হরিচাঁদ ঠাকুরের অবতারবাদ ও শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
প্রথমে বন্দনা অংশে বলা হয়েছে,
“পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।”
অথ মঙ্গলাচরণে, মতুয়াবাদের এক সহজ সত্য লিখিত হয়েছে,
“যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।
ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার।।”
তারপর, পূর্বের অবতারক্রম বর্ণনা করা হয়েছে। এবং এখানে “হরি”এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে,
“সকল হরণ করে তারে বলি হরি”
এবং বলা হয়েছে, “রাম হরি কৃষ্ণ হরি শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।”
এবং এর পরে অন্যদের “হরি” স্বীকারপূর্বক বলা হয়েছে,
“হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি”
অর্থাৎ রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ প্রভৃতি অবতারপুরুষরা হরি হলেও, পূর্ণ ছিলেন না। কিন্তু হরিচাঁদ সেই আদি, আসল, পূর্ণ হরি।
পুনর্বার অবতারের প্রয়োজন ও পূর্ব পূর্ব ভাগবত ও পুরাণ প্রসঙ্গে, এই পরিচ্ছেদে অবতার ক্রম বর্ণনার পরে হরিচাঁদ ঠাকুরকে অবতার স্বীকার করে নিয়ে তার আসার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। অবতারের স্বীকারোক্তি......।
“যে জন্যে এ অবতার, পশ্চাতে করি প্রচার
ওঢ়াকাঁদি কৈল শেষ লীলা”
আর উদ্দেশ্য.........
“মানবকুলে আসিয়ে, যশোমন্ত সুত হ’য়ে,
জন্ম নিল সফলানগরী।
প্রচারিল গূঢ়গম্য, সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম,
জানাইল এ জগত ভরি।।”
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তিনি কি ধর্ম জানালেন? সনাতন ধর্ম।
কিরূপে জানালেন? সূক্ষ্মরূপে।
তাহলে সনাতন ধর্মের সূক্ষ্মরূপ কি? সনাতন ধর্মের আদিরূপ। যেখানে স্থূলতা (বাহ্যিক অংগ, আচার আচরণ, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি) বাদ দিলে যা থাকে তাই সূক্ষ্ম অংশ।
অংশ অবতার হলেও স্বয়ং এর অবতার না হওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে এবং কখন স্বয়ং অবতার হন, তার একটি সময় বলা হয়েছে............
“বহুত দ্বাপর কলি আসে আর যায়।
স্বয়ং এর অবতার তাতে নাহি হয়।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তর শেষ যেই কলি।
অবতীর্ণ ভক্তবৃন্দ লইয়া সকলি।।”
অর্থাৎ অনেক যুগের আবর্তন হলেও, অষ্টাবিংশ মন্বন্তর শেষ যে কলি (বর্তমান কলি যুগ) সেই কলিতে ভক্তবৃন্দ সঙ্গে করে স্বয়ং আবির্ভূত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ প্যারার শেষের দিকে, গৌরাঙ্গ প্রভুর পরে দুই অবতারের কথা বলা হয়েছে। একজন শ্রীনিবাস। আর অন্যজন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।
