোড় হাতে।
যাওয়া উচিৎ হয় ঠাকুর বাড়ীতে।।
ঠাকুর চলিল সব ভক্তগণ ল’য়ে।
নাম সংকীর্তন করে আনন্দে মাতিয়ে।।
ঠাকুর বসিল গিয়া ঠাকুরের বাড়ী।
অধিকারী গোস্বামী প্রণামে ভূমে পড়ি।।
গোস্বামী গোলোক বলে জয় হরি বোল।
জয় হরি বলরে গৌর হরি বোল।।
সব ভক্তগণ বলে জয় জয় জয়।
অধিকারী লোটাইল ঠাকুরের পায়।।
প্রভু হরিচাঁদ বলে শুন হে গোঁসাই।
তুমি গুরু আমি শিষ্য ভিন্ন ভেদ নাই।।
ভব কর্ণধার হ’য়ে জগৎ তরা’লে।
নিজে যে তরিবা ইহা কবে ভেবেছিলে।।
কাঁদিয়া কহেন তবে গুরু অধিকারী।
তুমি গুরু আমি শিষ্য তায় যদি তরি।।
মহাপ্রভু বলে কোথা হেন কল্পতরু।
গুরু হ’য়ে শিষ্যকে বলিতে পারে গুরু।।
ভক্তগণ বলে এই ঈশ্বর অধিকারী।
গৌরাঙ্গ লীলায় ছিল শ্রীঈশ্বরপুরী।।
সে ঈশ্বর পুরি ইনি ঈশ্বরাবতার।
ঈশ্বর ঈশ্বর নাম হয় দোঁহাকার।।
অধিকারী ঈশ্বর, ঠাকুরে কেঁদে কহে।
অন্ন ভোজ নিতে হবে এ দীনের গৃহে।।
ঠাকুর কহেন বহু ভক্তগণ সাথে।
একা আমি অন্ন ভোজ লইব কি মতে।।
তাহা শুনি কাঁদে অধিকারী মহাশয়।
কান্না দেখে বলে হরিচাঁদ দয়াময়।।
ভোজন করা’তে ইচ্ছা পাইয়াছি টের।
মাকে বল রাঁধিতে তণ্ডুল দশ সের।।
কাঁচা কলা কুষ্মাণ্ডের করহ ব্যঞ্জন।
এক সের ডাল বল করিতে রন্ধন।।
গৃহে আছে ঘৃত ভাণ্ড আনহ বাহিরে।
কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করি দেহ সবাকারে।।
পাক হ’ল ভক্ত সব করিল ভোজন।
মহাপ্রভু ভোজ লন আনন্দিত মন।।
গণনাতে একশত ষাটি জন লোক।
ভোজন দেখিয়া নাচে গোঁসাই গোলোক।।
পরিপূর্ণ ভোজনে সকলে হৈল তৃপ্ত।
নৃত্য করে অধিকারী ভোজন সমাপ্ত।।
অধিকারী প্রতি প্রীতি মহাপ্রভু কন।
গোলোকে ল’য়ে আপনি করুন ভোজন।।
ঈশ্বর কৃতার্থ হ’ল প্রভুর সেবায়।
পরে স্বরূপের বাড়ী চলিল ত্বরায়।।
সব ভক্তগণ উঠে হরিধ্বনি দিয়ে।
হীরামন চলিলেন অগ্রবর্তী হ’য়ে।।
অধিকারী গোস্বামীর গলে কাঁথা ছিল।
সেই কাঁথা হীরামন মাথায় লইল।।
প্রভু হরিচাঁদ কহে হীরামন জয়।
জান না কি জন্যে কাঁথা ল’য়েছে মাথায়।।
উহার মনের ভাব দুই প্রভু পিছে।
আমি ভৃত্য দাসরূপ অগ্রে পাঠিয়াছে।।
মহাপ্রভু কহে অগ্রে যাক হীরামন।
অধিকারী কর তার পশ্চাতে গমন।।
আমি যাব তব পিছে আনন্দ হৃদয়।
তার পিছে যাবে দশরথ মৃত্যুঞ্জয়।।
আর সব ভক্ত যাবে তাহার পশ্চাতে।
গোলোক যাউক তার যথা ইচ্ছা মতে।।
তুমি মম অগ্রে থেকে গান ধরে দেও।
নেচে গেয়ে স্বরূপের বাড়ী চলে যাও।।
অধিকারী গোস্বামী ধরিল সংকীর্তন।
পশ্চাতে দোহারী করে যত ভক্তগণ।।
অধিকারী কণ্ঠধ্বনি সিংহের গর্জন।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ তাদৃশ দু’জন।।
আর সব ভক্তগণ পিছে পিছে যায়।
ভীম নাদ কণ্ঠধ্বনি মত্ত হস্তী প্রায়।।
সব জিনি দেয় ধ্বনি গোলোক গোঁসাই।
জ্বলন্ত পাবক যেন অগ্রে পিছে ধাই।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
সব ভক্ত মধ্যে গোলোকের এই বোল।।
সব ভক্তগণ গায় সুমধুর ধুয়া।
