১ম অংশ
শ্রীশ্রী অশ্বিনী চরিত্র সুধা
শীমৎ বিনোদ গোস্বামী
মাতা পিতার বন্দনা
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম সর্ব শাস্ত্রে কয়।
ভাবিয়া পিতার পদ রাখিনু মাথায়।।
যাহার কৃপায় আমি এ জগতে আসি।
তাহার শরণে পাপ খণ্ডে রাশি রাশি।।
না বুঝিয়া কত পাপ করেছি চরণে।
এ পাপের নাহি ক্ষমা সে চরণ বিনে।।
কত কষ্টে পিতা মোর করেছে পালন।
পিতৃঋণ শোধ দিতে পারে কোন জন।।
পিতা যে পরম বস্তু সাধনের ধন।
পূজিলি না সে চরণ ওরে মূঢ় মন।।
মায়াজালে হয়ে বন্দি সে সব ভুলিলি।
ঘরেতে রাখিয়া ধর বাহিরে খুঁজিলি।।
যখনে ছিলিরে মন পিতৃ মণিপুরে।
তথা হতে আইলিরে জননী জঠরে।।
দশ মাস দশ দিন ছিলি মাতৃগর্ভে।
মাতা মোর কত কষ্ট করে কত ভাবে।।
অসহ্য যাতনা মাতা সহে হাস্য মুখে।
আশাতে বাধিয়া বুক সদা থাকে সুখে।।
দশ মাস দশ দিন যখনে হইল।
প্রসব করিতে মাতা কত কষ্ট পেল।।
তারপর কতভাবে করেছে পালন।
স্তন দুগ্ধ দিয়ে মোরে বাঁচায় জীবন।।
তবু মাতা দিন রাত প্রফুল্ল অন্তরে।
স্নেহভরে কোলে করে কত যত্ন করে।।
নিজে না খাইয়া মাতা খাওয়ায়েছে মোরে।
মল মূত্র ধোয়ায়েছে ঘৃণা নাহি করে।।
এত কষ্ট করে মাতা তবু হাসি মুখে।
পুত্রের বদন হেরি পাসরিল দুখে।।
মা শব্দের তুল্য দিতে আর কিছু নাই।
ঐ চরণে গয়া গঙ্গা সব কিছু পাই।।
এ হেন মায়ের পদ ভাবিয়া অন্তরে।
লিখিলাম এই পুথি মা বাপের বরে।।
মাতা পিতার চরণে করিলাম স্তুতি।
পাপ দেহে যেন মোর জাগয়ে ভকতি।।
তাই বলি ওরে মন বেলা ডুবে গেল।
কান্দিয়া বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
হরিচাঁদ বন্দনা
নম নম হরিচান্দ পতিত পাবন।
তব শ্রীচরণে মোর থাকে যেন মন।।
সাধনা না জানি প্রভু ভজন না জানি।
নিজ গুণে দাও তব চরণ দু’খানি।।
তুমি হরি গুণনিধি জগতের সার।
এ ভব সাগর হতে কর মোরে পার।।
তোমার গুণের সীমা বর্ণিতে কি পারি।
গুণের অতীত তুমি দয়াল শ্রীহরি।।
তোমার ইশারাতে এ জগত চলে।
তোমার মায়াতে প্রভু এ জগত ভোলে।।
সত্য যুগে ছিলে তুমি নাম রূপ ধরি।
ত্রেতা যুগে রাম রূপে জন্মিলেন হরি।।
দ্বাপর যুগেতে প্রভু কৃষ্ণ অবতার।
কলিতে গৌরাঙ্গ রূপে হইল প্রচার।।
তারপর ওড়াকান্দি হলে অবতার।
ঐ চরণে কোটি কোটি করি নমস্কার।।
নম নম শান্তি মাতা জগত জননী।
হরিচান্দ প্রাণ প্রিয়া লোচন নন্দিনী।।
চরণ যুগলে মাগো করি নিবেদন।
দয়া করে অধমেরে দাও শ্রীচরণ।।
নম নম গুরুচাঁদ শ্রীহরি নন্দন।
করজোড়ে বন্দি তব যুগল চরণ।।
হরিনাম প্রচারিতে হইলে প্রকাশ।
অধমেরে করপ্রভু শ্রীচরণে দাস।।
নমঃ নমঃ যশমন্ত ঠাকুরের পিতা।
নমঃ নমঃ অন্নপূন্না ঠাকুরের মাতা।।
নমঃ নমঃ কৃষ্ণদাস প্রভু জ্যেষ্ঠ ভাই।
চরণেতে কোটি কোটি প্রণাম জানাই।।
নমঃ শ্রী বৈষ্ণব দাস অংশ অবতার।
নমঃ নমঃ গৌরি দাস সহিমা অপার।।
নমঃ শ্রী স্বরূপ দাস সবার একনিষ্ঠ।
ঠাকুর চরণে যার ভক্তি একনিষ্ঠ।।
নমঃ নমঃ শ্রীসুধন্য ধীর অবতার।
নমঃ নমঃ শ্রীপতিচান্দ তাহার কোঙর।।
নমঃ শ্রী প্রমথচান্দ তুমি গুণমণি।
নমঃ নমঃ বীণাপাণি মাতা ঠাকুরানী।।
নমঃ নমঃ মঞ্জুলীকা মাতা ঠাকুরাণী।
করপুটে বন্দি আমি চরণ দু’খানি।।
নমঃ নমঃ অংশু পতি নমঃ শচিপতি।
নম শ্রীহিমাংশু পতি পদে করি স্তুতি।।
ঠাকুর হইতে এল ঠাকুরের অংশ।
করজোড়ে বন্দি আমি ঠাকুরর বংশ।।
অধম বিনোদ বলে দিতে নারি সীমা।
কৃপা করে অধমেরে করে দিও ক্ষমা।।
ভক্তগণ বন্দনা
নম নম হীরামন ভক্ত চুড়ামনী।
নিজগুণে দাও তব চরণ দুখানী।।
নম শ্রীগোলকচন্দ্র পাগল গোঁসাই।
চরণেতে কোটি কোটি প্রণাম জানাই।
নম নম শ্রীলোচন বড় দয়াময়।
দয়া করে অধমেরে রাখ রাঙ্গা পায়।।
নম নম মৃত্যুঞ্জয় সাধু শিরমণি।
নম নম মহানন্দ প্রেম রসখনি।।
নম শ্রীতারক চন্দ্র কবি চূড়ামণি।
দন্তে তৃণ ধরি বন্দী চরণ দু’খানি।।
তোমার কৃপাতে পাই অমূল্য রতন।
লীলামৃত গ্রন্থখানি সুধার মতন।।
নমঃ নমঃ দশরথ পদ্মবিলাবাসী।
ঠাকুরের নামে প্রেমে হইল উদাসী।।
নমঃ নমঃ শ্রী অশ্বিনী প্রেমের মুরতী।
যাহার কৃপাতে পাই হরিচাঁদ গীতি।।
নমঃ নমঃ হরিপাল মহিমা প্রচুর।
গহন বাদার মধ্যে দেখিল ঠাকুর।।
নম শ্রীগোপাল সাধু কি মধু পাইয়া।
দক্ষিণ দেশে মাতাল হরিনাম দিয়া।।
নম নাটু নম ব্রজ নম বিশ্বনাথ।
দিবা নিশি থাকিতেন ঠাকুরের সাথ।।
উদ্দেশ্য বন্দিনু আমি যত ভক্তগণে।
অগণিত ভক্তবৃন্দ আছে যে খানে।।
অধম বিনোদ বলে ভক্তগণে বলি।
কৃপা করে অধমেরে দিও পদধূলি।।
জন্ম কথা
গঙ্গাচর্ণা বাস করে রাজচন্দ্র নাম।
পোদ্দার বংশেতে জন্ম অতি গুণধাম।।
সরল স্বভাব নিয়া করিত বসত।
তার হল তিন পুত্র সকলেই সৎ।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিল তার শ্রীকার্তিক নাম।
