পৃষ্ঠাঃ ১০১-১২০
পথ মধ্যে গুতা দিতে করেনা কসুর।
দেশোয়ালী প্যাদা যেন দেখিতে অসুর।।
নায়েবের কাছে এনে উপস্থিত করে।
অযুক্তি কটূক্তি কত করে তারপরে।।
ক্ষীণ - কন্ঠে প্রজা যদি কোন কথা বলে।
পেয়াদা -গর্জনে তাহা যায় রসাতলে।।
নায়েব মশায় সাজে “ক্ষুদে জমিদার “।
“বলে চৌদ্দ পোয়া কর পা দুটো উহার”।।
দেখিয়া কৌতুক করে প্রজা দুঃখে কান্দে।
পৃষ্ঠ - মোড়া দিয়ে তার দুই হস্তে বান্ধে।।
চাবুক লাগায় পিঠে আর মলে কান।
কেন্দে কেন্দে প্রজা ডাকে কোথা ভগবান!
কত জনমের পাপী আমি নীচ ঘরে।
পশু হতে হীন জীব মোরে গণ্য করে।।
বান্ধব নাহি 'ক কেহ অবনী মাঝারে।
গরীবের মনোদুঃখ বুঝিবার তরে”।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
তাই দেখি হাসি বলে নায়েব মশায়।।
“মনে মনে অভিশাপ করিতেছে বেটা।
ওরে প্যাদা আচ্ছা করে কর জুতাপেটা”।।
অসহায় মৃগ 'পরে যথা সিংহ পড়ে।
প্যাদা হতজ্ঞান করে প্রজা এক চড়ে।।
হতজ্ঞান দেখি প্রজা নায়েবের ভয়।
জলে তেলে সুস্থ করি তাহারে বসায়।।
বলে 'ওরে শঠ্ বেটা টাকা দিবি কবে ?
সাত দিনে নাহি দিলে টের পাবি তবে'।।
আজি কালি ও কাহিনী স্বপ্ন মনে হয়।
বর্ণে বর্ণে সত্য সব ছিল সে সময়।।
অশিক্ষা যাহারে রাখে ঢাকিয়া আঁধারে।
হিতাহিত জ্ঞান বল পাবে কি প্রকারে ?
জ্ঞানাঞ্জন বিদ্যা তাই আলোকেতে ভরা।
অজ্ঞান - বিনাশী তাহা সর্ব্ব দুঃখ -হরা।।
তাই বলিয়াছি বঙ্গে অনুন্নত যত।
অবিদ্যার অন্ধকারে ছিল জ্ঞানাহত।।
দুঃখ - যন্ত্রনায় সবে কাঁদে উভরায়।
'ত্রাণ কর, দুঃখ হর ' কোথা দয়াময়!
কাঙ্গালের সে কান্নায় দয়াময় হরি।
অবতীর্ণ বঙ্গ দেশে সফলা নগরী।।
যশোবন্ত ঘরে জন্মে হরিদাস নাম।
রত্ন পেয়ে দীনগণ পূর্ণ - মনোস্কাম।।
শ্রী হরি ঠাকুর বলি হ'ল পরিচয়।
চন্দ্র তুল্য কান্তি হেরি “হরিচাঁদ “কয়।।
কাঙ্গালে তারিতে প্রভু নর দেহ - ধারী।
অপরূপ রূপে তাঁর ভোলে নর নারী।।
এই হরিচাঁদ দেখ করূণা করিয়া।
দীন জনে উদ্ধারিল প্রেম ভক্তি দিয়া।।
“হরিলীলামৃত “নামে মহা গ্রন্থ খানি।
শ্রী তারক চন্দ্র লেখে অপূর্ব্ব কাহিনী।।
অভূত অপূর্ব্ব লীলা হরিচাঁদ করে।
তাঁর লীলা কেবা কত বলিবারে পারে ?
স্থুল কথা গ্রান্থাকারে প্রেমের ভাষায়।
সে তারক সুপরাগ গ্রন্থ লিখে যায়।।
প্রমাণ রয়েছে তা'তে প্রাঞ্জল ভাষায়।
যবে হরিচাঁদ নরদেহ ছেড়ে যায়।।
উত্তর সাধক হ'ল শ্রী গুরুচরণ।
তাঁর কাছে বলে যত ছিল আকিঞ্চন।।
অনুন্নত জাতি মাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।
আজ্ঞা করে হরিচাঁদ তারে বিধিমতে।।
পিতার আজ্ঞাতে প্রভু পালে ব্রহ্মচর্য।
নিরলস নিদ্রাহীন এমনি আশ্চর্য।।
দৃঢ় ভিত্তি পরে নিজ জীবন গড়িল।
মহা উদ্ধারণ - শক্তি প্রাণেতে জাগিল।।
গৃহীজনে দিতে মুক্তি দীনের করুণা।
আজীবন গুরুচাঁদ করিল সাধনা।।
অর্থ হয় মহাশক্তি গৃহী পক্ষে মূল।
অর্থকে অনর্থ বলা কত বড় ভুল।।
যথা - অর্থ তথা - লক্ষ্মী তথা নারায়ণ।
আপন জীবনে করে এই আচরণ।।
অর্থ হীন গৃহীজনে শিখায় কৌশল।
ঋণ দায়ে ডোবে যেই তারে দেয় বল।।
এ আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গুরুচাঁদ কয়।
“বিদ্যাশূন্য গৃহে কিন্তু অর্থ বৃথা যায়।।
পুরাণ - প্রবাদ বাক্য শুনিয়াছ তাই।
লক্ষ্মী সরস্বতী দোহে থাকে ভিন্ন ঠাঁই।।
আমি বলি ইহা ভুল সত্য ইথে নাই।
শ্রী বিষ্ণুর দুই পত্নী শাস্ত্র গ্রন্থে পাই।।
বিদ্যা - দেবী সরস্বতী ধন - দেবী লক্ষ্মী।
দোহে বিষ্ণুর সেবা করে শাস্ত্রে দেয় সাক্ষী।।
দোহে সতী প্রাণপতি বিনা নাহি জানে।
সতী নারী বিসম্বাদ করে কা'র সনে ?
ধনরূপে লক্ষ্মী দেবী ঐশ্বর্য দেখায়।
জ্ঞান রূপে সরস্বতী উজ্জ্বল করয়।।
দোহে এক স্বামী ভজে হয়ে এক মন।
বাদ বিসম্বাদ তারা করে না কখন।।
এই দুই শক্তি যদি নমঃশূদ্রে পায়।
জগত চিনিবে তারা কহিনু নিশ্চয়।।
আদর্শ দেখা'তে প্রভু নিজে কর্ম্ম করে।
পাঠশালে দেয় পুত্র বিদ্যা শিক্ষা তরে।।
প্রভুর প্রথম পুত্র শ্রী শশি ভূষণ।
দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুধন্য সুজন।।
তৃতীয় উপেন্দ্র নাথ কামজিনি কান্তি।
চতুর্থ সুরেন্দ্র নাথ দরশনে শান্তি।।
পাঠশালে না থাকিলে কোথা শিক্ষা পাবে।
পাঠশালা করে প্রভু ইহা মনে ভেবে।।
নিজগৃহ পরে প্রভু করে পাঠশালা।
দেশবাসী ছাত্র আসি করিল জটলা।।
ইহা পূর্বে ঘৃতকান্দী গ্রামে স্কুল ছিল।
যতেক কায়স্ত জুটি সে স্কুল গড়িল।।
গঙ্গারাম সরকার নামেতে পণ্ডিত।
স্বজাতি কায়স্ত গণে করে যত হিত।।
প্রবল আগ্রহে তবে প্রভু সেই খানে।
শ্রী শশিভূষণে দিল শিক্ষার কারণে।।
জ্ঞান ঋষি তত্ত্বমসি যাঁহার লক্ষণ।
সেই ' পরামর্ষি ' হয় শ্রী শশিভূষণ।।
বিস্তৃত জীবন তাঁর করেছি লিখন।
এই গ্রন্থে শেষ ভাগে হ'বে সংযোজন।।
এই ভাবে শশি পড়ে ঘৃত কান্দী গাঁয়।
স্বদেশে করিতে স্কুল মনে ভাব হয়।।
দেশবাসী সবে ডাকি প্রভু বলে বাণী।
“আমার বচন শুন জ্ঞানী,গুণী, ধনী।।
শিক্ষা যদি নাহি পায় মোদের সন্তান।
শিক্ষা ছাড়া এ জাতির না হবে কল্যাণ।।
অতএব পাঠশালা করিবারে চাই।
অনুমতি করি দেহ বান্ধব সবাই “।।
প্রভুর বচন শুনি সবার আনন্দ।
সবে বলে “ধন্য তুমি প্রভু গুরুচন্দ্র।।
পতিত - তারক ছিল প্রভু হরিশ্চন্দ্র।
উপযুক্ত পুত্র তাঁর তুমি গুরুচন্দ্র।।
বিদ্যাহীন এ সমাজ পিছে আছে পড়ি।
তরাও তাহারে তুমি অকুল কাণ্ডারী “।।
সবে মিলে বসি শেষে হ'ল পরামিশে।
পাঠশালা হবে গুরুচাঁদের আবাসে।।
শুভ দিনে পাঠশালা স্থাপিত হইল।
দলে দলে ছাত্র আসি তথায় জুটিল।।
কিছুদিন পরে সবে সেই পাঠশালা।
চৌধুরী গৃহেতে রাখে বাঁধি একচালা।।
সুবিজ্ঞ পণ্ডিত নইলে শিক্ষা বৃথা হয়।
সুশিক্ষা দিবার তরে সু শিক্ষক চায়।।
স্বজাতির মধ্যেতে নাহি মিলে হেন জন।
শিক্ষকের চিন্তা করি দুঃখেতে মগন।।
অন্য জাতী শিক্ষা দেয় শুধু অর্থ জন্য।
নমঃশূদ্র গণে করে মূর্খ - মধ্যে গণ্য।।
নিরুপায় হয়ে তায় সবে ক্ষুন্নমন।
পাঠশালে দৃষ্টি নাহি করে কোনজন।।
দিনে দিনে পাঠশালা সবে দিল ছাড়ি।
সবে মিলি উপনীত ঠাকুরের বাড়ী।।
বিনয় বচনে সবে করে নিবেদন।
“বড়কর্ত্তা শুন বার্ত্তা যা 'বলি এখন।।
শূণ্য গৃহ ভাল বলি দুষ্ট গরু - ছাড়া।
স্বজাতি বিহনে শিক্ষা চাহিনা আমরা।।
স্বজাতি শিক্ষক যদি মিলে কোন দিনে।
তাঁর হাতে শিক্ষা দিব আপন সন্তানে।।
বিহিত বিধান তার চাহি তব ঠাঁই।
স্বজাতি শিক্ষক মোরা সবে মিলি চাই”।।
বার্ত্তা শুনি গুরুচাঁদ মৌন হয়ে রয়।
কিছুকাল পরে প্রভু হাসি হাসি কয়।।
“শুনসবে দেশবাসী আমার বচন।
শিক্ষকের লাগি চিন্তা না কর এখন।।
এবে ভাদ্র মাস দেখ বরষার কাল।
দুই মাস গতে বাঞ্ছা হইবে সফল।।
দুই মাস পরে পাবে স্বজাতি পণ্ডিত।
তেঁহ হতে নমঃশূদ্রে পাবে বহু হিত”।।
কথা শুনি মহানন্দে সবে গৃহে যায়।
এদিকেতে হ'ল ক্রমে অঘ্রাণ উদয়।।
ইচ্ছাময় প্রভু মোর যাহা ইচ্ছা করে।
ইচ্ছামাত্র পূর্ণ হয় মুহূর্ত্ত ভিতরে।।
পরম পণ্ডিত রঘুনাথ সরকার।
দৈবক্রমে উপনীত ওড়াকান্দী ' পর।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম অতি মহাশয়।
স্বজাতি উন্নতি লাগি ঘুরিয়া বেড়ায়।।
ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ নমঃশূদ্র - পতি।
ফরিদপুরেতে আসি জানিলা সম্প্রতি।।
যার কাছে প্রশ্ন করে সেই বলে হেসে।
“কুলপতি গুরুচাঁদ “আছে এই দেশে।।
বহু মান বহু ব্যাখ্যা শুনিলেন তিনি।
দেখিবারে গুরুচাঁদে চায় গুণমণি।।
মনে ভাবি কতকাল ভ্রমি কত দেশে।
মনের বাসনা পূর্ণ হল হেথা এসে।।
ঠাকুরের গুণগাঁথা শুনে সর্ব্ব ঠাঁই।
মনে ভাবি আরোপূর্ব্বে কেন আসি নাই।।
ভাবিতে ভাবিতে চলে সেই মহাশয়।
কোন পথে ওড়াকান্দী জানা নাহি রয়।।
হেন কালে পথিমাঝে করে দরশন।
দীর্ঘ -শ্মশ্রু দীর্ঘ -কেশ এক মহাজন।।
দিব্য - কান্তি মনোহর সুহাস বদন।
ধীরপদে করিতেছে গজেন্দ্র গমন।।
মূরতি দেখিলে শির পদে নত হয়।
উজলিত দশ দিশি রূপের প্রভায়।।
দেবতুল্য মূর্ত্তি দেখি সেই রঘুনাথ।
শির নত করি পদে করে দণ্ডবৎ।।
সেই মহাজন তবে বলিল হাসিয়া।
“প্রণাম করিলে বাপ। কিসের লাগিয়া?
