পৃষ্ঠাঃ ৪৮১-৫০০
প্রভুজীর পদে যবে করিল প্রণাম।
চেয়ে দেখে প্রভু যেন নবঘন শ্যাম।।
উজ্জ্বল শ্যামল অঙ্গ মন্দ মন্দ হাসি।
সারা অঙ্গ হতে যেন ছোটে জ্যোতিঃ রাশি।।
কোথা সে গৌরাঙ্গ অঙ্গ কষিত কাঞ্চন?
কালো রূপে আলো যেন করেছে ভুবন।।
অপলক হতবাক বিপিন গোঁসাই।
ক্ষণ পরে দেখে সেই রূপ আর নাই।।
জ্ঞান ফিরে এল দেহে শুনিলেন কাণে।
দেবীচাঁদে ডাকি প্রভু কহিছে তখনে।।
‘‘কুটুমের ছেলে এ যে বিপিন বিশ্বাস।
এরে তুমি কেথা পেলে করিয়া তালাস?’’
দেবী কয় ‘‘দয়াময়! বিপিনের ভাগ্য।
কুটুম্ব বলিয়া তুমি তারে কর যোগ্য।।
লোকাচারে কুটুম্বিতা কর কৃপাময়।।’’
প্রভু কয় ‘যাহা ইচ্ছা করুক বিপিন।
আমি বলি তুমি তার হও গে জামীন।।’’
দেবীচাঁদ বলে ‘‘প্রবু যে আজ্ঞা তোমার।
তব কৃপা বলে লই বিপিনের ভার।।’’
কথা শুনে বিপিনের কোন কথা নাই।
ক্ষণে ক্ষণে ভাবাবেশে ছাড়িতেছে হাই।।
এইভাবে কিছুক্ষণ গত হয়ে গেল।
তাহারে ডাকিয়া তবে প্রভুজী কহিল।।
‘‘কি বিপিন সেই দিন পড়ে নাকি মনে?
কুটুম্বের বাড়ী এলে কুটুম্ব বিধানে।।
সে বিধান আজ তুমি যদি ছেড়ে দিলে।
কিসের কুটুম্ব তুমি এ-ঘরের ছেলে।।
আপনার বাড়ী ভেবে কর যাতায়াত।
ভয় নাই দেবী সদা রবে তব সাথ।।’’
মধুর বচন শুনি কান্দিল বিপিন।
বলে ‘‘বাবা আজ মোর বড় শুভদিন।।
আপনার দয়া পেয়ে ধন্য এ জীবন।
দয়া করে অভাগারে করুন গ্রহণ।।’’
প্রভু কয় ‘‘নাহি ভয় নিলাম তোমারে।
ওড়াকান্দী যাতায়াত কর বারে বারে।।
দেবীচাঁদ গুরু বলে কর তুমি মান্য।
দেবীর আশ্রয়ে তুমি হবে চির-ধন্য।।’’
এইভাবে গুরুচাঁদ করুণা করিল।
এবে শোন কি কার্য্য তাঁরেদিয়া হল।।
কর্ম্মী সাধক বিপিনচাঁদের মতুয়া-ধর্ম্ম প্রচার
দেবীচাঁদে গুরু মেনে গুরুচাঁদ কৃপাগুণে
শ্রীবিপিন দিনে দিনে শক্তিশালী হল।
গুরুপদে রেখে নিষ্ঠা প্রাণপণে করে চেষ্টা
হরিভক্ত সর্ব্ব শ্রেষ্ঠা প্রমাণ দেখাল।।
ধর্ম্ম কর্ম্মে সম্মিলণ মতুয়ার যে জীবন
পূর্ণ-ব্রহ্ম সনাতন গুরুচাঁদ করে।
অগ্রণী হইয়া তায় দেবীচাঁদে আগে ধায়
তাঁরে ধরে যেবা রয় তারে নেয় ধরে।।
শ্রীগোপাল গুণধাম বিপিন তপস্বীরাম
আর বহু ভক্ত আছে সেই গণনাতে।
স্বহস্তে মানুষ গড়ে দেবীচাঁদ দিল ছেড়ে
দেশে দেশে ফেলে তাঁরা নাম প্রচারেতে।।
প্রথম পরীক্ষা তায় বিধবার বিয়া দেয়
প্রভু গুরুচাঁদ কয় ‘‘জাতির কারণে।।
বিধবার বিয়া দিব শোন ভক্তগণ সব
এ জাতিকে তরাইব ভাবিয়াছি মনে।।
আমার এ কর্ম্ম-পথে থাকিতে আমার সাথে
ভাল যদি লাগে চিতে তাই মোরে বল।।’’
অগ্রভাগে দেবী কয় ‘‘আপনার এ ইচ্ছায়
বাধ্য আমি সর্ব্বদায় অচল অটল।।’’
গুরু যেই পথে চলে সেই পথে শিষ্যদলে
চলে সবে দলে দলে কিনা প্রতিবাদে।
গোপাল বিপিন দোঁহে কাজ করে সমারোহে
দুই ভাই কথা কহে সদা সিংহনাদে।।
দুই ভাই একত্তরে গুরুআজ্ঞা মান্য করে
বিয়া দিল ঘরে ঘরে মহা অনুরাগে।
গুরুচাঁদ শুনে তাই বলে আর কার্য্য নাই।
এ অবধি যাহা পাই আর নাহি লাগে।।’’
পরীক্ষা হইল শেষ গুরুচাঁদ হৃষীকেশ
ধরিলেন কর্ম্মীবেশ ধর্ম্ম আবরণে।
সাধনার এই পর্ব্ব দেবীচাঁদ দিল অর্ঘ্য
গুরুচাঁদ পাদপদ্মে গোপাল বিপিনে।।
তাই দুই মতিমান গুরুচাঁদে ধরা পান
হয়ে মহাশক্তিমান ধর্ম্মের প্রচারে।
জেলা হতে জেলান্তরে চলে দোঁহে হর্ষান্তরে
নাম দিয়ে ত্রাণ করে যত নারী নরে।।
বরিশাল জিলা পরে দেবীচাঁদ যথা ঘুরে।
দয়া করে বিপিনেরে নিজ সাথে লয়।
এই ভাবে সে বিপিন গুরুরূপে হয়ে লীন
পরিচিত দিনে দিন সবখানে হয়।।
বরিশালবাসী যারা বহু তর্কবাদী তারা
তাহাদের চিন্তাধারা বোঝা বড় দায়।
সহজে বিশ্বাস করা কভু নাহি করে তারা
দেহমন যেন ভরা তর্ক সমস্যায়।।
এ সব লিখন পড়ে বরিশালবাসী পরে
বহুদোষ ইথে ধরে বলিবেন কথা।
আমি বলি ‘‘শুন ভাই দোষ করে লিখি নাই
বল আমি কোথা পাই তেমন যোগ্যতা?
বরিশালবাসী সবে সহে নহে একভাবে
একভাবে এই ভবে নহে সর্ব্বজন।
ভালমন্দ সর্ব্বদায় সর্ব্বদেশে দেখা যায়
তারতম্য যাহা রয় তাহাতে লিখন।।
বিপিন গোস্বামী যিনি শক্তিশালী সাধু তিনি
সর্ব্বদেশে তাঁরে জানি মানে সর্ব্বজন।
বরিশাল বাস তাঁর কিন্তু তাঁর ব্যবহার
সুমহান সদাচার অতি সুশোভন।।
এইরূপ যত যত শির আমি করি নত
তাঁহাদের বিষয়েত এই কথা নয়।
সেই ভাব ধরে যারা তর্কবাদে চিত্ত ভরা
বলিয়া তাদের ধারা ইহা লেখা হয়।।
গোস্বামীজী নিজ মুখে বলিয়াছে যাহা মোকে
তাহা আমি যাই লিখে গ্রন্থের মাঝারে।
সেই কথা পাঠ করে যাহা ইচ্ছা বল মোরে
দোষী হই হত পরে সাধুর বিচারে।।
দেবীচাঁদ মহোদয় নাম প্রচারেতে যায়
বিপিনেরে ডাকি কয় ‘‘চল মোর সাথে।
উদয় গয়েরসকাঠি গুরুচরণের বাটি।
ঘর দ্বার পরিপাটি সর্ব্ববিধ মতে।।’’
তার পুত্র বিশ্বেশ্বর রোগ তার ভয়ঙ্কর
উন্মাদ রোগের পর তার কিবা আছে?
ওঝা বৈদ্য শত শত দেখিয়াছে অবিরত
কিন্তু রোগ দূরীভূত হয় নাই পাছে।।
ঠেকিয়া বিষম দায় মনোকষ্টে দিন যায়
নাহি দেখে সদুপায় ভাবিল অন্তরে।
সব কিছু দেখা হল অনর্থক অর্থ গেল
এখন কি করি বল কিসে রোগ সারে?
