মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ২৮১-৩০০

এদিকে ডক্টর মীড মনেতে উল্লাস
পূজা-বন্ধ দেখি মনে করিল বিশ্বাস
।।
দিবারাত্রি যাতায়াত করে প্রভু-স্থলে

তাঁর মনোমত কথা প্রভু সদা বলে
।।
ধর্ম্ম আলোচনা প্রভু কবে এক মনে

তাহা দেখি আশা হর সে মীডের মনে
।।
মাঝে মাঝে বলে প্রভু সে মীডের ঠাঁই

জাতি-শুদ্ধ আমি খৃষ্ট ধর্ম্ম নিতে চাই
।।
এই ভাবে প্রভু তাঁরে করিলেন জয়

মীড করে সেই কাজ প্রভু যাহা কয়
।।
স্কুল হল দূরে গেল চন্ডালত্ব গালি

নমঃশূদ্র ক্রমে হল প্রতিপত্তিশালী
।।
সব কাজ করে মীড মাঝে মাঝে কয়

কতকাল বড়কর্তা কাটাবে সময়
।।
প্রভু কহে জান মীড শশী বাড়ী নাই

তার কাঝে মতামত আমি নিতে চাই
।।
অবশ্য তাহারে তুমি জান ভালমতে

বাধা নাহি দিতে পারে আমার এ-মতে
।।
হেন কালে হল এক দুরন্ত ঘটনা

খৃষ্টধর্ম্মে গেল তবে নমঃ কয়জনা
।।
এতকাল চুপ ছিল শ্রীবিধু চৌধুরী

এই কান্ড দেখে মনে দুঃখ হল ভারী
।।
অবিলম্বে উপস্থিত ঠাকুরের ঠাঁই

বলে কর্তা এই কার্য্যে কৈফিয়ৎ চাই
।।
প্রভু হেসে বলে বিধু হইলে পাগল

আমাকে বকিয়া বল পাবে কোন ফল?
সাধারণে যাহা বুঝে তাহা বুঝে থাক

শুনিয়া তোমার কথা আমি যে অবাক
।।
শোন বিধু শুধু শুধু করিও না গোল

ইচ্ছা হয় হাটে হাটে দেও গিয়ে ঢোল
।।
শ্রীহরির পুত্র আমি কিছু ভুলি নাই

কিবা করি চুপ করে বসে দেখ তাই
।।
মনো কথা সব আজি বলিব না খুলে

কথাতে কি হবে বাপু কাজে সব পেলে
।।
প্রভুর বচনে বিধু উত্তর না দেয়
।।
মনে মনে হল তার বিষম সংশয়
।।
বিদেশেতে শশী বাবু করিছে চাকুরি
।।
তাঁহারে লিখিল চিঠি শ্রীবিধু চৌধুরী
।।
শশীবাবু গৃহে এসে কোন কার্য করে

বলিব সে সব কথা কিছুকাল পরে
।।
এবে শুন ভক্তগণ কোন ভাবে চলে

প্রভুর মননে তারা কেবা কি কি বলে
।।
দেবীচাঁদ, মহানন্দ গেছে পরাপারে

শ্রীতারক আছে বটে জীর্ণ-দেহ ধরে
।।
নির্ব্বিকার-চিত্ত তাঁর স্তুব্ধ-সিন্ধু প্রায়

কভু নাহি অন্যভাবে প্রভুর কথায়
।।
প্রভুর মঙ্গল-ইচ্ছা হইবে মঙ্গল

যাহা বলে তাহা করে নাহি কোন গোল
।।
সবভাবে ওড়াকা্ন্দী করে যাতায়াত

সমভাবে প্রভুপদে করে প্রণিপাত
।।
সমভাবে চোখে তাঁর বহে বারিধারা

এক প্রাণ একটান নহে কিছু হারা
।।
মহাসিন্ধু পূর্ণ যথা রহে চির দিন

সিন্ধু নহে জোয়ার-ভাটা খেলার অধীন
।।
সেই মত রসরাজ একভাবে চলে

প্রভুর মঙ্গল ইচ্ছা সবাকারে বলে
।।
ঐশ্বর্য্যের লোভে যত ভক্ত এসেছিল

প্রভুর মনন শুনি বহুত কহিল
।।
কেহ বলে এই কার্য মন্দ অতিশয়

হিন্দু হয়ে শেষে যাব খৃষ্টের আলয়?
যাবে যাক উনি একা মোরা কেন যাব?
ভক্ত হলে ঘরে বসে হরিচাঁন্দ পাব
।।
আভাষ অবশ্য মোরা পূর্ব্বে বুঝিয়াছি

বিধবার বিয়া দিয়া সব দেখিয়াছি
।।

এ সব খৃষ্টানী-কর্ম্ম করা ভাল নয়
যা করে করুক উনি যাহা মনে লয়
।।
মনে বুঝে দেখি বৃথা আসি ওড়াকান্দী

ঠাকুর পেতেছে সব জাত-মারা ফন্দী
।।
এ সব বলিয়া তারা বিদায় হইল

ভাব জেনে মনে মনে প্রভুজী হাসিল
।।
সেই সব ভক্ত যারা বিদ্রোহ করিল

দেশে গিয়ে নিজ নিজ দল গড়ে নিল
।।
ওড়াকান্দী নাহি আসে না দেয় হাজত

ব্যাভিচারে মত্ত হয়ে ডুবাল জগত
।।
মায়াচক্রে সে প্রকৃতি পিষে জীব দলে

সবে চুর্ণ হয় পড়ে মায়া-চক্র তলে
।।
চতুর যে জন রহে কীলক ধরিয়া

সেই মাত্র রক্ষা পায় মরে না পিযিয়া
।।
যে জন কীলক ছাড়ে তার রক্ষা নাই

এই সব দুষ্ট-ভক্তে ঘটিলও তাই
।।
তাহাদের নাম দিয়ে কোন কার্য্য নাই

দেশবাসী জনে জনে জানিবে সবাই
।।
প্রকৃতি-নিয়মে এই আছে শুদ্ধ ধারা

সর্ব্বদা সকল স্থান রহিবেক ভরা
।।
শূণ্য বলে কোন কিছু প্রকৃতিতে নাই

একে গেলে অন্যে এস পূর্ণ করে তাই
।।
বিদ্রোহ করিয়া কত ভক্ত চলে গেল

শূণ্য স্থান পূরাইতে অন্য দল এল
।।
এ সব প্রভুর ইচ্ছা বুঝিলাম সার

কল্যাণের পথ প্রভু করে পরিস্কার
।।
কর্ম্ম অনুসারে হয় শক্তি ব্যবহার

শক্তি অনুসারে লোকে পায় কর্ম্ম ভার
।।
যতটুকু যাকে দিয়া হয় প্রয়োজন

সে কাজ করায় তারে শ্রীমধুসুদন
।।
সকলি প্রভুর ইচ্ছা তিনি ইচ্ছাময়

রশি ধরি যেন সব পুতুল নাচায়
।।
আদি পর্ব্বে যেই সব ভক্ত দল ছিল

প্রেম-ভক্তি নিয়ে তাঁরা শুধু কেন্দে গেল
।।
কঠিন মরুর মত জীবের হৃদয়

ভক্ত অশ্রুবারি পেয়ে দ্রবীভুত হয়
।।
সরস হইল ক্ষেত্রে কৃষি উপযুক্ত

জ্ঞান-কর্ম্ম সম্মিলনে সৃষ্ট হল ভক্ত
।।
ভক্তি রসে ক্ষেত্রে যারা সিক্ত করেছিল

এইখানে তাঁহাদের কার্য শেষ হল
।।
কৃষিকর্ম্মে সুনিপুণ আসে সেই দল

যাঁহাদের দেহে মনে অবিনাশী বল
।।
ত্রিবেণী-সঙ্গমে যথা মিশে তিন ধারা

ওড়াকান্দী মিশে তিন ভক্তের ফোয়ারা
।।
মহানন্দ দেবী চাঁদ আর শ্রীতারক

তিন শক্তি মাতাইল বিশ্ববাসী লোক
।।
ওড়াকান্দী এবে যারা করে যাতায়াত

আদি মূল এই তিন প্রধান মহৎ
।।
ইহাদের শক্তি প্রাণে পেয়েছিল যারা

বিশ্ববাসী জীবগণে উদ্ধারিছে তাঁরা
।।
ত্রিশক্তি করিল পূজা প্রভুগুরুচাঁদে

অর্ঘ্য ছলে ভক্ত দলে দিল তাঁর পদে
।।
মহাহৃষ্ট জগদিষ্ট হাতে ধরি লয়

অপূর্ব্ব ভাবের খেলা জগতে খেলায়
।।
তারকের অর্ঘ্য হল যাদব নকুল

হরিবল মনোহর প্রেমেতে আকুল
।।
রমণী নামেতে এক মহাশক্তিশালী
।।
গুরুচাঁদ পদে তাঁর এ সব অঞ্জলি
।।
মহানন্দ প্রেমানন্দ নাচিয়া বেড়ায়

তারকের একযোগে পদে অর্ঘ্য দেয়
।।
অশ্বিনী গোঁসাই যিনি সঙ্গীত-আচার্য্য

মহানন্দে গুরুপদে করিলেন ধার্য্য
।।
তাঁরে আশীর্ব্বাদ করে তারক রসনা

গীত রচি পূরাইল মনের বাসনা
।।

সেই ভাবে হরিবর পেল আশীর্ব্বাদ
এক সঙ্গে শিরে ধরে দোঁহাকার পদ
।।
দেবীচাঁদ আনে অর্ঘ্য বহুদূর হতে

পবিত্র কুসুম কাটী আনে এক সাথে
।।
গোপাল বিপিন আর নেপাল গোঁসাই

মাধব তপস্বীরাম সবে ভাই ভাই
।।
ত্রিশক্তির অর্ঘ্য মধ্যে আছিল যাঁহারা

মতুয়া সঙ্ঘের স্তম্ভ সকলি তাঁহারা
।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্তে এবে আসিলাম ফিরে

প্রভুর মনন জানি ইহারা কি কর?
এক বাক্যে এই সব ভক্ত দলে কয়

যাহা কর তাতে মোরা আছি দয়াময়
।।
জাতি মান ধন জন দেহ প্রাণ মন

রাঙ্গা পায় করিয়াছি সব মমর্পণ
।।
তোমারে চিনি না মোরা এই জানি সার

অক্ষয় মঙ্গলে ভরা ইচ্ছা যে তোমার
।।
তুমি যাহা আজ্ঞা কর মোরা তাই করি

জাতি মান সব তুমি বাঞ্ছাপূর্ণকারী
।।
একনিষ্ঠ এই সব ভক্ত আসি মিলে

আপনারে ধরা প্রভু দেয় কুতুহলে
।।
পরীক্ষা করিয়া প্রবু ভক্ত বাছি নিল

আপনার ভাবে প্রভু আপনি ফিরিল
।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ সর্ব্ববিধ নীতি

