মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ২১-৪০

গ্রন্থারম্ভ

অষ্টাদশ খ্রীষ্টাব্দে পৃথিবীর অবস্থা

 

যদা যদাহি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি’-(গীতা)

 

কাঁদে দেবী বসুন্ধরা হাহাকার রবে

ধরাবাসী মত্ত সবে যুদ্ধের বাড়বে।।

অষ্টাদশ শত অব্দ গত প্রায় হ'

ফ্রান্স দেশে দাবানল জ্বলিয়া উঠিল।।

ধনিক বণিক আর গর্বি জমিদার

অবহেলে দীনজনে করে অত্যাচার।।

পশুসম নরনারী বাঁধে পদতলে

মানবতা চূর্ণ হয়ে গেল রসাতলে।।

ধর্ম ধ্বজাধারী সাজি যত পুরোহিত

ধর্মকে পিষিয়া করে কার্য বিগর্হিত।।

মাতৃত্ব সতীত্ব কহে হাস্যকর নীতি

নারী জাতি লয়ে করে পাপের বেসাতি।।

বিশ্ব যে সৃজিল তাঁরে গর্বে অবহেলি

রাজা সাজে বিশ্বকর্ত্তা ধর্ম পদে ঠেলি।।

আমিত্ব প্রভুত্ব মাত্র করে সর্ব সার

অত্যাচারে বসুন্ধরা কাঁপে থর থর।।

এই বাড় বাগ্নি মাঝে পৃথিবী পশিল

শান্তি, সুখ, শীতলতা সব দূরে গেল।।

মুষ্টিমেয় অত্যাচারী করে অত্যাচার

অগনিত নর প্রাণী করে হাহাকার।।

ত্রাহি ত্রাহি কন্ঠে ডাকে কোথা দয়াময়

তোমার সাধের সৃষ্টি পাপে ডুবে যায়।।

ত্রাণ করো ত্রাণ করো জগতের পতি

কালের করাল করে রক্ষ বসুমতি।।

অসহ্য পাপের ভার ধরা নাহি সহে

রাতুল চরণ পানে তাই চাহি রহে।।

অনাথ আতুর যত কাঁদে উভরায়

অসাম্য ভারেতে ধরা ডুবু ডুবু প্রায়।।

হে শান্ত শিবম প্রভু পুরুষ মহান

ধরাকে রক্ষিয়ে করো জীবের কল্যাণ।।

অগণিত দীনহীন ভাসে অশ্রুনীরে

প্রভুর আসন টলে অনন্ত সায়রে।।

আপনি নামিল প্রভু নররূপ ধরে

যুগে যুগে এই নীতি আছে পরস্পরে।।

সাধুর রক্ষণ আর পাতকী সংহার

ধর্মে রক্ষা করে প্রভু নাশে ধরাভার।।

হিরণ্যকশ্যিপু নাশ করে সত্য যুগে

রাবনে নাশিল রাম যুদ্ধে ত্রেতা যুগে।।

দ্বাপরে শাসিল কৃষ্ণ কংস শিশুপাল

কুরুক্ষেত্রে পাপী ধ্বংস যেন পঙ্গপাল।।

প্রাচীন ইহুদি গ্রন্থ দেখ পাঠ করি

যিহোবা করেছে ধ্বংস যত ধর্ম-অরি।।

ঈশা মুসা আদি করি যত মহাজন

সবারে পাঠায় প্রভু ধর্মের কারণ।।

আরব দেশেতে যবে ধর্মে দিল পীড়া

ভাঙ্গিতে চাহিল সবে ধর্ম-ধ্বজা চূড়া।।

শেষ নবী মহম্মদ উদয় হইল

শস্ত্র শাস্ত্র সঙ্গে করি ধর্ম প্রচারিল।।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেই ভাব হল

