মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৩৮১-৪০০

পতিই পরম ধন জানিয়া অন্তরে
দিবানিশি সে সুকলা পতি পূজা করে
।।
এইভাবে পতিপত্নী গৃহবাসে রয়

তীর্থে যেতে ইচ্ছা করে সেই মহাশয়
।।
সঙ্গী সহ যাইবারে করিলেন মন

পত্নীর নিকটে কহে আপন মনন
।।
শুন সতী তীর্থবাসে যেতে আমি চাই

তোমার আদেশ বিনা যেতে সাধ্য নাই
।।
ধর্ম্মপত্নী তুমি মোর আছ এই ঘরে

তোমার সম্মতি চাই ধর্ম্ম কর্ম্ম তরে
।।
তীর্থ ধর্ম্ম শুনিয়াছি মহাপূণ্যময়

তীর্থ ভ্রমণেতে যেতে মন মোর চায়
।।
ধর্ম্মকর্ম্মে মত নিবে ধর্ম্মপত্নী ঠাঁই

তাই এই পূণ্য কর্ম্মে তব আজ্ঞা চাই
।।
এতেক কহিলা যদি কৃকল সুজন

করজোড়ে সে সুকলা কহিছে বচন
।।
পরম পবিত্র তুমি ওহে মহামতি

সে প্রস্তাব করিলে তাহা পুণ্যময় অতি
।।
সরল অন্তরে আমি করি নিবেদন

পুণ্যময় কর্ম্ম তুমি কর অনুক্ষণ
।।
ধর্ম্মপত্নী কোন ধর্ম্ম করিবে পালন?
তার কিছু কথা আমি করি নিবেদন
।।
জাগাবে পতির প্রাণে ধর্ম্মের পিপাসা

ধর্ম্মপথে থাকে পতি সদা সেই আশা
।।
ধর্ম্মকর্ম্মে পতি সনে রহিবে সঙ্গিনী

আখ্যা পাবে পতিব্রতা সে সহধর্ম্মিণী
।।
মহাপুণ্যময় বটে তীর্থাদি ভ্রমণ

পূর্ণকর্ম্মে তব সঙ্গে করিব গমন
।।
সস্ত্রীক পালিবে ধর্ম্মশাস্ত্রের বচন

সে কারণে মোরে সঙ্গে করহ গ্রহণ
।।
পত্নীর বচন শুনি কৃকল ভাবিল

তীর্থযাত্রাকালে এ কি বিপদ আসিল
।।
পথি নারী বিবর্জিতা শাস্ত্রে ইহা কয়

নারী সঙ্গে নিতে মোর ইচ্ছা নাহি হয়
।।
বিশেষতঃ মোর নারী অতীব কোমলা

পথশ্রমে অঙ্গ তার হইবে বিকলা
।।
দুর্গম তীর্থের পথে যাতায়াত কালে

সুবর্ণ লতিকা সম পড়িবে সে ঢলে
।।
ক্রমে ক্রমে হতে পারে প্রাণনাশ তার

তারে ছাড়া পরে গতি কি হবে আমার?
ধর্ম্মের আশ্রয় মোর এই বর-নারী

তারে হারা হয়ে বল কিসে প্রাণ ধরি?
কুসুমের সম এই প্রাণ-প্রিয়া মোর

পতির চিন্তাতে সদা রয়েছে বিভোর
।।
সঙ্গে নিলে মহাদুঃখে কুসুম শুকাবে

তীর্থ-ধর্ম্ম পুণ্যকর্ম্ম সব বৃথা হবে
।।
অধিক কি এই নারী যদি মৃতা হয়

আমার কঠিন প্রাণ যাইবে নিশ্চয়
।।
সতী নারী ছেড়ে গেলে পতি কি আর রয়?
পতি পক্ষে সতী নারী পরম আশ্রয়
।।
অতএব তীর্থ-পথে চলিব একেলা

গৃহেতে রহিবে সতী পবিত্রা সুকলা
।।
মনে মনে এই চিন্তা করে মহাশয়

সুকলা জানিল প্রাণে তত্ত্ব সমুদয়
।।
দেহমন সমপূন পতিরে যে করে

পতির মনের কথা জানিতে সে পারে
।।
বুঝিয়া পতির মন সুকলা কহিল

হেন চিন্তা প্রভু তব মনে কেন এল?
পুরুষের পক্ষে বহু ধর্ম্ম নিরূপণ

নারীপক্ষে ধর্ম্ম শুধু পতির সেবন
।।
পতিই আশ্রয় তার সর্ব্বতীর্থ সার

পতি বিনে রমণীর গতি নাহি আর
।।
পতি স্বর্গ পতি মোক্ষ পতি তীর্থ ময়

পতির চরণে নারী সর্ব্ব তীর্থ পায়
।।


পতির দক্ষিণ পদে তীর্থ যে প্রয়াগ
পুস্কর নামেতে তীর্থ রহে বাম ভাগ
।।
যুবতীর্ণা পৃথক তীর্থং বিনা ভর্ত্তুর্নশোভতে

সুখদং নাস্তি বৈ লোকে স্বর্গমোক্ষপ্রদায়কম
।।
সব্যং পাদং স্বর্ভর্ত্তুশ্চ প্রয়াগং বিদ্ধি সত্তম

বামংচ পুস্করং সত্য যা নারী পরিকল্পয়েৎ
।।
....পদ্মপুরানম
ছায়া সম তব সাথে মোরে প্রভু লও

অধিনীর পানে চাহি কৃপাবন্ত হও
।।
আমারে ছাড়িয়া নাথ যেয়ো না কখনে

এ প্রাণ রবে না দেহে কভু তোমা বিনে
।।
এতেক কহিছে তাঁরে বহু স্নেহ করি

কৃকল কহিছে তাঁরে বহু স্নেহ করি
।।
শোন প্রিয়ে মম কথা না হবে খন্ডন

তোমাকে ব্যাজিতে আমি পারিকি কখন?
সতী নারী যেই জন করিয়াছে তাজ্য

সাধু সমাজেতে তেহ বড়ই অ-পূজ্য
।।
ধর্ম্ম তারে কভু নাহি করিবে কল্যাণ

ধর্ম্মহীন মূঢ় সেই পশুর সমান
।।
তোমা নাহি ছেড়ে যাব এই জান মনে

আমি সদা আছি বাধ্য তোমার সুগুণে
।।
এইরূপে যদি কথা কৃকল কহিল

শান্ত হয়ে সতী তবে গৃহেতে পশিল
।।
মনুষ্য চরিত্র দেখ বড়ই অদ্ভুত

মনে মনে সে কৃকল নহে শান্তিযুত
।।
তীর্থে যেতে মন তার হইল চঞ্চল

ধর্ম্মলোভে নারী সঙ্গে করিল মন্ত্রণা
।।
একা তীর্থে যাবে সঙ্গে নারীকে লবে না

মন্ত্রণা করিয়া সাধু গেল নিজ ঘরে

কোন কথা না কহিল সতীর গোচরে
।।
শেষ রাত্রে শয্যাত্যাগ করে মহাশয়

সঙ্গীর সঙ্গেতে তবে তীর্থ প্রতি ধায়
।।
কিছু না জানিল সতী এহেন ঘটনা

পতি প্রতি কোনরূপে সন্দেহ আসে না
।।
ক্রমে ক্রমে বেলা হল সতী ভাবে মনে

বেলা হল তবু পতি নাহি ফিরে কেনে?
দেবতা মন্দিরে নিত্য পূজার্চ্চনা হয়

দেবপূজা কাল আজি বুঝি সরে যায়
।।
ব্যাকুলা হইয়া সতী পল্লীমধ্যে যায়

স্বজন বান্ধব জনে ডাকিয়া শুধায়
।।
শুন হে বান্ধব সবে আমার বচন

কেহ কি পতিরে মোর করেছ দর্শণ?”
সুকলার বাণী শুনি প্রতিবেশী কয়

তোমার বচন শুনি লাগিল বিস্ময়
।।
মোরা জানি তর পতি তীর্থে চলে গেল

তুমি যে জান না তাহা কিসে বুঝি বল?
অদ্য প্রাতেঃ সঙ্গী সহ করিল প্রস্থান

এতক্ষণে বহু পথ হল আগুয়ান
।।
এমত বচন যদি কহে প্রতিবেশী

সুকলা ফিরিল গৃহে আঁখি জলে ভাসি
।।
গৃহে ফিরি সেই সতী করিছে বিলাপ

কোন জনে দিল মোরে হেন অভিশাপ?
জন্মান্তরে ছিল বুঝি মোর বহু পাপ

নিষ্ঠুর সাজিয়া পতি দিল এই তাপ
।।
পূর্ব্বজন্ম কর্ম্মফলে সেজেছি পাপিনী

পতি তাই ছেড়ে গেল আপন গৃহিণী
।।
এ ছার জীবনে বল কিবা কাজ আর?
বৃথা জন্ম থেকে পতি দূরে গেল যার
।।
তীর্থবাসে পতি মোর কত কষ্ট পাবে

আধিতে ব্যাধিতে বল কে তারে সেবিবে?
কোথায় মিলিবে শয্যা কোথায় আহার?
ভূমি শয্যা পরে রহে তীর্থে বাস যার
।।
বিলাস ব্যসন কিছু না ঘটে কপালে

সুখাদ্য কোথায় মেলে তীর্থবাসী হলে?

পতি যার তীর্থবাসে সহিতেছে দুঃখ
কোন মুখে নারী ঘরে করে ভোগ সুখ
।।
অদ্য হতে আমি তাই ছাড়িনু সুখেরে

যোগিনী সাজিয়া রব পতির সংসারে
।।
সেই হতে সেই সতী রহে ভূমি পরে

কভু অনাহারে রহে কভু একাহারে
।।
কখন করে না সতী করবী বন্ধন

হাস্য-পরিহাস-শূণ্য মলিন বদন
।।
তৈল, মৎস্য, ঘৃহ, দধি না খায় লবণ

আতপ তন্ডুল সিদ্ধ করেন গ্রহণ
।।
মিষ্টদ্রব্য করে ত্যাগ নাহি খায় ক্ষীর

হা পতি হা পতি বলি চক্ষে বহে নীর
।।
নিদ্রাহীন চোখে দেবী দিবারাত্রি রয়

পুরুষের সঙ্গে কভু কথা নাহি কয়
।।
এভাবে সুকলা তবে সাজিলা যোগিণী

পতি চিন্তা নিয়ে ঘরে থাকে একাকিনী
।।
তাহার সঙ্গিনী যত আসি তাঁর ঠাঁই

বলে সখি হেন ভাব মোরা দেখি নাই
।।
কি কারণে বল তব মলিন বদন?
দিবানিশি কেন সদা করিছ রোদন?”
সুকলা কহিছে সখি মম কর্ম্ম দোষে

