মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

মহা-মহাপ্রভুর ষষ্ঠ আজ্ঞাঃ (গদ্য)

মহা-মহাপ্রভুর ষষ্ঠ আজ্ঞাঃ

ষড়রিপুর নিকট হতে সাবধান থাকিবে।

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, ও মাৎসর্য - এই ছয়কে শাস্ত্রকারেরা ষড়রিপু বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন।

ক) কামের ক্রিয়া কি?
এই স্থলে কাম শব্দে নারী পুরুষের কায়িক সুখ সম্ভোগ। ইহাতে কি হয়? পিতৃধনের হানি হয়। পিতৃধনের হানি না হইলে যে বংশ রক্ষা হয় না। বংশ রক্ষা হইবে না কেন? নিয়মিত ঋতু রক্ষা কর, পশুর ন্যায় প্রাত্যহিক কায়িক সুখ সম্ভোগ করিও না। একমাত্র পুত্র দ্বারা বংশ রক্ষা হইতে পারে, পিণ্ডদান হইতে পারে। ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া মাত্র ঋতুযোগে নারীসঙ্গ করিলে সে পুত্র দীর্ঘায়ু এবং সর্বগুণ সম্পন্ন হইবে, নচেৎ পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ হেতু নারীসঙ্গ করিলে অকাল মৃত্যু, অকাল বার্ধক্য, অকাল কেশ পক্কতা এবং মস্তিষ্ক মজ্জা শুন্য হইয়া মেধা শক্তি হ্রাস পায়। সুতরাং মনুষ্যত্ব থাকিবে না। কাম ক্রিয়া দ্বারা ব্যাভিচার দোষ সংগঠিত হয়। ব্যাভিচার শুধু যে পরদারমূলক তাহা হে নিজ স্ত্রীতে অনিয়মিতরূপে (ঋতু রক্ষা ভিন্ন) গমনে কায়িক সুখ সম্ভোগ করা, তাহাও ব্যাভিচারের মধ্যে পরিগণিত। দম্পতির পরস্পর সম্পর্ক কি? স্ত্রীর পক্ষে স্বামী শুধু কি ভোগ বিলাসের জন্য তাহা নহে, ইনি প্রাণের উপাস্য দেবতা। সেবিকা দাসী হইয়া নিত্যই স্বামীর চরণ পূজা করিতে হয়। পাদোদক সেবন করিতে হয়। তাহা হইলে প্রসুত স্বাস্থ্যবান, রূপবান, গুণবান ও ধার্মিক হয়। ইহার ব্যতিক্রম করিলে সে নারী ব্যাভিচারিনী না হইলেও ধর্মপত্নী নহে। স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর কথা কি? স্ত্রী অর্থাৎ ত্রাণকর্ত্রী (স্ত্রৈ-ড) যিনি সর্বতোভাবে ত্রাণ করে। স্ত্রী কি শুধু কায়িক সুখোপভোগ্যা সোনার পুতুল? স্ত্রী কি শুধু বিলাসময়ী প্রেমরত্ন খনি? স্ত্রী কি শুধু ক্ষণিক সুখপ্রদা খেলার জিনিস? তাহা নহে। সাক্ষ্য- দেবাদিদেব-মহাদেব। তিনি সজ্ঞানে শ্রীশ্রী কালিকা মহাদেবীর শ্রীচরণ বক্ষে ধারণ করিয়াছেন। শাস্ত্রীর প্রমাণ স্ত্রী অন্নদান কালে অন্নদা। যখন স্নেহকর্ত্রী তখন মাতৃসমা। যখন রঙ্গিনী তখন সখীসমা। সুতরাং স্ত্রী অসামান্যা। তবে এক কথা ঋতু অরক্ষণ মহাপাপ। কারণ ঋতুরক্ষা না করিলে একটি জীবহত্যা সম পাপ হয়। সুতরাং কায়িক সুখের আশা পরিত্যাগ পূর্বক ঈশ্বরে আত্মদান করতঃ প্রার্থনা করিতে হইবে। হে ঈশ্বর! আমি তোমার আইন লঙ্ঘন পাপ ভয় প্রযুক্ত, তোমার ইচ্ছা পালনে প্রবৃত্ত হইলাম। অন্তরে এইরূপ ভয় রাখিয়া বংশরক্ষা কর; তখন নারীকে রমণী জ্ঞান করিতে হইবে। কেহ এই মহাবাক্যের অবমাননা করিলে সে পুরুষ হইলেও স্ত্রৈণ এবং মেয়ে হইলে সে কামুকা। পিতৃধন ব্যয়িত না হইয়া অক্ষয়রূপে থাকিলে মস্তকে পূর্ণচন্দ্র ন্যস্ত হয়, অমরত্ব লাভ হয়। স্বাক্ষী ত্রৈলঙ্গ স্বামী, প্রবাদ আছে মানব শরীরে তিনশ বৎসর জীবিত ছিলেন।