“আর এক জন্ম বাকী রহিল প্রভুর।
এই সেই অবতার শ্রীহরি ঠাকুর।।”
অথ দণ্ডভঙ্গ বিবরণে, গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস নেওয়ার পরে নিত্যানন্দ মহাভাবে ভাবিত হয়ে, নিমাইয়ের হাতের দণ্ড ভাঙ্গেন। যে ভাব গ্রহণ করে নিত্যানন্দ দণ্ড ভাঙ্গেন, সে কালে তা পূর্ণ হয়নি। তার এই হরিলীলায় দেখা যায়, সেই দণ্ডের প্রতীকীরূপ দণ্ড মতুয়াদের হাতে হাতে লাল নিশানরূপে দেখা যায়। এ গৌর অবতারের লীলাপ্রকাশ।
এখন ভগবান দণ্ড বয় না, ভক্তেরা সেই ভার নিয়েছে। এই সেই মহাভাব।
অতপর, ভক্ত-কণ্ঠহার পরিচ্ছেদে বলা হল, দণ্ড ভাঙল কিন্তু কমণ্ডুল কেন ভাঙল না? সেই সময়ের এক অঙ্গীকার, “শেষ লীলা কমণ্ডলু ভেঙ্গে হবে মালা।
লক্ষ্মীকে করিয়া ত্যাগ কমণ্ডলধারী।
কমণ্ডলু ভেঙ্গে লক্ষ্মী বলাইবে হরি।।”
এই যে মতুয়ারা আচার মালা পরে, এটা সেই কমণ্ডুল এর অংশ। এটা শান্তিজননীর দান। এটাও গৌর অবতারের পরিক্রমা।
যমকলি প্রভাব –গ্রন্থআলোচনা পরিচ্ছেদে, কিভাবে গৌরহরির বৈষ্ণব ধর্মে ত্রুটি তৈরি হল, এবং তা বর্ণনা করে, তার থেকে উত্তরণের জন্য অবতারের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে। এরপর,
“সুযুক্তি বিধানে প্রভু অবতীর্ণ হ’ল।
হরিচাঁদ নামে যত ভক্তে শিক্ষা দিল।।”
এর পর তার অনুসারীদের করনীয় কতিপয় উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তারপর
“এইভাবে করিবেন জীবের উদ্ধার।
এ কারণ হৈল যশোমন্তের কুমার।।”
গৌর-ভক্ত- খেদ ও দৈবাদেশ পরিচ্ছেদে, হরিঠাকুরের আবির্ভাবের পূর্ব উক্তির কথা বলা হল,
“এবে না পাইবে দেখা, গুরুজন শিষ্য শাখা,
স্থির কর সবে শোক মন।
কলির মধ্যাহ্নকালে, করিব একটি লীলে,
তারপর পাবে দরশন।।
মানুষে আসিয়া, মানুষে মিশিয়া,
করিব মানুষ লীলে।।”
অবতার অনুক্রম, যশোমন্ত ঠাকুর ও পৌরাণিক অন্যান্য ভক্ত চরিত্র পরিচ্ছেদে, সূক্ষ্ম সনাতন ধর্মের প্রকাশ করেছেন,
“কিসের রসিক ধর্ম কিসের বাউল।
ধর্ম যজে নৈষ্ঠিকেতে অটল আউল।।
সর্ব ধর্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থুল।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্তি এই হয় মূল।।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
এই সুক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাইতে।
জনম লভিলা যশোমন্তের গৃহেতে।।”
মহাপ্রভুর পূর্ব পুরুষগণের বিবরণ পরিচ্ছেদের শেষভাগে কবি রসরাজের অকপট স্বীকারোক্তি,
“ঠাকুরের এ বংশেতে, হরিচাঁদ অবনীতে,
করিলেন জনম গ্রহণ।
কহিছে তারকচন্দ্র, অবতীর্ণ হরিশ্চন্দ্র,
হরি হরি বল সর্বজন।।”
অন্নপূর্ণা মাতার যশোদা আবেশ প্যারাতে দেখা যাচ্ছে, রামকান্ত অন্নপূর্ণা দেবীকে তার উদরে বাসুদেব (শ্রীকৃষ্ণ) জন্ম নেবেন বলে আশীর্বাদ করছেন.........