আভূমি প্রণাম করে” মতুয়া “সুজন।
তোমা মধ্যে দেখি না ত সে সব লক্ষণ।।
মহাজন - বাক্য শুনি বলে রঘুনাথ।
“এই প্রণামের মধ্যে নাহি মোর হাত।।
তব মূর্ত্তি দেখি প্রভু মন ভুলে গেল।
প্রণাম করিনা আমি কে যেন করা'ল।।
এক নিবেদন প্রভু করি তব পায়।
মতুয়া বলিলে যাঁরে সে জন কোথায় “।।
সে মহাপুরুষ তবে বলে হাসি হাসি।
দশন মুকুরে যেন চন্দ্র পড়ে খসি।।
'শুনহে পথিক! তুমি বলো পরিচয়।
যেই জন হরি ভক্ত তারে মতো ' কয়।।
ওড়াকান্দী পুণ্যধামে হরি অবতার।
তাঁর যত ভক্ত আছে পৃথিবী ভিতর।।
'মতুয়া 'বলিয়া তাঁরা খ্যাতি পাইয়াছে।
আভূমি প্রণাম তাঁরা সবে শিখা 'য়েছে।।
যাহা হ'ক এবে দাও তব পরিচয়।
কোথা ঘর কেন তুমি এসেছ হেথায় ?
সবিনয় রঘুনাথ বলে তাঁর ঠাঁই।
“শিক্ষকতা “কার্য লাগি ঘুরিয়া বেড়াই।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আমি লভিয়াছি।
বহু কষ্টে কিছু বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি।।
স্বজাতির ঘরে মোর বিদ্যা নাহি চিনে।
স্বজাতি বিদ্বান করি ভাবি মনে মনে।।
যেই যেই দেশে যাই স্বজাতি ভিতর।
বিদ্যা অবহেলা করে বোঝে না আদর।।
সবে মনে ভাবে “বিদ্যা আমাদের ঘরে।
আসিতে পারেনা কভু কোনদিন তরে।।
ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ যত এই দেশে।
তাঁরা বিদ্যা শিক্ষা করে বিশেষ বিশেষে।।
বিধাতা করেছে সবে কৃষি - ব্যবসাই।
বিদ্যা শিক্ষা এই ভাগ্যে লেখা জোকা নাই।।
মনোদুঃখে বহু দেশে আমি ভ্রমিয়াছি।
মনোমত কথা প্রভু কথা কভু না শুনেছি।।
শান্তি নাই কোথা যাই মনোদুঃখে কান্দি।
হেনকালে শুনিলাম নাম ওড়াকান্দী।।
পতিতে তারিতে নাকি হ'ল অবতার।
ভাবিলাম গেলে সেথা যাবে মনোভার।।
হেথা আসি শুনিলাম হরিচাঁদ নাই।
তস্য পুত্র গুরুচাঁদ হয়েছে গোঁসাই “।।
জনে জনে জিজ্ঞাসিয়ে বুঝিলাম সার।
পিতার সুযোগ্য পুত্র শ্রী হরি কুমার।।
তাঁর কাছে মনোব্যথা জানাবার তরে।
ওড়াকান্দী মনে ভাবি চলিয়াছি ধীরে।।
কোন্ পথে যেতে হবে কিছু নাহি জানি।
ভাবিয়াছি পথে মোরে নেবে সেথা টানি।।
আপনাকে দেখে পথে করেছি ধারণা।
পথ বলি দেবে তুমি করিয়া করুণা “।।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল তাঁরে করিয়া মিনতি।
“কিবা নাম কোথা ধাম কোথায় বসতি ? “
সেই মহাজন তবে হাসি হাসি কয়।
“বাসুদেব “ নাম মোর শুন পরিচয়।।
শান্তিপুর ঘর মোর প্রেমবাড়ী থানা।
সব থেকে কিছু নাই এমনি ঘটনা।।
ঘর -ভরা আছে মোর সন্তান সন্ততি।
মোর বাক্য মানিবারে নাহি কা'র মতি।।
মনোদুঃখে ঘর ছাড়ি আসিয়াছি পথে।
দীন দুঃখী পেলে যাই তার সাথে সাথে।।
দীনে ভালবাসি দিয়ে সারা প্রাণ টুক্।
ধনী ছেড়ে দীনে নিয়ে তাই মোর সুখ।।
ওড়াকান্দী গাঁয়ে দুই বৈষ্ণব - বৈষ্ণবী।
পরম পবিত্র দোঁহে করুণায় ছবি।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আচারে বৈষ্ণব।
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান দোঁহার স্বভাব।।
অন্তরে কাঙ্গাল দোঁহে বাহিরে ঐশ্বর্য।
অহরহ পান করে প্রেমের মাধুর্য।।
মম গুরুদেব যিনি পরম উদার।
তাঁর সাথে সেই গৃহে যাই একবার।।
পতি সনে সাধ্বী দেয় উত্তম আহার।
ভক্তি দেখি মনে পাই আনন্দ অপার।।
অমৃত - অধিক লাগে অন্নাদি ব্যঞ্জন।
মনোসাধে প্রাণভরে করিনু ভোজন।।
আমার আনন্দ দেখি গুরুজীর সুখ।
বলে “বাসো! এতদিনে জুড়ালি রে বুক।।
সাথে সাথে নিয়ে তোরে ঘুরি যেথা সেথা।
এই খানে খে'লি অন্ন করিয়া মমতা।।
মোর সাথে থাকি বাছা কত কষ্ট পাও।
দিন কত ' এই গৃহে পুত্র হয়ে রও।।
অন্নপূর্ণা মাতা তোরে বাসিয়াছে ভাল।
পতি যশোবন্ত দেখ প্রেমের কাঙ্গাল “।।
গুরুজীর কথা শুনি সেই সতী কান্দে।
ইচ্ছা করে, বাধিলাম তার প্রেম ফাঁদে।।
পুত্র সাজি সেই ঘরে খেলিলাম কত!