শ্রীশ্রীধাম ওড়াকান্দির ভক্ত বাবাজী কমলদাস বৈরাগী, রামভরত মিশ্র, বিশ্বনাথ দরবেশ, হীরামন পাগল, অক্ষয়কুমার চক্রবর্তী, ইহারা অমরত্ব লাভ করিয়াছেন এবং চির সাধনে নিরুদিষ্ট আছেন। অন্যের সাক্ষ্য যদি বিশ্বাস না হয়, নিজে পরীক্ষা দাও। নারী স্পর্শ না করিয়া ছয়মাস মাত্র দেহে বাঁধ দাও। আপনা আপনি সাক্ষী পাইবা, শরীরে এক অপূর্ব জোয়ার ফিরিবে, দৈহিক কাম তিরোহিত হইয়া গুরুকাম বা নিস্কাম আসিবে। যাঁহার ছেলেমেয়ে বাঁচে না, তিনি পূর্ণ অষ্টাদশ মাস ব্রহ্মচর্য পালন করুণ, দেখিবেন তাহার ঘরে রূপবান, গুণবান, ধার্মিক এবং দীর্ঘায়ু সন্তান জন্মিবে। "সাধু সাবধান" মহোৎসবের সময় কেন বলে, এই ষড়রিপুর নিকট সাবধান থাকিতে বলে। মহাপাপ মাতৃহত্যা, নারীহত্যা, ভ্রুণ হত্যা প্রভৃতি কামক্রিয়া দ্বারা সংগঠিত হয়। যদি বল কাম কি নিবারণ করা যায়? অবশ্য করা যায়। সাধুসঙ্গ কর, নাম সংকীর্তন কর, ভাগবত আলোচনা কর, হরিনাম কীর্তন সিংহের গর্জনে ষড়রিপু ছাগ, মেষ, কুকুর প্রভৃতি কোথায় পালাইবে খুঁজিয়া পাইবে না। শুষ্ক কাষ্ঠে যেমন রসের বিন্দুমাত্র থাকে না। মরচা হইয়া যায়, যদি তাহা কোন জলাশয়ে নিমজ্জিত করা যায়, কালে কালে তাহা রসেতে এমন জর জর হয় যে স্পর্শ মাত্র গলিয়া খসিয়া হস্তচ্যুত হইয়া পড়িয়া যায়। কীর্তন মহাসাগরে প্লাবিত হও, তুমিও তাহাই হইবে। চব্বিশ ঘন্টা অর্থাৎ অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন পরায়ণ হও, আত্মা হইতে আপনাআপনি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাইবা।

খ) ক্রোধঃ-
ক্রোধ কাহাকে বলে? ক্রোধ অর্থ রাগ। ক্রোধের পরিণাম কি? বিপদোৎপত্তি। ক্রোধ দ্বারা বিপদ হইতে পারে। ক্রোধ দ্বারা সোনার রাজ্য শ্মশানে পরিণত হইতে পারে। ক্রোধ দ্বারা কারাবাস অবশ্যম্ভাবী। ক্রোধ যাহাকে আক্রমণ করে তাহার গুরুভক্তি তিরোহিত হয়। ক্রোধ হইলে অন্যকে কি আপন লোককে কটুবাক্য সহজেই বলা যায়। ক্রোধ আপনাকে পর করিতে পারে, ক্রোধী ব্যক্তির শত্রুর অভাব নাই। ক্রোধী ব্যক্তি আপনি আপনার শত্রু। ক্রোধ হইলে সদ্ জ্ঞান থাকে না। অতএব ক্রোধের বশবর্তী না হইয়া সতত সাবধান থাকিবে।

গ) লোভঃ- 
লোভ কাহাকে বলে? পরধন হস্তগত করিবার ইচ্ছাকে লোভ বলে। পাপের আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ করাই লোভের কার্য, লোকে বলে, "লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু"। লোভে নরহত্যা, পরদার, পরহিংসা, পরধন হরণ, পরনিন্দা প্রভৃতি মহাপাপের প্রশ্রয় দেয়া হয়। লোভে অসাধ্য সাধন প্রয়াসে লোকের মৃত্যু পর্যন্ত হইতে পারে। লোভে জ্ঞান চক্ষু নষ্ট হয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় অকর্মণ্য হয়। অতএব লোভ করিও না। পরদ্রব্য অন্যায়ভাবে গোপনে হস্তগত করা বা বলপূর্বক পরধন আয়ত্ব করা- ইহাই চুরি।

