পৃষ্ঠাঃ ৩০১-৩২০
বিপক্ষ দলের যিনি ছিল সরকার।
কোন গুণে তারকেরে হতে নারে পার।।
ব্রাহ্মণ পন্ডিত তাহে হল কুতুহলী।
তারকে পরীক্ষা করে ব্রাহ্মণ মন্ডলী।।
ভাবগতে আছে লেখা শ্রীদাম পিলাপ।
কৃষ্ণ হারা সে শ্রীদাম কহিছে প্রলাপ।।
কহিতে “কানাই” তার কন্ঠ বেঁধে গেল।
কা, কা, কহিয়া শ্রীদাম কানাই কহিল।।
কি হেতু কহিল হেন রাখাল শ্রীদাম?
তারকে জিজ্ঞাসা করে যত গুণধাম।।
মোরা যাহা ব্যাখ্যা করি আগে শুন তাই।
প্রকৃত সিদ্ধান্ত যেন তাতে হয় নাই।।
মোরা বলি “তোৎলা” ছিল শ্রীদাম রাখাল।
এক সঙ্গে দিতে নারে কোন শব্দে তাল।।
এই ব্যাখ্যা করি বটে শান্তি নাহি পাই।
প্রকৃত সিদ্ধান্ত কিছু শুনিবারে চাই।।
সভাজনে সবে তাহা করে সমর্থণ।
শুনিয়া চিন্তত হ’ল তারক সুজন।।
মাথা হেঁট করি সাধু রহিল বসিয়া।
বলে “হরি কর দয়া হৃদয়ে আসিয়া।।
তুমি বিনে কেবা জানে কিসে কোন মর্ম্ম?
এ-সব সিদ্ধান্ত বলা নহে মোর কর্ম্ম।।
দয়া করে কহ কথা যদি দয়া হয়।
তুমি-ছাড়া তারকের কে আছে কোথায়?
এত ভাবি দুই চোখে বহে জল-ধারা।
আপনা-আপনি যেন হ’ল জ্ঞান হারা।।
ভকতের দুঃখ হেরি নিজে ভক্তাধীন।
তারকের হৃদাসনে হলেন আসীন।।
যে-বাণী শোনেনা কেহ শুধু ভক্তে জানে।
সেই সুরে কথা কয় তারকের প্রাণে।।
“ওঠ ভক্ত ভয় নাই আমি আছি শিরে।
যা’কিছু বলার আমি বলা’ব তোমারে।।”
তন্দ্রাবেশে সে তারক শিহরি উঠিল।
হরি! হরি! হরি! বলি সভাতে দাঁড়াল।।
মরা-গাঙ্গে ভরা স্রোত-যথা বান ধায়।
তারকের মুখে ভাষা তেমনি জোগায়।।
বিনয় করিয়া কহে সভাজন ঠাঁই।
“ইহার সিদ্ধান্ত কহি হেন শক্তি নাই।।
তবে গুরু হৃদি-মধ্যে যে বাণী জোগায়।
নিবেদন করি তাহা এ রাজ-সভায়।।
তাতে যদি শান্তি আসে কাহার হৃদয়।
শ্রীহরিচাঁদের গুণে-মোর গুণে নয়।।
এবে বলি মূলসূত্র সিদ্ধান্তের কথা।
সুধা-ভান্ড পরিপূর্ণ ভকত-বারতা।।
ব্রজের রাখাল সবে সখ্য-রস-মূর্তি।
গোপালের পরে রাখে সেই ভাবে আর্তি।।
কেহ ছোট কেহ বড় কেহবা সমান।
বয়সের মধ্যে আছে অল্প ব্যবধান।।
নিষ্কলঙ্ক ছবি যেন প্রভাত-তপন।
অবাধ প্রাণের টানে খেলে সর্ব্বজন।।
আমাদের ঘরের ঘরে ব্রজের রাখাল।
ঘরে ঘরে নাচে কত ব্রজের গোপাল।।
রাখালেরা কোনভাবে কৃষ্ণে বাসে ভাল।
কৃষ্ণ যে-কে রাখালেরা তাহা কি বুঝিল?
রাখালে রাখালে জানে ভাবে প্রাণসখা।
কৃষ্ণ বিনে পোড়া প্রাণ যায় নারে রাখা।।
কিশোরের লাগি কান্দে কিশোর রাখাল।
কি-শরে কিশোর হিয়া বিঁধিল গোপাল?
কি-শর, কিশোর কৃষ্ণ! হানিলি কিশোরে।
কি স্বরে কিশোর কথা কহে নিদ্রা জাগরণে।।
যাঁর রূপ ভরা আছে সারা মনে প্রাণে।।
জাগরণে বনে বনে যাঁরে বুকে ধরি।
স্বপনের মধ্যে যার সঙ্গে খেলা করি।।
স্বপনের খেলা যেন নহে’ক স্বপন।
একভাব কিবা স্বপ্ন কিবা জাগরণ।
প্রতি রক্ত-কণিকায় যার সাড়া পাই।
কাণায় কাণায় ভরা প্রাণের কানাই।।
এ-কানাই ছেড়ে যদি যায় দূর দেশে।
আর কিবা থাকে বল সেই পোড়া দেশে?
“কানু নাই” এইকথা মনে নাহি মানে।
শ্রীদাম কান্দিয়া ফেরে যমুনা-পুলিনে।।
হারে স্মৃতি! ইতি উতি লতায় পাতায়।
‘ঐ বুঝি’ ঐ বুঝি বাঁশী শোনা যায়।।
প্রেমোম্মাদ শ্রীদামের নাহি জ্ঞান-লেশ।
লতায় পাতায় দেখে কৃষ্ণের আবেশ।।
কালিন্দির কালো জলে ধারা বয়ে যায়।
শ্রীদাম ভাবিছে বুঝি নবঘন-কায়।।
মনে মনে ভাবে এই নাকি কালীদহ কূপ।
শ্রীদাম নামিল জলে হইছে আকুল।।
কালীদহে কালীনাগ বড়ই দুরন্ত।
অবোধ কানু কি জানে সেসব বৃত্তান্ত।।
কি জানি কি ঘটে শেষে বিষম ঘটনা।
একা একা যাসনারে ওরে কেলে সোনা।।
এত বলি জলে ঝাঁপ দিল সে রাখাল।
কানু কোথা এ যে হায় কালিন্দির জল।।
কালিন্দির বুকে জল করে কল কল।
শ্রীদামের বুক ফাটে আঁখি ছল ছল।।
কুলে ওঠে সে-রাখাল চারিদিকে চায়।
তরুণ তমাল তরু দেখিবারে পায়।।
বুকে-আঁকা কালো চোখে দেখে তাই।
তমাল দেখিয়া ভাবে ঐ মোর কানাই।।
তমাল তরুর মূলে দাঁড়া’য়ে কানাই।
ব্যাকুল শ্রীদাম ছুটে বাহ্য জ্ঞান নাই।।
কানু-হারা শূণ্য প্রাণ সদা ছাড়ে হাই।
তমাল সাপুটী ধরে ভাবিয়া কানাই।।
কোথা কানু? এ যে তরু-পরশে কঠিন।
ক্ষোভে দুঃথে শ্রীদামের বক্ষ যেন ভিন।।
হতাশায় প্রাণে ক্ষোভ বাক্য নাহি সরে।
কানাই কহিতে শুধু কি কি শব্দ করে।।
ভাবাবেগে ভরা-বুক কন্ঠরুদ্ধ তায়।
ভাঙ্গা-স্বরে কা কা মাত্র শব্দ বাহিরায়।।
সখ্য-রসে-ভরা ছিল রাখালের প্রাণ।
কা কা শব্দ হ’ল তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।।
কা কা শব্দ করি পরে কানাই কহিল।
শ্রীদাম তোৎলা নহে-প্রেমেতে বিহবল।।
এত বলি শ্রীতারক নিস্তব্ধ হইল।
ব্রাহ্মণ পন্ডিত সবে ছুড়িয়া আসিল।।
কেহ কোল দেয় কেহ করে আশির্ব্বাদ।
বলে ধন্য শ্রীতারক কোটি ধন্যবাদ।।
এমত সিদ্ধান্ত মোরা কভু শুনি নাই।
হরিভক্ত সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বুঝিলাম তাই।।
ভক্তের হৃদয়ে সদা থাকে নারায়ন।
ভক্তের মুখের বাক্য না হয় খন্ডন।।
সাধারণে যাহা চোখে না দেখে কখন।
ভক্ত তার মধ্যে করে রস আস্বাদন।।
প্রকৃত সিদ্ধান্ত মোরা শুনিলাম আজি।
এ সিদ্ধান্ত শিরোধার্য্য হইলাম রাজি।।
কিবা শাস্ত্র কিবা গ্রন্থ পুরান নিচয়।
গ্রন্থকর্তা মনীষীর সত্য পরিচয়।।
যে-ভাব খেলিয়া যায় ভক্তের হৃদয়।
সেই ভাবে ধারা গ্রন্থে দেয় পরিচয়।।
কবি আর কাব্য তাই নহে’ত বিভিন্ন।
তোমাকে উপাধি দিব অদ্য সেই জন্য।।
ভাগবত-রস-শাস্ত্রে তুমি অধিকারী।
“শ্রীতারক ভাগবত” নাম দিনু করি।।
ভাগবত আর তুমি সমান সমান।
“শ্রীতারক ভাগবত” তাহার প্রমাণ।।
“শ্রীতারক ভাগবত” পাইল উপাধি।
যাঁর পদ-তরী পার করে ভবনদী।।
ভক্ত কৃপাগুণে ভেকরূপী কামাচারী গুরু-উদ্ধার
এ-ভবে কর্ম্মফল এড়ান কারো নাই।
কর্ম্মফল-কথা কিছু শুন সবে ভাই।।
কৃ-ধাতু-ত্রি-গুণ জান সত্তঃ রজঃ তমঃ।
ণক প্রত্যয় মনোময় আগমন নিগম।।
সৃষ্টি হল কর্ম্ম-জীব ইহা বলে রাখি।
ফলরূপে ভোগ যাহা তাহা শুধু বাকি।।
সাকারে কর্ম্মের খেলা নিরাকারে নাই।
কর্ম্মফলে বাধা তাতে সৃষ্টিতে সবাই।।
কর্ম্মগুণে ফল ভোগ কিবা লাভ হয়।
সুকর্ম্ম কুকর্ম্ম সব ফলে পরিচয়।।
এই কর্ম্মফল কেহ এড়াইতে নারে।
কর্ম্মফল শ্রেষ্ঠ তাই এ-ভব সংসারে।।
কর্তা ভিন্ন কর্ম্ম কেহ শাসিতে না পারে।
সর্ব্ব-কর্ম্ম-সাধ্য মাত্র প্রভুর চক্রধরে।।
তাঁর ভক্ত যেই জন তাঁরে দেছে প্রাণ।
তাঁর কৃপাগুণে বটে সেই বলবান।।
কর্ম্ম-চক্র-ভেদ বটে তাঁর পক্ষে সাধ্য।
কর্ম্মফল তাঁর আজ্ঞঅ মতে রয় বাধ্য।।
“কৃপা” গুণ যারে বলি কোন গুণ সেই?