হেলিয়া দুলিয়া নাচে গোবিন্দ মতুয়া।।
বিমুখ হইয়া পিছে মাথা নোয়াইয়া।
কক্ষ বাদ্য বুড়বুড়ি দু’বাহু তুলিয়া।।
তাহা শুনি মঙ্গল সে বুড়বুড়ি দেন।
বুড়বুড়ি করিতে বদনে উঠে ফেণ।।
সব ভক্ত করে লম্ফ উল্লম্ফ প্রল্মফ।
ঠিক যেন তাহাতে হ’তেছে ভূমিকম্প।।
কীর্তন হুঙ্কার উঠে গগন ভেদিয়া।
বৃক্ষ ছেড়ে পক্ষী সব চলিল উড়িয়া।।
শূন্যে উড়ে যায় পক্ষী ভকতের সঙ্গ।
জ্ঞান হয় দেবতারা হ’য়েছে বিহঙ্গ।।
গ্রাম্য পশু বন্য পশু যে ছিল যেখানে।
কীর্তন শুনিয়া ধারা বহে দু’নয়নে।।
ফুকরা হইতে যান বোয়ালিয়া হাট।
দোকানিরা দেখে শুনে কীর্তনের নাট।।
কার হয় অশ্রুপাত করজোড়ে রয়।
কেহ পাখা ধরিয়া বাতাস দেয় গায়।।
বুনোপাড়া গাড়িটানা মহিষ যে ছিল।
সকল মহিষ এসে একত্র হইল।।
কীর্তনের ধ্বনি শুনি উর্দ্ধ মুখ হয়ে।
উর্দ্ধকর্ণ করি যায় পথ আগুলিয়ে।।
অশ্রুজলে পরিপূর্ণ মহিষেরগণ।
বন্দীগুলা রজ্জু ছিঁড়ে আইল তখন।।
মহিষ কতকগুলি দৌড়িয়া চলিল।
আর কতগুলি তারা চাহিয়া রহিল।।
রক্ষকেরা নাহি পারে মহিষ ঠেকাতে।
বহু পরে ঠেকাইল অনেক কষ্টেতে।।
গো-চর নিকটবর্তী যত গরু ছিল।
উর্দ্ধ মুখ কর্ণ পুচ্ছ ধাইয়া চলিল।।
কোনটা গোছড় ছিঁড়ে চক্ষে পড়ে জল।
বৃষভ বলদ চলে ফেলাইয়া হাল।।
বৎস গাভী একত্র হইয়া দেয় লম্ফ।
তাতে যেন হয় বাসুকীর ফণা কম্প।।
হুলস্থূল লাগিয়াছে জীবাদি জন্তুর।
সংকীর্তন সঙ্গে চলে যতেক কুকুর।।
কুক্কুরে কুক্কুরে দেখা বিষম বিপদ।
একত্র হইয়া চলে নাহি হিংসা বাদ।।
এই রূপে উতরিল পাইকডাঙ্গায়।
স্বরূপের বাটী প্রভু হ’লেন উদয়।।
চারি পাঁচ শত লোক একত্র হইল।
হরিনাম সংকীর্তনে সকলে মাতিল।।
বহুক্ষণ পরে সেই কীর্তন ভাঙ্গিল।
স্নানান্তে ভকতগণ ভোজন করিল।।
চিঁড়া দধি মহোৎসব অগ্রেতে হইল।
অন্নপাক অন্তে সবে ভোজনে বসিল।।
খাও খাও দেও দেও নেও নেও রব।
কেহ খায় কেহ দেয় মহা মহোৎসব।।
হেনকালে উপনীত দ্বিজ একজন।
আমাদা নিবাসী নাম শ্রীহরি ভজন।।
মাতুল আলয় ছিল পাইকডাঙ্গায়।
ঠাকুরে প্রণাম করি ভূমিতে লোটায়।।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহে আমি নরাধম।
জন্মিয়াছি ব্রহ্মকুলে অধমস্যাধম।।
আমাকে করহ প্রভু কৃপার ভাজন।
বহুদিন ব্যাধি মম জ্বর পুরাতন।।
রোগে মুক্ত কর প্রভু নাহিক উপায়।
তব ভক্ত হ’য়ে আমি থাকিব ধরায়।।
হীরামনে ডেকে বলে গোলোক ঈশ্বর।
ব্রাহ্মণকে ধ’রে সেরে দেহ জীর্ণজ্বর।।
শুনি হীরামন গিয়া ব্রাহ্মণকে ধরে।
টানিয়া আনিল তারে বাড়ীর বাহিরে।।
বাটীর ঈশানকোণে পথে ছিল বালী।
পাতা দিয়া বাড়ি মারে আথালী পাতালী।।
উচ্ছিষ্ট কদলী পত্র ছিল তথা পড়ি।
চারি পাঁচ পাতা ধরি মারিলেন বাড়ি।।
বালী মধ্যে ব্রাহ্মণেরে ফেলে লোটাইয়ে।
বালী ধরি দেয় গায় মাজিয়ে ঘষিয়ে।।
প্রভু হরিচাঁদ আজ্ঞা সেরে যাবে জ্বর।
ব্যাধিমুক্ত উঠিয়া বসিল দ্বিজবর।।
ছেড়ে দিল ব্রাহ্মণেরে উঠিয়া দাঁড়ায়।
করজোড়ে দাঁড়াইল অশ্রুধারা বয়।।