সম্বন্ধ করিল সাথে অন্তরঙ্গ যত।।
হরিচাঁদ নাম যাঁর শুনিয়াছ কানে।
অভেদাত্মা মোরা দোঁহে ছিনু সর্ব্বক্ষণে।।
যেই “বাসো “সেই হরি কহিত সকলে।
নাচিতাম অন্নপূর্ণা জননীর কোলে।।
হরিপুত্র “গুরুচাঁদ “জানে সর্ব্বজনে।
নিজ -পিতা সম তেঁহ সদা মোরে মানে।।
সেই হরিচাঁদ যবে লীলা করে শেষ।
তেঁহ সঙ্গে আমি তবে ছেড়েছি সে দেশ।।
তবে এক মায়া মোর আজো কাটে নাই।
বড় ভালবাসে মোরে গুরুচাঁদ সাঁই।।
মনে হয় তাঁর মধ্যে আমি সদা আছি।
মম - আত্মা হরিচাঁদ তাঁহাতে পেয়েছি।।
প্রত্যক্ষ সাক্ষাতে মোর নাহি লয় মন।
অদেখার মাঝে তাঁরে দেখি সর্ব্বক্ষণ “।।
মুরজ মুরলী যথা কান্দে নিরালায়।
সে মহাজনের বাণী তথা শোনা যায়।।
বিস্মৃতির প্রায় শুনে সেই রঘুনাথ।
অগোচরে তাঁর কত হয় অশ্রুপাত।।
মহাজন প্রতি চাহি কহিছে কাতরে।
“কোন পথে ওড়াকান্দী বল দয়া করে।।
আপনার কথা শুনে প্রাণে এই বলে।
দিবানিশি থাকি পড়ে চরণ - কমলে।।
তবু মনে হয় যেন কেন ওড়াকান্দী।
আমার পাগল মন করিয়াছে বন্ধী।।
কিবা করি কোথা যাই নাহি পাই দিশে।
মতিচ্ছন্ন হ'ল বুঝি এসে এই দেশে।।
দয়া করে বল মোরে কোন পথে যাই।
কত দূরে ওড়াকান্দী বল শুনি তাই”।।
রঘুনাথ বলে যদি এহেন বচন।
হাসি হাসি বলে তাঁরে সেই মহাজন।।
“এবে সন্ধা হ'ল তুমি দেখ রঘুনাথ।
সাহসেতে ভর করি রাত্রে চল পথ।।
যতদূর গেলে হবে নিদ্রার আবেশ।
নিশ্চয় জানিও সেই ওড়াকান্দী দেশ।।
দক্ষিণ দিকেতে এবে তুমি চল হাঁটি।
তব ঠাঁই এবে আমি লইলাম ছুটি।।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে দেখা পাবে।
দেখা পেয়ে মোর কথা তাহাকে জানাবে।।
সে তোমা' রাখিবে দেশে দিতে পাঠশালা।
শিখা'বে বালক গণে করিওনা হেলা।।”
এত বলি দ্রুতগতি হ'ল অন্তর্দ্ধান।
বাতাসে মিশিয়া গেল হয় হেন জ্ঞান।।
আশ্চর্য মানিয়া রঘু রহে দাঁড়াইয়া।
কেবা এল কেবা গেল ভাবিছে বসিয়া।।
আশ্চর্য ঘটনা দেখি প্রেমে পুলকিত।
রঘুনাথ পথে তবে চলিল ত্বরিত।।
মনে ভাবে গুরুচাঁদে পেয়ে দরশন।
তাঁর কাছে জানাইবে সব বিবরণ।।
অবোধ্য প্রভুর খেলা খেলার চুড়ান্ত।
ধ্যানে জ্ঞানে নাহি বুঝে পেল সে অনন্ত।।
মনে ভাবে রঘুনাথ এ কেমন কথা।
এক রাতে ওড়াকান্দী যেতে চাওয়া বৃথা।।
হেথা হতে ওড়াকান্দী রহে বহুদূর।
তাহা ছাড়া আমি অদ্য কাতর প্রচুর।।
নিদ্রাবেশ অল্প পরে চোখে হবে মোর।
হারে মন অকারণ রাত্রে চলা তোর।।
পুনঃ ভাবে এই চিন্তা কেন হল মনে।
অবিশ্বাস কেন করি সেই মহাজনে।।
এই কথা মনে হলে প্রাণে এল বল।
রঘুনাথ চলে পথে চক্ষে বহে জল।।
যে জন বাতাসে মিশে অন্তর্দ্ধান হয়।
দৈবশক্তি ধারী নর হবে সে নিশ্চয়।।
এত ভাবি রঘুনাথ কিছু পথ চলে।
মনে হল এক ক্রোশ চলে অবহেলে।।
আশ্চর্য প্রভুর চক্র দেবে অগোচর।
নিদ্রা আসি রঘুনাথে করিল কাতর।।
ঘুম ঘোরে পদক্রমে অসার হইল।
বট বৃক্ষ মূলে পড়ি নিদ্রামগ্ন হ'ল।।
কোন্ ভাবে রাত্রি কাটে কেহ নাহি জানে।
জাগিল ঊষার আলো প্রভাত আঙ্গিণে।।
নয়ন মেলিয়া দেখে সেই রঘুনাথ।
কাটিয়া গিয়াছে রাত্রি এসেছে প্রভাত।।
বৃক্ষ তল ছাড়ি তবে চলে দ্রুত গতি।
একা যায় নাহি আর সাথে কোন সাথী।।
কিছুদূরে পেল দেখা এক পথিকেরে।
“ওড়াকান্দী কতদূরে “জিজ্ঞাসে তাঁহারে।।
বিস্মিত নয়নে পান্থ চাহে তার পানে।
ক্ষণকাল স্তব্ধ রহি কহিছে তখনে।।
“অনুমানে জ্ঞান হয় তুমি ভিন্ - দেশী।
নৈলে কোথা ওড়াকান্দী বল হেথা আসি।।
ওড়াকান্দী কোন বাড়ী তুমি যেতে চাও।
এই ত সে ওড়াকান্দী কোথা যাবে যাও।।
অকস্মাৎ রঘুনাথ চমকিয়া ওঠে।
মহা পুরুষের বাণী সত্য হল বটে।।
মনে ভাবিয়াছি যাহা তাহা সব ভুল।
ওহোরে অভাগা আমি শিমুলের ফুল।।
সাশ্রুনেত্রে রঘুনাথ চাহে তার পানে।
ধীরে ধীরে বলে তারে মধুর বচনে।।
“বহু দেশ ছাড়ি আমি এসেছি এ দেশে।
হরি পুত্র গুরুচাঁদ দেখিবার আশে।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম নাম রঘুনাথ।
পরম সৌভাগ্য মোর আজি সু - প্রভাত।।
প্রাণের বাসনা মোর আছে বহুতর।
ইচ্ছা আছে গুরুচাঁদে জানাতে সত্ত্বর।।
কোন্ ঘরে গুরুচাঁদ করিছে বসতি ?
দয়া করি বল ভাই আমাকে সম্প্রতি।।”
পথিক ডাকিয়া বলে “শুন মহাশয়।
রজত - ধবল সম অই দেখা যায়।।
“ঠাকুরের বাড়ী “ উহা পরম পবিত্র।
শ্রী হরিচাঁদের পীঠ পুণ্যতীর্থ ক্ষেত্র।।
টিনে - ঘেরা ঘর বাড়ী দেখিতে সুন্দর।
গুরুচাঁদ আছে বসি উহার ভিতর।।
অপলকে চেয়ে দেখে সুধী রঘুনাথ।
সসম্ভ্রমে করজোড়ে করে প্রণিপাত।।
ত্রস্ত - ব্যস্ত রঘুনাথ উঠে বাড়ী 'পরে।
অপরূপ শোভা দেখে গৃহের ভিতরে।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আছে উপবিষ্ট।
কথা কয় হাসি হাসি মনে হয়ে হৃষ্ট।।
ধীরে ধীরে রঘুনাথ নিকটেতে যায়।
ভক্তি ভরে দণ্ডবৎ করে রাঙ্গা পায়।।
সুদৃষ্টে চাহিয়া তারে মহাপ্রভু কয়।
“কে আপনি কোথা ঘর দিন পরিচয়।।
কিবা হেতু দণ্ডবৎ করিলেন মোরে।
কি উদ্দ্যেশ্যে আগমন হল হেথাকারে ?
আসন গ্রহণ করি বলুন সকল।
আপনার দরশনে চিত্তে এল বল।।
শ্রী মুখের মধুবাণী শুনি রঘুনাথ।
আসন গ্রহণ করে জুড়ি দুই হাত।।
পথি মধ্যে মহাজনে যাহা বলিয়াছে।
ধীরে ধীরে সব কথা মনে জাগিয়াছে।।
বিপুল বিনয়ে তবে রঘুনাথ কয়।
“করিতেছি নিবেদন তব রাঙ্গা পায়।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম ভিন্ন দেশে ঘর।
বিভিন্ন কারণে দেখা চাহি আপনার।।
ঈশ্বরের কৃপাক্রমে আমি নিজ দেশে।
বিদ্যালাভ করি কিছু নিজ ঘরে বসে।।
শিক্ষা শেষে এই ভাব এসেছে অন্তরে।
বিদ্যার সমান বন্ধু নাহিক সংসারে।।
এই নমঃশূদ্র জাতি বিদ্যাহীন দোষে।
দলিত ঘৃণিত হয়ে আছে বঙ্গ দেশে।।
মনে মনে আমি তাই করিলাম ঠিক্।
যদি কিছু পেয়ে থাকি স্বজাতি তা' নিক্।।
উদ্দেশ্য সাধিতে আমি বহু দেশে ঘুরি।
স্বজাতি বোঝেনা তাহা এই দুঃখে মরি।।
ঘুরিতে ঘুরিতে আসি সেই ফরিদপুরে।
তব নাম শুনিলাম প্রতি ঘরে ঘরে।।
সবে বলে এই নাকি আপনার পণ।
'নমঃশূদ্র ঘরে ঘরে দিবে বিদ্যা ধন'।।
এই কথা শুনি প্রাণে আনন্দ হইল।
ভাবিলাম মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হল।।
শুভক্ষণে ওড়াকান্দী বলে যাত্রা করি।
আশ্চর্য দেখেছি কত সারা পথ ভরি।।
বাসুদেব নামধারী এক মহাজন।
তব পিতৃ - বন্ধু বলি করিল কীর্ত্তন।।
হরি - হর অভেদাত্মা যেমন প্রকার।
তব পিতৃসনে সেই ভাব ছিল তাঁর।।
যেদিন শ্রী হরি করে লীলা সম্বরণ।
সেই হ'তে এই দেশে না দেয় দর্শন।।
সাধক দম্পতি ছিল এই ওড়াকান্দী।
গুরু তার রাখে তাঁরে সেই ঘরে বন্ধী।।
নিজ পুত্র সম তোমা করে দরশন।
তব ঠাঁই আসিবারে বলে সেই জন।।
আশ্চর্য শক্তি তাঁর বুঝিবারে নারি।
পলকে অদৃশ্য হ 'ল বায়ু - ভর করি।।
মোরে বলে চিন্তা নাই নিশি গত হ'লে।
ওড়াকান্দী উপনীত হবে অবহেলে।।
প্রথমে বিশ্বাস নাহি হয় সেই কথা।
এবে দেখি তাহা ঠিক মোর চিন্তা বৃথা।।
অসম্ভব কার্য এই কেমনে ঘটিল।
এক রাতে এত পথ মোরে সে আনিল।।
এই নিবেদন মোর বলি তব ঠাঁই।
আপনার উপদেশ আমি এবে চাই”।।
সে রঘুনাথের বাক্য যবে শেষ হ 'ল।
'হায়' 'হায়' বলি প্রভু কান্দিয়া উঠিল।।
বলে “ধন্য মহাশয়! তুমি ভাগ্যবান।
নিজ চোখে দেখিয়াছ স্বয়ং ভগবান।।
দণ্ডবৎ করি তোমা সরল - পরাণ।
নিজে দেখা দিল তোমা, প্রভু হরিচাঁন।।
পিতামহ পিতামহী দুই জন মোর।
অবিরত কৃষ্ণ প্রেমে ছিল দোঁহে ভোর।।
“রামকান্ত “ নামে সাধু মহিমা অপার।
বাসুদেব ' মুর্ত্তি সেবা সাধনা তাঁহার।।
অকপট ভক্তিগুণে সাধক দম্পতী।
রামকান্তে করে ভক্তি দোঁহে নিতি নিতি।।
তাঁহে তুষ্ট রামকান্ত দিল সিদ্ধ বর।
জন্ম নিবে বাসুদেব ঘরেতে তোমার।।
হরিচাঁদ রূপে বাসুদেব জন্ম নিল।
তাঁর আগমনে ধরা পবিত্র হইল।।
দয়া করে তাঁর ঘরে জন্ম দিল মোরে।
তোমাকে বলেছে কথা শুধু ভাবান্তরে।।
দুই মাস পূর্ব্বে পিতা স্বপ্ন ঘোরে বলে।
পণ্ডিত আসিবে দেশে দুই মাস গেলে।।
সেই দুই মাস আজি উতরিয়া যায়।
মনে ভাবি পিতৃবাক্য কিসে রক্ষা হয়।।
তাঁর কাজ তাঁরে সাজে তাই তিনি করে।
তোমাকে আনিয়া দিল আমার গোচরে।।
তুমি ধন্য কর ধন্য বিদ্যা - শুন্য জাতি।
দয়া করে ওড়াকান্দী কর তুমি স্থিতি।।
শ্রী গুরুর মুখে শুনি সব বিবরণ।
কেন্দে বলে রঘুনাথ “ আমি অভাজন।।
পেয়ে ধন হারা হই এমন যে অন্ধ।
বুঝিলাম কৃপা বিনে ঘুচে না'ক সন্দ।।
তাঁর সব কথা আমি এবে বুঝিয়াছি।
যাহা ইচ্ছা কর প্রভু শরণ নিয়াছি।।”
এই ভাবে রঘুনাথ পণ্ডিত সুজন।
ওড়াকান্দী স্থিতি কৈল আনন্দিত মন।।
বারশ ' সাতাশী সনে অঘ্রাণ মাসেতে।
পাঠশালা হল সৃষ্টি চৌধুরী বাটীতে।।
একেত পণ্ডিত সাধু রঘুনাথ নাম।
তাহে শক্তি দিল গুরুচাঁদ গুণধাম।।
দলে দলে ছাত্র আসি সকলে জুটীল।
অন্ধকার মাঝে যেন আলোক ফুটিল।।
শ্রী শশিভূষণ যিনি প্রভু জ্যেষ্ঠ - পুত্র।
সেই পাঠশালে পড়ে বলি সেই সূত্র।।
ফাল্গুন মাসেতে সবে করিলেন মন।
অন্যস্থানে পাঠশালা করিতে স্থাপন।।
গৃহস্থের গৃহ পরে ' পাঠশালা -ঘর।
উচিৎ না হয় মনে বুঝে অতঃপর।।
গ্রাম্য মধ্যস্থল দেখি একটি ভিটায়।
পাঠশালা গৃহখানি নির্মাণ করয়।।
দীর্ঘ এক ঘর তাতে বাঁধি পোতাখান।
টিনের ছাউনি করি করিল নির্ম্মাণ।।
আসবাব পত্র যত তৈরী করিল।
শুভ দিনে স্কুল গৃহে সবে প্রবেশিল।।
প্রভু গুরুচাঁদ করে দ্বার উদঘাটন।
জয় ধ্বনি করে জুটি দেশবাশী গণ।।
জয় হরিচাঁদ কী গুরুচাঁদ কী জয়।
জয়ের হুঙ্কারে যেন ধরা ফেটে যায়।।
গুরুচাঁদ বলে “শুন ভাই যত সব।
জাতির উন্নতি কিন্তু এই সূত্রপাত।।
যাক্ ধন যাক্ মান তা'তে ক্ষতি নাই।
সব দিয়ে এই দেশে স্কুল রাখা চাই।।
স্ব - জাতি শিক্ষক এবে পাইয়াছি মোরা।
আর কিসে ভয় করি কিসে দুঃখ করা?