ভার্ষ্যা ছাড়ি পতি মোর গিয়াছে প্রবাসে
।।
তাঁহার বিরহে মোর জীবন চঞ্চল

সেই হেতু চক্ষে দেখ সদা ঝরে জল
।।
পতিই নারীর সুখ শাস্ত্রের প্রমাণ

পতি ছেড়ে নারী বল কিসে রাখে প্রাণ?
সেই দুঃখে দেহ মোর হয়েছে অঙ্গার

পতি ছাড়া তুমি প্রাণ নাহি বাঁচে আর
।।
এতেক কহিলা যদি সুকলা জননী

প্রবোধে কহিল তাঁরে যতেক সঙ্গিনী
।।
শুন দেবী বৃথা তুমি করিতেছ খেদ

কিছু কাল পরে তবে রবে না বিচ্ছেদ
।।
তীর্থযাত্রা সারি তব পতি মহোদয়

অবশ্য আসিবে গৃহে নাহিক সংশয়
।।
তার লাগি আত্মকষ্ট কেন তুমি সহ

কি শিখাল এই ধর্ম্ম সেই কথা কহ
।।
অসার সংসার মাঝে কেহ কার নয়

কার লাগি কান্দ তবে কাহার আশায়?
বিশেষতঃ পতি তব ফিরিবেন ঘরে

কোন লাগি বল কষ্ট সহ তার তরে?
পান ভোজনাদি জান সংসারের ফল

তাহা ছেড়ে বল দেহে কোথা পাবে বল?
তাই বলি শোন সখী দুঃখ কর মিছে

আত্মা কষ্ট পেলে তাতে জীব নাহি বাঁচে
।।
আর এক কথা মনে উঠিয়াছে সখি

তব সম আচরণ কার নাহি দেখি
।।
তীর্থবাসে গিয়ে থাকে সকলের পতি

কেহ সঙ্গে যায় কেহ নাহি হয় সাথী
।।
যারা গৃহে থাকে তারা না হয় মলিন

পান ভোজনাদি ছেড়ে নাহি হয় ক্ষীণ
।।
দেখিয়া তোমার কান্ড হয়েছি বিস্মিত

এই ধর্ম্ম কোন শাস্ত্রে লিখেছে বিহিত?”
সঙ্গিনীর কথা শুনি সতী ডেকে কয়

সতীধর্ম্ম নীতি কেহ জানে না নিশ্চয়
।।
বেদে বলে নারী সদা রবে পতি সনে

সতত তুষিবে তাঁরে বিবিধ বিধানে
।।
পতি ছেড়ে যেই নারী রহে একাকিনী

সাধু শাস্ত্রে বলে তারে পুংশ্চলী পাপিনী
।।
পতি বর্ত্তমানে নারী পালে অন্য ধর্ম্ম

বিষ্ঠা মূত্র সম তার হয় সব কর্ম্ম
।।
বিদ্যামানে যদা কান্তে অদ্য ধর্ম্মং করোতি যা

নিষ্ফলং জায়তে সত্যঃ পুঃশ্চলী পরিকথ্যতে
।।
.....পদ্মপুরাণম

 

স্বামী তুষ্ঠে দেব তুষ্ট, তুষ্ট মুনি ঋষি
স্বামী-পদে নারী পায় গয়া গঙ্গা কাশী
।।
স্বামী গুরু, স্বামী নাথ, দেবের দেবতা

স্বামীই নারীর প্রভু বিধির বিধাতা
।।
তুষ্টে ভর্ত্তরি তস্যাস্ত তুষ্টাঃ স্যুঃ সর্ব্বদেবতাঃ
তুষ্টে ভর্ত্তরি তুষ্যন্তি ঋষয়ো দেবমানাবঃ
।।
ভর্ত্তা নাথো গুরুভর্ত্তা দেবতা বৈ তৈঃ সহ

ভর্ত্তা তীর্থশ্চ পুণ্যশ্চ নারীনাং নৃপনন্দন
।।
-ভূমিখন্ডম

রমনীর বেশভূষা পতির কারণে

পতি দূরে গেলে বেশাভূষা করে কেনে?
পতি অগোচরে নারী বেশভূষা করে

পাপিনী বলিয়া তারে কহে সাধু নরে
।।
তাহা ভিন্ন আর কথা আছে গুরুতর

পতি অগোচরে সজ্জা আছে পাপভার
।।
প্রমাণ তাহার শুন বলি একমনে

সতীত্ব হারাল পদ্য কেমন বিধানে?”

 

পদ্মাবতীর বৃত্তান্ত
কংশের জননী নাম সতী পদ্মাবতী

সত্যকেতু নাম তার পিতা মহামতি
।।
বিদর্ভ রাজ্যের রাজা সেই মহাশয়

ধর্ম্মপথে থাকি রাজ্য পালে সর্ব্বদায়
।।
মথুর রাজ্যের রাজা উগ্রসের নাম

মহাসুখে রাজ্য যেথা করে গুণধাম
।।
পরম রূপসী সেই সতী পদ্মাবতী

তাঁরে বিয়া কৈল উগ্রসেন নরপতি
।।
পত্মীসহ মহাতেজা করয় বিহার

পত্নীর চিন্তায় সদা চিত্ত মুগ্ধ তার
।।
এই ভাবে কিছু কাল যবে গত হয়

মনে মনে ভাবিলেন সত্যকেতু রায়
।।
বহুদিন কন্যা মুখ দেখি নাই চোখে

নাহি জানি কন্যা মোর কোন ভাবে থাকে
।।
পদ্মাবতী কন্যা আনি জুড়াব পরাণ

এতদিন তারে মনে করি নাই কেন
।।
পিতার নিকটে কন্যা বহু আদরিণী

মাতার নিকটে পুত্র সেই রূপ জানি
।।
পুত্র নিয়ে আছে সুখে পদ্মার জননী

কন্যার বিরহে পোড়ে এ পোড়া পরাণী
।।
পদ্মার জননী বলে ‘‘কন্যা বিয়া দিলে

পিতৃগৃহে রাখা মন্দ শাস্ত্রে ইহা বলে
।।
তবু মনে বলে কন্যা কিছু দিন তরে

অবশ্য রাখিব তারে এনে নিজ ঘরে
।।
কিছু কাল পরে কন্যা স্বামী গৃহে যাবে

আমার তাপিত প্রাণে পূর্ণ শান্তি হবে
।।
এত ভাবি সেই রাজা দূত পাঠাইল

দূত দিয়া উগ্রসেনে কহিতে লাগিল
।।
‘‘নিবেদন নরপতি করি তব পায়

কন্যাকে লইতে রাজা আমারে পাঠায়
।।
কন্যার বিরহে রাজা দুঃখী অতিশয়

তাই ইচ্ছা করে কন্যা নিতে পিত্রালয়
।।’’
ধীরভাবে শুন কথা উগ্রসেন রায়

মনেতে বিচার করে- কি কর্ত্তব্য হয়
।।
পরম ধার্ম্মিক বটে সত্যকেতু রাজা

দীপ্তমান সূর্য্য প্রায় অতি মহাতেজা
।।
স্নেহের বাঁধনে বান্ধে করি কন্যাদান

আমার মঙ্গল ইচ্ছা করে মতিমান
।।
অপত্য স্নেহের দায়ে কন্যা নিতে চায়

তাঁর আজ্ঞা অবহেলা উচিত না হয়
।।
প্রাণের অধিক মোর পদ্মাবতী সতী

তার প্রেমে মগ্ন আমি আছি দিবারাতি
।।
তথাপিত কর্ত্তব্য মোর জাগিয়াছে মনে

পাঠাইতে পদ্মাবতী পিতার ভবনে
।।

 

 

যেই প্রেম কর্ত্তব্যেরে অবহেলা করে
মোহনাম ধরে তাহা পৃথিবী ভিতরে
।।
পদ্মাবতী প্রতি মোর বহু প্রেম আছে

কিন্তু ক্ষুদ্র মানি তাহা কর্ত্তব্যের কাছে
।।
এত ভাবি নররায় পাঠাইল সতী

সুখে পিতৃ-গৃহে গেল সেই পদ্মাবতী
।।
মানব আচারে যাহা ঘটে সর্ব্বদায়

পদ্মাবতী পক্ষে তার না হল ব্যতায়
।।
পিতৃ গৃহে আসি পদ্ম প্রমত্তা হইল

পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান সব ভুলে গেল
।।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু দেখে চারিদিকে

আদরে কদরবাড়ে সুখে মত্ত থাকে
।।
বসন ভূষণে সদা ঢাকে নিজ দেহ

আপনার গুণগানে মত্ত অহরহ
।।
নিঃশঙ্ক চিত্তেতে সদা করিত ভ্রমণ

যথা ইচ্ছা তথা যায় পেলে নিমন্ত্রণ
।।
বাল্যের সঙ্গিনী যত তাহাদের সাথে

বন উপবনে যায় মাতি আনন্দেতে
।।
অপত্য স্নেহের দায়ে পিতামাতা হার

দেখিয়াও নাহি দেখে এ সব আচার
।।
বিন্দুমাত্র রূঢ় কথা যদি কেহ কয়

ক্রোধে জ্বলে ওঠে পদ্ম প্রাণে নাহি সয়
।।
এই ভাবে নারী-ধর্ম্মে পড়ে গেল ভুল

ফল-ভরা বৃক্ষ দেখ হারাইল মূল
।।
একদিন সেই পদ্মা সঙ্গিনীর সঙ্গে

রম্য উপবনে খেলা করে মনোরঙ্গে
।।
কর্ম্মফল আসি তবে দিল দরশন

এবে শুন কিসে তার হইল পতন
।।
গেভিল নামেতে দৈত্য কুবেরের দাস

দৈবক্রমে যেতে ছিল ভেদিয়া আকাশ
।।
নিম্নদৃষ্টি করি দেখে রমণীর মেলা

তরুণী রূপসী সবে করিতেছে খেলা
।।
মায়াবী দৈত্যের মনে কাম উপজিল

আকাশ ভেদিয়া তবে ভূতলে নামিল
।।
মায়াশক্তি বলে দেখে করিয়া গণনা

মথুরারাজের পত্মী সেই যে ললনা
।।
সতী-ধর্ম্মে ঘেরা বটে ছিল এতদিন

পিতৃ-গৃহে আসি তাহা হয়েছে মলিন
।।
গেভিল ভাবিছে মনে তবে আছে আশা

সতী-ধর্ম্ম হীনা নারী-সেই মোর বাসা
।।
পাপ-পথে এ বালারে পারিব মজাতে

নাহি ভয়-ধর্ম্মশক্তি নাই তার হাতে
।।
নারী-ধর্ম্ম ছাড়ি এবে মোহ চক্ষু অন্ধ

কিছুই দেখে না চোখে ভাল কিংবা মন্দ
।।
এত ভাবি সে গেভিল মায়া-মূর্ত্তি ধরে

উগ্রসেন রূপে দেখা দিল কিছু দূরে
।।
মোহন বাঁশিতে ধ্বনি করিতে লাগিল

বাঁশী শুনি পদ্মাবতী চঞ্চলা হইল
।।
স্বর প্রতি শীঘ্র গতি হল অগ্রসর

দেখে কিছু দূরে উগ্রসনে নরবর
।।
সতীধর্ম্ম-হারা পদ্মা জ্ঞান-চক্ষু নাই

দৈত্য যে পতির বেশে দেখিল না তাই
।।
মোহাচ্ছন্ন সেই নারী লজ্জ্বিতা হইল

লজ্জ্বা-ছিদ্র পথে পাপ তাহারে ঘিরিল
।।
মায়াবী গেভিল দৈত্য পাইল সুযোগ

পদ্মাবতী কন্যা সেথা করিল সম্ভোগ
।।
পাপের এমনি লীলা নরে বোঝা দায়

বক্ষে টেনে নিয়ে পাপ পরে চেনা দেয়
।।
এ ক্ষেত্রে ঘটিল তাহা সম্ভোগের পরে

পদ্মা বোঝে ধর্ম্ম নাশ করে অন্য নরে
।।
অতি ক্রুদ্ধা সেই পদ্মা শাপ দিতে গেল

মায়া-রূপ ছেড়ে দৈত্য নিজ রূপ নিল
।।
পদ্মা বলে ‘‘ওরে দুষ্ট দানব অধম

নিশ্চয় স্মরণ তোরে করিয়াছে যম
।।

 