দেখাইল গুরুচাঁদ সত্যভামা-পতি
।।
ক্রমে ক্রমে সেই ভাব করিব লিখন

গুরুচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্ব্বজন
।।

 

১৯১৪ খ্রষ্টাব্দ ও মহাসমর

ইউরোপ মহাদেশে আছে বহু জাতি
জার্ম্মাণ তাহার মধ্যে দুর্দ্দান্ত যে অতি
।।
পূর্ব্বেতে জার্ম্মাণ দেশে বহু রাজ্য ছিল

প্রুশিয়া তাহার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লভিল
।।
এই রাজ্যে বিসমার্ক নামে একজন

শুভক্ষণে করিলেন জনম গ্রহণ
।।
তাঁহার চেষ্টার বলে ক্ষুদ্র রাজ্য যত

বৃহত্তর জার্ম্মাণীতে হল পরিচয়

জার্ম্মাণ সাম্রাজ্যবলি হল পরিচয়

প্রুশিয়া রাজ্যের রাজা কাইজার হয়
।।
কাইজার কল্পনা করে পৃথিবী বিজয়

তলে তলে যুদ্ধ-অস্ত্র গোপনে সাজায়
।।
সলা পরামর্শ তেঁহ করে বিধিমতে

কোন মতে নাহি পারে যুদ্ধকে বাধাতে
।।
মনে মনে তার অঅর পূর্ব্ব দুঃখ ছিল

ফরাসী জাতির হাতে জার্ম্মাণী হারিল
।।
আলসেস লোরেণ নামে দুইটি প্রদেশ

ফরাসীরা করে নিল তাহাদের দেশ

অন্য বহু দুঃখ মনে জার্ম্মাণীর ছিল

পৃথিবীর রাজা হবে বাসনা করিল
।।
সেই লোভে ক্রমে ক্রমে যুদ্ধ সজ্জা করে

কেমনে বাধাবে যুদ্ধ ভাবিছে অন্তরে
।।
হেনকালে অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ যিনি

সারভিয়া রাজ্য মধ্যে চলিলেন তিনি
।।
দৈবের নির্ব্বান্ধ যাহা তাহাই ঘটিল

যুবরাজ সেই রাজ্যে নিহত হইল
।।
রাজরকতে কলঙ্কিত হল সরাভিয়া

যুদ্ধের দামামা ধ্বনি উঠিল বাজিয়া
।।
জার্ম্মাণী বুঝিয়া দেখে এই ত সুযোগ

অষ্ট্রিয়াকে ক্ষেপাইয়া যুদ্ধে দিল যোগ
।।
বেলজিয়াম হল্যান্ড দুটি ক্ষুদ্র দেশ

দুর্দ্দান্ত জার্ম্মানী দোহে করে দিল শেষ
।।
দুর্ব্বলের বন্ধুরূপে আসিল ইংরাজ

দুর্ব্বলে বাঁচাতে তাই পরে যুদ্ধ-সাজ
।।

 

জার্ম্মাণী ইটালী আর প্রচন্ড রাশিয়া
অষ্ট্রিয়া তুরস্ক সব গেল এক হইয়া
।।
এদিকে ফরাসী আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য

মৃত্যু কিংবা যুদ্ধ জয় করিলেন ধার্য্য
।।
কানাডা ভারতবর্ষ আর অষ্ট্রেলিয়া

আফ্রিকা উপনিবেশ মিশিল আসিয়া
।।
আরব পারস্য দোঁহে ক্রমে যোগ দিল

বুলগেরিয়া রুমানিয়া পূর্ব্বাহ্নে মরিল
।।
সার্ভিয়া মুছে গেল কোন চিহ্ন নাই

সমস্ত পৃথিবীব্যাপী বাধিল লড়াই
।।
তিন বর্ষ যুদ্ধ চলে ভীষণ আকার

জার্ম্মাণীর তবু নাহি ভাঙ্গে অহঙ্কার
।।
শেষ বর্ষে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিতা খন্ডে

নামিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অতীব প্রচন্ডে
।।
একে ইংরাজ আর ফরাসী জুটিয়া

জার্ম্মাণীর রক্ত সব নিয়াছে শুষিয়া
।।
রক্তশূণ্য দেহে মারে মার্কিন আঘাত

মৃতপ্রায় জার্ম্মাণেরা হল ভূমিস্মাৎ
।।
ভার্সাই নগরে পরে সন্ধিপত্র হ

অহঙ্কারী কারজাইদেশ ছেড়ে গেল
।।
এই যুদ্ধে ভারতের যত নরনারী

রাজার সাহায্য করে প্রাণ তুচ্ছ করি
।।
কেহ বা সৈনিক সাজে বীরত্বে নির্ভিক

বাঙ্গালী পাঞ্জাবী গুর্খা আর কত শিখ
।।
অর্থ দেয় স্বার্থ দেয় মজুর জোগায়

দেশ ছেড়ে কতজন গেল বসরায়
।।
মহাযুদ্ধে গুরুচাঁদ রাজার কল্যাণে

বহু নমঃশূদ্রে দিল যুদ্ধের কারণে
।।
বিভিন্ন বিভাগে তারা করিল চাকুরী

কেহ কেহ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ গেল মরি
।।
উৎসাহ দেখিয়া তাঁর মীড ডাকি কয়

উপর্যুক্ত কাজ এই হল মহাশয়
।।
রাজভক্ত নমঃশূদ্র জানিবেন রাজা

দিনে দিনে নমঃশূদ্র হবে মহাতেজা
।।
দলিত পীড়িত জাতি বঙ্গে যত আছে

তারা সবে শিক্ষা পাবে নমঃশূদ্র কাছে
।।
তোমার কার্যের ধারা আমি দেখিয়াছি

তরাবে পতিত জনে ভাবে বুঝিয়াছি
।।
যে বীজ রোপণ আজি করিলে ঠাকুর

ইহার শিকড় যাবে দূর হতে দূর
।।
এই বীজ যেই বৃক্ষ উঠিবে জাগিয়া

পতিত বাঙ্গালী তাতে যাইবে তরিয়া
।।
যে বাণী বলিল মীড তাহা দেখি পরে

সকলি হইল সত্য অক্ষরে অক্ষরে
।।
যুদ্ধ শেষে বঙ্গবাসী নব শক্তি পায়

পীড়িত জাতির হল নব অভ্যুদয়
।।
দেশের আইন-সভাবিস্তৃত হইল

বঙ্গদেশে বহুজনে ভোটাধিকার পেল
।।
অনুন্নত বলি যত জাতি বঙ্গে ছিল

ভোট দিয়া কাউন্সিলে মেম্বর পাঠাল
।।
ভীষ্মদেব দাস আর নীরোদ বিহারী

কাউন্সিলে সভ্য হল বহু চেষ্টা করি
।।
প্রথম আইন গৃহে ইহারা দুজন

নমঃশূদ্র পক্ষ হতে করে আগমন
।।
ভীষ্মদেব দাস হয় ওড়াকান্দী বাসী

প্রথমে তাঁদের বিদ্যা শিখাইল শশী
।।
কাউন্সিলে পশিবারে তেঁহ ইচ্ছা করে

মহাপ্রভু গুরুচাঁদে বলে ভক্তিভরে
।।
আপনার দয়া ভিক্ষা এই কার্যে চাই

চিরদিন তব ঠাঁই আমি কৃপা পাই
।।
আশীর্ব্বাদ চাই আমি জাতির কারণে

ক্ষুদ্র হয়ে কিবা ফল জাতির কারণে
।।
তাঁর বাক্য শুনি প্রভু বড়ই সন্তোষ

বলে ভীষ্ম করিও না বৃথা আপশোষ
।।

অবশ্য সাহায্য আমি করিব তোমারে
নিশ্চয় মেম্বর তুমি হবে এই বারে
।।
প্রভুর অমোঘ বাণী হল পরিপূর্ণ

মনোনীত-সভ্যরূপে ভীষ্ম হল ধন্য
।।
বরিশাল জিলা পক্ষে নীরোদ বিহারী

কাউন্সিলে সভ্য হন বহু চেষ্টা করি
।।
বিখ্যাত মল্লিক বংশে জনম তাঁহার

কুমুদের হন তিনি চতুর্থ সোদর
।।
তথাকার ভক্তগণে প্রভু ডাকি বলে

নীরোদ বাবুকে ভোট দিও এক দলে
।।
যেই দেশে হতে যে ভক্ত কাছে আসে

কাউন্সিলে কে দাঁড়াল তাঁহারে জিজ্ঞাসে
।।
অনুন্নত জাতি হয়ে যাতে সভ্য যায়

সেই মত উপদেশ সকলেরে কয়

বিস্তৃত আকারে তাহা বলিব যে পরে

এবে বলি সব কথা মূল-সূত্র ধরে
।।
দলিত জাতির এই নব অভ্যুদয়

রাজাকে সাহায্য-করা তার মূলে রয়
।।
সেই কা্র্যে মূলে দেখি গুরুচাঁদ প্রভু

তাঁরে ভিন্ন পতিতেরা উঠে নাই কভু
।।
মহাযুদ্ধে বিশ্বে এল মহাজাগরণ

সর্ব্বক্ষেত্রে আবিষ্কার হইল নূতন
।।
আকাশে উড়িল নর জলেতে ডুবিল

পৌরাণিক কথা সত্যে পরিণত হল
।।
কিবা রাজ্যে কি বাণিজ্যে নবযুগ

সকলে স্বাধীন হ উঠিল হুজুগ
।।
সেই আন্দোলন কথা পরে বলা হবে

এবে শুন মহাপ্রভু কি করিলা তবে
।।
খৃষ্টান হইবে বলি প্রভু দিল ভীর

ঐশ্বর্য্যের ভক্তিধারী ছিল যাঁরা যাঁরা

ভক্তিগুণে গুরুচাঁদে পাইলেন ধরা
।।
যাহা ইচ্ছা হয় মনে প্রভু করে তাই

এদিকে ছাড়িল দেহ তারক গোঁসাই
।।
সে কাহিনী অতঃপরে বলিবার চাই

কহি কহে গেল দিন আর বেলা নাই
।।

 

কবি রসরাজ শ্রীশ্রীতারকচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা ও বিরোধান বিবরণ


সেই ধন্য নরকুলে লোকে যাঁরে নাহি ভুলে
মনের মন্দিরে সদা সেবেসর্ব্বজন
.........মাইকেল মধুসুদন দত্ত


