আদিগীতিঃ ৫ম অংশ
গুরুচাঁদ দেহে শ্রীহরিচাঁদের সম্মিলন
হরিচাঁদ দয়াময় এসে পূর্ব বঙ্গে।
নরনারী ভাসাইল প্রেমের তরঙ্গে।।
খেলিয়ে মধুর খেলা দিল প্রেমধন।
ভক্তগণে কহে হরি হরি সংকীর্তন।।
নিজগুণে জীবে দিল নির্মল ভকতি।
কলুষ করিয়ে নাশ দিলেন মুকতি।।
অনর্পিত ধন যাহা করিলেন দান।
রোগারোগ্য করে মৃতদেহে পায় প্রাণ।।
ভবব্যাধি করে নাশ নাশে চিত্ত সন্ধ।
বিশুদ্ধ ভাবেতে হরি কাটে কর্ম বন্ধ।।
এমত মধুর লীলা করে নাই কভু।
হরিচাঁদ বেশে দেখা দিল বিশ্ব বিভু।।
হরিনাম তরী এনে সে যে কর্ণধার।
দুঃখী তাপী ছিল যত করিলেন পার।।
মধুময় লীলা করি ভক্তগণ সনে।
করিলেন লীলা সাঙ্গ আনন্দিত মনে।।
বহু ভক্ত সেই দিন ছিল ওঢ়াকাঁদি।
আকুল হইল ভক্তগণ কাঁদি কাঁদি।।
কেঁদে বলে কোথা গেল দয়ার আঁধার।
কেহ বলে হরিচাঁদ বাবারে আমার।।
কেহ কাঁদে হায় হায় করি উচ্চৈঃস্বরে।
কেহ বা মূর্ছিত হয়ে পড়ে ধরাপরে।।
কেহ বলে ওরে এবে অনলে পশিব।
হেন গুণনিধি আর কভু না পাইব।।
অগতির গতি মোর হরি দয়াময়।
কোথা গেল প্রাণধন ত্যাজিয়ে আমায়।।
আর না হেরিব সেই শ্রীচন্দ্র বদন।
অন্তর জানিয়ে কেবা ঘুচাবে বেদন।।
কেবা দিবে প্রেমসুখ হরি তোমা বিনে।
জ্বলে মরি ওহে হরি বিরহ আগুনে।।
ডুবাইয়ে শোক নীরে কোথা চলে যাও।
কৃপা করি আমা সবে সঙ্গে করি লও।।
নহে মোরা এ জীবন ত্যাজিব জীবনে।
বাঁচিয়ে কি লাভ আর আছে এ জীবনে।।
এমত আকুল হয়ে কাঁদে ভক্তগণ।
শোকের সমুদ্র মাঝে খেলে সন্তরণ।।
কেহ খায় হাবু ডুবু প্রাণ বাহিরায়।
ধৈরয ধরিতে নারে করে হায় হায়।।
ভক্তগণ দুঃখ হেরি হরি দয়াময়।
শূন্য থেকে শূন্য বাণী ভকতে শুধায়।।
শুন ওহে ভক্তগণ সুস্থ কর প্রাণ।
তোমাদের ছেড়ে নহে যাব অন্য স্থান।।
আর না কাঁদিও সবে স্থির কর কায়।
গুরুচাঁদ দেহে আমি নিয়েছি আশ্রয়।।
আমাসম গুরুচাঁদে করিও ভকতি।
সর্ব দুঃখ যাবে দূরে ঘুচিবে দুর্গতি।।
এই আমি মিশিলাম গুরুচাঁদ দেহে।
কাঁদিস না ভক্তগণ আমার বিরহে।।
শূন্য থেকে হেন বাণী কহে হরিচাঁদ।
সর্বজন শুনে তাহা বাড়িল আহ্লাদ।।
অনাদির আদি তাই বলে সর্বজন।
ভক্তগণে গুরুচাঁদে ডাকে প্রভু বলি।
হরিচাঁদ ভেবে হৃদে নেয় পদধুলি।।
হরি-গুরুচাঁদ বলি ডাকে কোন জন।
গুরুচাঁদ সাজিলেন জগত জীবন।।
হরিচাঁদ মিশিয়াছে গুরুচাঁদ সনে।
প্রভু অঙ্গ সৎকার করে সর্বজনে।।
কেহ বলে ওরে ভাই কারে বা ডরাই।
গুরুচাঁদ বেশে সেই ক্ষীরোদের সাঁয়ী।।
পাইব পরমানন্দ গুরুচাঁদ হ’তে।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ একই দেহেতে।।
পূর্বভাবে সবাকার আনন্দ হইল।
চাঁদে চাঁদে সম্মিলন হরি হরি বল।।
গৌল ফুটের বিবরণ
স্বয়ং শ্রীগুরুচাঁদ মহেশ ব্যাপারী।
শ্রীমঙ্গল বিশ্বনাথ স্বরূপ চৌধুরী।।
পদ্ম ঠাকুরাণী আর দাসের নন্দিনী।
সাধুদের সঙ্গে সঙ্গে চলে দুই ধনী।।
শ্রীরাম কুমার নামে প্রভু প্রিয় ভক্ত।
শ্রীহরিচাঁদের হয় অতি অনুগত।।
নড়াইল গ্রামে হয় বসতি ভবন।
হরিচাঁদ রূপ রসে সতত মগন।।
সেই গৃহে সবাকার হ’ল নিমন্ত্রণ।
হর্ষচিতে উপনীত মহতের গণ।।
নাম সংকীর্তন হয় সারাটি যামিনী।
কুল কুল নাদে বহে প্রেম তরঙ্গিণী।।
পুরুষ রমণী কারু নাহিই আছে হুঁশ।
অনেকে প’ড়েছে ঢলি হইয়ে বিহুঁশ।।
দিগন্ত ব্যাপিয়া চলে প্রেমের তরঙ্গ।
খরস্রোতে বহিতেছে নাহি দেয় ভঙ্গ।।
গ্রামবাসী সবে আসি দেখিবারে পায়।
পুরুষ ঢলিয়া পড়ে রমণীর গায়।।
রমণী ঢলিয়া পড়ে পুরুষের পদে।
উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে হরি প্রেমের বিচ্ছেদে।।
হরিগুরুচাঁদ বলে ভাসে আঁখিজলে।
হেরিয়ে গ্রামের লোক অগ্নিসম জ্বলে।।
কেহ বলে এই কাণ্ড সহ্য নাহি হয়।
জাতি কুল মজাইবে যত দুরাশয়।।
এক সনে হরিনাম করে কি কারণ।
জাতি কুল মজাইল না শুনে বারণ।।
এত বলি পাষণ্ডীরা হয়ে একত্তর।
বলে ভাই ইহাদিগে তাড়াও সত্বর।।
গৌল ফুটো কাশী ফুটো আর বাঁশী ফুটো।
এ তিনের কটুভাষ অতি বড় রুঠো।।
তারা কহে জাতি নাশাগণে শাস্তি দাও।
নহে গিয়ে কাছারিতে নায়েবে জানাও।।
সবে বলে অন্য নহে পারিবে এ কার্য।
গৌল ফুটো যাইবারে করিলেন ধার্য।।
ক্রোধভরে গৌল ফুটো পশিয়ে তথায়।
মিথ্যা অপভাষ কত নায়েবে জানায়।।
শুনিয়ে নায়েব বাবু পেয়াদা পাঠায়।
নায়েবের বার্তা গিয়ে সবাকে জানায়।।
শ্রীরাম কুমার বলে এখনেতে নয়।
প্রভাতে যাইব মোরা শুন মহাশয়।।
এত শুনি সে পেয়াদা কাছারিতে গিয়ে।
নায়েবের ঠাই কহে সব বিস্তারিয়ে।।
এদিকেতে সাধুগণ নামে প্রেমে মেতে।
প্রাতঃকালে উঠে সবে কাছারিতে যেতে।।
গুরুচাঁদ র’ল তথা আর সব গেল।
নায়েবের আজ্ঞামতে আবদ্ধ করিল।।
এদিকে ভবানী আর পদ্ম ঠাকুরাণী।
সবার মঙ্গল চিন্তা করে দুই ধনী।।
ও দিকে কাছারি মাঝে বসি সর্বজন।
প্রফুল্লিত চিত্যে সবে প্রেমাবিস্ট মন।।
কিছুক্ষণ বিশ্বনাথ চুপ করে থাকি।
জয় হরিচাঁদ বলি অঙ্গে দিল ঝাঁকি।।
ভাবেতে উন্মত্ত হ’য়ে নাচিতে লাগিল।
পরিধান বস্ত্রখানি খসিয়ে পড়িল।।
নেহারিয়ে ডিহিদার ভাবিতে লাগিল।
এবা কোন মহাভাব ধারণ করিল।।
সামান্য মানব নহে ইহারা সকল।
