মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

পৃষ্ঠাঃ ৪১-৬০

যেইকালে গুরুচাঁদ আবির্ভূত হল

পূর্বাপর প্রথা প্রায় বর্তমান ছিল।।

সেই রীতি অনুসারে শিক্ষা লাভ করি

দ্বাদশ বর্ষের কালে পড়া দিল ছাড়ি।।

গৃহে বসি শাস্ত্র পাঠ করে নিয়মিত

ক্ষণে ভ্রমে ভক্ত গৃহ পিতার সহিত।।

তরুণ অরুণ কান্তি দিব্য মনোহর

রূপ দেখি ভক্তগণে লাগে চমৎকার।।

গম্ভীর মূরতি প্রভু চারু কলেবর

বালবেশে শোভে যেন আপনি ভাস্কর।।

চন্দ্রকলা সম প্রভু বাড়ে দিনে দিন

এ দিকেতে হরিচাঁদ ক্রমে উদাসীন।।

সংসার ত্যজিয়া প্রভু উদাসী সাজিল

গৃহস্থ আশ্রমে গুরুচাঁদকে রাখিল।।

 

বিবাহ ও সংসার আশ্রমে প্রবেশ

 

দ্বাদশ বরষ কালে      বিদ্যাশিক্ষা ক্ষান্ত দিলে

ভক্ত গৃহে ফিরে প্রভু পিতার সংহতি

যেখানে যেখানে যায়        নর নারী মুগ্ধ হয়

রূপ দেখি মুখে শুনি মধুর ভারতী।।

চন্দ্র করোজ্জ্বল ভাতি    ভুবন মোহন জ্যোতিঃ

হাসি হাসি মুখে যেন সৌদামিনী রেখা

আজানুলম্বিত ভুজ         নাসা জিনি খগরাজ

ভালে হেরি দিব্য জ্যোতিঃ চারুচন্দ্র লেখা।।

দ্বিতীয় ভাস্কর সম         কলেবর নিরুপম

ঘন কৃষ্ণ কেশ দোলে পৃষ্ঠের উপরে

আনন্দে নাচিয়া চলে      চাঁদ যেন ধরাতলে

আধার নাশিয়া যায় চন্দ্রকলা শরে।।

ক্ষীরোদের নাথ হরি      এই ভাব লক্ষ্য করি

অন্তরে উল্লাস প্রভু দেখি গুরুচাঁদে

মনে ইচ্ছা গৃহীগণে        তরাবে সকল জনে

তাই গুরুচাঁদে ডাকি কহিলা আহ্লাদে।।

শোন পুত্র প্রণাধিক       তব প্রতি সমধিক

স্নেহ কৃপা কৃতজ্ঞতা আছে বিদ্যমান

বংশের গৌরব তুমি       তব প্রতি প্রীত আমি

তোমা পুত্র পেয়ে মোরে গনি ভাগ্যবান।।

শাস্ত্র গ্রন্থ আদি যত        পড়িয়াছ অবিরত

তত্ত্ব জ্ঞান তার মধ্যে লভিয়াছ কত

নিশ্চয় শিখেছ তুমি       সংসার করম ভূমি

গৃহাশ্রম সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সর্ব্ব বাদী মত।।

বেদ ব্যাস মহামুনি        পুরাণ রচিয়া তিনি

উপদেশে তার মধ্যে কহিয়াছে কথা

তাহা পড়িয়াছ তুমি       অধিক কি কব আমি

মনে কর সেই সব মধুময় গাঁথা।।

গৃহস্থ আশ্রম ধর্ম          ভূতলে নরের জন্য

সর্ব্বতীর্থ সর্ব্ব পুণ্য গৃহাশ্রমে রয়

গৃহীকে আশ্রয় করি       জীব রহে দেহ ধরি

গৃহাশ্রম সর্ব্বোত্তম সেই হেতু কয়।।

গার্হস্থাৎ পরমো ধর্ম্মো দ্বিতীয় নাস্তি ভূতলে

গৃহস্থস্য গৃহঃ পুণ্য সত্য পুণ্য-সমন্বিতঃ

সর্বতীর্থ ময়ো বৈশ্য সর্বদেব সমান্বিতাঃ

গার্হস্থ্যঞ্চ সমাশ্রিত্য সর্বে জীবন্তি জান্তবঃ

তাদৃশংনৈব পশ্য মিহ্যন্যমাশ্রমুত্তম্ ম।।

( পদ্ম পুরাণম্-ভূমিখণ্ডম )

সত্য আদি যুগ হতে      গৃহধর্ম বিধিমতে

পালিয়াছে নরনারী অসংখ্য নৃপতি

গৃহধর্ম পালি সুখে         অন্তিমে পরম লোকে

বিষ্ণু পদে বিষ্ণু লোকে করেছে বসতি।।

বিশেষতঃ কলিকালে     পরমায়ু ক্ষীণ বলে

নর পক্ষে গৃহধর্ম একান্ত প্রশস্ত

গৃহাশ্রমী হতে হলে        নারী সহ গৃহে মিলে

ব্রহ্মচর্য সদাচারে হইবে অভ্যস্ত।।

তাই বলি প্রিয়তম         শুন প্রিয় ইচ্ছা মম

যাকহিল শান্তি দেবী তোমার জননী

তোমাকে বিবাহ দিব      বধূ পেয়ে সুখী হ

বংশ রক্ষা হবে যশ ঘোষিবে অবনী।।

পিতৃমুখে এই বাণী        গুরুচাঁদ গুণমনি  শুনি

কানে প্রাণে ভীত মন হল

মনে ভাবে একি দায়      কেন পিতা হেন কয়

মোর ভাগ্যে এতদিনে দুর্ভাগ্য আসিল।।

মনে মোর এই আশা      ভাঙ্গিয়া বিষয়-বাসা

প্রেম ভরে মহাশূণ্যে উড়িয়া বেড়া'

যদি পরি মায়া-ডোর      আশা ভঙ্গ হবে মোর

মোক্ষ-ফল-দাতা পিতৃ-পদ ভূলে যাব।।

এত ভাবি মনে মনে       পিতৃদেব সন্নিধানে

বলে তাত! শুন তবে দাসের বচন

তুমি হরি জন্মদাতা      শান্তি দেবী মোর মাতা

আমি ধন্য পেয়ে তব যুগল চরণ।।

করিব চরণ সার             ভবসিন্ধু হব পার

তব নাম ঘুরে ঘুরে যাব বিলাইয়ে

মিছা সব পুত্র পৌত্র        মায়া রাক্ষসীর সূত্র

কিবা কাজ দারা সুত পরিজন দিয়ে।।

কর এই আশির্বাদ         পূরে যেন মনো সাধ

তব পুত্র পরিচয় চাহি আবনীতে

ব্রহ্মত্ব ইন্দ্রত্ব তুচ্ছ         চাহিনা মুক্তি গুচ্ছ

আমার কামনা তব কৃপাদাস হতে।।

এই বাক্য যদি কয়       তবে হরি রসময়

হাসি বলে প্রিয়তম শুন সমাচার

কর্মফলে জীবগণ         করে ভবে আগমন

কর্ম ফল সুনিশ্চিত অবনী মাঝার।।

শুন শুন মহাশয়           দারা পুত্র মিছা নয়

পুত্র হতে নরে পায় কূলের উদ্ধার

সৎ পুত্র যদি হয়            পুত্র গুণে মুক্তি পায়

ভগীরথ আদি যথা মহা গুণাকর।।

পুৎ নামে যে নরক        অন্যে সেথা অপারগ

একমাত্র পুত্রে করে সেখানে উদ্ধার।।

পুত্রেন লোনন জয়তি পুত্রস্তারয়তে কুলম্

সৎ পুত্রেন মহাভাগ পিতামাতা চ জন্তবঃ।।

( পদ্মপুরানম্ --ভূমিখণ্ডম্ )

অতএব মহাশয়           কিছু নাহি কর ভয়

গার্হস্থ্য আশ্রমে এবে করহে প্রবেশ

মনে রেখ এই ধর্ম         যাহা কিছু কর কর্ম

সর্ব কর্মফল ভোক্তা প্রভু হৃষীকেশ।।

তাঁর পদে দিয়ে মন       কর কর্ম সর্বক্ষণ

আমিত্ব প্রভুত্ব যেন নাহি জাগে মনে

তাঁর প্রীতি কাম জন্য     যাহা কর তাহা ধন্য

স্বীয় ভোগে যত কর সবই আকারণে।।

আর শুন বলি কথা        সত্য ধর্ম পবিত্রতা

গৃহী জনগণ পক্ষে জানিবে প্রধান

গৃহ ধর্ম শ্রেষ্ঠ হয়         তার তুল্য কেহ নয়

বেদ, স্মৃতি সর্বশাস্ত্রে রয়েছে প্রমাণ।।

আর গূঢ় কথা জান        এই কথা বলি কেন

আপনার মাঝে তুমি ডুব একবার

আপনারে দেখ তুমি     কি কারণে বলি আমি

গৃহী হয়ে গৃহ ধর্মে পাতিতে সংসার।।

আমি এক উদাসীন        নাহি রাত্রি নাহি দিন

কি জানি কাহার টানে ঘুরিয়া বেড়াই

সংসার করিতে হলে      তব সম পুত্র পেলে

সেই পুত্র ভিন্ন ভার অন্যে দিতে নাই।।

পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্ম পিতাহি পরমং তপঃ

এই বাণী সত্য বলি যদি জাগে প্রাণে

আমি আছি তব পিছে     তুমি কেন ভাব মিছে

যাহা বলি তাহা কর আর ভাব কেনে?

পিতৃ মুখে শুনি বাণী       গুরুচাঁদ গুণমণি

আপনার মাঝে যেন ডুবিল আপনি

স্তব্ধ রহি কিছুকাল        হাসি ওঠে খল খল

বলে পিতাঃ বুঝিয়াছি আপনার বাণী।।

তুমি পিতা ইচ্ছাময়       কর ইচ্ছা যাহা হয়

কর্তা তুমি মহাপ্রভু আমিতো কারণ

পূরাতে তোমার ইচ্ছা      বল মোরে যথা ইচ্ছা

তব ইচ্ছা হলে তাহা কে করে বারণ?

