মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

অন্তখণ্ডঃ ষষ্ঠ তরঙ্গ

অন্তখণ্ড
ষষ্ঠ তরঙ্গ
বন্দনা

জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
(জয় শ্রীসুধন্যচাঁদ সভ্যভামাত্মজ।
প্রেমানন্দে হরি গুরু শ্রীপতিচাঁদ ভজ।।)
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
 
শ্রীক্ষেত্র প্রেরিত প্রসাদ বিতরণ।
পয়ার
একদিন বসেছেন প্রভু হরিচাঁদ।
রাজ-জী ধরিল আসি প্রভুর শ্রীপদ।।
বলে প্রভু আমিত করেছি এক মন।
তব লীলা স্থান সব করিব দর্শন।।
তব লীলা দর্শনে উদ্যোগী মম হিয়া।
কিছুদিন বেড়াইয়া আসিব ফিরিয়া।।
এত বলি মহাসাধু করিল গমন।
এবে শুন শ্রীক্ষেত্র প্রসাদ বিবরণ।।
একদিন বসি প্রভু পুষ্করিণী কূলে।
ক্ষেত্র বাসী দুই পাণ্ডা এল হেন কালে।।
অনিমেষ নেত্রে রূপ করি দরশন।
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি স্পর্শিল চরণ।।
প্রভুকে দেখিয়া বলে চিনেছি তোমায়।
ফাঁকি দিয়া লুকাইয়া এসেছ হেথায়।।
শ্রীধাম উৎকলে আছ দারুব্রহ্ম মূর্তি।
তাহাতে তোমাতে এক পরমার্থ আর্তি।।
তুমি তিনি অভেদ আমরা নহে চিনি।
আদেশে জানা’লে প্রভু তাই মোরা জানি।।
পাণ্ডা কহে প্রভু হাসে দিয়া করতালি।
নড়া’লের ভবানী তা শুনিল সকলি।।
ভবানী দাঁড়িয়া ছিল মহাপ্রভু ঠাই।
কাঁদিয়া ব্যাকুলা তার অন্য জ্ঞান নাই।।
পাণ্ডা কহে তুমি হও নন্দের নন্দন।
ত্রেতাযুগে করেছিলে রাবণ নিধন।।
এবে ওঢ়াকাঁদি এসে পাতকী তরা’লে।
জগন্নাথ আবেশেতে জনম লভিলে।।
কৃষ্ণ আবেশেতে প্রভু কৈল গোষ্ঠলীলে।
শ্রীগৌরাঙ্গ আবেশেতে হরিনাম দিলে।।
তিন শক্তি আবির্ভূত এক দেহ ধরি
করিলে মানুষ লীলা মধুর মাধুরী।।
উদাসীন গিরিপুরি করিলেন উদ্ধার।
হয় নাই হবে না এমন অবতার।।
আদেশ করিয়া দিলে খোদ পাণ্ডা ঠাই।
ইচ্ছা করে পেট পুরে পায়সান্ন খাই।।
সেই পায়সান্ন পাক কমলার হাতে।
খোদ পাণ্ডা গেল পায়সান্ন ভোগ দিতে।।
ভোগ দিয়া মন্দিরের কপাট আঁটিল
ভোগ না লইল সে কপাট না খুলিল।।
খোদ পাণ্ডা দ্বার খুলে মন্দিরেতে যায়।
স্বর্ণথালা শূন্য দেখে ভোগ নাহি পায়।।
খোদ পাণ্ডা হত্যা দিয়া রহিল তখন।
শূন্যে হ’ল শূন্য বাণী প্রভুর বচন।।
পায়সান্ন পাক ইচ্ছা বহু দিনাবধি।
এই অন্ন পাঠাবে শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
করিবারে কৃষ্ণ সেবা আমার মনন।
তেকারণে পায়সান্ন করাই রন্ধন।।
শ্রীগৌরাঙ্গ রাম কৃষ্ণ গোপাল গোবিন্দ।
এক ভোগে হইবেক সবার আনন্দ।।
আমার ইচ্ছায় হইয়াছে এক কাণ্ড।
মন্দিরেতে দেখ গিয়া এক মেঠে ভাণ্ড।।
দেখ গিয়া তাহাতে আছয় মিষ্ট অন্ন।
মোর পিছে বামভিতে ভাণ্ড পরিপূর্ণ।।
শিবনাথ ভবনাথ দুই পাণ্ডা দিয়ে।
পায়সান্ন ওঢ়াকাঁদি দেহ পাঠাইয়ে।।
ফরিদপুর জিলা তেলীহাটী পরগণে
মুকসুদপুর থানা তাহার দক্ষিণে।।
তাহার মধ্যেতে আছে ওঢ়াকাঁদি ধাম।
সাধু যশোমন্ত সুত হরিচাঁদ নাম।।
ঝটপট কর কার্য আর কিবা চাও।
শীঘ্র এই ভাণ্ড সেই শ্রীধামে পাঠাও।।
সেই আমি, আমি সেই নহে ভেদ ভিন্ন।
সেই দেহে মোর সেবা হইবে এ অন্ন।।
তব আদেশেতে আসিয়াছি ভাণ্ড ল’য়ে।
বৈঠ প্রভো! দিব তব শ্রীমুখে তুলিয়ে।।
ক্ষেত্র হ’তে একদিন পথে আসিলাম।
নিশিযোগে বৃক্ষমূলে শয়নে ছিলাম।।
শয়নে ছিলাম দুই ভাই নিদ্রাবেশে।
জগন্নাথ বলরাম কহে স্বপ্নাদেশে।।
বলিলেন অন্ন ল’য়ে যাওরে সত্বরে।
জগন্নাথ দেখা পাবে পুষ্করিণী তীরে।।
প্রভুর আদেশে মোরা এলাম এদেশে
ওহে প্রভো সেইভাবে তোমা দেখি এসে।।
পাণ্ডা দিল ভাণ্ড খুলি কি দিব উপমা।