বন্দনা
মহাকবি শ্রীতারক অজ্ঞান-তিমির নাশক

রসরাজ কবি চুড়ামানি

প্রেমেক সাধক ধন্য যাঁর আগমন জন্য
ধন্য হল এ-মর ধরণী
।।
কন্ঠে যাঁর সরস্বতী সস্তকে ক্ষীরোদপতি
রসনাতে বাণী বাগেশ্বরী

হৃদয়-আসনে যাঁর গুরুচাঁদ মহেশ্বর
যুগলে প্রেমবারি
।।
হরিচাঁদ-তত্ত্ব-কথা হরি লীলামৃত গাঁথা
প্রেম-রসে করিল রচনা

বঙ্গ দেশে শ্রেষ্ঠ কবি জ্বলন্ত প্রেমের ছবি
কৃপা-কণা করি হে যাচনা
।।
তোমার জীবন-কথা পূর্ণ-প্রেম-পবিত্রতা

কোনভাবে কবির বর্ণনা

শক্তিহীন আমি দীন লক্ষ গুণে দীন হীন
ভক্তিহীন আমি অভাজন
।।
আমার অসাধ্য যাহা কেমনে বর্ণিত তাহা
সাধ্য মাত্র আছ এক পথে


 

 

তোমার কুসুম তুলি তব পদে পুষ্পজ্ঞলি
দিব আমি আজি কোন মতে
।।
যাঁর ফুল তাঁর স্নেহ ফুলে থাকে অহরহ
সেই শুধু ভরসা আমার

লীলামৃত বৃক্ষ হতে ফুলগুলি নিয়ে হাতে
দাঁড়ালাম আমি দুরাচার
।।
তোমার জন্মের কথা যাহা লিখিয়াছ সেথা
তাই পুনঃ লিখিলাম হেথা

তোমার কুসুম তুমি তুলি রও অন্তর্যামী
নাহি নিলে মনে পাব ব্যথা
।।
ওরে বৎস শোন তোর জন্ম বিবরণ

তুই যে জন্মিলি তোর পিতার সাধন
।।
দেখেছিস বাল্যকালে তোর খুল্লতাত

জন্ম অন্ধ নাম তার ছিল শম্ভুনাথ
।।
তোর জন্ম বিবরণ তোর মনে নাই

মৌখিক শুনিলি তোর পিসিমার ঠাঁই
।।
তোর পিতা কাশীনাথ ছিল কালী-ভক্ত

শক্তি আরাধিত কালী-পদে অনুরক্ত
।।
অপুত্রক ছিল বংশে পুত্র না জন্মিল

বংশ রক্ষা হেতু দুর্গা বলিয়া কান্দিল
।।
বট পত্রে লক্ষ দুর্গা নাম লিখে পরে

সপ্তাহ পর্য্যন্ত শিব স্বস্ত্যয়ন করে
।।
আচর্য্য ফকির চাঁদ করে স্বস্ত্যয়ন

স্বস্ত্যয়ন করি বলে জন্মিবে নন্দন
।।
স্বর্ণময়ী দশভূজা মূর্ত্তি গড়ি লয়

পূজা করিলেন শুভ নমবী সময়
।।
শ্রীনবকুমার শর্ম্মা পুরোহিত এসে

পূজা করে জগদ্ধাত্রী পূজার দিবসে
।।
সপ্তাহ পর্য্যন্ত চন্ডী করিল পঠন

অষ্টম দিবসে দিল ব্রাহ্মণ ভোজন
।।
নবমী দিবসে পূজা কৈল ভবানীর

তব পিতা বুক চিরে দিলেন রুধির
।।
মার্গ শীর্ষ অমাবস্যা শনিবার দিনে

তোর মাতা প্রসব করিল শুভক্ষণে
।।
নাম করনেতে নাম রাখিল তারক

আচার্য্য বলিল পুত্র হইবে রচক
।।
........শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত

যশোহর জেলাধীনে লহ্মীপাশা সন্নিধানে
নবগঙ্গা নদী বহি যায়

তাহার উত্তর পারে গৃহ শোভে থরে থরে
জয়পুর বলিগ্রাম কয়
।।
মহাসাধু রামদাস লহ্মীপাশা করে বাস
বহু নমঃশূদ্র তথা রয়

ক্রমে বৃদ্ধি হল বংশ নানা ভাবে নানা অংশ
ভিন্ন ভিন্ন দেশে চলি যায়
।।
এই নমঃশূদ্র বংশে জয়পুর মধ্য অংশে
কাশীনাথ আর শম্ভুনাথ

দুই ভাই এক ঘরে মহাসুখে বাস করে
যেন রাম লহ্মণ সাক্ষাৎ
।।
কাশী করে কবি গান দেশে দেশে পায় মান
জন্ম অন্ধ ছিল শম্ভুনাথ

ঢাকা কিংবা কলিকাতা কাশী যায় যথা তথা
গানে মত্ত ছিল দিন রাত
।।
শক্তি উপাসনা করে কালী-মুর্ত্তি ছিল ঘরে
দেবী পদে আর্ত্তি ছিল দৃঢ়

সব দিকে সুখী কাশী দেখা যায় হাসি হাসি
মনে কিন্তু কষ্ট ছিল বড়
।।
পুত্র নাহি জন্মে তার পিতৃ-পুরুষের ধার
কাশী বুঝি না পারে শোধিতে

দিনে দিনে ম্রিয়মান হল সে কাশীর প্রাণ
চিন্তা করে বহুবিধ মতে
।।

 

 

বহু পরামর্শ পরে যে কার্য্য করিল পরে
যত কিচু তার ইতিহাস

লীলামৃত গ্রন্থ মাঝে যাহা লিখে রসরাজে
আমি তাহা করেছি প্রকাশ

ফুল্ল যেন পূর্ণচন্দ্র আসিল তারকচন্দ্র
কাশীনাথে হল বাঞ্ছা পূর্ণ

মনে পেল মহাশক্তি দেখি তারকের কান্তি
রতি-পতি-গর্ব্ব কর চুর্ণ
।।
দিনে দিনে দিন যায় আধ স্বরে কথা কয়
তার মধ্যে ভাবের দ্যোতনা

রূপে শোভা ঢল ঢল হেসে ওঠে খল খল
নাচে যেন রূপের জ্যোছনা
।।
পঞ্চম বরষ কালে বসিয়া পিতার কোলে
কাব্য গাঁথা করিল রচনা

শুনে কাশীনাথে সুখ গর্ব্বে ভরে ওঠে বুক
প্রাণে তাঁর আনন্দ ধরেনা
।।
ক্রমে বয়ঃবৃদ্ধি হয় পাঠশালে তাঁরে দেয়
বর্ণশিক্ষা হল একদিনে

সংযুক্ত বর্ণের খেলা শিক্ষা করে একবেলা
বিস্ময় মানিল সবে মনে
।।
আদি পাঠ দিল তাঁরে দিন দিনে শেষ করে
প্রথম মানের শিক্ষা যত

দ্বিতীয় মানের পড়া সপ্ত দিনে হল সারা
পন্ডিতেরা হল বাক্য-হত
।।
এই ভাবে ছয় মাস শিখিলেন সবিশেষ
ছাত্রবৃত্তি পাঠ যাহা ছিল

কাশীনাথ বলে তাই আর পড়ে কার্য্য নাই
কবি গান-শেখা এবে ভাল
।।
ভাগবত রামায়ণ করিলেন অধ্যয়ন
আর পরে শ্রীমহাভারত

গীতা পড়ে স্মৃতি পড়ে যখনে যে পাঠ ধরে
একেবারে করে কন্ঠ-গতে
।।
আঠার পুরাণ পড়ে হেনকালে মনে পড়ে
চৈতন্য চরিতামৃত নাম

সে গ্রন্থ আনিল ত্বরা দেখে প্রেমরসে ভরা
এতদিনে পূর্ণ মনস্কাম

দিবারাত্রি পড়ে গ্রন্থ কভু নাহি করে ক্ষান্ত
ভাব দেখি সুখী কাশীনাথ

মনে মনে ভাব তাঁর তারকেরে অতঃপর
রাখিবেন আপনার সাথ
।।
নরে যাহা মনে ভাবে সব পূর্ণ হল কবে
পূর্ণ নহে সকল বাসনা
।।
কিছু দিন পরে তার শুন সব সমাচার
বলিতেছি সে সব ঘটনা
।।
পঞ্চদশ বর্ষ যবে তার বয়ঃক্রম হবে
নিয়তির অলঙ্ঘ্য নিয়মে

ছাড়িয়া সংসার-মায়া ত্যাজিয়া নশ্বর কায়া
কাশীনাথ গেল স্বর্গধামে
।।
একা ঘরে নিরুপায় ঠেকিয়া বিষম দায়
সে তারক করিল কল্পনা

পিতৃ-ব্যবসায় ধরি আমি কবি গান করি
তাই হোক আমার সাধনা
।।
পিতার দোঁহার যত সবে করি হস্তগত
মনোমত কবি গান গায়

দেখিয়া বালক-প্রায় কেহ নাহি ডেকে তায়
মনোদুঃখে বুক ফেটে যায়
।।
একদিন মনোদুঃখে সমস্ত দোহারডাকে
বলিলেন তারক গোঁসাই

কি কব দুঃখের কথা হেঁট হল মোর মাথা
দুঃখ-বলা স্থান নাহি পাই
।।
তোমরা যাহার সাথে গান কর বিধি মতে
শাস্ত্রজ্ঞান আছে যার সাথে

তার কাছে কবি গান কেহ নাহি শোনে কেন
বুঝিয়া না পাই কোন মতে
।।

ভোলা, সূর্য্য যেথা গায় বল দেখি মহাশয়
তার কাছে অন্যে কিবা গাবে?
বুঝিলাম তত্ত্ব-সার কবি গান বুঝিবার
এই দেশে নাহি কেহ এবে
।।
এই ভাবে কথা কয় সূর্য্ নারায়ণ তায়
হেসে উঠে খল খল করি

বলে শুন মহাশয় বলিলেন যে-ভাষায়
শুনে আমি লজ্জা পেয়ে মরি
।।
শাস্ত্রজ্ঞান যদি কও তুমি তার কিছু নও
বলিতেছি আমি যাঁর কথা

এক কথা যদি কয় বলি আমি সুনিশ্চয়
হেঁট করে রবে তুমি মাথা
।।
দূরে নহে তাঁর ঘর থাকে সে কালীনগর
নাম তাঁর সাধু মৃত্যুঞ্জয়

তাঁর মত শক্তিশালী নমঃশূদ্র বংশাবলী
মধ্যে অন্যে দেখা নাহি যায়
।।
শাস্ত্রজ্ঞান কত তাঁর শুন সেই সমাচার
ঘটে যাহা নবগঙ্গা তটে