ছেলে বলে ধর্ম্মনাশ করিলি আমার
আমার শাপেতে তোর নাহিরে নিস্তার
।।’’
বিষহীনা বিষধরে কেবা করে ভয়?
হাসিয়া গেভিল দৈত্য তাই তারে কয়
।।
‘‘অযথা গঞ্জনা নারী করো না আমায়

ধর্ম্মহীনা তুমি তাই নাহি মোর ভয়
।।
আমার আচার যাহা বলি তব ঠাঁই

দৈত্যাচারে দেখ মোরা ঘুরিয়া বেড়াই
।।
পরনারী পরধন হরণ করিয়া

দিবানিশি যথা তথা বেড়াই ঘুরিয়া
।।
যজ্ঞ-ধর্ম্মে নরনারী আছে যত জন

তাঁহাদের ছিদ্র মোরা করি অন্বেষণ
।।
কখনে মিলিলে ছিদ্র আর রক্ষা নাই

অনায়াসে ধর্ম্মনাশ করি সর্ব্ব ঠাঁই
।।
দৈত্য-ধর্ম্মে এই নীতি শুনহে ললনা

কিন্তু তিন স্থানে মোরা করিনা ছলনা
।।
সে-তিনের তেজে দৈত্য ভস্মীভূত হয়

শোন বলি সে-তিনের যাহা পরিচয়
।।
রক্ষাকর্ত্তা ভগবান বিষ্ণু নাম যাঁর

অগ্নিদোত্রী সুব্রাহ্মণ পবিত্র আচার
।।
পতিব্রতা নারী জানি সকলের সেরা

এতিনের কাছে কভু নাহি যাই মোরা
।।
পতিব্রত্য ধর্ম্ম কথা শুন দিয়া মন

পতিব্রতা নারী বল আছে কয় জন?
‘‘বাক্যে, মনে, কর্ম্মে নারী পতিকে তুষিবে

দেখিলে পতির ক্রোধ, ক্রুদ্ধ নাহি হবে
।।
তাড়িতা হইয়া নারী পতি নাহি ছাড়ে

তাঁর শান্তি দিতে প্রাণ ছাড়িতে যে পারে
।।
পতি-মধ্যে যেই নারী নাহি দেখে দোষ

স্নেহাদি শুশ্রূষা দানে জন্মায় সন্তোষ
।।
পতিব্রতা বলি তাঁরে কহে নারায়ণ

দেবে তাঁরে পূজা করে ছাড় দৈত্যগণ
।।

ব্রাহ্মণের পক্ষে যথা যজ্ঞাগ্নি তাঁহার
সন্তানের পক্ষে পিতা জানি যে প্রকার
।।
নারী পক্ষে পতি বটে তেমন প্রকার

পতিত্যাগ সতী পক্ষে নহে সদাচার
।।
অধিক বলিব কিবা সতীধর্ম্ম কথা

পতি ভিন্ন সতীনাহি হয় পতিব্রতা
।।
পতিত, ব্যাধিত, কিংবা কুন্ঠিত বিকল

বিত্তহীন, কর্ম্মহীন, বিহীন সম্বল
।।
এহেন যদ্যপি পতি হয় কোন কালে

যেই সতী নাহি যায় কভু তারে ফেলে
।।
বরঞ্চ আদরে তার শুশ্রূষা করয়

ধন্য সতী পতিব্রতা জানিবে তাহায়
।।
অর্থ, বিত্ত, রূপ যশ আছে অধিকারে

এহেন পতিরে নারী সদা বাঞ্ছা করে
।।
সতীত্ব ধর্ম্মের তাতে না হয় পরীক্ষা

পতিব্রতা ধর্ম্মে লাগে দুঃখাগ্নিতে দীক্ষা
।।
আমাকে শাপিবে বৃথা মোর দোষ নাই

আমার কর্ত্তব্য পথে ঘুরিয়া বেড়াই
।।
অগ্নির কি দোষ বল জ্বলাধর্ম্ম তার

উড়িয়া পতঙ্গ কনে পড়ে তার পর?
আমাদের ধর্ম্ম কিছু বলি পুনরায়

সে-ধর্ম্ম পালনে কিছু দোষ নাহি হয়
।।
ধর্ম্ম পথে নরনারী মোরা বটে রাখি

ধর্ম্ম-ছাড়া হলে গুরুদন্ড দিয়া থাকি
।।
পতি অগোচরে বেশ করে যেই নারী

পুংশ্চলী বলিয়া তারে আমি ব্যাখ্যা করি
।।
এবে বল কোন ধর্ম্মে তুমি আজ হেথা?
সেজেছ মোহিনী বেশে পতি তব কোথা?
পিতৃগৃহে আনন্দেতে প্রমত্তা হয়েছ

সতীর পবিত্র ধর্ম জলাঞ্জলি দেছ
।।
পতি অগোপরে রবে সাজিয়া যোগিনী

শাস্ত্রে এই মত কয় আমি তাহা জানি
।।

এবে বল দেখি তুমি কোন ধর্ম্মে আছ?
পতিকে রাখিয়া দুরে ধর্ম্মকে ছেড়েছ
।।
এই পাপে গুরুদন্ড দিতেছি তোমায়

আমার কার্য্যের ফল ব্যর্থ নাহি হয়
।।
ধর্ম্মের বিরোধী কর্ম্মে জান এই ফল

তব গর্ভে পুত্র হবে দৈত্য মহাবল
।।
বিষ্ণু-দ্রোহী, দেব-দ্রোহী হবে এ জগতে

কুযশ রটনা হবে সেই পুত্র হতে
।।
কু-কর্ম্মে কু-ফল ফলে সুফল সুকর্ম্মে

এখনো সামাল হয়ে পাল নিজধর্ম্মে
।।
এত বলি সেই দৈত্য গেল নিজালয়

দুঃখে কান্দে পত্মাবতী বসে নিরালায়
।।
সখিগণ আসি পরে সকলি জানিল

বিমর্ষ চিত্তেতে পদ্ম পিতৃগৃহে গেল
।।
পিতামাতা জানিলেন সব বিবরণ

পতি গৃহে গেল পদ্মা বিষাদিত মন
।।
সেই গর্ভে মহাদৈত্য কংস জন্ম নিল

গেভিলের বাক্য দেখ আপনি ফলিল
।।
এ সব কারণে সখি বলিয়াছি কথা

পতি ছাড়া হয়ে নাহি রহে পতিব্রতা
।।
পতি যদি কাছে নাহি রহিবারে পারে

কার্য্যব্যপদেশে যায় কাছে কিংবা দূরে
।।
পতিব্রতা নারী তবে সাজিবে যোগিনী

সুখ, ভোগ, বেশ ভূষা ত্যজিবে তখনি
।।
সেই হেতু দীনা বেশ আমি সাজিয়াছি

ফিরে যদি আসে পতি তবে প্রাণে বাঁচি
।।’’
এই মত কথা যদি সুকলা কহিল

সখি গণে সবে তাঁরে ধন্য ধন্য কৈল
।।
পতিব্রতা সতী-থাকে কত বড়দায়

পদে পদে বিপদের ছাড়া দেখা দেয়
।।
এইভাবে সে সুকলা কাটাইছে কাল

স্বর্গপতি ইন্দ্র আসি পাতে মায়া-জাল
।।
ইন্দ্র ভাবে এই নারী সাধ্বী অতিশয়

পরীক্ষা করিয়া দেখি কি ফল দাঁড়ায়
।।
পতি তার দূরে গেছে একানিনী ঘরে

কোন শক্তি বলে দেখি ধর্ম্মরক্ষা করে
।।
এত ভাবি ইন্দ্রেদের কামকে স্মরিল

চিন্তামাত্রে কাম আসি সম্মুখে দাঁড়াল?
ইন্দ্র বলে ‘‘শুন কাম আমার বচন

নারীকুলে ধন্যা দেখ নারী এই জন
।।
পরম পবিত্রা সতী নামেতে সুকলা

নাহি জানে পাপে চিন্তা নহেক চঞ্চলা
।।
তীর্থবাসে পতি তার করিয়াছে গতি

একাকিনী ঘরে আছে সেই মহাসতী
।।
অবশ্য পরীক্ষা আমি করিব তাঁহারে

দেখি সতী কোন বলে ধর্ম্মরক্ষা করে?
এই কার্য্যে তুমি মোর হইবে সহায়

বুঝিয়া করহে কার্য্য উচিত যা হয়
।।
ইন্দ্রের বচন শুনি কহিলেন কাম

তব আজ্ঞা শিরোধার্য্য আমি করিলাম
।।
এই কার্য্য মোর পক্ষে না হবে কঠিন

আমার শক্তির তত্ত্ব জান চিরদিন
।।
মুনি, ঋষি, দেব, নর, আর যক্ষ, রক্ষ

সকলি আমার বশ্য আছে বহু সাক্ষ্য
।।
কি বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র সবে আমি জানি

আমার বিক্রম জানে নিজে শূলপাণি
।।
সামান্যা মানবী এই তাহে একাকিনী

মুহুর্ত্তে আমার শরে মরিবে রমণী
।।
ইন্দ্র বলে ‘‘শুন কাম মম অভিপ্রায়

লোভে, ক্ষোভে, কামে, ত্রাসে এই কার্য্য নয়
।।
কেমন পবিত্রা সতী করিব পরীক্ষা

দেখি কোনগুণে সতী করে ধর্ম্মরক্ষা
।।
এত বলি দেবরাজ ধরে নরাকার

পরম সুন্দর যুবা অতি মনোহর
।।

 

সুকলার গৃহে আসি দিল দরশন
লালসায় অঙ্গভঙ্গী করে ক্ষণে ক্ষণ
।।
তার প্রতি মহাসতী চাহিয়া না দেখে

পতি চিন্তা মাঝে সতী মগ্ন হয়ে থাকে
।।
যেথা যায় সেই সতী ইন্দ্র ঘুরে সাথে

ভুলিয়া ও সতী নাহি চাহে তার ভিতে
।।
মায়ার পুতলি ইন্দ্র স্মরণ করিল

দূতীরূপে রতি আসি উপনীত হল
।।
ধরিয়া সতীর বেশ সুকলারে কয়

‘‘সত্য, ধৈর্য্য, ক্ষমা তব দেখি অতিশয়
।।
কাহার কামিনী তুমি কোন পুণ্যবান?
ভার্য্যারূপে পেয়ে তোমার মহা ভাগ্যবান
।।
সুকলা কহিল তারে ‘‘শুন তুমি সতী

