মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

আদিগীতিঃ ১ম অংশ

আদিগীতি

 

বন্দনা

জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।

জয় শ্রীবৈষ্ণবদাস জয় গৌরিদাস।।

জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।

পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।

জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।

জয় শ্রীগোলকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।

জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।

জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।

জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।

নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।

 

জয় শ্রীতারকচন্দ্র কবি রসরাজ।

লীলাগ্রন্থ ব্যক্ত করে ভকত সমাজ।।

মহেশ ব্যাপারী শ্রীহরিপাল জয়।

শ্রীঅক্ষয় চক্রবর্তী শ্রীঅশ্বিনী জয়।।

জয়  শশিভূষণ জয় প্রমথ মন্মথ।

উপেন্দ্র সুরেন্দ্র জয় আর ভক্ত যত।।

জয় ডক্টর চিরকুমার ভগবতী।

হরিবংশ অবতংশ জয়তু শ্রীপতি।।

মতুয়াগণের জন্ম যে যে দেশে হয়।

হ’য়েছে হ’বেন যত সকলের জয়।।

হরিবংশ হয় যত পুরুষ প্রকৃতি।

সবার চরণে বন্দি করিয়া প্রণতি।।

সবাকার শ্রীচরণে এই অভিলাষ।

বিচরণে রেখ সবে শ্রীচরণ পাশ।।

 

গ্রন্থ সূচনা

নমঃ নমঃ হরিগুরুচাঁদ দয়াময়।

ভকত হৃদিরঞ্জন সর্বলোকে কয়।।

অসাধ্য সাধন হয় তব করুণায়।

কায়মনোবাক্যে বন্দি তব রাঙ্গা পায়।।

বন্দি তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।

মহেশ ব্যাপারী সনে এস হৃদি মাঝ।।

অংশ অবতার বলি কহে মতুয়ারা।

কৃপা করি কর দান কারুণ্যের ধারা।।

প্রভুর এ মহাবাণী করহে পালন।

দোঁহার কৃপায় হবে অসাধ্য সাধন।।

গুরুচাঁদ শিরে রাখি বন্দি কায়মনে।

বন্দিতে অযোগ্য তবু বাঞ্ছা জাগে প্রাণে।।

লিখিতে তোমার গীতি কি শক্তি আমার।

ভজন বিহীন আমি অতি দুরাচার।।

প্রভুর আদেশক্রমে হইলাম ব্রতী।

প্রকাশ করহ দিয়া আপন শকতি।।

যেইভাবে লীলামৃত গ্রন্থ বিরচিত।

তদ্‌ অনুরূপ ইহা করহ লিখিত।

পুনঃ কহি গুরুচাঁদে দেহ নিজ শক্তি।

নিজে এসে কর প্রভু এ লীলার উক্তি।।

তুমি অগতির গতি পরম পাবন।

মম হৃদে বসি কর এ লীলা রচন।।

তব তত্ত্ব ওহে প্রভু নাহি আমি জানি।

নিজে কর সুপ্রকাশ ওহে অন্তর্যামী।।

অনন্ত তোমার লীলা অনন্ত ভকত।

আমি কি বর্ণিব যাহা শুলীন্দ্র অজ্ঞাত।।

নিজে কর নিজ লীলা জগতে প্রকাশ।

ভজন বিহীন আমি পূর্ণ কর আশ।।

বাঞ্ছা কল্পতরু হরি বলে সর্বজন।

নিজে বাঞ্ছা পূর্ণ কর এই আকিঞ্চন।।

লিখিতে তোমার তত্ত্ব,     নাহি জানি পরমার্থ,

কেমনে হে ধরিব লিখন।

নাহি মোর বর্ণ জ্ঞান,      নাহি জানি সে সন্ধান,

আশা মাত্র যুগল চরণ।।

আর মোর কেহ নাই,      শ্রীপদে এ ভিক্ষা চাই,

নিজগুণে দেহ হৃদে ভক্তি।

আপনি করুণা করে,       লেখনী ধরিয়া করে,

কর প্রভু এ লীলার উক্তি।।

নমঃ মাতা সত্যভামা,    তুমি গুরুচাঁদ বামা,

বন্দি তব যুগল চরণ।

আপন তনয় ব’লে,        এইবার কর কোলে,

আমি হই অতি অভাজন।।

তুমি মাগো ভাবারাধ্য,    তুমি সর্বশক্তি আদ্যা,

কি বর্ণিব তব গুণ গীতি।

নাহি মাগো কোন ভক্তি, নাহি মোর উক্তি শক্তি,

লিখিও মা স্বয়ং ভারতী।।

তুমি মাগো সারাৎসারা,   তুমি হে সঙ্কট হরা,

দুঃখ হরা তোমা সম নাই।

তব কৃপা বিহনেতে,       কেবা পারে কি করিতে,

তাই মাগো শ্রীপদে জানাই।।

কৃপাময়ী কর কৃপা,        হয়ে বীণাপাণি রূপা,

কর মাগো এ লীলা রচন।

অযোগ্য সন্তান বলে,      লহ মোরে তুলে কোলে,

শ্রীচরণে এই আকিঞ্চন।।

মাগো তুমি কালী বেশে, কৃপা কর কালিদাসে,

শুনেছি মা প্রভুর শ্রীমুখে।

ছিল মূর্খ কালিদাস,        গিয়েছিল তব পাশ,

জ্ঞান দান করিলে তাহাকে।।

তুমি মাগো হর জায়া,    মহাদেবী মহামায়া,

তুমি মাগো সঙ্কট হারিণী।

তুমিই আদ্যা অনাদ্যা,     তুমি মাগো ভবারাধ্যা,

তুমি মাগো করুণা দায়িনী।।

তাই বলি ওহে মাতা,     জানা আছে সেই কথা,

পার তুমি সকল করিতে।

কালিদাস হ’তে হীন,      ভক্তি শূন্য অতি দীন,

শক্তি নাই সেগুণ বর্ণিতে।।

বিশ্ব মাঝে আমি মূর্খ,     নাহি জানি তত্ত্ব সূক্ষ্ম,

নাহি মোর দেহে হেন আর্তি।

তাই মাত্র আশাকরি,      লিখিতে কলম ধরি,

তব ভরসাতে করি স্ফূর্তি।।

মম দেহে দাও শক্তি,     আমা দ্বারা কর উক্তি,

উনপঞ্চাশ স্বর ও ব্যঞ্জন।

গুরুচাঁদ লীলা যাহা,        প্রকাশ কর মা তাহা,

শ্রীচরণে এই আকিঞ্চন।।

আমি অতি দীনহীন,      দীন হতে অতি দীন,

দীননাথ মম গুরুচাঁদ।

তস্য জায়া রূপে তুমি,    অবতীর্ণ মর্তভূমি,

মম হৃদে দেহ রাঙ্গাপদ।।

মম হৃদে ভর করি,        উভয়ে কলম ধরি,

নিজ লীলা করহ বর্ণন।

মাতাই সন্তান তোষে,     সাধুগণে ইহা ভাষে,

নিজ বাঞ্ছা কর সম্পূরণ।।

 

মহাপ্রভুর পূর্ব পুরুষদের বিবরণ

এবে কহি প্রভুদের পূর্ব বিবরণ।

যে বংশেতে মহাপ্রভু অবতীর্ণ হ’ন।।

গুরুচাঁদ কৃপা করি বলেন শ্রীমুখে।

শুনে তাই লিখিলাম মনের পুলকে।।

ভালমন্দ নাহি বুঝি নাহি বর্ণজ্ঞান।

লিখনিতে লিখি যাহা তিনি যা লেখান।।

পুরাকালে সুবিখ্যাত কান্যকুব্জ হয়।

তার অন্তর্গত গ্রাম নামেতে হৈহয়।।

বাৎস্য নামে এক মুনি সাগ্নিক ব্রাহ্মণ।

তপেতে তপসী শ্রেষ্ঠ অতি বিচক্ষণ।।

শীতে করে জলাশয়ে গ্রীষ্মে অগ্নি জ্বালি।

তপ করে মহামুনি হ’য়ে কৃতাঞ্জলি।।

তাহার রমণী দেবী সাবিত্রী নামেতে।

প্রাণপণে চেষ্টা করে পতি সাহায্যেতে।।

স্বামীর মঙ্গল চিন্তা বিনা কিছু নাই।

অভিলাষ শূন্যা হেন খুঁজিয়া না পাই।।

একদা সে বাৎস্য মুনি নারীকে শুধায়।

শুনহে সাবিত্রী আমি বলি হে তোমায়।।

এ বাবতে মম পাশে নহে থেক আর। (বাবতে?)