অধর্মের কাল ভেরী বাজিয়া উঠিল।।

ফরাসী বিপ্লব বহ্নি ছুটে চারিভিতে

দেশে দেশে নর-নারী মরে অগণিতে।।

যেই দিকে চাহি শুধু দেখি অত্যাচার

দিকে দিকে হিংসা হিংসি ভীষণ আকার।।

পাপদাপে ধরা যেন যায় রসাতল

করুণ নয়নে চাহে বিশ্বের ভূ পাল।।

দেশে দেশে সাঙ্গ পাঙ্গ সবে পাঠাইল

অধর্ম নাশিয়া তাঁরা জীবে ধর্ম দিল।।

আমেরিকা খন্ডে জন্মে ধর্ম পথে মতি

জর্জ ওয়াশিংটন নামে বীর মহামতি।।

ইংলেন্ড জার্মানি ফ্রান্সে, ইতালি আরবে

ভারতে জাপানে চীনে দেখি নানা ভাবে।।

মহান ধর্মের বীর আদর্শ মানব

জন্ম নিল দেশে দেশে অমৃত স্বভাব।।

বিশেষতঃ বঙ্গদেশে ধর্মগুরু রুপে

মহান পুরুষ কত ভক্তের স্বরুপে।।

উদয় হইয়া করে ধর্মকে রক্ষণ

জীবের কল্যাণ কল্পে অসাধ্য সাধন।।

রামকৃষ্ণ আদি আর শ্রী রামমোহন

দেবেন্দ্র বিবেক আদি ভক্ত অগণন।।

পূর্ববঙ্গে ওড়াকান্দী প্রভু হরিচাঁদ

অবতার রূপে এলো করি সিংহনাদ।।

কি কারণে হল এত মহদাগমন

ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয় সে সব কারণ।।

হরিলীলামৃতগ্রন্থে কবি রসরাজ

অনেক কহিলা কথা প্রকাশিত আজ।।

বঙ্গীয় সমাজ শীর্ষে মধ্য অন্ত ভাগে

কলুষ ছুটিয়া চলে অতি দ্রুতবেগে।।

জ্ঞানী অবতার বুদ্ধ সাম্যবাদ আনে

ভারত একত্র হল একতা বন্ধনে।।

সাম্যবাদী বৌদ্ধ শক্তি অখন্ড প্রতাপ

তার মধ্যে ক্রমে ক্রমে প্রবেশিল পাপ।।

হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শক্তি রয়

বৌদ্ধ ধর্ম অভ্যুদয়ে হীন শক্তি হয়।।

সুযোগ খুঁজিয়া তারা ঘুরে যথাতথা

বৌদ্ধে হীনবল দেখি করিল শঠতা।।

অত্যাচারে অবিচারে যত বৌদ্ধগণে

নাশিল শাসিল ঘোর কঠোর বিধানে।।

আভিণব পুরাণাদি সৃজন করিল

মানুষে মানুষে ভেদ বজায় রাখিল।।

ব্রাহ্মণ বর্ণের শ্রেষ্ঠ এই নীতি বলে

শুদ্র বলি ক্ষুদ্র করে অপর সকলে।।

কথা উপকথা কত সৃজন করিল

ঘাটে মাঠে গাছে পথে দেবতা গড়িল।।

স্বরগের চাবিরাখে ব্রাহ্মণ সুজন

পদধুলি দানে করে পাপের মোক্ষণ।।

অবশ্য দক্ষিণা কিছু সঙ্গে দিতে হয়

দশ বিশ যাহা হোক ব্রাহ্মণেই পায়।।

পাপী করে প্রায়শ্চিত্ত শাস্ত্রের বিধান

বিপ্র আসি মন্ত্র পড়ি দক্ষিণাদি ল।।

মূল্যভেদে বিধানের তারতম্য রয়

মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যেৎএও নাকি হয়।।

জন্ম মৃত্যু বিবাহাদি কিছু ফাঁক নাই

পদে পদে বিপ্র পদে কিছু দেয়া চাই।।

 বিপ্রে স্বর্ণ দিবে আর দিবে ভূমিখন্ড

বিপ্র যদি তুষ্ট হয় তরিবে পাষণ্ড।।

স্বাধীন চিন্তার পথ এ হেন প্রকারে

বন্ধ করে বিপ্রদল শুধু স্বার্থ তরে।।

অনন্ত শক্তির কেন্দ্র মানবের মন

পাপ ভয়ে স্বর্গ লোভে করে আচ্ছাদন।।

নির্জ্জিত মানব হেথা কাঁদে চারিদিকে

অস্পৃশ্যবলিয়া বিপ্র ছোঁয়না তাহাকে।।

ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ

ব্রাহ্মণ প্রধানমার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।।

ব্রাহ্মণ দেবতাতাই ব্রাহ্মণের মান্য

হরি নাকি ধরেছিল ভৃগু পদচিহ্ন।।

তন্ত্র মন্ত্র ভেল্কি ভোজ রচি দিনে দিনে

গূঢ়ার্থ বাহির করে স্বার্থের সন্ধানে।।

বিপ্র যদি লোভে পড়ি করে পাপ কর্ম

তথাপি তাহার মান্যএই নাকি ধর্ম।।

এ মতে সমাজ ধর্ম গেল রসাতলে

ব্রাহ্মণ কহিলে কথা বেদ বাক্যবলে।।

নারকীয় লীলাখেলা সমাজে পশিল

বিপুল তান্ডবে দেশ রসাতলে গেল।।

দলিত গলিত যত পতিত মানব

ব্রাহ্মণের কুটচক্রে মৃত প্রায় সব।।

রক্ষিতে পতিত জনে সাম্যবাদ তন্ত্রে

গৌরাঙ্গ অর্পিল প্রেম হরিনাম মন্ত্রে।।

ব্রাহ্মণ চন্ডাল সবে হল একাকার

জাতি জাতি টানাটানি ঘুচিল সবার।।

একদেশে একজাতি এক ভগবান

মরুর বুকেতে বহে প্রেমের তুফান।।

মানুষে মানুষ মিশে প্রেমে গলাগলি

যবন ব্রাহ্মণ সবে করে কোলাকুলি।।

ব্রাহ্মণ ধর্মেতে পুষ্ট যত দুষ্ট গণ

এসব দেখিয়া হল বিষাদে মগন।।

টিকি আন্দোলন করি শাস্ত্র বাণী কয়

প্রাণ যায় সোভি আচ্ছাস্বার্থ ছাড়া দায়।।

স্বার্থ বলি দিতে তারা রাজি নহে কভু

বিপদে পড়িলে বটে হয় কিছু কাবু।।

বিপদের জাল যবে ছিন্ন হয়ে আসে

সর্প সম উচ্চ শির তোলে মহারোষে।।

অনর্পিত যেই ধন গৌরাঙ্গ আনিল

নামে প্রেমে মেখে তাহা জীবে বিলাইল।।

প্রেম ভয়ে ভীত হয়ে ব্রাহ্মণ সকল

দূরে দূরে থাকে শুধু করে কোলাহল।।

যখনে গৌরাঙ্গ করে লীলা সম্বরণ

ব্রাহ্মণের কূট বুদ্ধি জাগিল তখন।।

গৌরাঙ্গের ভক্তগণে বৈরাগী কহিয়া

ভিন্ন করি রাখে সবে সমাজ গড়িয়া।।

বৈরাগী বৈরাগীবলি তুচ্ছ করি সবে

সমাজ বন্ধন ভঙ্গ করিল তান্ডবে।।

কলিচক্রবলি ভক্ত করে হাহাকার

গৌরাঙ্গের ধর্ম বুঝি গেল ছারেখার।।

জাতিভেদ মূলচ্ছেদ যে ধর্ম করিল

ব্রাহ্মণের কূটচক্রে ভিন্ন ভিন্ন হল।।

হইল আউল মতে বাউল বিপক্ষ

দরবেশ দেখে নাড়া গালি দেয় রুক্ষ।।

ভিন্ন ভেদ বৈষ্ণবেতে বড়ই মজার

ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবহলে পূজ্য সবাকার।।

ব্রাহ্মণ বাটিতে পারে ভোগাদি নৈবেদ্য

স্পর্শ করে শুদ্র তাহা নাহি হেন সাধ্য।।

পবিত্র বৈষ্ণব ধর্মে পড়ে কুটিনাটি

দেহ শুচি করে বটে মনে থাকে মাটি।।

হরিনাম মহামন্ত্রবলে গেল যারা

দীক্ষা জন্যে কর্ণমন্ত্রগড়ে নিল তারা।।

প্রেমে ভোলা শ্রীচৈতন্য নামে ডুবে রয়

কোথা গেল উপবীত কেবা তত্ত্ব লয়।।

 তাহার ভকত সাজি পরে কতজন

মোটা সুতা গলে কৈল পৈতার সৃজন।।

নিজ নারী পরিহরি প্রভু কেঁদে গেল

পরনারী-ব্যভিচারী বৈষ্ণবসাজিল।।

বৈষ্ণবের মূল ধর্মে পড়ে গেল ত্রুটি

ব্রাহ্মণের মনে ছিল এই কুটি নাটি।।

সমাজ বন্ধন ক্রমে হইল শিথিল

জনে জনে ভাগে ভাগে সমাজ পঙ্কিল।।

এ হেন দুর্গতি দেখে জীবের জীবনে

অবতীর্ণ হরিচাঁদ সুযুক্তি বিধানে।।

নররূপে অবতীর্ণ পালে নর নীতি

গৃহস্থ সাজিয়া করে গৃহেতে বসতি।।

ঠেকিয়া জীবের দায় নরদেহ ধরে

নর ধর্ম পালে প্রভু নরের আকারে।।

উত্তর সাধক শূণ্য অবতার হয়

অবতার চলি গেলে শক্তি চলি যায়।।

আরও নিগূঢ় তত্ত্ব উঠে মম মনে

ভক্তগণ ছিল পূর্বে অবতার সনে।।

প্রভুর মনের ভাব কিছু নাহি জানি

যে বাণী বাখান তিনি বলি সেই বাণী।।

পূর্ণ শক্তি ধরিবারে ভক্তের সাধ্য নয়

যাঁর শক্তি তাই তাঁর সাথে চলি যায়।।

কিছুকাল ভক্ত দল করে কাঁদাকাঁদি

প্রভুকে রাখিতে চায় গ্রন্থ মধ্যে বাঁধি।।

মানুষ চলিয়া যায় সাঙ্গ হয় লীলা

ইতিহাসে লিখি রাখে তার যত খেলা।।

তাই বুঝি প্রভু মোর এই অবতারে

পিতা পুত্র অভেদাত্মা এল ধরা পরে।।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ দেহ ভিন্ন রয়

দুই দেহে এক খেলা আপনি খেলায়।।

হরিচাঁদ রূপে করে প্রথমে আবাদ

বীজ বুনি ফল দেখে প্রভু গুরুচাঁদ।।

চারি যুগে গৃহবাসী পিছে পড়ে ছিল

হরি-গুরুচাঁদ সবে উদ্ধার করিল।।

প্রেম ভক্তি দিয়ে হরি গৃহীর পরাণে

গৃহীন্যাসী কি সন্নাসী আনে এক খানে।।

গড়িয়া ধর্মের রাজ্য সবে প্রজা করি

গুরুচাঁদে ভার দিয়া চলি গেলা হরি।।

গুরুচাঁদ প্রভু তাহে পিতৃ ইচ্ছা মানি

গৃহধর্ম তত্ত্ব কহি মাতাল অবনী।।

উদার অসীম তত্ত্ব গুরুচাঁদ কহে

যেই মানে সেই জানে মোহ নাহি রহে।।

গৃহস্থে দেখাতে পথ জীবে দিতে শান্তি

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ কমনীয় কান্তি।।

গৃহধর্ম পালিপ্রভু জীবেরে শিখায়

গৃহী বড় হলে পরে কত বড় হয়।।

উদার আদর্শ হেন হবে নাক আর

গৃহস্থ জনের বন্ধু শ্রী গুরু আমার।।

এস ভাই গৃহবাসী দিন চলে যায়

গেল দিন হয়ে লীন পড় রাঙ্গা পায়।।

এমন দয়াল বন্ধু পাবে নাক আর

মোহ ছাড়ি ধর পাড়ি চল ভবপার।।

শঙ্কাহারী ত্রীপুরারী গুরুচাঁদ এল

হরি হর অভেদাত্মা ধরাতে নামিল।।

সেই পদ স্মরি সবে বল হরি বল

দীন মহানন্দ যাচে প্রেমামৃত ফল।।

 

আবির্ভাব

 

ভজ মন! হরি হর অভেদাত্মনে

চরণে শরণে ভয় নাই মরণে।।

( কবি রসরাজ)

 

বার শতিপান্ন সাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ অপার মহিমা।।

