পৃষ্ঠাঃ ১৮১-২০০
দুঃখী জনে দয়া করে দীনে বাসে ভালো।
অন্ধ জনে জ্বেলে দেয় জ্ঞান-চক্ষু-আলো।।
বহু দুঃখ ভোগী মোরা দেখিয়া নয়নে।
মোদের মঙ্গল তরে এসেছে এখানে।।
কতই দুঃখেতে দেখ কাটিয়াছে কাল।
বান্ধব ছিলনা কেহ এমনই কপাল।।
কৃপা করি হরি তাই মানুষে পাঠা'ল।
পতিতে জাগাতে দেখ মীড্ হেথা এল।।
যা' কিছু বেদনা আছে কহ তাঁর ঠাঁই।
অবশ্য পাইবে পথ কোন চিন্তা নাই।।”
এত যদি গুরুচাঁদ বলে সবাকারে।
জয় জয় ধ্বনি উঠে সভার ভিতরে।।
“জয় গুরুচাঁদ জয় মীড মহামতি।
জয় ধ্বনি করে সবে হৃষ্ট হয়ে অতি।।
আসন গ্রহণ তবে গুরুচাঁদ করে।
মীড দাঁড়াইল পরে সভার ভিতরে।।
সকলে উন্মুখ হ'য়ে তাঁর প্রতি চায়।
ধীরে ধীরে কথা মীড সভাজনে কয়।।
“ভক্ত মহোদয় গণ! এই কথা বলি।
এদেশে অতিথি আমি শুনহে সকলি।।
মোর কার্য রীতি যত বড়কর্ত্তা ঠাঁই।
সকলি বলেছি কিছু বাকি রাখি নাই।।
মোর প্রভু যীশুখ্রিষ্ট দীনে করে দয়া।
তাঁর ভাব পালি ' দিয়ে মন -প্রাণ -কায়া।।
এই দেশে কাণ্ড দেখি বড়ই অদ্ভূত।
মানুষে মানুষে হিংসা-কার্যে মজবুত।।
ইতর পশুর প্রতি যতটুকু দয়া।
মানুষে মানুষে নাহি তার কোন ছায়া।।
আদি অন্ত সে বৃত্তান্ত বড় কর্ত্তা মোরে।
বলিয়াছে দুঃখে মোরে প্রহরে প্রহরে।।
নমঃশূদ্র আদি যত দরিদ্রের গণ।
শিক্ষা, দীক্ষা হীন হ'য়ে কাটিছে জীবন।।
জমিদার মহাজন ধনে মানে উচ্চ।
দিনে রাতে তা ' সবারে করিতেছে তুচ্ছ।।
মানুষের অধিকারে করিয়া বঞ্চিৎ।
আজন্ম অন্যায় রাশি করেছে সঞ্চিৎ।।
সেই সব লোক যারা শিক্ষা দীক্ষা হীন।
অন্তরে বাহিরে সদা দুঃখেতে মলিন।।
তাহাদের দুঃখ রাশি দূর করে দিতে।
এসেছিল যীশুখ্রিষ্ট এ-মর জগতে।।
তাঁর যে আদর্শ তাহা রহি ' নিজ শিরে।
মোরা সবে ঘুরে দেখি দেশ-দেশান্তরে।।
তোমাদের উপকার যদি কিছু হয়।
সেই ভাবি মোরা দেখ এসেছি হেথায়।।
এই গুরুচাঁদ যিনি তোমাদের নেতা।
তাঁর কাছে জানিয়াছি তোমাদের ব্যথা।।
যথাসধ্য চেষ্টা মোরা অবশ্য করিব।
পালিব প্রভুর নীতি নতুবা মরিব।।
ধন-বল জন-বল কিছু নাহি চাই।
বসতি গড়িয়া র'ব জমি যদি পাই।।
জমি কিছু দান চাই বসতি করিতে।
তাহার ব্যবস্থা সবে কর বিধিমতে।।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ বলে মোর ঠাঁই।
বিদ্যাশিক্ষা পেলে নাকি কোন ভয় নাই।।
তাঁহার বচন আমি শিরোধার্য করি।
শিক্ষা লাগি দেখি আমি কি করিতে পারি।।
স্থান যদি পাই কিছু স্কুল গড়িবারে।
ছাত্র যদি পাই তা'তে পড়িবার তরে।।
অবশ্য গড়িব স্কুল নাহিক সন্দেহ।
স্কুল লাগি স্থান কিছু সবে মোরে দেহ।।
মধ্য ইংরাজী স্কুল করিয়াছ সবে।
সেই স্কুল হাই স্কুল করিতেই হবে।।
আমার ধর্ম্মের শিক্ষা যদি সেথা দেয়।
গৃহাদি করিয়া দিব আমরা তথায়।।
আমার ধর্ম্মের বাণী সবে বলিবারে।
অধিকার দিতে হবে সরল অন্তরে।।
“মিশন “ গড়িব আমি ধর্ম্ম প্রচারিতে।
তার লাগি জমি কিছু মোরে হবে দিতে।।
এই মত প্রতিশ্রুতি যদি আমি পাই।
অবশ্য করিব কার্য কিছু ভুল নাই।।
বিবেচনা করি সবে দেহ গো উত্তর।
যাহা কবে বল মোরে সকলে সত্বর।।”
এতেক বলিয়া মীড বসিল তখন।
সভাজনে কাণাকানি করে সর্ব্বজন।।
মৃদু গুঞ্জনের ধ্বনি উঠে চারিভিতে।
কোন কিছু কোন জন পারে না বলিতে।।
হেন কালে দাঁড়াইল জ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর।
“চুপ কর “ বলে সবে জুড়ি দুই কর।।
নিস্তব্ধ হইল সভা স্তব্ধ সিন্ধু প্রায়।
সাহেবে উদ্দেশ্য করি যজ্ঞেশ্বর কয়।।
“শুনহে ডক্টর মীড, মোদের বারতা।
সকল বুঝিনা মোরা যত বল কথা।।
আমাদের কর্ণধার অই বড় কর্ত্তা।
তাঁর সাথে হইয়াছে নাকি কথাবার্ত্তা।।
এ জাতির শুভা-শুভ পতন-উন্নতি।
সবাকার মূলে উনি সর্ব্বকালে গতি।।
উহার উপরে আছে সবার নির্ভর।
উনি যাহা করে তাহা মোদের সবার।।
অকূল সমুদ্রে জানি উনি কর্ণধার।
তাঁর ইচ্ছা বিনা ইচ্ছা নাহি কারো আর।।”
এমত কহিল যদি সাধু যজ্ঞেশ্বর।
সভা জনে দিল সায় সবে একত্তর।।
তবে ত ডক্টর মীড প্রভু পানে চাহে।
ধীরে উঠি মহাপ্রভু কিছু কথা কহে।।
স্বজাতির প্রতি প্রভু তবে ডাকি কয়।
“শুন সবে মোর মনে যত কিছু লয়।।
আমি বুঝি রাজ শক্তি সাহায্য ব্যতীত।
পতিত জনের কভু নাহি হবে হিত।।
রাজ পুরোহিত মীড তাহে শক্তি মন্ত।
আমি বলি তাঁহা হ'তে দুঃখ হবে অন্ত।।
মীড যবে আসিবারে করিল মনন।
তোমাদিগে’ সব কথা বলেছি তখন।।
সেই কথা মনে সবে করহে এখন।
মোর ইচ্ছা করিবারে জাতির তারণ।।
আমি বলি মীড যদি এই দেশে রয়।
অবশ্য মঙ্গল হবে নাহিক সংশয়।।
যা কিছু করিবে মীড সবে ইহা জান।
মোদের মঙ্গল হবে এই কথা মান।।
তাই এই ইচ্ছা আমি করিয়াছি মনে।
অবশ্য মীডেরে রাখি বিশেষ যতনে।।
যে ইচ্ছা করিবে মীড সে-ইচ্ছা আমার।
অকুল পতিত নিয়ে দিলাম সাঁতার।।
যাহা কিছু চাহে মীড সব আমি দিব।
জাতি যদি জাগে তবে কিবা না পারিব?
অতঃপর মীডে চাহি প্রভু বলে হাসি।
“জমি চাও জমি লও নাশ দুঃখ রাশি।।
কতখানি জমি মীড চাহ মোর ঠাঁই।
যাহা চা'বে তাহা পাবে কোন চিন্তা নাই।।
যাহা ইচ্ছা কর তুমি তাতে বাধা নাই।
পতিত উদ্ধার হোক্ এই মাত্র চাই।।
প্রভুর বচন শুনি মীডের বিষ্ময়।
মনে ভাবে হেন জন 'না দেখি কোথায়।।
যতকাল এই দেশে আসিয়াছি আমি।
বহুলোক দেখিলাম নানা স্থানে ভ্রমি।।
বিশেষতঃ নমঃশূদ্র বলি যারা কয়।
সবাকার রীতিনীতি জানি পরিচয়।।
কিন্তু এই বড়কর্ত্তা শ্রী গুরুচরণ।
কোন জনে নাহি দেখি ইহার মতন।।
এ- যেন জ্বলন্ত অগ্নি - আগ্নেয় পর্ব্বত।
রূপে গুণে কুলে শীলে মহামান্য সৎ।।
ইহাকে বেড়িতে মনে যা ' করি যুকতি।
বেড়াজাল ছোট হয় লজ্জা পাই অতি।।
কি জানি দয়াল যীশু কি দিয়া কি করে।
বাঁধিতে আসিয়া বাঁধা পড়িনু প্রকারে।।
তব ইচ্ছা পূর্ণ হোক ও হে পরমেশ।
এই কর্ম্মলীলা বুঝি জীবনের শেষ।।
এতেক ভাবিয়া মীড প্রভু পানে চায়।
দেখে মৃদু মৃদু হাসে প্রভু রসময়।।
মীড চাহি প্রভু তবে হাসি কথা কয়।
“নীরবে কি চিন্তা কর মীড মহাশয়?
