সভাগীতিঃ ৩য় অংশ
ভক্ত দেবীচরণের বাড়ী সভা
বানরী গ্রামেতে হয় শ্রীদেবী চরণ।
অনুক্ষণ চিন্তে গুরুচাঁদের চরণ।।
অতি শিষ্টাচারী তিনি প্রভুর ভকত।
গোঁসাই বলিয়ে তার হইল ব্যাখিত।।
ভাগ্যগুণে ম’তো হয় কোন কোন জন।
কেহ বলেছে মন্দ বলি কুবচন।।
ওড়াকান্দি ব’লে তারা না করে বিশ্বাস।
উপহাসচ্ছলে কত কহে কটুভাষ।।
কোথাকার হরি এল ওড়াকান্দি গায়।
মূর্খগণে ম’তো নাম ঢুলিয়ে বেড়ায়।।
অবতার হ’তে আর স্থান পায় নাই।
ওড়াকান্দি আসিয়েছে ক্ষীরোদের সাই।।
এই মতো নিন্দা করে সামাজিক লোক।
শ্রীদেবীচরণ গিয়ে জানায় প্রভুকে।।
যেতে হবে বানরীতে ওহে দয়াময়।
সামাজিকে বলে মন্দ সহ্য নাহি হয়।।
ওড়াকান্দি ব’লে কারে না হয় বিশ্বাস।
নিন্দা করে কত মতে বলে কটুভাষ।।
বুঝাইতে নারি পারি ঠেকিয়েছি দায়।
কৃপা করি যেতে হবে ওহে দয়াময়।।
সমাজের দ্বন্দ্ব ভাঙ্গা মম সাধ্য নয়।
সমাজে তাড়িয়ে মোরে করিয়েছে সায়।।
হইবে বিরাট সভা সজাতি সমাজে।
ত্যাগ করিবেন মোরে সে সভার মাঝে।।
এতেক শুনিয়ে প্রভু স্বীকার করিল।
আনন্দে ঠাকুর নিয়ে শ্রীদেবী চলিল।।
সঙ্গে চলে মহামান্য মিড মহাশয়।
যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস আর শ্রীবাবু অক্ষয়।।
শ্রীবিধু চৌধুরী চলে ভক্ত শিরোমণি।
অতীব সরল চিত্ত জ্ঞানে মহাজ্ঞানী।।
অত্যানন্দ চলে যত মতুয়া সুজন।
বানরীতে উপনীত প্রফুল্লিত মন।।
বৈসেন ভকত সনে প্রভু দয়াময়।
রামাগণে বামাস্বরে দিল জয় জয়।।
শ্রীদেবী স্বাপক্ষ্য যারা আনন্দে পুর্ণিত।
সবে মিলি প্রভু স্থানে হ’ল একত্রিত।।
ভক্তি চিত্তে লইলেন ঠাকুরে তুলিয়ে।
দেবী চরণের গৃহে বসিলেন গিয়ে।।
চারিদিকে ভক্তবৃন্দ মধ্যে গুরুচন্দ্র।
নক্ষত্র মণ্ডল যথা শোভে পূর্ণ চন্দ্র।।
গৃহ আলোকিত যথা বৈসে সর্বজন।
নরনারী এল ধেয়ে প্রফুল্লিত মন।।
সভার সৃজন কল্পে যত লোক ছিল।
প্রভুকে হেরিতে তারা সকলে আইল।।
প্রভুকে হেরিয়ে সবে মানিল বিস্ময়।
ওরে ভাই এ মানুষ সামান্য ত নয়।।
কিবা কমনীয় ভাই এ মুরতি খানি।
দরশন মাত্র হয় আকুল পরাণি।।
তৃষিত হরিণী যথা পেয়ে পেয়ে নীর।
অস্থিরতা দূরে গিয়ে হয় গো সুস্থির।।
তেমনি হইল সবে পেয়ে গুরুচন্দ্র।
বিদুরিত সবাকার হ’ল চিত্ত সন্দ।।
হেনভাবে বলাবলি করিয়ে সবাই।
কেহ বলে মরি ল’য়ে রূপের বালাই।
নিজ নিজ কর্মে ব্রতি হ’ল সর্বজন।
ক’রেছে সভার সজ্জা প্রকম্পিত মন।।
এদিকে দেবীচরণ আনন্দে বিভোর।
নয়নেতে প্রেমধারা ঝুরিছে অঝোর।।
আত্মস্মৃতি হারাইয়া নাচিয়ে বেড়ায়।
কি করা কর্তব্য তথা ভাবিয়ে না পায়।।
রামাগণ এসে সবে প্রভুকে নেহারে।
প্রণাম ক’রেছে তারা থাকিয়ে অদূরে।।
আড়ালে থাকিয়ে করে রূপ দরশন।
হেরিয়ে মোহন রুপ ফিরে না নয়ন।।
কেহ বলে দেখ দিদি রূপের মাধুরী।
মনে হয় রূপের বালাই ল’য়ে মরি।।
কোন বিধি গ’ঠেছিল হেন রূপখানি।
ধন্য সেই সতী যেবা ইহার জননী।।
এইমত নানা কথা বলে রামাগণে।
বিস্মিত হইয়ে রূপ নেহারে নয়নে।।
হেনভাবে বহুক্ষণ অতীত হইল।
তার মাঝে কোন জন কীর্তন ধরিল।।
অন্তঃপুরে হইতেছে পাক আয়োজন।
নানাভাবে বহুদ্রব্য হ’য়েছে রন্ধন।।
সভা সুসজ্জিত হয় বহির্বাটীতে।
সৃজন ক’রেছে সভা আনন্দিত চিতে।।
এদিকেতে মহাপ্রভু করিল ভোজন।
অপরে সেবিল যত আর আর জন।।
ক্রমাগত বহু সংখ্যা লোক আগমন।
ব্রাহ্মণাদি ভদ্রাভদ্র এল অগণন।।
সভা আলোকিত করি বৈসে সর্বজন।
প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে প্রভুর কারণ।।
শ্রীগুরু করুণাসিন্ধু অগতির গতি।
বিরাট সভায় প্রভু হ’ন সভাপতি।।
প্রভুর পার্শ্বেতে হয় মিডের আসন।
করিলেন হৃষ্ট মনে আসন গ্রহণ।।
অপরেতে বসিল যত ভদ্র মহোদয়।
বসিলেন সর্বজন আনন্দ হৃদয়।।
অগণিত লোক এসে ব’সেছে সভায়।
সামাজিক লোকে কথা হেসে হেসে কয়।।
শুনে স’ব ঠাকুরের ধরম করম।
পারে যদি আমাদের নাশিবারে ভ্রম।।
তবে ত ঠাকুরে মোরা মানিয়ে লইব।
না হলে এদেশে আর স্থান নাহি দিব।।
এরূপ ধারণা করি ব’সেছে সবাই।
প্রভুরূপ নিরখিয়ে ভুলে গেছে তাই।।
পাশরিয়ে নিজ নিজ মনের কল্পনা।
কেহ করে ঠাকুরের রূপের বর্ণনা।।
বলে আমি না মানিব সমাজের বাধা।
ঠাকুরে প্রতি কোন নাহি মোর ধাঁধাঁ।।
মানুষেতে নাহি মিলে এমন লক্ষণ।
আজানুলম্বিত ভুজ হের সর্বজন।।
হেনরূপ কভু আর নয়নে না দেখি।
রূপ হেরে পারি নাক পালটিতে আঁখি।।
হায় হায় একি হ’ল না পারি বুঝিতে।
ভুবন মোহন রূপ ধরে না আঁখিতে।।
এ হেন মানুষ পরে মন্দ হয় যার।
সেই জন বিশ্ব মাঝে অতি দুরাচার।।
এইমত বলাবলি করে কোন জন।
কেহ করে ফুলহার প্রভুকে অর্পণ।।
কেহ গিয়ে পরাইল মিডের গলায়।
যথাযোগ্য ব্যক্তিগণ আনন্দে দোলায়।।
অপরেতে কোন ব্যক্তি করেন বক্তৃতা।
মিড প্রতি ধন্যবাদ করি কহে কথা।।
শুনে মিড প্রভু পাশে চাহি অনুমতি।
বক্তৃতা করেন মিড সভায় সম্প্রতি।।
তোমাদের আশীর্বাদ ধরিলেম শিরে।
কৃতার্থ হইনু গুরুচাঁদ কৃপা বরে।।
তিনি হ’ন নমকুলে সর্বগুণাকর।
অনাদি পুরুষ ইনি ব্রহ্ম পরাৎপর।।