ভাব হেরে ডিহিদার ভাবিছে কেবল।।
তার মাঝে বিশ্বনাথ নিজ শিশ্ন ধরি।
ডিহিদার প্রতি বলে সবিনয় করি।।
বিশ্বাস না হয় দেখ পরখ করিয়া।
কামের কামান রাখি চরণে দলিয়া।।
মদনের বশীভূত আছে যারা যারা।
মন্দ ভাবে মন্দ চিন্তা সদা করে তারা।।
ইন্দ্রিয়ের কোপ তারা সহিতে না পারে।
আপন সদৃশ ভেবে নিন্দে যারে তারে।।
হীন ব্যক্তি হীন চিন্তা করে সর্বক্ষণ।
করিতে না পারে মহাবস্তু সংরক্ষণ।।
ইন্দ্রিয় সংযম ভবে করিয়েছে যারা।
শমনের ডর কভু নাহি করে তারা।।
এত বলি বিশ্বনাথ করে বীরদাপ।
মহাশক্তি দেখাইল করিয়ে প্রতাপ।।
মনে ভাবে ডিহিদার একি সর্বনাশ।
বড়ই অদ্ভুত ভাব করিল প্রকাশ।।
ইহারা মানব নহে দেবতা পুরুষ।
যেন কোন মহাভাবে ইহারা বেহুঁশ।।
মন্দ কর্ম ইহারা না করেন কখন।
নিশ্চয়ই বিশুদ্ধ প্রেমে মত্ত অনুক্ষণ।।
পাষণ্ডীর গণ যত না বুঝে কারণ।
চেষ্টা করে এই ভাব করিতে বারণ।।
মিথ্যা অপবাদ কহে এসে মম ঠাই।
স্বরূপ ভাবেতে আমি বুঝিলাম তাই।।
বৃথা অভিযোগ করে মর্ম না বুঝিয়া।
অন্তরেতে সাড়া দেয় কে যেন আসিয়া।।
পুনঃ ভাবে মন্দ নয় তাহারা কখন।
তাদের কারণে হ’ল সাধু দরশন।।
ডিহিদার ভাবে ইহা সজল নয়নে।
বিন্দু বিন্দু ধারা তার বহিছে তখনে।।
নিষ্কাম পুরুষ হয় মহতের গণ।
অনুক্ষণ হরিপ্রেমে থাকেন মগন।।
প্রেমেতে উন্মত্ত হয়ে বলে হরিবোল।
নিশ্চয় ইহারা সবে প্রেমের পাগল।।
এ ভাবে রাখা তো আর উচিৎ না হয়।
এবে দেখি হইয়েছে ক্ষুধার সময়।।
প্রাণেতে আশংকা পেয়ে বলে ডিহিদার।
মহতে পাইলে দুঃখ নাহিক নিস্তার।।
সবাই র’য়েছে এরা ভেবে হরিপদ।
দুঃখ দিলে পরিণামে আমার বিপদ।।
অতএব সাধুগনে করিব বিদায়।
মম দোষ হেন সাধু কভু নাহি লয়।।
এই ভাবি ডিহিদার ব’লেছে তখন।
কাছারী রাখিতে সবে না পারি এখন।।
যথা ইচ্ছা যেতে পার ওহে সাধুগণ।
মম অপরাধ নাহি লইও কখন।।
নহে যদি কৃপা করি থাক এ কাছারী।
আহারের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।।
ডিহিদারে বিশ্বনাথ বলেছে তখন।
আমাদের রান্না কার্য হ’ল সমাপন।।
ডিহিদার বলে কোথা হয়েছে রন্ধন।
পুনঃ বলে যে গৃহেতে হ’ল সংকীর্তন।।
ডিহিদার বলে তাহা হইবে কেমনে।
কাছারী এসেছে সবে এই মাত্র জানে।।
বিশ্বনাথ বলে শুন ডিহিদার ভাই।
লোক পাঠাইয়ে এবে জেনে দেখ তাই।।
এত শুনি তখনই লোক পাঠাইল।
রন্ধন হ’য়েছে শুনি অবাক হইল।।
ডিহিদার সাধুপদে মাগে পরিহার।
ক্ষম মোরে সবে মোর আমি দুরাচার।।
পাষণ্ডীর বাক্যে আমি করেছিনু সন্দ।
না জানিয়ে মূল তত্ত্ব বলিয়েছি মন্দ।।
মহা অপরাধী আমি হয়েছি চরণে।
সবে ক্ষম অপরাধ স্বীয় স্বীয় গুণে।।
মম বাণী শুন এবে সকল গোঁসাই।
ঘুচিয়েছে অন্ধকার কোন বাঁধা নাই।
যথা ইচ্ছা তথা পার করিতে গমন।
দিবানিশি কর হরিনাম সংকীর্তন।।
যেথা ইচ্ছা সবাকার পার করিবারে।
আদেশ করিনু এবে সরল অন্তরে।।
ডিহিদার আজ্ঞা পেয়ে যত সাধুগণ।
পুনরায় পূর্ব স্থানে করিল গমন।।
পরে ডিহিদার গৌল ফুটোকে ডাকিল।
কত মত ভাবে কত যে গালি পাড়িল।।
আরে রে ফুটোর বেটা বলি মন্দভাষ।
মম ঠাই গাহিলি মহতের অপযশ।।
অনুক্ষণ থাকে যারা হরিপ্রেমে মেতে।
অন্যায় করম তারা করিবে কি মতে।।
না জানিস মূল মর্ম না করিলি কাম।
মহতের নামে তাই গাহ বদনাম।।
সাধু হিংসা অপরাধ করিলি পামর।
ক্ষমা ভিক্ষা মেগে পদে হ’গে রে নফর।।
নহে তোর কুড়ি টাকা করি জরিমানা।
টাকা যদি নাহি দিস যেতে পারিবি না।।
এই মত দণ্ড তারে ডিহিদার কৈল।
তখনেই কুড়ি টাকা আনাইয়া নিল।।
আর কত গালাগালি করে ডিহিদার।
পাষণ্ডীরা মনে মনে সবে পায় ডর।।
কেহ এসে গুরুচাঁদ পদে লোটাইল।
সেই হ’তে সেই জনা মতুয়া হইল।।
সেই হ’তে পাষণ্ডীরা গণিল হুতাশ।
ভয়ে ভীত থাকে সদা মতুয়া সকাশ।।
ঘুচে গেল গণ্ডগোল নড়াইল গ্রামে।
অনেকেই হইল ভক্ত মেতে হরিনামে।।
ভয়ে কেহ সাধু হিংসা না করে কখন।
ওদিকেতে মতুয়ারা করিল ভোজন।।
চলিল আনন্দ মনে যার যে আবাস।
পাষণ্ডীর প্রাণে বড় বাড়িল হুতাশ।।
যদি কেহ হরিনাম করে ওই গ্রামে।
সকলেই যোগ দিত এসে হরিনামে।।
সাধু হিংসা যে করিবে তার মুণ্ডে বাজ।
পুনঃ পুনঃ বলেছেন কবি রসরাজ।।
গুরুচাঁদের চারিপুত্রের জন্ম
গুরুচাঁদ অঙ্গ সত্যভামার উদরে।
চারি ভাই জন্মিলেন এসে ধরাপরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম রাখে শ্রীশশীভূষণ।
নমঃশূদ্র কুলদ্বীপ স্বজাতি রঞ্জন।।
সুকমল তনুখানি অতি সুগঠন।
চন্দ্রভাতি যিনি হয় অঙ্গের কিরণ।।
অপরূপ যে লাবণ্য মরি কি বাহার।
অধরে সুধার হাসি নাসিকা সুন্দর।।
মনে হয় যেন সেই পার্বতী নন্দন।
সত্যভামা দেবী গর্ভে জনম গ্রহণ।।
নির্দিষ্ট করিতে যেন প্রাণে না কুলায়।
কি যেন কি হেরিলাম বিভীষিকা প্রায়।।
সুধন্য ঠাকুর হয় মধ্যম কুমার।
প্রচুর র’য়েছে ভবে যশঃকীর্তি যার।।
জন্মকালে সত্যভামা হেরে বিভীষিকা।
কেবা যেন পুত্র রূপে এসে দিল দেখা।।
কেঁদে কহে ওগো মাতা ত্যজিয়ে আমায়।
কেমনেতে বল মাগো আইলে হেথায়।।
অন্নপূর্ণা রূপে তুমি ছিলে মম ঘরে।
পুজিতাম পাদপদ্ম বিশুদ্ধ আচারে।।