যাঁর কাজ সেই করে মোরা উপলক্ষ্য।
যা' হোক তা' হোক ফল তাতে নাই দুঃখ।।
কারে দিয়ে কোন কার্য প্রভুজী করা'বে।
সেই চিন্তা করে বল কিবা ফল হবে।।
আর বলি শুন মীড মনোগত কথা।
বাঁধা পড়ে ' --যদি থাকে পরাণে মমতা।।
কেবা কারে বাঁধে নিজে না বান্ধিলে।
মন-বান্ধা পড়ে যদি, ঠিক বান্ধা হলে।।
বিস্ময়ের পরে মীডে জাগিল বিস্ময়।
মনে ভাবে এই ব্যক্তি সামান্য ত নয়।।
আমার মনের মধ্যে যে চিন্তা জাগিল।
এ মানুষ কোন সুত্রে তাহা টের পেল।।
অপরের চিন্তা-পাঠ-বিদ্যা বটে আছে।
এই ব্যক্তি কভু কিবা সে বিদ্যা শিখেছে।।
কি জানি কেমন হ'ল আজিকে ঘটনা।
আর স্তব্ধ থাকা মোর উচিত হবে না।।
এত ভাবি মীড তবে উঠিয়া দাঁড়া'ল।
প্রভু পানে চাহি তবে বলিতে লাগিল।।
“ বড় কর্ত্তা! মোর বার্ত্তা বলি তব ঠাই।
এই কার্যে আমি দশ বিঘা জমি চাই।।
দশ বিঘা জমি যদি মোরে কর দান।
তোমার জাতির কার্যে আমি দিব প্রাণ।
কি জানি আজিকে মোর কেমন হইল।
মোরে দিয়া এই সব কে যেন বলা'ল।।
নিশ্চয় বুঝিনু ইহা যীশুজীর কাজ।
তোমার কাজের ভার স্কন্ধে নিনু আজ।।”
এ মত ডক্টর যদি বলিল বচন।
প্রভুজী ডাকিয়া সবে বলিল তখন।।
“সভাজনে শুন সবে আমি যাহা কই।
দশ বিঘা জমি দিতে প্রতিশ্রুত হই।।
গ্রাম্য- মধ্যখানে দেখ পশ্চিম পাড়ায়।
আমার কতক জমি আছে নিরালায়।
সেই জমি মীডে আমি করিলাম দান।
আর যদি লাগে দিতে না করিব আন্।।
এই বাণী প্রভু যবে সভাতে বলিল।
“ধন্য ধন্য “ রব তবে চারিভিতে হ'ল।।
উল্লাসে ডক্টর মীড দাঁড়ায়ে তখন।
নিজ কর দিয়া করে শ্রী কর মর্দ্দন।।
সভাজনে প্রতি তবে মীড ডাকি কয়।
“ কিছু কথা শুন যত ভদ্র মহোদয়।।
যে-মহৎ কার্য আজ বড় কর্ত্তা করে।
কোন ভাষা দিয়া ব্যাখ্যা করিব তাঁহারে।।
যত কাল এই দেশে করি ঘোরাঘুরি।
ইহ সম শ্রেষ্ঠ - আত্মা কারে নাহি হেরি।।
ইচ্ছা যদি করে ইনি আপন উন্নতি।
কেহ রোধিবারে নাহি পারে তাঁর গতি।।
অধিক কহিব কিবা এই মহাজন।
যদি খ্রীষ্ট-ধর্ম্ম ইনি করেন গ্রহণ।।
নিশ্চয় করিয়া আমি বলি সবাকারে।
ভারতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নর হ'তে পারে।।
কিন্তু এই কার্য আজি এ মহাত্মা করে।
তদোধিক শ্রেষ্ঠ বলি মানিনু ইহারে।।
পতিত স্বজাতি ছাড়ি কোন ধন মান।
ইচ্ছা নাহি করিয়াছে মহাত্মার প্রাণ।।
পতিত জনের তরে সকলি ছাড়িল।
নিশ্চয় বুঝিনু আজি পতিত তরিল।।
যে কথা বলেছি আজি সভাজন ঠাঁই।
সে কার্য করিব আমি কোন বাধা নাই।।
যেই জমি বড় কর্ত্তা করিলেন দান।
সেই জমি পরে মোরা উড়াব নিশান।।
মিশন গড়িব তথা করিব ইস্কুল।
করিব ডাক্তারখানা নাহি হবে ভুল।।
যেই ইচ্ছা বড় কর্ত্তা করিয়াছে মনে।
তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ মোরা করিব যতনে।।
অধিক কি কব আর যীশুর কৃপায়।
নমঃশূদ্র ধন্য হবে কহিনু নিশ্চয়।।
যেই জাতি নেতা রূপে গুরুচাঁদে পায়।
সে-জাতি উদ্ধার হবে কহিনু নিশ্চয়।। “
এতেক কহিয়া দেয় বহু ধন্যবাদ।
শ্রীকর মর্দ্দনে পুনঃ জানায় আহ্লাদ।।
সভা ভঙ্গ হল প্রভু করেন ঘোষণা।
সবে যায় পথে পথে করিয়া রটনা।।
“আর ভয় নাই মোরা উদ্ধার হইব।
বড় কর্ত্তা গুরুচাঁদে কভু না ছাড়িব।।
সাহেব করিবে স্কুল নাহিক সন্দেহ।
বাকি নাহি র'বে শিক্ষা পাইবার কেহ।।
হরি - পুত্র গুরুচাঁদ মোদের সহায়।
এ - জাতি উদ্ধার হবে নাহি আর ভয়।
বলা বলি করি সবে গৃহ পানে ধায়।
শুন এবে কিবা হ 'ল প্রভুর আলয়।।
ডক্টর মীডের সহিত প্রভুর ভাবালাপ ও ডক্টর মীডের চিন্তা
সভা অন্তে প্রভু কহে শ্রীশশীভূষণে।
“জল যোগ করাও মীডে অতিথি বিধানে।।
মীডে চাহি পুনঃ প্রভু বলিল বচন।
“শুন মীড শশী যাহা করে নিবেদন।।”
শশী বাবু প্রতি মীড চাহি তবে কয়।
“এই বুঝি আপনার প্রথম তনয়।।
ইহ সঙ্গে পূর্বে মোর আছে জানা শোনা।
শুন বড় কর্তা এক বিচিত্র ঘটনা।।
ভীষ্মবাবু যবে মোরে আসিবারে বলে।
ওড়াকান্দী আসি আমি কিছু কাল গেলে।।
খোঁজ করি ভীষ্মদেবে দেখা নাহি পাই।
মনো দুঃখে সেই কালে ফিরে যেতে চাই।।
বিল মধ্যে শশী বাবু আমাকে ধরিল।
নৌকা ফিরাইতে মোরে বিনয় করিল।।
আমি ভাবি এই ব্যক্তি নহে নমঃশূদ্র।
এর দেখি বেশভূষা সবখানে ভদ্র।।
নিশ্চয় কায়স্থ কিম্বা ব্রাহ্মণ সন্তান।
ছল করি মোরে বুঝি দেখায় সম্মান।।
তাহাতে প্রথমে আমি স্বীকৃত না হই।
মন বুঝিবারে তাঁরে বহু কথা কাই।।
অবশেষে মুখ দেখি সংশয় ঘুচিল।
তাই শশী বাবু মোরে ফিরায়ে আনিল।।”
এত বলি সেই মীড করে উচ্ছ হাস্য।
সকলে হাসিল শুনি মীড মুখে ভাষ্য।।
তবে’ত শীশরে চাহি মীড কহে হাসি।
“কিবা নিবেদন তব বল মোরে শশী।।
অতি বিনয়েতে তবে প্রভু-পুত্র কয়।
“জলযোগ দিতে তোমা বড় ইচ্ছা হয়।।
আমরা দরিদ্র অতি না জানি আচার।
তব দয়া আছে জানি এ-জাতির উপর।।
তাহাতে সাহসী হয়ে করি নিবেদন।
অল্প কিছু ফল মূল করুন গ্রহণ।।”
একথা শুনিয়া মীড পত্নী-প্রতি চায়।
দেখিয়া মিসেস মীড হাসি হাসি কয়।।
“কিছুই আপত্তি মোর নাহি জলযোগে।
এই বাড়ী কেন যেন নিজ বাড়ী লাগে।।
ইহার কারণ আমি বুঝিয়া না পাই।
মনে হয় শশী যেন মোর নিজ ভাই।।
এই বাড়ী জল খেতে নাহি যেন মানা।
আন শশী বাবু আমি নিষেধ করি না।।”
প্রভুর গদীর কাছে শ্বেত বস্ত্রে ঢাকা।
সুন্দর টেবিল এক হইয়াছে রাখা।।
তার দুই দিকে দুই চেয়ার পাতিয়া।
শ্বেতবস্ত্রে সে দু’খানি রেখেছে মুড়িয়া।।
শশীবাবু মীড-পত্নী পানে চাহি কয়।
দয়া করি ঐ আসনে এবে যেতে হয়।।
উঠিল ডক্টরমীড পত্নীর সহিতে।
বসিল চেয়ারে দোঁহে চাহি চারি ভিতে।।
আপন গদীতে বসে প্রভু গুরুচন্দ্র।
কিছু দূরে দাঁড়াইল যত ভক্তবৃন্দ।।
শ্রীশশী, সুধন্য মিলি ভাই দুইজন।
জলযোগ দ্রব্য যত করে আনয়ন।।
বিস্তৃত টেবিল পরে রাখে সমুদয়।
শুন সবে এক মনে দ্রব্য-পরিচয়।।
কর্পূর-বাসতি জল কাঁচের ঝারিতে।
কাঁচের গেলাস দুই রাখে দুই ভিতে।।
বৃহৎ চীনের মাটী নির্ম্মিত বাসন।
দোঁহার সম্মুখে রাখে করিয়া যতন।।
ক্ষুদ্রাকৃতি চীনামাটী প্রস্তুত বাসনে।
বহুভাগে ফলমূল রাখিল যতনে।।
সুপক্ক শবরী কলা থালা সহ আনি।
চীনের বাসনে রাখে শ্রীশশী আপনি।।
সুপক্ক আম কাটি রাখে বাসনেতে।
দুই ঠাঁই জাম কিছু রাখে দুই ভিতে।।
কমলা লেবুর শোভা বলিহারী যাই।
সুপক্ক দাড়িম্ব দুটী রাখে দুই ঠাঁই।।
মনোলোভা কিবা শোভা আঙ্গুর আসিল।
সুপক্ক কাঁঠাল-গন্ধে সে গৃহে ভরিল।।
বেদানা, আপেল এল, এল নাশপাতি।
অঙ্গশোভা আহা কিবা খেজুরের পাতি।।
রসে-ভরা আনারস আতাফল কত।
জামরুল কালোজাম লিচুর সহিত।।
কচি শশা, তরমুজ আরো পক্ক বেল।
বোম্বাই পেঁপে এল অতি বড় দেল।।
সপেটা কতগুলি পেয়ারা আসিল।
অসুবিধা মনে করি তাল নাহি দিল।।
চারি ঠাঁই চারি ডাব পেটে ভরা জল।
ইহা ছাড়া বঙ্গদেশে মেলে কোন ফল?