 দোল পূর্ণিমার তিথি হোলির বাসর

ফাগে ফাগে রাঙা হল দিগ দিগন্তর।।

ফাগেতে রঞ্জিত রবি উঠে পূর্ব ভিতে

হরি বলে ভক্ত দলে লাগিল নাচিতে।।

মহাপ্রভু হরিচাঁদ বসিয়া প্রাঙ্গণে

প্রভুকে সাজাল যত ভক্ত নারীগণে।।

চরণে করিল কেহ ফাগের লেপন

কুসুমের দলে করে মস্তক বন্ধন।।

কপোলে, কপালে দিল রক্ত ফাগরেখা

করতলে দিল ফাগ রক্ত চন্দ্রলেখা।।

চন্দন বাটিয়া করে শ্রীঅঙ্গে লেপন

হুলু ধ্বনি হরি ধ্বনি মঙ্গলাচরণ।।

উভ করি বাঁধে কেহ শিরেতে কবরী

বিন্দু বিন্দু ফাগ দেয় তাহার উপরি।।

ধূপ দীপ আনে কেহ কুঙ্কুম চন্দন

নমো হরিচন্দ্রবলি করে আবাহন।।

গোকুলে খেলিল খেলা যেমন গোপিনী

ওড়াকান্দী ভক্ত নারী করিল তেমনি।।

মৃদু মৃদু হাসে প্রভু হোলির আনন্দে

হাসি দেখি পাগলিনী ভক্ত নারী কান্দে।।

এদিকে নাচিছে ভক্ত কীর্ত্তনে পাগল

অবিরাম করে নাম হরি হরি বল।।

ব্রজ নাচে নাটু নাচে নাচে বিশ্বনাথ

আনন্দে গোলক নাচে করে কক্ষাঘাত।।

রুদ্রতালে নাচে ভক্ত বীর হীরামন

কুমারের চক্র প্রায় ঘুরিছে বদন।।

হুঙ্কার ছাড়িয়া ঘুরে গোবিন্দ মতুয়া

মৃত্যুঞ্জয় বলে হরি দুবাহু তুলিয়া।।

নাটুয়ার নৃত্য করে মঙ্গল গোঁসাই

দশরথ বলে হরি ঘন ছাড়ে হাই।।

প্রভুকে ঘিরিয়া সবে করে লম্ফ ঝম্ফ

বীর দাপে ধরা কাঁপে যেন ভূমিকম্প।।

লোচন গোস্বামী এল বলে হরি হরি

আপনি উঠিয়া প্রভু আনে হস্তে ধরি।।

মহাপ্রভু বলে তবে লোচনের ঠাঁই

এমন পবিত্র দিন আর দেখি নাই।।

তোমাকে পাইয়া আজি বড়ই আনন্দ

বল প্রভু ইহা হতে কিবা প্রেমানন্দ।।

হাসিয়া লোচন বলে ওগো অন্তর্যামী

কি হেতু আনন্দ কর সব জানি আমি।।

মহেশ্বর মহাকাল এ পবিত্র দিনে

আসিয়া উদয় হবে তোমার ভবনে।।

পরম বৈষ্ণব ভোলা মত্ত হরিনামে

ভোলাকে তুষিতে ভক্ত মত্ত নামে প্রেমে।।

আজি নিশি ছিনু প্রভু সফলা নগরে

শেষ যামে দেখিলাম স্বপনের ঘোরে।।

আকাশ ভেদিয়া যেন এক মহাজ্যোতিঃ

নামিয়া তোমার গৃহে পরশিল ক্ষীতি।।

সেই জ্যোতিঃ আসি তব পদে লোটাইল

পদস্পর্শে সেই জ্যোতিঃ মূর্তিমন্ত হৈল।।

গৌরাঙ্গ বরণ কান্তি ঢল ঢল আঁখি

রূপ দেখি মনে বলে বসে বসে দেখি।।

করজোড় করি মূর্তি তোমাপিতা বলে

আপনা সম্বরি তুমি মূর্তি মধ্যে গেলে।।

আশ্চর্য মানিয়া আমি উঠিনু শিহরি

নিদ্রাটুটি গেল মোর বলে হরি হরি।।

প্রভাতে উঠিয়া তাই ভাবি মনে মনে

অদ্য জন্ম লবে ভোলা তোমার ভবনে।।

ভোলার রাতুল পদ দেখিব বলিয়া

ছুটিয়া এসেছি হেথা তোমাকে স্মরিয়া।।

প্রভু বলে গোঁসাইজী রহ সাবধান

অন্যে যেন নাহি পায় তত্ত্বের সন্ধান।।

হাসিয়া লোচন বলে তুমি মম গুরু

তব আজ্ঞা শিরোধার্য বাঞ্ছা কল্প তরু।।

 হেনকালে এক নারী এসে ত্বরা করি

বলে শুভ সমাচার শুনহে শ্রীহরি।।

আদ্যাশক্তি শান্তিদেবী তোমার ঘরণী

চন্দ্রসম পুত্র কোলে পেয়েছে এখনি।।

নাচিয়া নাচিয়া বলে গোস্বামী লোচন

বিশ্বগুরুএল নেমে শ্রীগুরু চরণ।।

ভক্ত সবে গুরুচাঁদ তাহারে কহিবে

ধন্যরে কলির জীব সকলে তরিবে।।

আনন্দে উতলা যেন প্রভু হরিচন্দ্র

ভক্ত গণে ডাকি বলে শুন ভক্ত বৃন্দ

ক্ষান্ত কর নাম গান শুনহে বচন

দেখ সবে অদ্য কেবা এসেছে এখন।।

কথা শুনি ভক্তগণে ক্ষান্ত করে নাম

লোচনের প্রতি রহে চেয়ে অবিরাম।।

লোচনে দেখিয়া সবে ভাবে মনে মনে

দেখিতে বলিল প্রভু এই মহাজনে।।

ভকতের ভাব দেখি শ্রী লোচন কয়

মুক্তা ফেলি কাচ পানে বল কেবা চায়।।

শুনহে ভক্ত সবে শুভ সমাচার

শান্তি মাতা কোলে পেল প্রভু দিগম্বর।।

এই কথা শ্রী লোচন যখনি বলিল

আনন্দে ভক্ত সবে নাচিয়া উঠিল।।

প্রসূতি গৃহের পানে সবে ছুটি যায়

গৃহের নিকটে থাকি শুনিবারে পায়।।

আব্ আব্ মত শব্দ গৃহ মধ্যে হয়

ববম্ ববম্ শব্দ যেন শোনা যায়

আরও আশ্চর্য এক সকলে দেখিল

শত সূর্য রশ্মি যেন গৃহেতে ফুটিল।।

পিছু পিছু হরিচাঁদ আসিয়া দাঁড়ায়

রশ্মি আসি প্রভু পদে আপনি লুকায়।।

এই দৃশ্য দেখি ভক্ত বলে হরি হরি

প্রেমানন্দে ভূমে পড়ে করে গড়াগড়ি।।

ভক্ত নারী উলুধ্বনি করে অবিরত

ভক্ত মুখে চলে ছুটে হরিধ্বনি স্রোত।।

আনন্দে ভকত যত করে নানা খেলা

লম্ফ ঝম্ফ করে কেহ ভাবেতে উতলা।।

ভাবোন্মাদ হীরামন হাসে অট্টহাসি

লম্ফদিয়া শ্রী গোলক পৃষ্ঠে পড়ে আসি।।

প্রেমের আলাপে তারে কহে হীরামন

আমি কি বৃষভ নাকি শিবের বাহন।।

ভাবালাপ শুনি বলে গোস্বামী গোলক

আপনা বৃষভ বলি হাসাইলে লোক।।

এ নহে কৈলাশ কিম্বা নহে স্বর্ণ কাশী

জানো নাকি ওড়াকান্দি কিসে ভালবাসি।।

শত গোলকের চেয়ে ধন্য ওড়াকান্দি

শত ব্রহ্মা শত শিব রহে হেথা বন্দি।।

আমার সোনার চাঁদ প্রভু হরিচাঁদে

মনপ্রাণ সঁপে পদে রেখেছে যে বেঁধে।।

সে কেন শিবের হবে সামান্য বাহন

মূল না জানিয়া তাই বল এবচন।।

এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে

ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব আদি ক্ষুদ্র তাঁর কাছে।।

এতেক কহিল যদি গোস্বামী গোলক

হীরামন ভূমে লুটে হইয়া পুলক।।

দুই সাধু জড়াজড়ি পড়াপড়ি করে

আনন্দে মাতিয়া ভক্ত নৃত্য করে ঘিরে।।

কোন ভক্ত ফাগ গুলি পাত্রেতে করিয়া

উভয় সাধুর গাত্রে দিতেছে ঢালিয়া।।

দেখিয়া ভক্তে করে উচ্চ হরি ধ্বনি

বজ্র স্বরে গেল যেন ভেদিয়া মেদিনী।।

ভাবের প্রলাপ কত কহে ভক্ত সবে

মৃত্যুঞ্জয় বৃহস্পতি আরোপের ভাবে।।

উচ্চ কন্ঠে ডেকে বলে সাধু মৃত্যুঞ্জয়

তোরা কি করিস সবে ভাবে বোঝা দায়।।

দেবগুরু বৃহস্পতি আমি আসিয়াছি

তোদের আচার দেখে আশ্চর্য মেনেছি।।

এসেছে দয়াল হরি হরিচাঁদ রূপে

ক্ষীরোদের নাথ মর্তে নরের স্বরূপে।।

কাঁদা কাঁদি করি তোরা কি কর্ম করিস

বুঝে নাহি পাই আমি কাজের হদিশ।।

প্রেমেতে বসতি করে হ্লাদিনী যে শক্তি

তারে পূজি সুখী সবে তাতে অনুরক্তি।।

দেবী বাণী প্রভু প্রিয়া অবিদ্যা নাশিনী

তাঁরে ভূলি কিবা পূজ শকতি হ্লাদিনী।।

বেদরূপে জন্মে বাণী প্রভুর শ্রীমুখে

কন্যারূপে বক্ষ মধ্যে রাখিয়াছি তাঁকে।।

বাণী পূজা বাণী সেবা কর সবে আজি

ভাবের প্রলাপ ছাড়ি হও কাজে কাজি।।

এত যদি ভাবালাপে কহে মৃত্যুঞ্জয়

মহাভাবে হীরামন বলিছে তাঁহায়।।

ওরে বেটা বৃহস্পতি কোথা তোর বাড়ি

কোন মুখে এলি বেটা দিতে হেথা আড়ি।।

বিদ্যার জননী নাকি তোর সরস্বতী

মোর প্রভু হরিচাঁদ সরস্বতী-পতি।।

বিদ্যা কি অবিদ্যা মোরা কিছু নাহি মানি

সর্ব সার মূল তত্ত্ব হরিচাঁদে জানি।।

তোর যে জননী বিদ্যা সেবাদাসী হয়ে

দিবানিশি প্রভুপদে রয়েছে পড়িয়ে।।

হ্লাদিনী ব্যাধিনী প্রায় প্রভু পদে রয়

এমন চরণ যদি চোখে দেখা যায়।।

তার কিসে লাগে বল বাণী কি হ্লাদিনী

মূল ছেড়ে ডাল লয়ে কর টানাটানি।।

ভক্তি মুক্তি নাহি চাই চাহিনা সম্পদ

যদি বাবা হরিচাঁদ দেয় রাঙ্গা পদ।।

ভক্তের আলাপ শুনি দয়াল ঠাকুর

ভক্ত গণে ডাকি বলে বাক্য সুমধুর।।

শুন শুন সাধুগণ আমার বচন

ভাবালাপ করে সবে আনন্দে মগন।।

সর্ব সিদ্ধি দাতা হয় হরি ভক্ত গণ

তোমাদের কাছে তাই এই আবেদন।।

যেই পুত্র করিয়াছে হেথা আগমন

তাঁর গুণে মুক্তি যেন পায় নরগণ।।

এই বংশ তার গুণে যেন ধন্য হয়

তারে দেখে দুঃখী তাপী যেন শান্তি পায়।।

হরিভক্ত গণ সবে করো আশির্বাদ

শ্রী গুরুচাঁদের যেন পুরে মনোসাধ।।

প্রভু যবে এই কথা বলে ভক্ত ঠাঁই

কাঁদিয়া ভকতে বলে দয়াল গোসাই।।

তোমার লীলার তত্ত্ব মোরা কিবা জানি

যাহা কও যাহা দেও তাই মাত্র মানি।।

সর্ব ফলদাতা হয় তোমার চরণ।।

এই ভাবে গুরুচাঁদ অবতীর্ণ হ

ধরার কলুষরাশি দুরে চলে গেল।।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ পরম রতন

হরি-গুরুচাঁদ প্রতি হরি বল মন।।

 

ওড়াকান্দী ঠাকুর বংশের ইতিহাস

 

এ বংশে জন্মিল যত,    শুদ্ধ শান্ত কৃষ্ণ ভক্ত

( কবি রসরাজ)

 

কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা    অপূর্ব ভাবের গোরা

শ্রী চৈতন্য জগত মাতাল

যোগী, ন্যাসী কি সন্যাসী ব্রাহ্মণ যবন মিশি

নামে প্রেমে একাকার হ'।।

প্রেম হীন বিদ্যা লয়ে      কুট তর্কে মত্ত হয়ে

অভিমানে পন্ডিত সবাই

কেহ সাজে ন্যায় রত্ন      কেহ কহে তর্ক রত্ন

উপাধির সীমা মাত্র নাই।।

দূরে গেল তর্ক জাল       সবে বলে হরিবল

ভাবের পাগল সবে হ

কি নাম আনিল গোরা     অফুরন্ত মধু পোরা

মধুময় জগত বানা।।

একে ত শিক্ষার কেন্দ্র    তাহে উঠে গৌরচন্দ্র

নবদ্বীপ ধন্য ধন্য হয়

বিভিন্ন প্রদেশ হতে        অবিরাম জনস্রোতে

নবদ্বীপ পানে সবে ধায়।।

কেহ শিক্ষা নিতে এল     কেহ প্রেমে ডুব দিল

কেহ করে চিরকাল বাস

এই রূপ ভাবাবেগে        খৃষ্টিয় ষোড়শ ভাগে

বঙ্গ দেশে এল রাম দাস।।

মৈথিলী ব্রাহ্মণ জাতি      ছিল রাঢ়েতে বসতি

পাতি পাতি ঘুরে তীর্থ ধাম

আগে যায় বৃন্দাবন        পতি পত্নী একমন

কাশী কাঞ্চী প্রয়াগাদি নাম।।

চন্দ্রনাথ তীর্থ শ্রেষ্ঠ         মনে ভাবি তাহা ইষ্ট

শিষ্ট সাধু এল বঙ্গ পানে

নবগঙ্গা পুন্যতোয়া      জুড়াতে তাপিত কায়া

যশোহরে এল গঙ্গা স্নানে।।

নবগঙ্গা নদী তীরে        লক্ষ্মীপাশা গ্রাম পরে

অতঃপরে করিলেন বাস

নমঃশূদ্র বীর জাতী       তথায় করে বসতি

রহিলেন তাহাদের পাশ।।

প্রতাপ আদিত্য নাম       মহারাজ পুণ্যধাম

তাঁর কীর্ত্তি গাঁথা সব শুনে

বায়ান্ন হাজার ঢালী       নমঃশূদ্র বংশাবলী

ব্যাখা তার করে সর্ব্বজনে।।

বীর্যবান সে প্রতাপ        পেল কত মনস্তাপ

অভিশাপ বাঙ্গালীর ভালে

শেষ হিন্দু নরপতি         ভোগ করে কি দুর্গতি

প্রাণ গেল কঠিন শৃঙ্খলে।।

তাঁর যত ছিল বীর        দুর্দ্দশায় নৃপতির

যবনের বশ্যতা মানিল

সেনা-বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে   কৃষি আদি কর্ম্ম নিয়ে