দেশবাসী সবে জানে সুধী-তর্কপঞ্চাননে
হার মানে তাঁহার নিকটে
।।
তিনি অতি মহাজন ভাগ্যে তার দরশন
হল মোর সে কালী নগরে
।।
দেখিলাম কতজনে পড়ে আছে সে চরণে
মগ্ন সাধু আপনা ভিতরে
।।
বলে সূর্য্যনারায়ণ তারকের মুগ্ধ মন
মনে মনে করে আলোচনা

শুনি তার বিবরণ আকৃষ্ট হয়েছে মন
মনে মনে জাগিছে কল্পনা
।।
আমি যাব তাঁর কাছে দেখি সেথা কিবা আছে
কোন গুণে সেই গুণমণি

এমন শকতি পায় বসে আছে কোনাশায়
কোন গুণে এত বড় গুণী
।।
প্রকাশ্যে তারক বলে সূর্য্ নারায়ন-স্থলে
শোন সূর্য্য আমার মনন

সে কালীনগরে যাব তোমাকেও সঙ্গে নিব
মৃত্যুঞ্জয়ে করি দরশন
।।
মোর মনে এই কয় মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যুঞ্জয়
নবরূপে করিতেছে খেলা

আমার পাগল মন করিতেছে আকর্ষণ
শোনা-মাত্র প্রাণে হল জ্বালা
।।
দিনস্থির করি দোঁহে চুপ করে গৃহে রহে
তারকের চোখে ঘুম নাই

মন যেন দেহ ছাড়ি চলিয়া গিয়াছে উড়ি
শূণ্য বুকে ঘন ছাড়ে হাই
।।
ব্যাকুল অন্তরে ঘুরে নদীতীরে বনান্তরে
ঘন ঘন কেন্দে উঠে প্রাণ

রাত্রি শেষে নিদ্রা ঘোরে মহামায়া বলে তাঁরে
শুনি বলি তাহার আখ্যান
।।

 

গোস্বামী মৃত্যুঞ্জয়ের কৃপালাভ


নিশি শেষে স্বপ্নাদেশে মহামায় কয়

শুনহে তারক তুমি মোর পরিচয়
।।
লহ্মী পাশা শ্রীমন্দিরে আমি অধিষ্ঠান

অহর্নিশি করি আমি তোমার কল্যাণ
।।
শুনহে তোমার পিতা ছিল কালীভক্ত

বুক চিরে মোর পদে দিল তার রক্ত
।।
তোমাতে বড়ই প্রীত আছি আমি তাই

তোমার মঙ্গল হোক সদা এই চাই
।।
সত্য সত্য মৃত্যুঞ্জয় অতি মহাজন

তাঁহার নিকটে কর অবশ্য গমন
।।
মহাশক্তি ধারী জান সাধু মৃত্যুঞ্জয়

মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে বলিনু নিশ্চয়
।।

 

এত বলি গেল চলি দেবী মহাশয়া
আভাসে তারক যেন দেখিলেন ছায়া
।।
নিদ্রা ভেঙ্গে সে তারক বসিল উঠিয়া

সূর্য়্য নারায়ণে কথা বলিছে ডাকিয়া
।।
শোন সূর্য্য! মনোধার্য্য বলি তব ঠাঁই

আর দেরী নহে মোরা অদ্য চলে যাই
।।
ত্রস্তে ব্যস্তে দুইজনে প্রস্তুত হইল

নব গঙ্গা পার হয়ে শ্রীমন্দিরে গেল
।।
দন্ডবৎ করে সাধু মন্দির প্রাঙ্গণে

ভক্তি ভরে বলে কথা সব মনে মনে
।।
ওগো দয়াময়ি মাতা, জগত জননী

তোমার অনন্ত গুণ আমি নাহি জানি
।।
দয়া করে যদি মোরে বলিয়াছ পথ

পাই যেন সে মহাপুরুষের সাক্ষাত
।।
এ ভাবে প্রার্থণা করি চলিল তারক

সূর্য্য নারায়ণ সঙ্গে নাহি অন্য লোক
।।
বেলা অবসান হল দোঁহে হেঁটে যায়

উপনীত হেইলেন গ্রাম কালিয়ায়
।।
তথা হতে দ্রুত গতি চলে পথ ধরে

সন্ধ্যাগ্রে পৌঁছিল দোঁহে সে কালীনগরে
।।
জিজ্ঞাসায় যবে যায় সাধুজীর বাড়ী

গৃহমধ্যে মৃতুঞ্জয় যায় তাড়াতাড়ি
।।
তাহা দেখি শ্রীতারক পিছে পিছে যায়

গৃহমধ্যে অতঃপর হইল উদয়
।।
কেন গেল গৃহমধ্যে বুঝিতে না পারে

কেন যেন জোর করে নিল তারে ধরে
।।
দেখিল গৃহের মধ্যে দুইটি আসন

একাসনে মৃতুঞ্জয় মুদিয়া নয়ন
।।
অন্যখানি শূণ্য আছে কেহ বসে নাই

বিস্মিত তারক ভাবে কোথা আমি যাই
।।
বসিবারে মৃত্যুঞ্জয় করিল ইঙ্গিত

নীরবে তারক বসে চিত্তে পুলকিত
।।
মুদিত নয়নে বসে সাধু মৃত্যুঞ্জয়

একদৃষ্টে সে তারক তাঁর পানে চায়
।।
সেইভাবে রাত্রি কাটে প্রভাত সময়

ইঙ্গিতে তারকে যেতে মৃত্যুঞ্জয় কয়
।।
আসন ত্যাজিয়া এল শ্রীতারকচন্দ্র

একা-ঘরে মৃত্যুঞ্জয় রহিলেন বন্ধ
।।
তারক বলিল তবে সূর্য্য নারায়ণে

আমি থাকি তুমি একা যাও গৃহপানে
।।
সূর্য্য নারায়ণ গেল রহিল তারক

সারাদিন বৃক্ষতলে কাটিল একক
।।
পুনরায় সন্ধ্যাগমে গৃহমধ্যে যায়

ইঙ্গিত বসিতে তারে বলে মৃত্যুঞ্জয়
।।
পুনরায় রাত্রি কাটে প্রভাত আসিল

ইঙ্গিতে তারকচন্দ্র বৃক্ষতলে গেল
।।
এই ভাবে তিন রাত্রি আর তিন দিন

একাসনে মৃত্যুঞ্জয় রহে হয়ে লীণ
।।
তৃতীয় রাত্রিতে তবে নিশীথ সময়

স্বচক্ষে তারকচন্দ্র দেখিবারে পায়
।।
জ্যোর্তিষ্ময় মূর্ত্তিধারী বহু নরনারী

অকস্মাৎ বসিলেন মৃত্যুঞ্জয় ঘিরি
।।
ওঁ গুরবে নমঃ বলি করে প্রণিপাত

আশীর্ব্বাদে মৃত্যুঞ্জয় তুলিলেন হাত
।।
মুহুর্ত্ত থাকিয়া সবে হল অন্তর্যাধ্তণন

দৃশ্য দেখি সে তারক যেন হতজ্ঞান
।।
মনে মনে কত প্রশ্ন উঠে মনে তাঁর

কন্ঠবন্ধ, কথা-বলা-চেষ্টা মাত্র সার
।।
সংশয়-দোদুল-চিত্ত বসিয়া তারক

হেনকালে পূর্ব্বভিতে ফুটিল আলোক
।।
নয়ন মেলিল ঊষা প্রভাতের কোলে

মৃত্যুঞ্জয় এ সময় আঁখিযুগ মেলে
।।
করুণা-পুরিত নেত্রে তারকে দেখিল

নয়নে নয়নে দোঁহে মিশামিশি হ
।।

কি মোহিনী শক্তি যেন ধরে মৃত্যুঞ্জয়
জ্ঞানহারা সে তারক পড়িল ধরায়
।।
ধীরে ধীরে মৃত্যুঞ্জয় ধরিলেন তারে

করুণ-কোমল হস্ত রাখিলেন শিরে
।।
ক্ষণপরে তারকের সঙ্গা ফিরে আসে

তাহা দেখি মৃত্যুঞ্জয় মৃদু মৃদু হাসে
।।
সঙ্গাপ্রাপ্ত সে তারক উঠিয়া বসিল

গোস্বামীর পদে পড়ি কান্দিতে লাগিল
।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে তুই শোন মোর সোনা

অদ্য হতে মম হাতে তুই হলি কেনা
।।
বাসনা পুরিবে তোর নাহি কোন ভয়

বলি দেখি কি বলিতে এলিরে হেথায়
।।
তারক কান্দিয়া বলে গুরু তুমি মোর

দয়া করে কাট যত মায়া-মোহ-ঘোর
।।
নিজগুণে দয়া যদি করিয়াছ প্রভু

চরণ ছাড়িয়া আমি নাহি যাব কভু
।।
হেসে তায় মৃত্যুঞ্জয় বলে মিষ্টভাষে

শুক্তি পেয়ে ভুলে গেলি রত্নাকরে এসে?
যাও বাছা গৃহে যাও এসো পুনর্ব্বার

ক্রমে ক্রমে হবে জানা সব সমাচার
।।
এইভাবে তারকের কৃপা-প্রাপ্তি হয়

নুতন জনম লয়ে গৃহে ফিরে যায়
।।
কৃপাবীজে মৃত্যুঞ্জয় দিল জন্ম তাঁর

কবি কহে সাধু-সঙ্গ-সর্ব্বতীর্থ-সার
।।

 

শ্রীশ্রীহরিচাঁদকে দর্শণ ও শক্তিলাভ


আমারে আড়াল করিয়া দাড়াও
হৃদয়-পদ্মদলে
--বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর দিন সে তারক গেল সেই দেশে

সাধনা করিছে যেথা মৃত্যুঞ্জয় বসে
।।
প্রণাম করিল গিয়া গোস্বামীর পায়

হাসি হাসি মৃত্যুঞ্জয় তারে ডেকে কয়
।।
তারক হে! তুমি নাহি জান সমাচার

ওড়াকান্দী হরিচাঁদ হরি-অবতার
।।
মোর যাহা কিছু দেখ সবি তাঁর দয়া

আমাকে ঘিরিয়া আছে তাঁর কৃপা-ছায়া
।।
জনম সফল যদি করিবারে চাও

সময় থাকিতে তুমি ওড়াকান্দী যাও
।।
যদি বল আমি তব সঙ্গে যেতে পারি

নয়ন সার্থক হবে যদি দেখ হরি
।।
কথা শুনি তারকের চিন্তা হয় মনে

হরি অবতার পুনঃ হল বা কেমনে?”
শেষ অবতার হল শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য