কৃকল নামেতে সাধু হয় মোর পতি
।।
তীর্থবাসে গেল পতি এ তিন বছর

তাঁহার বিরহে মোর চিত্ত জর জর
।।
এবে তব পরিচয় কহ মোর ঠাঁই

কিবা লাগি এইখানে আসিয়াছ ভাই?
দূতী বলে ‘‘শুন সতী আমার মনন

এক কার্য্য লাগি হেথা করি আগমন
।।
পরম নিষ্ঠুর তব পতি মহাশয়

বিনা দোষে সতী ছেড়ে তীর্থবাসে যায়
।।
বিনা দোষে যেই পতি গিয়াছে ছাড়িয়া

তার পথ চেয়ে কেন রয়েছ বসিয়া?
মানব জীবন দেখ নহে দীর্ঘতর

বয়সের ভেদে তাহে আছে কত স্তুর
।।
বাল্যকালে মানবের যায় ক্রীড়াচ্ছলে

বার্দ্ধকো দুঃখের রশি যায় বান্ধে হাতে গলে
।।
একমাত্র যৌবনেতে সুখের বিহার

সুখভোগ তব ভাগ্যে হলনা এবার
।।
যৌবনে তোমার পতি হয়েছে প্রবাসী

কোন লোভে আশা পথ চেয়ে আছ বসি?
বিফলে যৌবন যদি আজি চলে যায়

তবে কেন বল সতী এলে এ ধরায়?
আমি বলি যৌবনেরে কর উপভোগ

তাতে তব ভাগ্যে দেখ পরম সুযোগ
।।
এই যে পুরুষ রত্ন অতি রূপবান

ধন্যাঢ্য, সর্ব্বজ্ঞ রাখে সকল সন্ধান
।।
ইহ সঙ্গে সুখ ভোগ তুমি মত্ত হও

যৌবন-মদিরা পানে মহাসুখে রও
।।
এই মতে সেই দুতী করিল কীর্ত্তন

সুকলা কহিল তারে পবিত্র বচন
।।
‘‘শুন দূতি হেন বাক্য নাহি কহ আর

বুঝিলাম তুমি নাহি জান সমাচার
।।
ক্ষণিকের সুখলোভ দেখাইলে মোরে

নূতনত্ব কিছু নাহি ইহার ভিতরে
।।
যেই মতে কর নরে গৃহের নির্ম্মান

সেই তত্ত্ব নরদেহে দেখি বিদ্যমান
।।
আদিকান্ডে হয় শুধু গৃহের নির্ম্মাণ

মানবের বাল্যকাল ইহার সমান
।।
নির্ম্মাণের পরে গৃহ চিত্রিত করয়

চাকচিক্যশালী-গৃহ কিবা শোভা পায়
।।
মানব যৌবন জানি এইরূপ প্রায়

যৌবনের আগমনে রূপের উদয়
।।
পরে সেই গৃহ যবে ধ্বংস হতে যায়

গৃহ ছাড়ি গৃহস্বামী নবগৃহে ধায়
।।
বার্দ্ধক্য মানব দেহে এমনি প্রকার

বার্দ্ধক্যের আগমেন অস্থি চর্ম্ম সার
।।
মানব জীবনে দেখ সকলি চঞ্চল

যুবত্ব, বৃদ্ধত্ব কিছু নহেক প্রচল
।।
বালক যুবক হয় যুবক প্রাচীন

এক ঠাঁই কেহ বসে নহে চির দিন
।।
ঘটে ঘরে যথা ভরা রহে এক জল

আত্মা থাকে সর্ব্ব দেহে ব্যাপিয়া সকল
।।

 

 

কামনা লালসা যাহা ভোগের বাহন
কোনরূপে তারা তুষ্ঠ নহে কদাচন
।।
দেহী মাত্রে আছে দেখ বার্দ্ধক্য যৌবন

সৃষ্টি স্থিতি লয় তার আছে নিরূপণ
।।
মোহ বশে জীব ছোটে কামনার পথে

অতৃপ্ত বাসনা তৃপ্ত নহে কোন মতে
।।
এই যদি পরিণাম কামনার পথে

কিবা ফল বল দূতি মজিয়া তাহাতে?
আর বলি শোন তুমি নিগুঢ় কাহিনী

বিষ্ঠা-মূত্র-কৃমি-পূর্ণ এই দেহ জানি
।।
যেই রূপবান মোরে করিছে কামনা

তার বটে সেই দেহ একই ঘটনা
।।
তাতে বলি নূতনত্ব এই পথে নাই

জেনে শুনে বল কিসে সেই বিষ খাই?
কু-আশা আমার কাচে পূর্ণ নাহি হবে

তোমার প্রভুর কাছে এ-বাক্য কহিবে
।।’’
এই বাক্য শুনি দূতী করিল গমন

ইন্দ্রের নিকটে সব করে নিবেদন
।।
ইন্দ্র বলে ‘‘ধন্য সতী দেখিলাম চোখে

আর না করিব আমি পরীক্ষা তাহাকে
।।’’
কাম বলে মহারাজ কি বাক্য কহিলে

সামান্যা নারীর ঠাঁই পরাভব নিলে?
ইন্দ্র বলে ‘‘কাম তুমি করহে স্মরণ

গৌতমের অভিশাপ বহি যে কারণ
।।
সতী নারী প্রতি মোর নাহিক দুরাশা

মনে কর শিব-হস্তে তোমার দুর্দ্দশা
।।’’
মদন ডাকিয়া বলে শুন সুরপতি

আমি বটে জানি সত্য নরনারী-গতি
।।
কামনার পথে নারী অধিক বিহবলা

মনে মনে মন তার সতত উতলা
।।
মুখে বটে নাহি বলে অন্তরেতে চায়

বড় বড় কথা বলে সতীত্ব জানায়
।।
কিন্তু যদি অবকাশ পায় কোন ছলে

পত্যাখ্যান নারী নাহি করে কোনকালে
।।
বিশেষ আমার শাস্ত্রে অব্যর্থ সন্ধান

নিশ্চয় সুকলা দিবে নিজ কুলমান
।।’’
এত বলি কাম তবে রতিকে কহিল

‘‘সঙ্গী সাথী সবে নিয়ে মোর সাথে চল
।।’’
অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া তখন

ইন্দ্র ও রতির সঙ্গে চলিল মদন
।।
কামের কুটিল ইচ্ছা বুঝি নিজ মনে

সত্য কহে খেদভরে চাহি ধর্ম্মপানে
।।
‘‘দেখ ধর্ম্ম মহাদুষ্ট কামের দুরাশা

আমার আশ্রয় ধ্বংসে তার বড় আশা্
।।
তুমি, আমি, আর পূণ্য তিনের লাগিয়া

সুপবিত্রা সতী-গৃহে রেখেছি গড়িয়া
।।
তুমি জান কোথা কোথা আমার আবাস

একে একে আমি তাহা করিব প্রকাশ
।।
তপোধন বিপ্র আর পতিব্রতা সতী

সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় যেই নরপতি
।।
‘‘পতি তপোধনো বিপ্রঃ সুসতী যা পতিব্রতা

সুসত্যো ভূপতিধর্ম্মো মম গেহং ন সংশয়
।।’’
----ভূমিখন্ড-----
এই খানে গুরুচাঁদ সকলেরে বলে

‘‘কোন তত্ত্ব হল হেথা কেহ কি বুঝিলে?
অলঙ্কার দিয়া শাস্ত্রে বলেছে বচন

সহজ সরল ভাবে বলিব এখন
।।
ধর্ম্মকে রাখিলে ধর্ম্ম রাখে ধার্ম্মিকেরে

সেই কথা শাস্ত্রাবিদ বলেছে প্রকারে
।।
বিপ্র যদি মনে প্রাণে তপঃশীলা হয়

রাজা যদি সত্যপথে রাজত্ব চালায়
।।
নারী যদি পতিব্রতা হয় মনে প্রাণে

ধর্ম্ম সদা রক্ষা করে এই সব জানে
।।

 

 

অধিক সকল অর্থ শুন সবে বলি
পবিত্র জনেরে কভু নাহি ছোঁয় কলি
।।
পতিব্রতা সতী কিবা করে ব্যবহার?
পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান পতি সর্ব্বসার
।।
আপন বলিয়া ভবে তার কিছু নাই

সর্ব্বস্ব পতির পদে বিক্রীত সদাই
।।
মনে প্রাণে ভরা তার আছে পতিরূপ

তার চোখে আর নাহি দেখে অন্যরূপ
।।
সত্যকথা সত্যভাব সত্য ব্যবহার

আপনা হইতে জাগে হৃদয়ে তাঁহার
।।
এই নিষ্ঠা ধরি রাখে যেই পতিব্রতা

সত্য, ধর্ম্ম, পুণ্য আসি বাস করে সেথা
।।
নিস্কাম সতীর ব্রতে তার দীক্ষা হয়

কামের তাড়না কভু জাগেনা হৃদয়
।।
প্রকৃতির ভাবে যদি কোভু কোন ক্ষণে

কাম-বাঞ্ছা ওঠে জেগে পতিব্রতা প্রাণে
।।
পতি-নিষ্ঠা ব্রতে প্রাণে সত্য ব্যবহার

সত্যভাব দেয় বাধা কুকর্ম্মে তাহার
।।
শাস্ত্রে তাই বলিয়াছে করি অলঙ্কার

পতিব্রতা সতীনারী সত্যধর্ম্ম-ঘর
।।’’
এবে শুন সত্য কিবা বলে ধর্ম্ম ঠাঁই

কামের দুরাশা দেখে বলে ছেড়ে হাই
।।
সত্য বলে ‘‘শোন ধর্ম্ম এইসতী নারী

এর দেহে দেখ আমি সদা বাস করি
।।
সুসতীর দেহে মোর বড়ই আনন্দ

কামের কুটিল আশা তারে করে মন্দ
।।
ইতিপূর্ব্বে বহুবার এই দুষ্ঠ জন

বহুতর গৃহে মোর করেছে পতন
।।
এমনত পবিত্রা সতী অহল্যা কল্যাণী

কাম সঙ্গে ইন্দ্র ধর্ম্ম নাশিল আপনি
।।
মহাতাপ বিশ্বামিত্র আশ্রয় আমার

কাম এনে মেনকারে দিল ছারেখার
।।
কামের সঙ্গেতে যোগে আছে সুরপতি

সঙ্গিনী রঙ্গিণী রতি দুষ্ঠা সরস্বতী
।।
প্রবাসী কৃকল সাধু একেলা সুকলা

কি জানি কি দুষ্ঠ গণে করে ছলা কলা
।।
সসৈন্যে আসিছে কাম যুদ্ধের কারণে

সদুপায় কর ধর্ম্ম থাকিয়া এখানে
।।’’
সত্যের বচন শুনি ধর্ম্ম মহামতি

বলে ‘‘সত্য মোর বাক্য শুনহে সম্প্রতি
।।
প্রবাসী পতির লাগি সুকলা কাতরা

চিন্তা রোগে দেহমন আছে জরা জরা
।।
পতির কুশল যদি শুনিবারে পায়

দেহমন তেজোময় হইবে নিশ্চয়
।।
মোদের বান্ধব এই প্রজ্ঞামহামতি

সুকলারে শুভবার্ত্তা দিক শীঘ্র গতি
।।
ধর্ম্মের আজ্ঞায় তবে প্রজ্ঞা মহামতি

শকুনের রূপ ধরি চলে শীঘ্র গতি
।।’’
গৃহের উপরে বসি সুমঙ্গল কয়

‘‘শুনহে সুকলা সতি নাহি কোন ভয়
।।
তব পতি শীঘ্র গতি আসিছেন ঘরে

তৃতীয় দিবসে দেখা পাইবে তাঁহারে
।।
সুমঙ্গল বাণী শুনি সেই মহাসতী

করিল ‘‘মঙ্গল-যাগ’’ অতি শীঘ্র গতি
।।
হেনকালে ক্রীড়া রূপীমদনের দূতী

সুকলার আগে গিয়ে জানায় প্রণতি
।।
সুকলা কহিল তারে ‘‘তুমি কোন জন?’’
ক্রীড়া বলে ‘‘শোন দেবী মোর বিবরণ
।।
গুণবান, বলবান, পতি ছিল মোর

