মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৪৪১-৪৬০

আসিল সভার দিন গুরুচাঁদ ভক্তাধীন
ভক্ত সঙ্গে সভা প্রতি ধায়।
মন্মথ রঞ্জন যিনি প্রভুর সঙ্গেতে তিনি
আনন্দেতে চলিল সভায়।।
জ্ঞানী ভক্ত যঞ্জেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর
হইলেন প্রভুজীর সাথে।
এ দিকেতে খুলনায় সবে পথ-পানে চায়
সভাপতি আসে কোন পথে?
লোক জন সর্ব্বদায় ষ্টীমার ঘাটেতে যায়
ক্ষণে ক্ষণে আনে সমাচার

স্বেচ্ছাসেবী কর্ম্মী যত ঘুরিতেছে অবিরত
কিবা দিবা কিবা অন্ধকার।।
সুচিত্রিত অশ্বযান ঘাটে রাখে অধিষ্ঠান
বহিয়া আনিতে সভাপতি।
সেতাগণে সারি সারি ঘাটের মঞ্চের পরি
দাঁড়াইল সবে হৃষ্ট মতি।।
হেনকালে কিছু দুরে নদীর বক্ষের পরে
দেখা গেল ষ্টীমার খানি।
দৃষ্টি মাত্রে সবে কয় ‘‘জয় সভাপতি জয়’’
বহুক্ষণ করে জয় ধ্বনি।।
ধীরে ধীরে আসি তটে ষ্টীমার বাঁধিল ঘাটে
গুরুচাঁদ নামিলেন ধীরে।
সবে দৃষ্টি করে তাঁয় অপরূপ দেখা যায়
দেখে সবে জয় ধ্বনি করে।।
নেতাগণ অগ্রসর হইলেন মঞ্চোপর
দন্ডবৎ কর নত শিরে

প্রভুজী সুহাস হেসে অতিশয় মিষ্টি ভাষে
সবারে কুশল প্রশ্ন করে।।
মুকুন্দ বিহারী যিনি করে কর ধরি তিনি
অশ্বযানে উঠাল প্রভুরে।
প্রভু তাঁরে ডাকি লয় তাই তিনি সঙ্গে রয়
মন্থথ উঠিল একত্তরে।।
স্বেচ্ছাসেবী কর্মী যারা দুই সারি রহে তারা
সারি দীর্ঘ প্রায় বিশ রশি।
গাড়ী চলে ধীরে ধীরে দুই ধারে উচ্চেঃস্বরে
জয়ধ্বনি করে সবে আসি।।
‘‘জয় গুরুচাঁদ জয় জয় সভাপতি জয়
জয় নমঃশূদ্র জয়’’ কহে।
বিরাট মিছিল দেখি অপলকে মেলি আঁখি
নর নারী সবে চেয়ে রহে।।
এ ভাবে মিছিল করে সমস্ত শহর ঘোরে
দলে দলে ছোটে নর নারী।
ঠাকুরের নাম শুনে রূপ দেখে দুনয়নে
প্রণাম করিছে কর জুড়ি।।
এই ভাবে কিছু পরে সভা মন্ডপের ধারে
মিছিল করিল সবে ভঙ্গ।
আশ্রয় নির্দ্দিষ্ট যথা গুরুচাঁদ চলে তখা
মুকুন্দ বিহারী নিল সঙ্গ।
এই ভাবে রাত্রি যায় পর দিন সভা হয়
সভাপতি গুরুচাঁদ হল।
বঙ্গবাসী প্রধানেরা নমঃশূদ্র সবে যারা
সভামধ্যে সকলে আসিল।।
সভাপতির যে ভাষণ পড়িলেন যেই জন
নিরোদ বিহারী তাঁর নাম।
কোকিল-নিন্দিত স্বরে সে ভাষণ পাঠ করে
বসে শোনে যত গুণধাম।।
এমন সুন্দর সভা রূপে গুণে মনোলোভা
জ্ঞানী গুণী মহাত্মা-মিলন।
এর পূর্ব্বে কোন দিনে দেখে নাই কোন জনে
নমঃকুলে হেন আয়োজন
।।
কোন কোন মহাত্মায় এই সবা ক্ষেত্রে রয়
সংক্ষেপেতে দিব পরিচয়।
আনন্দ সাধক যিনি বরিশালে নেতা তিনি
সভাক্ষেত্রে হইল উদয়।

আসিলেন সনাতন নেতা তিনি অন্যজন
পিরোজপুরেতে তাঁর বাস

ষড়ানন সমাদ্দার সোহাগদলেতে ঘর
উকীল শ্রীভীষ্মদেব দাস।।
যশোহরে বাস জানি বসন্ত পন্ডিত যিনি
সঙ্গে এল আর কতজন।
আসিল যাদব ঢালী মুখে হরি হরি বলি
গুরুচাঁদে করিয়া স্মরণ।।
ঢাকার শহরে বাস শ্রীরজনী কান্ত দাস
একসঙ্গে রেবতী মোহন।
শ্রীজগত সরকার ঢাকার শহরে ঘর
ত্রিপুরার জগত মন্ডল।
আর ছিল বহুতর কত নাম কব আর
সাধ্য নহে কহিতে সকল।।
বেথুড়িয়া গ্রামে বাস যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস
প্রভু সঙ্গে আসিল আনন্দে।
আসিল গোপাল সাধু তারা মধ্যে যেন বিধু
ভক্ত সহ গুরুচাঁন্দে বন্দে।।
এই সম্মেলন হতে নমঃশূদ্র কোন পথে
চালনা করিবে রাজনীতি।
যাহা বলে দয়াময় সভা মধ্যে পাঠ হয়
তাতে সবে জানাল স্বীকৃতি।।
সেই সব নীতি কথা প্রকাশ করিব হেথা
যাহা বলে প্রভু দয়াময়।
গুরু যদি দয়া করে তবে বলা যেতে পারে
মোর সাধ্যে তাহা কভু নয়।।
‘‘নমঃশূদ্র জীর্ণ দীন বিদ্যাহীন চিরদিন
রাজা মহারাজ কেহ নয়।
নাহি জানে রাজনীতি বল কিসে হবে সাথী
উচ্চ হিন্দু যে যে পথে যায়?
অন্ন-চিন্তা ভয়ঙ্করী অন্য চিন্তা কিসে করি?
মনে মনে মরি সবে জ্বলে।
গাছের আগায় এসে যারা সুখে আছে বসে
বড় বড় কথা তারা বলে।।
সে-পথ তাদের জন্য আমাদের পথ ভিন্ন
সেই পথে সবে মোরা চলি।
ভোগ হলে জাগে ত্যাগ, কিছু নাই কিসে ত্যাগ?
‘‘ভোগ চাই’’ এই মাত্র বলি।।
বিদ্যা চাই ধন চাই বসন ভূষণ চাই
হতে চাই জজ ম্যাজিষ্ট্রেট।
সাগর ডিঙ্গাতে চাই দেখি সেথা কিবা পাই
কেন রব মাথা করে হেট?
অসহযোগের নীতি নিলে আজ মাথা পাতি
এই জাতি কভু উঠিবেনা

চিরকাল অন্ধকারে সেই যে রহেছে পড়ে
অন্ধকার আর ঘুচিবেনা।।
অবশ্য দে্শের তবে যাঁরা প্রাণপাত করে
ধন্য তাঁরা মানব জীবনে।
দেশ-প্রীতি দেশ-সেবা কভু ঘৃণা করে কেবা?
তারতম্য রয়েছে বিধানে।।
স্বাধীনতা যদি আসে, তা হতে কি শ্রেষ্ঠ আছে?
বুঝিনা যে এত অন্ধ নই

তবে যে নামিনা পথে, বহু বাধা আছে তাতে
এড়াইতে পারি বাধা কই?
তর্কের খাতিরে বলি অনুন্নত জাতি গুলি
এক সঙ্গে দিল যোগ দলে।
কি কাজ করিবে তারা? পাবে কোন কার্য্য-ধারা?
কিবা গিয়াছে দাঁড়াইবে ফলে?
জন চাকুরে তারা? আদালতে ঘোরা ফেরা
কতজনে করিতেছে তারা?
স্কুল-ছাড়া কথা হলে বলা যায় কুতুহলে
প্রায় সবে বিদ্যালয়-ছাড়া।।

 

 

তাতে বলি এই নীতি অনুন্নত যত জাতি
তাহাদের পক্ষে নাহি খাটে।
উচ্চ উচ্চ বর্ণ যারা স্কুল আদালতে ভরা
এই নীতি তাহাদের বটে।।
কিন্তু কি আশ্চর্য্য ভাই! তারা বেশী ছাড়ে নাই
প্রায় সবে আছে চাকুরীতে।
আদালতে মোকদ্দমা নিত্য তারা করে জমা
স্কুল খোলা দেখি সর্ব্বক্ষেত্রে।।
এই সব দেখে দেখে লও ভাই সবে শিখে
কোন ভাবে চলিছে সংসার।
বুদ্ধিহীন সরলতা আর নাহি চলে হেথা
কুট-বুদ্ধি বটে দরকার।।
স্বাধীনতা কথা ভাল, নেয়া ভাল দেয়া ভাল
ভাল তাতে নাহিক সন্দেহ।
‘‘কথা মালা’’ যাহা বলে পড়িয়াছে বাল্যকালে
সেই কথা ভুলিওনা কেহ।।
বাঘের গলায় হাঁড় টেনে যদি কর বার
পুরস্কার এক মুঠা ছাই।
যত সব মহাভাগ করিতেছে আত্মত্যাগ
তোমাদের জন্যে কিছু নাই।।
শুন বলি সে প্রমাণ যত সব মতিমান
আত্মত্যাগ করিছে ভারতে।
স্বাধীনতা পাবে যবে কারা উপকৃত হবে?
সেই কথা পার কি বলিতে?
কর্ত্তা আজ যারা যারা সে দিন একত্রে তারা
রচনা করিবে শাসন তন্ত্র।
রাজাদের সে সভায় তোমাদের স্থান নয়
তোমরাত শুধু বাদ্য যন্ত্র।।
যুদ্ধকালে প্রয়োজন বাদ্য যন্ত্র অগণন
যুদ্ধ শেষে কে করে সন্ধান?
যদি থাক সেনাপতি তবে হতে পারে গতি
সেই গুণে তুমি আজ আন।।
যে যে গুণে সেনাপতি কোথা পাবে এই জাতি?
শিশু মাত্র জাগরণ-পথে।
যৌবনের পূর্ণ বেগে যারা আজ চলে আগে
তুলনা কি চলে তার সাথে?
আসিবে যৌবন যবে তোমারো সে ভাব হবে
কালগুণে চলিবে আপনি।
আজ তাতে কার্য্য নাই তাই বলি শুন ভাই
ভুলে যাও সে সব কাহিনী।।
জাতির উন্নতি লাগি হও সবে স্বার্থত্যাগী
দিবারাত্রি চিন্তা কর তাই।
জাতি ধর্ম্ম, জাতি মান জাতি মোর ভগবান
জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই।।
কিবা বিদ্যা, কিবা ধনে কিবা শিল্পে, কি বিজ্ঞানে
রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে রাজ-কাজে।
সবখানে থাকা চাই তা ভিন্ন উপায় নাই
রাজবেশে সাজ রাজ-সাজে।।
নর নারী দুইজনে প্রতি কার্য্যে প্রতিক্ষণে
তালে তালে হও অগ্রসর।
অলসতা দেও ছেড়ে বল সবে বজ্র স্বরে
‘‘আগে চল নাহি অবসর।।’’
এই বাণী সমর্থন করিলেন সর্ব্ব জন
অন্য সবে বলিলেন কত।
প্রভুর ভাষণ শুনে যত নমঃশূদ্র গণে
ধন্যবাদ করে শত শত।।
সভা ভঙ্গ হল যবে প্রভুজী ডাকিয়া তবে
বলিলেন মুকুন্দের ঠাঁই।
‘‘বাবুজী শুনন কথা কার্য্য শেষ হল হেথা
মনে করি দেশে চলে যাই।।
মুকুন্দ বিহারী তায় দেখালেন সুবিনয়
প্রভু সঙ্গে চলিলেন ঘাটে।
স্বেচ্ছা-সেবী ছিল যারা সঙ্গে সঙ্গে চলে তারা
চলে প্রভু অশ্বযানে উঠে।।