চেয়ে দেখে ভাণ্ড মুখে উঠিতেছে ধুমা।।
প্রেমানন্দে দুই পাণ্ডা পরম আন্তরিকে।
একটু একটু দোঁহে দিল প্রভু মুখে।।
প্রভু বলে প্রসাদ এনেছ যেই দিনে।
আমি ইহা গ্রহণ করেছি সেই দিনে।।
এখনে তোমরা লও ফিরে মোরে দিও।
যাহা হোল আর কারে ইহা না বলিও।।
পাণ্ডা কহে মোরা জানি জানে সে দুজন।
ভাগ্যবান যেই সেও জানুক এখন।।
কে জানে তোমার খেলা কে বুঝিতে পারে।
অনন্ত না পেল অন্ত অভ্রান্ত অন্তরে।।
রামায়ণ গায়কেরা গায় রামায়ণে।
শিব শুক নারদ আদি তত্ত্ব নাহি জানে।।
তব ভৃত্য মোরা জগন্নাথ পরিবার।
নরকুলে নরাধম কি বুঝি তোমার।।
তব কৃপা জন্য ধন্য হইনু এবার।
ওঢ়াকাঁদি শ্রীধামে এ লীলার প্রচার।।
এ প্রসাদ নিলে দিলে বলিবারে মানা।
মোরা কি বলিব জানিবেক ভক্তজনা।।
অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গ সকলে জানিবে।
এ হেন আশ্চর্য লীলা গোপনে কি র’বে।।
প্রভু বলে হয় হয় না র’বে গোপন।
গ্রন্থে তুলি ভক্তগণে করিবে কীর্তন।।
অভক্ত কি ভক্ত ইহা জানিবে বিশেষ।
জানিলে ভবানী একা ভাসাইবে দেশ।।
এত বলি পাণ্ডাদ্বয় বিদায় করিল।
পাণ্ডাদ্বয় সে প্রসাদ অনেকে বিলাল।।
ওঢ়াকাঁদি চতুষ্পার্শ্বে যত গ্রাম ছিল।
বহুদিন থেকে সে প্রসাদ বিলাল।।
কেঁদে কেঁদে বলিত প্রসাদ বিবরণ।
মাঝে মাঝে করিতেন শ্রীরূপ দর্শন।।
ধন্যা সে ভবানী দেবী পাণ্ডা দুইজন।
জয় জগন্নাথ পূর্ববঙ্গে আগমন।।
ওঢ়াকাঁদি শ্রীক্ষেত্রে একত্র এক কাজ।
রচিল তারক চন্দ্র কবি রসরাজ।।
 
ভক্ত জয়চাঁদ উপাখ্যান।
পয়ার
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত জয়চাঁদ ঢালী।
তাহার বসতী ছিল গ্রাম ভূষাইলী।।
মধুমতী নদী তীরে ভূষাইলী গ্রাম।
পরগণে মকিমপুর জয়চাঁদ নাম।।
মকিমপুর কাছারী চাকরী ছিল তার।
কাছারীতে ভালবাসা ছিল সবাকার।।
নায়েব মহুরী কিংবা আমিন পেস্কার।
সবাই বাসেন ভাল বাক্য মানে তার।।
জমিদার যদি কোন কার্য করিতেন।
জয়চাঁদ নিকটেতে সম্মতি নিতেন।।
রাণী রাসমণি তিনি বড় দয়াময়ী।
মর্তলোকে জন্ম ভগবতী অংশ সেই।।
তাহার অধীন মকিমপুর পরগণা।
সদর কাছারী তার মকিমপুর থানা।।
আট আনা মাহিনা পাইক যত জন।
দশ টাকা ছিল জয়চাঁদের বেতন।।
আমলারা মফঃস্বলে নজর পাইত।
জয়চাঁদ যদি সেই সঙ্গেতে যাইত।।
আমলারা নজর পাইত যেই খানে।
জয়চাঁদ নজর পাইত সেই সনে।।
এই মত সম্মানিত ছিল কাছারীতে।
অধর্মের কার্য না করিত কোন মতে।।
নড়াইল নিবাসিনী ভবানী নামিনী।
রামকুমার বিশ্বাসের মধ্যমা ভগিনী।।
সেই মেয়ে আসিতেন ভূষাইল গ্রামে।
ছিলেন প্রমত্তা হরিচাঁদ নামে প্রেমে।।
তাহার নিকট শুনি হরিচাঁদ বার্তা।
জয়চাঁদ সমর্পিল মন প্রাণ আত্মা।।
জয়চাঁদে ভাই ভাই বলি ডাকিতেন।
জয়চাঁদ দিদি সম্বোধন করিতেন।।
ঠাকুরের মহিমা সে বহুত কহিল।
মন ভুলে জয়চাঁদ ভাবোন্মত্ত হ’ল।।
জয়চাঁদ কেঁদে কহে ভবানীর ঠাই।
ঠাকুর নিকটে আমি কেমনে বা যাই।।
কেমনে পাইব আমি ঠাকুরের দেখা।
ঠাকুরে না দেখে আর নাহি যায় থাকা।।
দেহ মন প্রাণ মম সকল নিয়েছে।
চর্ম চক্ষে দৃষ্টি মাত্রে বাকী রহিয়াছে।।
দেহ মাত্র রহিয়াছে পিঞ্জরের প্রায়।
মন পাখী উড়ে গেছে ঠাকুর যেথায়।।
আমি যে কি হইয়াছি বুঝা নাহি যায়।
হরিচাঁদ রূপ মম জেগেছে হৃদয়।।
ঝরে আঁখি রূপ যেন দেখি দেখা যায়।
শীঘ্র নিয়া হরিচাঁদে দেখাও আমায়।।
তাহা শুনি সে ভবানী করিল স্বীকার।
তোমারে দেখাব নিয়া ঠাকুর আমার।।
দিন করিল যাব কল্য সকালেতে।
ভবানী থাকিল জয়চাঁদের বাটীতে।।
নিশি পোহাইল দোঁহে ভাব উন্মাদেতে।