ব্রাহ্মণের বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইল।
যাও বলি হীরামন তারে আজ্ঞা দিল।।
লোটাইয়া পড়ে গিয়া প্রভুর চরণে।
মহাপ্রভু বলে তোর কি ভাব এখনে।।
ব্রাহ্মণ বলেন মোর আর ব্যাধি নাই।
আজ্ঞা কর নিরন্তর তব গুণ গাই।।
মহাপ্রভু বলে তোর যা ইচ্ছা করিস।
মম ভক্ত প্রতি সদা ভকতি রাখিস।।
থাকিলে ব্রহ্ম গায়ত্রী ব্রাহ্মণ শরীরে।
তবে কি ব্রাহ্মণ অঙ্গে ব্যাধি হ’তে পারে।।
সে সকল মন্ত্র দিয়া আর কি করিবা।
মানুষ বলিয়া আর্তি সতত রাখিবা।।
আজ তোর হ’ল বাছা ব্যাধি সব নাশ।
যাজনিক দ্বিজ বলে না হয় বিশ্বাস।।
মানুষ বলিয়া আর্তি সদা যেন রয়।
যজমান হিংসা যেন তো হ’তে না হয়।।
ব্রাহ্মণ কহিছে আমি এই ভিক্ষা চাই।
তব পদে থাকে মন কর প্রভু তাই।।
তাহা শুনি ব্রাহ্মণেরে করিল বিদায়।
বিদায় লইয়া দ্বিজ যায় নিজালয়।।
ব্রাহ্মণ আরোগ্য হ’ল শরীর পুলক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।।
বিধবা রমণীর শ্বেত কুষ্ঠ মুক্তি
পয়ার
মহাপ্রভু স্বরূপেরে বলে বাছাধন।
আমি এবে করি বৎস স্বস্থানে গমন।।
তোর বাটী আসিলাম বাঞ্ছাপূর্ণ হ’ল।
শ্বেত রোগা রমণী দেখিতে বাকী র’ল।।
তোর ঘরে অন্নভুক্ত রহে বহুদিন।
দেখিব সে নবীনা কি হ’য়েছে প্রবীণ।।
স্বরূপ বলিল প্রভু আসিলেন যবে।
সেই নারী প্রণমিল শ্রীপদ পল্লবে।।
প্রভু বলে আমি তাহা লক্ষ্য করি নাই।
ডেকে আন তাহাকে এখন দেখে যাই।।
আজ্ঞামতে স্বরূপ আনিল ততক্ষণে।
লোটায়ে পড়িল নারী প্রভুর চরণে।।
প্রভু বলে রে স্বরূপ! পূর্ব বাক্য রাখ।
সবার সম্মুখে একে মা বলিয়া ডাক।।
রায় কহে যবে দয়া হ’ল মম ভাগ্যে।
শ্রীধামে বসিয়া দাসে যবে দিলে আজ্ঞে।।
সেই হ’তে ঘুচিয়াছে শমনের শঙ্কা।
কাম জয়ী হইয়াছি মেরে জয় ডঙ্কা।।
এখন নাহিক ভয় মা বলিয়া ডাকিতে।
সেই হ’তে এই ভাব আমার মনেতে।।
মা ব’লে ডাকিতে যবে দিলেন হুকুম।
সে হ’তে এ’ দেহে নাই কামের জুলুম।।
সেই হ’তে আমাকে ছাড়িয়া গেছে কাম।
নির্বিঘ্নে বসিয়া জপ করি হরিনাম।।
প্রভু বলে আমি তাহা জেনেছি অন্তরে।
দণ্ডবৎ কর সবে আমি যাই ঘরে।।
এ মেয়ের শ্বেত রোগ আমি জানি তাই।
এক সঙ্গে থাক বটে তুমি দেখ নাই।।
স্বচক্ষে দেখিলে রোগ প্রত্যয় জন্মিবে।
তোর ভক্তিজোরে রোগ এবে সেরে যাবে।।
স্বরূপ বলেন আমি কিছুই না জানি।
শ্রীমুখের বাক্য সত্য এইমাত্র মানি।।
প্রভু কহে আর কেহ জানিতে নারিল।
অনেকের মনে এই সন্দেহ রহিল।।
মনের বিকার নাই তোমা দু’জনার।
আমি তাহা ভালমতে জেনেছি এবার।।
বাহির করহ রোগ দেখুক সকলে।
মনের বিকার যাক হরি হরি বলে।।
স্বরূপ বলেছে সেই রমণীর ঠাই।
কোথা তব শ্বেত রোগ বের কর তাই।।
প্রভু বলে রোগ আছে হাঁটুর উপরে।
আর একটুকু আছে বক্ষের ভিতরে।।
স্বরূপ ফেলিল তার বক্ষের কাপড়।
সবে দেখে রোগ আছে বক্ষের উপর।।
স্বরূপ কহেন সেই নারীর গোচরে।
আছে নাকি শ্বেত রোগ হাঁটুর উপরে।।
হাঁটুর উপরে রোগ দেখাইল নারী।