মোর পিতা হরিচাঁদ বলে গেছে মোরে।
বিদ্যা শিক্ষা স্বজাতিকে দিতে ঘরে ঘরে।।
বিদ্যা বিনা সব বৃথা দেখ মনে ভেবে।
বিদ্যা পেলে ধন মান সব কিছু পাবে।।
শুন স্বজাতির গণ সবে মনোকথা।
বিদ্যা শূন্য ধন মান সব জানো বৃথা।।
নমঃশূদ্র জাতি যদি বাঁচিবারে চাও।
যাক্ প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে লও।।
আমি বলি বিদ্যা শূন্য রবে যেই জন।
নমঃশূদ্র বলি তারে বলনা কখন।।
বিদ্যাবান যেই জন তাঁরে মান্য দাও।
বিদ্যার ভিত্তিতে সবে সমাজ গড়াও।।
যেই জন বিদ্যাবান পরম পণ্ডিত।
সমাজের পতি তারে মানিবে নিশ্চিত।।
বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যা ধর্ম্ম, বিদ্যা কর্ম্ম,অন্য সব ছার।।
বাঁচ বা না বাঁচ প্রাণে, বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন হ'লে বড় তার মূল্য নাই।।
বারে বারে বলি তাই স্বজাতির গণ।
শেখ বিদ্যা রাখ বিদ্যা করে প্রাণপণ “।।
এত যদি বলে প্রভু সভার ভিতর।
জনে জনে সবে মিলি করে অঙ্গীকার।।
“আজ হ'তে সবে মোরা অঙ্গীকার করি।
বিদ্যা ঘরে নিব তাতে বাঁচি কিবা মরি।।
ঘরে ঘরে জনে জনে করে আলোচনা।
প্রাণ দিয়ে কর সবে বিদ্যার সাধনা।।
প্রভুর চরণে করি এই নিবেদন।
মো ' সবার থাকে যেন সদা এই মন।।
দিনে দিনে মোরা সবে এই বুঝিয়াছি।
'হরিচাঁদে 'ঘরে পেয়ে ধন্য হইয়াছি।।
তাঁর ঘরে মহারত্ন গুরুচাঁদ তুমি।
পরম পবিত্র প্রভু তুমি অন্তর্যামী।।
ভয় নাই এ জাতির বুঝিয়াছি ঠিক।
যার যত মনে বলে ধন্য হয়ে নি'ক।।
জাতীয়তা পবিত্রতা একতার বাণী।
অন্ধকারে থেকে মোরা কিছু নাহি জানি।।
যেই শুভ দিনে এই জাতির ভিতর।
পরম দয়াল হরি হ'ল অবতার।।
সেই দিনে পুনর্জন্ম পেয়েছে এ জাতি।
দিনে দিনে হবে এর অবশ্য উন্নতি।।
ভাঙ্গা - বুকে এল আশা শূন্য-দেহে প্রাণ।
প্রাণ দাতা দয়াময় প্রভু হরিচান।।
ত্রেতা যুগে ক্ষাত্রজাতি সহেছিল কষ্ট।
কষ্ট দূর করেছিল রাম জগদিষ্ট।।
পরশুরামের হাতে ক্ষত্র নির্যাতিত।
দশরথ বাঁধা রয় প্রাণ ভয়ে ভীত।।
মান - দায় উভরায় কান্দে ক্ষত্রগণ।
সেই ঘরে জন্ম নিল রাম - নারায়ণ।।
পরশুরামের দর্প করিলেন চূর।
রামচন্দ্রে বলে ক্ষত্র প্রাণের ঠাকুর।।
দ্বাপরেতে জীবকুল কাঁদিয়া আকুল।
কৃষ্ণ রূপে করে লীলা যমুনার - কূল।।
বলদর্পী সবে হত কুরুক্ষেত্রে হল।
ধরা বলে ভার - হারী ধরাতে আসিল।।
যাহারে যে রক্ষা করে তাঁহারে সে ডাকে।
রাম নাম বিনা ক্ষত্র কিবা বলে থাকে?
'শ্রীকৃষ্ণ 'গৌরাঙ্গ ' আদি যত অবতার।
অন্য অন্য সম্প্রদায় করিল উদ্ধার।।
সরল কৃষক কুল সবে অবনত।
কোন অবতার নাহি করে দৃষ্টি পাত।।
এই সব অবতার বহু মহাজন।
বহুবিধ গ্রন্থ রাজি করেছে লিখন।।
ভক্ত বলি, সাধু বলি, বলি মুনি ঋষি।
বর্ণনা করেছে কত ভক্ত রাশি রাশি।।
পরিচয় সবাকার আছে সেই গ্রন্থে।
দলে দলে থরে থরে ফুল যথা বৃন্তে।।
আশ্চর্য ঘটনা সবে শুন দিয়া মন।
অবনত মধ্যে ভক্ত নাহি একজন।।
উচ্চকুলে জন্ম সবে ভক্ত পরিচয়।
নীচ কুলে জন্মে' কেবা ভক্ত কবে হয়?
সত্য বটে হরিদাসে ভক্ত বলি বলে।
ব্রহ্ম অংশে জন্ম নাকি যবনের কোলে।।
উপাধি করিল তারে ব্রহ্ম - হরিদাস।
নীচ জন উদ্ধারের কি হল প্রকাশ ?
ঝড়ু ভুঁইমালী বলি আর এক জন।
চরিতামৃতের মধ্যে রয়েছে লিখন।।
যবনের শাখা - জাতি ভুঁইমালী কয়।
যবন দেশের রাজা ছিল সে সময়।।
রাজ শক্তি ধারী যারা কিসে তারা হীন।
উচ্চ,নীচ সবে থাকে রাজার অধীন।।
রাজভয়ে যবনেরে নীচ নাহি বলে।
যবন তরিলে তা'তে নীচ কিসে তরে ?
চৈতন্যের মতে দেখি যত ভক্ত জন।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য আছে নিরূপণ।।
হীন বলি নীচ বলি যে সব - জনেরে!
দূর করি দিয়াছিল বনের ভিতরে।।
সেই সব সর্ব্বহারা মানুষের দল।
অবতার এলে তাঁরা কিবা পেল ফল।।
আর এক যুক্তি উঠে মনের ভিতর।
যার জাতি তার সাথী আর সব পর।।
উচ্চ বর্ণ বলি যাঁরা করেছিল গর্ব্ব।
কালের বিধানে দেখ আজি তারা খর্ব্ব।।
ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণে অবতার হয়।
যার যার ঘর সারি পরে ফাঁকি দেয়।।
যার জাতি তার সাথী তার যে আত্মীয়।
পর ঘর হ'তে হয় নিজ - ঘর প্রিয়।।
সকলে তারিতে যদি কেহ এসেছিল।
কিছু ধন্য হ'ল,অন্যে বাকি কেন র'ল?
অন্য ঘর ছিটে ফোঁটা নিজ ঘরে ঘড়া।
কেউ ধরে সুদর্শন কেউ সাজে নাড়া।।
যার যার তার তার পর - পাতে ছাই।
তারিতে সকল জনে কেহ আসে নাই।।
যেই উপকার করে তার দেয় দায়।
আপন নামের ডঙ্কা আপনি বাজায়।।
পিছনে পড়িয়া যাঁরা রয়েছে পতিত।
কেহ কভু করে নাই তাহাদের হিত।।
আর কত মনে পড়ে যুক্তি মিথ্যা নয়।
ব্যথিত না হ'লে সে কি ব্যথা বোঝে হায়!