চিন্তা জাগ্রদুন্মাদে ভাবনা বিচ্ছেদেতে।।
ব্রহ্ম মুহূর্তের কালে চলে দুইজনে।
প্রেমে গদ গদ বারি বহিছে নয়নে।।
প্রাতেঃ রাধানগরের বাজারে উদয়।
এক হাড়ি মণ্ডা ক্রয় করিল তথায়।।
পূর্বমুখী হ’য়ে চলে ঠাকুরের বাড়ী।
হাতে যষ্টি মস্তকেতে সন্দেশের হাড়ি।।
বাবা বাবা বলে হাই ছাড়ে বার বার।
মধুমতী নদী দোঁহে হইলেন পার।।
দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ সঘনে করিয়া।
চলিলেন তারাইল গ্রাম মধ্য দিয়া।।
খাগড়াবাড়ীয়া গ্রাম দক্ষিণ অংশেতে।
এক বেটা দস্যু বসে ধান্যের ভূমিতে।।
জমির টানিয়া নাড়া আলি বাঁধিতেছে।
দুজনাকে দেখে সেই আলিতে বসেছে।।
সেই দস্যু জিজ্ঞাসিল কোথায় যাইস।
মেয়ে লোক সঙ্গে করি কি জন্যে আসিস।।
একমাত্র মেয়েলোক করিয়া সঙ্গেতে।
কোথায় যাইস তোরা কোন সাহসেতে।।
জয়চাঁদ কহে আমি ওঢ়াকাঁদি যাই।
উনি মোর বড় দিদি আমি ছোট ভাই।।
এক বাবা হরিচাঁদ বাবার উদ্দেশ্যে।
ভাই বোন চলিয়াছি নির্বিকার দেশে।।
দস্যু বলে কি ঠাকুর পেয়েছিস তোরা।
মস্তকেতে হাঁড়ি তোর হাঁড়িতে কি ভরা।।
জয়চাঁদ বলে মোর হাঁড়িতে সন্দেশ।
দস্যু বলে কেন নিস করে এত ক্লেশ।।
কুপিণ্ডে যত বেটারা উঠায়েছে সুর।
যশা বৈরাগীর ছেলে হ’য়েছে ঠাকুর।।
জমিদারে দিল যার ভিটা বাড়ী বেঁচে।
সফলাডাঙ্গা ছাড়িয়া ওঢ়াকাঁদি গেছে।।
সে ঠাকুর হ’ল কিসে জাতি নমঃশূদ্র।
সেও নমঃশূদ্র বেটা তুই নমঃশূদ্র।।
সে হ’ল ঠাকুর কিসে তার বাড়ী যাস।
কিবা ঠাকুরালী তার দেখিবারে পা’স।
সন্দেশের হাঁড়িটারে নামি’য়ে রাখিয়ে।
না খাওয়ায়ে তোদের সে দিবে খেদায়ে।।
জয়চাঁদ বলে হাঁড়ি রাখিলেই হয়।
খেতে দিক নাহি দিক তার নাহি দায়।।
খেতে পাই না পাই রাখিলে হয় হাঁড়ি।
তা বলেত খেতে যাইব না তব বাড়ী।।
দস্যু বলে আয় তবে মম বাড়ী যাই।
অতিথির ভাত সে বাড়ীতে কভু নাই।।
ওরে বেটা ভণ্ড আর না করিস ছল।
সন্দেশের হাঁড়ি লয়ে মোর বাড়ী চল।।
মোর বাড়ী নামাইলে নাহি থুব ঘরে।
আমিও খাইব আরো খাওয়াব তোরে।।
জয়চাঁদ বলে আগে ওঢ়াকাঁদি যাব।
সেখানে খেতে না পেলে তোর বাড়ী রব।।
দস্যু বলে যা চলে তোর ঠাকুরের বাড়ী।
সেবা জন্যে মিষ্টি নিস হাতে কেন লড়ি।।
সন্দেশ লইতে হয় সেবার কারণ।
লড়ি নিস কার সঙ্গে করিবারে রণ।।
এত বলি দস্যু বেটা যষ্টি কেড়ে নিল।
আইলের নিম্নভাগে গাড়িয়া থুইল।।
পাড়াইয়া  দিল লড়ি মাটির তলেতে।
জয়চাঁদ বলে লাঠি নিব মাটি হ’তে।।
দস্যু বলে ভাগ্য তোর রাখিলাম লড়ি।
সন্দেশের হাঁড়ি নিব কর যদি তেড়ি।।
বল গিয়া ওঢ়াকাঁদি তোর সে ঠাকুরে।
লাঠি নিল এক বেটা না দিল আমারে।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ কাঁদিতে কাঁদিতে।
ওঢ়াকাঁদি উপনীত বিষাদিত চিতে।।
ঠাকুর বসিয়াছেন পশ্চিমাভিমুখে।
হেনকালে জয়চাঁদ দাঁড়াল সম্মুখে।।
ঠাকুর তখন বলিলেন জয়চাঁদে।
দস্যু হাতে পড়েছিলি বিষম প্রমাদে।।
যষ্টিখানা কেড়ে নিয়ে সে থুয়েছে গেড়ে।
ভাগ্যে সন্দেশের হাঁড়ি তোরে দিল ছেড়ে।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ কাঁদিয়া ভাসায়।
হেন অন্তর্যামী নাথ কোথা পাওয়া যায়।।
প্রভুর নিকটে রাখি সন্দেশের হাঁড়ি।
পদে পড়ি জয়চাঁদ যায় গড়াগড়ি।।
হরিচাঁদ বলে ওরে বাছা জয়চাঁদ।
ঝগড়া করিলে তোর ঘটিত প্রমাদ।।
জয় বলে রাজকার্যে যুদ্ধ করিয়াছি।
তার মত কতটারে পরাস্ত করেছি।।
পাঁচশত লোকের মহড়া একা দেই।
আমি জয় পরাজয় কা’রে দেই নাই।।
রণে যদি পাঁইতারা করি একবার।
