পৃষ্ঠাঃ ৫০১-৫২০
এই জন্ম বৃথা গেল আর কিবা চাহি বল
পর জন্মে পুনঃ যদি আসি।
জননীর কাছে তাই আমি ‘‘হরিভক্ত’’ চাই
‘‘হরিভক্তি’ আমি ভালবাসি।।’’
এ কথা ভাবিয়া মনে চাহিয়া জননী পানে
বারিচক্ষে কহিছে গোঁসাই।
দয়া যদি হয়েছে মা কহি আমি হর-রমা
হরিভক্তি চাহি তব ঠাঁই।।’’
জননী হাসিয়া কয় ‘‘বাবা তাহা সাধ্য নয়
হরিভক্তি পাইব কোথায়?
আমি আর মোর স্বামী ত্রিভুবনে সদা ভ্রমি
হরিভক্তি পাবার আশায়।।
শুন বলি এক কথা হরিভক্তি যথা তথা
মিলিবে না এই ধরা পরে।
হরিভক্তি যদি চাও ওড়াকান্দী চলে যাও
হরিভক্তি পাবে তথাকারে।।’’
এমত কহিয়া বাণী চলে গেলে সে-জননী
গোস্বামীজী ভাবিল অন্তরে।
মহা ব্রত নষ্ট করে ওড়াকান্দী কি প্রকারে
যাব আমি প্রভুর গোচরে?
তাতে আর কার্য্য নাই এত ভেবে ছেড়ে হাই
গোস্বামীজী চলিল পশ্চিমে।
কয়দিন পরে বটে আসি নবদ্বীপ ঘাটে
মত্ত হল শুদ্ধ হরি নামে।।
কোকিল-নিন্দিত স্বরে যে সময়ে গান করে
নর নারী যেন মূর্চ্ছা যায়।
সকলে কান্দিয়া কয় ‘‘কোথা হতে মহাশয়
দয়া করে আসিলে হেথায়?’’
গোস্বামী কহিছে হাসি ‘‘শোন নবদ্বীপবাসি
ওড়াকান্দী হরি অবতার।
তোমাদের গোরা রায় ছাড়িয়া গৌরাঙ্গ কয়
ধরিয়াছে নব কলেবর।।
শ্রীহরি ঠাকুর নামে এল ওড়াকান্দী ধামে
‘‘হরিচাঁদ’’ বলি ভক্তে কয়।
কায়া ছাড়ি পুনরায় নিজ পুত্র-দেহে রয়
‘‘গুরুচাঁদ’’ নামে পরিচয়।।
করিয়াছি মহাপাপ তাই এই নমস্তাপ
তাঁরে ফেলে আসিয়াছি দুরে।
শাস্তি যদি হয় শেষ ফিরিব আপন দেশ
প্রভু যদি মোরে ক্ষমা করে।।’’
তাঁর বাণী শুনি কাণে নবদ্বীপ বাসী জনে
বহু যত্ন করিল তাঁহারে।
মন যার উদাসীন সে কি বল কোনদিন
এক স্থানে থাকিতে কি পারে?
দুই দিন পরে তাই চলিলেন সে-গোঁসাই
একা একা বৃন্দাবন পথে।
বহু কষ্টে তথা যায় মনে ভাবে সর্ব্বদায়
আর নাহি ফিরিব গৃহেতে।।
এক দিন কুঞ্জ বনে বসি রহে আন মনে
হেনকালে এল এক নারী।
গোস্বামীর কাছে আসি কহিতেছে হাসি হাসি
‘দুটি কথা বলিতে কি পারি?’’
গোস্বামী তাহারে কয় ‘‘তাতে বাধা কিবা রয়
নারী জাতি মানি আমি মাতা।
পুত্রের নিকটে মাতা বলিবারে পারে কথা’
পদে আমি নত করি মাথা।।’’
নারী বলে ‘‘শোন-বাপ! অনর্থক মনস্তাপ
বহিতেছ আপন অন্তরে।
করিয়াছ যেই কাজ দোষ নাহি তার মাঝ
এই ধর্ম্ম গৃহীর ভিতরে।।
ব্রত-ভঙ্গ মহাপাপ প্রভু করিয়াছে মাপ
এবে তুমি ফিরে যাহ ঘরে।
গৃহীকে করিতে শুদ্ধ ওড়াকান্দী হরি-বুদ্ধ
আসিয়াছে বহু যুগ পরে।।
দেশে তুমি ফিরে যাও আর কেন কষ্ট পাও
যাঁর লোক যাহ তাঁর ঠাঁই।
কি লাগি আসিলে হেথা হেথা তাঁরে পাবে কোথা
সে-মানুষ আর হেথা নাই।।
আমি তাই বলি সন্ধী চলে যাও ওড়াকান্দী
ধর গিয়া প্রভুর চরণে।
আপনি সে গুরুচান মনে কত ব্যথা পান
তোমাকে ডাকিছে মনে মনে।।’’
এত বলি সেই নারী বাতাসেতে ভর করি
পলকের মধ্যে লুকাইল।
তাঁহার বচন শুনি শ্রীঅশ্বিনী মহাগুণী
পুনর্যাত্রা স্বদেশে করিল।।
যত কাছে কাছে আসে বক্ষ তাঁর যায় ভেসে
গুরুচাঁদে করিয়া স্মরণ।
মনে হয় সেই ক্ষণে যদি কেহ দিত এনে
গুরুচাঁদ হৃদয়-রতন।।
নাহি করে দৃষ্টি পাত পদে লাগে শিলাঘাত
ক্ষত হ’ল চরণ তাহার।
কোন দিকে লক্ষ্য নাই শুধু সদা ছাড়ে হাই
দেখা চাই প্রভু মহেশ্বর।।
এই ভাবে কিছু পরে আসি ওড়াকান্দি পরে
গোস্বামীজী দিল দরশন।
গুরুচাঁদে দেখা পায় কান্দিয়া পড়িল পায়
প্রভু বলে মধুর বচন।।
গোস্বামীরে ডেকে কয় ‘‘বল ঠেকে কোন দায়
গৃহ ছেড়ে গেলে বৃন্দাবন?
মনে মনে ভেবে পাপ পেলে কত মনস্তাপ
ইচ্ছা করে আপন মরণে।।
এক কথা পুরাতন শোন তুমি দিয়ে মন
আমার পিতার জীবকালে।
গোলকের নামে নামে ছিল বোড়াশিয়া গ্রামে
দ্বিতীয় গোলক একজন।
নামে নামে যে-সমতা তাই ডাকে ‘মিতা’ ‘মিতা’
মহা রাগে চলে দুই জন।।
গোলক পাগল যিনি মহা ভাবময় তিনি
হুঙ্কারিয়া চলে বীর রাগে।
দ্বিতীয় গোলক ভাবে আমি কবে কোন ভাবে
গোলকে ছাড়া’ব অনুরাগে।।
এত ভাবি মহাশয় নারী সঙ্গে নাহি রয়
মনে ভাবে রিপু জয়ী হবে
বংশ রক্ষা করিবারে তার পিতা বলে তারে
সাধু বলে ‘‘কে তাহা করিবে?’’
দিনে দিনে পিতা তাঁর বলিলেন বারে বার
বংশ রক্ষা করহে সুধীর।
পরিশেষে অনিচ্ছায় নারী সঙ্গ করে হায়
পিতৃ-আজ্ঞা করিল পালন।
গোলক পাগল বলে ‘‘বল মিতা কোন ছলে,
হারাইলে পরম রতন?’’
প্রাণে দুঃখ হল ভারী তাই গেল রশি পরি’
সে গোলক ত্যজিল জীবন।
সেই কথা শুনি কাণে পিতা মোর দুঃখী প্রাণে
বলে ‘‘বোকা বড় অভাজন।
এতটুকু পাপ করে কেন তুই গেলি মরে
এই পাপ-পাপ নহে বেশি।
নিত্য নিত্য নিজ ঘরে নর নারী পাপ করে
তবু তারা মুখে রাখে হাসি।।
সংসারী করিয়া পাপ পেতে বটে পারে মাপ
যদি প্রাণে জাগে অনুতাপ।
আর কত চা’স তোরা? এমন দয়ার ভরা
শুনি নাই কাহার আলাপ।।’’
গুরুচাঁদ বলে তাই শুনে অশ্বিনী গোঁসাই
দগ্ধ প্রাণে পেল শান্তি জল।
জীর্ণ শীর্ণ দেহে তার দেখা গেল অতঃপর
এল যেন নব শক্তি বল।।
বিধির বিধান যাহা অবশ্য ফলিবে তাহা
বাধা দিতে কেহ নাহি পারে।
ব্রত-ভঙ্গে প্রাণ তাঁর মুলোচ্ছেদ হ’ল যার
পুনঃ তারে নাহি পেল ফিরে।।
পদতলে ক্ষত তার বৃদ্ধি হয় নিরন্তর
শেষ যেন আসিল নিকটে।
শেষ গান রচি তাই ছাড়িলেন দুঃখে হাই
বাজে কথা মনের কপাটে।।
‘‘আপন বলিতে মোর
কেই হ’ল না ভবে।
যারে এত ভাল বাসি
সে ও ডুবায় গৌরবে।।’’-অশ্বিনী গোঁসাই
দিনে দিনে তনু ক্ষীণ আসিল শেষের দিন
গোস্বামীজী বুঝিলেন মনে।
কাছে কাছে ছিল যারা কান্দিয়া সকলে তারা
জিজ্ঞাসিল গোস্বামীর স্থানে।।
‘‘যদি কোন বাঞ্ছা মনে থেকে থাকে সঙ্গোপনে
দয়া করে বলহে হে গোঁসাই।’’
গোস্বামী ডাকিয়া কয় ‘‘অন্য কোন বাঞ্ছা নাই
এক বাঞ্ছা আছে বলি তাই।।
যবে দেহ হবে লয় নারীকেল বাড়ী গাঁয়
মহানন্দ পাগলের ধারে।
আমার জারিতে দেহ রাখিও করিয়া স্নেহ
শান্তি পা’ব বসে পরপারে।।’’
অতঃপর মহাকবি সহজ সরল ছবি
দেহ ছাড়ি করিল প্রয়াণ।
আজ্ঞা মতে দেহ তাঁর নারিকেল বাড়ী পর
রাখে সবে হয়ে আগুয়ান।
আর কি আসিবে কবি সাধকের পুণ্য-ছবি
মধুগীতি করিবে কি গান?