একাকী করিব তপ বাসনা আমার।।

ভিক্ষাবৃত্তি রহ তুমি শুন সুবদনী।

নগরে করহ ভিক্ষা সাজিয়া যোগিনী।।

পতি বাক্য শিরে ধরি চলিল নগরে।

(এক লাইন জ্ঞাপ আছে)

ভিক্ষা অন্নে পতি সেবা পরম যতনে।

প্রসাদান্নে পরিতুষ্টা রহে সর্বক্ষণে।।

কিছুদিন এইভাবে অতীত হইল।

পুনরায় মহামুনি নারীকে বলিল।।

অন্নভোজে আর মম নাহি প্রয়োজন।

বাতাহারে এবে আমি রাখিব জীবন।। (বাতাহারে?)

গৃহে গিয়ে কর তুমি হরিপদ সার।

সাহায্য করিতে তব হইবে না আর।।

পতি বাক্যে সাধ্বী সতী গৃহেতে চলিল।

পতিপদ হৃদে রাখি একাকী রহিল।।

পতির মঙ্গল চিন্তা করে অনুক্ষণ।

গৃহে থেকে পতি পদ ভাবে মনে মন।।

স্বামীর নিকট যেতে স্বামীর বারণ।

চিত্তপটে পতি মূর্তি করেছে অংকন।।

প্রাণ দিয়া পতিপদ সদা চিন্তা করে।

আকর্ষণ শক্তি মুনি এড়াইতে নারে।।

জলাশয় ত্যজি মুনি এল নিজ বাসে।

ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পত্নীর সকাশে।।

ধ্যান ভঙ্গে মহামুনি মেলিল নয়ন।

দেখে নিজ পত্নী পাশে না বুঝি কারণ।।

পূর্বভাবে ক্রোধ চিত্তে বলে মহামুনি।

কেন হেরি মম পাশে আরে রে পাপিনী।।

নিষেধ করেছি যেতে আমার নিকটে।

মম বাক্য অবহেলা কর অকপটে।।

কিবা তব মনভাব কিছুই না জানি।

নিশ্চয় করিব দান অভিশাপ বাণী।।

স্বামী বাক্যে নারী কহে কাতর বচন।

আপনার নিকটেতে যাইনি কখন।।

আপনি এলেন ঘরে কেন নাহি জানি।

গৃহেতে র’য়েছি আমি বসি একাকিনী।।

নারী বাক্যে মহামুনি সন্তুষ্ট হইল।

(একশব্দ জ্ঞাপ) বর হল ঠাই নারীকে বলিল।।

ধন্যময় নারীরূপে তুমি মহীতলে।

যাহা চাও তাহা দিব তোমা অবহেলে।।

সাবিত্রী বলিল বর অন্য নাহি চাই।

তোমা হেন পতি যেন জন্মে জন্মে পাই।।

তবে যদি বর দিতে একান্ত বাসনা।

তব সুখে মম সুখ প্রাণের কামনা।।

নারী বাক্যেতে মুনি সন্তুষ্ট হইল।

বামকর কনিষ্ঠায় নাভি পরশিল।।

গৌতম মন্ত্রেতে মুনি শক্তি প্রদানিল।

আপন স্বরূপ পুত্র তাতে জন্ম নিল।।

পুত্র মুখ দরশনে হইল আনন্দ।

নাম করণেতে নাম রাখে সদানন্দ।।

তস্য ঔরসেতে পঞ্চ পুত্রের উদয়।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

সর্ব জ্যেষ্ঠ সুতপা নামেতে ব্রহ্মচারী।

দ্বিতীয় নন্দন অনুতপা নামধারী।।

উগ্রতপা তৃতীয় চতুর্থে পঞ্চতপা।

সবার কনিষ্ঠা হয় নামে রামতপা।।

পঞ্চ ভাই সমশক্তি মহাতেজবান।

কঠোর ভাবেতে করে শ্রীহরির ধ্যান।।

তপবলে বিমানেতে কখনও বা চরে।

শ্রীহরির করুণায় হেন শক্তি ধরে।।

সেই বংশ যেইভাবে এল এই দেশে।

প্রকাশ করিব তাহা গুরুর আদেশে।।

আদিশুর নামে রাজা বংগ দেশে ছিল।

যজ্ঞ করিবার হেতু মনেতে চিন্তিল।।

স্বদেশেতে ছিল যত দেবল ব্রাহ্মণ।

যজ্ঞহেতু করিবারে না করে প্রেরণ।।

কান্যকুব্জে পাঠাইল দূত একজন।

ব্রাহ্মণ স্বকাশে গিয়ে করে নিবেদন।।

আদিশুর মহারাজা করে নিমন্ত্রণ।

যজ্ঞহেতু মাগিলেন পাঁচটি ব্রাহ্মণ।।

যথোচিত ভাবে পরে সন্তুষ্ট করিবে।

মম সনে পঞ্চ দ্বিজ যাইতে হইবে।।

শুনে এই দূত বার্তা করে অস্বীকার।

দূত এসে জানাইল রাজার গোচর।।

তাহে রাজা মনে মনে ক্রোধযুক্ত হ’য়ে।

অসভ্য যতেক লোক আনিল ডাকিয়ে।।

ঝালে মালো সুর্দ্দফরাস আকি করি।

ধোপা শীল আদি সাহা আনে বরাবরি।।

সাত শত ছাপ্পান্ন হ’ল গণনায়।

সূত্র গলে দিয়ে সবে ব্রাহ্মণ সাজায়।।

বৃষভ বাহনে সবে পাঠায় ত্বরিতে।

যোদ্ধাবেশে যায় সবে অস্ত্র নিয়ে হাতে।।

যুদ্ধং দেহি বলি সবে করে হুহুঙ্কার।

ব্রাহ্মণ না দিবে যদি করিব সংহার।।

ব্রাহ্মণগণ সবাই ভাবে মনে মনে।

বড়ই অদ্ভুত কর্ম হেরিনু নয়নে।।

বৃষভ বাহনে এল হইয়ে ব্রাহ্মণ।

এদের সহিত যুদ্ধ অবৈধ কারণ।।

স্পর্শমাত্র ব্রহ্মতেজ নিশ্চয় হারিব।

তাতে করি গো-হত্যা নরকে মজিব।।

প্রয়োজন নাই কভু করিতে সমর।

ব্রাহ্মণ নহেত এরা কপটি পামর।।

পঞ্চ দ্বিজ দিতে হবে শুনি বিপ্রগণ।

অতএব যাহ পঞ্চ দ্বিজের নন্দন।।

সাজিলেন পঞ্চ দ্বিজ যজ্ঞের কারণ।

ভৃত্যবেশে শূদ্রগণ সঙ্গেতে গমন।।

ভরদ্বাজ সার্বণ শাণ্ডিল্য শ্রীবাৎস্য।

কাম্বড়াদি পঞ্চ দ্বিজ এ যজ্ঞেতে উৎস।।

দান গ্রহণ করিবেনা রাজারে জানায়।

সভ্রমে গ্রহণ করে সে পঞ্চ জনায়।।

রাজা বলে তাই হবে শুন দ্বিজগণ।

সানন্দেতে কর মম যজ্ঞ সমাপন।।

মনে মনে আদিশুর ভাবিতে লাগিল।

দান না করিলে যজ্ঞ হইবে বিফল।।

দান করিবারে এক করিল কৌশল।

স্বর্ণজল নির্মাইয়ে ধৌত করি পান।

কর্পূর তাম্বুল মাঝে স্বর্ণ সিকি দান।।

কর্পূর তাম্বুল পানে দন্তেতে লাগিল।

থু থু করি সে তাম্বুল ভূমেতে ফেলিল।।

স্বর্ণ সিকি হেরে সবে করে অভিশাপ।

হীন বীর্য্য হ’য়ে দুষ্ট ভুঞ্জ নানা তাপ।।

স্বর্ণদানে সবাকারে নিস্তেজ করিল।

মনোদুঃখে পঞ্চ দ্বিজ দেশেতে চলিল।।

নিরগ্নি হ’য়েছে হেরি যতেক ব্রাহ্মণ।

স্থান নাহি পেল দেশে এই পঞ্চজন।।

পূর্বস্থানে এসে পরে হতাশ হৃদয়।

আদিশুর সমীপেতে সকল জানায়।।

আপনার যজ্ঞ হেতু সকল হারাই।

স্বদেশে এখন মোরা স্থান নাহি পাই।।

এবে মোরা কি করিব কোন দেশে যাব।

কাহার আশ্রয় পঞ্চ দ্বিজ স্থান পাব।।

মহারাজ শুনি কহে প্রবোধ বচন।

অন্য দেশে কেন আর করিবে গমন।।

এত বলি মহারাজ ভূমি দান কৈল।

ব্রহ্মোত্তর পেয়ে পঞ্চ দ্বিজ তথা রৈল।।

এইদান পূর্বে কোথা না ছিল কখন।

ব্রহ্মতেজ ধ্বংস এই দানের কারণ।।

নিরগ্নি হইল এই পাঁচটি ব্রাহ্মণ।

দেবল ব্রাহ্মণ সনে না হয় মিলন।।

তাই হেরি পঞ্চ দ্বিজ ব্যথিত হইল।

সঙ্গোপনে রাজা সনে মন্ত্রণা করিল।।

দেশস্থ ব্রাহ্মণগণে করি নিমন্ত্রণ।

সব দ্বিজে এক সনে করাও ভোজন।।

আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না রহিবে।

আপনার স্ববেশেতে রাখিতে হইবে।। (স্ববশেতে)

