মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

যম কলি প্রভাব গ্রন্থালোচনা (আলোচনা)

শ্রীমৎ তারক চন্দ্র সরকার প্রণীত শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের এই পরিচ্ছেদে শ্রীশ্রীহরিঠাকুরের অবতার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কারণ এবং মতুয়াদের কর্মপন্থা কি হবে এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। পূর্বাপর শাস্ত্রের ব্যাখ্যার আলোকে হরিঅবতারের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রথমেই শ্রীগৌরাঙ্গের প্রেম কলির মায়ায় বিলীন হওয়ায় আক্ষেপ করা হয়েছে। এবং এর কারণস্বরূপ ভাগবতের আশ্রয় নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কলির শুরুর দিকের কথা। রাজা পরীক্ষিত একদা স্নান করতে যান, তখন ধর্ম বৃষরূপে দণ্ডায়মান, মুদ্গর দিয়ে কলি যার পা ভেঙ্গে দিয়েছে। এবং বসুমতী সুরভীরূপে রাজা পরীক্ষিতকে ধর্ম ও কলির প্রত্যক্ষে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা পরীক্ষিত কলিকে কাটিতে তথা মেরে ফেলতে চাইল এবং বলে আমার অধিকারে কলির কোন স্থান নেই। প্রাণের ভয়ে কলি রাজার শরণ নেয় অর্থাৎ আশ্রয় গ্রহণ করে। কলি অনেক অনুনয় বিনয় করে চারটি স্থান চেয়ে নেয় থাকার জন্য। চারটি স্থান হলো ১. স্বর্ণকার দোকান, ২. বেশ্যালয়, ৩. সুরাপান যেখানে হয় ও ৪. জীবহত্যা যেখানে হয়। বিচার করলে দাঁড়ায় যদিও চার স্থান কলি চেয়ে নিল, কিন্তু তার স্থান সর্বত্র হয়ে গেল। কারণ সুপ্রাচীন কাল থেকেই স্বর্ণের প্রতি মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ, এর জন্য স্বর্ণকারের ঠাই গমন করবে একাংশ। ব্যাসের উল্লেখ করে বেশ্যার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পঞ্চসঙ্গ করে যে নারী তাকে বেশ্যা বলা হবে। মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে অহরহ জীব হত্যা করে খাদ্যের জন্য। 