দীন মহানন্দ কয় ‘‘অসম্ভব কিছু নয়
ইচ্ছা যদি করে ভগবান।।
মতুয়ার গুণ গাঁথা অমিয় পুরিত কথা
প্রাণ ভরে পিও সাধু জন।
মূঢ়মতি মহানন্দ, চিত্তে ভরা ঘোর সন্দ
জন্ম তার হ’ল অকারণ।
ভক্ত তারিণী ডাক্তারের জীবন কাহিনী
“And who tha stand and wait-”
-Milton
নমস্তে তারিণী বাবু ডাক্তার সুজন।
গুরুচাঁদ পদে ভক্তি যার অনুক্ষণ।।
বার শত অষ্টাত্তর সালে জন্ম নিল।
পিতামাতা তারে পেয়ে আনন্দিত হ’ল।।
গোপালগঞ্জের মধ্যে কৃষ্ণপুর গ্রাম।
নমঃ বংশে জন্ম নিল সেই গুণধাম।।
শ্রীঈশ্বর নামে পিতা উপাধিতে ‘বল’।
জ্ঞানী গুণী পঞ্চ ভাই হইল সকল।।
তারিণী, উমেশ, দুই মহেশেতে তিন।
বিরাজ, ত্রৈলোক্য যার আগেতে বিপিন।।
আদি শিক্ষা আড়পাড়া স্কুলেতে হ’ল।
তারপরে ঘোনাপাড়া সুখে পাঠ নিল।।
ওড়াকান্দি মান্য করে শ্রীঈশ্বরচন্দ্র।
সরল বিশ্বাস রাখে নাহি কোন দ্বন্দ্ব।।
ঘোনাপাড়া পাঠ শেষ করিল তারিণী।
মনে মনে চিন্তা করে সে ঈশ্বর গুণী।।
ওড়াকান্দি মধ্য বাংলা বিদ্যালয় আছে।
তারিণী লভিবে শিক্ষা সেই স্কুলে পাছে।।
এত ভাবি ওড়াকান্দি করিল গমন।
প্রভুর নিকটে করে সব নিবেদন।।
আপন মনের কথা বলিল খুলিয়া।
কথা শুনি প্রভু তাহে বলিল হাসিয়া।।
“ওড়াকান্দি এসে যদি তব পুত্র পড়ে।
তারে বাসস্থান দিব আমার এ ঘরে।।”
প্রভুর বচন শুনি কান্দিল ঈশ্বর।
বলে “বহু দয়া কৈল আমার উপর।।”
শুভ দিনে পুত্র সহ এল মহাশয়।
তদবধি সে তারিণী সেই গৃহে রয়।।
নিজ পিতা সম মানে প্রভু গুরুচাঁদে।
মাতা বলে প্রণমিল সত্যভামা পদে।।
বহু যত্নে প্রভু তারে করিল পালন।
ভক্তিভাবে সে তারিণী থাকে সচেতন।।
প্রভাতে জননী তারে ডাক দিয়া কয়।
“প্রভুর প্রভাতী খাদ্য লহ এ সময়।।”
খাদ্য লয়ে সে তারিণী দাঁড়াইয়া কয়।
তার হাতে প্রতিদিন মহাপ্রভু খায়।।
নিজ পুত্র সম রাখে স্নেহেতে বাঁধিয়া।
কৃষ্ণপুরে গেলে দিন কাটে যে কাঁদিয়া।।
এইভাবে ছাত্র বৃত্তি করিলেন পাশ।
ক্রমে মনে জাগে তার উচ্চ অভিলাষ।।
প্রভুর নিকটে তবে করে নিবেদন।
“এবে কোন কার্য আমি করিব এখন?”
প্রভু কয় “আমি বলি পড় গে’ ডাক্তারী।
পরে পেতে পার বটে রাজার চাকুরী।।”
আজ্ঞা পেয়ে সে তারিণী চলিল ঢাকায়।
বহিলেন গুরুচাঁদ তার যত ব্যয়।।
যেই কালে যত টাকা হয় প্রয়োজন।
সে তারিণী চাহে তাহা প্রভুর সদন।।
দয়াময় দয়া করি সব অর্থ দেয়।
তাহাতে তারিণী বাধ্য রহে সর্বদায়।।
প্রভুর কৃপাতে দেখ পরে সেইজন।
করিল ডাক্তারী পাশ হ’য়ে একমন।।
পাশ করে ঢাকা হ’তে আসিলেন বাড়ী।
প্রভুর নিকটে বলে করজোড় করি।।
“এবে কোন কার্য করি বল দয়াময়।”
প্রভু বলে “হে তারিণী নাহি কোন ভয়।।
প্রভুর কৃপায় বাঁধা কিছু নাহি হ’বে।
এক কথা তব ঠাই বলি আমি তবে।।
ডাক্তারী পরীক্ষা তুমি দিয়েছ যখন।
কি কি প্রশ্ন এল আমি জানি সর্বক্ষণ।।”
এত বলি সব প্রশ্ন বলে দয়াময়।
তারিণী সে সব শুনে হতবাক হয়।।
তারিণীরে ডাক দিয়া প্রভু পুনরায়।
বলে “যাও ঘরে যাও নাহি কোন ভয়।।”
ঘোনাপাড়া, ঘৃতকান্দি, গোপালগঞ্জেতে।
ডিঃ বিঃ ডাক্তারখানায় ছিল বহু মতে।।
পরে গেল বরিশাল জিলার ভিতর।
ভাণ্ডারিয়া হ’তে পিরোজপুরের শহর।।
এখানে স্বাধীন ভাবে করিল ডাক্তারী।
তারপরে পেল সে সরকারী চাকুরী।।
যেই ভাবে সরকারী চাকুরীটি পায়।
সব বলিয়াছি তাহা পূর্বের অধ্যায়।।
গুরুচাঁদ কৃপা বলে মীডের চেষ্টায়।
নমঃশুদ্র রাজকার্যে নিয়োজিত হয়।।
প্রথম চাকুরী পেল শ্রীশশিভূষণ।
পরে পরে কার্য পায় আর বহুজন।।
দ্বিতীয় দলের মধ্যে তারিণী ডাক্তার।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা বহু জানি তার।।
কার্য পেয়ে গেল চলি লক্ষ্ণৌ শহরে।
কিছুকাল সেইখানে চাকুরীটি করে।।
কিন্তু জলবায়ু তার সহ্য নাহি পায়।
দিনে দিনে তনুক্ষীণ স্বাস্থ্যের চিন্তায়।।
পত্র যোগে সব কথা জানা’ল প্রভুরে।
প্রার্থনা করিল “প্রভু রক্ষা কর মোরে।।”
দয়াময় প্রভু তারে বহু দয়া করে।
মীডেরে ডাকিল প্রভু আপনার ধারে।।
তারিণীর কথা সব তাহারে শুনা’ল।
সাহায্য করিতে তবী মীডেরে বলিল।।
প্রভুর আদেশ মীড নাহি করে হেলা।
সাধ্য মত করে কাজ শেষে কি পহেলা।।
প্রভুর বচনে মীড বহু চেষ্টা করে।
বদলী করিল তারে ব্রহ্মের ভিতরে।।
ব্রহ্মদেশে “শনিরাজ্যে” বহুকাল রয়।
কালো, থোজী, মিওদা, ছিল মান্দালয়।।
মিওদা নগরে হ’ল শেষের শয়ন।
সেইখানে মহামতি ত্যজিল জীবন।।
সমাধি মন্দির সেথা আছে দাঁড়াইয়া।
তারিণীর পুণ্যস্মৃতি বক্ষেতে ধরিয়া।।
তেরশত ছত্রিশ সালে কার্ত্তিক বেলায়।
নশ্বর জীবন ছাড়ি স্বর্গলোকে যায়।।
চাকুরী করিয়া তেঁহ বহু ধন পায়।
জন্মভূমি কৃষ্ণপুরে দালান উঠায়।।
তের শ’ চব্বিশ সালে শ্রীহরি মন্দির।
গড়িল আপন অর্থে সেই ভক্ত বীর।।
শ্রীহরি মন্দির গড়ি ভাবে মনে মন।
এ মন্দিরে পূজা পা’বে কোন কোন জন।।
“আদি গুরু পিতা মোর সাধক সুজন।
দুই শক্তি গুরুচাঁদে হইল মিলন।।
তাহার কৃপায় মোর ধন জন মান।
ত্রি-ভুবনে গুরু নাই তাহাঁর সমান।।
নরাকারে জানি তিনি আপনি ঈশ্বর।
মন্দিরে আনিয়া পূজা করিব তাহাঁর।।
তিনি মোর ব্রহ্মা বিষ্ণু তিনি মোর হরি।
আপদে বিপদে বন্ধু বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।
তিনি ভিন্ন কেহ কোথা নাহি ভগবান।
হৃদয় মন্দিরে সদা আছে অধিষ্ঠান।।
অন্তরে রেখেছি যারে গভীর নিরালে।
বাহির বসা’য়ে অর্ঘ দিব পদতলে।।”
এত ভাবি উপনীত হ’ল ওড়াকান্দি।
প্রভুর চরণে পড়ি উঠিলেন কাঁদি।।
প্রভু কয় “কি তারিণী! কান্দ’ কি কারণ?
অকপটে সব কথা কর নিবেদন”।।
কান্দিয়া তারিণী কয় ‘ওগো অন্তর্যামী!
সব তুমি জান’ বাবা! কি বলিব আমি?’
তোমার কৃপায় হ’ল শ্রীহরি মন্দির।
দিবানিশি হ’বে যেথা হরিনাম ভীর।।
‘বিগ্রহ দেবতা’ মোর মন্দিরেতে নাই।
যাঁহার মন্দির আমি তারে নিতে চাই।।
দেবতা-বিগ্রহ মোর আর কেহ নাই।
আমার সকলি তুমি জগত গোঁসাই।।
তোমার মন্দিরে বাবা! চল দয়া করে।
দেখিব মোহন রূপ দু’নয়ন ভরে।।
ভকতের টানে প্রভু থাকিতে কি পারে?
স্বীকার করিল প্রভু যেতে কৃষ্ণপুরে।।
দিন স্থির করি দিল প্রভু দয়াময়।
মহানন্দে সে তারিণী নিজ গৃহে যায়।।
দেবতা পূজার লাগি যত দ্রব্য লাগে।
তারিণী জোগাড় করে সব পূর্বভাগে।।
জোগাড় করিল সাধু এই সঙ্গে সঙ্গে।
পুণ্যময় মহোৎসব মন্দির প্রসঙ্গে।।
দেশে দেশে মতুয়ার হ’ল নিমন্ত্রণ।
দিন মত সবে আসি দিল দরশন।।
প্রভুকে আনিতে নিজে সে তারিণী যায়।
তাঁর সঙ্গে আসিলেন প্রভু দয়াময়।।
প্রভু যবে গৃহে আসি হইল উদয়।
দিকে দিকে ওঠে ধ্বনি ‘জয়’ ‘জয়’ ‘জয়’।।
নরনারী সবে যেন হারা’য়েছে দিশে।
সকলে প্রভুরে বেড়ে বাঁধা দিবে কিসে?
কতই আপন আহা! কত যে দরদী।
মনে হয় রূপ দেখি বসে নিরবধি।।
সকলের যেন সে যে একা কা’র নয়।
তাই সবে চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়ায়।।
এমন আপন বন্ধু কোথা পাবি আর?
যারা দেখে তারা বলে “আমার” “আমার”।।
সকলের সকল বন্ধু আছে সকলেতে।
সকলে চাহে গো তাই তাঁহারে দেখিতে।।
হুড়াহুড়ি পড়াপড়ি কত ভাবে হয়।
ভ্রূক্ষেপ নাহিক তা’তে দেখিতেই চায়।।
কিবা দেখে? কিবা পায়? কেবা তাহা জানে?