ব্রাহ্মণ কুলেতে ছিল জনম আমার।
সমাদরে পুজিতাম চরণ তোমার।।
সন্তান ছাড়িয়ে মাগো এসেছ হেথায়।
মাতৃহারা হ’লে পুত্র কেমনে জিয়ায়।।
বালকে ধরিতে মাতা আগু হতে চায়।
সংজ্ঞাহীন হ’য়ে পরে পড়িল ধরায়।।
এইরূপে জন্ম লয় সুধন্য ঠাকুর।
কষিত কাঞ্চন বর্ণ অতীব মধুর।।
ধাত্রীগণ রূপ হেরে ডেকে বলে মায়।
ধর মা সোনার চাঁদ ভুতলে উদয়।।
এইভাবে পুত্ররত্ন কোলে তুলে লয়।
তস্য পরে উপেন্দ্র ঠাকুর জন্ম লয়।।
অপরূপ রূপখানি যেন বৈশ্বানর।
তপত স্ফুলিঙ্গ বর্ণ অতি মনোহর।।
পরেতে জনম নিল ঠাকুর সুরেন্দ্র।
সুন্দর মূরতি খানি শ্রীআনন্দ চন্দ্র।।
অভিমন্যুসম রূপ বলে লোকজন।।
প্রতিঅঙ্গে ছিল তার বীরের লক্ষণ।।
এইভাবে চারি পুত্র জনম লভিল।
হরিগুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বল।।
শ্রী শশী ও সুধন্য স্বীয় কুল করে ধন্য
ফেলি দূরে সব আবর্জনা।
করি বহু পরিশ্রম জাতি বাঁধা অতিক্রম
দূর করে ভাই দুইজনা।।
কেহ বিদ্যাবন্ত লয়ে নিল পথ আগুলিয়ে
স্বজাতির গৌরব বাড়িল।
বিদ্যাবান ছিল যারা চাকরি পাইল তারা
বাঁধা বিঘ্ন সকল ঘুচিল।।
কার্য করে দূরসাধ্য ছিল দার অবরুদ্ধ
চাকরী না পেত এই জাতি।
শ্রম করি অপ্রমিত করে দ্বার উদঘাটিত
উদ্ধারিল স্বকুল স্বজাতি।।
তাহার কৃপায় আজ নিখিল ভারত মাঝ
মন্ত্রিত্ব পাইল এই কূলে।
ধন্য সে শশীভূষণ হইল কুলভূষণ
গুরুচাঁদ কৃপা তাঁর মূলে।।
মধ্যম সে শ্রীসুধন্য তিনি করিলেন ধন্য
দেখাইয়ে মধুর করণ।
আপনি করিয়া কর্ম জানাইল সূক্ষ্ম মর্ম
মহতীয় ভাব প্রকরণ।।
পবিত্র স্বভাব ধারী শুদ্ধদেব শুদ্ধাচারী
বিশুদ্ধ ভাবেতে মাতোয়ারা।
উচু নীচু ভেদ নাই সমতুল্য ভাই ভাই
যে থাকে প্রেমরসে পোরা।।
বলে সুমধুর ভাষ তাহে কত ভাবোচ্ছ্বাস
সুধাসম বাক্যের বিন্যাস।
সবাকারে আত্মবৎ দেখা মাত্র দণ্ডবৎ
হেনভাবে করেন প্রকাশ।।
কিবা ভাব সুমধুর করে মধ্যম ঠাকুর
হেন ভাব বর্ণিতে না পারি।
মতুয়ার প্রতি ভক্তি করেন মধুর উক্তি
গুরুচাঁদ ব্রহ্মজ্ঞান করি।।
পরে যিনি শ্রীউপেন্দ্র জগতে হ’ল আনন্দ
রূপে যেন দেব বৈশ্বানর।
মুখেতে মধুর হাসি যেন প্রভু পূর্ণ শশী
দরশনে নাশে অন্ধকার।।
পরে এল শ্রীসুরেন্দ্র যেন সেই পূর্ণচন্দ্র
নক্ষত্র মণ্ডলে শোভা পায়।
দ্বাপরেতে অভিমন্যু সমরে ত্যজিয়ে তনু
চন্দ্রলোকে হইল উদয়।।
এ যুগে অভিমন্যু হইলেন শ্রীসুরেন্দ্র
গুরুচাঁদ তনয় রূপেতে।
এইভাবে চারিজন ভবে করে বিচরণ
ব্যক্ত আছে নরসমাজেতে।।
শ্রীহরিচাঁদের পুত্র কনিষ্ঠের শুন সুত
শ্রীআদিত্য উমাকান্ত সুত।
হরিচাঁদ লীলাগান সুমধুর সু-আখ্যান
হল ভক্তগণ মনঃ পুত।।
শ্রীগিরি কীর্তনিয়ার আত্মবলিদান
মোল্লাকাঁদি করে বাস শ্রীরঘু কীর্তুনে।
তস্য পুত্র শ্রীগোলক জানে সর্বজনে।।
তার পুত্র গিরিধর পরম সুন্দর।
শ্রীগুরুচাঁদের হয় চির সহচর।।
শিশু কালে এক সনে করে বিদ্যাভ্যাস।
অনুক্ষণ হরিপ্রেমে বাড়ায় উল্লাস।।
সখ্য রসে প্রাণ বাঁধা গুরুচাঁদ পদে।
পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপেতে জানে হরিচাঁদে।।
হরিচাঁদ রূপে হৃদে তত ভাবনা।
অন্য কোন তন্ত্র মন্ত্র কিছুই জানে না।।
দেহ ধারী গিরিধর গুরুচাঁদ প্রাণ।
জনমের মত করে আত্মবলিদান।।
গুরো দাদা বলে সদা প্রভুকে ডাকিত।
হৃদি মাঝে রেখে সদা চরণ সেবিত।।
শৈশবের সখ্য বুলি ভুলেনি কখন।
মধুমাখা ভাবে সদা করে সম্ভাষণ।।
গুরুচাঁদ ডাকিতেন গিরিদাদু বলি।
এই ছিল দোঁহাকার প্রেমমাখা বুলি।।
বড় সুমহান সেই গিরি কীর্তনিয়া।
গুরুচাঁদ রূপে তার সদা মগ্ন হিয়া।।
তাহার নন্দন হয় অশ্বিনী, যাদব।
দুই পুত্র পেয়ে হয় প্রাণেতে উৎসব।।
গোলকের আর পুত্র মথুর কীর্তুনে।
অন্য কিছু নাহি জানে গুরুচাঁদ বিনে।।
তার হয় তিন পুত্র সর্ব সুলক্ষণ।
শৈশব হইতে তারা হরিপরায়ণ।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র দামোদর মধ্যম শ্রীধ্রুব।
কনিষ্ঠ শ্রীদিগম্বর সরল স্বভাব।।
হরিচাঁদ গুণ গায় দিবস যামিনী।
প্রভুর কৃপায় তারা করে মহাজনী।।
অতপর শুন এক আশ্চর্য ব্যাপার।
দৈবযোগে গুরুচাঁদ দেহে উঠে জ্বর।।
ক্রমাগত বৃদ্ধি হয়, না হয় বিরাম।
কোন মতে নাহি হয় জ্বরের আরাম।।
যন্ত্রণায় ছটফট করে দিবানিশি।
মেঘাছন্ন ভাবে যথা রহে পূর্ণশশী।।
দিন দিন তনু ক্ষীণ সুস্থ নহে আর।
ক্রমে প্রভুর হয় কৃশ কলেবর।।
কোন মতে প্রতিকার নাহি হয় রোগ।
গুরুচাঁদ বলে এ কি মোর কর্মভোগ।।
এইরূপ চিন্তা প্রভু করে অনুক্ষণ।
শ্রীগিরি কীর্তুনে এসে দিল দরশন।।
গুরুচাঁদ বলে দাদা বাঁচিব না আর।
অবশ্যই মৃত্যু বুঝি নিকটে আমার।।
এমত যাতনা ভাই সহ্য নাহি হয়।
মরিব রে গিরি দাদা বুঝেছি নিশ্চয়।।
গুরুচাঁদ মুখে শুনি এতেক বচন।
ক্রোধচিতে কহে কথা প্রভুর সদন।।
শোন ওরে গুরো দাদা তোরে বলে রাখি।
তোর মরণের আছে বহুদিন বাকী।।
এই গিরি বর্তমান যতক্ষণ আছে।
শমনের কি শকতি আসে তোর কাছে।।
আরো এক কথা আছে বাবার শ্রীমুখে।
জগত ঈশ্বর তোরে বলিবেক লোকে।।
তুই হবি এ সংসারের সবাকার মূল।
নরনারী সবাকার পরাণ পুতুল।।