সে-গুণের কাছে কিন্তু কর্ম্মফল নেই।।
“কৃপা-সিন্ধু” “কৃপা-ধন্য” হয়েছে যে জন।
কর্ম্মফল-বন্ধু-মুক্ত সদা তাঁর মন।।
প্রকৃতির দান যাহা বাহিরেতে রয়।
তা্ই নিয়ে কর্ম্মফল ধার শোধ লয়।।
“কৃপা-সিদ্ধ” কৃপা-রসে ডুব দিয়ে রয়।
প্রকৃতির পরিশোধ টের নাহি পায়।।
কর্ম্মএল এড়াবার কারো সাধ্য নাই।
ভাগবত পুরাণেতে সে-প্রমাণ পাই।।
সহস্র ধেনুর মধ্যে বৎস চেনে মাতা।
কর্তার পশ্চাতে কর্ম্ম ফিরে যথা তথা।।
“যথা ধেনু সহস্রেষু বৎসো বিন্দতি মাতরম।
তথা শুভাশুভৎ কর্ম্ম কর্ত্তারমনুগচ্ছতি।।”
----ভূমিখন্ডম।
কিন্তু ফলভোগ হয় বিভিন্ন প্রকারে।
কারে ফল স্পর্শে কারে স্পর্শ নাহি করে।।
তাহার প্রমাণ দেখি দস্যু রত্নাকরে।
পাপে মুক্তি পেল সেই নারদের বরে।।
কর্ম্মফলে দেহ তার হ’ল বটে লয়।
রাম নাম মগ্ন থেকে টের নাহি পায়।।
প্রকৃতির দান যাহা রয়েছে বাহিরে।
তাই নিয়ে কর্ম্মফল ঋণ শোধ করে।।
তাহাতে বলেছি আমি “কৃপা-সিদ্ধ’ জন।
সেই পারে কর্ম্মফল করিতে খন্ডন।।
মহতের কৃপাগুণে কর্ম্মফল নাশে।
শুনহে ঘটনা যাহা বলি অবশেষে।।
ব্যানার্জি প্যারীচরণ নামে মহাশয়।
লহ্মীপাশা গ্রামে ঘর যশোর জেলায়।।
বৃহৎ দীর্ঘিকা এক খনন কারণ।
নিয়াগ করিলে তেঁহ বহু লোকজন।।
চারিহস্তি পরিমিত গভীর হইলে।
প্রকান্ড দুর্দ্দুর এক দেখিল সকলে।।
এত বড় ভেক কেহ কভু দেখে নাই।
সর্ব্বাঙ্গে “চেটুয়া-ঢাকা” সবে দেখে তাই।।
মাটী দূর হল ভেক আলোক দেখিল।
ক্রোধ ভরে ফোঁস ফোঁস করিতে লাগিল।।
পিয়ারী বাকুবে তবে ডাকিল সকলে।
কথা শুনি প্যারীবাবু এল সেই স্থলে।।
দুই হাত দীর্ঘে হবে প্রস্থে এক হাত।
ভেক দেখি প্যারী বলে “এ কোন ডাকাত।।
এই জীব ভেক নাহি হবে কদাচন।
কি জান কি কর্ম্মফলে হয়েছে এমন।।”
কথা শুনি কোদালীরা বলে তার ঠাঁই।
“ইহার কারণ মোরা শুনিবার চাই।।
তিনি কন, “এই সাধ্য না হবে আমার।
মহাজ্ঞানী হরি ভক্ত সেই মহাশয়।।
তোমরা তাহারে ডেকে আন গো হেথায়।
কথা মত কোদালীরা তারকে ডাকিল।
সব শুনি সেই সাথে তারক আসিল।।
প্যারীবাবু বলিলেন তারকের ঠাঁই।
“তোমাকে ডেকেছি আমি তারক গোঁসাই।।
তত্ত্বজ্ঞঅনী সাধু তুমি আমি জানি ভাল।
প্রকান্ড ভেকের তত্ত্ব মোর কাছে বল।।
মোর মনে বলে এই ভেক কভু নয়।
কোন দিন এত বড় ভেক নাহি হয়?
আশ্চর্য্য ঘটনা তাতে চোখে যায় দেখা।
সর্ব্বাঙ্গ রয়েছে তবে “চাটুয়াতে” ঢাকা।।
ইহার মীমাংসা করি বুঝাও সকলে।
মনের সন্দেহ সব যাক দূরে চলে।।
ব্যানার্জির কথা শুনি তারক কহিল।
“আমি কিবা জানি বাবু সেই কথা বল।।
জানাজানি যাহা মোর সব ওড়াকান্দী।
এ সব তত্ত্বের আমি কিবা জানি সন্ধি।।
শ্রীহরির-পদ চিন্তা মনে করি সার।
অবশ্য করিব চেষ্টা ইহা মীমাংসার।।
এতবলি চক্ষু মুদি তারক বসিল।
ভেকের অতীত কথা সকলি জানিল।।
ক্ষণপরে চক্ষু মেলি সেই মহাশয়।
উপস্থি লোক জনে ডেকে ডেকে কয়।।
“অদ্ভুত ঘটনা সবে শুন দিয়া মন।
পূর্ব্ব জন্মে ছিল ভেক গুরু একজন।।
ভেকধারী বৈরাগী পালিল আচার।
বহু শিষ্য ক্রমে হইল তাহার।।
ঐশ্বর্য্য বাড়িয়া ধর্ম্মে দিল ছারখার।
শিষ্য নারী সঙ্গে সেই করে ব্যাভিচার।।
ভেকধারী হয়ে গুরু করে ব্যাভিচার।
এই জন্মে পেল তাই ভেকের আকার।।
গুরু যারা ব্যাভিচারি তার রক্ষা নাই।
গুরু-শিষ্য এক সঙ্গে সমান সবাই।।
ভবরূপ সাগরেতে শ্রীগুরু-তরণী।
বুকে করে শিষ্যে পার করে তাই জানি।।
তরী যদি ডুবে যায় আরোহী কি করে।
অকুল সাগর ডুবে জানে প্রাণে মরে।।
কর্ম্মফলে গুরু পেল ভেকের আকার।
“চেটা-রূপে” শিষ্য সর্ব্ব দেহ অলঙ্কার।।
গুরু-পদ নহে কভু সামান্য ব্যাপার।
গুরু যিনি গুরুতর দায়িত্ব তাহার।
শত শত গুরু মিলে সদ গুরু কই?
উপায় নাহিক কভু সদ গুরু বই।।
যা’ হোক তা’ হোক এই বলিলাম সার।
ব্যাভিচারী গুরু হয়ে এ-দশা ইহার।।
এতেক বলিয়া সাধু নীরব হইল।
পিয়ারী চরণ তবে ডাকিয়া কহিল।।
“সত্য যুক্তি বলি ইহা মোর মনে হয়।
দয়া করে অভাগার করহে উপায়।।।
অতীতের কথা যবে বলিয়াছি তুমি।
ভবিষ্যৎ আছে জানা মনে করি আমি।।
দয়া করে অভাগারে করহে উদ্ধার।
তোমার দর্শণে পাপ দুর হোক তার।।
তারক বলেন বাবু শাস্ত্রের প্রমাণ।
কর্ম্মফল ক্ষয়ে হয় দেহ অবসান।।
পুরাণে প্রমাণ তার শুন বলি তাই।
পদ্মপুরাণের মধ্যে সে প্রমাণ পাই।।
“তৈল ক্ষয়াদযথা দীপো নির্ব্বাণমধিগচ্ছতি।
কর্ম্মক্ষয়া ত্তথা জন্তু শরীরান্নাশ মৃচ্ছতি।।”
-----পদ্মপুরানম
মৃত্তি-তেল বহুদুঃখে ভোগ শেষ হল।
এবে দেহ নাশ হবে হরি হরি বল।।
সবে মিলে করতালে বলে হরি হরি।
লম্ফ দিয়ে ভেক তবে পড়িল আছাড়ি।।
পড়ামাত্র প্রাণ বায়ূ বাহির হইল।
ভোগ শেষে কামাচারী উদ্ধার পাইল।।
সাধু দরশনে কাটে কর্ম্মদোষ-ফল।
পাপ-ক্ষয়ে আত্মা তার হইল নির্ম্মল।।
তারকচাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
তারকের প্রীতে হরি হরি বল ভাই।।
দয়ার সাগর তারকচন্দ্র
আদর্শ মতুয়া বটে শ্রীতারক চন্দ্র।
মনে প্রাণে মানিলেন মতুয়ার ধর্ম্ম।।
মতুয়ার ধর্ম্ম যাহা স্বহস্তে লিখিলা।
আপন জীবনে তাহা পালন করিলা।।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
....শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত
জীব প্রতি দয়া তাঁর অসীম অনন্ত।
শুন বলি সে সম্বন্ধে একটি বৃত্তান্ত।।
গৃহের পালিত পশু ছিল যত গুলি।
সকলে তারকে চিনে শোনে তার বুলি।।
গরু গুলি তাঁরে দেখে বড় সুখ পায়।
আনন্দে নয়ন মুদে হস্ত দিলে গায়।।
তারকের স্পর্শ পেতে সকলের আশা।
তারকের কাছে তারা চায় ভালবাসা।।
পশু পাখী নর নারী গৃহে যত জন।
তারকের স্পর্শ পেতে লোভী সর্ব্বক্ষণ।।
গান করিবারে যবে বিদেশেতে যায়।
হম্বা রব করে গাভী চারিদিকে চায়।।
ঘাস জল খায় বটে তাতে মন নাই।
বিড়াল কুকুর কান্দে সর্ব্বদা সবাই।।
গান গাহি যেই কালে ফিরে আসে ঘরে।
আনন্দের মাত্রা যেন কোথঅ নাহি ধরে।।
দড়ি ছিড়ি গরুগুলি আসিবারে চায়।
মুখের ‘গেরাস’ ফেলে বিড়াল দৌড়ায়।।
পোষাপাখি পাখসাট মারিছে খাচায়।
সবে চায় তার গায় আগে হাত দেয়।।
দয়ার সাগরে সবে ডুব দিতে চায়।
‘জীবে দয়া’ এই তার সত্য পরিচয়।।
কি কারণে একদিনে সেই মহাশয়।
একটি “পালের” গরু করিল বিক্রয়।।
‘পাল’ ছেড়ে গরু কিন্তু যেতে নাহি চায়।
বহু কষ্টে নিল গরু ক্রেতা মহাশয়।।
ভাব দেখে তারকের কান্দিল পরাণ।
ভাবে-বলে ‘কাজ নাই গরু ফিরে আন।।
কিন্তু কথা দিয়া তাহা কেমনে লঙ্ঘিব।
দুঃখ পাব বলে কি না কাজে ছোট হবে?