প্রাণে বলে তাই দেখে দুইটি নয়নে।।
বারে বারে দেখে তবু নাহি মিটে সাধ।
মনে হয় কি যেন কি র’য়ে গেল বাদ।।
পুনরায় দেখে তাই, তবু তাই, তাই।
দেখিবার সাধ তার কিছু মিটে নাই।।
এভাবে পাগল করে’ যত নরনারী।
খেলিছে প্রেমের খেলা প্রেমময় হরি।।
তারিণীর গৃহে হ’ল তেমন প্রকার।
ভাবে মুগ্ধ নরনারী সবে একাকার।।
পঞ্চ ভাই তারিণীরা সবে করজোড়ে।
প্রভুর বন্দনা করে নয়নের নীরে।।
অতি হৃষ্ট দয়াময় তারিণীরে কয়।
“তোমার ভক্তিতে বাধ্য আমি সর্বদায়।।”
অতঃপর সে তারিণী করে নিবেদন।
“মন্দিরের দ্বার প্রভু কর উদ্ঘাটন।।”
প্রভু বলে “তাই হোক কর আয়োজন।
সঙ্গে সঙ্গে কর সবে নাম সংকীর্তন।।”
প্রভুর আদেশে তবে মতুয়ারা সব।
হরি! হরি! বলে সবে করে উচ্চরব।।
ডঙ্কা, সিঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে বলে হরিবোল।
নামের আনন্দে মেতে মতুয়া বিভোল।।
তারিণীরা পঞ্চ ভাই অতি সযতনে।
প্রভুকে করাল স্নান স্নিগ্ধ বারি দানে।।
পিতামাতা দুই জনে সিনান করায়।
মূল্যবান বস্ত্র আনি প্রভুরে সাজায়।।
শ্রীমন্দিরে পাতিয়াছে দুইটি আসন।
পট্ট বস্ত্রাবৃত তাহা অতি সুশোভন।।
মঙ্গল কলসি রাখে সম্মুখে তাহাঁর।
ধূপ দীপ চন্দনাদি বিবিধ সম্ভার।।
সুগন্ধ পূরিত মাল্য রাখে ডালি ‘পরে।
ধান্য দূর্বে পুষ্পরাজি আছে থরে থরে।।
পঞ্চ প্রদীপের আলো জ্বলে ঘৃত দিয়া।
কুম্কুম চন্দন কত আনিল বাটিয়া।।
ব্রহ্মদেশ হ’তে আনে সু-শ্বেত ব্যজন।
এই রূপে করিলেন বহু আয়োজন।।
স্নান অন্তে প্রভুজীরে কহিছে তারিণী।
“মন্দিরেতে চল এবে প্রভু গুণমণি।।”
দয়া করি দয়াময় গেল মন্দিরেতে।
তারিণীর পিতামাতা যায় তার সাথে।।
সযতনে তিনজনে বসা’ল আসনে।
চরণে প্রলেপ দিল কুম্কুম চন্দনে।।
গলে দিল ফুলহার পদে দূর্বাদল।
তারিণীর আঁখি ভরে ঝরিতেছে জল।।
নৈবেদ্য সাজা’য়ে রাখে বিবিধ বিধানে।
জুড়া’ল প্রভুর দেহ চামর ব্যজনে।।
পঞ্চ প্রদীপের আলো করেতে ধরিয়া।
তারিণী আরতি করে ঘণ্টা বাজাইয়া।।
ধূপ দীপ চন্দনাদি ভরা যেই ডালি।
বরণ করিয়া পদে দিল পুষ্পাঞ্জলি।।
একেত দয়াল প্রভু গৌরাঙ্গ বরণ।
শ্রীঅঙ্গে করেছে তাহে চন্দন লেপন।।
শোভাময় ফুলহার গলে দোলে ধীরে।
ভাবমগ্ন মহাপ্রভু আপন ভিতরে।।
জ্বল জ্বল ঝলমল রূপের ঝলক।
হেরিলে নয়ন কোণে পড়ে না পলক।।
সারা অঙ্গ হতে যেন আলোকের ধারা।
ছুটিয়া চলিছে যেন রূপের ফোয়ারা।।
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া পরে তারিণী সুজন।
শঙ্খধ্বনি যোগে পরে করে আবাহন।।
রামাগণে বামা কণ্ঠে করে হুলুধ্বনি।
ডঙ্কা শিঙ্গা রবে যেন ভেদিল মেদিনী।।
“শ্রীগুরুচন্দ্রায়ঃ নমঃ” মন্ত্রে পুষ্পাঞ্জলি।
করিলেন পঞ্চ ভাই মিলিয়া সকলি।।
এইভাবে শ্রী মন্দির প্রতিষ্ঠা হইল।
তারিণীর ভাগ্যগুণে প্রভু পূজা নিল।।
তারিণীকে ডাক দিয়া প্রভু তবে কয়।
“শুনহে তারিণী আমি বলি যা তোমায়।।
মন্দির প্রতিষ্ঠা হল বড়ই সুন্দর।
বাসের দালান তুমি কর এই বার।।
রাজশক্তি বিনা কেহ দালানে না থাকে।
সকলের মান কিন্তু দালানে রাখে।।
আমি বলি এবে গৃহে দালান গড়াও।
দিনে দিনে ধন মান সকলি বাড়াও।।”
তারিণী কান্দিয়া বলে “দয়াল আমার।
ভিক্ষা চাই পূর্ণ হোক যে ইচ্ছা তোমার।।”
তুষ্ট মনে প্রভু তবে গৃহেতে ফিরিল।
সঙ্গে সঙ্গে সে তারিণী শ্রীধামে আসিল।।
মন্দির প্রতিষ্ঠা লাগি যত দ্রব্য কিনে।
উপস্থিত করে তাহা শ্রীধামেতে এনে।।
মহালক্ষ্মী সত্যভামা জগত জননী।
তাঁরে বস্ত্র আনি দিল ভকত তারিণী।।
বিদায় মাগিয়া তবে ব্রহ্মদেশে যায়।
তেরশ একত্রিশ সালে আসে পুনরায়।।
প্রভুর আজ্ঞায় করে দালান নির্মাণ।
দশভুজা দুর্গা পূজা করে মতিমান।।
প্রভুর আজ্ঞায় পূজা করে মহাশয়।
যাহা করে সব করে প্রভুর ইচ্ছায়।।
দুর্গা পূজা যেই কালে করে মহাশয়।
সত্যভামা-গুরুচাঁদে আনিবারে যায়।।
পড়ে পদে বলে কেন্দে “ওগো দয়াময়।
মাতা নাহি গেলে মোর পূজা বৃথা যায়।।
যার পূজা তাঁর যদি দেখা নাহি পাই।
কার পূজা করি আমি বসে ভাবি তাই।।”
ভক্তাধীন দয়াময় ভক্তে দয়া করে।
যুগল রূপেতে গেল তারিণীর ঘরে।।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ তার হইল তখন।
প্রেমানন্দে সে তারিণী করিছে নর্তন।।
বারে বারে বলে “এই শেষ পূজা মোর।”
প্রলাপ কতই কহে ভাবেতে বিভোর।।
প্রভু ও মাতাকে তবে গৃহেতে রাখিয়া।
ব্রহ্মদেশে গেল চলি বিদায় মাগিয়।।
যেই যাত্রা শেষ যাত্রা আর ফিরে নাই।
মিওদা নগরে দেহ পুড়ে হল চাই।।
পরম পবিত্র সাধু তারিণী ডাক্তার।
ভকতের পদে করি কোটি নমস্কার।।
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী
প্রাণপণে করে ভক্তি তারিণী চরণ।
তাঁরে কৃপা করে প্রভু প্রাণধন।।
সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী প্রভু গুরুচান।
তারিণী চরণ হতে হইল প্রমাণ।।
ডাক্তারী পরীক্ষান্তে প্রশ্ন বলি দেয়।
এবে শোন কোন ভাবে পক্ক আম্র খায়।।
ব্রহ্মদেশে সে তারিণী যা দেখে সুন্দর।
অবশ্য প্রভুরে তাহা দেয় উপহার।।
একদিন সে তারিণী বসেছে টেবিলে।
ইচ্ছা কিছু জলপান করে কুতূহলে।।
ভৃত্য তাহে আনি দিল গুটিকত ফল।
সুপক্ক সুঘ্রাণযুক্ত ক’টি আম্র ফল।।
মনোলোভা কিবা শোভা ফলের আকার।
সুবাসে ভরিল গৃহ অতি চমৎকার।।
তারিণীর রীতি ছিল ভোজনের আগে।
শ্রীগুরুচাঁদের রূপ হৃদয়েতে জাগে।।
নিবেদন করি খাদ্য উদ্দেশ্য তাহাঁর।
প্রসাদের জ্ঞানে পরে করেন আহার।।
এইদিনে তারিণীর কি যে ভাব হল।
“রাখালিয়া ভাব” যেন অন্তরে পশিল।।
“ব্রজের রাখাল” যত চরিত্রে মধুর।
সখ্য রজ্ঝু দিয়ে বান্ধে বিশ্বের ঠাকুর।।
বনতলে ঘুরে ঘুরে “রাখালিয়া খেলা”।
এ বনে সে বনে যত রাখালের মেলা।।
দেহ থাকে হেথা সেথা মন জেগে রয়।
“প্রাণবন্ধু” কালাচাঁদে খুঁজিয়া বেড়ায়।।
বনতলে ডালে ডালে কত ফল ফলে।
রাখালে কুড়া’য়ে ফল ফেলে দলে দলে।।
ফল পেয়ে মুখে দিয়ে লাগিল মধুর।
জাগা মনে বলে কই “প্রাণের ঠাকুর”?
আর কিরে তাঁরে থু’য়ে ফল খাওয়া যায়।
“কালিয়ারে” খুঁজে খুঁজে ঘুরিয়া বেড়ায়।।
দেখা পেয়ে যায় ধেয়ে বলে “রে কানাই”!
এমন মধুর ফল আর খাস নাই।।
নে’রে ভাই দেরে গালে সব ফল টুক।
তাই খা’রে আমি দেখে পাব কত সুখ।।
প্রেমে বাধ্য ভবারাধ্য প্রেমে বান্ধা রয়।
রাখালে উচ্ছিষ্ট দিলে সুধাজ্ঞানে খায়।।
তাঁরে দিলে দেয় ফিরে লক্ষগুণে তার।
কিবা দিতে পারে বলে সীমানা তাহার।।
সামান্য বৃক্ষের ফল উচ্ছিষ্ট করিয়া।
সখ্য রসে দেয় তাঁর বদনে তুলিয়া।।
প্রতিদানে দেয় প্রভু ব্রহ্মার বাঞ্চিত।
শ্রীমুখের শ্রীপ্রসাদ তুলনা রহিত।।
রাখালে ডাকিয়া বলে “শোন রে রাখাল”।
কিছুতে নহেক মিষ্ট দেখ এই ফল।।
বিশ্বাস না কর যদি মুখে দিয়া দেখ।
যদি বল মিথ্যা বলি তবে বাজী রাখ।।
ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে কেবা বাঁধা দেয়।
শ্রীমুখের শ্রীপ্রসাদ রাখালেই খায়।।
সুমিষ্ট সুপক্ক আম্র চোখে দেখে তাই।
গুরুচাঁদে মনে পড়ে ছাড়ে দীর্ঘ হাই।।
“আহারে সুন্দর আম কিবা তোরে বলি?