তাঁর লাগি দিবা নিশি বহে অশ্রুলোর
।।
অভাগিনী নারী আমি তাহাতে পাপিনী

সেই দোষে মোরে ছেড়ে গেছে গুণমণি
।।
সর্ব্ব ঠাঁই ঘুরি তাই তাঁহার তালাসে?
তোমার ব্যথার কথা শুনি হেথা এসে
।।

 

সমান দুঃখিনী দোঁহে দেখিলাম তাই
দুঃখিনী এসেছে ছুটে দুঃখিনীর ঠাঁই
।।’’
এতেক বলিয়া ধনি করিল ক্রন্দন

তার দুঃখে সুকলার দুঃখী হল মন
।।
আহারে পাপের খেলা বলিহারি যাই

কোন ভাবে ধরে কারে কিছু ঠিক নাই
।।
দন্ডে দন্ডে পলে পলে রূপ বদলায়

যার ভাব তাই ধরে শেষে করে ক্ষয়
।।
কখনে দরদী সাজে কখনে বান্ধব

কভু সাজে দীন দুঃখী কখনে বৈভব
।।
বিশ্বাস জাগায়ে প্রাণে গৃহমধ্যে যায়

সর্ব্বস্ব লুটিয়া শেষে কাঙ্গাল সাজায়
।।
এ যেন রাবণ রাজা মহাযোগী বেশে

ভিক্ষাচ্ছলে জানকীরে হলে লয় শেষে
।।
এমন নিপুণা সতী সুকলা জননী

ক্রীড়াকেআশ্রয় দিল ভাবিয়া দুঃখিনী
।।
এদিকে মদন রাজা সাঙ্গাপাঙ্গো লয়ে

মায়াজাল ফেলি সেথা রহিল বসিয়ে
।।
কুসুম কানন করে অতি মনোলোভা

কিবা সে নন্দন বন কিবা তার শোভা
।।
ততোধিক উপবন সৃজন করিল

সৌরভে আকাশ বায়ু সকলি ভরিল
।।
মায়াবৃক্ষে দুলিতেছে মায়াময় ফুল

কনক কুসুম বলে চোখে লাগে ভুল
।।
ফুল হাসে পাখী গায় মায়া উপবনে

দেবতার মন হরে ছার নর গণে
।।
কাননের শুন এবে শুন দিয়া মন

মায়া-বণে মায়া-ভরা সকলি স্বপন
।।
লোভী জনে উপবনে ভোগ লাগি যায়

কুসুম ধরিতে গেলে বাতাসে মিশিয়া
।।
হস্ত পদ বাঁধা পড়ে মায়ার শৃঙ্খলে

পিপাসায় প্রাণ যায় ক্রমে তিলে তিলে
।।
এই উপবনে তবে মদনের দূতী

সুকলারে নিয়ে যাবে করে হেন মতি
।।
সুকলারে ডাক দিয়া কহে মায়া নারী

‘‘চল সখি পাপ-হর বলে মোরা ঘুরি
।।
এই বনে আছে জান পুণ্যময় স্মৃতি

এইবনে গেলে সতী ফিরে পায় পতি
।।’’
সঙ্গিনীর বাক্যে দেবী সন্দেহ না করে

তার সাথে চলিলেন বনের ভিতরে
।।
বনে বনে দুই সখী করিছে ভ্রমণ

কোন দৃশ্যে নাহি ভুলে সুকলার মন
।।
ধর্ম্ম-আবরণে ঢাকা দেহমন যাঁর

কেমনে স্পর্শিবে মায়া বরাঙ্গ তাহার
।।
সৌরভ আসিল কত বাতাস ভরিয়া

মকরন্দ রূপে মায়া পড়িল ঝরিয়া
।।
কার পানে সেই সতী চাহিয়া না দেখে

পতিরূপ সর্ব্বদায় মনেমধ্যে রাখে
।।
হেনকালে ইন্দ্র ডাকি কহে মদনেরে

‘‘এসেছে সুকলা তুমি বেঁধ তারে শরে
।।’’
মদন কহিছে ‘‘তুমি শোন সুরপতি

এমন করিতে মোর না হবে শকতি
।।
অনঙ্গ হয়েছে আমি ত্রিলোচন-শাপে

আজো স্মৃতি হলে মনে প্রাণ মোর কাঁপে
।।
আধারে করিয়া ভর তাই কাজ করি

নিজ হতে কোন কাজ করিতে না পারি
।।
শোন ইন্দ্র কহি আমি কার্য্য পরিচয়

কোন ভাবে নরনারী ভুলাই মায়ায়?
মোর যত সৈন্য দেখ আছে মোর সঙ্গে

সকলে আমার আজ্ঞা মানে মনোরঙ্গে
।।
নরদেহে করি ভর নারীকে ভুলাই

পুনরায় নর ছেড়ে নারী দেহে যাই
।।
এই ভাবে খেলা মোর চলে এ জগতে

এই ভাবে সকলেরে টানি নিজ পথে
।।

 

 

তাই বলি এবে তুমি মোরে বাক্য লও।
সুন্দর সুন্দর বেশে নিজেরে সাজাও।।
তোমারে করিয়া ভর আমি করি রণ।
অবলা নারীর আজি নিশ্চয় মরণ।।
মদনের কথা শুনি তবে সুরপতি।
সুন্দর পুরুষ বেশে চলে শীঘ্র গতি।।
সুকলার কাছে গিয়া দিল দরশন।
তার দিকে সুকলার ফিরেনা নয়ন।।
হেন কালে মায়া দূতী স্বরূপ প্রকাশে।
সুকলার প্রতি কথা বলে হেসে হেসে।।
‘‘শোন সখি এই ব্যক্তি অতি গুণবান।
স্বর্গরাজ্যে রাজা ইনি দেবেন প্রধান।।
তোমাকে কামনা ইনি করিছে সদায়।
ইহাকে বরণ করি যাহ সুরালয়।।
হেনকালে ইন্দ্র তবে কহিল বচন।
শোন সতী আমি বলি আমার মনন।।
তোমারে দেখিয়া মন পাগল হইল।
তোমার রূপেতে মোর নয়ন ভুলিল।।
পূর্ব্বে তাই দূহী গেল নিকটে তোমার।
তাই ঠাঁই নাহি পাই আশার সঞ্চার।।
তাই নিজে তব পাশে আমি আসিয়াছি।
কামনা পূরণ হলে তবে প্রাণে বাঁচি।।
আমার কামনা যদি পূর্ণ কর তুমি।
তোমাকে করিব রানী স্বর্গরাজ্যে আমি।।
দেব যক্ষ রক্ষ সবে তোমারে বন্দিবে।
মর-দেহে তুমি নারী অমর হইবে।।
মানব-জীবন দেখ বহু দুঃখে ভরা।
জন্ম, মৃত্যু, আধি, ব্যাধি, পাপ, তাপ, জরা।।
অমরত্ব পেতে দেখ কত মুনি ঋষি।
অনাহারে অনিদ্রায় কষ্ট সহে বসি।।
তবু সকলের ভাগ্যে অমরত্ব নয়।
অমরত্ব পেতে কত জন্ম কেটে যায়।।
এহেন অমূল্য ধন দিব যে তোমারে।
আমারে বরণ কর আনন্দে অন্তরে।।
সবারে ডাকিয়া প্রভু বলে এইখানে।
বল দেখি দুষ্ঠা নারী কি করে তখনে?
পতি, পুত্র, ঘর বাড়ী সব ছেড়ে যায়।
কুল মান বিসর্জ্জন করে ইন্দ্র-পায়।।
ইন্দ্র ত দূরের কথা কি দেখি জগতে?
শত শত দুষ্টা নারী চলে কোন পথে?
স্বর্গরাজা অমরত্ব কিছুই লাগেনা।
কামবৃত্তি চরিতার্থে পুরায় বাসনা।।
সর্ব্ব দেশে দেখি আমি সবার ভিতরে।
সামান্য কারণে নারী পাপে মজে মরে।।
ধনবান রূপবান যত ব্যাভিচারী।
শয্যা পার্শ্বে রেখে থাকে কত শত নারী।।
সধবা বিধবা কিংবা অনূঢ়া কুমারী।
একদরে দেয় দাস মিশ্রী আর মুড়ি।।
ইহার মূলেতে দেখ রয়েছে কারণ।
কামনার কাল-বিষে ঘনায় মরণ।।
গৃহস্থ ঘরের বধু বল কোন দোষে?
পতি ছাড়ে ঘর ছাড়ে কোন মোহ বশে?
কামনার ধর্ম্ম এই নাহি মিটে আশা

দিনে দিনে জীবদেহে বাড়ায় পিপাসা।।
জ্বলন্ত আগুনে যথা রাখিয়া কটাহ।
নারী গণে ভাজে ধান রাখি অহরহ।।
এই স্থানে সেই ধান থাকিতে না পারে।
এখানে সেখানে ছুটে পড়ে চারিধারে।।
আগুণের মধ্যে তার নাহি মিলে শান্তি।
হেথা সেথা ঘোরে নিয়ে আপনার ভ্রান্তি।।
সেই রূপ নর নারী দেখি সমূদয়।
জীবন-কটাহে তারা ঘুরিয়া বেড়ায়।।
কামনা-আগুন তলে জ্বলে ঘোরতর।
তার তাপে নর নারী ঘুরে নিরন্তর।।

 

 

হায়! হায়! যেথা যায় সেইখানে তাপ।
জীবের জীবন-পটে ঘোর অভিশাপ।।
কামনার অগ্নি জ্বলে নিজে তাপ সহে।
যাহা পায় তাহা কয় ‘‘নহে ইহা নহে।।’’
কামনার তাপে জীব কভু নহে স্থির।
তীর ছেড়ে নীরে পড়ে নীর ফেলে তীর।।
জীবনের অভিশাপ-কামনার খেলা।
বিক্ষুব্ধ সাগর-বুকে দাঁড়ি-হীন ভেলা।।
কামনার রজ্জু দিয়ে যদি নারী নর।
এক সূত্রে বাঁধা দোঁহে পড়ে পরস্পর।।
কামের তাড়নে যদি দিলে এক সাথে।
সে-বন্ধন হবে ছিন্ন জীবনের পথে।।
প্রকাশ্যে নিরালে কত ঘটে ব্যাভিচার।
অতৃপ্ত কামনা রাজ্যে এই ব্যবহার।।
কিন্তু যদি পতি-পত্নী পবিত্র বাঁধনে।
সত্য-রজ্জু দিয়ে বাঁধা পড়ে মনে প্রাণে।।
ধর্ম্ম রাজ্যে চলে দোহে নিষ্ঠা সহকারে

ব্রহ্মান্ড সৃজিতে শক্তি ধরিবারে পারে।।
ইন্দ্রত্ব, ব্রহ্মত্ব তাঁরা অতি তুচ্ছ গণে।
করজোড়ে সে বিধাতা নমে সে-চরণে।।
তাহার প্রমাণ দেখ রাজার নন্দিনী।
সাবিত্রী নামেতে যিনি শাস্ত্রের কাহিনী।।
পবিত্রতা গুণে দেখ সেই মহাসতী।
বিধির লিখন মুছে আনে নিজ পতি।।
পতি ভিন্ন অন্য সবে সতী তুচ্ছ করে