ব্যথিতের ঘরে যদি আসে কোন জন।
সেইত বুঝিবে ব্যথা ব্যথিত কেমন।।
ব্যথিতের ঘরে এল শ্রী হরি ঠাকুর।
কৃপা করি ব্যথিতের ব্যথা কৈল দূর।।
ব্যথিতের হেন বন্ধু আর কেহ নাই।
প্রাণের - ঠাকুর তাই হরিচাঁদ সাঁই।।
ঘরে ঘরে জনে জনে কত কি বলেছে।
তাঁর শক্তি পেয়ে জাতি জাগিয়া উঠেছে।।
তরি 'বা না তরি 'তা'তে দুঃখ কিছু নাই।
শ্রী হরি - চরণ সার কর সবে ভাই।।
ঘরে ঘরে সভা করি সবারে জানাও।
এসেছ দয়াল মাঝি তরী খুলে দাও।।
সবে মিলি পরামর্শ করিল সভায়।
ঘরে ঘরে এই বার্ত্তা দিতে যেতে হয়।।
প্রতি জেলা প্রতি ঘরে জাগাও চেতনা।
ঘরে ঘরে এই বাণী করহে রটনা।।
স্থির হল সভা হবে খুলনা জেলায়।
দত্তডাঙ্গা নামে গ্রামে ঈশ্বর আলয়।।
শ্রাদ্ধ কার্যে জ্ঞাতি ভোজ বৃহৎ আকারে।
ঈশ্বর গাইন নামে সেই ব্যক্তি করে।।
দেশে বা বিদেশে যত নেতৃবর্গ ছিল।
সেই বাটি হতে পত্র সবাকে পাঠাল।।
প্রথম 'জাতীয় সভা ' সেই বাড়ী হল।
ক্রমে ক্রমে সেই বার্ত্তা কহিব সকল।।
জাতি ছিল দুঃখে - জারা বন্ধু নাহি ছিল।
'গুরুচাঁদ' বন্ধু হয়ে সে ঘরে আসিল।।
চাঁদের কিরণ লাগে সকলের গায়।
মহানন্দ অন্ধকারে বসে অন্ধ রয়।।
নমঃশূদ্র সভা - ১২৮৭ বঙ্গাব্দ
শ্রী হরি চাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
নমঃশূদ্র বলে সবে “আর ভয় নাই।।
রোগ-শোক-দুঃখ-ব্যথা-জ্বালা অপহারী।
পরম দয়াল রূপে এসেছে শ্রী হরি।।
তারিতে কাঙ্গাল জনে বুকে দিতে আশা।
অন্ধ প্রাণে দিতে আলো মূক মুখে ভাষা।।
পিছে -পড়া নিস্বঃদল বুকে - ভরা ব্যথা।
কেহ বুঝে নাই তার মরমের কথা।।
মরা - দেহে দিতে প্রাণ জাগাতে সবারে।
প্রাণদাতা-হরি এল সফলানগরে।।
অসীম - তত্ত্বেতে -ভরা মানব - জীবন।
মর্ম্মকথা ঘরে ঘরে করে বিতরণ।।
“বলহীনে নাহি পায় আত্মার সন্ধান “।
কোন বলে তারে পাবে কহে মতিমান।।
'পবিত্র - চরিত্র কহে মূলভিত্তি তার।
সত্যবাক্য নামে-রুচি জান ' পরস্পর।।
জীবে দয়া পর নারী মাতৃতুল্য - জ্ঞান।
মানুষেতে - নিষ্ঠা কহে তত্ত্বের প্রধান।।
আশা - হারা ছিল যত শুনি সেই বানী।
আপনা বিলায়ে পূজে চরণ দু 'খানি।।
বিশ্বজয়ী - মন্ত্র যেন সবে পেল বুকে।
পতিত - পাবন হরি বলে তাঁরে ডাকে।।
অবতার মধ্যে দেখি এই কার্য ধারা।
প্রেমের তরঙ্গ তুলি চলে যায় তাঁরা।।
সে তরঙ্গে ডুবে যায় কত জনপদ।
জীব তাহে ডুবি পায় পরম আহ্লাদ।।
সে তরঙ্গ - গতি - বেগ কভু না থামিবে।
অনন্ত কালের বুকে বহিয়া চলিবে।।
যেই ঢেউ তুলে গেছে প্রভু রামচন্দ্র।
তাহে পুনঃ বেগ দিল বিভু কৃষ্ণ চন্দ্র।।
নবীন - ভাবের ঢেউ বুদ্ধ দেব তোলে।
মহা ভাব তোলে গোরা হরি হরি বলে।।
যে যে যুগে যতটুকু হয় প্রয়োজন।
সেই শক্তি নিয়ে আসে জগত - তারণ।।
অসীম শক্তির কেন্দ্র মানবের মন।
যুগে যুগে পলে পলে হয় বিবর্ত্তন।।
কলি হতে ফুল যথা ফুটে ধীরে ধীরে।
মানবের মন-পুস্প ফোটে সে প্রকারে।।
বিকাশের ধারা তার ক্রমে বেড়ে যায়।
পরিনতি পেলে তার বৃদ্ধি নাহি হয়।।
যত ফুল বাড়ে সে যে আলো তত চায়।
কলিতে কুসুম এই ব্যবধান রয়।।
আদি হতে অদ্যাবধি যত অবতার।
এই ধারা ক্রমে দেখি বিকাশ সবার।।
আদি পুরুষের রূপে রাম অবতার।
আপন জীবনে করে মানব - আচার।।
জীবে ভাবে এই ধর্ম্ম প্রভুতে সম্ভবে।
মানবের পক্ষে চেষ্টা শুধু বৃথা হবে।।
তাই দেখি সেই যুগে রাম ভক্ত যত।
প্রাণপণে হল বটে রাম - অনুগত।।
যে ধর্ম্ম আনিল রাম শিখাবার তরে।
মনে প্রাণে মানিল না তাহা কোন নরে।।
মানবের ধর্ম্ম তাহা বুঝাবার জন্য।
মথুরাতে কৃষ্ণ চন্দ্র হ 'ল অবতীর্ণ।।
নর - শ্রেষ্ঠ মহীপাল যুধিষ্ঠির বীর।
তাঁরে কেন্দ্র করি ধর্ম্ম শিখায় সুধীর।।
রাজা যেই ধর্ম্ম পালে প্রজা নাহি বুঝে।
'ধর্ম্ম ' বদ্ধ রহে শুধু রাজার সমাজে।।
জ্ঞান - অবতার বুদ্ধ নব যুগ আনে।
রাজা প্রজা সবে মাতে অহিংসার গানে।।
সবে একাকার হ'ল পেয়ে তাঁর শিক্ষা।
আসমুদ্র - হিমাচল নিল এক দীক্ষা।।
দেশে দেশে সাম্যনীতি হ 'ল পরচার।
মনে হল বিশ্ব বাসী হবে একাকার।।
কুটিল কলির চক্র বুঝা বড় দায়।
ব্রাহ্মণ্য - ধর্ম্মের ছলে সে কলি দাঁড়ায়।।
হিংসা দ্বেশ দ্বন্দ - নীতি আনে ঘরে ঘরে।
আর্য ম'ল হিন্দু হ'ল বীর্য গেল মরে।।
বিমাতা সাজিয়া হিন্দু বৌদ্ধ দূরে দিল।
যশোদার মত তারে অন্য দেশে নিল।।
মহাচীন জাপানেতে যত জাতি রয়।
বৌদ্ধ নীতি মানে তাঁরা বীর পরিচয়।।
নিজ দেশে বৌদ্ধ ধর্ম্ম স্থান নাহি পেল।
পর - দেশে বীর্য গুণে নৃপতি সাজিল।।
বৌদ্ধ ধর্ম্মে মুক্তি-মন্ত্র তারা সবে পায়।
ব্রাহ্মণ্য - ধর্ম্মের তলে ভারত ঘুমায়।।
জগতের আদি গুরু আর্য ঋষি যাঁরা।
ভারতের বুকে পেল অধরাকে ধরা।।
চারি - স্তম্ভ পরে যেই সমাজ গড়িল।
ধর্ম্ম - ভিত্তি ' পরে তারে উচ্চ চূড়া দিল।।
সেই ধর্ম্ম - ভিত্তি পরে ভেঙ্গে দিল যারা।
এ দেশের পতনের মূল হ'ল তারা।।
সেই যে ভেঙ্গেছে ভিত্তি আর জুড়ে নাই।
দিনে দিনে ভারতের অবনতি তাই।।
কৃষ্ণ আসি গোরা আসি অনেক কহিল।
বলাবলি সার হল ভিত্তি ফাঁক র'ল।।
গার্হস্থ্য - আশ্রমে ধরি নরকুল বাঁচে।
গৃহীকে করিয়া ভর সকলে রয়েছে।।
তাই দেখি গৃহ ধর্ম্ম সকলের মূল।
এই খানে বুদ্ধদেব করিলেন ভুল।।
এই ভুল এত কাল সারা নাহি হল।
ভুল সেরে মুক্তি দিতে হরিচাঁদ এল।।
গার্হস্থ্য আশ্রমে ভিত্তি করিল জীবনে।
সর্ব্ব শক্তি লভ্য হয় সে ধর্ম্ম পালনে।।
বিশ্ব ভরা নরকুলে আছে যে যেখানে।
গৃহ - ছাড়া বল দেখি আছে কয় জনে।।
শাস্ত্র - গ্রন্থ পুরাণাদি বহুৎ প্রমাণে।
গৃহাশ্রম সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সবে ইহা জানে।।
হরি লীলামৃত গ্রন্থে কবি রসরাজে।
যাহা কহে তাহা কহি সাধুর সমাজে।।
“গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।। “
গৃহী জনে দিতে মুক্তি হরি অবতার।
ব্যথিতের ঘরে জন্মে সফলা নগর।।
পূর্ব্ব পূর্ব্ব অবতারে প্রভু যা করিল।
উত্তর সাধক তার কেহ নাহি ছিল।।
ঢেউ তুলে যায় প্রভু আপনার লোকে।
ঢেউ চলে নিজ মতে জীব পিছে থাকে।।
উত্তর - সাধক তাই লাগে তাল দিতে।
উত্তর - সাধক হরি নিয়ে এল সাথে।।
আর দেখ নরাকারে করে যত কর্ম্ম।
নরাকারে পালে প্রভু মানবের ধর্ম্ম।।
আধি-ব্যাধি-জ্বরা-মৃত্যু সবার অধীন।
দীনবেশে থাকে যেন দীনেরও দীন।।
আপনারে ধরা দিতে প্রভু নাহি চায়।
দেখা দিয়ে ঢেউ তুলে তাই চলে যায়।।
তাঁরে দেখে যার মন হয়েছে পাগল।
ছুটে ছুটে খুঁজে তারে প্রেমেতে বিভোল।।
কিবা সেই কয়ে গেল কিবা দিয়ে গেল।
সে ধার ধারেনা যত ভাবের পাগল।।
মনোহরা রূপ দেখে মন ভুলে যায়।
রূপের তরঙ্গে পড়ি সাঁতার খেলায়।।
এ হেন জনের নহে গৃহস্থের ধর্ম্ম।
সে কেন বুঝিতে যাবে গৃহ-ধর্ম্ম-মর্ম্ম।।
রূপের পাগল চলে রূপের প্রবাহে।
সে ভাব না বুঝে গৃহী পিছে পড়ে রহে।।
তাই তত্ত্ব বুঝাবারে লাগে কোন জন।
উত্তর সাধক এবে শ্রী গুরুচরণ।।
পুত্র রূপে জন্ম নিল হরিচাঁদ - ঘরে।
পিতৃ-ধর্ম্ম-মর্ম্ম কথা শিখাল জীবেরে।।
যবে হরিচাঁদ আসি অবতীর্ণ হল।
তার রূপে বাধ্য কত পাগল সাজিল।।
গৃহ - ধর্ম্ম ছার বলি গৃহ ছেড়ে দিল।
রসরাজ হরি-পদে প্রাণ সমর্পিল।।
গোলক,বদন,আর বীর হীরমন।
বিশ্বনাথ শ্রী অক্ষয় আর শ্রী লোচন।।
নটবর, ব্রজনাথ, শ্রী রাম ভরত।
এই রূপ কত জন নাম ক'ব কত।।
রূপের পাগল এরা প্রেমের কাঙ্গাল।
গৃহাশ্রমকে গণ্য করে বড়ই জঞ্জাল।।
হরিচাঁদ - রূপ প্রভু যবে লুকাইল।
এই সব ভক্ত প্রায় উদাসী হইল।।
বিরহ - বেদনা যেবা সহিতে না পারে।
দেহ - তরী দিয়ে পাড়ি গেল ভবপারে।।
সবাই না হতে পারে গোলক পাগল।
গৃহীজনে আছে কত বিষয়ের গোল।।
এ আদর্শ সবজনে নিতে নাহি পারে।
গৃহীর আদর্শ তাই এল প্রভু - ঘরে।।
ঘর - ছাড়া ভোলানাথ গৃহস্থ সাজিল।
হরিপুত্র গুরুচাঁদ - রূপে জনমিল।।
মনের গঠন প্রভু প্রথমে করিল।
গুরুচাঁদ - রূপে গৃহ - ধর্ম্ম শিক্ষা দিল।।
গৃহস্থ জনের পক্ষে যাহা প্রয়োজন।
সর্ব্ব নীতি শিক্ষা দিল শ্রী গুরুচরণ।।
কঠোর সংযমে রাখি চরিত্র পবিত্র।
গৃহস্থ - আশ্রমে করে সেই মূল সুত্র।।
ধর্ম্ম নীতি কর্ম্মনীতি রাজনীতি যত।
ঘরে ঘরে জনে জনে কহে অবিরত।।
বিদ্যা হীন সমাজের কোন গতি নাই।
“বিদ্যা শেখ বিদ্যা শেখ “ বলিলেন তাই।।
স্ব - সমাজে দোষ ত্রুটি যত কিছু ছিল।
দূর করিবারে প্রভু মনস্থ করিল।।
ঘরে ঘরে আন্দোলন প্রয়োজন হল।
“সভা কর সভা কর “প্রভুজী হাঁকিল।।
একসাথে সবে মিলি করিল মন্ত্রণা।
একতা থাকিলে যাবে সকল যন্ত্রণা।।
'এক ঠাঁই বস ভাই ' প্রভু ভীর দিল।
প্রভুর ইচ্ছাতে সভা দত্ত ডাঙ্গা হল।।
এবে সেই সভা আমি করিব বর্ণন।
“জয় গুরুচাঁদ “ ধ্বনি - কর সর্ব্বজন।।
সভা বার্তা
এক হবে নমঃশূদ্র ধনী মানী জ্ঞানী ক্ষুদ্র
এ বারতা গেল ঘরে ঘরে।
যেই শোনে সেই কয় একি কাণ্ড মহাশয়
হেন কার্য কিসে হ'তে পারে?