বৃথাই সংসারে তুই আম হ’য়ে এলি।।
আজ যদি তোরে দিতে পারিতাম ডালি।
সফল হইত মোর প্রাণের অঞ্জলি!
আমি হেথা ব্রহ্মদেশে প্রভু মোর দূরে।
কত যে বেদনা বুকে কি বলিব তোরে।।”
এ ভাবে বিলাপ করে সে তারিণী বল।
মনোদুঃখে ঝরিতেছে দুই চক্ষে জল।।
নয়ন মুদ্রিত করে দেখে গুরুচান্দে।
“আম লও” বলি সাধু ফুকারিয়া কান্দে।।
এ দিকে কি ভাব চলে ওড়াকান্দি ধামে?
শুন সবে সেই কথা বলি ক্রমে ক্রমে।।
আপন আসনে বসি প্রভুজী গম্ভীর।
চারিদিকে বসে আছে কত ভক্ত বীর।।
আপনার ভাবে যেন প্রভুজী তন্ময়।
নীরবে বসিয়া সবে কথা নাহি কয়।।
ব্রহ্মদেশ হতে ডাকে তারিণী চরণ।
তার ডাকে সাড়া দিল ভকত জীবন।।
নয়নের জলে দিল যেই অর্ঘ দান।
গ্রহণ করিল তাহা নিজে ভগবান।।
দেশকাল পাত্র ভেদ তাঁর কিছু নাই।
ক্ষুদ্র জ্ঞানে মোরা তাহা বুঝিয়া না পাই।।
জীব পক্ষে আছে বটে কত অসম্ভব।
সয়ম্ভুর কাছে কিন্তু সকলি সম্ভব।।
সামান্য জ্ঞানের বোঝা বহি’ নিজ শিরে।
বিশ্ববাসী নর প্রাণী বুঝিতে না পারে।।
নর সাজে ধরা মাঝে আসে বটে নেমে।
নরের সহিত তুল্য নহে কোন ক্রমে।।
দুই ভাবে করে লীলা প্রভু দয়াময়।
ঐশ ও মানব চক্রে বিভিন্ন প্রথায়।।
ঐশ- চক্রে ধরে প্রভু গিরি গোবর্ধন।
নর- চক্রে শত্রু ভয়ে করে পলায়ন।।
ঐশ- চক্রে চলে তাঁর শুদ্ধ রাস লীলা।
নর-চক্রে রাখে তাঁর গোধনের মেলা।।
নর- চক্রে গুরুচাঁদ ওড়াকান্দি রয়।
ঐশ- চক্রে তারিণীর পক্ক আম্র খায়।।
আসনে নিস্তব্ধ বসি গম্ভীর ঠাকুর।
সুপক্ক আমের গন্ধ ছুটিল মধুর।।
মহাজ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর তাতে ডেকে কয়।
“মধুর আমের গন্ধ কিসে পাওয়া যায়?”
বলিতে বলিতে গৃহ হ’ল ভরপুর।
হেনকালে বলে কথা দয়াল ঠাকুর।।
“অদ্যকার যে তারিখ তাহা দেখে রাখ।
যে যে হেথা আছে বসে সকলেরে ডাক।
আম্রের তত্ত্বের আমি জানি সমাচার।
ব্রহ্মদেশে এই আম্র করেছি আহার।।
ব্রহ্মদেশে আম্র খায় তারিণী সুজন।
আমাকে করেছে সেই আম্র নিবেদন।।
সেই আম্র খাইলাম আমি এই মাত্র।
তারিণী বাড়িতে এলে শুন সব তত্ত্ব।।”
বিস্মিত হইয়া সবে তাকাইয়া রয়।
লিখিয়া রাখিল পরে তারিখ সময়।।
ছুটি লয়ে সে তারিণী দেশে পহুছিল।
ঠাকুরে দেখিবে বলে ওড়াকান্দি গেল।।
আমের সকল কথা হইল প্রমাণ।
সবে কেন্দে বলে “প্রভু স্বয়ং ভগবান”।।
সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী প্রভু গুরুচান।
কহিল তারিণী বাবু বহু ভাগ্যবান।।
ভক্তের বল শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ
ঘৃতকান্দিবাসী ভক্ত শ্রীকুঞ্জ বিহারী।
ভাগ্যগুণে দেখে কত লীলার মাধুরী।।
শ্রীমধুসূদন, কুঞ্জ এক গ্রামে বাস।
পূর্ণব্রহ্ম গুরুচাঁদে করেন বিশ্বাস।।
এক সঙ্গে দোহে যায় ওড়াকান্দি বাড়ী।
এক সঙ্গে ওঠে বসে নাহি ছাড়াছাড়ি।।
ইহাদের বিবরণ বলিয়াছি আগে।
বলিলে কুঞ্জ’র কথা মধুরেও লাগে।।
একদিন সেই কুঞ্জ ওড়াকান্দি যায়।
গিয়া দেখে গুরুচাঁদ হাঁটিয়া বেড়ায়।।
জোরে জোরে হাটে প্রভু নাহিক বিরাম।
মনে হয় শরীরেতে বহিতেছে ঘাম।।
কুঞ্জ যবে দণ্ডবৎ করিল চরণে।
প্রভু বলে “চুপ করে বস গে’ সেখানে।।”
হস্ত দিয়া দেখাইল শ্রীনাট মন্দির।
কুঞ্জ সেথা বসে রয় হইয়া গম্ভীর।।
এইভাবে এক ঘণ্টা গত হ’য়ে যায়।
হাঁটা সাঙ্গ করি প্রভু আসিল তথায়।।
দর দর ঘাম ঝরে প্রভুজীর গায়।
কুঞ্জকে তামাক দিতে বলে দয়াময়।।
তামাক সাজিয়া কুঞ্জ প্রভু হস্তে দিল।
ধীরে ধীরে মহাপ্রভু টানিতে লাগিল।।
করজোড়ে কুঞ্জ তবে কহিছে বচন।
“এত পরিশ্রম প্রভু কিসের কারণ?”
প্রভু কয় “শোন কুঞ্জ প্রকৃত ঘটনা।
কা’র কাছে এই কথা করো না রটনা।।
ব্রহ্মদেশে অদ্য এক ধর্ম সভা হ’ল।
তারিণী সভায় যেতে নিমন্ত্রণ পল।।
তারিণীর বাঞ্ছা মনে করিবে বক্তৃতা।
“হরিচাঁদ পূর্ণব্রহ্ম” কবে সেই কথা।।
যাত্রাকালে তাই মোরে উদ্দেশ্যেতে কয়।
“ধর্ম সভা স্থানে প্রভু থাকিও সহায়”।।
আমি তার সাথে তাই ছিনু এতক্ষণ।
বহু পরিশ্রম হ’ল তাহার কারণ।।
ব্রহ্মদেশে কিবা হ’ল তাহার কারণ।
স্বমুখে তারিণী যাহা করিল কীর্তন।।
প্রভুকে স্মরণ করে সে তারিণী যায়।
উপস্থিত হইলেন সে ধর্ম সভায়।।
বক্তৃতা করিতে বাবু উঠিল যখন।
শূন্যভরে গুরুচাঁদে করে দরশন।।
অপূর্ব ভাবের ঢেউ হৃদয়ে উঠিল।
তারে দিয়ে সব কথা কে যেন বলা’ল।।
সভা অন্তে সবে করে “জয়” “জয়” “জয়”।
এরপরে গুরুচাঁদে দেখা নাহি পায়।।
সেই কথা পত্র যোগে তারিণী লিখিল।
কুঞ্জ দেখে বর্ণে বর্ণে সকলি মিলিল।।
পরে যবে গৃহে এল তারিণী সুজন।
তার কাছে শোনে সবে সেই বিবরণ।।
নিভৃতে তাহারে ডাকি কুঞ্জ সব কয়।
কথা শুনে তারিণীর বক্ষ ভেসে যায়।।
প্রভুর চরণে পড়ি বলে “দয়াময়”!
দুর্বলের বল তুমি বুঝিনু নিশ্চয়।।
এই জন্য বক্তৃতাতে কষ্ট পাই নাই।
এই জন্য “জয় পত্র” সেই দিনে পাই।।”
এইভাবে কান্দে ভক্ত শ্রীতারিণী বল।
দুর্বলের বল প্রভু ভকতের বল।।
গুরুচাঁদ লীলা কথা সুধা হ’তে সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যায় ভব ক্ষুধা।।
শ্রীশ্রী প্রমথ রঞ্জনের বিলাত যাত্রা
(উদ্যোগ)
“সন্তান যাঁহার হেলায় সাগর ডিঙায়ে করিল লঙ্কা জয়”
--- দ্বিজেন্দ্র লাল
তের শত নয় সালে, আসিল জননী কোলে,
ওড়াকান্দি শিশু এক পরম সুন্দর।
গুরুচাঁদ ‘বর’ দেয়, তাই তারে শশী পায়,
ধন্য! ধন্য করে মিশে যত নারী নর।।
গেল বর্ষ গেল মাস, দিনে দিনে সুপ্রকাশ,
বাড়িতে লাগিল শিশু আপন বিভবে।
ক্রমে পঞ্চ বর্ষ যায়, বিদ্যালয়ে দিতে চায়,
শিশু তা’তে তুষ্ট নয় কভু কোন ভাবে।।
রাখালের সাথে জুটে, গোধন চরা’বে মাঠে,
সেই কার্যে প্রীতি তার সকলের বেশী।
নিজ করে ধরে তারে, আনি পাঠশালা ঘরে,
শিক্ষা দিল জোর করে তার পিতা শশী।।
শক্তিমান ভবে যারা, তাহাদের কার্যধারা,
সাধারণ হ’তে রহে অনেক প্রভেদ।
সুপরি চালনা হ’লে, এই শক্তিমান দলে,
জীবন করিতে পারে উচ্চ লক্ষ্য ভেদ।।
ফিরিল মনের গতি, মন চলে শিক্ষা প্রতি,
ধীরে ধীরে ক্রমে উঠে বিভিন্ন পর্যায়।
সিংহ শিশু যথা ধীরে, পদ রাখি স্তরে স্তরে,
ক্রমে উপনীত হয় পর্বত চূড়ায়।।
বিধির নির্বন্ধ যাহা, কে খণ্ডাবে বল তাহা,
তাহার বিধান দেখ চলে অবহেলে।
সরলা অবলা মাতা, নাবালক দুই ভ্রাতা,
সবে ফেলে গেল পিতা স্বর্গধামে চলে।।
নীরবে শোকাগ্নি সয়, গুরুচাঁদ ভাবময়,
পাষাণ টুটিয়া যায় সেই অগ্নি দাহে।
দুই কক্ষে দুই জন, প্রমথ মন্মথ রঞ্জন,
অন্তরদেবের সম শোকাভার বহে।।
ফল্গু সম স্নেহ ধারা, হৃদয় রহিল সারা,
বাহিরে কঠিন সাজি করিল তাড়না।
প্রমথ রঞ্জন তাই, পথে ভুল করে নাই,
শ্রীগুরুচাঁদের গুণে পুরা’ল বাসনা।।
তের শত একত্রিশে, সহপাঠী সহবাসে,
বিদেশে চলিতে প্রাণ হ’ল উচাটন।
পিতা নাহি বর্তমান, পিতামহ মুহ্যমান,
কা’র বলে ‘সপ্ত সিন্ধু’ করিবে লঙ্ঘন।।
এদিকে প্রভুর মনে, ইচ্ছা জাগে ক্ষণে ক্ষণে,
সাগর ডিঙা’তে দিবে নমশূদ্রে বল।
লাট বলে সেই কথা, দেখিয়া জগত পিতা,
নমশূদ্রে দিতে চাহে সঞ্জীবনী ফল।।
প্রমথ রঞ্জন ভাবে, পিতামহে কোন ভাবে,
আপনার মনোকথা করিবে প্রকাশ?