যাহা ইচ্ছা তাহা দাও    যাকরাবে তাকরাও

তোমার ইচ্ছায় বাধা না করিব আমি

তব ইচ্ছা বহিবারে      শক্তি যেন দিও মোরে

তব কার্যে তব শক্তি চাই অর্ন্তযামী।।

ধর্মাধর্ম নাহি জানি        পাপ পুণ্য নাহি চিনি

তব শক্তি এই মাত্র জানি যেন মনে

মম সম দীন হতে     কোন দিনে কোন মতে

তব কার্য যদি হয় ধন্য এ জীবনে।।

জানামি ধর্ম্মং ন চ মে প্রবিত্তিঃ

জানাম্য ধর্ম্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ

ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন

যথা নিযুক্তোস্মি তথা করোমি

( শ্রী মদ্ভাগবদগীতা )

গুরু চাঁদ মহেশ্বর          পিতা রূপে হরি তাঁর

পিতা পুত্রে করে লীলা নরে অগোচর

বহুকাল গত হয়          ঠেকিয়া জীবের দায়

ওড়াকান্দী অবতীর্ণ ক্ষীরোদ ঈশ্বর।।

গুরুচাঁদ বুঝে মনে          হরিচাঁদ কি কারণে

বিভা করি গৃহী হতে বলিল তাঁহারে

শিখাতে গার্হস্থ্য নীতি   কলি জীবে দিতে গতি

গৃহী রূপে সাজিলেন আপনি শঙ্করে।।

সাতবেরে গ্রামে ঘর       মহাপ্রাজ্ঞ গুণধর

রামকৃষ্ণ নামে সাধু ভজনে চতুর

কৃষ্ণ কথা আলাপনে      দিনে রাতে সর্বক্ষণে

মগ্ন থাকি রহে সাধু প্রেমেতে আতুর।।

তার নারী পুণ্যশীলা       নামে সতী দেববালা

পতিনিষ্ঠা পতিপ্রাণা পতি-পরায়ণা

পবিত্র চরিত্র দোঁহে        সদা কৃষ্ণ কথা কহে

কৃষ্ণ গত প্রাণ তাহে কৃষ্ণ উপাসনা।।

এ হেন পবিত্র ঘরে        রূপে গুণে আলো করে

আলোকসম্ভুতা কন্যা আবির্ভূতা হ

যবে কন্যা জন্ম লয়       রামকৃষ্ণ মহাশয়

দেখে যেন গৃহ তার আলোকে ভরিল।।

অপূর্ব ঘটনা দেখি         রামকৃষ্ণ মহাসুখী

মনে ভাবে সতী লক্ষ্মী এল ঘরে মোর

হেন কন্যা দেখিবারে      ছুটীলেন অন্তঃপুরে

মহাভাবে মহাসাধু হয়েছে বিভোর।।

প্রসূতি গৃহের দ্বারে        রামকৃষ্ণ দৃষ্টি করে

রূপ দেখি পালটিতে নাহি পারে আঁখি

উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী কন্যা    এ যেন রে নহে অন্যা