স্বরূপ ক্রন্দন করে হরিপদ ধরি।
সারে বা না সারে রোগ তাতে ক্ষতি নাই।
শ্রীচরণে থাকে মতি এই ভিক্ষা চাই।।
ঠাকুর বলেন সেই নারীকে চাহিয়া।
মনের বিকার তব গেছে কি ঘুচিয়া।।
ঠাকুরের পদ ধরি কহে সেই নারী।
যা বলাও তাহা আমি বলিবারে পারি।।
ত্রাণ কর্তা আপনি ঘুচিল মম পাপ।
আমি স্বরূপের মা স্বরূপ মম বাপ।।
ডাকামাত্র সেই শ্বেত রোগ সেরে গেল।
সভাশুদ্ধ হরিধ্বনি করিয়া উঠিল।।
ঠাকুরের পদে দোঁহে তখনে লোটায়।
রচিল তারক মৃত্যুঞ্জয়ের কৃপায়।।
গোস্বামী গোলোক ও অজগর বিবরণ
পয়ার
একদিন মহাপ্রভু বসিয়া নির্জনে।
পাগল গোলোকজীরে বলিল যতনে।।
কত ঠাই কতদিনে কর দৌড়াদৌড়ি।
অদ্য যাও গজারিয়া লক্ষ্মণের বাড়ী।।
শুনিয়া গোলোকচাঁদ করিল গমন।
বেগেতে চলিল হয় হরষিত মন।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
নামধ্বনি করি চলে তেজেতে অনল।।
ক্ষণে লম্ফে ক্ষণে দৌড়ে নামে করে দর্প।
বিল মধ্যে দেখে এক অজগর সর্প।।
বিল মধ্যে খাল এক আড়ে দুই নল।
নামিল পাগল তাতে উরু সম জল।।
সেই জল মধ্যে হ’তে উঠে অজগর।
ভেসে উঠে তাহার প্রকাণ্ড কলেবর।।
দুই চক্ষু জ্বলে যেন আকাশের তারা।
নাসারন্ধে কর মুষ্ঠি যায় যেন ধরা।।
চক্ষু মূল লাল নাসারন্ধ্রে টানে জল।
হইতেছে শব্দ বুড় বুড় কল কল।।
শ্বাস পরিত্যাগে স্বাহা স্বাহা শব্দ করে।
নর্দমার জল যেন বেগে পড়ে সরে।।
সর্ব অঙ্গ অজগর কালকূট বর্ণ।
মস্তক উপর মণি হরিপদ চিহ্ন।।
গোস্বামীর অঙ্গে যেই কান্থাখানি ছিল।
শ্বাস পরিত্যাক্ত জলে কান্থা ভিজে গেল।।
বদন ব্যাদান করি পড়িল অমনি।
দন্ত দুই পাঁতি যেন মুক্তার গাঁথনি।।
তাহা দেখি পাগলের লাগে চমৎকার।
বুঝিতে না পারে মর্ম কি হ’ল ব্যাপার।।
খাল পাড় হয়ে কূলে রহে দাঁড়াইয়া।
অজগর পানে প্রভু রহিল চাহিয়া।।
এ কখন সর্প নহে ভাবে মনে মনে।
ধাইয়া চলিল সর্প পাগলের স্থানে।।
হাঁ করিয়া পাগলকে চলিল গ্রাসিতে।
পাগল দৌড়িয়া যায় তাহার ত্রাসেতে।।
ক্ষণেক দৌড়িয়া শেষে দেখেন ফিরিয়া।
আসিতেছে অজগর মুখ বিস্তারিয়া।।
গোস্বামী ভেবেছে মনে ভয় করি কার।
মরণ জীবন সম হরিনাম সার।।
লইয়া বাবার নাম মারিতেছি ডঙ্কা।
চৌদ্দ ভুবনের মধ্যে কারে করি শঙ্কা।।
এসেছে আমাকে খেতে উহাকে ধরিব।
ধরিয়া লইয়া মহাপ্রভুকে দেখাব।।
হনুমান গিয়াছিল গন্ধমাদনেতে।
পর্বত মাথায় রাখে সূর্য শ্রবণেতে।।
ভরত বাটুলাঘাতে মুখে উঠে রক্ত।
রামনাম লইয়া বাঁচিল রাম ভক্ত।।
প্রথমতঃ কুম্ভিরিণী করিল উদ্ধার।
কালনেমী রাক্ষসের জীবন সংহার।।
কাহারে না করে ভয় রাম নাম জোরে।
নির্ভয় শরীরে হনু রামকার্য করে।।
কিছার মিছার প্রাণে কেন বেঁচে রই।
ভাবিতেছি মানব জনম হ’ল কই।।
বুঝি এই হেতু পাঠালেন কল্পতরু।
সর্প দর্প দেখে কেন হই এত ভীরু।।
বদন ব্যাদান করি যায় অজগর।
দর্প করিলেন প্রভু সর্প ধরিবার।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বলে।
লম্ফ দিয়া প’ড়ে অজগরে ধ’রে তুলে।।