মধ্যম গনেশ চন্দ্র কনিষ্ঠ শ্রীদাম।।
কার্তিকের সদা ছিল বৈষ্ণব আচার।
বৈরাগী উপাধী পরে হইল তাহার।।
মাসে মাসে করাইত বৈজ্ঞব ভোজন।
তার বাড়ী আসে কত সাধু মহাজন।।
হরিচান্দ ঠাকুরের মতুয়ার দল।
সেই গ্রামে আসে কত বলে হরি বল।।
একদিন শ্রীগোলোক আসিল তথায়।
মতুয়ার গণ লয়ে হরি গুণ গায়।।
পাগলের ভাব দেখে কার্তিক বৈরাগী।
পাগলের পদে পড়ে হল অনুরাগী।।
সেই হতে গুরু বলে করিল স্বীকার।
মন প্রাণ সপে দিয়ে হল নির্বিকার।।
রাই চরণ অক্রুর মদন মোহন।
গোস্বামী চরণে করে আত্ম সমর্পন।।
গঙ্গাচর্ণা গ্রামবাসী করে কত লোক।
পাগলেরে পেয়ে সবে হইল পুলক।।
সেই হতে গোস্বামীজী করে যাতায়াত।
ভক্তবৃন্দ থাকে কত পাগলের সাত।।
কার্তিক বৈরাগী যবে বিবাহ করিল।
ক্রমে ক্রমে নয় বর্ষ গত হয়ে গেল।।
অম্বিকা নামেতে হয় কার্তিকের নারী।
পুত্র কন্যা না জন্মিল মনে দুঃখ ভারী।।
পাগলেরে কাছে সবে জানাইয়া তাই।
কোন কিছু বলে নাক পাগল গোঁসাই।।
একদিন দৈব যোগে কার্তিকের ঘরে।
মতুয়ারগণ লয়ে হরি নাম করে।।
মহাভাব উথলিল প্রেমের তরঙ্গ।
কান্দিতে কান্দিতে সেই কার্তিকের নারী।।
পাগলের পদে পড়ে যায় গড়াগড়ি।
অমনি পাগল চন্দ্র ধরিয়া তুলিল।
মা মা বলিয়া পাগল ডাকতে লাগিল।।
মা মা বলিয়া পাগল স্তন পান করে।
বলে মাগো ছেলে হবে তোমার উদরে।।
হরিভক্ত হবে সে যে বলিলাম বাণী।
নাম করণেতে নাম রাখিস অশ্বিনী।।
পাগলের বরে মাতা গর্ভিণী হইল।
দশ মাস দশ দিনে প্রসব করিল।।
বার শত চুরাআশি সালে বুধবার।
কার্তিক মাসেতে জন্ম হইল তাহার।।
ব্রহ্ম মুহুর্তের কালে পূর্ণিমা যে তিথি।
পুত্র কোলে পেয়ে মাতা আনন্দিত অতি।।
আশে পাশে যত লোক শুনিতে পাইল।
হরি বলে সবে মিলে দেখিতে আসিল।।
উলুধ্বনি জয়ধ্বনি করে সবে মিলে।
দেশবাসী সকলেই হরি হরি বলে।।
অশ্বিনীর জন্ম ক্ষণ হেন জ্ঞান হয়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
অশ্বিনীর জন্ম কথা শুনে যেই জন।
ভক্তির উদয় হবে শুদ্ধ হবে মন।।
এদিন বিনোদ বলে পাচালীর ছন্দে।
হরিচান্দ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব আর কিবা চাও।
অশ্বিনীর প্রীতে সবে হরিগুণ গাও।।
বাল্য জীবন
গোলক চাঁদের বরে রত্ন জনমিল।
দিনে দিনে মাতৃকোলে বাড়িতে লাগিল।।
অশ্বিনীর মাতা পিতা আনন্দ হৃদয়।
মহারত্ম কোলে করি হরিগুণ গায়।।
কার্তিকের পুত্র দেখে আনন্দ হৃদয়।
পাগলের গুণগান গাহিয়া বেড়ায়।।
মাতৃ স্নেহে আশ্বিনী বাড়িতে লাগিল।
বিধাতার বিধি যাহা কে খণ্ডাবে বল।।
দুই বর্ষ ছয়মাস বয়স যখন।
তার মাতা পরলোকে করিল গমন।।
শিশুবেলা যার মাতা পরলোকে যায়।
তার দুঃখ সারে নাকো লোকে তাই কয়।।
মাতৃহারা শিশু সদা কান্দিয়া বেড়ায়।
তার পিতা কোলে করি করে হায় হায়।।
অশ্বিনীর পিসি মাতা দেখিয়া এ দৃশ্য।
তাহাকে পালিল শেষে মনে হয়ে হর্ষ।।
পিসিমার যত্ন পেয়ে বাড়িতে লাগিল।
তার পর সে কার্ত্তিক বিবাহ করিল।।
অশ্বিনীর বিমাতা সে নাম স্বরুপিনী।
প্রাণ দিয়ে অশ্বিনীকে ভালবাসে তিনি।।
মা মা বলিয়া যখন ডাকিত অশ্বিনী।
ছুটে এসে কোলে নিত হয়ে পাগলিনী।।
বাৎসল্যতে ভরপুর তাহার হৃদয়।
পাড়া প্রতিবেশী সবে মানিল বিস্ময়।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
ক্রমে ক্রমে পঞ্চবর্ষ বয়স হইল।।
একদিন তার পিতা বাড়িতে না ছিল।
পিসিমাতা বিমাতাও কার্যান্তরে গেল।।
একা একা বসে আছে ঘরের ভিতর।
মা বলিয়া কেন্দে ওঠে তাহার অন্তর।।
জলে ভরা আখি দু’টি হাটিতে হাটিতে।
উদয় হইল গিয়ে সে বেলে ঘাটেতে।।
মা মা বলিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।
কান্না শুনে গঙ্গা দেবী ভাসিয়া উঠিল।।
মাতৃ মূর্তি ধরি দেবী পুত্র নিল কোলে।
হরিভক্ত কোলে করি ভাসে আখি জলে।।
শোন তবে ওরে পুত্র তোরে আমি বলি।
তোর মুখে ভাল শুনি হরিনাম বুলি।।
মায়ের কথার বাণী শুনিয়া অশ্বিনী।
প্রাণ ভরে হরিনাম করেন তখনি।।
হরিভক্ত মুখে শুনি হরিনাম ধ্বনি।
নয়ন জলেতে ভাসে মাতা সুরোধনী।।
অলক্ষেতে বসে আছে ভক্ত কোলে করি।
হরিনাম শুনিতেছে সারা দিন ভরি।।
এদিকেতে বাড়ী শুদ্ধ খুঁজিতে লাগিল।
অশ্বিনীকে নাহি পেয়ে প্রাণ উড়ে গেল।।
অশ্বিনীর পিসিমা সে কান্দিয়া ভাসায়।
বিমাতা সে কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়।।
গ্রামবাসী এসে সবে করে হায় হায়।
জলে পড়ে গেছে নাকি মনে এন লয়।।
তাই ভেবে সবে মিলে খুঁজিতে লাগিল।
খাল নাল বিল আর পুকুর খুঁজিল।।
কোথাও না পেয়ে সবে করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
বেলে ঘাট হতে সে হইল উদয়।।