সকলে বিনয় করে প্রভুকে বিদায় করে
অতঃপর প্রভু গেল দেশে।
যবে গৃহে উপস্থিত কুসংবাদ বিপরীত
দেশবাসী জানাইল এসে।।
দূরে পদ্মবিলা গাঁয় উপস্থিত কু-সময়
মুসলমানে করিছে কল্পনা
শাস্তি দিবে নমঃশূদ্রে ফেলি চক্রব্যুহ মধ্যে
এবে বলি সেই সে ঘটনা।।

 

পদ্মবিলা দাঙ্গা


ফরিদপুরবাসী যত নমঃশূদ্রগণ।
অস্ত্র শস্ত্র লাটি খেলা জানে বিচক্ষণ।।
বড়ই তেজস্বী সবে তাহার কারণ।
অত্যাচার অবিচার মানে না কখন।।
ইসলাম ধর্মী লোক আছে সেই দেশে।
নমঃশূদ্র সঙ্গে বাস করে পাশে পাশে।।
উভয়ে কৃষক জাতি এ ব্যবসায়।
এক দেশে বাস করে এক দেশে রয়।।
কিন্তু কি দুর্ভ্যাগ্য! দেখ সময়ে সময়।
দুই জাতি দাঙ্গা করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।।
কোনখানে নমঃশূদ্র আগে দোষ করে।
কোনখানে ইসলাম আগে অস্ত্র ধরে।।
অস্ত্র খেলা দুজাতির জানা আছে ভাল।
সামান্য কারণে ঘটে বিষম জঞ্ছাল।।
কাশিয়ানী থানা মধ্যে পদ্মবিলা গ্রাম।
যেই দেশে ছিল সাধু দশরথ নাম।।
মহাজ্ঞানী রামতনু জন্মে সেই দেশে।
গোমস্তা রূপেতে ছিল ওড়াকান্দী এসে।।
তেরশতিরিশ সালে সেই পদ্মবিলা

বঙ্গবাসী দেখেছিল তান্ডবের লীলা।।
সামান্য ঘটনা এক তুচ্ছ হতে তুচ্ছ।
তাহা হতে জ্বলে, অগ্নি স্বর্গভেদী পুচ্ছ।।
লোকমুখে শুনি যাহা করিল রটনা।
কত মর্ম্মভেদী সেই দুরন্ত ঘটনা।।
খেলা নিয়ে মারামারি বালকে বালকে।
কণা হল পরিণত প্রচন্ড পাবকে।।
আদি পর্ব্বে নমঃশূদ্র সহে নির্য্যাতন।
তবু চেষ্টা করে তারা মীমাংসা কারণ।।
মুসলমানের মধ্যে পদ্মবিলা গ্রাম।
তাতে নীচ হয়ে বলে ‘‘মোরা ঠকিলাম।।
বিবাদেতে প্রয়োজন আর কিছু নাই।
নমঃশূদ্র, ইসলাম দোঁহে ভাই ভাই।।’’
কুচক্রী পাষন্ড দেখি আছে সর্ব্ব ঠাঁই।
যা হোক বিবাদ কিছু বাধানেই চাই।।
দুষ্টবুদ্ধি নিয়ে তারা সবখানে রয়।
ফাঁক পেলে বুদ্ধি দিয়ে সব করে ক্ষয়।।
নমঃশূদ্র সবে যদি এমত কহিল।
ইসলাম ধর্ম্মী যত সন্তুষ্ট হইল।।
কিন্তু দুষ্ট গ্রহ শনি আসিয়া জুটিল।
মুসলমানেরে ডাকি কহিতে লাগিল।।
‘‘কাফেরের এত বৃদ্ধি দেখা নাহি যায়।
ধর অস্ত্র কর রণ হোক সব ক্ষয়।।’’
সাধারণ লোক যারা তারা ডাকি কয়।
‘‘এই কার্য্য কোন ক্রমে উচিত না হয়।।
আমাদের কাছে তারা চাহিয়াছে ক্ষমা

হেন বাক্য আর নাহি বল শনি মামা।।’’
দুষ্ট কয় ‘‘হায়!হায়! কিবা শুনিলাম।
বুঝিলাম আজ হতে মরিল ইসলাম।।
পূর্ব্বস্মৃতি কোন কিছু মনে বুঝি নাই

ইসলামে মেরেছে কত ভেতে দেখ তাই।।
প্রতিশোধ তার যদি নিতে নাহি পার।
কলসী গলায় বেন্ধে জলে ডুবে মর।।

 

এইমত উত্তেজিত করে বাক্যবাণে।
সরল কৃষক তাহা বুঝিবে কেমনে?
বিন্দু বিন্দু বিষ খেয়ে বিষাক্ত হৃদয়।
ইসলাম গর্জ্জিয়া বলে ‘‘ঘটাব প্রলয়।।’’
নমঃশূদ্র সবে তাই পেয়ে সমাচার।
তারা বলে ‘‘হায় হায় রক্ষা নাই আর।।
পুনরায় চেষ্টা করি মীমাংসার তরে।
মীমাংসা না হলে তবে দেখা যাবে পরে।।’’
এইভাবে তারা সবে গেল পুনর্ব্বার।
বহু চেষ্টা করে তারা শান্তি মীমাংসার।।
কিন্তু সব বৃথা হল জুটিল ইসলাম।
নমঃশূদ্র সবে ভাবে বুঝি মরিলাম।

বিপদে বান্ধব কেবা আছে এই দেশে?
একমাত্র গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী বাসে।।
দ্রুত গতি তারা সবে এল ওড়াকান্দী।
প্রভুর চরণে পড়ে করে কান্দকান্দি।।
খুলনা হইতে প্রভু আসিল কেবল।
হেনকালে উপস্থিত নমঃশূদ্র দল।।
প্রভু কয় ‘‘যাহা বলি সেই কথা শোন।
মীমাংসায় চেষ্টা সবে কর দিয়ে পুনঃ।।’’
তারা কয় ‘‘দয়াময় সময় কোথায়?
মনে হয় তারা হানা দিয়াছে খোলায়।।
প্রভু কয় ‘‘দেও দিয়ে পুলিশে খবর।’’
তারা কয় ‘‘তার আগে সাজাবে কবর।।
মাতা পিতা পত্নী পুত্র জমি এক কানি।
ইহা ছাড়া আমাদের কিছু নাই জানি।।
এদের বাঁচাতে মোরা প্রাণ দিতে চাই।
আজ্ঞা কর বড়কর্ত্তা রণক্ষেত্রে যাই
।।
শ্রীহরির পুত্র তুমি নমঃর ভরসা।
শক্তি দাও গুরুচাঁদ মারি কিছু মশা।।
এতকাল এ জাতিরে করিয়াছ রক্ষা।
রক্ষাকর্ত্তা তব পদে এই মাত্র ভিক্ষা।।
তুমি শুধু বলে দাও করিবারে রণ।
তোমার আজ্ঞায় তুচ্ছ করিব জীবন।।’’
স্তব্ধ প্রভু কতক্ষণ কিছু নাহি বলে।
অকস্মাৎ বলিলেন চাহিয়া সকলে।।
‘‘শুন শুন নমঃশূদ্র আমার বচন।
যথা ধর্ম্ম তথা জয়শাস্ত্রের লিখন।।
অধর্ম্ম অন্যায় যুদ্ধ কেহ করিও না।
পরে ভিন্ন অগ্রে কোন অস্ত্র ধরিও না।।
আক্রমণ না করিলে কিছু নাহি কবে।
আক্রমণ করে যদি তবে যুদ্ধ দেবে।।
সর্ব্বক্ষণে সমাচার বলিবে আমারে।
আমি ভেবে দেখি হরি কোন ইচ্ছা করে।।’’
আজ্ঞা পেয়ে তারা সবে দ্রুত চলি গেল।
পলকে এ সব বার্ত্তা সকলে শুনিল।।
এই ভাবে দুই দলে হয় তোড়জোড়।
কাশীয়ানী পুলিশেরা পাইল খবর।।
দ্রুতগতি অকুস্থলে হল উপস্থিত।
তাহাতেও লোকজন নাহি হল ভীত।।
রাত্রি গেল ধীরে ধীরে প্রভাত উদয়।
সংখ্যাতীত ইসলাম আসিল খোলায়।।
নমঃশূদ্র পক্ষে লোক বেশী নাহি পাই।
দারোগা দেখিয়া তারা ভাবে ভয় নাই।।
উভয় দলের যত নেতৃবর্গ ছিল।
মুসলমান দারোগা সবারে ডাকিল।।
নমঃশূদ্র পক্ষে বীর অনন্ত সর্দ্দার।
পরাণপুরেতে আসি বাঁধিয়াছে ঘর।।
কুমারিয়া, লহ্মীপুরা, পদ্মবিলাবাসী।
যতেক প্রধান সবে উপস্থিত আসি।।
দারোগা কহিল ‘‘সবে ছাড় এই ঠাট

আমাকে সম্মুখে রেখে কর মিটমাট।।’’
নমঃশূদ্রগণে বলে ‘‘করিনা আপত্তি।
আপনি মধ্যস্থ হয়ে করুন নিষ্পত্তি।।

 

 

দারোগা বলিল ‘‘সব লোক ছেড়ে দাও।
রাগ ফেলে সুস্থ মনে বাড়ী চলে যাও।।’’
দুই দলে তাতে রাজী হল বটে মুখে।
মনে মনে অভিসন্ধি সকলের থাকে।।
তথাপিও নমঃশূদ্র যত প্রধানেরা।
কিছু কিছু লোক ছেড়ে দিয়াছিল তারা।।
মুসলমানের পক্ষে সৈন্য সমুদয়।
কিছু দুরে গিয়া তারা দাঁড়াইয়া রয়।।
এদিকে দারোগা তবে অশ্বপৃষ্ঠে উঠি।
কাশীয়ানী প্রতি তবে চলিলেন ছুটি।।
মুসলমান সৈন্যদের নিকটে আসিয়া।
কি জানি কি বলিলেন নাচাইয়া।