মতুয়ার ডঙ্কা ধ্বনি ধ্বনি যেন বজ্রধ্বনি
দেশবাসী সবে শুনিবলে ‘‘একি ভাই।
মতুয়া বলে না কথা হরি বলে যথা তথা
গুরুরূপ প্রাণে গাঁথা অন্য কিছু নাই।।
যে পথে মতুয়া চলে রোগ ব্যাধি যায় চলে
শান্তির হিল্লোলে খেলে আকাশে বাতাসে।
কাজ পেয়ে পরিচয় দুঃখী তাপী ছুটে যায়
শান্তি লোভে পড়ে পায় সবে অনায়াসে।।
ধরিয়া দেবীর পদে সে গুরুচরণ কাঁদে
কৃপা করে দেবীচাঁদ গেল তার বাড়ী।
শক্তিমন্ত গুণধাম অবিরাম করে নাম
উন্মাদের রোগারাম করে বলে হরি।।
বিস্মিত সে দেশবাসী দলে দলে তাই আসি
গোস্বামীর কাছে বসি করে নিবেদন।
‘‘আমরা বুঝেছি মনে নাম তুল্য কোনখানে
কিছু নয় কোন গুণে নামের মতন।।
তাই বলি হে গোঁসাই আমরা যে নাম চাই
সবে শিষ্য হতে চাই এক সঙ্গে মিশি।
সকলের নাম দাও আমাদের গুরু হও
দয়া করে কথা কও এখানেতে বসি।।’’
কথা শুনি দেবী কয় ‘‘কিবা বল মহাশয়
নাম আর কোথা রয় বিনা হরিনাম।
যদি বল মন্ত্র চাই হরি নাম বিনা ভাই
অন্য কোন মন্ত্র নাই আমি বলিলাম।।’’
সাধু যদি এই কয় ঘোর তর্ক মহাশয়
করিলেন সর্ব্বদায় উপস্থিত যারা।
সন্দেহ তাদের মনে কি যেন গোঁসাই জানে
তা না হলে কোন গুণে রোগী যায় সেরে।।
সন্দেহতে নাড়ে মাথা বলে ‘‘দেও আসল কথা
আর কেন চতুরতা করহে গোঁসাই।
ঠিক মন্ত্র দিলে পরে বরিশাল জেলা ভরে
শিষ্য হবে ঘরে ঘরে তাকে ভুল নাই।।’’
গোস্বামী যতেক কয় সন্দ তাতে দৃঢ় হয়
ডাক দিয়া সে সভায় কহে একজনে।
‘‘শোন সব অর্ব্বাচীন বয়সেতে মুঁই প্রাচীন
কয়টা বা বল দিন, রব এইখানে।।
যাহা বলি তাই কর জোরে গোস্বামীরে ধর
তাহা বলে পেতে পার কিছু বস্তু ধনে।
যদি নাহি শোনে কথা কর সবে এক পন্থা
গোস্বামীরে আর জ্যান্তা রেখে কাজ নাই।
নদী মধ্যে নিয়ে যাও সঙ্গে নিও ‘রামদা’ ও’
‘কলি জাটা’ কেটে লও মিলিয়া সবাই।।’’
এই ভাবে কয় যারা বিনা তর্কে কভু তারা
বিশ্বাসের ভাবধারা নিতে নাহি পারে।
বরিশালে এরা যারা তাহাদের ভাব ধারা
বৃথা তর্কে চিত্ত-ভারা সন্দেহেতে মরে।।
অবশ্য সকল দেশে তর্কবাদী আছে বসে
গণনায় দেখি আসে বরিশাল বেশি।
গণতন্ত্র যুগে ভাই ভোট ছাড়া কথা নাই
ভোটে জয়ী যারা ভাই তারা হও সুখী।।
বীর সাধু দেবী চান হল যবে অন্তর্দ্ধান
শ্রীবিপিন মতিমান বরিশাল পরে।
গ্রামে গ্রামে চলে সাধু বিতরিয়া নাম মধু
রূপে যেন স্নিগ্ধ বিধু দেশ আলো করে।।
জুগিয়া গ্রামেতে ঘর মন্ডল উপাধি তার
ভাব নিল মতুয়ার নামেতে অক্রুর।
বাজে কাঁশি বাজে খোল সবে বলে হরিবোল
মৃদঙ্গ মাদল ঢোল দিল সাথে সুর।।
যত দুরে চলে সুর দুর হতে আর দুর
বাজে ধ্বনি কি মধুর প্রাণ কাড়ি লয়।
একে ত নামের গুণ গোস্বামীর ভক্তি তূণ
শর তাতে প্রেমাগুণ বিরহ ব্যাথায়।।
যোদ্ধাবেশে ধর্ম্ম বীর সদা চলে উচ্চ শির
যেথা যেথা দিল ভীর সর্ব্বত্রেতে জয়।
কিবা শক্তি দেবী চান করেছিল তাঁরে দান
দেখা মাত্র বলে যান রোগ সমুদয়।।
মুগ্ধ সব নর নারী কান্দে সবে পদে ধরি
এই ভাবে ঘুরি ঘুরি করিল প্রচার।
সাগর তরঙ্গ যেথা তীরেতে লোটায় মাথা
মতুয়া ধর্ম্মের কথা নিল তার ধার।।
যেথা যায় সেথা কয় ‘‘শুন সবে পরিচয়
হরিচাঁদ দয়াময় পূর্ণ অবতার।
দয়া করে নমঃ কুলে অবতীর্ণ কলিকালে
নিজে প্রভু গেছে বলে ভয় নাই আর।।
মন্ত্র তন্ত্র দীক্ষা নাই পবিত্রতা রক্ষা চাই
গৃহ ধর্ম্মে সব পাই মানব জীবনে।
পবিত্রতা সত্য বাক্য যেন যেবা করে ঐক্য
হরি আচে তার পক্ষ সদা সর্ব্বক্ষণে।।
নরাকারে এবে নাই তবে তাঁরে কোথা পাই
বলিতেছি শোন তাই নিগূঢ় কাহিনী।।
গুরুচাঁদ পুত্র তাঁর নররূপে মহেশ্বর
শক্তি রাখি তাঁর পর গেছে গুণমণি।।
যাহা ছিল হরিচাঁদে ততোধিক গুরুচাঁদে
দেখিয়াছি পদে পদে তাতে বলি ভাই।
এস ছুটে জনে জনে গতি নাই তিনি বিনে
দিন গেল দিনে দিনে আর বেলা নাই।।’’
গোস্বামীর ভীর শুনি দুঃখী তাপী কত প্রাণী
গোস্বামীর গুরু মনি’’ পেল মহা শান্তি।
শিষ্য শাখা সঙ্গে করে সদা প্রেমানন্দে ভরে
আসে ওড়াকান্দী পরে নাহি হয় ভ্রান্তি।।
গোস্বামীর কীর্ত্তি যত ঘটিতেছে অবিরত
বলিতে মনের মত সাধ্য নাহি এবে।
ভবিষ্যতে গুণী যাঁরা সকলি লিখিবে তাঁরা,
তাতে কত সুধাধারা বিশ্ববাসী পাবে।।
আমি দরে মূল সূত্র যাই এই মাত্র
গুরুচাঁদ মধ্যে তত্ত্ব কেবা কিবা পেল?
শ্রীগুরু চরিত গাঁথা পূর্ণ রবে তাঁর কথা
মূল রেখে ডাল পাতা কুড়ান কি ভাল?
অসাধ্য প্রভুর লীলা নরে বোঝা দায়
অসাধ্য প্রভুর লীলা নরে বোঝা দায়।
গোস্বামী বিপিন মোরে সেই কথা কয়।।
একবার গোস্বামীর কন্ঠের ভিতর।
বিষাক্ত স্ফোটক হল অতি খরতর।।
জল বিন্দু গ্রাসিবারে শক্তি নাহি ধরে।
বাক্যলাপ করে কষ্টে ফিস ফিস স্বরে।।
মনে মনে ভাবিলেন বিপিন গোঁসাই।
‘‘এ বিপদে গুরুচাঁদ বিনা বন্ধু নাই।।
এই ভাবে বাড়ী বসে কোন কার্য্য নাই।
মরি বাঁচি আজ আমি ওড়াকান্দী যাই।।’’
কয় জনে সাথে করে গোঁসাই চলিল।
সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পরে ওড়াকান্দী গেল।।
গদী ঘরে আসনেতে প্রভু বসিয়াছে।
ইতি উতি কেহ কেহ কথা কহিতেছে।।
হেনকালে শ্রীবিপিন হইল উদয়।।
দন্ডবৎ করে গিয়া প্রভুজীর পায়।।
অন্য কোন কথা প্রভু বলিল না তারে।
শুধু বলে ‘‘পদ ধুয়ে এসো শীঘ্র করে।।
অন্য কোন কথা প্রতি নাহি দিব কাণ।
সারারাত্রি হেথা বসে কর তুমি গান।।’’
প্রভুর বচন শুনি গোস্বামীর ভয়।
মনে ভাবে কোন ভাবে বাক্য রক্ষা হায়।।
কথা বলি হেন সাধ্য কন্ঠে মোর নাই।
কোন ভাবে সারা রাত্রি আমি গান গাই।।
পুনঃ ভাবে এই চিন্তা মন্দ অতিশয়।
ব্রাহ্মান্ডে প্রভুর কিছু অজানা কি রয়?
কি জানি কি ইচ্ছা প্রভু করিয়াছে মনে।
যাহা বলে প্রভু আমি করিব এখনে।।
এত ভাবি শীঘ্রগতি পদ ধুয়ে এল।
প্রভুর সম্মুখে বসে কান্দিতে লাগিল।।
নীরবে ঝরিছে জল মুখে কথা নাই।
মনে মনে ডেকে বলে ‘‘জগত গোঁসাই।।
তোমার ইচ্ছা না হলে ধুলি নাহি নড়ে।।
তোমার ইচ্ছায় বারি মেঘ হতে পড়ে।।
তোমার ইচ্ছায় জানি কোন বাধা নাই।
আমা হতে ইচ্ছা নষ্ট হবে ভাবি তাই।।
ইচ্ছাময় নিজ গুণে ইচ্ছা পূর্ণ কর।
নিরুপায় বিপিনকে দয়া করে ধর।।
মনে মনে বলি সব ধরিলেন তান।
কন্ঠ হতে এল যেন সুরের উজান।।
বিস্মিত হৃদয়ে সাধু গান গেয়ে যায়।
দুই চোখে শত ধারা ধরাতে গড়ায়।।
এক গান শেষ করি যবে ক্ষান্ত দেয়।
‘‘গাও, গাও আরো গাও’’ বলে দয়াময়।।
প্রেমানন্দে এই ভাবে শর্ব্বরী পোহাল।
ঊষান কিরণে যেন ধরা জুড়াইল।।
প্রভু বলে এবে ক্ষান্ত কর তবে গান।
ঊষাকালে কর দিয়ে প্রভাতের স্নান।।’’
আজ্ঞা পেয়ে শ্রীপদেতে দন্ডবৎ করি।
উঠিল বিপিন সাধু বলে হরি হরি।।
পুস্করিনী মধ্যে নাম জল মুখে দেয়।
‘কোথায় স্ফোটক তার বেদনা কোথায়?
নীরোগ, নির্দ্দোষ কন্ঠ ক্ষত চিহ্ন নাই।
তাই দেখে কেন্দে বসে বিপিন গোঁসাই।।
এই ভাবে সে তারিখ পেল পরিচয়।
অবোধ্য প্রভুর লীলা নরে বোঝা দায়।।
অর দুই বার সাধু বিপদে পড়িল।
গুরুচাঁদ কৃপা গুণে প্রাণ রক্ষা হল।।
একবার পড়িলেন কলেরা কবলে।
দুদ্দর্শা ঘটিল যবে প্রভু বাক্য ফেলে।।
কলেরা রোগীর কাছে যেতে ছিল মানা।
করুনায় গোস্বামীর পরাণে শোনেনা।।
দয়া করে গেল যেই রোগীর নিকটে।
ফাঁক দেখে সে-কলেরা আক্রমিল বটে।।
যখনে সংবাদ গেল প্রভুজীর ঠাঁই।।
গালাগালি করে প্রভু যাহা ইচ্ছা তাই।।
তিরস্কার শান্তি দিয়ে দয়া করে কয়।
‘যাক চলে বিপিনের নাহি কোন ভয়।’
সেই দিনে কলেরার প্রকোপ কমিল।
সপ্তাহ মধ্যেতে রোগ আরোগ্য হইল।।
এই ভাবে অন্য রোগে সাধু আরবার।
দিনে দিনে হইলেন অস্থিচর্ম্মসার।।
মনে ভাবে ‘‘এই বুঝি ঘনিয়াছে শেষ।
হাঁটিতে শকতি নাই নাহি বল লেশ।।
অতি কষ্টে ওড়াকান্দী হইল উদয়।
প্রভু বলে ‘‘যাও চলে নাহি কোন ভয়।।
অমোঘ প্রভুর বাক্য সবে মানা করে।
দিনে দিনে গোস্বামীর ব্যাধি গেল সেরে।।
এসব দেখিয়া বলে বিপিন গোঁসাই।
প্রভুর লীলার তত্ত্ব বুঝি শক্তি নাই।।
অসাধ্য লীলার কথা বলে পুনরায়।
শেষবারে প্রভু যবে লহ্মীখালী যায়।।
ফিরিবার কালে এল সে মোল্লার কুলে।
নৌকা পড়ে বালুপূর্ণ ক্ষুদ্র একখালে।।
জোয়ারের জলে যবে জলবৃদ্ধি হয়।
ছোট বড় সব নৌকা সে সময়ে যায়।।
অল্প জলে নৌকা তলে বালু ধরে এটে।
সে সময়ে নৌকা চলা সাধ্য নাই মোটে।।
খালতলে যে সময়ে জল নাহি রয়।
প্রভুর তরুণী সেথা এল সে সময়।।
সবে বলে ‘‘কি উপায়? তরী চলে কিসে?