দেখে তার পিসি মাতা কোলেতে করিল।
কোথা ছিলি সোনা মোর কহিতে লাগিল।।
মাতৃহারা শিশু তুই মানিক রতন।
তোরে না দেখিলে বাপ বাঁচে না জীবন।।
বল তুই কোথা ছিলি সত্য করি বল।
আমাদের কাছে তুই না করিস ছল।।
তাই শুনি অশ্বিনী লাগিল বলিতে।
এতক্ষণ ছিনু আমি মায়ের কোলেতে।।
কোলে করে মাতা মোর কহিলেন বাণী।
কোলে বসে হরিনাম কর জাদুমণি।।
মা’র কোলে বসে আমি হরিগুণ গাই।
হরিনাম শুনে মাতা কেন্দে ছাড়ে হাই।।
তোমাদের কথা যেই পড়িল মনেতে।
ছুটিয়া এসেছি আমি মা’র কোল হতে।।
শিশু মুখে এই কথা যখন শুনিল।
নয়নের জলে সবে ভাসিতে লাগিল।।
আশ্চর্য ঘটনা সবে করিয়া শ্রবণ।
বিস্ময় মানিয়া তাই ভাবে মনে মন।।
কেহ বলে এ ছেলের ভাগ্যে কিবা আছে।
মৃত আত্মা এসে তাই হরণ করেছে।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ কলিতে লাগিল।
হেনকালে শ্রীকার্তিক কাড়িতে আসিল।।
শুনিয়া সকল কথা মানিল বিস্ময়।
পুত্র কোলে করে তিনি মুখ চুমু দেয়।।
পাগলের বরে এই পুত্র জনমিল।
তবে কেন এ ছেলের বিপদ ঘটিল।।
এর মাতা গিয়াছেন বৈকুন্ঠ ভুবন।
সে কেন করিবে কোলে অপূর্ব কথন।।
মনে হয় ছদ্মবেশে মাতা সুরধনী।
রত্নকে পাইয়া কোলে করেছেন তিনি।।
রত্নকে করিও যত্ন সবারে জানাই।
যারে আনিছে ভবে গোলোক গোঁসাই।।
এর ভবে কোনদিন বিপদ না হবে।
পাগলে আসিয়া তথা রক্ষা সে করিবে।।
এই কথা শুনে সবে সান্তনা পাইল।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।।
তারপরে অশ্বিনীকে পাঠশালে দেয়।
লেখাপড়া করে আর হরিগুণ গায়।।
পাঠশালা শেষ করে আসিলেন বাড়ী।
মা বাপের দুঃখ দেখে লেখা দিল ছাড়ি।।
নিজেদের গরু গুলি মাঠেতে চরায়।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরিগুণ গায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
সংসারের অনটন ক্রমেই বাড়িল।।
একাদশ বর্ষ যবে হইল তাহার।
তার পিতা মনে ভাবে কি করি এবার।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
ধনধান্যে পরিপূর্ণ কত মান্য তার।
তার বাড়ী অশ্বিনীকে বেতন করিয়া।
বন্দোবস্ত করে তারে দিল পাঠাইয়া।।
প্রতি মাসে এক টাকা বন্দবস্ত হল।
গরু রাখিবারে রত্ন সেই বাড়ী গেল।।
এইভাবে সেই বাড়ী গরু চরাইত।
পরের ফসল কভু গরুতে না খেত।।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরিগুণ গায়।
চারিদিকে হতে গরু আসিত তথায়।।
অশ্বিনীকে চটে আর মুখ পানে চায়।
ভাষাহীন পশুজাতি কি যেন কি কয়।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
হস্ত বুলাইয়া গায় স্বান্তনা করিত।।
শুন শুন ওহে গরু আমার বচন।
পরের ফসল কভু খেওনা কখন।।
তাই শুনি গরু গুলি চরিয়া বেড়াত।
পরের ফসলে কভু নাহি মুখ দিত।।
তাই দেখে রাখালেরা আসিত তথায়।
অশ্বিনীকে ডেকে যেতে কহিত সবায়।।
কহ ভাই কার কাছে এ মন্ত্র শিখিলে।
গরুতে না মুখ দেয় পরের ফসলে।।
তাই শুনে তাহাদের বলিত অশ্বিনী।
তন্ত্র মন্ত্র ওই সব আমি নাহি জানি।।
আমি শুধু হরিনাম করিয়া বেড়াই।
হরিনাম ছাড়া কভু মানি নারে ভাই।।
তাই শুনে রাখালেরা মানিত বিস্ময়।
অশ্বিনীকে ভাল তারা বাসিত সবাই।।
গরু লয়ে সন্ধ্যাবেলা গৃহেতে আসিত।
যার যেইখানে স্থান সেখানে দাঁড়াইত।।
দুগ্ধবতী গাভীগুলি দোহন করিত।
পূর্বের চাইতে দুধ অনেক হইত।।
তাই দেখে গৃহস্বামী সন্তষ্ট হইয়া।
অশ্বিনীকে কাছে নিয়ে কহিত কান্দিয়া।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
অবলা এই পশুজাতি কথা নাহি কয়।।
কোন গুণে এরা তোমা এত ভালবাসে।
তোমার কথায় এরা আখি জলে ভাসে।।
কহ বাছা এই ভাব বুঝিলে কেমনে।
মনে হয় পুর্বজন্মে এরা তোমা চেনে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী ভাবে মনে মনে।
মৌন হয়ে থাকে সদা ঝরে দুনয়েনে।।
তাই দেখে গ্রহস্বামী কিছু না বলিল।
ভোরবেলা সে অশ্বিনী বাড়ী চলে গেল।।
আর নাহি গেল সেই গৃহস্থের বাড়ী।
তার পিতা কহিলেন দু’টি হস্ত ধরি।।
কহ বাপ কি দুঃখেতে বাড়ী চলে এলে।
কথা নাহি কয় শুধু ভাসে আখি জলে।।
এই ভাবে বাল্যকাল হয়ে গেল সায়।
মহাভাবে মহারত্ন হরিগুণ গায়।।
এ দীন বিনোদ বলে পঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
হরি দর্শণ
হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত মহানন্দ নাম।
নারিকেলবাড়ী জন্ম ভক্ত গুণধাম।।
গৌরাঙ্গ লীলায় ছিল নামে নিত্যানন্দ।
এ লীলায় হইলেন নামে মহানন্দ।।
একদিন চলিলেন গঙ্গাচর্ণা গায়।
হরিভক্ত শিরোমণি মদনমোহন।।
তাহার বাড়ীতে গিয়ে করে সংকীর্ত্তন।
পাগোল আসিল সেথা শুনিল কার্ত্তিক।।
আনন্দেতে আত্মহারা হইল বিদিক।