প্রভুর অলঙ্ঘ্য বাণী কেমনে লঙ্ঘিবি।
না করি মধুর লীলা কোথায় পালাবি।।
এসেছিল কলিজীবে করিতে উদ্ধার।
না করিয়ে কোথা যাবি দাদারে আমার।।
তোরই কারণে এই লীলার প্রচার।
তো হইতে সর্বজীব হইবে উদ্ধার।।
তাহা না করিয়ে তোরে যাইতে না দিব।
তোকে যে নিতে এসেছে আমি তারে নিব।।
প্রতিজ্ঞা করিয়ে এবে বলি তোর ঠাই।
নিশ্চয় মরিব লয়ে তোর এ বালাই।।
প্রভু বলে কি বলিলি অসম্ভব বাণী।
এইমত কথা আমি কভু নহে জানি।।
একের মরণে বাঁধা দিয়ে অন্য জন।
তার তরে করে হেন আত্মা বিসর্জন।।
আমা লাগি কেন ভাই ত্যাজিবি জীবন।
নিজ দেহ কেন তুই দিবি বিসর্জন।।
গিরিধর বলে তুই শোন রে বচন।
গুরো বর্তমানে তোর হবে না মরণ।।
সম্ভব কি অসম্ভব তাহা নহে জানি।
নিশ্চয় ছাড়িব দেহ সত্য মম বাণী।।
আমি মৈলে জগতের কোন ক্ষতি নাই।
তুই মৈলে ভক্তবৃন্দ কাঁদিবে সবাই।।
তুই হারা হ’লে ভাই অনর্থ ঘটিবে।
বৈষ্ণবের কুটিনাটি খণ্ড না হবে।।
বিশুদ্ধ প্রেমের ধর্ম মর্ম প্রকাশ হবে না।
গার্হস্থ প্রশস্ত্য ধর্ম মর্ম জানিবে না।।
ঐশ্বর্যের মাঝে রবে মাধুর্য গোপন।
তুই বিনে বল তাহা কে করে সাধন।।
সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাতে সবায়।
তোর আশা যাহা মনে তা কি মিথ্যা হয়।।
যে সব র’য়েছে বাকী প্রকাশিতে ভবে।
কোন প্রাণে বিশ্ব ছাড়া হতে চাস্ এবে।।
এ কারণ আমি তোর লইয়ে বালাই।
পদধুলি দে মস্তকে আমি চলে যাই।।
প্রভু বলে কি বলিস রে প্রাণের ভাই।
আমি মৈলে হবে ক্ষতি শুনে দুঃখ পাই।।
হউক আমার মৃত্যু শোন দাদা মোর।
হৃদয় বিদরে ভাই বাক্য শুনে তোর।।
গিরি বলে গুরুচাঁদ শোন রে বচন।
ফেরাতে নারিবি তুই আমার মরণ।।
যদি তোরে কোন দিন ভালবেসে থাকি।
তোরে যদি দাদা ব’লে প্রাণ দিয়ে ডাকি।।
তুই যদি দাদা ব’লে ডাকিয়ে থাকিস।
তোর তরে দিব প্রাণ নিশ্চয় জানিস।।
এ গতি রোধিতে ভাই কভু না পারিবি।
কেন ভাই মিছিমিছি অনর্থ ঘটাবি।।
শেষের বিদায় ভাই মাগি এইবার।
এই দেখা শেষ দেখা হ’ল রে আমার।।
কৃপা করি দে বিদায় রে প্রাণের ভাই।
মনের আনন্দে আমি দেশে চলে যাই।।
এত বলি হরিচাঁদে স্মরিয়ে তখন।
শ্রীগুরুচাঁদের দেহে করে আলিঙ্গন।।
নিজ গৃহে চলি যায় বলে হরি হরি।
বলে বাবা হরিচাঁদ দেহ পদ তরী।।
উপনীত হয় গিয়ে আপন ভুবন।
ডেকে বলে সবাকারে শুনহ বচন।।
বাঁচিয়ে না যেন আমি হেন মনে লয়।
হরিনাম করি মোরে শুনাও সবায়।।
এত শুনি আত্মবর্গ ছিল যারা যারা।
সবে এসে প্রেম ভরে হরি বলে তারা।।
তিনদিন পরে করে গোলকে গমন।
হরি হরি বলি দেহ করিল পতন।।
নামে মত্ত হয়ে করে সে দেহ সৎকার।
শ্রীগুরুচাঁদের দেহে না রহিল জ্বর।।
প্রভু বলে হায় হায় কি করি এখন।
আমা লাগি গিরি দাদা ত্যাজিল জীবন।।
মম দেহে নাই সেই সাংঘাতিক জ্বর।
তাহার কর্মেতে মম সুস্থ কলেবর।।
এহেন প্রাণের সাথী কেবা আছে আর।
শোধিতে পারে না কেহ এই ঋণ ধার।।
আমার লাগিয়ে গিরি ত্যাজিল জীবন।
লক্ষণ অধিক সেই স্নেহের ভাজন।।
স্বার্থত্যাগী অনুরাগী ভাবুক সুজন।
মম তরে দিলে প্রাণ ছাড়িল ভুবন।।
এহেন মহান ব্যক্তি কে দেখেছে কবে।
অপরের বিনিময়ে কেবা মরে ভবে।।
ক’রে গেল গিরি দাদা বিশ্বের কল্যাণ।
সর্বজীবে দেখাইল আত্ম বলিদান।।
পরম মহান এই মহা ভাগবত।
বুঝহ তাহার প্রাণ যত ভাগবত।।
কি দেখাইল মধুর শ্রেষ্ঠতর কর্ম।
সমর্পিত দেহে মনঃ মর্মান্তিক মর্ম।।
প্রকৃত প্রণয় কিংবা ভালবাসা যাহা।
গিরিধর দেখাইল নিজে করে তাহা।।
কে আছে এমন ভবে দেখাতে পিরীতি।
কোথা লাগে তার কাছে পুরুষ প্রকৃতি।।
ধন্য ধন্য বলি প্রভু করেন বিলাপ।
অন্তরে উল্লাস বাহিরেতে পায় তাপ।।
ক্রমে বহু ভক্ত ঠাই করেন প্রকাশ।
স্মরিয়ে তাহার গুণ করে হা হুতাশ।।
এইরুপে মহাভাব প্রকাশ হইল।
সুভক্তি অন্তরে বিচরণ বিরচিল।।
গুরুচাঁদের সঙ্গে তারকচাঁদের বাক্যানুবাদ
হরিচাঁদ লীলাসাঙ্গ করিলেন যবে।
আকুল হইয়া কাঁদে ভক্তগণ সবে।।
আহা প্রভু দয়াময় লুকালে কোথায়।
মরমের ব্যথা আর জানাব কাহায়।।
তুমি অগতির গতি পরম কারণ।
ভকত হৃদি রঞ্জন বিপদ বারণ।।
তোমা বিনে এ জীবনে অন্য গতি নাই।
তোমা সম প্রাণ সখা কোথা গিয়ে পাই।।
অনলে পশিব কিংবা গরল খাইব।
কিংবা মোরা উদ্ধন্ধনে জীবন ত্যজিব।।
এইমত কাঁদে যত ভকতের গণ।
আঁখি জলে সবাকার তিতিল বসন।।
হরিচাঁদ বিরহেতে কাঁদিয়ে বেড়ায়।
আকুল হইয়া কেহ ধুলায় লোটায়।।
ছাড়িয়ে যাইতে যদি বাঞ্ছা ছিল মনে।
আমাদের মন প্রাণ হ’রে নিলে কেনে।।
কা’র মুখে শুনিব সে মধুর কাহিনী।
শীতল করিবে কেবা বিদগ্ধ পরাণি।।
ভক্তগণে হেনভাবে করেন রোদন।
দেশে কি বিদেশে ভ্রমে বিষাদিত মন।।
একদিন ভাবিলেন তারক রসনা।
বহুদিন শ্রীধামেতে যাইতে পারি না।।
দেখিতে বাসনা চিতে প্রভু গুরুচাঁদে।
স্মরি হরিচাঁদ রূপে মন দুঃখে কাঁদে।।
আর কি পাইবে সেই হৃদয় মাণিক।
কে আরা বলিবে পুত্রসম প্রাণাধিক।।
এমত বলিতে গিয়ে কাঁদে উভরায়।
ক্ষণে ক্ষণে কবিগান গাহিয়ে বেড়ায়।।
কবিরাজপুরে যায় গাহিবারে গান।
হরিচাঁদ বলে সদা ব্যকুলিত প্রাণ।।
নিশিযোগে সে আসরে গাহিতেছে কবি।
