মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

মধ্যখণ্ডঃ চতুর্থ তরঙ্গ

মধ্যখণ্ড
চতুর্থ তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস
জয়
শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয়
শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর
পতিত
পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয়
জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
 
শ্রীমদ গোলোক কীর্তনিয়া উপাখ্যান
পয়ার
মল্লকাঁদি বাসী কীর্তনিয়া রঘুনাথ।
তস্য জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম শ্রীগোলোকনাথ।।
রামভক্ত করিতেন রামায়ণ গান।
গন্ধর্বের মধ্যে যেন গালব প্রধান।।
নারদ করিল শিক্ষা গালব নিকটে।
রাগ রাগিণীতে তেম্নি শ্রীগোলোক বটে।।
একদিন ডুমুরিয়া গ্রামেতে আসিল।
সিকদার বাটীতে অতিথি হ’য়েছিল।।
সূর্যনারায়ণ সিকদার ডুমুরিয়া।
গোলোকে রাখিল অতি যতন করিয়া।।
নিশি ভোর শুকতারা প্রভাতী গগনে।
ব্রহ্মমুহূর্তের কালে জেগে দুইজনে।।
করিছেন হরিনাম দুই মহাশয়।
গোলোক কহিছে বড় ভাল এ সময়।।
বৈশাখী দ্বাদশী দিন ভায়রো বসন্ত।
শুনাও বসন্ত গান বাসনা একান্ত।।
সূর্য গায় বসন্ত অন্তরা গায় যবে।
গোলোক রাগিণী ধরে মধুর সু-রবে।।
কোথা হ’তে আসিল কোকিল এক ঝাক।
ঘরের চালের পরে পড়িল বেবাক।।
কীর্তনিয়া মহাশয় তান ধরে যবে।
সঙ্গে সঙ্গে তান দেয় পিককুল সবে।।
স্বরের সঙ্গেতে সেই বিহঙ্গম সব।
জ্ঞান হয় করে যেন হরেকৃষ্ণ রব।।
কিছুক্ষণ পরে সেই কোকিলের গণ।
কতক ঘরের মাঝে পশিল তখন।।
কতক পিঁড়ির পরে কতক ধরায়।
স্বরে স্বর মিশাইয়া অশ্রুধারা বয়।।
গান ক্ষান্ত ভানুদিত কিরণ ছড়াল।
কুহু রবে পিক সব উড়িয়া চলিল।।
এমন গায়ক ছিল ভক্ত শিরোমণি।
মাতাইল রামায়ণ সঙ্গীতে ধরণী।।
রামায়ণ গান যদি হ’ত কোনখানে।
বাল বৃদ্ধা যুবামত্ত হইত সে গানে।।
রাম রাম বলি যবে ধরিতেন তান।
স্মৃতি শূন্য হ’ত কারু না থাকিত জ্ঞান।।
এইভাবে গান করে জগত মাতাল।
এবে শুন যে ভাবেতে হরিবোলা হল।।
বাত ব্যাধি হ’য়ে ক্রমে অঙ্গ পড়ে গেল।
ধরাশয্যা গত ক্রমে অচল হইল।।
সবে বলে হরিঠাকুরের কাছে চল।
তাহার কৃপাতে কত রোগ মুক্ত হৈল।।
এদেশে আসেন তিনি রাউৎখামার।
এ গ্রামেও এসে থাকে মৃত্যুঞ্জয় ঘর।।
সেই ঠাকুরকে ভক্তি কর মহাশয়।
মরা জিয়াইতে পারে যদি দয়া হয়।।
গোলোক বলেছে আমি ঠাকুর না মানি।
ওর মত ঠাকুর কত মোট বৈতে আনি।।
সবে বলে নিকটেতে আছেন ঠাকুর।
রাউৎখামার গ্রাম নহে বেশই দূর।।
চল তোমা ধরে ল’য়ে যাই সেই বাড়ী।
গোলোক বলেরে দিলি ভবনদী পাড়ি।
একেবারে এসেছেন গৌরাঙ্গ নিতাই।
আজ বুঝি উদ্ধারিবে জগাই মাধাই।।
রঘু কীর্তুনের বেটা গোলোক কীর্তুনে।
ওর মত ঠাকুর ত’ আমরা মানিনে।।
কোথাকার বেটা এসে ঠাকুর কোলায়।
ওর মত ঠাকুরে আমার জুতা বয়।।
ওর মত লোক মোর নার দাঁড় বায়।
ওর মত লোক মোর পা ধুয়ে বেড়ায়।।
যত সব মূর্খ ভেড়ে ঠাকুর পেয়েছে।
ঠাকুরালি খাটে না এ গোলোকের কাছে।।
ও ঠাকুর যে মানুষ আমি সে মানুষ।
আমি বুঝি নারী অই ঠাকুর পুরুষ।।
যা থাকে কপালে হ’বে হয় হো’ক ক্লেশ।
কোথা হ’তে স্বয়ং এল কলি অবশেষ।।
আত্ম পরিজন আর প্রতিবাসী লোকে।
সবে মিলে ব’লে ক’য়ে বুঝায়ে গোলোকে।।
এ সময় গৌরব তোমার ভাল নয়।
অহংকার ছাড় এই অন্তিম সময়।।
অসুরত্ব বীরত্ব এখানে পরিহরি।
আত্মশুদ্ধ করিয়া বলহ হরি হরি।।
ঠাকুরের নাম হরি দেয় হরিনাম।
ইহকালে পরকালে পুরে মনোস্কাম।।
নহে দেব দেবী নহে কোন রূপ বার।
দেখিলে প্রত্যয় হ’বে স্বয়ং অবতার।।
হীরামন ম’রেছিল বাঁচাইল প্রাণে।
গোলোক বদন বাঁচিয়াছে প্রভু-গুণে।।
শ্রীহরিচাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
ছিল ক্ষুদ্র নমঃশূদ্র হ’য়েছে গোঁসাই।।
যাইতে হইবে শুদ্ধ ভকতি করিয়া।
মন যদি নাহি লয় আসিও ফিরিয়া।।
গোলোক কহিছে যদি ভকতি করিব।
অভক্তি অন্যায় কথা কেনবা কহিব।।
ভক্তিমন্ত হ’লে মুক্তি থাকে তার সাথ।
গোলোকে তরা’লে বলি গোলোকের নাথ।।
দুর্বাক্য আমি যে কত বলেছি তাহারে।
অন্তর্যামী হ’লে তাহা জেনেছে অন্তরে।।
সে কেন করিবে দয়া এ হেন পাপীরে।
মার খেয়ে দয়া করে তাহা হ’লে পারে।।
গোলোক কহিছে তবে ল’য়ে চল মোরে।
দেখি তোর সে ঠাকুর কি করিতে পারে।।
কর্মক্ষেত্রে ভবজীব ভোগে কর্ম ফের।
সারিতে না পারে যদি শেষে পা’বে টের।।
যদি বলিবারে পারে হৃদয়ের কথা।
তবে তার শ্রীচরণে নমিব এ মাথা।।
চারি পাঁচ জন ধরে নিল নৌকা পরে।
শয়ন অবস্থা ধরে নিল খালা পারে।।
হাতে হাতে ধরাধরি শূন্যে শূন্যে রাখে।
ঠাকুরের কাছে গিয়া ফেলিল গোলোকে।।
ঠাকুর আছেন বসে উত্তরের ঘরে।
গোলোকে রাখিল নিয়া পিঁড়ির উপরে।।