পরে নাহি অবতার গোরা রায় ভিন্ন
।।
শাস্ত্র গ্রন্থে কোথা নাই প্রমাণ তাঁহার

কিসে গুরু বলে হরিচাঁদ অবতার?”
অন্তর জানিয়া তবে কহে মৃত্যুঞ্জয়

তারক হে! সন্দ করা কভু ঠিক নয়
।।
শাস্ত্র গ্রন্থে প্রমাণাদি নাহি বল কিসে?
সে কথা বলিয়া গেছে শ্রীজীব বিশেষে
।।
শ্রীচৈতন্য ভাগবতে সন্ন্যাস অধ্যায়

মাতার নিকটে প্রভু অঙ্গীকারে কয়
।।
তব গর্ভে জন্ম লব আর দুই বার

এই নহে মাতা মোর শেষ অবতার
।।
ভক্ত গণে সঙ্গোপনে পুনঃ ইহা বলে

অবতার হব পুনঃ সংকীর্ত্তন-ছলে
।।
পড়িয়া দেখগে তাহা তারক গোঁসাই

এই বাক্য আমি কভু ভুল বলি নাই
।।
স্বচক্ষে দেখিবে যবে প্রভু হরিচান্দে

এ কথা স্বীকার তুমি করিবে আনন্দে
।।
এই কথা বলিলেন সাধু মৃত্যুঞ্জয়

শ্রীঘ্র গতি সে তারক নিজগৃহে যায়
।।

শ্রীচৈতন্য ভাবগত সংগ্রহ করিল
সন্ন্যাস অধ্যায় পরে পাঠ করি নিল
।।
দেখ সব লেখা আছে সত্য পরিচয়

বুঝিল গৌরাঙ্গ শেষ অবতার নয়
।।
কিন্তু অবতারে আছে বহুত লক্ষণ

পাপী বিনাশন আর সাধুর লক্ষণ
।।
অঙ্গে থাকে শুভ চিহ্ন দ্বাত্রিংশ প্রকার

অন্তর বুঝিয়া করে সেই ব্যবহার
।।
হরিচাঁদ হৎতে পারে মহৎ পুরুষ

শক্তিশালী হৎতে পারে সাধক মানুষ
।।
আর এক কথা মোর উঠিয়াছে মনে

আপন গুরুকে লোকে ভগবান মানে
।।
আমার প্রভুর গুরু প্রভু হরিচাঁন

সেই হেতু গুরু তাঁরে বলে ভগবান
।।
মোর পক্ষে ভগবান গুরু মৃত্যুঞ্জয়

তাঁর পদে মন মোর যেন সদা রয়
।।
কাজ নাই ওড়াকান্দী হরিচাঁদে দেখে

সদয় আমারে যদি প্রভু মোর থাকে
।।
পুনরায় তবে যায় সে কালীনগরে

মৃত্যুঞ্জয় হাসি তবে বলিল তাহারে
।।
হে তারক! আর কোন মনেতে সন্দেহঃ
এক মনে এই বারে মোর বাক্য লহ
।।
দূরে থেকে সে কল্পনা সে সব অলীক

ওড়াকান্দী গেলে তুমি সব পাবে ঠিক
।।
সন্দেহ-ভঞ্জন হরি আছে ওড়াকান্দী

চল এক সঙ্গে মোরা সেই পদ বন্দি
।।
এ মত কহিল যদি প্রভু মৃত্যুঞ্জয়

তারক স্বীকার করি পড়ে তাঁর পায়
।।
দুই দিন পরে দোঁহে করে শুভযাত্রা

অন্তর্য্যামী মহাপ্রভু জানিলেন বার্ত্তা
।।
সন্দেহ-দোলায় দোলে তারকের মন

কি জানি কি-ভাবে হরি দেয় দরশন
।।
হেন-মতে ওড়াকান্দী হেইল উদয়

চক্ষে জল মৃত্যুঞ্জয় হরি! হরি! কয়
।।
স্পর্শ মাত্রে শ্রীধামের পবিত্র প্রাঙ্গন

অকস্মাৎ উচাটন তারকের মন
।।
প্রাঙ্গণের প্রান্তভাগে চটকা তলায়

মহাপ্রভু বসিয়াছে ছিন্ন-কান্থা গায়
।।
বলিষ্ঠ উন্নত দেহ এক মহাজন

উম্মাদের প্রায় যেন করিছে ভ্রমণ
।।
সম-কায় দেখা যায় অন্য একজনে

প্রফুল্ল বদনে রহে প্রভুর পিছনে
।।
যবে মৃত্যুঞ্জয় আসি উপনীত হ

হাসি হাসি মহাপ্রভু কহিতে লাগিল
।।
ওরে গোলক! হীরামন! তোরা দেখে যা

মিত্যুনে এনেছে সাথে এক তোতার ছা
।।
সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করি পড়ে মৃত্যুঞ্জয়

প্রভু প্রতি এক দৃষ্টি সে তারক চায়
।।
মৃত্যুঞ্জয় উঠে বসে চক্ষে ঝরে জল

ভাব দেখি সে তারক হইল বিহ্ববল
।।
প্রণাম করিতে যবে ভূমি স্পর্শ করে

সন্দেহ-ভঞ্জন-প্রভু দেখাল তাঁহারে
।।
দুই পদ প্রসারিয়া প্রভু দেখাইল

ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন তারক দেখিল
।।
ঊদ্ধ দৃষ্টি করি তবে চাহিল তারক

ঊর্দ্ধ হস্ত করিলেন ভূবন-পালক
।।
সবে ভাবে অলসতা নাশিবার তরে

মহা প্রভু হস্ত পদ প্রসারিত করে
।।
তারক দেখিল কিন্তু সর্ব্ব সুলক্ষণ

শাস্ত্রে গ্রন্থে যেই সব করেছে কীর্ত্তন
।।
পঞ্চদীর্ঘো পঞ্চ সূহ্মঃ সপ্তরাক্তঃ ষড়োন্নতঃ

ত্রিহ্রাস্ব প্রীতিগাম্ভীর্য্যং দ্বাত্রিংশো লক্ষণ মহান
।।
সন্দেহ-মেঘেতে-ঢাকা ছিল যে হৃদয়

হরি কৃপা-বায়ু তাহা দূরে লয়ে যায়
।।

জ্ঞানহারা সে তারক পড়িল ধরায়
শির-স্পর্শ হল তার ঠাকুরের পায়
।।
কৃপাময় কৃপা করি শক্তি দিল তারে

বলে ধর মৃত্যুঞ্জয় ধর তুমি ওরে
।।
মৃত্যুঞ্জয় পরশিলে জ্ঞান ফিরে এল

উচ্চঃস্বরে সে তারক কাঁদিতে লাগিল
।।
লক্ষ কথা আসে মনে বুক ফেটে যায়

এক মুখে কিবা কবে করে হায় হায়
।।
প্রভু কয় মৃত্যুঞ্জয় এই তোতার ছা

আর কারে দিবি তুই মোরে দিয়ে যা
।।
কেন্দে বলে মৃত্যুঞ্জয় অনাথের নাথ

এ তোমাকে নেয়া দেয়া সব নিজ হাত
।।
তোতা তো সামান্য কথা ব্রহ্মান্ড তোমার

নেয়া দেয়া কর্তা তুমি ব্রহ্ম পরাপর
।।
দয়া করে এ তোতারে যদি তুমি নিলে

জনমের মত বাঁধ কৃপার শৃঙ্খলে
।।
মহাপ্রভু ডেকে বলে তবে তাই হোক

যা বলি তোতারে আমি সেই বুলি কোক
।।
এ সময়ে তারকের কিছু চিত্ত স্থির

দর দর ধারে দুই চক্ষে বহে নীর
।।
যেই মাত্র প্রভু বলে সেই বুলি কোক
।।
তারকের জিহ্বাগ্রে অম্নি ফুটিল শ্লোক
।।
অপলকে শ্লোকে শ্লোকে করিল বন্দনা

মৃত্যুঞ্জয় আনন্দিত শুনিয়া রচনা
।।
দেব-ভাষা সহযোগে বন্দনা করিল

মাতৃ-ভাষা সহযোগে ভাব লেখা হ
।।

 

স্তব
গুরু কৃপা দীনে অধম অধীনে
অনন্ত অসীম স্বামী
নরাকারে নাথ করি কৃপাপাত
নামিলে মনত ভূমি
।।
ছিলে নিরাকার নিলে নরাকার
স্বরূপে সাকার হলে

আপনা আপনি নিগুণ হে গুণি

সগুণ সাজিয়া রলে
।।
রসে রসময় লীলা লালসায়
অসীম সাজিলে সান্ত

স্বাদিতে আপনে বিবিধ বিধানে
করুণ-কোমল-কান্ত

অসীম--সীমা সেথা তোমা আমা
পরিচয় নাই পাই

সীমায় সীমানা সেথা জানা-শোনা
বাধা বিঘ্ন বটে নাই
।।
ইচ্ছায় ঈশ্বর রচে চরাচর
সাকারে আকার ধরে

ভাগে ভগবান এক বহু হন
বহুধা বিভাগ করে
।।
নিজ-রস নিজে রস-লিপ্সু সেজে
পাণি পাতি করে পান

ভক্ত ভগবান ভিন্ন-ভাব ভাণ
নিয়ে করে নিজে দান
।।
যে-ঘটে যা ঘটে তোমাতে তা বটে
ঘট-কর্তা ঘটময়

তার হে তারক তাপিত তারক
মৃত্যুহারী মৃত্যুঞ্জয়

ওহে নিরাকার নিয়েছ আকার
নরের আকার ধারী

যুগে যুগে তুমি সাজি যুগ স্বামী
ধবারে ধরিলে হরি

ধ্যানে ধরাধর ধরণী-ধাতার
ধরমে ধরিলে ধরা

মৎস্য মহান গুণে গরীয়ান
উদকে উদ্ধার করা
।।

কুর্ম্ম-ক্রিয়া করি বদ্ধ করি বারি
জগতে জাগালে সুখে

বরি বর দেহ বিরাট বরাহ
দর্পহারী দন্তে মুখে
।।
নরের আয়ণ নাম নারায়ণ
বরিলে বামন দেহ

নর আর সিংহ সাজিলে নৃসিংহ
নারকীরে নাহি স্নেহ
।।
নাশিলে ক্ষত্রিয় পীড়িতের প্রিয়
জামদগ্নি অবতার

দূর্ব্বাদল-কান্তি দয়া, ক্ষমা, শান্তি
শ্রীরাঘব রঘুবর
।।
বেনু বাজে বনে গোপী মরে প্রাণে
যমুনা উজানে ধায়

রারা রবে রাধা মিছে চুল-বাঁধা
কলসী কক্ষেতে কয়
।।
শুন লো সজনি জলকে যাবি নি?
আঁধার আসিছে চুপে