কিছুদিন পরে সেই প্রভু মহাজন।
যাত্রা কৈল ওড়াকান্দী স্থির করি মন।।
ওড়াকান্দী সন্নিকটে মাঠের ভিতর।
ঘটিল অপূর্ব্ব কান্ড শুন অতঃপর।।
সেই গরু সেই ক্রেতা জুড়িয়াছে হালে।
দারুণ গ্রীষ্মের তারে জল নাহি বিলে।।
পিপাসায় শুষ্ক কন্ঠ চক্ষে বহে জল।
ধীরে ধীরে কোনরূপে টানিতেছে হাল।।
কৃষক তাহাতে সুখী নাহি হয় মনে।
করিছে প্রহার তারে বিশেষ তাড়নে।।
যেইখানে হাল চাষে তার কাছে পথ।
দিবারাত্রি লোকজন করে যাতায়াত।।
যেই কালে শ্রীতারক সেখানে আসিল।
হাল স্কন্ধে সেই গরু তাঁহারে দেখিল।।
দরদী বান্ধবে দেখি মন নাহি মানে।
হাল ভেঙ্গ চলে ছুটে প্রভুর সদনে।।
হাম্বা হাম্বা রব করে চক্ষে বহে জল।
ভাব দেখে তারকের দেহে নাহি বল।।
তারকের গাত্র গুরু চাটিতে লাগিল।
তাই দেখি গোস্বামীর হৃদয় ফাটিল।।
মনে ভাবে হায়! হায়! আমি কি নিষ্ঠুর।
ইচ্ছা করে ‘অ-বলারে’ করিয়াছি দূর।।
অনুতাপে গোস্বামীর হৃদি ফাটি যায়।
ঝর ঝর অশ্রু তাঁর পড়িল ধরায়।।
ক্রেতারে ডাকিয়া বলে “শুন মহাশয়।
দয়া করে এই গরু ফিরে দিতে হয়।।
হাল-কার্য্যে এই গরু বহু কষ্ট পায়।
তাই দেখে মোর কাছে নালিশ জানায়।।
যে-টাকা দিয়াছ তুমি লহ তাহা ফিরে।
দয়া করে ছেড়ে দাও গরুটী আমারে।।
তোমার মঙ্গল হবে জানিও নিশ্চয়।
এই টুকু কর দয়া ক্রেতা মহাশয়।।
দেখিয়া গরুর কান্ড ক্রেতা’ত অবাক।
চুপ করে দেখে শুধু নাহি সারে বাক।।
পরে যবে শ্রীতারক এই কথা কয়।
নিরাপত্তে গরু ছাড়ে ক্রেতা মহাশয়।।
গরুরে উদ্ধার করি তারক চলিল।
সে-গরু তারকের সঙ্গে সঙ্গে গেল।।
এই ভাবে জীবে দয়া সীমা দিতে নাই।
দয়ার সাগর ছিল তারক গোঁসাই।।
অতঃপর শুন সবে আরেক ঘটনা।
দেশে দেশে সেই কির্ত্তি রয়েছে রটনা।।
একদিন পথে চলে গোস্বামী রতন।
চলেছে পদুমা গ্রামে মল্লিক-ভবন।।
সঙ্গেতে যাদব চন্দ্র ঢালী মহাশয়।
পরম ধার্ম্মিক যিনি অতি সদাশয়।।
তারকের পদাশ্রিত নিষ্ঠা সেই পদে।
পূর্ণ-ব্রাহ্ম-জগন্নাথ জানে গুরুচাঁদে।।
তাঁর যত কীর্ত্তি কথা বলিব পশ্চাতে।
এবে শুন কি ঘটনা ঘটে সেই পথে।।
দরিদ্র কুটীর এক পথপার্শ্বে রয়।
তারক যাদব দোঁহে সেই পথে যায়।।
কুটীরের পার্শ্বে যবে উপনীত হল।
সুন্দর বালক এক বাহিরে আসিল।।
পথ বাহুড়িয়া সেই বালক দাঁড়ায়।
গোস্বামীর পানে চাহি মৃদুস্বরে কয়।।
“তোমার যে যেতে হবে আমাদের বাড়ী।
না গেলে আজিকে তোমা নাহি দিব ছাড়ি।।
মাতা বলিয়াছে তোমা লইতে ডাকিয়া।
তোমাকে দেখেছি মোরা ঘরেতে থাকিয়া।।”
গোস্বামী ডাকিয়া বলে ‘চলুন যাদব।
বলুন কেমন প্রাণে উপেক্ষি” এ-সব?”
যাদব বালকে বলে “শোন রে গোপাল।
কত জন্ম তপস্যাতে পেলিএ কপাল।।
চলেছে “দয়ার গাজী” আর ভয় নাই।
চল চল তাড়াতাড়ি তোর বাড়ী যাই।।”
যাদবের ভাব দেখি বড়ই মধুর।
বুকে থাকে এক ভাব মুখে অন্য সুর।।
মৌখিক রহস্য করে গোস্বামীর সনে।
“পরম দেবতা” বলি মানে মনে প্রাণে।।
অল্পক্ষণে উপস্থিত বালকের বাড়ী।
বসিবারে এনে দিল দুইখানা পীড়ি।।
গৃহ মধ্যে কথা কয় বালকের মাতা।
বাহিরে গোস্বামী বসি শোনে সেই কথা।।
গোস্বামী ডাকিয়া বলে সেই রমণীরে।
“মাগো! কথা বল না’ক আসিয়া বাহিরে।।
আমিত তোমার পুত্র তুমিও জননী।
কাছে এসে কথা বল প্রাণ ভরে শুনি।।
গোস্বামীর কথা শুনি নারী কেন্দে কয়।
বাহিরে আসিতে বাবা নাহিক উপায়।।
জীর্ণ দীন বস্ত্র-হীন আমি অভাগিনী।
মোর দিন কাটে বাবা পরে এক কাণি।।
শত ছিন্ন বস্ত্রে করি লজ্জা নিবারণ।
কেমনে বাহিরে আসি বল বাপধন।।
তোমার গুণের কথা সর্ব্ব দেশে কয়।
দীনজনে ধনী হয় তোমার কৃপায়।।
নাড়ী-ছোঁড়া-ধন মোর এক মাত্র ছেলে।
স্বর্গে চলে গেছে স্বামী বালকেরে ফেলে।।
দয়া করে আশীর্ব্বাদ কর তুমি তারে।
আর কষ্ট তার যেন না হয় সংসারে।।
এই লাগি কষ্ট দিতে এনেছি ডাকিয়া।
কাঙ্গালের আশীর্ব্বাদ কর মন দিয়া।।
এই কথা বলে নারী ফুকারিয়া কান্দে।
বড়ই বাজিল ব্যথা সে তারকচান্দে।।
আপনার উত্তরীয় করি পরিধান।
নিজবস্ত্র রমনীরে করিলেন দান।।
যত অর্থ ছিল সাথে সব তারে দিল।
প্রাণ ভরে সে-বালকে আশীষ করিল।।
গোস্বামীর আশীর্ব্বাদে সে দীন বালক।
ধন পেয়ে ভবিষ্যতে হয় ধনী লোক।।
দীন বন্ধু সে তারক দীনের সহায়।
কত জনে করে দয়অ তুলনা কোথায়?
আর এক কথা শুন অপার মহিমা।
নিঃস্বার্থ তারকচন্দ্র শুনে নাহি সীমা।।
মাধব নামেতে তাঁর ছিল প্রতিবেশী।
গোস্বামীর কাছে টাকা কর্জ্জ লয় আসি।।
খত লিখি দিল আনি রেজেষ্ট্রেীর করিয়া।
টাকা পেয়ে গোস্বামীকে দিল সে ধরিয়া।।
দিনে দিনে দিন যায় তামাদি উদয়।
মাধবের ডাক দিয়া গোস্বামীজী কয়।।
কি মাধব টাকাগুলি শোধ দিবে কিনা?
শোধ করে দেও টাকা কেন থাক দেনা।।
খতের তামাদি এল কিবা করি বল।
আসল না পার কিছু সুদ দিয়ে ফেল।।
মাধব জানিত সাধু পরম দয়াল।
ধীরে ধীরে টাকা নেবে বসে কতকাল।।
যেমন দয়াল তাতে কোন চিন্তা নাই।
নালিশে আদায় টাকা করে না গোঁসাই।।
তাই ভেবে বাহ্য রাগে শক্ত কথা কয়।
বলে যাহা পার তুমি কর গে মশায়।।
ভারী কটা টাকা তাতে এতই তাগাদা।
এতই উত্যক্ত কর আমি নাকি গাধা?
টাকা নিছি খত দিছি আর কিবা চাও?
এভাবে আমারে আর কেন বা জ্বালাও?
মাধবের ভাগ্যদোষে হিতে বিপরীত।
দুই জন ভক্ত সেথা ছিল উপস্থিত।।
ক্রোধে পরিপূর্ণ হল তাহাদের মন।
গোস্বামীকে সঙ্গে করি করিল গমন।।
গৃহে গিয়া ক্রোধে বলে শুন দয়াময়।
মাধবের এই দম্ভ দেখা নাহি যায়।।
এতই মাধব দাস হল অহঙ্কারী।
ওরে সাজা দিব নিয়ে রাজার কাছারী।।
আপনার কোন কথা শুনিব না আজ।
এতই যোগ্যতা তার করে হেন কাজ?
কাল্য গিয়ে নড়াইল করিব নালিশ।
রাজার কাছারী হতে উচিত শালিশ।।
এত বলি জোর করি দিুই মহাশয়।
করিল খতের আর্জ্জি বিচার আলয়।।
বিবাদীর পরে যবে আসিল নোটিশ।
মাধব বুঝিল তবে কাজের হদিশ।।
আর্জ্জি দেখে মাধবের মন ভেঙ্গে গেল।
নালিশের কোন রূপ জবাব নাহি দিল।।
এক তর্ফা ডিক্রী হল দাবী সমুদয়।
তথপি মাধব তাতে কথা নাহি কয়।।
বিধির নির্ব্বন্ধ বল কে খন্ডাতে পারে?
