পৃষ্ঠাঃ ৫৪১-৫৬০
ভারত শাসন নীতি হ’ল আলোচনা।
সকল শুনিয়া পরে করে বিবেচনা।।
বাদ প্রতিবাদ বহু সেই স্থলে হয়।
যার যার স্বার্থ মত সেই কথা কয়।।
যৌথ নির্বাচন দাবী করিল কংগ্রেস।
সংখ্যাল্পে মুসলমান তা’তে করে দ্বেষ।।
পৃথক ভোটের দাবী তাহারা করিল।
সেই ভাবে ভোট প্রথা প্রবর্তিত হ’ল।।
পূর্বে যত অনুন্নত ছিল সম্প্রদায়।
তপশীলী বলি তারা এবে আখ্যা পায়।।
আইন সভার মধ্যে তা’দের লাগিয়া।
বিভিন্ন আসন দিল নির্দিষ্ট করিয়া।।
তাহা দেখি মহাত্মাজী উপবাস করে।
ইচ্ছা করে দেহত্যাগ করিবার তরে।।
“উন্নত কি অনুন্নত সবে মোরা হিন্দু।
ইহাদের মধ্যে ভেদ নাহি এক বিন্দু।।
দুর্বুদ্ধি করিয়া ভাগ ইংরাজে করিল।
আজ হ’তে হিন্দু বুঝি ধ্বংস হ’য়ে গেল।।”
এত ভাবি উপবাস করে মহাশয়।
তাহা দেখি হিন্দু সবে জুটিল পুণায়।।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত যায়।
বলেন প্রধানমন্ত্রী “আপত্তি না রয়।।
সবে মিলে এক হ’য়ে যদি কিছু কও।
বাধা কিছু নাহি যাহা চাও তাই পাও।।”
ভারতে যতেক হিন্দু মিশিল পুণায়।
আপোষে আসন সংখ্যা ঠিক করি লয়।
এক সঙ্গে ভোট হ’বে হ’ল নিরূপণ।
ভোট দিতে ভাগ নাহি হ’বে হিন্দুগণ।।
বঙ্গদেশে দশ ঠিক করিল ইংরাজ।
পুনরায় তিরিশ দিল হিন্দুর সমাজ।।
সমস্ত ভারতবর্ষে তপশীলী যত।
আসনের সংখ্যা বেশী পেল এত মত।।
মহাত্মা গান্ধীর কাছে আসন ব্যাপারে।
তপশীলী সবে ঋণী ভারত মাঝারে।।
এবে শোন কিবা দেয় ভারত আইনে।
উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ অব্দে রাজার বিধানে।।
গোল টেবিলেতে যাহা হ’ল নিরূপণ।
পার্লামেন্টে গেল তাহা পাশের কারণ।।
বহু স্থানে বহু ভাবে হ’ল সংশোধন।
পরিশেষে “শ্বেতপত্র” করিল মুদ্রণ।।
“ভারত আইন” নামে হ’ল পরিচয়।
যার বলে অদ্যাবধি শাসন চালায়।।
দুই পরিষদ হ’ল বড় প্রদেশেতে।
মনোনয়ন বর্জন হ’ল নিম্ন খাতে।।
উচ্চ পরিষদে সব পূর্বের আকার।
নির্বাচন মনোনয়ন বিভিন্ন প্রকার।।
নব প্রবর্তিত হ’ল একটি নিয়ম।
কোনক্রমে নাহি হয় তার ব্যতিক্রম।।
প্রতি তিন বর্ষ পরে উচ্চ পরিষদে।
এক তৃতীয়াংশ সভ্য ত্যাগ করে পদে।।
নিম্ন পরিষদে আয়ু পঞ্চবর্ষ জানি।
নির্বাচন প্রথা মতে সভ্য আনে টানি।।
লাটের সদস্য বলি কোন সভ্য নাই।
“রক্ষিত” “হস্তান্তরিত” ভাগ নাহি পাই।।
মন্ত্রীগণে চালাইবে সমস্ত বিভাগ।
লাটের ইচ্ছায় তারা করে পদত্যাগ।।
আর এক ভাবে বটে পদত্যাগ হয়।
অনাস্থা প্রস্তাবে যদি বেশী ভোট রয়।।
আপাততঃ দেখা যায় দেশবাসী সবে।
শাসকের ভার যেন পে’ল সর্বভাগে।।
কিন্তু পরীক্ষায় তাহা প্রমাণ না হয়।
ইংরাজের হাতে শক্তি পুরাপুরি রয়।।
কিবা পরিষদ কিবা যত মন্ত্রীগণ।
লাট বাধ্য নহে কভু কাহার সদন।।
শাসনের পক্ষে যদি তার মনে হয়।
অনায়াসে শাসনের ভার হাতে লয়।।
কিংবা কোন আইনের প্রয়োজন হয়।
পাশ করে নিতে পারে লাট মহোদয়।।
কিংবা পারিষদ যদি কিছু পাশ করে।
ইচ্ছা হ’লে লাট তাহা বাদ দিতে পারে।।
এমন বিস্তৃত শক্তি আছে বটে লেখা।
প্রায় কালে ব্যবহার নাহি যায় দেখা।।
প্রায়শঃ মন্ত্রীরা যাহা করে নিরূপণ।
লাট মহোদয় তাহা করে সমর্থন।।
প্রাদেশিক শাসনের এই পরিচয়।
কেন্দ্রীয় শাসন পন্থা বলি এ সময়।।
প্রাদেশিক স্ব-শাসনে স্বাধীনতা পা’বে।
কেন্দ্রীয় নীতির তলে সকলেই র’বে।।
প্রত্যেক প্রদেশ হ’তে বিভিন্ন সংখ্যায়।
কেন্দ্রীয় পরিষদে সভ্য নির্বাচিত হয়।।
ভারতের বুকে যত সামন্ত নৃপতি।
অথবা করদ বন্ধু করিছে বসতি।।
কেন্দ্রীয় শাসন চক্রে আসিবারে পারে।
কা’রে নাহি নে’য়া হবে শুধু জোর করে।।
“ফেডারেশন” নামে তার হ’বে পরিচয়।
আজিও ভারতে তাহা প্রচারিত নয়।।
“শ্বেতপত্র” দেখি যত কংগ্রেসের নেতা।
তারা বলে “ইংরাজেরা রাখে নাই কথা।।
ফাঁকি দিয়ে চোখে ধূলা দিতে চায় আজ।
দেখা যাক কোন ভাবে করে কোন কাজ।।
মিলিত হও রে ভাই কংগ্রেসি সকল।
যত পার সভ্য পদ কররে দখল।।”
এগার প্রদেশে যবে হ’ল নির্বাচন।
সাত দেশে কংগ্রেসিরা হ’ল অগণন।।
দাবী নিয়ে লাট সঙ্গে হ’ল প্রতিবাদ।
সপ্ত দেশে “ভারত আইন” হ’ল বাদ।।
অসহযোগের ফলে হ’ল আন্দোলন।
তার ফলে হ’ল নীতি “ভারত শাসন”।।
সংক্ষেপে লিখেছি আমি সেই পরিচয়।
মূলসূত্রে গ্রন্থ বার্তা বলি এ সময়।।
অসার সংসার
ধরিয়া মানব রূপ, নরাকারে বিশ্বভূপ,
নরাকারে করে নরখেলা।
নর-চক্রে ইহা করে, ঐশ চক্রে রাখে ধরে,
ধরা পরে করে যত লীলা।।
আপনি গৃহস্থ সাজি, গৃহ ধর্মে হ’য়ে রাজী,
আদর্শ দেখা’ল জনে জনে।
ক্রমে ক্রমে দিন যায়, জীবনের বেলা হায়!