সেত ছলা-কলা শুধু কথা বলা
মন-হারা কালো রূপে
।।
ফুরাল সে-অঙ্ক বেণূ হল শঙ্খ
আশঙ্কা অসুর-কুলে

কুরুক্ষেত্র রণে সুজন অর্জ্জুনে
বিশ্ব-রূপে দেখা দিলে
।।
থামিল তরঙ্গ লীলা হল সাঙ্গ
উত্তঙ্গ হিমাঙ্গ-পদে

রঙ্গের শিখরে গোমতীর শিরে
জনহীন জনপদে
।।
সেদিনে সদায় রক্তের রেখায়
মত্ত মানব দল

ছিনিমিনি ছলে অতি অবহেলে
বলহীনে বাধে খল
।।
অরুণ-অরুণ কোমল-করুণ
কম-কান্তি কৃপাময়

বুদ্ধ-মুর্ত্তি ধরে শুদ্ধোধন ধরে
রাজপুত্র রাজালয়
।।
প্রেম পবিত্রতা অহিংসা-বারতা
জানালে জগত-জনে

ভাই ভাই তাই ভিন্ন ভাব নাই
পরম পীরিত প্রাণে
।।
মায়ার মায়ায় সাগর শুকায়
মরুময় মর ধরা

তুলিলে তরঙ্গ সাজিলে গৌরাঙ্গ
নদীয়ায় নম-গোরা
।।
বেহালের বেশে দিলে দেশে দেশে
মধুমাখা হরিনাম

গলিল গৌরাঙ্গ ব্রজরাণী-অঙ্গ
মিশিল পুরুষোত্তম
।।
বুকের বেদনা কিছুতে শোধে না
সাধা সাধি হল সার

হলে হরিচাঁদ পূর্ণিমার চাঁদ

পরিপূর্ণ পারাবার
।।
যুগল চরণ রকত বরণ
রেশম বরণ কান্তি

চারু চন্দ্রানন সুদৃশ্য দশন
ঊন নহে এক ক্রান্তি

নিটোল কপোল বরণে ধবল
অমল মোহন জ্যোতিঃ
।।
রক্ত-রাগ শোভা আঁখি মনোলোভা
তরুণ অরুণ-ভাতি

দীর্ঘ দুই ভূজ বিশ্ব মনোসিজ
শাল-প্রাংশুবলি কহে

অতুলন ধন সে-ধন কখন
বচন-বাঁধনে রহে?

সুন্দর ললাট সুপ্রশস্ত তট
তিল ফুল জিনি নাসা

কেশদাম জিনি ফণীণী-নাগিণী
রাগিণী-কিঙ্কিণী-ভাষা
।।
ললিত-লোচন অরুণ-বরণ
ক্ষরিছে করুণা-ধারা

শীতলিয়া যায় করুণা ধারায়
জর-জর-জারা ধরা
।।
অতল সলিলে যথা মণি জ্বলে
দীনবেশে-ঢাকা হরি

রূপের মাধুরী দুনয়ন ভরি
হেরিয়া ঝুরিয়া মরি

শান্ত-সদানন্দ অসীম আনন্দ
প্রেমানন্দ-ময়-বিভু
।।
করহে করুণা দিয়ে কৃপা-কণা
পেতে যোগ্য নহি কভু
।।
চরণ শরণ আমি অভাজন
করিলাম করপুটে

আমার আমাকে দিয়াছি তোমাকে
রাখহে চরণ তটে
।।
গুরু মৃত্যুঞ্জয় যাঁর করুণায়
-ভাগ্য ঘটিল মোর

পদতটে তাঁর কোটি নমস্কার
অঞ্জলি নয়ন-লোর
।।
রচন-বচন শুধু অকারণ
কারণ-কারণ তুমি

মূঢ় মন্দমতি তাই গাঁথা গাঁথি
অবোধ অজ্ঞান আমি

অপরাধ ক্ষম প্রিয় প্রিয়তম মম
করিয়াছি অসম্ভ্রম

বিশ্বময় হরি দুঃখ তাপ-হারী
রাতুল চরণে নমঃ
।।
স্তব করি সে তারক পুনঃ পদে পড়ে

পুনরায় মৃত্যুঞ্জয় তারে তুলে ধরে
।।
প্রভু বলে রে তারক! সুস্থ হও এবে

বল দেখি ওড়াকান্দী এলে কিবা ভেবে?”
তারক কান্দিয়া কয় ওগো অন্তয্যামি

তৃণ হয়ে সিন্ধু বারি মাপিয়াছি আমি
।।
ঠাঁই নাই এবে দেখি আমি ভেসে যাই

দয়াকরে ধর মোরে এই ভিক্ষা চাই
।।
প্রভু বলে তাই হোক ধরিলাম তোরে

মিত্যুনে দেখাল পথ তারে ছেড়ে নারে
।।
যাও এবে দেশে চলি হয়োনা মলিন

তারক রে! তোর লাগি আমি যে জামিন
।।
হায়! হায়! করি সাধু পড়ে পুনর্ব্বার

ওহোরে দয়াল বন্ধু! বলে বারে বার
।।
এই ভাবে কৃপাদৃষ্টি লভিল তারক

নিজে মাতে আর সাথে মাতে কত লোক

হরি-কৃপাগুণে পেল অলৌকিক শক্তি

মন-প্রাণ করে সারা পদে অনুরক্তি
।।
সংক্ষেপে বলিব কিছু সেই পরিচয়

বিস্তৃত বলিতে গেলে পুথি বেড়ে যায়
।।
মৃত্যুঞ্জয় পদে বসি শাস্ত্র শিখি নিল

এব শুন কবিগানে কিসে শ্রেষ্ঠ হল?
ধন্য সে তারকচন্দ্র হরি-প্রিয় যিনি

পদে দন্ডবৎ করি লোটায় ধরণী
।।

 

তৎ কৃপৈব কেবলম্


প্রভুর দয়ার গুণে বলিহারি যাই

কৃপা-গুণে শ্রীতারক সাজিল গোঁসাই
।।
পিতৃ-ব্যবসায় তাঁর ছিল কবিগান

মনে ইচ্ছা সেই পথে করিবে প্রয়াণ
।।

 

তাহে বিধি বাদী হল কন্ঠে নাহি সুর
গান-ক্ষেত্রে গেল সবে করে দুর দুর
।।
মনের বেদনা সাধু সহিবারে নারে

মৃত্যুঞ্জয় পদে সব নিবেদন করে
।।
গোস্বামী বলিল তারে শুনহে তারক

দয়াময় হরিচাঁদ বেদনা হারক
।।
সেই পদে মনোব্যথা জানাও সত্বরে

অবশ্য গুচিবে ব্যথা বলিনু তোমারে
।।
আজ্ঞামতে সে তারক ওড়াকান্দী গেল

মনের বেদনা সব প্রভুকে জানা
।।
প্রভু বলে রে তারক কোন চিন্তা নাই

আমি যাহা বলি বাপু! তুমি কর তাই
।।
হাটে হাটে দেখে সবে দূর করে মোর
।।
একার্য্য করিলে তুমি ফলিবে সুফল

গলিবে তোমার বাক্য পাষাণেও জল
।।
শ্রীনাথের বাণী শুনি তারক কান্দিল

সাষ্টাঙ্গ প্রণমি তবে শ্রীপদ বন্দিল
।।
প্রভু-আজ্ঞা মনে কার্য্য করিল সুধীর

কন্ঠে সুর হল তাঁর মধুর গম্ভীর
।।
পরে যত গান কবে সেই মহা সাধু

সবে বলে শুনিলাম মধু হতে মধু
।।
তৎ কৃপৈর কেবলং সর্ব্ব আশা সার

কবি কহে হরি বিনে বন্ধু নাহি আর
।।

 

শ্রীহরি-চূড়াগোস্বামী তারকচন্দ্র


ধন্য কবি শ্রীতারক কহে সর্ব্বজনে

দেশে দেশে সবে সবে গানের কারণে
।।
একবার ডাক হল ঢাকার জিলায়

মনে মনে তারকের হল কিছু ভয়
।।
অভয় চরণ-ধারী প্রভু হরিচন্দ্র

উপনীত প্রদপ্রান্তে সে তারকচন্দ্র
।।
মনে মনে বলে কথা মুখে নাহি ফুটে

প্রভু কয় তারকের বুন্ধি নাহি মোটে
।।
ঢাতাত বাড়ীর কাছে যাকনা পাবনায়

প্রেমে পুলকিত তনু কহিল তারক

অন্তর্য্যামী দয়াময় ভূভার-হারক

মনে ভয় সর্ব্বদা কিসে কিবা করি?
সকলি তোমার দয়া বুঝিনু শ্রীহরি

যেথা যাই দয়াময়, তাতে ভয় নাই

মনে ভয় কর্ম্মদোষে তোমারে হারাই
।।
শ্রীমুখে যখনে প্রভু করিলে স্বীকার

গিয়াছে সকল দুঃখ ভয় নাই আর
।।
এত বলি দন্ডবৎ করিল চরণে

অতঃপর উপনীত শান্তিমাতা স্থানে
।।
প্রণাম করিয়া বলে ওগো লীলাময়ি

রাতুল চরণে মাতাঃ নত-শির হই
।।
ঢাকা যাব গান গাব এ বাসনা মনে

দয়া করে দয়াময়ী দেখিও নয়নে
।।
মাতৃ-শক্তি বিনা পুত্রে কোথা পাবে বল?
তাতে আমি ভক্তিহীন চক্ষে নাহি জল
।।
দয়াময়ী জননীগো কৃপা নেত্রে চাহ

চলেচি ঢাকার পথে অনুমতি দেহ
।।
তারকের বাণী শুনি হাসিয়া জননী

স্নেহ করে বলে তারে শুন গো বাছনি
।।
ঢাকায় চলেছ তুমি আমি তাহা জানি

সেথা হতে মোর লাগি শাখা এন কিনি
।।
জানি আমি ভাল শাঁখা ঢাকায় শহরে

এক জোড়া কিনে এনে দাও তা আমারে
।।
যাও ঢাকা বলিলাম কোন ভয় নাই

বারে বারে বলি কিন্তু শাঁখা আনা চাই
।।

 

 

 