এত শুনি মহারাজ করে নিমন্ত্রণ।

এক ঠাই এল যত দেবল ব্রাহ্মণ।।

স্তুতি বাক্যে মহারাজ বলেন বচন।

না করিলে মম যজ্ঞ তোমরা তখন।।

এবে আমি সবাকারে করি নিমন্ত্রণ।

কৃপা করি কর মম অভীষ্ট পূরণ।।

আমার উদ্যান বাটি বসিয়া সবাই।

ভোজন করহ তথা সকল গোঁসাই।।

শুনিয়া ক্রোধেতে বলে সব দ্বিজমুনি।

গণিকাসদৃশ সেই রজক নন্দিনী।।

তার সনে কামাসক্ত তুই পাপমতি।

পদ্মিনীর গৃহে নিবি ব্রাহ্মণ সন্তুতি।।

আরে আরে মহাপাপী কি কহিব তোরে।

পাপ পথে যাত্রী তুই ল’য়ে সে দুষ্টারে।।

তোরে আর কি কহিব শোন পাপপতি।

কুষ্ঠব্যাধি হোক্‌ তোর হোক্‌ অধোগতি।।

ব্রাহ্মণের জাতিপাত করিতে মনন।

তাই বুঝি এ সংকল্প আরে রে দুর্জন।।

মহাপাপে হোক্‌ তোর জীবন সংশয়।

আভিশাপ করে সব ক্রোধিত হৃদয়।।

মনঃক্ষুন্নে মহারাজ গৃহেতে চলিল।

কুষ্ঠব্যাধি হ’য়ে শেষে জীবন ত্যাজিল।।

বল্লাল নামেতে হয় রাজার আমাত্য।

ক্রমে ক্রমে জানিলেন এ সব বৃত্তান্ত।।

ক্রোধ ভরে প্রজাগণে আদেশ তখনে।

অত্যাচার কর যত দেবল ব্রাহ্মণে।।

বল্লাল আদেশে যত প্রজার কুমার।

দেবল ব্রাহ্মণগণে করে অত্যাচার।।

কারো কোন সানুনয় না শুনে কখন।

প্রহার করিছে কত বলি কুবচন।।

অসহ্য সে অত্যাচার বর্ণনা অতীত।

দেবল ব্রাহ্মণগণ হইল ব্যথিত।।

দেশ ছাড়ি কেহ কেহ করে পলায়ন।

রাজার স্ববশে তবু নহে কোনজন।।

কেহ গিয়ে ধান্য ক্ষেতে রোপিতেছে ধান্য।

ধানী নমঃশূদ্র বলে হ’ল সবে গণ্য।।

কেহ গিয়ে মৎস্য ধরে বিলের মাঝারে।

জিয়ানী বলিয়া আর না মারে তাহারে।।

কেহ কাটা মৎস্য বেঁচে পশিয়ে বাজার।

সব ঠাই বলে ভাই আমরা কাড়ার।।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

কেহ কেহ বলে ভাই কি করি এখন।।

না পারি সহিতে ভাই এই অত্যাচার।

নিশ্চয় কারণ নিতে হইবে রাজার।।

কেহ বলে গোত্র ত্যজি জীবন বাঁচাও।

ভাল যদি চাও তবে অন্য গোত্র কও।।

স্বগোত্র ত্যজিয়ে এবে অন্য গোত্র হ’ব।

মুনি মধ্যে শ্রেষ্ঠ এক আছয় কাশ্যপ।।

কাশ্যপ গোত্রজ বলি কহে যেই জন।

তাঁর প্রতি অত্যাচার না করে কখন।।

পবিত্র হইল ত্যাগী এই সে কারণ।

পার্বত্য প্রদেশে কেহ করিল গমন।।

ভাওয়ালে র’ল গিয়ে রাখিতে জীবন।

নমঃশূদ্র বলি তারা কহে সর্বজন।।

শূদ্র নয় দ্বিজ হয় নমঃশূদ্র জাতি।

বল্লাল কারণে হয় এ হেন দুর্গতি।।

গোত্র ভ্রষ্ট হ’ল বটে ধর্ম ভ্রষ্ট নয়।

ব্রাহ্মণ পদ্ধতি নিয়ে অনুক্ষণ রয়।।

পূর্ব অনুরাগ কেহ কভু ভুলে নাই।

ব্রাহ্মণের ক্রিয়া ধর্ম পালিছে সবাই।।

কালগুণে মহতেরা সতেজ লুকায়।

তাহাতে কি মহতের মান কমে যায়।।

সেই মত লুকায়িত নমঃশূদ্রগণ।

ভুলে নাই ব্রাহ্মণের ব্রহ্মত্ব রতন।।

পরে শুন যে ভাবেতে হয় পরিচয়।

বলিতে দুঃখের কথা মুখে না জুয়ায়।।

এদিকেতে শ্রীসুতপা নামে যেই জন।

আইলেন বংগ দেশে করিতে ভ্রমণ।।

শুনিতে পাইল ক্রমে সব বিবরণ।

মর্মব্যথা পেয়ে মুনি করে বিচরণ।।

মনে ভাবে হয়ে ব্রহ্ম কুলে অত্যাচার।

এস্থান ত্যাজিতে এবে উচিৎ আমার।।

এবে দেখি কোথা যত দেবল ব্রাহ্মণ।

কি ভাবেতে কালক্ষয় করে সর্বজন।।

এত ভাবি ভাওয়ালে করিল গমন।

দেবলা ব্রাহ্মণগণে পাইল তখন।।

আদ্যোপান্ত বিবরণ সকল শুনিল।

প্রকৃত ব্রাহ্মণ বলে জানিতে পাইল।।

রহিল তাদের সনে হইয়া মিলন।

কে খণ্ডাতে পারে বল বিধির লিখন।।

তা সবার পাশে দিল নিজ পরিচয়।

সকলে রহিল তথা আশ্বস্ত হৃদয়।।

ক্রমে তারা সুতপার গুণে বাধ্য হ’ল।

সুতপাকে গুরু বলি স্বীকার করিল।।

সুতপাও তাহাদের ভক্তিবাধ্য হ’য়ে।

নমঃশূদ্র কন্যা এক করিলেন বিয়ে।।

সেই গর্ভে জন্মিলেক পুত্র একজন।

জয়দেব বলি নাম রাখে সর্বজন।।

তাঁর হ'ল এক কন্যা দুইটি নন্দন

প্রতাপ প্রসন্ন নাম সর্ব সুলক্ষণ।।

নন্দিনীর নাম রাখে ভগবতী নামে।

বিবাহ হইল তার কলাকোপা গ্রামে।।

মহাবল পরাক্রান্ত পুত্র দুইজন।

অস্ত্রে শস্ত্রে বিশারদ যুদ্ধে বিচক্ষন।।

ভাওয়ালের যে রাজা পিতৃ নাম পুরি।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

নমঃশূদ্রগণ তথা প্রতাপের সনে।

পূর্ব দুঃখ পাশরিয়ে রহে এক মনে।।

বল্লাল আশ্রিত বিপ্র যত জন ছিল।

এ সব জানিয়া তারা প্রমাদ গণিল।।

মহাবল পরাক্রান্ত তারা যদি হয়।

নিশ্চয় শাসিবে পরে হেন মনে লয়।।

অতএব এবে সবে হও সতর্কিত।

সুযোগ পাইলে তারা শাসিবে নিশ্চিত।।

এত বলি সবে মিলে করে মন্ত্রণা।

তাগিদে মারিয়া ভাই ঘুচাও যন্ত্রণা।।

কৌশলেতে তা সবাকে করহ নিধন।

রক্ষা যদি কর সবে আপন জীবন।।

কেহ বলে চল তবে দুই চারিজন।

সঙ্গে করি বিপ্র লহ একজন।। (একশব্দ নেই)