যাঁর লাগি ধ্যান কৈল আপনি পিনাকী।।

আয়ত লোচনা দেবী       যেন ভাস্করের ছবি

নিখুঁত নিটোল দেহ রক্ত পদতল

সুকেশা সুনাসা হেরি      মুখপদ্ম আহা মরি

রূপ-গোলা পাত্রে যেন পদ্ম ঢল ঢল।।

রাম কৃষ্ণ শাস্ত্র জ্ঞাতা     চিত্তে গাঁথা কৃষ্ণ কথা

কৃষ্ণ প্রিয়া সত্যভামা স্মরণে আসিল

রূপে সত্যভামা সম        এই কন্যা হবে মম

সত্যভামানাম বলি তাহারে ডাকিল।।

জীব ধর্ম অনুসারে         সত্যভামা ক্রমে পরে

মাতৃকোল ছাড়ি দেবী হাঁটিতে শিখিল

আশ্চর্য করম যত         করে দেবী অবিরত

তাহা দেখি নরনারী আশ্চর্য মানিল।।

চপলা নহেক মাতা        স্থির যান গিরিসুতা

মৃদু মৃদু হাসে দেবী আপনা আপনে

যেই করে দরশন    সব হয় বিস্মরণ

অপলকে দেখে রূপ ভরিয়া নয়নে।।

পঞ্চম বরষ কালে         মিলি দেবী সখী দলে

মনোরঙ্গে করে খেলা অদ্ভূত প্রকারে

যেই দেখে সেই কয়    এ মেয়ে তো মেয়ে নয়

শাপভ্রষ্টা দেবী কেহ আসিল সংসারে।।

সুন্দর মৃত্তিকা আনি       গড়ি দেব শূল পাণি

তাঁর আগে জুড়ি পাণি বসে এক মনে

তুলিয়া কুসুমদাম          হার গাঁথি মনোরম

গলে হার দেয় আর দেয় সে চরণে।।

কান্দি বলে প্রাণেশ্বর      প্রাণাধিক দিগম্বর

দাসী বলে ঠাঁই দাও রাতুল চরণে

ভোলানাথ আশুতোষ     জানি মোর কত দোষ

দয়া করে রেখ মোরে করুণ নয়নে।।

দেখি এই পূজাচার        দেশবাসী নারী নর

সবে বলে এই কন্যা হবে কোন দেবী

দেবী যদি নাহি হবে      তবে বল কি স্বভাবে

পূজা করে দেবতারে মোরা তাই ভাবি।।

পূজা করা বুঝে কিসে     পূজা কেন ভালবাসে

এত নহে ক্ষুদ্রমতি বালিকার খেলা

ভাগ্যবতী লক্ষ্মীযুতা       হবে বুঝি শৈলসুতা

নৈলে কেন শিব পূজা করে সারা বেলা।।

এই ভাবে দিন চলে       দশম বরষ কালে

হরি-গৃহে যেতে দেবী করিল বাসনা

গুরুচাঁদ বিভা লাগি        হরিচাঁদ কন্যা মাগি

সাতবেরে উপনীত যেথা বরাঙ্গনা।।

গগনে প্রহর বেলা         প্রভুর কি লীলা খেলা

পথ হাঁটি চলে প্রভু চারিদিকে চায়

দেখে এক বৃক্ষ তলে      ভাসিয়া নয়ন জলে

বালা-এক শিবপদে ফুল জল দেয়।।

থমকি দাঁড়াল হরি       কার কন্যা এ কিশোরী

গৌরী যেন নামিয়াছে আপনি ভূতলে

আহা মরি কি মাধুরী      এই নাকি গিরিপুরী

ভষ্ম মাঝে অগ্নি যেন ধিকি ধিকি জ্বলে।।

হেন কালে সেই কন্যা     চক্ষে যার অশ্রুবন্যা

ফিরে দেখে কিবা রূপ জগত মোহন

প্রভু তাঁরে চেনে চিহ্নে    শৈলসুতা সাজি কন্যে

আসিয়াছে ধরাপরে জীবের কারণ।।

মা! মা! বলি ডাক      দেয় জননী ছুটিয়া যায়

হরিপদে পড়ে দেবী প্রণাম করিয়া

মহাপ্রভু মহানন্দে          পিতৃস্নেহে প্রেমানন্দে

ধরা হতে বুকে কন্যা লইল তুলিয়া।।

নর ভাবে কহে কথা      বল শুনি ওগো মাতা

কেবা পিতা কেবা মাতা কোনখানে বাড়ী

সুহাস হাসিয়া দেবী       নিষ্কলঙ্ক পূর্ণ ছবি

বলে পিতা! পিতা মোর ক্ষীরোদের হরি।।

রসিকের চূড়ামণি         হরিচাঁদ রসখনি

বলে কন্যা! ঠিক কহ না ভাণ্ডিও কথা

ক্ষীরোদের হরি যিনি     তব পিতা যদি তিনি

আমি জানি তবে তুমি জগতের মাতা।।

হরি গৌরী কিবা কয়     তার তত্ত্ব কেবা পায়

যারা জানে তারা জানে জানে তাঁরা তাঁরা

মায়ামুগ্ধ নর মোরা        নয়নে আঁধার ভরা

মায়া মোহে অন্ধ সদা নয়নের তারা।।

জীবভাবে বলে মাতা      রামকৃষ্ণ মোর পিতা

চেয় দেখ দেখা যায় আমাদের বাড়ী

তুমি মোর সাথে চল      বেলা দ্বিপ্রহর হল

মোর সাথে নাহি গেলে দিব না'ক ছাড়ি।।

বলে হরি দয়াময়     “তোর ভাব বোঝা দায়

তোর ভাবে ভব ভোলা আমি কিবা ছার

তাই তোরে মা মা ডাকি তোর নাম নিয়ে থাকি

ওরে বেটী তোর লীলা অনন্ত অপার।।

দেবী তায় কহে বাণী     কিবা কও নাহি জানি

সামান্য বালিকা আমি অতি জ্ঞান হীনা

যদি পদে দেহ ঠাঁই        সফল জনম তাই

অবোধ বালিকা বলে চরণে ঠেলনা।।

রামকৃষ্ণ ভবনেতে      সত্যভামা দেবীর সাথে

দয়াময় হরিচাঁদ হইল উদয়

ঠাকুরে দেখিয়া তবে      রামকৃষ্ণ মহাভাবে

শ্রী হরির পাদপদ্ম প্রণাম করয়।।

স্তুতি বাক্য কত কয়      পাদ্য অর্ঘ্য আনি দেয়

করজোড়ে বলে প্রভু বসহ আসনে

আজি মম কি সৌভাগ্য   তব সম পূজা যোগ্য

পরম রতন বিধি মিলাল এ দিনে।।

কুশলে তো আছ তাতঃ   পুত্র পরিজন সাথ

যথারীতি হরিনাম হতেছে প্রচার

বল এবে মহাজন          কিবা হেতু আগমন

কোন পুণ্যে এ সৌভাগ্য উদয় আমার।।

প্রভু বলে হাসি হাসি    “সাধে কি হেথায় আসি

আমার জননী তুমি বাঁধিয়াছ ঘরে

মা-হারা সন্তান আমি      ত্রিভুবনে সদা ভ্রমি

মাতৃদরশন হল বহুদিন পরে।।

সে সব এখনে থাক        শীঘ্র গতি হোক্ পাক

তুমি আমি দোঁহে এবে করি আলাপন

এবে কহ কৃষ্ণ কথা       জুড়াই প্রাণের ব্যাথা

প্রেমময় কৃষ্ণ নাম অশান্তি নাশন।।

রামকৃষ্ণ শুনি বানী        করে কৃষ্ণ কৃষ্ণ ধ্বনি

প্রেমানন্দে মত্ত হয়ে করে ছোটাছুটি

কখনে অন্দরে যায়        ছুটে আসি পুনরায়

শ্রী হরির পদতলে করে লুটাপটি।।

হরি বলে শুন সাধু         ব্যস্ত কেন শুধু শুধু

তব ঘরে অন্নপূর্ণা করিছে বিরাজ

সকলি জোটাবে তিনি  তুমি আমি কিবা জানি

ছুটাছুটি লুটাপুটি ছেড়ে দাও আজ।।

অনন্ত প্রভুর লীলা        কে বুঝিবে তাঁর খেলা

কি অভাবে যেথা রয় কমলার পতি

শ্রী হরির বার্তা পেয়ে      নরনারী আসে ধেয়ে

খাদ্য দ্রব্য দধি দুগ্ধ আনে শ্রীঘ্র গতি।।

দেবী সত্যভামা ধন্যা      কন্যারূপে অন্নপূর্ণা

স্বহস্তে রন্ধন দেবী করিল সত্তর

হরি কৃষ্ণ দুইজনে         বসে খায় একখানে

সত্যভামা দেবী হল বন্টনে তৎপর।।

হরিচাঁদ বলে হাসি         বহুদিন উপবাসী

আমি যেন ছিনু ঘরে জননী অভাবে

মাতা দেয় অন্ন আজি     আপনি জননী সাজি

পরিতৃপ্ত হল প্রাণ ভোজন উৎসবে।।

শুন রামকৃষ্ণ এবে        আসিলাম কিবা ভেবে

সেই তত্ত্ব বলি আমি পরম আহ্লাদে

মোর জ্যেষ্ঠ পুত্র সনে     তোমার দুহিতা ধনে

বিভা দিতে চাই আমি বহু মনোসাধে।।

জননীর পানে চায়        হাসি হাসি কথা কয়

তাহা শুনি সত্যভামা মধুর হাসিল

হাসি দেখি বলে হরি       “দেখ রাম দৃষ্টি করি

মোর বাক্যে কন্যা তব সন্দেহ নাশিল।।

রামকৃষ্ণ দেখে চেয়ে    আনন্দে হাসিছে মেয়ে

মনের সংসয় তার সব দূরে গেল

রামকৃষ্ণ বলে কান্দি    মোরে ছেড়ে ওড়াকান্দী

সোনার পুতুল আজি বিদায় হইল।।

শুন হরিচাঁদ ভাই     আর কোন কথা নাই

তব গৃহ লক্ষ্মী তুমি লও নিজ ঘরে

নাহি জানি কোন পুণ্যে   সতী হয়েছিল কন্যে

আমি ধন্য এতদিনে পুষিয়া মাতারে।।

আহারান্তে যবে আসি      দিন স্থির করে বসি

রামকৃষ্ণ বলে মোর প্রাণে না জুড়ায়

প্রাণাধিকা প্রিয়তমা      কন্যা মোর সত্যভামা

তারে ছেড়ে গৃহে মোর থাকা হবে দায়।।

মোর মনে সদা কয়       কন্যা যদি ছেড়ে যায়

মম প্রাণ ধরাপরে আর নাহি রবে

যাহোক তা হোক ভাই বিবাহেতে কার্য নাই

এই কন্যা গেলে চলে আর কি আসিবে।।

আত্মীয় স্বজন যত         বলে তারে কত মত

শাস্ত্র গ্রন্থ লোকাচার শুনা 'ল প্রচুর

শেষক্ষণে বলে তারে      কিবা ফল দুঃখ করে

কন্যা নিল ভগবান শ্রী হরি ঠাকুর।।

রামকৃষ্ণ হল শান্ত       শোক দুঃখ করে ক্ষান্ত

সুস্থ মনে দিন স্থির সকলে করিল

পুত্র কন্যা দেখাদেখি      করে সবে মহাসুখী

রামকৃষ্ণ গুরুচাঁদে আশির্বাদ দিল।।

উত্তাল আনন্দ রোল     বাজে কংস বাজে ঢোল

ভেরী তুরী বাজে আর বাজিছে শানাই

পুত্র বিভা দিবে হরি       দলে দলে আসে নারী

ক্ষণে ক্ষণে হুলুধ্বনি করিছে সবাই।।

শ্রী হরির ভক্ত যত         সকলেই আনন্দিত

অগনিত দ্রব্য কত আনে ভারে ভারে

শান্তি দেবী পুত্রধনে        সাজাল আপন মনে

মস্তক আঘ্রাণ করি চুমা দিল শিরে।।

পিতৃ মাতৃ পদে পড়ি      পদধুলি শিরে ধরি

গুরুচাঁদ যাত্রা কৈল কন্যার ভবনে

আহা কি অপূর্ব রূপ        ভরিয়া নয়ন কূপ

দেখামাত্র প্রাণ কাড়ি লয় একটানে।।

রামকৃষ্ণ গৃহোপরে        অপরূপ শোভা করে

ঠিক যেন দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন

আলো করে ঝলমল       মহানন্দে কোলাহল

মহা সিন্ধু মাঝে যেন উঠিছে গর্জ্জন।।

বরকন্যা সভাস্থলে         আসিয়া উদয় হলে

রূপ দেখি সভাজন মূর্চ্ছাপ্রায় হল

গুরুচাঁদ সত্যভামা          সদাশিব আর উমা

গিরিপুরি ছাড়ি যেন ধরাতে নামিল।।

এইভাবে বিয়া হয়         গুরুচাঁদ রসময়

গৃহধর্ম্মে অতঃপর করিল প্রবেশ

গৃহীজনে রক্ষিবারে        হরি-আজ্ঞা অনুসারে

ওড়াকান্দী মহেশ্বর গুরুচাঁদ বেশ।।

 

গৃহাশ্রমের শিক্ষা লাভ

 

বিয়া করি গুরুচাঁদ সংসারী সাজিল

তাঁরে কত নীতি কথা শ্রী হরি কহিল।।

পিতৃসনে গুরুচাঁদ ভক্ত গৃহে যায়

ভক্তের ভাবের তত্ত্ব সব শিখি লয়।।

কিছুকাল পরে সেই শ্রী হরি ঠাকুর

গুরুচাঁদে ডাকি বাক্য কহিল প্রচুর।।

শুন পুত্র তব কাছে মোর সমাচার

আজি হতে দিনু তোমা সংসারের ভার।।

আয় ব্যায় যাহা কিছু সকলি করিবে

জানাবার হলে তাহা মাতাকে জানাবে।।

মাতাপুত্রে কর সুখে সংসার রচনা

তার মধ্যে আর মোরে কভু ডাকিও না।।

গৃহাশ্রম কথা কিছু কহি তব ঠাঁই

প্রয়োজনে আরো কব কোন চিন্তা নাই।।

গৃহধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম জানিবে নিপুন

গৃহধর্ম মধ্যে রয় সর্ববিধ গুণ।।

গৃহাশ্রমে ভর করি সর্বজীব রয়

শাস্ত্রেতে বাখানে গৃহ সর্ব তীর্থ ময়।।

গৃহাশ্রম রক্ষা হেতু কর্মই প্রধান

সুকর্মে সুফল ফলে পাপে অকল্যাণ।।

আর শুন শাস্ত্র বাক্য কিছু মিথ্যা নয়

কোন গৃহে ধর্মরাজ বসতি করয়।।

ধর্মযুক্ত গৃহী যেথা পবিত্রা রমনী

ধর্ম সেথা বাস করে দিবস রজনী।।

ধর্মের আত্মীয় যত সত্য প্রজ্ঞা আদি

সেই গৃহে বাস করে সুখে নিরবধি।।

এতৈঃ সার্দ্ধং বসাম্যেব সতীষু ধর্ম্মবৎ সুচ

সাধুষ্বেতে ষু সর্ব্বেষু গৃহরূপেষু মে সদা।।

উক্তেনাপি কুটুম্বেন বসাম্যেব ত্বয়া সহ।।

(পদ্ম পুরাণম্)

নিজালয় বসি কর্ম কর ধর্ম মতে

ধর্মে দিবে যশ-মান ধনের সহিতে।।

রিপু নাশেধর্ম কর্ম সর্ব বিধ ফল

ষড় রিপু হতে দূরে থাক চিরকাল।।

ষড়রিপু দমিবারে আছে শুদ্ধ পথ

ষড় বর্ষ নারী সঙ্গে না কর সুরত।।

ভিন্ন ভিন্ন রহ দোঁহে পবিত্র আচারে

রাজপুত্র জন্ম লবে তোমাদের ঘরে।।

আর দিন ডেকে বলে সত্যভামা মায়

শুনোগো জননী মোর কল্যাণ আশ্রয়।।

নারী ধর্ম কথা কিছু বলিব তোমারে

তোমা হতে সবে শিক্ষা পাবে এ সংসারে।।

নারী জাতি স্বভাবতঃ কোমল হৃদয়া

পিতৃগৃহে যেতে চায় সুখে মত্ত্ব হৈয়া।।

শাস্ত্রে বলে চিরধীনা রমনী রহিবে

বাল্যে পিতা প্রৌঢ়ে পুত্র যতনে পালিবে।।

পতি পেয়ে নারী হবে তাঁহার অধীনা

জীবনে হবে না নারী কখন স্বাধীনা।।

কেবা পিতা কেবা মাতা কেবা বন্ধু ভাই

পতি ভিন্ন রমনীর অন্য গতি নাই।।

(“কন্যা মাতা পিতা ভ্রাতা কস্যাঃ স্বজনবান্ধবাঃ

সর্বস্থানে পতির্হ্যেকো ভার্ষায়াস্ত ন সংশয়”)

সু গৃহিনী বলে কারে শুন বলি তাই

সু অর্থে পবিত্র জান ইথে ভুল নাই।।

পবিত্র রহিয়া যেবা পতি সেবা করে

লক্ষ্মী আসি বাস করে সদা তার ঘরে।।

পতি গতি করে নারী পতিব্রতা কয়

সদ্ভাবে চলিলে নারী সতী আখ্যা পায়।।

সৎ থাকে পতি সেবে পতিব্রতা সতী

সাধ্বাসতীকথা তবে বলিব সম্প্রতি।।

সেবাদানে তোষে পতি সন্তোষ বিধানে

ইহাধিক সময়েতে ডাকে ভগবানে।।

সাধনা-নিপুনা দেবী পরমা প্রকৃতি

নরগণে বলে তাঁরে ধ্বন্যা সাধ্ব্যা-সতী।।

তাই বলি জননীগো মম বাক্য লও

সৎ থাকি পতি সেবি সাধ্বা সতী হও।।

ষষ্ঠ বর্ষ পতি পত্নি রহ শুদ্ধ ভাবে

দেব তুল্য পুত্র কন্যা আবশ্য লভিবে।।

শ্রী হরির মুখে শুনি মধু মাখা বাণী

করজোড়ে নিবেদন করিল জননী।।

ওগো পিতঃ এ অধিনী এই ভিক্ষা চায়

পতি পদে মন যেন সদা মোর রয়।।

তব আজ্ঞা পালিবারে পারে যেন পতি

তাঁর দাসী হতে যেন থাকে মোর মতি।।

মোরা দোঁহে হই যেন তোমার সেবক

তুমি যে পরম গুরু বিশ্বের জনক।।

এমত বিনয় শুনি পুত্রবধু মুখে

আনন্দে শ্রী হরিচাঁদ হাসে মহাসুখে।।

শিরে কর দিয়া তারে আশীষ করিল

জগত জননী হও এই বাক্য বলিল।।

এসব কহিয়া হরি সংসার ছাড়িল

অবিরাম হরিনাম প্রচার বাড়িল।।

ভক্তসঙ্গে মনো রঙ্গে নাম গুণ গান

ঘরে ঘরে নাম রসে উঠিল তুফান।।

নাম অস্ত্রে করে হরি প্রথম আবাদ

কৃষক সাজিয়া ভূমি কর্ষে গুরুচাঁদ।।

ধর্ম অস্ত্রে হরিচাঁদ পাপকে কাটিল

কর্ম বলে গুরুচাঁদ পুণ্যকে আনিল।।

পবিত্র চরিত্র বীজ তাহে দিল বুনি

প্রসস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম ফলিল তখনি।।

গৃহীজনে পেল মুক্তি অনর্পিত যাহা

কলি শেষে গুরুচাঁদ বিলাইল তাহা।।

আপনি আচারি গুরু সে ধর্ম শিখায়

গুরুকৃপা গুণে মহানন্দ তাই কয়।।

 

সংযম শিক্ষা লাভ

 