অমূল্য কুমার নামে, বাস ওড়াকান্দি গ্রামে,
পিতা তার জানি শ্রীকমলা কান্ত দাস।।
বি.এস.সি. করি পাশ, কলিকাতা করে বাস,
মনে মনে ভাবে এবে কিবা করা যায়?
প্রমথ রঞ্জন ভাবে, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে,
সঙ্গী যদি হ’ন মোর এই মহাশয়।।
অমূল্যের কাছে গিয়ে, তাহারে বলে বুঝা’য়ে,
মোর কথা শোন তুমি খুড়া মহাশয়!
কোন ভয় নাই মনে, চল মোরা দুই জনে,
সাগর ডিঙায়ে যাই রাজার আলয়।।
তাহাতে অমূল্য কয়, “কিছু বাধা নাহি তায়,
মোর পিতা সুস্থ মনে যদি দেন মত।
পিতাকে বুঝাতে হ’লে, যাও তুমি তার স্থলে,
এই ছাড়া আমি নাহি দেখি কোন পথ।।”
অমূল্যের কথা শুনি, প্রমথ রঞ্জন গুণী,
কমলা কান্তের কাছে হ’ল উপস্থিত।
বহুত বুঝায়ে তারে, নিল ‘মত’ জোর করে,
আপনার কথা তারে বুঝা’ল বিহিত।।
কমলা কান্তেরে কয়, “শোন দাদা মহাশয়,
আমার যা মনে হয় বলি সেই কথা।
মোর পিতামহ ঠাই, আপনার বলা চাই,
অমূল্য প্রমথ দোহে করেছে একতা।।
আসুন উভয়ে তাই, দোহে বিলাত পাঠাই,
নমশূদ্র জাতি তা’তে পাবে উপকার।
এই ভাবে কথা হ’লে, পিতামহ যদি বলে,
অনায়াসে যা’ব মোরা সাগরের পার।।”
এমত আগ্রহ দেখি, প্রমথ রঞ্জনে ডাকি,
আশীর্বাদ করিলেন শ্রীকমলাকান্ত।
বলে “ভাই ভয় নাই, ঈশ্বরের শুভেচ্ছায়,
প্রাণপণে চেষ্টা আমি করিব একান্ত।।”
এত বলি মহাশয়, প্রভুর নিকটে যায়,
অন্তর্যামী দয়াময় সব জানে মনে।
অগ্রভাগে বলে তাই, ‘কি কমলা কান্ত ভাই,
শুভ বার্তা আজ যেন শুনিব এ কানে।।
সে সব শুনিব পাছে, বহুত সময় আছে,
অগ্রভাগী কথা কিছু আমি তবে বলি।
মনে মোর যেই ভাব, এ জাতির যে স্বভাব,
ইচ্ছা হয় একা একা ভিন্ন পথে চলি।।
আমার যা’ মনে হয়, শুন বলি মহাশয়,
অদ্যাবধি এ জাতির মধ্যে কোন জন।
উচ্চ শিক্ষা পায় নাই, বিদেশেতে যায় নাই,
আজো কেহ করে নাই বিলাত গমন।।
মহামূর্খ এ সমাজ, নাহি চেনে শুভ কাজ,
অল্প পেয়ে স্বল্পে তুষ্ট কাঙ্গালের প্রায়।
মোরে যদি মান তুমি, এক কথা বলি আমি,
বিলাতে পাঠাও পুত্র ওগো মহাশয়।।
প্রভুর বচন শুনি, সে কমলাকান্ত গুণী,
আশ্চর্য ভাবিয়া মনে চাহিয়া রহিল।
ভাবিলেন মনে মনে, ইনি দেখি সব জানে,
এর কাছে কিবা ক’ব মনেতে ভাবিল।।
তবু ধীরে ধীরে কয়, “শুন কর্তা মহাশয়,
আমার প্রাণের কথা জানিলা আপনে।
তাই করি নিবেদন, একসঙ্গে দুই জন,
পাঠাইয়া দিব মোরা বিদ্যার কারণে।।
আপনার পৌত্র গুণী, প্রমথ রঞ্জন জানি,
তার সঙ্গে একযোগে অমূল্যে পাঠাও।
নমশূদ্র বল পাবে, ধরাতলে কীর্তি রবে,
দয়া করে এই কার্যে কর অনুমতি।”
অন্তরের ভাব ঢাকি, প্রভু বলিলেন ডাকি,
“মোর কথা শুন তুমি দাস মহাশয়।
মোর বটে ইচ্ছা আছে, বলিতেছি তব কাছে,
সুধন্যরে ডাক হেথা দেখি সে কি কয়।।
আমারে বিশ্বাস নাই, কবে আছি কবে নাই,
তাতে মনে এই কার্যে সাহস না পাই।
সুধন্য যদ্যপি কয়, তবে বটে পারা যায়,
সেই ভার নিলে বটে কোন ভয় নাই।।”
প্রভুর মধ্যম পুত্র, শ্রীসুধন্য সুপবিত্র,
পিতৃ আজ্ঞা পেয়ে আসি দাঁড়া’ল নীরবে।
প্রভুজী তখনে তায়, সকল খুলিয়া কয়,
বলে “তব অভিপ্রায় বল সত্য ভাবে”।।
কি যেন আসিল মনে, সকলি বিধাতা জানে,
নানা যুক্তি প্রদর্শনে সেই মহাশয়।
কথা কয় আধা আধা, বিলাতে যাইতে বাধা,
দিতে তিনি ইচ্ছা করে ভাবে বোঝা যায়।।
বুঝিয়া মনের ফাঁক, প্রভু বলে “তবে থাক,
অমূল্য একাকী যাক সাগরের পারে।
আশীর্বাদ করি তারে, সে যেন জাতির তরে,
যশ মান সুকল্যাণ পারে আনিবারে।।”
জানাজানি হ’ল কথা, প্রমথ নোয়ায়ে মাথা,
মনে পেয়ে বড় ব্যথা কান্দে নিরালায়ে।
প্রমথের সাথে সাথে, প্রভু দুঃখ পায় চিতে,
কিছু পারে না বলিতে বিবাদের ভয়ে।।
নর-চক্র ফেলে গুণী, ঐশ-চক্রে আনে টানি,
আপন-আপন জানি ভক্ত গোপালেরে।
পূর্ণব্রহ্ম ইচ্ছাময়, কেবা তারে বাধা দেয়,
দিনে দিনে পূর্ণ হয় যাহা ইচ্ছা করে।।
শুন সেই পরিচয়, কিভাবে সম্ভব হয়,
প্রমথ রঞ্জন যায় সাগরের পারে।
প্রভু করে সুকৌশল, গোপালের ভক্তিবল,
অসম্ভব সুসম্ভব প্রভু কৃপা জোরে।।
শ্রীগুরু-চরিত কথা, ভবভয়হারী গাঁথা,
আপদ বিপদ নাশে মুহূর্ত সময়।
মহানন্দ কর্ম দোষে, কান্দে শুধু কুলে বসে,
পারাপারে যেয়ে তরী তারে ফেলে যায়।।
গোপালচাঁদের প্রতিশ্রুতি ও প্রমথরঞ্জনের বিলাত গমন
প্রমথরঞ্জন দুঃখে কাটাইছে কাল।
হেনকালে ওড়াকান্দি আসিল গোপাল।।
যাদব নকুল এল আসিল বিপিন।
উপনীত হ’ল সবে রথযাত্রা দিন।।
প্রভুর কার্যের ধারা নরে অগোচর।
দেশে দেশে জানিয়াছে সবে সমাচার।।
শ্রীগুরুচাঁদের পৌত্র প্রমথরঞ্জন।
শিক্ষা লাগি করিবেন বিলাত গমন।।
মতুয়ারা সবে তা’তে সুখী অতিশয়।
সবে বলে “হ’ল তবে সুদিন উদয়।।”
কিন্তু ওড়াকান্দি এসে দেখে ভাবান্তর।
তার জন্য মনে দুঃখ হ’ল সবাকার।।
একে একে বার্তা যত সকল শুনিল।
প্রধান মতুয়াবর্গ একত্র হইল।।
সবে মিলে করিলেন শুভ আলোচনা।
এই কার্যে বাধা হ’তে কিছুতে দিবে না।।
সবে চল “চল যাই প্রভুর নিকটে।
তাঁর কাছে সব কথা বলি অকপটে।।
‘অর্থ বলে’ বাধে যদি কোন গোলমাল।
প্রভুর সঙ্গেতে মোরা দিব তবে তাল।।
যার যে শক্তি আছে সেই ভাবে মোরা।
সাহায্য করিব এই কথা হ’ল সারা।।”
অতপর দলে বলে সব সাধু যায়।
প্রভুর নিকটে গিয়া হইল উদয়।।
অগ্রণী হইয়া কথা কহিল যাদব।
চারিদিকে বসে শোনে মতুয়ারা সব।।
যাদব কহিছে “বাবা করি নিবেদন।
দেশে বসে শুনিলাম এক বিবরণ।।
ঘরে ঘরে রটিয়াছে এই শুভ বার্তা।
বিলাতে পাঠা’বে পৌত্র ওড়াকান্দির কর্তা।।
বড় সুখে ওড়াকান্দি আসিলাম তাই।
এখানে ত’ বাবা তার কোন চিহ্ন নাই।।
কি কারণে লোকে ইহা করিল রটনা।
আমরা শুনিব বাবা সে সব ঘটনা।।”
যাদবের কথা শুনি প্রভু ডেকে কয়।
যা’ রটে তা’ বটে কিন্তু সবখানে নয়।।
আমার ত’ ইচ্ছা ছিল পাঠাতে বিলাতে।
সুধন্যের মনে মনে ভয় হ’ল তা’তে।।
বিলাত ধনীর দেশ ধনে জনে ভরা।
গরীবের সাধ্য নাকি নহে বাস করা।।
একে ত’ প্রাচীন আমি তা’তে মনে ভয়।
কি জানি কি কোনদিন কি জানি কি হয়।।
একে ত’ বিলাত তা’তে বহুদূর পাল্লা।
আমাতে সম্ভব নহে সে সব ঝামেলা।।
এই দেশে যতদূর পড়াশোনা হয়।
তা’তে নাকি কাজ হ’বে সুধন্য তা’ কয়।।
ধীরে ধীরে কহে প্রভু উদাসীর সুরে।
মুখে বটে নাহি বলে বেদনা অন্তরে।।
কথা শুনি মতুয়ারা বহু দুঃখ পায়।
হেনকালে শ্রীগোপাল দাঁড়াইয়া কয়।।
“কিছু বলিবারে বাবা সাহস না পাই।
তবু এক কথা আমি জানিবারে চাই।।
আমরা যতেক আছি মতুয়ারগণ।
মোরা সবে ব্যয়ভার করিলে গ্রহণ।।
তাহলে কি বড় বাবু যেতে সেথা পারে?