জল নাই, থাক, সবে সেই খানে বসে।।
জোয়ার আসিল তবে তরী খুলে দিব।
যত চেষ্টা করি নাক ফল নাহি পাব।।
প্রভুজী শুনিয়া বলে ‘‘ওর অলসেরা।
‘‘পারিব না’ বলে কাজ ছেড়ে দিলি তোরা?
পার কিনা পার তার চেষ্টা নাহি কর।
বন্দুকের নাম নাই গুলি খেয়ে মর।।
ধন নৌকা, যত বোকা, আমি সাথে ধরি।
দেখি মোরা তরী নিতে পারি কিনা পারি।।’’
প্রবুর বচন শনি সঙ্গী সাথী যারা।
হাতে হাতে ধরে তরী টান দিল তারা।।
এদিকে প্রভুজী কিন্তু নৌকার ভিতর।
‘‘গুরা’’ ‘পরে বাঁধায়েছে পদযুগ তাঁরা।।
জোর দিয়া বলে প্রভু টান দেরে জোরে।
বলা মাত্র তরী কিন্তু চলে ধীরে ধীরে।।
প্রভু কয় ‘‘দেরে টান, টান দেরে জোরে।।’’
বলা মাত্র তরী কিন্তু চলে ধীরে ধীরে।।
প্রভু কয় ‘‘দেরে টান, টান দেরে জোরে।।’’
বলিতে বলিতে তরী চলে বায়ু ভরে।।
অর্দ্ধ ক্রোশ দীর্ঘ হবে সেই ছোট খাল।
তাহা ছেড়ে থাকে তরী যেথা বেশী জল।।
আশ্চর্য্য মানিয়া ভক্তে কথা নাহি কয়।
প্রেমানন্দে সকলের চক্ষে ধারা বয়।।
এই মত কত লীলা করে দয়াময়।
প্রভুর অসাধ্য লীলা নরে বোঝা দায়।।
শ্রীমৎ নকুল চন্দ্র গোস্বামীর জীবন কথা
গোস্বামীর নকুল চন্দ্র অতি শক্তিমান।
শুন সবে বলি কিছু তাঁর আখ্যান।।
শ্রীগুরুচাঁদের শ্রেষ্ঠ ভক্ত একজন।
করজোড়ে গোস্বামীরে করিনু বন্দন।।
তের শত দুই সালে লহ্মীকাটী গাঁয়।
শুভক্ষণে জন্ম নিল সেই মহাশয়।।
খুলনা জিলার মধ্যে লহ্মীকাটী গ্রাম।
দৌলতপুরের থানা জেনে লিখিলাম।।
তাঁর পিতা মহাশয় যে দুর্গাচরণ।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নাম যাঁর জানি পঞ্চানন।।
উপাধি পাল চৌধুরী জাতি নমঃশূদ্র।
ধনে মানে কুলে শীলে কভু নহে ক্ষুদ্র।।
বাল্য হতে সে নকুল বহু তেজবন্ত।
সময়ে সময়ে যেন হত উদভ্রান্ত।।
একদিন বিলমধ্যে গেল হারাইয়া।
বহু কষ্টে পেল তাঁরে খুঁজিয়া খুঁজিয়া।।
যশোহর জিলাদীনে ডোমরা গেরামে।
নকুলের মাতামহ মত্ত ছিল নামে।।
মাঝে মাঝে শ্রীতারক সেই বাড়ী যায়।
শিশুকালে নকুলের সাথে দেখা দেয়।।
সুন্দর বালক দেখি গোস্বামী সুজন।
নকুলেরে করিলেন অঙ্কেতে ধারণ।।
মহতের স্পর্শ লাগে নকুলের গায়।
স্পর্শগুণে নকুলের হয় ভাগ্যোদয়।।
বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষা কিছু না করিল।
পঞ্চবিংশ বর্ষপরে কিঞ্চিৎ শিখিল।।
এতকালে তার দিন গেল কোন ভাবে?
ক্রমে ক্রমে সেই কথা বলিতেছি তবে।।
সমান বয়সী যত বাল মিশিয়া।
করিতের হরিনাম নাচিয়া নাচিয়া।।
দলের প্রধান ছিল নকুল গোঁসাই।
যাহা বলে সে নকুল সবে করে তাই।।
কীর্ত্তনাদি মহোৎসব হলে কোন খানে।
নকুলের দল যায় প্রেমানন্দ মনে।।
কীর্ত্তনাদি করে বটে মতুয়া না চেনে।
নিন্দা বা স্ত্ততি নাহি করে কোন জনে।।
এই ভাবে একদিন গোস্বামী রতন।
কুলসুর গ্রামে আসি দিল দরশন।।
যশোহর জিলা মধ্যে কুলসুর গ্রাম।
মতুয়ারা সেই খানে করিতেছে নাম।।
রসরাজ কৃত বই ‘‘মহাসংকীর্ত্তন।’’
তাহা হতে গান করে মতুয়ার গণ।।
এক গান শুনে তার মন ভুলে গেল।
ভাবেতে হৃদয় মুগ্ধ আঁখি ছল ছল।।
আদি পদ সে গানের করিনু লিখন।
যাহা শুনে নকুলের ভুলে গেল মন।।
‘‘তোরা দেখসে এক সোনার মানুষ এসেছে।
মানুষ কোন দেশে, ছিল কার কাছে-
এ’ত বিধির গঠন, নয় গো কখন,
মানুষে মানুষ মিশেছে।।’’
----কবিরসরাজ তারকচন্দ্র।
মনে বলে ‘‘হেন গান আর শুনি নাই।
এ গানের বই আম কোন খানে পাই?
যার বই তারে কহে বিনয় বচন।
কিছু দিন বইখানি দিন মহাজন।।
আপনার বই আমি ফিরাইয়া দিব।
মনোমত গান কিছু লিখিয়া লইব।।’’
নকুলের কথা শুনি সেই মহাশয়।
আনন্দ অন্তরে তাঁরে বই দিয়ে দেয়।।
দেশে আসি দলে মিশি গোস্বামী নকুল।
প্রেমানন্দে গায় গান হইয়া আকুল।।
ক্রমে ক্রমে মতুয়ারা তারে সর্ব্বদায়।
মহোৎসব হলে তারে যত্নে ডেকে লয়।।
এসময়ে গোস্বামীজী বিবাহ করিল।
বিবাহের পরে এক বর্ষ কেটে গেল।।
ওড়াকান্দী বারুনীর শুভ সমাচার।
সে সময়ে দেশে দেশে হয়েছে প্রচার।।
গোস্বামী ভাবিল মনে ওড়াকান্দী যাবে।
কেমন বারুণী হয় স্বচক্ষে দেখিবে।।
আপনার লোকজনে গোস্বামী বলিল।
‘‘ওড়াকান্দী যাবে চলি চল সবে চল।।’’
আনন্দে দলের লোক নাচিয়া উঠিল।
সকলে বলিল ‘‘বড় শুভ দিন এল।।’’
ডঙ্কা, শিঙ্গা, ভেরী, তুরী, লোহিত নিশান।
বীরমুর্ত্তি সে নকুল অগ্রে অগ্রে যান।।
দলে লোক তিন শত বয়সে সমান।
মহানন্দে একসঙ্গে করে সবে গান।।
ক্রমে সবে উপস্থিত মধুমতী তীরে।
সভয়ে পাটনী তবে দিল পার করে।।
বীরভাবে তারা সবে ওড়াকান্দী এল।
দল দেখে গুরুচাঁদ আনন্দিত হল।।
পরিচয় জিজ্ঞাসিল নকুলের ঠাঁই।
পরিচয় পেয়ে ডাকে ‘‘চৌধুরী মশাই।।’’
প্রভু কয় ‘‘এইমত বীর দল চাই।
তোমরা আসিলে কাছে বড় শান্তি পাই।।
শুনহে নকুল তুমি আমার বচন।
মাঝে মাঝে ওড়াকান্দী কর আগমন।।’’
প্রভুর নিকটে পরে লইল বিদায়।
বিদায়ের কাছে প্রভু ডাক দিয়া কয়।।
‘‘আমি বলি তোমাদের পারে বাধা নাই।
কোন কড়ি লাগিবে না বলে দিনু তাই।।’’
নকুলের দল তবে চলিল হাঁটিয়া।
উপনীত মধুমতী তীরেতে আসিয়া।।
মঙ্গলপুরের ঘাটে যেই খেয়া রয়।
মাথা পিছু দু’পয়সা পার হতে লয়।।
কিন্তু দেখ নকুলের দলে ছিল যারা।
কোনভাবে নদীপার হইলেন তারা?
সর্ব্বদশী গুরুচাঁদ যাহা বলেছিল।
ঘটিতে ঘটিতে দেখ তাহাই ঘটিল।।
জেলেরা নদীর মধ্যে ফেলিতেছে জাল।
হেনকালে শোনে ধ্বনি বল হরিবল।।
জেলেরা ভাবিল আজ দিন বড় ভাল।
হরিবলে দলে দলে মতুয়া আসিল।।
মতুয়ারে অদ্য মোরা পার করে দিব।
মতুয়া করিলে পার বেশী মাছ পাব।।
চিরকাল এই কথা জানি ভাল মোরা।
বহুশক্তি ধরে ওড়াকান্দী মতো’রা।।
তাই যবে নকুলের দল এলো চলে।
জোড়হাতে বলিতেছে যত সব জেলে।।
‘‘দয়া করে গোস্বামীরা এস এই নায়।
তোমাদের পার করি বহু ইচ্ছা রয়।।
জেলেদের কথা শুনি দলে ছিল যারা।
তারা কয় ‘‘একি কান্ড নাহি বুঝি মোরা।।
কোথা বা সে ওড়াকান্দী কোথা মধুমতী।
এই কি আশ্চর্য্য কান্ড ঘটিল সংপ্রতি?