জলে ভরা আখি দু’টি হাটিতে হাটিতে।।
ব্যস্ত হয়ে গেল তথা পাগলে আনিতে।
কাঁদিয়া ধরিল গিয়া পাগলের পায়।।
দয়া করে চল তুমি আমার আলয়।
পাগল চলেছে তুমি সুস্থ কর মন।।
সেবা করাইবে হেথা মদনমোহন।।
মদনের বাড়ী হল নাম সংকীর্ত্তন।
নামে প্রেমে মত্ত হল ভকতের গণ।।
মদনের ঘরে বসে ভোজন করিয়া।
কার্ত্তিকের বাড়ী এল ভক্তগণ নিয়া।।
কার্ত্তিকের বাড়ী যবে হইল উদয়।
পরিবার সহ এসে চরণ ধোয়ায়।।
উলুধ্বনি হরিধবনি করে সবে মিলে।
সবাকার অন্তরেতে আনন্দ উথলে।।
অশ্বিনী পড়িল এসে পাগলের পায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
কার্ত্তিক আসিয়া বলে পাগলের ঠাই।
শুন শুন ও পাগল তোমাকে জানাই।।
আজি হতে অশ্বিনীকে তোমার চরণে।
সমর্পন করিলাম মঙ্গল কারণে।।
আজ হতে অশ্বিনীর গুরু তুমি হও।
আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।।
তাই শুনি মহানন্দ আনন্দ হৃদয়।
অশ্বিনীকে হস্ত ধরে কোলেতে বসায়।।
হরিনাম মহামন্ত্র করিলেন দান।
সেই হতে গুরুপদে সপিলেন প্রাণ।।
মহানন্দ বলে শুন ওহে বাছাধন।
হরিচান্দ পদে যেন থাকে তব মন।।
হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি সর্বসার।
মন প্রাণ সপে দিয়ে হও নির্বিকার।।
গুরুবাক্য শুনি রত্ন প্রণাম করিল।
ভক্তগণে বলে সবে হরি হরি বল।।
সেই হতে মহানন্দ গুরুরূপে হয়।
গুরু সেবা করে রত্ন আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে ভক্তগণে করে সংকীর্ত্তন।
হরিনামে মাতোয়ারা ঝরে দু’নয়ন।।
এইভাবে সারাদিন হরিনাম হয়।
বাহ্যজ্ঞান হারা সবে হরিগুণ গয়।।
শতাধিক হরিভক্ত হইল গণনা।
মাত্র দুই সের চাউল হইল রান্না।।
কার্ত্তিক কাঁদিয়া বলে পাগলের ঠাই।
কেমনে হইবে সেবা বলহে গোঁসাই।।
তাই শুনি মহানন্দ দ্রুত গতি ধায়।
অন্ন পাত্র কাছে গিয়ে হইল সদয়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
অন্না পাত্রে হস্ত দিয়া কহিল তখন।।
এই অন্নে হয়ে যাবে নাহি কোন ভয়।
ভোজন করিল সবে আনন্দ হৃদয়।।
আশ্চর্য দেখিয়া সবে হরি হরি বলে।
কার্ত্তিক ঢলিয়া পড়ে ভক্ত পদতলে।।
তাহা দেখি মহানন্দ কার্ত্তিকে ধরিয়া।
কোলাকুলি করে শেষে প্রেমেতে মাতিয়া।।
হরিচাঁদ লীলা খেলা বড় চমৎকার।
হয় নাই হবে নাক এ বিশ্ব মাঝার।।
অল্প অন্ন অল্প ডাল ঠাকুর কৃপায়।
শতাধিক ভক্ত তাহা প্রাণ ভরি খায়।।
এহেন আশ্চর্য লীলা করি দরশন।
হরি বলে কাঁদে যত হরি ভক্তগণ।।
কার্ত্তিক অমনি সেথা গড়াগড়ি যায়।
পরিবারসহ এসে পড়িল ধরায়।।
কিছু পরে প্রেমনিধি হইলেন ক্ষান্ত।
হরি গুণগানে সেথা নিশি হল হস্ত।।
ভোরবেলা এল তথা শ্রীরাইচরণ।
পাগল চরণে এসে করে নিবেদন।।
আমার বাড়ীতে চল মতুয়ার সব।
এ দীনের গৃহে গিয়ে কর মহোৎসব।।
তাই শুনি মহানন্দ বাক্য দিল সায়।
ভক্তগণ লয়ে সেথা হইল উদয়।।
হরিনামে মাতোয়ারা মতুয়ার গণ।
প্রেমে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
অশ্বিনীকে ডেকে বলে সে রাইচরণ।
কদলির পত্র কেটে আন বাছাধন।।
তোমার উপর আমি দিলাম এ ভার।
কদলীর পাতা এনে দিও ত সত্ত্বর।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী করিল গমন।
কদলীর বনে গিয়ে দিল দরশন।।
মহাভাব উথলিল তাহার অন্তরে।
ছল ছল আখি দু’টি হরিনাম করে।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলিয়া কাঁদিল।
প্রকান্ড শার্দুল এক তথায় আসিল।।
শার্দুলের গলা ধরি হরি হরি বলে।
ভক্তের পরশে ব্যাঘ্র ভাসে আখি জলে।।
আকস্মাৎ সেই ব্যাঘ্র হল অন্তর্ধান।
তাই দেখে সে অশ্বিনী হারাইল জ্ঞান।।
কিছু পরে মহারত্ন দেখিল চাহিয়া।
কতগুলি নারীমুর্ত্তি নাচিছে আসিয়া।।
ষোড়শী যুবতী তারা নৃত্য গীত গায়।
তাই দেখে সে অশ্বিনী পড়িল ধরায়।।
মা বলিয়া সম্বোধন করিল তখন।
ভক্তি গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
শুন শুন মাতাগণ আমার বচন।
অধমেরে কৃপা করি দিও শ্রীচরণ।।
সাধন ভজন আমি কিছুই না জানি।
জলে ভরা আখি দু’টি কহে স্তুতি বাণী।।
হরিভক্ত মুখে শুনি এহেন বচন।
অদৃশ্য হইয়া গেল সেই নারীগণ।।।
হরি বলে কাঁদিতেছে ভক্ত শিরোমণি।
আসিয়া দিলেন দেখা হরি গুণমণি।।
হরিচাঁদ বলে শুন হে বাছাধন।
ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।।
হরি মুর্ত্তি দরশন করিয়া তখন।
কাঁদিয়া ধরায় পড়ে হল অচেতন।।
হরিচান্দ লীলাখেলা কে বোঝে ধরায়।
অশ্বিনীকে দেখা দিয়া লুকাইয়া যায়।।
কিছু পরে সে অশ্বিনী চৈতন্য পাইয়া।
নয়নের জলেতে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।।
তারপর সে অশ্বিনী কালাপাতা কাটি।