সেই স্থানে গিয়ে এক কৌশল করিব।

প্রকারেতে তা সবার জীবন হরিব।।

এইমত পরামর্শ করি সর্বজন।

সঙ্গে নিল বৃদ্ধ দ্বিজ অতীব দুর্জন।।

ভাওয়ালেতে গিয়ে তারা দিল দরশন।

জয়স্তু বলিয়ে করে সভাতে গমন।।।

ব্রাহ্মণ হেরিয়া রাজা প্রতাপ প্রসন্ন।

ব্রাহ্মণের প্রতি দোঁহে দেখায় সৌজন্য।।

পাদ্য অর্ঘ দিয়ে পূজে ব্রাহ্মণের পদ।

ব্রাহ্মণেরা বলে তব বাড়ুক সম্পদ।।

স্বস্তি বাণী বলি সবে সভায় বসিল।

কেহ নাহি জানে গুপ্ত শত্রু প্রবেশিল।।

বাক্যের প্রবন্ধে যত চাটুকার গণ।

রাজা প্রতি বলে দাও ব্রাহ্মণ ভোজন।।

কল্যাণ হবে শুন তব মহাশয়।

তোমার মত যে নাহি হেরি সদাশয়।।

চাটুকার বাক্যে চলে ভাই দুইজন।

স্বীকার করিল দিতে ব্রাহ্মণ ভোজন।।

বৃদ্ধ বিপ্রে রাখি পরে বিদায় মাগিল।

বৃদ্ধ বিপ্রে কূট জ্বাল ক্রমে বিস্তারিল।।

দুই ভাই নাহি জানে তাহার কারণ।

অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস বলিয়ে ব্রাহ্মণ।।

সুযোগ পাইলে বিপ্র অতি সঙ্গোপনে।

মধুর বাক্যেতে কহে বড় রাণী স্থানে।।

শুন মাগো তোমা আমি বড় ভালবাসি।

করিতে কল্যাণ তব আমি হেতা আসি।।

যেন ইহা নাহি জানে কভু ছোট রাণী।

প্রকারে করিব তোমা রাজার জননী।।

বিপ্রগণ সেই দিন আসিবে হেথায়।

এক কর্ম ক’র মাগো সেইত সময়।।

বারি পূর্ণ ঝারি দিয়ে করিও ভকতি।

বিপ্র বরে তব পুত্র হইবে ভূপতি।।

এক যুক্তি দেয় বিপ্র উভয় রাণীকে।

নিজ নিজ স্বামী পাশে বলেছে কৌতুকে।।

পরে হ’ল সেইদিন আইল ব্রাহ্মণ।

কূটচক্রে ভাবে কর্ম করিছে সাধন।।

হেন কালে বড় রাণী ঝারি নিয়ে হাতে।

চলিলেন তিনি সেই ব্রাহ্মণের সাক্ষাতে।।

ছোটরাণী বলে দিদি তুমি যাও কোথা।

ব্রাহ্মণ বারিতে শুধু মোর আছে কথা।।

এক কথা দুই রাণী বলে বারে বার।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