কাবুলী বাদাম এল আখরোট সহ।
পোস্তা এল খাস্তা হয়ে কত কব কহ।।
‘অসম্ভব’ বলি যদি কেহ ভাব মনে।
তার ভ্রান্তি দূর লাগি বলিব এখানে।।
ওড়াকান্দী পাড়াগাঁয়ে এ সব জিনিষ।
কে জানিত বল নাকি ফলের হদিশ।।
আমি বলি একবার ওড়াকান্দী যাও।
দেখে এসো ওড়াকান্দী কত ফল পাও।।
হরিচাঁদ-কল্পবৃক্ষে ফলে সর্ব্বফল।
কিসের অভাব বল তুচ্ছ-বৃক্ষ-ফল।।
ভকত রঞ্জন যিনি ভক্ত প্রাণ ধন।
তাঁর কিছু থাকে নাকি অভাব কখন।।
দিবারাত্রি ভারে ভারে বিশ্ববাসী নর।
ফল ফুল আনি দেয় প্রভুর গোচর।।
যেখানে যে ভাল দ্রব্যকোন ভক্ত পায়।
প্রভু লাগি প্রাণ দিয়া জোগাড় করয়।।
সেই হেতু বলিয়াছি অসম্ভব নয়।
গুরুচাঁদ-কল্পবৃ্ক্ষে সব মিলে যায়।।
কিবা সে ডক্টর মীড করিবে আহার।
শুদ্ধ হয়ে রহে দেখি ফলের বাহার।।
আনিল গরম জল ‘কেটলি’ করিয়া।
ডক্টর মীডের কাছে রাখিল ধরিয়া।।
চা আনে বিস্কুট আনে আনিল মাখন।
শ্রীঘ্রগতি কাজ করে ভাই দুইজন।।
ক্ষীর-নাড়ু ক্ষীর-সাজ বাসনে রাখিল।
চিনি রাখি দুই খান চামচ আনিল।।
কলিকাতা বাসকালে শ্রীশশীভূষণ।
এসব যোগাড় করি করে আনয়ন।।
রাখিল বিলাতী কেক স্বদেশী সন্দেশ।
মিশ্রীমাখা সরভাজ আয়োজন শেষ।।
সমস্ত দেখিয়া মীড মৃদুভাষে কয়।
“বড়কর্তা কেন কর অর্থ অপচয়।।
এত আয়োজন আমি কোথা দেখি নাই।
কত অর্থ ব্যয় হল মনে ভাবি তাই।।
আমরা ইংরেজ জাতি অল্পাহার করি।
অথচ এখানে খাদ্য আছে সারি সারি।।
অর্থ-অপচয় করে বাঙ্গালী সমাজ।
খাদ্য লাগি এত ব্যয় নহে ভাল কাজ।।
মীডের বচন শুনি প্রভু হাসি কয়।
আপনার অনুমান কিছু ঠিক নয়।।
অর্থ ব্যয় করি নাই এ সব সংগ্রহে।
এ সব আমার ঘরে মজুত ত রহে।।
আমার পিতা গুণে এই পরিচয়।
এ সব পাইতে মোর নাহি অর্থব্যয়।।
এই যে ভকত সব আছে দাঁড়াইয়া।
এরা সবে দেয় মোর পিতারে স্মরিয়া।।
অঙ্গুলি নির্দ্দেশে প্রভু ভক্ত দেখাইল।
স্থির-নেত্রে একদৃষ্টে মীড চেয়ে রল।।
সবার কাঙ্গাল বেশ এক বস্ত্রধারী।
অথচ নহেত কেহ কড়ার ভিখারী।।
তেজদীপ্ত অঙ্গ হতে জ্যোতিঃ বাহিরায়।
মেষ-শিশু-সম যেন চাহে নিরুপায়।।
দীর্ঘ কেশ দীর্ঘ শ্মশ্রু বলিষ্ঠ গঠন।
হীন বলে তার মধ্যে নহে কোন জন।।
ভক্তগণে দেখি মীড লাগে চমৎকার।
পত্নীকে ডাকিয়া বলে “দেখ একবার।।”
চাহিল মিসেস মীড মতুয়ার পানে।
আশ্চর্য্য মানিয়া তেঁহ ভাবে মনে মনে।।
সভাকালে লক্ষ্য নাহি করিয়াছি কিছু।
নিশ্চয় সকলে তবে বসেছিল পিছু।।
প্রথমে দেখিলে মনে না জাগে সম্ভ্রম।
কিছু পরে সেইভাবে জাগে ব্যতিক্রম।।
জ্বলন্ত-অনল যেন ভষ্ম-মাঝে-ঢাকা।
মূল-বৃক্ষ গুরুচাঁদ এরা সবে শাখা।।
ক্ষণেক দেখিয়া মেম দৃষ্টি ফিরাইল।
পত্নীরে সম্বোধি মীড কহিতে লাগিল।।
“দেখ প্রিয়া এই সব ভকত সকল।
রাগাত্মিকা ভক্তিরসে করে টলমল।।
সকলে দীনের বেশে আছে দাঁড়াইয়া।
কি যেন ইহারা সবে পেয়েছে আসিয়া।।
ইহাদের দরশনে মনে এই হয়।
ইহাদের বাসভূমি ধরাধামে নয়।।
মেষ-শিশু-সম যেন কত অহসায়।
কিন্তু বক্ষমাঝে যেন অগ্নিরাশি রয়।।
যে-শক্তি এদের বুকে এই তেজ দিল।
তার তুল্য শক্তি প্রেয়া কোথা আছে বল?
দিনে দিনে কি আশ্চর্য্য দেখি এই দেশে।
আমার হৃদয় মুগ্ধ হইল নিমেষে।।
মনে বলে পরে পরে আর কি দেখিব।
পেয়েছি মনের মানুষ এই দেশে রব।।
এইভাবে আলাপনে বেলা শেষ হল।
জলপার করি মীড বিদায় হইল।।
অতঃপর ভক্ত সঙ্গে প্রভুর আলাপ।
প্রেমানন্দে করে সবে প্রেমের বিলাপ।।
সন্ধ্যা আগমনে সবে করে সংকীর্ত্তন।
মহারোল উঠি যেন ভেদিল গগন।।
আপন তাঁবুতে বসি মীড শুনি তাই।
সবে বলে “শুন শুন হেন শুনি নাই।।
উতরোল কলরোল করিছে কাহারা?
শঙ্খ শিঙ্গা বাজে শাঁখ বাজিছে টিকারা।।
মনে হয় এই শব্দ নহে বেশীদূর।
শব্দে যেন আকাশ-বাতাস-ভরপুর।।
চাকরের কাছে মীড জিজ্ঞাসে তখন।
“বল দেখি এই শব্দ কিসের কারণ?”
সাহেবের খানসামা সেই দেশে বাস।
সব-মর্ম্ম-জানা তার সে করে প্রকাশ।।
“হুজুরের গোচরার্থে নিবেদন করি।
মতুয়ারা উচ্চশব্দে বলিতেছে হরি।।
সাহেব বলিছে “বল মতুয়া কাহারা?
ভৃত্য বলে “হরিচান্দের ভক্ত যাহারা।।
ঠাকুরের বাড়ী যারা দাঁড়িইয়া ছিল।
দীর্ঘ কেশ দীনবেশ আঁখি ছল ছল।।”
সাহেব বলিছে “কেন মতুয়া উপাধি।
ভক্ত কেন নাহি বল ভক্ত ওরা যদি?”
ভৃত্য বলে “শুনিয়াছি এই পরিচয়।
হরিনামে তারা সবে মাতোয়ারা হয়।।
জ্ঞান শূণ্য হরিনামে করয় কীর্তন।
মাতোয়ারা তাই “মতো বলে সর্ব্বজন।।।”
সাহেব ভাবিয়া বলে “বুঝিনু সকল।
এইখানে নমঃশূদ্র পায় সর্ব্ববল।।
ঈশ্বরের প্রতি নিষ্ঠা মত্ত সেই নামে।
তাই শক্তিশালী এরা এই ধরা ধামে।।
এরা যারে মানে সেই কেমন পুরুষ।
নিশ্চয় সেজন নহে সামান্য মানুষ।।”
মতুয়া দেখিয়া মীড চিন্তিত হইল।
কবি কহে চিন্তা ছাড়ি হরি হরি বল।।
কর্ম তরঙ্গে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ
প্রস্তাবনা
হরিতে ধর্মের গ্লানি রক্ষিতে সাধক প্রানী
নিজ গুণে গুণমণি আসে।
নাশিতে দুষ্টের শক্তি নিয়ে বিভু-প্রেম-ভক্তি
নরাকারে ধরাধামে আসে।।
আদরিণী কন্যা ধরা যুগে যুগে আছে ধরা
প্রেমময় পিতা তারে রাখে।
অঙ্গে যবে মাখি ধূলা শোকে দুঃখে শোকাকুলা
‘আয়! কোলে আয়’ বলি ডাকে।।
আপন কোমল করে ধূলা মাটি দূর করে
অমল-ধবল করে অঙ্গ।
ধরা হাসে খল খল মুছে ফেলে আঁখিজল
দেখি খুশী হয় কি সে-ত্রিভঙ্গ।।
কিছু কাল পরে হায় ধরা সব ভূলে যায়
পুনরায় ধূলি পড়ে লুটে।
সারা গায় মাখি ধূলা কাঁদে বসি সারা বেলা
ক্ষমা ভিক্ষা করে করপুটে।।
আহা কিবা দয়াময় গলে’ যায় সে কান্নায়
পুনঃ বুকে টানি লয় তারে।
বলে ‘শুন ধরা রাণী! করনা এমন খানি
তোরে ধু’বে কেবা বারে বারে?