এতদূরে গুরুচাঁদ দেখিল কেমনে?
সর্ব্বদর্শী গুরুচাঁদ বুঝিলাম মনে।।’’
নকুল ডাকিয়া বলে ‘‘শুন ভাই সব।
কি দেখিলে কিবা বোঝ’ এই সব ভাব?’’
সঙ্গী যারা বলে তারা ‘‘ঠকিয়াছি ভাই।
হেন ব্যক্তি গুরুচাঁদ আগে বুঝি নাই।।
দূরে থেকে সব দেখে, জানিতেও পারে।
এমন সোনা মানুষ দেখি নাই ওরে।।’’
এই কথা জনে জনে সকলেই বলে।
উঠিল ভাবের ঢেউ মধুমতী কুলে।।
হেনকালে নৌকা আসি কুলেতে ভিড়িল।
প্রেমানন্দে সকলেই নৌকায় চড়িল।।
সুদীর্ঘ চারটি তরী হল ভাসমান।
হেনকালে সে নকুল ধরিলেন গান।।
‘‘তোরা কে কে যাবি আয় পারে-
তোদের পারের কড়ি লাগবে না রে।।’’
মধুমতী নাচে রঙ্গে জলের তরঙ্গে।
তরী পরে মগ্ন তারা ভাবের প্রসঙ্গে।।
তরঙ্গে তরঙ্গে মিলি হল একাকার।
আরোহী কি দাঁড়ি মাঝি জ্ঞান নাহি কার।।
তীরে বসি নরনারী করে বলাবলি।
‘‘এ কোন ভাবে খেলা খেলিছে সকলি।।’’
ভাবে মত্ত অরোহীরা তরী চলে ধীরে।
কুলে গেল সেই তরী দুই ঘন্টা পরে।।
এইভাবে সে নকুল বাড়ী চলে গেল।
গুরুচাঁদে দেখে মন ব্যাকুল হইল।।
সপ্তাহ গৃহেতে থাকি সাধু পুনরায়।
হইলেন ওড়াকান্দী শ্রীধামে উদয়।।
মতুয়া পবিত্র কথা সুধাধিক সুধা।
কবিকহে পিও সাধু যাবে ভবক্ষুধা।।
শ্রীশ্রী ঠাকুরের কৃপালাভ
শ্রীধামে আসিয়া প্রণাম করিয়া
নকুল বসিয়া রয়।
হাসিয়া মধুর কহিল ঠাকুর
‘‘আসিলি কিসের দায়?।।
কহিছে নকুল হয়ে প্রেমাকুল
‘‘অকুল কান্ডারি তুমি!
কিছুই কহিতে কিছুই লইতে
আসি নাই হেথা আমি।।’’
প্রভুজী হাসিয়া কহিছে ডাকিয়া
‘‘বলিলি কেমন কথা?
কিছু নাহি নিবি কিছুনা বলিবি
তবে কি আসিলি বৃথা?’’
যজ্ঞেশ্বর তার তাকে ডাকি লয়
প্রভু হতে কিছু দূরে।
পরে তারে কয় ‘‘শোন মহাশয়
ফেলিয়াছ ভুল করে।।
নিজে দয়াময় কৃপা দিতে চায়
বাধা কর কেন তাতে?
আপনি রতন আসিছে যখন
কিবা দোষ তাহা নিতে?
তুমি’ত সরল বোঝ সে গরল
কর যে বিষম ভুল।
যেতে ভব পারে ডাকিছে তোমারে
তুমি যে ছাড়না কুল।।’’
শুনি তার কথা নকুল অগত্যা
তার মতে দিল সায়।
গিয়ে করপুটে প্রভুর নিকটে
এক বাক্য চেয়ে লয়।।
কহিছে ঠাকুর ‘‘শোনরে নকুল
যাহা বলি করা চাই।
অষ্টাদশ মাস পত্নী সহবাস
করিওনা বলি তাই।।’’
নকুল ভাবিল কোন জ্বালা হল
কেমনে পারিব তাহা?
একবর্ষ ধরি নাহি ছোব নারী
এসব যাবে কি সহা?
না পারি সে ভাল কিন্তু কিসে বল
পারি বলে নাহি পারি?
প্রতিজ্ঞা আমার করিয়া স্বীকার
অস্বীকার নাহি করি।।
কি জানি কি হয় কথা ভাল নয়
স্বীকার করিয়া ডাঙ্গা।
একার্যে নিরিখ লাগে বটে ঠিক
যথা রাখে মাছরাঙ্গা।।
রাখিয়া বিকার করিলে স্বীকার
অবশ্য কুফল ফলে।
আপন স্বভাবে যদি হয় হবে
বলে কেন বাধি জালে।।’’
এতেক ভাবিয়া নকুল উঠিয়া
কহিছে প্রভুর ঠাঁই।
‘‘বলিলে যে কথা কখনে আমি তা’
পারিবনা-মাফ চাই।।’’
প্রভু বলে ডাকি ‘‘বলিলি তুই কি
নারিবি রাখিতে কথা?
না মানিলে কথা কেন এলি হেথা
আসা হল তোর বৃথা।।
যদি না পারিস ভাল না থাকিস
আসিস না ওড়াকান্দি।
আসুক তাহারা কথা মানে যারা
যারা নাহি জানে ফন্দী।।’’
প্রভুর মহিমা কেবা দিবে সীমা
কেবা বোঝে কার্য ধারা।
কারে কিযে কয় কিসে কিযে হয়
কিছুই বুঝিনা মোরা।।
প্রভুর বচনে নকুলের মনে
দুঃখ বটে কিছু হল।
প্রভুরে চাহিয়া বিষাদে হাসিয়া
ঝরিল নয়নে জল।।
প্রভু প্রতি কয় ‘‘শোন দয়াময়।
আমারে করিলে মানা।
না বলিলে ফিরে আসিবনা ফিরে
হেথা নাহি দিব হানা।।’’
এতেক কহিয়া প্রণাম করিয়া
নকুল চলিয়া যায়।
পথে চিন্তা করে ‘‘কেমন প্রকারে
বাক্য-রক্ষা কিসে হয়?
গৃহে যদি রই কি জানি কি হই
কি জানি নারীর খেলা।
দেড় বর্ষ ধরে রব দূরে দূরে
যৌবনের এই বেলা।।’’
গৃহে ফিরে গেল কিছু না কহিল
আপন নারীর কাছে।
সাজিয়া উদাসী ঘোরে দিশি দিশি
হরি বলে সদা-নাচে।।
তাহার রমণী গুণময়ী ধনি
মনে নাহি করে দুঃখ।
স্বামী তুষ্ট যাতে তিনি ও তাহাতে
পরাণে পাইল সুখ।।
দু্ই বর্ষ গত হল এই মত
নকুল মাতিল নামে।
হেথা দয়াময় ব্যস্ত অতিশয়
ওড়াকান্দী পুণ্য ধামে।।
উনশিয়া ঘর অনন্ত কুমার
তাহারে ডাকিয়া কয়।
‘‘অনন্ত কুমার যাহ একবার
দেখ নকুল কোথায়?
দুই বর্ষ গেল তবু নাহি এল
পড়েছি বিষম দায়।
তার বাড়ী যাও তারে গিয়ে কও
কর্তা ডেকেছে তোমায়।।’’
অনন্ত চলিল লহ্মীকাটী গেল
নকুলে ধরিল বাড়ী।
বলে ‘‘মহাশয় প্রভুর আজ্ঞায়
চল তুমি তাড়া তাড়ি।।
কহিল নকুল ‘‘আমিও ব্যাকুল
যাইতে প্রভুর ঠাঁই।
কিছু কাল পরে যাব তাঁর ধারে
আজ যেতে সাধ্য নাই।।’’
প্রভুর দয়ায় সীমা নাহি রয়
দয়ার তুলনা নাই।
যত যাই ছেড়ে প্রভু ধরে বেড়ে
আর কি এমন পাই?
প্রভুর পুনরায় আদুকে পাঠায়
নকুলেরে আনিবারে।
নকুলের প্রাণ মহাভাব আনে
এইভাব চোখে হেরে।।
ভাবিছে নকুল প্রেমেতে আকুল
‘‘ওহোরে দয়ার বন্ধু!
জোর করে ধরে মোরে দয়া করে
এমনি করুণা-সিন্ধু।।’’
ভাবেতে মাতিয়া শ্রীধামে আসিয়া
পড়িল প্রভুর পদে।
কহিল ‘‘দয়াল প্রাণে দাও বল
মজিয়াছি অপরাধে।।
প্রভু ডেকে কয় ‘‘নাহি কোন ভয়
আমি যে রয়েছি তোর।
দেশে দেশে যাও সবে নাম দাও
থাকিও প্রেমেতে ভোর।।’’
করে এই উক্তি প্রভু দিল শক্তি
নকুল আনন্দ পায়।
দেশে দেশে যায় শ্রীনাম বিলায়
প্রেমেতে বিভোর রয়।।
প্রভু কৃপা করে শুন অতঃপরে
কার শক্তি পেল প্রাণে।
স্মরিয়া গোপালে নয়নের জলে
মহানন্দ তাই ভণে।।
শ্রীমৎ যাবদ মল্লিক কর্ত্তৃক শক্তিদান
ঠাকুরের কৃপা পেয়ে সে নকুল ধায়।
নাম প্রচারের লাগি দেশে দেশে যায়।।
যশোহর জিলাধীনে হিদা নামে গ্রামে।
নাম ধর্ম্ম প্রচারিল গোস্বামী প্রথমে।।
সেই গ্রামে একদিন মিশিয়া সকলে।
মহোৎসব করিবারে মতুয়ারা চলে।।
যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।
মহোৎসবে চলিলেন হরি হরি বলি।।
পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে নাম নেপাল বিশ্বাস।
মতুয়ার প্রতি তার ঘোর অবিশ্বাস।।
মতুয়ারা নাম গানে সদা মত্ত রয়।
ঘৃণাভরে সে নেপাল ফিরিয়া না চায়।।
প্রভুর লীলার তত্ত্ব নাহি যায় জানা।
যেই বাদী তারে দলে না এনে ছাড়েনা।।
এক্ষেত্রে তেমনি দেখি সকলি ফলিল।
দিবা দ্বিপ্রহরে অগ্নি জলিয়া উঠিল।।
স্নান করিবারে সব মতুয়ারা যায়।
নেপালের গৃহে অদ্নি জ্বলে সে সময়।।
মতুয়া দয়াল কত শোন এবে তাই।
হিংসা দ্বেষ মতুয়ার প্রাণে কিছু নাই।।
অপরের দুঃখে তারা নাহি পায় সুখ।
তারে হিংসা করুক না যে যাহা পারুক।।
নেপালের ঘরে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল।
চারিদিক হতে লোক ছুটিয়া আসিল।।
দাউ দাউ জ্বলে অগ্নি ভীষণ আকার।
মনে হয় ঘর বাড়ী হবে ছারখার।।
দূর হতে যত জনে আসিল ছুটিয়া।
অগ্নির বিক্রম দেখি রহে দাঁড়াইয়া।।
হায়, হায় সব বুঝি পুড়ে ছাই হয়।
নিরুপায় সে নেপাল কান্দিয়া বেড়ায়।।
হেনকালে সেথা ছুটে আসিল নকুল।
মানবের দুঃখে প্রাণে হইল আকুল।।
কিছু শুনিবারে নাহি করিল অপেক্ষা।
মনে মাত্র ভাব তার ‘‘কিসে পায় রক্ষা?’’
জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে ঝাপায়ে পড়িল।
মুহুর্ত্তের মধ্যে গৃহের চালেতে উঠিল।।
বীর মূর্ত্তি সে নকুল অপূর্ব্ব বাখান।
ব্রজস্বরে বলে কন্ঠে ‘‘জয় হরিচান।।’’
নেপালে ডাকিয়া বলে ‘‘ওহোরে অজ্ঞান!
রক্ষা যদি পেতে চাস হরি বলে কান্দ।।
মতুয়ারে যত্ন করি করাবি ভোজন।
হরিভক্ত মতুয়ারে করিবি পূজন।।’’
কান্দিয়া নেপাল বলে ‘‘আর ভ্রম নাই।
দয়া করে রক্ষা কর দয়াল গোঁসাই।।
হরিচাঁদে বিনিব যে হেন শক্তি কোথা।
দয়া করে দাও শক্তি ওহে শক্তিদাতা।।
আজিকার এ বিপদে যদি রক্ষা পাই।
মহোৎসব হবে হেথা এই ভিক্ষা চাই।।’’
নকুল ডাকিয়া বলে ‘‘ভিজা কাঁথা আন।
আগুন নিবাব আমি বলে হরিচান।।’’
বীর্য্যবন্ত সে গোস্বামী যবে ইহা বলে।
জল কাঁথা নিয়ে লোক ধায় দলে দলে।।
প্রভুর করুণা গুণে মুহুর্ত্ত ভিতরে।
দাবানল শান্ত হল পলকের তরে।।
অগ্নি যুদ্ধে জয়ী হবে নামিল নকুল।
তারে দেখে নরনারী সবে প্রেমাকুল।।
গোস্বামী যাদব যাঁর উপাধি মল্লিক।
ঘন ঘন নকুলেরে করেছে নিরিখ।।
মহাভাব তাঁর প্রাণে হইল উদয়।
ভাবাবেশে নকুলেরে বক্ষে ধরি লয়।।
কার্য্যগুণে নকুলের হল ভাগ্যোদয়।
বক্ষে ধরি গোস্বামীজী নকুলেরে কয়।।
‘‘নকুল যে! যেই কার্য্য আজিকে করিলি।
হরিচাঁদ কৃপাগুণে ধন্য হয়ে গেলি।।
যে কার্য্য করিলি তুই কিবা দিব আর।
তোরে দিনু সব শক্তি যা কিছু আমার।।’’
কান্দিয়া নকুল বলে ‘‘দয়াল গোসাই।
আমাকে করহে কৃপা শক্তি নাহি চাই।।
শক্তি দিয়ে কি করিব কৃপা যদি পাই।
রণে, বলে কোনখানে ভয় মোর নাই।।’’
এই ভাবে প্রেমালাপ ভাবালাপ হল।
অতঃপর মতুয়ারা সিনান করিল।।
মহোৎসব বাড়ী সবে হল উপস্থিত।
আনন্দে সবার চিত্ত প্রেমে পুলকিত।।
হেনকালে সে নেপাল দিল দরশন।
অবিরল নেত্রজল বহিছে তখন।।
কেন্দে বলে ‘‘দেখ মোর ভক্তি শক্তি নাই।
দয়া করে মোর গৃহে চলুন গোঁসাই।।
শ্রীহরিচাঁদের নামে দিব মহোৎসব।
দয়া করে মতুয়ারা চলিবেন সব।।’’
গোস্বামী যাদব তবে করুণা করিল।
দয়া করি নেপালের গৃহেতে চলিল।।
মহাভাব সেইখানে হইল কীর্ত্তন।
দলে দলে লোকজন করে আগমন।।
যাদব ডাকিয়া বলে নকুলের প্রতি।
‘‘মনোমত গান কর নকুল সুমতি।।’’
যাদবের আজ্ঞামতে নকুল তখন।
গান করে মহাভাবে হইয়া মগন।।
অশ্বিনী গোঁসাই কৃত ভাবাঙ্গ সঙ্গীত।
গান শুনে সকলের চিত্ত বিমোহিত।।
‘‘মনে এক বাঞ্ছা ছিল ঘটল না আমার।
আমার হৃদিপদ্মে হরিচাঁদে-
সাজায়ে মিলাব চাঁদের বাজার।।’’
ভক্ত কবি অশ্বিনী গোঁসাই-
গান শুনে ভাবে মত্ত যাদব মল্লিক।
ভাবাবেশে স্থানকাল নাহি কিছু ঠিক।।
নকুলের প্রতি কৃপা দ্বিগুণিত হল।
ভাবে মুগ্ধ হয়ে সাধু নাচিতে লাগিল।।
সারা অঙ্গে ফুটে ওঠে আনন্দ কিরণ।
নকুলেরে করিলেন অঙ্কেতে ধারন।।
জননি যেমনি লয় আপন শিশুরে।
সেইমত গোস্বামীজী ধরে নকুলেরে।।
পুতুল অঙ্কেতে যথা শিশু করে খেলা।
নকুলে অঙ্কেতে করি দেয় কত দোলা।।
ভাব দেখি গৃহবাসী সকলে অজ্ঞান।
ডুবিল কঠিন ধরা বহে প্রেমবান।।
প্রহর অবধি চলে কীর্ত্তনের খেলা।
গগনে হইল তবে দ্বি-প্রহর বেলা।।
যাদব গোস্বামী তবে হইল সুস্থির।
মতুয়ারা দিল সবে জয় জয় ভীর।।
স্নান করিবারে সব করিলেন মন।
জনে জনে অঙ্গে করে তৈলের মর্দ্দন।।
নেপাল আসিয়া বলে যাদবের ঠাঁই।
‘‘এক মণ চাল পাক হয়েছে গোঁসাই।।
লোক পরিমাণ যাহা করি অনুমান।
পঞ্চ শতাধিক হবে এই হয় জ্ঞান।।
কি উপায় দয়াময় বলুন এখনে।।’’
যাদব মল্লিক কয় ‘‘ভয় নাই মনে।।
ভোজন দিবার কর্ত্তা এই ভবে যিনি।
আমাদের যা ব্যবস্থা করেছেন তিনি।।
এক মনে ডাক তাঁরে ছাড় অন্য মন।
একমনে একমণে হবে অগণন।।’’
এত বলি সবে মিলে এল স্নান করি।
আহারে বসিল সবে দিয়ে ঘর সারি।।
‘‘জয় হরি গুরুচাঁদ’’ মতুয়ার ভীর।
সেই সাথে নেপালের চক্ষে বহে নীর।।
স্বচ্ছন্দে করিল সেবা যত নরনারী।
কোন কিছু কম নহে তরী তরকারী।।
আকন্ঠ ভোজন করে সবে আনন্দেতে।
এ সব সম্ভব হল প্রভুর দয়াতে।।
ভকতের পুণ্য দেহে প্রভু করে বাস।
ভক্তে যাহা বলে প্রভু তাই করে পাশ।।
শ্রীগুরু-চরিত কথা সঞ্জীবনী সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যায় ভব-ক্ষুধা।।
বাঞ্ছাপূর্ণকারী হরি প্রভু গুরুচাঁদ
বাঞ্ছাপূর্ণকারী হরি হৃদয়-রঞ্জন।
গোস্বামী নকুল কহে শোন বিবরণ।।
তের শ’ চৌত্রিশ সালে প্রভু গুরু চান।
বহু ভক্ত প্রভু গৃহে করে অভিযান।।
যহোশর জিলা আর খুলনা জিলায়।
দয়া করে মহাপ্রভু বহু স্থলে যায়।।
সেই কালে গোস্বামীজী নকুল সুজন।
প্রভুকে আপন গৃহে নিতে করে মন।।
প্রভু তাতে দিল মন আনন্দ অন্তরে।
বাক্য পেয়ে সে নকুল গেল নিজ ঘরে।।
গৃহে গিয়া ভ্রাতৃ সঙ্গে আলোচনা করে।
সব শুনে ভ্রাতা তার কহে নকুলেরে।।
‘‘প্রভুজী আসিবে তাতে বড় শান্তি পাই।
কিন্তু এক কথা মনে ভেবে দেখ ভাই।।
যত ধান্য ঘরে আছে বর্তমান কালে।
কিছু যেন টানাটানি হবে মনে বলে।।
সপ্তাহ পরেতে যদি আসিতেন প্রভু।
পাকা ধান পেলে চিন্তা নাহি হত কভু।।
দাদার বচন তবে নকুল ভাবিল।
সেই ভাব হলে বটে কার্য্য হত ভাল।।
পরক্ষণে ভাবে আমি কিবা ভাবি মনে।
এ ভাব ভাবি যে শুধু আপন ওজনে।।
দয়াময় গুরুচাঁদ যেখানে উদয়।
সর্ব্ব ঘট পূর্ণ সেথা অভাব কোথায়?
এই চিন্তা করা মোর বড়ই অন্যায়।
যা হবার হোক তাই প্রভুর ইচ্ছায়।।
এত ভাবি ডাক দিয়া বলিছে দাদারে।
‘‘তার লাগি চিন্তা কভু করো না অন্তরে।।
পূর্ণ ব্রহ্ম গুরুচাঁদ যেইখানে যায়।
কিসের অভাব সেথা সব পূর্ণ রয়।।
তাঁর ইচ্ছা যাহা তাই পূর্ণ হবে ভাই।
ইচ্ছাময় ইচ্ছায় বাধা দিতে নাই?’’