বালিকার মত মাতা আব্দার জানায়
আঁখি ঝরে তারকের বক্ষ ভেসে যায়

দন্ডবৎ করি যাত্রা করে মহাশয়

নির্দিষ্ট তারিখে হল ঢাকায় উদয়
।।
বহু লোক সমারোহ গানের খেলায়

তারক বসিয়া কান্দে একা নিরালায়
।।
আরোপে দেখিল শীরে শ্রীহরি ঠাকুর

মনে এল দৃঢ় শক্তি শঙ্কা হল দূর
।।
বিপক্ষ নায়ক যিনি কবি সরকার

গানে, শাস্ত্রে সর্ব্বভাবে বহু শিক্ষা তার
।।
মনে মনে ছিল তাঁর গর্ব্ব অতিশয়

নিশ্চয় তারকচন্দ্রে দিবে পরাজয়
।।
বিষেশত বিদেশেতে আর শক্তি কম

আজি তার ভাগ্যে পরাজয় একদম
।।
কিন্তু যারে শক্তি দেছে নিজে শক্তিময়

কোন শক্তি কিসে তারে করে পরাজয়?
পর্ব্বতের গাত্রে যদি লোষ্ট্রাঘাত হয়

পর্ব্বত অচল রহে লোষ্ট্র হয় ক্ষয়
।।
এক্ষেত্রে তেমনি হল গানের আসরে

অন্যপক্ষে সরকার পদে পদে হারে
।।
তারকের দলে ছিল প্রবীণ দোহার

সূর্য্য নারায়ন আর ভোলা সাথে তাঁর
।।
উভয়ের কন্ঠে যেন পিকরাজ যিনি

সভা শুদ্ধ হল মুগ্ধ সেইস্বর শুনি
।।
সুরের মুর্চ্ছনা যেন ভেদিল আকাশ

নীরব সভার লোক নীরব বাতাস
।।
পাঁচালী বলিতে যবে উঠে শ্রীতারক

মুখ পানে চেয়ে থাকে সভাশুদ্ধ লোক
।।
একেত গোরাঙ্গ কায় নবীন বয়স

তাহাতে রচনা তাঁর অতীব সরস
।।
থরে থরে কথা যেন মুক্ত সম ঝরে

যেই শুনে বক্ষ ভাসে নয়নের নীরে
।।
এই ভাবে সারা রাতি গানের আসরে

মন্ত্র-মুগ্ধ মত থাকে যত নারী নরে
।।
এমনি হইল দশা অত্যাশ্চর্য্যময়

বিপক্ষে নায়ক যবে আসিল সভায়
।।
সবে বলে, “শ্রীঘ্র তুমি সেরে যাও

অপর দলের গান শুনিবারে দাও
।।
গর্ব্ব গেল হত মান হল সরকার

চুপ করি রহে বসি মুখ অন্ধকার
।।
অহং চুর্ণদীনবন্ধু যাঁর সাথে রয়

তাঁরে ব্যথা দিলে গেলে ব্যথা পেতে হয়
।।
এই ভাবে রাত্রি গেল ঊষার উদয়

এবে শুন কি ঘটনা ঘটিল তথায়?
প্রভাতে তারক একা মাঠ মধ্যে যায়

মলত্যাগ করিবার ইচ্ছা মনে রয়
।।
কিশোর রাখাল এক আসি হেনকালে

পথ আগুলিয়া কথা তারকেরে বলে
।।
শুন শুন মহাশয় আমার বচন

কল্য রাত্রে তব গান করেছি শ্রবণ
।।
সব কথা শুনিয়াছি তাতে ভুল নাই

একটি কারণ আমি বুঝিয়া না পাই
।।
তুমি যবে কথা বল গানের আসরে

ক্ষুদ্র এক শিশু দেখি তব শিরোপরে
।।
সেই শিশু বল কেবা তব সঙ্গে রয়?
এখনে তাহারে রাখি আসিলে কোথায়?”
কিশোর কহিছে কথা শুনেছে তারক

রাখালের অঙ্গে খেলে রূপের ঝলক
।।
আশ্চর্য্য মানিয়া সাধু ভাবিছে তখন

এ বালক রাখালত নহে কদাচন
।।
ব্রজের বালক এই রাখালের রাজা

ব্রহ্মা বিষ্ণু সবে করে যাঁর পদ পূজা
।।
সেরূপ ছাড়িয়া এবে আছে ওড়াকান্দী

সেয়েছিত ছাড়িব না রাখি করে বন্ধী
।।

 

এত ভাবি বাহুড়িয়া ধরিবারে যায়
অকস্মাৎ সে রাখাল বাতাসে মিলায়
।।
কান্দিয়া তারক তবে ভুমে পড়ে লুটী

বলে হায়! দয়াময় এসেছিল খাঁটি
।।
ওড়াকান্দী বসে প্রভু বলিল আমারে

তোর সাথী আছি আমি ভয় কি অন্তরে?
অলক্ষ্যে রয়েছে প্রভু ভাবিয়াছি তাই

প্রত্যক্ষে রয়েছে সাথে তাহা দেখি নাই

তোমার দয়ায় প্রভু কোটি দন্ডবৎ

অজ্ঞান অবোধ আমি বড়ই অসৎ
।।
গান শেষ করি পরে কিনিলেন শাখা

পর দিনে ত্যাগ করি চলিলেন ঢাকা
।।
ওড়াকান্দী উপনীত হইলেন যবে

প্রভু বলে কি তারক! ছিলে কোন ভাবে
।।
রাখালে বান্ধিতে তুমি নাহি পাও দিশে

রাখালে তালাস কর ওড়াকান্দী এসে
।।
প্রভুর বচন তবে তারক কান্দিল

আদ্যোপান্ত সে বৃত্তান্ত প্রভুকে কহিল
।।
প্রভু বলে সব জানি তবু তব ঠাঁই

শুনিলে সে সব কথা বহু সুখ পাই
।।
অতঃপর অন্তঃপুরে উদয় তারক

জননী আসিল ছুটে হইয়া পুলক
।।
শাঁখা দেও শাঁখা দেওবলে বারে বার

তারকের দুনয়নে বহে অশ্রুধার
।।
বাহির করিল শাঁখা জননী পরিল

অপরূপ সাজ যে জননী ধরিল
।।
পরে তাহা দেখি প্রভু তারকেরে কয়

লহ্মীরে করিলে দান ধনবৃদ্ধি হয়
।।
শ্রীমুখের বাক্য প্রবু না হ;য় বিফল

ক্রমে ক্রমে তারকের হল ধন বল
।।
যাবৎ জীবিত ছিল তারক গোঁসাই

শাঁখা দিতে কোনমতে ভুল করে নাই
।।
করুণা রূপিণী লহ্মী শান্তি মাতা হ

প্রভুর আজ্ঞাতে ভক্তে বহু ধন দিল
।।
তারকের শিরে দেখি শিশুরূপী হরি

গেল দীন কহে দীন কর্ম্মদোষে মরি
।।

 

হরিভক্তে বাসে ভাল সর্ব্ব দেবতায়


ধন্য শ্রীতারকচন্দ্র সাধু শিরোমণি

যাঁর শিরে হরিচাঁদ প্রেম-রস-খানি
।।
অপূর্ব্ব তাঁহার কীর্ত্তি শুন সর্ব্ব জন

কালীমাতা করে কৃপা স্নেহের কারণ
।।
লহ্মীপাশা কালীকাতা সবে জানে কথা

বহু পুরাতন তাহে জাগ্রত দেবতা
।।
নবগঙ্গা নদীতীরে প্রকান্ড মন্দির

বরাভভ মুর্ত্তি সেখা দাঁড়াইয়া স্থির
।।
মন্দিরের গাত্রে লেখা যাহা পরিচয়

জনশুতি তাহা ভিন্ন অন্য কথা কয়
।।
পরিচয়-পত্রে শব্দ খেলা অনুমান
।।
সেই জন্য জনশ্রুতি মানিব প্রধান

রামদাস সাধু যিনি মৈথিলিী ব্রাহ্মণ

শ্রীহরির পূর্ব্ব পুরুষ সেই মহাজন
।।
লহ্মীপাশা বাস করে সেই মহাশয়

তাঁহার সমাধি পরে এ মন্দির হয়
।।
হরিলীলামৃত গ্রন্থে আছে বিবরণ

স্বহস্তে তারকচন্দ্র করেছে লিখন
।।
জনশ্রুতি ইতিহাস দোঁহে মিলি কয়

এ সিদ্ধান্ত সত্য তাই লিখিনু হেথায়
।।
মন্দিরে গাত্রে লেখা কামদেব নাম

ভাবে বুঝি ইনি রামদাস গুণধাম
।।
বহু কাল পরে যবে লিখেছে লিখন

রাম সাজে কাম” “দাস” “দেবে নিমগন
।।

 

এগার পঁচিশ অঙ্ক লেখে অনুমান
সেই কালে রামদাস ছিল অধিষ্ঠান
।।
তাতে বলি মন্দিরের গ্রাত্রে যাহা লেখা

আক্ষরিক সত্য তাতে নাহি যায় দেখা
।।
যাহোক তাহোক এই মানিলাম সার

মন্দির নির্ম্মিত হল সমাধি উপার
।।
এবে শুন কালীমাতা কি কার্য্য করিল

দেশবাসী সবে সেই কথা জানে ভাল
।।
একদা শাখারী এক এল লহ্মীপাশা

বহু অর্থলাভ হবে মনে করে আশা
।।
মন্দিরেতে গিয়া তেঁহ প্রণাম করিল

লাভশায় মার কাছে, মানত মানিল
।।
পরে গ্রামে মধ্যে সেই ব্যক্তি চলে গেল

এবে শুন পূর্ব্বে কোন ঘটনা ঘটিল
।।
তারক গানের লাগি যেতে চায় ঢাকা

শান্তি দেবী মাগিলেন তার কাছে শাঁখা
।।
ঢাকা হতে সে তারক শাঁখা এনেছিল

শান্তিদেবী সেই শাঁখা শ্রীহস্তে পরিল
।।
ক্ষীরোদ-বাসিনী দেবী শাঁখা পরে হাতে

কৈলাস-বাসিনী তবে ভাবিলেন চিতে
।।
মাতারে দিয়াছে শাঁখা তারক সুজন

আমি বা বঞ্চিত তাতে হব কি কারণ?
মাতৃ-ভক্ত সে তারক আমি জানি মনে

ক্ষীরোদ-বাসিনী পুত্র একা নিবে কেনে?
শ্রীহরির প্রিয়জন মোদের আত্মীয়

আদরের ধন সে যে প্রিয় হতে প্রিয়
।।
মাতা তারে কৃপা করে আমি কিবা করি?
মনে হয় তারকের অন্যারূপ ধরি
।।
তাহলে আদর মোরে করিবে তারক