প্রেমের পাথারে ভাসে সেই মহাকবি।।
গাহিছে বিরহ গীতি শ্রীমতী রাধার।
অবিরত দু’নয়নে বহে অশুধার।।
ডগমগ শ্রোতাবর্গ নাহি কোন রব।
প্রেমের পাথারে ভাসে দুঃখী তাপী সব।।
রূপচাঁদ নামে হয় ব্যক্তি একজন।
মদন নামেতে হয় তাহার নন্দন।।
দশ কিবা বর্ষ বার বয়স তাহার।
পিতার সম্মুখে বৈসে আনন্দ অপার।।
বড়ই সৌভাগ্যবান সেই সে বালক।
অপরূপ রূপ হেরি হৃদয় পুলক।।
মুস্টী পরিমাণ যেন বিগ্রহ মূরতি।
তুলনা বিহীন রূপ মধুর আকৃতি।।
তারকের শিরোপরে করে ঝিকিমিকি।
বালক হেরিয়ে বলে ও বাবা ও কি।।
তার পিতা রূপচাঁদ দেখিতে না পায়।
চুপ ক’রে থাক বলি পুত্রকে সান্তায়।।
নীরবেতে রূপরাশি নেহারে বালক।
বুঝিতে না পারে শিশু অন্তরে পুলক।।
সেইভাবে নিশিগত হইল যখন।
নিজ গৃহে সে বালক করিল গমন।।
গোছড় সেই তো যায় গরু বাঁধিবারে।
রসনার সনে দেখা পথের মাঝারে।।
চ’লেছেন রসরাজ ঝায়ি দিয়ে হাতে।
বালক জিজ্ঞাসা করে অতি হর্ষচিতে।।
একবার কৃপা করি কহ সরকার।
কেবা ছিল আপনার মস্তক উপর।।
মুস্টী পরিমাণ সেই মূরতি সুন্দর।
কষিত কাঞ্চন যিনি রূপ মনোহর।।
কহ দেখি সরকার কেবা সে তোমার।
কেন বা বসিল তব মাথার উপর।।
বালকের বাক্য শুনি কবি চূড়ামণি।
বিস্মিত হইয়া তথা বসিল অমনি।।
শিশুকে করিয়ে কোলে অশ্রু বিসর্জন।
বলে বাপ কি ভারতী করালি শ্রবণ।।
কেবা রয় মম শিরে করিলি দর্শন।
কিছু নাহি জানি তাহা আমি অভাজন।।
তোর ভাগ্যবলে রুই দেখা পেলি তার।
বড়ই অভাগা আমি অতি দুরাচার।।
কিছুই না জানি বাপ কিবা তোরে কই।
তব অঙ্গ স্পর্শে আজ আমি ধন্য হই।।
এত বলি রসরাজ কাঁদে উভরায়।
হো হো হো হরি বলিতে মুঝে না বুঝায়।।
বালকে লইয়ে ভাসে প্রেমের গোলায়।
তারকের কোলে শিশু কাঁদে উভরায়।।
হেনভাবে কিছুক্ষণ তথায় রহিল।
সান্তনা হইয়া দোঁহে স্বকার্যে চলিল।।
গান অন্তে তথা হ’তে বিদায় লইয়া।
উন্মনা ভাবেতে দেশে উদিল আসিয়া।।
কোনমতে শান্ত নহে তারকের প্রাণ।
অবশেষে শ্রীধামেতে করিল প্রয়াণ।।
ভক্তিভরে প্রণমিল গুরুচাঁদ পায়।
গর্জন করিয়ে প্রভু তারকেরে কয়।।
আরে রে দুর্মতি তুই কেন হেথা এলি।
কেন তুই এ ভাবেতে মোরে প্রণমিলি।।
তোদের ঠাকুর আর এখানেতে নাই।
যথায় আছেন তিনি চ’লে যা সে ঠাই।।
দূর হ’রে মুঢ়মতি সম্মুখ হইতে।
যা আছে আমার বুঝি আইলি লুটিতে।।
মন হতে মুছে ফেল সে সব ধারণা।
নিরস্ত থাকিতে বুঝি আমাকে দিবি না।।
সে কল্পনা একেবারে মুছে ফেলে দে।
(লাইন জ্ঞাপ)
কেবা তোর সে ঠাকুর খুঁজে গিয়ে নে।।
আমি বলি তোর হরি গিয়েছে চলিয়া।
তবু কেন হেথা তুই রহিলি বসিয়া।।
এইভাবে কটুবাক্য বাহিরে প্রকাশ।
তাহা শুনি তারকের প্রাণেতে উল্লাস।।
ধীরে ধীরে কহে বাণী অতি সুমধুর।
অন্য স্থানে যায় নাই আমার ঠাকুর।।
আমার ঠাকুর যিনি আছে বর্তমান।
এই দেহ সেই দেহ নহে ব্যবধান।।
গুরুচাঁদ বলে কোথা তোর সেই হরি।
তারক ব’লেছে আমি সম্মুখে নেহারি।।
সম্মুখে র’য়েছে এই মূর্তি হরিহর।
তুমি মম সেই হরি ব্রহ্ম পরাৎপর।।
তব মুখে না শুনিনু বুঝিয়েছি সব।
তুমিই জগত গুরু ভবাদি বান্ধব।।
যত তিরস্কার কর বুঝেছে তারক।
তুমি অগতির গতি ভব নিস্তারক।।
তাহার প্রমাণ আমি পেয়েছি এখন।
মহাপ্রভু লীলাঅন্ত করিল যখন।।
ভক্তগণে কাঁদে সবে আকুল হৃদয়।
শূন্য থেকে শূন্যবাণী কহে দয়াময়।।
আর না কাঁদিও যত ভকত নিচয়।
গুরুচাঁদ দেহে আমি নিয়েছি আশ্রয়।।
শ্রীমুখের বাণী সেই কভু মিথ্যা নয়।
তব দেহে মম হরি কহিনু নিশ্চয়।।
সেই হেতু মম প্রতি কহ কটু বাণী।
ইহার স্বরূপ তত্ত্ব আমি ভাল জানি।।
চিরদিন ভ্রাতৃভাবে বা বাসিয়েছ।
আজ দেখি পিতৃতুল্য গালি যে দিয়েছ।।
অদ্য কেন হেরি তব বিপরীত ভাব।
কেন প্রকাশিলে অদ্য প্রভুর স্বভাব।।
এ হেন স্বভাব তব না ছিল কখন।
কোথা পেলে বল তুমি এ সব লক্ষণ।।
কোথা পেলে এই যুক্তি গালি দিতে মোরে।
হরিচাঁদ বিনে শক্তি অন্যে নাহি ধরে।।
হরিচাঁদ মিশিয়েছে তোমার শরীরে।
প্রকাশ হইল মোর উপলক্ষ্য ক’রে।।
বিশ্ববাসী সবে আসি পদানত হ’বে।
কত জন কত ভাবে আসিয়ে মিলিবে।।
সকলে বুঝিবে মোরা কার জন্য কাঁদি।
উড়িয়ে পড়িবে তারা এসে ওঢ়াকাঁদি।।
না জানি কত বিরক্তি সবাই করিবে।
অসহ্য বিরক্তি কত সহিতে হইবে।।
ঠাকুরের ন্যায় শেষে যাও পালাইয়া।
সেই আশংকায় মোর ফেটে যায় হিয়া।।
আমার অন্তর মাঝে এই আকিঞ্চন।
বিশ্ববাসী সবে যেন পায় প্রেমধন।।
এত শুনি গুরুচাঁদ বলে হেসে হেসে।
যা হবার হবে শেষে তুমি যাও দেশে।।
প্রভুবাক্যে রসরাজ বিদায় লইয়ে।
নিজবাসে চলি যায় আনন্দ লভিয়ে।।
কবিগান গেয়ে গেয়ে বেড়ায় আনন্দে।
গুরুচাঁদ ভাবি সদা রহে প্রেমানন্দে।।
প্রেমের আভাস অনুভবে বোঝা যেত।
স্বেদ কল্প পুলকাশ্রু প্রকাশ পাইত।।
ধন্য শ্রীতারকচন্দ্র কবি রসরাজ।
হরিচাঁদ মূর্তি গুরুচাঁদ অঙ্গমাঝ।।
জানাইল সবাকারে নিজ সাধ্য বলে।
বিচরণ স্থান মাগে চরণ কমলে।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদের মহাজনী বিস্তার
শ্রীধামেতে হ’ল পূর্ণচাঁদ পরকাশ।
ভকত চকোর প্রাণে বাড়িল উল্লাস।।
পতিত পাবন নাম প্রকাশ করিতে।