শ্রী হরির ভক্ত শ্রেষ্ঠ নাম শ্রী গোলক

ব্যাধি হতে মুক্তি পেয়ে সাজিল সেবক।।

নারিকেলবাড়ী গ্রামে বসতি তাহার

প্রভু কৃপা দৃষ্টি পেয়ে ত্যজিল সংসার।।

সদা রহে ওড়াকান্দী সাজিয়া প্রহরী

তাহা করে প্রভু যাহা দেন আজ্ঞা করি।।

শ্রী ধামের যাবতীয় গৃহস্থালী কর্ম

সে সব সম্পন্ন করা গোলকের ধর্ম।।

শ্রী শ্রী হরি লীলামৃতগ্রন্থে রসরাজ

গোলক চরিত্র কথা লিখে তার মাঝ।।

সংসারের ভার দিয়া শ্রী গুরুচাঁদেরে

ভক্ত গৃহে হরিচাঁদ নাম দিয়া ফেরে।।

নিয়মিত গৃহকার্য গোলক করিত

এবে মাঝে মাঝে গুরুচাঁদকে ডাকিত।।

একদিন প্রাতঃকালে সেই ভক্ত বীর

পাকা ধান্য কাটিবারে মন কৈল স্থির।।

ডাকি বলে গুরুচাঁদে বড় দাদা এস

আমি ধান কাটি তুমি মোর ধারে বস।।

গোলকের ডাক শুনি প্রভু চলে সাথে

নৌকায় বসিয়া প্রভু গোলক জলেতে।।

অলসের মত ধান কাটে ধীরে ধীরে

তামাকু সাজিয়া দিতে বলে বারে বারে।।

কতবার গুরুচাঁদ তামাকু সাজিল

গোলকের ভাব দেখি মনে ক্রোধ হল।।

তামাকু সাজিতে পুনঃ আজ্ঞা করে যেই

রাগ করে বলে প্রভু আমি এতে নেই।।

অলস দুর্ব্বল বুড়া গায়ে নাহি বল

কাজ নাই বসে খায় তামাকু কেবল।।

যাহা ইচ্ছা কর তুমি আমি চলে যাই

অকেজো লোকের সাথে বাক্যালাপ নাই।।

এতবলি গুরুচাঁদ ক্রোধিত অন্তরে

নৌকা ফেলি উঠিলেন বাড়ির উপরে।।

গৃহমধ্যে প্রবেশিতে শ্রী হরি ডাকিল

একা কেন ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করিল।।

মনোক্ষোভে গুরুচাঁদ কহিছে পিতারে

অলস গোলক বুড়া কাজ নাহি করে।।

তামাকু সেবনে আছে বড়ই আনন্দ

বহুবার সাজিয়াছি সহিয়াছি গন্ধ।।

আর নাহি পারি পিতা থাকিতে সেখানে

অলসের সঙ্গে থাকা নাহি লয় মনে।।

কথা শুনি হরিচাঁদ কহিল প্রভুকে

শোন গুরুচাঁদ তুমি চেন না গোলকে।।

তোমাকে দিয়াছি আমি সংসারের ভার

গোলক করেছে মনে গূঢ় অর্থ তার।।

তুমি বুঝিয়াছ মনে এই ঘর বাড়ি

গোলক বুঝেছে সে তো বাহির কাছারী।।

ধর্ম খুঁটি দিয়া বান্ধি যেই ধর্ম ঘর

গোলক বুঝিছে পেলে সেই গৃহভার।।

এ হেন দ্বায়িত্ব পূর্ণ যেই মহাভার

পার কিনা নিতে করে পরীক্ষা তাহার।।

এ ভার বহিতে লাগে অসীম সংযম

সংযমেতে প্রাপ্ত হয় ধৈর্য পরাক্রম।।

সামান্য দুখেঃর কাজ জানিবে অস্থায়ী

মহা দুঃখ সহ্য কর সাজিতে বিজয়ী।।

একেলা গোলক তোমা করিল বিরক্ত

লক্ষ প্রাণী ভার নিতে তুমি তো অশক্ত।।

তব ধৈর্য পরীক্ষিতে গোলকের মন

তার কাছে গেলে হেরে এ হ'ল কেমন।।

গোলক অলস কিসে মহাবীর্যবান

দেখ গিয়া কাটিয়াছে সেই সব ধান।।

ধৈর্য শক্তি না থাকিলে সকলি বিফল

ধৈর্য ধর কর্ম কর প্রাণে হবে বল।।

আর শোন গুরুচাঁদ আমার বচন

আমি যবে না রহিব কি হবে তখন।।

সংখ্যাতীত নরনারী সকলি আসিবে

নানা ভাবে সবে মিলি বিরক্ত করিবে।।

সকলি সহিতে হবে ধৈর্য শক্তি দিয়ে

সে সব এখনে শেখ এক মন হয়ে।।

আর শোন জ্ঞানী লোক যেই কথা কয়

যে সয় সে মহাশয় কথা মিথ্যা নয়।।

পিতৃ উপদেশে প্রভু সান্ত্বনা পাইল

গোলকের কাছে পুনঃ আপনি ধাইল।।

গিয়ে দেখে একি কাণ্ড অত্যাশ্চর্য ময়

সব ধান কাটিয়াছে বুড়া মহাশয়।।

যে কার্য করিতে লাগে লোক দশজন

একাকী গোলক তাহা করিল সাধন।।

প্রভুকে দেখিয়া সাধু হাসিয়া বলিল

আমাকে ডাকিতে বাবা তোমাকে পাঠাল।।

গুরুচাঁদ বলে দাদা সকলি তো জান

উঠে এস বাড়ী পরে আর জলে কেন।।

এইভাবে গুরুচাঁদ সংযম শিখিল

গোলকের প্রতি মন নির্মল হইল।।

প্রভুর অপূর্ব লীলা বুঝা বড় দায়

গোপালের কৃপাগুণে মহানন্দ কয়।।

 

আর্য সাধনায় জীবন তত্ত্ব

 

নাহন্যোঃবিদ্যতে পন্থায়নায়”-উপনিষদ

 

আর্য জাতি মহাভাগ       চারিভাগে করে ভাগ

মানব জীবনে

আদি ব্রহ্মচর্য তার         গৃহধর্ম অতঃপর

পালিবে যতনে।।

তৃতীয়ত বানপ্রস্থ         ভিক্ষু হবে শেষপ্রস্থ

জীব শেষ যামে

এমন মহান নীতি         জীবের কল্যাণ গতি

নাহি ধরাধামে।।

কালস্য-কুটিলাঃ গতিক্রমে আর্য ছন্নমতি

জীবন সংগ্রামে

গুণ কর্ম বিভাগেতে        ভিন্ন হল নানা পথে

জাতি বর্ণ নামে।।

মূল নীতি হল ভুল         অকুলে হারায়ে কুল

আর্য জাতি ম

কর্মজাতি মুছে দিয়ে    জন্ম জাতি মেনে নিয়ে

হিন্দু সৃষ্টি হল।।

তাই আর্য রক্ষিবারে       বারে বারে অবতারে

নামিল ঈশ্বর

যুগ অনুযায়ী ধর্ম       সবারে শিখাল মর্ম

ভারত উপর।।

তবু তাহে নাহি হয়        অবতার চলি যায়

আপনার লোকে

কাল গতি চক্রতলে        আর্য মরে পলে পলে

জ্বরা ব্যাধি শোকে।।

এমন কেনবা হল      কোন খানে ভুল র

সেই তত্ত্ব কথা

বলি তাহা মনোখেদে     শ্রী গুরু গোপাল পদে

নোয়াইয়া মাথা।।

কাল কুহকিনী চলে        অবাধ গতির ছলে

অনন্তের পথে

নিত্য নূতনত্ব দিয়ে        জীব মন ভুলাইয়ে

চলে অব্যাহতে।।

রানত কাঁদি যায়         কেহ ফিরে নাহি চায়

নূতন আনন্দে

আহা কর বড় ভুল         কেহ নাহি বুঝে স্থুল

নূতনের ছন্দে।।

আজিকের নূতন যাহা     কাল পুরাতন তাহা

ইহা মিথ্যা নয়

আজিকার যে নতুন       কালি সাজে পুরাতন

কাল গর্ভে ধায়।।

আদি অন্ত একাকার        বালবৃদ্ধ যে প্রকার

একত্ব স্বভাবে

লোক মুখে শুনি তাই      বুড়া গুড়া ভেদ নাই

কাজে কিংবা ভাবে।।

যেই পুরাতন ফেলি        আর্য চলে পথ ভুলি

সেই সে প্রাচীনে

মিশাবে জীবনে যবে      পুনঃ হিন্দু আর্য হবে

আপন জীবনে।।

কূট তর্কবাদী যারা         নিশ্চয় বলিবে তারা

দিয়ে করতালি

পুরাকালে কিবা ছিল    সকলি তো জানি ভাল

শুন তবে বলি

কর্মশক্তি ছিল কম        তাই নাকে পূরে দম

তপস্যা করিত

আকাশ কুসুম যাহা        যত্ন করে পেতে তাহা

হাত বাড়াইত।।

অনন্ত অসীম যিনি         রূপ নাকি ধরেতিনি

দিত দরশন

মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে     ভোজ ভেল্কি দেখা পেয়ে