পালাইয়া যায় লোক হাজার হাজার।।
অদ্য আমি বলহীন নহে কোন মতে।
তথাপি পরাস্ত মানি শৃগালের হাতে।।
সিংহের শাবক ইহা ধরিল শৃগালে।
সিংহ হ’য়ে ভয় হ’ল শৃগালের পালে।।
তব শক্তি ধৈর্য ডুরি বোঝা যে দিনেতে।
দিলেন ভবানী দিদি মোর মস্তকেতে।।
সেই হতে হারিয়াছি পূর্ব বুদ্ধি বল।
সে জন্য ছাড়িনু লাঠি নিল দুষ্ট খল।।
হেনকালে দয়ারাম ছেড়ে দিল গরু।
গরু রাখিবারে গেল বাঞ্ছাকল্পতরু।।
বলিলেন ভবানীরে বাড়ী মধ্যে যাও।
তুমি গিয়া খাও জয়চাঁদে খাওয়াও।।
আমি এই পালানেতে গরু চরাইব।
তোমরা খাইয়া এস বিদায় করিব।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ বাড়ী মধ্যে গিয়ে।
ঠাকুর নিকটে পুনঃ আসিলেন খেয়ে।।
ঠাকুর বলেন তোরা আর কি করিবি।
এইত দেখিলি মোরে আর কি দেখিবি।
নয়ন মুদিয়া মোরে চিন্তিবি যখনে।
অমনি আমার দেখা পাইবি তখনে।।
যে লাঠি নিয়াছে কাজ নাহি সে লাঠিতে।
আমি এই লাঠি দেই রাখিস সঙ্গেতে।।
কারো সঙ্গে কখন না করিও জুলুম।
মালেকে যাইতে রণে দিলে সে হুকুম।।
অস্ত্র শস্ত্র না নিয়ে এ লাঠি নিয়ে যেও।
বিপক্ষেরে ঐ লাঠি ঘুরায়ে দেখাইও।।
যা হ’বার হইবেক ভয় করিও না
এই লাঠি সর্বজয়ী রণে হারিবে না।।
এই লাঠি অগ্রভাগ এইটুকু ফাঁড়া।
সুতা দিয়া বাঁধিয়া আগায় দিও জোড়া।।
প্রভুর শ্রীপদধূলি লইয়া মাথায়।
কাঁদিতে কাঁদিতে সাধু নিজ দেশে যায়।।
গৃহে আসি সেই লাঠি সুতায় বাঁধিল।
সযতনে তৈল জল মর্দন করিল।।
জয়চাঁদ মনে চিন্তা করে অনুক্ষণ।
নয়ন মুদিলে হরি দিবেন দর্শন।।
না দেখিলে সেইরূপ প্রত্যয় না হয়।
পরীক্ষা করিতে ধ্যানে বসিল সন্ধ্যায়।।
কত পাপ করিয়াছি নাহি লেখা জোখা।
দয়া করি প্রভু কি আমাকে দিবে দেখা।।
এত ভাবি জয়চাঁদ আরোপে বসিল।
নয়ন মুদিয়া রূপ চিন্তিতে লাগিল।।
করুণা নিধান হরি বুঝি ভক্ত মন।
জয় চাঁদে দয়া করি দিলেন দর্শন।।
কি সৌভাগ্য জয়চাঁদ হরি দেখা দিল।
রসরাজ বলে সবে হরি হরি বল।।
 
জয়চাঁদের যুদ্ধজয়।
পয়ার
জয়চাঁদ হ’তে আছে আর এক কার্য।
ঠাকুর মহিমা সেই বড়ই আশ্চর্য।।
কাছারীতে নতুন এক নায়েব আসিল।
ভূস্বামীর ভালবাসা নায়েব হইল।।
চৌগাছি নিবাসী বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস।
সুচরিত্র প্রবল প্রতাপে হ’ল যশ।।
নায়েবের নিজ জমিদারী ল’য়ে গোল।
বিপক্ষ পক্ষের সঙ্গে বাঁধিল কোন্দল।।
বিপক্ষে প্রধান জমিদার একজন।
মহা হুলুস্থল হ’ল বেঁধে গেল রণ।।
যে দিন হইবে যুদ্ধ তিনদিন অগ্রে।
বড় চিন্তাযুক্ত বাবু কিবা আছে ভাগ্যে।।
জয়চাঁদে কহে কেঁদে হইয়া কাতর।
বলে ওহে জয়চাঁদ কি হইবে মোর।।
তিনদিন পরে এই যুদ্ধ দিতে হবে।
যুদ্ধে না পারিলে মম বাড়ী লুঠে নিবে।।
সিপাহী লইয়া তুমি মম বাড়ী যাও।
এ বিপদ হ’তে তুমি আমাকে বাঁচাও।।
মোর দেশে সিপাহী আছে ত’ ভাল ভাল।
তবু মোর শান্তি নাই চিন্তা নাহি গেল।।
তাহা শুনি জয়চাঁদ করিল স্বীকার।
যা করেন হরিচাঁদ করিব সমর।।
আটজন সিপাহী লইয়া জয়চাঁদ।
যাত্রা করে জয়চাঁদ স্মরি হরিচাঁদ।।
চৌগাছি দিনের মধ্যে উতরিল গিয়া।
তিনদিন পরে রণ হইবে ভাবিয়া।।
নিরস্ত আছয়ে সে সিপাহী নয় জন।
অপর সিপাহী আর নাহি একজন।।
দুই দিন পরে রণ জনরব আছে।
দেশীয় সিপাহীগণ কেহ না এসেছে।।
একদিন অগ্রে বিপক্ষেরা দিল হানা।
রণোন্মত্ত কেহ কার নাহি শুনে মানা।।
মহারোল গণ্ডগোল সমরের ধ্বনি।
নায়েব হইল ত্রস্ত সেই ধ্বনি শুনি।।
অট্টালিকা পর গিয়া দেখিবারে পায়।
বিপক্ষের দল এসে হয়েছে উদয়।।