প্রভু বলে ও কারে করিলি আনয়ন।
এ নাকি শ্মশান ভূমি করিবি দাহন।।
মরা এনে কেন ফেলাইলি মোর কাছে।
মরা মাদারের গাছ গাজীর নামে বাঁচে।।
নিয়া যা তোদের মরা দূরে নিয়ে রাখ।
গাজী নামে সির্নি মেনে এক মনে থাক।।
সঙ্গে যারা এসেছিল করে পরিহার।
তারা কহে হাজী গাজী তুমি সর্বসার।।
তুমি ওঝা তুমি বৈদ্য তুমি ধন্বন্তরী
তুমি কৃষ্ণ তুমি বিষ্ণু তুমি হর হরি।।
ঠাকুর বলেন আমি কিসের মানুষ।
বিদ্যাবুদ্ধিহীন আমি অতি কাপুরুষ।।
রঘু কীর্তুনের বেটা গোলোক কীর্তুনে।
আমি কি মানুষ বাপু উহার ওজনে।।
মোর মত লোক ওর পা’র জুতা বয়।
মোর মত লোক ওর পা ধুয়ে বেড়ায়।।
মোর মত লোক ওর নার দাঁড় বায়।
মোর মত লোক ওর মোট বয়ে খায়।।
কলি কালে নাহি কোন স্বয়ং অবতার।
নলীয়া বারের পর বার নাহি আর।।
কোথা হ’তে আসিয়াছি ঠাকুর কিসের।
ব্যাধি যদি নাহি সারে শেষে পা’ব টের।।
শুনিয়া বিস্মিত হৈল গোলোকের মন।
উঠিতে না পারে বলে দেহ শ্রীচরণ।।
অপরাধ করিয়াছি বলে জানা’ব কি।
আমি দৈত্য মদে মত্ত পাষণ্ডী দেমাকী।।
ব্রহ্মাণ্ডেতে নাহি আর মো’সম পাতকী।
সুখে মত্ত হইয়া হয়েছি চির দুঃখী।।
যারা মোরে আনিয়াছে তোমার নিকট।
তাহাদের সঙ্গে আমি করিয়াছি হট।।
সবে বলে তুমি নাকি স্বয়ং অবতার।
ত্যক্ত হ’য়ে তাদের করেছি কটুত্তর।।
আমি ত’ পাষণ্ডী নাহি ভকতি আমার
তুমি’ত করুণানিধি আমি দুরাচার।।
পতিত পাবন নাম ধর দয়াময়।
এমন পতিত আর পাইবা কথায়।।
কোন যুগে পেয়েছ কি এমন পতিত।
মহাউদ্ধরণ নাম ধর কর হিত।।
অজামিলে উদ্ধারিলে সে হয় ব্রাহ্মণ।
পূর্বে তার ছিল কত সাধন ভজন।।
মাতৃসেবা পিতৃসেবা করিত সদায়।
বৈষ্ণব আচার ছিল সরল হৃদয়।।
মায়া নারী দিয়া তারে মোহে পুরন্দর।
সেই মায়া নারী সঙ্গে করে পাপাচার।।
নারায়ণ নাম ল’য়ে হইল উদ্ধার।
তাহাতে দয়াল নাম না হ’ল প্রচার।।
কলিকালে দয়াল অবতারে দুটি ভাই।
উদ্ধার করিলে প্রভু জগাই মাধাই।।
ব্রহ্ম বংশে অবতংশ জন্মালে দোহারে।
নাম ব্রহ্ম প্রচারিতে দস্যুবৃত্তি করে।।
না করে বৈষ্ণব নিন্দা পরস্ত্রী হরণ।
এ সকল পাপ না করিলে কদাচন।।
জোর জার করে খেত মারিয়া কাড়িয়া।
তাহা দোঁহে উদ্ধারিলে নাম ব্রহ্ম দিয়া।।
তোমাদের দয়াগুণ করিলে প্রচার।
তোমার হইতে হ’ল তাহারা উদ্ধার।
উদ্ধারিলে হীরানটী প্রচারিলে ভক্তি।
দারুব্রহ্ম অবতারে, তারে কৈলে মুক্তি।
ভক্তিহীন জ্ঞানহীন আমি পাপাচারী।
পশু হ’তে পশু গণ্য মিছা দেহ ধরি।।
ঠাকুর বলেন বাছা নহেত কপট।
আমার মত ঠাকুরে বহে তোর মোট।।
জগতের মোট বহি ঘুচাই সংকট।
দেরে মোট উঠাইয়া বহি তোর মোট।
গোলোক বলিছে মোট দিব দয়াময়।
হেন শক্তি দেহ যদি তবে দেওয়া যায়।।
মোট যদি নিতে চাইলে বলিলে শ্রীমুখে।
তবে মোট নিতে হ’বে এই দায় ঠেকে।।
তুমিত’ করুণাময় এবে গেল বোঝা।
নিজশক্তি প্রকাশিয়া তুলে লও বোঝা।।
ঠাকুর বলেন ভাল ঠেকাইলি দায়।
নিলাম এ বোঝা তোর গা তুলিয়া বয়।।
গোলোকের দেহে প্রভু শক্তি সঞ্চারিল।
গেল রোগ সে গোলোক উঠিয়া বসিল।।
স্বেদ কম্প পুলকাশ্রু বহিতে লাগিল।
ঠাকুরের পদ ধরি স্তব আরম্ভিল।।
ভূভার হরণ জন্য তব অবতার।
এবার হরহে! হরি গোলোকের ভার।।
পাষণ্ড দলন কৈলে গৌর অবতারে।
পাপ শিরোচ্ছেদ কৈলে দয়া অস্ত্র ধেরে।।
চক্রধারী দয়া সুদর্শন চক্র ধরি।
ভূভার হরণ কর গোলোক উদ্ধারী।।
প্রতিজ্ঞা করেছ তুমি ভূভার হরিবা।
সাধু পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতি নাশিবা।।
 
শ্লোক
পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
 
পয়ার
এ তোমার স্বীয় কার্য না করিলে নয়।
যার যে স্বভাব তাহা খণ্ডন না যায়।।
মনে ভাবি হেন কর্ম না করিব আর।
স্বভাবে করায় কর্ম দোষ কি আমার।।
তব দয়া লীলাগুণ নামগুণ কত।
কে বর্ণিতে পারে তাহা অক্ষম অনন্ত।।
যা কিছু বর্ণনা করি বলিবারে চাই।
বর্ণনায় দোষ তার তুলনাই নাই।।
যদ্যপি ভর্ৎসনা করি তবু তুমি সাঁই।
জিহ্বা মন বাক্য তুমি গোলোক গোঁসাই।।
বিধি বিষ্ণু শিব তোমা চিনিতে না পারে।
বর্ণে হারে বর্ণেশ্বরী বাগীশ্বরী হারে।।
অনন্ত তোমার লীলা বুঝে শক্তি কার।
বিধি হর হারে আর মানব কি ছার।।
ভাগবতে শ্রীমুখেতে করেছ স্বীকার।
আমার যে লীলা তা আমার বোঝা ভার।।
ভাল হ’ল ব্যাধি হ’ল মঙ্গল লাগিয়া।
পাইনু পরম পদ সেই হেতু দিয়া।।
এই মত স্তুতি বাক্য বলিতে বলিতে।
বেলা অপরাহ্ণ হ’ল বিশুদ্ধ ভাবেতে।।
প্রভু বলে যা গোলোক যা এখন ঘরে।
ভক্তিগুণে বন্দী রহিলাম তোর তরে।।
গোলোক বলিছে আর নাহি দিব ছাড়ি’।
ভক্তি নাই দয়া করে চল মম বাড়ী।।
ঠাকুর বলেন বাছা তুমি যাও ঘরে।
তুমি যাও এবে আমি যা’ব তার পরে।।
ঠাকুরে প্রণাম করি গোলোকে উঠিল।
হরিধ্বনি দিয়ে গৃহে হাঁটিয়া চলিল।।