নারায়নে শাপ দেয় যদি ধর্ম্ম হরে।।
তাহার প্রমাণ দেখ তুলসী সুন্দরী।
ছলে যাঁর ধর্ম্ম নাশ করিলেন হরি।।
নারায়নে দিল শাপ সেই অপরাধে।
বহিল সতীর শাপ নিজে কালাচাঁদে।।
সতী পক্ষে পতি ভিন্ন নাহি অন্য জন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব কিংবা নিজে নারায়ণ।।
পতিই সতীর পক্ষে স্বয়ং ঈশ্বর।
পতি সেবা ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম নহি তার।।
সতীগুণে পতি ধন্য বলে লোকাচারে।
মিথ্যা নহে-সত্য ইহা বলি বারে বারে।।
স্ত্রীভাগ্যে ধনের আশা করে সব লোকে।
সেই জন্যে লোকাচারে কথা বলে থাকে।।
সতীর সোয়ামী যেন পর্ব্বতের চূড়া।
অসতীর পতি যেন ভাঙ্গা নায়ের গুড়া।।
তাই বলি মা-সকল হও পতিব্রতা।
এবে শোন সে সুকলা বলে কোন কথা।।
ইন্দ্র যদি লোভ দিল অমরত্ব-ধনে।
বিষ-সম বাজে কথা সুকলার কাণে।।
ক্রুদ্ধা অতি সহাসতী ডাক দিয়া কয়।
‘‘আ রে রে দুরাত্মা তুই ঘোর পাপাশয়।।
একা নারী ভাবি মোর কর দুষ্ট বুদ্ধি।
কালের আহবানে তোর হল এত বৃদ্ধি।।
শোন দুষ্ট একা আমি নাহি কদাচন।
নিজে ধর্ম্ম করে মোরে সতত রক্ষণ।।
পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান প্রহরী আমর।
সতীত্ব ধনুকে জ্ঞানরূপে তীক্ষ্ণ শর।।
সত্যের বর্ম্মেতে ঢাকা আমার শরীর।
ইহাদিগে ধ্বংস করে নাহি হেন বীর।।
সতী-কোপনামে অগ্নি আছে দুই চোখে।
এ-বিশ্ব নাশিতে পারে চক্ষের পলকে
।।
ইন্দ্র পরিচয় দিলি ওরে মূঢ় ভ্রান্ত।
দেবরাজ ইন্দ্র দেখি অতি গুণবন্ত।।
তাঁর মুখে এই কথা শোভা নাহি পায়।
ছলাকারী মহাদুষ্ট তুই রে নিশ্চয়।।
অথবা সত্যই যদি ইন্দ্র তুই হস?
কি সাহসে হেন কথা নিজ মুখে কস?
তোর রীতি নীতি আমি সব জানি ভাল।
তোর দোষে সে অহল্যা পাষাণী সাজিল।।

ধর্ম্ম-হারা সতী তাই শাপ নাহি দিল।
গৌতমের অভিশাপে কিছু দুঃখ হল।।
বুড়া ঋষি নড়া-বুদ্ধি তাই পেলি রক্ষে।
তোর বাবা তোর প্রাণ চেয়ে নিল ভিক্ষা।।
রক্ষা তোর সেই দিনে আমি জন্মি নাই।
আজো সবে ইন্দ্র-মূর্ত্তি চোখে দেখে তাই।।
কিন্তু স্বভাবের দোষ কিসে বল যায়?
নিজে কাল টেনে তোর এনেছে হেথায়।।
ইন্দ্র চন্দ্র ব্রহ্মা কিষ্ণু যেই তুমি হও।
বাঁচিয়া থাকিতে যোগ্য তুমি আর নও।।
কালাগ্নি সতীর কোপে আর রক্ষা নাই।
দুষ্ট ব্যভিচারি তোরে দন্ড দিতে চাই।।
যদি কেহ থাকে তোর শেষের আশ্রয়।
প্রাণ ভরে তোরে ডেকে নে রে এ সময়
।।
এত বলি মহা সতী ডাকে আয় আয়।
আয়রে সতীত্ব তেজ অগ্নি হয়ে আয়।।
বলিতে বলিতে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল।
স্বর্গ মর্ত্ত্য ত্রিভুবন পলকে ঘিরিল।।
হতজ্ঞান ইন্দ্র দেখে আকাশে চাহিয়া।
উঠিছে অগ্নির শিখা অসীম ব্যাপিয়া।।
তার মধ্যে দেখে নাচে নিজে মহাকালী।
অসুর নাশিনী বেশে গলে নর-খুলী।।
লক লক নড়ে জিহবা রক্ত ধারা ঝরে।
দক্ষিণে খর্পর তাঁর খান্ডা বাম করে।।
মহাভীত সুরপতি জ্ঞান নাহি আর

কোথা রতি? কোথা কাম? সব অন্ধকার।।
নিশ্চয় মরণ বুঝি দেব সুরপতি।
পড়িল সতীর পদে করিয়া প্রণতি।।
মা মা বলি ডাকে ইন্দ্র পড়িয়া ধরায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
জানু পাতি করজোড় সে ইন্দ্র তখন।
স্তুব করে সতী-পদ করি নিরীক্ষণ।।

 

স্তব


‘‘জয়তু! জয়তু! তৃপ্যতু! তৃপ্যতু!
সতীরূপা কাল-ধাত্রি!
সম্বর! সম্বর! তেজঃ ভয়ঙ্কর
আমি যে মরণ-যাত্রী।।
ভীমা ভয়ঙ্করা ভব-ভয়-হরা,
ভীষণা ভাবিনী বেশে।
পলকে প্রলয় য়টিবে নিশ্চয়
কালের কেতন কেশে
।।
অবোধ অজ্ঞান তাই অপমান
দিতে চাই জননীরে।
ভাঙ্গিয়াছে ভুল ভাবিয়া আকুল
পাপ কেন নিছি শিরে।।
যে কর্ম্ম করেছি মরি কিংবা বাঁচি
কোন দুঃখ তাতে নাই।
একের কারণে মরে সর্ব্বজনে
মিনতি চরণে তাই।।
কাল-অগ্নি ঢেকে এ অপরাধীকে
শুধুই কথায় বাণে।
তারে শুধু লও জগত বাঁচাও
অপরে মারিবে কেনে?
সতীর মহিমা দিতে নারে সীমা
আপনি জগত-স্বামী।
সাজিয়া অজ্ঞান কামে হতজ্ঞান
গরণ খেয়েছি আমি।।
শুন গো জননি ব্রহ্মান্ড ধারিণি।
পাতকী সন্তানে ক্ষম।
ক্রোধ-অগ্নি জ্বেলে আঁখি খুলে দিলে
রাতুল চরণে নমঃ।।

 

 

জননী আমার আপনি সংহার
চরণে পড়িয়া রয়।
নারী-রূপধারী তুমি সতী নারী
আজিকে বুঝিছে হায়।।
সতীর দোহেতে সতীত্ব রূপেতে
তেজময়ী তুমি মাতা।
ক্ষম অপরাধ দেহ নিত্য পদ
চরণে রাখিনু মাথা।।
করুণা রূপিণী কৃকল-গৃহিণী
সেজেছ নারীর সাজে।
চরণে শরণ করেছে গ্রহণ
ক্ষমা কর দেবরাজে।।’’
এ ভাবে করিল স্তব দেব সুরপতি।
শূণ্য হতে বলে তবে দেবী ভগবতী।।
অতি ধন্যা প্রিয়া কন্যা কৃকল গৃহিণী।
ক্ষমা কর দেবরাজে ওগো সীমন্তিনী।
আর না করিবে ইন্দ্র এ হেন আচার।
তোমাকে পরীক্ষা করে মনে ভাব তাঁর।
অবোধ অজ্ঞান ইন্দ্র বৃদ্ধি নাহি ধরে।।
পবিত্র গঙ্গার জল কিসে শুদ্ধ করে।।
বহু শিক্ষা দেবরাজ পেল তব ঠাঁই।
শরণাগতরে মেরে কোন ফল নাই।।’’
দৈববাণী শুনি কোণে কৃকল-গৃহিনী।
চাহিয়া ইন্দ্রের পানে কহিলা তখনি।।
‘‘মাতার আজ্ঞায় ইন্দ্র! করিলাম ক্ষমা।
কিন্তু এক সর্ত বটে দিব আমি তোমা।।
যে যেখানে যেই নারী সতীধর্ম্মে আছে।
ত্রাণকর্ত্তা রূপে রবে তাহাদের কাছে।।
কোন দুষ্টু যদি চাহে ধর্ম্ম নাশিবারে।
অবশ্য হানিবে ব্রজ সে দুষ্টের শিরে।।’’
করজোড়ে বলে ইন্দ্র ‘‘ওগো কৃপাময়ি।
তোমার পবিত্র সর্তে আমি বাধ্য হই।।
আমি রব দেব তোমা আনন্দ অন্তরে।
অবিলম্বে তব পতি আসিবেন ঘরে।।
তোমার কীর্ত্তির কথা শুনিবে যে নারী।
পতিসহ হবে সেই স্বর্গ অধিকারী।।’’
এতেক বলিয়া ইন্দ্র বিদায় হইল।
স্বর্গে যেতে পথে পথে অন্তরে ভাবিল।।
‘‘এই যে কৃকল সাধু পুণ্যধর্ম্ম-আশে।
সতী ফেলে একা চলে দুর তীর্থবাসে।।
পুণ্যময় ধর্ম্মতত্ত্ব তার জানা নাই।
পবিত্র ধর্ম্মের তত্ত্ব তাহারে শিখাই।।
সুকলার সম সতী যার ঘরে রয়।
শত শত তীর্থফল ঘরে বসে পায়।।
অবোধ কৃকল তাহা বুঝিতে না পারে।
সতী ফেলে মিছামিছি তীর্থে তীর্থে ঘুরে।।
তাহারে শিখাব আজ পূণ্যধর্ম্ম কথা।
যেভাবে শিখাল মোরে তাঁর পতিব্রতা
।।
এত ভাবি ইন্দ্র তবে চলিল দক্ষিণে।
যে দিকে কৃকল সাধু ফিরে গৃহ পানে।।
গৃহের নিকটে আসি নামি পঙ্গাজলে।
করিল তর্পণ সাধু অতি কুতুহলে।।
তর্পণ করিয়া বৈশ্য জুড়ি কর পানি।
তৃপ্ত হও তৃপ্ত হওকরে এইধ্বনি।।
পিতৃ পুরুষের প্রতি করিল তর্পণ।
বলে ‘‘তীর্থ-যাত্রা ফল করিনু অপূর্ণ।।’’
হেনকালে দেখ তথা কিবা কান্ড হল।
প্রত্যক্ষে কৃকল সাধু দেখিতে লাগিল।।
জ্যোতির্ম্ময় রূপধারী কোন মহাজন।
কৃকলের পিতৃগণে করিছে পীড়ন।
পিতৃপুরুষেরা কান্দি কহিছে বচণ।
‘‘কোনপাপে আমাদিগে’’ করিছে শাসন।।’’
জ্যোতির্ম্ময় মহাজন ক্রোধভরে কয়।
‘‘চৌর্য্য অপরাধে দোষী তোমরা নিশ্চয়।।

 

 