যেতে চায় আঁধারের পানে।।
মনে মনে সমাচার, পেল প্রভু মহেশ্বর,
ত্রিদিবে কাঁদিছে দেবগণ।
ছাড়িয়া ধরার খেলা, মিলা’তে দেবের মেলা,
মনে মনে করে আয়োজন।।
পুত্র রূপে যারা এল, সকলেরে পাঠাইল,
নিজে প্রভু রহিলেন পাছে।
পতি পদে নিষ্ঠা মতি, সত্যভামা স্বয়ং সতী,
পতি মুখ চেয়ে বটে আছে।।
মহাপ্রভু এ সময়, দূরে কোথা নাহি যায়,
ভক্তসহ রহে মনোরঙ্গে।
ব্রহ্মচারী চারিজন, গুরুপদে দিয়ে মন,
সর্বদায় রহে প্রভু সঙ্গে।।
কে কে চারিজন হয়, শুন তার পরিচয়,
ইহা ভিন্ন আর বহু ছিল।
শ্রীনব কুমার রায়, “ঠাকুর” উপাধি কয়,
ইহা মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হ’ল।।
দীনবন্ধু যার নাম, কাশীয়ানী গ্রামে ধাম,
সরল সহজ সাধু জানি।
সে নীলরতন রায়, পূর্বে যার পরিচয়,
শিয়ালীতে হ’ল জানাজানি।।
নেপাল নামেতে যিনি, সরল সহজ জানি,
ওড়াকান্দি রহে সর্বক্ষণ।
শ্রীনব কুমার রায়, কাছে থাকে সর্বদায়,
বহু কীর্তি করিল দর্শন।।
এ চারিজনের সাথে, আলাপন দিবা রাতে,
করে প্রভু আপনার ভাবে।
কভু সবে ভালোবাসে, কভু মহারোষে রোষে,
মনে হয় এখনি নাশিবে।।
সংসার অসার কহে, বলে “আর নহে, নহে,
আর নাহি ধন কিছু চাই।
পাইয়াছি বহু ধন, আর নাহি চাহি ধন,
এখানে সব ধন ছাই।।”
নিদ্রা মোটে নাহি যায়, “অতন্দ্র” বসিয়া রয়,
ডাক দিয়া বলে সকলেরে।
“খড়গ হস্তে উগ্রচণ্ডা, বাম করে ধরে খাণ্ডা,
রাত্রি ভরে জীব হত্যা করে।।
যে জন ঘুমায়ে রয়, তার রক্ষা নাহি রয়,
খড়গে তারে কাটে উগ্রচণ্ডা।
যে জন জাগিয়া রয়, তার আর কিসে ভয়,
তারে নাহি কাটে কোন খাণ্ডা।।
সামাল সামাল তাই, নিদ্রাহীন থাকা চাই,
কাল নিদ্রা “কাল” ডেকে আনে।
যে জন রহিবে জেগে, কোন তাপে কোন রোগে,
তারে কভু ছোঁবে না মরণে।।”
মাঝে মাঝে প্রভু কয়, “প্রমথ আসিলে হয়,
তার লাগি’ আছি মাত্র বসে।
আগে যদি চলে যাই, আসিয়া প্রমথ ভাই,
মোরে বলে কাঁদিবে যে শেষে।।”
সংসারের আলাপন, নাহি করে দিয়ে মন,
প্রেমালাপ করে দিবারাতি।
যারে দেখে তারে কয়, “শোন শোন মহাশয়,
কোন ভাবে করে নমঃ জাতি।।
কুরুচি, কুনীতি যত, বলে প্রভু অবিরত,
পরে বলে বহু দুঃখ ভরে।
সমস্ত জীবন ভরে, বলিলাম ঘরে ঘরে,
তবু এই জাতি নাহি সারে।।”
দিবারাতি শোনে গান, যখনে যেখানে যা’ন,
শুধু তত্ত্ব হয় আলাপন।
শুধু বলে বারে বারে, “প্রমথ আসিলে ফিরে,
সুস্থ বটে হয় মোর মন।।
কিছু কাজ আছে বাকী, তার লাগি চেয়ে থাকি,
আর কিছু নাহি লাগে ভালো।
সঙ্গে মোর এল যারা, সকলে গিয়াছে তারা,
মন ডেকে বলে তুমি চল।।”
প্রভুর হয়েছে মন, তাই প্রমথরঞ্জন,
দেশ প্রতি করিলেন যাত্রা।
এল প্রমথরঞ্জন, প্রভুর জুড়া’ল মন,
আনন্দের নাহি আর মাত্রা।।
ইতিমধ্যে পরস্পর, শুন কিছু সমাচার,
প্রমথ রঞ্জন কিবা করে।
শ্রীগুরু চরিত কথা, নাশে দুঃখ নাশে ব্যাথা,
মহানন্দ বুঝিতে না পারে।।
ব্যারিস্টার রূপে প্রমথ রঞ্জনের কার্যাবলী
উনিশ শ’ তিরিশ অব্দে আসিলেন দেশে।
কলিকাতা বসিলেন ব্যারিস্টার বেশে।।
মধুর সুন্দর মূর্তি তেজস্বীতা ভরা।
জ্ঞানে গুণে আলাপনে সকলের সেরা।।
প্রধানমন্ত্রীর ভাগে বঙ্গীয় সভায়।
তপশীলী জাতি মাত্র “দশাসন” পায়।।
বড়ই অন্যায্য তাহা সকলেই কয়।
বঙ্গদেশে তার জন্য আন্দোলন হয়।।
“অনুন্নত জাতি সঙ্গ” বলি পরিচয়।
প্রমথ রঞ্জন এক সমিতি গড়ায়।।
রায় বাহাদুর নাম রেবতী মোহন।
ঢাকার জিলায় বাস করে সেইজন।।
সভাপতি এই সংঘে হইলেন তিনি।
প্রমথ-রঞ্জন সহ-সভাপতি জানি।।
পুণা-চুক্তি বলে হ’ল তিরিশ আসন।
বড়ই আনন্দ পেল অনুন্নত গণ।।
বঙ্গবাসী বর্ণহিন্দু তা’তে সুখী নয়।
দেশভরি আন্দোলন করিয়া বেড়ায়।।
প্রমথ রঞ্জন লিখি’ বহু পত্রিকায়।
সেই মনোবৃত্তি নিন্দ করিলেন তায়।।
খুলনা জিলার মধ্যে লক্ষ্মীখালী গাঁয়।
এর প্রতিবাদে এক জনসভা হয়।।
প্রমথরঞ্জন তা’তে হন সভাপতি।
দেশবাসী লোক তা’তে আনন্দিত অতি।।
উনিশ শ’ তেত্রিশ সালে অনুন্নত জাতি।
ফরিদপুরেতে তারে করে সভাপতি।।
ফরিদপুরেতে লাট করিল গমন।
প্রমথ রঞ্জন সঙ্গে নিয়ে কত জন।।
লাটের নিকটে এক দিল “ডেপুটেশন”।
অনুন্নতে দুঃখ যত করে আলাপন।।
প্রমথ রঞ্জন পরে আসি কলিকাতা।
লাট সঙ্গে তার গৃহে কহিলেন কথা।।
তার সঙ্গে আলাপনে লাটে সুখ পায়।
প্রমথ রঞ্জন পরে বহু স্থানে যায়।।
গুণবান দেখি যত উচ্চ হিন্দুগণে।
কন্যা বিয়া দিতে চায় প্রমথরঞ্জনে।।
প্রমথ রঞ্জন তা’তে বাধ্য নাহি হয়।
নিজ সমাজের কন্যা খুঁজিয়া বেড়ায়।।
দিকে দিকে প্রমথের উঠিতেছে যশ।
তাহা শুনি প্রভু খুশী ওড়াকান্দি বাস।।
বিধির বিধান দেখ নরে অগোচর।
ইতিমধ্যে সত্যভামা ত্যজে কলেবর।।
এবে শুন বলি আমি সেই পরিচয়।
কোন ভাবে সত্যভামা দেহ ছেড়ে যায়।।
শ্রীশ্রীসত্যভামা দেবীর মহাপ্রস্থান
“তোরা দুঃখ জানিস কিরে, জানকীরে
কত না কান্দায়ে ছিলে।
দুঃখ না সইতে পেরে, মাটি ফুঁড়ে,
মাটির সাথে মাটি হলে।।”
--- কবি রসরাজ তারকচন্দ্র
ঘোর কুজ্ঝাটিকা জাল ধরারে ঘিরিল।
অকারণ সব মন উচাটন হ’ল।।
তেরশ’ ঊনচল্লিশ সাল দেখা দিল।
কুজ্ঝাটিকা ঘেরা মাস মাঘ যবে এল।।
ক্ষণে ক্ষণে মতুয়ার কেন্দে ওঠে মন।
কি যে হবে কেহ কিছু বুঝে না কারণ।।
এ দিকে জননী দেবী সত্যভামা সতী।
অগ্রভাগে গেলা চলি পিছে রেখে পতি।।
নিরালে নীরবে দুঃখ বহি চিরকাল।
নিজলোকে গেল মাতা ফেলিয়া সকল।।
আপনি দেখিলা কন্যা হরি রসময়।
জগত জননী শক্তি দেখিবারে পায়।।
পিতৃগৃহ ছাড়ি দেবী পতিগৃহে এল।
পিতৃগৃহে এ জনমে আর নাহি গেল।।
চিরকাল মৃদুভাষা কহিলা সবারে।
রুষ্ট দেবী নাহি হ’ল কভু কা’র পরে।।
একে একে চারিপুত্র গেল পরপারে।
প্রভুর বচনে মাতা সব সহ্য করে।।
নীরবে বাসিত ভালো সব ভক্তগণে।
মুখে মৃদু হাসি চাহে করুণ নয়নে।।
কোন কোন ভক্তে ডেকে বলিতেন মাতা।
“ওগো বাছা শোন তুমি মোর এক কথা।।
একখানি যাঁতি মোরে তুমি কর দান।
করিবেন হরিচাঁদ তোমার কল্যাণ।।”
মতুয়া সংঘের যত শ্রেষ্ঠ ভক্তগণ।
মনে হয় যাঁতি তারা করেছে অর্পণ।।
কি জানি কি লাগি মাতা যাঁতি চেয়ে লয়।
মনোমত হ’লে ভক্ত তারে মাত্র কয়।।
লোকাচারে ছিল মাতা রাজার সংসারে।
শত শত নরনারী পদ পূজা করে।।
তবু বাক্যে কিংবা কার্যে কিংবা আচরণে।
জননীরে কেহ রুষ্ট দেখেনি কখনে।।
স্বামী যা’তে তুষ্ট মাতা তা’তে রাজী হয়।
বিনা বাক্যে একমনে বাক্য রেখে যায়।।
এমন পবিত্র ছবি দেখেনি ধরণী।
ধন্য সত্যভামা দেবী জগত জননী।।
স্বামী পদধূলি বহি’ আপনার শিরে।
ভক্তগণে কাঁদাইয়া গেল পরপারে।।
কত যে কঠিন প্রাণে প্রভু শোক সয়।
উপরে গম্ভীর প্রভু বুক ফেটে যায়।।
ঘরে ঘরে কাঁদিলেন ভক্তে জনে জন।
বুক-ফাটা কান্না কাঁদে প্রমথরঞ্জন।।
মহোৎসব করিবারে হৈল আয়োজন।
সর্বদেশ হ’তে এল সব ভক্তগণ।।
বহু ভক্ত কেশ পাশ ফেলিল মুড়িয়া।
সশ্রদ্ধ করিল শ্রাদ্ধ আসরে বসিয়া।।
মহোৎসবে ভক্তগণ দধি দিতে চায়।
সেই মর্মে তিনশত টাকা ব্যয় হয়।।
পরে দেখ সেই টাকা নাহি কেহ দিল।
একাকী গোপাল সাধু সকলি বহিল।।
সমস্ত জীবন ভরি নানাবিধ শোকে।
কত যে বেদনা দেবী সহিলেন বুকে।।
নিরালায় ব্যাথা সয় কথা নাহি কয়।
ঠিক যেন সর্বংসহা বসুমতী প্রায়।।
হায় মাতঃ! আর কি গো রাতুল চরণ?
বিশ্ববাসী জীবকুলে করিবে দর্শন?