মাধব পড়িল মারা কিছু দিন পরে।।
নানা দেশে নানা কাজে গোস্বামী নিযুক্ত।
অল্পই জানিলা তেঁহ এই সব তত্ত্ব।।
এ দিকেতে ভক্ত দলে জোগাড় করিয়া।
মাধবের বাড়ী এল মাল ক্রোক নিয়া।।
দৈবক্রমে গোস্বামীজী গৃহে উপস্থিত।
ভক্তগণে এল বাড়ী প্যাদার সহিত।।
মাধবের নারী জানি সব সমাচার।
গোস্বামীর পদে পড়ি করে হাহাকার।।
গোস্বামীর শান্তায়ে তারে শুনিলেন কথা।
হেঁট করি রহিলেন আপনার মাথা।।
বিষম বেদনা-রেখা ফুটিল বদনে।
বহু তিরস্কার করে নিজ শিষ্য গণে।।
দেনা-দায়ে মুক্ত হল মাধবের নারী।
গোস্বামী নিলেন নাক এক কাণা কড়ি।।
পেয়াদা বিদায় করে নিজ দিয়ে টাকা।
এমন দয়াল ভবে নাহি যায় দেখা।।
পর-দুঃখে দুঃখী সদা মতুয়া সুজন।
শ্রীতারক তারমধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।।
নিঃস্বার্থ দয়ার দানে কাঙ্গালে বাঁচায়।
দ্বিতীয় চরিত্র-চিত্র এই পরিচয়।।
নামে রুচি মতুয়ায় নীতি অন্যতম।
এ-নীতি পালনে তেঁহ ছিল সর্ব্বোতম।।
বারুণীতে যায় ভক্ত কন্ঠে করে নাম।
বীরের স্বভাবে চলে সবে গুণ ধাম।।
অবশ্য নামেতে নিষ্ঠা রাখে দূঢ়তর।
তার মধ্যেভাব আছে ভাবে ভাবান্তর।।
শ্রীতারক যাত্রা করে ধাম ওড়াকান্দী।
গৃহ হতে হরি বলে সাধু ওঠে কান্দি।।
সারা পথে হরিনামে নাহিক বিশ্রাম।
নয়নের জলে বক্ষ ভাবে অবিরাম।।
স্বেদ কম্প পুলকাশ্রু সাত্ত্বিক বিকার।
ক্ষণে ক্ষণে পথিমধ্যে হইত তাঁহার।।
ধামে আসি পরমর্ষি পড়ে ধরাতলে।
মৃত্তিকা কর্দ্দম হয় তাঁর অশ্রুজলে।।
দরশন পরশন যেবা তাঁরে করে।
মহাপ্রেম-সিন্ধু মাঝে ডুব দিয়া মরে।।
মতুয়া চরিত্রে যাহা দ্বিতীয় লক্ষণ।
শ্রীতারক পূণ তাহা ছিল সর্ব্বক্ষণ।
মতুয়া-চরিত্রে যাহা পরম লক্ষণ।।
মানুষেতে নিষ্ঠা যাহা জানে সর্ব্বজন।।
এই গুণে তারকের তুল্য দিতে নাই।
প্রমাণ তাহার জানে সর্ব্বত্র সবাই।।
নিজ-কৃত গানে তেঁহ করিল রচনা।
কাজ কি আমার মন্ত্র বীজে।
হরিচাঁদ ছবি রবির কিরণ
উথলিল মধু হৃদ-সরোজে।।
.........তারকচন্দ্র
তন্ত্র মন্ত্র দীক্ষা শিক্ষা করিলেন ত্যাগ।
শুধু হরিচাঁদে রাখে দৃঢ় অনুরাগ।।
এই নিষ্ঠা নিল তাঁরে প্রেমময় লোকে।
সেই সূত্রে পিতা-পুত্রে অভিন্নতা দেখে।।
কায়া ছাড়ি হরিচাঁদ গুরুচাঁদে কয়।
শ্রীতারক পেল তার আদি পরিচয়।।
নিষ্ঠাগুণে তারকের নাহি হল ভুল।
তাই দেখে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদে স্থুল।।
শক্তি সত্য কায়া মিথ্যা নিষ্ঠাবান জানে।
তাই তাঁর মন চলে শক্তির সন্ধানে।।
যে শক্তি করেছে তাঁর পরাণ হরণ।
ঘরে ঘরে ঘুরে তাঁরে করে অন্বেষণ।।
যেইখানে মেলে দেখা আর কথা নাই।
সেই পদে মন প্রাণ বিক্রীত সবাই।।
তাই দেখি নিষ্ঠা-গুণে তারক প্রধান।
মন-মানুষের নিল করিয়া সন্ধান।।
মতুয়ার তিন গুণে পূর্ণতারকেতে।
সেই শিক্ষা পেল ক্রমে সবে তাঁহা হতে।।
তাঁহার জীবন কথা অসীম অনন্ত।
কণামাত্র বলি পরে করিব সে ক্ষান্ত।।
গো-মড়ক ব্যাধি দূর করণ
তারক গোস্বামী আসে নড়াইল হতে।
সঙ্গেতে যাদবচন্দ্র আসিলেন পথে।।
বেলা শেষে দুেইজনে চলিছে ত্বরিত।
প্রকান্ড মাঠের মধ্যে হল উপস্থিত।।
হেনকালে সুবৃহৎ কুক্কুর আকারে।
গো-মড়ক ব্যাধি এল মাঠের ভিতরে।।
লক লক করে জিহবা যেন রক্ত ঝরে।
আভাষে যাদব দেখে ক্ষণমাত্র তারে।।
উচ্চকন্ঠে গোস্বামীজী বলে “হরি বল”।।
সঙ্গে সঙ্গে আঁখি তার করে ছল ছল।।
যাদবেরে বলে ডাকি “শুন মহাশয়।
কোন কিছু অদ্য তুমি দেখেছ হেথায়?”
যাদব কহিছে দীরে “শোন দয়াময়।
আভাষে দেখেছি যাহা বলি তব পায়।।
দীর্ঘ দেহ এক জীব কুকুরের প্রায়।
দেখিলাম অকস্মাৎ পালাইয়া য়ায়।।”
গোস্বামী কহিল “ঠিক বলিয়াছ তুমি।
স্পষ্টতর দৃশ্য বটে দেখিয়াছি আমি।।
গো-মড়ক ব্যাধি এই শুন মোর কাছে।
পাশ্ববর্তী গ্রামে রোগ প্রবেশ করেছে।।
হইবে বিষম দশা আর রক্ষা নাই।।
বহু গরু মারা যাবে শুন মোর ঠাঁই।।”
এইভাবে দুইজনে আলাপন করে।
গ্রামবাসী একজনে এল তথাকারে।।
যাদব তাহারে খুলে বলিলেন সব।
সেজন শোনে না কাণে ইতই গৌরব।।
কিছু পরে অনিচ্ছায় করে পরিচয়।
শুনিলেন শ্রীতারক সরকার যায়।।
সেইদিন সন্ধ্যাকালে বড় ঝ হ’ল।
বড় বড় বৃক্ষ কত তাহাতে ভাঙ্গিল।।
অন্ধকারে যাদবের পথ চলা ভার।
গোস্বামীর কিন্তু কষ্ট নহে একবার।।
গাঢ় অন্ধকারে তাঁর দৃষ্টি নাহি বাধে।
সারা পথ আসিলেন যথা নিরাপদে।।
পরদিন সেই গ্রামে গো-মড়ক হল।
সপ্তাহ মধ্যেতে প্রায় সব পশু মল।
গ্রামবাসী সবে বলে উপায় কি এখন?
চোখে দেখা নাহি যায় পশুর মরণ।।
যেই ব্যক্তি গোস্বামীরে উপেক্ষা করিল।
সব কথা এবে তার স্মরণ হইল।।
আদ্যোপান্ত সে বৃত্তান্ত কহিল সকলে।
সবে বলে হায় হায় কি কার্য্য করিলে।।
মহাসাধু সে তারক দৈব শক্তিধারী।
অন্যায় হয়েছে তারে অবহেলা করি।।
সবে মিলে চল যাই গোস্বামীর ঠাঁই।
এ বিপদে তাঁরে ধরে কুল যদি পাই।।
দৈবের ঘটনে দেখ প্রভু সেই দিন।
নড়াইল যেতে ছিল বিশেষ কারণে।।
গ্রামবাসী সবে করে চরণ বন্দনা।
বলে প্রভু দয়া বিনে পরান বাচে না।।
বিনয়ে গোস্বামী তবে কহিল বচন।
যাহা বলি সবে তাহা কর আয়োজন।।
মিষ্ট বিনা দুধ চাল একত্রে বাঁধিবে।
গোহালে রাখিয়া তাহা বালকে খাওয়াবে।।
সেই মত কাজ যবে গ্রামবাসী করে।
পরদিন গো-মড়ক গেল দুরে সরে।
দেবী সরস্বতী কর্তৃক গ্রন্থদান ও শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত রচনা
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ এই দুইজনে।
লীলামৃত গ্রন্থ লেখা ইচ্ছা করে মনে।।
কিছু অংশ লিখি দোঁহে গেল ওড়াকান্দী।
বসিলেন দুই সাধু প্রভু পদ বন্দি।।
মহাপ্রভু হরিচাঁদে বিনয়েতে কয়।
হৃদয়ের আশা কহি ওগো দয়াময়।।
আপনার লীলা যাহা অপূর্ব্ব অনন্ত।
ধরা পরে প্রকাশিতে চাহি যে বৃত্তান্ত।।
প্রভু বলে এই কার্য্য কভু না করিবে।
সময় হইলে গ্রন্থ প্রকাশিত হবে।।
কিন্তু মনে নাহি মানে-সহে না বিলম্ব।
পুনরায় লিপিকার্য্য করিল আরম্ভ।।
ইচ্ছাময় যাহা ইচ্ছা নাহি করে নিজে।
সে-কার্য্য কেমনে হবে তাঁর বিশ্ব মাঝে?