জীবিকার উপায় করিল।।

নমঃশূদ্র দিল ঠাঁই         রামদাস পেয়ে তাই

পাশাপাশি করিলেন বাসা

জিজ্ঞাসে তাদের ঠাঁই      কি কারণে বল ভাই

তোমাদের এ হেন দুর্দ্দশা।।

এই প্রশ্ন শুনি কানে       যত নমঃশূদ্র গণে

বলে শুন দয়াল ঠাকুর

মনো মধ্যে যত ব্যাথা    পরেতে পরেতে গাঁথা

বলি কথা আজি করি দূর।।

পাল বংশ মহাতেজা      বঙ্গ দেশে যবে রাজা

বৌদ্ধ ধর্ম আসিল এদেশে

বৌদ্ধ রাজ-ধর্ম মানি      বঙ্গ বাসী যত প্রাণী

বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিল শেষে।।

উদার বুদ্ধে নীতি          নাহি জানে ভেদ নীতি

জাতি জাতি ভাগ নাহি করে

প্রেমের নিগড়ে বান্ধি      সবে করে কাঁদা কাঁদি

ভ্রাতৃভাব আনিল সংসারে।।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মেতে পুষ্ট        ভেদ বুদ্ধি দ্বারা দুষ্ট

স্বার্থ লোভী ব্রাহ্মণের দল

খেদে বলি একি হল       সব রসাতলে গেল

সম হল ব্রাহ্মণ চন্ডাল।।

কি উপায় করি এবে      কিছু নাহি পাই ভেবে

কোন ভাবে বৌদ্ধরে তাড়াই

বাহিরে মিত্রতা করি      অন্তরে গরল পুরি

বৌদ্ধ অঙ্গে সে বিষ ছড়াই।।

যেমন হয়েছে কাল        কালগুণে সবে কাল

ব্রহ্মা আদি দেবতা সবাই

ব্রহ্মা নিদ্রাগত রয়         তাই ব্রাহ্মণের ভয়

ভিত্তি ছাড়া কোথা বা দাড়াই।।

 এরূপ করিয়া যুক্তি        যত ব্রাহ্মণের শক্তি

ছল করি বৌদ্ধ সাজি রয়

বৌদ্ধ সেজে বৌদ্ধ ভানে   অযুক্তি বিধান মানে

হীন গুণে বৌদ্ধরে দেখায়।।

যারা বুদ্ধি জীবি ছিল     প্রকাশ্যে বিদ্রোহী হ

ডেকে বলে দেশবাসী ঠাঁই

কি কারণে বৌদ্ধ মান     বৌদ্ধরে ডাকিয়া আন

বৌদ্ধ ধর্মে কোন যুক্তি নাই।।

প্রমাণ দেখিতে চাও       জাজ্জ্বল্য প্রমাণ লও

বৌদ্ধ কিবা করে দেখ তাই

বসে দেখ একি কাণ্ড      যত বৌদ্ধ সব ভণ্ড

আচরণে বুঝহে সবাই।।

এই ভাবে যুক্তি দিয়ে      সবে নিল ভুলাইয়ে

পরে গড়ে অভিনব ধর্ম

কিছু কিছু বৌদ্ধ নীতি     হিন্দু ধর্মে দিল গাঁথি

কেহ নাহি বুঝিল সে ধর্ম।।

অভিনব পুরাণাদি         লিখে সবে নিরবধি

বেদ ভাষ্যবলি তারে কহে

সৃজিল দেবতা কত        যার যার মনোমত

সবে শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র কেহ নহে।।

তন্ত্র মন্ত্র উপাখ্যান         শাস্ত্র মধ্যে পেল স্থান

ব্রাহ্মণ সাজিল পুরোহিত

ক্রিয়া কর্ম যজ্ঞ যাগে      সর্বত্র ব্রাহ্মণ লাগে

সর্ব্ব ঠাঁই ব্রাহ্মণ পূজিত।।

পাপ ক্ষয়, স্বর্গ লাভ       প্রজাপতি পদ্মনাভ

ব্রাহ্মণের পদে রেখে দেয়

ব্রাহ্মণ দেবতা হল         ব্রাহ্মণে পূজিলে ভাল

অনায়াসে স্বর্গ ধামে যায়।।

ব্রাহ্মণ হইলে রুষ্ট             কিছুতেই নাহি ইষ্ট

জগদিষ্ট কৃষ্ণ নাকি বলে

লোভ আর ভয় দিয়ে     ভাবে ব্যাখ্যা বুঝাইয়ে

সকলে টানিল নিজ দলে।।

ক্রমেতে প্রবল হ       বৌদ্ধ পথ ছেড়ে দিল

রাজা কত গেল সেই দলে

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের ধ্বজা    রাজ্য লোভে করে পুজা

আপনারে ব্রহ্ম দাসবলে।।

কত হল অত্যাচার        কিবা কব সমাচার

বৌদ্ধ কত বধ্য ভূমে যায়

যে ছাড়ে বৌদ্ধের ধর্ম      সে হয় পরম ধন্য

রাজ দ্বারে সন্মান সে পায়।।

বঙ্গ দেশে পাল রাজা     হল যবে হীন তেজা

রাজা হল আদিশূর রায়

ব্রাহ্মণ না পেয়ে বঙ্গে     নিদারুণ মনোভঙ্গে

কান্যকুব্জ পানে ছুটে যায়।।

পঞ্চ ব্রাহ্মণের গণ         করে বঙ্গে আগমণ

পঞ্চ শূদ্র সঙ্গে সঙ্গে এল

বল্লাল সেনের কালে       কৌলিন্য প্রথার ছলে

পঞ্চ শূদ্র কুলীন হইল।।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রাজা       শ্রী বল্লাল মহাতেজা

রাজ্য মধ্যে করিল ঘোষণা

বঙ্গ ভূমি পুণ্য স্থান      বৌদ্ধ হল অন্তর্দ্ধান

বৌদ্ধ ধর্ম্মে কেহ থাকিবে না।।

এবে নমঃশূদ্র যারা        সকলি ব্রাহ্মণ তারা

বৌদ্ধ ধর্মে নিয়া ছিল দীক্ষা

রাজার ঘোষণা শুনি       অন্তরে প্রমাদ গনি

খেদে বলে এ কোন পরীক্ষা!