অতি দর্পে কহে সর্পে তোরে ধ’রে নিব।
ওরে ফণী তোর মণি প্রভু পদে দিব।।
ফণীবর পেয়ে ডর তখনি দাঁড়ায়।
সুন্দর কুমার হ’য়ে দৌড়াইয়া যায়।।
ধেয়ে যায় ফণী, হ’য়ে সুন্দর বালক।
পিছে পিছে ধেয়ে যায় গোস্বামী গোলোক।।
কৃষকেরা হাল ধরা করিছে দর্শন।
যোগালে রাখালে তারা একাদশ জন।।
বালক সেখানে গিয়া বলে সবাকারে।
রক্ষা কর তোমরা এ বেটা মোরে মারে।।
তাহা শুনি কৃষকেরা রুষিয়া উঠিল।
দাঁড়াও এখানে দেখি কোন বেটা এল।।
আমাদের কাছে তুমি আসিয়াছ হেথা।
তোমাকে মারিবে হেন কাহার যোগ্যতা।।
তাহা শুনি গোস্বামী আইলেন বাহুড়ী।
উপনীত হ’ল গিয়া লক্ষ্মণের বাড়ী।।
আহারাদি করিলেন লক্ষ্মণের বাসে।
পাগলামী করে ক্ষণকাল বীর রসে।।
বীর রসে যান ভেসে গোলোক গোঁসাই।
ওঢ়াকাঁদি আসিলেন ঠাকুরের ঠাই।।
পুষ্করিণী তীরে হরি বসিলেন এসে।
কিছুদূর গোলোক নিভৃতে গিয়া বসে।।
প্রভু হরিচাঁদ জিজ্ঞাসিলেন গোলোকে।
লক্ষণ কেমন আছে কি এসেছ দেখে।।
খনার বচন আছে সাপ স্বপ্ন পোনা।
দেখিয়া যে না ফুকারে মুনি সেই জনা।।
অসম্ভব দেখিলে না কহে বিজ্ঞজনে।
মনের মনন কথা থাক মনে মনে।।
কি শুনিবা অধিক জানা’ব কিবা আর।
আজ কোন মহাভাগ হইল উদ্ধার।।
শুনিয়াছ ভারত পুরাণ রামায়ণ।
শাপ ভ্রষ্ট ভবে জন্মে কত মহাজন।।
কোন মহাপুরুষের শাপে কোন জন।
স্থানভ্রষ্ট হ’য়ে থাকে পর্বত কানন।।
যক্ষমুনি শাপে গন্ধকালী ভবে এসে।
কুম্ভিরিণী মুক্তি পেল হনুমান স্পর্শে।।
অদ্য কোন মহাভাগ হইল উদ্ধার।
বহিরাংগ লোক মাঝে না কর প্রচার।।
মহাপ্রভু কহিলেন গোলোকের স্থানে।
এ সময় যাহারা ছিলেন সন্নিধানে।।
গোস্বামীর পদ ধরি তাহারা জিজ্ঞাসে।
এড়াইতে না পারিয়া গোস্বামী প্রকাশে।।
ত্রেতাযুগে সূর্যবংশে রাজা অযোধ্যায়।
ব্রাহ্মণের পাদোদক ভক্তি করে খায়।।
একদিন ভগবান তারে ছলিবারে।
ব্রাহ্মণ বেশেতে যান ত্রিশঙ্কুর দ্বারে।।
কুষ্ঠাব্যাধিগ্রস্থ বিপ্র হ’লেন কানাই।
ভাগবতে দ্বাদশ প্রস্তাবে আছে তাই।।
ব্রাহ্মণের পাদোদক হাতে ধরি নিল।
তার মধ্যে ক্লেদ কীট দেখিতে পাইল।।
ঘৃণা করি না খাইল থুইল মাথায়।
সেই অপরাধে সর্প যোনী প্রাপ্ত হয়।।
সেই জন্য কৃষ্ণপদ পাইল মাথায়।
প্রভু কৃষ্ণ ব্রজে কালীনাগ কালীদয়।।
না চিনিয়া ভগবানে করিল দংশন।
মস্তকে চরণ দিল প্রভু জনার্দন।।
অদ্যাবধি মস্তকেতে প্রভু পদচিহ্ন।
যদ্যপি সে সর্প তবু ত্রিভুবন মান্য।।
কালীনাগ কৃষ্ণপদ করিয়া ধারণ।
বলে প্রভু তোমার যে রাতুল চরণ।।
ভাবিয়া না পায় পদ ব্রহ্মা পঞ্চানন।
পদ লাগি শিবা করে শ্মশানে ভ্রমণ।।
সেই পদে বিষদন্তে দংশিলাম আমি।
এ পাপেতে হ’তে হয় বিষ্ঠা কণ্ডু কৃমি।।
দিয়াছ অভয় পদ বাঞ্ছা নাহি আর।
কত সুখ পাইতাম হ’লে নরাকার।।
ওহে প্রভু নরবপু যদি পাইতাম।
মনো সাধ মিটাইয়া পদ সেবিতাম।।
কবে হ’বে হেন ভাগ্য তুমি সানুকুল।
শুনিয়াছি নরবপু ভজনের মূল।।
এই অপরাধ প্রভু আমার ঘুচাও।
দয়া করি ওহে হরি নরবপু দেও।।