অতঃপর আসিলেন রাইচাদ বাটি।।
কাঁদিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই।
হরিচান্দ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
গুরুচান্দের বর লাভ
মহানন্দ পদাশ্রিত হইল অশ্বিনী।
দিবানিশি মুখে তার হরি নাম ধ্বনি।।
হরিচান্দ গুরুচান্দ পোষা শুক পাখি।
মহাভাবে মাতোয়ারা ঝরে দু’টি আখি।।
নির্জনে বসিয়া সদা হরিগুণ গায়।
প্রেমের পাথারে রত্ন ভাসিয়া বেড়ায়।।
একদিন তার পিতা সে ভাবে দেখিয়া।
বলিলেন মহানন্দ পাগলকে গিয়া।।
শুন শুন ও পাগোল বলি যে তোমায়।
গঙ্গাচর্ণা চল তুমি আমার আলয়।।
অশ্বিনীর ভাব আমি বুঝিতে না পারি।
দিবা নিশি ফেরে সদা হরি নাম করি।।
সংসারের কর্ম কিছু করিতে না চায়।
মহাভাবে থাকে সদা হরিগুণ গায়।।
তাই শুনি মহানন্দ গঙ্গাচর্ণা এল।
অশ্বিনীর সেই ভাব দেখিতে পাইল।।
মহানন্দ বলে তুমি শুন বাছাধন।
কর্মনাহি করে বাছা কিসের কারণ।।
হাতে কাম মুখে নাম এযুগের ধর্ম।
কি বুছিয়া ছেড়ে দিলে সংসারের কর্ম।।
প্রশস্ত গার্হ্স্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
হরিচান্দ অবতীর্ণ এ বিশ্ব সংসারে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
অন্য কিছুতেই আমি শান্তি নাহি পাই।।
হরিনামে কি আনন্দ দিতে নারি সীমা।
প্রেমের তরঙ্গে ভাসি কি দিব উপমা।।
নামে প্রেমে মত্ত্ব হয়ে যেদিকে তাকাই।
হরিচাঁদ ছবিখানি দেখি বারে পাই।।
আকাশে বাতাসে আর লতায় পাতায়।
হরিচান্দ ছবিখানি ভাসিয়া বেড়ায়।।
তাই দেখে বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া যায়।
কি করিতে কি না করি বুঝিয়ে না পাই।।
হেন বাক্য মহানন্দ শুনি কানেতে।
অশ্বিনীকে বুকে ধরি লাগিল কহিতে।।
শুন শুন বাছাধন বলি তব ঠাই।
তোর মত হরিভক্ত এ জগতে নাই।।
চলো তোরে লয়ে যাই ওড়াকান্দি বাড়ি।
শ্রীধামেতে বসে আছে পারের কান্ডারী।।
হরি হর এক আত্মা গুরুচাঁদ নামে।
দেখিতে পাইবা তাহা যাইয়া শ্রীধামে।।
হেরিলে সে গুরুচাঁদ যুগল চরণ।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
তাই শুনি মহারত্ন বাক্যে দিল সায়।
গুরু সেবা করিলেন আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে কার্ত্তিকের আনন্দ উথলে।
কেঁদে কেঁদে মহানন্দ পাগলকে বলে।।
আশ্বিনীকে যে দিনেতে তোমাকে দিয়েছি।
আমার জনম ধন্য সেদিন জেনেছি।।
বংশে যদি হরিভক্ত একজন হয়।
সে বংশ উজ্জ্বল হয় তাহার দ্বারায়।।
আমার ঔরস ধন্য তাতে জানা গেল।
গোলকচাঁদের বরে এ রত্ন জন্মিল।।
আজ হতে ঘরবাড়ী সকল তোমার।
যাহা ইচ্ছা তাহা কর কি আছে আামার।।
এই কথা যখনেতে কার্ত্তিক বলিল।
মহানন্দ ধরে তারে আলিঙ্গন দিল।।
কার্ত্তিকেরে বলে কয়ে পাগল তখন।
অশ্বিনীকে সঙ্গে করে করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুণগান করিতে করিতে।
ভাবে গদগদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
পথে যেতে হরিভক্ত আসিয়া জুটিল।
পিছে পিছে তারা সবে চলিতে লাগিল।।
এইভাবে কত বাড়ী ঘুরিল পাগল।
সবার মুখেতে শুধু হরি হরি বোল।।
এই বেশে সবে মিলে বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত নারিকেল বাড়ী।।
পাগলের বাড়ী সবে কীর্ত্তনে মাতিল।
হরি বলে সে অশ্বিনী কাঁদিতে লাগিল।।
গুরুপাঠ মহাতীর্থ অশ্বিনী জানিয়া।
গড়াগড়ি যায় তথা মাটিতে পড়িয়া।।
হরিনামে মাতোয়ারা গড়াগড়ি যায়।
বাহ্যজ্ঞান হারাইল সমাধির প্রায়।।
তাই দেখ মহানন্দ অশ্বিনীকে ধরে।
কোলে করে রাখিলেন সমাদর করে।।
পদ্ম হস্ত বুলায়েছে অশ্বিনীর গায়।
গুরুর পরশ পেয়ে সুস্থ হয়ে রয়।।
ভোজনাদি করি সবে সে নিশি কাটায়।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়।।
আচমন করি সবে পান্তা সেবা করি।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা বলে হরি হরি।।
পথে যেতে হরিনাম করিতে করিতে।
উদয় হইল গিয়ে প্রভুর ধামেতে।।
দেখিয়া সে গুরুচাঁদ মহানন্দে কয়।
শুক পাখি ছানা তুমি পাইলে কোথায়।।
হরি বোলা পাখী এই শ্রীধামে আসিল।
আমার মনের বাঞ্ছা আজি পূর্ণ হল।।
তাই শুনি মহারত্ন চরণে পড়িল।
চরণে ধরিয়া সে যে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
অধমেরে কৃপা করি কর হে গ্রহণ।।
তব চরণেতে প্রভু এই ভিক্ষা চাই।
জনমে জনমে যেন ভুলিয়া না যাই।।
গুরুচাঁদ বলে বাছা শুন সমাচার।
তোর দ্বারা হরিনাম হইবে প্রচার।।
আমার পিতার গীতি তুইতো লিখিবি।
আমি তোরে বর দেই লিখিতে পারিবি।।
মহানন্দে ডাক দিয়া গুরুচাঁদ কয়।
শুন শুন মহানন্দ বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে তুমি নিয়ে আসিলে হেথায়।