“রামকান্ত বলে মাগো বলি যে তোমারে।
বাসুদেব জন্মিবেন তোমার উদরে।।”
শ্রীহরি ঠাকুরের জন্ম বিবরণ পরিচ্ছেদে বলা হল, কি জন্য এ অবতার,
“কৃষ্ণ প্রেম সুনির্মল উচ্চেতে না র’বে।
নিম্ন খাদে থাকে বারি দেখ মনে ভেবে।।”
অতপর, বলা হল,
“এই মত দেখ নানা কারণ বশতঃ।
গোলক বিহারী হ’ল যশোমন্ত সুত।।”
আরও বলা হল, গৌরাঙ্গ লীলায় যিনি বিশ্বরূপ ছিলেন, এ জন্মে তিনিই কৃষ্ণদাস।
“যিনি ছিল বিশ্বরূপ গৌরাঙ্গ লীলায়।
তিনি কৃষ্ণদাস যশোমন্ত পুত্র হয়।।”
এরপর যশোমন্ত ঠাকুর ও অন্নপূর্ণা দেবীর জন্ম পরিক্রমা বর্ণনা করা হয়েছে,
“ধন্য অন্নপূর্ণা হেন পুত্র পেল কোলে।
দ্বাপরে যশোদা যিনি ছিলেন গোকুলে।।
দ্বাপরে ছিলেন নন্দ যশোদার কান্ত।
যশোমতি কান্ত এবে হ’ল যশোমন্ত।।
ধরা দ্রোণ দুইজন তস্য পূর্ব্বে ছিল।
নন্দ যশোমতি তেই দ্বাপরে হইল।।
কলিকালে জগন্নাথ মিশ্র শচীরাণী।
এবে যশোমন্ত অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী।।”
রামকান্ত বৈরাগীর পূর্ব্বাপর প্রস্তাব কথন পরিচ্ছেদের শেষভাগে বলা হয়েছে, রামকান্তের পূজ্য বাসুদেবই হরি হয়ে এসেছেন সফলা নগরে,
“এই বাসুদেব জন্ম সফলা নগরী।
তারক রসনা ভরি বল হরি হরি।।”
জয়পুর রাজকুমারের পুনর্জীবন পর্বে হরিঠাকুরের পাঁচ ভাইকে বিষ্ণুর পঞ্চ অংশ হিসেবে দেখান হয়েছে,
“এক বিষ্ণু পঞ্চঅংশে ভুবনে প্রকাশ।।
পঞ্চভাই জন্ম নিল ভুবনের মাঝ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।”
মহাপ্রভু শ্রীশ্রীহরিচাঁদের গোপালবেশ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে তার এই বাল্য খেলা পূর্বের থেকে প্রাপ্ত.........
“ঠাকুর কহিল সর্বে, ওরা যথা ছিল পূর্বে, ভ্রমণ করেছি তার তটে।।
ওরা বড় ছিল খল, আমি দিনু প্রতিফল, কাত্যায়নী নাম মন্ত্রগুণে।
দমন করেছি কালী, সেই হ’তে চিরকালি, দেখে চিনে নাম শুনে মানে।।”
এখানে শ্রীকৃষ্ণের কালীয় নাগ দমনের কথা বলা হয়েছে।
জ্ঞানযোগ ও রস প্রকরণ পরিচ্ছেদে রামকান্তকে শ্রীহরি ঠাকুরের গুরুরূপে স্বীকার করে নিয়েছেন যা জন্ম জন্মান্তরের
“রামকান্তে বলিতেন তুমি মম গুরু।
যুগে যুগে তুমি মোর বাঞ্ছাকল্পতরু।।”
অথ লক্ষ্মীমাতার জন্ম-বিবাহ ও যশোমন্ত ঠাকুরের তিরোভাব পর্বে শান্তি দেবীর পূর্ব জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে,
“বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী যিনি সত্যে বেদবতী।
অম্বরীষ কন্যা যিনি দ্বাপরে শ্রীমতি।।
বিষ্ণুপদ সেবানন্দ ক্ষীরোদ বাসিনী।
ত্রেতাযুগে সীতা সতী দ্বাপরে রুক্মিনী।।
বিষ্ণুপ্রিয়া নাম ধরে গৌরাঙ্গ গৃহিণী।
কলিতে হ’লেন তিনি লোচন নন্দিনী।।”
শ্রীমদ্ ব্রজনাথ পাগলোপাখ্যান পরিচ্ছেদে ব্রজনাথকে বলছে,
“আমি তোর কৃষ্ণ হই আমি তোর ইষ্ট।।
যশোদা দুলাল আমি ভকত বৎসল।
তোর জন্য বাছা আমি হ’য়েছি পাগল।।”
তারপর বলা হয়েছে স্বয়ং হরিঠাকুরের মুখে.........
“এবে আমি হইয়াছি যশোমন্ত সুত।
তোমার দেহেতে হইলাম আবির্ভূত।।
মুখডোবা ছিনু বাসুদেব মূর্তি ধরে।
যশোমন্ত সুত হইনু রামকান্ত বরে।।”
রামলোচনের বাটী মহোৎসব ও চৈতন্য বালার দর্প চূর্ণ পর্বে বলা হয়েছে,
“হরিবোলা সাধুদের ভক্তি অকামনা।
তন্ত্র মন্ত্র নাহি জানে ব্রজ উপাসনা।।”
এখানে ব্রজ উপাসনা বলা হয়েছে। কি সেই ব্রজ উপাসনা। এ হচ্ছে বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের অপ্রাকৃত অকামনা প্রেমের উপাসনা। যাকে আত্মিকরণ করা হয়েছে মতুয়া সাধনতত্ত্বে।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদের চতুর্ভুজ রূপ ধারণ ও গোস্বামী গোলোকচাঁদের বংশাখ্যান অনুচ্ছেদে শ্রীহরি ঠাকুরের আদিরূপ দেখলেন গোলক পাগল।
“শঙ্খ চক্র গদাপদ্ম চতুর্ভুজধারী।
পরিধান পীতাম্বর মুকুন্দমূরারী।।”
অথ মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের উপাখ্যান প্রবন্ধে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের লুকিয়ে আনা বিষ খেয়ে না মরার পর তার উপলব্ধি......