তারে বর দিলে সেই নররূপ হরি।
এর পর শ্রেষ্ঠলীলা যে সময় করি।।
জাতিসর্প খল দংশী অদ্য তাতে পাপ।
পরজন্মে আবার হইতে হবে সাপ।।
গুপ্তভাবে থেক গিয়া বিলে পদ্মবনে।
পিতা যশোমন্ত গৃহে জন্মিবো যখনে।।
রুদ্র অংশে জনমিবে আমার সেবক।
পরম ভকত সেই নামেতে গোলোক।।
যেদিন হইবে দেখা তাহার সঙ্গেতে।
বিষ্ণুলোকে যা’বে সুখে চ’ড়ে পুষ্পরথে।।
বিষ্ণু পরিষদ হ’বে বলিলাম তাই।
পাইবা সালোক্য মুক্তি একলোক ঠাই।।
সেই কালীয়ার প্রাপ্তি হ’ল বিষ্ণুলোক।
কারু কাছে না কহিও বাপরে গোলোক।।
এই কথা যে সময় শুনিল গোলোক।
নিভৃতে বলিল প্রভু শুনিল তারক।।
দশরথ তাহা জানি লিখি পাঠাইল।
সে লেখা দেখিয়া তাহা তারক রচিল।।
ভক্তা নায়েরীর মহোৎসব
পয়ার
নায়েরী নামেতে নারী কলাতলা বাস।
পরমা বৈষ্ণবী দেবী হরিপদে আশ।।
বালিকা বিধবা দেবী শুদ্ধা তদ্বধি।
সাধুসেবা কৃষ্ণসেবা করে নিরবধি।।
ঠাকুরের ভক্তগণ যায় তার বাসে।
ঠাকুরের নাম শুনে প্রেমানন্দে ভাসে।।
সবে বলে ওঢ়াকাঁদি স্বয়ং ভগবান।
তাহা শুনি নায়েরীর কেঁদে উঠে প্রাণ।।
ঠাকুরে দেখিব বলে চিত্ত উচাটন।
উদ্দেশ্যে করিল দেবী আত্মসমর্পণ।।
দৈবাধীন ঠাকুরের ভক্তসঙ্গ পেয়ে।
ওঢ়াকাঁদি শুভ যাত্রা করে সেই মেয়ে।।
পথে যেতে মনে মনে করে আনাগোনা।
যেমন কপাল প্রভু দেখা ত দিবে না।।
নেত্রনীরে গাত্র ভাসে চলে কাঁদি কাঁদি।
উপনীতা হইল শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুরের রূপ দেখে হয় জ্ঞানহারা।
কাঁপে গাত্র শিব নেত্র বহে অশ্রুধারা।।
দুই দণ্ড কাল প্রায় রহে দণ্ডাইয়ে।
প্রভুর শ্রীমূর্তি দেখে একদৃষ্টে চেয়ে।।
যুগল নয়নে তার বহে অশ্রুধার।
কণ্ঠরোধ বক্ষঃস্থল তিতিল তাহার।।
ঠাকুর বলেন তোর কেন হেন দশা।
স্থির হ’য়ে বল তোর মনে কিবা আশা।।
দণ্ডবৎ হ’য়ে কেন রৈলি দাঁড়াইয়ে।
মনে যাহা থাকে তাহা বল প্রকাশিয়ে।।
তাহা শুনি সেই নারী ধীরে ধীরে কহে।
জনমে জনমে যেন পদে মতি রহে।।
প্রভু বলে তোর মতি থাকিল আমায়।
জনমে জনমে তোর প্রতি দয়াময়।।
প্রভু ক’ন নায়েরি মা যাগো অন্তঃপুরে।
দেখ গিয়া ঠাকুরানী কি কি কার্য করে।।
বাক্য শুনি অন্তঃপুরে চলিল নায়েরী।
লক্ষ্মীমার পদ বন্দে স্তুতি নতি করি।।
গৃহকার্য করে সব মেয়ে ব্যবহারে।
শান্তিমাতা প্রফুল্লিতা নায়েরী আচারে।।
পরদিন বিদায় হইয়া বাড়ী যায়।
যাইতে পারে না ঠাকুরের পানে চায়।।
ফিরে ফিরে চায় তার বক্ষে বহে নীর।
থাকি থাকি ঝাঁকি মারে প্রফুল্ল শরীর।।
অষ্টসাত্ত্বিক বিকার জন্মিল আসিয়া।
সবে চমৎকৃত হৈল সে ভাব দেখিয়া।।
দুই তিন মাস এই ভাবে রহে ঘরে।
ওঢ়াকাঁদি আত্মস্বার্থ হরিনাম করে।।
দুই তিন মাসান্তর যায় ওঢ়াকাঁদি।
অন্তঃপুরে থাকে ছয় সাত দিনাবধি।।
এইভাবে যাতায়াত করে বহুদিন।
ঠাকুরের নিকটে কহিল একদিন।।
ওহে মহাপ্রভু মম আছে কিছু ধন।
আজ্ঞা হ’লে তব নামে করি বিতরণ।।
প্রভু বলে ভাল ভাল তাই করা চাই।
সাধুসেবা ভিন্ন ভবে ভাল কার্য নাই।।