তার কৃপাযোগে আমি এদেশে এসেছি।
তার করুণাতে আমি সম্মান পেয়েছি।।
অন্ধের নয়ন মণি অজ্ঞানের জ্ঞান।
বায়ুরূপে সবাকার দেহে অধিষ্ঠান।।
তাহাকে চিনিব হেন সাধ্য আছে কার।
বিশ্বে যার লীলাগুণ অপার অপার।।
এতশুনি সর্বজনা মানিল বিস্ময়।
কেহ বলে এই মিড কেন হেন কয়।।
রাজবংশে জন্ম যার মানব প্রধান।
সে কেন ঠাকুরে করে এমত ব্যাখ্যান।।
মনে হয় ঘটিয়েছে মস্তিষ্ক বিকার।
তাই বলে হেন ভাব সভার মাঝার।।
কেহ বলে ঠাকুরের আছে কোন শক্তি।
সে কারণ এ সাহেব করে হেন উক্তি।।
মোহিনী মন্ত্রেতে ওকে বাধ্য করিয়েছে।
নইলে কি সাহেব থাকে ঠাকুরের কাছে।।
পুন বলে মিড প্রতি অমিয় বচন।
যে যেমন বিশ্বমাঝে সে ভাবে তেমন।।
আপনাকে নীচ ভেবে অন্যকে বাঁড়ায়।
সেই সে মহান ব্যক্তি এ বিশ্ব ধরায়।।
মিড বলে যেই জন শক্তি করে দান।
কেবা আছে বিশ্ব মাঝে তাহার সমান।।
প্রভু বলে সেই জন বুঝে সে সন্ধান।
বিশ্ব মাঝে সেই ব্যক্তি পরম মহান।।
মিড বলে সর্ব শক্তি যাহার গোচরে।
কেবা আছে হেন আর বিশ্ব চরাচরে।।
প্রভু বলে আমি কিসে হই ভগবান।
আমি দ্বিজ নমশূদ্র জাতির সন্তান।।
মিড বলে পূর্বে যাহা বুঝিয়ে নিয়েছি।
সেই কথা এবে আমি পুনঃ বলিতেছি।।
ভগবান অঙ্গ চিহ্ন আছে অই অঙ্গে।
প্রকাশ করিব তাহা বাক্যের প্রসঙ্গে।।
শ্লোক
পঞ্চদীর্ঘ পঞ্চসূক্ষ্ম সপ্তরক্ত ষরন্নত।
ত্বং ব্রষ্য পৃথি গাম্ভীর্য্য দ্বাবিংশ লক্ষণ মহান।।
এই সব চিহ্ন যার অঙ্গে শোভা পায়।
মানব রূপেতে ভ্রমে এ বিশ্ব ধরায়।।
তাকে যদি ভগবান ব’লে মেনে নয়।
কে ঠেকাবে তারে হেন কেবা সেই হয়।।
এক দুই তিন চিহ্ন যাহার দেখিবে।
অবশ্য মহাপুরুষ বলিয়ে মানিবে।।
আর অঙ্গে সব চিহ্ন বর্তমান রয়।
তাহার চরণ তলে নিয়েছি আশ্রয়।।
স্বজাতি বিজাতি ব’লে কিবা আছে তাঁর।
তাঁর কাছে নাহি কোন জাতির বিচার।।
এইভাবে বলে কথা মিড মহাত্মন।
বাক্য কাটাকাটি করে শুনে সর্বজন।।
বড়ই অদ্ভুত খেলা খেলে গুরুচাঁদ।
মিডকে করেন সদা উচ্চপদ দান।।
মিড তাহা নাহি শুনে ভ্রমেও কখন।
অনুক্ষণ প্রভুপদ করিছে বন্দন।।
প্রভু প্রতি বলে মিড বিনয় করিয়ে।
আপনার লীলা তত্ত্ব না পাই বুঝিয়ে।।
আপনি করে কর্ম অন্যে দিয়ে ভার।
বুঝিতে তাহার তত্ত্ব কি শক্তি আমার।।
হেন শক্তি নাহি মম এ ক্ষুদ্র আধারে।
কিবা জানাইব এই সভার মাঝারে।।
এই ভাবে হ’ল মহাভাব উদ্দীপন।
মোহিত হইল যেন সভ্যসদগণ।।
প্রেমানন্দ উপজিল সেই সভামাঝ।
কেহ বলে কিবা শুভদিন হ’ল আজ।।
দেবীকে নিন্দিত যত সামাজিক গণে।
পতিত হইল তারা প্রভুর চরণে।।
ক্ষমা ভিক্ষা চাহে সবে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
নয়নের জলে দিল বক্ষ ভাসাইয়া।।
সন্দেহ দোলায় আর নাহি একজন।
সমূলেতে হ’য়ে গেল সন্দেহ ভঞ্জন।।
কেঁদে কেঁদে প্রভু পদে মাগে পরিহার।
হায় হায় শব্দ মাত্র সভার মাঝার।।
জানি না মূলের কত মন্দ বলিয়াছি।
তে কারণ শ্রীচরণে দোষী হইয়াছি।।
অপরাধ ক্ষমা কর ওহে দয়াময়।
অভাজন ব’লে প্রভু না হও নিদয়।।
পতিতের বন্ধু ভবে আর কেহ নাই।
পতিত পবিত্র কর এই ভিক্ষা চাই।।
এই মত কেঁদে কেহ চরণে জানায়।
মধুর বাক্যেতে প্রভু ব’লেছে তথায়।।
দেবীকে বাসিও ভাল ঘুচিবে সংশয়।
কর সদা হরিনাম দূরে যাবে ভয়।।
ওড়াকান্দি যাতায়াত কর দেবী সনে।
দূরে যাবে মনব্যথা শান্তি পাবে প্রাণে।।
এইমত বলি প্রভু শান্তাল তাহারে।
অবিরত সে জনার দু’নয়ন ঝরে।।
দেবীর চরণে গিয়ে মাগে পরিহার।
দেবী বলে চিরবন্ধু তোমার আমার।।
তোমাদের কারণেতে এল গুরুচাঁদ।
তোমরা প্রকৃত ভক্ত ঘুচালে বিষাদ।।
এই মত বলে যত শ্রীদেবী চরণ।
ততই আকুল হ’য় সে করে রোদন।।
এইভাবে হ’ল মহা তরঙ্গ উদয়।
নাহি আর দ্বেষাদ্বেষী সব ভেসে যায়।।
ভেসে গেল কুলমান প্রেমের সাগরে।
বহু লোক কেহ কিছু বুঝিতে না পারে।।
সেই হইতে অনেকেই মতুয়া হইল।
দ্বেষাদ্বেষী ভাব আর প্রাণে না থাকিল।।
আনন্দে পূর্ণিত হ’য়ে সভা সাঙ্গ হয়।
কি যেন কি হ’য়ে গেল মুখে না জুয়ায়।।
কেহ কেহ বলে ভাই কি যেন কি হ’ল।
বলিতে শকতি আজ কারো না আসিল।।
মিডের বাক্যেতে যেন হারাইল জ্ঞান।
কেমন ভাবেতে মিড দেখাল প্রমাণ।।
শুনে প্রমাণের কথা সন্দেহ ঘুচিল।
কি যেন কি হৃদি মাঝে আনন্দ বাড়িল।।
যত বলে তত শুনি মধুর মধুর।
বুঝিলাম ভবারাধ্য মোদের ঠাকুর।।
ওড়াকান্দি ব’লে আর নাহি অবিশ্বাস।
পাপ তাপ দূরে গেল তিমির বিনাশ।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ বলে নানামতে।
শুনিয়ে কাহার দুঃখ হইল মনেতে।।
সে ব’লেছে হায় হায় দুরাদৃষ্ট হ’লে।
পেয়ে নিধি চিনিতে না পারে কর্মফলে।।
কেহ বলে শুন ভাই তাহার কারণ।
কেমনে চিনিবে বল সাধনের ধন।।
কর্মদোষে অজ্ঞানান্ধ হয় ধরাধামে।
কভু নাহি হয় রুচি সুমধুর নামে।।
মায়া মোহে আবরণ তাহার চক্ষেতে।
চিনিতে পারে না তবু পেলেও সাক্ষাতে।।
সকলি তাহার খেলা বোঝা বড় দায়।
কেবা জানে কা’কে দিয়ে কি খেলা খেলায়।।
একেরে করেন ভক্ত অন্যে করে দ্বন্দ্ব।
কাহাকে করিয়ে রাখে ভবে অজ্ঞানান্ধ।।