যার যার তার তার আছি মোরা পরস্পর
নিজ দেশে নিজ ভাব লয়ে।
একতা হবে কিসে বাস করি ভিন্ন দেশে
ভিন্ন - ভাব ভিন্ন - ভাষা ক'য়ে?
জ্ঞানী গুণী সাধু যারা সবে কহিলেন তারা
এই কথা ঠিক নাহি বল।
সবে এক জাতি মোরা হাতে হাতে হাত-ধরা
সভা স্থলে চল সবে চল।।
স্ব- জাতি প্রধান যত সব হও একত্রিত
হেন শুভ দিন কি গো পাবে ?
চল চল চল ভাই বৃথা তর্কে কাজ নাই
তীর্থ ফেলে কেন ঘরে র'বে ?
শুনিয়াছি এই বার্ত্তা আসিবেন বড় কর্ত্তা
হরি পুত্র গুরুচাঁদ নাম।
মহাধনী মহা গুণী সমাজের শিরোমণি
রূপে গুণে তিনি অনুপম।।
হরিচাঁদ পিতা তাঁর যিনি ছিল অবতার
ভাগ্য গুণে এল এই ঘরে।
কিবা বলে বড় কর্ত্তা শুনে আসি সেই বার্ত্তা
দেখি দুঃখ যায় নাকি দূরে।।
দলে দলে লোক ধায় আসে দত্ত ডাঙ্গা গাঁয়
শ্রী ঈশ্বর গাইনের বাড়ী।
মহা ধনবান তিনি অশেষ গুণেতে গুণী
দেশ মধ্যে আছে জমিদারী।।
অভয় চরণ নাম তস্য পুত্র গুণধাম
দেশ মধ্যে মান কৈল কত।
তার পঞ্চ পুত্র জানি ধনী মানী সবে গুণী
পর উপকারে সদা রত।।
ভবানী শঙ্কর যিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র হন তিনি
বিবাহ করিল ওড়াকান্দী।
শশিভূষণের কন্যা রূপে গুণে অতি ধন্যা
গাইন ঠাকুরে হ'ল বন্ধি।।
আদি সভা এই ঘরে নমঃশূদ্র মিলি করে
নেতৃ বর্গ সবে আসি মিলে।
ফরিদপুর খুলনা কেহ বাকী ছিল না
যশোহর বরিশালে চলে।।
যজ্ঞেশ্বর রামতনু সুন্দর সুঠাম তনু
ওড়াকান্দী গোমস্থা যে ছিল।
স্ব স্ব দেশে স্ব - প্রধান এই দুই ভাগ্যবান
প্রভু সনে দত্ত ডাঙ্গা এল।।
শ্রী বিধুভূষণ নাম ওড়াকান্দী যার ধাম
চৌধুরী বংশেতে বংশপতি।
তারিণী পোদ্দার যিনি গোব্ রা নিবাসী তিনি
দত্ত ডাঙ্গা এল হৃষ্ট - মতি।।
বাস করে কালিয়ায় ধন্য জগন্নাথ রায়
সরদার আদি পরিচয়।
পাটগাতি গ্রামে ঘর ধনী যেন জমিদার
মণ্ডল উপাধি তারা কয়।।
দ্বারিক মণ্ডল নাম রূপে গুণে অনুপম
দত্ত ডাঙ্গা আসি পহুছিল।
বরিশাল জিলা বাসী গ্রামের নাম চাঁদসী
কেশব ডাক্তার সেথায় এল।।
যশোহরে পারখালী যত বাড়ৈ বংশাবলী
সেই দেশে বাস করে সুখে।
সে - বংশে প্রধান যিনি সভা মধ্যে এল তিনি
যুক্তি পূর্ণ কথা তার মুখে।।
নব কৃষ্ণ যার নাম পাটকেল বাড়ী ধাম
তথা বাস করে মহাতেজে।
নিমন্ত্রণ পেয়ে যায় সেই ধনী মহাশয়
যথাযোগ্য মাননীয় সাজে।।
নড়াইল জমিদার তুলনা মিলেনা যার
তস্য গৃহ - সন্নিকটে বাস।
আদালতে কাজ করে মান্য আছে দেশ ভরে
নাম তার পিয়ারী বিশ্বাস।।
নিমন্ত্রণ যবে পান দত্ত ডাঙ্গা অধিষ্ঠান
হ'ন সেই গুণী মহাশয়।
রঘুনাথ সরকার থাকে ওড়াকান্দী পর
সভা লাগি দত্ত ডাঙ্গা যায়।।
বড়বেড়ে গ্রামে ঘর পোদ্দার উপাধী যার
রামধন নামে মহাধনী।
হরিদাস পুর গাঁয় হীরা বংশে জন্ম লয়
যুধিষ্ঠির নামে হ'ন যিনি।।
গোপীনাথপুর বাসী চৌধুরী কুলেতে শশী
দেব নারায়ণ যার নাম।
রামলোচন বিশ্বাস রাউৎ খামারে বাস
বহু কার্য করে গুণধাম।।
সাচিয়া দহেতে রয় বিশ্বাস উপাধি কয়
শ্রী উমাচরণ মহাশয়।
ময়মনসিংহে বাস রামনাথ বিশ্বাস
স্কুল করে সে ঘোনা পাড়ায়।।
দ্বারিক মোক্তার কয় মান্যবান অতিশয়
কুতূহলে যায় দত্তডাঙ্গা।
ভাগ্যবান তিনি অতি স্বজাতির প্রতি প্রীতি
বাস করে শহর যে ভাঙ্গা।।
নমঃকুলে মহারথী ছিল যত ইতি উতি
হৃষ্ট মতি সবে যায় চলে।
ওড়াকান্দী হতে প্রভু তার মধ্যে যেন বিধু
সভাপানে ধায় দল বলে।।
সঙ্গে চলে যজ্ঞেশ্বর সঙ্গে নিয়ে যজ্ঞেশ্বর
গুরুচাঁদ রূপে মহেশ্বর।
শ্রী বিধু ভূষণ ধায় তেজে যেন সিংহ - ধায়
প্রভুর সম্মুখে জুড়ি কর।।
নিজাম কান্দিতে ধাম যাদব বিশ্বাস নাম
প্রভুর তরণী পরে ওঠে।
যাদব মল্লিক নাম অতিশয় গুণধাম
প্রভু সঙ্গে চলে কর পুটে।।
মহেশ বেপারী যিনি সাধকের শিরোমণি
মাঝি সাজি বসে হা 'লে গিয়ে।
“শ্রী হরি চাঁদের জয় “ পতাকাতে লেখা রয়
আগা' নায়ে দিল তা ' উড়ায়ে।।
অনুমান বিশ জন একত্রে করে গমন
যাত্রাকালে হরিধ্বনি দিল।
পুরবাসী হতে নারী সুকন্ঠে সুরব করি
হুলুধ্বনি সকলে করিল।।
যে - পথে তরণী চলে নর নারী দলে দলে
ঘাটে আসি সন্মান জানায়।
নরে বলে হরি হরি হুলুধ্বনি করে নারী
ধান্য দূর্ব্বা কেহ শিরে দেয়।।
চন্দন বাঁটিয়া কেহ সাজায় প্রভুর দেহ
মাল্যদান কেহ করে গলে।
একে'ত সুন্দর চাঁদ মনোহর গুরুচাঁদ
ফুল সাজে ভরাচাঁদ চলে।।
নয়নে নেহারে যেই সেই বলে ' নেই নেই '
“মন প্রাণ কিছু মোর নাই।
কিবা রূপ দেখিলাম! দেখিয়া যে মজিলাম!
মনে বলে সাথে সাথে যাই।।
কোথা ছিল ঢাকা রূপ ভরিয়া নয়ন কূপ
মরমের মণি- কোঠা ভরে।
অফুরন্ত রূপ রাশি কোথা লাগে রবি শশী
কোটী কোটী পদে আছে পড়ে।।
অধরে মধুর হাসি মুক্তা যেন রাশি রাশি
গলে 'গলে ' পড়ে ধরাতলে।
চাহিলে নয়ন পানে হেন ভাব হয় মনে
জন্মে জন্মে রহি পদ তলে।।
হাসি হাসি কথা কয় মন প্রাণ কাড়ি লয়
সুধা যেন ঝরে মুখ হতে।
যেই দেখে সেই ভোলে ভাসিয়া নয়ন জলে
বলে “প্রভু! রাখ চরণেতে।।
অপরূপ রূপ হেরি যত সব নরনারী
বলে সবে এ কোন মানুষ।
রূপ আছে কায়া নেই মনে হয় এই সেই
হরিচাঁদ সহজ পুরুষ।।
তাঁরে দেখিয়াছি সবে তুল্য - রূপ এই ভবে
আর কোথা মোরা দেখি নাই।
সেই রূপ সেই ভাব তার কান্তি সে - স্বভাব
এই মানুষেতে মোরা পাই।।
এ যেন সে হরিচাঁদ হয়ে এল পূর্ণ চাঁদ
নব ভাব - রূপ কান্তি লয়ে।
নবীন বয়স দেখি করুণ কোমল আঁখি
হরি- রূপে রয়েছে মিশিয়ে।।
দীন বেশে ছিল হরি সেই রূপ পরিহরি
রাজ বেশে এল মহারাজ।
মনে তাঁর কিবা আছে জানা সব যাবে পিছে
কোন লাগি' পরে রাজ সাজ।।
সবে এই মত কয় তরণী চলিয়া যায়
মঙ্গল আরতি গাহে ভক্ত।
মহেশ বসিয়া হা'লে হরি বলে হেলে দুলে
গুরুচাঁদ - পদে অনুরক্ত।।
পূর্ব্বেতে নিয়ম ছিল আসিলে শরৎ কাল
বিজয়ার দিনে করি যাত্রা।
দ্বিগ্বিজয় করিবারে সাঙ্গ পাঙ্গ সঙ্গে করে
রাজ গণে দিত জয় - বার্ত্তা।।
দিকে দিকে জয় জয় প্রজাগণে সবে কয়
রাজা চলে মনের আনন্দে।
কবি - কুল সেই কথা ছন্দে বাঁধে করি গাঁথা
রাখে সব পুরাণ - প্রবন্ধে।।
বিজয়ার অভিযান হ'ত রাজা আগুয়ান
দেশে দেশে জয় পত্র পায়।
ফিরিয়া আপন ঘরে মহোল্লাসে যজ্ঞ করে
বীর গাঁথা ঘরে ঘরে কয়।।
দেখি এই শোভা যাত্রা মনে পড়ে গেই বার্ত্তা
গুরুচাঁদ রাজ রাজেশ্বর।
শুভ যাত্রা করি যায় সাঙ্গ পাঙ্গ সঙ্গে রয়
শুভ্র কান্তি শুদ্ধ কলেবর।।
যে পথে তরনী চলে উচ্চ কন্ঠে জলে স্থলে
গায় সবে মঙ্গল আরতি।
তরি চলে কল কল আঁখি করে ছল ছল
দলে দলে করিছে প্রণতি।।
বিল ছাড়ি তবে তরী মধুমতি-বক্ষ ধরি
মহাবেগে চলিল দক্ষিণে।
যেই দেখে সেই কয় এই নায় কেবা যায়
জয় ধ্বনি করে নাম শুনে।।
কেন জয় ধ্বনি করে কেহ না বুঝিতে পারে
মনের আগল গেছে খসি।
তীর বেগে তরি ছুটে বসিয়া নদীর তটে
একি কাণ্ড! সবে ভাবে বসি।।
পরদিন শুভ প্রাতে তরণী লাগিল ঘাটে
দত্তডাঙ্গা ঈশ্বর - আলয়।
প্রভু আগমন শুনি ধনী মানী মূর্খ জ্ঞানী
সবে আসি ঘাটেতে উদয়।।
কি ছিল প্রভুর মনে কেবা বল তাহা জানে
ঘাটে যবে লাগিল তরণী।
উঠি ছাপ্পরের পরে প্রভু পদ্মাসন করে '
স্থির হয়ে বসিলা অমনি।।
ডগ - মগ উঠে রবি ভুবন - মোহন ছবি
রক্তচ্ছটা ছুটিয়া আসিল।
সবে বলে একি হায় রবি ছুটে পড়ে নায়
শূন্য ছাড়ি ভূতলে নামিল।।
রবি আজ কোনখানে ভূতলে কিংবা গগনে
জ্ঞান - হারা হয়ে সবে কয়।
নৌকায় যে রূপ রাশি কোথা পাবে রবি শশী
তারা যেন পদতলে রয়।।
সবে বলাবলি করে ' এ মানুষ কোথা ছিল রে
রাজ বংশে রাজার তনয়।
ব্যথিত নমঃর ঘরে আসিল কেমন করে
অসম্ভব বুঝিনু নিশ্চয়।।
ভাগ্যবান যারা যারা স্বচক্ষে দেখিল তারা
গুরুচাঁদ - পদে জ্যোতিঃ ফুটে।
'জয় গুরুচাঁদ জয়' আকাশে বাতাস কয়
পড়ে সবে ভূমি তলে লুটে।।
পূর্ণ - ব্রহ্ম পুর্ণানন্দ বিশ্ব গুরু গুরুচন্দ্র
প্রেম মকরন্দ দিতে এল।
গুরুচাঁদ এল ঘাটে সকলে চরণে লুটে
মহানন্দ পিছে পড়ে র'ল।।
সভা আয়োজন
বিনয়ে ঈশ্বর কহে গুরুচাঁদ ঠাঁই।
“দয়া করে তীরে চল এই ভিক্ষা চাই।।
তব আগমনে ধন্য আলয় আমার।
আমার সৌভাগ্য বল কিবা আছে আর?
তব পিতা ভাগ্যবান শ্রী হরি ঠাকুর।
উদ্ধারিল জগতের অনাথ আতুর।।
নমঃশূদ্র সবে ধন্য সে রতন পেয়ে।
মনক্ষুণ্ণ এবে, সবে রতন হারায়ে।।
তবু শান্তি পাই মনে তুমি ত রয়ে'ছ।
নমঃশূদ্র উদ্ধারিতে কত না করেছ।।
তব তুল্য কেহ নাই এ নমঃকুলে।
তুমি ত নমঃর রাজা বুঝিনু সকলে।।
পিতা যাঁর ধর্ম্মরাজ প্রভু হরিশ্চন্দ্র।
শিরে তাঁর রাজছত্র বুঝিলাম মর্ম্ম।।
মম গৃহে হয় সভা তোমার ঘটনা।
দয়া করে গৃহে গিয়ে পূরাও বাসনা।।'
ঈশ্বরের স্তুতি বাণী গুরুচাঁদ শুনি।
নামিলেন ভূমিতলে ছাড়িয়া তরণী।।
সাঙ্গ পাঙ্গ চারিধারে চলে সারি সারি।
শ্রী হরি বলিয়া সবে করি শ্রী হরি।।
চলেছেন গুরুচাঁদ বাড়ীর উপর।
কেমনে বর্ণিব শোভা অতি মনোহর।।
রাজতুল্য ব্যক্তি বটে ঈশ্বর গাইন।
রুপি'ছে কদলী বৃক্ষ করিয়া লাইন।।
থরে থরে ফুলরাশি শোভে মাল্য কারে।
দেবদারু - পত্র দোলে তাহার ভিতরে।।
ঘাট-সন্নিধানে দ্বার অর্দ্ধৃ বৃত্তাকারে।
মঙ্গল কলসী শোভে উভে দুই ধারে।।
সিংহদ্বার - সম দৃশ্য সু - উচ্চ প্রাচীর।
পত্র পুস্প আচ্ছাদিত অতি সুগম্ভীর।।
এই রূপ চারিস্থলে চারিটি দুয়ার।
চলে গেছে রাজপথ তাহার ভিতর।।
ধীরে চলে গুরুচাঁদ শিরে ছত্র ধরি।
পাশে পাশে চলিছেন শ্রী বিধু চৌধুরী।।
মন্ত্রীবর যজ্ঞেশ্বর তার পিছে চলে।
হাতে - হাত ধরি রামতনু কথা বলে।।
সবার অগ্রেতে পথ দেখায় ঈশ্বর।
চারিদিকে উঠে ধ্বনি জয় জয়কার।।
ঠেলাঠেলি ফেলাফেলি চলে চারিভিতে।
সবে চায় গুরুচাঁদে একটু দেখিতে।।
রূপ দেখি পালটিতে নাহি পারে আঁখি।
নারীগণে হুলুধ্বনি করে থাকি থাকি।।
জয় হরিচাঁদ জয় সর্ব্বলোকে কয়।
জয় গুরুচাঁদ ধ্বনি উঠিল সভায়।।
বাড়ী ' পরে গুরুচাঁদ উদয় হইল।
সু-শ্বেত বিছানা করি বসিবারে দিল।।
নাট-মণ্ডপেতে বসে দয়াল ঠাকুর।
ঘর বেড়ি হুড়া-হুড়ি হ'তেছে প্রচুর।।
সবে বলে ' পথ ছাড় মোর দেখা চাই।
এমন মোহন-রূপ আর দেখি নাই।।
এই রূপ চোখে যদি নাহি হল দেখা।
বৃথাই জীবন মোর শুধু বেঁচে-থাকা'।।
কিসে যেন ভুলায়েছে যত নর -নারী।
কেহ বলে 'হরিপুত্র' কেহ বলে 'হরি'।।
যেমন যাহার মন সেই দেখে তাই।
শুধু মাত্র শব্দ শুনি 'তারে দেখা চাই'।।
এই ভাবে বেলা হল প্রথম প্রহর।
জলযোগ করে প্রভু গৃহের ভিতর।।
ভিড় কিন্তু নাহি কমে ক্রমে বেড়ে যায়।
কেবা মানা করে তা'তে কেবা কান দেয়।।
গগনে হইল বেলা দ্বিতীয় প্রহর।
স্নান করি গুরুচাঁদ করেন আহার।।
উপস্থিত লোক যত আহারাদি কৈল।
সভা করিবারে সবে সভাগৃহে গেল।।
সভা দৃশ্য বর্ণনা
অপূর্ব্ব সভা - মণ্ডপ, উর্ধ্বে শ্বেত চন্দ্রা তপ
মধ্যে তার রক্ত - পদ্ম আঁকা।
চারিদিকে চারি দ্বার, দেখি অতি মনোহর
মঙ্গল কলসী পদে রাখা।।
পুতিয়া কদলী বৃক্ষ, পুস্প তাহে লক্ষ লক্ষ
মধ্যে তার দেবদারু পত্র।
বৃত্তাকারে দ্বার - শির, দাঁড়াইয়া রহে স্থির
শিরে যেন ধরিয়াছে ছত্র।।
সভার উত্তর দিকে, চারিটি পালঙ্ক রেখে
ঢাকে তাহা সত রঞ্চি দিয়া।
তার' পরে কাষ্ঠাসন, ঠিক যেন সিংহাসন
শ্বেত - বস্ত্রে রেখেছে মুড়িয়া।।
সম্মুখ ভাগেতে তার, কিবা শোভা মনোহর
টেবিল রাখিল সাজাইয়া।
ফুলদানী দুই ধারে, রাখিয়াছে ফুল ভরে
গন্ধ ছুটে বাতাস ভরিয়া।।
সম্মুখ ভাগেতে তার, শয্যা অতি পরিস্কার
বিস্তৃত প্রাঙ্গণ জুড়ি রহে।
ইন্দ্র - সভা তুল্য শোভা, পত্র পুস্পে মনোলোভা
'ধন্য সভা 'সবে ডাকি কহে।।
কাষ্ঠাসন বহুতর, রেখেছে মঞ্চের পর
আরো বহু সভা বেড়ি রহে।
জ্ঞানী গুণী নেতা যারা, মঞ্চের উপরে তারা
স্তব্ধ থাকি কথা নাহি কহে।।
যথা - যোগ্য স্থান লয়ে, বসে সবে ঠিক হয়ে
হেনকালে উঠে জয় ধ্বনি।
পঞ্চ - সহস্র প্রমাণ, লোক হবে অনুমান
দেব - সভা তুল্য সভা গণি।।
আসিলেন গুরুচাঁদ, সঙ্গে যত পারিষদ
হুলুধ্বনি জয় ধ্বনি উঠে।
যবে আগুয়ান হন, সভাশুদ্ধ লোকজন
দাঁড়াইল সবে কর পুটে।।
ছিল কত তর্ক বাদী, মনে মনে ছিল বাদী
দেখি গুণনিধি রহে চুপ।
উজ্জ্বল বরাঙ্গ কায়, তরুণ - তপন - প্রায়
মুগ্ধ সবে দেখি সেই রূপ।।
যবে সভা প্রবেশিল, এই মত ভাব হল
দাঁড়াইয়া সবে রহে স্থির।
হস্ত উত্তোলন করি, হৃদয়ে শ্রী হরি স্মরি
ক্ষণেক নমিয়া নিজ শির।।
গুরুচাঁদ বলে কথা, ' শুনহে স্বজাতি ভ্রাতা
আজি দেখ বড় শুভ দিন।
আরম্ভ হইবে সভা, সভা হবে মনোলভা
কেহ আজি হ'য়োনা মলিন।।
মনোগত যত কথা, সবে আজি কহ হেথা
মনোব্যথা কর অবসান।
এতকাল মহাদুঃখে, কথা নাহি ছিল মুখে
বলে কথা জুড়াও পরাণ।।”
এই বাণী শেষ করি, বসিলা আসন পরি
গুরুচাঁদ প্রভু দয়াময়।
দ্বারিক মোক্তার যিনি, সভাতে দাঁড়ায়ে তিনি
ধীরে ধীরে এই কথা কয়।।
“কহ সব সভাজনে, সভাপতি কোনজনে
অদ্য হেথা করিবে বরণ ?”
পণ্ডিত শ্রী রঘুনাথ, করি সবে দণ্ডবৎ
কহিলেন মধুর বচন।।
“স্ব-জাতির এ-সভায়, মোর নিবেদন রয়
সভাপতি করি নির্ব্বাচন।
যদি অনুমতি হয়,আমি বলি এ সভায়
উপযুক্ত আছে একজন।।
গুরুচাঁদ বরকর্ত্তা, জানে সবে যাঁর বার্ত্তা
শ্রী হরিচাঁদের পুত্র যিনি।
স্ব-জাতির এ সভায়, তাই মোর মনে লয় অদ্য হোন্ সভাপতি তিনি।।”
মঞ্চ'পরে নেতা যত, করে করে করাঘাত
শুভ - বাক্য সমর্থন করি।
সবে কহে ' জয় জয়, জয় সভাপতি জয়
জয় শব্দ উঠে শূন্য ভরি।।
সভাপতির আসনে, বসাইল গুরুচাঁনে
ফুল - মালা দিল গলে তাঁর।
আহা কিবা রূপ হেরি, বর্ণনা করিতে নারি
অঙ্গ স্পর্শে ধন্য ফুল হার!
মঞ্চ পরে চারিধারে, নেতৃবর্গ তথাকারে
সবে বসিয়াছে হৃষ্ট মনে।
প্রতিজনে মাল্য দান, দিয়া করে সু সন্মান
শোভা দেখি সকলে বাখানে।।
কেশব ডাক্তার যিনি, পুরাভাগে গিয়া তিনি
সম্বোধি সকল জনে বলে।
“স্ব জাতি বান্ধব যত, সবে করি দণ্ডবৎ
মনোকথা বলে কুতূহলে।।
ছিন্ন ভিন্ন সবে মোরা, আছি বঙ্গ দেশ ভরা
একত্রতা কভু হয় নাই।
অদ্য শুভ দিন ধন্য, স্ব-জাতি - মিলন জন্য
মিলিয়াছি সবে এক ঠাঁই।।
জাতীয়তা বিনে ভাই, উন্নতির আশা নাই
সেই ভাব বলিব এখানে।
এক ভাবে এক টান, এক মূলে বাঁধা প্রাণ
এক সুর গাহে এক তানে।।
সেই ভাব যদি হয়, এ জাতির নাহি ভয়
দিনে দিনে ঘটিবে উন্নতি।
সবে লহ এক দীক্ষা, কর এক পণ - রক্ষা
মূলমন্ত্র মনে রাখ জাতি।।
কেশব ডাক্তার তবে, কথা বলি এই ভাবে
করিলেন আসন গ্রহণ।
ধন্য ধন্য সবে কয়, করে করতালি দেয়
আনন্দেতে সবে বহুক্ষণ।।
পাটগাতী গ্রামে ঘর, দিব্য - কান্তি মনোহর
দ্বারিক মণ্ডল যাঁর নাম।
মঞ্চ পরে দাঁড়াইয়া, সভা দণ্ডবৎ হৈয়া
কহি লেন কথা গুণধাম।।
“শুনহে স্বজাতি ভাই, এ জাতির রক্ষা নাই
সবে যদি নাহি এক হও।
ভাব ' মনে নহি ক্ষুদ্র, বীর্যবান নমঃশূদ্র
এক তালে সবে পা ফেলাও।।
কু-সংস্কার আছে যত, দূর কর অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে।
মান - জ্ঞান থাকা চাই, নিজ - মান রাখা চাই
কর কাজ সবে একত্তরে”।।
এত বলি মহাশয়, বসিলেন পুনরায়
সভা করে করতালি ধ্বনি ---
দ্বারিক মোক্তার যিনি, উঠিয়া দাঁড়ান তিনি
করতালি পড়িল অমনি।।
সবিনয়ে করজোড়ে, সবে নমস্কার করে
ধীরে ধীরে বলিলেন তিনি।
“নমঃশূদ্র বন্ধু গন! করি এই নিবেদন
বলি সবে যাহা কিছু জানি।।
ভুল দোষ ত্রুটি গুলি, সভাসদ মণ্ডলী
দয়া করি করিবেন ক্ষমা।
অসাধু যদ্যপি বলি, সব ফেলিলেন ঠেলি
সাধু সব রাখিলেন জমা।।
'নমঃশূদ্র ' নমঃশূদ্র ' শুনি মাত্র এই শব্দ
নাহি জানি সব পরিচয়।
অপর যতেক হিন্দু, কেহত নহেরে বন্ধু
মোদেরে শোষণ করি খায়।।
কৃষি জীবি সব মোরা, খাদ্য শস্য ঘর - ভরা
থাকে বটে কতক সময়।
জমিদার মহাজন, হরে লয় সব ধন
কাঙ্গালের সাজে ঘুরি হায়!
বিদ্যাহীন আছি মোরা, তাই করিতেছি সারা
ব্রাহ্মণ কায়স্থ আদি জাতি।
যদ্যপি অবিদ্যা যায়, তবে আর নাহি ভয়
কোন দিকে নাহি হবে ক্ষতি।।
সকলে মিলিয়া ভাই, পাঠশালা করা চাই
প্রতি জেলা প্রতি গ্রামে গ্রামে।
বিদ্বান হইলে সবে, কেহ ঘৃণা না করিবে
মান্য হবে নমঃশূদ্র নামে”।।
এতেক বলিল যবে, করতালি মহারবে
করতালি করে সব জন।
দ্বারিক মোক্তার যিনি, ধীরে ধীরে পরে তিনি
করিলেন আসন গ্রহণ।।
গুরু চরন বিশ্বাস, আটের হাটেতে বাস
মহাশয় ব্যক্তি সেই জন।
দাঁড়ায়ে সভার আগে, কর জোড়ে বর মাগে
ধীরে ধীরে করে নিবেদন।।
“ স্বজাতি বান্ধব যত, করি সবে দণ্ড বৎ
মাগি বর সবাকার পায়।
সভার বন্দনা সারি, বলিবারে যেন পারি
স্বজাতির কিসে শুভ হয়।।
পর-অন্ন পর-সেবা, ধরা ধামে করে যেবা
তার আর নাহিক উপায়।
পর অন্ন ছাড় ভাই, পর-সেবা কার্য নাই
দেখা যাক কি ভাব দাঁড়ায়।।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ সবে, গর্ব্ব করে যে গৌরবে
মোরা তার কিবা ধার ধারি।
নিজ ঘরে প্রসাদান্ন, করো সবে তাহা মান্য
তা'তে মোরা বাঁচি কিংবা মরি।।
শুন সব মহাশয়, এক কথা মনে হয়
ক্ষৌর কার্যে লাগে যে নাপিত।
ব্রাহ্মণ যবন মিলে, এক হাতে ক্ষৌরি হলে
সেই কার্য হয় কি বিহিত ?
নমঃশূদ্র আছি যারা, সে ধার ধারি না তারা
ব্রাহ্মণ নাপিত আছে ভিন্ন।
পবিত্র বলিতে গেলে, আছে কিছু নমঃকুলে
ধর্ম্ম কর্ম্ম তারা করে মান্য।।
“স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পর - ধর্ম্ম ভয়াবহঃ
গীতা ভাগবতে তাই বলে।
নিজ ধর্ম্ম নাহি মান্য, খেলে পরে পর-অন্ন
অন্ন দোষে ধর্ম্ম যাবে চলে।।
শুনহে স্বজাতি ভাই, মোর অন্য কথা নাই
পর - অন্ন না করো গ্রহণ “।
এত বলি সেই জন, করি কথা সমাপন
করিলেন আসন গ্রহণ।।
বোম্ভাগ গ্রামেতে ঘর, পণ্ডিত জী শ্রী ঈশ্বর
ঈশ্বর পণ্ডিত নাতে খ্যাত।
উঠিয়া আসন হতে, করজোরে প্রণিপাতে
নিজ শির করিলেন নত।।
চাহিয়া সভার পানে, ' ভাই সব! সম্বোধনে
কহিলেন গুটী কত কথা।
“শ্রবণ করুন সবে, বড় হব কোন ভাবে
তার লাগি কর একাগ্রতা।।
এক হয়ে যাহা কবে, এক মনে যা ' করিবে
সেই কার্য না হবে বিফল।
অন্য কথা শোনা নাই, অন্য মানা মানি নাই
এক লক্ষ্য রাখিবে সকল।।
কুসংস্কার যত আছে, ফেল সব ধুয়ে মুছে
ভাল কর সব হবে ভাল।
ভাল তুমি হবে যবে, মন্দ আর কে বলিবে
ঘুচে যাবে আপদ জঞ্জাল।।