এই ভাবে তারা তবে স্থির করে মন।
ভাবনার ভাব জানে পতিত পাবন।।
ভকতের শান্তি দিতে প্রভু কত ব্যস্ত।
ভকতের পাছে সদা রাখে কৃপাহস্ত।।
নকুলের চিন্তা প্রভু জানিলেন মনে।
কিভাবে পুরায় বাঞ্ছা শোন সর্ব্ব জনে।।
প্রভুর আসিতে কাবী কয় দিন আছে।
শত বর্ষ মনে হয় নকুলের কাছে।।
দিবানিশি প্রভু রূপ করিতেছে ধ্যান।
শয়নে স্বপনে কহে ‘‘কোথা গুরুচান।।’’
এই মত ভাবে সাধু কাটায় সময়।
একদিন দেখে স্বপ্ন সেই মহাশয়।।
স্বপনে দেখিল যেন নকুলের বাড়ী।
আসিয়াছে গুরুচাঁদ অকুল কান্ডারী।।
একা প্রভু নহে তাঁর সঙ্গে একজন।
মোহন মুরতি যাঁর রেশম বরণ।।
শির হতে দীর্ঘ কেশ কটি-বিলম্বিত।
অরুণ নয়ন দুটি করুণা-পুরিত।।
দীর্ঘ ভূজদ্বয় দোলে দুই পার্শ্ব দিয়া।
কুসুম কোরক রাগ সে দেহ বেড়িয়া।।
কিবা সে অতুল শোভা রাতুল চরণে।
ধরে না রূপের ঢেউ ক্ষুদ্র এ নয়নে।।
মৃদু মৃদু হাসি নাচে অধর রেখায়।
দেখা মাত্রে অগোচরে প্রাণ কাড়ি লয়।।
যত রূপ নরকুল দেখে ভুবনে।
এরূপের কাছে তুচ্ছ হয় সব মানে।।
কিবা রূপ ধরে বল ফাল্গুণী জ্যোছনা?
কিবা সে ঊষার হাসি কিসের তুলনা?
কিবা সে ফুলের হাসি কিবা প্রজাপতি?
বিচিত্র ভূধর শোভা কত জানে ভাতি?
কিবা সে জননী দেখে শিশুর বদনে?
কিবা রূপ দেখে নর প্রিয়ার আননে?
এসব রূপেতে বটে রয়েছে মোহিনী।
কিন্তু চিরস্থায়ী তাহা নহে তাই জানি।।
এ সব রূপের মাঝে নহে চিরশান্তি।
এসব রূপের মাঝে আসে পরে ক্লান্তি।।
কিন্তু সেই রূপ ধরে সেই মহাজন।
তাহা দেখে শ্রান্তি ক্লান্তি আসে না কখন।।
এক দৃষ্টে সে নকুল চাহে অপলক।
অজানা ভাবে স্রোতে আনিছে পুলক।।
কেন্দে তায় পায়ে পড়ে গুরুচাঁদে কয়।
‘‘এ’ কারে আনিলে সাথে বল দয়াময়।।’’
মধুর হাসিয়া প্রভু বলে নকুলেরে।
‘‘শুন হে নকুল আমি বলি যে তোমারে।।
এই যে মোহন মূর্ত্তি এসেছে হেথায়।
মম পিতৃদেব ইনি হরি রসময়।।
শীঘ্র করি পাতি দাও তাঁহারে আসন।
বহু ভাগ্যে পেলে তুমি তাঁর দরশন।।’’
প্রভুর বচন শুনি নকুল যে নই।
কোন গুণে দিল দেখা ক্ষীরোদের সাঁই।।
বিস্মিত-পুলক চিত্তে নকুল তখন।
কেন্দে কেন্দে পাতিলেন দুইটি আসন।।
একখানি পরে বসে প্রভু দয়াময়।
অন্যখানি জুড়ে বসে হরি রসময়।।
কিবা কব নকুলের আনন্দের কথা।
ধরনী লোটায়ে সদা কুটিতেছে মাথা।।
ক্ষণে ক্ষণে আনন্দেতে করে লম্ফদান।
বলে ‘‘জয় হরিচান জয় গুরুচান।।
কোথা রে জগৎবাসি! সবে ছুটে আয়।
এমন সুদিন তোরা পাবি না রে হায়!
হরি, হর একসঙ্গে নেমেছে ভুবনে।
দেখে যা জগতবাসি দেখে যা নয়নে।।’’
এই ভাবে করে সাধু ভাবের আলাপ।
ক্ষণে ক্ষণে যেন কহে প্রেমের প্রলাপ।।
এই ভাবে কিছুক্ষণ গত হয়ে যায়।
প্রভুকে ডাকিয়া যেন হরিচাঁদ কয়।।
‘‘আর কেন চল তবে শ্রীগুরুচরণ!
অন্য ঠাঁই মোরা এবে করিব গমন।।’’
এত বলি দয়াময় ছাড়িল আসন।
সেই ভাব দেখে তবে নকুল সুজন।।
মনে ভাবে এ রতন যদি চলে যায়।
আর কেন বেঁচে থাকি বল এ ধরায়।।
হরি বিনে বল আর বেঁচি থাকি কিসে?
এখনি ত্যজিব প্রাণ হরির সকাশে।।’’
এত ভাবি মনে মনে সেই মহাশয়।
আছাড়ি পড়িল সাধু শ্রীহরির পায়।।
‘‘যেওনা, যেওনা তুমি পরাণ-হরণ।
তুমি গেলে সেই দন্ডে ত্যাজিব জীবন।।
নয়নের মণি তুমি জীবনের আশা।
তুমি ছেড়ে গেলে প্রাণ ছাড়ে দেহ-বাসা।।
দয়া করে দয়াময় এই ঘরে রও।
যদি যেতে হয় তবে অভাগারে লও।।’’
এই মত কাঁদাকাদি করিছে নকুল।
অকুল-কান্ডারী দিল অকুলেতে কুল।।
গুরুচাঁদ পানে চাহি বসে পুনরায়।
শ্রীগুরুচাঁদের অঙ্গে পলকে মিশায়।।
ঈষৎ আভাষে তাহা নকুল দেখিল।
গুরুচাঁদ অঙ্গে হরিচাঁদ লুকাইল।।
এই দৃশ্য যেই ক্ষণে দেখিবারে পায়।
তখনি ঘুমের নেশা তার কেটে যায়।।
সজাগ হইয়া সাধু উঠিলেন কান্দি’।
পরদিন প্রাতেঃ বলে ‘‘যাব ওড়াকান্দী।।’’
কিছুক্ষণ পরে সাধু ওড়াকান্দী যায়।
প্রভুকে দেখিয়ে কান্দে পড়িয়া ধরায়।।
প্রভু কয় ‘‘কি নকুল কান্দ’ কি কারণ?
তোমার গৃহেতে যেতে আছে মোর মন।।’’
দুই দিন পরে প্রভু করিলেন যাত্রা।
নকুলের নাহি আর আনন্দের মাত্রা।।
গোপীনাথপুর আর সূচীডাঙ্গা গাঁয়।
দয়া করি উঠিলেন প্রভু দয়াময়।।
উপনীত হইলেন পরে বড়দিয়া।
হৃদয় ডাক্তার নিল যতন করিয়া।।
যে যে কীর্ত্তি পথে পথে করে দয়াময়।
ভ্রমণ বৃত্তান্তে দিব সেই পরিচয়।।
এই খানে নকুলেরে প্রভু দিল ছাড়ি।
বলে ‘‘শীঘ্র হে নকুল! যাও তুমি বাড়ি।।
তুমি অগ্রে যাও আমি আসিব পশ্চাতে।
কোন বাধা নাহি হবে তব গৃহে যেতে।।’’
প্রভুর বচনে সাধু গৃহে ফিরে গেল।
দুই দিন যায় তবু প্রভু না আসিল।।
আকুল হইয়া সাধু ছুটিল ত্বরায়।
মিলিল প্রভুর দেখা গ্রাম পদুমায়।।
প্রভু বলে ‘কি নকুল ব্যস্ত কেন বেশী।
অগ্রভাবে চল মোরা বেড়াইয়া আসি।।
তোমার ক্ষেতেতে দেখ আছে পাকা ধান।
সেই ধান কেটে মোরে করো অন্নদান।।’’
কথা শুনি নকুলের চোখে ঝরে জল।
মনে ভাবে অন্তর্য্যামী জেনেছে সকল।।
প্রভুর ইচ্ছার পরে নির্ভর করিল।
দশদিন পরে প্রভু তার বাড়ি গেল।।
স্বপ্ন-দৃষ্ট মত ঘরে করিল আসন।
গুরুচাঁদ দেখে বলে ‘‘অতি সুশোভন।।’’
পাকিল ক্ষেতের ধান কাটা হল সারা।
সেই ধানে চাল যত ভানিয়াছে তারা।।
সব চাল হল ব্যয় মতুয়া সেবনে।
নকুলের বাঞ্ছাপূর্ণ হল এত দিনে।।
একদিন পরে প্রভু গৃহে যেতে চায়।
আপন আসন হতে উঠিয়া দাঁড়ায়।।
সেই দৃশ্য নকুলের স্বপ্ন মনে পড়ে।
লোটায় পড়িল তবে প্রভু পদ ধরে।।
কেন্দে কয় ‘‘দয়াময়! যেয়োনা এখন।
যেয়োনা, যেয়োনা তুমি পতিত পাবন।।’’
যাহা দেখে স্বপ্নে তাহা ঘটিল বাস্তবে।
গুরুচাঁদ বলে ‘‘মোর যাওয়া নাহি হবে।।’’
নকুল চাহিয়া দেখে গুরুচাঁদ অঙ্গে।
মোহন মুরতি পশে প্রেমের তরঙ্গে।।
শ্রীগুরুচাঁদের লীলা সুধাধিক সুধা।
কবি কহে খেলে দুরে যায় ভব-ক্ষুধা।।
সাধক কবি অশ্বিনী গোঁসাই
অশ্বিনী গোঁসাই ধন্য প্রেম মহাজন।
কর জোড়ে বন্দিলাম তাঁহার চরণ।।
গোলকের বরে জন্ম কার্ত্তিকের ঘরে।
খুলনা জেলার মধ্যে গঙ্গাচর্না পরে।।
মহানন্দ ছিল তাঁরে শুদ্ধ প্রেমভক্তি।
শ্রীতারক দিল তাঁরে রচনার শক্তি।।
সঙ্গীতের অর্ঘ্য দিল দুই বিগ্রহেরে।
‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত’’ নামে ব্যপ্ত চরাচরে।।
পরম উদার সাধু কার্ত্তিক সুজন।
পুত্রে শিক্ষা নাহি দিল দরিদ্র্য কারণ।।
আক্ষরিক জ্ঞান মাত্র হ’ল পরিচয়।
স্বভাব শক্তিতে দেখ রচনা করয়।।
‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত’’ যদি কর অধ্যায়ন।
বুঝিবে কবির বুকে কবিত্ব কেমন।।
নবীন ভাবের রসে মাধুর্য্য মিশিয়া।
উদাত্ত সুরের রেশে চলিছে ভাসিয়া।।
প্রেমতত্ত্বে, সমহিত গানের কবিতা।
যত গান রচিয়াছে অশ্বিনী গোঁসাই।।
চিরন্তন ভাব তার পুরাতনী নাই।।
এ হেন সাধক কবি যেথা জন্ম লয়।
সেই দেশ সেই জাতি তাতে ধন্য হয়।।
এবে শোন গোস্বামীর কিছু বাল্য লীলা।
গোস্বামী বাসিত ভাল থাকিত একেলা।।
গুণ গুণ স্বরে সদা হরি গুণ গায়।
ভাবের তরঙ্গ যেন ঢেউ খেলে যায়।।
সাংসারিক অভাবেতে বহু কষ্ট পায়।
তার পিতা তাই তাঁরে মজুরী খাটায়।।
কৃষাণ রাখিল তাঁরে মালাকার বাড়ী।
কাজ করে গান গায় দিবা বিভাবরী।।
একদা দুপুরবেলা ছুটির বেলায়।
আর আর কৃষাণেরা গৃহে চলে যায়।।
অশ্বিনী গোঁসাই বলে সকলের ঠাঁই।
‘‘অগ্রভাগে চল সবে আমি পিছে যাই।।’’
সকলে চালিয়া গেল রহিল গোঁসাই।