বোকা না থাকিলে কে চিনিত জ্ঞানবান।
পাষাণ্ডিত হ’লে কেবা চিনি ভগবান।।
পাষণ্ড দলন নামে কবে কে বলিত।
পতিত পাবন ব’লে কবে কে ডাকিত।।
চোর না থাকিলে সাধু না হ’ল প্রকাশ।
কর্ম না থাকিল ভবে কে কাটিত পাশ।।
এ কারণ নহে মন্দ পাষণ্ডী কখন।
অসাধু সাধুর বন্ধু যেন সর্বক্ষণ।।
দেবীচরণ ঠাকুর পেয়েছে ঠাকুর।
তাই অদ্য দেখাইল এ লীলা প্রচুর।।
এইমত সরলার্থ করিতে করিতে।
অনেকেই চলে যায় নিজ আবাসেতে।।
এইভাবে হইতেছে কথোপকথন।
অন্তঃপুরে হইয়েছে রান্না সমাপন।।
শ্রীদেবী বিনয় করে কহে প্রভু প্রতি।
ভোজন করুন এবে অগতির গতি।।
সেই বাক্যে সবে মিলি করিল ভোজন।
সর্ব শান্তি হ’ল গুরুচাঁদের কারণ।।
(এক লাইন জ্ঞাপ)
ভক্তগণে হরি বলে পরম আহ্লাদ।।
এইভাবে অন্ধকার দূরীভূত কৈল।
হরিগুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
মহাপ্রভুর চাঁদকাটি গমন
চাঁদকাটি গ্রামবাসী গোপাল বিশ্বাস।
প্রভুর পদেতে তাঁর একান্ত বিশ্বাস।।
সরল চরিত্র হয় অতীব সদ্জ্ঞানী।
প্রভুকে লইতে বাঞ্ছা করিলেন তিনি।।
কৃপাময় গুরুচাঁদ ভক্তগণ সাথে।
সাজিলেন কৃপা করি ভক্ত গৃহে যেতে।।
শ্রীযজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস বুদ্ধে বৃহস্পতি।
শ্রীবিধু চৌধুরী সুজন মহামতি।।
শ্রীবিপিন চন্দ্র বালা আর সনাতন।
শ্রীরাজ কুমার আর শ্রীষষ্ঠীচরণ।।
দিগম্বর কীর্তনিয়া মল্লকাঁদি বাস।
প্রভুর সঙ্গেতে চলে পরম উল্লাস।।
অন্যান্য অনেক ভক্ত সঙ্গেতে গমন।
হরিচাঁদ বলি তরী বাহিল তখন।।
মালীখালী উপনীত হইলেন গিয়ে।
শ্রীবদন চন্দ্র রায় আইল শুনিয়ে।।
প্রভুকে নেহারি সেই রায় মহাশয়।
আরোহিল তরী পরে ভাবাশ্রিত কায়।।
গুরুচাঁদ পাদপদ্মে করিল মিনতি।
কৃপাদান কর প্রভু অগতির গতি।।
বলিতে না পারে আর ভাবেতে বিভোর।
বহিতেছে প্রেমধারা নয়নে অঝোর।।
কৃপাদান করিলেন প্রভু গুরুচাঁদ।
উপনীত তাঁর গৃহে সঙ্গে পারিষদ।।
উত্তম আসনে বৈসে কৃপার সাগর।
শ্রীবদনচন্দ্র রায় ভাবেতে বিভোর।।
প্রভু আগমন বার্তা শুনে গ্রামবাসী।
বহু নরনারী তথা উপজিল আসি।।
চারিদিকে ভক্তবৃন্দ মধ্যে গুরুচন্দ্র।
নক্ষত্র বেষ্টিত তথা শোভে পূর্ণচন্দ্র।।
নেহারিয়ে রামাগণে দিল হুলুধ্বনি।
ভক্তগনে প্রেমানন্দে করে হরিধ্বনি।।
কেহ কেহ ঠাকুরের রূপ নিরখয়।
দু’নয়নে প্রেমধারা বক্ষ ভেসে যায়।।
কোন জন তাঁর মাঝে ধরেছে কীর্তন।
কীর্তনেতে সবে হয় প্রেমেতে মগন।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় মধুর মধুর।
নরনারীগণ শান্তি পাইল প্রচুর।।
অন্তঃপুরে করে রান্না যত রামাগণ।
রন্ধন করিতে নারে মন উচাটন।।
প্রেমেতে পূর্ণিত হ’য়ে রান্না সমাপিল।
কীর্তনান্তে মহাপ্রভু ভোজন করিল।।
পুনরায় কীর্তনেতে মাতিল সকলে।
হুঙ্কার করিছে কেহ জয় হরি বলে।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় গুরুচাঁদ।
হীরামন মৃত্যুঞ্জয় শ্রীগোলক চাঁদ।।
জয় জয় দশরথ জয় মহানন্দ।
জয় কবি রসরাজ শ্রীতারক চন্দ্র।।
জয় শ্রী অশ্বিনী জয় কহ সর্বজন।
জয় জয় ইত্যাদি শ্রীহরি ভক্তগণ।।
এইভাবে প্রেমে মাতে মতুয়ারগণ।
বহিল প্রেমের বন্যা কে করে বারণ।।
এহেন ভাবেতে নিশি প্রভাত হইল।
হরি ব’লে তরী খুলে বাহিরে চলিল।।
উপনীত চাঁদকাটি বাজার নিকটে।
গোপাল বিশ্বাস এসে দাঁড়াইল তটে।।
গললগ্নী কৃতবাসে বলেছে তখন।
এই স্থানে করিবেন প্রভু পদার্পণ।।
ভক্তির্বাধ্য গুরুচাঁদ তীরেতে নামিল।
ভক্তগণ কেহ কেহ সঙ্গেতে চলিল।।
বসিলেন মহাপ্রভু করুণা করিয়ে।
ভক্তগণ বসিলেন প্রেমপূর্ণ হিয়ে।।
মিছরির শরবত প্রস্তুত করিল।
মনোনীত ভাবে সবে সেবন করিল।।
প্রেমানন্দে পুনরায় আইল তরণী।
ভক্তগণে বাহে তরী দিয়ে হরিধ্বনি।।
ভরত মণ্ডল হয় নাও টানাবাসী।
তাহার ঘাটেতে তরী উতরিল আসি।।
রামাগণে বামাস্বরে করে হুলুধ্বনি।
প্রেমভরে মতুয়ারা করে হরিধ্বনি।।
অগণিত ভক্ত এসে হইল উদয়।
ভক্তিভরে প্রণমিল মহাপ্রভু পায়।।
ভরত মণ্ডল এসে প্রভু সন্নিধানে।
ভক্তি চিতে বলিতেছে মধুর বচনে।।
প্রেমে গদগদ চিত্ত ভাবেতে বিভোর।
নয়নেতে প্রেমধারা ঝরিছে অঝোর।।
ফুকুরিয়ে প্রভু স্থানে বলেছে বচন।
কৃপা কর মহাপ্রভু জগত জীবন।।
আপনার এই গৃহে চলুন একবার।
ভজন বিহীন আমি অতি দুরাচার।।
এমত বলিতে গিয়ে কাঁদে উভরায়।
কৃপা করি চলিলেন প্রভু দয়াময়।।
ভক্তির্বাধ্য ভবারাধ্য বুঝি ভক্ত মন।
ভকতের গৃহে প্রভু করেন গমন।।
ভক্তগণ সঙ্গে করি বসেন কৌতুকে।
বহুলোক এসে তথা প্রণমে প্রভুকে।।
কেহ কেহ প্রভু রূপ করে নিরীক্ষণ।
বিস্মিত হইয়ে করে নয়ন দর্শন।।
কেহ বলে হেন রূপ না দেখি কখন।
আহা কি মধুর রূপ ভুবন মোহন।।
চতুর্দিকে রহিয়াছে ভকত মণ্ডলী।
নব ঘন মেঘে যেন খেলিছে বিজলী।।
অঙ্গচ্ছটা বাহিরায় বিদ্যুৎ আকার।
তপত সুবর্ণপ্রায় মরি কি বাহার।।
আহা কিবা শোভে গুরুচাঁদ মূর্তিখানি।
মেঘের কোলেতে যথা শোভে সৌদামিনী।।
এইভাবে বহুজন বলিতে লাগিল।
অপরেতে ভক্তগণ নাম আরম্ভিল।।
প্রেমাবেশে মত্ত যত মতুয়ার গণ।