জীব গোস্বামী লিখিত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের আশ্রয় নিয়ে বলা হচ্ছে, গৌরাঙ্গ যখন প্রেম প্রচার করল, তখন পাপ পুণ্য শুন্য হয়ে যাবে এই ভয়ে চিত্রগুপ্ত ও যম তাদের স্ব স্ব কার্য থেকে বিরত থাকেন। সে সময় ষড়রিপু উপস্থিত হয়ে তাদের কার্যকলাপ যমকে জানিয়ে বলে আপনার অধিকার যায় নি। আমরা থাকতে আপনার অধিকার যেতে পারে না। কাম বলে আমি প্রকৃতিরূপে গৌরাঙ্গের প্রেম শোষণ করে নিব। একা চৈতন্য কিছুই করতে পারবে না বলে আশ্বাস দেন। কলি বলে আমি ভেকধারী সাধু হয়ে যুক্তি সহকারে চৈতন্যের মত যেন মানুষে না মানে তা বুঝাব। এভাবে কলি ও ষড়রিপু যৌথভাবে নানা মত প্রচার করল। ফলে গৌরাঙ্গের মতের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হল। সৃষ্টি হল বৈষ্ণবের কুটিনাটি। এটা কর না, ওটা কর না, একে ছুইও না, ওকে ছুইও না ইত্যাদি। তাছাড়া কলি ও ষড়রিপুর প্রাদুর্ভাবে মাতা, পিতা, গুরুজনকে অবজ্ঞা করা শুরু হল। এভাবে যখন গৌরাঙ্গের মত প্রায় লোপের পথে তখন শ্রীনিবাস রূপে প্রভু অবতীর্ণ হন নরোত্তম কে সঙ্গী করে। তাঁরা মধুর মাধুর্য প্রেম প্রকাশ করল বটে, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। কলি আবার তার প্রভাবে প্রেম লোপ করে ফেলল। এতে বীরভদ্র ও তার চার প্রিয় শীষ্য চার সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করল। বনচারী, অখিলচাঁদ, সেবা কমলিনী ও হরিগুরু এই চার সম্প্রদায়। বীরভদ্র তার পূর্ব মহাজনদের ধর্ম তার শিষ্যদের জানালে তারা প্রকৃতি আশ্রয় করে সাধনে সিদ্ধ হলো। প্রকৃতি আশ্রয় করে প্রেম হচ্ছে চণ্ডীদাস রজকিনীর প্রেম। কিন্তু এই প্রেম বিলাতে গিয়ে তা বিপথে চলে গেল। সৃষ্টি হল ন্যাড়া-নেড়ির দল। এরা সাধনকে উপলক্ষ্য করে, মজে রইল কাম রসনায়। নিস্কাম প্রেম সাধন করতে গিয়ে কামে জড়িয়ে সব নষ্ট করে দিল। জাতি নিয়ে দলাদলি সৃষ্টি হল। একেক দল একেক মতে। (উদাহরণ স্বরূপ বর্তমানের গৌড়িয় মঠ এবং ইসকন একই গুরুর শিষ্য হলেও তাদের মতের মিল নেই, কেউ কারো সহ্য করতে পারে না।)। এর মধ্যে শিবের চৌষট্টি নিশার প্রাদুর্ভাব হবে। শনিবারে আর মঙ্গলবারে “বার” সাজাবে। এখন দেখা যায়, বিভিন্ন সাধুর বার। বেল গাছ ও তুলসী গাছের মাহাত্ম লোপ করে দিবে। তবে সব কথার শেষ কথা, মাধুর্যের ভক্তে কলির কোন প্রভাব খাটবে না। অন্যদিকে রোগ শোক দিয়ে মতে দ্বিমত ঢুকবে। যেখানে সেখানে তীর্থ সৃষ্টি হবে, কুলজা, কুলাচার ধর্ম নষ্ট হবে। এতে ঈশ্বরের পথ ভেবে বিপথে গমন করবে। ওই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত মতে শ্রাদ্ধ্যৎস্বর্গ তণ্ডুল স্পর্শে প্রেম শূন্য ও অজালোম (ছাগলের চুল) স্পর্শে ভক্তি চূর্ণ হয়। আরও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে বসুন্ধরা পাপে পূর্ণ হবে, শস্য ফলবে না, নদনদী খাল বিল শুকিয়ে যাবে ইত্যাদি। এসমস্ত হবে মারুতির ক্রোধে, সীতার অভিশাপে ও হনুমানের দর্পে। তারা শিব দুর্গা মানবে না, কৃষ্ণপ্রেমকে অবজ্ঞা করবে, মরা নাম মনে করে হরিনাম নিবে না। এরূপভাবে বৈষ্ণব ধর্মে ত্রুটি উৎপন্ন হল। তারপর যদুবংশ ধ্বংস হওয়ার কিছু কারণ আলোকপাত করেছেন। গান্ধারীর শাপ ছিল যদু বংশ ধ্বংস হবে। তারা সতীর (ত্রেতা যুগে বালির স্ত্রী) অভিশাপ ছিল গুপ্তবানে ভগবান মৃত্যুবরণ করবে (বালির পুত্র অংগদ এ জন্মে গোপন তীরে শ্রীকৃষ্ণকে মারে), যদু বালক কর্তৃক ব্রাহ্মণের অপমান (দ্বিজ দুর্বাসাকে অপমান) ইত্যাদি কারণে যদু বংশ ধ্বংস হতে পারে। কিন্তু মূল কারণ হল ভূভার হরণ। 

এই সমস্ত কুটিনাটি, আচার ব্যবহার, ছ্যুতমার্গ, দূর করার জন্য সুযুক্তিবিধানে প্রভু হরিচাঁদ অবতাররূপে আবির্ভূত হন। এবং শ্রীহরিচাঁদের শিক্ষা তথা লীলামৃতের সিদ্ধান্ত বর্ণীত হয়েছে। কিভাবে জীবন যাপন করবে?
১. নিজ নারী সংগে নিয়ে গৃহস্থধর্ম পালন করবে। নারীকে উপেক্ষা করে নয়, সংগে নিয়ে ঈশ্বর আরাধনা করতে হবে। 
২. গৃহকর্ম সব করবে। গৃহধর্ম পালন করার জন্য যে সব কাজ করতে হয়, তার কোনটাকে উপেক্ষা করা যাবে না। 
৩. গৃহে থেকেই সন্ন্যাস, বাণপ্রস্থ ও ব্রহ্মচারীর মত জীবন যাপন করবে।
৪. হাতে কাজ করবে, মুখে ঈশ্বরের নাম থাকবে।
৫. সর্বদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যার আশ্রয় নিবে না।
৬. পরনারীকে মাতৃতুল্য জ্ঞান করবে। 
৭. সর্বদা সচ্চরিত্র রবে।
৮. পরের দুঃখে দুঃখ বোধ করবে।
৯. অদীক্ষিত তীর্থ ভ্রমণ করবে না।
১০. মুক্তিস্পৃহা বা মুক্তির ইচ্ছা থাকবে না, এবং মুক্তির উপলক্ষ্যে কোন সাধন ভজন করবে না, করবে প্রেম লাভের জন্য। কর্মের মাধ্যমেই ধর্মের বা ঈশ্বরের সাধনা করবে।
১১. হরিনাম মন্ত্রে জীবে প্রেম দান। হরিপ্রেমেই জীবের আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং ইহজাগতিক মুক্তি কর্মে।

 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free