জন্মিলে মরিতে হবে      এ জীবন নাহি রবে

ধর্ম মাত্র অমর ভুবনে

ভীত হয়ে ধর্ম ছেড়ে       বেঁচে রব এ সংসারে

কাজ নাই এ ছার জীবনে।।

থাক ধর্ম যাক জান       রাখিতে ধর্মের মান

মোরা সবে করি যে প্রতিজ্ঞা

যা ইচ্ছা করুক রাজা      যাহা ইচ্ছা দিক সাজা

তবু নাহি মানিব এ আজ্ঞা।।

কিংবা দেশ ছেড়ে যাব    বনে কি জঙ্গলে র

না থাকিব রাজধানী পাশে

যদি মোরা রাখি ধর্ম      মোদেরে রাখিবে ধর্ম

দেখা যাক কিবা হয় শেষে।।

এই কথা করি ঠিক       যত ব্রাহ্মণ নির্ভিক

বৌদ্ধ মতে করে উপাসনা

সে কথা জানিতে পেরে রাজা অতি ক্রোধ ভরে

বলে দেখ বৌদ্ধ কতজনা।।

যে খানে যে বৌদ্ধ পাও  কারে নাহি ক্ষমা দেও

মুণ্ডচ্ছেদ করহে সবার

অদ্য হতে সপ্তদিনে      যদি আজ্ঞা নাহি মানে

এই আজ্ঞা পালিবে আমার।।

এই আজ্ঞা শুনি কানে     বৌদ্ধ ব্রাহ্মণের গণে

জনে জনে করে আলোচনা

শুনহে সকলে ভাই        যে দেশে বিচার নাই

ক্ষণমাত্র সে দেশে রবনা।।

এত বলি দলে দলে       দেশ ছাড়ি যায় চলে

তবু কেহ ধর্মকে না ছাড়ে

ধর্মকে সহায় করি        সবে রাজধানী ছাড়ি

নিজে নড়ে ধর্মকে না নাড়ে।।

বল্লাল শুনিয়া কথা        বলে আর যায় কোথা

সৈন্য দিয়া সকলি নাশিব

আস্পর্দা বেড়েছে কত     কর সব মুণ্ড পাত

বৌদ্ধ ধর্ম রসাতলে দিব।।

মন্ত্রী ছিল সু বিদ্ধান        মনে মনে ব্যাথা পান

প্রাণে তার বিষম বেদনা

চক্ষে তার বহে নীর      মনে মনে করে স্থির

হেন কর্ম কভু ঘটিবে না।।

বিনা কাজে নরবলি       রাজা হোক মহাবলী

হেন কার্য উচিত না হয়

রাজাকে বলিয়া দেখি   রাজা কথা রাখে নাকি

হতভাগ্য যাতে প্রাণ পায়।।

বলে শুন মহীপাল         বৌদ্ধ ব্রাহ্মণের দল

দূরে গেছে ছেড়ে রাজধানী

সম্বর আপন ক্রোধ        কেন লবে প্রতিশোধ

রাজ ধর্ম ইহা নহে গুণি।।

এদিকে বৌদ্ধের দল       ত্যাজি রাজধানী স্থল

গহন কান্তারে চলে যায়

খাদ্যা খাদ্য নাহি মিলে   কেহ জলে কেহ কূলে

নানা ভাবে জীবন কাটায়।।

ডাকিয়া বল্লাল কয়        শুন মন্ত্রী মহাশয়

ঐ যারা দূরে গেল চলি

কিবা হবে পরিচয়        কোন জাতি বলা যায়

বৌদ্ধ শব্দ যাও সবে ভুলি।।

তবে মন্ত্রী মহাশয়         না দেখি কোন উপায়

মনে ভাবে কিবা দেব নাম

ধর্মে বৌদ্ধ সুনিশ্চয়      তবু ব্রাহ্মণ-তনয়

শুধুমাত্র জাতী তত্ত্বে বাম।।

যজ্ঞ সুত্র গলে নাই        জাতি বলে কিবা ছাই

শূদ্র ভাব এই মাত্র দেখি

শূদ্রের নমস্য বটে         বলি আমি অকপটে

নমঃশূদ্র নাম তাই রাখি।।

বল্লাল যে দিল নাম        শুন ওহে গুনধাম

সেই নামে আছে পরিচিত

কালে কালে বংশ বৃদ্ধি    হৃত-ধন-হৃত-ঋদ্ধি

যোগশূন্য ধর্মের সহিত।।

কুচক্রি ব্রাহ্মণ সবে        অত্যাচারে ঘোর রবে

বৌদ্ধ ধর্ম দেয় দূর করি

নবীন হিন্দুর ধর্মে         বেদ বিধি ক্রিয়া কর্মে

বৌদ্ধ সবে ক্রমে এল ফিরি।।

লক্ষণ সেনের কালে       হিন্দু রাজ্য গেল চলে

ইসলামে রাজ্য কেড়ে লয়

যতেক ব্রাহ্মণ ছিল       ইসলামে মানিয়া নিল

রাজ কার্যে বড় পদ পায়।।

সমাজে সাজিয়া ক্ষুদ্র      ছিল যত হীন শুদ্র

ব্রাহ্মণের রুদ্র রোষ ভয়

উদার ইসলাম নীতি      এক প্রাণ এক জাতি

কেহ কেহ সেই ধর্ম লয়।।

ইসলামের যে রাজা       বুদ্ধিমান মহাতেজা

মনে চিন্তা করে এই সদা

স্বধর্মী না যদি পাই        এ রাজত্বে রক্ষা নাই

পদে পদে পাব বহু বাঁধা।।

এত ভাবি মনে মনে       ছলে বলে প্রতিদিনে

কত হিন্দু যবন করিল

উচ্চ পদ স্বার্থ দিয়ে        অর্থে মন ভুলাইয়ে

শক্তি শালী হিন্দুকে ধরিল।।

নমঃশূদ্র ছিল যারা        সে ধার ধারেনা তারা

আত্ম শক্তি বজায় রাখিল

আত্মরক্ষা করিবারে       ক্রীড়াদি অভ্যাস করে

শক্তি শালী বীর জাতি হল।।

প্রতাপ আদিত্য যবে     হিন্দুকে জাগাবে ভেবে

রাজ্য গড়ি সৈনিক গড়ায়

নমঃশূদ্র হতে তুলি        বায়ান্ন হাজার ঢালী

তা সবারে সৈনিক সাজায়।।

প্রতাপের পরাজয়         ইসলামে রাজ্য পায়

ভেঙ্গে গেল প্রতাপের দল

সেই নমঃশূদ্র ক্রমে        ক্ষাত্র বীর্য পরাক্রমে

বঙ্গ ভূমে হল লাঠিয়াল।।

রাজধানী হতে দূরে      বাস করে একত্তরে

হিন্দু নীতি সব নাহি জানে

ক্রমে কাল গত হয়        পরিচয়ে হিন্দু কয়

হিন্দু গণে হীন বলি গণে।।

শুনি কথা রামদাস        মনে করে এই আশ

নমঃশূদ্র পাশে আমি র'

বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ গণে         কহিব সরল মনে

নমঃশূদ্রে উদ্ধার করিব।।

সকলে ব্রাহ্মণ অংশ       ব্রহ্ম কুলে অবতংস

মোর মত এরাও ব্রাহ্মণ

এরা যদি কুল পায়        ব্রাহ্মণের কিবা ভয়

ব্রহ্ম শক্তি দেখিবে ভুবন।।

এই ভাবে অতঃপরে       নবগঙ্গা নদী তীরে

লক্ষ্মীপাশা গ্রামে করে বাস

সতী সাধ্বী পতিব্রতা      দোহে মিলি একত্রতা

প্রেমানন্দে রহে রাম দাস।।

শুদ্ধ শান্ত দিব্যকান্তি     প্রেম, দয়া, ক্ষমা, শান্তি

দীর্ঘ দেহ গৌরাঙ্গ বরণ

পতি অনুযায়ী সতী      উচ্চশির দিব্যজ্যোতিঃ

হেমপ্রভা অঙ্গের গঠন।।

শক্তি মন্ত্রে উপাসনা       ছিল আদি আরাধনা

পরে যবে এল নদীয়ায়

প্রেমের তরঙ্গে পড়ি       করে প্রেমে গড়াগড়ি

ভক্ত পদ ধুলি মাখে গায়।।

ত্রিশূল রাখিত সাথে       ভক্তি তত্ত্ব কথামৃতে

সভা ডাকি কহিত প্রচুর

শাক্ত ভাবে শাক্ত যারা    বৈষ্ণবের মনোহরা

তারে ডাকে বৈষ্ণব ঠাকুর।।

ভেদহীন মনে প্রাণে        আপন বলিয়া জানে

বিশ্ববাসী যত জীবগণে

উদার চরিত দেখি        সবে বলে থাকি থাকি

এ মানুষ ছিল কোনখানে।।

নমঃশূদ্র সঙ্গে রয়         তাদের ডাকিয়া কয়

শোন সবে আমার বচন

জাতি মধ্যে ভগবান     তোরা সবে ডেকে আন

গতি দিবে শ্রীমধুসূদন।।

ভগবান নাহি এলে       মুক্তি বল কোথা মিলে

মুক্তি রহে সে চরণ তলে

যদি ডেকে আন তাঁরে     নিবে সে উদ্ধার করে

শুদ্ধ হবে কৃপা গঙ্গা জলে।।

 এই ভাবে রাম দাস       নমঃশূদ্র সঙ্গে বাস

করিলেন শ্রী লক্ষ্মী পাশায়

নমঃশূদ্র সবে জুটি        গৃহ এক পরিপাটি

তাঁর লাগি সবে তুলি দেয়।।

আনি দেয় দ্রব্য কত       সেবা করে অবিরত

সাধক দম্পতি যাহা চায়

এই ভাবে দিন যায়        কোলে এক পুত্র পায়

চাঁদমণি বলি ডাকে তায়।।

বঙ্গ বাসী ব্রাহ্মণেরা       সকলে জুটিয়ে তারা

বলে হায় একি অঘটন

মোরা সবে রহি দূরে      রাম দাস কি প্রকারে

নমঃশূদ্রে করিছে পালন।।

আমরা থাকিতে সব       নমঃশূদ্রে হল সব

না সহিব হেন অপমান

কোনগুণে এত গুণী        আমারা সকলে শুনি

রামদাসে শীঘ্র ডেকে আন্।।

রামদাসে ডেকে কয়      শুন শুন মহাশয়

একি আচরণ তব হেরি

ব্রহ্ম কূলে জন্ম লয়ে       কোন গুণে বাধ্য হয়ে

বাস কর নমঃশূদ্র বাড়ি।।

অস্পৃশ্য দরিদ্র জাতি    নাহি জানে রীতি নীতি

কি কারণে সেই সঙ্গে রহ

তব আচরণ দেখি         আমরা বড়ই দুঃখী

এই মতি কেন তব কহ।।

শুনি কথা রামদাস        হাসিয়া মধুর হাস

বলে শুন স্বজাতি সুজন

নাহি জানি মর্ম কথা      কহ কথা যথা তথা

এই নহে সাধুর আচরণ।।

অস্পৃশ্য দরিদ্র বলি       যারে কর গালাগালি

পরিচয় কিছু জান তার

কেমনে চিনিবে বল       কতকাল গত হ

সে দিন কি মনে পরে আর।।

তোমাদের পিতৃগণ        জ্ঞাত ছিল বিবরণ

প্রতাপ আদিত্য জ্ঞাত ছিল

যত ব্রাহ্মণ মণ্ডলী         বায়ান্ন হাজার ঢালী

বল দেখি কোথা হতে এল।।

তৎপূর্ব বিবরণে           এই বঙ্গ সিংহাসনে

যবে ছিল পাল রাজা গণ

বল দেখি মহাশয়          বঙ্গে কোন ধর্ম রয়

কোথা ছিল ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ।।

যদি বল সবে ছিল        কথা ত বলিতে ভাল

তবু প্রশ্ন আসে মম মনে

কোন জন্যে আদিশূর      কান্যকুব্জে অতদূর

ছুটে গেল ব্রাহ্মণ কারণে।।

সত্য কথা এবে বলি      শুন সবে কর্ণ খুলি

বঙ্গ বাসী আছ যতজন

যবে পাল রাজা হয়       শুন সব মহাশয়

বৌদ্ধ ভিন্ন না ছিল ব্রাহ্মণ।।

কি কব কালের শক্তি     বেদাচার অনুরক্তি

কালে কালে আর্য ছেড়ে দিল

সমাজের শিরোমণি       ছিল যে ব্রাহ্মণ গুণী

হীনাচারে হীন বুদ্ধি হ।।

বেদাধ্যায়ী যে ব্রাহ্মণে   রাজা মানে প্রজা গণে

তাঁর যত বংশধর গণ

মত্ত হয়ে হীন ভাবে       আচরণে কি স্বভাবে

পূর্ব স্মৃতি হৈল বিস্মরণ।।

রাজ দ্বারে চাটুকার       সেজে রহে অতঃপর

রাজ ধর্ম নিজ ধর্ম কহে

রাজা যবে বৌদ্ধ হয়      ব্রাহ্মণ কি বাদ যায়

রাজাজ্ঞায় বৌদ্ধ সাজি রহে।।

বঙ্গ ভূমে ঘটে তাই       বৌদ্ধ ছাড়া কেহ নাই

পরে যবে হিন্দু রাজা হয়

যতেক ব্রাহ্মণ ছিল        পুনরায় হিন্দু হ

কেহ কেহ পূর্ব ভাবে রয়।।

 হিন্দু বৌদ্ধ রেষারেষি     নাহি ছিল মেশামেশি

বৌদ্ধ সহে কত অত্যাচার

কত হীন আখ্যাপায়       ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয়

আর বলি শুন সমাচার।।

বুদ্ধ হল অবতার            হিন্দু কৈল পূজা তাঁর

এই ছলে বৌদ্ধ হিন্দু হ'

বৌদ্ধ হিন্দু ধর্মে এল       যাহারা পশ্চাতে ছিল

হীন ভাবে সমাজেতে র'।।

যত নমঃশূদ্র গণ             সকলি বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ

আর যত আছে হীন ভাবে

ক্ষত্রিয় নন্দন কেহ         কেহ বৈশ্য শূদ্র কেহ

নানা আখ্যা লভিয়াছে এবে।।

ব্রহ্ম সূত নমঃশূদ্র          তোমা হতে নহে ক্ষুদ্র

এক বংশে জন্ম ও তাদের

কাল চক্র তালে তালে    তুমি আজ ধন্য হলে

ক্ষুদ্র কেহ কপালের ফের।।

মৈথিলী ব্রাহ্মণ আমি       ভ্রমিআছি আর্য ভূমি

জানি চিনি সব ব্রাহ্মণেরে

বঙ্গ বাসী আছে যত      মোর এই অভিমত

সমগুণে গণি সবাকারে।।

আর মম মনে কষ্ট         হায় কিবা দুর দৃষ্ট

হীনহয়ে রহে ব্রহ্ম সূত

আমার কর্তব্য হবে        উদ্ধার করিব সবে

সেই কার্য মোর মনঃপূত।।

শুনিয়া ব্রাহ্মণ গণ          বলে একি অঘটন

তব মনে এই ভাব নাকি

যাহা ইচ্ছা কর তাই      কিছুই আপত্তি নাই

মোরা তবে দূরে বসে দেখি।।

ক্রমে ক্রমে দিন গেল      পুত্র তার বড় হল

যৌবনেতে করে পদার্পণ

রামদাস ভাবে মনে      পাত্রী পাই কোন খানে

বিয়া দিব শ্রী চন্দ্রমোহন।।

বঙ্গ বাসী ব্রহ্ম কূলে      পাত্রী খুঁজে পলে পলে

বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হয় তাহে

ব্যঙ্গ করি বঙ্গ বাসী বলে শুন হে সন্ন্যাসী  পুত্র

যোগ্য কন্যা হেথা নহে।।

ব্রহ্ম সূত নমঃশূদ্র          গুণেতে নহেত ক্ষুদ্র

আর নাকি বীর বংশাবলী

দেখ গিয়ে সেই ঘরে       কমলা বিরাজ করে

পেলে পেতে পার মহা কালী।।

দুঃখ মনে নিদ্রা যায়       স্বপনে আদেশ পায়

নমঃশূদ্র ঘরে রাজ লক্ষ্মী

সেই কন্যা দেখি পরে     চন্দ্রমোহনের তরে

বধু করে ধর্ম রেখে সাক্ষী।।

জীবনের শেষ দিনে       পুত্রে ডাকি সন্নিধানে

বলে চাঁদ হয়ো না কাতর

রাখে কৃষ্ণ কেবা মারে মারে কৃষ্ণ রাখে কে রে

এই বাক্য মনে কর সার।।

মম হৃদাসনে বসি         বলিয়াছে কাল শশী

এই বংশে আসিবেন তিনি

হরি হবে অবতার         সন্দেহ নাহিক আর

প্রেম গুণে বাঁধিবে অবনী।।

যাহা কভু দেখে নাই      যাহা কভু শোনে নাই

এমত আশ্চর্য হবে লীলা

নীচ জন উচু হবে         সম ভাবে রবে সবে

সমক্ষেত্রে হবে প্রেম খেলা।।

প্রস্তুত থাকিও সবে     কে জানে আসিবে কবে

পুত্র পৌত্র রহ শুদ্ধ ভাবে

পবিত্র রাখিবে বংশ       অধর্মে হয়োনা ধ্বংস

পবিত্রতা গুণে তারে পাবে।।

এত বলি মহাশয়          দেশ ছাড়ি চলি যায়

ভক্ত সবে জুটি একত্তরে

দেহ সাথে ত্রিশূলেরে      এক সাথে ভষ্ম করে

শোকচ্ছায়া পড়ে ঘরে ঘরে।।

যে সমাধি ক্ষেত্রে তাঁরে    রেখেছিল নারী নরে

কিছুকাল পরে সেই খানে

শ্রী কালী মন্দির ঘর       নবগঙ্গা নদী ধার

সবে মিলে গড়িল যতনে।।

চন্দ্রমোহন তারপরে       পিতৃ আজ্ঞা অনুসারে

পবিত্র চরিত্র রাখি চলে

শুকদেব তার পুত্র         ক্রমে ক্রমে বলি সুত্র

জয় পুর গেল হরি বলে।।

আচারে নৈষ্ঠিক ভক্ত      নামে প্রেমে অনুরক্ত

শুকদেব জীবন কাটায়

সাধনায় সুনিপুণ         অশেষ গুণের গুণ

কালিদাস নামে পুত্র পায়।।

পরম বৈষ্ণব তিনি        প্রেমরস-রত্ন খানি

তাঁর গুণে বাধ্য দেবতায়

দেখিয়া সাধক ধন্য        বৈষ্ণব সেবার জন্য

দেবশীলা তার বাড়ী যায়।।

পিতৃ বাসস্থান ছেড়ে       পাচুনে গ্রামের পরে

এল কালিদাস গুণধাম

পাথর আসিত ঘাটে       এই কথা সবে রটে

হইল পাথর ঘাটা নাম।।

তার হল তিন পুত্র        সাধু শিষ্ট সুচরিত

জেষ্ঠ্য পুত্র নাম নিধিরাম

মধ্যম শ্রী রবি দাস        কৃষ্ণ পদে অভিলাষ

কনিষ্ঠ শ্রীজীব গুণধাম।।

নিধিরাম সর্ব্ব জেষ্ঠ্য       গুণে শ্রেষ্ঠ কর্মে শ্রেষ্ঠ

দুই পুত্র এল তার ঘরে

তেজস্বী মুকুন্দ রাম       অপর মোচাই নাম

কনিষ্ঠ কার্তিক নাম ধরে।।

অশেষ গুণের ধাম         ঠাকুর মুকুন্দরাম

সফলা ডাঙ্গায় এল পরে

পঞ্চ পুত্র সেই ঘরে        জন্ম নিল পরে পরে

রূপে গুণে দেশ আলো করে।।

যশোবন্ত সনাতন          প্রাণ কৃষ্ণ রামমোহন

রণ কৃষ্ণ সে পাঁচের নাম

সর্ব জ্যেষ্ঠ যশোবন্ত        গুণে তার নাহি অন্ত

অশেষ গুণেতে গুণধাম।।

হরি চিন্তা হরি কথা       হরি সুখ হরি ব্যথা

হরি দেহ হরি মন প্রাণ

অন্নপূর্ণা নামে সতী        পতি পদে নিষ্ঠাবতী

পতি সঙ্গে করে গুণগান।।

নন্দ যশোমতী মত        কৃষ্ণ প্রেমে সদা রত

বাৎসল্য রসেতে মগন

যে দিকে যেখানে চায়   কৃষ্ণ কে দেখিতে পায়

কৃষ্ণ রূপে ভরেছে নয়ন।।

কৃষ্ণ ছাড়া কিছু নাই    কৃষ্ণে থাকি কৃষ্ণে খাই

কৃষ্ণ যেন রয়েছে ঘিরিয়া

দেহ প্রাণ সঁপে দিয়ে       কৃষ্ণ ময় ভাব নিয়ে

কৃষ্ণ প্রেমে গিয়াছে মরিয়া।।

এই ভাব যেথা হয়         তথা আসে রসময়

অন্নপূর্ণা তাঁরে পেল কোলে

সে রামদাসের বাণী       পূর্ণ করে চিন্তা মনি

অবতীর্ণ হল হরিবলে।।

অগ্রে এল কৃষ্ণ দাস       হরি হল হরিদাস

পরে আসে শ্রী বৈষ্ণব দাস

তারপরে গৌরী দাস       পরেতে স্বরূপ দাস

পঞ্চ অংশে ভুবনে প্রকাশ।।

শ্রী হরি ঠাকুর নামে       অবতীর্ণ ধরাধামে

ভক্তে ডাকে হরিচাঁদ বলে

অনন্ত ক্ষীরোদ ছাড়ি      ওড়াকান্দী এল হরি

পাপী তাপী তরাবে সকলে।।

কর্মভার দিতে পরে       ডেকে আনে মহেশ্বরে

ভোলা এল গুরুচাঁদ রূপে

পিতৃশক্তি যবে পায়       হরি-গুরুচাঁদ হয়

পিতাপুত্র স্বয়ং স্বরূপে।।

এই গুরুচাঁদ লীলা          অশেষ ভাবের খেলা

এই গ্রন্থে কিছু নিরূপণ

শ্রী গুরুচাঁদের ঘরে         চারি পুত্র জন্ম ধরে

জেষ্ঠ পুত্র শ্রী শশিভূষণ।।

মধ্যম সুধন্য নামে         মত্ত ছিল নামে প্রেমে

উপেন্দ্র সুরেন্দ্র দুই জন

শ্রী শশিভূষণ যিনি         অশেষ গুণেতে গুণী

করেছিল চাকুরী গ্রহণ।।

সাব রেজিস্টার পদে      চাকুরী করিত সাধে

নমঃশূদ্রে শিক্ষা দান ছলে

মনে ভাব ছিল তার       যত্নে হলে তৎপর

পদ পাবে নমঃশূদ্র দলে।।

নমঃশূদ্র জাতী মাঝে      প্রথম চাকুরী কাজে

নিয়োজিত হইলেন তিনি

এক সঙ্গে ছিল যারা      চাকুরী পাইল তারা

ডেপুটী কুমুদ হল জানি।।

খুলনা জেলায় ঘর         রূপে অতি মনোহর

নাম তার কুমুদ মল্লিক

বিদ্যা শিক্ষা করে পরে   ঘুরে দেশ দেশান্তরে

রাজ কার্যে নাহি হয় ঠিক।।

শেষে গেল ওড়াকান্দী     গুরুচাঁদে বলে কান্দি

বল প্রভু কি করি উপায়

লেখাপড়া শিখিলাম        চাকুরী না পাইলাম

পড়িয়াছি বিষম লজ্জায়।।

আপনি জাতীর কর্তা      জানাই দুঃখের বার্তা

এবে কিছু করুন উপায়

জন্মি নমঃশূদ্র কুলে       ক্ষুদ্র বলে সবে ঠেলে

মন দুঃখে প্রাণ ফেটে যায়।।

কাতর বচন শুনি            দয়ালের শিরোমণি

দয়াকরি বলিলেন তারে

মনে নাহি কর ভয়        আছে হরি দয়াময়

দেখ হরি কি দিয়ে কি করে।।

নামেতে ডক্টর মীড        খৃষ্ট ধর্ম্মেতে নৈষ্ঠিক

অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশ বাসী