বিষপানে মরিতেন মানব হইলে।
আমার মনের কথা কেমনে জানিলে।।
আমি যে এনেছি বিষ গোপন করিয়া।
কেহ নাহি জানে আনি কাপড়ে বাঁধিয়া।।
গোপনে রেখেছি কিসে পাইল সন্ধান।
অন্তর্যামী ইনিত স্বয়ং ভগবান।।
শ্রীহীরামন পাগলের উপাখ্যানে হরিঠাকুর হীরামন পাগলের পূর্ব জন্মসমূহের বিবরণ দিচ্ছেন এভাবে,
মহাপ্রভু ডেকে বলে সেই হীরামনে।
রামাবতারের কথা পড়ে তোর মনে।।
লংকাদগ্ধ বনভঙ্গ সাগর লঙ্ঘন।
রাজপুত্র বনবাসী নারীর কারণ।।
ভেবে দেখ মনে তাহা হয় কিনা হয়।
যে সকল কার্য্য বাছা করিলি ত্রেতায়।।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিরূপাক্ষ সমুদ্ভব।
দ্বিতীয় মহান রুদ্র অযোনী সম্ভব।।
তৃতীয়ে শ্রীহনুমান রামনাম অঙ্গে।
চতুর্থে মুরালীগুপ্ত শচীসুত সঙ্গে।।
পঞ্চমে তুলসীদাস ষষ্ঠে হীরামন।
আদি হি, অন্ত ন, মধ্যে রাম নারায়ণ।।
হনুমান দ্বীনকার এ কোন কারণ।
হীন হ’য়ে হীন মধ্যে শ্রীরাম স্থাপন।।
মহাপ্রভুর শ্রীরাম মূর্তি ধারণ প্রবন্ধে,
অভিনব রূপ নব দূর্বাদল শ্যাম।
দেখিতে দেখিতে হ’ল দাশরথি রাম।।
আর যত লোক ঠাকুরের ঠাই ছিল।
সবে দেখে প্রভু হরিচাঁদ দাঁড়াইল।।
হীরামন দেখিল সাক্ষাৎ সেই রাম।
শিরে জটা বাকলাটা সুন্দর সুঠাম।।
একা হীরামন দেখে রাম দয়াময়।
সে রূপের আভা মাত্র দেখে মৃত্যুঞ্জয়।।
বামপার্শ্বে কুক্ষিমধ্যে দেখে ধনুর্গুণ।
কটিতে বাকল শিরে জটা কক্ষে তুণ।।
বনবাসে যেই বেশে যান ঋষ্যমুখে।
তেম্নি অপরূপ রূপ হীরামন দেখে।।
পুনরায় রামরূপ হীরামন দেখতে চাইলে,
হীরামন বলে কোথা পূর্ণব্রহ্ম রাম।।
হীরামন বলে প্রভু মোরে দেখা দাও।
আরবার রামরূপ আমারে দেখাও।।
প্রভু কহে কহি তোরে ওরে হীরামন।
যদি কেহ কারু কিছু করে দরশন।।
অস্মভব দেখে জ্ঞানী প্রকাশ না করে।
শুনিলে সন্দেহ হয় লোকের অন্তরে।।
গোস্বামীর শ্রীধামে গমন পরিচ্ছেদে হীরামনের স্বীকারোক্তি,
তব শ্রীমুখের আজ্ঞা যদি পায় হীরে।
ব্রহ্মাণ্ড ডুবা’তে পারে গোষ্পদের নীরে।।
ত্রেতাযুগে তব শ্রীমুখের আজ্ঞা পাই।
আঠার বর্ষের পথ এক লম্ফে যাই।।
আনিনু গন্ধমাদন তব কৃপাগুণে।
এই পরিচ্ছেদেই হরিঠাকুরকে তার পূর্বের অবতার শ্রীনিবাস বলে সম্বোধন,
হীরামন বলে আজ্ঞা কর শ্রীনিবাস।
যবনেরে সবংশেতে করিব বিনাশ।।
গোস্বামী দশরথোপাখ্যান পরিচ্ছেদে দশরথ ঠাকুরকে দেখার পূর্বে ঠাকুরকে অবতার বা ভগবান রূপে বিশ্বাস করতে পারেনি,
শুনে দশরথ কয় বিশ্বাস না হয়।
কোন হরি ওঢ়াকাঁদি হইল উদয়।।
কিন্তু দেখার পর হরিঠাকুরের বাণী,
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।