‘হরিচাঁদ’ ‘গুরুচাঁদ’ বলে ছাড়ে হাই।।
খেজুর গাছের নীচে করি পদ্মাসন।
বসিয়া গোস্বামী হল ভাবেতে মগন।।
‘নিরালার সাথী হরি দেখা দাও মোরে।
ঝরিল নয়ন তাঁর হরিচাঁদে স্মরে।।
কান্দিয়া কান্দিয়া সাধু নিদ্রাগত হল।
সুষুপ্তির মাঝে কত স্বপন দেখিল।।
বৃক্ষতলে পড়ি সাধু সুখে নিদ্রা যায়।
রৌদ্র কর আসি তাঁর পড়িল মাথায়।।
ভকত জনেরে দেখ সবে বাসে ভাল।
দৈবে এক অজগর সেখানে আসিল।।
ভকতে চিনিতে তার বাকী নাহি থাকে।
নিজ অঙ্গ দিয়া তাই রৌদ্র কর ঢাকে।।
বহুক্ষণ গত দেখি সবে উচাটন।
‘অশ্বিনী ফিরেনা কেন তাই ভাবে মণ।।
তত্ত্ব নিতে কৃষাণেরা সেইখানে যায়।
সেই ভাবে গোস্বামীরে দেখিবারে পায়।।
বড়ই আশ্চর্য্য মনে তাহারা ছুটিল।
গৃহস্বামী কাছে আসি সকলি কহিল।।
ত্র্যস্তে ব্যস্তে গৃহস্বামী তথা ছুটে যায়।
ততক্ষণে গোস্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ হয়।।
গোস্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ দেখি অজগর।
নিজলোকে চলি গেল দৃষ্টির অন্তর।।
গৃহস্বামী এসে দেখে কোথা কেহ নাই।
একেলা বসিয়া আছে অশ্বিনী গোঁসাই।।
বিপুল বিনয় তবে সেই মহাজন।
নিজ গৃহে গোস্বামীরে লইল তখন।।
তার পরে গেল স্বামী নারিকেল বাড়ী।
মহানন্দ গোস্বামীর শ্রীচরণ ধরি।।
যেথা যায় সে অশ্বিনী সদা গান গায়।
কৃষাণের কার্য্য তাতে কম পড়ে যায়।।
তাহাতে কৃষাণ তাঁরে রাখিতে চাহে না।
যাহা বল গোস্বামীজী কথা’ত কহে না।।
দয়াময় মহানন্দ বলে তাই জেনে।
‘‘অশ্বিনী কৃষাণ র’বে আমার আঙ্গিণে।।
‘‘অকেজো’’ বলিয়া তাঁরে সবে বাদ দেয়।
আমি দেখি ‘‘বাদে কোন কাজ হয়।।’’
তদবধি নারিকেল বাড়ী তেহ রয়।
গুণ গুণ স্বরে গুণ সর্ব্বাদায় গায়।।
ভক্তের পরীক্ষা দেখ কত ভয়ঙ্কর।
পদে পদে বিপজ্জাল আছে নিরন্তর।।
নারিকেলবাড়ী পরে ছিল এক নারী।
মনে মনে ইচ্ছা তার করে ব্যাভিচারী।।
গোস্বামীর কাছে তাই করিল প্রস্তাব।
মনে মনে গোস্বামীর হ’ল বড় তাপ।।
‘‘আহা নারী! বিষ খেয়ে মরিবারে চাও।
সোজা পথ ছেড়ে কেন ‘বাঁকা’ পথে যাও।।
গোস্বামী ভাবিল মনে তারে দিব শিক্ষা।
নাম গুণে হবে পার ভীষণ পরীক্ষা।।
পুনরায় সেই নারী যবে কথা কয়।
গোস্বামী কহিল ‘‘রাজী হইনু নিশ্চয়।।
যেই দিন তব স্বামী গৃহে নাহি রবে।
আমার নিকটে তুমি খবর পাঠাবে।।
আহলাদিতা সেই নারী করে সেই মত।
গোস্বামীজী সেই গৃহে হ’ল উপস্থিত।।
কু-আশায় নারী কয় ‘‘করহ শয়ন।।’’
গোস্বামী কহিল ‘‘বসে থাকি কিছুক্ষণ।।
গুটি’কত গান আমি করিব নিশ্চয়।
পরে মোরে বল তুমি যাহা ইছ্চা হয়।।’’
স্বীকৃতা হইল নারী সাধু করে গান।
ভাব ধরে চলে যেন সুরের উজান।।
এক, দুই, তিন করি যত গান গায়।
ভাবের তরঙ্গে পাপ রসাতলে যায়।।
কাম দূরে গেল নারী পেল মনস্তাপ।
‘‘সাধুরে করেছি আমি মিলন প্রস্তাব।।
কু-চরিত্রা, অপবিত্রা আমি অভাগিনী।
সাধু গুরু মহাজনে আমি নাহি মানি।।’’
অনন্ত নরকে মোর যথাযোগ্য স্থান।
কর্ত্তব্য নহেক আর রাখিতে পরাণ।।’’
এত ভাবি সেই নারী পড়ে তাঁর পায়।
বলে ‘‘বাবা! দয়া করে রক্ষ হে আমায়।।
না চিনিয়া করিয়াছি বহু বাচালতা।
পাপ হতে রক্ষা কর হলে মোর পিতা।।’’
গোস্বামী কহিল ‘‘মাতা! বলি তব ঠাঁই।
পাপে যদি জাগে তাপ তবে পাপ নাই।।
পুনঃ যেন হেন ইচ্ছা না আসে অন্তরে।
স্বামীকে বলিও সব তাঁর পদ ধরে।।
তাঁর পদে মাপ নিয়ে হও নিষ্ঠাবতি।
স্বামী পদে সদা মাতা রাখিও ভকতি।।
পর পুরুষের সঙ্গ করে যেই নারী।
অনন্ত নরকে বাস হইবে তাহারি।।
তাই বলি পাপ চিন্তা ছেড়ে দাও মাতা।
প্রাণ পণে রাখ শুধু স্বামীর যে কথা।।
স্বামীর বচনে নারী পাপচিন্তা ছাড়।
মতুয়া হইল তারা গোস্বামীরে ধরে।।
হেনকালে প্রভুপাদ স্বামী মহানন্দ।
ত্যজিল মরত ধাম কাটি কর্ম্মবন্ধ।।
গোস্বামীজী তার পরে দুর্গাপুরে এল।
হরিবর সাধুজীর আশ্রয়ে রহিল।।
তার দলে ‘কবিগান’ করে কিছু দিন।
হরি-প্রমরসে সদা রহে বটে লীন।।
কিছু কাল পরে নিজে দল সাজাইল।
বহু স্থানে ‘কবিগান’ করে বেড়াইল।।
ইতিমধ্যে দেখা পেল গোস্বামী তারকে।
তাঁহার ‘চরণ বন্দে’ পরম পুলকে।।
মাঝে মাঝে গোস্বামীর সঙ্গে মহাশয়।
ওড়াকা্ন্দী গুরুচাঁদে দেখিবারে যায়।।
শ্রীতারক বলে তাঁরে প্রভুর বারতা।
মনোযোগে সে-অশ্বিনী শোনে সব কথা।।
গুরুচাঁদ সঙ্গে নহে বেশী আলাপন।
নিরালে চলিছে তাঁর সাধন ভজন।।
একবার গোস্বামীজী চলিলেন ঢাকা।
দল নিয়ে গান সেথা করিবেন একা।।
পদ্মা পাড়ি দিয়া গেল ঢাকার জেলায়।
দৈব যোগে নৌকা তাঁর জলে ডুবে যায়।।
গোস্বামীর যত বস্ত্র সব ডুবে গেল।
অন্তরে গোস্বামী তাতে বহু কষ্ট পেল।।
মূল্য দিয়া বস্ত্র কেনে হেন সাধ্য নাই।
মহাকষ্ট ভাবে মনে অশ্বিনী গোঁসাই।।
ভকতের দুঃখ হেরি প্রভু দয়াময়।
ভকতের দুঃখ রাশি দুর করে দেয়।।
গান অন্তে গোস্বামীজী তরীতে আসিল।
অকুল পদ্মার বুকে তরণী ভাসিল।।
চারিদেকে গোস্বামীজী ফিরিয়া নয়ন।
নৌকা মধ্যে নিজ বস্ত্র করে দরশন।।
তাড়াতাড়ি তাহা ধরি দেখিল গোঁসাই।
রয়েছে সকল দ্রব্য কিছু যায় নাই।।
তাহা দেখি প্রাণ তাঁর প্রেমে পূর্ণ হল।
‘‘কত দয়া করছ’’ বলে গান বিরচিল।।
কিছুকাল পরে তার গোস্বামী তারক।
পৃথিবী ছাড়িয়া তবে গেল পরলোক।।
সেই হতে গোস্বামীজী করে অবিরত।
ওড়াকান্দী শ্রীধামেতে সদা যাতায়াত।।
ক্রমে ক্রমে গুরুচাঁদ বলিলেন তাঁরে।
‘‘সঙ্গীত রচনা কর তারকের বরে।।
তোমারে করেছে কৃপা তারক গোঁসাই।
তাঁর মত গান কর আমি তাই চাই।।’’
কাঁন্দিয়া অশ্বিনী বলে ‘‘ওগো দয়াময়।
তারক গোলক সব আছে তব পায়।।
আমার শকতি নাই করিতে রচনা।
সব হতে পারে যদি করহে করুণা।।’’
প্রভু কয় ‘‘নাহি ভয় আমি বল দিব।
রচনা করিয়া আন আমি তা শুনিব।।’’
সেই হতে সর্ব্বদায় সেই মহাত্মায়।
গুরুচাঁদ পদে আনি গান অর্ঘ্য দেয়।।
যে যে খানে গুরুচাঁদ করেন গমন।
সর্ব্বদায় অশ্বিনীরে করেন স্মরণ।।
প্রভুর সঙ্গেতে সাধু হেথা সেথা যায়।
মানস কুসুম গাঁথি প্রভুরে সাজায়।।
ওড়াকান্দী এল তাঁরে প্রভু ডেকে কয়।
‘‘গান কর, গান কর, গোস্বামী মশয়।।’’
লৌকিক আচারে শেষ জীবনের দিকে।
ব্যথিত ছিলেন প্রভু বহুবিধ শোকে।।
বেদনার ক্ষণে তাই গোস্বামী সুজন।
সাজায়ে গানের অর্ঘ্য করিত অর্পন।।
‘‘দরদী’’ সাজিয়া প্রভু গানের অঞ্জলি।
আপনার শুভ্র করে লইতেন তুলি।।
এই ভাবে প্রভু তাঁরে বহু কৃপা করে।
বহু জনে গুরু বলে মান্য করে তাঁরে।।
বহু দেশে চলে সাধু প্রচার কারণে।
‘‘হরি গুরুচাঁদ’’ নাম দেয় সর্ব্বজনে।।
বহু গান যবে তাঁই হইল রচনা।
মুদ্রিত করিতে চায় গ্রন্থ একখানা।।
প্রভুর আজ্ঞায় গ্রন্থ হইল মুদ্রিত।
হইল গ্রন্থর নাম ‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত।।’’
ক্রমে ক্রমে এই ভাবে দিন যায় গত।
‘‘দৈবই প্রেবল ভবে’’ জানিবে নিশ্চিত।।
পরম সংযমী সাধু অশ্বিনী গোঁসাই।
কি কুক্ষণে বিয়া কৈল মনে ভাবি তাই।।
কামবাঞ্ছা গোস্বামীজী নাহি মনে করে।
‘‘প্রভুর ইচ্ছায় ধন্য’’ ভাবে নিরন্তরে।।
নারী হতে এজগতে আসিয়াছে পাপ।
বাইবেল শাস্ত্রে বলে ‘‘নারী অভিশাপ।।’’
নারীর কারণে সাধু ত্যজিল জীবন।
এবে শোন বলিতেছি সেই বিবরণ।।
ভকত চরিত্র কথা সুধা হতে সুধা।
কবি বলে পিও সবে যাবে ভব-ক্ষুধা।।
জীবনে বীতস্পৃহা ও গোস্বামীর দেহত্যাগ
``Woman! Thou art the worst
Necessity of Life.''