খৃষ্ট ধর্ম প্রচারিতে         বহু বাঞ্ছা তার চিতে

ভারতে উদয় হল আসি।।

আসিয়া ফরিদপুরে        মনে মনে চিন্তা করে

কোথা পাব মিশনের স্থান

শ্রী শশিভূষণ যিনি         সাহেবের ভাব জানি

সাহেবেরে করে আমন্ত্রণ।।

মীড ওড়াকান্দী আসি     বিপুল সন্মান রাশি

পাইলেন গুরুচাঁদ কাছে

উভ উভে জানিলেন       উভ উভে মানিলেন

প্রেমে বদ্ধ হইলেন পাছে।।

গুরুচাঁদ দেখে তবে         রাজ শক্তি বিনা ভবে

ধর্ম কর্ম সকলি দুর্ব্বল

মীড যদি চেষ্টা করে      নমঃশূদ্র জাতী তরে

দিতে পারে ত্রাণকারী ফল।।

মীডে প্রভু ডেকে কয়           শুন শুন মহাশয়

জীর্ণ শীর্ণ নমঃশূদ্র জাতি

উচ্চ বংশে জন্ম বটে      কাল চক্রে সব ঘটে

কর্ম দোষে এ হেন দুর্গতি।।

পরম দয়াল যীশু           পরম পিতার শিশু

পতিতেরে দেয় মুক্তি পদ

তার অনুগামী তুমি        রহ ওড়াকান্দী ভূমি

তাহা হলে পাইব আহ্লাদ।।

গুরুচাঁদ মুখে শুনি          এসব মধুর বাণী

ওড়াকান্দ মীড বাঁধে ঘর

উদ্ধারিতে নমঃশূদ্রে       চেষ্টা করে যথাসাধ্যে

সেই কার্যে অতি তৎপর।।

কুমুদের কাছে শুনি       যতেক দুঃখের বানী

মীডে ডাকি প্রভু কহে কথা

শুন ওগো মহাশয়         পড়েছি বিষম দায়

তুমি বিনে কে ঘুচাবে ব্যাথা।।

আজি মম জাতি মাঝে কেহ নাহি রাজ -কাজে

আমি ইহা বুঝি অকল্যাণ

কিছু কিছু শিক্ষা পেয়ে   কত আছে দুঃখী হয়ে

রাজ কার্যে নাহি পায় স্থান।।

সাহেব কহিছে হেসে    কে কোথায় আছে বসে

বল শুনি দয়াল ঠাকুর

আমি রাজ পুরোহিত      সকল প্রজার হিত

আমি বটে করিব প্রচুর।।

গুরুচাঁদ কহে বাণী         নৈষ্ঠেকের শিরোমণি

এই দেখ শশী ও কুমুদ

শ্রী রাধা চরণ আছে       আমার বাড়ির কাছে

কাজ কর্মে অতি মজবুত।।

আমার বচন ধর              এদের উপায় কর

রাজকার্য দেহ সকলেরে

এদের দুর্দ্দশা দেখে      আমি মরি মহা দুঃখে

অনুরোধ সে সবার তরে।।

শ্রী শশিভূষণ কন          শুন ওহে মতিমান

রাজ প্রতিনিধি যেবা আছে

মোদের দুঃখের কথা   মনো মধ্যে যত ব্যাথা

সব তুমি বল তার কাছে।।

সাহেব স্বীকৃতি হল       লাট দরবারে গেল

জানাইল নমঃশূদ্র কথা

রাজ ভক্ত বীর জাতি     সদা ধর্ম পথে মতি

জাতি মধ্যে অপূর্ব একতা।।

রাজ প্রতিনিধি শুনি       মীডের এ হেন বাণী

বলে সাধু চলি যাহ ঘরে

তব বাঞ্ছা পূর্ণ হবে        নমঃশূদ্র কার্য পাবে

ধন্য হবে অবনী ভিতরে।।

এই সাধনার জোরে       কিছুদিন গত পরে

কুমুদ ডেপুটী পদ পায়

তার কিছু পূর্বে শশি      রাজ কার্য মধ্যে পশি

নমঃকুল উদ্ধার করয়।।

নমঃশূদ্র জাতি তরে       সদা চিন্তা শশি করে

পাঠশালা করে নিজ দেশে

জাতির উন্নতি লাগি       নিদ্রাহীন নিশি জাগি

কত ভাবে করে পরামিশে

সরল উদার প্রাণ            সীমাহীন ধর্ম জ্ঞান

পিতৃ পদে ভক্তি রাখে অতি

গুরুচাঁদ প্রাণ ভরে          বড় ভালবাসে তারে

আশীর্বাদ সদা তাঁর প্রতি।।

বিনম্র স্বভাব দেখি         করুণ কমল আঁখি

ভাতৃ গণে দেখে প্রাণ সম

শিক্ষা চাই দীক্ষা চাই    শিক্ষা ভিন্ন গতি নাই

শিক্ষা দিব আকিঞ্চন মম।।

স্বদেশে বিদেশে থাকি    চরিত্র পবিত্র রাখি

বিদ্যাশেখে শ্রী শশি ভূষণ

তরুণ অরুণ কান্তি          চন্দাননে ক্ষমা শান্তি

দেহ সম অঙ্গের গঠন।।

চাঁদসী নিবাসী ধন্য       নমঃশূদ্র অগ্রগন্য

প্রসন্ন কুমার দাস নামে

প্রসিদ্ধ ডাক্তার বংশ      সবে ধন্বন্তরি অংশ

সবে ভক্ত মনসা আশ্রমে।।

তস্য কন্যা সুচরিতা       অনঙ্গ মোহিনী মাতা

শ্রী শশি ভূষনে করে দান

একে একে পঞ্চ কন্যা     সকলে পবিত্রা ধন্যা

তার গর্ভে হন অধিষ্ঠান।।

পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা    মনে ভাবি মহা তেজা

পুত্র লাগি করে আরাধনা

সু-পুত্র লভিতে গৃহে       নারী হতে দূরে রহে

হরি মন্ত্রে করে উপাসনা।।

দুই বর্ষ গত হয়           শুদ্ধ ভাবে দিন যায়

এক দিন প্রাতঃকালে উঠি

প্রণমি পিতার পায়        কর জোড় করি রয়

কোন কিছু নাহি বলে ফুটি।।

 গুরুচাঁদ রসময়             পুত্র পানে চাহি কয়

বলেশশি না ভাবিও মনে

পুত্র এক তব ঘরে         আসিতেছে অতঃপরে

বংশ ধন্য হবে তাঁর গুণে।।

এই আশীর্বাদ শুনি        শ্রী শশি ভূষণ গুণী

পিতৃ পদে পরে লোটাইয়া

বলেপিতঃ! ভিক্ষা চাই জন্মে জন্মে স্থান পাই

তব ঘরে পুত্র রূপ নিয়া।।

সেই নিশি স্বপ্ন ঘোরে      নিদ্রিত আপন ঘরে

শ্রী শশি ভূষণ রহে একা

যামিনির শেষ ভাগে       কেহ যেন তার আগে

হাসি হাসি দিল আসি দেখা।।

শ্রী শশি ভূষণে ডাকি      শিরে যেন হস্ত রাখি

কহিলেন আনন্দ সংবাদ

বিভূ পদে ভিক্ষা মাগি   রত্ন এক তোমা লাগি

আনিয়াছি অমূল্য সম্পদ।।

পুত্র রূপে তব ঘরে         শ্রী গুরু চাঁদের বরে

আসিবেন তোমার আলয়

পবিত্র করিবে বংশ       রিপুকূল হবে ধ্বংস

সত্য ইহা জানিবে নিশ্চয়।।

বর্ষ পরে জ্যৈষ্ঠ মাসে      ভুবন মোহন বেশে

তের শত নয় সাল গণি

শনিবার মধ্য রাত্রি        গঙ্গা স্নান পূণ্য তিথি

জন্মিলেন পুত্র মহাগুণি।।

বরীয়ান যোগ রয়         নক্ষত্রের পরিচয়

হস্তা নামে পূণ্য শীলা অতি

দশমী তিথির কালে       দশহরা গঙ্গা জলে

সেই কালে নামিলেন ক্ষিতি।।

প্রমথরঞ্জন নাম           অশেষ গুণের ধাম

আদি ব্যারিস্টার নমঃকুলে

আইন সভার সভ্য         হিন্দুর পরম গর্ব

প্রমথরঞ্জনে পেয়ে দলে।।

সহজ সরল প্রাণ          গুণশীলে গরীয়ান

বীর্য বান চরিত্র সুন্দর

মতুয়া সংঘের পতি       মহাপ্রাজ্ঞ মহামতি

ছলা কলা নাহি ধারে ধার।।

মন্মথ রঞ্জন যিনি          পরে জন্ম নিল তিনি

পরম উদার তার প্রাণ

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম পিতা    মনে রাখে সেই কথা

মুন্সেফ রূপে অধিষ্ঠান।।

সমপ্রাণ দুটি ভাই          ভেদাভেদ কিছু নাই

এক প্রাণ রহে দুই দেহে

কোন কিছু মনে হলে      মনের কপাট খুলে

দুই ভাই দুই জনে কহে।।

নামেতে কপিল কৃষ্ণ      সূর্য সম তেজে উষ্ণ

প্রমথরঞ্জন পুত্র পায়

বাসুদেব আশুদেব         রূপ যিনি কামদেব

মন্মথের দুটী পুত্র রয়।।

শ্রী গুরু চাঁদের পায়        দীন এই ভিক্ষা চায়

ইহ সবে রাখিবে কুশলে

সবে দীর্ঘ জীবি হোক     ধরাতলে কীর্ত্তি রোক

পবিত্র করুক নমঃকুলে।।

ঠাকুর বংশের কথা       পরম পবিত্র গাঁথা

পাপ তাপ কলুষ নাষন

ভক্তি করে শুনে যেই     পারে যেতে বাধা নেই

এই বাক্য না হবে লঙ্ঘন।।

শ্রী গুরুচাঁদের লীলা        শ্রী গুরুচাঁদের খেলা

বুঝিবারে সাধ্য কিছু নাই

কিবা কাজ বসে থেকে    চল সবে তাঁকে ডেকে

হরিবলে ভব পারে যাই।।

  

বাল্য লীলা ও বিদ্যাভ্যাস

“The child is father of the man” (Wordsworth)

 