লেখা-গ্রন্থ আকস্মাৎ হল অন্তর্দ্ধান।
খোঁজাখুঁজি করে কত মেলে না সন্ধান।।
অতএব গ্রন্থ লেখা নাহি হল আর।
লীলাসাঙ্গ হরিচাঁদ করে অপঃপর।।
ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে সময় হইল।
দশরথ, মৃত্যুঞ্জয় তারকে কহিল।।
“প্রভুর লীলার কথা করহে রচনা।
রচনা করহে তুমি তারক রসনা।।”
মনে ভয় সে তারক স্বীকার না করে।
এবে শুন কি ঘটনা হ’ল অতঃপরে।।
একদা আপন গৃহে তারক গোঁসাই।
নিদ্রাকালে “হরি” বলে, চাড়িলেন হাই।।
পরাণ-পুতুল হরি স্মরণে আসিল।
স্মরণে শয়নে বসি তারক কান্দিল।।
কিছু পরে নিদ্রামগ্ন সে তারক হয়।
দেবী বীণাপাণি আসি তথায় উদয়।।
বরাভয়হস্ত রাখে তারকের শিরে।
অসীম স্নেহেতে মাতা কহিলা তাঁহারে।।
“পুত্র শ্রেষ্ঠ তুমি মোর কবি অগ্রগণ্য।
তোমার গৌরবে মোর বক্ষা সদা পূর্ণ।।
প্রাণপতি প্রেম-গীতি তব কন্ঠে থাকি।
সতত জীবেরে কহি উচ্চ রবে ডাকি।।
এ-বারে আসিলা প্রতি নমঃশূদ্র ঘরে।
তোমাকে আনিনু আমি তাই জয়পুরে।।
লীলা-গীতি চিরকাল তোমারি রচনা।
প্রভু তাই দশরেথে করেছিল মানা।।
প্রেম-নিষ্ঠা দশরথ কথা নাহি শোনে।
তাই লীলা-গীতি এনে রাখি নিজ স্থানে।।
লীলা সাঙ্গ হ’ল এবে লীলা-গীতি কও।
এনেছি প্রথম লেখা করে তুলে লও।।”
এত বলি দয়ামীয় তারকের হাতে।
রাখিলা পূর্ব্বে গ্রন্থ বহু স্নেহমতে।।
অর্দ্ধ-নিদ্রা জাগরণে তারক দেখিল।
গ্রন্থ দিয়া বীণাপাণি অন্তর্দ্ধান হ’ল।।
ব্রহ্ম মুহুর্ত্তের কালে গোস্বামী জাগিল।
দেখিলা হস্তের পরে গ্রন্থ কে রাখিল।।
অকস্মাৎ স্বপ্ন-কথঅ মনে পড়ে যায়।
গ্রন্থ বুকে চেপে ধরে কহে হায়! হায়।।
মায়ের করুণা-ধারা এইভাবে পায়।
প্রত্যক্ষে বাগেদেদী যাঁরে গ্রন্থ দিয়ে যায়।।
এত কৃপা পেল তবু সাহস না পায়।
চুপ থাকে লীলাগ্রন্থ লেখা নাহি হয়।।
এক নিশি শেষভাগে গোস্বামী গোলক।
সপ্নে সে তাহাকে বলে “শোনরে তারক।।
লীলামৃত নাহি দিলে রক্ষা তোর নাই।
রক্ত কিংবা লীলামৃত একখানা চাই।।”
নৃ-সিংহমূরতিধারী অতি ভয়ঙ্কর।
তারকের গাত্র তাহে কাঁপে থর থর।।
ভীতমনে গোস্বামীজী স্বীকার করিল।
সেই হতে লীলামৃত রচিতে লাগিল।।
এসব বৃত্তান্ত আছে লীলামৃত মাঝে।
নিজ হস্তে লিখিলেন কবি রসরাজে।।
আর কীর্ত্তিকথা তাঁর আছে বহুতর।
সমস্ত প্রকাশে নাহি পায় অবসর।।
কণামাত্র বলি তাহা করিতেছি শেষ।
তারকের আগমনে ধন্য বঙ্গদেশ।।
বারশ’ চুয়ান্ন সালে আষাঢ় মাসেতে।
জন্ম নিল শ্রীতারক প্রভু আজ্ঞামতে।।
তেরশ’ একুশ সালে মার্গশীর্ঘ কালে।
শ্রীতারক ছাড়িলেন এই ধরাতলে।।
সৎকার জন্যে দেহ নেয় নদীকূলে।
উপস্থিত নরনারী হরি হরি বলে।।
চন্দনের বৃষ্টি হল চিতার উপরে।
আশ্চর্য্য মানিয়া সবে হরিধ্বনি করে।।
শুধুতাহা মাত্র নহে পুষ্প বরিষণ।
চিতা পরে হল তাহা দেখে সর্ব্বজন।।
মহাশক্তিধারী গেল ছাড়িয়া পৃথিবী।
আর না দেখিবে ধরা সে মোহন ছবি।।
এই ভাবে দেহত্যাগ করিল তারক।
পরবর্তী এককথা শুন সর্ব্বলোক।।
তারকচন্দ্র-অমর
মার্গশীর্ষ শেষভাগে তারিখ একুশে।
কায়া ছাড়ি গোস্বামীজী চলে নিজে দেশে।।
দিকে দিকে উঠে ঘোর ক্রন্দোনের রোল।
পশুপাখী, নরনারী সবে উতরোল।।
অপূর্ব্ব শক্তির কথা প্রত্যক্ষ ঘটনা।
মৃত্যু-পরে যেই বার্ত্তা হইল রটনা।।
চন্দ্রদীঘলীয়াবাসী জগদীশ নাম।
ব্রাহ্মণ কুলেতে জন্ম সেই গুণধাম।।
যেদিন তারকচন্দ্র দেহ তেয়াগিল।
সে দিনতে তেঁহ বটে শহরেতে ছিল।।
নামেতে মাদারীপুর শহর সুন্দর।
আড়িয়ালখাঁর পার সুঠাম বন্দর।।
পথিমধ্যে সে তারক তারে দেখা পায়।
ডেকে বলে “জগদীশ শুনহে আমায়।।
ব্রহ্মপুত্রে যাইবারে করিয়াছি মন।
গৃহে ফিরে আর আমি যাবনা এখন।।
আমার দৌহিত্র আছে মম গৃহ পরে।
তার লাগি এই জুতা কিনেছি শহরে।।
তুমি এই জুতা দিয়ে যাও তার লাগি।
তব ঠাঁই এইবারে বিদায় যে গামি।।”
জগদীশ পরে তবে দেশেতে ফিরিল।
দেশে আসি জয়পুরে উপস্থিত হল।।
আসি শোনে সেই দিনে জুতা কিনিয়াছে।
একদিন পূর্ব্বে তাঁর গোস্বামী মরেছে।।
হায়! হায়! কবি দ্বিজ কান্দিতে লাগিল।
দেশে দেশে সে ঘটনা সকলে কহিল।।
আজো সেই জুতোজোড়া আছে জয়পুরে।
সকলে রেখেছে তাহা তারক-মন্দিরে।।
তারকের লীলা খেলা বেলা শেষ হল।
সাধু জনে সবে মিলে হরি হরি বল।।
১৩১০ সাল হইতে ১৩২০ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
তের শত দশ সালে মধুর শারদ কালে
আরম্ভিল দশভূজা-পূজা।
সপ্তম এডওয়ার্ড করিলেন দেহত্যাগ
শ্রীপঞ্চম জর্জ হল রাজা।।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন করিল বাঙ্গালীগণ
“স্বদেশী বলিয়া হ’ল খ্যাত।।
কেহ গেল দ্বীপান্তর কেহ ম’ল ফাঁসি পর
আন্দোলন করে অবিরত।।
আসিল অম্বিকাচরণ ভুলে নমঃশূদ্র গণ
‘স্বদেশী’ সাজিতে হ’ল ব্যস্ত।
প্রভুর নিকটে যায় ভুল ভাঙ্গে দয়াময়
বাক্যযুদ্ধে সকলি পরাস্ত।।
প্রভু যবে করে রাগ আন্দোলন করে ত্যাগ
রাজভক্ত হইল প্রমাণ।।
স্বজাতির দুঃখ হেরে রাজশক্তি ধরিবারে
ইচ্ছঅ করে প্রভু ভগবান।।
নামেতে ডক্টর মীড ধন্য রাজ-পুরোহিত
তাঁর সনে হৈল আলাপন।
প্রেম-গুণে হ’ল বন্দী মীড এল ওড়াকান্দী
স্কুল আরো গড়িল মিশন।।
বঙ্গ এক হল জুড়ে লাট এল ফরিদপুরে
প্রভু তাঁরে করে দরশন।
লাট চিনিলেন তাঁরে তাই বলে উচ্চঃস্বরে
“নমঃশূদ্র-পিত” এইজন।।
হ’ল “দিল্লী দরবার” মেডেলাদি পুরস্কার
রাজভক্ত প্রজা সবে পে’ল।
লাট আসি পুনরায় ফরিদপুর জেলায়
গুরুচাঁদ সে ‘পদক দিল।।
অযথা চন্ডাল গালি নমঃশূদ্র কুল-কালী
মুছিয়া ফেলিতে আয়োজন।
দেশে দেশে আন্দোলন করিল শ্রীগুরু চরণ
চেষ্টা করে নমঃশূদ্রগণ।।
মীড তা’তে দিল সায় কলঙ্ক মুছিয়া য়ায়
নমঃশূদ্র হইল নির্ম্মল।
ঘরে ঘরে শিক্ষা দিতে প্রভু ইচ্ছা করে চিতে
তার লাগি করে আন্দোলন।।
লইয়া স্বজাতি বৃন্দ সভা করে গুরুচন্দ্র
এক সভা করিব বর্ণন।
গোপীনাথ পুর বাসী সকলে জানা’ল আসি
সভা তারা করে আবাহন।।
গুরুচাঁদ মত দেয় মীডে সঙ্গ করি লয়
সভা পরে দিল দরশন।
মীডেরে রাখিতে বাধ্য ইচ্ছা করে ভবারাধ্য
সভাপতি করিবে তাঁহারে।।
কেশব ডাক্তার তায় বহু আপত্তি জানায়
আর বহু কটু উক্তি করে।
নিন্দা করে সাহেবেরে প্রকাশ্য সভার পরে
মীড মনে ভাবে অপমান।
সে সব শুনিয়া কাণে প্রভু দুঃখ পেয়ে মনে
ক্রোধে বলে “ওরে ধরে আন।।
এতই হয়েছে ধন্য কা’র নাহি রাখে মান্য
ভদ্রাভাদ্র না মানে অতিথি।
কিসে এত অহঙ্কার? দেখা’ব সভার পর
শোচনীয় হবে ওর গতি।।”
প্রভু এই রূপে কয় কেশব ডাক্তার তায়
স্তব্ধ হয়ে রহিল সভায়
মনে গণি অপমান কিছু পরে চলি যান
উপস্থিত কুটুম্ব-আলয়।।
উপাধি মজুমদার প্রতিপত্তি বহুতর
সেই গৃহে চলিল ডাক্তার।
তাদের বুঝায়ে কয় স্বজাতির সে সভায়
বড় কর্ত্তা করে কটুত্তর।।
কুটুম্বের অপমানে সবে ব্যথা পেয়ে মনে
সভা গৃহে হ’ল উপস্থিত
শুনিয়া সকল কথা গুরুচাঁদ জ্ঞান-দাতা
প্রত্যুত্তর করে সমুচিত।।
সবারে ডাকিয়া বলে “উত্তর শুনিতে হ’লে
চল সবে আপন ভবনে।
তোমাদের গৃহে বসি সকল উত্তর রাশি
দিব আমি বিবিধ বিধানে।।
তোমরা’ত নহ পর কুটুম্বিতা পরস্পর
তব ঘরে মোর ঘরে আছে।
তোমাদের বাড়ী গিয়ে সবারে একত্রে নিয়ে
আলোচনা করা যাবে পাছে।।
সবে খুসী হ’ল তাতে অতিশয় যতনেতে
প্রভুকে আনিল নিজ গৃহে।
আহারাদি করি শেষ দয়াময় হৃষীকেশ
সবার ডাকিয়া তবে কহে।।
“শুন সবে ভ্রাতৃগণ কথা এক পুরাতন
তোমাদের বংশে ঘটে যাহা।
তোমাদের নাহি মনে কিন্তু আমি নিশিদিনে
ভুলিতে পারিনা কভু তাহা।
নামেতে দুর্গাচরণ এই বংশে মহাজন
সম্পর্কেতে ছিলেন শ্বশুর।
বড় দুঃখ পেল তিনি আমি তাহা সব জানি
সেই দুঃখ করিলাম দূর।।”
অতঃপর দয়াময় সকল খুলিয়া কয়
যে ভাবেতে চাঁদসী ডাক্তার।
বিবাহের উপলক্ষ্যে প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে
বহু দুঃখ মনে দিল তাঁর।।
সব কথা বলা হ’লে মজুমদারেরা বলে,
“ইনি হ’ন পরম বান্ধব।
ঠিক ঠিক বলিয়াছে তাতে কিবা দোষ আছে
মন্দ কার্য্য করিল কেশব।।”
বহু যত্ন করে পরে প্রভুকে রাখিল ঘরে,
দুই দিনে আসিতে না দেয়।
তৃতীয় দিবস কালে সকলে ডাকিয়া বলে
গুরুচাঁদ প্রভু দয়াময়।।
“ঢাকা যেতে হবে মোর আর নাহি কর জোর
“এবে দেশে করিব প্রস্থান।
বান্ধবের এই রীতি সুঃখে থাকে সাথী
মান কিম্বা হোক অপমান।।”
এভাবে বিদায় নিয়ে আপনার গৃহে গিয়ে
ঢাকা যেতে করিল উদ্যোগ।
যজ্ঞেশ্বর তাতে কয় “মীড সাথে যেতে চায়”
প্রভু কয় “বড় শুভ যোগ।।”
ঢাকা নমঃশূদ্র সভা বিচিত্র সভার শোভা
নমঃশূদ্র সবে যোগ দিল।
জ্ঞানী গুণী সাধু যাঁরা সকলে কহিল তাঁহা
সভাপতি গুরুচাঁদ ভরসা।।
অর্ব্বাচীন একজন তাতে রুষ্ট তার মন
বি,এ, পাশ তিনি একজন।
বিদ্বান থাকিতে ঘরে অন্য সভাপতি করে
হল যেন বৃশ্চিক দংশন।।
ক্ষোভ সম্বরিতে নারে প্রতিবাদ উচ্চস্বরে
সভামধ্যে করিল তখন।
বলে “একি ব্যবহার উপযুক্ত কেহ আর
নাহি নাকি এই সভা পরে?