সভাতে যতেক লোক ছিলেন বসিয়া।
সবে করে হরিধ্বনি আশ্চর্য মানিয়া।।
ঘরে ঘরে হুলুধ্বনি করে রামাগণে।
গোলোক উদ্ধার হ’ল কয়ে সর্বজনে।।
হরিচাঁদ ল’য়ে যত ভক্তগণ সাথে।
মাঝে মাঝে যান সে  গোলোকের বাড়ীতে।।
মহানন্দ চিদানন্দ সৌরকর রাশি।
দিবানিশি সমভাতি গার্হস্থ সন্ন্যাসী।।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত পদ্ম প্রস্ফুটিত।
ভক্তবৃন্দ পদ্মমধু পিয়ে সর্বজীবে।
রসনা রসনা হরি হরি বল সবে।।
 
বিধবা রমণীর ব্যাধিরূপ পৈশাচিক দৃষ্টিমোচন
পয়ার
একদা প্রভুকে দেখি যাইয়া শ্রীধাম।
অপরাহ্ণ সময়ে বিদায় হইলাম।।
আমি আর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস দু’জন।
তিলছড়া গ্রামেতে করিনু আগমন।।
উতরিনু শ্রীনবীন বিশ্বাসের বাড়ী।
তিনি রাখিলেন বড় সমাদর করি।।
আমাদের সংবাদ পাইয়া এক নারী।
নবীনের বাটীতে আসিল ত্বরা করি।।
সমস্ত রজনী হরিনাম সংকীর্তন।
সেই নারী বিষাদিতা মলিন বদন।।
নাহি আর অন্য কথা করেছে রোদন।
গোস্বামীর পদে মাথা কুটিছে কখন।।
একবার দুই হাতে দু’টি পদ ধরে।
কতক্ষণ রাখিলেন বক্ষের উপরে।।
চারিদণ্ড রজনী আছয় হেনকালে।
হরিনাম সংকীর্তন সবে ক্ষান্ত দিলে।।
সকলকে শয্যা দিয়া শুইল গোঁসাই।
একা সেই দুঃখিনীর চক্ষে নিদ্রা নাই।।
হেন অবকাশে সেই নারী কাঁদে খেদে।
ধরিলেন মৃত্যুঞ্জয় গোস্বামীর পদে।
অনাথা বিধবা আমি দুঃখিনী যুবতী।
ধরি পায় সদুপায় কর মহামতি।।
জলোদরী বেয়ারাম হ’য়েছে আমার।
দুঃখিনীরে কর এই রোগ প্রতিকার।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে আমি উপায় না দেখি।
কর্মফল ফলিয়াছে আমি করিব কি।
প্রভাতে উঠিয়া মোরা যাই নিজালয়।
সে নারী কাঁদিয়া ধরে গোস্বামীর পায়।।
তারক কহিছে আর সহেনা পরাণে।
তুচ্ছ ব্যাধি জন্য এত নিষ্ঠুরতা কেনে।।
যাহা ইচ্ছা দয়া করে তাহা দেন বলে।
শেষকালে যা থাকে তা’ হবে ওর ভালে।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে ওঢ়াকাঁদি যাত্রা কর।
প্রণামী প্রণামী দিয়া পাদপদ্ম ধর।।
পাঁচসিকে লয়ে তুই যাস ওঢ়াকাঁদি।
মহাপ্রভু পদে পড়ে কর কাঁদাকাঁদি।।
সেই নারী তাহা শুনি গিয়া নিজধাম।
নিশি জাগরণে জপে হরিচাঁদ নাম।।
কেমনে পাইব আমি প্রভুর চরণ।
বিনা সাধনায় নাহি পা’ব দরশন।।
হরিচাঁদ উদ্দেশ্যে থাকিয়া করি আশা।
বহু নিশি জাগরণে করিল তপস্যা।।
প্রাতেঃ উঠি একদিন মনে কৈল যুক্তি।
এ বিপদে হরিপদ বিনে নাহি মুক্তি।।
আমা হ’তে নাহি হ’বে সাধন ভজন।
ভরসা প্রভুর নাম পতিত পাবন।।
ওঢ়াকাঁদি গেল নারী কাঁদিতে কাঁদিতে।
দেখে একা বসে প্রভু পুকুর পাড়িতে।।
পাঁচসিকা জরিমানা রেখে পদপরে।
প্রণাম করিয়া নারী হরিপদে পড়ে।।
প্রভু দেখে পেটে ব্যাধি নহে কদাচন।
পৈশাচিক দৃষ্টি যেন উদরী লক্ষণ।
দণ্ডবৎ করি যবে শ্রীপদে পড়িল।
দয়া করি পাদপদ্ম মস্তকেতে দিল।।
গলে বস্ত্র করজোড়ে উঠিয়া দাঁড়াল।
হরি হরি ব’লে নারী কাঁদিতে লাগিল।।
বাহ্যেতে দেখায় পদ দিল মেয়েটিরে।
শ্রীপদ পরশ করে পিশাচের শিরে।।
পাদস্পর্শে সে পিশাচ মুক্তি হ’য়ে গেল।
ব্যাধিমুক্ত রমণী সে পূর্ববৎ হ’ল।।
প্রভু বলে কেন আ’লি আমার সাক্ষাতে।
মৃত্যুঞ্জয়ের কথামত আইলি মরিতে।।
আসিলি করিলি ভাল মম বাক্য ধর।
এ পাপে শ্রীক্ষেত্রধামে যাহ একবার।।
মুক্ত হ’লি কি না হ’লি বল শুনি বাছা।
মোরে এনে দেহ এক ময়ূরের বাচ্চা।।
পেটে হাত দিয়া তবে সেই নারী কয়।
ওহে প্রভু আমার ঘুচিয়ে গেছে দায়।।
ঠাকুর বলে মণি পাঁচসিকে দিয়ে।
এতবড় বিপদ কি যা’বি মুক্ত হ’য়ে।।
তোর পেটে ব্যাধি ছিল পাঁচমাস বটে।
তারে পাঠিয়েছি আমি ময়ূরের পেটে।।
পাণ্ডাদের সঙ্গে বাছা ক্ষেত্রে চলে যা।
মোরে এনে দিন এক ময়ূরের ছা।।
সে নারী শ্রীক্ষেত্রে গেল জগন্নাথে আর্তি।
রথের উপরে দেখে হরিচাঁদ মূর্তি।।
নারী বলে কেন আমি আসি এতদূর।
ওঢ়াকাঁদি আছ যদি দয়াল ঠাকুর।।
এই সেই সেই এই ভিন্নভেদ নাই।
এবে আমি ময়ূরের বাচ্চা কোথা পাই।।
রথে থেকে প্রভু বলে বাচ্চা পাইয়াছি
দেশে যা দেশে যা আমি ওঢ়াকাঁদি আছি।।
এ বাণী শুনিল যেন দৈববাণী প্রায়।
দেশে এসে গেল শেষে ওঢ়াকাঁদি গায়।।
প্রভুর চরণে নারী নোয়াইল মাথা।
কেঁদে কেঁদে কহে সেই ক্ষেত্রের বারতা।।
প্রভু বলে ওঢ়াকাঁদি আমি হরিদাস।
জগবন্ধু বলে তোর হ’ত কি বিশ্বাস।।
তেঁই তোরে পাঠাইনু শ্রীক্ষেত্র উৎকলে
বাড়ী যাগো মন যেন থাকে আমা বলে।।
ওঢ়াকাঁদি অবতীর্ণ কাঙ্গালের বন্ধু।
কবি কহে ভবসিন্ধু তার কৃপাসিন্ধু।।
 
বুধই বৈরাগীর গৃহদাহ বিবরণ
পয়ার
লক্ষ্মীপুর গ্রামে বুদ্ধিমন্ত চূড়ামণি।
ভাই ভাই ঐক্য হেন নাহি দেখি শুনি।।
একদিন দুই ভাই ওঢ়াকাঁদি গিয়া।
বাটী আসিলেন মহাপ্রভুকে লইয়া।।