কেহ বলে বলিলেন হস্ত ইঙ্গিত করিয়া।
যা ইচ্ছা করগে আমি যেতেছি চলিয়া।।’’
অন্য জনে বলে ‘‘ইহা অতি মন্দ কথা।
দারোগারে দোষারোপ করিতেছ বৃথা।।
ইঙ্গিতে দারোগা বাবু দিলেন বলিয়া।
ঘরে যাও সবে আমি যেতেছি চলিয়া।।’’
দারোগা জীবনে এই দেখি অভিশাপ।
ভালমন্দ যাহা কর নাহি পাবে মাপ।।
বিস্তৃত সে সব তত্ত্ব বলে কার্য্য নাই।
কি ঘটনা ঘটে সেথা বলিতেছি তাই।।
দারোগা চলিয়া গেল দৃষ্টির বাহিরে।
হেনকালে ইসলামেরা দাঁড়াইল ফিরে।।
অসংখ্য নরের মুন্ড যেন সিন্ধু প্রায়।
নমঃশূদ্র তাহা দেখে করে হায়! হায়।।
মহাপ্লাবনের মত ছুটিছে ইসলাম।
নমঃশূদ্র কেন্দে বলে ‘‘এই মরিলাম।।
যাহা ভাগ্যে ছিল আজ ঘটিল না বটে।
রণ দাও যারা আছে ফেরা নাই মোটে।।
এখনি পাঠাও লোক বড়কর্ত্তা ঠাঁই।
গিয়ে বলে ‘‘দয়াময়! নমঃ আর নাই।।’’
অসংখ্য মুসলমান নমঃর বিপক্ষে।
দয়া যদি হয় প্রভু তবে কর রক্ষে।।’’
এত বলি বরে কালী কৈলাস সর্দ্দার।
বলে ‘‘তোরা কে কে যাবি আয় মরিবার।।
অসুর নাশিনী কালী আছে পক্ষে মোর।
রক্ষা কর্ত্তা হরিচাঁদ সেই মাত্র জোর।।’’
কৈলাসের কথা শুনি অনন্ত সর্দ্দার।
লম্ফ দিয়ে বলে ‘‘আছি সঙ্গেতে তোমার।।
শ্রীপূর্ণ, রজনী দোঁহে দিঘড়া নিবাসী।
শম্ভু, ষষ্ঠী, চারি ভাই নামে রণে আসি।।
কালীনগর, দিঘড়া, সদ্দারের বাস।
নাম শুনে ইসলামের লাগিত তরাস।

দিঘড়া গ্রামেতে এক ছাড়া-ভিটা আছে।
বেত বনে ঢাকা এবে ‘‘জঙ্গল’’ হয়েছে।।
পুরাণ প্রবাদ বাণী যাহা শোনা যায়।
সেই ভিটা পরে নাকি দেবতা আশ্রয়।।
পূর্ব্ব হতে সদ্দারের রয়েছে নিয়ম।
আজ নাহি করে তারা তার ব্যতিক্রম।।
রণে যাবে যায় তারা তার পূর্ব্ব ভাগে।
সারা রাত্রি বসে বসে সেইখানে জাগে।।
দৈববাণী শোনে তারা রাতের আঁধারে।
আজ্ঞা পেয়ে রণে দিয়ে শত্রু জয় করে।

আশ্চর্য্য একটি কথা বলিব এখনে।
সেই ভিটা রয় ঢাকা শুধু বেতবনে।।
বহুকাল আছে বেত ভিটার উপরে।
ভিটা ছেড়ে কোন বেত নীচে নাহি পড়ে।।
সেই বেত কেহ নাহি কাটে কোন দিনে।
বেতে বেতে ভরা ভিটা শুধু বেত বনে।।
কিভাবে কোথায় প্রভু রাখে কোনধন।
সামান্য মানব মোরা বুঝিনা কখন।।
সেই সূত্র ছেড়ে দিয়ে মূল সূত্রে ফিরে।
বলিতেছি শোন সেথা কি হইল পরে।।

ভাদ্রমাসে গঙ্গা যথা ছোটে দিশে হারা।
সেই মত এল ছুটে মুসলমানেরা।।
‘‘আল্লা হে আকবর’’ বলি ছাড়িল জিগির।
শব্দে যেন ধরা ফেটে হিইল চৌচির।।
হাতে ঢাল চক্ষু লাল কপালে সিন্দুর।
দক্ষিণ করেতে বর্শা গর্ব্বিত হিন্দুর।।
কার হস্তে রাম দাও কাহারো ধনুক।
ঝক ঝক লক লক করিছে কার্ম্মুক।।
প্রতি রক্ত বিন্দু যেন নাচে রণ সঙ্গে।
হুলুধ্বনি নারীগনে করে সঙ্গে সঙ্গে।।
অবশ্য-মৃত্যুর কোলে পড়িতে ঝাঁপায়ে।
বীরমুর্ত্তি নমঃশূদ্র রয়েছে দাঁড়ায়ে।।
সে দৃশ্য বর্ণিতে দেখ মোর সাধ্য নাই।
বীরত্ব মন্ডিত দৃশ্য মনে দেখ ভাই।।
দেখিতে দেখিতে এল ইসলাম বাহিনী।
মুখে বলে ‘‘আল্লা’’ ‘‘আল্লা’’ হর্ষ পূর্ণ ধ্বনি।।
তাহা দেখি নমঃশূদ্র দেরী নাহি করে।
‘‘কালী মায় কি জয়’’ বলে নামিল সমরে
।।
গ্রামের নিকটে আছে ক্ষুদ্র এক খাল।
তার কুলে হানা দিল নমঃশূদ্র দল।।
অসংখ্য ইসলাম নাচে খালের ওপারে।
অল্প-সংখ্যা নমঃশূদ্র বসিয়া এপারে।।
ইসলাম পড়িল তাতে ঘোর সমস্যায়।
শত্রুর সম্মুখে খাল পার হাওয়া দায়।।
কৌশলী সদ্দারগণে তীহ্ম বুদ্ধি গুণে।
দুরে দুরে খাল তীরে হানা দিল রণে।।
বিষম হইল দশা খাল ডিঙ্গাবারে।
কিছুক্ষণ শত্রু পক্ষ থাকে চুপ করে।।
মহোল্লাসে এসেছিল জিনিবারে রণ।
খালে বাধা দিল শুধু দৈবের ঘটন।।
এত বড় অভিযান নষ্ট হতে যায়।
মহাক্রুব্ধ হল তাতে শত্রু সমুদয়।

ক্রোধ যদি স্কন্ধে চড়ে বুদ্ধি লোপ হয়।
নির্ব্বুদ্ধিতা পাপে অেক মেষে হয় ক্ষয়।।
শত্রু পক্ষে সেই কথা সত্য বটে হল।
ক্রুব্ধ হয়ে ইসলামেরা জলেতে নামিল।।
মনে ভাবে ‘‘কুলে আছে কয়টী কাফের।
কুলে উঠে একে একে কেটে নেবে ছের।।
বিশ গুণে বেশী মোরা তাতে মুসলমান।
ক্ষুদ্র হিন্দু কিসে হবে মোদের সমান?
বিশজনে এক সাথে করে আক্রমণ।
শত শত হিন্দু আজ করিব নিধন।।’’
এত ভাবি জলে নামে বিপক্ষের দল।
ফলিল খালের মধ্যে অব্যর্থ যে ফল।।
অল্প পরে বিপক্ষের চেতনা জাগিল।
শত শত ক্ষত হয়ে ফিরে কুলে গেল।।
তাহাতেও রক্ষা নাই পৃষ্ঠ কেবা ঢাকে?
ভয় পেলে বিপক্ষেরা সেইদৃশ্য দেখে।।
রণে ভঙ্গ দিয়ে সবে ছুটিতে লাগিল।
নমঃশূদ্র তাহা দেখি খাল ডিঙ্গাইল।।
শত্রুর পশ্চাতে ছুটে মার মার।’’
দিশা-হারা শত্রু ছোটে জ্ঞান নাহি আর।।
কিছু দুরে দিয়ে ফিরে এল নমঃশূদ্র।
প্রথমাঙ্ক হল শেষ পদ্মবিলা যুদ্ধ।।
যতক্ষণ লাগিয়াছে লিখিতে কাহিনী।
ততোধিক অল্পকালে যুদ্ধ শেষ জানি।।
আদি অঙ্কে যুদ্ধ কিবা কৌশলের খেলা।
প্রকৃত যুদ্ধের কথা বলি এই বেলা।।
ভয় পেয়ে পিবক্ষেরা ছুটিতে লাগিল।
কিছু দূরে গিয়ে তারা ফিরিয়া দাঁড়াইল।।
তারা ভাবে এই ভাবে নির্ব্বোধের মত।
পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে কেন হই সবে হত।।
মরিত মরিব সব সম্মুখ সমরে।
ভয় পেয়ে মিছামিছি কেন যাই ফিরে।।

 

এত ভাবি প্রধানেরা ফিরিয়া দাঁড়াল।
হস্ত মেলে সৈন্য দল সকলে ঠেকাল।।
তারা বলে ‘‘ওরে ভাই! মোরা কত বোকা।
নমঃশূদ্র আমাদের দিল এক ধোঁকা।।
বুদ্ধি দোষে মরি মোরা মিথ্যা কভু নয়।
তানা হলে এত লোক কিসে পাই ভয়?
এক বুদ্ধি কর সবে যাতে হবে জয়।
সেই পথে আছে মাত্র একটি উপায়।।
দেখ খাল দীর্ঘ বটে নহে বেশী দুর।
খাল এড়ে আক্রমণ কর নমঃ-পুর।।
এই যদি কর তবে নমঃরা সকলে।
কোন কেহ নাহি যাবে আর খাল কুলে।।
খাল ছেড়ে নমঃযবে আসিবে সে ধারে।
এক দলে তাড়াতাড়ি যেও খাল পারে।।
এই ভাবে দুই দিকে কর আক্রমণ।
অবশ্য পড়িবে মারা নমঃশূদ্র গণ।।
সেই ভাবে তারা সবে আসিল বাহুড়ি।
এবে শোন কিবা হল ওড়াকান্দী বাড়ী।।
সর্দ্দারেরা যেই লোক পাঠাইয়া দেয়।
সে গিয়া গড়ায়ে পড়ে প্রভুজীর পায়।।
প্রভু বলে ‘‘ওরে বোকা বল সমাচার।’’
সে বলে ‘‘দয়াল প্রভু! রক্ষা নাই আর।।’’
এত বলি বলে খুলি সব বিবরণ।
তাহা শুনি প্রভুজীর আরক্ত নয়ন।।
ক্রোধে প্রভু বলে ডেকে ‘‘কোন ভয় নাই।
তুই ছুটে যারে চলে আমি রণে যাই।।’’
কি সে কি শক্তি প্রভু দিল তার দেহে।
ছুটে ছুটে চলে আর গ্রামে গ্রামে কহে।।
‘‘ওরে ভাই আয় তোরা আয় মোর সনে।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ চলেছেন রণে।।’’
বিদ্যুতের মত বাণী নাচাল পরাণ।
বাল বৃদ্ধ এক সঙ্গে করে লম্ফ দান।।
মৃত্যু ভয় কার মনে নাহি পেল স্থান।
সবে বলে ‘‘জয় হরি! জয় গুরুচাঁন।।’’
হেনকালে প্রভু পুনঃ বলিল গর্জ্জিয়া।
‘‘ঘৃতকান্দী গিয়ে আনকুঞ্জরে ডাকিয়া।।’’
আজ্ঞা মাত্রে লোক ছুটে গেল ঘৃতকান্দী।
শোনা মাত্র কুঞ্জ চলে এল ওড়াকান্দী।।
কুঞ্জকে দেখিয়া প্রভু ডাক দিয়া কয়।
‘‘ওরে কাঞ্জ! নমঃ তরী বুঝি ডুবে যায়।।
আমি যাহা বলি কুঞ্জ মন দিয়া শোন।
এই যুদ্ধ ধর্ম্মযুদ্ধ জাতির করণ।।
বিনা দোষে ইসলামে করে অত্যাচার।
এই যুদ্ধে তাহাদের রক্ষা নাহি আর।।
‘‘যথা ধর্ম্ম তথা জয়’’ এক বাক্য সার।
ধর্ম্ম পথে যে চলিবে ক্ষয় নাহি তার।।
এই ধর্ম্মদন্ড আমি দিতেছি তোমায়।
দন্ড হাতে পেলে তার নাহি পরাজয়।।’’
এত বলি প্রভু তারে এক যষ্টি দিল।
বলে ‘‘কুঞ্জ! ভয় নাই বল হরি বল।।
হরি বলে ডঙ্কা মেরে সবে যাও রণে।
এ যুদ্ধে সহায় হবে যত পিতৃ গণে।।
তারক গোলক আর যত সাধু জন।
প্রত্যক্ষে তাহারা আসি করিবেন রণ।।
ধর্ম্ম রক্ষা করিবারে আছে সাধু জন।
ধর্ম্মের সহায় হরি পতিত পাবন।।
তারা সবে যাবে যুদ্ধে আর যাব আমি।
মোদের সারথি নিজে হরি অন্তর্য্যামী।।
যাও, যাও, কুঞ্জ তুমি দেরী নাহি কর।
ধর্ম্ম লাগি হরি বলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মর।।
যুদ্ধ কালে কেহ যেন নাহি করে শঙ্কা।
জয় ধ্বনি, হরি ধ্বনি কর মার ডঙ্কা।।
অধর্ম্ম পথেতে যুদ্ধ কেহ করিবে না।
ধর্ম্ম পথে যুদ্ধ হলে কেহ মরিবে না।।’’