কহিত বচন।।

গণ্ডি বদ্ধ হয়ে র       কূপ মণ্ডুকের মত

দেশ ভাবে বিশ্ব

বিজ্ঞানের আলোচনা      কেহ কিছু জানিত না

এমনি রহস্য।।

দাস্য ভাব ছিল ভারী      ব্রাহ্মণের পদতরী

করিত সম্বল

অন্ধ যুগ পুরাকাল          বর্ত্তমান শ্রেষ্ঠ কাল

প্রধান সকল।।

নর আজ সুখী কত        সুখে কাল হয় গত

জীবনে মরণে

নাহি কোন অত্যাচার      মান্যামান্য পরস্পর

আছে সর্ব্বখানে।।

বিজ্ঞানের কি উন্নতি       জলে স্থলে সদা গতি

করিছে মানব

সবে মিলি গড়ে নীতি     বল দর্পী হতে ভীতি

গেছে চলে সব।।

আপামর সর্বজনে          শিক্ষা পায় সর্বস্থানে

নাহি বাধাবিঘ্ন

সাম্যনীতি ঘরে ঘরে       পালিতেছে নারী নরে

জীবন যাত্রা স্নিগ্ধ।।

আদি, ব্যাধি, জ্বরা তৃষ্ণা সবে আজি ভগ্ন আশা

বিজ্ঞানের গুণে

উদার ধর্মের নীতি         পালিছে সবারে নিতি

সম দরশনে।।

শুনিতে মধুর বটে         তর্কবাদী যাহা রটে

সদা বাহ্য দৃশ্যে

বিচার করিলে মূলে        ধরা যায় সব ভূলে

জানিবে অবশ্যে।।

অধুনা কালের গতি        যতকিছু রতিনীতি

কিবা পরিনাম

ইন্দ্রিয় পোষণ লাগি       নর আছে সদা জাগি

তাই মোক্ষধাম।।

ঘুরিয়া সুখের পাছে      সুখ মোহে পরে আছে

নর নারী যত

সকলের অত্যাচার         কোথায় অভাব তার

কোথা সাম্য মত।।

অসংযত ইন্দ্রিয়াদি        আনিয়াছে মহাব্যাধি

ভোগ তৃষ্ণা পথে

ভোগে আনে মহাভোগ    দারুণ বিষয় রোগ

ঘিরিছে জগতে।।

যাহা আছে তাহা ছাই     আর সুখ ভোগ চাই

নরনারী কহে

বল দর্পী পদ তলে        কত জন ভূমণ্ডলে

দুঃখ জ্বালা সহে।।

বিজ্ঞানের যে উন্নতি      কিবা করিছে সম্প্রতি

মারনাস্ত্র গড়ে

অস্ত্রে যেই বলবান         হয়ে যেন হতজ্ঞান

পররাজ্যে পড়ে।।

অসুর স্বভাবে তাই      দিকে দিকে দেখি তাই

শুধু অত্যাচার

রাজ্যে রাজ্যে রাজে রাজে শুধু হিংসা ধ্বনি বাজে

ভীষণ আকার।।

ধর্মনীতি সুসরল           কোথায় দেখেছে বল

বর্তমান কালে

ধর্মান্ধ পশু যে কত        ধর্মপীঠ করে হত

অতি কতুহলে।।

শিক্ষা নাকি সর্বঠাঁই       কিবা শিক্ষা পায় ছাই

জীবন গঠনে

ভোগবাহী শিক্ষা দিয়ে    সুখ শান্তি দূর করে

ডাকে যে মরণে।।

জুয়াচুরি ধাপ্পাবাজী       ঘরে ঘরে দেখি আজি

পেতেছে সন্মান

ধর্মকথা তুচ্ছ অতি        ধর্ম দুর্বলের নীতি

করে উচ্চারণ।।

নিত্য নব সুখ পায়        প্রাণ কিন্তু না জুড়ায়

আছে শূন্য হয়ে

ত্যাগে যে মহান শান্তি    নরে কহে তাহে ভ্রান্তি

সুখেরে চাহিয়ে।।

ভোগের বিজ্ঞান নিয়ে     শান্তি গেছে দূর হয়ে

অন্তরে কাঙ্গাল

বাহ্য দৃশ্যে বড় ভাল      অন্তরে নিবিড় কাল

মাকালের ফল।।

তাই বলি শুন ভাই        এ পথে যে শান্তি নাই

জীবের জীবনে

জীবের শান্তির লাগি      আর্য হল সর্বত্যাগী

শুদ্ধ তপোবনে।।

সাধনে চিনিয়া আত্মা      বিশ্বে দিল মহাবার্তা

ধর্ম জাগরণে

ধর্মকে করিয়া ভিত্তি      তাহে গড়ে সর্বনীতি

জীবের জীবনে।।

আর্য ঋষি সাধনাতে       আদি যুগে এ ভারতে

কহিল বারতা

গৃহী কি সন্ন্যাসী হও      পাবে সব যাহা চাও

দূরে যাবে ব্যথা।।

সেই মূল তত্ত্ব হতে       প্রচারিল এ জগতে

বর্ণাশ্রম ধর্ম

তাহা হতে উচ্চতর        কেহ বলে নাহি আর

জীবনের মর্ম।।

বলিয়াছি ইতিপূর্বে        যত অবতার সর্বে

কি কাজ করিল

কালচক্রে ব্যাভিচারী      এ জগতে নরনারী

সবারে কহিল।।

যুগ ধর্ম মতে সবে       রহ পবিত্র স্বভাবে

ভ্রান্ত পথ ছাড়ি

নূতনের সহকারে         প্রতিবার অবতারে

গেল ধর্ম গড়ি।।

নূতন চালিয়ে যায়        যুগ ধর্ম লোপ হয়

অসত্যের চাপে

মূল ছাড়ি ধরি ডাল       চলিয়াছে এতকাল

পরধর্ম ছাপে।।

তাই হরিচাঁদ বলে         জগতের জীবকুলে

গম্ভীর নিনাদে

শুন শুন জীব কুল         এতদিন করি ভুল

পরেছে বিপদে।।

পড়ি কাল চক্রতলে       মূল তত্ত্ব গেছ ভুলে

মানবের ধর্ম

যদ্যপি উদ্ধার চাও        আর্য নীতি মানি লও

কর আর্য কর্ম।।

মানবব জীবন পথে       আর্য ঋষি ধর্ম হতে

নাহি কিছু শ্রেষ্ঠ

মানব জীবনটাকে       বাটি চারিটি স্তবকে

অতীব উৎকৃষ্ট।।

সংযম সাধনা করি       হয়ে মহা শক্তি ধারী

গড়িবে সংসার

সুকর্মে সংসার ধর্ম        পালিতে কর্তব্য কর্ম

বিধানে তাহার।।

যবে কর্ম শেষ হয়         সাধনেতে মন ধায়

উদ্ধার কারণে

পূর্ণ সাধনেতে তবে        মনে পূর্ণ শান্তি পাবে

শ্রী হরি সাধনে।।

এ আদর্শ কোথা পাই      হরিচাঁদে দেখে তাই

বসি রাত্রি দিনে

দেখে গুরুচাঁদ ভিন্ন         ইহা সাধ্য নহে অন্য

দিতে জীবগনে।।

গুরুচাঁদে বলে তাই        “মূল নীতি মানা চাই

তোমার জীবনে

তোমাকে আদর্শ করি     জগতের নরনারী

পড়িবে চরণে।।

আগে কর বিদ্যাভাস      রিপুদলে কর নাশ

পরেতে গৃহস্থ

বিষয় বাসনা ছাড়ি        বল সবে হরি হরি

শেষে বানপ্রস্থ।।

এই নীতি পালে যেই      শান্তি ধামে রহে সেই

পরম আহ্লাদে

চলিতে জীবন পথে       দুঃখ নাই কোন মতে

শান্তি পদে পদে।।

আপন জীবনে তাই       এই ধর্ম রাখা চাই

বিশেষ যতনে

তোমারে দেখিয়ে সবে    এই ধর্ম শিক্ষা পাবে

আপন জীবনে।।

পিতৃ মুখে শুনি তত্ত্ব       মানব জীবনামৃত

মঙ্গল মধুর।।

গুরুচাঁদ প্রাণপণে           সেই শুদ্ধ তত্ত্ব মানে

ভোগ করি দূর।।

সেই কথা ক্রমে ক্রমে     প্রকাশিব গুরুনামে

পরম পবিত্র

মতুয়া ভক্তের দয়া        গোপালের পদছায়া

বাঞ্ছা এই মাত্র।।

 

গার্হস্থ্য সন্ন্যাসী

 

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়’-

রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর

 