হেরে তাই দুই ভাই হইল বাহির।

অস্ত্র হাতে দোঁহার কম্পিত শরীর।।

একে বলে মম নারী এ কার্য্য করিবে।

অন্যে বলে তাহা কভু সঙ্গত না হবে।।

এই মত বাক্য যুদ্ধ করে দুই জন।

ক্রোধেতে দোঁহার অংগ কম্পে ঘনে ঘন।।

কে বল খণ্ডাতে পারে বিধির লিখন।

দোঁহার অস্ত্রেতে হয় দোঁহার নিধন।।

করতালি দিয়া ধায় যতেক ব্রাহ্মণ।

বলে এত দিনে কর্ম হইল সাধন।।

কুচক্রি ব্রাহ্মণ দ্বারা হ’ল এই কর্ম।

দুই রাণী ক্রমে তার জানিলেন মর্ম।।

পঞ্চ মাস গর্ভবতী ছিল বড় রাণী।

পতিশোকে দগ্ধীভূতা দিবস যামিনী।।

ক্রমে দশ মাস গত হইল যখন।

প্রসবিল এক পুত্র সর্ব সুলক্ষণ।।

কুমার বলিয়ে নাম রাখিল তাহার।

বল্লাল আশ্রিত বিপ্র পায় সমাচার।।

পুনঃ করে কুমন্ত্রণা বধীতে কুমারে।

তস্কর পাঠাও এক ভাওয়াল নগরে।।

প্রাণবধ কর তার অতি সুকৌশলে।

পাষাণে আছাড়ি কিংবা ফেলিয়ে সলিলে।।

এত শুনি যায় তথা শিক্ষিত তস্কর।

রাহু যেন চলি যায় গ্রাসিতে ভাস্কর।।

অতি সন্তর্পণে সেই লইল কুমারে।

রূপ হেরি স্থির চিত্তে কুমারে নেহারে।

কুমারের কান্তি হেরি তস্কর ভুলিল।

সামান্য না হবে তাহা অন্তরে বুঝিল।।

কুমারে করিয়া কোলে দূর দেশে যায়।

পটুকালী গিয়ে শেষে করিল বিক্রয়।।

বণিকেরা মুগ্ধ হ’য়ে কুমারের রূপে।

রাখিলেন মহম্মদ ঘোরীর সমীপে।।

সে সব লিখিতে গেলে গ্রন্থ বেড়ে যায়।

সেই বংশ হয় লোপ ব্রাহ্মণ দ্বারায়।।

এত শুনি রামতপা নামে হন যিনি।

স্বস্ত্রীকে ভ্রময় তীর্থ সদাকাল তিনি।।

পূর্বদেশে এসে সবে জানিল বৃত্তান্ত।

তাহাতে দুঃখিত হ’ল প্রাণেতে একান্ত।।

কাশী কাঞ্চি দ্রাবিড়াদি ভূমি বৃন্দাবন।

একে একে স্ব তীর্থ করিল ভ্রমণ।।

রামদাস নাম তিনি করিয়ে ধারণ।

ক্রমে লক্ষ্মীপাশা এসে দেন দরশন।

নবগঙ্গা নদী লক্ষ্মীপাশার উত্তরে।

সুরধনী নাম ব্যাখ্যা রামদাস করে।।

সুরধনী দক্ষিণেতে নিজ বাসস্থান।

স্বস্ত্রীক রহেন তথা আনন্দিত প্রাণ।।

হরিকথা আলাপনে মত্ত অহর্নিশি।

মোহিত হইল যত লক্ষ্মীপাশাবাসী।।

স্বজাতি হেরিয়ে প্রাণে বাড়িল উল্লাস।

প্রেমানন্দে সেই স্থানে করিলেন বাস।।

কেহ বলে রামতপা কেহ ব্রহ্মচারী।

কোন জন বলে রাম রাম ব্রহ্মচারী।।

এইভাবে বহুদিন অতীত হইল।

সে স্থান ত্যাজিয়ে কেহ যাইতে নারিল।।

রমণী তাহার হয় পতি অনুরক্তা।

প্রকৃত প্রস্তাবে ধনী হন হরিভক্তা।।

সে নারীর প্রাণে হ’ল পুত্রের কামনা।

স্বামীপাশে নিবেদিতে সাহস করে না।।

পতি হয় সুপবিত্র তাহে ব্রহ্মচারী।

স্বস্ত্রীক রয়েছে তবু নাহি স্পর্শে নারী।।

এহেন স্বামীর পাশে বলিবে কেমনে।

অনুক্ষণ সেই কথা ভাবে মনে মনে।।

একদিন নিশিযোগে পতিপদ প্রান্তে।

পতিপদ করে পূজা বসিয়ে একান্তে।।

রামদাস পত্নী প্রতি বলেছে বচন।

কেন হেরি প্রিয়ে তব মলিন বদন।।

ব্রাহ্মণী বলেছে নাথ কি কহিব আর।

অন্তরেতে পুত্রবাঞ্ছা হ’য়েছে আমার।।

পতি বাক্যে রামদাস বলেছে তখনে।

কাত্যায়নী ব্রত তুমি কর সযতনে।।

কাত্যায়নী ব্রত করি রাণী যশোমতী।

পুত্ররূপে প্রাপ্ত হ’ল অখিলের পতি।।

সংসারে ধর্মেতে মতি নাহিক আমার।

কেমনে পুরাব প্রিয়ে বাসনা তোমার।।

পতির বচনে সতী নিরস্ত রহিল।

স্বামীর সুখেতে সুখ মনেতে করিল।।

একদিন শুন এক অপূর্ব ঘটন।

কাত্যায়নী মাতা এসে দিলেন দর্শন।।

ব্রহ্মচারী প্রতি কহে মাতা শুভঙ্করী।

মম বাক্যে একবার স্পর্শ কর নারী।।

তোমা হতে সপ্তম পুরুষ হবে যবে।

তব বংশে ভগবান অবতীর্ণ হবে।।

যদি তুমি মম বাক্যে না কর পালন।

আসিতে না পারে সেই ব্রহ্ম সনাতন।।

অতএব মম বাক্য কর না লঙ্ঘন।

পুত্র রত্ন পারে তুমি হরি পরায়ণ।।

আর এক কথা মম শুন যাদুমণি।

রহিবে অদ্ভুত কীর্তি ব্যাপিয়া ধরণী।।

তব মৃতদেহ যথা সৎকার করিবে।

পীঠস্থান বলি সবে জানিতে পারিবে।।

চারিদিন সেই স্থানে রবে মতিমান।

দেব নরে প্রণমিবে বলি পীঠস্থান।।

মাতৃ বাক্যে ব্রহ্মচারী রমণী স্পর্শিল।

মনোমত পুত্ররত্ন তাহাতে জন্মিল।।

প্রচুর অদ্ভুত লীলা বুঝে সাধ্য কার।

কবি কহে কর গুরুচাঁদ পদ সার।।

 

চন্দ্রমোহনের কাহিনী ও বংশ আখ্যান

অতপর ব্রহ্মচারী                    মুখে বলে হরি হরি

পুত্র মুখ করি দরশন।

কিছুদিন গত পরে         চলি যায় লোকান্তরে

মাতা পুত্র করয় রোদন।।

যথায় সৎকার করে        মন্দির হইল পরে

কালীমূর্তি হ’ল প্রতিষ্ঠিত।

মাতা পুত্র তাই হেরি      মুখে বলে হরি হরি

হ’ল তাতে আনন্দ পুর্ণিত।।

পরে ত্যজি লক্ষ্মীপাশা    জয়পুর করে বাসা

ভালবাসা পায় সবঠাই।

সদা করে সাধুসঙ্গ         প্রেমে পুলকিত অঙ্গ

সে ভাবের তুল্য দিতে নাই।।

তস্য পুত্র গুণধাম                    শুকদেবতার নাম

তার পুত্র নাম কালিদাস।

পাথর ঘাটেতে গিয়ে      বাস করে হৃষ্ট হ’য়ে

লীলামৃত আছয় প্রকাশ।।

রবিদাস নিধিরাম          কনিষ্ঠ শ্রীজীব নাম

তিন পুত্র সহিত তথায়।

সদা করে সাধু সেবা       সংকীর্তন রাত্রি দিবা

সাধু সঙ্গে সময় কাটায়।।

বাণিজ্যে উপার্জ্জে ধন     তাহাতে সাধু সেবন

করি রবে আনন্দচিত।

হরে কৃষ্ণ প্রেমাধীন       বিগত হইত দিন

ক্ষেত্র কার্য্য অল্প পরিমিত।।

একদিন কৃষ্ণ ধ্যানে       তুলসী দেবীর স্থানে

বসেছিল কালিদা যিনি।

করে করি মালা জপ      অন্তরে কৃষ্ণ আরোপ

হেনকালে হ’ল দৈববাণী।।

সাধু সেবা যে দিনিতে     হ’বে তব ভবনেতে

এই বিলে আছয়ে পাথর।

আসিয়া বিলের কুলে      দাঁড়াইও হরি বলে

ভুরি ভুরি উঠিবে প্রস্তর।।

সে সব পাথর নিয়ে        নিজ ভবনেতে গিয়ে

সাধু সেবা করিও যতনে।

সাধু সেবা হ’লে পরে      আসিয়া বিলের তীরে

সে পাত্র রাখিও পূর্বস্থানে।।

এরূপ করেন তিনি         গ্রাম্যলোকে তাই শুনি

দিত কালিদাসের দোঁহাই।

পাথর লইয়ে পরে         মহোৎসব সাঙ্গ করে

সে পাথর রাখে পূর্ব ঠাই।।

লীলামৃত গ্রন্থ মাঝ         লিখেছেন রসরাজ

পুনঃ তাহা না লিখিব আর।

একদিন একজনে          সে সব পাথর এনে

একখানি রাখে নিজ ঘর।।

সন্ধ্যা হইল উত্তীর্ণ          সেই পাথরের জন্য

হু হু শব্দ উঠিতেছে জলে।

বিলের যত পাথর         সবে হ’য়ে একত্তর

সেই জল বৃদ্ধি হ’য়ে চলে।।

যে ঘরে পাথর ছিল        জলেতে ভাসিয়া নিল

মধুমতী জলের মাঝারে।

দেব শীলা স্বপ্ন বেশে      বলি গেল কালিদাসে

কলুষ পশিল এ নগরে।।

সে কালিদাসের সুত       নিধিরাম জ্যেষ্ঠ পুত্র

তিনি হন পরম নৈষ্ঠিক।

সে নিধিরামের ঘরে       দুই পুত্র জন্ম ধরে

মোচনরাম কনিষ্ঠ কার্ত্তিক।।

যে জন মোচনরাম        অশেষ গুণের ধাম

সফলা নগরে করে বসবাস।

তার হয় পঞ্চ পুত্র          ক্রমে শুন তার সূত্র

হরি প্রেমে সদাই উল্লাস।।

যশোমন্ত সনাতন                   প্রাণকৃষ্ণ রামমোহন

রণকৃষ্ণ এ পাঁচ সন্তান।

সর্ব জ্যেষ্ঠ যশোমন্ত       তার হয় পঞ্চ পুত্র

এ পঞ্চের ঠাকুর আখ্যান।।

এ কয় পুরুষ মাঝে        মত্ত সাধু সেবা কাজে

কৃষ্ণ প্রেম ভক্তি নিরবধি।

কে বা হ’ল সন্ন্যাসী        কেহ বৃন্দাবনবাসী

তাহে বংশে ঠাকুর উপাধি।।

তুলনা বিহীন সবে         মত্ত হরি প্রেমার্ণবে

অনুক্ষণ চিত্ত প্রেমময়।

মহাপ্রভু এ বংশেতে       দেখা দিল অবনীতে

হরিচাঁদ রূপেতে উদয়।।

যাহার চরিত্র কথা          লীলামৃতে আছে গাঁথা

বর্ণনা অতীত সুধাকর।

শিরে ধরি গুরুচাঁদে        মাতিয়ে পরমানন্দে

বিচরণ করিল প্রচার।।

 

হরি পিতা যশোমন্তের কাহিনী

 

যশোমন্ত চরিত্র কথা অমৃত ভাণ্ডার।

প্রবাহিত হয় সদা যেন সুধাধার।।

যে জন করিবে পান ভব ক্ষুধা যাবে।

ত্রিতাপ যাতনা হ’তে নিস্তার সে পাবে।।

সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পুরুষ প্রধান।

দিবানিশি করে সদা হরি গুণ গান।।

শিশুকাল হ’তে হয় হরি পরায়ণ।

তিলকাদি ছাপা মালা অঙ্গেতে ধারণ।।

বৈষ্ণব লক্ষণ হরি প্রেম অনুরাগী।

সর্বলোকে বলিতেন বৈরাগী বৈরাগী।।

যশোমন্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হইল যখন।

অন্নপূর্ণাসহ পরে প্রণয় বন্ধন।।

পরম বৈষ্ণবী মাতা অন্নপূর্ণা সতী।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