কীর্তনের ধ্বনি উঠে ভেদিয়ে গগণ।।
নরনারী অনেকেই ঢলিয়ে পড়েছে।
কেহ বা মূর্ছিত হয়ে ভূমেতে রয়েছে।।
এইভাবে হ’ল নাম দ্বিতীয় প্রহর।
বহিল ভাবের বন্যা অতি খরতর।।
গুরুচাঁদ বলি কেহ কাঁদে উভরায়।
নয়ন জলেতে তাঁর বক্ষ ভেসে যায়।।
কেহ কেহ আস্ফালন করে হরি বলে।
মাতৃগণে রান্না করে ভাসে আখিজলে।।
শাক শুক্তা ডাল ডালনা বিবিধ ব্যঞ্জন।
ভক্তিভরে পরমান্ন করেছে রন্ধন।।
নাম ক্ষান্ত করিলেন মতিয়ার গণ।
স্নান সমাধিয়ে সবে করিল ভোজন।।
ভক্তিভরে যোগাইল প্রভুর সেবায়।
প্রভু মোর করে ভোজ আনন্দ হৃদয়।।
বিশ্রাম করেন প্রভু শয্যাতে বসিয়ে।
নানা কথা বলে কেহ নিকটে আসিয়ে।।
প্রভু বলে মম কথা শুন সর্বজন।
এই দেখ আসিয়েছে অভয় চরণ।।
চেয়ে দেখ দাঁড়িয়েছে চক্ষে বহে জল।
চলরে সবাই মোরা সেই গৃহে চল।।
এত বলি ম’তোগণে দিল হরিধ্বনি।
প্রভুর চরণে পৈল ভরত রমণী।।
শান্তাইয়ে মহাপ্রভু গমন করিল।
হরিগুরুচাঁদ প্রীতে হরিধ্বনি বল।।
অভয়চরণের গৃহে মহাপ্রভুর গমন
অভয় চরণ নাম, চাঁদকাটী বাসধাম,
হালদার উপাধি তাহার।
পরম দয়াল গুরু, চাঁদ বাঞ্ছাকল্পতরু,
চলিলেন অভয়ার ঘর।।
অভয় চরণ পরে, প্রেম পূর্ণ কলেবরে,
করে দিল উত্তম আসন।
বসিলেন তদুপরে, ভক্তগণ সমিভ্যরে,
গুরুচাঁদ ভকত রঞ্জন।।
হেরিয়ে রূপ মাধুরী, মোহিত যে নরনারী,
অনিমেষে সবে চেয়ে রয়।
গুরুচাঁদ রূপ ছবি, উদিল অক্ষর রবি,
চারিদিকে হ’ল দীপ্তময়।।
হেরিয়ে রূপের ছটা, খসে গেল পঞ্চকাটা,
কুল লাজ ভয় গেল দূরে।
মজিয়ে সে রূপ রসে, আখিজলে যায় ভেসে,
কেহ ডুবে রূপের সাগরে।।
এইমত জনে জনে, আপ্লূত হইয়ে মনে,
হাবুডুবু খায় অবিরাম।
প্রেমের তরঙ্গ মাঝে, ভাসে ভকত সমাজে,
তরঙ্গের নাহিক বিরাম।।
এইমত বহুক্ষণ, হল প্রেম প্রস্রবণ,
অপরেতে তরঙ্গ থামিল।
সবে বলে হরি হরি, দুনয়নে বহে বারি,
ক্রমে ক্রমে সবে শান্ত হ’ল।।
পুনঃ ধরি সংকীর্তন, প্রেমেতে হ’ল মগন,
উচ্চৈঃস্বরে করে হরিনাম।
মুহুর্মুহু হরিধ্বনি, শুন্যেও শুনায় ধ্বনি,
সে ধবনির নাহিক বিরাম।।
কেহ করে স্তব স্তুতি, তোমা বিনে নাই গতি,
মতি গতি তুমি সর্বসার।
(এক লাইন জ্ঞাপ)
প্রেমের বারিধি তুমি, তুমি হও অন্তর্যামী,
কলিজীব করিতে তারণ।
উদয় হয়েছে তাই, তুমি হে ক্ষীরোদ সাই,
দীনবন্ধু পরম কারণ।।
মায়ামোহ অন্ধকার, নাশিবারে অবতার,
তাহে সব সকরুণ ভাতি।
কলির কলুষ মত, করিবেন দূরীভূত,
জ্বেলে জ্ঞানালোক বাতি।।
এইরূপে ভক্ত যত, হয়ে সবে প্রেমাশ্রিত,
ভাসিতেছে প্রেমের গোলায়।
মত্ত হরি প্রেম সুখে, কেহ বা প্রলাপ বকে,
কত ভাব প্রকাশ হে হয়।।
বলে ওহে গুরুচাঁদ, দেহ মোরে রাঙ্গাপদ,
নিস্তার করহ দীনহীনে।
কেহ হারাইয়ে স্মৃতি, বলে মোর কত গতি,
আর কেহ নাই তোমা বিনে।।
তুমি মোর নীলমণি, আমার হৃদয় মণি,
আয় মোর হৃদয় রতন।
মানুষে মানুষে মিশে, উদিলরে এই দেশে,
আমি তোরে চিনেছি এখন।।
তুমি মম হরিচাঁদ, সেজেছিস গুরুচাঁদ,
হরি এবে মূর্তি হরিহর।
আকারে আকার ঢাকা, তবু রূপ যায় দেখা,
তুই সেই সর্ব মূলাধার।।
এমত বলিতে গিয়ে, ধৈর্য বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে,
হরি বলে লোটায় ধরণী।
কেহ বা আকুল হয়ে, যতনে নিল তুলিয়ে,
কর্ণমূলে করে হরিধ্বনি।।
প্রেমের নাহিক ক্ষান্ত, বহিতেছে অবিশ্রান্ত,
নরনারী অনেকে বিহুশ।
কেহ বলে কোথা হরি, এসে হে মস্তক ‘পরি,
তুই সেই মনের মানুষ।।
এইমত বহুক্ষণ, হয় প্রেম প্রস্রবণ,
অতঃপর তরঙ্গ থামিল।
নাম গান হ’ল ক্ষান্ত, সকলে হইল শান্ত,
প্রেমভরে হরিধ্বনি দিল।।
গোপালের গৃহে গমন
শান্ত ভাবে হ’ল যত মতুয়ার গণ।
রান্না শেষ করিয়েছে যত রামাগণ।।
নানাবিধ দ্রব্য কত উপাদেয় খাদ্য।
করিতেছে আয়োজন প্রাণে যাহা সাধ্য।।
ঘৃতপক্ক ডাল ডালডা ভাজা বড়াবড়ি।
চালিতা অম্বল আমসির চড়চড়ি।।
অতঃপর মহাপ্রভু বৈসেন ভোজনে।
আনিয়ে সকল দ্রব্য যোগায় যতনে।।
দুই তিন গৃহ হ’তে আনিয়ে যোগায়।
(লাইন জ্ঞাপ)
মতুয়ার গণ সবে ভোজনে বসিল।
প্রেমভরে কেহ কেহ ভীর আরম্ভিল।।
হরিচাঁদ জয় জয় গুরুচাঁদ জয়।
শ্রীগোলোক হীরামন জয় মৃত্যুঞ্জয়।।
এইমত পদ করি ভীর দিল সবে।
ভোজ শেষ করিলেন পরম উৎসবে।।
অতঃপর তাম্বুলাদি করিয়ে সেবন।
পুনরায় আরম্ভিল মধুর কীর্তন।।
প্রেমাবেশে মত্ত হ’য়ে করে হরিনাম।
নাম রসে হ’ল মগ্ন নাহিক বিরাম।।
প্রেমেতে বিহ্বল অতি ডগমগ কায়।
হরিচাঁদ বলি সবে ধূলাতে লোটায়।।
কেহ বা গর্জন করে সিংহসম ধ্বনি।
মনে হয় যেন তাহে কম্পিত ধরণী।।
এই ভাবে করে তথা নিশি জাগরণ।
কীর্তনেতে মাতোয়ারা মতুয়ার গণ।।
প্রভাতে উঠিল ভানু থামিল তরঙ্গ।
সবে মিলি হরি বলি নাম করি সাঙ্গ।।
প্রাতঃক্রিয়া করিলেন হরষিত হৃদে।
সব ভক্ত প্রণমিল গুরুচাঁদ পদে।।
পরে প্রভু ভক্তগণ করিয়ে সংহতি।
গোপালের গৃহে চলে অগতির গতি।।
চাঁদকাঠী উপনীত মনের হরিষে।
বলিতেছে মহাপ্রভু ভক্তগণ পাশে।।
আমার বচন শুন ভকত সমাজে।
মহাভাব হবে অদ্য কীর্তনের মাঝে।।
এত বলি মহাপ্রভু রহিল নীরবে।