পিতৃ আজ্ঞা গুরুচাঁদ শিরোধার্য করি

সংসারের ভার নেয় নিজ স্কন্ধোপরি।।

ক্ষণে ক্ষণে ভক্ত গৃহে যায় পিতৃসাথে

ভক্তের চরিত্র দেখে প্রেমানন্দ চিতে।।

গম্ভীর প্রকৃতি প্রভু নাহি চপলতা

চলে যেন সিংহ শিশু দৃঢ় একাগ্রতা।।

ঘন কৃষ্ণ কেশ দাম লম্বিত মস্তকে

ধূর্জ্জটীর জটাসম দোলে থাকে থাকে।।

গৌরাঙ্গ বরণ কান্তি সূর্য সম প্রভা

কুসুম কোরক জিনি বয়ানের আভা।।

মহা তেজোময় হেরি নয়নের জ্যোতিঃ

দৃষ্টি মাত্র পাপী প্রাণে জাগে মহাভীতি।।

ভাবময় ভক্ত যত প্রেমানন্দ ভরে

গুরুচাঁদে হেরি তেঁহ আঁখি বারি ঝরে।।

সবাসঙ্গে মিশে প্রভু নাহি কোন ভেদ

তবু আচরণে দেখি অনেক প্রভেদ।।

হংস যথা বারি মধ্যে পুলকে ভ্রময়

বারি মধ্যে ডুবে ভাসে আনন্দে খেলায়।।

বারি হতে কূলে যবে সেই হংস ধায়

এক বিন্দু বারি দেহে নাহি দেখা যায়।।

বারিকে আধার করি করে জলক্রীড়া

বারিতে সম্বন্ধ নাহি, সত্ত্বা বারি ছাড়া।।

দেহ মধ্যে আত্মা যথা জীব কালে রয়

আত্মা খেলে তাই দেহ চলিয়া বেড়ায়।।

জীর্ণ বস্ত্র সম দেহ ফেলি আত্মা যায়

নিশ্চল পতিত দেহ মাটিতে লুটায়।।

দেহেতে সম্বন্ধ আত্মা কিছু নাহি রাখে

বিশ্রামের ঘরভাবে কিছুকাল থাকে

বিহায় কায়ং নির্লক্ষ্যং পতিতং নৈব পশ্যতি

তথাঃ--

সহবর্দ্ধি তয়োর্নাস্তি সম্বন্ধঃ প্রাণ দেহয়োঃ।।

ভূমি খণ্ড

সেই ভাবে গুরুচাঁদ মিশে সবা সঙ্গে

আপনাতে রহে ডুবি আপন তরঙ্গে।।

শ্রী গোলক হীরামন, সাধু মৃত্যুঞ্জয়

গুরুচাঁদে মান্য তারা করে অতিশয়।।

ইহ সঙ্গে গুরুচাঁদ করয়ে সম্প্রতি

ভাবালাপ করে সদা এদের সংহতি।।

যবে গৃহে রহে থাকে একক হইয়া

বাহির বাটিতে রাত্রি বিনিদ্র কাটিয়া।।

গভীর নিশীতে করে একা পরিক্রম

কভু বৃক্ষ তলে বসি দৃষ্টি করে ব্যোম।।

নির্ভয় উদার চিত্তে গাঢ় নিশাকালে

আপনার ভাবে ডুবি মাঠ মধ্যে চলে।।

পিতা যবে গৃহে আসে ভকত সংহতি

আহারাদি সুব্যাবস্থা করে শীঘ্র গতি।।

পিতার অগ্রেতে প্রায় কভু নাহি যায়

দূরে রহি প্রীতি কার্য সকল করয়।।

ইচ্ছামত পিতা যদি কভু ডাকি লয়

পিতার প্রীতার্থে সব মনন কহয়।।

দিনভরি করে প্রভু গৃহস্থালী কর্ম

ঠিক যেন ব্রতচারী পালে ব্রতধর্ম।।

আলস্য নাহিক কভু কোন কার্য লাগি

রাত্রে অল্প নিদ্রা যায় বেশি রহে জাগি।।

হাসি গল্প রসালাপ কিছু মাত্র নাই

দূরে দূরে পাপি সব রহিত সবাই।।

এইভাবে গুরুচাঁদ পিতৃ বাক্য রাখে

শুন দেবী সত্যভামা কি ভাবেতে থাকে।।

শান্তি দেবী জননী সদা সেবা করে

গৃহস্থালী কর্ম করে আনন্দ অন্তরে।।

কোন কর্ম করিবারে শান্তি দেবী ধায়

হাত হতে সত্যভামা তাহা কাড়ি লয়।।

হাসিয়া বধূকে মাতা কত করে রোষ

এইটুকু কাজ করা কিসে মোর দোষ।।

একেত বালিকা তুমি তাহে আদরিণী

সব কাজ একা তুমি পার না জননী।।

কৃত্রিম রোষের ছলে মাতা এই বলে

সত্যভামা দেবী তাহে বলে কতূহলে।।

তোমার চরণে দাসী আমি যবে আছি

সকল কাজের ভার আপনি নিয়েছি।।

আমি তব কন্যা দেবী বলিনু নিশ্চিত

তব সেবা করে মনে হই বড় প্রীত।।

কর্মেতে আনন্দ মোর জান ঠাকুরাণী

আমাকে বঞ্চিত করে হয়ো না পাষাণী।।

তোমার প্রীতিতে মোর জনম সফল

তব আশির্বাদ হয় মোর মহাবল।।

পিত্রালয়ে যেতে তাঁর নাহি লয় মন

বর্ণে বর্ণে হরি-বাক্য করিছে পালন।।

যখন গৃহেতে ফিরে প্রভু হরিশ্চন্দ্র

যতনে পূজেন দেবী চরণার বিন্দ।।

তাহে তুষ্ট হরিচাঁদ বলিত হাসিয়া

ঘরে ছিলে পাষাণী মা কেমন করিয়া।।

এবে পুত্র মুখ দেখি কতই উতলা

মোরে ছেড়ে দিয়ে ঘরে কেমনে রহিলা।।

শ্রী হরির মুখে শুনি মধুময় বাণী

প্রভুকে বলিত কথা করি জোড় পাণি।।

পাষাণের মেয়ে আমি স্বভাবে পাষাণী

তোমা হেন গুণনিধি তাই নাহি চিনি।।

তোমাকে চিনিতে তাতঃ পারিতাম যদি

তোমাকে পাহারা দিতাম বসে নিরবধি।।

মোর পক্ষে তুমি বটে রয়েছ অচেনা

তোমাকে চিনেছে যত ভকত ললনা।।

তারা সবে মন তব করিয়াছে চুরি

পাষাণী মা ফেলে তাই রহ তেঁহ বাড়ি।।

কথা শুনি হরিমণি আনন্দ পাইল

শিরে হাত রাখি তাঁর আশীষ করিল।।

বলে মাগো তুমি মোরে হারায়েছ আজ

কিছু দিন সেবা লব থাকি গৃহ মাঝ।।

অন্নপূর্ণা তুমি মাগো আছ এই ঘরে

নিত্য সুখে অন্ন বাটি দিবে তুমি মোরে।।

এই ভবে মহাদেবী পালে নিজ ধর্ম

নাহি জানে হাসি, কলা, চটুলার কর্ম।।

স্বামীর মঙ্গল চিন্তা করে দিবা রাতি

হরিপদে বর মাগে করিয়া প্রণতি।।

স্বামী হতে দূরে বটে রাখে নিজ দেহ

মনে প্রাণে স্বামী পদে সীমাহীন স্নেহ।।

বয়সে বালিকা বটে কর্মেতে গৃহিণী

ধীর পদে যাতায়াত মধুর ভাষিণী।।

গুরুচাঁদ সত্যভামা শঙ্কর শঙ্করী

রূপে গুণে সর্বাতীত নর দেহ ধারী।।

তাঁদের গুণের কথা অসীম অনন্ত

কেবা কি বলিতে পারে যার নাই অন্ত।।

পথভ্রষ্ট নর কুলে দেখাইতে পথ

পাপীরে দণ্ডিতে আর রাখিবারে সৎ।।

আপন জীবনে পালি যাহা শ্রেষ্ঠ ধর্ম

নর রূপে নর মাঝে করে সেই কর্ম।।

মনে প্রাণে যেই মানে প্রভুর আদর্শ

দেবতা বাঞ্ছিত শান্তি পেয়ে মহাহর্ষ।।

আদি জন্ম পরে বিদ্যা বালক বয়সে

বিদ্যা শেষে ব্রহ্মচর্য পালিল বিশেষে।।

আদর্শ গার্হস্থ্য নীতি পরে করে সার

বংশ রক্ষা ধনার্জন পবিত্র আচার।।

সুশিক্ষা আত্মজগণে সমাজ সংস্কার

মূঢ় অন্ধ নরগণে করিলা উদ্ধার।।

রাজ শক্তি সহযোগে জাতির কল্যাণ

জ্ঞান দানে গড়ি তোলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।।

রাজ কার্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা বাড়িল

হীন মান হীন আখ্যা দূর করি দিল।।

অর্থনীতি শাস্ত্রনীতি শিল্প ব্যবসায়

রাজনীতি ধর্মনীতি সকলি শিখায়।।

দূর্নীতি দূরত্ব যত সমাজেতে ছিল

বজ্রদণ্ড দানে সব দূর করি দিল।।

এমত প্রকারে গড়ি সমাজ জীবন

পিতৃ ধর্ম ঘরে ঘরে করে বিতরণ।।

বিনিদ্র রজনী কাটে ধর্ম আলাপনে

দয়া দণ্ডে শুদ্ধ করে যত ভক্ত গণে।।

ভক্ত মন উল্লাসিতে ভক্ত গৃহে যায়

যথা যায় তথাকারে সর্ব্বনীতি কয়।।

ধর্ম কর্ম শুদ্ধাচার পবিত্র চরিত্র

ধীর হও সাধু হওবলে যত্র তত্র।।

পৃথিবী ভরিয়া দিতে নিজ জাতি নাম

অবিরাম আন্দোলন নাহিক বিশ্রাম।।

নিজ পৌত্র গণে তবে লণ্ডনে পাঠা

কিছুই অসাধ্য নহে এই শিক্ষা দিল।।

প্রথমে বিলাতে দিয়া নিজ পৌত্রগণে

অসীম সাহস দিল জাতির পরাণে।।

এ জাতির নাম গেল পৃথিবী ভরিয়া

প্রমথ রঞ্জন এল ব্যারিষ্টার হৈয়া।।

উত্তর সাধক ধন্য প্রমথ রঞ্জন

দেশ বাসী জনে গণে করেছে রঞ্জন।।

তেঁহ আগমন দেখি আনন্দ লভিল

কর্ম কাণ্ড ছাড়ি প্রভু আত্ম কাণ্ডে গেল।।

অহর্নিশি অবিরাম কহে হরি কথা

বিনা মূল্যে দেয় ফল মোক্ষ ফল দাতা।।

উত্তর আয়ণে প্রভু গেল নিজ লোকে

প্রমথ রঞ্জন মাঝে শক্তি গেল রেখে।।

গোপাল চাঁদের পদ মনে করি সার

ক্রমে ক্রমে এই সব করিব বিস্তার।।

হাতে কাজ মুখে নাম মতুয়ার রীতি

হরি-গুরুচাঁদ বিনে ভবে নাই গতি।।

 

পুত্র কন্যাদির জন্মগ্রহণ ও তাঁহাদিগের চরিত্র মাহাত্ম্য বর্ণন

বন্দনা

 

জগৎ তারণ প্রভু শ্রী হরি ঠাকুর

ওড়াকান্দী করে লীলা মধুর মধুর।।

যে আতুর দুঃখী জনে ইতিপূর্বে কেহ

কোন দিনে কোন ভাবে করে নাই স্নেহ।।

সেই ব্যথিতের দুঃখে বড় দুঃখী হৈয়া

হরিচাঁদ অবর্তীর্ণ সাঙ্গ পাঙ্গ লৈয়া।।

তেঁহ কার্যে তেঁহ পুত্র প্রভু গুরুচাঁদ

পূর্ণ করি দীনজনে দিলা প্রেমাহ্লাদ।।

পবিত্র গৃহীর ধর্ম আপন জীবনে

আপনি পালিলা প্রভু জীবের কল্যাণে।।

তেঁহ কার্য সহযোগে দেবকুল যত

তেঁহ বংশে জন্ম নিল সাজি সুতাসুত।।

ধন্য শ্রী শশী ভূষণ বংশ শ্রেষ্ঠ যেই

তস্য গুণে মুগ্ধ সদা আঁছিল সবাই।।

পিতৃ কার্যে তেঁহ চেষ্টা সবার অধিক

উদার চরিত্র বান সত্যেতে নির্ভীক।।

জয় সুধন্য কুমার দ্বিতীয় নন্দন

বিনয়ের অবতারমধুর বচন।।

তেঁহ হরি পদে সদা নয়ন রাখিলা

হরিচাঁদ লীলাগীতি কতই লিখিলা।।

কন্দর্প মোহন কান্তি শ্রী উপেন্দ্র নাথ

তেঁহ নিত্য রহে সদা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাথ।।

বহু গুণী সুরেন্দ্রনাথের জয় জয়

সমাজ উন্নতি লাগি চিন্তা সদা রয়।।

করুণা রূপিণী দেবী শ্রী করুণা ময়ী

প্রভু কন্যা সতী ধন্যা পদে নত হই।।

গুরু গোপালের পদ মনে করি সার

এদের পবিত্র লীলা করিব প্রচার।।

 

প্রস্তাবনা

ষষ্ঠ বর্ষ পালে প্রভু কঠোর সংযম

বিংশতি বরষ হল এবে বয়ঃক্রম।।

পিতৃ আজ্ঞা অনুক্রমে এ সময় হতে

কিছুকাল বাস করে পত্নির সহিতে।।

পতি সতী উভয়ের দৃঢ় ব্রহ্মচর্য

উভয়ের তেজস্বী যথা মধ্যাহ্নের সূর্য।।

আদর্শ দম্পতি দেখি যত নারী নরে

দণ্ড বৎ করে পদে অবনত শীরে।।

সবে বলে কিমাশ্চর্য সাধনা গভীর

দুরন্ত যৌবন কালে দোঁহে ধীর স্থির।।

নিশ্চয় মনুষ্য নহে এ দেব দম্পতি

জীব তরাইতে হল ধরাপরে স্থিতি।।

কেহ বলে এই বাক্য কিসের সন্দেহ

দেব বিনা এই ঘরে আসে নাকি কেহ।।

পূর্ণ ব্রহ্ম হরিচাঁদ এল যেই ঘরে

সেই ঘরে দেব বিনা কে আসিতে পারে।।

এ সব হরির খেলাকেহ বলে কান্দি

তাঁর কৃপা গুণে হল তীর্থ ওড়াকান্দী।।

যাহার যে ভাব মনে সেই ভাবে কয়

এ সব আলাপে প্রভু কান নাহি দেয়।।

পিতৃ আজ্ঞা অনুসারে বংশ রক্ষা করে

ক্রমে চারি পুত্র এক কন্যা জন্ম ধরে।।

জগৎ তারিতে এল হরি-গুরুচাঁদ

পেয়ে চাঁদ শ্রী গোপাল পাইল আহ্লাদ।।

 