অবিচারে, অনাচারে নিত্য বিশ্ববাসী।
কত ব্যাথা বুকে তব দিল রাশি রাশি।।
করুণা রূপিণী মাতা করিয়াছে ক্ষমা।
জগত জননী মাতা দেবী সত্যভামা।।
শ্রীগুরু-রঞ্জিনী দেবী জগত পালিনী।
উদ্দেশ্যে চরণপদ্মে প্রণমি এখনি।।
দয়া করে দয়াময়ী! এসো পুনরায়।
তোমার স্নেহের কণা মহানন্দ চায়।।
প্রমথ রঞ্জনের শুভ-পরিণয়
বিলাত হইতে ফিরি প্রমথ রঞ্জন।
বিবাহের লাগি কন্যা করে দরশন।।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ আদি উচ্চ বর্ণ হ’তে।
প্রমথ রঞ্জনে চায় বহু কন্যা দিতে।।
তাহাতে না সুখী হ’ল প্রমথের মন।
স্বজাতির মধ্যে কন্যা করে অন্বেষণ।।
বরিশাল জিলা মধ্যে জব্দ কাঠি গ্রাম।
আনন্দ সাধক নামে অতি গুণধাম।।
অশ্বিনী সাধক নামে তার পুত্র যিনি।
তাঁহার তৃতীয়া কন্যা নামে বীণাপাণি।।
সেই কন্যা দেখিলেন প্রমথ রঞ্জন।
এতদিন পরে সুস্থ হ’ল তার মন।।
হর পক্ষে যথা গৌরী রাম পক্ষে সীতা।
“বশিষ্ঠেঃচ অরুন্ধতীঃ” ব্রাহ্মণের গীতা।।
রাজযোটকেতে হ’ল শুভ পরিণয়।
“বরপণ” বলে কিছু দাবী নাহি রয়।।
বিবাহ করিয়া লক্ষ্মী ঘরেতে আনিল।
বধূ দেখি গুরুচাঁদ সন্তুষ্ট হইল।।
বিয়া করে দেশে এল প্রমথ রঞ্জন।
এদিকে পড়িল সাড়া ভোটের কারণ।।
শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ মিশন
তের শ’ ঊনচল্লিশ সাল গণনায়।
দুর্গাপূজা কালে ভক্ত ওড়াকান্দি যায়।।
শত শত ভক্ত সেথা করে আগমন।
সবারে ডাকিয়া প্রভু বলিলা বচন।।
“শুন ভক্তগণ! যাহা আসিয়াছে মনে।
‘মিশন’ গড়িব এক প্রচার কারণে।।
মতুয়া ধর্মের নীতি করিতে প্রচার।
‘মিশন’ গড়িব মোরা অতি চমৎকার।।
দেশে দেশে মিশনের বহু শাখা র’বে।
আমার বাবার নাম প্রচার করিবে।।”
প্রভুর বচনে সব ভক্তে সায় দিল।
‘হরি-গুরুচাঁদ’ নামে মিশন গড়িল।।
প্রমথ রঞ্জন তা’তে হ’ন সভাপতি।
“মতুয়ার মহাসংঘ” তার পরিণতি।।
পিতৃ কীর্তি প্রচারিতে প্রভুজীর মন।
এই কার্য হাই স্কুলে করে নিরূপণ।।
সহস্র রজত মুদ্রা ওড়াকান্দি স্কুলে।
দান করিলেন প্রভু অতি কুতূহলে।।
প্রতি বর্ষে সে টাকায় যত সুদ হয়।
সে সুদ হইবে ব্যয় নিম্নোক্ত উপায়।।
তারকচাঁদের কৃত “হরি লীলামৃত”।
তাহা হ’তে পাঠ বটে হ’বে মনোনীত।।
কৃতিত্ব তাহাতে যেবা দেখাইতে পারে।
স্কুলের কমিটি তারে পুরস্কৃত করে।।
নারী শিক্ষা তরে প্রভু আপন আলয়।
“শান্তি-সত্যভামা” নামে স্কুল গড়ি’ দেয়।।
দশভূজা তবে এক গড়িল মন্দির।
শ্রীহরি মন্দির বেড়ী গড়িল প্রাচীর।।
দিনে দিনে ভক্ত সঙ্গ ক্রমে বেড়ে যায়।
ভক্ত লাগি করে প্রভু বিশ্রাম-আলয়।।
“রাসের মণ্ডপ” বলি তুলিলেন ঘর।
ত্রিতল টিনের ঘর দেখিতে সুন্দর।।
রাস মণ্ডপের কাছে দক্ষিণ বাহিনী।
দীর্ঘিকা খনন করে নয়ন রঞ্জিনী।।
“কামনা সাগর” বলি তারে আখ্যা দেয়।
শুন বলি “সাগরের” গূঢ় পরিচয়।।
শ্রীমুখেতে বাক্য প্রভু যা’রে যাহা বলে।
অবশ্য সকল বাক্য অনায়াসে ফলে।।
আধি, ব্যাধি দায়ে নিত্য শত শত জন।
প্রভুর নিকটে আসি করিত রোদন।।
কিবা কি প্রভুর লীলা বুঝিতে না পারি।
কখনে কি বলে প্রভু কোন ভাব ধরি।।
“কামনা সাগর” করি প্রভু ডেকে কয়।
এ ‘সাগর’ ডুবাইলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।
এখানে ডুবায় যদি করিয়া কামনা।
অবশ্য পুরায় হরি তাহার বাসনা।।
তদবধি দিবারাত্রি শত শত নর।
কামনা করিয়া ডুবে “কামনা সাগর”।।
অপুত্রকে পুত্র পায় দীনজনে ধন।
“কামনা সাগর” মানে প্রভুর বচন।।
প্রভুর বচন মেনে চলে সমুদয়।
“কামনা সাগর” তার এক পরিচয়।।
সমগুণধারী করে আরেক “সাগর”।
মাতৃ নামে প্রতিষ্ঠিত “শ্রী শান্তি সাগর”।।
প্রভুর লীলার ভাব কে বুঝিতে পারে?
অজস্র অর্থের ব্যয় এ সময়ে করে।।
ওড়াকান্দি বিলাঞ্চল রাস্তা ঘাট নাই।
বছরের অধিকাংশ নৌকা চলে তাই।।
জল কমে গেলে আর নৌকা নাহি চলে।
যাতায়াতে মহাকষ্ট হয় তার ফলে।।
প্রভু কয় “এই কষ্ট সহি কি কারণ?
অবশ্য রাস্তার আমি করিব গঠন।।”
এত বলি দেশবাসী সকলেরে ডাকে।
মনোগত ভাব তবে বলিল সবাকে।।
সবে কয় “কর্তা! এই রাস্তা কি থাকিবে?
জলে ডুবে রাস্তা সব ধুয়ে মুছে যা’বে।।”
প্রভু কয় “নাহি ভয় রাস্তা ঠিক র’বে।
আমি বলি রাস্তা কোথা নষ্ট নাহি হ’বে।।”
ডক্টর মীডের শিস্য অক্ষয় সুজন।
ওড়াকান্দি চিরস্থায়ী বাসিন্দা এখন।।
প্রভুর বাক্যেতে তার সুদৃঢ় প্রত্যয়।
তিনি কন “এই বাক্য লঙ্ঘন না হয়।।”
পরে সবে এক সঙ্গে করে আলাপন।
কত ব্যয় ধরা যায় রাস্তার কারণ।।
অনুমান শত টাকা নিরূপিত হ’ল।
সব টাকা দিতে প্রভু স্বীকার করিল।।
কার্য কালে দেখা গেল বহু টাকা লাগে।
কথা শুনি প্রভু তবে বলিলেন রেগে।।
“এক কদর্পক আর আমি নাহি দিব।
এত টাকা বল আমি কোথায় পাইব?”
ক্রোধ দেখি কেহ তাঁর কাছে নাহি যায়।
অক্ষয় বাবুর কাছে সকলে উদয়।।
সব কথা শুনি তবে অক্ষয় আসিল।
প্রভুর নিকটে বসি কহিতে লাগিল।।
“বড় কর্তা এক কথা বলি তব ঠাই।
রাস্তা বলে টাকা বটে কিছু নাহি চাই।।
কিন্তু এক কথা আমি করি বিবেচনা।
আপনার টাকা দিয়ে কাজ ত’ হল না।।
আধাআধি হ’লে কাজ তা’তে কিবা ফল?
এর চেয়ে ভালো ছিল দেশ ভরা জল।।”
অক্ষয়ের কথা শুনি প্রভুজী হাসিল।
সব টাকা দিবে বলি স্বীকার করিল।।
এইভাবে ওড়াকান্দি রাস্তার নির্মাণ।
দয়া করি করিলেন প্রভু গুরুচান।।
কতই সুযোগ এবে হয়েছে তথায়।
মুখে বলে সেই কথা শেষ নাহি হয়।।
এইভাবে ওড়াকান্দি রাস্তা হ’য়ে গেল।
ঘৃতকান্দি রাস্তা নিতে প্রভুজী ইচ্ছিল।।
ঘৃতকান্দিবাসী সবে প্রভু ডেকে কয়।
“রাস্তা দিতে ইচ্ছা কি গো কর মহাশয়?”
তারা বলে “মোরা সবে দেখি চিন্তা করে।
কোন ভাবে এই কাজ করা যেতে পারে?”
কিন্তু দেশে গিয়ে কিছু ঠিক নাহি হ’ল।
দিনে দিনে কতদিন শুধু চলে গেল।।
ভাব দেখে গুরুচাঁদ পতিত পাবন।
ডাক দিয়া বলে “শুন হে রাধা চরণ!
তব গৃহাবধি যদি এই রাস্তা যায়।
স্বর্গ-পথ তুল্য পথ তবে সৃষ্টি হয়।।”
এই রাধাচরণের শুন পরিচয়।
ঘৃতকান্দি বাস করে সেই মহাশয়।।
“মৃধা” বলি দিত সবে আদি পরিচয়।
উপাধি মজুমদার পরে সবে কয়।
তপস্বীরামের পুত্র সেই মহাশয়।
কুঞ্জবিহারীর বটে নোয়া খুড়া হয়।।
তার প্রতি ঠাকুরের কতই করুণা।
বহু বহু আছে জানি তাহার নিশানা।।
ইহার কনিষ্ঠ পুত্র কুমুদরঞ্জন।
গোপালের অনুষঙ্গ সদা সেইজন।।
রাধাচরণের পিতা যবে মারা যায়।
তাহার কিঞ্চিৎ পূর্বে ডাক দিয়া কয়।।
ঠাকুরের নিকটেতে ছিল এক খত।
কর্জ নিয়াছিল বটে টাকা এক শত।।
তপস্বী ডাকিয়া বলে পুত্রের নিকটে।
“কিছুকাল পরে আমি মারা যাব বটে।।
বড় শান্তি হ’ত যদি দেখিতাম চোখে।
ঠাকুর দিয়াছে খত ফিরি’য়ে তোমাকে।।”
কথা শুনি দ্রুত চলে সে রাধাচরণ।
নয়নের জলে বন্দে প্রভুর চরণ।।
খুলিয়া সকল কথা প্রভুকে জানা’ল।
দয়া করে দয়াময় খত দিয়া দিল।।
শ্রাদ্ধের পরেতে টাকা মিটাইয়া দিল।
এতই প্রভুজী তারে বাসিতেন ভালো।।
পিতৃ শ্রাদ্ধে প্রভু তারে তিন টাকা দেয়।
আর এক কথা শোন বলি পরিচয়।।
রাধাচরণের মাতা আসন্ন সময়।
ঠাকুরের শ্রীপ্রসাদ খাইবারে চায়।।
সে রাধাচরণ ছুটে যায় ওড়াকান্দি।
ঠাকুরের কাছে সব বলিলেন কান্দি।।
ঠাকুর ডাকিয়া বলে জননীর ঠাই।
“এক বাটি মিষ্ট শীঘ্র এইখানে চাই।।”
মাতা মিষ্ট এনে দিলে প্রভু তারে কয়।
“শীঘ্র তুমি বাড়ী যাও মৃধা মহাশয়।।
অদ্য বাড়ী হ’তে কোথা দূরে নাহি যেয়ো।
তোমার মাতার শব ‘কাচায়ে’ (জমির আইল) পোড়া’য়ো।।”
এই রাধাচরণেরে প্রভু তাই কয়।
“রাস্তা হ’লে সেই রাস্তা স্বর্গ তুল্য হয়।।”
সে রাধাচরণ বলে করিয়া মিনতি।
“কেমনে এসব আমি বলিব সম্প্রতি।।
দেশ মধ্যে এক ব্যক্তি খুন হইয়াছে।
সে চিন্তায় সকলেই চিন্তাযুক্ত আছে।।
এই কথা বলিবারে তাই ভয় পাই।”
কথা শুনে ডেকে বলে জগত গোঁসাই।।
“এই কথা মুখে নাহি বল পুনরায়।!