কোথাকার হরি এল ওঢ়াকাঁদি গায়।।
নদীয়াতে গৌররূপে গোলোক-বল্লভ।
ওঢ়াকাঁদি জন্ম তার কিসে অসম্ভব।।
মীন হৈনু, কূর্ম হৈনু, বরাহ নৃসিংহ।
তা হ’তে কি হীন হৈনু ল’য়ে নরদেহ।।
মাতাকে কড়ার দিনু নদীয়া ভুবনে।
করিব মা শেষ লীলা ঐশান্য কোণে।।
এই সেই লীলা এই সেই অবতার।
ইহার উপরে পূর্ণ লীলা নাহি আর।।
প্রভু হরিচাঁদ তাঁর নিজ লীলা সম্পর্কে আরও বললেন,
প্রভু বলে শেষ লীলা বড় চমৎকার।
লীলাকারী যেই তার নিজে বোঝা ভার।।
শ্রীমদ গোলোক কীর্তনিয়া উপাখ্যান পরিচ্ছেদে, তার সাথে সাক্ষাৎকারের পূর্বে ঠাকুরকে অবিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে,
যা থাকে কপালে হ’বে হয় হো’ক ক্লেশ।
কোথা হ’তে স্বয়ং এল কলি অবশেষ।।
আর দেখা হওয়ার পর,
তুমি কৃষ্ণ তুমি বিষ্ণু তুমি হর হরি।
বিধবা রমণীর ব্যাধিরূপ পৈশাচিক দৃষ্টিমোচন পরিচ্ছেদে ওই নারীর উক্তি,
সে নারী শ্রীক্ষেত্রে গেল জগন্নাথে আর্তি।
রথের উপরে দেখে হরিচাঁদ মূর্তি।।
নারী বলে কেন আমি আসি এতদূর।
ওঢ়াকাঁদি আছ যদি দয়াল ঠাকুর।।
এই সেই সেই এই ভিন্নভেদ নাই।
এবং শ্রীক্ষেত্র থেকে ফেরার পর ঠাকুরের বাণী ওই নারীর প্রতি,
প্রভু বলে ওঢ়াকাঁদি আমি হরিদাস।
জগবন্ধু বলে তোর হ’ত কি বিশ্বাস।।
তেঁই তোরে পাঠাইনু শ্রীক্ষেত্র উৎকলে।
বুধই বৈরাগীর গৃহদাহ বিবরণ অধ্যায়ে হরি ঠাকুর বলছেন,
ঘৃণা মহাপাপ স্পর্শে পালের হৃদয়।
সেই পাপে অগ্নিতাপ হীনতেজ হয়।।
ব্রহ্মতেজ বিষ্ণুতেজ অগ্নিতেজ জ্বলে।
সব তেজ নষ্ট হয় আমাকে নিন্দিলে।।
গুরুকে না চিনে বেটা করে গুরুগিরি।
অহংকারী গুরুকার্যে নহে অধিকারী।।
মাচকাঁদি গ্রামে প্রভুর গমন পরিচ্ছেদে প্রভুর উক্তি,
প্রভু বলে সেই আমি ভাব যদি তাই।
সেই আমি যদি তোরা সেই পঞ্চ ভাই।।
এই পঞ্চ ভাই তোরা দ্বাপর লীলায়।
শেষে ভবানন্দ পুত্র আমি নদীয়ায়।।
যুগে যুগে ভক্ত তোরা হইলি আমার।
এবে তোরা পঞ্চ পুত্র শঙ্কর বালার।।
হীরামন গোস্বামী কর্তৃক মৃন্ময়ী দুর্গাদেবীর স্তন্যপান পরিচ্ছেদে হীরামনের উক্তি,
আমাদের এই মাতা সেই মাতা হ’লে।
দেখিয়া চিনিত মোরে করিতেন কোলে।।
প্রভু রাম পূজিলেন দুঃখের সময়।
মাল্যবাণ পর্বতে মা হ’লেন উদয়।।
শ্রীমদ্রসিক সরকারের উপাখ্যানে রসিক সরকারের গৌরাঙ্গকে স্বয়ং বলে প্রমাণ করার পরের উক্তি,
সেই শ্রীগৌরাঙ্গ মোর এল ওঢ়াকাঁদি।
নমঃশূদ্র কুলে অবতার গুণনিধি।।
যশোমন্ত রূপে জীবে ভক্তি শিখাইল।
জয় হরিচাঁদ জয় সবে মিলে বল।।
দি্গ্বিজয়ীর দিব্য জ্ঞান লাভ পরিচ্ছেদে মহাপ্রভুর মুখে উক্ত হয়েছে,