বারে বারে ধূলা মাখে ধূলা মেখে তারে ডাকে
বারে বারে সে ধুলা ধোয়ায়।
যুগে যুগে অভিনব কত হল এই ভাব
ভাবে ভাব অভাবনা হয়।।
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা সবগুলি শিশু তারা
সব তার হাতের পুতুল।
সে যেন বসি একেলা আনমনে করে খেলা
খেলা তার আজানা অতুল।।
শিশু-সম সে বিরাট মেলিয়া সৃষ্টির নাট
দণ্ডে দণ্ডে কত গড়ে ভাঙ্গে।
কোথা উঠে হাসি রোল দুঃখ কোথা উতরোল
বাঁধা নাহি কিছু তার সঙ্গে।।
আপনি সে ইচ্ছা ময় সৃষ্টি করে স্ব-ইচ্ছায়
ইচ্ছা ভিন্ন নাহিক বিকার।
ভাঙ্গা-গড়া কাজ তার নাহি ধারে কারো ধার
অচিন্ত অমোঘ শক্তি তার।।
ইচ্ছা বহে’ শক্তি তাঁর তাই নামে ‘অবতার’
বাহ্য-দৃশ্যে আকারেতে ভিন্ন।
এ যেন সমুদ্র সাথে যোগ রাখি কোন মতে
ক্ষুদ্র কায় কূপ থাকে পূর্ণ।।
আকারে দেখিতে কূপ, অন্তহীন সিন্ধু-রূপ
প্রতি জল বিন্দু মাঝে আছে।
আকারে বিকার দেখি, মোরা কূপ বলে ডাকি
পরিপূর্ণ সিন্ধু তারি পাছে।
যিনি পূর্ণ তাঁর খণ্ড, খণ্ড আদি-মান-দণ্ড
খণ্ড খণ্ড জুড়ি’পূর্ণ হয়।
খণ্ডে-পূর্ণে নাহি ভেদ, আমরা করি বিভেদ
গণ্ডী রেখা ছায়া-বাজী প্রায়।।
সীমা দিয়ে দৃষ্টি ঘেরা, তাই নাহি দেখি মোরা
এক হয়ে আছে ‘পূর্ণ জুড়ি।
সীমানা ভাঙ্গিয়া যায়, তাহাতে প্রকাশ হয়
খণ্ড পূর্ণ দোহে জড়াজড়ি।।
ধরার বেদনা দেখি, আপনি কমলা আখি
খণ্ডে শক্তি দিয়া ব্যথা নাশে।
স্থুল-দৃষ্টি ধরা কয়, “এই মোর দয়াময়
অন্তরালে বসি প্রভু হাসে।।
শক্তি রূপে বার-বার, প্রভু হয় অবতার
শ্রেষ্ঠাকার নরাকার ধরে।
ধরার জনম খণ্ডে, ইতিহাস এ ব্রহ্মাণ্ডে
মীন কুৰ্মরূপে লীলা করে।।
সৃষ্টি অগ্রসর হয়, নর রূপ শ্রেষ্ঠ কয়
জীব-মধ্যে তারে শ্রেষ্ঠ কৈল।
চেতনাচেতন-তত্ত্ব, কিবা সত্য পরমার্থ
নর-মধ্যে জ্ঞান-শক্তি হৈল।
ঈশ শক্তি সুবিকাশ, মানবে হল প্রকাশ
অন্য জীবে হল না প্রকাশ।
নরে তাই ধরা পরে, দণ্ড শক্তি হাতে ধরে
নৃপ সাজি করিতেছে বাস।
নর মনে করে যুক্তি, অজানা অচেনা শক্তি
চরাচর শাসে রাজ দণ্ডে।
কিছু অংশ মোরা পাই, তাতে মনে করি ভাই
ঈশ শক্তি আছে এই ভাণ্ডে।।
ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে, তাই প্রকৃতি উপরে
সহজাত অধিকার আছে।
নরাকারে পূর্ণ তিনি, সৰ্ব্বব্যাপী ব্যপ্ত যিনি
নর-মধ্যে শক্তি প্রকাশিছে।।
প্রত্যক্ষ তাঁহার রূপ নর-রূপ বিশ্বভূপ
তার মাঝে রহি দেয় সাড়া।
নর আর ভগবানে,ভেদ নাহি কোন খানে
নিজ রূপ নিজ-হাতে-গড়া।।
সেই শক্তি ইচ্ছাময়, করে যাহা ইচ্ছা হয়
আধারের না করে অপেক্ষা।
নশ্বরে সৃজিত দেহ, কোন দিনে কভু কেহ
শক্তি ছাড়ি নাহি করে ভিক্ষা।।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, শেষাবধি আদি হতে
নরাকারে এল হরিচাঁদ।
দেহ যবে হ’ল লয়, আপনি সে ইচ্ছাময়
পূর্ণ শক্তি রূপে গুরুচাঁদ।।
হরি চাঁদ-রূপ দেখে, দলিত পতিত বা কে ?
কিবা হেতু পতিত সংসারে?
দেখে ব্যভিচারে ভ্রষ্ট, যারা নাহি চিনে ইষ্ট
তেহ সবে অন্ধকারে মরে।।
মূল ভিত্তি সদাচার, পবিত্র চরিত্রটার
মুক্তি-মন্ত্র তেঁহ সবে দিল।
‘সং’সাজি সংসারে বদ্ধ, ধৰ্ম পথ সদা রুদ্ধ
সংসারের মায়া দূরে কৈল।।
সংসারে নাহিরে কিছু, সবে আয় মোর পিছু
কাঙ্গালের বেশে হরি কয়।
চিত্তভূমি সিক্ত কৈল, বপনের কাল হৈল
প্রেম-নীরে সবে ডুবে যায়।
এক দৃষ্টি এক ধ্যান, ভক্তি, পবিত্রতা, জ্ঞান
মলিনতা নাশে স্থিতি হৈল।
ক্ষেত্ৰ দেখি সুপ্রস্তুত, প্রভু যশোবন্ত সুত
রূপ ছাড়িবারে ইচ্ছা কৈল।।
আদিতে আবাদ করি, কর্ষণ করিল হরি
মুক্তি-বীজ আনে তার পরে।
কর্ষকের রূপ ছাড়ি, সাজিলা বপন-কারী
এক রূপে দুই নাহি করে।।
তাই রূপ অন্ত করি, গুরুচাঁদ রূপ-ধারী
হরি-গুরু পূৰ্ণচন্দ্র হৈল।
হরি যে-সংসার ছাড়ে, গুরুচাঁদ তাই ধরে
জগজীবে মহামুক্তি দিল।।
স্বভাব প্রবল বড়, কহি তাহা অতঃপর
হরিচাঁদ রূপ যবে ঢাকে।
গুরুচাঁদ মধ্যে পশি, ভাবে বসে দিবানিশি
আন মনে চুপ করি থাকে।।
মহাদেবী সত্যভামা, গুণে যাঁর নাই সীমা
তেহ ঠাই প্রভু বলে খেদে।
‘শুন প্রিয়া মোর কথা, মনে পাই বড় ব্যথা
সংসার রাখিল মোরে বেঁধে।।
আমি ইচ্ছা নাহি করি, করিতে ‘সংসার-গিরি,
মোর মনে সদা এই ভয়।
ছাড়িয়া বিষয়-কাণ্ড, রাত্রি কিংবা দিন দণ্ড
প্রেমানন্দে দিন কেটে যায়।।
অনিত্য যাহার নাম, এই যে সংসার ধাম
তার লাগি কেন ঘুরি মিছে।
আমি ভোলা ভোলনাথ, নাহি করি দৃষ্টিপাত
সংসারে পড়িয়া থাকি পিছে।।
কি কাণ্ড করিলা হরি, বিষম লজ্জায় মরি
ভোলানাথ ভুলইয়া আনি।
সংসার-পাষাণ গলে, বাঁধিয়া ফেলিল জলে
তীরে নিতে হবে তারে টানি।।
উপায় নাহিক দেখি, কি জানি কমল আঁখি
কারে দিয়া কোন কার্য করে।
আমার বলিতে যাহা, সকলি হরেছে তাহা
মোর বলে নাহি কিছুঘরে।।
আমার এমন-যেই, তারে কেন দূরে দেই
মিছে মিছে সাজিয়া সংসারী।
সদা বলি হরি হরি, হরি পারের- কাণ্ডারী
হরি বলে বাহি নিজ-তরি।।
অন্য কোন ভাব নিয়া, না থাকিব শুন প্রিয়া
তার ভাবে মত্ত সদা রব।
যে-ইচ্ছা তাহার হয়, তাই হোক নাহি ভয়
ডুবি যদি তাহাতে ডুবিব।।
সংসারের যে-বাসনা শুন বলি শবাসনা
হীরা, মণি, সোনা, দানা, ছাই।
পাগলা ভোলার পক্ষে, এ কোন ছার পরীক্ষে
ভুল-ছাড়া ভোলানাথে নাই।।
করিনু সংসার ত্যাগ, হরি নাম-মহাযাগ
অনুরাগে রাগ দিয়ে বলি।
যাহা ইচ্ছা কর তুমি, ভোলানাথ যার স্বামী
তারে আমি বলি তুই ম’লি।।”
শুনিয়া স্বামীর কথা, সত্যভামা জগন্মাতা
কিছুমাত্র কথা না কহিল।
মৌন রহে হরজায়া, ভোলা আনন্দিত হৈয়া
নিজ ভাবে ডুবিয়া রহিল।।
কিছুদিন গত হয়, গভীর নিশীতে তায়
গৃহ ছাড়ি প্রভু যবে চলে।
বৃহৎ রসাল বৃক্ষ, পত্র যাহে লক্ষ লক্ষ
নিত্য রাত্রি বসে তার তলে।।
প্রভুরে চাহিয়া দেবী, নিখুঁত পবিত্র-ছবি
মুরজ-মুরলী স্ববে কহে।
‘শুন প্রভু দয়াময়, কোথা যাও এ সময়
গৃহ-ছাড়ি চলা ঠিক নহে।।
কিছুদিন পূৰ্ব্বে তুমি, পরাণ বান্ধব স্বামী
যে বাৰ্ত্তা বলে’ছ মোর কাছে।
তার কিছু সদুত্তর, করি নাই তথা’পর
সব কথা মোর মনে আছে।।
তোমার স্বভাব জানি, গুণাতীত গুণমণি
নিগুণ বিষয়ে মত্ত নহ।
তবে কেন ভোলানাথ, আসিলে প্রভুর সাথ
সেই কথা মোর কাছে কহ।।
তুমি জান আমি জানি, কেন হরি-রত্ব-খনি
দোঁহাকারে আনিল ধরায়।
জীব দুঃখী দেখে ভারী, পরম দয়াল হরি
জগজ্জীবে উদ্ধারিতে চায়।।
পূৰ্ব্বে পূৰ্ব্বে যে যে এল, জীবে মন্ত্র যাহা দিল
অপূর্ণ কারণে তাহ ব্যর্থ।
জীব সাজি জীব-দায়, হরিচাঁদ এ ধরায়
জগজীবে দিল পরমার্থ।।
সংসারে জড়িত রহে, তাহা হতে দূরে নহে
জগতের যত নরকুল।
যা’ ধরি বাঁচিয়া রয়, ‘ধৰ্ম বলি তারে কয়
এই ব্যাখ্যা কভু নহে ভুল।।
সংসার ধরিয়া রয়, নরনারী জীবচয়
ধৰ্ম ভিত্তি পরে যদি তাহা।
কখনে সাজা’তে পার, বিনয়েতে বলি হর
সৃষ্টি কত শুদ্ধ হবে আহা!