যাহা বলি তাহা কর মৃধা মহাশয়।।
আমার গৃহেতে দেখ রয়েছে কোদালি।
তৈল মেখে তাই নিয়ে যাও তুমি চলি।।
তিন চাপ মাটি কেটে ফেলে রেখে এসো।
কোদাল লইয়া ফিরে হেথা এসে বস।।”
প্রভুর আজ্ঞায় তবে সে রাধাচরণ।
তিন চাপ মাটি কেটে করিল গমন।।
হেন কালে দেখ এক আশ্চর্য ঘটন।
দেশবাসী সকলের আছে বটে জানা।।
পূর্ণচন্দ্র, চারুচন্দ্র উপাধি বিশ্বাস।
উভয়ে কায়স্থ তারা ঘৃতকান্দি বাস।।
‘রাস্তা’ ‘রাস্তা’ করি দোঁহে কোলাহল করি।
উপনীত হইলেন ঠাকুরের বাড়ী।।
পূর্ণ বিশ্বাসের কাছে চাঁদা বেশী চায়।
সেই হেতু গোলমাল হইল সেথায়।।
সকল শুনিয়া প্রভু পূর্ণচন্দ্রে কয়।
“এক কথা বলি শোন বিশ্বাস মশায়?
ধন জন টাকা কড়ি চিরকাল নয়।
“কীর্ত্তীয্যস্য সঃ জীবতি” শাস্ত্রে এই কয়।।
এই দেশে এই রাস্তা যদি সৃষ্টি হয়।
কত উপকার পাবে লোক সমুদয়।।
তার লাগি অর্থ দিতে কেন বা কুণ্ঠিত।
এতে টাকা কভু নাহি হইবে লুণ্ঠিত।।
টাকা দিতে এত কষ্ট যদি মনে হয়।
রাস্তা কর আমি দিব টাকা সমুদয়।।”
প্রভুর বচনে তারা লজ্জিত হইল।
সব টাকা দিবে পূর্ণ স্বীকার করিল।।
তখনি রাস্তার কাজ আরম্ভ হইল্ল।
দেখিতে দেখিতে রাস্তা ঘৃতকান্দি গেল।।
কোদালিরা বলে সবে মৃধাজীর ঠাই।
“শোন মৃধা মহাশয়! বৃষ্টি এবে চাই।
ঠাকুরের কাছে এই দরবার করি।
দেশ পুড়ে গেল বৃষ্টি দাও তাড়াতাড়ি।।”
ঠাকুরের কাছে যবে সেই কথা কয়।
ঠাকুর বলিল “রাস্তা এখন কোথায়?
তোমার বাড়ীর কাছে যদি গিয়া থাকে।
বলিনু অবশ্য বৃষ্টি নামিবে কালিকে”।।
পরদিন বর্ষা হ’য়ে দেশ ডুবে গেল।
মৃধাদের গৃহাবধি সেই রাস্তা হ’ল।।
সমস্ত রাস্তার ব্যয় পাঁচ শত টাকা।
শ্রীপূর্ণচন্র বিশ্বাস দিয়া দিল একা।।
শ্রীগুরুচাঁদের কথা সর্ব দুঃখহারী।
অন্ধ সেজে মহানন্দ গেল ডুবে মরি।।
বনে থাকে মুনি ঋষি খাদ্য কোথা পায়?
বনে থাকে মুনি ঋষি খাদ্য কোথা পায়?
ঘৃতকান্দিবাসী কুঞ্জ ভাবে সর্বদায়।।
একদিন মহাপ্রভু গুরুচাঁদ যিনি।
কুঞ্জকে ডাকিয়া কথা বলিলেন তিনি।।
“বনে থাকে মুনি ঋষি তারা কিবা খায়?
আমরা পরীক্ষা তাঁর করিব নিশ্চয়।।
অদ্য রাত্রে ওড়াকান্দি তুমি কর দেরী।
কল্য প্রাতে দেখি কোন কার্য করে হরি।।”
বিস্মিত হইল কুঞ্জ প্রভুর বচনে।
মনে ভাবে “প্রভু ইহা পেল কোনখানে।।
আপনার মনে মনে ভাবিয়াছি আমি।
ভাবনা জেনেছে সব প্রভু অন্তর্যামী।।”
প্রেমে পুলকিত কুঞ্জ ওড়াকান্দি রয়।
অতি ভোরে প্রভু তারে ডাক দিয়া কয়।।
“ওঠ, ওঠ, কুঞ্জ তুমি কত নিদ্রা যাও।
নীরবে চলিয়া এসো কারে নাহি কও।।”
চারিদিকে ঘোর কুব্জটিকা ঘেরা রয়।
কোন কিছু দেখিবারে নাহিক উপায়।।
শীঘ্রগতি চলে প্রভু কুঞ্জ পিছে ধায়।
সুদূর বিলের মধ্যে হইল উদয়।।
রাশি রাশি ঘাস দিয়ে “আল” ঢাকা রয়।
তাহার পিছনে বসে প্রভু দয়াময়।।
গ্রাম হ’তে এতদূরে এত নিরালায়।
ভুলক্রমে সেই পথে কেহ নাহি যায়।।
সেই খানে বসি প্রভু কৃষ্ণ-কথা কয়।
একা কুঞ্জ সাথী তার আর কেহ নয়।।
কৃষ্ণ-কথা বলে প্রভু কুঞ্জ বসে শোনে।
ঠিক যেন দুইজনে মুনি তপোবনে।।
হেনকালে এক ব্যক্তি নিয়ে এল ফল।
প্রণাম করিয়া বসে চক্ষে ঝরে জল।।
তরমুজ বেল আদি এক ঝাঁকা লয়ে।
অন্য এক ব্যক্তি এসে রহিল বসিয়ে।।
পরপর এইভাবে এল কতজন।
চিড়া দই আনে কেহ ঘৃতাদি মাখন।।
অন্য অন্য মিষ্ট দ্রব্য আসিয়া জুটিল।
সমস্ত দেখিয়া কুঞ্জ ভাবিতে লাগিল।।
এত দ্রব্য কেবা খাবে মনে ভাবি তাই।
কেবা কয় কে যে আনে বুঝিয়া না পাই।।
ক্রোধ ভরে প্রভু তারে বলিছে ডাকিয়া।
“কোন দেশে যাস তুই আমারে ফেলিয়া?
“কৃষ্ণ-কথা” শোন বসে কি চিন্তা করিস।
পেয়ে ধন হারা হ’য়ে এজন্য মরিস।।”
হেনকালে কলাপাতা নিয়ে দুইজন।
উপস্থিত হ’ল আসি প্রভুর সদন।।
ক্রোধে প্রভু বলে তারে “তোর রক্ষা নাই।
কেন পাতা দিলি হেথা বল শীঘ্র তাই।।”
তারা কেন্দে বলে বাবা কি খেলা খেলাও।
এ জগতে কত খেলা খেলিয়া বেড়াও।।
দুই ভাই প্রাতে মোরা চষিতেছি হাল।
হেনকালে লোক তুমি পাঠালে দয়াল।।
সেই বলে কলা পাতা চেয়েছে ঠাকুর।
বিল মধ্যে আছ বসে নহে বেশিদূর।।
আজ্ঞা মতে পাতা নিয়ে আসিলাম হেথা।
এই ত বলেছি বাবা যাহা সত্য কথা।।
বেথুড়ী নিবাসী বুড়ী ডাকে কর্ণের মা।
তারে দিয়ে পাঠাইল দেবী সত্যভামা।।
“প্রভুর প্রভাতী খাদ্য তুমি নিয়ে যাও।
মুড়ি আর জল নিয়ে গদী ঘরে দাও।।”
বুড়ী এসে দেখে প্রভু নহে সেই খানে।
ফিরে গিয়ে বলে তাই মাতার সদনে।।
মাতা বলে “ঠিক ঠিক মোর ভুল হ’ল।
প্রভু গেছে বিল মধ্যে মনেতে পড়িল।।
কলসি পুরিয়া জল সেথা নিয়ে যাও।
আর কার কাছে এই কথা নাহি কও।।”
কথা মত সেই বুড়ী জল নিয়ে যায়।
প্রভুর নিকটে গিয়ে হইল উদয়।।
মহাপ্রভু বলে তবে সে কুঞ্জের ঠাই।
“এখনে কি কথা কিছু বুঝেছ গোঁসাই।।
বনে থেকে মুনি ঋষি কিবা কাজ করে?
এক মনে তারা সবে ডাকে সে ঈশ্বরে।।
যে করে হরির চিন্তা তার যত ভার।
নিজ স্কন্ধে লয় হরি জগত ঈশ্বর।।
বনে থাকে মুনি ঋষি হরি চিন্তা করে।
আহার যোগায় হরি বিবিধ প্রকারে।।
তার ‘পরে দিলে ভার চিন্তা নাহি আর।
নিষ্ঠা ভ্রী দেও ভার হরির উপর।।”
প্রভুর বচন শুনি কান্দিছে সকলে।
প্রেমানন্দে কুঞ্জ তবে হরি! হরি! বলে।।
ধ্বনি শুনি নরনারী বহু জন গেল।
ঠাকুরে দেখিয়া সবে আশ্চর্য মানিল।।
সবে মিলে করে পরে আনন্দ উৎসব।
দলে দলে নরনারী করে কলরব।।
মহোৎসব অন্তে প্রভু গৃহেতে ফিরিল।
কুঞ্জের মনের ধাঁধাঁ দূর হয়ে গেল।।
কত ভাবে ভক্তে শিক্ষা গুরুচাঁদ দেয়।
অপূর্ব অভূত লীলা নরে বোঝা দায়।।
শ্রীগুরুচাঁদের লীলা নাশে ভব ভয়।
মহানন্দ কর্ম মন্দ বোঝে নারে হায়!
শ্রীশ্রীপ্রমথ রঞ্জনের ব্যবস্থা -পরিষদে প্রবেশ
উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ অব্দে “ভারত আইন”!