এই যে কৃকল বৈশ্য তোমাদের সূত।
নিজ হস্তে শ্রাদ্ধ পিন্ড করেছে প্রস্তুত।।
শাস্ত্রে বলে ধর্ম্মপত্নী সঙ্গে করি লবে।
সতী নারী শ্রাদ্ধ পিন্ড প্রস্তুত করিবে।।
এই দুষ্ট সেই ধর্ম্ম করিয়াছে ভঙ্গ।
ধর্ম্ম পত্নী ঘরে ফেলে এসেছে নিঃসঙ্গ।।
যেই মূঢ় ধর্ম্মযুতা সতী নারী ফেলে।
ফললোভে তীর্থে যায় নিজ বাহুবলে।।
তার কৃতযত ধর্ম্ম সব বৃথা যায়।
তার দত্ত পিন্ড নিলে চুরি করা হয়।।
আর শুন সতীগুণে কত ফল হয়।
সতী যেথা সর্ব্বতীর্থ তথা আসি রয়।।
যার গৃহে সত্যবতী সতী নারী রয়।
দেব, ঋষি, বেদ শ্রুতি অধিষ্ঠান হয়।।
পুণ্যা নদী, পুণ্যতীর্থ যে আছে যেখানে।
সতী নারী যেথা রয় রহে সেইখানে।।
এ কারণে গৃহাশ্রমে সর্ব্বোত্তম কয়।
গার্হস্থ্য ধর্ম্মের তুল্য অন্য কিছু নয়।।
‘‘গার্হস্থ্যৎ পরমোধর্ম্মো দ্বিতীয়োনাস্তি ভূতলে।।’’
---পদ্মপুরাণম---
আর বলি শুন বৈশ্য ধর্ম্মনীতি যত।
ত্রিভূবনে ধর্ম্ম নাই গৃহধর্ম্ম মত।।
যত্র ভার্য্যা তত্র গৃহ সাধু জনে কয়।
ভার্য্যা ছাড়া গৃহ ধর্ম্ম কিসে বল হয়?
পুণ্যবতী সতী নারী পুণ্যতীর্থ ময়।
সতীর গুণেতে গৃহ স্বর্গ তুল্য হয়।।
তোমার পবিত্রা সতী সুকলা নামিনী

তোমার বিরহে গৃহে কাদে একাকিনী।।
তাঁহারে ফেলিয়া তুমি যে ধর্ম্ম করিলে।
সেই সব ধর্ম্মফল গিয়াছে বিফলে।।
যদি নিজ শুভ চাও নিজ গৃহে যাও।
পত্নীর সন্তুষ্ট করি শ্রাদ্ধপিন্ড দাও।।
পিতৃপুরুষেরা তবে পাইবে নিস্তর।
অন্যথায় দন্ড আমি দিব ঘোরতর।।
এমত শুনিয়া বাণী কৃকল তখন।
মহাদুঃখে গৃহপানে করিল গমন।।
কৃকলে আসিতে দেখি সুকলা কল্যাণী।
উচ্চরবে করিলেন সুমঙ্গল ধ্বনি।।
পাদ্য অর্ঘ্য শীঘ্রগতি করে আনয়ন।
স্বহস্তে পতির পদ করে প্রক্ষালন।।
অঞ্চলে মুছায় পদ যতন করিয়া।
দন্ডবৎ করে পদে গলে বস্ত্র দিয়া।।
কুশল জিজ্ঞাসা করে সুমধুর ভাষে।
সুখাদ্য আনিল দেবী চক্ষের নিমেষে।।
মনে মনে কৃকলের জাগে অনুতাপ

বলে ‘‘দেবী! আজ মোরে কর তুমি মাপ।।
বড়ই কুকর্ম্ম আমি করেছি জীবনে।
কোন ফল হয় নাই তীর্থাদি ভ্রমণে।।
তব সম সতী সদা গৃহে আছে যার।
সর্ব্বতীর্থ করে বাস গৃহেতে তাহার।।
মূঢ় আমি সেই তত্ত্ব পূর্ব্বে বুঝি নাই।
অনর্থক তীর্থবাসে কত কষ্ট পাই।।
মমতা রূপিনী তুমি কত গুণময়ী

তোমার স্নেহের আমি সদা বাধ্য রই।।
তোমার গুণের কতা কি বলিব আর।
দোষ পেয়ে কোন দোষ লহনা আমার।।
নিষ্ঠুর সাজিয়া আমি ফেলে একাকিনী।
গোপনে করিনু ত্যাগ সতী শিরোমণী।।
এত বড় অপরাধ কিছু নাহি মনে।
ফিরে পেয়ে পূজ মোরে পরম যতনে।।
হায়, হায় মন্দমতি আমি অভাজন।
দেখি নাই নিজ ঘরে পরম রতন।।’’
এতেক বলিয়া বৈশ্য অনুতাপ করে।
শশব্যস্ত সে সুকলা কহে পদ ধরে।।

‘‘প্রাণনাথ হেন বাক্য আর না কহিও।
পদানতা সুকলার পরাণে রহিও।।
তোমার মঙ্গল ইচ্ছা রক্ষিয়াছে মোরে।
আমি বেঁচে আছি শুধু তব কৃপা জোরে।।
কত অপরাধ নাথ এই অভাগিনী।
পারে নাই পূজিবারে চরণ দুখানি।।
নারীর জীবনে যাহা পরম সম্বল।
কর্ম্ম দোষে হারা হয়ে ছিনু এতকাল।।
কত যে করুণা তব তুল্য দিতে নাই।
দয়া করে অভাগীরে দেখা দিলে তাই।।
এই কথা বলে দেবী কান্দিয়া কান্দিয়া।
দুই হস্তে পতিপদ বক্ষেতে বান্ধিয়া।।
কৃকল কান্দিছে আর কান্দিছে সুকলা।
শূণ্যে জয়ধ্বনি করে যত দেববালা।।
দেব ঋষি মুনিগণে করিছে স্তবন।
ধন্য সতি ধন্য পতি ধন্য দুই জন।।
অপঃপর সে কৃকল পত্নীর সহিতে।
পিতৃগণে পিন্ডদান করে বিধিমতে।।
তবে পিতৃগণ তার দিব্যদহে ধরি।
স্বর্গ পথে গেল চলি আশীর্ব্বাদ করি।।
কিছুকাল পরে দেখ পতী পত্নী দোঁহে।
তাজিয়া মরত ধাম উর্দ্ধে যেতে চাহে।।
ইচ্ছা মাত্রে বিষ্ণু লোক হতে অকষ্মাৎ।
আসিল ধবল মূর্ত্তি জ্যোতির্ম্ময় রথ।।
সেই রথে এক সাথে পতি পত্নী গেল।
দোঁহা আগমনে স্বর্গে দুন্দুভি বাজিল।।
বিষ্ণুলোকে যেই মাত্রে করিল প্রবেশ।
নর দেহ ছাড়ি নিল ‘‘বিষ্ণুলহ্মী’’ বেশ।।
সতীর গুণেতে তাই নমস্কার করি।
সতীলহ্মী প্রীতে সবে বল হরি হরি।।


 

 

 

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের লহ্মীখালী হইতে প্রত্যাগমন


প্রভুর বচন রাশি যেন মধু-পোরা।
নর নারী কেন্দে কেন্দে যেন জ্ঞান-হারা।।
কাঞ্চন জননী প্রতি প্রভু ডাকি কয়।
‘‘বড় ক্ষিদে মাগো তুই খেতে দে আমায়।।
নিষ্ঠুরা জননী তুই দয়া মায়া-হীনা।
ক্ষিদে পেয়ে কান্দে ছেলে খেতে কি দিবিনা।।
বালকের প্রায় প্রভু করিছে কাকুতি।
তাহা শুনি কেন্দে ওঠে শ্রীকাঞ্চন সতী।।
দ্রুত গতি ধায় মাতা রন্ধন শালায়।
স্নান লাগি মহাপ্রভু রাহিরেতে যায়।।
ভক্তগণে জনে জনে স্নান করি আসে।
বিস্তৃত প্রাঙ্গণে সবে আহারেতে বসে।।
উত্তরের ঘরে বসে প্রভু দয়াময়।
স্বহস্তে কাঞ্চন দেবী অন্ন আনি দেয়।।
স্বয়ং লহ্মী করিয়াছে অন্নাদি রন্ধন।
তৃপ্তি সহকারে প্রভু করিল ভোজন।।
প্রসাদ বাঁটিয়া দিল সভার ভিতরে।
কেহ শিরে রাখে তাহা কেহ বক্ষে ধরে।।
এই ভাবে প্রেমানন্দে মহোৎসব হল

মহাপ্রভু লহ্মীখালী রজনী বঞ্চিল।।
অবিরাম করে নাম ভকতের দল।
আনন্দে সবার চোখে ঝরিতেছে জল।।
গোপালের খুল্লতাত নাম জয়ধর।
সূহ্মজ্ঞানী ছিল তিনি বাক্যে তৎপর।

গোপালের মামা যার নাম সোনারাম

সেই মামা এই খুড়া তারা ছিল বাম
।।
প্রভুকে দেখিয়া দোঁহে ভাবে মনে মন।
‘‘এমন মানুষ মোরা দেখিনি কখন।।
এতদিন গোপালেরে ভাবিয়াছি মন্দ।
ঠাকুরকে দেখিয়া দূর হল সব সন্দ।।

কুলের গৌরব পুত্র শ্রীগোপাল চন্দ্র
মোরা ধন্য বংশে পেয়ে হেন কুল-চন্দ্র।।
পুত্র নহে পিতা অদ্য হয়েছে গোপাল।
কেটে গেছে নয়নের কুয়াসার জাল।।
উভয় বংশের ভার দিব যে গোপালে।
ধন্য হবে দুই বংশ গোপালে মানিলে।।
এই ভাবে আলাপন করি দুই জনে।
প্রণাম করিল আসি প্রভুর চরণে।।
প্রভু কয় ‘‘শুন বলি হালদার মশায়।
তোমার সঙ্গেতে পূর্ব্বে হল পরিচয়।।
হাওলাদার জয়ধর গোপালের খুঁড়া।
উভয়ে জ্ঞানেতে শ্রেষ্ঠ বয়সেতে বুড়া।।
ভেবে দেখ দিন বেশী নাহিক সম্মুখে।
সব ফেলে যেতে হবে যথন সে ডাকে।।
জনম ভরিয়া কত করিয়াছ খেলা।
কি কি করে বল দেখি কেটে গেল বেলা।।
শেষ খেয়া-ঘাটে যবে যাইবে দুজনে।
কিবা সাথে নিয়ে যাবে ভেবেছ কি মনে?
পারে যেতে কড়ি লাগে সেই কড়ি কই?
কিছু নিলে হবে নারে হরি নাম বই।।
সে-কড়ির কি-জোগাড় করেছ দুজনে?
কোন দিনে সেই কথা ভেবেছ কি মনে?
প্রভুর বচন শুনি উভয়ে অজ্ঞান।
কেন্দে বলে ‘‘রক্ষা কর ওহে ভগবান।।
মোহের আঁধারে চক্ষু ঢাকা এতদিনে।
দয়া করে জ্ঞান দানে বাঁচালে দুজনে।।
আমাদের কিছু বটে নাহিক সম্বল।
সম্বলের মধ্যে মাত্র আছে শ্রীগোপাল
।।
মোরা ধন্য বংশ ধন্য গোপালের গুণে।
গোপালে ধরিয়া যদি পাই তোমা ধনে।।
তোমাকে গোপাল চেনে মোরা নাহি চিনি।
ভরসা গোপাল মাত্র ওহে গুণমণি।।’’
এত বলি উভয়ের চক্ষে ঝরে জল।
মহাপ্রভু বলে ‘‘কথা শুনহে গোপাল।।
তোমার মাতুল আর খুড়া মহাশয়।
উভয়েরে যত্ন করে রাখিও সদায়
।।
উভয়েরে ডাকি পরে বলে দয়াময়।
আমার বচন শোন দুই মহাশয়।।
জীবনে গোপালে দোঁহে ছাড়িও না ভুলে।
গোপালের গুণে কুল পাইবে অকুলে।।
তদবধি জয়ধর সব ছেড়ে দিল।
গোপালের সঙ্গে আসি একত্র হইল
।।
যাবৎ জীবিত ছিল ছিল একমনে