সংসার ক্ষেত্রে শ্রী গুরুচাঁদ

গুরুচাঁদে দিয়া ভার হরিচাঁদ বিভু

সংসারের পর দৃষ্টি না করিত কভু।।

বয়সে বালক মাত্র যৌবনে উন্মেষ

গুরুচাঁদ গৃহাশ্রমে করিল প্রবেশ।।

পূর্ণ লক্ষ্মী শান্তি মাতা দেয় পরামর্শ

সংসার চালায় প্রভু মনে হয়ে হর্ষ।।

ভক্তগণ কত দ্রব্য হরিচাঁদে দেয়

তার প্রতি হরিচাঁদ দৃষ্টি না ফিরায়।।

তবে ভক্তগণে জুটি সব দ্রব্য আনি

রাখি দেয় যথা রয় জগৎ জননী।।

শ্রী গুরুচাঁদের দেখি অপার মহিমা

বাঞ্ছা কল্পতরু প্রভু গুণে নাহি সীমা।।

ভক্ত দত্ত দ্রব্য প্রতি কভু দৃষ্টি নাই

কায় ক্লেশে আনি অর্থসদা ভাবে তাই।।

একদিন শান্তি দেবী পরীক্ষা কারণে

হাসিয়া জিজ্ঞাসে কথা গুরুচাঁদ স্থানে।।

প্রাণাধিক গুরুচাঁদ, শুন মম কথা

অর্থ পেতে এত চেষ্টা কর কেন বৃথা।।

তোমার পিতার গুণে দেখ বাছা মোর

অভাব গিয়াছে দূর কেটে গেছে ঘোর।।

যাহা আসে তাতে সুখে দিন চলি যায়

এত কষ্ট কর কেন কিবা এত দায়।।

মাতার মনন বুঝি প্রভু কন হাসি

ভালই শুনিনু মাতা তব বাক্য রাশি।।

বল দেখি জননীগো সবে কোন গুণে

এনে দেয় এত দ্রব্য তোমার ভবনে।।

কোন বৃক্ষে এত ফল ধরে গো জননী

হরি-কল্প-বৃক্ষে ফল ফলে যে আপনি।।

কল্প বৃক্ষ মূলে মোর পিতা হরিচাঁদ

অফলা জমিতে যিনি করিল আবাদ।।

তার গুণে আসে ফল, ফল তাঁরে চায়

নিজে নিজে এসে ফল পরে তাঁর পায়।।

ফল মূল তুচ্ছ কথা তোমাদের ঠাঁই

যাঁরে পূজে ব্রহ্মা বিষ্ণু তাঁর তুল্য নাই।।

তাঁহার ঘরণী তুমি জননী আমার

আমাকে পরীক্ষা করা কিবা দরকার।।

তারিতে জগৎ জীবে আসিয়াছ দোঁহে

তোমা না চিনিল জীব ভুলে মায়া মোহে।।

তোমাদের খেলা যবে শেষ হয়ে যাবে

শূন্য ঘরে বলো মাগো ফল কে আনিবে।।

আমি চাই চেষ্টা করি সংসার গড়াতে

আমার যে হবে মাগো কাজ করে খেতে।।

এত যদি বলে প্রভু মাতা হাসি কয়

তব বাক্যে বাছা মোর ঘুচিল সংশয়।।

যে ভাব তোমার মনে তাই যেন থাকে

অভাব কখনো বাছা ছোবেনা তোমাকে।।

আর আশির্বাদ করি শুন বাছাধন

তব ঘরে দিবে লোকে দ্রব্য অগণন।।

তোমাতে বড়ই প্রীত জনক তোমার

আমিও পরম তুষ্ট এই জান সার।।

ভবিষ্যৎ জানিবারে বাঞ্ছা যদি মনে

কল্য প্রাতে দেখিবে তা নিজের নয়নে।।

এত বলি শান্তি মাতা গৃহ কার্যে গেল

কল্য কি দেখিবপ্রভু ভাবিতে লাগিল।।

 

ভবিষ্যৎ দর্শন

“Behold! The lord hath unveiled the future”-- The Holy Bible

 