দুটি মত্ত হস্তী আর চারিটি তুরঙ্গ।
লোক পাঁচ ছয় শত করে রণরঙ্গ।।
এক হস্তী উপরে মাহুত একজন।
বন্দুক লইয়া করে আরও দুইজন।।
অশ্বোপরে অশ্বারোহী বন্দুক করেতে।
ঢাল তলোয়ার করে পদাতিক সাথে।।
তলোয়ার ভাজায়েছে সড়কী ঝাঁকিছে।
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করিতেছে।।
তাহা দেখি নায়েবের উড়িল পরাণ।
জয়চাঁদে কহে কেঁদে গেল ধনপ্রাণ।।
তুমি মম ধর্ম বাপ কি কহিব আর।
দয়া করি কর মোরে বিপদে নিস্তার।।
জয়চাঁদ বলে মোর যা থাকে কপালে।
চেষ্টা করে দেখি বাবা হরিচাঁদ বলে।
জয়চাঁদ রণসজ্জা করিল তখন।
কটিতে বাঁধিল এঁটে পিন্ধন বসন।।
ঢাল তলোয়ার সড়কী কিছু নাহি নিল।
হরিচাঁদ দত্ত ষষ্ঠি লইয়া চলিল।। (যষ্টি)
আর আটজনে নিল ঢাল তলোয়ার।
হরিচাঁদ বলে জয়চাঁদ অগ্রসর।।
সুত বাঁধা ভাঙ্গা লাঠি জয়চাঁদ নিল।
বাবা হরিচাঁদ বলে হুঙ্কার ছাড়িল।।
হাঁটু গাড়া দিয়া মুখ ভূমে নামাইয়া।
মহানাদ করে বাবা বলে থাবা দিয়া।।
দাঁড়াইয়া লম্ফ দিল কালের সমান।
লাঠি ভাজাইয়া যুদ্ধে হ’ল আগুয়ান।।
আয় আয় বলিয়া ছাড়িল ভীমনাদ।
দেখিয়া বিপক্ষ দলে গণিল প্রমাদ।।
অশ্ব, করী আরোহী বন্দুক পূর্ণ করি।
দোনালা বন্দুক মারে জয়চাঁদোপরি।।
লাঠিতে লাগিয়া গুলি ধুম অগ্নি হয়।
বিপক্ষের দল দিকে সেই গুলি ধায়।।
সুধন্বার বাণে যেন সুধন্বা সংহার।
সৈন্য ক্ষয় ফিরে যায় অশ্ব, করবির।। (করীবর)
বিপক্ষের দলেতে লাগিল মহামার।
বন্দুকের ধুমে হ’ল ঘোর অন্ধকার।।
সমরে বিমুখ হয়ে সৈন্যগণ ফিরে।
দৌড়িয়া পালায় সব টিকিতে না পারে।।
তুরঙ্গম চারিটি পালায় মহাবেগে।
করীবর পালায় শুণ্ডেতে গুলি লেগে।।
সক্রোধে মাহুত মারে অঙ্কুশের বাড়ী।
মাহুত ফেলিয়া হস্তী ধায় দৌড়াদৌড়ি।।
দৌড়িয়া সারিতে নারে কুজা হয় হাতী।
তুরঙ্গ মাতঙ্গ ভঙ্গ পলায় পদাতি।।
হস্তীর নিনাদে হয় রণস্থল কম্প।
হরিচাঁদ স্মরি জয়চাঁদ মারে লম্ফ।।
জয়চাঁদ দেখে এক মহাবীর সাথে।
সমরে কোমর বাঁধা লৌহদণ্ড হাতে।।
জয়চাঁদে ডেকে বলে মাভৈ মাভৈ।
নাহি ভয় ওরে জয় হ’লি রণজয়ী।।
কৃপাদৃষ্টি করি ষষ্টি যে দিয়াছে তোরে।
তোমার কারণে রণে সে পাঠাল মোরে।।
সেই হরি আবির্ভূত সম্মুখ সমরে।
তার কৃপা তব পরে তোর ভক্তি জোরে।।
জরাসন্ধ গদাঘাত করে ভীম শিরে।
সেই গদাঘাত নিজে গদাধর ধরে।।
এই রণে সেইরূপ রাখিল তোমায়।
গুলির আঘাত কি লাঠিতে ফিরে যায়।।
অদ্যকার রণ হ’ল তেমন প্রকার।
গৃহে ফিরে চল রণে কার্য নাহি আর।।
এতশুনি জয়চাঁদ ক্ষান্ত দিল রণ।
জয় জয় ধ্বনি করে সঙ্গে সঙ্গীগণ।।
রণ জয় জয় জয় হরিচাঁদ জয়।
জয় শ্রীগোলকচন্দ্র জয় মৃত্যুঞ্জয়।।
অই বেশে এসে বিষ্ণুচরণের ঠাই
বিদায় মাগিল, বাবু মোরা দেশে যাই।।
তাহা শুনি বিষ্ণু বাবু বিদায় করিল।
সঙ্গী ল’য়ে জয়চাঁদ নিজ দেশে গেল।।
জয়চাঁদ রণজয় অপূর্ব কাহিনী।
হরিচাঁদ প্রীতে ভাই বল হরিধ্বনি।।
জয়চাঁদ রণজয়ী শুনে যেই জন।
সর্ব কার্য সিদ্ধি তার জিনিবে শমন।।
শ্রবণে পাপের নাশ প্রেম ভক্তি পায়।
রসনা কহিছে হরি কহ রসনায়।।
 
দীননাথ দাস প্রসঙ্গে সারী শুক কথা।
পয়ার
হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত দীননাথ দাস।
নমঃশূদ্র কুলোদ্ভব ওঢ়াকাঁদি বাস।।
একদিন দীন আর তারক দু’জনা।
প্রভুর লীলার কথা করে আলোচনা।।
দীননাথ দাস বলে তারকের ঠাই।
স্বচক্ষে দেখিনু যাহা শুন তবে ভাই।।
একদিন হরিচাঁদ দয়াল আমার।
নূতন আশ্চর্য লীলা করিল প্রচার।।
রামধন গরু রাখে বাড়ীর পালানে।
