মহা-মহাপ্রভুর দ্বাদশ আজ্ঞাঃ (গদ্য)
মহা-মহাপ্রভুর দ্বাদশ আজ্ঞাঃ
ঈশ্বরে আত্মদান কর।
আত্মদান অর্থাৎ আত্ম সমর্পণ। আমিত্বহীন হওয়া বা আত্মজ্ঞান বিসর্জন দেওয়া। সুখে, দুঃখে, বিপদে, সম্পদে সবসময় সর্বতোভাবে অনুভূতিহীন হওয়ার নামই আত্মসমর্পণ। ছেলে মরেছে অথচ দুঃখ নাই। তাহার ছেলে তাহার নিকট গিয়াছে। বিদেশে আসিয়াছিল দেশে তাহার বাপের নিকট গিয়াছে, আমিও সেই দেশে পিতার নিকট যাইব। বিদেশ বাণিজ্য ভূমি। বাণিজ্যের দেশ, লাভ করিতে পারিলে বিজয় নিশান উড়াইয়া দেশে যাইব। প্রভু আমাকে কোন একটা জিনিস দিয়া আমাকে প্রহরী রাখিয়াছিলেন, আজ তাহার জিনিস তিনি গ্রহণ করিলেন, আমি অবসর পাইলাম। শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলাম, আজ সেই মায়া শৃঙ্খল খুলিয়া গেল, আমি ঋণমুক্ত! আনন্দ! কি আনন্দ! কি আনন্দ!! শোক নাই, দুঃখ নাই, আগেও যেমন পরেও তেমন, ছেলে মরিয়াছে অথচ অভাববোধ নাই। সাক্ষী সুরগ্রাম নিবাসী আড়ঙ্গচন্দ্র বৈরাগী। যেদিন তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমৎ গোলক চন্দ্র বৈরাগী মানব লীলা সম্বরণ করিলেন, মৃত গোলকের মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নি, নারী সকলে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলেন, বৃদ্ধ আড়ঙ্গ বৈরাগী বলিলেন, আমার গোলক বড় ভাল মরণ মরিয়াছে কারণ এই জন্মগ্রহণ পরে কোনরুপ পাপ করে নাই, তোমরা কেহ কাঁদিও না। এরূপ পবিত্র মরণ কেহ মরিতে পারে না। তথাপি সকলে কাঁদিতে লাগিলেন। অতঃপর বৃদ্ধ বৈরাগী ঠাকুর বলিলেন, তোমরা যদি কান্না কর তবে আমি তোমাদের বাড়ি ত্যাগ করিয়া যাইব। তথাপি সকলে কাঁদিতে লাগিলেন। বৈরাগী ঠাকুর কান্নাতে অশান্তি বোধ করিয়া তিনি হরিনাম করিতে করিতে শ্রীধাম ওড়াকান্দি গমন করিলেন। মহা-মহাপ্রভু জানিতেন যে আড়ঙ্গের পুত্র গোলকের মৃত্যু হইয়াছে, অতএব প্রভু বিষাদিত ভাবে বসিয়া আছেন, হেনকালে বৈরাগী ঠাকুর গিয়া শ্রীধামে উপনীত হইলেন, হাস্যমুখ। কোন দুঃখের চিহ্ন নাই, আত্ম সদানন্দ। মহা-মহাপ্রভু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আড়ঙ্গ, তোমার পুত্র গোলক নাকি মারা গিয়াছে, শুনিলাম, বোধকরি সে কথাটি মিথ্যা। তদুত্তরে আড়ঙ্গ বৈরাগী বলিলেন, আজ্ঞা প্রভো, সে কথা মিথ্যা, আমার পুত্র মারা যায় নাই, আমার পুত্র মরিলে আমার মুখ কি কালা হইত না? ছেলে মরিল আমার, তবে মুখ কালা কেন তোমার? তুমি জগৎ পিতা, তোমার ছেলে মরিয়াছে, তুমি আমাকে ছেলেটির প্রহরী করিয়া রাখিয়াছিলে, আজ সে তোমার নিকট আসিয়াছে, তাই জানিতে আসিলাম গোলক তোমার নিকট আসিয়াছে কি না। ইহাকে বলে আত্মদান। আত্ম সমর্পিত ব্যক্তি চাহেন কি শুধু তাহাকে? তাহারা বলেন যে, "প্রভো! ছেলে যাক, মেয়ে যাক, ধন যাক, জন যাক, জমাজমি, টাকাকড়ি, সব যাক, সব সহ্য করিতে পারিব, কিন্তু হে প্রভু তুমি যাইও না, আমি কেবল তোমাকে চাই।" আত্মদান যেমন জলে জল মিশে যাওয়া বা চিনি দানা জলে মিশে যাওয়া বা জলে লবণ মিশে যাওয়া, আমিত্ব তুমিত্বহীন অব্যক্ত ভাব ব্যক্ত করা অসাধ্য। আমি যেমন আছি, যাহাতে অর্পিত হইলাম বা যিনি আমাকে যোগদান করিলেন উভয়ের সাযুজ্য ভাবই আত্মদান।