“পার্লামেন্টে” পাশ করে ইংরাজ প্রবীণ।।
তার পরিচয় পূর্বে হইয়াছে লেখা।
তপশীলী জাতি পক্ষে সু-উজ্জ্বল রেখা।।
“পূণা-চুক্তি” অনুসারে তপশীলী জাতি।
অধিক আসন পেয়ে অতি হৃষ্ট মতি।।
তিরিশ আসন পেল এই বঙ্গ দেশে।
দখল করিয়া সব তপশীলী বসে।।
তপশীলী মধ্যে যত জাতি দেখা যায়।
সর্বশ্রেষ্ঠ নমশূদ্র নাহিক সংশয়।।
প্রমাণ হইল তাহা নির্বাচন কালে।
ত্রয়োদশ জন হ’ল নমশূদ্র দলে।।
তের শত বিয়াল্লিশ ভোট-যুদ্ধ হয়।
প্রমথ রঞ্জন আসি ভোটেতে দাঁড়ায়।।
বহু জন পদপ্রার্থী সে ফরিদপুরে।
দুইবারে ভোট তাই হ’ল তথাকারে।।
ইহার কারণ শুন আইনে বিধান।
তপশীলী জাতি পক্ষে বটে এ প্রমাণ।।
যতেক আসন সংখ্যা রয়েছে বণ্টন।
প্রতি আসনের জন্য প্রার্থী চারিজন।।
ইহার অধিক প্রার্থী হলে কোন ঠাই।
দুইবার নির্বাচন সেথা করা চাই।।
প্রাথমিক নির্বাচনে প্রতি আসনেতে।
চারিজন নির্বাচিত হবে বিধি মতে।।
এই ভোট দিবে মাত্র তপশীলী যারা।
শেষ ভোটে হিন্দু মাত্র অধিকারী তারা।।
ফরিদপুরেতে ভোট হ’ল দুইবারে।
প্রমথ রঞ্জন শ্রেষ্ঠ তাহার ভিতরে।।
প্রমথ রঞ্জন আর বিরাট মণ্ডল।
দুইজনে হন সভ্য নহে গণ্ডগোল।।
মুকুন্দ বিহারী হ’ন খুলনা জিলায়।
পুলিন নামেতে ভ্রাতা হন হাওড়ায়।।
শ্রীউপেন্দ্র এবদর বরিশাল বাসী।
যোগেন্দ্র মণ্ডল সভ্য বর্ণ-হিন্দু শাসি।।
ঢাকায় শ্রীধনঞ্জয়, মধু পাবনায়।
লক্ষ্মীনারায়ণ হন জিলা নদীয়ায়।।
মনমোহন, অমৃত, জগত মণ্ডল।
রসিক বিশ্বাস সহ এই নমঃ দল।।
এ যাবৎ তিন জন মন্ত্রী হইয়াছে।
পুলিন, যোগেন্দ্র বাবু হইলেন পাছে।।
অগ্রে হ’ল শ্রীমুকুন্দ আদি পদধারী।
শ্রীপ্রমথ হবে পরে সেই বাঞ্ছা করি।।
নমশূদ্র কুলে ধন্য এরা মহাশয়।
দিনে দিনে সকলের যেন শুভ হয়।।
মহাপ্রস্থানের আভাষ
“মন! চল যাই নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে,
মিছে ভ্রম অকারণে।”
(স্বামী বিবেকান্নদ কর্তৃক)
ঠেকিয়া জীবের দায়, নরাকারে দেখা দেয়,
নরভাবে করে নর লীলা।
নর সম সুখী দুঃখী, করুণ কোমল আঁখি,
নর নিয়ে চলে তাঁর খেলা।।
আপনার মত তারে, নরে দেখে নরাকারে,
তাই তারে বুঝিতে না পারে।
বোঝার ভুলের তলে, তাই প্রভু যায় চলে,
ধরে রাখা যায় নাহি তারে।।
ভক্তরূপে আছে যারা, আপন হারানো তারা,
তাঁর ইচ্ছা মানে সর্বসার।
যে ইচ্ছা করেন প্রভু, তাহাতে তাহারা কভু,
বাধা দিতে নহে অগ্রসর।।
যদি কোন ভক্ত জন, মনে মনে করে মন,
থাকিতে বলিবে তারে জোরে।
চতুরের শিরোমণি, কোন ভাবে কেন জানি,
ভুল দিয়ে রাখে তারে দূরে।।
যবে প্রভু চলে যায়, আভাষে সকলে কয়,
ভুলে ঢাকা নরে নাহি বুঝে।
তাই যবে চলে যায়, নরে করে হায়! হায়!
বন্ধু-হারা অভাগার সাজে।।
প্রমথ রঞ্জন ফিরে, আসিলেন যবে ঘরে,
মনে ইচ্ছা করে দয়াময়।
এই লীলা করি শেষ, যাব চলে নিজ দেশ,
বেশী আর রব না হেথায়।।
দয়াময়ী সত্যভামা, গুণে যার নাহি সীমা,
পূর্বভাগে মাগিল বিদায়।
শিব হ’ল সতী-হারা, কিসে আর দেহ ধরা,
নিজ লোকে প্রভু যেতে চায়।।
ছলা কলা কত খেলা, করে প্রভু সারা বেলা,
চির সঙ্গী যারা কাছে রয়।
একদিন চারিজনে, ডাকিয়া আপন স্থানে,
বারে বারে তাহাদের কয়।।
“ওরে নব! ওরে নীলে! দীনে আর ও নেপালে!
অঙ্গীকার কর মোর কাছে।
জীবনে বিবাহ নাই, র’বি তোরা ভাই ভাই,
বিয়া আর না করিবি পাছে।।”
কান্দিয়া কান্দিয়া সারা, প্রতিজ্ঞা করিল তারা,
প্রভু বলে “তোরাই আমার।
তোরা কি রাখিবি মোরে? এই বিশ্ব চরাচরে,
কা’র আর নাহি ধারী ধার।।”
শ্রীনব কুমার যিনি, নিষ্ঠাগুণে শ্রেষ্ঠ জানি,
তারে প্রভু ভালোবাসে বেশী।
গরুচাঁদে সমর্পণ, করিয়াছে দেহ মন,
বুকে প্রভু কথা কয় আসি।।
তাহার অন্তর তলে, এক নব ভাব খেলে,
সঙ্গীগণে করিল প্রকাশ।
“শুন সবে বলি ভাই, মনে যাহা সাড়া পাই,
মোর কথা কর হে বিশ্বাস।।
অল্প কিছু কাল পরে, আর এই ধরা পরে,
বাবা নাহি দেহেতে রহিবে।
যার মনে যাহা আছে, বল সব তার কাছে,
পরিণামে সময় না পাবে।।”
সন্দেহেতে মন ভরা, প্রথমে বিশ্বাস তারা,
করিতে চাহে না কোন মতে।
কিছু দিন পরে তার, বোঝে তারা পরস্পর,
বাক্য সত্য পারে বটে হতে।।
সকলে নবকে বলে, “চল ঠাকুরের স্থলে,
কোন বাক্য চেয়ে রাখি মোরা।”
নব বলে “একি দায়! নিতে যদি কিছু হয়,
তার কাছে চেয়ে নে গো তোরা।।”
নবকে নিরালে ডাকি, গুরুচাঁদ কমলাখি,
বলে “নব! বলি যে তোমায়।
বিদায় দিয়াছে মোরে, সকলেই এ সংসারে,
তুমি মোরে দিও না বিদায়।।”
শুনিয়া প্রভুর কথা, হেঁট করে রহে মাথা,
মনে মনে ভাবে মহাজন।
“কিছু যদি চেয়ে লই, তারে রাখা হ’ল কই,
তারে ছেড়ে দিব কি কারণ।।”
প্রধান ভকতগণে, নব বলে জনে জনে,
“প্রভু যেন বেশী দিন নাই।”
সেই কথা শুনি কানে, এক সাথে চারি জনে,
গোপাল যাদব আর বিপিন গোঁসাই।।
নকুল গোস্বামী যিনি, একসঙ্গে যান তিনি,
গিয়া বসে ঠাকুরের কাছে।
অন্তর্যামী ভগবান, মহাপ্রভু গুরুচান,
বলে হেথা কে কে বসে আছে।।
সেই কালে চারিজন, বলে বাবা অভাজন,
যাদব, গোপাল, আর বিপিন, নকুল।
আপনি কাণ্ডারি বিনে, মতো’ তরী দিনে দিনে,
অকুলেতে কোথা পাবে কুল।।
প্রভু কয় “নাহি ভয়, শোন চারি মহাশয়,
এ তরীতে দিয়েছ কাণ্ডারি।
বিলাতে পড়ায়ে যারে, ফিরায়ে এনেছি ঘরে,
সে চালাবে এই ম’তো তরী।।
আমার হাতেতে হাত, তোমাদের চারি হাত,
দেও ধরা আমার এ হাতে।”
প্রভুর আদেশ শুনে, ততক্ষণে চারিজনে,
দিল হাত কান্দিতে কান্দিতে।।
চারি হাত ধরে হাতে, মন্মথের হস্ত সাথে,
মিশায়ে বলিল দয়াময়।
“প্রমথ বাড়ীতে নাই, মন্মথ তাহারি ভাই,
তার হাতে হাত দিলে হয়।।
প্রতিজ্ঞা করিয়া মোরে, বল সব চিরতরে,
ইহাদের করিবে পালন?
আমার বলিতে আর, কেহ নাহি ধরা’পর,
আছে এরা ভাই দুইজন।।”
সকলে কান্দিয়া কয়, “যাহা বল দয়াময়,
অবশ্য পালিব সবে মোরা।
কিন্তু বাবা একি কথা, তুমিই ছেড়ে যাবে কোথা,
এ কথা যে বড় ব্যাথা ভরা।।”
প্রভু কয় “শুন সবে, চিরদিন কেহ ভবে,
জীব দেহে বাঁচিয়া না রহে।
জন্মিলে মরণ আছে, কেবা চিরকাল বাঁচে,
নশ্বর জীবন তাই কহে।।
আমি যাই যাব চলে, ভাব নাকি তাই বলে,
ঠাকুর না র’বে ধরা ‘পরে?