একদা ঠাকুর ভাবে বসি বিরলেতে।।
এই জাতি নাহি জানে করিতে বাণিজ্য।
অর্থাভাবে কোন কিছু নাহি করে গ্রাহ্য।।
অতি দীন ভাবে করে জীবন যাপন।
না করিতে পারে কেহ অর্থ উপার্জন।।
অন্যান্য জাতিতে শুধু বাণিজ্য করিয়ে।
বহু ধন উপার্জন করে সুখী হ’য়ে।।
অতএব এ জাতিকে বাণিজ্য শিখাব।
নৌকা বানাইয়ে নিজে মহাজন হ’ব।।
কিছুদিন পূর্বে তাহা ঠাকুর করিল।
ক্রমে এসে মাঝিগণ একত্র হইল।।
মহেশ ব্যাপারী হয় পরম বিশ্বাসী।
প্রেম অনুরাগী হরি পদ অভিলাষী।।
কানাই বিশ্বাস আর শ্রীনাথ বিশ্বাস।
এ তিন পরম ভক্ত তালতলা বাস।।
শ্রীগুরুচরণ বালা গুরুচাঁদ ঢালী।
রামতনু হীরা আর পরীক্ষিত ঢালী।।
জগমোহন হীরা আর বংশী মহাভাগ।
ঠাকুরের প্রতি যার বাড়ে অনুরাগ।।
ভজরাম চৌধুরী ও দ্বিতীয় কানাই।
যজ্ঞেশ্বর দাস আর বিশ্বাস কোদাই।।
নীলমণি এল দাস মহিমা চরণ।
বিশুদ্ধ অন্তরের বৈরাগী বৃন্দাবন।।
দুঃখীরাম বালা নামে নিজিড়ায় বাস।
ঠাকুরের তরী বায় পরম উল্লাস।।
ভুবন বিশ্বাস নামে সাচেদাহ বাসী।
বেপারী হইল তিনি ওঢ়াকাঁদি আসি।।
হরচন্দ্র চৌধুরী শ্রীগোপাল বিশ্বাস।
সকলেই তরী বায় অন্তরে উল্লাস।।
সবার প্রধান হয় মহেশ ব্যাপারী।
আপনি শ্রীহরিচাঁদ যাহার কান্ডারী।।
অগ্রে গিয়ে হরিচাঁদ যে মাল কিনিত।
মহেশ ব্যাপারী গিয়ে নৌকায় পুরিত।।
সঙ্গে থেকে হরিচাঁদ বিক্রয় করিত।
মহেশ ব্যাপারী তাহা চাক্ষুষ দেখিত।।
মহেশের সঙ্গে যেন থাকে হরিচাঁদ।
মহেশের হৃদে তাহে বাড়িল আহ্লাদ।।
হয় নাই হবে নারে এমন ব্যাপারী।
হরিচাঁদ সনে কেলী দিবা বিভাবরী।।
ধন্য তালতলা ধন্য ব্যাপারীর গণ।
মহেশ ব্যাপারী গুণে ধন্য সর্বজন।।
ধান চাউল হরিদ্রা কলাই মুশুরী।
গোলা কিনিতেন কভু মহেশ ব্যাপারী।।
বহু অর্থলভ্য হ’ত বাড়িত সে ধন।
সন্তুষ্ট হ’তেন তাহে প্রাণ হরিধন।।
মাঝিগণ সবাকার আনন্দিত প্রাণ।
সকলেই জানে হরি স্বয়ং ভগবান।।
বহুদেশ দেশান্তর ভ্রমিয়ে বেড়ায়।
সবাকেই নিসঙ্কটে রাখে দয়াময়।।
শিক্ষা দিতে তেজারতি সবে দয়াময়।
বাসিন্দা দোকান করেন ঘোনা পাড়ায়।।
কার্যদক্ষ শ্রীগুরুচরণ বালা তায়।
ভ্রাতুষ্পুত্র কালীবালা কর্মচারী হয়।।
করিল দ্বিতীয় বাসা ভেড়ার বাজার।
শ্রীরামতনু বিশ্বাস মহুরী তাহার।।
কার্যদক্ষ হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী সুজন।
শ্রীরামকান্ত চৌধুরী প্রফুল্লিত মন।।
শ্রীগুরুচাঁদ ঢালী যে এল তার পরে।
সমপ্রাণ গুরুচাঁদ ভাবেন যাহারে।।
শ্রীপূর্ণ বিশ্বাস হয় তালতলা বাসী।
প্রথম যৌবন তার পরম উল্লাসী।।
বিপুল ভাবেতে তথা করে কারবার।
সকলেই করে কর্ম আনন্দ অপার।।
তারাইল বাজারেতে তার বাসা হয়।
বহু দ্রব্য আমদানী করেন তথায়।।
তথাকার কার্যদক্ষ কাঙ্গালী ব্যাপারী।
প্রাণ দিয়ে করে কর্ম বহু শ্রম করি।।
অন্য বাসা ঘর করে আড়ুয়াকাঁদিতে।
কার্যদক্ষ সুধন্য ঠাকুর হন তাতে।।
বীরেশ্বর বিশ্বাস বেথুড়িয়ায় বাস।
লক্ষণ ঠাকুর আর শ্রীঈশ্বর দাস।।
শ্রীনীলকান্ত চৌধুরী গোপাল বিশ্বাস।
শ্রীমহেশ মাঝি সঙ্গে পরম উল্লাস।।
বিকি কিনি করে সদা আনন্দ হৃদয়।
এইভাবে গুরুচাঁদ ব্যবসা জানায়।।
কিভাবেতে হ’তে হয় ভবে লক্ষ্মীবন্ত।
শিক্ষা দিল সর্বজীবে সত্যভামা কান্ত।।
কি কৌশলে জীবগণ বাণিজ্য করিবে।
কিভাবে ধনবান হ’তে পারে সবে।।
শস্যহীনা বসুন্ধরা নেহারি নয়নে।
জীবের উপায় প্রভু ভাবে মনে মনে।।
জীবের মঙ্গল চিন্তা করি দয়াময়।
নানাভাবে করিলেন সহজ উপায়।।
এ বাণিজ্য না জানিত নমশূদ্রগণ।
অন্যান্য জাতিতে ইহা করে সর্বক্ষণ।।
জমাজমি শূন্য হয় তবে সাহাজাতি।
ব্যবসায় করে তারা বিপুল সম্পত্তি।।
সর্বসুখী হয় মাত্র ব্যবসা কারণ।
বাণিজ্যেতে করে বহু ধন উপার্জন।।
প্রভু গুরুচাঁদ হন সর্বজাতীশ্বর।
জীবহিতে করেন মহাজনী বিস্তার।।
কে বুঝিবে এই তত্ত্ব কত মধুময়।
সর্বজীবে সম দয়া ঠাকুর হৃদয়।।
ক্রমে ক্রমে বহুজনে বাণিজ্য শিখিল।
বাণিজ্য ব্যবসা লক্ষ্মী অনেকে বুঝিল।।
অনেকেই এ বাণিজ্য বুঝিল যখন।
প্রভু বলে সবে বুঝে দাও মম ধন।।
গৃহে গিয়ে সবে করে ধন উপার্জন।
অনেকে বুঝি এসে ব্যবসা কেমন।।
এত শুনি সর্বজনে ধন বুঝে দিল।
গৃহে গিয়ে কোন জন নৌকা বানাইল।।
কেহ অন্য তহবিলে কর্মে হয় রত।
ধন উপার্জন করে যার যেই মত।।
রামতনু বিশ্বাস মহৎ মহাশয়।
শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদিতে চাকরী করয়।।
ঠাকুরের নিজবাটী হ’লেন মহুরী।
কর্ম করে অনুক্ষণ বলে হরি হরি।।
কাহাকে বা গুরুচাঁদ দেন অনুমতি।
বাণিজ্য করহ এবে হয়ে শুদ্ধমতি।।
সচ্চরিত্রধারী হ’য়ে হও সদাগর।
অট্টালিকা হবে তার বরেতে আমার।।
যেইজন কম বেশী ওজন করিবে।
মূলধন হারা হবে কিছুই না রবে।।
সূক্ষ্ম পথে থেকে সূক্ষ্ম করিবে ওজন।
সকলের কাছে প্রিয় হ’বে সেইজন।।
সহরে ওজন সহী সর্বদা রাখিবে।
সত্যভাষী হ’য়ে যেবা ধন উপার্জিবে।।
পুরুষানুক্রমে তার ধন বৃদ্ধি হ’বে।
অভিমানী হ’লে ধন ক্রমে নাহি রবে।।
অপরের ধন কিছু না করিবে চুরি।
কারো সনে কভু নাহি কর বাটপারি।।