বিদ্বানের সমাদর বোঝা গেল অতঃপর
নাহি হবে নমঃশূদ্র ঘরে?
জানি উনি ধনবান তাতে পাবে শ্রেষ্ঠ মান?
এই রীতি মানা নাহি যায়।
আমার মন্তব্য এই এইমতে আমি নেই
সভাপতি কর পুনরায়।।
বিশ্বাস শ্রীযজ্ঞেশ্বর ক্রোধে কাঁপে থর থর
ডেকে বলে সভাজন ঠাঁই।
“স্বজাতি বান্ধব বর্গ আমি অতীব অযোগ্য
দু’টী কথা বলিবারে চাই।।
বাবুটীকে নাহি চিনি তবু মনে অনুমানি
বি,এ কিম্বা এম,এ পাশ উনি।
জানি না কয় পুরুষে আছে বিদ্বানের বেশে
দেশ মধ্যে কত বড় ধনী।।
আমি যতদূর জানি নমঃশূদ্র শিরোমণি
তার বংশে আছে কি না আছে।
যদি কেহ থাকে ভাই তাহাতে আপত্তি নাই
সভাপতি হোন নেচে নেচে।।
এই কিবা ব্যবহার? এই নাকি সদাচার?
এই নাকি বিদ্যাশিক্ষা-জ্ঞঅন?
শুন বাবু বলি বার্তা, সভাপতি যেঁই কর্তা
মুনি ঋষি তাঁরে করে ধ্যান।।
বিদেশী ইংরাজ জাতি এই মীড মহামতি
যাঁর রাজ্যে বাস করি মোরা।
তিনি দেখ নতমুখে সম্মান দিয়াছে এঁকে
বসে আছে যেন বাক্য-হারা।।
‘বিদ্যঅ’ বলে অহঙ্কার করিয়াছ সভা পর
বল দেখি বিদ্যা কাকে কয়?
বিদ্যার আদিতে যাহা কভু কি দেখেছ তাহা
তার সাথে আছে পরিচয়?
শুন হে বিদ্বান বাবু বিদ্যা বুদ্ধি সব কাবু
হাবু ডুবু করে যাঁর কাছে।
বিদ্যার জননী যাঁরে সদা পূজে সদাচারে
দেখ তিনি বসিয়া রয়েছে।।
গুণ-মধ্যে রাজা ধর্ম্ম বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান কর্ম্ম
সবে তাঁর পদানত দাস।
সেই ধর্ম্ম যাঁর বুকে তুমি তাঁরে কোন মুখে
“যোগ্য নহে” করিলে প্রকাশ?”
এই ভাবে কথা কয় যজ্ঞেশ্বর মহাশয়
হেনকালে দাঁড়াইলা মীড।
সভাজনে সম্বোধিয়া বাজে কথা বাদ দিয়া
কথা বলে রাজ পুরোহিত।।
মিষ্ট ভাষে ধীরে ধীরে বলিলেন বাবুটিরে
তাতে বাবু হইল লজ্জিত।
দাঁড়াইয়া করজোড়ে প্রভুকে বিনয় করে
ক্ষমা চাহি নিল যথোচিত।।
যথোচিত সভা হয় ফিরে এল দয়াময়
নিজ বাস ওড়াকান্দী ধামে।
সন্দেহ মীডের মনে কাজ করি কি কারণে
খৃষ্টান না হল এই গ্রামে।।
জানিয়া মীডের মন প্রভু যায় ঘন ঘন
মীড সঙ্গে আলাপন করে।
প্রভু কহে কিবা করি আমার’ত ইচ্ছা ভারী
শশী যেন কোন ভাব ধরে।।”
দেশবাসী জনে কয় “শোন সব মহাশয়
খৃষ্ট-ধর্ম্ম মনে লাগে ভাল।
খৃষ্টান হেইতে মনে ইচ্ছা করে প্রতি ক্ষণে
শুধু বাধা ভেবে পরকাল।।”
এ কথা প্রচার হয় আনন্দিত মীড তায়
ঘন ঘন করে যাতায়াত।
নাম তার বিশ্বেশ্বর ওড়াকান্দী পরে ঘর
খৃষ্টান হইল আকস্মাৎ।।
দেশবাসী জুটি সবে কহে সবে কলরবে
নমঃশূদ্রে নাহি আর রক্ষঅ।
শশীবাবু ছিল দুরে কেহ গেল তাঁর ধারে
পত্র যোগে কেহ করে ভিক্ষা।।
বাবু শীঘ্র বাড়ী চল রসাতলে দেশ গেল
তব পিতা কি জানি কি করে।
জাতি দিল বিশ্বেশ্বর মনে হয় পরস্পর
সবে যাবে খৃষ্টানের ঘরে।।”
শুনি এই সমাচার ব্যস্ত হ’য়ে অতঃপর
শশী বাবু গৃহেতে আসিল।
প্রণমি পিতার পায় করজোড়ে কথা কয়
আঁখি যুগ করে ছল ছল।।
প্রভু তাঁরে বলে হাসি “কি কারণে ওহে শশি
কার্য্য ছাড়ি আসিয়াছ গৃহে?
দেশবাসী সবে বুঝি তোমাকে এনেছে আজি
আমাকে বুঝাতে সমারোহে।।
তার আবশ্যক নাই সব আমি টের পাই
যার কাজ সেই ভাল জানে।
আমাকে খ্রীষ্টান করে হেন শক্তি কেবা ধরে
সব কথা আছে মোর প্রাণে।।
তুমি কার্য্যস্থলে যাও সবাকারে বলে দাও
বৃথা চিন্তা কেন সবে করে।
জাগাতে পতিত জনে কত ভাব ওঠে মনে
মোর কেহ বুঝিতে না পারে।।”
পিতৃ মুখে শুণি বাণী সকলে ডাকিয়া আনি
শশী বাবু বলিলেন কথা।
সবে শান্তি পে’ল প্রাণে শশীবাবু কার্য্যস্থানে
চলিলেন মনে একাগ্রতা।।
প্রভু ত্যাগ করে ভাণ মীডেরে ডাকিয়া কন
“শোন মীড আমি যাহা বলি।
তোমাকে বিশ্বাস করি আছি তব ভাব ধরি
হিন্দু ধর্ম্ম দিছি জলাঞ্জলি।।
পূজিতাম দশভূজা আর কত ছিল পূজা
সব ছাড়ি খৃষ্ট-নীতি শুনি।
ভাবিয়াছি ধর্ম্ম ভরে মীড হেথা বাস করে
ধর্ম্মপ্রাণ মীড গুণমণি।।
ধর্ম্ম মধ্যে জাতি নাই ধর্ম্ম আছে সব ঠাঁই
তার মধ্যে আছে তারতম্য।
যে-ধর্ম্ম সহজ পথে চালায় জীবন রেথ
সেই ধর্ম্ম সর্ব্ব-জন-গম্য।।
যাতে নাই ছলা কলা তাতে নাই কথা-বলা
সহজ ইচ্চায় নাচে প্রানে।
যার আছে পরচার নিশ্চয় তাঁর
ক্ষুদ্র শক্তি ইথে নাহি আন।।
বল তুমি কোন মতে বিশ্বেশ্বর আকস্মাতে
খৃষ্ট-ধর্ম্ম করিল গ্রহণ।
মোর মনে এই লয় ঠেকিয়া পেটের দায়
হিন্দুধর্ম্ম করেছে বর্জ্জন।।
যেই ধর্ম্ম এই ভাব ঘোর স্বার্থন্ধ স্বভাব
সেই ধর্ম্ম আমি নাহি লব।
আমার পিতার ধর্ম্ম সরল সহজ ধর্ম্ম
তাই মেনে নমঃশূদ্র রব।।
এক কথা মহাশয় তোমাকে বলিতে হয়
তব গীর্জ্জা মোর গৃহ ধারে।
তোমার মিশন ধারে তুলি তাহা অতঃপরে
রাখ সেথা পবিত্র আচারে।।
তোমাদের যে-আচার আমাদের ব্যবহার
ভিন্ন ভিন্ন আছে চির দিন।
অশিক্ষিত মোরা সবে হতে পারে কোন ভাবে
গীর্জ্জা তব হইবে মলিন।।”
শুনিয়া প্রভুর কথা মীড হেঁট করি মাথা
বহু চিন্তা উঠে তার মনে।
“যথা আজ্ঞা” বলি মুখে হৃদয়ে পরম দুঃখে
চলি গেল আপন ভবনে।।
কিছু দিন পরে তার চলি গেল পর পার
শ্রীসুরেন্দ্র ঠাকুর সুজন।
দেশবাসী সবে তায় কান্দিয়া আকুল হয়
শোকাকুল হল সর্ব্বজন।।
সনাতন নির্ব্বিকার গুরুচাঁদ মহেশ্বর
ধরা যেন সহে ধরা-ভার।
জন্ম মৃত্যু সম তাঁর কে আপন কেবা পর
চক্ষে বারি নাহি পর তাঁর।।
দেশবাসী জনে জনে প্রভু বলে দিনে দিনে
“কেহ যেন না হয় খৃষ্টান।
তারে দিয়ে যেবা কাজ সব শেষ হল আজ
নিজ ধর্ম্ম রাখ অধিষ্ঠান।।
সমাজের ব্যাধি যত করিবারে অবগত
দেশে দেশে করয়-ভ্রমণ।
ক্রমে তাহা সবাকারে ইচ্ছা করি বলিবারে
যদি গুরু দেয় শ্রীচরণ।।
এবে শুন মধু বাণী কোন ভাবে গুণমণি
পুনরায় পূজে দশভূজা।
কেন পূজা ছাড়ি দেয় কেন করে পুনরায়
কোন ভাবে করে মহা তেজা।।
কিবা ইচ্ছা মনে তাঁর কিবা জানি সমাচার
শুধু মনে যেই টুকু দেখি।
ব্যাখ্যা কিছু নাহি জানি ধরিয়া লেখনীখানি
ইতিহাস তার অত্র লিখি।।
সুবিজ্ঞ রসিক যত পদে করি দন্ডবৎ
এই মাত্র করি নিবেদন।
কল্পকত গুরুচান্দে যে-ফল রয়েছে বেন্ধে
আমি শুধু দিই বিবরণ।।
রসলিপ্সু ভক্ত যাঁরা সেই ফল পিয়ে তাঁরা
রস যাহা কর আস্বাদন।
আমি দীন দুরাচারী কোন গুণে ফলে ধরি
জন্ম তাই গেল অকারণ।।
পুনরায় দশভুজা পূজারম্ভ
প্রভুর কনিষ্ঠ পুত্র গেল লোকান্তরে।
গৃহবাসী সবে তবে বলে অতঃপরে।।
দশভূজা পূজা মোরা করি পুনরায়।”
দেবী পূজা হ’লে তা’তে সর্ব্বসিদ্ধ হয়।।
পভু বলে ‘এই কার্য্য আমি না করিব।
মরণের ভয়ে শেষে দেবতা ডাকিব?”