এবে এক কার্য্য কর বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে নিয়ে তুমি জয়পুর যাও।
তারকের কাছে দিয়ে কবিত্ব জাগাও।।
হরিবোলা পাখী এই জগতে আসিল।
জীবের কল্যাণ হেতু পাগল আনিল।
গোলোকচাঁদের বরে আসিল ধরায়।
হরি লীলাগীতি হবে ইহার দয়ায়।।
তুমি যবে গুরুরূপে করিলে গ্রহণ।
তোমার কৃপায় হবে একার্য সাধন।।
মহানন্দ বলে প্রভু বলি তব ঠাই।
শ্রীমুখের বাক্য সত্য মনে ভাবি তাই।।
তুমি যারে কৃপা কর ওগো দয়াময়।
জীবনে মরণে তার নাহি কোন ভয়।।
পতিত তারিতে প্রভু আসিলে জগতে।
দয়াময় নাম তব হইল তাহাতে।।
গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিয়া।
বিদায় হেইল শেষে আশ্বিনীকে নিয়া।।
জয়পুর যাব বলে করিল গমন।
অধম বিনোদ বলে হরি বল মন।।
অশ্বিনীর তারকের কৃপা লাভ
অশ্বিনীকে সঙ্গে করি সেই মহানন্দ।
চলেছেন মহাভাবে পরম আনন্দ।।
হরিচাঁদ গুণকথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
জলে ভরা আখি দু’টি প্রেমিক অশ্বিনী।
পিছনে পিছনে চলে জুড়ি দুই পাণি।।
এইভাবে চলেছেন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত তারকের বাড়ী।।
তারকের পদে সবে প্রণাম করিল।
হরি বলে রসরাজ আর্শীবাদ দিল।।
ভক্তি ভাবে তারকের মহানন্দ কয়।
শুন শুন রসরাজ বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে নিয়ে আমি আসি তব ঠাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
গুরুচাঁদ দিয়াছেন আদেশ করিয়া।
কবিগান শিক্ষা দাও ইহাকে রাখিয়া।।
তারক বলেছে আমি ভাবি মনে মনে।
অশ্বিনীকে কবিগান শিখাব যতনে।।
দয়াময় গুরুচাঁদ অন্তরে জানিল।
তোমা দ্বারা অশ্বিনীকে এখানে পাঠাল।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞা আমি পালন করিব।
অশ্বিনীকে যত্ন করি কবি শিখাইব।।
সেই হতে অশ্বিনীকে তথায় রাখিয়া।
মহানন্দ আসিলেন দেশেতে চলিয়া।।
সেই হতে তারকের সঙ্গে সঙ্গে রয়।
তারকেরে গুরু মানি রহিল তথায়।।
চিন্তামণি দেবীকেই ডাকে মা বলিয়া।
তিনি তারে ভালবাসে পুত্র স্নেহ দিয়া।।
সকালে বিকালে রত্ন হরিগুণ গায়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
সেই ভাব দেখি সবে আনন্দ হৃদয়।
সবাকার মনে হয় প্রেমের উদয়।।
মাঝে মাঝে রসরাজ কবিগান করে।
অশ্বিনীকে নিয়ে যায় কবির আসরে।।
যখনেতে হয় তথা কাব্য আলোচনা।
সেদিনের কথা সব হয়ে যায় জানা।।
সেই ভাবে কবিগান শিখিতে লাগিল।
ভাবের আবেশ তার ক্রমেই বাড়িল।।
এইভাবে মাঝে মধ্যে কবিগান গায়।
সংসারের কর্ম করে সকল সময়।।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম আদর্শ দেখাতে।
হালের বলদ ছিল আবাদ করিতে।।
শম্ভু নামে এড়ে ছিল আর ছিল গাভী।
বকনা গরু ছিল যে নামেতে সুরভী।।
সেই গরু মাঝে মাঝে অশ্বিনী চরাত।
মাঠি গিয়ে সে অশ্বিনী হরিনাম নিত।।
হরিনাম করিবারে ঝরে দু’টি আখি।
মনে হয় হরিচাঁদের পোষা শুকপাখী।।
হরি বলা পাখী সে যে জগতে আসিল।
শুকপাখী সবে তারা অনুগত হোলো।।
পতিত জমিতে গিয়ে গরু চরাইত।
প্রাণভরে গরু গুলি সে নাম শুনিত।।
হরিনাম শুনে তারা ছাড়ে আখিজল।
তাই দেখে সে অশ্বিনী বলে হরিবল।।
হরিনামে মাতোয়ারা ছাড়ে শুধু হাই।
চক্ষু জলে ভাসে বাহ্যজ্ঞান নাই।।
ভাষাহীন পশুজাতি হেন দৃশ্য দেখি।
একদৃষ্টে চেয়ে আছে না পালটে আখি।।
শুকপাখী উড়ে এসে গা পৃষ্টে পড়িত।
হরিনাম শুনে তারা আনন্দে নাচিত।।
অশ্বিনীর হরিনামে হেন জ্ঞান হয়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
কোকিল আসিয়া সেথা ধরে কুহু তান।
মনে হয় তারা করে হরি গুণগান।।
হরিভক্ত ভালবাসে পশু পাখিগণ।
তাই তারা কাছে এসে নিয়াছে স্মরণ।।
ক্ষণেক চৈতন্য পেয়ে নয়ন মেলিল।
গরুগুলি চেয়ে আছে দেখিতে পাইল।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
গরুকে কহিছে ডেকে হস্ত দিয়া গায়।।
মাঝে গিয়ে ঘাস খাও মনের হরষে।
পেট ভরে গেলে আমি নিয়ে যাব শেষে।।
তাই শুনি গরুগুলি মাঠ মধ্যে যায়।
মনের আনন্দে তারা চরিয়া বেড়ায়।।
তারপর সে অশ্বিনী বৃক্ষতলে যেত।
বসিয়া বসিয়া শুধু হরিনাম নিত।।
মনমত গরুগুলি ভোজন করিয়া।
অশ্বিনীর কাছে এসে দাঁড়ায় আসিয়া।।
অশ্বিনী বলিত মোরা চল বাড়ী যাই।
পথ বেয়ে গরুগুলি চলিত সবাই।।
পিছনেতে চলে রত্ন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যা অগ্রে উপনীত তারকের বাড়ী।।
যত্ন করি গরুগুলি গোয়ালে বাঁধিত।
হাত মুখ ধুয়ে সে যে গৃহেতে পশিত।।
তারকের কাছে গিয়া জুড়ি দুই হাত।
ছল ছল আখি দু’টি করে প্রণিপাত।।