শুদ্ধচিত্তে শুচি ভাবে থাকিবে সতত।
সত্যনিষ্ঠ হ’য়ে থাক ব্যবসাতে রত।।
তাতে লক্ষ্মী বশ হবে জানিও নিশ্চয়।
ব্যাভিচারী হলে তার ধন নাহি রয়।।
এখন বুঝিয়ে দেও আমার এ ধন।
নিজধন নিয়ে কর ধন উপার্জন।।
এত শুনি বুঝি দিল প্রভুর সে ধন।
প্রেমানন্দে চলে সবে আপন ভবন।।
এইমত গুরুচাঁদ বুঝে নিল ধন।
কৃপা করি কাহারে বা করে মহাজন।।
গৃহে গিয়ে করে কেহ বিবিধ ব্যবসা।
নৌকা চালাইয়ে করে মহাজনী পেশা।।
মানসা করিয়ে যায় ব্যবসা করিতে।
প্রভুর কৃপায় পেল বহু লভ্য তা’তে।।
পুনঃ এসে প্রভুপদে করিয়ে জ্ঞাপন।
ঠাকুরের কাছে দেয় মানসিক ধন।।
পুনঃ করে মানসী সে পুনঃ এসে দেয়।
এরূপে সুলাভ প্রাপ্ত অনেকেই পায়।।
ঠাকুরের কৃপাযোগে বহু বহুজন।
ক্রমে ক্রমে তারা সবে হয় মহাজন।।
নিদর্শন আছে তার অনেক গ্রামেতে।
অট্টালিকা প্রাপ্ত কেহ প্রভুর কৃপাতে।।
এমন পরম বন্ধু কেবা আর ভবে।
হাতে ধরি কর্ম শিক্ষা কে দিয়েছে কবে।।
কৃষিকর্ম বাণিজ্যাদি করিত আপনি।
গৃহধর্ম শিক্ষা দেন গুরুগুণমণি।।
সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জগতে জানায়।
আপনি করিয়ে কর্ম শিখা’ল সবায়।।
জীবহিতে বহু কর্ম আপনি করিল।
হরিগুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।
শ্রী শ্রীনাথের বিবাহ ও বিচরণের জন্ম কথা
তালতলাবাসী রামনিকাশী বিশ্বাস।
দুই পুত্র পেয়ে তার পরম উল্লাস।।
সচ্চরিত্রধারী তিনি পরম সুজন।
গুরুচাঁদে প্রাণ মন করেছেন অর্পণ।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীকানাই বিশ্বাস সুমতি।
অতি সদ্জ্ঞানী হয় সরল প্রকৃতি।।
কনিষ্ঠ শ্রীনাথ হয় অতি নিষ্ঠাবান।
কপটতা চতুরতা না জানে কখন।।
বিবাহ করেছে মাত্র কানাই বিশ্বাস।
শ্রীনাথে বিবাহ দিতে প্রভুরাভিলাষ।।
প্রভু বলে শুন তুমি আমার বচন।
বাণিজ্য করিতে আর যেও না এখন।।
শ্রীনাথ ব’লেছে কি গৃহেতে থাকিব।
চরণ বন্দনা করি বাণিজ্য করিব।।
প্রভু বলে হয় তব যৌবন সময়।
পাত্রীকে রাখিতে নারি কত বড় দায়।।
সেই হেতু তোমার থাকিতে হ’বে ঘর।
বেঁধে রাখ মম নৌকা বচন আমার।।
শ্রীনাথ থাকে না ঘরে চলিল নৌকায়।
বাণিজ্য করিতে শ্রীনাথ পুনঃ যায়।।
পুনরায় এল ঘাটে প্রভু পুনঃ বলে।
নিশ্চয় মারিব তোরে নৌকা খুলে গেলে।।
অগত্যা থাকিতে হ’ল শ্রীধামে বসিয়া।
গুরুচাঁদ কহে বাণী শ্রীনাথে চাহিয়া।।
কৃষ্ণপুরবাসী হয় বালা বংশজাত।
শ্রীঅক্রুর চন্দ্র বালা পরম ভকত।।
তাহার নন্দন হয় শ্রীউমাচরণ।
তোমা প্রতি তাহার যে একান্ত মনন।।
সলোকামণি নামিনী তাহার ভগিনী।
তোমা তরে রাখিয়েছি শুন মম বাণী।।
তোমাকে দিয়ে সে ভগ্নি হইবে কৃতার্থ।
সাহায্য করিতে কিছু দিতে হবে অর্থ।।
শ্রীনাথ বলেছে বাণী প্রভুর সদন।
কেবা দিবে কা’র ঠাই কেবা লবে পণ।।
ইহার তাৎপর্য কিছু বুঝিতে না পারি।
কোন পক্ষে কেবা কর্তা না পাই বিচারি।।
শ্রীউমাচরণ বালা দাঁড়িয়ে তথায়।
শ্রীনাথের বাক্য শুনি প্রফুল্লিত কায়।।
মনে ভাবে যেই মত ভগিনী আমার।
ঠাকুর রেখেছে বটে উপযুক্ত বর।।
প্রভু কয় শ্রীনাথেরে শুন বাছাধন।
আমিই করিব দান আমি লব পণ।।
শ্রীনাথ পড়িল বাঁধা প্রভুর বাক্যেতে।
তবুও শ্রীনাথ গেল বাণিজ্য করিতে।।
সুলভ্য হইল তার এ ক্ষ্যাপে প্রভুর।
পণের টাকা গুণে লইল ঠাকুর।।
পুনঃ আজ্ঞা নাহি দেন খুলিতে তরণী।
শ্রীনাথের পানে চাহি বলে কটু বাণী।।
আমার ইচ্ছার পর করিস আঘাত।
সত্য কথা বল এবে আমার সাক্ষাৎ।।
রাখিবি কি না রাখিবি বচন আমার।
করিবি কিনা করিবি বিবাহ এবার।।
অলঙ্ঘ্য আমার বাণী শোন দুরাত্মন।
কোথা পেলি হেন শক্তি করিতে লঙ্ঘন।।
প্রভু বাক্যে ভক্তবীর আবদ্ধ হইল।
ঠাকুরের আজ্ঞামতে বিবাহ করিল।।
দশদিন কোন মতে থাকিলেন ঘরে।
পুনরায় চলি যায় বাণিজ্যের তরে।।
এই ভাবে করে সদা ব্যাপার বাণিজ্য।
বিবাহ ক’রেছে বটে নাহি করে গ্রাহ্য।।
বহুদিন চলি যায় নাহি স্পর্শে নারী।
নারীর অন্তর বার্তা জানে মাত্র নারী।।
বিধি নিয়োজিত কর্ম হয়ে গেল শেষ।
সুযোগ্য বিবাহ করি চলিল বিদেশ।।
গৃহে এলে নাহি চায় রমণীর পানে।
পবিত্র স্বভাব নিয়ে রহে সর্বক্ষণ।।
কিন্তু বড় দুঃখ তাহে রমণীর প্রাণে।
পতিসুখ না ঘটিল প্রথম যৌবনে।।
তুষানল সম সদা দহিত হৃদয়।
প্রকাশ করিতে নারে লোকলজ্জা ভয়।।
পিতৃগৃহে গিয়ে ধনী কাঁদে মন দুঃখে।
দুঃসহ যাতনা সেই রমণীর বুকে।।
বুঝিল কন্যার দুঃখ তাহার জননী।
প্রবোধ দিতেন কত বলে মিষ্ট বাণী।।
এইভাবে বহুদিন গত হ’য়ে যায়।
তথাপি শ্রীনাথ কভু ফিরিয়ে না চায়।।
শ্রীউমাচরণ প্রতি বলে তার মাতা।
আয় দেখি বাছাধন শোন এবে কথা।।
চল বাপ ওঢ়াকাঁদি ঠাকুরের ঠাই।
মরমের কথা আজ ঠাকুরে জানাই।।
তখনেই ওঢ়াকাঁদি করিল গমন।
গুরুচাঁদ পদে সব করে নিবেদন।।
আদ্যপান্ত সব কথা শুনিলেন ঠাকুর।
মিষ্ট বাক্য বলে কত মধুর মধুর।।
অতঃপর সবাকারে করিল বিদায়।
শ্রীনাথ আইল পরে আনন্দ হৃদয়।।
প্রভু বলে এবে তুমি নৌকা ছেড়ে দাও।
মম বাক্যে গৃহে থেকে কর্ম করি খাও।।
শ্রীনাথ বুঝিতে পেল কারণ তাহার।
প্রভুর বাক্যেতে পরে করিল স্বীকার।।