সভক্তি ভক্তগণ শুনিলেন সবে।।
হেনকালে প্রভু তরী ঘাটেতে উদয়।
রামাগণে উচ্চৈঃস্বরে দিল জয় জয়।।
প্রভুর নিকটে এল গোপাল সুমতি।
প্রভু পদে প্রণমিল করিয়ে ভকতি।।
অভ্যর্থনা করে কত গুরুচাঁদ পদে।
আপনার গৃহে নিল আনন্দিত হৃদে।।
গৃহের মাঝারে করি উত্তম আসন।
বসাইল ভক্তি ভরে সাধনের ধন।।
শয্যাপরে বসিলেন প্রভু গুরুচন্দ্র।
আনন্দেতে বৈসে যত ভকতের বৃন্দ।।
কেহ বা গৃহের মাঝে কেহ বারেন্দায়।
প্রাঙ্গণেতে বহু ভক্ত হরিষ হৃদয়।।
এইমত বৈসে যত মতুয়ার গণ।
কেহ কে প্রেমভরে ধরেছে কীর্তন।।
প্রেমেতে মাতিয়ে সবে হইল উন্মত্ত।
উভরায় ধায় যথা করি মদ মত্ত।।
সেই মত ভ্রমে কেহ কীর্তনের মাঝ।
কেহ বা কীর্তন করে সম পশুরাজ।।
কেহ কেহ নৃত্য করে ঘুরিয়া ফিরিয়া।
প্রেমধারা বহিতেছে বয়ান বাহিয়া।।
ভাবের বিকারে কেহ মেরেছে উলম্ফ।
লম্ফ ঝম্ফ গাত্রকম্প যেন ভূমিকম্প।।
এই মত হ’ল তথা নাম সংকীর্তন।
অপরেতে সেই গৃহে হইল ভোজন।।
বিশ্রাম করিয়ে সবে উঠিল নৌকায়।
ভক্তগণ গাহে গুণ আনন্দ হৃদয়।।
চালাইয়া দিল তরী হরি হরি বলি।
বাহিতেছে প্রভু তরী হয়ে কুতূহলী।।
নানারঙ্গে বলেশ্বর নদীতে পৌছিল।
ভকতের গণ হরিনামে মত্ত ছিল।।
ডাকাতিয়ার বালারা লইল প্রভুকে।
হরিগুরুচাঁদ ধ্বনি করিয়ে পুলকে।।
শ্রীনাথ বালার গৃহে হইল উদয়।
রামাগণে বামাস্বরে করে জয় জয়।।
অগণিত লোক এসে হইল মজুত।
কেহ কেহ স্তুতিবাদ করিল বহুত।।
বহুলোক প্রভু রূপ করে দরশন।
রূপ হেরে বিমোহিত সবাকার মন।।
শোভা করে ভক্ত মাঝে প্রভু গুরুচন্দ্র।
নক্ষত্র বেষ্টিত যথা শোভে পূর্ণচন্দ্র।।
কেহ বলে কিবা রূপ ভুবন মোহন।
এহেন মূরতি কভু না হেরি কখন।।
রূপের ছটায় করে চারিদিক আলো।
কেহ বলে কোথা হ’তে এ মানুষ এল।।
এইমত নানা কথা করে আলাপন।
হরি কথা আরম্ভিল ভকত রঞ্জন।।
লোক আগমনে ক্রমে হ’ল ধুমধাম।
ভক্তগণে কেহ কেহ করে হরিনাম।।
তাহাতে প্রেমের বন্যা চলিল বাহিয়া।
কেহ বা ব’লেছে হরি প্রেমেতে মাতিয়া।।
এইভাবে হ’ল তথা নাম সংকীর্তন।
অন্তঃপুরে রান্না করে যত রামাগণ।।
ঘৃতপক্ক ডাল ডালনা বিবিধ ব্যঞ্জন।
উপাদেয় দ্রব্য কত হইল রন্ধন।।
নাম ক্ষান্ত হ’ল প্রভু বৈসেন ভোজনে।
যোগাইল দ্রব্য আদি যত বামাগণে।।
প্রাঙ্গণে বসিল যত মতুয়ার গণ।
সেই সঙ্গে করে সেবা আরো বহুজন।।
এইভাবে ভোজ কর্ম হইল সমাধা।
(লাইন জ্ঞাপ)
বিশ্রাম করিতে সবে আনন্দে বসিল।।
কলাবতী নামে এক রমণী আসিয়ে।
বলিতেছে প্রভু ঠাই কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে।।
কল্য প্রাতে যেতে হবে কলাতলা গায়।
দুঃখিনীরে দিতে হবে ও পদে আশ্রয়।।
ভক্তির্বাধ্য গুরুচাঁদ স্বীকার করিল।
অপরেতে সবে মিলি বিশ্রাম লভিল।।
গাহিল প্রভাতী গীতি প্রভাত সময়।
কীর্তনে হইল মহাভাবের উদয়।।
প্রেমভরে করে নাম মতুয়ার গণ।
ঘরের চালের ‘পরে পড়ে পিকগণ।।
গানের স্বরে তারা মিলাইয়া স্বর।
প্রেমে মেতে যেন নাম করে পিকবর।।
ক্রমেই বাড়িল সেই প্রেমের তরঙ্গ।
প্রাঙ্গণে পড়িল ক্রমে যতেক বিহঙ্গ।।
কোন বিহঙ্গময় এসে কীর্তনের মাঝে।
উড়িয়া পড়িল গুরুচাঁদ পদাম্বুজে।।
পদ পরে মাথা রাখি ধরণী লোটায়।
হেরিয়ে সবার চিত্ত হয় দ্রবময়।।
পুনরায় উড়ে এল আপনার দলে।
উড়ে পরে নৃত্য করে দুটি পাখা তুলে।।
রামাগণে তাহা হেরি করে হুলুধ্বনি।
কেহ কেহ প্রেমভরে করে হরিধ্বনি।।
ম’তোগণে প্রেমে মগ্ন কেহ বা বিহুশ।
কেহ হয় জ্ঞানহারা কারো আছে হুশ।।
সে জন কাঁদিয়ে বলে অদ্য কি হেরিনু।
পিকবরে কিবা করে মোরা কি করিনু।।
অন্যজন শুনে তার গলাটি ধরিয়ে।
হা হা গুরুচাঁদ বলে পড়িল ঢলিয়ে।।
স্পষ্টভাবে প্রভু নাম মুখে নাহি সরে।
গুঃ গুঃ গুঃ গু শব্দমাত্র মুখেতে নিঃস্বরে।।
মৃতপ্রায় হ’ল সেই এমত করিয়ে।
কেহ বা আকুল হ’য়ে প’ড়েছে ঢলিয়ে।।
কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ঢলাঢলি হইল এমত।
কেবা কারে ধ’রে তোলে নাহিক সম্বিত।।
হেনকালে গুরুচাঁদ বলেছে বচন।
সুস্থ হ’য়ে শুন এস আশ্চর্য কথন।।
পূর্বেতে ইহারা ছিল শ্রীবৃন্দাবনে।
গাহিত কৃষ্ণের গুণ সুমধুর তানে।।
তোমরা ক’রেছ নাম সেই ত সময়।
তাহে পিকবর দেহে আনন্দ উদয়।।
প্রাতঃক্রিয়া সবে মিলি করে সমাপন।
কলাতলা যেতে হবে শুন সর্বজন।।
এত যদি বলিলেন প্রভু দয়াময়।
হরিধ্বনি দিয়া উঠে মতুয়া নিচয়।।
কেহ বলে জয় জয় গুরুচাঁদ জয়।
জয় যশোমন্ত জয় হরিচাঁদ জয়।।
জয় পিকবর জয় মতুয়ার জয়।।
যাহার কৃপায় অদ্য হেরি মহাভাব।
আহা মরি কিবা এই বৃন্দাবন ভাব।।
আহা মরি হেন ধন কোথা গিয়া পাব।
এ হেন হৃদয় ধনে কেমনে রাখিব।।
এতেক বলিয়ে সবে শয্যা পরিহরি।
সত্বরে আইল সবে প্রাতঃক্রিয়া করি।।
কিন্তু নাহি সেই ভাব হয় নিবারণ।
হৃদি মাঝে সে তরঙ্গ বহে অনুক্ষণ।।
অপরেতে সবে মিলি ফলাহার করি।
কলাতলা চলিলেন ব’লে হরি হরি।।
এইমত প্রেমকেলি ভক্তগণ সনে।
গুরুচাঁদ পদ ভাবি কহে বিচরণে।।
মহাপ্রভুর কলাতলা ভ্রমণ
ভক্তসনে চলিলেন প্রভু দয়াময়।
রামাগণে বামাস্বরে করে জয় জয়।।