দুই হাতে পদ ধুলি লইত মাথায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
তাই দেখি রসরাজ বলিত বচন।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
মায়ের চরণে গিয়ে প্রণাম করিত।
স্নেহ ভরে মাতা মোর তাহাকে কহিত।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন।
মনের বাসনা তোর হইবে পূরণ।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
হাতে কাম মুখে নাম করিত সদায়।।
এইভাবে কতি দিন গত হয়ে গেল।
মাঝে মধ্যে কবিগান শিখিতে লাগিল।।
একদিনি অশ্বিনীকে বলে রসরাজ।
এবে তুমি মাঠে গিয়ে কর কৃষিকাজ।।
হালের বলদ লয়ে জমি চাষিবারে।
মাঝে মধ্যে চলে যাও বলি যে তোমারে।।
এইকথা বলা মাত্র তারক সুজন।
পশ্চিমপাড়ায় গেল করিতে ভ্রমন।।
গুরু বাক্য শুনি রত্ন ভাবে মনে মন।
কোন জমি চাষ করি নাহি নির্ধারণ।।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লগিল।
বলদের কাছে গিয়ে কাতরে কহিল।।
শুন শুন গো দেবতা আমার বচন।
যেই জমি চাষ হবে কর হে গমন।।
তোমরাত জান ভাল মোর জানা নাই।
যেই জমি চাষিবারে বলেছে গোঁসাই।।
তাই শুনি গরু দু’টি গমন করিল।
পিছে পিছে সে অশ্বিনী চলিতে লাগিল।।
লাঙ্গল জোয়াল স্কন্ধে চলে পিছে পিছে।
যে জমিতে গিয়া গরু দাঁড়াইয়া আছে।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী লাঙ্গল জুড়িল।
হরি বলে সেই জমি চষিতে লাগিল।।
জমি চাষ করে আর হরিগুণ গায়।
হরি নাম শুনে গরু দ্রুতগতি ধায়।।
দেখিতে দেখিতে জমি চাষ হয়ে গেল।
অমনি হালের গরু ছাড়াইয়া দিল।।
তাহাদের বলিলেন মাঠ মধ্যে যাও।
পতিত জমিতে গিয়ে চরিয়া বেড়াও।।
গরুগুলি ছেড়ে দিয়ে ভক্ত শিরোমণি।
মাঠ পার্শ্বে বৃক্ষতলে চলিল অমনি।।
শ্রম করি বসে গিয়া বৃক্ষের ছায়ায়।
ঘার্মাক্ত দেহখানি সুশীতল হয়।।
গুণগান হরিনাম করিতে করিতে।
শয়ন করিল শেষে বৃক্ষের ছায়াতে।।
নিদ্রার আবেশ হয়ে হল অচেতন।
ঘুম ঘোরে হরিনাম করে উচ্চরণ।।
ভীষণ রৌদ্রের তাপ বৃক্ষ পাতা ফাঁকে।
সূর্যের কিরণ পড়ে হরিভক্ত মুখে।।
হরিভক্ত কষ্ট দেখে দয়াময় হরি।
অশ্বিনীকে ছাড়া দেয় সর্প মূর্তি ধরি।।
দয়াময় হরি আজি ভক্তের লাগিয়া।
সর্পরূপে ছায়া দেয় ফণা বিস্তারিয়া।।
দেখরে জগতবাসী দেখরে চাহিয়া।
কিভাবে কি করে হরি ভক্তের লাগিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী বৃক্ষ তলে রয়।
মধ্যাহ্ন হইল গত হল অসময়।।
অসময় হলো দেখি তারক গোঁসাই।
অশ্বিনী আসে না কেন মনে ভাবে তাই।।
মন বড় উচাটন কি করি উপায়।
অশ্বিনীকে খুঁজিবারে মাঠ মধ্যে যায়।।
মাঠে মধ্যে গিয়ে তিনি দেখিবারে পায়।
পতিত জমিতে গরু চরিয়া বেড়ায়।।
অশ্বিনীকে নাহি দেখি ভাবিতে লাগিল।
বৃক্ষতলে লক্ষ্য করে দেখিতে পাইল।।
কিছু দুর থেকে দেখে আশ্চর্য ঘটনা।
মস্তক উপরে আছে সর্পরাজ ফণা।।
এমন সাপের ফণা কভু দেখি নাই।
পরাণ ভরিয়া দেখে তারক গোঁসাই।।
ধীরে ধীরে শ্রীতারক নিকটেতে গেল।
অদৃশ্য হইয়া সর্প বাতাসে মিশিল।।
তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল।
আধ আধ ভাষা দিয়ে বলে হরেবল।।
ছুটে গিয়ে অশ্বিনীকে বুকেতে ধরিল।
মহাভাবে সে তারক কহিতে লাগিল।।
কত কষ্ট করি আছ হাল চাষ করি।
তাই তব মনে বাছা দুঃখ হল ভারী।।
কেন বাছা শুয়ে আছ গাছের ছায়ায়।
শ্রীঘ্র তুমি ঘরে চল বেলা বয়ে যায়।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া সে যে কান্দিতে লাগিল।।
হাল চাষ করি আসি গরু ছেড়ে দিয়ে।
বৃক্ষতলে এসে আমি রয়েছি ঘুমায়ে।।
বেলা বয়ে গেছে মোর হেলায় হেলায়।
অপরাধ ক্ষমা কর ধরি তব পায়।।
তারক বলেছে তোর অপরাধ কিরে।
তোর মত হরিভক্ত নাই এ সংসারে।।
ত্বরা করি চল বাছা গৃহে চলে যাই।
অন্য কথা দিয়ে তব আর কার্য্য নাই।।
তারকের বাক্য শুনি অশ্বিনী তখন।
গরু লয়ে করিলেন গৃহেতে গমন।।
সেই হতে ভাবিলেন কবি রসরাজ।
অশ্বিনীকে দিয়ে আর করা’ব না কাজ।।
কাঁদিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
হরিভক্ত দরশনে গঙ্গার পাপ মোচন
এইভাবে শ্রী অশ্বিনী, জয়পুর থাকে তিনি
ভক্তি করে তারকের পায়।
কবিগান শিখিবারে, দলেতে দোয়ারী করে
মহাভাবে থাকিত সদায়।।
অশ্বিনীর কন্ঠ সুর, মধু হতে সুমধুর
আসরেতে করে কবিগান।
আসরেতে শ্রোতাবৃন্দ, শুনিয়া পরমানন্দ
হরিচাঁদ ভক্ত শিরোমণি।
গান শুনি আনন্দিত, আসরের শ্রোতা যত
শ্রোতাগন কাহে একজন।
প্রেমরসে তনুখানি, হরিভক্ত শিরোমণি
হরি বলে ঝরে দু’নয়ন।
হরিচাঁদ রূপরসে, সদা আখি জলে ভাসে
হরিচাঁদে সপে মন প্রাণ।
যেদিকে ফেরায় আখি, হরিচাঁদ রূপ দেখি
অমনি হারায় বাহ্যজ্ঞান।।