জীবন মরণে গুরু হৃদয় ধারণ।

দিবানিশি ভজে সতী পতির চরণ।।

যে ভাবেতে হরি পিতা জগতে উদয়।

বলিতে বাসনা মম জাগিল হৃদয়।।

ধরা দ্রোণ নামে হয় ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।

অন্তরেতে পূজে সদা হরি চিন্তামণি।।

ভিক্ষায় করিত সদা উদর পূরণ।

তিলকাদি ছাপা মালা করিত ধারণ।।

হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি প্রাণধন।

হরি নাম নিতে সদা ঝরে দু’নয়ন।।

জীবন যৌবন হরি কুলমান হরি।

শ্রীহরি ক্ষুধার অন্ন পিপাসার বারি।।

এইভাবে মত্ত প্রেমে ধরা আর দ্রোণ।

ধরা পাশে দিতে ধরা চলে নারায়ণ।।

নারদে করিয়া সঙ্গে অতিথির বেশে।

উপনীত হইলেন ক্ষুধার আবেশে।।

ধরা পাশে মিষ্ট বাক্য ব’লেছে বচন।

খেতে দাও মাগো মোরা অতিথি দু’জন।।

শ্রুতমাত্র দোঁহাকার কম্পিত জীবন।

গৃহেতে তণ্ডুল নাই ভাবে দুইজন।।

বসিতে আসন দিয়া ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।

পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পূজে হরি চিন্তামণি।।

ব্রাহ্মণ চলিল ভিক্ষা করিতে নগরে।

ব্রাহ্মণী যে একাকিনী রহিল আগারে।।

কাঁদিয়ে ব’লেছে ধরা কোথা দয়াময়।

দাসীকে করহ রক্ষা এসে এ সময়।।

দ্রোণ না ফিরিল ঘরে ব্রাহ্মণী আকুল।

নয়ন জলেতে তার ভাঙ্গিল দু’কুল।

অতিথি অভুক্ত যায় কি করি এখন।

কেন বা রাখিব বল এ ছার জীবন।।

এমত আকুল হ’য়ে কাঁদিছে ব্রাহ্মণী।

বলে কৃপা কর মোরে হরি গুণমণি।।

মম গৃহে পাঠাইলে অতিথি দু’জন।

কিছু নাই কিবা দিয়ে করাব ভোজন।।

কাঁদিয়ে অলাবু পাত্র নিল কক্ষ পরে।

সরসীর তীরে এক মুদীর দোকান।

উপনীত হয় ধরা দোকানীর স্থান।।

কেঁদে কেঁদে কহে ধরা দোকানীর ঠাই।

ধারেতে বেশাতি কিছু লইবার চাই।।

মম গৃহে আসিয়াছে অতিথি দু’জন।

কিছু নাই কিবা দিয়ে করাব ভোজন।।

আমাকে বেশাতি দেহ ধরি তব পায়।

নইলে অতিথি মম অভুক্ত যে যায়।।

এত শুনি সে দোকানী কহিল তখন।

এক কথা বলি তোমা কর গো শ্রবণ।।

বক্ষ পয়োধর কেটে দেহ যদি মোরে।

তবে ত বেশাতি পারি দিতে গো তোমারে।।

এমত অযোগ্য ভাষা বলিল দোকানী।

ব্রাহ্মণীর শিরে যেন পড়িল অশনি।।

ধরা বলে কেন বল এমন বচন।

স্তন কেন দিতে পারি আপন জীবন।।

স্বীকার করিল ধরা দোকানী সদন।

ওদিকে সন্তোষ হ’ল শ্রীমধুসুদন।।

চাবুকে কাটিয়ে স্তন দিল দোকানীরে।

দোকানী লইল স্তন প্রফুল্ল শরীরে।।

চাউল ডাউল তৈল লবণাদি লঙ্কা।

পেয়ে দ্রব্য ধরা বলে গেল মোর শঙ্কা।।

দ্রব্য ল’য়ে হর্ষ চিতে করিল গমন।

জলপাত্র কক্ষে চলে আপন ভবন।।

বড়ই অদ্ভুত খেলা খেলে চক্রপাণি।

এদিকে অতিথি রূপে অপরে দোকানী।।

কেবা বুঝে শ্রীহরির এ অপূর্ব লীলা।

বুঝিতে ভক্তের মন করে কত ছলা।।

রন্ধন করিতে ধরা ভাসে আঁখি জল।

অতিথি সেবিতে নারি তাহে অন্তর্জল।।

মম গৃহে আসিয়াছে অতিথি দু’জন।

ক্ষুধায় পীড়িত বুঝি হ’ন দুইজন।।

নাহি জানি কত কষ্ট পাইল অন্তরে।

এতেক ভাবিয়া ধরা কাঁদিছে অন্তরে।।

রন্ধন করিল শেষ কাঁদিয়া কাঁদিয়া।

ভোজনের ঠাই করে ব্যাকুলিত হিয়া।।

নারদে লইয়া ভজ করে দয়াময়।

ভোজনের দ্রব্য যত ব্রাহ্মণী যোগায়।।

স্তন কাটা রুধি ছিল বসনে ধরার।

তাই হেরে হ’ন হরি ক্রোধিত অন্তর।।

ধরা প্রতি রুঢ় ভাষে বলে নারায়ণ।

অস্পৃশ্য রমণী তোর মন্দ আচরণ।।

হেন দশা তোর হ’ল কেন না বলিলি।

অস্পর্শিতা হ’য়ে কেন মোরে খেতে দিলি।।

কেঁদে কেঁদে ধরা দেবী ব’লেছে তখন।

অস্পর্শিতা নহে আমি হ’য়েছি কখন।।

আমার কর্মের ফের কি বলিব আর।

করিতে না পারি কভু আতিথ্য দোঁহার।।

স্বামী মোর তোমা দোঁহে রাখিয়ে ভবনে।

নগরেতে গিয়াছেন ভিক্ষার কারণে।।

বহুক্ষণ গেল নাশ নাহি এল ঘরে।

সেই মনোদুঃখ মম দু’নয়ন ঝরে।।

অতিথি অভুক্ত গেলে জীবনে কি ফল।

এত ভাবি চলিলাম আনিবারে জল।।

গিয়ে দেখি তথা বৈসে এক মহাজন।

বিনয় বচনে বলি দোকানী সদন।।

কাতরে যাচিনু দ্রব্য ধারেতে আনিতে।

দোকানী বলিল মোরে স্তন কেটে দিতে।।

অন্তরে ধারণা এক জাগিল আমার।

স্তন দিয়া হয় যদি অতিথিসৎকার।।

তুচ্ছ স্তন তাতে কিবা আছে ভয়।

অতিথি সৎকার মোর যে প্রকারে হয়।।

এত ভাবি নিজ হস্তে ছুরিকা ধরিয়া।

দোকানীরে স্তন দিনু কর্তন করিয়া।।

পড়িতেছে সেই রুধি বাহিয়া বসন।

করিয়াছি এই কর্ম ক্ষমহ ব্রাহ্মণ।।

বলিতে বলিতে ধরা করিছে রোদন।

শুনিয়া বিস্মিত সে নারদ তপোধন।।

দয়াময় বলে শুন বচন আমার।

যে ভাবেতে অদ্য মোরে করালে আহার।।

এই ঋণ মাগো আমি শোধিতে নারিব।

দ্বাপরেতে পুত্র রূপে এই স্তন পিব।।

এবে মাগো মম ঠাই এস একবার।

দেখি কিবা ভাবে কাটিয়াছে পয়োধর।।

কাঁদিতে কাঁদিতে ধরা প্রভুপাশে এল।

কাটা স্তন পরে প্রভু হস্ত বুলাইল।।

অক্ষত হইল স্তন পূর্বের মতন।

ধরা ভাবে এত নয় সামান্য রতন।।

নিশ্চয় গোলক নাথ ছলনা করিতে।

অতিথির বেশে এল দাসীর গৃহেতে।।

এত ভাবি ধরা দেবী করিছে রোদন।

হেনকালে নিজ গৃহে আইলেন দ্রোণ।।

সেবা করিতেছে ধরা দয়ার আঁধারে।

দু’নয়ন ঝর ঝর ঝরে শতধারে।।

ধরা প্রতি কহে দ্রোণ কহ সমাচার।

কিবা দিয়ে করিয়াছ অতিথি সৎকার।।

স্বামী পাশে ধরাদেবী সকলি বলিল।

শ্রুতমাত্র দ্রোণ যেন বিস্মিত হইল।।

কেমনেতে সে যাতনা সহিলে হে সতী।