দয়ারাম ঘাস কেটে দেয় গরু স্থানে।।
বাটীর পশ্চিমদিকে গরু রাখিতেছে।
হরিচাঁদ পথে বসি তাহা দেখিতেছে।।
দু’জনার প্রতি প্রভু অতি দয়াবান।
ধীরে ধীরে দু’জনার নিকটেতে যান।।
গোকুলের রাখালিয়া পূর্বভাব মনে
গরু রাখিবারে বড় ইচ্ছা সর্বক্ষণে।।
দয়ারাম বলে প্রভু আর কোথা যাও।
হইয়াছে ঘাস কাটা হেথা বসি রও।।
ভরিবে গরুর পেট এই ঘাস খেলে।
বসিয়া থাকিলে গরু বেড়াইবে চরে।।
এস প্রভু তিনজন বসি এক ঠাই।
ইচ্ছায় চরুক গরু বসে দেখি তাই।।
বসিলেন হরিচাঁদ আর দয়ারাম।
রামধন বসিয়ে করেছে হরিনাম।।
কাটা ঘাস খেয়ে গরু বেড়ায় চরিয়ে।
দুই এক গরু যদি যায় বাহুড়িয়ে।।
কখন ফিরায় দয়ারাম রামধন।
প্রভু হরিচাঁদ উঠে ফিরায় কখন।।
হরিচাঁদ দুইজনে বলিলেন ডেকে।
দু’জনে রাখহ গরু এই স্থানে থেকে।।
আমি এই ফাঁকে গিয়ে আসি বেড়াইয়ে।
তিনজনে যাব শেষে একত্র হইয়ে।।
এত বলি যান প্রভু পশ্চিমাভিমুখে।
যাইতে যাইতে পথে দীননাথে দেখে।।
প্রভু বলে দীননাথ আয় মম সাথে।
যাইতেছি বেড়াইতে তোদের বাড়ীতে।।
তাহা শুনি দীনদাস সঙ্গেতে চলিল।
দীনবন্ধু সঙ্গে দীননাথ দাস গেল।।
দাসেদের বাটীর নিকটে আসিলেন।
বাটীর উত্তর পালানেতে বসিলেন।।
দীনদাস সঙ্গে মাত্র আর দীনবন্ধু।
দীনদাসে বলিলেন করুণার সিন্ধু।।
হিজলিকা বৃক্ষ তার তলায় বসিয়ে।
প্রভু বলে দীন আন তামাক সাজিয়ে।।
দ্রুতপদে দীনদাস বাড়ী মধ্যে যায়।
তামাক সাজিয়ে এনে দেখিবারে পায়।।
একটি শালিক পাখী বৃক্ষপরে ছিল।
আসিয়া প্রভুর পদে মাথা ছোঁয়াইল।।
যোগাসনে প্রভু তথা বসিয়া ছিলেন।
পদে পড়ি পাখীটি উরুতে বসিলেন।।
দীনদাস বলে একি পাখির সাহস
না জানি ইহার মধ্যে আছে কোন রস।।
প্রভু বলে এ রস কৌতুক বুঝিবি কি।
ব্রজ রস পাত্র এ ব্রজের শুকপাখী।।
ব্রজে ছিল সারী শুক শালিক হ’য়েছে।
পূর্বের সাহসে মোর উরুতে বসেছে।।
এ ভাবে বসিবে কেন, না থাকিলে চেনা।
জনমে জনমে থাকে নয়নে নিশানা।।
তমালের ডালে ছিল কোকিলার মেলা।
সারী-শুক বকুলের ডালে করে খেলা।।
বৃন্দাবনে দেখিয়াছি এই সব লীলা।
এই সেই বৃন্দাবন তমালের তলা।।
গোকুলে জন্মিল কৃষ্ণ নন্দঘোষ ঘরে।
বৃন্দাবনে বাস করিলেন গিয়া পরে।
মায়াপুরী জন্মে হরি শ্রীগৌরাঙ্গরূপে।
লীলা করে গুপ্ত বৃন্দাবন নবদ্বীপে।।
বুঝিয়া দেখিলে এই সেই সেই ভাব
সফলাডাঙ্গায় ওঢ়াকাঁদি লীলা সব।।
সফলাডাঙ্গায় জন্ম ওঢ়াকাঁদি বাস।
তেমনি করেন লীলা দাদা কৃষ্ণদাস।।
তোর ভাল ভাগ্য ছিল যদি দেখেছিস।
অরসিক স্থানে নাহি প্রকাশ করিস।।
এবে আমি যাই ভাই গোধন চরাতে।
রামধন দয়ারামে রেখে আনু পথে।।
যখন উঠিল প্রভু পক্ষীরাজে উড়ি।
নাচিতে লাগিল প্রভু স্কন্ধপরে পড়ি।।
প্রভু বলে হইয়াছে আয় মম হাতে।
এত বলি প্রভু দাঁড়ালেন হাত পেতে।।
হস্তে পড়ি শালিক শ্রীমুখ পানে চায়।
পাখা উড়ু উড়ু মুখে মুখ দিতে যায়।।
শালিকের দু’নয়নে জল ধারা বয়।
পাখী হাতে করি হরি পথ চলি যায়।।
যখনে গেলেন প্রভু বাটীর পালানে।
প্রভু বলে পাখী তুই যারে নিজস্থানে।।
মানুষের শ্রেষ্ঠ পাখী বলে ভক্ত লোক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত রচিল তারক।।
 
রাম ভরতের পুনরাগমন।
পয়ার
একদিন মহাপ্রভু ওঢ়াকাঁদি ব’সে।
ভকত সুজন কত বসিয়াছে পার্শ্বে।।
তারকেরে কহিলেন প্রভু হরিচাঁদ।
কতদিন করে জীবে সংসারের সাধ।।
বাড়ী থেকে সকলেরে কহেন প্রকারে।
মানুষ আসিবে পুনঃ আমা দেখিবারে।।
যে মানুষের মিয়াদ খাটে রামধন।
সে মানুষ করিতেছে পুনরাগমন।।
আমি যে কি করি তার নাহি নিরূপণ।