শাখা পাব বস্ত্র পাব পাইব পুলক
।।
এই ইচ্ছা দয়ামীয় করিলেন মনে

কিছু পরে সে শাঁখারী আসিল সেখানে
।।
শাঁখারী দেখিয়া মাতা ইচ্ছা করে মনে

তারকে করিবে দয়া মাতা সেই দিনে
।।
শাঁখারী মানৎ করে দেবী তাহা শোনে

তথাস্তুবলিলা দেবী আপনার মনে
।।
গ্রাম মধ্যে সে শাঁখারী পশিল যখনে

ঘরে ঘরে খরিদ্দার হল সর্ব্ জনে
।।
নিমেষের মধ্যে তার বিক্রী হল সারা

ভাব দেখে সে শাঁখারী যেন বাক্য-হারা
।।
দ্রুতগতি পুনরায় নৌকায় আসিল

পুনরায় দ্রব্য লয়ে গ্রামেতে ছুটিল
।।
মন্দিরের কাছে গিয়ে হইল স্মরণ

মায়ের কৃপাতে হল লভ্য অগণন
।।
পুনরায় মন্দিরেতে পাশিল শাঁখারী

প্রণাম করিছে সেথা বহুক্ষণ ধরি
।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু যাঁর মায়া বুঝিতে না পারে

সেই মায়াময়ী এল কন্যারূপ ধরে
।।
লাল চেলি পরিধানে এলায়িত কেশ

আলো-করা কালোরূপে ডুবে গেছে দেশ
।।
মলিন বদন যেন আঁখি ছল ছল

কাঙ্গালীনী সাজে মাতা দিয়ে মায়া-জাল
।।
শাঁখারী প্রণাম করি উঠিল দাঁড়ায়

দেখে কালো মেয়ে এক বসেছে তখায়
।।
মিটি মিটি কালোরূপে দিতেছে ঝলক

শাঁখারী দাঁড়ায়ে দেখে পড়ে না পলক
।।
কালো মেঘ কালে যেন সৌদামিনী হাসে

হাসিয়া জননী তারে বলে মৃদুভাষে
।।
শুন গো শাঁখারী তুমি আমি যাহা কই

আমি বটে তারকের প্রিয়-কন্যা হই
।।
বড় সাধ মনে মোর শাঁখা পরিবারে

এক জোড়া শাঁখা তুমিদিয়ে যাও মোরে
।।
শাঁখারী বলিল মাগো বলিয়াছ ভাল

শাঁখা দিলে দাম তার কেবা দিবে বল?

তোমার পিতার নাম বলিল তারক
আমত চিনি না মাগো সেই কোন লোক
।।
হাসিয়া দেখাল দেবী অই দেখা যায়

নদীর ওপারে মোর পিতার আলয়
।।
তুমি যদি মোর আগে যাও সেই বাড়ী

কোথায় রয়েছে টাকা বলে দিতে পারি
।।
গৃহ মধ্যে ঝাঁপি আছে ঢাকনীতে ঢাকা

তার মধ্যে পিতা মোর রাখিয়াছে টাকা
।।
বহুদিন তার মধ্যে রাখিয়াছে পিতা

মনে হয় তার মনে নাহি সেই কথা
।।
এ ভাবে বলিলে পিতা দিয়া দিবে দাম

শ্রীঘ্র শাখা দেও তুমি মায়া মোর নাম
।।
ঈশ্বরী যে ইচ্ছা করে কেবা বাধা দেয়

শাখারী ভুলিয়া গেল দেবীর কথায়
।।
সযতনে দুই হাতে পরাইল শাঁখা

দেবীর বদনে খেলে বিদ্যুতের রেখা
।।
পরশনে শাঁখারীর কর্ম্ম-বন্ধ ক্ষয়

সংসার আসর মনে সেই ভাব হয়
।।
শাঁখা বেচা টাকা নেয়া সব যেন ফাঁকি

প্রাণ তার কেন্দে কেন্দে ওঠে থাকি থাকি
।।
মাতারে ডাকিয়া বলে শুন গো জননী

তোমার গৃহেতে আমি যাইব এখনি
।।
মোর সাথে চল তুমি নাহি কর দেরী

আমার কি হল তাহা বুঝিতে না পারি
।।
মনে শুধু বলে যাই তারকের বাড়ী

মোর সাথে চল মাতা চল তাড়াতাড়ি
।।
মায়াময়ী ছল করি বলিলেন কথা

শাঁখারী বুঝিবে কিবা যাহা বলে মাতা
।।
অগ্রভাগে তুমি যাও পার-ঘাটে

দেবীর মন্দিরে পূজা দিব আমি বটে
।।
পূজা সারি পরে আমি যাব নিজ ঘরে

অপেক্ষা করহ কিছু নদীর কিনারে
।।
কথা শুনি সে শাঁখারী নদী তীরে যায়

অপেক্ষা করিল সেথা কতক সময়
।।
এক দ্বার মন্দিরের অন্য দ্বার নাই

দ্বার প্রতি লক্ষ্য করে রয়েছে সদাই
।।
কই কোথা কেহ নাই কেহ না আসিল

শাঁখারী ভাবিল বুঝি মেয়ে ফাকি দিল
।।
পুনরায় মন্দিরেতে করিল প্রবেশ

সেথা নাই মানবের কোন গন্ধ-লেশ
।।
আশ্চর্য্য মানিয়া চলে সেই যে শাঁখারী

শ্রীঘ্র গতি উপনীত তারকের বাড়ী
।।
দেখিল তারক বসি করে আলাপন

নবীন বয়স যেন গৌরাঙ্গ বরণ
।।
ধীরে ধীরে উপস্থিত তারকের ঠাঁই

বলে এক কথা আমি বলিবারে চাই
।।
মায়া নামে তব কন্যা মন্দিরের ধারে

এক জোড়া শাঁখা নিল আমার গোচরে
।।
তব ঠাঁই পাঠাইল দামের কারণ
।।
দয়া করি মোরে দাম দাও মহাজন
।।
শাঁখারীর কথা শুনি হাসিল তারক

বলে মোরে তুমি নাকি পেয়েছ বালক?
কন্যা বলি বল কারে কন্যা মোর নাই

বিবাহ করিনি তার কন্যা কোথা পাই?
অনুমানে বুঝি তোমা ঠকায়েছ কেহ

শুনিয়া তোমার কথা আমার সন্দেহ
।।
কথা শুনি শাঁখারীর মুখে কথা নাই

বলে তার প্রমাণাদি আমি দিতে চাই
।।
শাঁখা নিয়ে কন্যা তব বলিয়াছে কথা

নিশ্চয় তোমারে দাম দিবে মোর পিতা
।।
টাকা জন্যেতে যেন চিন্তা নাহি করে

ঘরের মঘ্যেতে টাকা ঝাঁপির ভিতরে
।।
বহু দিন রাখা-টাকা তব মনে নাই

সত্য কিংবা মিথ্যা তুমি খুঁজে দেখ তাই
।।

এই মত কথা যদি বলিল শাঁখারী
মনে মনে সে তারক উঠিল শিহরি
।।
কোন কথা নাহি বলি গৃহ মধ্যে যায়

ঝাঁপির মধ্যেতে দেখা টাকা বাঁধা রয়
।।
আশ্চর্য্য মানিয়া সাধু আসিল বাহিরে

বারেবারে শাঁখারীরে নিরীক্ষণ করে

পরে বলে শুন ভাই মিত্যঅ বল নাই
।।
কন্যা মোর কোথা গেল বল দেখি তাই
।।
শাঁখারী বলিল তাঁরে সকল ঘটনা

হায়! হায়! করি কান্দে তারক রসনা
।।
শাঁখারীরে ডেকে কবে ওরে ভাগ্যবান

এমন জননী পেয়ে ছেড়ে দিলে কেন?
চল চল শ্রীঘ্র চল মন্দিরেতে চল

স্বচক্ষে দেখিতে পাবি নিজ কর্ম্মফল
।।
এস্তে ব্যাস্তে দুইজনে গেলে নদী পার

দ্রুত গতি গেল দোঁহে মন্দির ভিতর
।।
দেখে নব শঙ্খ শোভে মায়ের শ্রীকরে

শাঁখা দেখি সে শাঁখারী বলে উচ্চেঃ স্বরে
।।
ঐ শাঁখা পরায়ে আমি দিছি তার হাতে

সে যে কন্যা এ যে মাটি সম্ভব কি মতে?”
কান্দিয়া তারক বলে ওরে ভাগ্যবান

স্বচক্ষে দেখিল মাতা তবু সন্দিহান?
মাটী-মূর্ত্তি শঙ্খ যদি করেন ধারণ?
অঙ্গুলির পরে তারা করেন গ্রহণ
।।
এ যে দেখ হস্ত-কন্ঠে শোভিছে সুন্দর

প্রত্যক্ষ দর্শণ তুমি কিবা চাই আর?
ধন্য তুমি জগন্নাতা দেখিলে নয়নে

শত কোটি দন্ডবৎ তোমার চরণে
।।
এত বলি সাধু তার পদে গড়ি যায়

শাঁখারী কান্দিয়া পড়ে তারকের পায়
।।
কেন্দে কেন্দে বলে তাঁরে ওগো মহাজন

মাতাকে দেখিুন শুধু তোমার কারণ
।।
তোমাকে করেছে দয়া দয়াময়ী শ্যাম

বত গুণে দেখিলাম হর-মনোরাম
।।
নয়নের ঘোর মোরে কেটেছে এখন

তুমি মম গুরু মোরে দেহ গো চরণ
।।
অনেক বলিয়া তাঁরে তারক শান্তায়

ব্যবসায় ফেলে পরে গৃহে চলে যায়
।।
সেই হতে তার মন হইল উদাসী

গৃহ ছেড়ে চলে গেল হইল সন্ন্যাসী
।।
এ দিকেতে রাত্রিকালে তারক দেখিল

স্বপ্ন-ঘোরে মাতা তারে আপনি কহিল
।।
তব কন্যা পরিচয় শাঁখা লইয়াছি

এই শাঁখা চিরকাল তব ঠাঁই যাচি
।।
স্বপ্নাদেশে যে আদেশ তারক পাইল

আপন জীবনে যাহা সর্ব্বদা পালিল
।।
চিরকাল ঢাকা হতে শাখা এন দেয়

ওড়াকান্দী লহ্মীপাশা এই দুজাগায়
।।
হরি ভক্তে ভালবাসে সর্ব্ব দেবতায়

হরি-ভক্ত-পদ-রজঃ মহানন্দ চায়
।।

 

তারক-ভাগবত


শ্রীহরিচাঁদের কৃপা যাঁর পরে রয়

অসাধ্য তাঁহার কিছু নাহিক ধরায়
।।
শ্রেষ্ঠ কবি বলে হল তারকের নাম

দেশে দেশে সবে তাঁরে ডাকে অবিরাম
।।
বাহ্মণ পন্ডিত কিবা রাজার সভায়

বহু শাস্ত্র-বেত্তা বলি তাঁর পরিচয়
।।
এবে কহি সর্ব্ব জনে অপূর্ব্ব ঘটনা

করিল অপূর্ব্ব লীলা তারক রসনা
।।
নড়াইল রাজবাড়ী কবির আসরে

ব্রাহ্মণ পন্ডিত বসে সভা শোভা করে
।।
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free