ধরা বলে কি কহিব ওহে প্রাণপতি।।

ছলিবারে এল দেখ দেব নারায়ণ।

কাটা স্তনে পদ্ম হস্ত করিল অর্পণ।।

অক্ষত হ’য়েছে স্তন নাহি সে বেদন।

কৃপা করে এল দেখ দেব নারায়ণ।।

ব্রাহ্মণ শুনিয়া তাহা অবাক হইল।

দোঁহে মিলে প্রভু পার্শে কাঁদিতে লাগিল।।

প্রভু বলে শুন বাপ তোমাকে শুধাই।

চির ঋণী হইয়াছি তোমা দোঁহা ঠাই।।

এই ঋণ আমি কভু শোধিতে নারিব।

জন্মে জন্মে পিতামাতা বলিয়া ডাকিব।।

এত যদি বলিলেন দেব গদাধর।

ভূমিতে লুটিয়ে দোঁহে কাঁদে পুনর্বার।।

কৃতাঞ্জলি হ’য়ে পরে স্তব আরম্ভিল।

কৃপা কর দীনহীনে ভকত বৎসল।।

তুমি আদি গুণনিধি ত্রিজগৎগুরু।

যুগে যুগে হও তুমি বাঞ্ছাকল্পতরু।।

তব তত্ত্ব নাহি জানি ওহে হৃষীকেশ।

কৃপা করি ধর প্রভু স্বরূপের বেশ।।

স্তুতি করে দোঁহে মিলি প্রেমাবিস্ট কায়।

দোঁহে মিলি পড়ে ঢলি মহাপ্রভু পায়।।

অচেতন হইল সেই দ্রোণ আর ধরা।

ভকত বৎসল হরি পড়িয়াছে ধরা।।

ভকতের বাঞ্ছা হরি করিতে পূরণ।

চতুর্ভুজ মূর্তি প্রভু করিল ধারণ।।

শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চতুর্ভুজধারী।

পরিধান পীতাম্বর মুকুন্দ মুরারি।।

ক্ষণ মাত্র দেখালেন স্বরূপের রূপ।

পুনরায় নারায়ণ ধরে পূর্ব রূপ।।

দোঁহে মিলি সকাতরে করিল রোদন।

মহাপ্রভু বলে শুন আমার বচন।।

দ্বাপরেতে হ’বে দোঁহে নন্দ নন্দরাণী।

আমি হ’ব তোমাদের পুত্র নীলমণি।।

যেই স্তন কেটে দিলে আমার কারণ।

তব কোলে বসি মাগো পিব সেই স্তন।।

পুত্র বেশে তব গৃহে রহিব তখন।

রাখালের সনে আমি চ’রাব গোধন।।

আকুল হইয়া কাঁদে ধরা আর দ্রোণ।

প্রবোধিয়া দোঁহাকারে চলে নারায়ণ।।

পরজন্মে জন্মে দোঁহে বৃন্দাবন ধামে।

প্রকাশ হইল নন্দ নন্দরাণী নামে।।

সে দ্বাপরে বসি হরি যশোদার কোলে।

ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ করে মা মা বলে।।

বৃন্দাবন লীলা সাঙ্গ করি দয়াময়।

গৌররূপে মায়াপূরী মাঝে জন্ম লয়।

ব্রহ্মকুলে জনমিল নন্দ গোপরাজ।

জগন্নাথ মিশ্ররূপে নবদ্বীপ মাঝ।।

শচীরাণী হইলেন মাতা নন্দরাণী।

গৌররূপধারী পুত্র সেই নীলমণি।।

সেই যুগে মহাপ্রভু করিল সন্ন্যাস।

তাহাতে মহাপ্রভুর না পুরিল আশ।।

মাতৃ সেবা অপরাধ তাহাতে পড়িল।

মাতৃ পাশে অঙ্গীকার তখন করিল।।

তব গর্ভে জন্ম ল’ব আরো দুইবার।

শেষ লীলা খেলাইব ঈশানে আমার।।

শেষ লীলা হ’বে মাগো মোর চমৎকার।

নিজে যে কি করিব গো নিজে বোঝা ভার।।

এই রূপে মাতৃ ঠাই অঙ্গীকার ছিল।

শ্রীনিবাসরূপে প্রভু পরে জন্ম নিল।

নিত্যানন্দ নরোত্তম রূপে জনমিল।।

সে অদ্বৈত রামচন্দ্র রূপেতে উদিল।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

খেতরিতে তিন প্রভু প্রেম প্রচারিল।

অকামনা প্রেমভক্তি তাতে না রহিল।।

পরজন্মে সফলা নগর করে ধন্য।

হরিচাঁদ রূপে এসে হন অবতীর্ণ।।

যশোমন্ত সুত রূপে হ’লেন প্রসূত।

তখনি ক্ষীরোদ শক্তি হ’ল আবির্ভূত।।

জ্যোতিঃরূপে সেই শক্তি হইল মিলন।

আমি হরি আমি হরি বলিল তখন।।

সেই শচী অন্নপূর্ণা হরিচাঁদ মাতা।

যশোমন্ত রূপে নন্দ হ’ন হরিপিতা।।

হেন ভাবে হরিচাঁদ এলেন ধরায়।

কবি রসরাজ তাহা প্রকাশ করয়।।
হরিপিতা যশোমন্ত পরম বৈষ্ণব।

বৈষ্ণবে লইয়ে সদা করে মহোৎসব।।

ভক্তিভরে স্ত্রী পুরুষে বৈষ্ণবে সেবিত।

হা কৃষ্ণ বলিয়ে সদা নয়ন ঝরিত।।

ক্ষণে ক্ষণে বলিতেন কোথা বিশ্বরূপ।

দুঃখিনীকে দেখা দাও ধরিয়ে স্বরূপ।।

এইমত কেঁদে কেঁদে হইত আকুল।

অন্তর্যামী হরি তাতে হ’তেন ব্যাকুল।।

একদিন অন্নপূর্ণা হ’ন শুদ্ধমতি।

বিশ্বরূপ জন্মে তাহে সুন্দর মুরতি।।

কৃষ্ণপদ যশোমন্ত সদা করে আশ।

এই হেতু পুত্র নাম রাখে কৃষ্ণ দাস।।

পুত্রকে ডাকিতে কৃষ্ণ নাম করা হ’বে।

কৃষ্ণ দাস নাম রাখে তাহা মনে ভেবে।।

এক পুত্র কোলে পেয়ে অন্য নহে আশ।

যতনে পালন করে পুত্র কৃষ্ণ দাস।।

এইভাবে যশোমন্ত পুত্রবান হ’ল।

যশোমন্ত প্রীতে সবে হরি হরি বল।।

 

কৃষ্ণদাসের জন্ম বিবরণ ও অন্নপূর্ণার প্রতি রামকান্তের বর প্রদান

 

বার শত নয় সালে সাতই আশ্বিনে।

বিশ্বরূপ জন্ম নিল এসে এ ভুবনে।।

এক পুত্র কোলে পেয়ে অন্য আশা নাই।

মহানন্দে সাধু সেবা করেন সদাই।।

কৃষ্ণ ব’লে অনুক্ষণ ঝরে দুটো আখি।

কেঁদে বলে কোথা মোর শ্যাম শুক পাখি।।

যশোদা আবেশ হ’য়ে কাঁদিত যখন।

বলে কোথা আছে মোর প্রাণকৃষ্ণধন।।

কোন দেশে আছ মম হৃদয়ের মণি।

বহুদিন হেরি নাই চন্দ্র মুখখানি।।

এই মত কাঁদে মাতা আকুল হইয়া।

আখিজল পড়িত যে বয়ান বাহিয়া।।

অন্তরেতে কৃষ্ণ চিন্তা বিনে চিন্তা নাই।

হা কৃষ্ণ বলিয়া কেঁদে ছাড়িতেন হাই।।

অতঃপর শুন এক অপূর্ব কথন।

হরিচাঁদ জনমের পূর্ব বিবরণ।।

বিশ্বামিত্র নামে মুনি রাম অবতারে।

পরে মুনি সান্দীপণী অবন্তি নগরে।।

কলিকালে গঙ্গাদাস রূপে নদীয়ায়।

ভারতী গোঁসাই শক্তি সম্মিলন তায়।।

পরজন্মে মুখডোবা কান্ত গুণমণি।

রামকান্ত নামেতে বৈষ্ণব চূড়ামণি।।

অন্তরে উল্লাস কৃষ্ণ প্রেম অনুরাগী।

সর্বলোকে বলিতেন বৈরাগী বৈরাগী।।

বাসুদেব মূর্তিখানি রাখিতেন সঙ্গে।

বাৎসল্য ভাবেতে সেবা করে মনোরঙ্গে।।

অন্নাদি প্রস্তুত করি সাধু রামকান্ত।

বলিতেন ভোগ লহ ওহে প্রাণকান্ত।।

(এক লাইন জ্ঞাপ)