সবে করে জয়ধ্বনি, শ্রীতারক তাহা শুনি
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কয়।
শুন শুন বাছাধন, তুমি প্রেম মহাজন
হরি বলে আর্শীবাদ দেয়।
এইভাবে দেশে দেশে, কবিগান করি শেষে
জয়পুর গিয়ে সাঝে রয়।
হরিভক্ত শিরোমণি, শ্রীতারক তাহা জানি
কর্ম করিবারে নাহি দেয়।।
বলে তুমি শুন সোনা, কোন কর্ম করিওনা
সদা কর হরি গুণগান।
হরিচান্দ লীলাগীতি, লিখ তুমি শীঘ্র গতি
আশীর্বাদ করিলাম দান।।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ, করেছেন আশীর্বাদ
আমি আর বাক্যে দিনু সায়।
তারকচাঁন্দের বাণী, শুনিয়া সে অশ্বিনী
কাঁদিয়া ধরিল গিয়া পায়।।
ছল ছল আখি দু’টি, কহিছেন কর পুটি
আমা দ্বারা সম্ভব না হয়।
বিদ্যা বুদ্ধি মোটে নাই, কেমনে লিখিব তাই
বল গুরু করি কি উপায়।।
তারক কহিছে বাণী, শুন শুন জাদুমণি
হরিচাঁদ হৃদয় আসিয়া।
তোমা দিয়া লেখাইবে, উপলক্ষ তুমি হবে
ভাব তুমি কিসের লাগিয়া।।
গুরু মুখে এই বাণী, শুনি ভক্ত শিরোমণি
কিছুদিন জয়পুরে রয়।
সদা হরিনাম করে, হরিনামে আখি ঝরে
প্রেমের তরঙ্গে ভেসে যায়।।
এইভাবে দিন গেল, কতদিন গত হল
শুন এক আশ্চর্য ঘটনা।
নব গঙ্গা নদি তীরে, অশ্বিনী বেড়ায় ঘুরে
হরিনাম কখন ভোলে না।।
নব গঙ্গা নদীকুলে, হিজলিকা বৃক্ষ দোলে
শাখাগুলি জলের উপর।
মহানন্দে বাহু তুলে, গঙ্গা মাকে পাব বলে
ঠিক যেন উপাসনা করে।।
সেই বৃক্ষ শাখা পরে, বসিয়া আনন্দ ভরে
প্রেমিক অশ্বিনী সদা রয়।
হরিচাঁদ পোষা পাখি, হরিনামে ঝরে আখি
প্রেমের তরঙ্গে ভেসে যায়।।
এক শাখে পদ দিয়ে , অন্য শাখাতে বসিয়ে
আনন্দেতে হরিগুণ গায়।
হরি হরি হরি বলে, ভেসেছে নয়ন জলে
সেই জল জলে ভেসে যায়।।
হরিনাম ধ্বনি শুনে, ভেসে ওঠে সুরোধনী
হরিভক্ত সঙ্গ পেতে চায়।।
বসিয়া মকর পৃষ্ঠে, চেয়ে আছে এক দৃষ্টে
নাম গুণে পরাণ জুড়ায়।।
ঝর ঝর আখি ঝরে, ধরে মাতা দুই করে
সর্ব পাপ হরণ আশায়।।
ভগীরথ যেদিনেতে, গঙ্গা আনে এ মহিতে
গঙ্গা জম্মে শ্রীহরির পায়।।
জন্মিয়া সে সুরধনী, ভগবানে বলে বাণী
কেন প্রভু জন্মালে আমায়।
দয়াময় বলে বাণী, শুন মাতা সুরধনী
শীঘ্র গতি যাহ মা ধরায়।।
পাপী তাপী উদ্ধারিতে, যাহ তুমি অবনীতে
ভগীরথ সঙ্গে তুমি যাও।
সগরের বংশ যত, ব্রহ্ম পাশে ভস্মীভূত
আগে তুমি তাদের তারাও।।
আর যত পাপী হবে, তোমা যদি পরশিবে
তারা সবে মুক্ত হয়ে যাবে।।
গঙ্গা বলে দয়াময়, ধরি আমি তব পায়
মম পাপ কেমনে ঘুচিবে।।
শুনিয়া গঙ্গার বাণী, কহিলেন চক্রপাণী
শুন গঙ্গা বলি তব ঠাই।
আমা হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
হরিভক্ত সঙ্গ করা চাই।।
মম ভক্ত দরশনে, মম ভক্ত পরশনে
সর্ব পাপ মুক্ত হয়ে যাবে।
তাই আজি সুরধনী, হরিনাম ধ্বনি শুনি
দরশনে পরাণ জুড়া’বে।।
রোজ রোজ তথা আসি, গাছের ডালেতে বসি
এইভাবে হরিনাম করে।
গঙ্গা মা আনন্দ মনে, নিত্য আসি নাম শোনে
আনন্দে মকর লেজ নাড়ে।।
গ্রামবসী একজন, করি তাই দরশন
তারকের কাছে গিয়া কয়।
অশ্বিনীকে কর মানা, সে যেন গাছে যায় না
কবে যেন কুম্ভীরেতে খায়।।
নদীকুলে বৃক্ষডালে, বসে হরি হরি বলে
নয়নের জলে ভেসে যায়।
আমি দেখিলাম এসে, কুম্ভীর রয়েছে ভেসে
তাই আমি জানাই তোমায়।।
হেন কথা শুনি কানে, রসরাজ ভাবে মনে
কোন কিছু না পায় ভাবিয়া।
সাপে যারে ছায়া দেয়, তারে কি কুমীরে খায়
নিজ গিয়ে দেখিব আসিয়া।।
তাই ভাবি মনে মনে, থাকিয়া গোপনে স্থানে
চেয়ে চেয়ে দেখিবারে পায়।
অশ্বিনী বসিয়া ডালে, সদা হরি হরি বলে
নয়নের জলে ভাসে যায়।।
মা গঙ্গা মকর পরে, দুই হাতে উচু করে
ধরিতেছে নয়নের জল।
ধরিয়া নয়ন বারি, লইতেছে শিরপরি
আনন্দেতে বলি হরি বল।।
মনে ভাবে রসরাজ, কি যেন হইল আজ
গঙ্গা মাকে করে দরশন।
হেন দৃ্শ্য চোখে দেখি, পালটিতে নারে আখি
ঝর ঝর ঝরে দু’নয়ন।
দেখিয়া গঙ্গার মুর্ত্তি, করে কত স্তব স্তুতি
বলে মাগো রাখিও চরণে।
পাপী তাপী উদ্ধারিতে, আসিলেন অবনীতে
ধন্য আমি তব দরশনে।।
নিজ পাপ মুক্ত হতে, হরিভক্ত সঙ্গ নিতে
খেলা কর এখানে আসিয়ে।
ধন্য ধন্য শ্রী অশ্বিনী, হরি ভক্ত শিরোমণি
ধন্য আমি তার গুরু হয়ে।।
এইভাবে স্তুতি করে, হরি বলে আখি ঝরে
কেন্দে কেন্দে পড়িল ধরায়।
তাই দেখে সে অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরোমণি
গুরু পদে কেঁদে কেঁদে কয়।।
আমি বড় অপরাধী, তুমি মোর গুণনিধি
চরণেতে ক্ষমা ভিক্ষা চাই।
তারক কহিছে বাণী, শুন শুন জাদুমণি
তোর কোন অপরাধ নাই।।
অশ্বিণীর হস্ত ধরে, চলিলেন ধীরে ধীরে
তখনি গৃহিতে চলে গেল।
কান্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
হরিভক্ত সঙ্গ নাহি হলো।।