আনন্দেতে ভক্তগণ চ’লেছে বাহিয়ে।
কলাতলা উপনীত হইলেন গিয়ে।।
কলাতলা বাসী ভক্ত নামেতে ভজন।
তাহার গৃহেতে যান ভকত রঞ্জন।।
সেই ঘাটে প্রভু তরী যখনে উদয়।
গলে বাস দিয়ে তথা ভজন দাঁড়ায়।।
অন্তরেতে তরঙ্গ বহে আঁখি ছলছল।
মুখে না নিঃস্বরে বাণী প্রেমেতে বিহ্বল।।
বুঝিয়ে ভক্তের মন ভক্ত রঞ্জন।
ভক্ত সঙ্গে উপনীত তাহার ভবন।।
পূর্বোচিত সেই কথা করি আলাপন।
ব্রজভাবে মত্ত তনু প্রেমেতে মগন।।
কথার প্রসঙ্গে আঁখি করে ছলছল।
ভাবের বিকারে কারো মুখে উঠে লাল।।
সেইভাবে বহুক্ষণ অতীত হইল।
ভাব অনুযায়ী কেহ কীর্তন ধরিল।।
উঠিল মধুর ধ্বনি কীর্তনের ভীতে।
দিগন্ত ব্যপিয়ে ধ্বনি উঠে গগনেতে।।
দেবগণ যেন তথা শুন্য ভর করি।
প্রেমাবেশে মত্ত হ’য়ে বলে হরি হরি।।
মতুয়ারা করে নাম প্রেমানন্দে মেতে।
বড়ই মধুর ভাব কীর্তনের ভীতে।।
কেহ বা কীর্তন মাঝে শুনিবারে পায়।
শুন্যে মহা কলরব অত্যাশ্চর্যময়।।
নীরবে থাকিয়ে সেই কর্ণ পাতি রয়।
তবু যেন শুন্যে ধ্বনি শুনিবারে পায়।।
পুনরায় সেই জন হরি হরি বলে।
লম্ফ দিয়ে যেতে চায় দেবতার দলে।।
এইভাবে লম্ফ ঝম্ফ করে ছুটাছুটি।
কেহ বা ভূমেতে পড়ি কামড়ায় মাটি।।
কেহ কেহ প্রেমাবেশে বলে হরি হরি।
কেহ বা বিক্রমে যথা বীরেন্দ্র কেশরী।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় প্রেমেতে বিভোর।
কেহ চেয়ে থাকে যথা ভূষিত চকোর।।
এইমত হ’ল সেই কীর্তন মাঝারে।
ধৈর্য ধরিয়ে কেহ গৃহে রইতে নারে।।
গৃহ ছাড়ি এল তথা কেহ উভরায়।
এইভাবে নরনারী অগণিত হয়।।
কীর্তন মাঝেতে যেন বন্যা উথলিল।
হরি হরি হরি বলি কাঁদিতে লাগিল।।
মহাবাতে পড়ে যথা কদলীর বন।
হেন ভাবে বহুলোক ভূমেতে পতন।।
হৈ হৈ রব মাত্র শুনা যায় শব্দ।
শ্রবণেতে অন্য সবে হ’ল যেন স্তব্দ।।
অন্তঃপুরে রান্না করে যত রামাগণ।
প্রেমধারা সবাকার হ’তেছে পতন।।
কক্ষে কুম্ভ করি যায় আনিবারে বারি।
প্রতিপদ বিপক্ষেতে বলে হরি হরি।।
কেহ ঝাল বাটে কেহ কাটে তরকারী।
সে বামার অবিরত ঝরে প্রেম বারি।।
এইমত সব ধনী কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে।
রন্ধন করিল তারা আকুল হইয়ে।।
রান্না ছাড়ি কোন নারী ত্বরিত গমনে।
হুলুধ্বনি করে গিয়ে কীর্তনের স্থানে।।
পুনঃ এসে রান্না কার্য করে সমাপন।
ওদিকেতে নাম ক্ষান্ত করে ম’তোগণ।।
প্রভুর স্নানের লাগি সুশীতল বারি।
কোন নারী আনিয়ে রেখেছে কুম্ভপুরী।।
অতঃপর মহাপ্রভু স্নান সমাধিল।
সিক্ত বস্ত্র ত্যজি প্রভু বসন পরিল।।
ভোজনের ঠাই করে নারী কলাবতী।
প্রভুকে বসায় তথা করিয়ে ভকতি।।
আনন্দেতে প্রভু মোর করেন ভোজন।
অপরেতে করিল ভোজ মতুয়ার গণ।।
বিশ্রাম করিল সবে হরষিত কায়।
কেহ বা বসিয়ে তথা হরিকথা কয়।।
কথার প্রসঙ্গে কেহ ধ’রেছে কীর্তন।
পুনরায় প্রেমে মত্ত মতুয়ার গণ।।
কাহারো হ’য়েছে অষ্ট সাত্বিক বিকার।
লোমকূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটন আকার।।
শ্বেতকম্প পুলকাশ্রু বীভৎস পুলক।
ঘন ঘন শ্বাস বহে নেত্র অপলক।।
কেহ বা হুঙ্কার করে বলে গুরুচাঁদ।
কেহ বলে কোথা হৃদি আকাশের চাঁদ।।
(লাইন জ্ঞাপ)
কেহ বলে সেই হৃদে সাধনের ধন।।
কেহ কাঁদে উভরায় গুরুচাঁদ বলে।
বক্ষস্থল ভেসে যায় নয়নের জলে।।
বীর বেশে কেহ করে বীরত্ব প্রকাশ।
লাফিয়ে লাফিয়ে ফেরে মনেতে উল্লাস।।
রাগাত্মিকা ভাবে কেহ হয় মাতোয়ারা।
রক্তবর্ণ চক্ষু যেন আকাশের তারা।।
কেহ বা প্রলাপ বকে হইয়ে অজ্ঞান।
অবিরত ধারে কারো ভেসেছে বয়ান।।
এ হেন ভাবেতে হয় নাম সংকীর্তন।
প্রেমের সাগরে মগ্ন মতুয়ার গণ।।
কেহ বলে হায় হায় কি কর্ম করিনু।
পাইয়ে দুর্লভ তনু বিফলে হারিনু।।
(লাইন জ্ঞাপ)
সংসার গৌরবে ডুবে আছি নিশিদিনে।।
ভব কর্ণধার এল মানব আকারে।
না চিনিয়ে পড়ে আছি অজ্ঞান আধারে।।
হায় হায় কি করিনু কি হইবে শেষে।
বিফল জীবন গেলে থেকে মায়াবশে।।
এইমত ভাবে উঠে প্রেমের উচ্ছাস।
অনুক্ষণ প্রাণে তার বাড়ে হা হুতাশ।।
যখনেতে দিনমণি যায় অস্তাচলে।
নাম ক্ষান্ত করিলেন মতুয়া সকলে।।
নাম রসে মগ্ন সবে নরনারী গণ।
মনে নাই কেবা আর করিবে রন্ধন।।
স্ত্রী পুরুষ নাহি হুশ ঢলিছে সবাই।
সবে মাত্র গুরুচাঁদ ব’লে ছাড়ে হাই।।
এহেন সময় ডেকে বলে একজন।
ম’তোগণ শুন এবে আমার বচন।।
হৃদি মাঝে প্রেম ভাব রাখ লুকাইয়া।
রন্ধন করগে সবাই ধৈর্য ধরিয়া।।
হৃদয় মাঝারে রাখ হৃদয়ের ধনে।
দেখিতে পাইবে যবে পড়িবেক মনে।।
অন্তরের ধন রাখ যতনে অন্তরে।
অন্তর ছাড়িয়ে কভু রবে না অন্তরে।।
অন্তরে রাখিয়ে এবে যাও গো অন্তরে।
রন্ধন করগে সবে গিয়ে অন্তঃপুরে।।
এত শুনি কেহ যায় রান্না করিবারে।
রন্ধন করিতে তার দুনয়ন ঝরে।।
এইভাবে রান্না কার্য সমাপ্ত হইল।
অতঃপরে সেবা কার্য সমাধা করিল।।
শান্ত চিতে সর্বজনে বসিল শয্যায়।
প্রভু বলে যেতে হবে গঙ্গাচর্ণা গাঁয়।।
প্রেমানন্দ ভরে সবে হরিধ্বনি দিল।
হরি বলে হরি তরী বাহে হরি বল।।
মহাপ্রভুর গঙ্গাচর্ণা ভ্রমণ