দয়া করে সেই কথা বলুন আমারে।।”
প্রভু বলে “যেতে দিতে বাধা নাই কোথা।
তোমরা বোঝ না কেন আসল যে কথা।।
আমার বড়ই সাধ যাইবে প্রমথ।
কিন্তু বল কোথা পাব অর্থ আমি এত?”
পুনরায় সে গোপাল করজোড়ে কয়।
“এক কথা বলি বাবা আমি পুনরায়।।
কত টাকা লাগে বাবা এই শুভ কর্মে।
বড়ই বেদনা আমি পাইয়াছি মর্মে।।”
প্রভু ডেকে কয় “তুমি শুন হে গোপাল।
এই কাজে টাকা দিয়ে পায় না নাগাল।।
রাজা বাদশাহ যারা আছে এই দেশে।
তারা টাকা দিতে পারে বটে অনায়াসে।।
আমরা দরিদ্র জাতি অর্থবিত্ত শূন্য
বিশেষতঃ মেজবাবু আছে মনঃক্ষুণ্ণ।।
এই বৃদ্ধ বয়সে আমি বল পা’ব কোথা?
কিবা করি ফল নাই করিয়া মমতা।।
তোমরা মতুয়া যত মোরে ভালবাস।
সর্বদায় সকলে ত’ ওড়াকান্দি আস।।
তোমাদের যে অবস্থা সব আমি জানি।
তোমাদের পক্ষে ইহা অসম্ভব মানি।।
অধিক কি ক’ব আমি গরীব আচারে।
চৌদ্দ হাজার টাকা হ’লে হ’তে পারে।।
বল দেখি এই টাকা কেবা মোরে দিবে।
নিশ্চয় বুঝিনু বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হ’বে।।”
প্রভুর কণ্ঠেতে বাজে বিষাদের সুর।
মনে হয় প্রাণ যেন দুঃখে ভরপুর।।
শুনিয়া সকল কথা গোপাল বসিল।
মাথা হেট করে তবে ভাবিতে লাগিল।।
কিবা ল’য়ে ওড়াকান্দি আমি আসিলাম।
বাবার দয়ার পরে কত কি পেলাম।।
ঋণগ্রস্ত হ’য়ে আসি ওড়াকান্দি ধামে।
ঋণ কোথা? আছি আজ পরম আরামে।।
গ্রন্থ ছাপাইতে বাবা ক’টি টাকা নিল।
এক গুণে নিয়ে প্রভু শতগুণে দিল।।
যা’ কিছু হয়েছে মোর সব দিল তিনি।
অনন্ত দয়ার সিন্ধু প্রভু গুণমণি।।
অর্থ কড়ি জমা জমি সব দে’য়া তাঁর।
আমি ত’ প্রহরী শুধু দয়ায় তাঁহার।।
তাঁর কার্যে তাঁর ধন আমি নিতে কই।
বাবা ব্যাথা পায় আমি কেন বসে রই?
এত ভাবি সে গোপাল উঠিয়া দাঁড়া’ল।
করজোড় করি তবে কান্দিতে লাগিল।।
তাহা দেখি প্রভু বলে “কি বল গোপাল?
যা’ বলিতে চাও বল সকাল সকাল।।”
গোপাল বলিছে “বাবা করি নিবেদন।
দাসের অযোগ্য আমি অতি অভাজন।।
কোন কিছু বলা মোর সম্ভব না হয়।
যা বলি সকলি বলি তোমার দয়ায়।।
মূর্খ আমি মনে মনে যাহা বুঝিয়াছি।
শ্রীচরণে নিবেদন সব করিতেছি।।
মনে কয় বড় বাবু বিলাতেতে গেলে।
সকলে উদ্ধার হ’বে এই নমঃকুলে।।
আজ দেখি আসিয়াছে পরম সুযোগ।
নমঃশূদ্র পক্ষে ইহা অতি শুভযোগ।।
নাহি জানি মেঝে বাবু কিসে ভয় পায়।
কাঙ্গালের মনে বাবা এক কথা কয়।।
আমি দীন অতি ক্ষীণ নাহি জ্ঞান কাণ্ড।
আমাকে করেছ রক্ষা দিয়ে কৃপাদণ্ড।।
কত দয়া অভাগারে করিয়াছ তুমি।
সে সব দয়ার কথা কত ক’ব আমি?
অফুরন্ত দয়া বাবা শেষ নাহি তার।
দয়ায় দয়ায় ভরা দয়ার পাথার।।
কে বল চিনিত বাবা এই দীনহীনে।
তব কৃপা গুণে আজ দেশে দেশে চেনে।।
কি যে সে পরশমণি তব নামে রয়।
নাম নিলে মহাভণ্ড মহাসাধু হয়।।
পাতকী নারকী হোক তা’তে বাধা নাই।
গুরুচাঁদ নাম নিলে হয় সে গোঁসাই।।
কি ক’ব পরের কথা সাক্ষী আমি নিজে।
ভাল কিছু করি নাই কভু কোন কাজে।।
আমাকে তরা’বে বলে খেল এক খেলা।
যে কালে ছাপালে বাবা শ্রীহরির লীলা।।
অর্থাভাবে “গ্রন্থ” নাকি ছাপা নাহি হয়।
সে সব চাতুরী বাবা মোর মনে কয়।।
দিবানিশি লক্ষ্মী যার পদসেবা করে।
অর্থাভাব হল শেষে লক্ষ্মীপতি ঘরে?
সাগর তৃষ্ণার্ত হয় পাহাড় কোমল?
নাগে ভীত হল খগপতি মহাবল।।
তেজ হীন হল সূর্য শীতে করে ভয়?
যম পাশে ভীত হল প্রভু মৃত্যুঞ্জয়?
হনুমান ভীত হল দেখে দুষ্ট চেড়ী।
নারায়ণে বন্দী করে দিয়ে মায়া বেড়ী?
এসব সম্ভব যথা নহে কোন কালে।
মনে হয় “অর্থাভাব” বল সে কৌশলে।।
কোন ভাবে কারে দয়া করিতেছ তুমি।
মানুষে জানে না তাহা ওহে অন্তর্যামী!
সেই কালে অভাগারে করুণা করিলে।
দয়া করে গুটি কত টাকা মাত্র নিলে।।
নিলে যাহা তুচ্ছ তাহা কিছু মূল্য নাই।
প্রতিদানে শতগুণে দিনে দিনে পাই।।
আমি ত’ বুঝেছি বাবা! যত কিছু দিলে।
তোমার ঘরের ধন ঘরেতে রাখিলে।।
আমার কর্মেতে যদি সে সব আসিত।
বহুপূর্বে মোর ঘরে তারা দেখা দিত।।
যেই মাত্র ওড়াকান্দি আনিলে আমারে।
ধন মান সব তবে গেল মোর ঘরে।।
তা’তে বলি সেই সব মোর গুণে নয়।
সকলি হয়েছে বাবা তোমার দয়ায়।।
মোর ঘরে যাহা কিছু সকলি তোমার।
প্রহরী সাজিয়া আমি রক্ষা করি দ্বার।।
নিবেদন তাই পদে দয়াল ঠাকুর।
দয়া করে এ জাতির দুঃখ কর দূর।।
চৌদ্দ হাজার নিলে যদি কার্য হয়।
লক্ষ্মীখালী বাড়ী হতে আন দয়াময়।।
যে ধন রেখেছ সেথা সকলি তোমার।
প্রার্থনা মঞ্জুর কর এই অভাগার।।”
এত বলি সে গোপাল পড়ে ভূমিতলে।
বয়ান ভাসিয়া যায় নয়নের জলে।।
চারিদিকে মতুয়ারা ফুকারিয়া কান্দে।
অঙ্গ ঝাঁকি দিয়া তবে বলে গুরুচান্দে।।
“কি কথা শুনালে মোরে গোপাল গোঁসাই।
তব তুল্য লোক দেখি ত্রিভুবনে নাই।।
রাজা মহারাজা যাতে সাহস না পায়।
সে সাহস বল তুমি পেয়েছ কোথায়?
এত টাকা বল তুমি কোথা হতে দিবে?
কার্যে অগ্রসর হলে ফেরা নাহি যাবে।।
এমন সাহস বল কে দিল তোমায়?
চৌদ্দ হাজার টাকা অল্প স্বল্প নয়।।”
প্রভুর বচন শুনি কহিছে গোপাল।
“কিসের সাহস মোর আছে বা দয়াল!
বল কি সাহস মোর অন্য কিছু নাই।
বলাবল সব তুমি জগত গোঁসাই।।
আমি কোথা টাকা পাব কোথা হ’তে দিব।
তোমার যা’ আছে ঘরে তাই হ’তে নিব।।
জমাজমি ধান চাল যত কিছু আছে।
তোমাকে আনিয়া দিব তোমার তা’ বেচে।।”
পরীক্ষা হইল শেষ প্রভুজী হাসিল।
আনন্দে মাতিয়া তবে কহিতে লাগিল।।
“ও! যাদব! ও! বিপিন! শোন হে নকুল।
এই যে গোপাল সাধু সেজেছে বাতুল।।
ছেলে আছে মেয়ে আছে আছে আত্মজন।
তার জন্য চিন্তা বেটা করে না কখন।।
জমাজমি বেচে কিনে মোরে দিতে চায়।
মনে ইচ্ছা প্রমথেরে বিলাতে পাঠায়।।
এ বল কেমন লোক কেমন পরাণ?
রাজা বাদশাহ নহে ইহার সমান।।
আপনার সব বেচে দিতে চায় মোরে।
আজ হতে সে গোপাল কিনিল আমারে।।
যে কাজ করিল সাধু তার তুল্য নাই।
ভবিষ্যৎ কথা আমি কিছু বলে যাই।।
চন্দ্র সূর্য যতকাল আছে ধরা ‘পরে।
গোপালের নাম সবে কবে ঘরে ঘরে।।”
প্রভুর বচন শুনে গোপাল বেহুঁশ।
মতুয়ারা সবে বলে “কি ধন্য! পুরুষ!”