মহাপ্রভু বলে আমি ছিনু নদীয়ায়।
চেন কিনা চেন আমি শচীর তনয়।।
তুমি দিগ্বিজয় ছিলে কেশব কাশ্মীরী।
আমি সেই বালক নিমাই গৌর হরি।।
অতপর দিগ্বিজয়ীর পূর্ব জন্মের স্মৃতি স্মরণ হওয়ার পরের স্বীকারোক্তি,
সেই তুমি, তুমি সেই, আমি দিগ্বিজয়।
তুমি প্রভু সর্বেশ্বর শচীর তনয়।।
অদোষ দরশি তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া কান্ত।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদের কৃষ্ণরূপ ধারণ খণ্ডে কমল দাস কর্তৃক হরি ঠাকুরের শ্রীকৃষ্ণরূপ দর্শনের কথা বলা হয়েছে,
পরিধান পীতবাস যেন কাল শশী।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা বাঁকা হাতে আছে বাঁশী।।
বনমালা গলে দোলে বক্ষদেশ ঢাকা।
চরণে চরণ দিয়ে হ’য়ে আছে বাঁকা।।
মস্তকেতে শিখি পাখা শ্রীপদে নুপুর।
এইমত রূপে আছে শ্রীহরি ঠাকুর।।
জাত মৃতপুত্রের জীবন দান পরিচ্ছেদে তারক সরকারের মুখে বলা হল,
অপার মহিমা প্রভু পূর্ণ অবতার।
প্রশস্থ গার্হস্থ্য ধর্ম এল শিখাবার।।
অবনীতে অবতীর্ণ ভব কর্ণধার।
করিলেন শেষ লীলা অতি চমৎকার।।
আনন্দের প্রতি স্বপ্নাদেশ পরিচ্ছেদে হরিচাঁদ ঠাকুর স্বপ্নে আনন্দকে তার পূর্ব জন্মের কথা বলছেন,
তবে একদিন আমি কুরুক্ষেত্র রণে।।
অর্জুনের সারথি ছিলাম যে সময়।
হনু বলে প্রভু আর সহ্য নাহি হয়।।
যদি আজ্ঞা করিতেন প্রভু ভগবান।
একটানে ফেলাতাম কর্ণের রথ খান।।
শ্রীক্ষেত্র প্রেরিত প্রসাদ বিতরণ খণ্ডে পাণ্ডা কর্তৃক বিবৃতি,
প্রভুকে দেখিয়া বলে চিনেছি তোমায়।
ফাঁকি দিয়া লুকাইয়া এসেছ হেথায়।।
শ্রীধাম উৎকলে আছ দারুব্রহ্ম মূর্তি।
তাহাতে তোমাতে এক পরমার্থ আর্তি।।
তুমি তিনি অভেদ আমরা নহে চিনি।
আদেশে জানা’লে প্রভু তাই মোরা জানি।।
এবং
পাণ্ডা কহে তুমি হও নন্দের নন্দন।
ত্রেতাযুগে করেছিলে রাবণ নিধন।।
এবে ওঢ়াকাঁদি এসে পাতকী তরা’লে।
জগন্নাথ আবেশেতে জনম লভিলে।।
কৃষ্ণ আবেশেতে প্রভু কৈল গোষ্ঠলীলে।
শ্রীগৌরাঙ্গ আবেশেতে হরিনাম দিলে।।
তিন শক্তি আবির্ভূত এক দেহ ধরি।
করিলে মানুষ লীলা মধুর মাধুরী।।
দীননাথ দাস প্রসঙ্গে সারী শুক কথা পরিচ্ছদে শুকসারী পাখি সম্পর্কে হরিঠাকুরের উক্তি,
প্রভু বলে এ রস কৌতুক বুঝিবি কি।
ব্রজ রস পাত্র এ ব্রজের শুকপাখী।।
ব্রজে ছিল সারী শুক শালিক হ’য়েছে।
পূর্বের সাহসে মোর উরুতে বসেছে।।
এ ভাবে বসিবে কেন, না থাকিলে চেনা।
জনমে জনমে থাকে নয়নে নিশানা।।
তমালের ডালে ছিল কোকিলার মেলা।
সারী-শুক বকুলের ডালে করে খেলা।।