তোমরা ভকতি তারে কর সর্বজন।।
কুটি নাটি সব কাটি করিবে দমন।
জানাইবে মূল ধর্ম সূক্ষ্ম সনাতন।।
কুটি নাটি কাটিয়া করিয়া পাপ ক্ষয়।
তোমরা সকলে কর সে মানুষে ভয়।।
এত বলি সতর্ক করিল সবাকারে।
প্রভু লীলা সাঙ্গ করিলে তারপরে।।
কতদিনে ওঢ়াকাঁদি রাজ-জী উদয়।
ঠাকুরে না দেখে কাঁদে পড়িয়া ধরায়।।
বড়কর্তা গুরুচাঁদে যায় ধেয়ে ধেয়ে।
তুমি দাদা দিলে কেন বাবারে ছাড়িয়ে।।
তুমি যদি না ছাড়িতে যাইত না ছেড়ে।
ভাল চা’স যদি তবে এনেদে আমারে।।
পুনঃ বলে নারে দাদা তোর দোষ নাই।
এইরূপে লীলা করে গোলোকের সাঞী।।
জগত পতির খেলা বুঝিবারে নারি।
যুগে যুগে এইরূপে বহুলীলাকারী।।
শেষে ধৈর্য ধরিয়া রহিলা ওঢ়াকাঁদি।
হরিচাঁদ বলিয়া ফিরিত কাঁদি কাঁদি।।
বড়কর্তা গুরুচাঁদ সঙ্গেতে ভ্রমণ।
দুষ্ট দুরাচার সব করিত দমন।।
কিছুদিন পরে গুরুচাঁদকে কহিয়া।
তীর্থ ভ্রমণের ছলে গেলেন চলিয়া।।
ফিরে না আসিল আর গিয়া তীর্থ ধাম।
তীর্থে তীর্থে করিতেন হরিচাঁদ নাম।।
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ হন অবনীতে।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ সাহা শূদ্র সাধু নর।
ছত্রিশ বর্ণের লোক হ’ল একত্তর।।
দ্বিজ নমঃশূদ্র ছিল অকর্মে পতিত।
পতিত পাবন তার করিবারে হিত।।
পঞ্চ অংশে বঙ্গদেশে শেষ লীলা জন্য।
হরিচাঁদ নাম ল’য়ে হ’ল অবতীর্ণ।।
মহানন্দ চিদানন্দ গোলোক আদেশ।
হরিলীলা রচিবারে নরহরি বেশ।
প্রভু গুরুচাঁদ পাদপদ্ম ভেবে হৃদে।
রচিল তারকচন্দ্র ভাবি হরিচাঁদে।।
 
ময়না পাখীদ্বয়
পয়ার
প্রভুর চরিত্র কথা মধুর বর্ষণ।
এবে শুন ময়না পাখীর বিবরণ।।
আশ্বিনে অম্বিকা পূজা গানের কারণে।
দলসহ ঢাকাধামে করিনু গমন।।
বাল্যকাল হ’তে সদা করি কবিগান।
প্রথমেতে যবে কৈনু দলের সাজান।।
কণ্ঠস্বর শ্রুতিকটু বদ অতিশয়।
গান শুনি সবে দূর করিয়া তাড়ায়।।
বিরস বদনে শেষে ওঢ়াকাঁদি যাই।
মনোকষ্ট জানা’লেম মহাপ্রভু ঠাই।।
গান করিবারে যাই কণ্ঠে নাহি সুর।
গান গাহি শুনে সবে করে দূর দূর।।
কি করিব দয়াময় বলুন উপায়
পৈতৃক ব্যবসা মম আমা হ’তে যায়।।
মহাপ্রভু বলে বলি তোমার নিকটে।
এই কথা জানাইবা প্রতি হাটে হাটে।।
যারে দেখ তারে তুমি ব’ল বারে বারে।
মোর গান নাহি শুনে দেয় দূর করে।।
তাহা তুমি করিলে করিতে পার গান।
সাত হাট সেধে সেধে হও অপমান।।
তাহা শুনি সাত হাট করিলাম তাই।
তাহা করিলাম যাহা বলিল গোঁসাই।।
আশ্বিনে যাইব ঢাকা গান গাইবারে।
ভাবিলাম যাব প্রভু পদ দৃষ্টি করে।।
প্রভু বলে তারক ঢাকাতে তুমি যাও।
মোর জন্যে এন এক ময়নার ছাও।।
প্রভু আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া তখন।
ঢাকা গিয়া ঢাকেশ্বরী করিনু দর্শন।।
পাঁঠা মেড়া বলি দেখি দুঃখিত হইয়া।
সদলে আইনু ফিরে হরিধ্বনি দিয়া।।
হেনকালে পথে এক ময়না বিক্রেতা।
দুটি ময়নার ছাও ল’য়ে এল তথা।।
কত মূল্য চাহ বলিলাম তার ঠাই।
বিক্রেতা বলিল আমি নয় টাকা চাই।।
নয় টাকা দিয়া পক্ষী করিনু খরিদ।
গান করি বাড়ী যাই পাইনু সুহৃদ।।
ন’ড়াল নিবাসী রামকুমার বিশ্বাস।
শ্রীধামের সংবাদ শুনিনু তার পাশ।।
বলিলাম সবিনয় শ্রীরামকুমারে।
বড় নৌকা ল’য়ে ওঢ়াকাঁদি গেলে পরে।।
অনেক বিলম্ব হবে এই পাখী লও।
তুমি গিয়া শ্রীধামে প্রভুকে পাখী দেও।।
দুই পাখী মধ্যে যেটা ছিল হৃষ্ট পুষ্ট।
কুমারে দিলাম পাখী হ’য়ে অতি হৃষ্ট।।
পাখী ল’য়ে সুখী হ’য়ে কুমার চলিল।
বাটী গিয়ে ভবানীর কাছে পাখী দিল।।
কল্য প্রাতেঃ ওঢ়াকাঁদি যাব দুইজন।