নৌকায় না গেলে পুনঃ থাকি নিজ ঘর।
প্রভুর অভীষ্ট হেতু করিল সংসার।।
গৃহকর্ম করে আর হরিনাম লয়।
সলোকামনির তাহে আনন্দ হৃদয়।।
দিবসেতে গৃহকর্ম করে সযতনে।
পতিপদ চিনতে সদা আপনার মনে।।
নিশিযোগে পতিপদ সেবিত কৌতুকে।
প্রেমভরে পতিপদ ধরিতেন বুকে।।
শ্রীনাথ হইল মুগ্ধ নারীর সেবায়।
গৃহবাস করে বড় প্রফুল্ল হৃদয়।।
কিছুকাল মহানন্দে অতীত হইল।
রমণীর স্বকামনা পূরণ করিল।।
একদিন কেঁদে কেঁদে ক’রেছে কামনা।
নিজগুণে পুরাইও মনের বাসনা।।
পুত্রদান করিবারে যদি অভিলাষ।
হেন পুত্র দাও যেন হয় তব দাস।।
তোমার চরণতলে যেন পায় স্থান।
চিরদাস করি প্রভু রেখ সন্নিধান।।
এমত প্রার্থনা করে মিলিয়ে দম্পতি।
দশমাস অন্তে এক জন্মিল সন্ততি।।
পুত্রমুখ দরশনে আনন্দ লভিল।
বিচরণ বলি নাম পুত্রের রাখিল।।
শুভদিনে শুভক্ষণে জন্মে বিচরণ।
শ্রীহরির প্রীতে হরিবল সর্বজন।।
যুধিষ্ঠির বিশ্বাসের মানবলীলা সম্বরণ
যুধিষ্ঠির বিশ্বাসের শুনহ কাহিনী।
মান্যমান হন তিনি অতী সদজ্ঞানী।।
মতুয়ার প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভকতি।
অতুল ঐশ্বর্য তবু সরল প্রকৃতি।।
প্রকৃত মতুয়া বটে সেই যুধিষ্ঠির।
দয়ার্দ্র হৃদয়খানি অতীব সুস্থির।।
গুরুচাঁদ পদে ছিল একান্ত ভকতি।
অন্তরের ভাব সদা ছিল উর্দ্ধগতি।।
ম’তোগণে ভালবাসে ভাগবত বলি।
অঙ্গেতে মাখিত ম’তোদের পদধূলি।।
গোস্বামী শ্রীহীরামন কিংবা সে তারক।
এ দোঁহাকে পেয়ে হত হৃদয় পুলক।।
রসনাকে ডাকিতেন জামাতা বলিয়ে।
রসনা পাইত শান্তি সে ডাক শুনিয়ে।।
প্রকৃত বৈষ্ণব ওঢ়াকাঁদি ভাবাশ্রিত।
অন্তরঙ্গ পেলে হ’ত আনন্দে পূর্ণিত।।
মহানন্দে করে বাস আইচ পাড়ায়।
অন্তরেতে অনুক্ষণ হরিগুণ গায়।।
মাধুর্য অন্তরে লিপ্ত ঐশ্বর্য প্রকাশ।
হরিপ্রেমে মাতোয়ারা অন্তরে উল্লাস।।
তাহার ঘরণী হয় সাধনা নামিনী।
হীরামন করে ভক্তি পিতৃতুল্য মানি।।
বৃদ্ধকালে যুধিষ্ঠির ব্যাধিযুক্ত হয়।
লীলাসাঙ্গ হবে তাহা বুঝিল হৃদয়।।
বিধির লিখন কেবা খণ্ডাইতে পারে।
বড় সাধ হ’লে তারকেরে হেরিবারে।।
মনে ভাবে যদি মোর জামাতা আসিত।
বিদগ্ধ জীবন মম শীতল হইত।।
রজনী বিশ্বাস হয় সুযোগ্য নন্দন।
তাহাকে ডাকিয়া বলে শুন বাছাধন।।
জামাতাকে আনিবারে জয়পুরে যাও।
হেথা এনে রতনে আমারে দেখাও।।
আমার অবস্থা বল জামাতার কাছে।
তোমাকে হেরিতে মাত্র প্রাণবায়ু আছে।।
কৃপা করি একবার আসে যদি হেথা।
নেহারিলে দূরে যেত মরমের ব্যথা।।
এত শুনি শ্রীরজনী ব্যস্ত চিত্তে চলে।
চালনা গ্রামেতে গিয়ে দেখে ভাগ্যবলে।।
মজুমদার বাড়ী বৈসে তারক রসনা।
চিত্ত স্থির নহে যেন হয়েছে উন্মনা।।
শুক্তা গ্রামে হইয়েছে কবির বায়না।
দোঁহারের গণ সবে ক’রেছে রওনা।।
দক্ষিণ দিকেতে চাহি মন উচাটন।
লক্ষ্মীপুর বাসী দিয়ে করেছে গমন।।
পশ্চিম দিকেতে যেন পদ নাহি চলে।
মনে মনে পড়ে সে আইচপাড়া বলে।।
চালনা গ্রামেতে গিয়ে বসিয়ে পড়িল।
হেনকালে শ্রীরজনী তথায় আইল।।
নেহারিয়ে শ্রীরজনী প্রফুল্ল হৃদয়।
আবেগ ভরেতে গিয়ে প্রণমিল পায়।।
বলে আপনাকে আমি আনিতে চ’লেছি।
বাবার আসন্ন ভাব অন্তরে বুঝেছি।।
উচাটন মন প্রাণ আপনার তরে।
কৃপা করে যেতে হবে আমাদের ঘরে।।
আছে কিনা আছে বেঁচে আমার জনক।
মুহুর্মুহু বলে কোথা জামাতা তারক।।
শুনিয়ে রসনা চলে ত্বরিত গমনে।
উপনীত হ’ন যুধিষ্ঠিরের ভবনে।।
দেখিলেন যুধিষ্ঠির র’য়েছে শয্যায়।
নয়নে বহিছে ধারা বরিষাও প্রায়।।
ক্ষণে ক্ষণে থেকে মারে অঙ্গ ঝাঁকি।
তারক তারক বলে মুদিয়ে দু’আঁখি।।
রসনা ব’লেছে আমি আসিয়াছি এই।
বল এবে আপনার মনোকথা যেই।।
এত যদি বলে বাণী রসনা তারক।
বাবা আসিয়েছে বলি হৃদয় পুলক।।
পুনঃ সকাতরে বলে এসেছে জামাতা।
পালন করিতে হবে শেষের এ কথা।।
জীবনান্ত কাল মম হ’য়েছে উদয়।
এই বার পদতরী দেহত আমায়।।
তারক ব’লেছে ইহা সম্ভব না হয়।
জামাতা বলিয়ে মোরে ডাকেন সদায়।।
আমিও শ্বশুর জ্ঞানে ভাবি আপনাকে।
বিপদে ফেলেন কেন এ দীন তারকে।।
যুধিষ্ঠির বলে বাপ শুনহ বচন।
জামাতা বলিয়ে তোমা ডাকি যে কারণ।।
যেমত মায়ের বাক্যে যত শিশুগণ।
পিতাকে জামাতা করে মায়ের বচন।।
সেইমতে তোমাকে যে ডাকি চিরদিন।
পুত্রস্থানীয় আমি অতি দীনহীন।।
জামাতা নহে বটে তুমি মম পিতা।
শেষের মিনতি রাখ এই শেষ কথা।।
যদি নাহি দিবে শিরে রাতুল চরণ।
বিফল হইল এই জনম ধারণ।।
ভজন বিহীন যদি কারো পুত্র হয়।
তা হলে কি পিতা মাতা দূরে ফেলে দেয়।।
তাই বুঝি নিষ্ঠুরতা ক’রেছে প্রকাশ।
এতবলি যুধিষ্ঠির ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।।
তারক রসনা অদ্য প’ড়েছে বিপদে।
আন্তরিক শক্তি দিয়ে ডাকে হরিচাঁদে।।
বাবা হরিচাঁদ বলি ডাকিল যখন।
সুমেরুর চুড়া যেন হইল পতন।।
হরিগুরুচাঁদ স্মরি দিল শ্রীচরণ।
সেই ক্ষণে যুধিষ্ঠির ত্যাজিল জীবন।।
অকস্মাৎ শূন্য মার্গে হেন জয়ধ্বনি।
তারক বলেছে সবে দাও হুলুধ্বনি।।
রমণীর গণ সবে হুলুধ্বনি দিল।
তারক বলে’ছে তিনি বৈকুণ্ঠে চলিল।।
এইভাবে যুধিষ্ঠির জীবন ত্যজিল।
তারক রসনা প্রীতি হরি হরি বল।।