প্রভুর বচন শুনি কুঞ্জ ছুটে যায়।
যারে দেখে তারে বলে কে কে যাবি আয়।।
পড়িল বিষম সাড়া প্রতি ঘরে ঘরে।
বাল, বৃদ্ধ, শিশু, যুবা, যুদ্ধ সজ্জা করে।।
আপন সন্তানে মাতা সাজাইয়া দেয়।
বরে ‘‘বাছা! যাও নাহি কোন ভয়।।
তোমার সহায় আছে নিজে হরিচাঁন।
তাঁহারে স্মরণে রেখে হও আগুয়াণ।।’’
গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পড়ে গেল রোল।
নারী করে হুলুধ্বনি নরে হরি বোল।।
ডঙ্কা, শিঙ্গা, ভেরী, তুরী মৃদঙ্গ মাদল।
ধর্ম্মযুদ্ধে মন্ত্র মাত্র হরি হরি বোল।।
শতেক সহস্র মিশি যুদ্ধ পানে ধায়।
ডঙ্কা, কাশি, ভিন্ন তারা অস্ত্র নাহি লয়।।
এদিকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে দৃশ্য ভয়ঙ্কর।
ভয় পেয়ে নমঃশূদ্র কাঁপে থর থর।।
যে শত্রু পালিয়ে গেল সে বা কেন ফিরে।
নিশ্চয় কালের দন্ড পড়িল এ শিরে।।
চিন্তা কিবা করি আর যা থাকে কপালে।
প্রাণপণে দিব যুদ্ধ মিলিয়া সকলে।।
হেনকালে যেই জন ওড়াকান্দী গেল।
ফিরিয়া আসিয়া সেই কহিতে লাগিল।।
‘‘ভয় নাই বীরগণ! কর গিয়া রণ।
নিজে যুদ্ধে আসিবেন শ্রীগুরু চরণ।।
‘‘যথা ধর্ম্ম তথা জয়’’ বলেছে এ বাণী।
অধর্ম্ম করো না কেহ তাঁর আজ্ঞা মানি।।’’
কি যে সে বিদ্যুৎ শক্তি সবে দেহে পেল

আনন্দে মিলিয়া সবে বলে হরিবল।।
হেনকালে দলে দলে চারিদিক হতে।
হরিবলে আসে সবে ডঙ্কা শিঙ্গা হাতে।।
ধ্বনি শুনি নেচে ওঠে নমঃশূদ্র প্রাণ।
আনন্দে যতেক বীর করে লম্ফ দান।।
প্রলয় সমুদ্র যেন গর্জ্জন করিল।
চারিদিকে শুনি শব্দ হরি! হরি! বল।।
আশ্চর্য্য মানিয়া দেখে ইসলামের গণ।
কোন ভাবে কোথা ছিল এরা কতক্ষণ।।
আচম্বিত মাটি ফুঁড়ে যেন রে উঠিল।
এমন আশ্চর্য্য কেবা দেখিয়াছে বল?
ডঙ্কা বাজে শিঙ্গা বাজে ভেরী দিল তার।
রণ-মত্ত নমঃশূদ্রে সাজাল মাতাল।।
প্রাণের মমতা ছেড়ে একত্রে মিশিয়া।
অযুত শত্রুর মধ্যে পড়ে ঝাঁপ দিয়া।।
কি যে সেথা হল হায়! ভোজ বাজী প্রায়।
কল্পনা নয়নে দেখ বলিবার নয়।।
বীরেন্দ্র কেশরী যথা অতি ক্রোধ ভরে।
মদমত্ত কুঞ্জরের আক্রমণ করে।।
অতিকায় যুথনাথ হস্তি মহাবল।
সিংহের বীর্য্যের বলে পড়ে ধরাতল।।
সেই মত ভাব যেন হইল সেখানে।
হার মেনে শত্রু পক্ষ ভঙ্গ দিল রণে।।
প্রাণদায় ব্যস্ত হয়ে ছুটিল সকলে।
পশ্চাতে ধাইল তবে নমঃশূদ্র দলে।।
দেশ হতে বহু দুরে দিল খেদাইয়া।
আর না আসিল শত্রু গেল পালাইয়া।।
পশ্চাতের কথা কিবা করি আলাপন।
পুলিশ দারোগা পরে করে আগমন।।
দাঙ্গার তদন্ত হল বহুদিন ধরি।
বিচারেতে পেল শাস্তি জন দুই চারি।।
বিপদের দিনে রক্ষা গুরুচাঁদ করে।
তাঁর জয় ধ্বনি সবে করে ঘরে ঘরে।।
প্রভু কয় ‘‘শুন সবে নমঃশূদ্রগণ।
দাঙ্গা যুদ্ধ করা ভাল নহে কদাচন।।
অকারণে কার সনে না কর বিবাদ।
বিবাদে বাড়ায় দেখি শুধুই আপদ।।

আত্মরক্ষা কারণেতে পার যুদ্ধ দিতে।
কিন্তু কাজ নাহি কর অধর্ম্মের পথে।।
বিশেষতঃ এক কথা কহি সকলেরে।
হিন্দু ও মুসলমান আছি দেশ ভরে।।
এক ভাষা, এক আশা, এক ব্যবসাতে

কেন বা করিবে রণ তাহাদের সাথে।।
দুই ভাই এক ঠাঁই রহ মিলে মিশে।
ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে।।’’
শ্রীগুরুচাঁদের বাণী জ্ঞানলোকে দেয়।
মহানন্দ চির-অন্ধ দেখেনা রে হায়।।

 

লর্ড লিটনের গোপালগঞ্জ আগমন


পদ্মবিলা দাঙ্গা শেষ হইল যখন।
গোপালগঞ্জেতে লাট করে আগমন।।
লর্ড লিটনের নাম জানে বঙ্গবাসী।
পত্নী সহ উপনীত হইলেন আসি।।
হইল বিপুল দৃশ্য শহরের পরে।
অসংখ্য আসিল লোক কাতারে কাতারে।।
কালীপদ মৈত্র নামে ছিলেন ডেপুটি।
তেঁহ সজ্জা করাইল অতি পরিপাটি।।
জেলার প্রধান যত সবে যোগ দিল।
নমঃশূদ্র জাতি পক্ষে বহুত আসিল।।
মানপত্র বহু জাতি দিল সে সভায়।
নমঃশূদ্র পক্ষে কথা গুরুচাঁদ কয়।।
চন্দ্রনাথ বসু নামধারী একজন।
গোলাবেড়ে বাস করে সেই মহাজন।।
নমঃকুলে জন্ম তার অতি তেজবন্ত।
স্বজাতির প্রতি প্রীতি তাঁহার একান্ত।।
ওড়াকান্দী ঘৃতকান্দী মল্লকান্দি হতে।
নমঃশূদ্র প্রধানেরা চলে এক সাথে।।
গোপাল গঞ্জেতে আসি হইল উদয়।
এক সাথে সবে মিলে মানপত্র দেয়।।
এ জাতির শিক্ষা দীক্ষা রাজকার্য্য চাই

রাজার বিরুদ্ধে মোরা কভু যাই নাই।।
রাজভক্ত বলি মোরা আছি পরিচিত।
তত্ত্ব জেনে এই সব করুন বিহিত।।
এই মত বহু কথা মানপত্রে রয়।
রজত পাত্রেতে করি মানপত্র দেয়।।
লাট যবে কলেআসে তখনে ডেপুটী।
সকলের পরিচয় দেয় খাঁটি খাঁটি।।
লাটে গুরুচাঁদে যবে পরিচয় হল।
বহুত মঙ্গল কথা ডেপুটী কহিল।।
‘‘ধর্ম্মগুরু এক জন শ্রীগুরু চরণ।
বঙ্গ দেশে শিষ্য তার আছে আগণন।।
ধনবান গুরণবান তাহাতে ধার্ম্মিক।
বাক্য কি কার্য্যেতে সদা অত্যন্ত নির্ভিক।।
তাঁর গৃহে অশিক্ষিত নাহি কোন জন।
নরনারী শিক্ষা প্রাপ্ত অতি সুশোভন।।
বহু বহু লোক বটে আছে এ জেলায়।
এর মত লোক অঅর দেখা নাহি যায়।।’’
এ সব বৃত্তান্ত শুনি লাট মহোদয়।
করে কর দিয়া তাঁরে সম্মান জানায়।।
এই ভাবে জনে জনে দিল পরিচয়।
অধিক না লিখি কিছু গ্রন্থ-বৃদ্ধি ভয়।।
মানপত্র উত্তরেতে বলে বঙ্গেশ্বর।
‘‘বড়ই সন্তুষ্ট আমি সবার উপর।।
যিনি যাহা লিখিয়াছেন শুনিলাম সুখে।
কত যে আনন্দ হল কিবা বলি মুখে।।
সকলেরে ধন্যবাদ দিয়া অতঃপর।
সভাভঙ্গ করি চলি গেল বঙ্গেশ্বর।।
প্রভু যবে দেশে ফিরে যাইবারে চায়।
শ্রীবেণী পালেল ভ্রাতা তাঁরে ডাকি কয়।।

 