অতএব সর্বতোভাবে লোভ পরিহার্য। লোভ গুরুবৃত্তি হরণ করে, সাক্ষী উমাজুড়ি নিবাসী মন্দির বৈরাগী। শ্রীশ্রীধাম ওড়াকান্দির মত গ্রহণ করিয়া সকলের দাস হইয়া চরণ বন্দনা করতঃ প্রভুর দয়ায় কালে কালে ঠাকুর উপাধী পাইল। শ্রীধাম ওড়াকান্দির মানসিক প্রভুকে না দিয়া নিজেই উপভোগ করিতে আরম্ভ করিল, নিজে বারুণী মিলাইল, বহুতর ভক্ত হইল। প্রভুকে অমান্য করিয়া কিছুদিন পরে, বিষ ভক্ষণের ফলে দেহ ব্যাধিযুক্ত হইল। পরে অচল হইয়া ব্যাধির যন্ত্রনায় একশেষ হইল। অভক্ষ ভক্ষণ করিয়া কালের কবলে কবলিত হইল, সোনার সংসার ছারখার হইল। স্ত্রী কন্যা ক্রমে ক্রমে অন্যের সংসারে গিয়া তাহাদের ঘর করিতে আরম্ভ করিল। অতএব লোভ প্রযত্নে পরিহার্য।

ঘ) মোহঃ- 
আত্ম বিস্মৃত হইয়া কোন বিষয়ে মনোনিবেশ করাকে মোহ বলে। মোহ অর্থে মুর্চ্ছা। মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ। এই মোহ দ্বারা সাধু লোকের সততা নষ্ট হয়, মোহ কর্তৃক লোকের হিতাহিত জ্ঞান তিরোহিত হয়। মদ্যপান, গাঁজা, ভাঙ্গ, চরস, আফিম প্রভৃতি মাদকদ্রব্য সেবন, পাশা খেলা, তাস খেলা, দাবা খেলা, জুয়া খেলা, সলই খেলা, পরনারী, পরবশ হওয়া, এইসব দুষ্কার্য মোহের পরিণাম। মোহ অজ্ঞানান্ধ। জীবিত অথচ মরণ অধিক। প্রমাণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় মুগ্ধ হইয়া পতিপ্রাণা নারী দ্রৌপদীকে পণ ধরিয়া হারিয়া ছিলেন। অতএব মোহ সতত পরিহার্য।

ঙ) মদঃ-
মদ অর্থে অহঙ্কার, আত্মগৌরব। অর্থাৎ আমি বড়, আমি ভাল, আমার কার্য ভাল, আমার সবই ভাল- ইহাকে মদ বা আত্মশ্লাঘা বলে। অহম্ অর্থ আমি, কার অর্থ শব্দ। অহঙ্কার অর্থ আমি শব্দ, আমিত্ব থাকিতে তাহাতে অর্থাৎ ঈশ্বরে মনোনিবেশ করা যায় না। মদের দ্বারা সৎসঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে হয়, মদের দ্বারা জগতের বিরক্তি ভাজন হইতে হয়। মদ্যপ ব্যক্তিকে কেহই ভালবাসে না। মত্ততা-তম গুণের আধার। মদ শব্দের সাধারণ অর্থ সুরা, যাহা পান করিলে আত্মস্মৃতি রহিত হয়। মদের অনুসঙ্গ কার্য অতি ঘৃণার্হ। মদগর্বিত ব্যক্তি কর্মে জলাঞ্জলি দিয়া থাকে। শত প্রবোধ দাও, তাহা ফিরিবার নয়।

চ) মাৎসর্যঃ-
পরশ্রীকাতরতাকেই মাৎসর্য বলে। প্রতিবেশীর প্রচুর ধন আছে, আমার নাই, যাহাতে উহার ধন না থাকে, দরিদ্র হয় তাহা করিব- ইহাকে মাৎসর্য বলে। মাৎসর্যের পরিণাম যে অনন্ত নরক সে জ্ঞান থাকে না। মাৎসর্য দ্বারা চুরি, ডাকাতি, পরদার, হিংসা, নিন্দা সকল হইতে পারে। কেন, এত কেন, জগতে ত ধনের কমি নাই। প্রতিবেশীর লক্ষ টাকা আছে, তুমি সংসার কুড়াইয়া কোটিপতি হও। ওর ধনের প্রতি তোমার হিংসা কেন? যাহাতে প্রতিবেশীর দুই পয়সা আয় হইবে তুমি তাহাতে বাধা দাও কেন? নিজে ভাল হও, তোমার ভাল হইবে।

এই ষড়রিপু এক শৃঙ্খলাবদ্ধ। ইহাদিগকে দমন করিতে চেষ্টা কর, ইহার একটি দমন হইলে সবই নিবারিত হইতে পারে। সাধুসঙ্গ করে, অসম্ভব কিছুই নয়।

প্রভুর উপদেশ- তুমি মাত্র অকারণে মুখের হাসিটি নিবারণ কর। কট করে আমি হাসিব না। দেখিবা হাস্যহীন হইলে মুখ মলিন হইবে, তোমাকে দেখা যাইবে যেন প্রাণের কোন জিনিস হারাইয়াছ। মুখ মলিন হইলে যিনি তোমাকে দেখিবেন তাহার প্রাণে দয়ার সঞ্চার হইবে। এই সঙ্গে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য সবই হীনবীর্য ও মলিন হইবে। একটি দিন হাসি ত্যাগ কর, আপনাআপনি সাক্ষ্য পাইবা।


 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free