ক্ষণে গান করে দোঁহে দিয়া করতালি।
ক্ষণে নাচে দুই ভাই হরি হরি বলি।।
প্রভুকে আনিয়া ঘরে পুলকিত কায়
মেয়েরা আনন্দে মগ্ন ঠাকুর সেবায়।।
হেনকালে দীক্ষাগুরু আইল বাটীতে।
দু’টি ভাই আরো পুলকিত হইল তাতে।।
নামেতে গোবিন্দচন্দ্র পাল মহাশয়।
অধিকারী কায়স্থ সে পাল উপাধ্যায়।।
রামভদ্র পাল সিদ্ধ পুরুষ রতন।
সেই বংশধর ইনি সাধু মহাজন।।
রামভদ্র পাল যদি বৃক্ষতলে যেত।
ডাক দিলে পক্কফল মাটিতে পড়িত।।
তাল তাল তোরে ডাকে রামভদ্র পাল।
বলিতে বলিতে অম্নি পড়িত সে তাল।।
অকালে অপক্ক ফল বৃক্ষেতে থাকিত।
ডাক দি’লে পক্ক হয়ে মাটিতে পড়িত।।
আম জাম বদরী বা খর্জূর কাঁঠাল।
অন্যে বলে ডাকে তোরে রামভদ্র পাল।।
বলা মাত্র ফল সব পড়িত তলায়।
অপক্ক থাকিলে পক্ক হ’ত সে সময়।।
এমন মহৎ লোক রামভদ্র পাল।
তাঁর বংশধর শ্রীগোবিন্দচন্দ্র পাল।।
শুষ্ক কাষ্ঠ ধর্ম তার স্নানাদি দু’বেলা।
তিলক ধারণ জপে তুলসীর মালা।।
এহেন গোস্বামী যবে আসিল বাটীতে।
দুই ভাই আনন্দিত হইল মনেতে।।
আসিয়া গোবিন্দ কহে বাছারে বুধই।
বসিতে আসন বাছা করিয়াছ কই।।
চূড়ামণি বুধই কহিছে দু’টি ভাই।
মহাপ্রভু নিকটেতে করিয়াছি ঠাই।।
আমাদের ঠাকুর আছেন যেই ঘরে।
দুই প্রভু সেখানে বসুন একতরে।।
গুরুদেব গোবিন্দ যাইয়া সেই ঘরে।
বলে বুধ এখানে বসা’বি আমারে।।
মেয়েছেলে কত লোক বসিয়াছে ঘরে।
আমি না বসিব এই ঠাকুর গোচরে।।
চূড়ামণি বলে যত আছ বাজে লোক।
বাহিরিতে যাও বৃদ্ধা যুবা কি বালক।।
কেহ না থাকিও আর উত্তরের ঘরে।
মাত্র দুই প্রভু থাকিবেন একত্তরে।।
শুনিয়া সকল লোক আইল নামিয়া।
ঠাকুরের শয্যাপরে গুরু বৈসে গিয়া।।
মহাপ্রভু বুদ্ধিমন্তে ডাক দিয়া বলে।
কাহাকে আনিলি মোর অঙ্গ যায় জ্বলে।।
পাল বলে গাত্র জ্বলে কিসের কারণ।
বুধাইরে কহে পাখা করহ ব্যজন।।
সাধু গুরু দেখিলে মহৎ সুখে দোলে।
আমি গুরু মোরে দেখে অঙ্গ যায় জ্বলে।।
নেরে বাছা ঠাকুরকে নিবি কোনখানে
বুদ্ধিমন্ত বলে উঠে আসুন আপনে।।
দক্ষিণ ঘরেতে দিল গুরুদেব স্থান
সেই ঘরে গুরু তবে করিল প্রস্থান।।
গ্রামবাসী যতলোক পুরুষ বা মেয়ে।
প্রভু দরশনে সবে চলিলেন ধেয়ে।।
কেহ হরি বলে কহে করে সেবা কার্য।
পুলকিত অঙ্গ সব জ্ঞান নাহি বাহ্য।।
দক্ষিণের ঘরে গুরু একা মাত্র রয়।
যেই আসে সেই বলে ঠাকুর কোথায়।।
কেহ গিয়ে উঁকি মারে দক্ষিণের ঘরে।
ঠাকুরে না দেখে দুঃখে সবে আ’সে ফিরে।।
বুদ্ধিমন্ত গুরুদেবে ভক্তি আদি করে।
পাক করিবারে দিল দক্ষিণের ঘরে।।
পাক জন্য যত কিছু দ্রব্য এনে দিল।
জল ছিটাইয়া সব দ্রব্য ঘরে নিল।।
পুনঃ পুনঃ ধৌত করি পাক পাত্র আদি।
শুষ্ককাষ্ঠে দিল জল ছিটাইতে বিধি।।
এক মেয়ে সেই কাষ্ঠে জল ছিটাইল।
পরে গুরু শুষ্ককাষ্ঠ পরশ করিল।।
পুনর্বার জল দিল গুরুদেব তায়।
পাক আরম্ভিল কাষ্ঠে অগ্নি না জ্বলয়।।
গুরু বলে নিত্য নিত্য আমি পাক করি।
শুষ্ক কাষ্ঠ উপরে সিঞ্চণ করি বারী।।
এমত কাষ্ঠত আমি পাই নাই কভু।
ঘৃতাদি ঢেলেছি কাষ্ঠ নাহি জ্বলে তবু।।
ধুমায় লোহিত চক্ষু পাক করিবারে।
এত কষ্ট পাই তোরা দেখিলি না মোরে।।
চূড়ামণি রাগ করে মেয়েদের প্রতি।
গুরুদেবে তোরা কেন না করিস ভক্তি।।
মেয়েরা বলেছে কাষ্ঠ শুকনা আছিল।
নিজে গুরু জল দিয়া কাষ্ঠ ভিজাইল।।
বুদ্ধিমন্ত চূড়ামণি প্রভুকে জানা’লে।
পাক করে গুরুদেব অগ্নি নাহি জ্বলে।।
প্রভু বলে তোর গুরু কায়স্থের ছেলে।
নমঃশুদ্র ভেবে মোরে অবজ্ঞা করিলে।।
ঘৃণা মহাপাপ স্পর্শে পালের হৃদয়।
সেই পাপে অগ্নিতাপ হীনতেজ হয়।।
ব্রহ্মতেজ বিষ্ণুতেজ অগ্নিতেজ জ্বলে।
সব তেজ নষ্ট হয় আমাকে নিন্দিলে।।
গুরুকে না চিনে বেটা করে গুরুগিরি।
অহংকারী গুরুকার্যে নহে অধিকারী।।
হেন অহংকারী লোক যথা আইসে যায়।
অগ্নিদগ্ধ নৈলে সেই স্থান শুদ্ধ নয়।।
পাকান্তে করুক সেবা তাতে ক্ষতি নাই।
অর্থলোভে গুরুগিরি এমন গোঁসাই।।
এই বাক্য মহাপ্রভু যখনে বলিল।
অবিলম্বে পাক কার্য সমাধা হইল।।
সেবায় বসিল বহু কষ্টে পাক করে।
দ্বার রুদ্ধ করি সেবা করিলেন পরে।।
সবে বলে দ্বার রুদ্ধ কর কি কারণ।
গুরু বলে না করিও ভোগ দরশন।।
দৈবে যদি কুক্কুরে আসিয়া সেবা দেখে।
কুক্কুর উচ্ছিষ্ট তাহা সেবা করিবে কে।।
বিশেষতঃ শ্রীকৃষ্ণ নৈবিদ্য তাহা নয়।
প্রসাদ না হ’লে অন্ন বৈষ্ণবে কি খায়।।
সেবা করি গুরু বৈসে আসনের পর।
হেথা প্রভুসেবা কার্যে মেয়েরা তৎপর।।
অন্ন লয়ে মেয়ে সব দিলেন প্রভুরে।
ভোজন করেন প্রভু উত্তরের ঘরে।।
একটি কুক্কুর দৈবে আসিল তথায়।
প্রভুর ভোজন পানে একদৃষ্টে চায়।।
জিহ্বা লক্ লক্ করি কাঁপিতে লাগিল।
গৃহ হ’তে প্রভু সেই কুক্কুরে দেখিল।।
পাত্র ল’য়ে প্রভু তবে আসিল বাহিরে
কুক্কুরকে অন্ন দিয়া প্রভু সেবা করে।।
পালগুরু তাহা দেখি করে হায় হায়।
