মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

একটি মতুয়াদলের আত্মপ্রকাশ ও পরিসমাপ্তি

গ্রামের নাম উত্তর খলিসাখালী। অনেক বছর আগে থেকে এই গ্রামের ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি প্রতিবছর মতুয়া মহোৎসব হয়। এবং এ উপলক্ষে বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফেলা গোঁসাইয়ের মহোৎসব হয় প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার। (ফেলা গোঁসাইয়ের মেলার কথা বললে অনেকেই জেনে থাকবেন)। কিন্তু এই গ্রামে কোন মতুয়া দল ছিল না।

 

পশ্চিম পাড়ার কার্তিকের (ছদ্মনাম) বাড়িও প্রতিবছর সাধ্যমত গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে (সঙ্গে দু এজন মুরব্বী থাকত) সাধুসেবা করাত ঠিক ফেলা গোঁসাইয়ের মহোৎসবের আগের দিন।

 

কার্তিকের দুই ছেলে। তারা গ্রামের এক যুগালে (এক বয়সের) কয়েকজনকে নিয়ে দল উঠাবে বলে কার্তিককে জানায়। কিন্তু কার্ত্তিক বলে তোরা ছোট মানুষ, পারবি ক্যান? কিভাবে উঠাবি? কিন্তু বাচ্চাগুলো নাছোড়বান্দা। তারা দল উঠাবেই। অগত্যা কার্ত্তিক রাজী হয়। কিন্তু কার্ত্তিক ভেবে পায় না, কিভাবে কি করবে?

 

অনুষ্ঠানের দিন। সবাই মিলে পাটখড়িতে কাগজ কেটে কেটে লাগিয়ে নিশান বানিয়ে ফেলল। আর গ্রামের মেলা থেকে কেনা ছোট ছোট ঢাক, থালা, কাঁসার বাটি দিয়ে দল সজ্জিত করে ফেলল। এবং যথাসময়ে তাদের এই সজ্জিত দল উঠল। সেকি আনন্দ! যারা না করেছেন, তারা বুঝবেন না। আর এর মাধ্যমে কার্তিকের সাধুসেবা রূপান্তরিত হল মতুয়া মহোৎসবে। সেই মতুয়া মহোৎসব আজো নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠিত হয়। যার শুরু এভাবেই।

কার্তিকের বাড়ি মহোৎসবের পরের দিনই ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি মহোৎসব হয়। ওই ছেলেগুলো পরের দিন ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়িও দল উঠাতে চাইল। কিন্তু কিভাবে? তারা কার্তিককে বলল, আমরা ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি দল উঠাব। কিন্তু দলের যে অবস্থা তাতে তিনি চিন্তিত হলেন। কিন্তু নিরাশ করলেন না। বললেন উঠা।

 

সবাই আবার আনন্দে মেতে উঠল। গতকালের সেই দল আবার একইভাবে সাজিয়ে ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ির দিকে যাত্রা করল। ছোট ছোট ঢাক, কাঁসার থালা, ঝাঁঝ, চাকি ইত্যাদি এর কাগজের নিশান নিয়ে সবাই হরিবোল দিয়ে যেতে লাগল।

 

গোঁসাই বাড়ির কাছাকাছি আসলে ছেলে গুলোর এই উৎসাহ আর আগ্রহ দেখে যে সব দল আগে উঠেছিল তারা আবার নিজেদের ঢাক, নিশান ও অন্যান্য যন্ত্রাদি নিয়ে এই ছোটদের দলকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে আসল। যে দলটি একটু আগেও ছোট ছিল, তা এখন অনেক বড় হয়ে গেল। আর এতে ছেলেগুলোর আনন্দ আরও বেড়ে গেল। তারা মনের আনন্দে হরিবোল দিয়ে প্রথমবারের মত গ্রামের দল হিসেবে ফেলা গোঁসাইয়ের মহোৎসবে যোগ দিল।

 

আর এর সাথে সাথে উত্তর খলিসাখালী গ্রামের মতুয়া দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু।

এরপর উত্তর খলিসাখালী গ্রামে কোন মহোৎসব বা সাধুসেবা হলে এই ছোট্ট মতুয়া দল সেখানে উপস্থিত হয়ে যেত। তাদের সম্বল কেবল হরিবোল আর ওই নামের কাগজের নিশান।

 