ভক্ত গৃহে হরিচাঁদ         সাঙ্গ করি প্রেমাহ্লাদ

সেই দিনে ওড়াকান্দী ধামে ফিরি এল

নামেতে ভবানী বুড়ি      নড়াইল তার বাড়ী

প্রভু সঙ্গে শ্রীধামেতে উপনীত হ।।

ভক্তি মতি অতিশয়       তাঁর গুণে বাধ্য রয়

হরিচাঁদ প্রভু মোর ক্ষীরোদ ঈশ্বর

মনোগত বহুকথা          ভবানী বলিত তথা

ভক্তি গুণে প্রভু করে বাঞ্ছা পূর্ণ তাঁর।।

যেদিন আসিল ধামে      যামিনির শেষ যামে

প্রভু পদ কাছে বসি করে পদ সেবা

কি জানি কি ভাবি মনে   চাহিয়া প্রভুর পানে

বলে এক কথা মোর মনে ওঠে বাবা।।

তোমার সোনার ধাম      ধাম মধ্যে সর্বোত্তম

শিব লোক ব্রহ্ম লোক ধন্য সব হতে

এমন পবিত্র ধামে         তোমার পবিত্র নামে

কবে বিশ্ববাসী আসি মাতিবে নামেতে।।

আমার যে ইচ্ছা হয়       শুন ওহে দয়াময়

এই ধামে হত যদি ধর্ম্ম মহামেলা

দলে দলে সাধুগণ         করে যদি আগমন

নাম রসে মেতে সবে করে প্রেম খেলা।।

চারিদিকে শুনি কত       মেলা মিলে শত শত

ধর্ম মেলা তার মধ্যে মিলে নানা দেশে

সবা হতে উচ্চভাব         তোমার মধুর ভাব

হেথা কেন মিলালেনা মেলা সবিশেষে।।

ভবানির কথা শুনি         ভবেশের শিরোমণি

কৃপা করি কহিলেন বাক্য সুমধুর

শুন শুন মা ভবানী       তব ইচ্ছা আমি জানি

পূরাব তোমার ইচ্ছা চিন্তা কর দূর।।

চল বর্হিবাটী যাই          চেয় দেখ রাত্রি নাই

প্রভাতের পূর্বে তুমি দেখিবে স্বচক্ষে

ভবিষ্যতে এই ধামে    যে মেলা মিলিবে ক্রমে

সেই দৃশ্য দেখ তুমি ভক্তগণ পক্ষে।।

ইহা কেহ দেখে নাই       কার কাছে কহি নাই

নিজ কন্যা বলি তোমা এ দৃশ্য দেখাই

কোথা কিছু না বলিবে     সব গোপনে রাখিবে

আমি গেলে বল সবে বাধা কিছু নাই।।

এত বলি দ্রুত গতি       ক্ষীরোদ বাসিনী পতি

ভবানীকে সঙ্গে করি প্রাঙ্গণে আসিল

পদ্ম হস্ত চক্ষে দিয়ে       ভবানিকে সম্বোধিয়ে

বলে কন্যা চেয় দেখ কিবা দৃশ্য হল।।

পদ্ম স্পর্শ পেয়ে চোখে    ভবানী চাহিয়া দেখে

ওড়াকান্দী যেন আর ওড়াকান্দী নাই

উত্তাল তরঙ্গ প্রায়         চতুর্দিকে শব্দ হয়

অগণন নরগণ জুড়ি সর্ব ঠাঁই।।

উন্নত ইষ্ট কালয়        শ্রীধাম জুড়িয়া রয়

হ্রদের আকারে দেখে তড়াগ নিচয়

শ্রী পুরীর পুরোভাগে       অমল ধবল রাগে

সুউচ্চ মন্দির শীর্ষ দাঁড়াইয়া রয়।।

লোহিত পতাকা উড়ে     মন্দিরের শীর্ষ চূড়ে

শঙ্খ শিঙ্গা ডঙ্কা কাংশ বাজে হুহুঙ্কারে

অসংখ্য মতুয়া ভক্ত     নামে গানে প্রেমে মত্ত

বাহু তুলি নৃত্য করে মধুর ঝঙ্কারে।।

যত দূর দৃষ্টি যায়          লোকারণ্য ময় ময়

চলে ছুটে বালবৃদ্ধ যুবক যুবতী

নরস্রোত অবিরাম         চলে ওড়াকান্দী ধাম

কন্ঠে কন্ঠে ওঠে ধ্বনি হরিনাম গীতি।।

শ্রীধামের পাদ মূলে       ক্রোশ জুড়ি সর্বস্থলে

অসংখ্য দোকানী বসে দোকান খুলিয়া

যাহা চাই তাহা পাই   “নাইকথা মোটে নাই

পৃথিবী এনেছে যেন উজার করিয়া।।

খাদ্য দ্রব্য বাদ্য দ্রব্য       বসন ভূষণ দ্রব্য

খেলা ধুলা দ্রব্য কত রাখে সাজাইয়া

ব্রতচারী মঠাচারী          দলে দলে সারি সারি

গলি গলি ভিক্ষা করে খোল বাজাইয়া।।

মিলেছে মোহন মেলা    সিংহ ব্যাঘ্র জন্তু খেলা

দলে দলে তাবু ফেলি করে প্রদর্শন

বাজীকর জুয়াচোর     লোভী, দ্বেষী আর চোর

মেলাতে নাহিক স্থান সব অদর্শন।।

নাহি কোন দরাদরি        এক বাক্য রাখে ধরি

জয় হরিচাঁদধ্বনি সাথে সাথে তার

শ্রী হরির প্রেমের খেলা   আসে যত দেল খোলা

মন খাঁটি রেখে সবে করিছে বাজার।।

শাসন লাগেনা তথা       আপনি নোয়ায় মাথা

কে যেন আড়ালে থাকি সকলে চালায়

অধিকার খর্ব করি          যম এসে বলে হরি

হরিভক্ত পদ ধুলি মাখে সর্ব গায়।।

শ্রীধাম প্রাঙ্গণ পরে        অবিরাম উচ্চৈঃস্বরে

হরি বলি ভক্ত দলে ধুলিতে গড়ায়

ভুলি তৃষ্ণা ভুলি ক্ষুধা     নয়নের জলে কাঁদা

শ্রীধামের ধুলি তুলি ভক্তে মাখে গায়।।

ভাসিয়া নয়ন জলে        অগনিত বামাদলে

হুলুধ্বনি দেয় সবে রহিয়া রহিয়া

সবার অলক্ষ্যে থাকি      করুণ কোমল আঁখি

ভক্তে দেখে শান্তি মাতা চাহিয়া চাহিয়া।।

শ্রী নাট মন্দির ঘরে        রত্ন সিংহাসন পরে

পবিত্র আসন এক করিছে বিস্তার

মনে হয় কোন রাজা      শক্তিমন্ত মহাতেজা

তেঁহ আসি বসিবেন আসন উপর।।

সকলি আশ্চর্য গণি        জ্ঞান হারা সে ভবানী

দ্রুত পদে ছুটী চলে বাড়ীর ভিতরে

পথে দেখে আগুয়ান       মহাপ্রভু গুরুচাঁন

আনন্দে মাতিয়া দেবী বলিল তাঁহারে।।

ওরে দাদা এস ছুটে      অপূর্ব ঘটনা ঘটে

বাবার দয়াতে দেখ ওড়াকান্দী পুরে

বড় দুঃখ মোর মনে       তত্ত্ব কেহ নাহি জানে

তুমি মাত্র যোগ্য দেখি জগতের পরে।।

দুর্ভাগা জগত বাসী        দেখিল না কেহ আসি

কোটি স্বর্গ আছে মিশি এই পুণ্য ধামে

যক্ষ রক্ষ দেবগণ          আসিয়াছে অগণন

সকলে মেতেছে আজি হরিচাঁদনামে।।

চল চল শীঘ্র করি কি     খেলা খেলিছে হরি

দেখিবারে চাও যদি বিলম্ব না কর

মিলেছে প্রেমের মেলা    মর্তে দেখ স্বর্গ খোলা

বাবার চরণ ছুঁলে দেখিবারে পার।।

ভবানীর কথা শুনি         গুরুচাঁদ গুণমনি

ত্বরিতে চলিল যথা হরিচাঁদ বসে

শ্রীপদে প্রণত হয়ে         পদধূলি শিরে নিয়ে

কর জোড়ে দাঁড়াইল পিতৃপার্শ্বে এসে।।

নয়ন না পালটিতে        দেখে প্রভু চারিভিতে

অভূত অপূর্ব যত মহা দৃশ্যাবলী

অজানা অচেনা যেন       মনে হয় অনুমান

মর্ত্তে ছাড়ি স্বর্গ হতে আর উর্দ্ধলোকে

মিলিছে বিপুল মেলা      কি যেন অনন্ত খেলা

জয় জয় ধ্বনি শুধু শুধু চারিদিকে।।

অপলক দৃষ্টি মেলি        গুরুচাঁদ মহাবলী

অভূত অপূর্ব্ব লীলা দেখে দাঁড়াইয়া

মুখচন্দে কথা নাই         নয়নে পলক নাই

দেখিছে পিতার লীলা নয়ন ভরিয়া।।

দেশ কাল পাত্র মাত্র       মনে কিছু নাহি মাত্র

একাকী চলিছে যেন অকূল সাগরে

জ্যোতিষ্মান সূর্য প্রায়      হরিচাঁদ শোভা পায়

তাঁহে লক্ষ্য করি সবে ভাসে প্রেম নীরে।।

দেখিলা চৌদিক হতে    সবে পুষ্পাঞ্জলি হাতে

নরাকারে জ্যোতির্ম্ময় পুরুষ রমণী

গললগ্নী কৃতবাসে      আসিয়া শ্রী হরির পাশে

পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে পদে লোটায় ধরণী।।

করজোরে করে স্তব      দেব দেবী সেই সব

হরিচাঁদ প্রতি চাহে সজল নয়নে

পরে গুরুচাঁদ প্রতি         করিয়া ভূমিতে নতি

মন্দ গতি চলে সবে গগনের পানে।।

দীর্ঘ শ্মশ্রু দীর্ঘ কেশ       পুণ্য ময় শুদ্ধ বেশ

মুনি ঋষি এল সবে পতাকা বহিয়া

সবে করে হরিধ্বনি       কাঁপে যেন ধরারাণী

মতুয়ার বেশে সবে আইল ধাইয়া।।

বজ্র কণ্ঠে করে নাম       সর্ব দেহে ঝড়ে ঘাম

লক্ষ্য মাত্র প্রাণারাম হরি গুণমণি

রামাগণ বামা কণ্ঠে        হুলু দেয় দণ্ডে দণ্ডে

কিবা শুনি মধুমাখা প্রেমময় ধ্বনি।।

অশ্ব, গজ, শত শত       সংখ্যা তার বলি কত

রাজ তুল্য কত নর এসেছে মেলাতে

অসংখ্য হেরি জনতা      নাহি মুখে বাহ্য কথা

সবে ব্যাকুলিত যেন শ্রী হরি দেখিতে।।

শ্রী নাট মন্দির ঘরে        রহিয়াছে থরে থরে

অসংখ্য সারিতে কত বিবিধ আসন

সজ্জন পণ্ডিত যত         যার যার মনঃপুত

স্থানে বসি করিয়াছে আসন গ্রহণ।।

মধ্য সিংহাসন খানি      শুন্য কেন নাহি জানি

রাজর্ষি বুঝিবা কেহ বসিবে আপনি

এই কথা মনে হয়         গুরুচাঁদ ডাকি কয়

এই মর্ম কথা পিতা বল মোরে শুনি।।

শুন্য কেন সিংহাসন      বসিবেন কোন জন

সেই জন এবে কোথা জানিবারে চাই

কেবা সেই ভাগ্যবান      জানিতে ব্যাকুল প্রাণ

তাঁরে দেখে মনো সুখে নয়ন জুড়াই।।

অনন্ত অসীম লীলা        তোমার প্রেমের খেলা

তব দয়া গুণে আজি দেখিলাম চোখে

এ দৃশ্য কেন দেখালে মোরে কিবা শিক্ষা দিলে

দয়া করি বল পিতঃ আপনার মুখে।।

এ মেলা মিলিবে কোথা মিলিছে কি মিলিবে তা

সেই তত্ত্ব আমি কিছু নাহি পাই দিশা

কে মিলাবে এই মেলা   কোথা হবে এই খেলা

এ মেলা দেখিতে মোর মনে বড় আশা।।

বুঝিলাম অনুমানে   বসিবে যে সিংহাসনে

সে জন মিলাবে এই ধর্ম মহামেলা

এ দৃশ্য যদি দেখালে    সে জন কোথা রাখিলে

তাঁরে নাহি দেখি শুধু দেখি তাঁর খেলা।।

পুনঃ ভাবি নিজ মনে      অই দিব্য সিংহাসনে

তোমাক বসালে সাজে অতি মনোহর

যথা যোগ্য কার্য হয়       মনোব্যাথা দূরে যায়

রাজ রাজেশ্বর তুমি চারু কলেবর।।

নিবেদন শুনি কানে       চাহিয়া পুত্রের পানে

মৃদু হাসে রসময় রস সিন্ধু রাজ

ললিত ঝঙ্কার তুলি       ভেদ করি মর্মস্থলী

কহে কথা যেন গান গাহে পিক রাজ।।

শুন হে গুরু চরণ         প্রাণ তুল্য প্রাণধন

তোমাতে বড়ই প্রীত আছি চিরকাল

দেখিলে যে ধর্ম মেলা   হেথা হবে সেই মেলা

সিংহাসনে রবে তুমি দেব মহাকাল।।

আত্মা বৈ জায়তে পুত্রএই জান তার সুত্র

তব মাঝে মোর লীলা হবে পরিপূর্ণ

ভবানীর ভক্তিগুণে         ভবিষ্যতে টেনে এনে

কাল ব্যাবধান আজি করিয়াছি চুর্ণ।।

এই ওড়াকান্দী ধামে      মম নামে তব নামে

ধর্ম মহামেলা হবে অভূত অপূর্ব

ধর্ম সিংহাসনে বসি        তুমি হবে পূর্ণ শশী

ক্ষুদ্র ধর্ম তারাবৎ সবে হবে খর্ব।।

শুনেছ জননী ঠাঁই         তাহা বুঝি মনে নাই

যাহ হবে ভবিষ্যতে তা আজি দেখিলে

সংযত নয়ন মনে       যাদেখিলে এই খানে

সকলি ফলিবে তবে এভাব রাখিলে।।

এই কথা যবে কয়         সে দৃশ্য লুকায়ে যায়

মহাভাবে গুরুচাঁদ চরণে পড়িল

বলে অনাদির আদি      এ দৃশ্য দেখালে যদি

মনোভ্রান্তি আজি হতে আমারে ছাড়িল।।

আমি ত নিমিত্ত মাত্র      তব হাতে রহে সূত্র

তাহে বান্ধা স্বর্গ মত্ত্য যতেক মণ্ডল

যাহারে যে কথা কও    যে ভাবে যারে নাচাও

সবে নাচে তব হাতে তোমারি সকল।।

কে বুঝে তোমার তত্ত্ব     তুমি যে পরম তত্ত্ব

তব প্রেমে হয়ে মত্ত ছুটেছে জগত

করণ-কারণ তুমি          স্থাবর জঙ্গম ভূমি

যাহা কিছু দেখি আমি তোমার সৃজিত।।

অসীম অধর তুমি          তুমি প্রভু তুমি স্বামী

যাহা কিছু পাই আমি সকলি অপূর্ণ

কে পারে জানিতে তোমা  কেবা পায় তব সীমা

তোমারে বর্ণিতে পারে নাহি হেন বর্ণ।।

শুনিয়াছি কুরুক্ষেত্রে       চাহিয়া করুণ নেত্রে

তোমার কৃপার পাত্র পাণ্ডব অর্জ্জুনে

দেখাইলে বিশ্ব রূপ        বিশ্ব জোড়া অপরূপ

দেখিয়া অপূর্ব্ব রূপ পড়িল চরণে।।

ভবিষ্যৎ দেখা ছলে        সেই রূপ দেখাইলে

কত দয়া প্রকাশিলে ও হে বিশ্বনাথ

কি আর বলিব তাতঃ     পদে কোটি দণ্ডবৎ

আমি তব পদানত কর আত্মসাৎ।।

যে দয়া দেখালে মোরে   এহেন রূপ সাগরে

সেই দয়া দয়া করে রাখ মোর শিরে

তব দয়া আছে মোরে    কায় মনো বাক্য ঘিরে

এ চিন্তা অন্তরে যেন রহে সদাকারে।।

আমি কিছু নাহি চাই      যাহা ইচ্ছা কর সাঞী

তোমা ছাড়া কিছু নাই বুঝিনু অন্তরে

যাহা কর ইচ্ছাময়         সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়

লোকে করে লোকে কয় মোহের আন্ধারে।।

অতুল অনন্ত স্বামী       পিতা তুমি মাতা তুমি

কিবা নাহি নহ তুমি তুমি ত সকল

মাটির মায়াতে পড়ি       তোমাতে সম্বন্ধ গড়ি

আসল সম্বন্ধ ছাড়ি করি কোলাহল।।

এ মায়া প্রপঞ্চ পরে       রয়েছি মায়াতে ঘিরে

তোমাকে না দেখি প্রভু দৃষ্টি নাহি চোখে

দয়া সু দর্শন দিয়ে        মায়া ধাঁধা ঘুচাইয়ে

নয়নে আলোক দিয়ে তরাও আমাকে।।

পুত্র মুখে স্তব শুনি         ক্ষীরোদের পূর্ণ মনি

বলে শোনরে ভবানী! বলি তোর ঠাঁই

নিজ চোখে যা দেখিলি   নিজ কানে যা শুনিলি

আজ্ঞা বিনা প্রকাশিলে তোর রক্ষা নাই।।

শুনিয়া প্রভুর বাণী         কহে বাণী সে ভবাণী

শোন বাবাহাবা মেয়ে আমি মোটে নই

মরনের কিবা ভয়         পিতা যার মৃত্যুঞ্জয়

মরণে করিনা ভয় যদি কন্যা হই।।

তা'তে কিবা শঙ্কা করি   তুমিত মারিবে হরি

সেই মরা বাঞ্ছা করি সেই মরা চাই

এত দয়া মোর পরে       ল বল কি প্রকারে

এত দয়া পেতে মোর কোন সাধ্য নাই।।


শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free