‘‘প্রণাম হে বড়কর্ত্তা করি তব পায়।
কলিকাতা চলিয়াছি জানাই তোমায়।।’’
শ্রীবেণীমাধব পাল বড় ভাগ্যবান।
এবে কিছু বলি শোন তাঁহার আখ্যান।।

 

শ্রীবেনীমাধব পালের উপাখ্যান


শ্রীবেণীমাধব পাল ঘৃকতান্দী গাঁয়।
শুন সবে বলি কিছু তার পরিচয়।।
বংশেতে কায়স্থ বটে সেই মহাশয়।
জীবনের আদিভাগে বহু কষ্ট পায়
।।
তাঁহার জননী দেবী কামিনী নামেতে।
দুঃখে কষ্টে কাটে কাল পুত্র নিয়ে সাথে।।
ওড়াকান্দী অবতীর্ণ শ্রীহরি ঠাকুর।
পরম দয়াল তিনি মহিমা প্রচুর।।
যারে যাহা বলে তিনি তাই সিদ্ধ হয়।
দলে দলে কত লোক তাঁর কাছে যায়।।
বুদ্ধিমতি, ভক্তিমতী সেই যে কামিনী।
একদা প্রভুর কাছে চলিল আপনি।।
প্রগাঢ় বিশ্বাস তার অন্তরেতে ছিল।
পিতৃ ভাবে হরিচাঁদ চরণ বন্দিল।।
দীর্ঘ কেশপাশে ছিল নারীর মস্তকে।
কটিদেশ বিলম্বিত স্তবকে স্তবকে।।
সেই কেশপাশ দিয়া দুঃখিনী রমণী।
বান্ধিল হরির পদ জানি চিন্তামনি।।
চিন্তামনি প্রভু সব জানিলা অন্তরে।
দয়া করি বলে তারে হস্ত রাখি শিরে।।
‘‘ঘরে যাও ওগো মাতা নাহি কোন ভয়।
তব পুত্র রাজা হবে বলিনু নিশ্চয়।’’

কান্দিয়া রমনী তাহে বহুত কহিল।
দয়া করি দয়া ময় সকলি শুনিল।।
তদবধি সে কামিনী সদা মনে প্রাণে।
শ্রীহরিচাঁদেরে নিজ পিতা সম মানে।

এই ভাবে ক্রমে ক্রমে দিন গত হয়।
নামেতে গিরিশচন্দ্র বসু মহাশয়।।
বহু ব্যবসায় তার কলিকাতা পরে।
বেণীকে আনিল সঙ্গে মোহরার করে।।
সদ্ভাবে সকল কাজ করে বেণী পাল।
শ্রীহরির কৃপাক্রমে ফলিল সুফল।।
ক্রমে ক্রমে গিরীশের অংশীদার হল।
ব্যবসায় ক্রমে তার ধন বেড়ে গেল।।
বহু বহু পুণ্যকর্ম্ম নানাস্থানে করে।
বাসনা হইল জমিদারী কিনিবারে।।
ফরিদপুরের মধ্য্যে আমগাঁও গ্রাম।
রাজস্ব দেনার দায়ে হইল নীলাম।।
সেই গ্রাম বেণীবাবু খরিদ করিল।
শ্রীহরির বাক্য দেখ ক্রমেতে ফলিল।।
জমিদারী কেনে বটে অধিকার নাই।
পূর্ব্ব জমিদার তাঁরে নাহি দেয় ঠাঁই।।
প্রজা সবে বাধ্য করি রাখিল বিপক্ষে।
বেণীর হইলা বাধা অধিকার পক্ষে।।
আমগাঁও গন্ডগ্রাম নহে বটে ক্ষুদ্র।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ আছে আর নমঃশূদ্র।।
বেণী ভাবে এ বিপদে কি উপায় করি।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদে আমি গিয়ে ধরি।।
তিনি মোরে ভালবাসে জানি চিরকাল।
শ্রীহরির পুত্র তিনি পরম দয়াল।।
তিনি বিনে গতি নাহি পাব এ বিপদে।
নিবেদন করি আমি সব তাঁর পদে।।
এত ভাবি মহাশয় ওড়াকান্দী গেল।
দন্ডবৎ করি পরে বলিতে লাগিল।।
‘‘বড়কর্ত্তা পড়িয়াছে বিষম সঙ্কটে।
আপনি করিবে রক্ষা পেতে পারি বটে।।

 

কিনিয়াছি জমিদারী আমগাঁও গাঁয়।
অবাধ্য সকল প্রজা কি করি উপায়?
বহু নমঃশূদ্র বাস করে সেই গ্রামে।
তারা বাধা হতে পারে আপনার নামে।।
চিরকাল দয়া পাই আপনার কাছে।
এবার করিলে দয়া মান মোর বাঁচে।।
দয়া করে মোর সাথে সেথা যেতে হবে।
আপনার দেখা পেলে সকলে মানিবে।।’’
দয়ার সাগর প্রভু দয়া-ভরা প্রাণ।
বেণীরে করিয়া দয়া বলে ভগবান।।
‘‘ভয় নাই বেণী বাবু আমি সঙ্গে যাব।
তোমার সাহায্য আমি নিশ্চয় করিব।।’’
সেই মতে প্রভু তবে চলে আমগাঁয়।
যজ্ঞেশ্বর বিশ্ববাসি সঙ্গে সঙ্গে যায়।।
বেণী বাবু নিজে যায় প্রভুর সংহতি।
আর বহু লোক হল প্রভুজীর সাথী।।
এদিকে শুনিল সবে আমগাঁও গাঁয়।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ আসিছে তথায়।

নমঃশূদ্র সবে ভাবে ‘‘বড়ই সৌভাগ্য।
তাঁরে পেতে এই গ্রামে মোরাত অযোগ্য।।
বেণীবাবু আনে বলে তাঁরে হেথা পাই।
বেণীবাবু প্রতি রোষ রাখিও না ভাই।।
বিশেষতঃ বড়কর্ত্তা আমাদের যিনি।
এই কার্য্যে নিজে নিজে আসিছেন তিনি।।
তিনি যদি এই কাজে ব্যর্থ হয়ে যান।
কিছুতে থাকে না আর জাতির সম্মান
।।
বড়কর্তা গুরুচাঁদে বেণীবাবু আনে।
নমঃর গৌরব ইহা ভেবে দেখ মনে।।
বড়কর্তা মোরা সবে পাই বহু মান।
তাতে বলি বেণীবাবু করিয়াছে ভাল।
আমাদের মনোব্যাথা দুর হয়ে গেল।।
বেণীর বিরুদ্ধে মোরা কেহ নাহি যাব।
গুরুচাঁদ সঙ্গে তারে সম্মান করিব।।
এত বলি তারা সবে করে আয়োজন।
উভয়েরে মান্য দিতে যাহা প্রয়োজন।।
এদিকেতে যত ছিল কায়স্থ ব্রাহ্মণ।
মনে মনে হিংসা তারা করে সর্ব্বক্ষণ।।
বেণী পাল জমিদারী যাতে নাহি পায়।
সেই মত চেষ্টা তারা করে সর্ব্বদায়।।
ইতিপূর্ব্বে গ্রাম সব এক হয়েছিল।
গুরুচাঁদ আগমনে বাঁধন খসিল।।
নমঃশূদ্রগণে আর নাহি শোনে কথা।
ভাব দেখি তাহাদের হেট হল মাথা।।
তবু বহু চেষ্টা করে একতা কারণে।
কিন্তু নমঃশূদ্রে আর কথা নাহি শোনে।।
হতাশ হইয়া আর করে আঙ্গীকার।।
বেণী পালে মোরা কভু নাহি দিব কর।।
এদেশে আসিলে তারে নাহি সম্মান।
থাকে থাক যায় যাক তাতে ধন প্রাণ।।’’
এই ভাবে তারা যবে সত্য করি রয়।
বেণীপাল সঙ্গে প্রভু উদয় তথায়।।
নমঃশূদ্র সবে জানি এই সমাচার।
দলে দলে নৌকা প্রতি সবে অগ্রসর।।
বহু নিয়মেতে তারা সম্মান দেখায়।
প্রভুর নিকটে সব কথা খুলি কয়।।
তাহাদের কথা শুনি প্রভুর আনন্দ।
প্রভু কয় ‘‘কেহ নাহি কর’’ কর বন্ধ।
বড়ই দয়াল এই ধনী জমিদার।
ইহার নিকটে পাবে বহু উপকার।।’’
প্রভুর বচনে তবে নমঃশূদ্রগণে।
বেণীরে সম্মান দেয় অতি প্রীত মনে।।
যাঁর বাঁশী শুনে গলে কঠিন পাষাণ।
যাঁর আগমনে বহে প্রেমবন্যা বান।।

 

তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ পরম রতন।
তাঁরে দেখে ভুলে গেল নরনারীগণ।।
জয়ধ্বনি করি তাঁরে গৃহে পরে লয়।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তারে সম্মান দেখায়।।
দলে দলে নরনারী আসে বহুতর।
প্রভুকে দেখিয়া সবে বলে ‘‘কি সুন্দর।।
এমন মোহন মুর্ত্তি আর দেখি নাই।
কোটি জন্ম পুণ্যফলে আজ দেখা পাই।।
দৃষ্টিমাত্রে মনপ্রাণ করে আকর্ষণ।
সুধামাখা বাক্যে মন করে গো হরণ।।
কি যে হয় কেন হয় নাহি পাই দিশে।
মনে হয় দিবারাত্রি থাকি পদে বসে।।’’
এই মত জনে জনে বলাবলি করে।
একবার দেখে সবে পুনঃ আসে ফিরে।।
এই ভাবে বলে কথা সারা গ্রাম ভরি।
শুনিয়া ভাবিল যত ব্রাহ্মণের নারী।।
‘‘মহৎ পুরুষ ছিল শ্রীহরি ঠাকুর

যাঁর নামে আধি ব্যাধি সব হয় দুর।।
তাঁহার নন্দন এই গুরুচাঁদ নাম।
চল সখি দেখে আসি সেই গুণধাম।।’’
এত বলি ব্রাহ্মনীরা চলিল হাঁটিয়া।
ব্রাহ্মণেরা পারিল না রাখিতে ধরিয়া।।
এদিকেতে প্রভু তবে বসিল আহারে।
বহু আয়োজন তাতে নমঃশূদ্রে করে।।
আহারে বসিল প্রভু কমল লোচন।
গৃহ মধ্যে একা খায় নাহি অন্য জন।।
হেনকালে ব্রাহ্মনীরা মিলিয়া সকলে।
সেই গৃহে উপস্থিত হল কুতুহলে।।
প্রভুজী দেখিয়া বলে ‘‘কাহারা আসিল?’’
তাহা শুনি ব্রাহ্মনীরা মধুর হাসিল।।
তারা বলে ‘‘মহাশয় মোরা যে ব্রাহ্মণী।
আপনাকে দেখিবারে এসেছি এখনি।।’’
প্রভু ব্যস্ত হয়ে বলে দেহ গো আসন।
বড় দয়া করে এল এই মাতাগণ।।
প্রভুর আজ্ঞায় দিল আসন পাতিয়া।
ব্রাহ্মনীরা বসিলেন সেখানে আসিয়া।।
প্রভু কয় ‘‘বল শুনি ওগো মাতাগন।
কি কারণে কর সবে হেথা আগমন।।
আমি এক নমঃশূদ্র বিদ্যা বুদ্ধি নাই।
আমাকে দেখিতে কেন চাহ ভাবি তাই।।’’
ব্রাহ্মনীরা বলে ‘‘শুন শ্রীহরি নন্দন।
নমঃশূদ্র দেখিবারে আসিনা কখন।।
শ্রীহরির পুত্র তুমি পরম রতন