গুরুচাঁদ জন্ম নিল হরিচাঁদ ঘরে

শান্তি মাতা আনন্দিত মুখচন্দ্র হেরে।।

অনিমেষ হেরে মুখ দুটি আঁখি ভরে

সতত চুম্বেন দেবী কোমল অধরে।।

আধ আধ স্বরে যবে মা মা বলি ডাকে

স্মৃতি হারা শান্তি মাতা পুত্রে সারে বুকে।।

ক্রমে ক্রমে দিন গত সপ্তম বরষে

গুরুচাঁদ করে খেলা মনের হরষে।।

অদ্ভুত শিশুর খেলা লাগে যে বিস্ময়

ধীর স্থীর সুগম্ভীর মহা ভাবময়।।

যতেক খেলার সাথী আছে তাঁর কাছে

খেলিবে কি ভয়ে ভয়ে, সবে রহে পিছে।।

যেই আজ্ঞা গুরুচাঁদ করে সাথী প্রতি

আজ্ঞা মত করে কাজ তরান্বিত অতি।।

বাহ্য দৃষ্টে মনে হয় বড়ই কঠিন

বয়সে বালক বটে কার্যেতে প্রবীণ।।

অন্তরের অন্তঃস্থলে বড়ই দয়াল

যেই জন ভালবাসে সে পায় নাগাল।।

একদা ঘটনা এক শুন মন দিয়া

কোমল পবিত্র কত গুরুচাঁদ হিয়া।।

অনাথ বালক এক ভিক্ষার কারণে

গ্রাম পথে চলি যায় আপনার মনে।।

দুরন্ত বালক কত জুটি এক সাথে

অনাথ বালকে বেড়ি ধরে তার হাতে।।

একাকী পাইয়া তারে করে অত্যাচার

নিরুপায় সে অনাথ করে হাহাকার।।

তাহার ক্রন্দনে হাসে দুরন্তের দল

থুথু দেয় মুখে তার এত বড় খল।।

দূর হতে গুরুচাঁদ তাহা দৃষ্টি করি

অন্তরে বেদনা পেয়ে আসিল বাহুড়ি।।

ষষ্ঠ বর্ষ বয় ক্রম হবে যেই কালে

মহা ক্রোধ করি প্রভু দুষ্ট গণে বলে।।

আরে রে দুরন্ত সব এ কেমন কথা

একা পেয়ে অনাথেরে দেও তারে ব্যথা।।

ভাল যদি চাও তবে দূরে যাও সরে

তা না হলে শাস্তি দেব কঠিন প্রহারে।।

সংহার মূরতি দেখি দুরন্তের গণ

ভীত হয়ে দ্রুত গতি করে পলায়ন।।

তবে প্রভু অনাথেরে সাথে করি চলে

উপনীত নিজালয়ে জননীর স্থলে।।

বলে মাগো এই জন বড়ই কাঙ্গাল

মার খেয়ে দেখ এর চোখে বহে জল।।

একে খেতে দাও অন্ন, আর ভিক্ষা দাও

আমার মনের দুঃখ জননী ঘুচাও।।

গুরুচাঁদ মুখে শুনি এই মধু বাণী

আনন্দে কোলেতে তাঁরে করেন জননী।।

বলে ডেকে যাদুমনি তব দয়া জোরে

আনাথের দুঃখ গেল আজ চিরতরে।।

ক্ষীরোদ বাসিনী দেবী এ বাক্য কহিল

অনাথ বালকে ডেকে অন্ন খেত দিল।।

ভোজানান্তে অনাথেরে কহিলা জননী

কিবা ভিক্ষা নিবে আর যাও যাদুমনি।।

সে অনাথ মাতৃবাক্যে ফিরে গেল ঘরে

গিয়ে দেখে খুরা তার গেছে পরপারে।।

তাহার যতেক বিত্ত আছিল প্রচুর

অনাথ বালকে পেয়ে দুঃখ হল দূর।।

বয়স সপ্তম বর্ষ পরিপূর্ণ হল

হরিচাঁদ গুরুচাঁদে নিকটে ডাকিল।।

বলে শুন বাপ ধন বলি তব ঠাঁই

নমঃশূদ্র কুলে দেখ বিদ্যা শিক্ষা নাই।।

 আমার প্রাণের ইচ্ছা তোমাকে পড়াই

বিদ্যার অমূল্য মূল্য জগতে শিখাই।।

কথা শুনি গুরুচাঁদ অতি হর্ষ ভরে

বলে বাবা অই ইচ্ছা আমার অন্তরে।।

পদ্মবিলা বাসী সাধু দশরথ নাম

ছাত্র গণে শিক্ষা দিত সেই গুণধাম।।

তার গৃহে ছিল বটে এক পাঠশালা

দশরথ দেয় শিক্ষা তথা দুই বেলা।।

একদিন দশরথ আসি ওড়াকান্দী

বসিলেন শ্রী হরির পাদ পদ্ম বন্দি।।

হরিচাঁদ বলে শুন সাধু দশরথ

তব কাছে বলি আমি মম মনোরথ।।

আমার নন্দন দেখ শ্রী গুরু চরণ

উহাকে বিদেশে দিব বিদ্যার কারণ।।

তব গৃহে পাঠশালা আছে অনুপম

আমি নাহি জানি তার কিসে কি নিয়ম।।

মম পুত্র গুরুচাঁদে সাথে করি লও

বাঙ্গলা মতের শিক্ষা তাহারে শিখাও।।

কথা শুনি দশরথ আনন্দে কহিল

জীবন সার্থক মোর আজিকে হইল।।

তবে শুভ দিন এক দশরথ দেখে

গুরুচাঁদে সঙ্গে নিল মনের পুলকে।।

গৃহে রাখি যত্ন করি বিদ্যা শিক্ষা দেয়

গুরুচাঁদ দেখা মাত্র সব শিখি লয়।।

ক্রমে ক্রমে দশরথ উদাসী সাজিল

গুরুচাঁদ তাই পদ্মবিলা ছাড়ি এল।।

মল্লকান্দী গ্রামে ঘর শ্রী গোলক নাম

শ্রী হরির প্রিয় ভক্ত অতি গুণধাম।।

তাঁহার চরিত্র কথা কবি রসরাজ

বর্ণিলেন শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত মাঝ।।

গোলকের পুত্র নাম গিরি কীর্ত্তনীয়া

গুরুচাঁদে বাসে ভাল মন প্রাণ দিয়া।।

উভয় বয়সে তুল্য চরিত্রে তেমতি

গিরিধর সাজিলেন গুরুচাঁদ সাথী।।

তবে সে গোলকে ডাকি হরি দয়াময়

বলে শুন হে গোলক যাহা মনে লয়।।

মম পুত্র গুরুচাঁদে বিদ্যাশিক্ষা তরে

রাখিবারে চাই বাপু তোমাদের ঘরে।।

গোলক পুলক চিত্তে বলে ওহে নাথ

তব করুণায় করি কোটী দণ্ডবৎ।।

শ্রী গুরু চরণ যদি মোর বাড়ি রয়

আমি ছার মোর বংশে সবে ধন্য হয়।।

অতঃপর গুরুচাঁদ মল্লকান্দী গ্রামে

বিদ্যা শিক্ষা করে থাকি গোলকের ধামে।।

শ্রী গুরুচরণ আর সাধু গিরিধর

এক আত্মা দুই দেহ ভিন্ন কলেবর।।

তাহার প্রমাণ শুন পরবর্তী কথা

গিরিধর কির্তুনের অপূর্ব বারতা।।

হরিচাঁদ কায়া প্রভু লুকাইয়া যায়

গুরুচাঁদে শক্তিরূপে অধিষ্ঠান হয়।।

কিছুকাল পরে দেখ দৈবের ঘটন

মহাজ্বরে গুরুচাঁদে করে আক্রমণ।।

প্রভুর অসাধ্য লীলা বুঝিবারে নারি

ক্ষণে ক্ষণে ডেকে বলে আমি বুঝি মরি।।

প্রভুর ব্যাধির কথা শুনি গিরিধর

উপনীত ওড়াকান্দী প্রভুর গোচর।।

প্রাণসখা গিরিধরে দেখিয়া নয়নে

ডেকে বলে গিরি দাদা আর এলে কেনে।।

আমার দারুণ ব্যাধি হয়েছেরে ভাই

সকলে বিদায় দাও দেহ ছেড়ে যাই।।

কথা শুনি গিরিধর চমকিত হল

কিছুকাল স্তব্ধ রহে কিছু না কহিল।।

পরে ডেকে বলে শুন গুরুচাঁদ সোনা

পরপারে এবে তোর যাওয়া হবে না।।

 জগতের বোঝা তোরে দিয়াছে গোঁসাই

তুই গেলে জগতের উপায় যে নাই।।

এতই জ্বরের যদি হয়ে থাকে ক্ষুধা

তোরে ফেলে মোরে নিক নাই কোন বাধা।।

সামান্য মানব আমি সামান্য জীবন

বাঁচি মরি তাতে নাই দুখের কারণ।।

আমি গেলে দেখ মাত্র এক প্রাণ যাবে

তুই গেলে বল কোথা জগত দাঁড়াবে।।

অপার মহিমাশালী সেই গিরিধর

গৃহে যেতে সেই দিনে দেহে নিল জ্বর।।

ক্রমে বৃদ্ধি হল জ্বর গিরির শরীরে

কালজ্বর গুরুচাঁদে তাতে গেল ছেড়ে।।

সপ্তাহ পরেতে প্রভু নীরোগ হইল

গিরিধর জ্বর রোগে জীবন ত্যজিল।।

এমন মহান ছিল সেই গিরিধর

তার সাথে গুরুচাঁদ পড়ে একত্তর।।

বয়সে বালক দোহে জ্ঞানেতে প্রবীণ

ভিন্ন ভাবে দেখা দেখি নাহি কোনদিন।।

মাঝে মাঝে দুই জনে ওড়াকান্দী যায়

পুনঃ ফিরে আসে দোহে গিরির আলয়।।

তিন বর্ষ এই ভাবে বিদ্যা শিক্ষা করি

গুরুচাঁদ এল ফিরি ওড়াকান্দী বাড়ী।।

বাসনা প্রবল প্রভুর বিদ্যালাভ তরে

মনোভাব প্রকাশিল পিতার গোচরে।।

কথা শুনি হরিচাঁদ আনন্দ পাইল

ওড়াকান্দী মক্তবেতে প্রভুকে পাঠা।।

কিছুকাল তথাকারে শ্রী গুরুচরণ

আরবী পারসী ভাষা করে অধ্যয়ন।।

সাধু গুরু মতুয়ার চরণে প্রণতি

সেকালের শিক্ষা রীতি বলিব সম্প্রতি।।

সতেরশ সাতান্ন সালে পলাশীর ক্ষেত্রে

ইংরাজ লভিল বঙ্গে রাজ দণ্ড ছত্রে।।

শত বর্ষ লাগে প্রায় ভারত বিজয়ে

কোম্পানী রাজত্ব করে স্বার্থেতে মজিয়ে।।

প্রজার সুখের দিকে কিছু লক্ষ্য নাই

স্বার্থ পেলে সর্বশান্তি আর কিবা চাই।।

আচার বিচার নীতি শিক্ষা দীক্ষা যত

যার ধর্মে যাহা যাহা তার তার মত।।

মুসলিম রাজত্ব কালে উর্দ্দু পার্শি ভাষা

রাজ ভাষা বলি তারা মান্য পেল খাসা।।

রাজার প্রসাদ লোভী যারা যারা ছিল

রাজ কার্যে রত থাকি সে ভাষা শিখিল।।

রাজধানী হতে দূরে যত জমিদার

পৌরাণিক মতে চলে তাদের বিচার।।

রাজ কর দিলে আর কোন চিন্তা নাই

নিজ রাজ্যে স্ব-প্রধান ভূ স্বামী সবাই।।

তাহার প্রমাণ আছে দ্বাদশ ভূস্বামী

বার ভূঁইয়া নামে খ্যাত এই বঙ্গ ভূমি।।

নিজ দেশে স্ব-প্রধান জমিদার যত

শিক্ষা দীক্ষা দেয় সবে নিজ মনোমত।।

প্রায়শঃ বঙ্গেতে ছিল হিন্দু জমিদার

নিজ রাজ্যে তারা সবে শিখাত আচার।।

জমিদারী মহাজনী দলিল লিখন

শিক্ষা বলি ছিল এই দেশে প্রচলন।।

ইহার অধিক যদি শিখিবারে চায়

টোলে শিখি দেব ভাষা শাস্ত্র বেত্তা হয়।।

কেহ যদি রাজ কার্যে চাহে পশিবারে

রাজভাষা শিক্ষা করে মুন্সীর গোচরে।।

চতুষ্পাঠী খুলি রহে ব্রাহ্মণ সুজন

ছাত্রগণে শিক্ষা দেয় লিখন পঠন।।

বেতন বলিয়া কিছু না ছিল তখন

বিনা মূল্যে শিক্ষা দিত যশের কারণ।।

স্বেচ্ছা কৃত দান প্রায় দ্রব্যাদি সম্ভার
সেই দানে গুরুজীর চলিত সংসার।।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free