যে সময় হইবেক যে অর্থ তোমার।
অমনি করিবে ব্যয় হুকুম আমার।।
এ সময় কত অর্থ আছয় তোমার।
কি রকম পারিবা করিতে ব্যয় তার।।
নায়েরী কহিছে কিছু নাহি জানি আমি।
যাহা ইচ্ছা তাহা কর সব হও তুমি।।
প্রভু বলে নায়েরী মতুয়া সব ডাক।
জনমের মত এক কীর্তি করি রাখ।।
চাউল লাগিবে তোর বিশ কুড়ি মণ।
এর উপযুক্ত দ্রব্য কর আয়োজন।।
তাহাই স্বীকার করি চলে গেল দেশে।
করিল উদ্যোগ তার মনের উল্লাসে।।
পুনর্বার ওঢ়াকাঁদি চলিল নায়েরী।
নিজে প্রভু দিল তার দিন অবধারী।।
প্রভু বলে তোর কিছু করিতে হ’বে না।
কর গিয়া আয়োজন যে তোর বাসনা।।
নায়েরী করিল সাধুসেবা আয়োজন।
এদিকে ঠাকুর দিতেছেন নিমন্ত্রণ।।
গোলোক পাগলে ডেকে বলে হরিচাঁদ।
মহোৎসব করিবারে নায়েরীর সাধ।।
যাহ বাছা নিমন্ত্রণ করহ সবারে।
পরস্পর বলাবলি যে দেখে যাহারে।।
বৈশাখের সাতাশে আটাশে ঊনত্রিশে।
তিনদিন মহোৎসব করিবা হরিষে।।
পূর্বদিন অধিবাস ভোজ মধ্য দিনে।
শেষ দিন প্রহরেক নাম সংকীর্তনে।।
মহোৎসবে বাজে কথা কহিতে দিবে না।
খা’বে আর হরিনাম গা’বে সর্বজনা।।
হরি ভিন্ন আর নাহি কর গণ্ডগোল।
শুধুমাত্র বলাইবা সুধা হরিবোল।।
সেইদিন হ’তে স্বামী গোলোক পুলকে।
মহোৎসব নিমন্ত্রণ আরম্ভিল লোকে।।
নায়েরীর বাড়িল যে আনন্দ অপার।
কবি বলে রবি গেল দিন নাই আর।।
মহোৎসব ও নিমন্ত্রণ
পয়ার
জয় হরি বল জয় গৌর হরি বল।
নামের হুঙ্কার ছাড়ি চলিল পাগল।।
আর দিন পাগল রাই চরণকে ল’য়ে।
উপনীত হইলেন বইবুনে গিয়ে।।
পাগল বলিল রাই তুমি বাড়ী যাও।
আমি আসিতেছি তাহা অগ্রে গিয়া কও।।
গঙ্গাচর্ণা আসিবার সময় কালেতে।
কলাতলা দেখা হ’ল নায়েরীর সাথে।।
নায়েরী রাইকে ধরি বাড়ী পর নিল।
মহোৎসবের বার্তা সব জানাইল।।
রাই কহে জানত না বৃত্তান্ত সকল।
তোমার এ নিমন্ত্রণ দিতেছে পাগল।।
এ সময় পাগল আসিল ফিরে ঘুরে।
নায়েরীর কথা রাই কহে পাগলেরে।।
পাগলের ঠাই রাই কহিতে লাগিল।
পাগল বলেন ইহা কেন জিজ্ঞাসিল।।
করিবেক মহোৎসব যদি থাকে ভাগ্যে।
বিশেষতঃ মহাপ্রভু দিয়াছেন আজ্ঞে।।
অমনি চলিল দোঁহে গঙ্গাচর্ণা হ’তে।
ওঢ়াকাঁদি মহোৎসব চৌধুরী বাটীতে।।
স্বয়ং মহাপ্রভু যান চৌধুরী আলয়।
নায়েরীর নিমন্ত্রণ পাগল জানায়।।
ঠাকুর বলেন সবে যাও কলাতলা।
মহোৎসব করিবেক একটি অবলা।।
আমি করিয়াছি আজ্ঞা কেহ না থাকিও।
নায়েরীর মহোৎসবে সকলে যাইও।।
অধিবাস দিন তথা গেলেন পাগল।
ক্রমে হরিবোলা চলে বলে হরি বোল।।
মহোৎসব দিনে সব হইল উদয়।
সঙ্গেতে অনেক লোক চলে মৃত্যুঞ্জয়।।
বদন গোস্বামী যায় লইয়া মতুয়া।
পার হ’তে এসে ঘাটে নাহি পায় খেয়া।।
পঞ্চাশৎ রশি হবে নদীর বিস্তার।
সেই নদী মধ্যে কেহ দিতেছে সাঁতার।।
হরি বলি কেহ যায় ঝাঁপিয়া ওপার।
কেহ লম্ফ দিয়া পড়ে নদীর ভিতর।।
নদীর মধ্যেতে আছে শিকারী কুম্ভীর।
তার যন্ত্রণায় লোক অনেকে অস্থির।।
ঘাটে বাশ গাড়ী তাতে বাতা লাগাইয়া।
খোঁয়াড় বাঁধিল তাতে প্রেক লোহা দিয়া।।