প্রেমাবেশে মত্ত হ’য়ে বাহিল তরণী।
মাঝে মাঝে মতুয়ারা করে হরিধ্বনি।।
গঙ্গাচর্ণা উপনীত অশ্বিনীর ঘরে।
বসিলেন মহাপ্রভু হরিষ অন্তরে।।
অশ্বিনী গোঁসাই যিনি প্রেমরত্ন খনি।
দুনয়নে বহে ধারা প্রেম তরঙ্গিণী।।
কিছু বলিবার শক্তি না আছে তাহার।
দুনয়নে প্রেমধারা বহে শতধার।।
তাহা দেখে হ’ল মহাভাবের উদয়।
প্রেমাবেশে ভক্তগণ নাম পদ গায়।।
চারিদিকে হ’তে এল নরনারী গণ।
বাল বৃদ্ধ এল কত না যায় বর্ণন।।
হরিধ্বনি হুলুধ্বনি পড়িতে লাগিল।
প্রেমের তরঙ্গ মাঝে অশ্বিনী ডুবিল।।
কীর্তন হইল তথা মধুর মধুর।
সেই গৃহে ফলাহার হইল প্রচুর।।
ত্বরিতে তরিত চলে ভক্তগণ সঙ্গে।
শ্রীমধু বালার ঘাটে উদিলেক রঙ্গে।।
তথা হ’তে মহাপ্রভু করেন গমন।
হেনকালে শুন এক আশ্চর্য কথন।।
ওই গ্রামবাসী ভক্ত নামেতে শ্রীনব।
প্রভুকে লইতে তার মনে ছিল ভাব।।
ভুলক্রমে সেই গৃহে যাওয়া না হইল।
শ্রীরাজ নগর দিকে তরণী বাহিল।।
নবকৃষ্ণ মাতা হয় নাম সিন্ধুমণি।
প্রভু লাগি পায়াসান্ন রাধিল সে ধনী।।
প্রভু না যাওয়ায় ধনী করে হাহাকার।
কেঁদে বলে কিবা গতি হইবে আমার।।
কেঁদে কেঁদে সেই ধনী ধরণী লোটায়।
ধেয়ে গিয়ে বলে ধনী সে মধু বলায়।।
কি করিব কি হইল না পাই ভাবিয়ে।
প্রভু নাহি গেল মোর দুঃখিনী বলিয়ে।।
অভাগিনী হেরে মোরে গেলেন চলিয়ে।
এ ছার জীবন রাখি বল কি লাগিয়ে।।
প্রভু আসা আশে আমি মিষ্টান্ন রাঁধিয়ে।
চাতকিনী সমা আছি পথ নিরখিয়ে।।
এই পরমান্ন আমি কারে খাওয়াইব।
এ ছার জীবন আমি নিশ্চয় ত্যজিব।।
মধুবালা বলে এক আছে সদুপায়।
সেই পরমান্ন তুমি দেহত আমায়।।
এতশুনি সেই ধনী তাহাই করিল।
সব দ্রব্য নিয়ে মধু ত্বরিতে ধাইল।।
হেথা বসি কাঁদে সেই নবের জননী।
অন্তরে জানিল গুরুচাঁদ গুণমণি।।
হেনকালে মধুবালা নিকটে উদয়।
তরী রাখ তরী রাখ বলে উভরায়।।
মহাপ্রভু বললে তরী রাখ এইখানে।
দেখ মধু কি কারণ ডাকে ঘনে ঘনে।।
মধুবালা ব্যস্ত হয়ে তরণী ধরিল।
পায়াসান্ন ধরি মধু কহিতে লাগিল।।
নবের জননী ইহা রন্ধন করেছে।
গৃহে নিয়ে আপনাকে ভুঞ্জাবে ভেবেছে।
ইত্যাদি করিয়ে মধু নিবেদন কৈল।
পরেতে প্রভু ঠাই অর্পণ করিল।।
প্রভু বলে এই স্থান হোক বৃন্দাবন।
বন সেবা করি আমি আনন্দিত মন।।
ব্রাহ্মণ স্বরূপা সেই নবের জননী।
অদ্য আমি সাজিলাম ব্রজ নীলমণি।।
তোমরা সবাই ব্রজ রাখালাদি গণ।
এস মোরা করি সবে বন ভোজন।।
বলিতে বলিতে মহাভাব উদ্দীপন।
অগ্রভাগে প্রভু কিছু করেন ভোজন।।
প্রভু বলে শুন এবে মতুয়ার গণ।
বাটরা করিয়ে এবে লহ সর্বজন।।
মতুয়ার গণ সবে তাহাই করিল।
মহাভাবে মগ্ন হ’য়ে তরণী বাহিল।।
কাঁদিতে কাঁদিতে মধু করিল প্রস্থান।
অশ্বিনী গোঁসাই তাহে ধরিলেন গান।।
ব্রজভাবে মত্ত হ’য়ে চক্ষে পড়ে জল।
প্রভু গুরুচাঁদ হ’ল প্রেমেতে বিহ্বল।।
রাজনগরেতে হয় তারাচাঁদ ঢালী।
সেই ঘাটে উপনীত হরি হরি বলি।।
ভক্তিভরে তারাচাঁদ প্রভুকে লইল।
ভক্তগণ সনে প্রভু আনন্দে বসিল।।
পূর্বভাবে সংকীর্তন করে মতুয়ারা।
সবাকার দুনয়নে বহে প্রেমধারা।।
সুমধুর ভাবে তথা হ’য়েছে কীর্তন।
ধেয়ে এল গ্রামবাসী নরনারীগণ।।
মহা ঝড় বহে যথা কীর্তনের মাঝে।
মেঘের সদৃশ যেন কীর্তনে গরজে।।
কেহ বা আকুল হ’য়ে কাঁদে উভরায়।
কেহ বা গুরুচাঁদ বলে ধরণী লোটায়।।
নরনারী সবে যেন হ’ল জ্ঞানহারা।
সবাকার দুনয়নে বহে বারি ধারা।।
এইভাবে হরিনাম বহুক্ষণ করি।
শুধুমাত্র শুনা যায় হরি হরি হরি।।
গৃহে কি বাহিরে হরি শুন্যে যেন হরি।
মনে হয় যেন হরি নামেম গিছে ঘেরি।।
রান্না ঘরে বসি যত ছিল রামাগণ।
কাহার বা আঁখিজলে ভেসেছে বদন।।
রান্নাবান্না হরিনাম সব ক্ষান্ত হ’ল।
সবে মিলি সেবা কার্য সমাধা করিল।।
বিশ্রাম ক’রেছে বসি প্রভু দয়াময়।
কৃষ্ণধন নামে এক বালক উদয়।।
প্রভুর নিকট বলে অমিয় বচন।
যাইতে বলেছে মাতা মোদের ভবন।।
প্রভু বলে কেবা তুমি বালক সুমতি।
কোন গ্রামে হয় বৎস্য তোমার বসতি।।
কৃষ্ণধন বলে এই গ্রামে হয় ঘর।
মা বিহনে আর কেহ নাহিক আমার।।
মা বলেছে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।
দধি করিয়েছে মাতা তাই দিব খেতে।।
সরল সুমতি সেই কৃষ্ণধন হয়।
প্রভু সনে কহে কথা হইয়ে নির্ভয়।।
প্রভু বলে দিতে যদি মায়ের কামনা।
তোর গৃহে আমি গিয়ে সে দধি খাব না।।
মাকে বল গিয়ে বৎস দধি দিতে মোরে।
আনন্দে খাইব দধি বসি এই ঘরে।।
এতশুনি কৃষ্ণধন করিল গমন।
প্রভুর বচন কহে মায়ের সদন।।
পুত্রের বচন শুনি দধি নিয়ে হাতে।
প্রভুর নিকটে এল অতি ব্যস্ত চিতে।।
দধি রেখে প্রভু পদে প্রণাম করিল।
আনন্দেতে মহাপ্রভু সে দধি সেবিল।।
তথা হ’তে ভক্তগণ করিয়ে সংহতি।
আপনার তরী পরে উঠিল ঝাটিতি।।
প্রভুর তরণী পরে চলে কৃষ্ণ মাতা।
প্রভু বলে মম সঙ্গে তুমি যাবে কোথা।।
কৃষ্ণের জননী বলে ঘাটেতে নামিব।
এইতুকু সময় এ তরীতে রহিব।।
এতেক শুনিয়ে সবে দিয়ে হরিধ্বনি।
ধীরে ধীরে চালাইল প্রভুর তরণী।।
কৃষ্ণধনের ঘাটেতে যখন উদিল।
কৃষ্ণের জননী তাহে হরিধ্বনি দিল।
তীরে গিয়ে ব্যস্ত হ’য়ে আসন করিল।