কিসের ঠাকুর এই কুক্কুরে খাওয়ায়।।
হারে চূড়া হারে বুধ কাণ্ডজ্ঞান নাই।
এই ঠাকুরকে ল’য়ে তোদের বড়াই।।
ওই বেটা যশোমন্ত বৈরাগীর ছেলে।
ঠাকুর জন্মিবে কেন নমঃশুদ্র কুলে।।
অতিশয় ভালোলোক ছিল যশোমন্ত
তার ঘরে হেন ছেলে বিধির কি কাণ্ড।।
হরিভক্তি বিলাসাদি গ্রন্থ নাহি জানে।
কুক্কুর দৃষ্ট নৈবিদ্য খায় সে কারণে।।
না করে আহ্নিক স্নান নাহি জপমালা।
কুক্কুর লইয়া খায় বেশ করে লীলা।।
মেয়ে মর্দে একসাথে মিশিয়া সকল।
তাল নাই মান নাই বলে হরিবোল।।
আমি গুরু আমার নিকটে না বসিয়া।
প্রেমে মত্ত যত মূর্খ কাহাকে লইয়া।।
বুধই কহিছে হারে পোদা গুরু পাল।
ডাকিলে পড়ে না আর বেল কলা তাল।।
তুমি হও শুদ্র জাতি কায়স্থের কুলে।
গুরুযোগ্য নও গুরু অধিকারী ছেলে।।
গুরু দেখি ভক্তি নাই হয় শিষ্য মনে
শূদ্রের অবজ্ঞা হয় দেখিয়া ব্রাহ্মণে।।
হাঁড়ি মুচি জোলা দেখি ভক্তির উদয়।
গুরু কি শিষ্যের দোষ বুঝিলেই হয়।।
গ্রন্থে কহে অবৈষ্ণব গুরু কর্তে নাই।
আমাদের ভাগ্যদোষে ঘটিয়াছে তাই।।
‘বিষ্ণুর্জনাতি বৈষ্ণব’ বলে জ্ঞানীজনে।
নিন্দা কর সাক্ষাতে পাইয়া জনার্দনে।
রাজসূয় যজ্ঞে কি করিল যদুবীর।
মুচিরাম দাস পূজা কৈল যুধিষ্ঠির।
যজ্ঞে এল মুনি ঋষি ব্রাহ্মণ প্রধান।
সবার উপরে মুচিরামের সম্মান।।
শ্রীরঘুনাথের খুড়া বুড়া কালীদাস।
ঝড়ু ভুঁইমালীর উচ্ছিষ্ট কৈল গ্রাস।।
কুবের জোলার ছেলে তাত বুনে বৈসে।
কৃষ্ণের গলায় মালা পরায় মানসে।
নকিম তাহার ছেলে দেখিবারে পায়।
আরোপে দিতেছে মালা কৃষ্ণের গলায়।।
চূড়ায় ঠেকিয়া মালা ভূমে পড়ি গেল।
নকিম ডাকিয়া তার পিতাকে বলিল।।
বুনো তাঁত ওহে তাত তবে পা’বে সুখ।
উঁচু কর হাতখানা আরো একটুক।।
পিতার আরোপ পুত্র আরোপেতে জানে।
অন্তরে কৃষ্ণ আরোপ হাতে তাঁত বুনে।।
তাহার তোড়ানি যেবা ভক্তি করি খায়।
হৃদিপদ্মে কালাচাঁদে সেই দেখা পায়।।
কোন কালে পাল বেটা দেখেছিস তারে।
গালাগালি দিস বেটা মরিবার তরে।।
গৃহ হ’তে এক টাকা এনে তাড়াতাড়ি।
প্রণামী বলেছে তুমি শীঘ্র যাও বাড়ী।।
বিদায় করিতে তারে হইল উৎকণ্ঠা।
নাহি গেল বিকালে বাজায় শঙ্খ ঘণ্টা।।
দেবলা গোপাল শ্রীবিগ্রহ সেবা করে।
প্রভু বলে পাল গুরু সেবা করে কারে।।
যে গোপালে পূজা করে ওকি তারে চিনে।
গোপাল উহার পূজা ল’বে কি কারণে।।
ঝাঁজ ঘণ্টা শঙ্খ বাজায়েছে সন্ধ্যাকালে।
তাহা শুনে আমার সর্বাঙ্গ যায় জ্বলে।।
প্রাতেঃ উঠে মহাপ্রভু ওঢ়াকাঁদি যায়।
বুধই বৈরাগী তার পিছে পিছে ধায়।।
পথে হাতে আর কহে অঙ্গ জ্বলে যায়।
তাহা শুনি পাল গুরু ফিরে ফিরে চায়।।
ওঢ়াকাঁদি গিয়া প্রভু হইল উপনীত।
ফিরে এল বুদ্ধিমন্ত হ’য়ে দুঃখ চিত।।
গুরুকে প্রণাম করি বিদায় করিল।
দক্ষিণার টাকা ল’য়ে গুরু গৃহে গেল।।
অগ্রহায়ণ মাসেতে এই কার্য হ’ল।
দৈবযোগে একদিন বিপদ ঘটিল।।
মাঘমাসে বেলা দেড় প্রহর সময়।
অগ্নি লেগে বাড়ী তার দগ্ধ হ’য়ে যায়।।
দশ বিঘা জমির যে ধান্যগোলা সহ।
ঘর দ্বার শয্যা সব হ’য়ে গেল দাহ।।
হুঁ হুঁ শব্দে অগ্নি যদি উঠিলেন জ্বলি।
তার মধ্যে বুদ্ধিমন্ত ঘৃত দিল ঢালি।।
করজোড়ে গলে বস্ত্র বলেছে বচন।
শ্রীমুখের নিমন্ত্রণ করুণ ভোজন।।
তারপর ওঢ়াকাঁদি গেল দুই ভাই।
শ্রীধামে বলিল গিয়া মহাপ্রভু ঠাই।।
বলে ওহে মহাপ্রভু হইয়াছে ভাল।
বাড়ী পুড়ে গেছে এবে লক্ষ্মীপুর চল।।
লক্ষ্মীকান্ত চল যাই লক্ষ্মীপুর গ্রাম।
পরম আনন্দে সবে ল’ব হরিনাম।।
পোড়া বাড়ী শীতল করিতে কেহ নাই।
সে জন্য তোমাকে নিতে আসি দু’টি ভাই।।
চল চল মহাপ্রভু ল’য়ে দলবল।
কৃপাবারি সিঞ্চণে করুণ সুশীতল।।
শুনি মহাপ্রভু আর বিলম্ব না কৈল।
লক্ষ্মীপুর গ্রামে হরি উপনীত হৈল।।
ঠাকুরকে ল’য়ে বাড়ী যায় দু’টি ভাই।
বলে হরি বলরে সুখের সীমা নাই।।
প্রভু সেবা শুশ্রূষাদি করে ভালোমতে।
পাঁচসিকা প্রণামী দিলেন শ্রীপদেতে।।
একজোড়া নববস্ত্র আনিয়া তখন।
আদরে চাদর ধুতি করিল অর্পণ।।
প্রেমানন্দে ভাসে নাই সুখের অবধি।
প্রভুকে রাখিয়া এল ক্ষেত্র ওঢ়াকাঁদি।।
বিংশ জন ভক্ত ছিল মহাপ্রভু সঙ্গে।
আসিতে যাইতে নাম করে নানা রঙ্গে।।
শ্রীহরির কৃপাদৃষ্টি যাহার উপর।
সংসারের চিন্তা আর থাকে না তাহার।।
আদেশ করিল প্রভু ভক্তগণ প্রতি।
সকলে করহ দয়া বুধইকে সম্প্রতি।।
বুধইর বাড়ী পূর্বে যত ঘর ছিল।
ঠাকুর কৃপায় তার দ্বিগুণ বাড়িল।।
পোড়া ধান্যে অবশেষে যাহা কিছু ছিল।
তাহাতে সংসার ব্যয় স্বচ্ছন্দে চলিল।।
তারক পারকহেতু দয়িত পাগল।
কবি কহে হরিবল যাবে ভবগোল।।
মহানন্দ চিদানন্দ গ্রন্থ বিরচিত।
ভূলোক আলোক শ্রীগোলোক পুলকিত।।
 
বুদ্ধিমন্ত বৈরাগীর চরিত্র কথন
পয়ার
পাগলের বরেতে সাহসে করি ভর।
আর এক প্রস্তাব লিখিব অতঃপর।।
বুদ্ধিমন্ত বৈরাগীর চরিত্র পবিত্র।
রচনা করিতে মম শক্তি নাই তত্র।।
জয়নগর বন্দরে গিয়াছে বুধই।
হাই ছাড়ে সদা বাবা হরিচাঁদ কই।।
জোনাসুর কুঠির উপর দিয়া পথ।
সে পথে যাইতে দেখে বেগুনের ক্ষেত।।
একেত’ কার্ত্তিক মাস কুঠির উপরে।
নীল, গাজা খড়ি পোড়াইত যথাকারে।।
বহুদিন প’চে প’চে মাটি হ’ল সার।
নূতন বেগুন গাছ তাহার উপর।।
ধ’রেছে বেগুন মাত্র তোলা নাহি আর।
নূতন বেগুন সব দেখিতে সুন্দর।।
বুনোজাতি তারা ক্ষেত করিয়াছে ভালো।
নব নব বেগুনে করেছে ক্ষেত আলো।।
 দেখি দুই তিন বন্দে বেগুন উত্তম।
তার মধ্যে এক বন্দে অতি মনোরম।।
বুনোজাতি নাম তার বুধই সর্দার।
তাহার বেগুন ক্ষেত বড়ই সুন্দর।।
বুদ্ধিমন্ত তাহা দেখি না পারে রহিতে।
যেন কত দায়, নারে সুস্থির হইতে।।
হইল তাহার মনে এভাব উদয়।
এ বেগুন লাগাইব প্রভুর সেবায়।।
বাটী গিয়া বড়শী দিয়া কৈ মাছ ধরি।
সেই মাছ আর এই বেগুন তরকারী।।
লক্ষ্মীমাতা করে যদি ব্যঞ্জণ রন্ধন।
জগন্নাথ খেলে মম সফল জীবন।।
কেমনে বেগুন নিব অস্থির ভাবিয়া।
হেনকালে এক নারী উপস্থিত গিয়া।।
বুধই তাহাকে বলে শুন ওগো মাতা।
কাহার বেগুন এই জান সেই কথা।।
নারী বলে জানি আমি বার্তাকুর বার্তা।
বুধই বুনোর ক্ষেত আছে তার মাতা।।
ওই দেখা যায় সেই বুধইর বাড়ী।
বুধই বাড়ীতে নাই বাড়ী আছে বুড়ি।।
বার্তা শুনি বুদ্ধিমন্ত চলে গেল তথা।
যথায় বসিয়া আছে বুধইর মাতা।।
বুড়ির চরণে গিয়া করিল প্রণাম।
বলে মাতা মোর হয় বুদ্ধিমন্ত নাম।।
তব ছেলে বুদ্ধিমন্ত আমিও বুধই।
আমি তব ছেলে মোর মিতা গেছে কই।।
মিতা বুঝি বাড়ী নাই খেতে কিবা আছে।
শীঘ্র মোরে খেতে দাও ক্ষুধা হইয়াছে।।
বুড়ি বলে মোরা বুনো শোন ওরে বাবা।
ভাজা পোড়া ঘরে নাই খেতে দিব কিবা।।
চিড়া না বানাই মোরা মুড়ি না বানাই।
বানাইতে নাহি জানি ভাত মাত্র খাই।।
বুধই বলেছে মাতা বড় ক্ষুধা পাই।
মা বলেছি তব ভাত খেলে দোষ নাই।।
বুড়ি ভাবে মা বলে চরণে দিল হাত।
ভক্তি করে সেবা দিল খেতে চায় ভাত।।
বড়ই মমতা হ’ল বুড়ির অন্তরে।
জল দেওয়া পান্তাভাত দিল বুধইরে।।
বাবা জগবন্ধু বলি ছাড়িলেন হাই।
বলে বাবা ভাবনার ফল যেন পাই।।
বুড়ি দিল পান্তাভাত সম্মুখে আনিয়ে।
ক্ষেতে ছিল কাঁচালঙ্কা আনিল দৌড়িয়ে।।
খাইয়া বলে গো মাতা বড় ভাল খাই।
মরিচ আনিতে মা বেগুন দেখতে পাই।।
মিতা নাই বাড়ী মা কি বলিব তোমায়।
গুটি কত বেগুন লইতে ইচ্ছা হয়।।
ভাত খেয়ে দণ্ডবৎ করে তার পায়।
বুড়ির পায়ের ধূলা মাখে সর্ব গায়।।
বুড়ি বলে বাবা’ত বেগুন নিতে চেলে।
বুধই কহিছে মাতা ভাল হয় দিলে।।
আগে আগে বুড়ি যায় বেগুনের ক্ষেতে।
সুন্দর সুন্দর গুলি লাগিল তুলিতে।।
বৈরাগী ফেলিয়া দিল গায়ের চাদর।
বেগুন তুলিয়া বুড়ি রাখে তার পর।।
বেগুন তুলিল প্রায় ছয় সাত সের।
বুদ্ধি কহে আর কার্য নাহি বেগুনের।
অমনি প্রণাম করি বুড়ির পদেতে।
বেগুন চাদরে বেঁধে নিল মস্তকেতে।।
বুদ্ধি কহে আশীর্বাদ কর মা আমায়।
এ বেগুনে জগবন্ধুর সেবা যেন হয়।।
পথে আসি দাঁড়াইয়া রহিলেন বুড়ি।
বেগুন লইয়া বুদ্ধি যায় দৌড়াদৌড়ি।।
ত্বরা করি উত্তরিল বাটীতে আসিয়া।
কবজী মারিতে গেল বড়শী লইয়া।।
নৌকা বেয়ে বিলমধ্যে গিয়া তাড়াতাড়ি।
প্রধান কবজী মৎস্য মারে তিন কুড়ি।।
মৎস্য আর বেগুন লইয়া প্রাতঃকালে।
বাবা জগবন্ধু বলি ওঢ়াকাঁদি চলে।।
পথে যেতে ডাকে কোথা বাবা জগবন্ধু।
উথলিল তাহার হৃদয়ে প্রেম সিন্ধু।।
এইভাবে পথে ডাক ছাড়িতে ছাড়িতে।
উপনীত হইল ওঢ়াকাঁদির বাড়ীতে।।
প্রণমিয়া জিজ্ঞাসিল লক্ষ্মীমার ঠাই।
বলিলেন শান্তি দেবী প্রভু বাড়ী নাই।।
বুদ্ধি কহে জগবন্ধু কোথায় আমার।
মাতা বলে গিয়াছেন রাউৎখামার।।
আজ্ঞা দিল লক্ষ্মীমাতা যাহ তুমি তবে।
এনেছ বেগুন মৎস্য উহা কেবা খাবে।।
অন্তর্যামিনী কমলা জেনে মনোভাব।
বলে বুদ্ধ তোর শুদ্ধ ভক্তের স্বভাব।।
তুই মোর প্রাণাধিক তুই মোর প্রাণ।
তোর মুখে প্রভু করে অন্নজল পান।।
এনেছ যে বেগুন বুনোর ভাত খেয়ে।
বুড়ির পায়ের ধূলা অঙ্গেতে মাখিয়ে।।
কত কষ্টে এনেছ বিলের কই ধরি।
মানসে মানসা তোর ভোজ ল’বে হরি।।
এমন ভক্তির মাছ ভক্তির বেগুন।
ঠাকুর না খেলে হবে বেগুনে বেগুন।।
ব্যস্ত হ’য়ে বুদ্ধি কহে শুনগো জননী।
রাখ তব অর্ধ অংশ হরি অর্ধাঙ্গিনী।।
সেই মাছ তরকারী অর্ধ অর্ধ রেখে।
রাউৎখামার চলে মনের পুলকে।।
ঠাকুর ছিলেন রামসুন্দরের বাড়ী।
দণ্ডবৎ কৈল গিয়া শ্রীচরণে পড়ি।।
মন জেনে অন্তর্যামী বলিল তখন।
কোথা হ’তে এলি বাছা এত ব্যস্ত কেন।।
বুদ্ধি কহে বালাবাড়ী চল দয়াময়।
তাহা হ’লে আমার অভীষ্ট পূর্ণ হয়।।
এনেছি মাছ তরকারী মনে আছে তাক।
অক্রুর বালার ভার্যা করিবেন পাক।।
আপনি করুন সেবা ভক্তবৃন্দ ল’য়ে।