রাখ দিদি এই পাখী করিয়া যতন।।
রাখিবার খাঁচা নাই কোথা রাখি পাখী।
হাঁড়ি মধ্যে রাখে সরা দিয়া মুখ ঢাকি।।
শ্বাস রুদ্ধ হ’য়ে পাখী রাত্রিরে মরিল।
প্রাতেঃ ওঢ়াকাঁদি যেতে আয়োজন কৈল।।
সরা তুলে দেখে পাখী মরেছে তখনে।
কুমার ভবানী বসে কাঁদে ভাই বুনে।।
কুমার বলেছে দিদি তোমারে জানাই।
মরা পাখী ল’য়ে চল ওঢ়াকাঁদি যাই।।
কাঁদিতে কাঁদিতে দোঁহে ওঢ়াকাঁদি গেল।
মৃত পাখী পদে রাখি সব জানাইল।।
প্রভু বলে এই পাখী মরিয়াছে নাকি।
মোর মন বলে ঘুম পড়িয়াছে পাখী।
উঠ উঠ বলে প্রভু পৃষ্ঠে দিল হাত।
শ্রীঅঙ্গ পরশে প্রাণ পেল অকস্মাৎ।।
তাহা দেখি দু’জনের চক্ষে ঝরে নীর।
প্রেমে গদ গদ হ’ল রোমাঞ্চ শরীর।।
শ্রীপদে প্রণামী ভাই ভগ্নি বাড়ী গেল।
শ্রীধামে ময়না পাখী বহুদিন ছিল।।
রাম কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ শ্রীগৌরাঙ্গ বল।
হরি হরি বলিয়া নয়নে বহে জল।।
এদিকে তারক ল’য়ে ময়নার ছাও।
বলিত ময়না হরিচাঁদ গুণ গাও।।
ওঢ়াকাঁদি অবতীর্ণ ভব কর্ণধার।
হরি হরি হরি হরি বল বার বার।।
শিখাইল ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর।
ওঢ়াকাঁদিগণ নাম শিখাইল আর।।
হীরামন গোলোক লোচন মহানন্দ।
শিখাইল হরিশ্চন্দ্র আর গুরুচন্দ্র।।
রাত্রি এক প্রহর থাকিতে নাম করে।
ক্ষান্ত করে সূর্য এলে প্রহরেক পরে।।
দুধ ভাত চা’ল ছোলা বুট মুগ আর।
ভোজনান্তে হরে কৃষ্ণ বলে বার বার।।
অন্য কোন লোকে যদি সে নাম শুনিত।
চিত্র পুত্তলিকা মত দাঁড়াইয়া র’ত।।
নাম ল’য়ে নয়নের জলে ভেসে যেত।
আড়া হ’তে খাঁচাপরে হইত মূর্ছিত।।
ক্ষণে ক্ষণে পক্ষগুলি উর্দ্ধ মুখ হ’ত।
মূর্ছিত হইলে পরে তাহা সম্বরিত।
আড়াতে সংযুক্ত পদ গলা ধরে টান।
দুপাখা তুলিয়া করেন নামামৃত পান।।
তারক পরম সুখী পাখীর গানেতে।
পাঁচ সাত বর্ষ গত হ’ল এই মতে।।
একদিন সেই পাখী আহার করাতে।
বাহির করিয়াছিল সেই খাঁচা হতে।
তারক বলিল পাখী খাঁচা মধ্যে দিয়ে।
শীঘ্র দেহ খাঁচার দরজা আটকায়ে।।
এইমাত্র কথা বার্তা তথা হ’য়েছিল।
ভ্রমে ক্রমে দরজা আটকান নাহি হ’ল।।
দরজা আটকান হ’ল না দিল খিল।
জীব জীবনের আশা নাহি এক তিল।।
দৈবে খাঁচা হ’তে পাখী বাহির হইল।
মাটিতে পড়িবা মাত্র বিড়ালে ধরিল।।
ডাকিতে লাগিল পাখী হইয়া অস্থির।
দন্তাঘাতে বিদ্ধ দেহ পড়েছে রুধির।।
দৌড়ে গিয়া সেই পাখী সকলে ধরিল।
মৃত প্রায় হ’য়ে পাখী দুই দিন ছিল।।
আর না করিল পাখী জল ফলাহার।
হরেকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণ বলে অনিবার।।
লোচন গোস্বামী বলে মম বাক্য লও।
ত্যাগ কর মমতা পাখীরে ছেড়ে দাও।
পূর্বদিনে প্রহরেক বেলার সময়।
মার্জরে আঘাত করে সে পাখী গায়।।
সে হইতে সদা করে হরে কৃষ্ণ নাম।
হরি বল হরি বল নাহিক বিরাম।।
যদি সেই পাখী কেহ দেখিবারে যায়।
হরি বল হরি বল হরি বল কয়।।
কত হরিনাম করে নাহিক বিরাম।
হরি বলিতে বলিতে রুদ্ধ হয় দম।।
কোন দমে বলে হরি বিশ ত্রিশ বার।
দুনয়নে বহে অবারিত জলধার।।
হরে কৃষ্ণ হরি হরি বলিতে বলিতে।
অকস্মাৎ দেহ পাত পড়িল মহিতে।।
তারক স্বকরে করি সে পাখী ধারণ।
নবগঙ্গা জলে দেহ দিল বিসর্জন।।
ব্রজে ছিল যত পাখী নিকুঞ্জ কাননে।
রাধা শ্যাম মিলন দেখিত দুনয়নে।।
ওঢ়াকাঁদি প্রভু লীলা ঐশান্য কোণে।
এই সব ব্রজ পাখী এল সে কারণে।।
সেই সব পাখী এল ভকত সমাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

 
শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free