তোমাকে দেখিতে তাই করি আগমন।।
দেখিয়া পরম প্রীত হইলাম মনে।
হইল জনম ধন্য তব দরশনে।।
আহারান্তে প্রভু তবে বসিয়া তথায়।
ব্রাহ্মণীগণের সঙ্গে বহু কথা কয়।।
কথাবার্ত্তা শুনি তবে ব্রাহ্মণী সকল।
প্রণাম করিয়া চলে চক্ষে বহে জল।।
সমাচার শুনি তবে ব্রাহ্মণের গন।
প্রভুর নিকটে সবে করে আগমন।।
আলাপনে সুখী তারা হইলেন সবে।
বলে সবে ‘‘মোরা নাহি যাব অন্যভাবে।।
বেণী বাবু কর পাবে দিনু অধিকার।
আমাদের বাবু কর বাধা রহিল না আর
।।’’
প্রভুর কৃপায় বেনী দখল পাইল।
প্রভুর কৃপাই ধন্য হরি হরি বল।।

 

১৩২০ সাল হইতে ১৩৩২ সাল পর্যন্ত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ


তেরশত বিশ সালে দেবীচাঁদ নাই।
জরাজীর্ণ দেহে আছে তারক গোঁসাই।।

হরিলীলামৃত গ্রন্থ মুদ্রণ কারনে।
তারক গোস্বামী ভিক্ষা করে বহু স্থানে।।
তের শএকুশ সালে মার্গশীর্ষ মাসে।
দেহ ছাড়ি সে তারক যায় নিজ দেশে।।
তেরশ বাইশ সালে রথযাত্রা হয়।
তস্য পূর্ব্বে দুর্গাপূজা হল পুনরায়।।
দশভূজা নিজ হতে পূজা মাগি লয়।
তার ইচ্ছা পূর্ণ করে প্রভু দয়াময়।।
ইউরোপ মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইল।
রাজকার্য্যে মহাপ্রভু সাহায্য করিল।।
তারকচাঁদের মহাপ্রস্থানের পরে।
কবিবর হরিবর বহু চেষ্টা করে।।
লীলামৃত গ্রন্থ নাহি হইল মুদ্রন।
তাহা দেখি গোপালে অতি ক্ষুন্ন মন
।।
প্রভুর আজ্ঞায় অর্থ করিলেন দান।
গোপালের হাতে নিল নিজে ভগবান।।
প্রেমে বাধ্য ভবারাধ্য লহ্মীখালী গেল।
গোপাল সাধুর তাতে মহিমা বাড়িল।।
তের শপচিশ সালে শ্রীশশিভূষণ।
দেহ ত্যাগ করি করে স্বর্গে আরোহণ।।
তের শছাব্বিশ সালে মহা ঝড় হয়।
বঙ্গদেশে নানা স্থানে বহু লোক ক্ষয়।।
তের শসাতাশ সালে হল আন্দোলন।
অসহযোগের নীতি গান্ধীর সৃজন।।
প্রভুর নিকটে পত্র চিত্ত বীর দেয়।
উপযুক্ত প্রত্যুত্তর করে দয়াময়।।
তের শআঠাশ সালে পাতলা গমন।
করিলেন দয়াময় ভক্তের কারণ।।
তের শতিরিশ সালে পুনঃ পাতলায়।
ভক্তি গুণে দয়াময় ভক্ত সাথে যায়।।
যাদবের রাগাত্মিকা ভক্তি পরিচয়।
অন্তর্য্যামী গুরুচাঁদ বুঝিবারে পায়।।
রাজমন্ত্রী আসিলেন মহাকুমা পরে।
প্রভুকে সম্মান দেয় সভার ভিতরে।।
পদ্মবিলা দাঙ্গা হল তের শতিরিশে।
গোপালগঞ্জেতে পরে বঙ্গেশ্বর আসে।।
শ্রীলর্ড লিটন নামে অতি মহাশয়।
প্রভুর যতেক গুণ পেল পরিচয়।।
তের শত একত্রিশ সালের গনণ।
শ্রীহরি মন্দির তবে হইল গঠন।।
শ্রীহরি চাঁদের দন্ত তাতে রক্ষা হয়।
শ্রীহরি মন্দিরে সবে পূজা অর্ঘ্য দেয়।।
তেরশআঠাশ সালে পত্তন হইল।
ক্রমে ক্রমে শ্রীমন্দির গঠন করিল।।
বহু কর্ম্মে প্রভু এসব সময়।
জাতির উন্নতি লাগি ঘুরিয়া বেড়ায়।।
যেথা যায় সেথা কয় উন্নতির কথা।
ক্ষণে ক্ষণে সেথা কয় উন্নতির কথা।
ক্ষণে ক্ষণে বলে সবে ‘‘করহে একতা।।
এক নমঃশূদ্র মধ্যে বহু শাখা ছিল।
প্রভু কহে ‘‘এই কার্য্য নহে মোটে ভাল।।
শাখা বা প্রশাখা কারা এক সবে মোরা।
দীনের কৌলিন্য দাবী শুধু কর্ত করা।।
নমঃশূদ্র মধ্যে কোন ভিন্ন ভেদ নাই

এক বংশে মোরা জন্মি সবে ভাই ভাই।।
অজ্ঞানতা বশে পূর্ব্বে নমঃশূদ্র গণ।
ভাই ভাই ছিন্ন ভেদ ভাবিত তখন।।
প্রভু বলে ‘‘আত্ম ধ্বংস বাঞ্ছা কর মনে।
সাবধান ভাই ছেড়ে ডেকোনা মরণে।।
অযুক্তি আদর্শ প্রভু কভু নাহি বলে।
বলে যাহা কাজে তাহা করে সর্ব্বস্থলে।।
বিভিন্ন শাখার মধ্যে মিলন কারণে।
পরস্পরে বান্ধিলেন কন্যা সম্প্রদানে।।
প্রিয় ভক্ত গোপালের দিল এই ভার।
তিনি বিবাহাদি ক্রিয়া করে পরস্পর।।

শ্রাদ্ধের আসরে কিংবা শ্রীহরি বাসরে।
দয়াময় গুরুচাঁদ বলে সকলেরে।।
‘‘বোকা জাতি নমঃশূদ্র নীতি নাহি জানে।
শ্রাদ্ধেতে বিবাহে ব্যয় করে অকারণে।।
ঘরে নাই অন্ন যার দেনা বহুতর।
পিতৃ-শ্রাদ্ধে করা চাই ‘‘দানের সাগর।
’’
শ্রাদ্ধ নহে পেট-পূজা সাজাইয়া লয়।
এত যে কষ্টের কড়ি সব করে ক্ষয়।।
শ্রাদ্ধ হলে শ্রাদ্ধ হয় শাস্ত্রের প্রমাণ।
মূলতত্ত্ব নাহি জানে যতেক অজ্ঞান।।
ব্রাহ্মণের কুট চক্রে নিজে ক্ষয় হয়।
পরিনামে করে শুধু হায়! হায়! হায়!
এর ফলে কিবা হয় সাক্ষী দেখ তার।
নমঃর ঘরেতে ধন নাহি থাকে আর।।
এক পুরুষের ধন নমঃশ্রদ্রে পায়।
বহুকাল কোন ঘরে ধন নাহি রয়।।
তাই বলি অর্থ নীতি শেখ যতনেতে।
অর্থ নাহি পায় কেহ যথা তথা হতে।।
বিবাহ শ্রাদ্ধের ব্যয় কামাইয়া দও।
সাধ্য অনুযায়ী কাজ সকলে করাও।।’’
শ্রহরি মন্দির যবে নির্ম্মিত হইল।
শ্রীহরিচাঁদের রাস প্রভুজী করিল।।
ক্ষীরোদশায়ীর মূর্ত্তি করিয়া গঠন।
শা্ন্তি মাতা মুর্ত্তি তাতে করিল যোজন।।
ভক্তগণে বলে ডাকি ‘‘শোন ভক্তগণ।’’
শ্রীহরিচাঁদের রাস অপূর্ব্ব কথন।।
রাসতত্ত্ব কেহ নাহি জান ভালমতে।
নন্দের গোপাল রাস করে কোন পথে?
কামিলিপ্সা তার মধ্যে কিছু নাহি ছিল।
নিস্কাম প্রেমের জন্যে তেঁহ রাস কৈল।।
রাসতত্ত্ব বলি সবে শুন সমাচার।
রাসের নিগূঢ় তত্ত্ব অতি মচৎকার।

রাসেতে পুরুষ কৃষ্ণ অন্য সবে নারী।
কৃষ্ণে বেড়ি নৃত্য করে যতেক সুন্দরী।।
সারা মন প্রাণ দিয়া কৃষ্ণে পেতে চায়।
ধরি ধরি করে কৃষ্ণ ধরা নাহি দেয়।।
মানব মনের এই দেখ ভাবধারা।
পেয়ে যারে নাহি পায় তাতে আত্মহারা।।
ভোগের লালসা হতে জন্মে আদি প্রেম।
খনি মধ্যে থাকে যথা অকষিত হেম।।
অগ্নিতাপে সে কাঞ্চন যবে শুদ্ধ হয়।
ঝক ঝক করে তাহা আপন প্রভায়।।
আদি প্রেম জন্মে বটে কামনা ভিতরে।
পেয়ে পেয়ে ভাগ করে প্রেম যায় মরে।।
পেয়ে যদি নাহি পায় ভোগ-ইচ্ছা মরে।
বিরহ আগুণে প্রেম নিস্কামতা ধরে।।
রাসক্ষেত্রে তাই কৃষ্ণ ধরা নাহি দেয়।
গোপিনীর কাম-ইচ্ছা ভস্মীভূত হয়।।
নিস্কাম প্রেমেতে তারা জলধরে চায়।
নিস্কাম প্রেমের তরে রাসলীলা হয়।।
শ্রীহরিচাঁদের রাস পূর্ণ হতে পূর্ণ।
এই রাস নরনারী সকলের জন্য।।
নিস্কাম সাধনা সবে এই রাসে পাবে।
অকাম কামনা-চক্রে শান্তি মাআসিবে।।’’
সেই হতে রাস লীলা হয় ওড়াকান্দী।
চারি উৎসবের কেন্দ্রে মতুয়ারা বন্দী।

শ্রীবারুণী রথযাত্রা দশভূজা পূজা।
মহালীলা পূর্ণরাস অতি মহাতেজা।।
কর্ম্মচক্রে ধর্ম্মবর্ম্মে মতুয়া জীবন।
দিনে দিনে গড়ে প্রভু অনাথ শরণ
।।
শেষ কর্ম্ম এ জাতির মঙ্গল বিধানে।
উচ্চ শিক্ষা লভিবারে পাঠাতে লন্ডনে।।
অসম্ভব কার্য্য ভাবি নমঃশূদ্রগণ।
এই কার্য্যে অগ্রসর না হল কখন।।