কমলাঁখি তাহা দেখি যাই সুখি হ’য়ে।।
বুধইর নৌকাপরে উঠে দয়াময়।
বালাদের বাড়ী গিয়া হ’লেন উদয়।।
অক্রুরের স্ত্রীর কাছে বুদ্ধিমন্ত গিয়া।
বিনয় করিয়া বলে চরণ ধরিয়া।।
যে ভাবে আনিল তাহা বলিল তখন।
বলে মাতা ভাল ক’রে করগে রন্ধন।।
অক্রুর বালার ভার্যা শুনে চমকিতা।
আমি কি করিব পাক ভয় হই ভীতা।।
ভয় ভীতা শ্রদ্ধান্বিতা ভক্তির সহিতে।
পাক করি ঠাকুরে বলিল যোড়হাতে।।
সেবায় বসিল প্রভু ভক্তগণ ল’য়ে।
প্রেমানন্দে বুদ্ধিমন্ত বেড়ায় নাচিয়ে।।
স্ত্রীর সঙ্গে অক্রুর করে পরিবেশন।
ভক্ত সঙ্গে মহাপ্রভু করেন ভোজন।।
ভোজনান্তে মহাপ্রভু করে আচমন।
সভাকরি বসিলেন ল’য়ে ভক্তগণ।
গিরি কীর্তনিয়া আর মথুর দু’জনে।
গোবিন্দ মতুয়া আদি বালারা সগণে।।
শ্রীরামসুন্দর আর গুরুচাঁদ ঢালী।
ঠাকুর নিকটে সুখে বসিল সকলি।।
পাকের প্রশংসা আর মৎস্য বেগুন।
ভোজনান্তে সবে প্রকাশিছে তার গুণ।।
সুন্দর বেগুন আর মৎস্যের আস্বাদন।
হয় নাই হবে নাক এমন সুস্বাদন।।
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে বুদ্ধিমন্ত ঠাই।
এ বেগুন কোথায় পাইলে বল তাই।।
বুদ্ধিমন্ত আদ্যোপান্ত কহে বিবরণ।
শুনে রোমাঞ্চিত সব ভক্তের গণ।।
কেহ কেহ কাঁদে প্রেমে গদ গদ হ’য়ে।
কেহ কাঁদে ঠাকুরের চরণে পড়িয়ে।।
কেহ কেহ কাঁদে প্রেমে গড়াগড়ি দিয়ে।
প্রেমের বন্যায় সবে চলিল ভাসিয়ে।।
কেহ কেহ বুদ্ধিমন্তে ধরে দেয় কোল।
প্রেমাস্ফুট শব্দে কেহ বলে হরিবোল।।
অই প্রেমে উঠে গেল কীর্তনের ধ্বনি।
প্রেমের তরঙ্গে ভাসে ভক্ত শিরোমণি।।
নাহি লোক নিন্দা ভয় অলৌকিক কাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
 
মাচকাঁদি গ্রামে প্রভুর গমন
পয়ার
মাচকাঁদি গ্রামে শ্রীশঙ্কর বালা নাম।
পঞ্চ পুত্র তাঁহার সকলে গুণধাম।।
লক্ষ্মীদেবী গর্ভজাত তারা পঞ্চ ভাই।
যেমনি পাণ্ডব পঞ্চ ঠিক যেন তাই।।
জ্যেষ্ঠ শ্রীউদয় চাঁদ ভার্যা গুণমণি
মধ্যম শ্রীজয়চাঁদ আনন্দা রমণী।।
নোয়া হরানন্দ বালা নারী রসবতী।
সেজে রামকুমার কামনা নামে সতী।।
কনিষ্ঠ শ্রীব্রজনাথ বালা শিষ্ঠাচারী।
তাহার গৃহিণী দেবী বসন্ত কুমারী।।
তিলছড়া বংশী গা’ন তাহার দুহিতা।
সাধ্বী সতী পতিব্রতা রূপ গুণান্বিতা।।
পঞ্চভাই প্রেমে মত্ত ঠাকুরের ভাবে।
ঠাকুরের নিকটেতে আসে যায় সবে।।
হরিনামে মাতোয়ারা নাহি অবসর।
হাতে কাম মুখে নাম করে নিরন্তর।।
সন্ধ্যা হ’লে গৃহকার্য করি সমাপন।
সবে মিলে বসে করে নাম সংকীর্তন।।
ঠাকুরের আজ্ঞাবহ থাকে সর্বক্ষণ।
পঞ্চভাই এভাবে করে কাল যাপন।।
একদিন হরিচাঁদ আনিব বলিয়া।
জয়চাঁদ কহে ঠাকুরের কাছে গিয়া।।
ব্রজনাথ ওঢ়াকাঁদি আসিল যখন।
ঠাকুর আছেন মম আছে নিমন্ত্রণ।।
কল্য নিমন্ত্রণ করে গেছে জয়চাঁদ
অদ্য মোরে নিতে আসিয়াছে ব্রজনাথ।।
ব্রজনাথ সঙ্গে আমি মাচকাঁদি যা’ব।
কে যাইবি আয় তথা হবে মহোৎসব।।
বলিতে বলিতে হরি বলিতে বলিতে।
চারি শত লোক সঙ্গে হৈল অকস্মাতে।।
ভক্ত হ’ল চারিশত হরি বলে মুখে।
নাচিয়া গাইয়া যায় পরম কৌতুকে।।
হরিনাম ধ্বনি ধেয়ে উঠিল গগনে।
সবে মিলে হরি বল বলেছে বদনে।।
প্রহরেক করে সবে নর্তন কীর্তন।
ঠাকুর বলিল স্নান কর সর্বজন।।
স্নান করি ভক্তসব আসিয়া বসিল।
জল খা’ব বলে সবে কহিতে লাগিল।।
এক কাঠা ধান্য জাত চিঁড়ে আছে ঘরে।
লোক দেখি চিন্তান্বিত পড়িল ফাপরে।।
একা প্রভু আসিবেন বালাদের মন।
ভকত আসিবে সঙ্গে ঊর্ধ্ব বিশ জন।।
তাহাতে হইল ভক্ত এই চারিশত।
জল সেবা করিবারে সবার সম্মত।।
জ্যেষ্ঠ শ্রীউদয় বালা মেজে জয়চাঁদ।
শ্রীরামকুমার হরানন্দ ব্রজনাথ।।
কাঁদিয়া পড়িল এসে ঠাকুরের পায়।
কি হ’বে কি হ’বে প্রভু নাহিক উপায়।।
এক কাঠা ধান্য চিঁড়া দধি দুইখান।
মাত্র পাঁচসের চিনি গেল জাতি মান।
মহাপ্রভু বলে তোর চিঁড়া দধি আন।
দেখিব কেমনে আজ যায় জাতি মান।।
চিঁড়া দধি চিনি আন আমি দেখি সব
ইহা দিয়া করিব চিঁড়ার মহোৎসব।।
ঠাকুরের সম্মুখেতে চিঁড়া এনে দিল।
দধি চিনি চিঁড়া প্রভু সকল দেখিল।।
প্রভু বলে চিঁড়া লও সভার মধ্যেতে।
একমুষ্ঠি করি গিয়া দেও সব পাতে।।
প্রভু আজ্ঞামতে চিঁড়া দিল সব পাতে।
অর্ধ চিঁড়া ফুরাইল সব পাতে দিতে।।
চিনি পাঁচ সের সব পাতে পাতে দিলা।
সব পাতে দধি দিল এক এক মালা।।
সব পাতে সব দিল আজ্ঞা অনুসারে।
জ্ঞান হয় ত্রিভুবনে ফুরাইতে নারে।।
সব ভক্ত সেবা করে অতি কুতূহলে।
প্রেমানন্দে ভিড় দিয়া হরি হরি বলে।।
চিঁড়া দধি যখনেতে লইল মাখিয়া।
দশগুণ বৃদ্ধি হ’য়ে উঠিল ফুলিয়া।।
যার পাতে দিতে যায় সেই করে মানা
চিনি দধি চিঁড়া খেয়ে ফুরা’তে পারে না।।
অলৌকিক ক্রিয়াতে বিস্মিত সর্বজনে।
খায় আর হরি হরি বলেছে বদনে।।
অশ্রুজলে সকলের বক্ষঃ ভেসে যায়