গৃহবাসী তাহ সবে হ’ল ক্ষুন্ন মন।
পরে দেখ ঘটে সেথা অপূর্ব্ব-ঘটন।।
যামিনীর শেষ-যামে শয্যাত্যাগ করি।
প্রাঙ্গণে চলিছে প্রভু বলে হরি! হরি!।।
হেন কালে জীর্ণা দীনা রুগ্ন এক নারী।
প্রভুর সম্মুখে এল জোড়হস্ত করি।।
প্রভু কয় “এ কি দায়।তুই কি বা চা’স?
সবে’ যা’ সরে ‘যা’ কেন আমারে জ্বালাস?”
নারী বলে “দয়াময় করো’না ছলনা।
দেখ দেব আমি হই শিবের ললনা।।
তুমি না পূজিরে মোরে কেহ নাহি পূজে।’
পূজা-হীনা, জীর্ণ দীনা আছি ধরা-মাঝে।।
ঘরে ঘরে জনে জনে কত পূজা দেয়।
সঙ্গিনী পিচাশী যত সেই পূজা লয়।।
মেষ বলি, অজা বলি, করে জনে জনে।
রক্ত-মাখা পূজা আমি গ্রহণ করিনে।।
আমি’ত বৈষ্ণবী তাহা তুমি ভাল জান।
আমাকে বঞ্চিতা প্রভু কর আর কেন?
প্রকৃত পূজার তত্ত্ব কেহ নাহি জানে।
আমকে তুষিতে তাই অজা-রক্ত আনে।।
মোর ভোগে তাহা কভু করিনা গ্রহণ।
তাই দিয়ে পালি প্রভু পিশাচীর গণ।।
তব গৃহে পূজা হ’ত সাত্তক আচারে।
সেই পূজা লইতাম আনন্দ অন্তরে।।
সকলি জান’ত প্রভু কিবা বলি আর।
আজ্ঞা কর পূজা হোক এই গৃহ পর।।
শ্রীশশী, সুধন্য এরা ভাই দুইজন।
মম পুত্র বটে তারা এ-বুকের ধন।।
তাহারা পূজিবে দোঁহে তুমি রহ দুরে।
তোমাকে দেখিব আমি দু’নয়ন ভরে।।”
এত যদি মহাদেবী প্রভুকে কহিল।
কথা শুনি গুণমণি আনন্দে হাসিল।।
দেবীরে ডাকিয়া বলে “শুন গো ভবানী।
হইবে তোমার পূজা ইহা যাও জানি।।
তোমার বিনয় ঠেলি কি প্রাকরে?
রাখিলাম তব বাক্য আনন্দ অন্তরে।।”
অতঃপর কর সবে পূজা দিতে হয়।
দেবী নিজে পূজা লাগি করিল বিনয়।
তাহারে নিজে পূজা লাগি করিল বিনয়।
তাঁহারে বিমুখ করা উচিত না হয়।।”
মহা সমারোহে হ’ল পূজা অয়োজন।
পরম আনন্দে সবে হ’ল নিমগন।।
ভক্ত মধ্যে হরিবর কবি সরকার।
অন্য কবি ভাই তার নাম মনোহর।।
গান করে দুই ভাই কৃষ্ণ আলাপন।
শুনিয়া গানের পাল্লা সুখী সর্ব্বজন।।
পুনরায় বিজয়ায় হ’ল শান্তি-সভা।
ভক্ত মধ্যে পুনরায় পূজারম্ভ হ’ল।
‘হরিগুরুচাঁদ’ প্রীতে হরি হরি বল।।
শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত গ্রন্থমুদ্রণে আলোচনা
গোস্বামী তারকচন্দ্র ভক্ত-শিরোমণী।
স্বপ্নাদেশে রচিলেন “লীলামৃত” খানি।।
মহাপ্রভু গুরচাঁদ গ্রন্থ শুনি কয়।
‘উত্তম হয়েছে গ্রন্থ প্রভুর কৃপায়।।”
“শ্রীহরি চরিত্র সুধা” আদি নাম ছিল।
শশীবাবু বলিলেন “নাম নহে ভাল।।”
তিনি রাখিলেন নাম “হরিলীলামৃত”।
গুরুচাঁদ বলে “নাম হয়েছে সঙ্গত।।”
পুনরায় প্রভু বলে “শুন ভক্তগণ।
অবশ্য করিতে হবে এ গ্রন্থ মুদ্রণ।।
সবে মিলি কিছু কিছু অর্থ যদি দাও।
মুদ্রিত আকারে তবে সবে গ্রন্থ পাও।।”
ভক্ত গণে কিছু কিছু স্বীকার করিল।
কিছু অর্থ সেই খানে আদায় হইল।।
বার্দ্ধক্যে দুর্ব্বল বটে তারক গোঁসাই।
তিনি কহে “চল সবে ভিক্ষার কারণে।।
এক সঙ্গে চারিজন চলিল দক্ষিণে।
ভক্ত গৃহে চলে সবে ভিক্ষা লাগি যাই।।
দলপতি সাজিলেন তারক প্রাচীন।
বাবুরাম, হরিবর, সঙ্গেতে বিপিন।।
এক সাথে চারিজনে ভ্রমে দেশে দেশে।
আদায় হইল কিছু টাকা অবশেষে।।
পরিমাণ দেড় শত হইল আদায়।
তথা হতে শ্রীতারক দেশে ফিরে যায়।।
পথিমধ্যে দুর্গাপুরে রাত্রি কাটাইল।
সব টাকা একত্তরে হরিবরে দিল।।
গৃহে দিয়া গোস্বামীজী হইল অচল।
অন্তরে বুঝিয়া দেখে এত মৃত্যুকাল।।
নিজ-গৃহে হরিবরে ডাকিয়া আনিল।
“লীলামৃত” গ্রন্থখানি তার কাছে দিল।।
যাদবে ডাকিয়া বলে আর হরিবরে।
“মুদ্রিত করিও গ্রন্থ দোঁহে চেষ্টা করে।।”
অল্প দিন পরে তবে তারক গোঁসাই।
জীব-লীলা সাঙ্গ করে সবে জানে তাই।।
তার পরে হরিবর যাদব সহিতে।
বহু চেষ্টা করিলেন গ্রন্থ ছাপাইতে।।
আবশ্যক অর্থ কড়ি সংগ্রহ না হয়।
অর্থাভাবে গ্রন্থ ছাপা বাদ পড়ে যায়।।
সকলে আশ্চর্য্য হ’ল এ-কথা ভাবিয়া।
গ্রন্থ-ছাপা বন্ধ থাকে কিসের লাগিয়া?
মতুয়ারা সবে যদি হয় এক মন।
গ্রন্থ-ছাপা বন্ধ থাকে কিসের কারণ?