এভাবে এক বছর ঘুরে আবার ফেলা গোঁসাইয়ের মহোৎসব এসে গেল। মেলার কয়দিন আগে ছেলেপেলেদের এই দলের জন্য কার্ত্তিক চারটি লাল নিশান ও একটি বাংলাদেশের পতাকা নিজ খরচে বানিয়ে দিল (যদিও তখন তার অবস্থা এতই শোচনীয় যে, একবার খেলে পরের বারের চিন্তা করতে হয় কিভাবে জোগাবে)।

 

এই লাল নিশান আর পতাকা দলে নতুন মাত্রা যোগ করল। আরও লোকজন এসে দলে ভিড়ে গেল। এই সমস্ত নিশান নিয়ে আগের মতই আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে কার্তিকের বাড়ি ও ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি মহোৎসবে যোগ দিল। এবারও ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি উঠার সময়, পূর্বের উঠা দলগুলো অনেক সহযোগিতা করল।

 

আগের দলে ছিল কাগজের সাদা নিশান। আর এবারের দলে লাল সাদা নিশানের সমন্বয়। বড়ই চমৎকার। তখন ফেলা গোঁসাইয়ের বাড়ি ৫০/৬০ টি দল আসত। অধিবাস মঙ্গল বার দিনেও ৩/৪ টি দল আসত। এবং ৩/৪ দিন মহোৎসবের আনন্দের পুরো গ্রাম মেতে থাকত।

 

একবার চিন্তা করুণ তো, এই যেখানে এত বড় বড় দল বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে। তার মধ্যে এই ছোট ছোট ছেলেদের ছোট দল। যার অবলম্বন কেবল লাল সাদা নিশান আর ছোট ছোট ঢাক ঢোল। আর সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো হরিবোল আর হরিবোল।

এভাবেই এই ছোট্ট মতুয়া দলের দেড় বছর কেটে গেল। ছোট বেলার মতুয়া দল আর মহোৎসবের খিচুড়ি এর মজাই আলাদা। যারা এটা না করেছেন, তাদের উপলব্ধির বাইরে। একদিন পূর্ব পাড়ার অনিল বালার বাড়িতে তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে (নিশান পরিবর্তন) আমাদের এই মতুয়া দল হেসে-খেলে, হরি বোল বলে, ঢাক বাজিয়ে, আনন্দ করে।

 

অনুষ্ঠান হতে ফেরার পথে, যখন বাড়ির খুব কাছাকাছি, তখন এক মধ্যবয়সী অচেনা লোক পিছন থেকে ডাক দিয়ে আমাদেরকে থামালেন। বললেন, খোকারা তোমাদের বাড়ি কোথায়? তোমাদের দলকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমার খুব ভালো লেগেছে। আমরা বললাম, এইত সামনে (আমাদের বাড়ির দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে)।

 

তিনি বললেন, তোমাদের দল চালায় কে? আমরা সকলে বললাম, আমরা চালাই। তারপর তিনি বললেন, আমার বাড়ি সাতগিরে (সাত ঘরিয়া) গ্রামে। আমার বাড়ি সামনের মাসে (ঠিক দিন তারিখ মনে নেই) মচ্ছব (মহোৎসব)। তোমাদের দলের আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ। যেতে হবে কিন্তু!

 

আমরা বললাম, আমরা তো ছোট। অতদূর যেতে পারব। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা বাবাকে বলব। তারপর উনার নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে নিলাম। নাম কানাই মল্লিক, বাড়ি সাতগিরে।

 

রাত্রে আমরা বাবাকে জানাই, এই ঘটনার আদ্যপান্ত। তিনি বললেন, সেকিরে! বাইরে দল নিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা। তোরা কিভাবে যাবি। জানা নেই, শোনা নেই, নিমন্ত্রণ নিয়ে বসে আছিস। আমরা বললাম, কি করব? উনি যেভাবে বললেন। বাবা বললেন, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়?

 

এরপর বাবা খোঁজ খবর নিলেন নিমন্ত্রণকারীর। এবং চিন্তা করলেন গ্রামের বাইরে একটি দল নিয়ে যেতে হলে গায়ক লাগবে, ঢাক ঢোল লাগবে। এসব চিন্তা করে গ্রামের কয়েকজনের সাথে কথা বলে, আমাদের এই নিমন্ত্রণের কথা বললেন। এবং সবাই রাজী হল। এরপর গ্রামে একটি মিটিং ডাকা হল, মিটিং এ আমাদের দলের সব আদ্যপান্ত বর্ণনা করা হল, এবং এই নিমন্ত্রণের কথা বলা হল। গ্রামের সবাই মোটামুটি একমত, সবাই একসাথে থেকে এই দলের সরঞ্জামাদি কিনবে এবং সব মানুষ একসাথে মতুয়াদল নিয়ে সাতগিরে যাওয়া হবে।