গোপাল পালিল তাঁরে পরম যতনে।।
কাঞ্চন জননী দেবী নিজ-মাতা প্রায়।
নিজহস্তে জয়ধরে সেবাদি করয়।।
মহানন্দে জয়ধর সর্ব্বক্ষণে কয়।
‘‘মোর মত সুখী কেহ নাহি এ ধরায়।।
মাতা মোর পূর্ণলহ্মী কাঞ্চন জননী।
গোপাল আমার বাবা ভক্ত শিরোমণী।।
যাহাদের পায়ে আসি সকলে লোটায়।
তারা মোরে যত্ন করে নাওয়ায় খাওয়ায়।।
রাজা মহারাজা নহে আমা হতে ধন্য।
এসব হয়েছে শুধু গোপালের জন্য।।
আমি খুড়া নড়াবড়া কোন গুণ নাই।
তবু দেখ সর্ব্বক্ষণ কত শান্তি পাই।।
ক্ষণে ক্ষণে করি আমি দাদাকে স্মরণ।
ভাবি হায় দাদা যদি থাকিত এখন।।
সাজান বাগানে তার ফলিয়াছে ফল।
সেই ফল ভোগ করি একাই কেবল।।
চিরকাল একসঙ্গে সব করিয়াছি।
দাদা মোরে সব দেছে আমি কি দিয়াছি?’’
এত বলি কান্দিতেন সেই মহাশয়।
নরপতি সমসুখী জীবন সন্ধ্যায়।।

 

বিষয় সম্পত্তির তাঁর যাহা কিছু ছিল।
সনোসুখে সব ধরে গোপালকে দিল।।
পঞ্চদশ বর্ষ পরে সেই মহাশয়।
জীবলীলা সাঙ্গ করি স্বর্গে চলি যায়।।
সংক্ষেপে জীবনী তাঁর করিনু লিখন।
মূল সূত্রে আসি কথা বলিব এখন।।
দুই দিন রহে প্রভু লহ্মীখালী গাঁয়।
লক্ষ লক্ষ লোক এল গোপাল আলয়।।
রাজসুয় যজ্ঞ যথা করে যুধিষ্ঠির।
সেই মত কার্য্য করে গোপাল সুধীর।।
প্রভুর লাগিয়া আনে দ্রব্য সমুদয়।
গুরুর সেবার যোগ্য যাহা মনে লয়।।
বস্ত্র আনে ছত্র আনে থাল থাল বাটি।
বালিশ তোষক আনে শীতল যে পাটি।।
লেপ আনে মূল্যবান ছড়ি একখানি।
জোড়বস্ত্র সবই আনে জোড়ের উড়ানী।।
তৃতীয় দিবসে প্রভু গৃহে যেতে চায়।
গোপাল কান্দিয়া বলে যাহা ইচ্ছা হয়।।
তোমার ইচ্ছায় চলে ব্রহ্মান্ড সকল।
আমার ইচ্ছা যে প্রভু সকলি বিফল।।
দীনে যদি মহামূল্য রত্ন কভু পায়।
সে রত্ন ছাড়িতে কভু প্রাণে কি জুড়ায়।।
অসংখ্য রত্নের খনি আছে চরণে।
সেই প্রভু দয়া করে এসেছে এখানে।।
আমার ইচ্ছাতে প্রভু সব জান তুমি।
যাহা ইচ্ছা কর বাবা কি বলিব আমি।।
প্রভু কয় হে গোপাল মোর বাক্য ধর

যাহা বলি সেই মত কার্য্য তুমি কর।।
এবাড়ী আমার বাড়ী সকলি আমার।
এসেছি, আসিব হেথা আর কতবার।

আমি বলি এবাড়িতে আছি সর্ব্বক্ষণে।
বিশ্বাস রাখিলে তুমি দেখিবে নয়নে।।

আর এক কথা বলি রাখিও স্মরণে।
এক কার্য্য আজ আমি করিনু এখানে।।
ওড়াকান্দি এক খুটা আমি রাখিলাম।
অন্য খুটি লহ্মীখালী আমি পুতিলাম।।
প্রহরী সাজিয়া রক্ষা কর এই খুটা

নিশ্চয় জানিও এই বাক্য নহে ঝুটা।।
প্রভুর বচন শুনি সাষ্টাঙ্গে গোপাল।
ধরায় লুটায়ে পড়ে চক্ষে ঝরে জল।।
কাঞ্চন দেবীরে তবে প্রভু বলে ডাকি।
কি গো মাতা কোন কথা তুমি বল নাকি।।
আমি যাহা বলি তাহা শোন মন দিয়ে।
এই কথা কোন দিনে যেওনাক ভুলে।।
মা বলে ডেকেছি তোমা শোন ঠাকুরাণী।
নারী জাতি আমি কিন্তু বেশী নাহি মানি।।
আমার জননী ছিল দেবী শান্তি মাতা।
তাঁর ছেলে মা মা বলে নহে তুচ্ছ কথা।।
আমার মায়ের মত থাকিও পবিত্র।
সাবধান ইহা নাহি ভুল ক্ষণ মাত্র।।
মাতা কয় ‘‘দয়াময় কিছু নাহি জানি।
কখন ভুলিনা যেন তোমার এ বাণী।।
মম পতি তব দাস যেন সদা রয়।
পতির চরণে যেন মোর মতি ধায়।।
পতি যেন সুখে থাকে হরিভক্ত হয়।
পতি চিন্তা থাকে যেন আমার হৃদয়।।
মাতার বচন শুনি প্রভু বলে ধন্য।
তোমাকে বলেছি মাতা শুধু এই জন্য।।
পতির মঙ্গল চিন্তা সতীর সাধনা।
পতি ভিন্ন সতী নারী কিছুত জানেনা।।
বড়ই আনন্দ হল শুনি তব কথা।
ধন্য সতী নিষ্ঠামতি অতি পতিব্রতা।।
এত বলি দয়াময় বিদায় মাগিল।
হুলুধ্বনি, জয়ধ্বনি সকলে করিল।।

বাড়ী ছাড়ি উঠে প্রভু নৌকার উপর।
গোপাল চলিল সঙ্গে প্রেমে থর থর।।
হেনকালে দেখ এক মধুর ঘটনা।
স্বমুখেতে প্রভু যাহা করিল রটনা।।
প্রভু লাগি যে যে দ্রব্য গোপাল আনিল।
ভক্তগণে বয়ে নিয়ে নৌকাতে রাখিল।।
সকল আনিল বটে রহিয়া সবাই।
তোষকাদি আনিবারে কার মনে নাই।।
কাঞ্চন জননী যবে আসিলেন ফিরে।
দেখিলেন তোষকাদি খাটের উপরে।।
ত্রস্তে-ব্যস্তে সে জননী আপনি তখন।
কক্ষ পরে তোষকাদি করিল গ্রহণ।।
দ্রুত গতি ঘাট প্রতি চলিছে জননী।
ঘাট হতে নৌকা তবে ছাড়িল তখনি।।
সকলে ঘাটের কাছে দাঁড়াইয়া রয়।
ধীরে ধীরে চলে তরী এমন সময়।।
দূর হতে ডাকে মাতা করিয়া মিনতি।
‘‘ক্ষণ মাত্র রাখ’’ নৌকা জগতের পতি।।
তোমার শয্যার সজ্জা সাথে করি লও।
দেয়া দ্রব্য দয়াময় কারে দিয়ে যাও।

ভাবময় মহাপ্রভু ভাবে বাধ্য রয়।
দাঁড়ি গণে ডেকে বলে প্রভু এ সময়।।
‘‘কুলেতে ভিড়াও তরী কর কিছু দেরী।
দেখ দেখি কে আসিছে এত তাড়াতাড়ি।।
সোণার বরণ দেখি বনদেবী প্রায়।
দেখ দেখি কে আসিছে ছুটিয়া ত্বরায়।।’’
সকলে চাহিয়া তারে চিনিল অমনি।
তারা বলে ‘‘এ যে মাতা কাঞ্চন জননী
।।’’
প্রভু কয় হায় হায় মাতা ছোটে কেন?
যাও যাও শীঘ্র শীঘ্র সেই তত্ত্ব জান।।
বলিতে বলিতে মাতা ঘাটেতে উদয়।
প্রচন্ড লেপের বোঝা কক্ষ পরে রয়।।
প্রভু বলে ‘‘কি গো মাতা এত ব্যস্ত কেন?’’
মাতা কয় দয়াময় সব তুমি জান।।’’
তোমার লেপের বোঝা পড়ে ছিল পাছে।
এসব আনিতে সবে ভুল করিয়াছে।।
তোমার লেপের বোঝা আনিয়াছি বয়ে।
দয়া করে এই সব যাও তুমি নিয়ে।

প্রভু বলে ধন্য ধন্য তুমি সতী মেয়ে

ভক্তি গুণে তুমি মোরে রাখিলে বান্ধিয়ে।।
দাঁড়ি যারা দ্রুত তারা তোষকাদি নিল।
জয়ধ্বনি করি তবে তরণী ছাড়িল।।
ভোলা নদী ধরি গেল বাদার নিকটে।
পশ্চিমে চলিল নৌকা তারপরে বটে।।
গভীর বনের বাজ্য নদীর কিনারে।
প্রভুর তরণী চলে মধ্যনদী ধরে।।
খড়মা নদীর বুকে তরী চলি যায়।
বামে তরী বাদাবন বটে ঢাকা রয়।।
কিবা সে বাদার শোভা অতি মনোরম।
গাছে গাছে ডালে ডালে নাহি ব্যতিক্রম।।
অনন্ত গাছের সারি মিশেছে অনন্তে।
কে যেন সৃজিল সব বসিয়া একান্তে।।
এক এক জাতি বৃক্ষ রহে এক ঠাঁই।
বৃক্ষতল পরিষ্কার জঙ্গলাদি নাই।।
নদীর কিনারে ঝোঁপ জঙ্গলাদি রয়

নদী চরে গোলপাতা বিচিত্র শোভায়।।
সুন্দর কিনারে ঝোঁপে গা ঢাকিয়া রয়।
জীবমাত্র নদীতীরে উপস্থিত হয়।।
লষ্ফ দিয়ে ধরে তারে ব্যঘ্র মহাশয়।।
ডাঙ্গায় বাঘের বাসা জলেতে কুমীর।
কোন প্রাণী বাদা মধ্যে নহেক সুস্থির।।
নির্ভয়ে চড়ায় উঠি কুম্ভীর মশায়।
আপন পাষাণ-দেহ রোদ্রেতে শুকায়
।।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free