জাতির মনেতে তাই দৃঢ় শক্তি দিতে।
নিজ পৌত্রে ইচ্ছা করে বিলাতে পাঠাতে
।।
মনে মনে ইচ্ছা করে মুখে নাহি কয়।
প্রমথ রঞ্জন ডিগ্রী পেল এ সময়
।।
ডিগ্রী পলে বি,, পাশ করিয়া গৌরবে।
এম,, পড়ে কলিকাতা যশের সৌরভে।।
একবর্ষ পাঠ তাঁ হইল যখন।
প্রভুর ইচছায় তিনি ভাবে মনে মন।।
সহপাঠী ছাত্র যত ছিল একসাথে।
বহুবিধ কথা তারা বলে বহুমতে।।
নিজ নিজ উচ্চাকাঙ্খা জানায় পুলকে।
জীবনের ভবিষ্যৎ ভরিবে আলোকে।।
সব কথা বসে শোনে প্রমথরঞ্জন।
বিলাত যাইতে ইচ্চা হইল তখন।।
একেত মহান কার্য্য তাতে পিতৃহীন।
ভরসা যে পিতামহ তিনিও প্রাচীন।।
ইতি উতি ভাবি মনে শান্তি নাহি পায়।
মনে মনে গুমরিছে প্রাণ ফেটে যায়।।
এই ভাবে দুঃখে যবে দিন কাটে তাঁর।
গোপালগঞ্জেতে এল স্যার জন কার।।
বঙ্গের অস্থায়ী লাট ছিল সেই জন।
গোপালগঞ্জেতে এল দর্শন কারণ।।
নিমন্ত্রণ পেয়ে প্রভু তখাকারে যায়।
ডেপুটি বহুত মান তাঁহারে দেখায়।।
ইহার কারণ বলি শুন মন দিয়া।
অসহযোগের নীতি দেশেতে আসিয়া।।
কায়স্থ ব্রাহ্মণগণে মিলিয়া সকলে।
‘‘ইংরাজে মানিনা’’ মোরা এই কথা বলে।।
লাটেরে সম্মান দিতে কেহ নাহি যাবে।
ঘাটে মাঠে এই কথা বলে নানাভাবে।।
তাহাতে ডেপুটি তবে চিন্তিত হইল।
প্রভুকে সকল কথা চিঠিতে জানাল।।
প্রভু বলে ‘‘লোক দিব লাগে যতজন।
চিন্তা কি ডেপুটিবাবু আছি যতক্ষণ।।’’
কথামত দয়াময় বহু লোক সঙ্গে।
উপস্থিত দরবারে অতি মনোরঙ্গে।।
তাহাতে ডেপুটিবাবু বহু সুখী হল।
লাটের নিকটে তাঁর গুণ ব্যাখা কৈল।।
সকল শুনিয়া লাট বলিলেন তাঁরে।
‘‘বিলাত ফেরত কেহ নাহি কি এ ঘরে?’’
ডেপুটী করিল তবে সেই আলোচনা।
বিলাত গমনে সেই প্রথম নিশানা।।
ইচ্ছাময় ইচ্ছা যাহা করে নিজ মনে

ইচ্ছা মাত্রে পুর্ণ তাহা হয় দিনে দিনে।।
কিভাবে বিলাত গেল প্রমথরঞ্জন।
সেই তত্ত্ব-কথা পরে করিব বর্ণন।।
ভক্তগণে প্রীত মনে অর্থ করে দান।
কে কে দিল পরে বলি সেই উপাখ্যান।।
তস্য পূর্ব্বে দিব ভক্ত সঙ্ঘ পরিচয়।
প্রধান প্রধান ভক্ত যত জন রয়।।
সংক্ষিপ্ত জীবনী কিন্তু করিব বর্ণন।
‘‘জয় গুরুচাঁদ’’ ধ্বনি কর সর্ব্বজন।।

 

১৩৩২ সালে ভক্ত সঙ্ঘের সংক্ষিপ্ত পরিচয়


অনন্ত ক্ষীরোদ-তলে অনন্ত ফণায়।
আপনি অনন্তদেব যাঁরে শিরে রয়।।
অনন্ত শক্তির ধাত্রী ‘‘লহ্মী’’ রূপে বসি।
যাঁর পদে অর্ঘ্য দেয় বসে দিবানিশি।।
ইচ্ছার বিকারে যাঁর সৃজিত ব্রহ্মান্ড।
অনন্ত অন্তত বিম্ব যাঁর ক্ষু্দ্রভান্ড।।
মহাসাগরের বুকে বুদ্ধুদের প্রায়।
কল্পে কল্পে বিশ্ব যাঁর সৃষ্টি স্থিতি লয়।।

 

অনন্ত রূপেতে ছবি যাঁর ইচ্ছা গড়ে।
আপনি নির্লিপ্ত রয় বিশ্ব চরাচরে।।
ইচ্ছা হল তাই দিল মানবেরে জ্ঞান।
গুণমধ্যে শ্রেষ্ঠ যাহা তত্ত্বের প্রধান।।
আকারে মানবে করে আপনার প্রায়।
তত্ত্বজ্ঞানী নরগণে সেই কথা কয়
।।
অনন্ত সাগর বুকে তলহীন বারি।
প্রতি বিন্দু কণা ধরে আছে জীব সারি।।
যেখানে যে জন আছে দেখিল যাহা।
আপনার ভাবে মনে বলে যায় তাহা।।
আপনার ভাবে নর তারে ব্যাখ্যা করে।
কেবা জানে পশুপাখি কোন ভাবে ধরে?
মানবের শাস্ত্র আছে দর্শন, পুরাণ।
শিল্প আছে সৃষ্টি আছে সাহিত্য বিজ্ঞান।।
প্রকৃতির যেই শক্তি তাহা উঘাড়িয়া।
মানব নিতেছে নিজ জগত গড়িয়া।।
প্রকৃতির শক্তি পরে কোন অধিকার।
নরভিন্ন অন্য জীবে নাহি কোথা আর।।
অধিকার বল কিম্বা বল ব্যবহার।
কিম্বা বল প্রকৃতির প্রকৃত আকার।।
মানব সাধনা কিংবা বল তার জ্ঞান।
পেয়েছে প্রকৃতি-তত্ত্বে অ-পূর্ব্ব সন্ধান।।
তাঁর জীব মধ্যে নর বহু অগ্রসর।
তার শাস্ত্র আছে তার আছেন ঈশ্বর।।
সে জানে বিরাট বিশ্বে সর্ব্বতত্ত্বময়।
রয়েছে এমন শক্তি যে বিশ্ব চালায়।।
অ-সাধ্য অ-বাধ্য তার নাহি কোনখানে।
সকলে জুড়িয়া একা আছে সর্ব্বস্থানে।

সর্ব্বজ্ঞ সুন্দর তিনি, সকলের শ্রেষ্ঠ।
শ্রেষ্ঠর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি প্রভু জগদিষ্ট।।
তিনি যে, কিবা নহে, কেবা তাহা বলে?
তাঁরে বলা শেষ নাহি হবে কোন কালে।।
জ্ঞান কি আকারে কিংবা ধ্যানে কি বিজ্ঞানে।
বিরাটের সাড়া নর দেখে যে যেখানে।।
শ্রেষ্ঠের স্বরূপ চিহ্ন দেখে মধ্যে তাঁর।
নর বলে ‘‘এই রূপ আমার ঈশ্বর।।’’
যেখানে শ্রেষ্ঠত্ব আছে সেথা প্রভু রয়।
জীব মধ্যে নরগণ শ্রেষ্ঠ বটে হয়।।
তাই নর ভাবে প্রভু তাহার স্বরূপ।
এই খানে তত্ত্ব কিন্তু নাহি রয় চুপ।।
মানবের মধ্যে পুনঃ আছে স্তর ভেদ।
আকারে জ্ঞানেতে দেখি কতই প্রভেদ।।
বিশ্বাসে বেড়িয়া সেই মহাসত্য রয়।
সকল মানব গোষ্ঠী তাহা জ্ঞাত নয়।।
যেই জন জানে তত্ত্ব সত্যের বিকাশ।
জেনে তত্ত্ব বিশ্বমাঝে করেন প্রকাশ।।
নর শ্রেষ্ঠ তার মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠতর।
নর দেখে তাঁর মাঝে বিকাশ তাঁহার।।
সূহ্ম হতে সূহ্ম জানি অহং তত্ত্ব জ্ঞান।
গোচরে কি অগোচরে চলে অভিযান।।
আপনার রূপধারী তাই কোন জনে।
সহজে মানব মন মানিতে না জানে।।
তাই মুখে বলে কথা মনে অহংকার।
এই ব্যক্তি সুনিশ্চয় অবতার তাঁর।।
তাঁর শক্তি এর মধ্যে করিতেছে খেলা।
‘‘তিনি এই’’ একেবারে নাহি যার বলা।।
অবশ্য আরেক তত্ত্ব থাকিতেও পারে।
প্রকাশ্যে বলিব তাহা সাধুর গোচরে।।
অনন্ত অসীম যিনি নিত্য নির্ব্বিকার।
অক্ষয় বলিয়া যাঁরে ব্যাখ্যা করে নর।।
সীমাবদ্ধ নর দেহ কিংবা অন্য দেহে।
পরিপূর্ণ শক্তি বল কোন ভাবে রহে?
সাগরের সাথে নদী আছে যোগাযোগ।
সাগরের কাছে নদী বল কিসে লাগে?

নদী মধ্যে আছে বটে সাগরের জল।
সেই জল নদী মধ্যে করে কল কল।।
তাতে কি সাগর নদী এক বলা যায়?
নদী ও সাগরে ভেদ এইখানে রয়।।
নদীরে সাগর বলি কেহ নাহি কয়।
‘‘অবতার’’ তত্ত্বখন্ডে সেই পরিচয়।।
তার মধ্যে আছে দেখ বিভিন্ন প্রকার।
বিভিন্ন সাগরে নদী বিভিন্ন আকার।।
কোন নদী মিশে গিয়ে বৃহৎ নদীতে