মোরে সবে দেও ছেড়ে, প্রমথ রহিল ‘পরে,
সে দেখিবে সব তোমাদেরে।।”
কিছু কথা শোন এবে, শ্রীপ্রমথ কোন ভাবে,
চলিছেন আপন জীবনে।
যখনে বাড়ীতে রয়, বসে থাকে সর্বদায়,
প্রভুর নিকটে এক মনে।।
প্রভু যত কথা কয়, বসে বসে শোনে তায়,
সুদৃঢ় বিশ্বাস বুকে রাখে।
মুখ হতে নিষ্ঠীবন, প্রভু করে বরিষণ,
গায়ে গেলে ভক্তি ভরে মাখে।।
করিলেন ব্যারিস্টারি, পূর্ণ দুই বর্ষ ধরি,
ভাল কিন্তু নাহি লাগে মনে।
প্রভু তারে একদিনে, আপনার কাছে এনে,
বলে কথা অতীব যতনে।।
“শুন হে প্রমথ ভাই, মনে যাহা বলি তাই,
পাশ করে হ’লে ব্যারিস্টার।
তার মধ্যে যাহা তত্ত্ব, “মিথ্যাকে বানানো সত্য,
সত্য মিথ্যা সব একাকার।।”
এটুকু শিখিতে ভাই, বিলাতে পাঠাই নাই,
মহান উদ্দেশ্যে আছে পাছে।
বড় যত হও তুমি, আর বড় হই আমি,
আনন্দে পরাণ মোর নাচে।।
তুমি বড় হলে পরে, সবে সেই সূত্র ধ’রে,
আমার বাবার নাম ক’বে।
আমার বাবার ধর্ম, আমাদের যত কর্ম,
দেশে দেশে প্রচারিত হবে।।
এই ইচ্ছা বুকে রেখে, বিলাতে পাঠাই তো’কে,
অর্থ দিবে সে নহে কামনা।
আমার বাবার নাম, ভরে থাক বিশ্বধাম,
এই মাত্র মনের বাসনা।।”
শুনিয়া প্রভুর বাণী, প্রমথরঞ্জন গুণী,
ব্যারিস্টারি করিলেন ত্যাগ।
কার্য কিংবা আচরণে, ত্যাগী হ’ল সর্বক্ষণে,
মনে রাখে দৃঢ় অনুরাগ।।
কহে ভকতের ঠাই, “মোর অন্য বাঞ্ছা নাই,
যাহা বলে সে ঠাকুর দাদা।
প্রাণ দিয়ে তা’ করিব, অন্য দিকে না চাহিব,
না মানিব তা’তে কোন বাধা।।”
একদা নিশীথ কালে, সবে আছে নিদ্রাতলে,
জেগে মাত্র সে নব কুমার।
প্রভুর চরণ সেবা, করে তেহ রাত্রি দিবা,
শ্রান্তি ক্লান্তি কিছু নাহি তার।।
হেনকালে দয়াময়, নব কে ডাকিয়া কয়,
“আর কেহ আছে কি এখানে?”
করজোড়ে নব কয়, “অন্য কেহ নাহি রয়,
দাস আমি রয়েছি চরণে?”
হাসিয়া প্রভুজী কয়, “হেথা আর কেহ নয়,
মাত্র তুমি আর মাত্র আমি।
পিতা-পুত্রে আলাপন, এস করি কিছুক্ষণ,
যা’ বলিব সাক্ষী মাত্র তুমি।।
এই যে প্রমথ আছে, কিবা কয় কার কাছে,
তুমি তার কিছু জান নাকি?
যত জনে কথা কয়, মোর মনে এই হয়,
প্রায় সবে দেয় মোরে ফাঁকি।।”
কান্দিয়া কহিছে নব, “বাবা আমি কিবা ক’ব,
বড় বাবু অতি ভক্তিমান।
তিনি কহে সর্বদায়, পিতামহ যাহা কয়,
তার লাগি দিব আমি প্রাণ।।”
প্রভু বলে “যদি তাই, তবে শোন বলে যাই,
যা বলিবে প্রমথ রঞ্জন।
সব তা’তে আছি আমি, এই কথা জান তুমি,
এই বাক্য না হবে লঙ্ঘন।।”
ক্রমে ক্রমে দিন যায়, দিনে দিনে দয়াময়,
দেহ যেন রাখিতে না চাহে।
কলিকাতা হ’তে তায়, শ্রীপ্রমথ চিঠি পায়,
ঠাকুরের কাছে গিয়া কহে।।
ঠাকুর ডাকিয়া কয়, “দাদা! নাহি কোন ভয়,
শীঘ্রগতি যাও কলিকাতা।
আইন সভায় যাও, আমি বলি “রাজা হও,
দূর কর এ জাতির ব্যথা।।”
প্রমথ কান্দিয়া কয়, “কতদিনে যেন হয়,
আইন সভার কাজে দেরী।
এই অবসর পেয়ে, যদি তুমি ফাঁকি দিয়ে,
চলে যাও অকূল কাণ্ডারি।।”
বিষাদের হাসি হেসে, প্রভু বলিলেন শেষে,
“যাও দাদা, দিতেছি এ কথা।
তুমি না আসিলে ফিরে, কভু এই বাড়ী ছেড়ে,
আমি নাহি যাব আর কোথা।।
তোমারে না বলে কথা, আমি নাহি যাব কোথা,
এই বাক্য করিও বিশ্বাস।”
প্রভুর এ কথা পেয়ে, প্রমথ চলিল ধেয়ে,
প্রভু ছাড়ে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস।।
ভক্তগণে রহে ঘিরি, প্রভু ভাবে কিবা করি,
অবিলম্বে পাতে মায়া জাল।
প্রভু কিছু হ’ল সুস্থ, বলে “নাহি হও ব্যস্ত,
দেশে যাও বিপিন গোপাল।।”
প্রভু মায়া সূত্র ধরে, কে তাহা কাটিতে পারে,
ভক্ত সবে হইল বিদায়।
কবি কহে “শুন ভাই, ইহা ছাড়া পথ নাই,
এই ভাবে প্রভু ফাঁকি দেয়।।”
মহাপ্রস্থান
“কোথা যাও ফিরে চাও, ওহে দিনমণি!
তুমি অস্তাচলে দেব! করিলে গমন,
ভারতে আসিবে পুনঃ বিষাদ-রজনী।।”
---- নবীন চন্দ্র সেন।
বসন্ত আসিল নিয়ে ফুল রাশি রাশি।
আকাশে হাসিল চন্দ্র মধুময় হাসি।।
মলয় সমীরে যেন জুড়াইল প্রাণ।
শাখে শাখে যত শাখী কণ্ঠে ভরা গান।।
আলোকে উজল ধরা ভরা গন্ধে গন্ধে।
বিশ্ববাসী মত্ত যেন মিলন আনন্দে।।
রে কাল! নিষ্ঠুর তুই বড়ই কঠিন।
আপনার মনে চলি গেলি চিরদিন।।
তোরে নাহি ব্যথা দেয় শিশুর ক্রন্দন।
জননীর দুঃখে তোর ঝরে না নয়ন।।
সতীর বেদনা চোখে নাহি পড়ে তোর।
দুরন্ত ডাকাত তুই, আপনাতে ভোর।।
নিয়তি নামিনী তোর নিয়ত সঙ্গিনী।
ভাঙা-গড়া নিয়ে খেলে দিবস রজনী।।
ইঙ্গিত করিবে তুই আর রক্ষা নাই।
সোনার বাগান পুড়ে হয় ভস্ম ছাই।।
রে কাল! দংশন তোর কত ভয়ঙ্কর।
পলকে আলোর বুকে দিস অন্ধকার।।
মধুর হাসিছে শিশু জননীর কোলে।
আধ আধ স্বরে শিশু ডাকে মা মা বলে।।
জননীর ডুবিয়া যায় স্নেহের তুফানে।
শত চুমু খায় তার শিশুর আননে।।
জননীর সে আনন্দে স্বর্গ নেমে আসে।
রে কাল! দুরন্ত তুই-তুই সর্বনেশে।।
মুহূর্তে করাল দন্ত করিয়া বাহির।
নিষ্ঠুর আঘাত দিস বক্ষে জননীর।।
সোনার কমল পড়ে অকালে ঝরিয়া।
চোখের সমুখে মণি নিসরে হরিয়া।।
তাই বলি কাল তুই কত যে নিষ্ঠুর।
তোর বুকে গাঁথা শুধু বেদনার সুর।।
তা’ না হ’লে বল দেখি ওরে সর্বনেশে!
তেরশ তেতাল্লিশ সালে এলি কোন বেশে?
ফাল্গুন আকাশ তলে উজল আলোকে।
বল দেখি কোন সুরে দিলি কালী মেখে?
গুরুচাঁদে পেয়ে ধরা ছিল গরবিনী।
কোন সুরে সাজালিরে তারে অনাথিনী।।
মকরন্দ ভরা ছিল ভকত হৃদয়।
(দুই লাইন জ্ঞাপ)
কেন রে দহিলি তাহা বিষের জ্বালা?
মতুয়া তরণী কেন ফেলিলি অকুলে?
মাঝি রেখে কেন তরী দিলি তুই ঠেলে?
বল দেখি ওরে অন্ধ! ওরে দয়াহীন।
কি নিয়ে মতুয়া আর কাটাবেরে দিন?
সে যে হায়! মতুয়ার নয়নের আলো।
তার মত মতুয়ারে কে বাসিবে ভালো?
সুখে সখা ছিল সে যে দুঃখেরি বান্ধব!
পোড়া প্রাণে বল ব্যথা কোনখানে স’ব।।
বলরে নিয়তি তুই বল দয়াহীনে।
নয়নের মণি তুই কেড়ে নিলি কেনে?