ভক্তিভাবে রামকান্ত চাক্ষুষ দেখিত।।

এমত করিত সাধু বাসুকে লইয়া।

বাসুদেব কোলে করি বেড়ায় ভ্রমিয়া।।

রামকান্তে নিতে এলে শিষ্য কোনজন।

বলিতেন বাসুদেবে কর নিমন্ত্রণ।।

বসু যদি কৃপা ক’রে যায় তব ঘরে।

তবে তো যাইতে পারি বলিনু তোমারে।।

এইভাবে ভক্তাশ্রমে ভ্রমণ সদায়।

অনুক্ষণ বাসুগুণ গাহিয়ে বেড়ায়।।

মাঝে মাঝে আসিতেন সফলা নগরে।

অধিক্ষণ থাকিতেন অন্নপূর্ণা ঘরে।।

মা বলিয়ে ডাকে সাধু অন্নপূর্ণা মায়।

গুণ গুণ বাসু গুণ অনুক্ষণ গায়।।

ক্ষণে ক্ষণে বাসু মাতা ক্ষণে কৃষ্ণ মাতা।

ক্ষণে ক্ষণে ডাকিতেন বৈষ্ণব দুহিতা।।

অন্নপূর্ণা মাতা প্রতি রামকান্ত কয়।

বাসুকে করহ কোলে এ শুভ সময়।।

তাই শুনি বাসুদেবে করিত গ্রহণ।

রামকান্ত প্রেমানন্দে করিত ভ্রমণ।।

সপ্তাহ থাকিত বাসু অন্নপূর্ণা ঘরে।

ভক্তিভাবে অন্নপূর্ণা বাসু পূজা করে।।

একদিন স্বপ্নাদেশে নিশি অবসানে।

কৃষ্ণরূপ অন্নপূর্ণা দেখিল স্বপনে।।

হেরিলেন জ্যোতির্ময় রূপের মাধুরী।

শিরেতে মোহন চুড়া করেতে বাঁশরী।।

স্বামী পাশে বলিলেন স্বপন বৃত্তান্ত।

অন্নপূর্ণা প্রতিবাসী কহে যশোমন্ত।।

কৃষ্ণ চিন্তা কর সদা তাই হেন দেখ।

না কর প্রকাশ এবে নীরবেতে থাক।।

সেই দিন সেই ভাবে বঞ্চিল রজনী।

স্বপ্ন কথা বসি মাতা ভাবে একাকিনী।।

ঢেঁকিশালে চিড়া ভানে দক্ষিণেতে ঢেঁকি।

কৃষ্ণ বলে অন্নপূর্ণার ঝরে দুটি আখি।।

হেনকালে রামকান্ত বৈরাগী আসিয়া

স্তন পান করিলেন গলে হাত দিয়া।।

পুত্র ভাবে ঠাকুরাণী রাখিলেন কোলে।

স্নেহাবেশে ভাসে দু’টি নয়নের জলে।।

বলে অদ্য পোহাইল কি সুখ যামিনী।

প্রভাত আবেশ বুঝি ফলিল এখনি।।

রামকান্ত বলে মাগো বলি হে তোমারে।

বাসুদেব জন্ম ল’বে তোমার উদরে।।

কিছুদিন পরে রামকান্ত আর দিনে।

বাসুদেব কোলে করি বসিল যতনে।।

বাসুদেব বলে যাব সফলা নগরে।

পূজাদি লইব মাতা অন্নপূর্ণা ঘরে।।

বাসুদেবে ল’য়ে সাধু পরম কুশলে।

যশোমন্ত গৃহে আসি উপনীত হ’লে।।

মুহূর্তেক দিবা আছে সন্ধ্যার অগ্রেতে।

অন্নপূর্ণা ঝাঁট দেয় ঝাঁটা ল’য়ে হাতে।।

ঠাকুরাণী ঝাঁট দেন পূর্বাভিমুখেতে

রামকান্ত আসিলেন পূর্বদিক হ’তে।।

সম্মুখে যাইয়া সাধু বলে যে মাতায়।

কোলে কর বাসুরে সময় ব’য়ে যায়।।

আস্তে ব্যাস্তে বাসুদেবে রাখিলেন ধরে।

রাখিলেন পূর্বভাবে বাম কক্ষ ‘পরে।।

হইল অপূর্ব শোভা দরশন ক’রে।

রামকান্ত চারিদিকে নাচে ফিরে ঘুরে।।

সজল নয়ন সাধু প্রেমে পুলকিত

হাতে তালি দিয়ে নেচে নেচে গায় গীত।।

দেখরে নগরবাসী হ’ল কি আনন্দ।

অনায়াসে অন্নপূর্ণা পাইল গোবিন্দ।।

কিবা পুণ্য ক’রেছিল চৌধুরীর ঝি।

অনায়াসে কোলে পেল বাসুদেবজী।।

রামকান্ত কহে যশোমন্ত বৈরাগীরে।

কিছুদিন বাসুদেবে রাখ তব ঘরে।।

রামকান্ত বলে মাগো বড়ই মেনেছে।

যশোদার কোলে যথা গোবিন্দ ব’সেছে।।

কান্ত বলে থাক বাসু মায়ের কোলেতে।

কিছুদিন পরে তোমা লইব সঙ্গেতে।।

সপ্তাহ পর্যন্ত বাসু থাকে মাতৃ ঠাই।

স্নেহভরে পূজা করে তুল্য দিতে নাই।।

পুনঃ আসি রামকান্ত বাসুকে লইত।

বাসুকে করিয়া কোলে আনন্দে ভ্রমিত।।

এইমত রামকান্ত আসে আর যায়।

বড় ভাল বাসে সাধু অন্নপূর্ণা মায়।।

একদিন শুন এক অপূর্ব কথন।

নিশিযোগে যশোমন্ত দেখিল স্বপন।।

এক শিশু অন্নপূর্ণা কোলেতে বসিয়া।

স্তন পান  করিতেছে মা মা মা বলিয়া।।

নীল শতদলসম রূপ সুমধুর।

রাঙ্গা পায় শোভা করে বাজন নুপুর।।

গলদেশে বনমালা করিতেছে শোভা।

মস্তকে মোহন চুড়া অতি মনোলোভা।।

মোহন বাঁশরী করে করেতে শোভন।

এইমত যশোমন্ত নেহারে স্বপন।।

যশোমন্ত ঠাকুরাণী প্রতি বলে তাই।

স্বপনে হেরিনু প্রিয়ে তোমাকে জানাই।।

বিবরিয়ে সব কথা কহে যশোমন্ত।

অন্নপূর্ণা বলে তবে শুন প্রাণকান্ত।।

কেহ যদি দেখে কোন আশ্চর্য স্বপন।

নিশিযোগে প্রকাশ না করে বুধজন।।

যশোমন্ত বলে প্রিয়ে এবে নিশি নাই।

প্রভাত হইল নিশি চেয়ে দেখ তাই।।

মাতা বলে সুস্বপন দেখেছ নয়নে।

নিশি নাই বলে তাই ভাব মনে মনে।।

কিংবা কোন ভুত দৃষ্টি লেগেছে তোমার।

তাই তুমি হেন ভাব বল বার বার।।

যশোমন্ত বলে  যদি দানব লক্ষণ।

তবে কেন হেরিলাম মুরলী বদন।।

অন্নপূর্ণা বলে নাথ শুনহ বচন।

কৃষ্ণ চিন্তা তব হৃদে জাগে অনুক্ষণ।।

স্বরূপের রূপ তব নয়নে লাগিল।

তাই বুঝি হেন রূপ হৃদয়ে জাগিল।।

হেনভাবে সেই দিন নিশি পোহাইল।

প্রাতঃকালে রামকান্ত বৈরাগী আসিল।।

রামকান্ত অন্নপূর্ণা প্রতি ডেকে কয়।

বাসুকে কর মা কোলে কালগত হয়।।

এত বলি রামকান্ত বাসুকে অর্পিল।

অন্নপূর্ণা বাসুদেবে সস্নেহে ধরিল।।

বাসুকে করিয়া কোলে ঝরে দু’নয়ন।

ঘুরে ফিরে রামকান্ত করিছে কীর্তন।।

দ্রোণ বলে ওহে বাসু এস হে এখন। (দ্রোণ?)

এস মোরা অন্য ঠাই করিব ভ্রমণ।।

ইঙ্গিতে বলিছে বাসু এবে নহে যাব।

মাতৃ কোলে বসি আমি স্তন দুগ্ধ খাব।।

পেয়েছি সে নন্দরাণী আর পিতা নন্দ।

এই গৃহে পাব আমি অতুল আনন্দ।।

রামকান্ত প্রেমানন্দে বলিল বচন।

তাহাই করিও বাসু এস হে এখন।।

বুঝিয়া মধুর ভাব বাসুকে লইল।

অন্নপূর্ণা প্রতি মাতা পুত্রবর দিল।।

এইভাবে অন্নপূর্ণা ধন্য মাতা সতী।

স্ত্রী আচারে একদিন হইল শুদ্ধমতি।।

শয়নে ছিলেন শ্রীযশোমন্ত বৈরাগী।

অন্নপূর্ণা বসিলেন পদ সেবা লাগি।।

পদসেবি প্রণমিয়া করি যোড় পাণি।

পদপার্শ্বে শয়ন করিল ঠাকুরাণী।

যশোদা আবেশে বর দিল রামকান্ত।

বিরচিল তারক রসনা এ বৃত্তান্ত।।

শ্রীগুরুচাঁদ আদেশে কহে বিচরণ।

হরিচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্বজন।।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free