প্রেমের তরঙ্গ উঠে ওড়াকান্দি বাড়ী।
প্রেমানন্দে মতুয়ারা বলে হরি হরি।।
হেনকালে দাঁড়াইল গোস্বামী নকুল।
প্রভুর বচন শুনে ভাবে প্রেমাকুল।।
বলে “বাবা এক কথা করি নিবেদন।
জানি তুমি দয়াময় পতিত পাবন।।
তারিত পতিত জনে করিতেছ খেলা।
দিনে দিনে দেখি কত প্রেমময় লীলা।।
যে পথ দেখাল আজি গোপাল গোঁসাই।
সেই পথে সাথে সাথে মোরা যেতে চাই।।
আমি বলি যত মতো’ আছে দেশে দেশে।
এ কার্যে সাহায্য দিবে আনন্দেতে এসে।।
তাই বলি বড় বাবু যাউক বিলাতে।
মতুয়ারা দিবে টাকা তাহারে পড়াতে।।”
গোস্বামী নকুল যদি সেই কথা কয়।
যাদব, বিপিন সবে উঠিয়া দাঁড়ায়।।
আর যত মতো’ ছিল সকলে উঠিল।
নকুলের বাক্যে তারা সবে সায় দিল।।
ভক্তের মিনতি শুনি প্রভুজী তখন।
বলিতে লাগিল কথা অতি হৃষ্টমন।।
“শুন শুন সাধুগণ আমার বচন।
তোমাদের বাক্যে আমি আনন্দে মগন।।
সবে মিলে যেই কার্য আজিকে করিলে।
প্রমথরঞ্জনে আজি তোমরা কিনিলে।।
আজ হ’তে সে তোমাদের হইল ঠাকুর।
তোমাদের মনোব্যাথা করিবে সে দূর।।
সুধন্যকে একবার ডাক’ এইখানে।
তারে কিছু কথা আমি বলিব এখনে।।”
প্রভুর আজ্ঞায় তবে একজন গিয়ে।
সুধন্য বাবুকে সেথা আনিল ডাকিয়ে।।
পিতার নিকটে আসি দাঁড়াইয়া রয়।
তার প্রতি চাহি তবে বলে দয়াময়।।
“আমার বচন শোন সুধন্য সুজন।
তোমাকে করেছি আমি সংসার অর্পণ।।
চারি পুত্র মধ্যে মাত্র তুমি আছ বেঁচে।
সকলে আব্দার তাই করে তব কাছে।।
মনে মোর ছিল সাধ এই বংশ হ’তে।
একটি বালক আমি পাঠা’ব বিলাতে।।
আমার পিতার কথা সদা মনে জাগে।
পথ পা’বে নমশূদ্র সকলের আগে।।
প্রমথকে পাঠাইতে ইচ্ছা ছিল মনে।
সে কার্যে তোমার তত উৎসাহ দেখিনে।।
আমি বলি সে প্রমথ যেতে যদি চায়।
সেই কার্যে বাধা দে’য়া উচিৎ না হয়।।
অবশ্য যে সব তুমি বলেছ বচন।
অযৌক্তিক তাহা আমি বলি না কখন।।
এত বড় কাজ করা একার কি সাধ্য?
সে সব কথায় বটে আছি আমি বাধ্য।।
কিন্তু দেখ ঠাকুরের ইচ্ছা কি সুন্দর।
কোন ভার থাকিল না মোদের উপর।।
যার কাজ তিনি নিজে নিল আজ হাতে।
সেই কথা হ’ল এই মতুয়া সভাতে।।
বাবার যতেক ভক্ত এই বাড়ী আসে।
বাবার গুণেতে তারা মোরে ভালবাসে।।
তারা সবে এইমাত্র বলেছে আমারে।
বিলাত পাঠাবে তারা সেই প্রমথরে।।
যত টাকা লাগে তারা দিতে তা’ স্বীকার।
একাই গোপাল দিবে চৌদ্দটি হাজার।।
মতুয়ারা কিনে নিতে চায় সেই ছেলে।
আমি তা’তে বাধা বল দিব কিবা বলে?
তাই বলি মতুয়ারা বলিছে যখন।
সুস্থ মনে অনুমতি দেও গে’ এখন।।”
সকল শুনিয়া তবে মেঝে বাবু কয়।
“অনুমতি দিতে বাধা মোটে নাহি রয়।।
আপনার জন সব মতুয়ার গণ।
তারা সবে করিয়াছে যখনে এ’ মন।।
তা’তে বুঝি এই কার্যে মোটে সন্দ’ নাই।
অনুমতি দিতে আর বাধা মোটে নাই।।”
এত বলি মহাশয় গেল নিজ ঘরে।
মতুয়ারা এক সঙ্গে পরামর্শ করে।।
শীঘ্র শীঘ্র বড় বাবু প্রস্তুত হইয়া।
বিলাতে করুণ যাত্রা টিকিট কাটিয়া।।
কিছু কিছু টাকা সবে এ সময়ে দিব।
প্রভুকে লইয়া পরে ভ্রমণ করিব।।
পরামর্শ শেষ করি প্রভুকে জানায়।
প্রভুজী বলিল “ইহা কথা মন্দ নয়।।”
এ সময়ে বড় বাবু গৃহে নাহি ছিল।
পত্র যোগে সব কথা তাহারে জানা’ল।।
“পাসপোর্ট” ব্যবস্থাদি করিতে লিখিয়া।
টিকিটের মূল্য প্রভু দিল পাঠাইয়া।।
আনন্দে প্রমথ যেন হইল পাগল।
প্রভুর করুণা ভাবি চক্ষে ঝরে জল।।
“পাসপোর্ট” ব্যবস্থাদি সমাপ্ত করিয়া।
উপনীত হইলেন গৃহেতে আসিয়া।।
ওড়াকান্দি আসি শোনে সব সমাচার।
হরিভক্ত মতুয়ার উচ্চ ব্যবহার।।
সাথে সাথে শুনিলেন গোপালের কথা।
শ্রদ্ধায় প্রমথ তাই নোয়াইল মাথা।।
এই কার্যে মতুয়ার সত্য পরিচয়।
প্রমথরঞ্জন পেয়ে মুগ্ধ অতিশয়।।
মনে মনে করিলেন এই অঙ্গীকার।
“আমি মতুয়ার, মতো’ হইল আমার।।
মতুয়ার জন্য ধন্য হইল জীবন।
আমারে কিনিল যত মতুয়ার গণ।।
সকলের মূলে দেখি মোর পিতামহ।
কত যে গভীর তার রহিয়াছে স্নেহ!
এই পিতামহ আর মতুয়ার গণ।
ইহাদের লাগি ধন্য আমার জীবন।।
প্রভু যদি কৃপা করে দেশে আনে ফিরে।
জীবন বিলা’ব আমি ইহাদের তরে।।”
সে কথা সেদিনে বলে প্রমথরঞ্জন।
বর্ণে বর্ণে সবটুকু পালিছে এখন।।
গোপালচাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা অতিশয়।
বিলাতে থাকিতে এক পত্র তারে দেয়।।
সেই পত্র এইখানে করিনু উদ্ধৃত।
তাহা হ’তে মনোভাব হ’বে প্রমাণিত।।
(শ্রীমৎ গোপালচাঁদ সাধু ঠাকুরের নিকট লিখিত)
London Wl.-24th August, 1929
শ্রীশ্রীচরণকমলেষু-
অসংখ্য প্রণিপাতপূর্বক নিবেদন এই, বিলাতে আসিয়া অবধি আপনাদের নিকট কোন পত্রাদি লিখিতে পারি নাই।তবে আপনাদের কুশল সংবাদ অন্যান্য পত্র হইতে অবগত হইয়া থাকি।অদ্য শ্রীমান মহানন্দের পত্র পাইলাম।বোধ হয় শুনিয়া থাকিবেন, আপনাদের আশীর্বাদে আমি ব্যারিস্টার হইয়াছি।আগামী বৎসর এই সময়ে বাড়ী ফিরিব।এ বৎসর হাইকোর্টের কার্যাদি শিক্ষা করিবার জন্য এখানে থাকিতে হইতেছে।বিশেষ আর কিছু লিখিবার নাই।আশীর্বাদ করিবেন যেন মঙ্গলমত থাকিয়া আগামী বৎসর দেশে ফিরিতে পারি।তারপর কথা এই দীর্ঘ তিন বৎসর কাল বিদেশী লোকের সহিত বাস করিয়াও আমি মতুয়াদের ভুলিতে পারি নাই।ঠাকুরদাদার অভয় বাণী ভুলিয়া যাই নাই।জগতের নানা স্থান দর্শন করিয়াছি এবং আরও করিব; কিন্তু তাহার মধ্যে প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছি ঠাকুরদাদার মত লোক আর এ ব্রহ্মাণ্ডে নাই।তাঁহারই অনুগ্রহে আমার এত সৌভাগ্য হইল।অতএব তাঁহার আদেশ পালনই আমার জীবনের সর্বপ্রথম কর্তব্য।দেশে ফিরিয়া আমিও আবার মতুয়া-ধর্মে দীক্ষিত হইব।ভোগ-বিলাসিতায় কোন কালে লোকের সুখ হয় নাই এবং হইবেও না।সেই জন্যেই ঠাকুর সর্ব-ত্যাগী ছিলেন।
আমার ঠিকানা উপরে ইংরেজীতে ছাপান অক্ষরে দেওয়া হইল।যদি দয়া করিয়া পত্রের উত্তর দেন, তবে বড়ই সৌভাগ্য মনে করিব।ইতি-
সেবক
শ্রীপ্রমথরঞ্জন ঠাকুর
মূলসূত্র ধরে এবে বলি কিছু কথা।
প্রমথ শুনিল গৃহে সকল বারতা।।
তের শ’ তেত্রিশ সাল বাংলা গণনায়।
ভাদ্র মাসে সে প্রমথ যাত্রা করি যায়।।
অমূল্যকুমার দাস দোঁহে এক সঙ্গে।
চলিল সাগর পথে অতি মনোরঙ্গে।।
গৃহ হ’তে বিদায়ের কি মধুর দৃশ্য!