উপসাগরেতে কেহ পড়ে নানা পথে।।
কোন নদী পড়ে গিয়ে সাগরের বুকে।
নদীতে নদীতে এই ভিন্ন ভাব থাকে।।
সাগরের জল আসে উপসাগরেতে।
সেই জল ছোটে পরে যত নদী পথে।।
তাহা হতে জল পায় যত উপনদী।
এই ভাবে তাহাদের চলা নিরবধি।।
সাগরের শেষ হয় উপসাগরেতে।
উপসাগরের শেষ হয় নদী পথে।।
মহাসাগরের খেলা থাকে বহু দূরে।
প্রত্যক্ষ সংযোগ নদী সেথা নাহি ধরে।।
অবিরম বিবর্তন ধরা মাঝে হয়।
সাগরের পথ কত রুদ্ধ হয়ে যায়।
তাহার প্রমাণ দেখ কাস্পিয়ান সাগর।
হৃদ হয়ে আছে পড়ে দেশের ভিতর।।
এই সব সাগরেতে যেই নদী পড়ে।
সাগরের বুকে পড়ে তাই নিয়ে ঘোরে।।
কিন্তু মহাসাগরের বিবর্তন নাই।
আপন লীলার মাঝে প্রকট সদাই।।
মহাসাগরের বুকে যদি কোন নদী।
আপনার মূল রেখে চলে নিরবধি।।
মহাসাগরের খেলা তার বুকে চলে।
জনপদ সিক্ত হয় তার স্নিগ্ধ জলে।।
শুকায় না নদী সেথা নিত্য বয়ে যায়।
শ্রীহরিচাঁদের এই সত্য পরিচয়।।
এতকাল যে যে শক্তি নামিল ধরায়।
জীবের কল্যাণ হেতু লীলা করে যায়।।
কেহ এল বিষ্ণু শক্তি কেহ নারায়ণ।
গোলক বিহারী কেহ মুনির নন্দন
।।
অনন্ত শক্তির কেন্দ্র ক্ষীরোধাব্ধী হতে।
কোন শক্তি আসে নাই জীবকে তারিতে।।
তার ইচ্ছা-শক্তি তাই নামিল ধরায়।
শ্রীহরি ঠাকুরন নামে পূর্ণ শক্তিময়।।
কল্পবৃক্ষ মূল তিনি গুরুচাঁদ কান্ড।
দুই রূপে পিতাপুত্র ধরেছে ব্রহ্মান্ড।।
গুরুচাঁদ ‘‘কান্ডে’’ দেখি কত শাখা পত্র।
সংক্ষেপে বলিব তার পরিচয় মাত্র।।
গুরুচাঁদ বৃক্ষে ফুটে কি সুন্দর ফুল।
গোপাল যাদব আর বিপিন নকুল।।
কবিরত্ন আর যিনি কবি চুড়ামণি।
প্রেমিক শ্রীহরিবর সরকার জানি।।
স্বভাব কবিত্বে ভরা ছিল যাঁর প্রাণ।
অশ্বিনী গোঁসাই ধন্য রচিলেন গান।।
রূপচাঁদ গোস্বামীর তেজ অতিশয়।
‘‘রমনী গোঁসাই’’ নামে হল পরিচয়।।
ডাক্তার তারিণী বাবু ব্রহ্মদেশে রয়।
পিতৃসম গুরুচাঁদে মানে মহাশয়।।
পরেশ সর্দ্দার নাম জয়ারাবাদ বাস।
পারশুলাবাসী সাধু শ্রীহরি বিশ্বাস।।
কৃষ্ণপুরবাসী সাধু নাম সোনাতন।
শ্রীবিপিন, তারিণীর ভাই একজন
।।
পাটিকেলবাড়ীবাসী ষষ্ঠী বাবু নাম।
অবিরত যাতায়াত ওড়াকান্দী ধাম।।
বিচরণ, বলরাম, কানাই, কেদার।
মহাকর্মী মাধবেন্দ্র ওড়াকান্দী পর।।

গোলক পাগল যিনি মহাভাবময়।
মহানন্দ, দশরথ, ভ্রাতুষ্পুত্র হয়।।
শ্রীদশরথের পৌত্র মাধবেনদ্র নাম।
কর্ম্মী ভক্ত সেজে রহে ওড়াকান্দী ধাম।

গৃহকর্ম্ম লেখাপড়া সবখানে রাজী।
যেথা যান গুরুচান মাধবেন্দ্র মাঝি।।
কাথলী নিবাসী সাধু নাম নিবারণ।
তারকচাঁদের শিষ্য তিনি একজন।।
এই মত শত শত কত আর বলি।
অসংখ্য ভকত নিয়ে মতুয়া মন্ডলী।।
যতেক প্রধান সাধু তাঁহাদিগে ধরে।
অসংখ্য আসিল ভক্ত ওড়াকান্দী পরে।
গ্রন্থ সমাপন পর্ব্বে কিছু পরিচয়।
দিব যদি গুরুচাঁদ রাখে রাঙ্গা পায়।।
বিস্তৃত লিখিতে গেলে মতুয়া জীবন।
কোন কালে তাহা নাহি হবে সমাপন।।
দিনে দিনে কতজনে উদার মহৎ

পবিত্র হইবে তারা নিয়ে এই পথ।।
জ্ঞানী, কবি, ভক্ত কত আসি ভবিষ্যতে।
শত শত গ্রন্থ রচি বিলাবে জগতে।।
মধুর রচনা তাঁরা করিবে রচনা।
মম সম দীন হতে সে সব হল না
।।
সে সব প্রধানে ধরে এল বহুজন।
সংক্ষেপে বর্ণিত কিছু তাঁদের জীবন।।
মহতের কথা বলি হেন সাধ্য নাই।
ভুল দোষক্রুটী জন্যে পদে ক্ষমা চাই।।
শ্রীগুরু-রচিত কথা সুধা হতে সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যায় তব-ক্ষুধা।।

 

 

 

 

 

ভক্তকবি শ্রীমৎ হরিবর সরকারের জীবনকথা


প্রেমিক সাধক কবি ভক্ত হরিবর।
ফরিদপুর জিলা মধ্যে দুর্গাপুর ঘর।।
রচনা কি কবিগানে বহু খ্যাতি যাঁর।
তাঁর পদে সবিনয়ে করি নমস্কার।।
ধন্য কবি বঙ্গ দেশে আনন্দ সুজন।
তাঁর পুত্র হরিবর গুণে মহাজন।।
পুত্রহীন আনন্দের দুঃখ অতিশয়।
মহোদুঃখ হরিচান্দে কেন্দে কেন্দে কয়।।
শ্রীহরি ডাকিয়া বলে আনন্দের ঠাঁই।
‘‘শুন হে আনন্দ আমি যাহা বলি তাই।।
এক বর্ষ ব্রহ্মচার্য্য পালপত্নী সাথে।
অবশ্য সুপুত্র লাভ হইবে তাহাতে।।’’
প্রভু আজ্ঞা শিরোধার্য্য আনন্দ করিল।
তার ফলে পুত্ররূপে হরিবরে পেল।।
বার শত পচাত্তর সালের গণনা।
পুত্র দিল হরিচাঁদ করিয়া করুণা।।
শ্রীহরির বরে জন্ম নিল মহাশয়।
হরিবর বলি তার পিতা নাম দেয়।।
পুত্র লয়ে শ্রী আনন্দ ওড়াকান্দী গেল।
ভক্তিভরে বহু কথা হরিকে কহিল।।
নমঃকুলে আছে যত ‘‘কবি সরকার।’’
সুরসিক বলি ব্যাখ্যা পায় হরিবর।।
পুত্রের শিক্ষার লাগি আনন্দ সুজন।
গ্রাম মধ্যে পাঠশালা করিল গঠন।।
তথা হতে প্রাথমিক পাঠ শেষ করি।
ছাত্রবৃত্তি পড়িবারে গেল দেশ ছাড়ি।।
ঘোণাপাড়া গ্রামে গিয়ে ছাত্রবৃত্তি পড়ে।
বিশেষ যশের সঙ্গে তাহা পাশ করে।।

 

তখনে নিয়ম ছিল ছাত্রবৃত্তি পড়ি।
মোক্তার হইত লোকে পড়িয়া মোক্তারী।।
পাঠ শেষ করি তেঁহ মোক্তারী পড়িল।
পরীক্ষাতে শেষ কালে পাশ নাহি পেল।।
তারপরে শ্রীআনন্দ পুত্রে বিয়া দিল।
সেই হতে হরিবর সংসারী সাজিল।।
কিছুকাল গতে জন্মে একটি নন্দন

পুত্র সহ পত্নী মল দৈবের ঘটন।।
একে ত স্বভাব কবি তাতে ব্যথা পেল।
পত্নীর বিয়োগে এক গ্রন্থ বিরচিল।।
পুনরায় করিলেন দার পরিগ্রহ।
ভুলিলেন ক্রমে ক্রমে পত্নীর বিরহ।।
বাসুড়িয়া গ্রামে তার শ্বশুর আলয়।
মাঝে মাঝে কবিবর তথাকারে যায়।।
এ সময়ে হরিচাঁদ নরাকারে নাই।
ধামেশ্বর গুরুচাঁদ সবে জানে তাই।।
প্রধান ভকত জানি স্বামী মহানন্দ।
অক্ষয়, কার্ত্তিক, আর শ্রীতারকচন্দ্র।।
বহু দেশে ভ্রমে তাঁরা প্রচার কারণে।
মতো নহে শ্রীআনন্দ হরিচান্দে মানে।।
রোগের বিধান যাহা প্রভু গেছে বলে।
ব্যাধি হলে সে আনন্দ সেই ভাবে চলে।।
তাই জানে তাই মানে কবি হরিবর।
নাহি জানে মতুয়ার সব সমাচার।।
গীত বাদ্য কার্য়্যে তিনি বাল্যকাল হতে।
বিশেষ সুদক্ষ তিনি আছে নানামতে।।
একদিন বাসুড়িয়া গেল হরিবর।
আশ্চর্য্য শুনিল কথা এক সমাচার।।
বাসুড়িয়া গ্রামে কত মতোরা আসিবে।
মন্ডল বাড়ীর পরে মহোৎসব হবে।

শ্বশুরের গৃহ হতে বেশী দুরে নহে।
তাই তারা বাক্যচ্ছলে হরিবরে কহে।।
মহোৎসবে যেতে কিবা আছে তব মন?’’
হরিবর বলে ‘‘তাহা করে কোনজন?
টলুয়া বৈরাগী যদি করে মোহৎসব

সেথা যেতে মনে করি মহা অগৌরব।।’’
তারা বলে মহাশয় এরা তারা নয়

মতুয়ার মহোৎসব শোন পরিচয়

জাতিভেদ প্রথা কিছু নাহি বাঁধাবাঁধি।
মতো হলে সবে মিলে করে কাঁদাকাঁদি।।
জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ সবে সমভাবে দেখে।
সকলের পদধুলি সবে নিয়ে থাকে।।’’
ক্রোধে কয় হরিবর কার্য্য ভাল নয়।
কতগুলি কার্য্য দেখি মন্দ অতিশয়।।
তাহাদের নেতা বল আছে কোন জন।
নিশ্চয় তাঁহারে আমি করিব শাসন।।’’
এতবলি পরদিন সেই হরিবর।
মহোৎসবে উপনীত হইল সত্বর।

পথে যেতে শোনে কাণে সুললিত ধ্বনি।
ব্যাকুল হইল প্রাণ গীতধ্বনি শুনি।।
মধুর মৃদঙ্গ বাজে মতুয়ারা গায়।
‘‘কে যাবি গৌরঘাটে, আয় চলে আয়।।’’
তারকের কৃত বোলভাবরসে ভরা

স্বভাব কবির চিত্ত হল দিশাহারা।।
কি যে মনে করে এল কিছু মনে নাই।
মনের গোপনে যেন ওঠে শুধু হাই।।
দ্রুতগতি সভামধ্যে হরিবর যায়।
মৃদঙ্গে সঙ্গৎ তার মনে নাহি লয়।

ত্বরা করি নিল ধরি মধুর মৃদঙ্গ।
সুসঙ্গত বাদ্য করি ঝাঁকি দিয়ে অঙ্গ।।
এই ভাবে গানে মত্ত রহিল তথায়।
গান অন্তে এল ফিরে শ্বশুর আলয়।।
সবে বলে কি কি তর্ক হইল সেখানে?
হরিবর বলে তর্ক নাহি ছিল মনে।
’’


 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free