মুখে মুখে বলে সবে কাজ নাহি হ’ল।
সে-ভাব দেখিয়া সবে আশা ছেড়ে দিল।।
হরিবর তবু কিন্তু চেষ্টা নাহি ছাড়ে।
এই ভাবে দিনে দিনে দিন যায় বেড়ে।।
তেরশ’ একুশ সালে বারুণী সময়।
হরিবর কেন্দে কেন্দে গুরু চাঁদে কয়।।
“দয়া করে বাবা তবে করুন আদেশ।
লীলামৃত গ্রন্থ ছাপা করিবারে শেষ।।
আপনার আজ্ঞা বিনে কিছুই হবে না।
আজ্ঞাছাড়া মোরে টাকা কেহ’ত দিবেনা।।”
প্রভু বলে হরিবর আমি দিচ্ছি বলে।
যে যাহা পরিবে টাকা দিবে তোমাস্থলে।।
ইচ্ছাময় কিবা ইচ্ছা করে অন্তরালে।
গ্রন্থছাপা হবে কিনা কিছু নাহি বলে।।
কিছু কিছু টাকা সবে দিলে হরিবরে।
এবে শুনে ইচ্ছাময় কোন ইচ্ছা করে।।
গোপাল সাধু
“মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘায়তে গিরিম” ......স্তবমালা
``And lo! the spirit of the Lord descend
on him as a dove”- The Holy Bible
জিলার দক্ষিণ প্রান্তে ক্ষুদ্র এক গামে।
জন্মিল পুরুষ এক শ্রীগোপাল নামে।।
লহ্মীখালী নামে গ্রামে খুলনা জিলায়।
বার শত আশী সালে আসি জন্ম লয়।।
হিন্দুবংশে অবতৎস নমঃশূদ্র জাতি।
মাতা’ল জগৎজীবে হরি নামে মাতি।।
পিতা তাঁর স্তব্ধ, শান্ত শ্রীরাম চরণ।
উপাধি হাওলাদার-ধনী একজন।।
মাতা তাঁর কালী দেবী সাব্ধী সতী অতি।
মহাসুখে পতি সহ করেন বসতি।।
রাম চাঁদ, জয়ধর সহোদর ভাই।
ভ্রাতৃ-প্রেমে বাস করে ভিন্ন ভাব নাই।।
আদিবাস করে দোঁহে বেতকাটা গ্রাম।
সেই গ্রামে বিভা কৈল রাম গুণ ধাম।।
রামধন হালদার অতি মহাশয়।
তাঁর ঘরে দুই কন্যা আসি জন্ম লয়।।
দুই পুত্র নিলমণি আর সোণারাম।
মহাসুখে বাস করে সেই গুণধাম।।
শ্রীরামচরণে দেখি অতি গুণবান।
পরম আদরে কন্যা করিলেন দান।।
বিভা-পূর্ব্বে বামচাঁদ লহ্মীখালী যায়।
জমিদার হ’তে বহু ভূ-সম্পত্তি পায়।।
বড়ই তেজস্বী ছিল সে রাম চরণ।
মিথ্যাকথা জুয়াচুরী জানেনা কখন।।
পবিত্র চরিত্র তাতে সদা সত্য বাদী।
সেই হেতু শ্রীগোপালে দান কৈল বিধি।।
অবলা সরলা মাতা কালী নাম ধরে।
শ্রীগোপালে কোলে পে’ল পতি-পূজা করে।।
পতি সতী এক সেঙ্গ কৃষ্ণ গুণ গায়।
‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে চক্ষে ধারা বয়ে যায়।।
এমন জনক যেথা জননী এমন।
সেথা কেন আসিবে না সাধু মহাজন?
বার শত আশী সালে শুভ প্রাতঃ কালে।
নামিল গোপালচন্দ্র ধরণীর কোলে।।
বিস্তৃত জীবন কথা আজি নাহি বলি।
গ্রন্থের ভাবের ভাবে ভাব ধরে চলি।।
গুরুর দয়ায় যদি কাল ভবিষ্যতে।
পারি যদি কথা তাঁর কর ভালমতে।।
এবে শুন সংক্ষেপেতে যাহা বিবরণ।
করিলেন শ্রীগোপাল জনম গ্রহণ।।
বাল্যকালে বিদ্যা শিক্ষা হ’ল বাংলা মতে।
মন ব্যস্ত থাকে সদা গোধন চরাতে।।
গোধন চরাবে কিবা বনমধ্যে বসি।
ক্ষণে চিন্তা করি কান্দে ক্ষণে উঠে হাসি।।
আপনার মনে গাভী চরিয়া বেড়ায়।
কার কোন দ্রব্য ক্ষতি করেনা কোথায়।।
জন্মিল কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীমাধব নাম।
কৈশোর বয়সে ত্যাগ করে ধরাধাম।।
বয়সে ষোড়শ বর্ষ পরিপূর্ণ হ’ল।
শ্রীরাম আপন পুত্রে বিভা করাইল।।
আড়ংঘাটা গ্রামে বাস শ্রীগোবিন্দ নাম।
তাঁর কন্যাসহ বিভা বিদল গুণধাম।।
ভগবতী তূল্য রূপ করুণ চাহনি।
মাতৃ-মূর্ত্তি মহাসতী কাঞ্চন জননী।।
কণক-বরণী মাতা শ্রীকাঞ্চনময়ী।
কোটি কোটি দন্ডবৎ সেই পদে হই।।
গোপালের শ্যালিকা এক নামেতে কামিনী।
ওড়াকান্দী হরিভক্ত একজন তিনি।।
বিবাহের রাত্রি গতে প্রফুল্ল ঊষায়।
“ঝারি” হাতে সে গোপাল পায়খানা য়ায়।।
নির্ম্মল তরুণ ঊষা বহিছে মলয়।
আপনা আপনি যেন মন খুলে যায়।।
হেনকালে সে কামিনী সুললিত স্বরে।
পরাণ খুলিয়া ঘরে বসে গান করে।।
কে-যেন টানিছে তারে ধরে মনপ্রাণ।
তাঁরে বিনে বৃথা যেন জাতি কুল মান।।
পরাণে-পরাণে টানে চোখে নাহি দেখা।
চোখে মুখে ওঠে জেগে বিরহের রেখা।।
কামিনী গাহিল গান ব্যথা-ভরা মনে।
পদ-মাত্র উল্লিখিত করিনু এখানে।।
“করেব যা’ব ওড়াকান্দী,
ও ঘরে রয়না আমার মন।।”
মানব-প্রতৃতি কি যে বুঝিয়া না পাই।
সে-যেন কাহারে চেয়ে সদা ছাড়ে হাই।।
সারা-জন্ম কারে যেন করিছে তালাস।
যত-কিছু পাক তাতে সেটে না’ক আশ।।
সত্য বটে জগতের যত সমারোহ।
মানব চিত্তকে ঢেলে রাখে অহরহ।।
কিন্তু সমারোহ যবে অবসান হয়।
মন কেন্দে বলে ওঠে “সে তোর কোথায়?”
বিরহ তারাতে তাই বেজে ওঠে সুর।
ব্যথা দিয়ে মাথা তাহা কত যে মধুর।।
সেই সুরে কত জনে ঘর ছেড়ে যায়।
“দরদী” তালাস করে সারা বিশ্বময়।।
বিবাহের করলোলে মন ডুবে ছিল।
কলরোল শেষ হলে বিরহ বাজিল।।
পরাণ কান্দিয়া ওঠে “প্রাণবন্ধু!” বলে।
ওড়াকান্দী ভিন্ন তাঁরে কোথা গেলে মেলে??
এ যেন বিরহী যক্ষ রামগিরি শিরে।
বিরহিণী গোপী যেন যমুনার তীরে।।
পরাণ-বান্ধব হরি! আজি তুমি কই?
তুমি বিনে রাতি দিনে কিবা ল’য়ে রই?
হৃদয়ে আঁধার রাত্রি নাহি আলো-রেখা।
হৃদয় উজল করি এসে দাও দেখা।।
যে-বিরহে গেয়েছিল কবি বিদ্যাপতি।
সে-বিরহ কন্ঠে পেল কামিনী সতী।।
“আথির যামিনী, তিমির দিগভরি’
বিজুরিক পাতিয়া।
বিদ্যাপতি কহে-হরি বিনে কৈসে,
গোঙ্গায়িবি দিন-রাতিয়া।।”
কামিনীর গানে মুগ্ধ নর নারী সব।
মনে হয় পশু পাখী নাহি করে রব।।
গান শুনি আত্ম-ভোলা কাঞ্চন জননী।
কামিনীর সঙ্গে গান গাহিলা আপনি।।
ভরিল সুরের রেশ আকাশে বাতাসে।
গোপাল শুনিল গান পায়খানা বসে।।
কিবা সে পরাণ-হারী সুরের লহরী।
পলকেতে মন প্রাণ সব নিল হরি।।
সে-যে কি দারুণ ব্যথা উঠিল হৃদয়।
মনে হয় বুক ভেঙ্গে প্রাণ বাহিরায়।।
অকারণে ঝর ঝর চক্ষে ঝরে বারি।
কান্দিল গোপাল সেথা মন প্রাণ ভরি।।
‘ওড়াকান্দী’ ‘ওড়াকান্দী’ কিবা শুনিলাম।
ওড়াকান্দী কিবা আছে নাহি বুঝিলাম।।
কিছু পরে সে-কামিনী গান বন্ধ কৈল।
মোহন মুরলী যেন নীরব হইল।।
পায়খানা হতে ফিরে আসিল গোপাল।
সবে দেখে গোপালের দুই চক্ষে জল।।
কামিনীর কাছে বলে গোপাল সুজন।
“দয়া করে” বল দিদি সব বিবরণ।।
ওড়াকান্দী কিবা আছে গাও কার গান?
গান শুনে কেন্দে কেন্দে ওঠে কেন প্রাণ?
কে শিখা’ল এই গান কোথা তাঁর ঘর?
কোথা গেলে বল দেখা পা’ব আমি তাঁর।।
আকুল করেছে মোরে প্রাণ নি’ছে কাড়ি।
পাগল হয়েছে হিয়া মন গেছে উড়ি।।”
বল বল বল মোরে সে মানুষ কোথা?
যাঁর নামে আঁখি ভরে বুজে বাজ্যে ব্যথা।।”
গোপালের ভাব দেখি সে কামিনী কয়।
“শুন ভাই যাহা বলি সত্য পরিচয়।।
ওড়াকান্দী এসেছিল মানুষ রতন।
হরিচাঁদ নাম তাঁর রেশম বরণ।।
তাঁর ভাবে মত্ত যারা তারা এই গাহে।
তাঁর নাম তাঁর গান সকলেরে কহে।।
আমার দেশেতে আছে মতুয়া গণ।
এই গান তারা সবে করে সর্ব্ব ক্ষণ।।
আমি গান শিখিয়াছি তাহাদের কাছে।
এই মত কত শত আর গান আছে।।”
গোপাল বিনয়ে তবে বলে কামিনীরে।
“দয়া করে চল দিদি আমাদের ঘরে।।”
তোমার নিকটে গান চাহি শুনবারে।
ওড়াকান্দী কথা কিছু বলিবে আমাবে।।”
দৈবক্রমে কামিনীর যাওয়া নাহি হ’ল।
বিবাহান্তে সে গোপাল গৃহেতে ফিরিল।।
কামিনীর গান তেঁহ না ভোলে কখন।
মনে ভাবে ওড়াকান্দী করিবে গমন।।
নরে ভাবে ইহা, তাহা, সকলি করিবে।
হবে কিনা হবে তাহা কেমনে বলিবে?
ইচ্ছা ময় ইচ্ছা যদি করে নিজ মনে।
মানবের বাঞ্ছা পূর্ণ হয় সেই ক্ষণে।।
গোপালের বাঞ্ছা তাই পূর্ণ নাহি হ’ল।
সংসার আসিয়া ক্রমে তাঁহাকে ঘিরিল।।
ক্রমে ক্রমে দুই পুত্র জন্মে তাঁর ঘরে।
এক কন্যা নিল জন্ম গৃহ আলো করে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র হরশীত যবে জন্ম লয়।
দৈবের বিধান যাতা কে তারে খন্ডায়
মহাত্মা রামচরণ দেহ রক্ষা করে।
একপুত্র শ্রীগোপালে রাখিয়া সংসারে।।
অপুত্রক জয়ধন থাকে এক সঙ্গে।
পড়িলা গোপাল প্রভু সংসার-তরঙ্গে।।