বিষাদ মাখানো তা’তে আছিল অবশ্য।।
দেশবাসী সবে বটে আনন্দিত মন।
জনে জনে করিলেন সু-অভিনন্দন।।
উৎসাহ বাড়িল তা’তে কিছু সন্দ’ নাই।
কিন্তু সব গেল ডুবে এসে এক ঠাই।।
প্রভুর চরণে যবে করে প্রণিপাত।
আশীর্বাদ করে প্রভু শিরে রাখি হাত।।
বুকের জমাট বাধ বুঝি ভেঙ্গে গেল।
প্রমথের হাত ধরে প্রভুজী কান্দিল।।
প্রমথ লুটায়ে তা’তে পড়িলেন কোলে।
প্রভুর চরণে ভিজায় নয়নের জলে।।
প্রভু বলে “যাও দাদা! করি আশীর্বাদ।
পূর্ণ যেন করে প্রভু তব মনোসাধ।।
এ বংশ উজ্জ্বল কর স্বদেশে ফিরিয়া।
যেতে যেন পারি আমি চোখেতে দেখিয়া।।”
এইভাবে গৃহ হ’তে বিদায় হইল।
সঙ্গে সঙ্গে বড় মাতা কলিকাতা এল।।
নয়ন রঞ্জন পুত্র প্রমথরঞ্জন।
জননীর দুই চোখে ঝরিল শ্রাবণ।।
বিদায়ের পূর্বভাগে ডাকিল গোপালে।
সংবাদ পাইয়া সাধু এল দলে বলে।।
সাধুরে বিনয় করি আশীর্বাদ চায়।
কাঁদিয়া গোপাল বলে “বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।”
অসীম সাগর বুকে চলিলেন বীর।
মতুয়ারা দিল অর্ঘ্য ঢেলে অশ্রুনীর।।
প্রমথরঞ্জন তবে বিলাত পৌছিল।
পরে শোন মহাপ্রভু কি কার্য করিল?
শ্রীগুরুচরিত গাঁথা বিপদাপহারী।
মহানন্দ বলে সবে শোন নিষ্ঠা করি।।
পরম দয়াল শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
(লক্ষ্মীখালী ভ্রমণ)
“তোমারি দেওয়া প্রাণে
তোমারি দেওয়া দুঃখ।”
-কান্ত কবি রজনীকান্ত
প্রমথ রঞ্জন চলি গেলেন লন্ডন।
প্রভুর নিকটে পত্র দেয় ঘন ঘন।।
গোপাল স্বীকার করে চৌদ্দ হাজার।
দেশে দেশে রটে’ গেল সেই সমাচার।।
স্তম্ভিত হইল সবে শুনি সেই কথা।
যেই শোনে শিহরিয়া হেট করে মাথা।।
ধনী মানী জ্ঞানী মূর্খ বহু লোক জন।
ওড়াকান্দি যাতায়াত করে সর্বক্ষণ।।
যারে দেখে প্রভু তারে ডাক দিয়া কয়।
“অসম্ভব কথা এক শোন মহাশয়।।
আমার একটি শিস্য নামেতে গোপাল।
বাস করে বাদাবনে শুধু নোনা জল।।
উপরে দেখিলে তারে বোঝা নাহি যায়।
মহাশক্তিশালী বটে সেই মহাশয়।।
বহু কীর্তি আছে তার যাহা শোনা যায়।
দেশবাসী সবে তার জানে পরিচয়।।
আমি যবে লীলামৃত গ্রন্থ ছাপিয়াছি।
সব টাকা সে গোপাল নিজে দিল যাচি।।
সে ত’ মাত্র পাঁচ শত বেশী টাকা নয়।
এবারে করেছে যাহা অত্যাশ্চর্য্যময়।।
প্রমথ বিলাত যেতে করিল মনন।
আমি বলি টাকা দিতে পারি না কখন।।
শুনিয়া গোপাল মোরে করে অঙ্গীকার।
একা টাকা দিবে সেই চৌদ্দ হাজার।।
আর যত মতো’ আছে সব টাকা দিবে।
সেই অর্থে সে প্রমথ বিলাতে পড়িবে।।
এত বড় দানবীর দেখিয়াছ চোখে?
বারুণীতে এসো আমি দেখাব তাহাকে।।”
প্রভুর বচনে সবে ধন্য ধন্য কয়।
সকলেই শ্রীগোপালে দেখিবারে চায়।।
এদিকে গোপাল সাধু করিয়াছে মন।
প্রভুকে আবার নিবে আপন ভবন।।
মনে মনে তার এক গূঢ় ইচ্ছা রয়।
প্রকাশ করে না তাহা মনে মনে কয়।।
প্রভুর আদেশে তেহ মন্দির গড়িল।
মন্দির শিখরে বটে কেতন উড়িল।।
কিন্তু তা’তে তুষ্ট নহে সাধুজীর মন।
মনে মনে এই ইচ্ছা তার সর্বক্ষণ।।
দয়াময় গুরুচাঁদে আনিয়া মন্দিরে।
পুজিবে চরণ পদ্ম দুটি আঁখিনীরে।।
জীবন্ত বিগ্রহ “প্রভু হরি-গুরুচাঁদ”।
সেই পদে পুষ্প দিতে তার মনোসাধ।।
সেই ভাব মনে করি ওড়াকান্দি যায়।
দরবার করিলেন পূজার সময়।।
প্রভু বলে “মোর যেতে বাধা কিছু নাই।
কিছুদিন পরে বটে আমি যেতে চাই।।
এবে তুমি গৃহে গিয়ে কর আয়োজন।
সপ্তাহ পরেতে হেথা কর আগমন”।।
মণিহারা ফণী যেন পেল নিজ মণি।
সেই ভাবে গৃহে ছোটে সাধু গুণমণি।।
দেশে দেশে সকলেরে দিল সমাচার।
“লক্ষ্মীখালী আসিবেন প্রভু গুণাকর।।”
সমাচার পেয়ে যেন সবে আত্মহারা।
মহানন্দে নাম গানে সবে মাতোয়ারা।।
বরিশাল যশোহর ফরিদপুরেতে।
যত ভক্ত ছিল সবে এল হৃষ্ট চিতে।।
ঘর দ্বার পরিষ্কার করে ভক্তগণে।
হরষিত, কাশীনাথ থাকে সনে সনে।।
মিস্ত্রীডাঙ্গাবাসী ভক্ত গণেশ মণ্ডল।
লক্ষ্মীখালী উপনীত বলে হরিবোল।।
তার সাথে সাথে চলে সাধু পতিরাম।
গোপালের আদি শিস্য অতি গুণধাম।।
বেতকাটাবাসী সাধু নাম নিবারণ।
সোনারাম, রতিকান্ত চলে তিনজন।।
মাদুরপাল্টায় বাস শ্রীমধুসূদন।
“কবিরাজ” খ্যাতি ভক্ত তিনি একজন।।
তার ভ্রাতুষ্পুত্র হল শ্রীসখীচরণ।
গোপালের শ্রেষ্ঠ ভক্ত তিনি একজন।।
দিগরাজবাসীধনী নাম নিবারণ।
শ্রীরাইচরণ তার ভাই অন্যজন।।
কনিষ্ঠ অভয় নামে রচক সাধক।
বহুগান রচিয়াছে হইয়া পুলক।।
বুড়বুড়ে বাসী সাধু শ্রীপূর্ণ চরণ।
গোপালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত সেইজন।।
উপাধি মৌলিক তার অতি নিষ্ঠামতি।
তাহার হৃদয়ে সদা ভক্তির বসতি।।
কাইনামারীতে বাস উপাধি মণ্ডল।
শ্রীমহিত রামধন মনে নাহি গোল।।
আড়ংঘাটায় বাস শ্রীকালীচরণ।
উপাধি “ঠাকুর” তার অতি মহাজন।।
রোমজাইপুর বাসী শ্রীগুরু চরণ।
তার ভ্রাতুষ্পুত্র যিনি নামে পঞ্চানন।।
আদিতে “তাপালী” বলি দিত পরিচয়।
প্রভুর আদেশে পরে “রায়” বলি কয়।।
বড়দিয়া বাস করে নাম কেনারাম।
শ্রীমন্ত বিশ্বাস যিনি বাশতলী ধাম।।
চৌমোহনা গ্রামে বাস নাম লক্ষ্মীকান্ত।
এই মত দেশে দেশে যত সাধু সন্ত।।
একে একে উপস্থিত হ’ল লক্ষ্মীখালী।
শ্রীঅভয়চরণ রায় বাড়ী ধনখালী।।
অভয় চরণ রায় অভয় হালদার।
শ্রীপূর্ণ চন্দ্র মৌলিক জানি সাথে তার।।
তিন জনে এক সঙ্গে থাকে এক ঠাই।
মনে হয় সহোদর যেন তিন ভাই।।
এই মত সাধু যত এল লক্ষ্মীখালী।
সকলেরে শ্রীগোপাল বলিলেন খুলি।।
দয়া করি দয়াময় আসিবে এ দেশে।
তারে সবে কর পূজা বিশেষ বিশেষে।।
দেশ ধন্য হ’বে তা’তে ঘুচিবে জঞ্জাল।
দয়াময় গুরুচাঁদ পরম দয়াল।।
আর এক কথা সবে শুন দিয়া মন!
এ দেশে আসিবে প্রভু কিসের কারণ?
এ জাতি তুলিতে প্রভু সদা চেষ্টা করে।
তাই কত কষ্টে দেখ দেশে দেশে ঘোরে।।
তাই প্রভু এ জাতির মঙ্গল কারণ।
পাঠাইলা নিজ পৌত্র বিলাত ভুবন।।
একা প্রভু পারে বটে এ কার্য সাধিতে।
পারে বটে প্রভু একা সব অর্থ দিতে।।
কিন্তু তিনি ইচ্ছা করে সবে অর্থ দিক।
প্রভুর এ কার্যে সব থাকুক শরিক।।
এ বড় দয়ার কথা শুন সর্বজন।
প্রভু দিতে চায় সবে অমূল্য রতন।।
আমি বলি এই কার্যে যে যে অর্থ দেয়।
সে বংশে বিদ্বান বহু আসিবে নিশ্চয়।।
যে যেখানে দিবে অর্থ প্রভু সেথা যাবে।
প্রভুর কৃপায় তারা ধন্য হ’য়ে র’বে।।
এই কথা যবে বলে গোপাল গোঁসাই।
“জনে জনে বলে মোরা অর্থ দিতে চাই”।।
গোপাল করিল পরে পথ নিরূপণ।
কোন কোন গৃহে প্রভু করিবে গমন।।
এইভাবে স্থির যবে হ’ল সমুদয়।
ওড়াকান্দি প্রতি তবে সে গোপাল ধায়।।
প্রভু আগমন আশে হেথা সর্বজন।
লক্ষ্মীখালী রহে বসি উচাটন মন।।
প্রভুর লীলার তত্ত্ব কেবা কত বুঝে?
কত যে মাধুরী ভরা তার লীলা মাঝে!
কখনে কান্দায় কা’রে কখনে হাসায়।
হাসি-কান্না দিয়ে প্রভু জগত চালায়।।
ওড়াকান্দি শ্রীগোপাল উপস্থিত হ’ল।
গোপালে দেখিয়া প্রভু কহিতে লাগিল।।
“শুন হে গোপাল তুমি মোর বাক্য লও।
কিসে লক্ষ্মীখালী যা’ব সেই কথা কও।।
একে ত’ প্রাচীন আমি তা’তে বলহীন।
ক্রমেই দুর্বল যেন হই দিন দিন।।
তোমাকে দিয়েছি কথা তাহা মিথ্যা নয়।
কিন্তু কোথা যেতে মনে পাই বড় ভয়।
কি জানি কি লোনা জলে গেলে একবার।
ফিরি কি না ফিরি কিবা ঠিক আছে তার।।”