উর্দ্ধ বাহু করি কেহ হরিধ্বনি দেয়।।
কেহ বলে হেনমতে কভু নাহি খাই।
কেহ বলে হেন ভোজ কভু হয় নাই।।
চিঁড়া মাত্র ষোল সের তার অর্ধ আছে।
দ্বৈগুণ্য ভোজন দেহ অবশ হ’য়েছে।।
এমন সুস্বাদ আর কভু খাই নাই।
মধুর হইতে সুমধুর স্বাদ পাই।।
কেহ বলে ওরে ভাই শুনি তাই শাস্ত্রে।
একহাঁড়ি দধি ছিল জটিলের হস্তে।
সেই দধি কোটি কোটি ব্রাহ্মণেরা খায়।
দেবের দুর্লভ দধি স্বাদু অতিশয়।।
ব্রাহ্মণেরা খায় দধি সুধার সমান।
এত দধি দুইখান সে’ত একখান।।
কোটি ব্রাহ্মণেরা খায় যাহার দয়ায়।
সেই প্রভু মাচকাঁদি হ’লেন উদয়।।
চিঁড়াতে অক্ষয় দৃষ্টি সে প্রভু করিল।
এই সে কারণে চিঁড়া অক্ষয় হইল।।
কেহ বলে ওরে ভাই শুনেছি ভারতে।
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের কালেতে।।
রাজা দুর্যোধন ধন ভাণ্ডারেতে ছিল।
শত্রুতা করিয়া ধন বিলাইয়া দিল।।
তথাপি সে ধনাগার পরিপূর্ণ ধনে।
ধন ফুরাইতে নারে যার দয়াগুণে।।
সেই দয়াময় হরি বসিয়া সাক্ষাতে।
চিঁড়া দধি অফুরাণ তাঁহার গুণেতে।
কেহ বলে ওরে ভাই আর কিবা চাও।
যার এ আশ্চর্য লীলা তার গুণ গাও।।
শ্রীউদয় বালা চারি ভাই সঙ্গে করি।
লোটা’য়ে পড়িল ঠাকুরের পদ ধরি।।
কেঁদে বলে ওহে প্রভু ব্রহ্ম সনাতন।
পঞ্চপাণ্ডবকে রক্ষা করিলে যেমন।।
ষাইট সহস্র শিষ্য ল’য়ে মুনিবর।
সন্ধ্যাহ্নিক করিতে গেলেন সরোবর।।
পঞ্চভাই কৃষ্ণ ঠাই জানাইল দৈন্য।
কৃষ্ণা ঠাই কৃষ্ণ গিয়া খাইল শাকান্ন।।
তৃপ্তস্মী বলিয়া জল খাইল নারায়ণ।
তব তৃপ্তে জগতৃপ্ত ত্রিলোকের জন।।
অদ্য তাত করলে তাত ওহে ভগবান।
রক্ষা কৈলে ওহে প্রভু বালাদের মান।।
প্রভু বলে সেই আমি ভাব যদি তাই।
সেই আমি যদি তোরা সেই পঞ্চ ভাই।।
এই পঞ্চ ভাই তোরা দ্বাপর লীলায়।
শেষে ভবানন্দ পুত্র আমি নদীয়ায়।।
যুগে যুগে ভক্ত তোরা হইলি আমার।
এবে তোরা পঞ্চ পুত্র শঙ্কর বালার।।
আর কথা দিয়া কিবা আছে প্রয়োজন।
অন্ন পাক করহ তণ্ডুল এক মণ।।
শাক তরকারী দিয়া করহ ব্যঞ্জন।
তাহাতে স্বচ্ছন্দে হইবে পরিবেশন।।
আশ্চর্য মানিয়া সব প্রভু ভক্তগণ।
আনন্দে করেছে সবে নাম সংকীর্তন।
এক মণ তণ্ডুলের অন্ন পাক হ’ল
চারি শত ভক্ত তাহা ভোজন করিল।।
এ হেন প্রভুর লীলা অতি চমৎকার।
হরি বল কহে দীন রায় সরকার।।
 
সতী স্বামী সহ মৃতা বা দম্পতির স্বর্গারোহণ
পয়ার
প্রভু ভক্ত ব্রজনাথ অতি শিষ্টাচারী।
তার নারী নাম তার বসন্ত কুমারী।।
সাধ্বী সতী পতিব্রতা পরমা সুন্দরী।
প্রভু পদে ভক্তি মতি বলে হরি হরি।।
তিলছড়া গ্রামবাসী শ্রীবংশীবদন।
বসন্ত তাহার কন্যা হরিপদে মন।।
দিবসেতে গৃহকার্য করেন যখনে।
হাতে কাম মুখে নাম করে রাত্রি দিনে।।
যামিনীতে পতিসাথে থাকে এক ঘরে।
পতি পদ বক্ষে ধরি হরি নাম করে।।
ব্রজনাথ হরিনাম করে নিরন্তর।
ঠিক যেন এক প্রাণ এক কলেবর।।
ব্রজনাথ ব্রজভাবে মত্ত নিরন্তর।
কালক্রমে তাহার শরীরে হ’ল জ্বর।।
দেখিয়া বসন্তদেবী চিন্তাকুল ছিল।
একদিন পরে তার চিন্তাজ্বর হ’ল।।
শুনি বংশীবদন গাইন মহাশয়।
দেখিতে জামাতা কন্যা মাচকাঁদি যায়।।
সপ্তদিন জ্বরে পড়ে শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হ’ল।
ব্রজনাথ সকলকে কহিতে লাগিল।।
ভ্রাতাগণে বলে আমি চরণের দাস।
আমাকে বিদায় দেহ যাই প্রভু পাশ।।
এত বলি হরি হরি বলিতে লাগিল।
ঘনশ্বাস দেখি সবে বাহিরে আনিল।।
শয়নে নয়ন মুদে হরিপদ ধ্যায়।
হরি হরি বলিয়া জীবাত্মা বাহিরায়।।
ভাই সবে বলে কেহ করনা রোদন।
ভায়ের স্বস্থানে ভাই করেছে গমন।।
জামাতার মৃত্যু দেখি শ্রীবংশীবদন।
কন্যার নিকটে যান করিয়া রোদন।।
কহিছে বসন্তদেবী পিতার গোচরে।
হ’য়েছে পিপাসা বড় জল দেহ মোরে।।
তাহা শুনি বংশী কহে নন্দিনীর ঠাই।
কেমনে খাইবে জল ম’রেছে জামাই।
কহেন বসন্তদেবী কি কহিলে পিতা।
দাসী ফেলে কোথা যান তোমার জামাতা।।
বিলম্ব না কর পিতা ধ’রে লহ মোরে।
জীবন শীতল করি পতি মুখ হেরে।।
এ জীবন জল পান করিব কি সুখে।
আজ যদি প্রাণনাথ ত্যজিল দাসীকে।।
এত বলি সতী কন্যা উঠিয়া বসিল।
পতির নিকটে যেতে উদ্যতা হইল।।
হেটে যেতে চায় সতী উঠিতে না পারে।
দেখে ত্রস্ত হ’য়ে ব্যস্ত বংশী গিয়া ধরে।।
পিতাকে ধরিয়া সতী পতি ঠাই এসে।
অমনি শয়ন কৈল পতি বাম পার্শ্বে।।
দিলেন দক্ষিণ হস্ত পতির স্কন্ধেতে।
পতি অঙ্গ জড়িয়া ধরিল বাম হাতে।।
উচ্চৈঃস্বরে হরি নাম করি উচ্চারণ।
হরি স্মরি’ শরীর ত্যজিল ততক্ষণ।।
এ হেন মরণ দেখি ধন্য ধন্য মানি।
শোক দুঃখ নাহি কারু করে হরিধ্বনি।।
হরি হরি করি ধরি লইল শ্মশানে।
দাহকার্য সমাধিল হরি গুণ গানে।।
এক সঙ্গে দু’জনার করিল সৎকার।।
কবি কহে রবি গেল হরি কর সার।।

শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free