আদর্শ সংসারী সাজি, এস মোরা দোহে আজি
হরি স্মরি করি তার কাজ।
পিতার বচন ফেলে, পুত্র যদি অবহেলে
কত দুঃখ পাবে হরি-রাজ।।
আপনা সারিবে যারা, সন্ন্যাসী সাজুক তারা
সেই পাঠ তুমি কর দূর।
সংসারী সাজিয়া থাক, প্রভুর বচন রাখ
কর তুমি যে-আজ্ঞা প্রভুর।।
এই দেখ তব ঘরে, পুত্র রূপে জন্ম ধরে
আসিয়াছে তনয় তনয়া।
আদর্শ নাহি দেখা’লে, এই সব মেয়ে ছেলে
কিসে পাবে ধৰ্ম-বৃক্ষ-ছায়া।।
আমার বচন ধর, নাশ চিত্ত অন্ধকার
সংসারী সাজিয়া কর কর্ম্ম।
শুন প্রভু নিবেদন, নাহি কর অন্য মন
রাখ প্রভু রাখ পিতৃধর্ম্ম।।
দেবী যদি এই কয়, প্রভু দাঁড়াইয়া রয়
ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে রৈল।
উজ্জ্বল আলোক রাশি, গুরুচাঁদ মধ্যে পশি’
গৃহ খানি আলময় কৈল।।
প্রভু কহে হাসি হাসি, নাশিয়া আঁধার রাশি
শরতের চন্দ্র যেন হাসে।
“ শুন দেবী যাহা কই, তব উপদেশ লই
ফিরিলাম পুনঃ গৃহবাসে।।
তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক, তাঁর বাক্য সত্য রো’ক
তাঁরে ভাবি হইনু স্বীকার।
সংসারী সাজিয়া তবে, রহিলাম এই ভবে
আর মনে নাহিক বিকার।।
শুনি পতির ভারতী, জগন্মাতা মহাসতী
প্রভু প্রতি বিনয় করিল।
ঘর ছাড়া ভোলানাথ, আসিয়া হরির সাথ
হরি আজ্ঞা মতে গৃহী হৈল।।
আসিল শ্ৰীগুরুচন্দ্ৰ, জীবে দিতে মুক্তি মন্ত্র
পদ স্পর্শে ধরা ধন্যা হল।
মহানন্দ দীন হীন, কাটেনা জন্মের ঋণ
কাঁদে ভেবে দিন চলে গেল।।
ডক্টর মীডের সন্দেহ
উনিশ শ’ পাঁচ সালে বঙ্গ ভঙ্গ হয়।
পর বর্ষে ওড়াকান্দী মীডের উদয়।।
প্রভু গুরুচাঁদ আগে প্রতিজ্ঞা করিল।
প্রতিজ্ঞা জানিয়া প্ৰভু জমিদান দিল।।
জমি পেয়ে মীড মনে পাইল আনন্দ।
তাহা করে যাহা বলে প্রভু গুরুচন্দ্র।।
প্রভুর গৃহেতে মীড সদা আসে যায়।
মন খুলে উভে মিলি কত কথা কয়।।
যত মীড আসে কাছে ততই বিস্ময়।
কোনজন গুরুচাঁদ বুঝিয়া না পায়।।
কভু ভাবে জ্ঞানবান পুরুষ বিশেষ।
পুনঃ দেখে জ্ঞানে তার নাহি কোন শেষ।।
এইভাবে দিন যায় যায় না সন্দেহ।
মীড কাজ করে মনে বড় উৎসাহ।।
একদা প্রভুর ঠাই মীড বসিয়াছে।
আসিতেছে ভক্তগণ মীড দেখিতেছে।।
মনে মনে ভাবে মীড কিবা গুণে এরা।
গুরুচাঁদে বলে “ইনি জগতের সেরা।”
অন্তর্যামী গুরুচাঁদ জানিয়া অন্তরে।
মীড প্রতি চাহি তবে এই উক্তি করে।।
“শুনহে ডক্টর মীড আমার বচন।
তোমাদের দেশে কত আশ্চর্য ঘটন।।
বিজ্ঞানের বলে জানি তোমাদের জাতি।
আশ্চর্য ঘটনা করে সবে দিবারাতি।।
টেলিগ্রাফ করিয়াছে আর টেলিফোন।
শত ক্রোশ দূরে করে কথোপকথন।।
আর নাকি আবিস্কার করেছে সম্প্রতি।
বিনা-তারে কথা কয় জেলে এক-বাতি।।
আর আর অত্যাশ্চর্য কতই ঘটনা।
তোমাদের জাতি করে করিয়া সাধনা।।
সব পারে বটে তারা কিন্তু বলি তবু।
মরা-দেহে প্রাণ দিতে পারে নাই কভু।।
আর বলি শুন মোরা ভারতের বাসী।
যন্ত্র পাতি নাহি বটে নহি সে প্রত্যাশী।।
(* রেডিও)
মোরা জানি এই ভাণ্ডে সৰ্ব্ব শক্তি রয়।
জাগা’তে পারিলে তারে সব জানা যায়।।
যন্ত্ৰযোগে যেই কথা বলিছ তোমরা।
নিজ-হৃদি-মধ্যে তাহা পাই যে আমরা।।
তাহার প্রমাণ আছে শাস্ত্রে পুরাণেতে।
কত ঠাঁই কত জনে জানে এই মতে।
একটি প্রাচীন কথা বলি তব ঠাঁই।
কোন গুণে মোরা তাহা জানিবারে পাই।।
নিচল পুরেতে জান এই বঙ্গ দেশে।
দরিদ্রের ঘরে জন্ম দুই কন্যা এসে।।
জ্যেষ্ঠা কন্যা গুণে ধন্যা ধৰ্ম পথে মন।
সন্ন্যাসিনী ভাবে করে জীবন যাপন।।
কনিষ্ঠা সরলা অতি বুঝে না সন্ন্যাস।
গৃহ ধৰ্ম্মে মন তার গৃহে করে বাস।।
কিছু কাল পরে দেখ বিধির ঘটনা।
জ্যেষ্ঠা উদাসিনী হ’ল করিতে সাধনা।।
কনিষ্ঠারে পিতামাতা বিবাহ করা’ল।
পতি সনে সতীরাণী পতিগৃহে গেল।।
কঠোর সাধনা করে সে জ্যেষ্ঠা ভগিনী।
দিনে দিনে শক্তি লাভ করিলা আপনি।।
হেন শক্তি লাভ হ’ল করিলে মনন।
অভিশাপে নিতে পারে জীবের জীবন।।
কনিষ্ঠা ভগিনী কিন্তু হেথা গৃহবাসে।
অন্য সাধনাদি কিছু মনে নাহি আসে।।
“পতি-প্রীতি-কাম” যাহা তাহাই সাধন।
এক মনে করে সতী পতির পূজন।।
পতির শান্তির লাগি সব বিসর্জ্জন।
দিতে পারে সতী যদি কভু করে মন।।
পতি তাঁর নিৰ্ব্বিকারে কৃষি কৰ্ম করে।
অফলা জমিতে ফলে সতী যার ঘরে।।
পতির মনন সতী জানিবারে পারে।
সতীর চিন্তন পতি রাখে প্রাণে ধরে।।
শন্তির কুটিরে দোঁহে শান্ত হ’য়ে রয়।
পাপ তাপ দোঁহে দেখি দূরে সরে যায়।।
হেনকালে একদিন সে-জ্যেষ্ঠা ভগিনী।
কনিষ্ঠারে দেখিবারে ইচিছলা আপনি।।
মনে মনে এই ভাব দেখা’বে তাহারে।
কত দুঃখে আছে ভগ্নী থাকিয়া সংসারে।।
বিষম সংসার তাহে অসীম যন্ত্রণা।
সন্ন্যাসিনী-জীব-ধন্যা, মিলেনা তুলনা।।
এত ভাবি সন্ন্যাসিনী বনস্থলী ছাড়ি।
ভগিনীর গৃহ পানে চলে তাড়া তাড়ি।।
হস্তেতে ত্রিশূল তার রদ্ৰাক্ষ গলায়।
মুক্তকেশী রুক্ষ দৃষ্টি দেখে লাগে ভয়।।
খর পদে ক্ষিন্ন-নারী ক্ষিপ্ৰ গতি চলে।
পথ ধরি চলি যায় কথা নাহি বলে।।
হেন কালে দুষ্ট বুদ্ধি কাক এক জন।
করিল পুরীষ ত্যাগ থাকি উড্ডয়ন।
মলত্যাগ করি কাক উড়ে যেতে চায়।
পড়িল কাকের বিষ্টা নারীর মাথায়।।
আঁখি ঘুরাইয়া নারী শূন্য পানে চায়।
দেখে কাক দিয়ে ডাক দূরে সরে যায়।,
ক্রোধে রক্তচক্ষু নারী দিল অভিশাপ।
“আরে দুৰ্ব্বদ্ধি তোর এত বড় দাপ।।
অকারণে মোর মুণ্ডে মলত্যাগ কৈলি।
দিনু অভিশাপ তুই মুণ্ড শূন্য হৈলি।।”
বলা মাত্র মুণ্ড খসি কাক পড়ে গেল।
‘যথা কৰ্ম যথা ফল’ সে নারী কহিল।।
এ দিকে আপন গৃহে কনিষ্ঠা ভগিনী।
“হায়, হায়” করি দেবী উঠিলা আমনি।।
পুনরায় পথে ধায় সেই সন্ন্যাসিনী।
ক্রোধেতে পূর্ণিত মন কঠিন চাহনি।।
কিছু দূর গেলে পুনঃ ঘটিল ঘটনা।
এক দৃষ্টে বক করে মাছের সাধনা।।
ক্ষণ পরে সেই নারী সেই পথে যায়।
শব্দ শুনি বক ফিরি তার পানে চায়।।
প্রাণ ভয়ে বক যবে আকাশে উড়িল।
পাখসাট বায়ু তার মস্তকে লাগিল।।
কাকের আচারে ক্ষুব্ধ ছিল তার মন।
বকের ব্যাভারে হ’ল দ্বিগুণ এখন।।
সন্ন্যাসিনী বলে “বক করহে অপেক্ষা।
এই দণ্ডে দিব তোরে সমুচিত শিক্ষা।।
মোরে অবহেলা করি উড়িবারে চাও।
এই দণ্ডে ওরে মূর্খ! ভষ্ম হয়ে যাও।।”
দুরন্ত বালক যদি অস্ত্র হাতে পায়।
ভাল মন্দ দ্রব্য কত কেটে করে ক্ষয়।।
যাবৎ সু-ধার অস্ত্র তার হাতে থাকে।
তাবৎ অনিষ্ট করে চক্ষের পলকে।।
বলবান কেহ যবে অস্ত্র কাড়ি লয়।
দুরন্ত দুর্ব্বল সাজে কথা নাহি কয়।।
সেই নারী সে প্রকার সাধনা-প্রভাবে।
কিছু শক্তি লাভ করি মরিল গৌরবে।।
ক্ৰোধ-বাণে শক্তি তার ক্রমে হল ক্ষয়।
অভিশাপে বক হেথা পড়িল ধরায়।।
হেথা সতী নিজ গৃহে বসিয়া দেখিল।
দিদির কোপেতে তার বক মৃত হ’ল।।
“এতই কঠিন প্রাণ দিদি গো তোমার’।
বলে দেবী পুনঃরায় করে হাহাকার।।
উদ্দেশ্যে দিদির প্রতি বলিছে বচন।
“ধৰ্মনীতি দিদি তুমি না জান কখন।।
“দয়া বিনা ধৰ্ম নাই” মহাজন বাক্য।
তব প্রাণে তাহা কভু নাহি হ’ল ঐক্য।।
মহারাজ যুধিষ্ঠির ধৰ্ম অবতার।
যে বাক্য কহিল তেঁহ দ্রৌপদী গোচর।।
ক্রোধে পাপ ক্রোধে তাপ ক্রোধে কুলক্ষয়।