কৃপাময় গুরুচাঁদ তীরেতে নামিল।।
ভক্তগণ সনে বৈসে প্রভু দয়াময়।
কৃষ্ণের জননী কাঁদে করে হায় হায়।।
কি দিবে কি দিবে ভাবে প্রভুর সেবায়।
ভাণ্ড ল’য়ে গাভী প্রতি কেঁদে কেঁদে কয়।।
কৃপণতা কর না মা দুগ্ধ দে আমায়।
তোর দুগ্ধ লাগাইব প্রভুর সেবায়।।
কেঁদে কেঁদে গাভী মাতা দোহন করিল।
অপরিমিত সে দুগ্ধ গাভী দানিল।।
সেই দুগ্ধ এনে দিল প্রভু সন্নিধানে।
কিছু নিয়ে প্রভু তাহা দিল ভক্তগণে।।
কাড়াকাড়ি করি সবে সে দুগ্ধ খাইল।
প্রেমভরে কেহ কেহ হরিধ্বনি দিল।
তাহে কৃষ্ণ জননীর না মিটিল আশা।
প্রভুর সেবার লাগি কেটে দিল শশা।।
সেই শশা লুট বলি করিল গ্রহণ।
অপরে চলিল সবে আনন্দিত মন।।
হরি হরি বলি তরী দিল চালাইয়ে।
কাঁদিতেছে কৃষ্ণ মাতা তীরে দাঁড়াইয়ে।।
যতক্ষণ প্রভু তরী হয় নিরীক্ষণ।
কৃষ্ণের জননী চাহি কাঁদে ততক্ষণ।।
ভক্তগণে প্রভু তরী উজানে বাহিল।
হরিগুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
মহাপ্রভুর অন্যান্য ভক্তগৃহে ভ্রমণ
শুধু মাত্র বা - বা শব্দ ক’রেছে বদনে।
অবিরত প্রেম ধারা বহে দুনয়নে।।
গ্রামবাসী জানি সবে প্রভু আগমন।
সবে এসে প্রেমেভরে করে দরশন।।
দিনমণি অস্তাচলে করেছে গমন।
সুমধুর রবে কেহ ধরেছে কীৰ্তন।।
হাসে কাঁদে নাচে গায় প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
বীরবেশে কোন জন বেড়ায় নাচিয়।।
অঙ্গঝাঁকি মারে কেহ বলে হরি হরি।
গড়াগড়ি যায় কেহ ভূমের উপর।।
এইমত বহুক্ষণ কীৰ্তন হইল।
নাম ক্ষান্ত দিয়ে সবে ভোজন করিল।।
পুনরায় নাম রসে হইল মগন।
সেইবারে সারানিশি হইল বঞ্চন।।
প্রভাতে চলিল সবে মিত্রডাঙ্গা গাঁয়।
সেই গ্রামবাসী ভক্ত শ্ৰীআদান রা।।
হেরিয়ে প্রভুর তরী ভাবে মনে মনে।
প্ৰভু কি করিবেন কৃপা এ ভজন হীনে।।
বলিতে প্রভুর তরী ঘাটেতে উদিল।
শ্ৰীআদানচন্দ্র রায় প্রেমেতে মাতিল।।
কাঁদিতে কাঁদিতে এল প্রভুর সদন।
অবিরত ধারে তার ভেসেছে বদন।।
ভক্তিভাবে নিজগৃহে প্রভুকে লইল।
ভক্ত সঙ্গে মহাপ্ৰভু তীরেতে নামিল।।
বসিলেন গৃহমাঝে হরিষ অন্তরে।
রামাগণ বামাস্বরে হুলুধ্বনি করে।।
অপরে করিল তথা জল ফল হার।
কীৰ্ত্তন ক’রেছে সবে আনন্দ অপার।।
ধ্বনি শুনে গ্রাম বাসী এল বহুজন।
নরনারী সবে করে ঠাকুরে দর্শন।।
মতুয়া সনে সবে নাম পদ গায়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায় ।।
আকুল হইয়ে কাদে কীৰ্ত্তনের মাঝে।
কেহ করে স্তুতিবাদ গুরু পদ্যম্বুজে।।
নমঃ নমঃ গুরুচাঁদ - জগত রঞ্জন।
ভকতের প্রাণধন হরিচাঁদের নন্দন।।
তুমি আদি গুণনিধি হও সৰ্ব্বসার।
কে জানে তোমার তত্ত্ব ওহে সৰ্ব্বসার।।
এসেছে হে গুরুচাঁদ রূপেতে এবার।
নিস্তার করিতে কলি জীব পাপ ভার।।
তুমি অগতির গতি পতিত পাবন।
রক্তিম বরণ ধারী ভুবন মোহন।।
যেবা সার করিতেছে প্ৰভু তব নাম।
অবহেলে হয় তার পুর্ণ মনস্কাম।।
তব দেহে বিরাজিত প্রভু হরিশ্চন্দ্র।
দোহারূপে একরূপ হ'লে গুরুচন্দ্র।।
এই মত স্তব স্তুতি বহুত করিয়ে।
কাঁদিতেছে তুমি পরে আকুল হইয়ে।।
কেহ করে বীর দৰ্প বীর রসে মাতি।
সমর প্রাঙ্গণে যথা মদ মত্ত রাতি।।
কেহ বা কীৰ্তন মাঝে করে হরিধ্বনি।
হুলুধ্বনি করিতেছে যত সব ধনী।।
রাগাত্মিক ভাবে হয় কাহার হৃদয়।
পালক বিহীন চক্ষু রক্তবর্ণ হয়।।
শ্বেদকম্প পুলকাশ্রু হ’তেছে কাহার।
কাহার হয়েছে অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার।।
অনুক্ষণ কহিতেছে প্রেম প্রভজন।
ঘূর্ণবায় সমবহে অতি বিচক্ষণ।।
শ্লোক
পপাত ধরণী পুষ্টে বাতেনং বাতেনং কদলী যথা।
প্ৰেমযুক্তাং ভক্তাগণৌ তদৃশ পপাত ধরা।।
হেনরূপে মহাঝড় কীৰ্তনের মাঝে।
মেঘের মন্ডলে যথা অশনি গরজে।।
জয়ঢাক বাজে আরো বাজে করতাল।
মধুর মৃদঙ্গ বাজে শুনিতে রসাল।।
ঝাঁজ সিঙ্গা পাকোয়াজ বাজিছে কীৰ্তনে।
সৈন্যগণ ধায় যথা সমর প্রাঙ্গণে।।
সেই মত করে কেহ কেহ মারে লম্ফ।
কোন কোন মতুয়ার হয় গাত্র কম্প।।
এইভাবে বহুক্ষণ হইল কীর্তন।
অপরে হইল শান্ত মতুয়ার গণ।।
গ্রামবাসী যারা ছিল কীৰ্তন মাঝারে।
কীৰ্তন ছাড়িয়ে তারা সুস্থ হ’ল পরে।।
এইমত হল নাম দ্বিতীয় প্রহর।
কেহ বলে অদ্য হেথা চাঁদের বাজ।।
প্রেম ক্ষান্ত হয়ে শান্ত বৈসে সৰ্ব্বজন।
মহাপ্রভু করিলেন স্নান সমাপন।।
প্ৰভু মোর বসিলেন গৃহের মাঝারে।
স্বভক্তি আনে দ্রব্য প্রভুর গোচরে।।
মহাপ্ৰভু গুরুচাঁদ করিলেন ভোজন।
হরিধান করি সেরা করে ম’তোগণ।।
কেহ ভীর দেয় হরি গুরুচাঁদ বলি।
হরে হরে ভীর দেয় হ’য়ে কুতুহলী।।
এইভাবে হ’ল তথা ভোজন সমাপন।
ভোজনান্তে করে কেহ তাম্বুল চৰ্ব্বণ।।
হেনকালে এল তথা ভক্ত তিন জন।
হরিচাঁদ বলি চলে আপন ভবন।।
শ্রীবিপিন ষষ্ঠি চন্দ্র আর সনাতন।
প্রভু ঠাই বিদায় মাগিয়া তিনজন।।
অন্যান্য অনেক ভক্ত হইল বিদায়।
আনন্দেতে সবে ভক্ত উঠিল নৌকায়।।
তরী আরোহিতে প্রভু উদ্যোগী হইল
রায়ের স্বগোষ্টি এসে পদে প্রণমিল।।
অতঃপর মহাপ্ৰভু স্বস্থানে চলিল।
কবি কহে দিন গেল হরি হরি বল।।
সভা গীতি সমাপ্ত