কাল-চক্র আর তুই পাষাণ পাষাণী।
তোদের কারণে ধরা সাজিল দুঃখিনী।।
শোন্ শোন্ শোন্ তবে নিষ্ঠুর নিষ্ঠুরা।
কোন ভাবে নিলি হরে ভক্ত-মন-চোরা।।
ফাল্গুন আকাশ ছিল উদার নির্মল।
সহসা আনিলি তোরা মেঘ ভরা জল।।
কল কল ধারে ধরা ডুবালি ধারায়।
অশনি নির্মোঘ যেন ধরা ফেটে যায়।।
শন্ শন্ বহে বায়ু ভীষণ বাত্যায়।
ত্রাসে কাঁপে নরকুল প্রাণে এল ভয়।।
কাল রাত্রি এসে যেন ধরাকে গ্রাসিল।
তোদের নিষ্ঠুর রথ শ্রীধামে নামিল।।
আপন বিধান প্রভু না লঙ্ঘে আপনে।
ধীরে ধীরে চলে তাই সে রথের পানে।।
ভক্তের পরাণ হরি ভক্ত প্রতি মায়া।
চলে যায় তবু ফিরে চাহে করি দয়া।।
বিরহ বেদনা বুকে নাহি সহে আর।
ঘর ছেড়ে গেল দূরে সে নবকুমার।।
যাত্রাকালে উচ্চ কণ্ঠে বলে দয়াময়।
“মোর শেষ বাণী-যথা ধর্ম তথা জয়।।
স্নেহের পুতলি নব! বাবা তুই কই।
এ জনমে কথা বৎস! এই মাত্র কই।।”
আলো ভরা কালো আঁখি মুদিয়া আসিল।
অভাগা ভক্তের দল কান্দিয়া উঠিল।।
দীন কান্দে, নীলে কান্দে কান্দিল নেপাল।
নবকুমারের চোখে নাহি ধরে জল।।
অভুমন্যু, মাধবেন্দ্র, পড়িল ভূতলে।
কান্দিয়া সুখদা দেবী বসিয়া নিরালে।।
মনে মনে সুখদার জাগে কত কথা।
কতই করিল প্রভু তাহারে মমতা।।
ভাগ্যদোষে স্বামীহীনা তরুণ জীবনে।
আদরে পালিলা প্রভু পরম যতনে।।
বিশ্বাসী বন্ধুর মত তারে চিরকাল।
সর্বনীতি দিল শিক্ষা পরম দয়াল।।
সরলা অবলা মাতা বড় ঠাকুরাণী।
ফুকারিয়া কান্দিলেন আপনি জননী।।
কান্দিছে বলিছে দেবী “বাবা কোথা যাও।
কান্দিছে দুঃখিনী কন্যা চক্ষু মেলে চাও।।
চিরকাল ছায়াদানে পালিয়াছ মোরে।
পিতৃহীন শিশু দুটি ছিলে বক্ষে ধরে।।
কা’র মুখ পানে তারা চাহিবে আজিকে।
তা’দের জীবন বুঝি গেল দুঃখে দুঃখে।।”
কে কা’রে শান্তাবে বল শোকের সভায়।
পিতৃহারা বিশ্ববাসী সেই দিনে হয়।।
কুচক্রী কালের খেলা শেষ হ’য়ে গেল।
ঝড় বৃষ্টি বন্যা সব মুহূর্তে থামিল।।
পলকের মধ্য বার্তা গেল ঘরে ঘরে।
দলে দলে নরনারী ছুটে এল পরে।।
ওড়াকান্দি স্কুলবাসী যত ছাত্রগণ।
উর্ধশ্বাসে সবে ছুটে আসিল তখন।।
পাদরি মাস্টারস আর মিস টমসন।
সঙ্গে সঙ্গে সে অক্ষয় করে আগমন।।
ওড়াকান্দি, ঘৃতকান্দি, আর যত যত।
সর্বদেশ হতে লোক হ’ল সমবেত।।
সকলের চক্ষে বহে ঘন জলধারা।
সবে বলে “পিতৃহীন আজিকে আমরা”।।
কানাই মাস্টার নামে একটি গায়ক।
তার গান শুনে প্রভু পাইত পুলক।।
শেষের আসরে গান করিল কানাই।
আঁখি জলে ভাসে সবে ছাড়ে ঘন হাই।।
শ্রীহরি মন্দির যেথা আছে দাঁড়াইয়া।
তার পূর্বে ভিতে দেহ রাখিল আনিয়া।।
সর্বাঙ্গে মাখিয়া পরে ঘৃতাদি চন্দন।
ব্রহ্মার বদনে তুলে দিল সর্বজন।।
যাও প্রভু! মর’ মাঝে অমরার ধন!
কেমনে রাখিবে ধরা বন্দিয়া চরণ?
অবিরাম দেবকুল ডাকিছে তোমায়।
পথ চেয়ে কান্দে মাতা ঐ অমরায়।।
ক্ষীরোদ সাগরে তব জনক জননী।
তোমারে ডাকিছে সদা ওহে গুণমণি।।
ধরার বেদনা বুকে সহিয়াছ কত!
কুসুম কোমল হিয়া হ’ল কত ক্ষত।।
অনাদি অসীম ছিলে সসীম সাজিয়া।
সীমার বেদনা কত নিলে যে বহিয়া।।
সুখ দুঃখাতীত প্রভু যাও নিজ লোকে।
তুমি সুখে থাক প্রভু চাহিনা তোমাকে।।
অনাথিনী ধরারাণী রহিবে দুঃখিনী।
মুছিবে নয়ন স্মরি চরণ দু’খানি।।
কোটি কোটি নরনারী হৃদয় রাখিয়া।
পুজিবে চরণ যুগ আঁখি-নীর দিয়া।।
তোমার চরণ-রেখা কাল-সিন্ধু তীরে।
অব্যয় অক্ষয় হোক চিরকাল তরে!
মায়া মুক্ত ওহে ভোলা! যাও নিজ ঘরে।
করিল তর্পণ বিশ্ব নয়নের নীরে।।
“বিশ্বাসে মিলায়ে হরি তর্কে বহুদূর”
দেহ ছাড়ি গুরুচাঁদ মুদিলা নয়ন।
গৃহ হ’তে দূরে ছিল প্রমথরঞ্জন।।
আইন সভার কার্যে ব্যস্ত কলিকাতা।
“টেলিগ্রাম” যোগে তারে জানায় বারতা।।
অতঃপর গৃহে গেল প্রমথরঞ্জন।
কোনরূপ নহে তার বিষাদিত মন।।
সবে কয় “প্রভু দেহ গিয়াছে ছাড়িয়া।”
শুনিয়া প্রমথ তাহে উঠিল হাসিয়া।।
ডেকে কয় “সত্য নয় এ সব কাহিনী।
আমার ঠাকুর্দা কেবা তাহা আমি জানি।।
তার বাক্য মিথ্যা হ’তে কভু দেখি নাই।
সে যে চলে গেছে তাহা বিশ্বাসে না পাই।।
বারে বারে আমাকে যে বলে গেছে কথা।
তোরে না বলিয়া আমি যাব না’ক কোথা।।
তার বাক্য মিথ্যা হ’বে করি না বিশ্বাস।
নিশ্চয় ঠাকুর্দা আছে আমাদের পাশ।।
যার ইচ্ছা সেই শ্রাদ্ধ পার করিবারে।
শ্রাদ্ধের প্রস্তাব নাহি কর মোর ধারে।।”
শ্রাদ্ধ করা অর্থ তারে দিলাম বিদায়।
তাহারে বিদায় দিতে প্রাণে নাহি কয়।।
আইন সভার কার্য বহু আছে মোর।
কলিকাতা যাব চলে রাত্রি হ’লে ভোর।।
নীরবে শুনিল নব যত কিছু কথা।
করিতে লাগিল চিন্তা হেঁট করে মাথা।।
মনে মনে চিন্তা করে সে নব কুমার।
প্রমথরঞ্জনে ক’বে সব সমাচার।।
একাকী তাহারে প্রভু বলেছে যে কথা।
প্রমথরঞ্জনে ক’বে সে সব বারতা।।
অভিমন্যু বিশ্বাসের দোকানের কাছে।
সব কথা মনে করি নব বসিয়াছে।।
অধর বিশ্বাস আর প্রমথরঞ্জন।
হেনকালে সেই পথে করিছে গমন।।
এক দৃষ্টে রহে চেয়ে সে নব কুমার।
অন্তরের ভাষা ফেটে নয়নে তাহার।।
চাহিয়া তাহার পানে প্রমথরঞ্জন।
অন্তরের ভাব সব করিল গ্রহণ।।
গদীঘরে গিয়া পরে সংবাদ পাঠায়।
ইচ্ছা করে নব তাহা ফিরাইয়া দেয়।।
মনে ভাবে আমি বুঝি করেছি অন্যায়।
গোস্বামী বিপিন চাঁদে তাই ডেকে কয়।।
“ঠাকুরের দূত আমি দিয়াছি ফিরায়ে।
দয়া করে ঠাকুরকে আনুন ডাকিয়ে।।
সকলের অগোচরে সব কব তারে।
পেয়ে আজ্ঞা তবু তাই যাই নাই ধারে”।।
গোস্বামী বিপিন চন্দ্রে সকল খুলিয়া।
সে নব কুমার কহে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
বিপিন গোস্বামী তাই শুনিয়া সকল।
ঠাকুরের কাছে যায় আঁখি ছল ছল।।
বহুক্ষণ আলাপন করিয়া যখন।
অন্দরে করিছে যাত্রা প্রমথরঞ্জন।।
হেনকালে গোস্বামীজী করজোড়ে কয়।
“আমার সঙ্গেতে বাবা আসুন সেথায়।।
নিবেদন আমাদের কিছু বটে আছে।
তার জন্য আসিয়াছি আপনার কাছে”।।
শোনামাত্র চলে দ্রুত প্রমথরঞ্জন।
রাস মণ্ডপেতে আসি দিল দরশন।।
সর্ব দ্বার রুদ্ধ করি গিয়ে দোতালায়।
তিন জনে এক সঙ্গে বসে কথা কয়।।
যে সব বলিয়া গেছে প্রভু গুরুচান।
সে নব কুমার সব তাহারে জানান।।
সকল জানানো হ’লে তারা দুই জন।
লুটায়ে পড়িল ধরে তাহার চরণ।।
বলে “বাবা মতুয়ারে রক্ষা কর তুমি।
তোমার মধ্যেতে আছে নিজ অন্তর্যামী।।
নিজ মুখে সেই কথা বলেছে মোদেরে।
দয়া করে আমাদিগে’ রেখ কোলে করে।।”
সকল শুনিয়া বলে প্রমথরঞ্জন।
“তোমরা বলিলে সব কেমন বচন।।
স্বয়ং শক্তিধারী ছিল মোর পিতামহ।
যক্ষ রক্ষ দেব যারে পুঁজে অহরহ।।
তার সেই শক্তি বল কিসে আমি ধরি?
মূষিক ধরিতে পারে যাহা ধরে করী?
হলাহল বিষপান সাজে ভোলানাথে।
সে সব সাজিলে বল কেমনে আমাতে?
বিশ্বাসের বলে বটে মিলে হরিধন।
সিংহ দুগ্ধ মেটে পাত্রে রহে না কখন।।
এ সব আমারে কেন কর নিবেদন।
এ সবের যোগ্য আমি নহি কদাচন।।
তবে এক কথা আমি বলিবারে পারি।
নিতান্ত আমারে যদি রাখ সবে ধরি।।
তোমরা যতেক আছ ঠাকুরের গণ।
যারা কেহ ওড়াকান্দি কর আগমন।।
ঠাকুরের এই বাড়ী তোমাদের বাড়ী।
আমাকে রাখিতে পার’ করিয়া প্রহরী।।
যা’তে এই ঘর বাড়ী পরিষ্কার রয়।
সেই চেষ্টা পারি আমি করিতে সদায়।।
ইহার অধিক আমি করিতে না পারি।
রাখিলে রাখিতে পার সাজায়ে প্রহরী।।
তার মধ্যে আর মোর আছে বহু কথা।
সকল মতুয়াগণে ডেকে আন হেথা।।
সকলের মনোভাব আগে জানা চাই।
সকলে না বলে যদি তা’তে আমি নাই।।
ঠাকুরালী পদ নিতে মনে করি ভয়।
ঠাকুর বল কি মেলে মুখের কথায়?”