ক্রোধে বুদ্ধিভ্রংশ ইথে নাহিক সংশয়।।
ক্রোধ রিপু বসে দিদি যে কাজ করিলে।
স্বখাত-সলিলে তুমি ডুবিয়া মরিলে।।
“ক্রোধস্তু সাশ্রয়দ্রোহী তং শ্রেয়োহসী পরিত্যজেৎ”
—বৃহদ্ধৰ্মপুরাণম্
এতকাল সাধনাতে পেয়েছিলে যাহা।
‘কাগাবগা’ খুন করে শেষ হল তাহা।।”
এতেক বলিয়া দেবী নীরব হইল।
আরোপেতে স্বামী-ধ্যানে ডুবিয়া রহিল।।
দেখে দেবী আরোপেতে স্বামী কৰ্মরত।
গাত্রে তার ঘৰ্মরাশি ঝরে অবিরত।।
দারুণ নিদাঘ - তাপে তাপিত শরীর।
শুষ্ক - কণ্ঠ পিপাসায় বড়ই অস্থির।।
এহেন দেখিয়া দেবী ব্যথা পায় প্রাণে।
প্রাণে প্রাণে স্বামী-ধনে গৃহ পানে টানে।।
সতীর চিন্তনে পতি থাকিতে না পারে।
কৰ্ম ছাড়ি গৃহ পানে চলে ধীরে ধীরে।।
ক্ষণ পরে গৃহ দ্বারে উপনীত হ’ল।
দেখে পত্নী দাঁড়াইয়া আঁখি ছল ছল।।
সযত্নে পতিরে দেবী বসা’ল আসনে।
পদ ধৌত করিবারে শুদ্ধ-বারি আনে।।
যতনে পতির পদ সে-জলে ধোয়ায়।
আপন অঞ্চলে পদ যতনে মুছায়।।
তালপত্র-পাখা আনে করিতে ব্যজন।
হেন কালে দিদি তার করে আগমন।।
বহিৰ্দ্ধারে থাকি দিদি সংবাদ পাঠায়।
নিজ আগমন বার্ত্তা প্রকারে জানায়।।
মনে ভাবে ভগ্নী আসি স্বামী সমিভ্যারে।
অবশ্য লইবে তারে সমাদর করে।।
নিজ শক্তি দেখাইয়া লাগাবে চমক।
ঠিক যেন যাদুকরে ভুলায় বালক।।
কল্পনা করিয়া তেহ হাসে মনে মন।
মনে ভাবে ‘আমি ভবে শ্রেষ্ঠ এক জন’।।
কঠোর সাধনা বলে লভেছি শকতি।।
বিশ্ববাসী সবে মোরে করিবে ভকতি।।
এ সব চিন্তায় তার পুলকিত অঙ্গ।
মুহুৰ্ত্তে সকল ভাব হল তার ভঙ্গ।।
যে জন সংবাদ লয়ে গৃহ মধ্যে যায়।
সেই ফিরি আসি তবে বলিছে তাহায়।।
“শোন সন্ন্যাসিনী! তুমি আমার বচন।
তোমার সংবাদ আমি বলেছি এখন।।
তব ভগ্নী শুনিয়াছে তব আগমন।
কিন্তু অন্য কার্যে তিনি নিযুক্ত এখন।।
স্বামীর সেবাতে তেঁহ আছে তাঁর পাশে।
জুড়াতে স্বামীর অঙ্গ পাখার বাতাসে।।
তব কাছে আসিবারে সম্ভব না হবে।
আপনি চলুন সেথা আত্মীয়তা-ভাবে।।
নিজ মুখে ভগ্নী তব এ সব কহিল।
তোমাকে লইতে সাথে আমাকে পাঠা’ল।।
কথা শুনি সন্ন্যাসিনী ক্রোধে হতবাক।
মনে ভাবে ‘বোন’ হ’য়ে এতই দেমাক্”।।
আপন ভগিনী তাই এবে দিনু ক্ষমা।
দেখা যাক কোথা তার অহঙ্কারে সীমা।।
এক দুই তিন বারে ক্ষমিব তাহারে।
পুনঃ দোষ পেলে রক্ষা নাহিক সংসারে।।
এত ভাবি ক্ষুদ্ধ মনে গৃহ মধ্যে যায়।
কিন্তু সন্ন্যাসিনী মনে মানিল বিস্ময়।।
যেইমাত্র প্রাঙ্গণেতে পদ পড়ে তার।
প্রাণ যেন শূন্য হয়ে করে হাহাকার।।
কি যেন পরম ধন হারাইয়া গেল।
কি যেন হারায়ে প্রাণ চঞ্চল হইল।।
ইতি উতি করি ক্রমে গৃহ পানে যায়।
দেখে ভগ্নী মগ্ন আছে স্বামীর সেবায়।।
অকস্মাৎ ক্রোধ তার জুলিয়া উঠিল।
ডাক দিয়া ভগিনীরে কহিতে লাগিল।।
ওরে ছন্নমতি। তুই কি মোহে মাতিয়া?
আমাকে অবজ্ঞা করি আছিস বসিয়া?
কি আর বলিব তোরে শুধু নিজ-ভগ্নী।
তাই কষ্টে রাখি চেপে মোর ক্রোধ-অগ্নি।।
যদ্যপি অপর কেহ করিত এমন।”
এই কথা বলা মাত্র কি হ’ল তখন।।
হস্ত তুলি ভগ্নী তারে নিষেধ করিল।
স্তব্ধ হ’য়ে সন্ন্যাসিনী চাহিয়া রহিল।।
কে যেন জিহবার শক্তি করিল হরণ।
কোন কথা করিবারে নারে উচ্চারণ।।
বিস্ময়ে চাহিয়া রহে ভগিনীর দিকে।
স্বর্গ জ্যোতিঃ ফুটে যেন ভগিনীর মুখে।।
তবে সেই দেবী-ভগ্নী হাসি হাসি কয়।
“অকারণে রোষ দিদি করোনা আমায়।।
ক্রোধে যদি অগ্নি বল অগ্নির কি গুণ ?
দগ্ধ কার্যে অগ্নি দেখ বড়ই নিপুণ।।
নিজ’ পর বলি অগ্নি চিনে না কাহারে।
যারে পায় তারে খায় নিত্য নির্ব্বিকারে।।
আর দেখ ছাই রাখে আগুনে চাপিয়া।
কিন্তু অগ্নি নাহি থাকে চুপটি করিয়া।।
ধীরে ধীরে ভষ্মরাশি ভেদ করি উঠে।
ভষ্মে খেয়ে অগ্নি পরে চারিদিকে ছুটে।।
যে-জন আগুনে চাপে অগ্নি তারে খায়।
তাই বলি “দিদি! অগ্নি-চাপা ভাল নয়।।
আপন ভগিনী বলি করিয়াছ ক্ষমা।
কিন্তু নিজে কত পাপ করিয়াছ জমা।।
কি ভয় দেখাও দিদি ছোট ভগিনীরে।
আমি নই ‘কাগা’ ‘বগা’ বিলের ভিতরে।।
মুণ্ড কাট ভষ্ম কর আপন গৌরবে।
মনে বলে তব শাস্তি অনন্ত রৌরবে।।
তত্ত্ব নাহি জানি যেবা করে দোষ-কৰ্ম।
ক্ষমা পেলে পেতে পারে যদি রাখে ধৰ্ম।।
কিন্তু তত্ত্ব জানি যেবা ধৰ্ম নাহি পালে’।
তাহার উদ্ধার নাহি হবে কোন কালে।।
আমরা গৃহস্থ জন পদে পদে দোষী।
সেই চিন্তা মোরা সবে করি দিবানিশি।।
সংসার ছাড়িয়া যারা ধৰ্ম্মের কারণে।
সব ছাড়ি চলে যায় গহন কাননে।।
তারা যদি মূঢ়-সম করে দোষ-কৰ্ম।
কিসে ঠিক থাকে তার সন্ন্যাসের ধৰ্ম ?
ক্ষুদ্র জীব ‘কাগা’ ‘বগা’ বিবেক-বিহীন।
তার প্রতি ক্রোধ করে কোন অর্ব্বাচীন ?
বিশেষতঃ ইন্দ্রিয়াদি সংযম কারণে।
লয়েছ সন্ন্যাস ব্রত প্রথম জীবনে।।
এত কষ্ট সহি যাহা কর উপাৰ্জ্জন।
‘কাগা’ ‘বগা’ খুন করে হারালে এখন।।
অধিক তোমাকে দিদি কি আর বলিব।
ধৰ্ম-কৰ্ম-সব-বৃথা না গেলে স্বভাব।।”
এতেক বলিয়া দেবী মৌন হয়ে রয়।
সন্ন্যাসিনী হত-তেজ পড়িল ধরায়।।
কান্দিয়া কান্দিয়া কহে ভগিনীর প্রতি।
“ভগ্নী নহ দিদি তুমি মহামান্যা সতী।।
তোমারে দেখিয়া ধন্য হইল জীবন।
তোমাকে গুরুত্বে আমি করিনু বরণ।।”
এই ভাবে সন্ন্যাসিনী সংশোধন হ’ল।
বল মীড কোন গুণে এসব ঘটিল।।
মীড কহে “বড় কৰ্ত্তা! শুন মোর কথা।
ধৰ্ম-গ্রন্থ মাত্রে লিখে কত উপকথা।।
সে-সব শিক্ষার লাগি করয় রচন।
প্রত্যক্ষে এসব নাহি ঘটে কদাচন।।”
মীডের সন্দেহ দেখি প্ৰভু ডেকে কয়।
“প্রত্যক্ষ ঘটনা এবে শুন মহাশয়।।
মম পিতা হরিচাঁদ আছিলেন যিনি।
শুন এবে কোন কার্য করিলেন তিনি।।
অধিক দিনের কথা নহে এই সব।
শুনহে প্রত্যক্ষ শক্তি অতুল বিভব।।
যুধিষ্ঠির-রঙ্গ নামে ভক্ত এক জন।
একদা পিতার ঠাঁই করে নিবেদন।।
“পরম দয়াল হরি! কৃপা নেত্ৰে চাহ।
অভাগার পানে চাহি দু’টি কথা কহ।।
বড় ইচছা হইয়াছে যাইব বাদায়।
আনিয়া বাদার গাছ লাগা’ব নৌকায়।।
তব আজ্ঞা বিনে বনে যেতে শঙ্কা করি।
অনুমতি কর তুমি দয়াময় হরি।।”
পিতা বলে ‘যুধিষ্ঠির! কোন ভয় নাই।
করগে বাদার কাজ স্মরিয়া গোঁসাই।।
যুধিষ্ঠির বলে ‘হরি আর কে গোঁসাই।
জগত-গোঁসাই তুমি ক্ষীরোদের সাঞী।।
তোমার নামের বলে জলে ভাসে শীলা।
তোমার নামেতে শিব জপে জপ মালা।।
স্মরিয়া তোমার নাম চলিনু বাদায়।
করহে দয়াল প্রভু যাহা ইচ্ছা হয়।।”
এতেক বলিয়া তবে ভক্ত যুধিষ্ঠির।
প্ৰণিপাত করি চলে চক্ষে বহে নীর।।
গৃহে আসি লোক জুটি উঠিল নৌকায়।
“জয় হরিচাঁদ” বলি বাদা-প্রতি ধায়।।
কাজ করে যুধিষ্ঠির স্মরে হরিচান্দে।
সন্ধ্যাকালে নায় বসি হরি বলে কান্দে।।
কাজ প্রায় শেষ হ’ল এ হেন সময়।
শুনহে ডক্টর মীড! কি ঘটে তথায়।।
একদা প্রভাত কালে একা যুধিষ্ঠির।
একা ছুটে চলে যেথা অরণ্য গভীর।।
কিছু দূর গিয়ে তেহ শুনে এক শব্দ।
শব্দ শুনি যুধিষ্ঠির দাঁড়াইল স্তব্ধ।।
হেনকালে যমদূত-সম বিভীষণ।
প্রচণ্ড দুরক্ত ব্যাঘ্ৰ দিল দরশন।।
ব্যাঘ্ৰ দেখি যুধিষ্ঠিরে না সরে বচন।
মনে ভাবে এর হাতে নিশ্চয় মরণ।।
কে মোরে রক্ষিবে আজ কাল-দূত হতে?