বৃন্দাবনে দেখিয়াছি এই সব লীলা।
এই সেই বৃন্দাবন তমালের তলা।।
গোকুলে জন্মিল কৃষ্ণ নন্দঘোষ ঘরে।
বৃন্দাবনে বাস করিলেন গিয়া পরে।।
মায়াপুরী জন্মে হরি শ্রীগৌরাঙ্গরূপে।
লীলা করে গুপ্ত বৃন্দাবন নবদ্বীপে।।
বুঝিয়া দেখিলে এই সেই সেই ভাব।
সফলাডাঙ্গায় ওঢ়াকাঁদি লীলা সব।।
রাম ভরতের পুনরাগমন খণ্ডে বলা হল,
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ হন অবনীতে।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ সাহা শূদ্র সাধু নর।
ছত্রিশ বর্ণের লোক হ’ল একত্তর।।
দ্বিজ নমঃশূদ্র ছিল অকর্মে পতিত।
পতিত পাবন তার করিবারে হিত।।
পঞ্চ অংশে বঙ্গদেশে শেষ লীলা জন্য।
হরিচাঁদ নাম ল’য়ে হ’ল অবতীর্ণ।।
ভগবান শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ উপাখ্যান অধ্যায়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরের পূর্ব জন্মের কথা বলা হয়েছে,
এ সময় আচম্বিতে শব্দ এক হয়।
শূন্য হ’তে শুনা গেল দৈববাণী প্রায়।।
বলিলেন তোরা সবে ইষ্টজ্ঞানে সেব।
হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদ মহাদেব।।
আমি ধারাবাহিকভাবে শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতের আলোকে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অবতারতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করলাম। হতে পারে আমার বুঝার ভুল বা জ্ঞানের অভাব। তাই হয়ত লীলামৃত যা বলতে চেয়েছে বা বোঝাতে চেয়েছে তা বুঝতে পারি নাই।
মতুয়া ও অন্যান্যদের অনেকেই হরিঠাকুরকে অবতার হিসেবে মান্য করেন না। কাউকে আমি মান্য করতে বলছি না। যেটা সত্য তা একদিন প্রকাশিত হবে। তবে হরিঠাকুরকে জানুন, এই আমার নিবেদন।
হরিঠাকুরকে অবতার হিসেবে মানুন আর মহাপুরুষ হিসেবে মানুন তাতে কোন ক্ষতি নেই। তিনি যে তত্ত্ব বা জ্ঞান দিয়ে গেছেন, তাকে ধারণ করুণ হৃদয়ে এবং সেই মতানুযায়ী কাজ করুণ।
শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর যে শিক্ষা ও কর্মের পথ দেখিয়েছেন, সেই পথে চলুন। শিকড়কে অস্বীকার করে কারো উন্নতি করা বা হওয়া সম্ভব না।
এই অধপতিত জাতির উন্নতি কল্পে হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর যা করেছেন, তা পূর্বের কোন মহাপুরুষ করতে পারেন নাই। তিনি আমাদের ধর্মের অধিকার দিয়েছেন, কর্মের অধিকার দিয়েছেন, সর্বোপরি মানুষের অধিকার দিয়েছেন।
হরি ঠাকুর সকলের মঙ্গল করুণ। হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল।