মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৩২১-৩৪০

মেঘ-আবরণে সূর্য্য পড়িলেন ঢাকা
নীড়ে যেন কান্দে পাখী বন্ধ দুই পাখা
।।
হয়ে বন্ধূ ওড়াকান্দী হল বিস্মরণ

অষ্টাদশ বর্ষ ক্রমে রহে অচেতন
।।
হেনকালে ওড়াকান্দী প্রভু গুরুচন্দ্র

দেশে দেশে দিল ভীর-বাণী বজ্র-মন্দ্রা
।।
কাল ঘুম ছেড়ে জাগ জগতের জীব

নর কুলে নিয়ে জন্ম কেন হলে ক্লীব?
স্বরগ ছানিয়া সুধা আনিলাম সাথে

কে কে নিবি ছুটে আয় সময় থাকিতে
।।
ভীর শুনি দলে দলে নর নারী ধায়

দুরন্ত বাদার লোক কেহ নাহি যায়
।।
প্রভু দেখে সবাকারে হবে তরাইতে

এইবারে কেহ নাহি থাকিবে তফাতে
।।
যখনে গেলনা কেহ প্রভু ঠেকে দায়

আপনার লোকে তাই বাদাতে পাঠায়
।।
বানেরী নিবাসী সাধু শ্রীদেবী চরণ

প্রভুর আজ্ঞাতে এল সেই মহাজন
।।
অগ্রদূত হয়ে এল শ্রীগণেশ নাম

অদি পর্ব্বে সেই গেল লহ্মীখালী ধাম
।।।
সে সব বৃত্তান্ত পূর্ব্বে করেছি বর্ণনা

পুনঃ নাহি সে-সকল করিব যোজনা
।।
দেবীচাঁদ গোস্বামীজী বহু শক্তিশালী

তাহার আদর্শে মাতে ভকত সকলি
।।
গোপাল মাতিল আর মাতিল শ্রীনাথ

মাতিল মাধবচন্দ্র গোপালের সাথ
।।
এই তিন জনে হল আদিতে মতুয়া

পরে বহু মত্ত হৈল গোপালে ধরিয়া
।।
গোপাল মাতিল আর ভকত শ্রীনাথ

এক সঙ্গে বাণীয়ারী করে যাতায়াত
।।
দেবীচাঁদ নিল সবে ওড়াকান্দী ধামে

দেখিয়া শ্রীগুরুচাঁদে মত্ত হল নামে
।।
তৃষিতে-চাতক-হিয়া চাহে চন্দ্র পানে

আহা কি দেখিল রূপ ভরিয়া নয়নে
।।
পাষাণ-প্রাচীরে ঘেরা বারি যেন ছিল

ব্রজধারী গুরুচাঁদ পাষাণ ভাঙ্গিল
।।
কারা মুক্ত ছুটে বারি গর্জ্জন করিয়া

গেলরে বাদার দেশপ্লাবনে ডুবিয়া
।।
গোপালে দেখিয়া তাঁর পরম আহলাদ

আনন্দে নাচিছে তাহে স্বামী দেবীচাঁদ

গুরু-কৃপা মহাতেজে আসর পুড়িল

আনন্দে গোপাল বলে বল হরি বল
।।
হরি বল, হরি বল, হরি হরি বল

দিবানিশি সমভাবে আঁখি ছল ছল
।।
যখনে গোপাল করে নাম সংকীর্ত্তন

মনে ভাবে হরি বলে ত্যজিবে জীবন
।।
যথা মাতে ভীমসেন কুরুক্ষেত্রে রণে

গোপাল তথা মাতে নাম সংকীর্ত্তনে
।।
তেজে তাঁর দূরে রয় বদ্ধ-জীব যারা

হরি বলে সে গোপাল হয়ে জ্ঞান-হারা
।।
সিংহ নাদে সে গোপাল হরি হরি কয়

মনে হয় সেই ধ্বনি ওড়াকান্দী যায়
।।
প্রাণের মমতা ছাড়ি করে হরিনাম

প্রাণ জুড়ে বসিলেন হরি গুণ ধাম
।।
ভকত রঞ্জন হরি ভক্ত দেহে এল

জড় দেহে গোপালের পূর্নজন্ম হল
।।
জগত কহিল তাঁরে শ্রী গোপাল সাধু

ঘরে ঘরে বিলাইল হরি নাম মধু
।।
এবে শুন কোন ভাবে পুর্ণজন্ম হল

কোন ভাবে সে গোপাল কৃপা-সিদ্ধি পেল
।।
ইহার প্রমাণ আছে সে মহাভারতে

সশরীরে যুধিষ্ঠির যায় স্বর্গ পথে
।।
বহুত পরীক্ষা দিল সেই ধর্ম্ম রায়

সকলি উত্তীর্ণ হল প্রভুর কৃপায়
।।

পরিশেষে পুন্যতীর্থে করে স্নান দান
নরদেহ শুদ্ধ হল শাস্ত্রের প্রমাণ
।।
গুরু-কৃপা-তীর্থ জলে গোপাল ডুবিল

নরদেহে তাই তাঁর পুর্ণজন্ম হল
।।
অপূর্ব্ব বারতা সবে শুন দিয়া মন

অগোচরে লীলা করে মতুয়ার গন
।।
গোপালের ভাব দেখি পাষন্ডের রোষ

দুরে দুরে তারা সবে খোঁজে তার দোষ
।।
দাপাদাপি হুড়াহুড়ি করে রাত্রিদিন

মতো সেজে বসে আছে যত অর্বাচীন
।।
আমরাও জপে থাকি হরিনাম মন্ত্র

কই তাতে লাগে নাতো ঢাকা ঢোল যন্ত্র
।।
হরিনাম নিলে নাকি মরা বেঁচে ওঠে

যত বেটা মতুয়ারা সেই কথা রটে
।।
দেব দেবী মানামানি কোন কিছু নাই

বাবা হরিচাঁদ বলে সদা ছাড়ে হাই
।।
জাতি ধর্ম্ম সব নাশ হবে কালে কালে

সময় থাকিতে ঠান্ডা কর এই দলে
।।
এত বলি পাষন্ডেরা সবে জোট করে

গোপালকে শাসিবারে নায়েবেরে ধরে
।।
সুবর্ণ সুযোগ তাতে আর জুটে গেল

সেই দিনে দেবচাঁদ লহ্মীখালী এল
।।
পাষন্ডেরা বলে গিয়ে নায়েবের ঠাঁই

গোপালের গৃহে আজ এসেছে গোঁসাই
।।
উভয়েরে ডেকে আন এ কাছারী বাড়ী

অপমান জরিমানা করে দেও ছাড়ি
।।
পেয়াদা পাঠাও তুমি তাদের গোচরে

ইচ্ছাতে না আসে যদি আন তবে ধরে
।।
দশ টাকা নজরানা রাখিলাম মোরা

আর দশ টাকা দেব কাজ হলে সারা
।।
অর্থ লোভে সে নায়েব তাতে রাজি হয়

গোপালে ধরিতে তবে পেয়াদা পাঠায়
।।
পেয়াদা আসিয়া বলে গোপালের ঠাঁই

তোমাকে কাছারী আমি দরে নিতে চাই
।।
তুমি চল আর সাথে তোমার গোঁসাই

নায়েবের আজ্ঞা যাহা বলিলাম তাই
।।
শুনিয়া গোপাল বলে এ কেমন বার্তা?
যেতে হয় আমি যাব কেন যাবে কর্তা?
যতক্ষণ দেহে মোর আছে মাত্র প্রাণ

কর্তারে করিতে নাহি দিব অপমান
।।
যাহা কিছু কর মোরে তাতে দুঃখ নাই

আমি একা যাব সঙ্গে যাবেনা গোঁসাই
।।
হেন কালে দেবীচাঁদ সেই ঠাঁই এসে

বলিছে গোপালে ডেকে মৃদু মৃদু ভাসে
।।
কিবা দোষ ও গোপাল আমি সাথে গেলে?
রাজাত প্রজার বাপ-প্রজা তাঁর ছেলে
।।
পিতার নিকটে যেতে পুত্রে নাহি ভয়

চল মোরা এক সাথে যাব সে জাগায়
।।
গোপাল কান্দিয়া বলে প্রভুহে আমার

-আজ্ঞা পালিতে বাবা পারিনা তোমার
।।
তুমি যদি চল সাথে অনর্থ ঘটিবে

কিজানি কি শেষ কালে লোক খুন হবে
।।
যদ্যপি পাষন্ড কেহ নিজ ভাগ্য দোষে

অপমান করিবারে তব পারে রোষে
।।
প্রাণ যায় যাবে তাতে নাহি করি ভয়

পাষন্ডের প্রাণ নিয়ে ফেলাব ধূলায়
।।
তাই বলি দয়াময় শুধু আমি যাই

তোমার করুণা গুণে কোন ভয় নাই
।।
তোমার অভয় নাম থাকিলে স্মরণে

ভয় নাই জলে স্থলে কিংবা রণে বনে
।।
শ্রীমুখে করুন আজ্ঞা আমি ঘুরে আসি

আমার জামীন তুমি আছ দিবানিশি
।।
গোপালের বাক্যে তব গোস্বামী ফিরিল

নায়েবের কাছে একা গোপাল চলিল
।।

 

এদিকে পাষন্ড সবে করিতেছে সায়
নায়েবের শাস্তি ছাড়া কিবা করা যায়?
বড় জোর জুতা-পেটানায়েব করিবে

কিংবা দুই শত টাকা জরিমাণা চাবে
।।
দুশো টাকা দিতে বটে কষ্ট কিছু হয়

দশ বিশ জুতা বাড়ীসেত কিছু নয়
।।
বিশ কেন শত জুতা-বাড়িমোরে দাও

হাসি মুখে মাথা পেতে নিতে পারি তাও
।।
এতে বিষ নাহি যাবে লেজে বিষ রয়

লেজ ছেড়ে বিষ পরে আসিবে মাথায়
।।
তাতে বলি বিষধরে কিসের মমতা?
একেবারে দেহ হতে ছিড়ে নেও মাথা
।।
এই ভাবে পাষন্ডেরা করিল একতা

ঠিক হল ভেঙ্গে দেবে গোপালের মাথা
।।
খালের নিকট সবে ঝোঁপের আড়ালে

অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে তারা বসে দুই দলে
।।
খালের দক্ষিণ পারে অর্দ্ধ সংখ্যা রয়

উত্তর পারেতে থাকে আর সমুদয়
।।
খালের উপরে রহে বংশ-দন্ড চার

তাই দিয়ে লোক জনে হয় পারাপার
।।
বাড়ী ফিরিবারে জানি সেই মাত্র পথ

তাই দুই ধারে বসে যতেক অসৎ
।।
গোপাল কাছারী গেল অপরবেলায়

ফিরিতে লাগিবে সন্ধ্যাভাবে বোঝা যায়
।।
সন্ধ্যার আগেতে জোটে পাষন্ডেরা সব

ঝোপের আড়ালে থাকে নাহি করে রব
।।
অল্প কিছু বেলা আছে এহেন সময়

গোপাল কাছারি আসি হইল উদয়
।।
একক গোপালে দেখি নায়েবের ক্রোধ

ক্রোধেতে আরক্ত চক্ষু বাক্য হল রোধ
।।
গোপাল ভূমিতে পড়ি করিল প্রণাম

ক্রোধে পূর্ণ নায়েবের দেহে ঝরে ঘাম
।।
মৃত্তিকা আসন করি বসিল গোপাল

নায়েব দাঁড়াল ফিরে মিটাইতে ঝাল
।।
ক্রোধ ভরে বলে তাঁকে আরে পাষন্ড

হুকুম অমান্য করি একা এলি ভন্ড?
বল তোর গুরু কোথা? কোথা রেখে এলি?
ঠিক না বলিলে তোর ভেঙ্গ দেব খুলি
।।
বিনয়ে গোপাল বলে নায়েব মশায়

আমার গোঁসাই কেন আসিবে হেথায়?
যাহা কিছু আছে দোষ সকলি আমার

কোন কার্য্যে কোন দোষ নাহিক তাঁহার
।।
মোরে নিয়ে যাহা ইচ্ছা কর তুমি তাই

আমার দোষের শাস্তি নেবে কি গোঁসাই?
গোপালের কথা শুনি নায়েব তখন

ক্রোধেতে জ্বলিল যেন দীপ্ত হুতাশন
।।
একে ত মনসা দেবী তাতে ধূপ-জ্বালা

অঙ্গ-জ্বলে নায়েবের সেই সন্ধ্যা বেলা
।।
আদেশ অমান্য করে আদি অপরাধ

সম্মুখে আসিয়া করে বাদ-অনুবাদ
।।
মহাক্রোধে নায়েবের বুদ্ধি লোপ হল

তিন শত জরিমানা নায়েব হাঁকিল
।।
কটুত্তর বহুতর করে পরে পরে

বলে জুতা না মারিনু শুধু দয়া করে
।।
শ্রেষ্ঠ প্রজা তোর পিতা ছিল এই দেশে

তার লাগি ছেড়ে তোরে দিনু ভালবেসে
।।
সপ্তাহ কালের মধ্যে জরিমানা চাই

তারিখ খেলাপহলে আর রক্ষা নাই
।।
নায়েবের কথা শুনি হাসিল গোপাল

মনে মনে হেসে বলে আহা কি দয়াল
।।
যে ভাবে বাসিলে ভাল নায়েব মশায়

কি জানি কি পরিণামে কি যেন কি হয়
।।
প্রকাশ্যে তাহারে বলে করজোড় করি

এখন নায়েব বাবু যেতে আমি পারি?

সামান্য মানুষ আমি তাতে ধন হীন
মালেকের বাধ্য প্রজা আছি চিরদিন
।।
জরিমানা ডাকিয়াছে শুনিলাম তাই

একবার মালেকের কাছে আমি যাই
।।
তাঁর পায়ে নিবেদন আমি করে দেখি

কিছু জরিমানা মাপ বাবু করে নাকি?
কোন দোষে জরিমানা হয়েছে আমার

দয়া করে তুমি তাই বল একবার
।।
নায়েব বলিল দোষ আছে বহুতর

হরিনাম কর কেন দেশের ভিতর
।।
দেব দেবী নাহি মান মান না আচার

এসব কারণে দন্ড হয়েছে তোমার
।।
গোপাল হাসিয়া বলে শুনিলাম ভাল

তাহলে ত হরিনাম দেশ হতে গেল
।।
যাহা হয় তাহা হোক আমি তবে আসি

নাম-করা ছাড়ি কিসে নাম ভালবাসি
।।
দেখি জমিদার মোর কোন কথা কয়

দন্ডবৎ শ্রীচরণে নায়েব মশায়
।।
এত বলি পথ ধরি গোপাল ফিরিল

সন্ধ্যার আঁধার আসি পৃথিবী ঘিরিল
।।
এ দিকেতে দেবী চাঁদ গোস্বামী সুজন

ইতি উতি ঘুরে সাধু স্থির নহে মন
।।
গোপালের সতী নারী কাঞ্চন জননী

হরশীত, কাশী নামে দুই পুত্র জানি
।।
সবে ডাকি বলিতেছে গোস্বামী রতন

এসো মোরা সবে মিলি করিব কীর্ত্তন
।।
গোপাল গিয়াছে একা রাজার কাছারী

তাহার মঙ্গল লাগি বল হরি হরি
।।
বিপদে বান্ধব কেন নাহি হরি বিনে

আয় মোরা সে বান্ধবে ডাকি এক মনে
।।
অমৃত-মাথানো সুরে দেবী কথা কয়

হরশীত কাশী কান্দে কান্দে তার মায়
।।
মাঙ্গালের বন্ধু কোথা রয়েছে বসিয়ে?
করুণ নয়নে প্রভু দেখহে চাহিয়ে
।।
আপন বলিতে বাবা, আর কেহ নাই

অকুল তরঙ্গে পড়ে বুঝি মারা যাই
।।
তুমি না করিলে দয়া আর কে করিবে?
তুমি না দেখিলে বাবা আর কে দেখিবে?”
কান্দে সতী কা্ন্দে তাঁর কোল-ভরা শিশু

সাথে সাথে কান্দিতেছে পাখী আর পশু
।।
উঠিল কান্নার ঢেউ আকাশ ভেদিয়া

গোস্বামীর পদে পড়ে আকুল হইয়া
।।
কাঙ্গালের সে-কান্নায় আসন টলিল

ভকতে রক্ষিতে হরি আপনি আসিল
।।
চক্রীর চক্রান্ত বল কে বুঝিতে পারে?
নরাকারে এল হরি পাষন্ডের ধারে
।।
খালের উত্তর পারে আগে প্রভু গেল

পাষন্ডের কাছে গিয়া কহিতে লাগিল
।।
আমি দেখি তোমাদের বুদ্ধি শুদ্ধি নাই

কোন ভাবে কর কাজ ভাবিয়া না পাই
।।
পাষন্ডের দেখে যেন সাথী একজন

তাহাদের কাছে আসি কহিছে বচন
।।
তারা বলে কোন কথা এসেছ বলিতে?
প্রভু কয় কোন কিছু পার না শুনিতে

অন্ধকারে চোখ কাণ সব বন্ধ হল

খালের দক্ষিণ পারে শীঘ্র গতি চল
।।
দুই পারে দুই দল থাকা ভাল নয়

এক যোগে কাজ হলে কাজ ভাল হয়
।।
বিশেষতঃ দক্ষিণ পারেতে মোরা যারা

আমরা না করিব কাজ তোমাদের ছাড়া
।।
আমাদের কাছ দিয়া আসিবে গোপাল

দুই দল দুই খালে মাঝখানে খাল
।।
যত কিছু কাজ বুঝি করিব আমরা?
বিনা কাজে শেষে বুঝি নাম নিবে তোরা
।।

এ সব চালাকী নয় চল এক ঠাঁই
এক সাথে কাজ হবে তাই মোরা চাই
।।
পাষন্ডেরা বলে তবে চল এক ঠাঁই

সেই ভাবে কাজ হলে কোন বাধা নাই
।।
উত্তর পারের দল দক্ষিণেতে গেল

আপনি দয়াল প্রভু অদৃশ্য হইল
।।
দক্ষিণপারের দলে বলে একি কান্ড?
স্থান ছেড়ে এল কেন যত অপগন্ড?”
উত্তর পারের দলে বলে একি কথা?
ডেকে এনে অপমান? ভেঙ্গে দেব মাথা
।।
দক্ষিণ পারের দল বলিছে রাগিয়া

কে এনেছে তোমাদের এখানে ডাকিয়া

যারা এল তারা বলে তোমরা ডাকিলে

তোমাদের একজন ওপারেতে গেলে
।।
তারা বলে স্থান ছেড়ে কেহ যাই নাই

যারা এল তারা বলে মিথ্যুক সবাই
।।
অন্য দলে রেগে বলে তোরা মিথ্যাবাদী

মাথা ভেঙ্গে দেব সব কথা বল যদি
।।
কথা কাটাকাটি করে দুই দলে মিশে

একাকী গোপাল তবে সেই পথে আসে
।।
হরি যারে রক্ষা করে কেবা তারে মারে?
পাষন্ডেরা একসাথে গোলমাল করে
।।
কেবা গেল কেবা এল কোন লক্ষ্য নাই

গোলমালে মত্ত রল পাষন্ড সবাই
।।
গোপাল ফিরিল গৃহে অতি নিরাপদে

সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে গোস্বামীর পদে
।।
গোপালের দেখিয়া সবে প্রেমে পূর্ণ হল

হরি বলে তবে সবে কান্দিতে লাগিল
।।
সেই ভাবে নিশি ভোর করিল সকলে

প্রভাতে গোস্বামী তবে গোপালেরে বলে
।।
বানীয়ারী এবে আমি চলিব গোপাল

হরি বলে সবে মিলে থাকিও সামাল
।।
এই ভাবে গোপালের প্রাণ রক্ষা হল

শ্রীগুরুর কৃপা ধন্য হরি হরি বল
।।

 

মহাসঙ্কীর্ত্তন শ্রীশ্রীহরি আবির্ভাব ও গোপালের কৃপাসিদ্ধি লাভ


তবে ত গোপাল একা চলিল দশানী

মালিকের বাড়ী সেথা সেই কথা জানি
।।
বারুজীবি কুলে জন্ম নাম যদুনাথ

বিশ্বাস উপাধি তাঁর বড়ই বিখ্যাত
।।
চন্দ্রনাথ যদুনাথ তৃতীয় শ্রীনাথ

পরম ধার্ম্মিক তাঁরা জমিদার সৎ
।।
চিরদিন গোপালেরে তারা ভালবাসে

মাঝে মাঝে সে গোপাল রাজ-বাড়ী আসে
।।
ক্রমে ক্রমে যদুবাবু শনিলেন কাণে

গোপাল মেতেছে এবে হরিনাম গানে
।।
তাহাতে বড়ই সুখী হল জমিদার

ধন্য ধন্য সেই ব্যক্তি প্রজা সাধু যারা
।।
শ্রীনাথ বাবুর পুত্র শ্রীমহেন্দ্র নাম

পরম উদার তিনি অতি গুণধাম
।।
গোপালেরে দেখে যেন, গোঁসাই ঠাকুর
।।
মহকুমা বাগহাট খুলনা জিলায়

দশানী নামেতে গ্রামে আছে পরিচয়
।।
সেই গ্রামে চলিলেন গোপাল সুধীর

মুখে নাম অবিরাম চক্ষে বহে নীর
।।
সভক্তি প্রণাম করে আসনে বসিল

জমিদার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিল
।।
ক্রমে ক্রমে সব কথা গোপাল জানায়

জমিদার বলে কার্য্য বিশেষ অন্যায়
।।
আমার নায়েব হয়ে হেন ব্যবহার

এই দোষে মোর হাতে পাবে না নিস্তার
।।

ক্রোধে অগ্নি সম জ্বলে জমিদারগণ
তখনি নায়েবে দিল করিয়া লিখন
।।
অকারণে গোপালের কর জরিমানা

তোমার মতন দুষ্ট মোরা রাখিবনা
।।
প্রজা তাহা পুত্র তাহা ভেদাভেদ নাই

দান্ড দাও মোর পুত্রে এতই বড়াই
।।
শোনা কথা শোনা নাই-করিনু সাব্যস্ত

আমাদের কার্য্য হতে তুমি বরখাস্ত
।।
গোপালের সাথে দিল প্যাদা একজন

সেই পত্র নিয়া দিবে নায়েব-সদন
।।
অতঃপর নিজ গৃহে ফিরিল গোপাল

প্রভুর করুণা ভাবি চক্ষে ঝরে জল
।।
প্যাদা আসি উপনীত নায়েবের ঠাঁই

নায়েব পড়িয়া পত্র ছেড়ে দীর্ঘ হাই
।।
চাকুরীটী গেলে তার সংসার বাঁচে না

রাগ করে আজ তিনি মোটেই নাচে না
।।
বাবুর আদেশ মান্য নায়েব করিল

চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ী চলে গেল
।।
সংবার জানিয়া তবে পাষন্ডেরা কয়

বেশী ঘুষ খাইয়াছে বাবুরা নিশ্চয়
।।
টাকা খেয়ে গোপালেরে দিয়াছে ছাড়িয়া

দিনে দিনে গোপাল ত চলিবে বাড়িয়া
।।
কি উপায় করা যায় ঠিক কর মনে

যার যার মনোমত বলে জনে জনে
।।
হেনকালে একজনে ডাক দিয়া কয়

শোন সবে আমি এক ভেবেছি উপায়
।।
শত্রুতা করিয়া তারে মারা নাহি যাবে

তারে মার দিতে হবে ডেকে বন্ধু ভাবে
।।
কীর্ত্তন করিতে তারে ডাককোন বাড়ী

তার সাথে সবে মিলে কর গড়াগড়ি
।।
গড়াগড়ি জড়াজড়ি পড়াপড়ি কর

কীর্ত্তনের ছলে তারে সবে ধরে মার
।।
ধন্য ধন্য করি সবে তাতে দিল সায়

গোপালের কাছে পরে পাষন্ডেরা যায়
।।
প্রসন্ন সুতার নামে লোক একজন

লহ্মীখালী বাস করে অতি দীনজন
।।
তাহার পত্নীর নাম অলকা সুন্দরী

দৈবেতে কলেরা রোগে প্রাণে গেল মরি
।।
পাষন্ডেরা তাতে বলে এই ত সুযোগ

কার্য্যসিদ্ধি উপলক্ষ্যে বড় শুভ যোগ
।।
বলিয়া কহিয়া সবে গোপালের অন

রোগী দেখাব ভাব যেন তারে মান
।।
রোগী দেখিবারে ছলে আন বাড়ী পরে

রোগীরে মারিলি কেন? দাবী কর পরে
।।
প্রাণ-হীনে প্রাণ ফিরে বল কবে পায়?
গোপালের বাঁধ করেস রোগী-মারা-দায়
।।
যথেচ্ছা প্রহার করে করিবে চালান

খুনী হয়ে জেলে যাবে হবে হতমান
।।
সবে সায় এ-মন্ত্রনায় দিলে পরে পরে

প্রসন্নকে পাঠাইল গোপালেল ধারে
।।
যেজন সঁপেছে প্রাণ শ্রীগুরুর পদে

গুরু তারে রক্ষা কয় গোপালের ঠাঁই

দয়া করে মোর গৃহে চলুন গোঁসাই

আমার পত্নীর আজি কলেরা হয়েছে

মনে বলে এই যাত্রা বাঁচে কি না বাঁচে
।।
তার ইচ্ছা হরিনামে মতুয়া হইবে

আপনার দেখা পেলে পরাণে বাঁচিবে
।।
পরম দয়াল তুমি সবে মোরা জানি

দয়া করে মোর গৃহে চল গুণমনি
।।
এভাবে বিনয় যদি প্রসন্ন করিল

নির্ম্মল উদার চিত্ত গোপাল ভাবিল
।।
পর দুঃখে দুঃখী হতে গুরুর আদেশ

বিশেষতঃ হরিভক্তহীন এই দেশ
।।

 

একে ত দুঃখীর কান্না তাতে হরিনাম
যাহা করে গুরুচাঁদ স্বীকৃত হলাম
।।
প্রকাশ্যে প্রসন্নে বলে তুমি বাড়ী যাও

জল ঢেলে সে রোগীরে সিনান করারও
।।
এবে অল্প বেলা আছে সন্ধ্যার সময়

তোমার গৃহেতে আমি হইব উদয়
।।
মোর সঙ্গে আর যাবে মতুয়া সুজন

তব গৃহে সারা রাত্রি করিব কির্ত্তন
।।
প্রসন্ন ফিরিয়া গেল আপনার ঘরে

সব শুনি পাষন্ডেরা এল জোট করে
।।
কত কষ্টে মতুয়ারা সে কালে কাটায়

সংক্ষেপেতে কিছু আমি দিব পরিচয়
।।
নদী খাল কেহ তারে পার নাহি করে

দুর দুর করে গেলে বাড়ীর উপরে
।।
ভাই বন্ধু কেহ নাই সকলি বিপক্ষ

মতুয়ার অভিযোগে নাহি মেল সাক্ষ্য
।।
প্রকাশ্যে কীর্ত্তন হলে আর রক্ষা নাই

রাত্রিকালে কোন গৃহে পাবে নাক ঠাই
।।
যথাতথা কটুবাক্য সহে অপমান

ভিন্ন জাতি সম সবে করে তারে জ্ঞান
।।
নিরালে জঙ্গলে তাই মতো বলে হরি

লোক যদি আসে কাছে থাকে চুপ করি
।।
বিপদে অবধি নাই পথে-চলা ভার

দুষ্টুগণে বলে তারে করিবে সংহার
।।
অসহ্য পরীক্ষা তার আসে পদে পদে

হায় হায় নিরুপায় সদা প্রাণ কাঁদে
।।
পলাইয়া যায় সবে বানিয়ারী গ্রামে

তথা হতে ওড়াকান্দী চলে ক্রমে ক্রমে
।।
দুঃখ-অগ্নি দহনেতে চিত্ত সুনির্ম্মল

তাই পেল ভরা-বুকে প্রমামৃত ফল
।।
সে-সব কাহিনী বলে আজ কার্য্য নাই

অল্পে-অল্পে সে-বৃত্তান্ত ক্ষান্ত করে যাই
।।
এবে বলি মূলসূত্র কীর্ত্তনের কথা

গোপালের গৃহ হতে মতুয়া একতা
।।।
যে দিনে প্রসণ্ন আসি বিনয় করিল

মতুয়ারা প্রায় সবে উপস্থিত ছিল
।।
মোট শুদ্ধ জন দশ মতুয়া গণনা

এর বেশি সংখ্যা মতো তখনে ছিলনা
।।
গোপাল সকলে বলে শুন সবে ভাই

প্রাণ দিয়ে হরিচাঁদে আজ ডাকা চাই
।।
কি জানি কি দুষ্ট ছল গ্রাম্য লোকে করে

বিশেষতঃ যাইতেছি তাহাদের ঘরে
।।
বিপদ জানত সবে থাকে পায়-পায়

কি জানি কি ইচ্ছা আজ করে ইচ্ছাময়
।।
আর কথা শোন বলি মনে যাহা আসে

কোন ভাবে হরিনাম করিবে বিশেষে
।।
এই দেহে প্রাণ নাহি রবে চিরদিন

কোন ভাবে কাটা যায় জনমের ঋণ
।।
অবশ্য মরিতে হবে ইহা নহে ভুল

এক চিন্তা তাই সবে মনে কর স্থুল
।।
মরণ যখনে ধ্রুব কিবা চিন্তা আর?
হরি বলে মর সবে যেতে ভব পার
।।
কিবা জানি কোন ভাবে এই প্রাণ যাবে?
হরি বলে মরি যদি তবে কীর্ত্তি রবে
।।
নিশ্চয় মরিব সবে নাম সংকীর্ত্তনে

এই ভাবে থাকে যেন সবাকার মনে
।।
গোপালের মুখে শুনি এ-সব বারতা

মতুয়ারা কেন্দে বলে এই ঠিক কথা
।।
প্রাণ দিয়ে সবে আজ বল হরি হরি

যদ্যপি মরিতে হয় এই ভাবে মরি
।।
ডঙ্কা, শিঙ্গা, করতাল আর এক তারা

কংস কাসি সঙ্গে করে চলে মতুয়ারা
।।
অগ্রে চলে শ্রীগোপাল পরেতে মাধব

পরে পরে চলিলেন মতুয়ারা সব
।।

 

রাম বিষ্ণু, শ্রীনাথাদি বেতকাটা বাস
ঘন ঘন বলে হরি ঘন ছাড়ে শ্বাস
।।
হইল প্রহর রাত্রি সবে হেনকালে

প্রসন্নের বাড়ী ওঠে হরি, হরি বলে
।।
প্রাঙ্গণের পরে যবে উপস্থিত হ

বস্ত্রে-ঢাকা মরা-শব দেখিতে পাইল
।।
আর চারিদিকে দেখে বহু লোকজন

পসন্নের আত্মীয়েরা করিছে ক্রন্দন
।।
দেখামাত্র মতুয়ারা বুঝিলেন সার

আজিকার এ-বিপদে নাহিক উদ্ধার
।।
কূট-চক্র-জালে-বেড়া মতুয়ার গণ

মনে ভাবে আজ বুঝি নিশ্চয় মরণ
।।
গোপালের গৃহে বসি যেই কথা হ;

সেই কথা মতুয়ারা স্মরণ করিল
।।
বিপদ দেখিয়া বুকে এল মহাবল

এক সঙ্গে ধ্বনি করে বল হরি বল
।।
গোপাল ডাকিয়া বলে প্রসন্নের ঠাই

বসিতে বিছানা কিছু দেহত মশাই
।।
অন্য কোন কথা মোবে না কহিব

বসে বসে সারারাত্রি হরিনাম লব
।।
প্রসন্ন বলিল সব পরে দেখা যাবে
।।
কাছে ছিল পাষন্ডেরা তারা বলে তাই

আগে তুমি কর যাহা বলিছে গোঁসাই
।।
সে দিনে সেখানে ঘটে যে-সব ঘটনা

সাধ্য নাই লিখি তার ক্ষুদ্র এক কণা
।।
একে মোর প্রাণে নাই কোন কবি-শক্তি

তাতে ভাব-ছাড়া চিত্তে নাহি কিছু ভক্তি
।।
আমার সাধ্যেতে নহে সে-সব বর্ণনা

শুধু মাত্র যাই লিখি ঘটনার কণা
।।
বুকে যাহা ওঠে ফুটে মুখে ফোটে কই?
লেখনী আসাড় হল তাই বসে রই
।।
বুকে যেই ঢেউ উঠে তার কিছু টুকু

পারেত লেখনী মোর সে-টুকু লিখুক
।।
অসীমের ঢেউ যাহা ভাব তার নাম

ভাষায় বাঁধিতে তারে হই ব্যর্থকাম
।।
লেখনী আর্ধেক বটে ভাষা হতে লয়

ভাব আর লেখা এত দূরে দূরে রয়
।।
লিপি শুধু ভাবে যেতে বর্ণ পরিচয়

কবিতা-কুসুম-রাজ্য বহু দূরে হায়
।।
তবে বটে আদিক্ষেত্রে লিপি প্রয়োজন

লিপি ধরি রস-লিপ্সু করিবে চয়ন
।।
ভাব-রাজ্যে যেথা আছে তাম্ররস সুধা

সেথা গিয়ে রসিকের মিটে যাবে ক্ষুধা
।।
রসিকের পদে তাই করি নিবেদন

শুষ্ক শব্দ গ্রন্থি মোর করুন গ্রহণ
।।
আপনার চিত্ত রসে ভিজায়ে তাহারে

দেখুন আনন্দ তাতে দিলে দিতে পারে
।।
কোন কিছু দেখিবারে মোর সাধ্য নাই

আপন অন্তরে চিত্র দেখুন সবাই
।।
এক পাশে বসিয়াছে মতুয়ার গন

বিপদ রাক্ষসী আসে মেলিয়া বদন
।।
সম্মুখে বসনে-ঢাকা মৃতা নারী দেহ

চারিদিকে পাষন্ডেরা-বন্ধু নহে কেহ
।।
ঘোর অমানিশা তাহে ঘন অন্ধকার

অল্প সংখ্যা মতুয়ারা-বিপক্ষে বিস্তার
।।
প্রলয়ের পূর্ব্বে যেন নিস্তব্ধ প্রকৃতি

স্তব্ধ চলে পাষন্ডেরা ভীষণ মূরতি
।।
বারুদের স্তুপ যেন রয়েছে সাজানো

বাকী শুধু এতটুকু আগুন লাগানো
।।
অথবা অকুল সিন্ধু মাঝে যথা তরী

প্রবল বাত্যায় নাড়ে আছাড়ি পাছাড়ি
।।
ভয়াকুল দাঁড়িকুল দাঁড় টানে বসে

মনে হয় তরী ডুবে চক্ষের নিমেষে
।।

 

ততোধিক বিপদেতে পড়িল গোপাল
মনে মনে কেন্দে বলে কোথায় দয়াল
।।
এই কি তোমার ইচ্ছা আনিয়া বিজনে

কেড়ে নেবে মূল্যহীন এই ক্ষুদ্র প্রাণে?
তাতে যদি সুখী হও কোন দুঃখ নাই

তুমি সুখী হও বাবা তাই আমি চাই
।।
তোমার ইচ্ছায় বাবা সৃষ্টি, স্থিতি, লয়

কর তুমি যাহা ইচ্ছা ওগো ইচ্ছাময়
।।
যে-ভাবে রেখেছ তুমি তাতে মনে হয়

এই প্রাণ নেবে আজি তুমি ইচ্ছাময়
।।
তবে কেন আর বৃথা কালক্ষয় করি

দেহ ছাড়ি দয়াময় বলে হরি হরি
।।
যেই নাম সেই তুমি নাম-রূপ হরি

তোমাকে ডাকিয়া হরি, তোমাতেই মরি
।।”’
এত ভাবি সে-গোপাল সঙ্গিগণ কয়

প্রাণ ভরি, বল হরি নাহিক সময়
।।
এখানের ভাব যাহা বুঝেছ অন্তরে

এস সবে হরি বলে যাই তবে মরে
।।
সঙ্গী দলে তাতে বলে কোন চিন্তা নাই

যদি মরি-হরি বলে সবে মর্ত্তে চাই
।।
এত বলি মতুয়ারা ধরিলেন গান

গানে যেন সারা-বিশ্বে বহিল উজান
।।
মরণ-যাত্রীর সুখে ভাব-মাখা-সুরে

উঠিল প্রেমের বন্যা লহরে লহরে
।।
পদমাত্র শুন সবে গাছে যেই গান

আমার প্রাণ বাঁচাওরে দয়াল

তোমায় না দেখিলে প্রাণ আমার বাঁচেনারে
দেশ কাল পাত্র তোতে ভকত-হৃদয়

গান যেন ভেসে ভেসে কোন দেশে যায়
।।
যে ডাকে ডাকিল তাঁরে ভকত প্রহলাদ

যার ডাকে পায় হরি পরম আহলাদ
।।
সেই ডাকে বনে বনে ধ্রুব ডাকে তাঁরে

যে ডাকে রাখিল হরি ভক্ত সুধম্বারে
।।
সেই ডাকে মতুয়ারা ডাকে সেই দিনে

আপনি নাড়িল হরি ক্ষীরোদ শয়নে
।।
নাম রূপে ভক্ত দেহে হল আবির্ভূত

উঠিল কীর্ত্তনে ঢেউ অদ্ভুত-অদ্ভুত
।।
কোথা গেল কংস-কাসি কোথা করতাল

শুধু মাত্র ধ্বনি শুনি বল হরি বল
।।
আসিল নামের ঢেউ জগৎ ডাবায়ে

পাপী তাপী সবে নাচে আপনা ভুলিয়ে
।।
রুদ্র-রসে শ্রীগোপাল দিল এক লম্ফ

ধরা নড়ে টল টল যেন ভূমিকম্প
।।
বীর রসে ভক্ত গণে লম্ফ ঝম্ফ দেয়

হেন কালে দেখ সেথা কোন ভাব হয়
।।
দয়াময় হরিচাঁদ আবির্ভূত হল

প্রসন্নেরে ভর করি কীর্ত্তনে নামিল
।।
মহাভাবে সে প্রসন্ন ডাক দিয়া কয়

আয় তোরা বল হরি কে আছিল কোথায়?”
পলকে সকলে দেখ সে-প্রসন্ন নাই

মূর্তি োমন্ত বীর্য্যবন্ত সবে দেখে তাই
।।
হরি আগমনে তবে কীর্ত্তন থামিল

ধরায় পড়িয়া সবে মতোরা কান্দিল
।।
গোপালে ডাকিয়া বলে আহারে গোপাল

তুমি দেখি সখা মোর নন্দের দুলাল
।।।
তোমার কীর্ত্তনে আমি বড় শান্তি পাই

কিন্তু এক কাজ ভুল বলিতেছি তাই
।।
মহাশক্তিশালী বটে এই হরি নাম

যে যাহা কামনা করে পূরে মনস্কাম
।।
কোন ভাবে নাম নিলে নামে ফল দেয়

শুনি বলি সেই কথা বলিব তোমায়
।।
আসতের সঙ্গ ছাড়ি কর হরি নাম

নামে দিবে প্রেমসুধা পূর্ণ মনস্কাম
।।

 

এই খানে দেখ কত আসিয়াছে ভক্ত
ভকতে মরিতে চায় এমনি পাষন্ড
।।
এরা যেথা থাকে সেথা নাম নাহি ফলে

ভবিষ্যতে অসরেতে নিয়োনা আর দলে
।।
আবির্ভাবে হরি যদি এই কথা কয়

ক্রোধে জ্বলে ওঠে যত পাষন্ড নিচয়
।।
তারা ভাবে ভাব ধরে প্রসন্ন সুতার

তাহাদিগে এই ভাবে করে তিরস্কার
।।
গোপালে প্রসন্ন সবে মারিবার তরে

তলে তলে পাষন্ডেরা ষড়যন্ত্র করে
।।
এদিকে গোপাল কেন্দে পড়িল ধরায়

বলে বাবা এ নারীর কি হবে উপায়
।।
মরিয়াছে বহুক্ষণ দেহে প্রাণ নাই

কেমনে বাঁচিবে মরা বলে দেহ তাই
।।
কেবা তুমি আসিয়াছ আমি নাহি চিনি

ভাবে বুঝি তুমি মোর হরি গুণমনি
।।
দয়া করি রক্ষা যদি করিলে আমায়

এ মরা বাঁচায়ে দেও ওগো দয়াময়
।।
ভকত-রঞ্জন তবে বলিল হাসিয়া
।।
অচেনা কেমনে থাকি এখানে আসিয়া?
ক্ষীরোদ শয়নে আমি আছি সদাকাল

এবে ওড়াকান্দী আছি শুন হে গোপাল
।।
আর আর কথা যাহা এবে নাহি কব

অগ্রভাগে মরা নারী বাঁচাইয়া লব
।।
এত বলি বস্ত্র ফেলি দয়াময় হরি

উঠাইল সে নারীকে হস্তে কেশ ধরি
।।
প্রচন্ড চপেটাঘাত করে তার পিছে

অন্য হাতে চুল তার ধরা থাকে মুঠে
।।
বজ্রস্বরে কেহ তারে ওরে রে পাপীনি

এতক্ষণ শুয়ে রলি কোন ভাবে শুনি?
ওঠ ওঠ জাগ জাগ দ্যাখ চক্ষু মেলে

এসেছে গোপাল সাধু হরি হরি বলে
।।

 

এই ভাবে কথা কয় সেই মহাবল
অলকা কান্দিয়া বলে মোরে দেও জল
।।
মরা-নারী প্রাণ পেয়ে উঠিল যখনি

গোপাল ধূলায় পড়ে কান্দিয়া তখনি
।।
যত নর নারী ছিল গড়াগড়ি করে

পাষন্ডেরা দেখে সব থাকিয়া অন্তরে
।।
হরি বলে রোগে বিধি আমি নাহি দিব

যাবলে গোপাল আমি তাহাতে থাকিব
।।
গোপাল চাহিয়া বলে রোগে দাও বিধি

গোপালে কান্দিয়া বলে বিধাতার বিধি
।।
বিধির বিধানে যাহা কভু লেখে নাই

যাঁর কৃপা ক্রমে আজ চক্ষে দেখি তাই
।।
বিধাতার বিধি তুমি নাহিক সন্দেহ

আমি কি বলিব প্রভু সব তুমি কহ
।।
হরি বলে যা বলিব সকলি বলেছি

তুমি যাহা কহ আমি তার মধ্যে আছি
।।
বল বল কাল ক্ষয়ে আছে কিবা ফল

চেয়ে দেখ রোগী তব চাহিতেছে জল
।।
এত যেদি বলে হরি গোপালের কাছে

গোপাল দেখায়ে বলে ডাব আছে গাছে
।।
ডাব পেড়ে জল দাও তাতে সুস্থ হবে

রোগ ব্যাধি দুর্ব্বলতা সব চলে যাবে
।।
অভূত অপূর্ব্ব লীলা করে দয়াময়

স্বচক্ষে দেখিল যারা তারা ইহা কয়
।।
বার তের হাত দীর্ঘ নারিকেল গাছ

উর্দ্ধদেশ ফল তার নহে কাছে-কাছ
।।
মহাশক্তিধারী হরি হস্ত বাড়াইল

অনায়াসে এব ডাক পেড়ে এনে দিল
।।
এক হাতে রাখি ডাব অন্য হাত দিয়া

কাটিলেন ডাব কিছু হাতে না লইয়া
।।
অলকা খাইল জল ব্যাধি গেল দূরে

কান্দিয়া অলকা পড়ে ধূলি শয্যাপরে
।।

কেন্দে কয় দয়াময় অবলা রমণী
তোমার লীলার তত্ত্ব কিছু নাহি জানি
।।
মরণের ঘর হতে আনিলে ফিরায়ে

তোমারে পূজিব বাবা কি কথা বলিয়ে?”
এই ভাবে সে অলকা কান্দে ফুলে ফুলে

পুনরায় দয়াময় ধরে তার চুলে
।।
ক্রোধ ভরে বলে তারে ওরেরে পাপিষ্ঠা

জল খেয়ে বল পেয়ে গেছে বুঝি তেষ্টা
।।
নাকি সুরে কাঁদাকাট শিখিয়াছ ভাল

জ্ঞান আছে এ দিকেতে রাত কত হল?
অভূক্ত সাধুরা সবে বসিয়া উঠানে

শ্রীঘ্র করে ভাত রেঁধে এনেদে এখানে
।।
প্রভুর বচনে তবে অলকা উঠিল

গোপালের কাছে হরি আপনি বসিল
।।
ক্ষণ পরে সে-অলকা আসিল বাহিরে

কেন্দে কেন্দ বলিতেছে ভেসে অশ্রুনীরে
।।
এক কণা চাল বাবা মোর ঘরে নাই

কোথা পাব, কি রাঁধিব বল বাবা তাই
।।
প্রভু বরে হে গোপাল! থাক বসে কেনে?
অলকা চাহিল চাল চাল দাও এনে
।।
প্রভুর হুকুমে শুনি গোপাল ভাবিল

আশ্চর্য্য এ সব কান্ড যেখানে ঘটিল
।।
যেখানে এসেছে হরি ক্ষীরোদ বিহারী

সেইখানে কোন কাজে কিবা শঙ্কা করি
।।
অকস্মাৎ চিত্তে তাঁর উঠিল যুকতি

আমি জানি প্রভু মোর কমলার পতি
।।
যেই পদ সযতনে লহ্মী সেবা করে

সেই পদ রাখে প্রভু এ ধূলির পরে
।।
ইহা আজি নহে ধূলা পরম-পদার্থ

ইথে আছে সর্ব্বধন বুঝিলাম তত্ত্ব
।।
যেই খানে পদ রেখে প্রভু বসে ছিল

তথা হতে শ্রীগোপাল মুষ্টি-ধূলা নিল
।।
অলাকরে ডাকি বলে শুন গো জননী

ধান-ভানা চাল কোথা আমি নাহি জানি
।।
সর্ব্বফল দাতা যাহা সেই পদধূলি

দিতেছি তোমার হাতে হরি হরি বলি
।।
উনানে তাতিয়া জল হাড়ির ভিতরে

হরি বলে এই দ্রব্য দেও তাতে ছেড়ে
।।
যাঁর স্পর্শে মরা দেহে পেয়ে গেলে প্রাণ

তাঁর পদধূলি আজ দিবে অন্নদান
।।
প্রেম ভরে সে অলকা ধূলি নিয়ে গেল

গোপালের আজ্ঞামত জল মধ্যে দিল
।।
ঢাকিয়া হাঁড়িয়া মুখ করজোড়ে কান্দে

এদিকেতে কথা হরি বলেছে আনন্দে
।।
হেন কালে দেখ কান্ড বড়ই অদ্ভুত

এক স্থানে পাষন্ডেরা আছিল মজুত
।।
হরিকে মারিতে যারা করেছিল মন

অকস্মাৎ কেন্দে তারা উঠিল তখন
।।
হস্ত পদ তাহাদের দেখিতে দেখিতে

অতিশয় বেদনায় লাগিল ফুলিতে
।।
দারুণ ব্যথার দাপে প্রাণ ফেটে যায়

নিরুপায় হয়ে পড়ে শ্রীহরির পায়
।।
হরি বলে ওরে ওরে পাষন্ড দেমাকী

কোন দোষে এই হল খুলে বল দেখি
।।
প্রাণ যায়! নিরুপায়! পাষন্ড সকলে

পূর্ব্বাপর সব কথা বলে প্রভু স্থলে
।।
কি ভাবে গোপালে সবে মারিতে চাহিল

পূর্ব্বাপর সব কথা খুলিয়া বলিল
।।
শেষ ভাগে কোন ভাবে ষড়যন্ত্র করে

সব কথা খুলে বলে প্রভুর গোচরে
।।
প্রভু বরে যাহা বলে গোপাল সুজন

তাতে মুক্তি পাবি সবে বলিনু কারণ
।।
গোপালের পেদে পড়ে কাঁদা কাঁদি করে

গোপাল বলিল তবে ডাকিয়া সবারে
।।

হরিভক্ত যেইখানে করয় কীর্ত্তন
আপনি দয়াল হরি করে আগমন
।।
কীর্ত্তনের ধুলি তাতে মহাশক্তিশালী

সর্ব্ব ব্যাধি দূর তাতে আমি ইহা বলি
।।
ভক্তি করে কীর্ত্তনের ধুলি মাখা অঙ্গে

রোগ পীড়া যত কিছু যাবে সঙ্গে সঙ্গে
।।
তবেত পাষন্ড সবে ধূলাতে লুটাল

পলকের মধ্যে রোগ দূরে চলে গেল
।।
হেনকালে এক ব্যক্তি কান্দিতে কান্দিতে

গড়াগড়ি করে পড়ি ধূলি মধ্যেতে
।।
গোপাল ডাকিয়া বলে তুমি কান্দ কেন?
সে বলে দয়াল তুমি সকলি ত জান
।।
সপ্তাহ পূর্ব্বেতে মোর মরেছে নন্দন
।।
দয়া করে প্রাণদান কর মহাজন
।।
শ্রীহরি ডাকিয়া বলে দেহ কোথা আছে?
যদি থাকে তারে এনে দে রে মোর কাছে
।।
শ্মশানের পানে পরে সেই ব্যক্তি ধায়

দেহ-অংশ কোন খানে কিছু নাহি পায়
।।
ফিরিয়া আসিয়া পরে করে নিবেদন

দেহাংশ কিছুই প্রভু মিলেনা এখন
।।
প্রভু বলে ভাগ্যহীন চুপ করে থাক

দেহ যার নাই হেথা সেই চলে যাক
।।
এমত সময় এল অলকা সুন্দরী

বলিছে প্রভুর অগ্রে করজোড় করি
।।
তোমার দয়ায় বাবা প্রসাদান্ন হল

কোথায় প্রসাদ দিব তাই মোরে বল
।।
শুনিয়া বিস্মিত যত উপস্থিত জনে

তারা ভাবে এই কার্য্য হইল কেমনে?
বিনা চালে অন্ন হল মরা-দেহে প্রাণ

উঠিল ভাবের বন্যা প্রেমের তুফান
।।
ভক্তাভক্ত, কি পাষন্ড যতজন ছিল

ভূমিতলে পড়ে সবে গড়াগড়ি দিল
।।
কি যে হল কে যে এল বুঝিতে না পারে

এসব দেখিছে যেন সবে স্প্ন ঘোরে
।।
হেনকালে গোপালের করে ধরি কর

শ্রীহরি চলিয়া গেল বনের ভিতর
।।
ক্ষণ পরে লক্ষ্য করে দেখিল সবাই

প্রভু আর শ্রীগোপাল সেইখানে নাই
।।
বন অন্তরালে বসি কোন কথা হল

পৃথিবীর নরনারী কিছু না জানিল
।।
অল্প পরে দুই প্রভু আসিলেন ফিরে

হরি-শক্তি ছেড়ে গেল সেই প্রসন্নেরে
।।
হত-জ্ঞান সে-প্রসন্ন পড়ে ভূমিতলে

ক্ষণ পরে জ্ঞান পেয়ে হরি হরি বলে
।।
কীর্ত্তনের ধূলি দিয়ে পে প্রসাদ হল

আনন্দে সকলে সেই প্রসাদান্ন খেল
।।
এই ভাবে শ্রীগোপাল হল কৃপা-সিদ্ধি
।।
দিনে দিনে সেই ভাব ক্রমে হয় বৃদ্ধি
।।
শ্রীহরি ডাকিল তাঁর শ্রীগোপাল সাধু

সে নামে বিখ্যাত হল পিয়ে প্রেম-মধু
।।।
এবে বলি শুন আর কোন শক্তি পায়

কোন শক্তি বলে গুরুচাঁদ ধরা দেয়?

 

শ্রীশ্রীদেবী চাঁদ ও শ্রীশ্রীতারক চাঁদের বর লাভ


মরা বাঁচে বিনা চালে অন্ন রাধি দেয়

শ্রীগোপাল সাধু বলে হল পরিচয়
।।
দেবী-চাঁদ শুনিলেন সমস্ত কাহিনী

অমনি গোপালে বক্ষে লইলেন টানি
।।
ডেবে বলে রে গোপাল বাঁচালি আমারে

আমার যা কিছু আছে তোরে দিব ধরে
।।
গোস্বামীর সঙ্গে সাধু ওড়াকান্দী যায়

বসে বসে লীলা দেখে কথা নাহি কয়
।।

 

হেনকালে তেরশত সপ্তদশ সালে
বিধবা-বিবাহ দাওপ্রভু দিল বলে
।।
শ্রীমুখের আজ্ঞাক্রমে সে দেবীচরণ

নানা স্থানে বিবাহের করে আয়োজন
।।
গোপাল বিপিন এই ভাই দুইজন

বহু কষ্টে বিবাহাদি করে সংঘটন
।।
দেবী যায় ওড়াকান্দী সঙ্গেতে গোপাল

প্রভুকে প্রণাম করে চক্ষে বহে জল
।।
সেই দিন গোপালের দেয় পরিচয়

নন্দের গোপাল বলি গুরুচাঁদ কয়
।।
দুই বর্ষ গত হয় এমন সময়

গোস্বামী তারক চন্দ্র দক্ষিণেতে যায়

খোনকারবেড় নামে আছে এক গ্রাম

গান করিবারে যায় কবিগুণধাম
।।
রসরাজে ওড়াকান্দী গোপাল দেখেছে

বিশিষ্ট আলাপ তাঁর সঙ্গে নাহি আছে
।।
বানিয়ারী গ্রামে বসি সংবাদ শুনিল

শ্রীতারক গোস্বামীজী দক্ষিণেতে গেল
।।
দ্রুতগতি সে-গোপাল গৃহপানে ধায়

মনে ইচ্ছা রহিবে সে গানের সভায়
।।
পরম সাধক কবি করিবেন গান

নিশ্চয় উঠিবে সেথা প্রমের তুফান
।।
এত ভাবি দ্রুতগতি দেশ-মুখে চলে

পথ চলে আর মুখে হরি হরি বলে
।।
হেনকালে শুন এক দৈবের ঘটন

কলেরায় তারকেরে করে আক্রমণ
।।
সাথী যারা দূরে তারা কাছে নাহি যায়

রোগ নিয়ে গোস্বামীজী রহে একেলায়
।।
হেনকালে উপস্থিত সাধুজী গোপাল

গোস্বামীর কষ্ট দেখি চক্ষে বহে জল
।।
হেনকালে গোস্বামীজী চক্ষু মেলে চায়

পায়খানা যাবে ভেবে উঠিবারে যায়
।।
আগু হয়ে সে-গোপাল ধরিল যখন

গোস্বামী কহিল তারে অতি কুবচন
।।
ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়া দাঁড়াইয়া রয়

এত গালি খায় তবু কথা নাহি কয়
।।
পুনরায় তাঁরে যবে ধরিবারে যায়

ক্রোধ ভরে গোস্বামীজী তাঁহাদের শুধায়
।।
কেরে বেটা এলি হেথা কোন দেশে ঘর?”
গোপাল ভাবিছে মনে কি দিব উত্তর
।।
ওড়াকান্দী হতে তেঁহ বানীয়ারী গেল

তথা হতে খোনকারবেড় পঁহুছিল
।।
মনে করেগোস্বামীকে বলিবে সকল

কর জোড় করি বলে আঁখি টলমল
।।
বলে ওড়াকান্দী হতে আমি আসিয়াছি

আর কি শুনিবে কবি উঠিলেন নাচি
।।
গোপালে জড়ায়ে বলে ওরে দয়াময়

তোমাকে পাঠাল প্রভু দেখিতে আমায়?
নিশ্চয় বুঝিনু তবে আর মৃত্যু নাই

তোমাকে পেয়েছি কাছে আর কিবা চাই”?
প্রাণপণে গোস্বামীর শুশ্রষা করিল

নিজ হাতে গোস্বামীর বিষ্ঠা ফেলাইল
।।
গোপালের নিষ্ঠা দেখি গোস্বামী বিস্মিত

মনে ভাবে এরে কৃপা করাই উচিত
।।
যাত্রার প্রাক্কালে তাই দিল তারে বর

শুনহে গোপাল তুমি বচন আমার
।।
যে ভাবে আমার সেবা করিয়াছ তুমি

তার লাগি এই বর দিয়া যাই আমি
।।
সাধন ভজন তোর কিছু না লাগিবে

আপনি শ্রীগুরুচাঁদ করুণ করিবে
।।
গোপাল কান্দিয়া তবে লুটায় ধরণী

শ্রীতারক গোপালেরে বক্ষে নিল টানি
।।
এই ভাবে কৃপা পেল প্রভুজী গোপাল

দিবানিশি নামে গানে মত্ত মাতোয়াল
।।

এই সব কৃপা পেয়ে শক্তিমন্ত হয়
এবে শুন কোন প্রেমে গুরুচাঁদ পেল?
আদি আজ্ঞঅ বিধবারে বিবাহ করাল

নন্দের গোপাল আখ্যা গুরুচাঁদ দিল
।।
দ্বিতীয় কীর্ত্তির কথা করিব কীর্ত্তন

শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের মুদ্রণ
।।
কর্ম্মগুণে কর্ত্তা মেলে শুধু বাক্যে নয়

কর্ম্ম-ছাড়া বৃথা-বাক্য মহানন্দ কয়
।।

 

শ্রীমৎ গোপাল চাঁদের নিঃস্বার্থ দান ও শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত গ্রন্থ মুদ্রণ


তের শবাইশ সালে বারুণী সময়

ভক্তগণে কিছু অর্থ হরিবরে দেয়
।।
সে সময়ে শ্রীগোপাল দুই টাকা দিল

পূজা শেষে গ্রন্থ পাবেএই কথা হ
।।
তের শতেইশ সালে পূজার সময়

ওড়াকান্দী শ্রীধামেতে সে-গোপাল যায়
।।
পূজা শেষে প্রভু কাছে গোপাল কহিল

এইখানি গ্রন্থ নিব মনে ইচ্ছা ছিল
।।
কত মূল্য নিব প্রভু জানিবারে চাই

টাকা দিয়ে একখানি গ্রন্থ নিয়ে যাই
।।
প্রভু বলে সেই গ্রন্থ ছাপা হয় নাই

টাকা নিয়ে গ্রন্থ দেব-গ্রন্থ কোথা পাই?
আমি ত বলেছি বাপু! সেই হরিবরে

গ্রন্থ ছেপে এনে দাও অতীব সত্বরে
।।
কি জানি কি করিছে সে কিছু নাহি জানি

গ্রন্থ বুঝি ছাপা আর হল নারে মণি
।।
বড়ই নিরাশ চিত্তে বলিছে গোপাল

মোর মনে এক কথা উঠেছে দয়াল
।।
আপনার বাক্য নষ্ট হতে নাহি পারে

মনে হয় সেই ভাবে বলোনি আহারে
।।
ঠিক ভাবে বাক্য যদি তারে দিতে প্রভু

গ্রন্থ-ছাপা কার্য্যে বাধা পড়িত না কভু
।।
আপনার মনে যেন কি ভাব রয়েছে

তাই পদে পদে কার্য্য বাধা পড়িতেছে
।।
-কথা কহিল যদি গোপাল সুজন

ধীরে ধীরে গুরুচাঁদ কহিছে বচন
।।
ঠিক ভাবে কথা যদি বলিয়া না থাকি

ঠিক ভাবে বলে তবে পরীক্ষাটা দেখি
।।
এত বলি দয়াময় ছাড়িয়া আসন

গোপালের প্রতি চাহি করে নিবেদন
।।
শুন হে গোপাল আমি কহি তব ঠাঁই

আমার পিতার কীর্ত্তি ছাপাইতে চাই
।।
সেই কীর্ত্তি গাঁথা তুমি দেহ ছাপাইয়া

এ জগতে রহ তুমি অমর হইয়া
।।
প্রভুর বচন শুনি গোপাল অজ্ঞান

লোটায়ে পড়িয়া বলে পদে দেহ স্থান
।।
কোন কথা আর মোর বলিবার নাই

কত টাকা লাগে এতে তাই জান্তে চাই
।।
প্রভু বলে টাকা চাই শঞ্চ শতাধিক

বেশী কিছু লাগে নাকি নাহি তাহা ঠিক
।।
গলবস্ত্র করজোড়ে গোপাল দাঁড়াল

বারিধারা বহে চক্ষে কহিতে লাগিল
।।
শ্রীমুখের আজ্ঞঅ যদি প্রভু আমি পাই

নিজ হতে এই টাকা আমি দিতে চাই
।।
নরাচারে শিহরিয়া উঠিলেন প্রভু

বলে হেন কথা পূর্ব্বে শুনি নাই কভু
।।
কি সাহসে ওরে বেটা এ-মত বলিলি?
পাঁচ শত টাকা লাগে কথা কি বুঝিলি?”
গোপাল কান্দিয়া কয় দয়ার সাগর

পাঁচ শত টাকা মোর নহে অগোচর
।।
পাঁচ শত ছার কথা তব দয়া বলে

অসাধ্য সাধন হতে পারে ভূমন্ডলে
।।

শ্রীমুখের আজ্ঞামাত্র ভরসা আমার
আজ্ঞঅ পেলে টাকা হবে চিন্তা কিবা আর?”
অন্তর্য্যামী প্রভু সব বুঝিছে অন্তরে

তথাপি জিজ্ঞাসা তারে মানব আচারে
।।
ওরে বেটা কত কাঠা জমি তোর আছে?
ঠিক ঠিক কথা তুই বল মোর কাছে
।।
গোপাল বলিল প্রভু তব দয়াগুণে

দুশ বিঘা খাস জমি পাই দুই জনে
।।
অপুত্রক খুড়া আর আমি অভাজন

এক সঙ্গে দুশ বিঘা পাই দুই জন
।।
শ্রীমুখেতে আজ্ঞা যদি কর দয়াময়

এই টাকা দিতে মোর নাহি কোন দায়
।।
গোপালের কথা শুনি প্রভু আনন্দ

বলে ধন্য হে গোপাল! তুমি বটে ধন্য

কতদিনে টাকা তুমি আনিবে হেথায়?”
দশদিনে দিব টাকা সে গোপাল কয়
।।
প্রভু বলে টাকা দাও কিসের কারণ?”
গোপাল কহিছে শুন পতিত পাবন

চিরকাল কত ভাবে ক্ষয় হল ধন

কিন্তু তার কোন চিহ্ন নাহিক এখন
।।
শুধু ধনক্ষয় নহে হয়েছি দায়িক

কোথা গেল এত ধন নাহি পাই ঠিক
।।
এবে তাই ভেবে আমি দেখিলাম মনে

এতদিন গেল ধন শুধু অকারণে
।।
অকাজে ভেঙ্গেছি অর্থ কাজ নাহি করি

দিনে দিনে দেনা-দায় দেখি ডুবে মরি
।।
মনে তাই ভাবিয়াছি সেই পথ ছেড়ে

ঠিক পথে ধন কিছু ভাঙিব সংসারে
।।
সৎপথে সৎকার্য্য আমি নাহি চিনি

নিজগুণে চিনাইলে আজ গুণমণি
।।
ব্রহ্ম বিষ্ণু শিব যাঁরে ধ্যানে নাহি পায়

তাঁর লীলা লেখা হল মানব-ভাষায়
।।
প্রচার হইবে তাহা প্রতি ঘরে ঘরে

তার চেয়ে শুভ কর্ম্ম আছে কি সংসারে?
মনে মনে ইচ্ছা মোর ছিল বহু দিন

কিন্তু মনে ভাবি আমি কতই মলিন
।।
মলিনের ধন কিসে শুভ কর্ম্মে লাগে?
তাই ভেবে এ প্রস্তাব করি নাই আগে
।।
অদ্য যবে শ্রীমুখেতে দিলে আজ্ঞা করি

ডোবা মনে জেগে ওঠে আশা-ভরা তরী
।।
মনে হল হেন দিন আর নাহি পাব

সর্ব্বস্ব বিক্রয় করে টাকা এনে দিব
।।
এই ভাবে সে-গোপাল যদি কথা কয়

ক্ষণেক নিস্তব্ধ থাকিবলে দয়াময়
।।
মনে হয় তব বাক্য নাহি হবে ফাঁকা

ঘরে যাও হে গোপাল নিয়ে এসো টাকা
।।
আজ্ঞামাত্রে সে গোপাল দন্ডবৎ করে

এস্তে ব্যত্তে উপস্থিত হল নিজ ঘরে
।।
পত্নী তাঁর মহাসতী শ্রীকাঞ্চন দেবী

ঠিক যেন মূর্ত্তিমতী ভগবতী-ছবি
।।
তাঁরে ডাকে আর ডাকে নিজ পুত্রগণে

হরশীত কাশীনাথ ভাই দুই জনে
।।
সকলে নিকটে এলে কহিছে বচন

আমার বচন সবে শুন দিয়া মন
।।
যাহা জিজ্ঞাসিব তার সকল উত্তর

দেহ সবে অকপটে ফেলে অন্ধকার
।।
এই ঘর এই বাড়ী বলত কাহার?
কার গুণে কর সবে এ-ঘর সংসার?
কেবা রক্ষা করে বল পিবদে পড়িলে?
কার কৃপাবলে সবে আছ ভূমন্ডলে?
ইহার উত্তর আগে দেহ মোর ঠাঁই

আর কিছু কথা আছে পরে বলি তাই
গোপালের কথা শুনি কাঞ্চন জননী

উত্তর করিল তাঁরে জুড়ি দুই পাণি
।।

শোন প্রভু! যেই ভাব আসে মোর মনে
সব-কিছু ঘটিতেছে হরি-কৃপা গুণে
।।
সেই হরি ওড়াকান্দী অবতীর্ণ হল

তাঁর দয়া ভিন্ন কেবা কোথা বাঁচে বল
।।
সকলি দিয়াছে তিনি ধন, জন, প্রাণ

ত্রিভুবনে নাহি বন্ধু তাঁহার সমান
।।
তিনিই করেন রক্ষা সম্পদে বিপদে

ভক্তি যেন থাকে প্রভু তাঁর রাঙ্গা পদে
।।
মাতা যদি বলে ইহা পুত্রে বলে তাই

মনে খুসী হল তবে গোপাল গোঁসাই
।।
পুনরায় প্রশ্ন করে বুঝিবারে মন

বেশ হল সবে মিলে বলত এখন
।।
এমন বান্ধব যিনি ভক্ত-শিরোমণি

তিনি যদি চায় কিছু আপনা আপনি
।।
সেই দ্রব্যে তাঁরে দেয়া মন্দ কিংবা ভাল

মন খুলে সেই কথা সবে মোরে বল
।।
আর কিছু এই সাথে বলিবারে চাই

এক সাথে দুই ভাব যেন আমি পাই
।।
বাঁচায়ে রাখিছে যিনি সকল সময়

এমন কি তিনি যদি প্রাণ নিতে চায়
।।
কোন ভাব তোমাদের মনে তাতে আসে?
সে-উত্তর দেও মোরে সকলে শেষে
।।
আবার কাঞ্চন দবী করজোড়ে কয়

শোন প্রভু সার কথা যাহা মনে হয়
।।
কি কারণে জিজ্ঞাসিছ কিছু নাহি বুঝি

যাহা আসে মনে তাহা কই সোজাসুজি
।।
যিনি রক্ষা করে প্রাণ, প্রাণ যে তাঁহার

তাঁর প্রাণ তিনি নিবে বাঁধা কিবা তার
।।
তবে বটে ধন্য হই যদি চেয়ে নেয়

তার তূল্য দয়া আমি দেখিনা কোথায়
।।
শ্রীকাঞ্চন দেবী যবে এ-মত কহিল

গোপাল কহিল মোর জন্ম ধন্য হল
।।

 

পতি-পত্নী একমতি যদি নাহি হয়
পরম দুর্ভাগা তারা জানিবে ধরায়
।।
তোমার উত্তর শুনি বড়ই আনন্দ

এবে শুন বলি সব প্রশ্নের সম্বন্ধ
।।
শ্রীহরির লীলাগীতি-লীলামৃত নাম

লিখেছে তারকচন্দ্র কবি গুনধাম
।।
সেই গ্রন্থ ছাপা হবে বলেছে ঠাকুর

গ্রন্থ পড়ে ধন্য হবে লনাথ আতুর
।।
পাঁচশত টাকা তাতে খরচ লাগিবে

প্রভু বলে এই টাকা খরচ লাগিবে
।।
প্রভু বলে এই টাকা বল কেবা দিবে?”
আমি তাই মনে ভাবি হেন শুভ কর্ম্ম

পরম পবিত্র অতি পুণ্যময় ধর্ম্ম
।।
তাই বলিয়াছি আমি মহাপ্রভু ঠাঁই

আজ্ঞা পেলে সব টাকা আমি দিতে চাই
।।
দয়া করে প্রভু মোরে দিয়াছেন আজ্ঞা

আমার রাখিতে হবে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা
।।
প্রশ্ন করি বুঝিলাম সবাকার মন

বল কোন কার্য্য সবে করিবে এখন?”
।।
গোপালের কথা হলে জননী কহিল

আপনার কথা শুনে প্রাণে শান্তি এল
।।
আমি বলি ধান চাল যাহা কিছু আছে

এই টাকা দেহ প্রভু সব-কিছু বেচে
।।
ভিক্ষা করে খাই খাব তাতে নাই দুঃখ

গ্রন্থ-ছাপা হলে মনে পাব স্বর্গসুখ
।।
এমত কহিল যদি কাঞ্চন জননী

পুত্রগণে বলে মোরা এই বাক্য মানি
।।
তবে ত গোপাল সাধু উতি উতি ধায়

দেখে কিছু ধান্য আছে একটী গোলায়
।।
সেই ধান আরো চাল বিক্রয় করিল

ইতি উতি করে টাকা পাঁচ শত হল
।।
সামান্য কতক চাল রহিল গৃহেতে

কোন ভাবে দিন যাবে নাহি ভাবে চিতে
।।
টাকা নিয়ে ওড়াকান্দী হইল উদয়

তাহাতে দেখিয়া সবে মানিল বিস্ময়
।।
প্রভু বলে কি গোপার! আনিয়াছ টাকা?
আমি জানি গোপালের কথা সব পাকা
।।
গোপাল কান্দিয়া বলে দয়াল আমার

তোমার ইচ্ছায় চলে সর্ব্ব চরাচর
।।
শ্রীমুখের বাক্য কভু নষ্ট নাহি হয়

সব টাকা আনিয়াছি তোমার দয়ায়
।।
এত বলি টাকাগুলি দিল প্রভু ঠাঁই

টাকা পেয়ে প্রভু বলে আর ভয় নাই
।।
গোপালের ভক্তিগুণে গ্রন্থ ছাপা হবে

গ্রন্থ পেয়ে হরিভক্ত কত সুখ পাবে
।।
শোন বলি হে গোপাল! যে কার্য্য করিলে

বাবার দয়ায় তুমি অমর হইলে
।।
এই দান শ্রেষ্ঠ বলি করে ঘরে ঘরে

অক্ষয় তোমার কীর্ত্তি হবে চিরতরে
।।
প্রভুর মধ্যম পুত্র সুধন্য কুমার

তারে ডাকি প্রভু বলে এই সমাচার
।।
আর বলে আন ডেকে সেই হরিবরে

গ্রন্থ নিয়ে যাক চলে ছাপাবার তরে
।।
প্রভুর আদেশে তবে আসে হরিবর

কবিচুড়ামণি যিনি দূর্গাপুরে ঘর
।।
আর কত ভক্ত এল প্রভুর আলয়

সবারে ডাকিয়া প্রভু বারে বারে কয়
।।
এই যে গোপাল সাধু মস্ত বড় দাতা

এর মত লোক আর নাহি দেখি কোথা
।।
লীলামৃত ছাপাইতে সব টাকা দিল

এতবড় দাতা আর কোথা আছে বল?
আর শুভ ভক্তগণ নিগূঢ় কাহিনী

কোন লেখা খেলে টাকা আমি সব জানি
।।
জোয়ারের জল যথা আসে নদী ভরে

ভাটা এলে স্রোত ধরে যায় পুনঃ ফিরে
।।
কবে আছে কবে নাই-নাহিক ঠিকানা

কোন দিকে কেহ তারে বাঁধিতে পারে না
।।
যেই কালে মানবের ঘরে ধন থাকে

কোন ব্যবহারে তারে নরপ্রাণী রাখে?
আত্ম-সুখে ক্ষয় তারে করে পলে পরে

টাকা কিন্তু সব দেখে কথা নাহি বলে
।।
দিনে দিনে সহে টাকা সব অপমান

শেষকালে একদিনে কোথা চলে যান
।।
শ্রী রূপেতে আসে টাকা লহ্মীর বাহন

লহ্মীর সঙ্গেতে থাকে নিজে নারায়ণ
।।
বিশ্ববাসী সবে যাঁর অপমান সন্তান

আত্মসুখী নরে তাঁরে করে অপমান
।।
বিশ্বের মঙ্গলে যার ধন নিয়োজিত

তার ধন ক্ষয় কভু হবে না নিশ্চিত
।।
গোপালের ধন দান হল সে পর্যায়

গোপালের ধন আর নাহি হবে ক্ষয়
।।
শত মুখে প্রভু কহে প্রশংসা বচন

গোপালের দান ব্যাপ্ত হল ত্রিভুবন
।।
প্রভু তবে ডাক দিয়া কহে হরিবরে

চলে যাও কলিকাতা গ্রন্থ ছাপিবারে
।।
সুধন্য, গোপাল আর তুমি একজন

তিন জনে এক সঙ্গে করহ গমন
।।
প্রভুর আজ্ঞাতে তিনি তখনি ছুটিল

পরদিনে কলিকাতা উপস্থিত হল
।।
পান্ডুলিপি প্রেসে দিলে গন্ডগোল হয়

প্রেসয়ালা বলে ইহা ছাপা নাহি যায়
।।
কারণ জিজ্ঞাসা করে সুধন্য কুমার

প্রেস বলে এক স্থানে আপত্তি আমার
।।
নমঃশূদ্র ঘরে এল স্বয়ং ভগবান

এই কথা ছাপিবারে নাহি বলে প্রাণ
।।
বহু তর্কাতর্কি পরে তবে রাজী হল

ছলে বলে কিছু টাকা বেশী নিয়া নিল
।।

ছিদাম মুদির লেনে ছিল এক প্রেস
এতদিনে তাহা বুঝি হইয়াছে শেষ
।।
শাস্ত্র প্রচার প্রেসে নাম বলি কয়

দুই মাসে ছাপানর কার্য্য শেষ হয়
।।
প্রুফ দেখা লেখা জোখা করে হরিবর

এই কার্য্যে বহু শ্রম হইল তাহার
।।
তাতে নাহি দুঃখ পায় মনেতে আনন্দ

ছাপা হল লীলামৃত প্রেম-মকরন্দ
।।
প্রভুর মনন আর গোপালের ধন

শ্রম করে হরিবর হয়ে একমন
।।
তেরশ তেইশ সালে গ্রন্থ ছাপা হ

প্রতিখন্ড তিনটাকা মূল্য রেখে দিল
।।
উদিল লীলামৃত পূর্ণচন্দ্র প্রায়

ভকত-চকোর সুধা পান করে তায়
।।
ব্যাধিতের ব্যথা-হীরা শোকেতে সান্ত্বনা

কর্ম্মপাকে মহানন্দ গ্রন্থ পড়িল না
।।

 

রথযাত্রা উৎসব


গ্রন্থ পেল সুখী হল ভকত নিচয়

ভক্তগনে ডাকি তবে বলে দয়াময়
।।
পরম পবিত্র হয় হরিলীলামৃত

ঘরে ঘরে এই গ্রন্থ হউক পূজিত
।।
শিখ জাতি করে পূজা শ্রীগ্রন্থ সাহেবে

স্বর্ণচূড়া মন্দিরেতে রাখিয়াছে এবে
।।
অমৃত সহর হয় পাঞ্জাব প্রদেশে

শিখ জাতি গ্রন্থ-পূজাকরে তথা এসে
।।
আমার পিতার গ্রন্থ রবে ঘরে ঘরে

নিত্য পূজা পাবে তাহা বিবিধ প্রকারে
।।
বড় বীর শিখ জাতি ভারত ভিতরে

বীর আর সাধু ভাব আছে একত্তরে
।।
বাঙ্গালার শিখ হবে এই নমঃশূদ্র

ধর্ম্মে কর্ম্মে হবে শ্রেষ্ঠ নাহি রবে ক্ষুদ্র
।।
শুন বলি ভক্তগণ নিগূঢ় বারতা

সর্ব্ব-ধর্ম্ম ওড়াকান্দী করিবে একতা
।।
তারক লিখেছে গ্রন্থে দেখ মনে করি

এবাড়ীর নাম ছিল উড়িয়া নগরী
।।
শ্রীক্ষেত্রে প্রসাদ নিত্য পায় সব জন

সে প্রসাদ ওড়াকান্দী দেয় কি কারণ?
দৈবযোগে প্রভু বলে আছি ওড়াকান্দী

ভবনাথ, শিবনাথ এল কান্দি কান্দি
।।
জগন্নাথ-ক্ষেত্র শক্তি ওড়াকান্দী রয়

সেই হেতু শ্রীপ্রসাদ পাঠাইয়া দেয়
।।
যেখানের যেই লীলা হবে হেথা

মোর এই বাক্য কভু নাহি হবে বৃথা
।।
এই ইচ্ছা ভক্তগণ উঠিয়াছে মনে

রথযাত্রা মহোৎসব করিব এখানে
।।
জগন্নাথ-শক্তি হেথা আছে আমি জানি

তাঁর ক্ষেত্রে তাঁর রথ এসো মোরা টানি
।।
এই কথা প্রভু যদি করিল প্রস্তাব

আনন্দেতে ভক্তগণে সায় দিল সব
।।
বারুণীর কালে এই কথাবার্ত্তা হল

স্বদেশী মেস্তরী আসি রথ নির্ম্মাইল
।।
দেশে দেশে ভক্তগণে পায় সমাচার

শুনি কাণে ভক্তগণে আনন্দ অপার
।।
রথযাত্রা দিনে সবে উপস্থিত হল

পরম আনন্দে সবে রথকে টানিল
।।
লোক সমারোহ তাহে বহুত হইল

ভক্ত সবে নেচে নেচে বলে হরি বল
।।
প্রভু কহে রথযাত্রা প্রতি বর্ষে হবে

ভক্ত সবে সে-উৎসবে অবশ্য আসিবে
।।
তদবধি ভক্তগণ রথযাত্রা কালে

ওড়াকান্দী ধামে সবে যায় কুতূহলে
।।

 

শ্রীবারুণী, দূর্গাপূজা আর রথযাত্রা
তিন কালে করে প্রভু উৎসবের মাত্রা
।।
পরবর্তী কালে যবে রাসযাত্রা হয়

চার উৎসবের কেন্দ্র করে দয়াময়
।।
রাজ-ভাবে রাজাচার প্রভুজী শিখায়

প্রভু হতে নমঃশূদ্র সর্ব্ব শিক্ষা পায়
।।
শুধু নমঃশূদ্র কিবা অনুন্নত জাতি

ওড়াকান্দী হতে শিক্ষা পেয়েছে সম্প্রতি
।।
তুলিয়া ভবের ঢেউ হরে মনপ্রাণ

সুকর্ম্ম চিনায়ে করে জীবের কল্যাণ
।।
গুরুচাঁদ-কৃপা পেয়ে সবে ধন্য হল

ছিনিমিনি করে করে মহানন্দ মল
।।

 

মহাত্মা শশীভূষণ ঠাকুর


বারশপঁচাত্তর সাল ভাদ্র মাসেতে

শ্রীশশীভূষণ জন্মি নিলেন ধরাতে
।।
জন্মকালে হরিচাঁদ গৃহেতে আছিল

সুপুত্র জন্মিবে বলি আশীষ করিল
।।
পরম সুন্দর রূপ চারু কলেবর

রূপ দেখি আনন্দিত যত নারী নর
।।
চন্দ্র জ্যোতিঃ মুখে দেখি হরি বলে হাসি

শশি সম রূপে পুত্র নাম থাক শশী
।।
দিনে দিনে বাড়ে শশী স্বর্গ শশী প্রায়

সুধীর মধুর ভাষী আধ কথা কয়
।।
পঞ্চম বয়ষ কালে বিদ্যারম্ভ হয়

গঙ্গাচরণ পন্ডিত ঘৃতকান্দী গায়
।।
তেঁহ ঠছাই কিছুকাল লেখাপড়া করি

বর্ণশিক্ষা ব্যাঞ্জনাদি এল সব সারি
।।
নমঃকুলে জন্ম রঘুনাথ সরকার

শিক্ষক সাজিয়া এল ওড়াকান্দী পর
।।
ওড়াকান্দীবাসি যত স্বজাতির গণ

শিক্ষাকর্য্যে রঘুনাথে করিল বরণ
।।
গ্রাম মধ্যে গৃহ এক নির্ম্মাণ করিল

সেই ঘরে পাঠশালা স্থাপতি হইল
।।
নমঃ করে বিদ্যাদান অদ্ভুত ঘটনা

বর্ণহিন্দু সবে করে জল্পনা কল্পনা
।।
নমঃ করে বিদ্যাদান নমঃ শিক্ষা পায়

নমঃ যদি শিক্ষা পায় কি হবে উপায়
।।
তাই ভেবে বর্ণহিন্দু আলোচনা করে

প্রকাশ্যে বলিতে নারে নমঃশূদ্র ডরে
।।
নমঃ মধ্যে আদি স্কুল ওড়াকান্দি হল

নমঃশূদ্র ছাত্রবর্গ সকলি জুটিল
।।
এই পাঠশালে পড়ে শ্রীশশীভূষণ

নিম্ন ছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে সমাপন
।।
ছাত্রবৃত্তি কেন্দ্র রয় মহকুমা পরে

মাদারীপুর বলিয়া জানে সর্ব্ব জনে
।।
ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষাতে শ্রীশশীভূষণ

কৃতিত্বে করিল পাশ জানে সর্ব্বজন
।।
উচ্চছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে অতঃপর

পরীক্ষা করিল দান মহাকৃমা পরে
।।
বারশ নব্বই সালে মধ্যছাত্রবৃত্তি

পাশ করি বড় বাবু লভিবেন বৃত্তি
।।
বড়ই মেধাবীছাত্র শ্রীশশীভূষণ

শিক্ষকে বাসিত ভাল পুত্রের মতন
।।
দেশ মধ্রে শিক্ষা শেষ অতঃপর হল

ইংরেজী শিখিতে প্রাণে কামনা জাগিল
।।
পিতৃপদে মনোখেদে করে নিবেদন

ইংরেজী শিখিতে কিবা উপায় এখন
।।
এই দেশে নাহি তাতঃ সেই বিদ্যালয়

প্রাণের বাসনা বুঝি প্রাণে হল ক্ষয়
।।
দয়া করি মোরে পিতাঃ পাঠান বিদেশে

রাজবিদ্যা লব শিখি বিদেশেতে বসে
।।

 

পুত্র মুখে শুনি বাণী প্রভু বড় সুখী
বলে শশি থাক বসি ভয় আছে কি?
প্রাণে যদি ইচ্ছা থাকে অবশ্য পুরিবে

রাজবিদ্যা শিক্ষা তুমি নিশ্চয় করিবে
।।
মনে চিন্তা করে প্রভু কি করি উপায়?
পুত্রধনে শিক্ষা লাগি রাখিব কোথায়
।।
হেনকালে উপনীত তারক গোঁসাই

গানে জ্ঞানে প্রেমে ধ্যানে যাঁর তুল্য নাই
।।
হরিচাঁদে সমর্পিত আত্মা মন তনু

জ্ঞানে বৃহস্পতি তথা রূপে যেন ভানু
।।
অভেদাত্মা হরিগুরুচাঁদ বলি জানে

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এক জানি মানে
।।
শ্রীহরির লীলাকালে যেমন আসিত

সেই মত ওড়াকান্দী করে যাতায়াত
।।
সেই যে তাকরচন্দ্র দিল দরশন

ভক্তিভাবে পূজিলেন শ্রীগুরু-চরণ
।।
আনন্দে হাসিয়া প্রভু কুশল জিজ্ঞাসে

তারক উত্তর করে আঁখিজলে ভেসে
।।
তব কৃপা দৃষ্টি প্রভু যার পরে রয়

অকুশল তার সঙ্গ ছাড়ি দূরে যায়
।।
তব কৃপা বারিধারা পড়ে যেই শিরে

দুরন্ত সংসার তাপে কি করিতে পারে?
বারি মধ্যে শীতলতা গুণ আছে জানি

শীতলতা গুণে স্নিগ্ধ হয় সব প্রাণী
।।
যেই পাত্রে থাকে বারি তাতে ভেদ নাই

শীতলতা রহে সদা বলিহারি যাই
।।
তব কৃপা-বারি প্রভু তাপ-জ্বালা-নাশী

যেই পায় সেই স্নিগ্ধ তাপমধ্যে বসি
।।
বড়ই কুপাত্র আমি পাপ-তাপে জারা

আমা হতে প্রভু-কার্য্য কিছু নহে সারা
।।
বিফল জীবন বটে বিফল জনম

নাহি মোর ভক্তি শক্তি নাহি পরাক্রম
।।
তোমার কৃপার গুণে বলিহারি যাই

কৃপাগুণে সর্ব্বস্থানে মহাশান্তি পাই
।।
তাই বলি কৃপাগুণে আছি যে কুশলে

তব কৃপা রাখে মোরে জলে কিংবা স্থলে
।।
বিনয় বচনে যদি বলিল তারক
।।
ব্যাখ্যা তারে করে প্রভু হইয়া পুলক
।।
আহারাদি শেষে ডাকি বলে তারকেরে

শোন শোন হে তারক বলি যে তোমারে
।।
তব বাসস্থল হয় জয়পুর গ্রামে

নবগঙ্গা তীরে দেশ সুন্দর সুঠাম

নানা বর্ণ বাস করে সে গ্রাম মাঝারে

বিশেষতঃ সুশিক্ষিত সবে বাস করে
।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর নবশাখ

কুম্ভকার কর্ম্মকার নহেত একক
।।
নমঃশূদ্র তেলী মালী আছে বহুতর

সর্ব্ববর্ণ সম্মিলনে গ্রামটি সুন্দর
।।
শিক্ষা দীক্ষা সভ্যতাদি সকলি রয়েছে

ধনী জ্ঞাণী সুবিদ্বান কতই জন্মেছে
।।
আমাদের দেশে দেখ তার কিছু নাই

আলোহীন অন্ধ দেশে বাস করি তাই
।।
স্কুল পাঠশালা দেখ আছে মাত্র কটা

বাংলা শিক্ষা দেয় শুধু কিছু পরিপাটি
।।
ইংরেজী শিক্ষার কেন্দ্রে এই দেশে নাই

পুত্রগণে বল দেখি কোথায় পাঠাই
।।
এতেক বচন প্রভু কহে মনোদুঃখে

তারক শুনিয়া বাণী রহে অধোমুখে
।।
ক্ষণকাল পরে বলে দয়াল ঠাকুর

মনোকথা বলি খুলে দুঃখ কর দূর
।।
যদি মম সাধ্য মধ্যে কোন কিছু রয়

তব কৃপা বলে আমি করিব নিশ্চয়
।।
প্রভু কর হে তারক ছাত্রবৃত্তি পড়ি

শশী রহে বাড়ী বসে উপায় কি করি?


 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free