মতুয়ারা তাহা দেখি ভয় নাহি করে।
হরি বলে ঝম্ফ দিয়া জল মধ্যে পড়ে।।
কেহ বলে সনাতনে করেছিলে পার।
হয় পার কর নহে করহ আহার।।
শিকারী কুম্ভীর তথা মাঝে মাঝে ভাসে।
মতুয়ারা তাহা দেখি হরি বলে হাসে।।
এইমত মাতোয়ারা মনের আনন্দে।
হাসে কাঁদে নাচে গায় ডাকে হরিচাঁদে।।
পাগল আসিল পারে ওপারে বদন।
একখানি নৌকা পেয়ে উঠিল তখন।।
এপার আসিয়া সব নামিবার কালে।
নৌকাখানি ডুবে যায় মধুমতী জলে।।
যার নৌকা সেই জন আসিয়া তথায়।
কাঁদিতে লাগিল ধরি পাগলের পায়।।
এমন সময় এক কুম্ভীর ভাসিল।
কুম্ভীরের সম্মুখেতে পাগল পড়িল।।
ঝাঁপ দিয়া ডুব মারি পাগল সেখানে।
ডাক দিয়া বলে তোর নৌকা এইখানে।।
ভয়ে কেহ নাহি যায় নদীর কিনারে।
নৌকার গলই জাগে জলের উপরে।।
গোঁসাই কহিছে তোর কিছু নাহি ডর।
গলই জেগেছে তুই আগু হ’য়ে ধর।।
ধরিয়া লইল নৌকা সেচিল তখন।
তাহাতে হইল পার যত ভক্তগণ।।
নায়েরীর বাটী সব হ’ল উপস্থিত।
দৈবে ঘোর মেঘ সজ্জা হৈল আচম্বিত।।
গোলোক পাগল দেখি কুপিল তখন।
মহোৎসব বাদী ইন্দ্র হ’ল কি কারণ।।
মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসে ডেকেছে ঘনে ঘন।
এস মোরা করিব ইন্দ্রেরসহ রণ।।
অন্বেষণ করে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের।
মৃত্যুঞ্জয় পাগলের ভাব পেল টের।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে, রাগে স্বধর্মের হানি।
এস হে ঠাকুর খুড়া মোরা হার মানি।।
মৃত্যুঞ্জয় বাক্য শুনি গোলোক পাগল।
মনোগত রাগ যত হ’য়ে গেল জল।।
বলিতে বলিতে মেঘ অমনি বর্ষিল।
দুই চারি ফোঁটা অল্প অল্প বৃষ্টি হ’ল।।
হইল পূর্বের মত নির্মল আকাশ।
পাগলের মহিমা হইল সুপ্রকাশ।।
নির্বিঘ্নেতে মহোৎসব হইল অমনি।
দিবানিশি ক্ষান্ত নাই শুধু হরিধ্বনি।।
বাড়ীর উপরে করিয়াছে একস্থান।
সেখানে সকলে করে হরিনাম গান।।
কেহ বসে কেহ উঠে নাচিয়ে নাচিয়ে।
কেহ কেহ ভূমে পড়ে অচৈতন্য হ’য়ে।।
কেহ প্রেমে ধরাধরি করে পড়াপড়ি।
কেহ কেহ কেঁদে কেঁদে যায় গড়াগড়ি।।
তাহার উত্তর পার্শ্বে ভোজনের ঠাই।
যখন যা’র যা ইচ্ছা খেতেছে সবাই।।
লাবড়া অম্বল ডা’ল ভাজা দধি চিনি।
খেয়ে খেয়ে সকলে দিতেছে হরিধ্বনি।।
কেহ ভিড় দেয় বলে সাধু সাবধান।
ক্ষণে পিছাইয়া ক্ষণে হয় আগুয়ান।।
গৌর অবতারে প্রভুর কামনা রহিল।
তে কারণে ওঢ়াকাঁদি অবতীর্ণ হ’ল।।
বলিতে বলিতে বলে মধুরস বাণী।
কেহ তার পিছে পিছে দেয় হরিধ্বনি।।
পাতা রাখি ভূমে কেহ এঁটে হাতে মুখে।
দাঁড়াইয়া বাবা হরিচাঁদ বলে ডাকে।।
এই মত তিন দিন মহোৎসব হ’ল।
মতুয়ার গণ সব একত্রিত ছিল।।
লোক পরিমাণ অনুমান করি সবে।
দু’হাজার লোক সে মধ্যের দিন হ’বে।।
শেষ দিন লোক হবে চারি পাঁচ শত।
ভোজন করিল হরিভক্তগণ যত।।
নায়েরীর পূর্ণ হ’ল মনের বাসনা।
প্রেমে পুলকিত দেবী কাঁদিয়া বাচে না।।
হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজনে।
রসনা বাসনা নামরস আস্বাদনে।।