 

তারপর গ্রামের সকলের থেকে চাঁদা তুলে নিশান, ঢাক, ঢোল ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি বানান হল। দেখতে দেখতে আমাদের দল অনেক বড় হয়ে গেল। সাথে গানবাজনার ব্যবস্থা হল। গ্রামের গায়ক, পাশের গ্রামের কয়েকজন সহ বেশ ভালই হল।

মহাধূমধামে আমরা কানাই মল্লিকের বাড়ি দল নিয়ে গেলাম এবং বহুত আনন্দ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমরা গৃহকর্তার আশীর্বাদ নিয়ে সেবারের মত চলে এলাম। এরপর পর পর ৩/৪ বছর আমরা ওই একই বাড়ি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।

এভাবেই আমাদের সেই ছোট্ট মতুয়া দলের গ্রাম ছেড়ে বাইরে পদার্পণ। 

আমাদের সেই ছোট্ট মতুয়া দলটি ধীরে ধীরে অনেক বড় হল। গ্রামের প্রায় সকল মানুষ এতে যোগ দিল। এমনকি আশেপাশের গ্রামেরও অনেক লোক আমাদের মতুয়া দলের সাথে বিভিন্ন মতুয়া মহোৎসবে যাওয়া শুরু করে। গ্রামে প্রতি সপ্তাহে গানবাজনার আয়োজন করা হল যাতে সকলে গান বাজনা শিখতে পারে।

 

ভালই চলছিল। চারিদিকে যত জায়গা হতে নিমন্ত্রণ আসত প্রায় সব মতুয়া মহোৎসবে আমরা যোগ দিতাম। প্রথম দিকে নিমন্ত্রণ আসলে আমরা সেই ছোট্ট দলের প্রতিনিধিরা তা গ্রহণ করতাম। পরে ধীরে ধীরে তা দলের গোঁসাই শ্রেণির হাতে যেতে থাকে। এভাবে ৪/৫ বছর চলে গেল।

 

ছোট্ট সেই দলের হরিবোলারা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। তারা স্কুলে বড় ক্লাসে উঠতে থাকে, তাদের পড়াশুনার চাপও বাড়তে থাকে। অভিভাবকরাও তাদের নজরদারী তাদের উপর বাড়াতে থাকে। ফলে ওই মতুয়া দলের নিয়ন্ত্রন আস্তে আস্তে বড়দের হাতে যাতে থাকে। এবং ৫/৬ বছরের মধ্যে আগের সেই নিয়ন্ত্রণকারীরা হয়ে গেল শুধু সাধারণ সদস্য।

শুভকামনা জানাই এই নতুন দলের জন্য। আর তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

যে দলের গঠন যত দ্রুত, তার ভাঙনও বোধ হয় তত দ্রুত।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, যোগ্য ব্যক্তির হাতে এই দল চালানোর ভার গেল না। আর অন্য দিকে গ্রামেও দলাদলি শুরু হয়ে গেল। ফলে দলেও বিভাজন শুরু হল। প্রথমে গ্রামের দলাদলিকে কেন্দ্র করে মতুয়াদলটিও দু’ভাগ হয়ে যায়। দল ভাগের সাথে সাথে দলের গায়করাসহ সকলে দু’ভাগ হয়ে যায়। ফলে দল দুর্বল হতে শুরু করে।

 

ছোট দলটি আর চলে না। কিন্তু বড় দলটি এখনও চলে। তবে আগের মত আর চলে না। অনেক জায়গা থেকে নিমন্ত্রণ আসলেও যাওয়া হয় না বিভিন্ন কারণে। দলটি ১৩/১৪ বছরের মধ্যেই দলটি মোটামুটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন উত্তর খলিসাখালী গ্রামে কোন মতুয়া দল নেই। কিন্তু এই গ্রামের প্রায় সবাই মতুয়া মতাবলম্বী।

 

গ্রামের সেই অনুষ্ঠানগুলো এখনও আগের মতই হয়, কিন্তু গ্রামের সেই দল আর নেই, সেই দল আর ওঠেনা। সেই মানুষ হয়ত আছে, কিন্তু সেই রূপে আর নেই। সেই মতুয়া দলও নেই। গ্রাম্যদলাদলি আর ব্যক্তিস্বার্থের কাছে বলি হয়ে গেল সেই মতুয়া দল।

হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free