-P.R. Thrkur-
কাম-বাঞ্ছা হীন সাধু হরিনাম-প্রেম মধু
আনন্দ অন্তরে করে পান।
নারী বাধা নহে তায় পুত্র বাঞ্ছা প্রাণে রয়
নিতি নিতি করে তাই ধ্যান।।
কতই বিনয় করে গোস্বামীরে বারে বারে
বলে ‘‘মোরে এক পুত্র দাও।।’’
গোস্বামী তাহারে কয়, ‘‘জানিলাম সুনিশ্চয়
আমার মরণ তুমি চাও।।
কিবা হতে পুত্র দিয়ে দেখ চারিদিকে চেয়ে
পুত্ররূপে কত শত্রু রয়।
হরিপদে মন দাও পুত্ররূপে তাঁরে চাও
জন্মান্তরে পাইবে নিশ্চয়।।’’
নারী তাহে নহে বাধ্য বলে ‘‘প্রভু দেহ’’ সদ্যঃ
কেবা জানে পরে কিবা হবে?
পুত্র লাগি’ নারী সঙ্গ তাতে যদি ব্রত ভঙ্গ
বিবাহ করিলে কেন তবে।।’’
গোস্বামী কহিল ‘‘নারী! দেখরে বিচার করি
পুত্র কিংবা স্বামী তুমি চাও?
যদি পুত্রে অভিলাষ ছাড়হে স্বামীর আশ
বিদায় করিয়া মোরে দাও।।’’
নারী কথা নাহি কয় অশ্বিনী গোঁসাই তায়
মনে মনে বহু দুঃখ পেল।
মহাদুঃখে ছাড়ে হাই মনে ভাবে কেহ নাই
বন্ধু মোর কেহ না হইল।।
নারী হয়ে হল কাল আনিলাম কেটে খাল
কামিনী রূপিণী কুম্ভীরিণী।
কর্ম্মফল আছে যাহা অবশ্য ফলিবে তাহা
ইচ্ছা বুঝি করে চিন্তামনি।।
‘‘হরি লীলামৃতে আছে আপন রমণী কাছে
ঋণী ছিল প্রভু হীরামন।
পুত্রে জন্ম দিয়া তাই আর ঘরে ফিরে নাই
মোর ভাগ্যে তাহাই লিখন।।’’
নারী-বাঞ্ছা পূর্ণ করে গোস্বামীজী বলে তারে
‘‘তব গর্ভে হইবে নন্দন।
বংশরক্ষা হ’ল বটে বলি আমি অকপটে
শেষ হ’ল আমার জীবন।।’’
বীতস্পৃহা এল প্রাণে তাই ঘোরে নানাস্থানে
শেষ গান করিল রচনা।
‘‘দেখিলাম এই ভবে কোনরূপে কোন ভাবে
বন্ধু মোর কেহ ত হ’ল না।।
জীবন ত্যজিবে বলে হেথা সেথা সাধু চলে,
আঠার বাঁকীর তীরে এল।
সধুমতী ত্রি-মোহনা যেন নাহিক সীমানা
বারি মধ্যে বাঁপা’য়ে পড়িল।।
শিকারী কুম্ভীর সেথা জাগাইয়া ছিল মাথা
শিকার পড়িল ভাবে মনে।
তীরবেগে ছুটে এল গোস্বামীর কাছে গেল
চেষ্টা করে ধরিতে চরণে।।
গোস্বামী বড়ই সুখী বলে ‘‘তুই আয় মাসি।
তোর গর্ভে আমি যেতে চাই।
দেখিলাম ভবার্ণবে কোনরূপ কোনভাবে
আমার বান্ধব কেহ নাই।।’’
প্রভু কি যে খেলে খেলা কেবা বোঝে তাঁর লীলা
ইচ্ছাময় পূর্ণ সনাতন।
সাপে বাঘে কি কুম্ভীরে কভু কোন দিন তরে
তাঁর ভক্তে করেছে নিধন?
বারে বারে তিনবার সে কুম্ভীর অগ্রসর
গোস্বামীর কাছে বটে হল।
হরিভক্ত দেখে শেষে দূরে চলে গেল ভেসে
গোস্বামীর বাঞ্ছা না পূরিল।।
আঠার বাঁকীর জলে গোস্বামী আসিয়া চলে
ভেসে রয় ডোবে না কখন।
তেরখাদা গিয়া ওঠে একটা মুচির ঘাটে
সেই গৃহে রহে কতক্ষণ।।
অন্নজল সেথা খায় পরে সেথা হতে ধায়
অনির্দ্দিষ্ট পথের সন্ধানে।
কভু জলে কভু কুলে এই ভাবে ছুটে চলে
উপস্থিত হ’ল বাদাবনে।।
বনের মধ্যেতে যায় দেখে এক গৃহরয়
বনমধ্যে অতি নিরালায়।
সন্ধ্যার আগম দেখি ভাবে এই গৃহে থাকি
দেখি ভাগ্যে কি আছে কোথায়।’’
গভীর হইল রাত্রি নিরালার পথ যাত্রী
সেই গৃহে একা বসি রহে।
গৃহবাসী ছায়ামূর্ত্তি দেখিয়া গভীর রাত্রি
গৃহমধ্যে প্রবেশিতে চাহে।।
কিন্তু হ’ল একি দায় গৃহ মধ্যে কেবা রয়
অগ্নি যেন জ্বলে তার অঙ্গে।
দখল করিতে ঘর ছাড়ামূর্ত্তি পরস্পর
উৎপাত করে এক সঙ্গে।।
গোস্বামী নির্ভীক চিতে চেয়ে দেখে চারিভিতে
ছাড়ামূর্ত্তি অতি ভয়ঙ্কর।
গোস্বামী ভাবিছে মনে এরা কেন মোরে টেনে
এতক্ষণে করেনা সংসার।।
ছায়ামূর্ত্তি সবে পরে অবশ্য বুঝিতে পারে
হরিভক্ত এই মহাজন।।
তাই ডেকে তাঁরে কয় ‘‘শুন ওগো মহাশয়
তব পদে করি নিবেদন।।
শুনুণ মোদের কথা মোরা বাস করি হেথা
এই গৃহ করি অধিকার।
আপনার আগমনে শক্তি নাই কোনজনে
গৃহমধ্যে যাবে অতঃপর।।’’
এ বাক্য শুনিয়া কাণে আনন্দে গোস্বামী ভণে
‘‘শুন সবে ছাড়ামূর্ত্তি ভাই।
তোমাদের গৃহ এই আগে তাহা বুঝি কই
এবে তবে আমি চলে যাই।।’’
এতেক কহিলা গুণী করি হরি! হরি! ধ্বনি
অরণ্যের মধ্যেতে চলিল।
অতি বৃদ্ধা এক নারী এক বোঝা কক্ষে করি
গোস্বামীর সম্মুখে আসিল।।
গোস্বামীরে ডেকে কয় ‘‘শোন ওগো মহাশয়
একে নারী তাহে আমি ক্লান্ত।
দয়া করে নিলে বোঝা আমি কিছু হই সোজা
ধর যদি হয়ে কৃপাবন্ত।।’’
শুনিয়া নারীর বাণী তারে ভাবিয়া দুঃখিনী
তার বোঝা নিজ শিরে নিল।
কত দূরে গেলে পরে সে নারী জিজ্ঞাসে তাঁরে
‘‘কোন বর চাহ’’ তাই বল।।
গোস্বামী ভাবিলা মনে ‘বর দিতে চাহে কেনে
এই নারী কভু নারী নহে।
আমারে ভুলাবে বলে বোঝা নিয়ে এল কোলে
তাই বুঝি বর দিতে চাহে।।
এত ভাবি মনে মনে চাহিয়া নারীর পানে
গোস্বামীজী কহিলেন কথা।
‘‘কিবা বর দিতে চাও সেই কথা খুলে কও
মোরে বর দেয়া হবে বৃথা।।’’
হাসিয়া রমণী কয় ‘‘রহ যাহা ইচ্চা হয়
ধন জন অথবা রাজত্ব।
যাহা চাহ তাহা দিব বেশী আর কিবা কব
দিতে পারি ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব।।’’
কথা শুনি সে-অশ্বিনী ভাবে কেবা এল ইনি
মনে হয় হরের ঘরণী।
কিবা চাব তাঁর কাছে চাহিবার কিবা আছে
জীবনের শেষ এই জানি।।