এইভাবে কথা বলে প্রমথরঞ্জন।
মনে মনে খুশী তাতে সাধু দুই জন।।
আদি কালে গুরুচাঁদ যেমন কহিল।
প্রমথরঞ্জনে তাহা প্রত্যক্ষ হইল।।
প্রমথরঞ্জন পরে গেল কলিকাতা।
সকলের কাছে নব বলে সব কথা।।
আসিল গোপাল সাধু লক্ষ্মীখালী হ’তে।
যাদব নকুল দোঁহে এল এক সাথে।।
গোপাল বিপিন আর যাদব নকুল।
একসঙ্গে চারিজনে করিলেন স্থুল।।
“কুলে যদি নিতে হয় মতুয়ার তরী।
প্রমথরঞ্জনে তবে কর গো কাণ্ডারি।।”
এই তত্ত্ব স্থির হ’ল খুলনা শহরে।
প্রমথরঞ্জনে সবে রহিলেন ধরে।।
শ্রীগুরু চরিত গাঁথা নাশে ভব ভয়।
পদে পদে জেনে বার্তা মহানন্দ কয়।।
শ্রীশ্রীপ্রমথরঞ্জনের রাজসূয় যজ্ঞ বা মহা বিরাট মহোৎসব
তেরশ চুয়াল্লিশ সালে মাঘের প্রথমে।
হইল বিরাট যজ্ঞ ওড়াকান্দি গ্রামে।।
দুর্গাপূজা রাসোৎসবে আলোচনা হ’ল।
মাঘে যজ্ঞ হ’বে বলি ঘোষণা করিল’।।
বঙ্গদেশে যে যে খানে যত ভক্ত রয়।
সকলে আনন্দ চিত্তে যজ্ঞে যোগ দেয়।।
ওড়াকান্দি, ঘৃতকান্দি, মল্লকান্দি হ’তে।
সহস্র সেবক আসি মেশে এক সাথে।।
যজ্ঞ কর্তা সাজিলেন প্রমথরঞ্জন।
এক সাথে এক মনে মন্মথরঞ্জন।।
চারি হোতা সিদ্ধ বাক্য করিলেন স্থুল।
গোপাল, যাদব আর বিপিন নকুল।।
কর্মাধ্যক্ষ মাধবেন্দ্র সঙ্গে নারায়ণ।
সেবক প্রধান হল ঠাকুর কিরণ।।
ভাণ্ডারী রাজেন্দ্র আর রায় সনাতন।
মল্লকান্দি বাসী দুই ধনী মহাজন।।
নীরবে করিল কাজ অভিমন্যু নাম।
দোকানী সাজিয়া আছে সেই গুণধাম।।
পাটিকেলবাড়ী বাসী মনোহর নাম।
সঙ্গে শম্ভু দুই ভাই খাটে অবিরাম।।
হরিনগরেতে বাস জানি কাঞ্চিরাম।
ঠাকুর করিল পরে কাশীরাম নাম।।
ধোপড়া, দীঘড়গাতী আর জিকাবাড়ী।
যতেক মতুয়া সবে এল জোট করি।।
শ্রীশশীভূষণ বালা আর মনমোহন।
উদ্ভব চলিল সঙ্গে সে রাম জীবন।।
শীলটীয়াবাসী নাম শ্রীগিরিশচন্দ্র।
বহু কর্মী সঙ্গে এল হইয়ে আনন্দ।।
ঘৃতকান্দিবাসী যত সবে জনে জন।
মহাযজ্ঞ ক্ষেত্রে সদা করে বিচরণ।।
আশ্চর্য কতই কাণ্ড এবে শোনা যায়।
“প্রমথ করিছে যজ্ঞ ওড়াকান্দি গাঁয়।
পাতা চাল নিয়ে তোরা চলে যা’ সেথায়।।”
কত যে পাতার বোঝা এল যজ্ঞ ক্ষেত্রে।
দলে দলে লোক চলে দিবা কিংবা রাত্রে।।
তিন শত মন দধি হ’ল আয়োজন।
ইহা ভিন্ন ভক্তে আনে দধি অগণন।।
আমিষ বিহীন হ’ল যজ্ঞ আয়োজন।
ডাল, ভাজা, শুক্তা, দধি, লাবড়া ব্যঞ্জন।।
সুমধুর টক করি দিল সব পাতে।
সহস্রেক “চিন্তাপাত্র” খাটিল সভাতে।।
প্রমথ আদিত্য দণ্ডে আরম্ভ করিল।
যজ্ঞ শেষে দিবা দণ্ড কিছু মাত্র ছিল।।
লক্ষাধিক লোক যজ্ঞে করিল আহার।
হেন যজ্ঞ বঙ্গভূমে হয় নাই আর।।
যত চায় তত পায় খাদ্য সমুদয়।
পরিতৃপ্তি সহকারে সবে খাদ্য খায়।।
যজ্ঞ শেষে কিছু দধি উদ্বৃত্ত রহিল।
কর্মী দলে মিশে তা’তে কি কার্য করিল?
নাতি দীর্ঘ এক কূপ করিয়া খনন।
তার মধ্যে দধি রেখে করিল মন্থন।।
“শ্রীদধি-সমুদ্র” লীলা করে ভক্ত জনে।
সিনান করা’ল সেথা প্রমথরঞ্জনে।।
দেবী বীণাপাণি সঙ্গে প্রমথরঞ্জন।
এক সঙ্গে স্নান করে ভক্তের কারণ।।
প্রেমের তরঙ্গ যেন নামিল ধরায়।
কি যেন কি দেখি ভক্ত কেঁদে পড়ে পায়।।
গোপাল, বিপিন আর নকুল, যাদব।
শ্রীদধি সমুদ্রে স্নান করিলেন সব।।
আর যত ছিল ভক্ত একে একে সবে।
শ্রীদধি সমুদ্রে স্নান করে মহাভাবে।।
এভাবে বিরাট যজ্ঞ সুসম্পন্ন হ’ল।
“ধন্য যজ্ঞ” “ধন্য যজ্ঞ” সকলে কহিল।।
শ্রীগুরুচাঁদের লীলা নরে বোঝা ভার।
অজ্ঞানান্ধ মহানন্দ চোখে অন্ধকার।।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ স্মৃতি সভা
“সাথে করে এনেছিলে
মৃত্যুহীন প্রাণ।
মরণে তাহাই তুমি
করে গেলে দান।।”
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওড়াকান্দি মহাযজ্ঞ হ’ল সমাপন।
কলিকাতা আসিলেন প্রমথরঞ্জন।।
বঙ্গবাসী উচ্চবর্ণ হিন্দু যত রয়।
প্রমথরঞ্জনে সবে ডাক দিয়া কয়।।
“তব পিতামহ ছিল পুরুষ মহান।
আমরা সকলে তারে করিব সম্মান।।
তার মৃত্যুদিন তাই করিয়া স্মরণ।
আমরা করিব সবে সভার শোভন।।”
কলিকাতাবাসী যত নমঃশূদ্র ছিল।
এই বার্তা ক্রমে তারা সকলে শুনিল।।
মহানন্দে আয়োজন করে কুতূহলে।
স্মৃতি-সভা স্থান হ’ল এলবার্ট হলে।।
তের শত চুয়াল্লিশ ফাল্গুন বাসরে।
স্মৃতি সভা উদযাপিত হ’ল সেই ঘরে।।
“রাষ্ট্রপতি” নির্বাচিত সে সুভাষ চন্দ্র।
যতেক বাঙ্গালী তা’তে পাইল আনন্দ।।
এই স্মৃতি সভা গৃহে আসিলেন তিনি।
জে.সি. গুপ্ত নাম তার সভাপতি যিনি।।
ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ করে পরিশ্রম।
কোন কার্যে কিছু নাহি হ’ল ব্যতিক্রম।।
শ্রদ্ধাঞ্জলি দিল সেথা শ্রীসুভাষচন্দ্র।
“মহা পুরুষ” আখ্যা পেল প্রভু গুরুচন্দ্র।।
উনশিয়া গ্রামে ঘর সেই ফরিদপুরে।
পণ্ডিত শ্রীহরিদাস ব্যাপ্ত চরাচরে।।
মহামহোপধ্যায় সিদ্ধান্ত বাগীশ।
স্মৃতিসভা বাসরেতে করেন আশিস।।
যতেক প্রধান বর্গ করিল বক্তৃতা।
প্রশংসা করিয়া বলে ঠাকুরের কথা।।
কেহ বলে “সাধু লোক” কেহ “অবতার”।
সকলে জানায় শ্রদ্ধা স্মৃতিতে তাঁহার।।
আনন্দবাজার নামে দৈনিক পত্রিকা।
ঠাকুর সম্বন্ধে তাহা লিখে বহু লেখা।।
পৃথিবী বিখ্যাত যিনি গান্ধী মহাশয়।
‘মহাত্ম’ বলিয়া যার আছে পরিচয়।।
প্রমথরঞ্জনে তিনি এক পত্র দিল।
ঠাকুর সম্বন্ধে কথা তাহাতে লিখিল।।
সেই পত্র এইখানে করিনু উদ্ধার।
বঙ্গভাষা যোগে ব্যাখ্যা করিলাম তার।।
“প্রিয় প্রমথরঞ্জন ঠাকুর মহাশয়।
পত্রযোগে পাইলাম তব পরিচয়।।
ওড়াকান্দি বাসী যিনি ঠাকুর মহান।
গুরুচাঁদ নামধারী গুরুর প্রধান।।
বহু বহু শিস্য যার আছে বঙ্গদেশে।
সহজ সরল যিনি বাক্য কিংবা বেশে।।
তার পৌত্র তুমি তাহা বুঝিলাম মনে।
দুটি কথা লিখিলাম তাঁহার কারণে।।
সহজ সরল পথে তব পিতামহ।
দুর্গত সেবার ব্রত ছিল অহরহ।।
তার মতে দুর্গতের জন্য সর্বদায়।
উৎসর্গ করিতে প্রাণ মন যেন ধায়।।”
Dear Pramatha Ranjan Thakur.
I see that you are the grandson of Sri Sri Guruchand Thakur, Orakandi, I understand that your grandfather was a great ‘Guru’ having many disciples. I hope that you will by adopting a life of simplicity and serve like your grandfather dedicate yourself to the cause of the down-trodden.
Yours sincerely
12.04.38 M.K. Gandhi
সূর্য বল কবে ঢাকা থাকে মেঘতলে?
মহতের জ্যোতিঃ তথা সেইরূপ চলে।।
স্মৃতি সভা কালে সবে পেল পরিচয়।
কি মহাপুরুষ এসে ছিল এ ধরায়।।
শ্রীগুরুচাঁদের লীলা অনন্ত অপার।
কে কত বুঝিবে যার নাহি কোন পার?