নিশ্চয় পড়িনু মারা আসিয়া বাদাতে।।
কি ফল ভারিয়া আর --কোন রক্ষা নাই।
মৃত্যু-পূৰ্ব্বে প্রাণ ভরে হরি গুণ গাই।।
পরম দয়াল হরি হরিচাঁদ মোর।
তাঁরে ডাকি দেখা যদি দেয় মনোচোর।।
সে-বিনে নাহি রে বন্ধু এ-বিপদ কালে।
তাঁরে ডাকি দয়া যদি করে দুঃখী বলে।।
এত ভাবি যুধিষ্ঠির কেন্দে কেন্দে কয়।
“কোথা র’লে হরিচাঁদ প্রভু দয়াময়।।
তব আজ্ঞা মতে বাবা আসিয়া বাদায়।
তুমি বলেছিলে বাবা নাহি কোন ভয়।।
তব বাক্য মিথ্যা নহে আমি অভাজন।
মম-কৰ্ম-দোষে বাক্য হইল লঙ্ঘন।।
শত অপরাধী পিতা আছি রাঙ্গা পায়।
দয়া করি কর রক্ষা যদি ইচছা হয়।।
জীবনে মরণে কৰ্ত্তা তুমি বিশ্ব-পতি।
ডুবা'লে ডুবাতে পার যাহা হয় মতি।।
মরিতে আমার প্রাণে কোন শঙ্কা নাই।
মরি বাঁচি সদা যেন তব নাম গাই।।
“হরিচাঁদ, হরিচাঁদ, হরিচাঁদ’ বলে’।
ভূমিতলে যুধিষ্ঠির পড়িলেন ঢলে।।
এবে শুন ওড়াকান্দী কোন কাণ্ড হয়।
কোন কার্য করে সেথা হরি রসময়।।
যেই মাত্র যুধিষ্ঠির ‘হরিচাঁদ’ কয়।
পিতা তবে ডাকিলেন আমার মাতায়।।
বলে “শুন শান্তি দেবী আমার বচন।
শীঘ্ৰ করি ধামা এক কর আনয়ন।।
বড়ই বিপদে আছে ভক্ত যুধিষ্ঠির।
তার লাগি প্রাণ মোর বড়ই অস্থির”।।
পিতৃ আজ্ঞা শুনি মাতা ধাইয়া চলিল।
বড় এক ধামা আনি তাঁর হস্তে দিল।।
উপুড় করিয়া ধামা চাপা দিয়া রাখে।
‘ভয় নাই যুধিষ্ঠির’ বলে পিতা ডাকে।।
ওদিকে মাটিতে পড়ি শুনে যুধিষ্ঠির।
“ভয় নাই ভয় নাই” রব সুগম্ভীর।।
মস্তক তুলিয়া তাই চাহিয়া দেখিল।
অত্যাশ্চর্য কাণ্ড দেখি বিস্মিত হইল।।
চেয়ে দেখে যুধিষ্ঠির আঁধারের রেখা।
অরণ্য বেড়িয়া শেষে ব্যাঘ্ৰে দিল ঢাকা।।
আঁধারের আস্তরণ চক্ষের পলকে।
বিপদে টানিয়া নিল আলোর ঝলকে।।
সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়ে ভাবে যুধিষ্ঠির।
প্রেমে পুলকিত তনু চক্ষে’ প্রেম নীর।।
কেন্দে বলে ‘এই কার্য হরিচাঁদ-বিনা।
অন্য কেহ ত্রিভুবনে করিতে পারে না।।
নিশ্চয় দয়াল হরি করিয়াছে রক্ষা।
অপরাধ ভঞ্জনার্থে দিল এই শিক্ষা’।।
অতঃপর নৌকা ছাড়ি দেশ পানে ছুটে।
হরিচাঁদ রূপ সদা চিত্তে তার ফুটে।।
তার মাতা পুত্র লাগি বহু চিন্তা করে’।
উপনীত ওড়াকান্দী শ্ৰীহরি গোচরে।।
পদে পড়ি সেই বুড়ী কান্দি কান্দি কয়।
‘বল প্ৰভু দয়া করি কি হবে উপায় ?
যদাবধি যুধিষ্ঠির গিয়াছে বাদায়।
তার লাগি চিন্তা করি প্রাণ কান্দে হায়।।
কতদিন গত হ’ল তবু নাহি ফিরে।
প্রাণ মোর ওঠে কেন্দে নাহি থাকে ঘরে।।
তোমার আজ্ঞায় সে ত গিয়াছে বাদায়।
কোন ভাবে যুধিষ্ঠিরে রেখেছ কোথায়?”
বুড়ীর বিনয় শুনি পিতা তারে কয়।
“ঘরে যাও বুড়ী তুমি নাহি কোন ভয়।।
আমাকে হৃদয় মধ্যে রাখে যুধিষ্ঠির।
সদা তারে ঘিরে রাখে অভয়-প্রাচীর।।
বন মধ্যে একদিন ব্যাঘ্র এসেছিল।
ভয় পেয়ে যুধিষ্ঠির আমাকে ডাকিল।।
ভক্তে রক্ষিবারে আমি করি আয়োজন।
ধামা দিয়া ব্যাঘ্র আমি ঢেকেছি তখন।।
অই দেখ অইখানে ধামার ঢাকনি।
ব্যাঘ্র-বদ্ধ আছে তথা দিবস রজনী।।
যেই ক্ষণে যুধিষ্ঠির বন ছাড়ি আসে।
আমি ছাড়ি দিব ব্যাঘ্র যেতে নিজ বাসে।।
অদ্য যুধিষ্ঠির দেখি নৌকা ছেড়ে দিল।
ভয় নাই ঢাকা-ব্যাঘ্ৰ দেখিবে ত চল।।
প্রভুর বচনে বুড়ী সাহসী হইয়া।
ব্যাঘ্ৰ দেখিবারে চলে প্ৰভু সঙ্গ নিয়া।।
প্রভু বলে “বুড়ী তুমি মোর কথা লও।
ব্যাঘ্ৰ যদি দেখ তবে ঢাকনি উঠাও”।।
প্রভুর আজ্ঞায় বুড়ী ঢাকনি তুলিতে।
লাগিল ভীষণ ব্যাঘ্ৰ গৰ্জ্জন করিতে।।
ভয় পেয়ে বুড়ী পুনঃ ঢাকনি ছাড়িল।
প্রভু বলে “কি গো বুড়ী কথা সত্য হল?”
এই ব্যাঘ্ৰ যদি তুমি না দেখ নয়নে।
আমার বচন সত্য বুঝিতে কেমনে?
থাক এবে যুধিষ্ঠির ছেড়েছে জঙ্গল।
ঈশ্বরের ইচছা ক্রমে হউক মঙ্গল।।
এবে কেন ব্যাঘ্র আর রাখি দিয়ে ঢাকা।
বন্য-পশু কত কাল যায় আর রাখা ?
এত বলি পিতা মোর ঢাকনি উঠায়।
সকলে দেখিল এক মূষিক দৌড়ায়।।
পুনরায় পড়ে দায় সেই যুধিষ্ঠির।
বিষম ঝড়েতে পড়ে? তরণী অস্থির।।
পৰ্ব্বত-প্রমাণ-ঢেউ লাগিছে নৌকায়।
মনে হয় সেই দণ্ডে তরী ডুবে যায়।।
কেন্দে বলে যুধিষ্ঠির “দয়াল ঠাকুর।
এ ভাবে পরীক্ষা বাবা কর কত দূর।।
পরীক্ষা যোগ্য আমি নহি ত কখন।
আমি শুধু আছি বেঁচে দয়ার কারণ।।
কাঠের নৌকায় বসি দেখিতেছি কাণ্ড।
ঝড় আসে বারি ছোটে তরঙ্গ প্রচণ্ড।।
আমি বুঝি কাষ্ঠ-তরী পরে যাহা ঘটে।
সব সত্য হল আজি আমার ললাটে।।
অকুল-ভব-বারিধি দুঃখ-বারি-ভরা।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ, তরঙ্গে তাহারা।।
দণ্ডে দণ্ডে সে-তরঙ্গে দেহ-তরী পড়ে।
দিশে-হারা মন মাঝি হাল নাহি ধরে।।
বারে বারে দেহ-তরী ডুবে যেতে চায়।
শুধু মাত্র বেঁচে থাকে তোমার কৃপায়।।
যেই কৃপা রক্ষা করে এ-দেহ তরণী।
কাষ্ঠ তরী রক্ষিবারে সেই পারে জানি।।
যাহা ইচ্ছা কর প্রভু তা’তে আমি রাজি।
ডোবা নায় জানি বাবা তুমি মাত্র মাঝি”।।
এত বলি কান্দাকান্দি করে যুধিষ্ঠির।
মাল্লা মাঝি সবে কান্দে বড়ই অস্থির।।
কত কাল এই ভাবে কাটিল সময়।
সকলে চাহিয়া দেখে জল নাহি নায়।।
সবে ভাবে কিআশ্চর্য জল কোথা গেল ?
কেবা এসে ডোবা নায় জল ফেলে দিল ?
এ দিকে শুনহে মীড আশ্চর্য বারতা।
ওড়াকান্দী বসে কিবা করিলেন পিতা।।
যেই কালে যুধিষ্ঠির নৌকা’ পরে কান্দে।
প্রাণ ভরে এক মনে ডাকে হরিচান্দে।।
সৰ্ব্বদশী পিতা মোর সকলি দেখিল।
পাত্র হস্তে পুকুরের জলেতে নামিল।।
ক্ষিপ্র-হস্তে পুকুরের জল ফেলে কুলে।
তাহা দেখি হীরামন যায় সেই স্থলে।।
পিতার পরম ভক্ত ছিল হীরামন।
তাঁর পদে দেহ-মন সব সমর্পণ।।
মহা বলবান সাধু নামিলেন জলে।
পিতৃ হস্ত হ’তে পাত্র নিল কুতূহলে।।
জল ফেলে অবহেলে ভীমসেন প্রায়।
কুলে উঠি পিতা মোর দাঁড়াইয়া রয়।।
কিছু কাল জল-ফেলা যখনে হইল।
‘থাক’ ‘থাক’ বলি পিতা নিষেধ করিল।।
কূলে উঠি হীরামন হরিচাঁদে কয়।
‘যুধিষ্ঠির রক্ষা পেল তোমার কৃপায়।।’
পিতা কন “হীরামন! এ মোর স্বভাব।
যেই ভাবে ভক্ত ভাবে মোর সেই ভাব।।
ভক্তেতে আমাতে তুমি জানিবে অভিন্ন।
ভক্ত মান্য হ’লে তাতে আমি হই মান্য।।
ভক্ত যা’তে সুখী হয় তাতে সুখী আমি।
ভক্ত মোরে জানে তাই আমি অস্তৰ্যামী।।
অধিক কি কব আমি ভক্তের জীবন।
যথা ভক্ত তথা আমি সত্য-নিরূপণ।।
“নাহং তিষ্ঠামি বৈকুষ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে নচ
মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ।
-শ্ৰীশ্ৰী হরিভক্তি বিলাস
ভক্তি ডোরে বান্ধে ভক্ত অচ্ছেদ্য-বন্ধনে।
সেই ডোরে টান দিলে থাকি বা কেমনে?
বৈকুষ্ঠে ক্ষীরোদ লক্ষ্মী পদ সেবে মোর।
তাহা হ’তে শান্তি দেয় ভকত-চকোর।।
অধিক কি বলি তুমি ভেবে দেখ মনে।
তোমাকে শাসিল ওঝা কিরূপ শাসনে।।
সেই সব ব্যথা আমি বুক পেতে লই।
ভক্ত যদি সুখে থাকে আমি সুখী হই”।।
পিতার মুখেতে শুনি এ হেন বচন।
ধূলায় পড়িয়া হীরা হ’ল অচেতন।।
পূৰ্ব্ব-স্মতি মনে পড়ি ব্যথা পেল মনে।
“বাবা” বলি তাই পড়ে বাবার চরণে।।
এবে শুন যুধিষ্ঠির বাড়ীতে আসিয়া।
নৌকা রাখি উপনীত ওড়াকান্দী গিয়া।।
সকলের মুখে সব বার্ত্তা শুনি গেল।
শ্ৰীহরি চরণে পড়ি কান্দিতে লাগিল।।
যে ভাবে রক্ষিল তারে হরি দয়াময়।
সব শুনে কেন্দে কেন্দে ধূলাতে গড়ায়।।
পিতা বলে “যুধিষ্ঠির! কান্দিস কি মিছে।
ভয় নাহি ঠাঁই পায় হরি-ভক্ত-কাছে।।
যার জীব সেই রক্ষা করিছে সদায়।
আমিত নিমিত্ত মাত্র আমার কি দায় ?
জলে পড়ি যদি কেহ ডুবে যেতে চায়।
থাকিলে নিকটে লোক ধরিয়া উঠায়।।
যে-জন উঠায় তারে — সে কি রক্ষাকৰ্ত্তা?
উপলক্ষ্য মাত্ৰ সবে-প্রভু হৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা ? '
যুধিষ্ঠির বলে “প্ৰভু! ভাণ্ডিও না আর।
আমি জানি হৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা তুমি সৰ্ব্বসার।।
লক্ষ্য উপলক্ষ্য আদি যাহা কিছু বল।
সকলের মূলে তুমি তুমি সৰ্ব্ব বল।।
তোমার চরণে প্রভু এই নিবেদন।
জন্মে জন্মে ও চরণে থাকে যেন মন।।”
এ ভাবে বিনয় করি যুধিষ্ঠির যায়।
‘বল মীড কোন গুণে এ সকল হয় ? ?
সমস্ত শুনিয়া তবে মীড বলে কথা।
“বড় কৰ্ত্তা শুন তুমি আমার বারতা।।
আমরা ইংরাজ জাতি যাহা কিছু দেখি।
তাহা মানি, অনুমান মনে করি ফাঁকি।।
প্রত্যক্ষ ঘটনা যদি দেখিবারে পাই।
সত্য বলে মানি তাহা ইথে ভুল নাই।।
মীডের বচনে প্রভু হাসিয়া তখন।
ইচ্ছিল মীডের সন্দ” করিতে খণ্ডন।।
ইচ্ছাময় ইচছা যদি করে নিজ মনে।
সকলি করিতে পারে মহানন্দ ভণে।।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের ভবিষ্যত কথন ও
ডক্টর মীডের সন্দেহ ভঞ্জন
মীডেরে চাহিয়া প্রভু বলিল তখন।
“তোমার মনের ভাব বুঝিনু এখন।।
প্রত্যক্ষ ঘটনা যদি দেখিবারে চাও।
এবে মীড তুমি তবে গৃহে চলি যাও।।
আদ্য যেই কালে হ’ল কথোপকথন।
আগামী পরশ্ব হেথা কর আগমন।।
আমি যাহা বলি এবে শুন মন দিয়া।
আসিছে একটি ভক্ত দধি-ভাণ্ড নিয়া।।
হেথা আসিবারে লাগে দু’দিন সময়।
পরশ্ব এখানে সেই আসিবে নিশ্চয়।।
আদ্যকার যে সময় বলিতেছি কথা।
এ সময়ে আসিবে সে হবে না অন্যথা।।
আপন-নয়নে তুমি প্রত্যক্ষ করিবে।
আশা করি মনোভ্রাক্তি সব দূর হবে।।
আমার স্বভাব নহে এই সব বলা।
বড়ই-বিপদে-ভরা এই পথে-চলা।।
তোমার বিশ্বাস লাগি এই সব বলি।
ক্রমে ক্রমে মীড তুমি জানিবে সকলি।।”
দুরন্ত বিস্ময়ে পূর্ণ মীডের হৃদয়।
মনে ভাবে এই মত কি প্রকারে হয় ?
দেখা যাক কিবা হয় আগামী পরশ্ব।
সত্য যদি হয় তবে মানিব অবশ্য।।
এমত ভাবিয়া মীড লইল বিদায়।
নিজ-পত্নী নিকটেতে সব কথা কয়।।
শুনিয়া মিসেস মীড বলিল তখন।
“তোমার সঙ্গেতে আমি করিব গমন।।
এই কথা সত্যে যদি পরিণত হয়।
গুরুচাঁদে পিতা বলি মানিব নিশ্চয়।।
দুই দিন গত হ’ল তৃতীয় দিবসে।
প্রহরেক বেলা কালে প্রভু আছে বসে।।
হেন কালে পত্নী সহ মীড মহামতি।
উপনীত তথাকালে অতি দ্রুত গতি।।
পরম যতনে প্ৰভু তাদের বসা’ল।
প্রীতি কুশলাদি সব জিজ্ঞাসা করিল।।
পরে মীড প্রতি চাহি জিজ্ঞাসা করিল।
“দেখুন ডক্টর মীড কি সময় হ’ল ?”
ঘড়ি পানে চাহি মীড বলিছে তখন।
“নয়টা বাজিয়া কুড়ি মিনিট এখন।।”
প্রভু বলে আর দশ মিনিটের পরে।
দধি-ভাণ্ড-সহ লোক আসিবে এ ঘরে।।
কাৰ্ত্তিক তাহার নাম গৌরাঙ্গ বরণ।
এই বাড়ী পূৰ্ব্বে তেহ আসেনি কখন।।
দধিভাণ্ড মাথে তার এক হাতে ছাতি।
বয়স চল্লিশ হবে নমঃশূদ্র জাতি।।”
বলিতে বলিতে সেথা এল সেই জন।
মস্তকে দধির ভাণ্ড গৌরাঙ্গ বরণ।।
প্রভু বলে “দেখ মীড এই সেই লোক।
দুই মাস পূৰ্ব্বে এর গেছে পুত্র-শোক।।”
দধি ভাণ্ড রাখি যবে প্ৰণাম করিল।
আপনার কাছে মীড তাহারে ডাকিল।।
পুঁছিল তাহার ঠাঁই নাম ধাম জাতি।
বর্ণে বর্ণে সত্য হ’ল নহে ইতি উতি।।
আশ্চর্য জানিয়া মীড ভাবে নত শিরে।
“এই বাৰ্ত্তা বড় কৰ্ত্তা পে’ল কি প্রকারে ?
মহা শক্তিধারী এই পুরুষ রতন।
যতেক সন্দেহ মোর হইল খণ্ডন।।
এ হেন ব্যক্তির দেখা আর নাহি পাই।
যাহা বলে বড় কৰ্ত্তা তাহা করে যাই।।
নিশ্চয় বুঝিনু ইনি ঐশশক্তিধারী।
নমঃকুলে এর মত অন্যে নাহি হেরি।।
এমত ভাবিছে মীড নীরব অন্তরে।
কহিল মিসেস মীড প্রভুর গোচরে।।
“এক কথা বড় কৰ্ত্তা আমি ভাবিয়াছি।
সেই হেতু মীড সহ হেথা আসিয়াছি।।
সমস্ত শুনেছি আমি মীডের নিকটে।
মন খুলে তাই সব বলি অকপটে।।
মনের প্রতিজ্ঞা মোর ছিল সেই দিনে।
পতিসহ আজ আমি আসিব এখানে।।
যদ্যপি ঘটনা সত্য দেখি নিজ চোখে।
“ধৰ্ম পিতা” বলি আমি ডাকিব তোমাকে।।
আমার বাসনা পূর্ণ হ’ল আজি তাই।
তুমি মোর ধৰ্ম-পিতা শশী মোর ভাই।।
মিসেস মীডের কথা শুনিয়া শ্রবণে।
আনন্দে মাতিয়া প্রভু বলিলা তখনে।।
“তুমি মোর ধৰ্ম-কন্যা করিনু স্বীকার।
তব কাছে নাহি মোর কোনই বিচার।।
নিজ বাড়ী নিজঘর ভাবিবে সদায়।
যাতায়াত কর মাগো সৰ্ব্বদা হেথায়।।”
শুনিয়া মিসেস মীড করে নিবেদন।
“এক কথা বলি আমি করুন শ্রবণ।।
খৃষ্টানের জাতি মোরা তা’তে পরদেশী।
সামাজিক ক্রিয়া কৰ্ম্মে মোরা নাহি মিশি।।
তোমরা হিন্দুর জাতি মোরা দিলে জল।
পান নাহি কর মনে ভেবে অমঙ্গল।।
আমি যদি কন্যা আজি হয়েছি তোমার।
আমার হস্তে কি তুমি করিবে আহার ?”
মিসেস মীডের মুখে শুনি এই বাণী।
হাসি হাসি কথা কয় প্রভু গুণমণি।।
“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন।
জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই পাবে না কখন।।