পৃষ্ঠাঃ ৪৬১-৪৮০
সকলে ডাকিয়া বলে আশ্চর্য্য অই।
দুরে যাহা বলি নাক কাছে চুপ রই।।
কি যেন মোহিনী শক্তি মতুয়ারা ধরে।
কাছে গেলে কথা কেহ বলিতে না পারে।।’’
হরিবর ভাবে মনে যাবে পুনরায়।
দেখিবে মতুয়া দেহে মোহিনী কোথায়?
পরদিন গেল পুনঃ মতুয়ার বাড়ী।
মনে মনে আজ বটে রাখিলেন আড়ি।।
হেনকালে মহানন্দ গোস্বামী সুজন।
আসিয়া বাড়ীর পরে দিল দরশন।।
কিবা সে মোহন কান্তি ভাবে ঢলঢল।
দীর্ঘ কেশ দীর্ঘ শ্মশ্রু আঁখি ছল ছল।।
শ্যামল কোমল কান্তি কোরকের সম।
ভস্মে ঢাকা অগ্নি সম জ্যোতিঃ অনুপম।।
সন্ধ্যা তারকার প্রায় আঁখি দুটি স্থির।
অধরে মৃদুল হাসি বা সুগম্ভীর।।
এমন মোহন ছবি যেই দেখিয়াছে।
বলাবলি নাই কিছু প্রাণ সঁপিয়াছে।।
করুণ কোমল চোখে বারেক তখন।
গোস্বামীজী হরিবরে করে দরশনে।।
মন্ত্র-মুগ্ধ ফণী যথা সাপুড়িয়া ধরে।
পলকে ধরিল স্বামী সেই হরিবরে।।
অবশ বিবশ দেহ বাক্য শক্তি নাই।
ঘন ঘন হরিবর ছাড়িতেছে হাই।।
কুমুদিনী পেল যেন চন্দ্র দরশন।
রবির কিরণে পদ্ম মেলিল নয়ন।।
সেই মত ভাব হল তাঁহার হৃদয়।
বাক্যহারা হয়ে পড়ে গোস্বামীর পায়।।
কৃপা দানে গোস্বামীজী তাঁহারে ধরিল।
তর্কবাদী হরিবর সেখানে মরিল।।
ভাব-ঘোরে ভাব নিয়ে পুনর্জম্ম হয়।
এবে শুন বলি কিছু সেই পরিচয়।।
উদাস ভাব ও গৃহকর্ম্ম ত্যাগ-পিতার আক্রোশ
মহানন্দ দেখে মন পাগল হইল।
গৃহকর্ম্ম গৃহধর্ম্ম নাহি লাগে ভাল।।
গোস্বামীকে মনে করি কান্দে সঙ্গোপনে।
পিতা বাদী, যেতে নাহি পারে কোনখানে।।
মাঝে মাঝে মহানন্দ দিতেন দর্শন।
যত দেখে তত ব্যস্ত হয় তার মন।।
উদাসীর ভাবে মত্ত কাজ নাহি করে।
শ্রীআনন্দ তিরস্কার করে হরিবরে।।
সাথে সাথে মহানন্দে গালি দেয় জোরে।
‘‘পাগল করিল কেন মোর হরিবরে।
ছেলেধরা জুয়াচোর যত মতুয়ারা।।
একেবারে করিয়াছে মোর দফা সারা।।’’
অলক্ষ্যে আনন্দ করে গালি বরিষণ।
গোস্বামী আসিলে ভক্তি করেন তখন।।
গালি দেয় শ্রীআনন্দ গোস্বামী রতনে।
নাম শুনে হরিবর শান্তি পায় প্রাণে।।
এত যে কটুক্তি করে আনন্দ সুজন।
হরিবর নহে দুঃখী তাহার কারণ।।
ভাবময় গোস্বামীজী বুঝিলেন মনে।
হরিবর কষ্ট সহে তাঁহার কারণে।।
দুঃখ দূর করিবারে সেই মহাত্মায়।
দুর্গাপুর গ্রামে আসি হইল উদয়।।
বহু যত্ন সে আনন্দ করে গোস্বামীরে।
আপন দুঃখের কথা বলে অতঃপরে।।
‘‘আশা ছিল হরিবর হইবে মোক্তার।
কিন্তু ফেল পরীক্ষাতে হল সেই বার।।
অকর্ম্মা বসিয়া গৃহে কার্য্য নাহি করে।
মনোদুঃখে সদা যেন আছি আমি মরে।।
তোমার সঙ্গেতে ঘোরে তাতে বাধা নাই।
গৃহকর্ম্ম ত্যাগ করে দুঃখে মরি তাই।।’’
গোস্বামী আনন্দে ডাকি বলিল তখন।
‘‘হরিবর লাগি চিন্তা করেনা কখন।।
মোক্তারী করেছে ফের তাতে লজ্জা নাই।
হরিবরে এক পাশ আমি দিয়ে যাই।।
‘দল’ করে হরিবর কবিগান গাবে।
তাহাতে তোমার দুঃখ সব দূরে যাবে।।’’
আনন্দে আনন্দ কয় ‘‘শুন মহাজন।
মনে মনে আমি তাই করেছি মনন।।
দয়া করে হরিবরে তাই বলে যাও।
কমায়ে দুঃখের বোঝা আমারে বাঁচাও।।’’
কথাশুনি হরিবর গোস্বামীরে কয়।
‘‘কবি গানে যেতে বাবা আমি করি ভয়।।
গানে গানে তোমা ভুলে যাব দিনে দিনে।
করি দলে আমি নাহি যাব সে কারণে।।’’
গোস্বামী কহিল তারে ‘‘শোন হরিবর।
যাহা বলি তাহা কর নাহি কোন ডর।।
যেথা যাও আমি সদা রব সাথে সাথে।
এ বাক্য ঠেলনা মোর তুমি কোন মতে।।’’
গোস্বামীর আজ্ঞামতে সেই হরিবর।
কবিগান করিবারে হল তৎপর।।
আদি শিক্ষা লাভ হল পিতার নিকটে।
শ্রীতারক পরে গুরু হইলেন বটে।।
হলদিবুনীয়া নামে বাদা সন্নিধানে।
আছে এক গ্রাম ইহা জানে সর্ব্বজনে।।
সেই দেশে হরিবরে পিতার সহিতে।
গান করিবারে গেল আনন্দিত চিতে।।
তারকের সাথে সেথা আনন্দের গান।
মালগাজী করে গান দুই মতিমান।।
তথা হলে রামপাল থানা প্রতি যায়।
আনন্দে সে পথ তবে তারকেরে কয়।।
‘‘মোর বাক্য শোন তুমি তারক সুজন।
মমপুত্র হরিবরে করহে গ্রহণ।।
পুত্র বলে শিষ্য বলে তারে তুমি লও।
রাখিবেন কি বাক্য মোর সেই কথা কও।।’’
আনন্দে তারক বলে ‘‘কোন বাধা নাই।
আজি হতে হরিবরে লইলাম ভাই।।’’
পিতার আদেশে তাই সেই হরিবর।
তারকচাঁদের পদে করে নমস্কার।।
গুরু বলে মান্য তাঁরে করে মনে প্রাণে।
পুনরায় আজ্ঞা পেল গুরুচাঁদ স্থানে।।
গুরুচাঁদ বলে তারে ‘‘শুন হরিবর।
তারকের মত লোক নাহি দেখি আর।।
তাঁরে গুরু কর তুমি সরল অন্তরে।
সফল জনম তবে হবে ভবপরে।।’’
এই ভাবে গুরু করি শ্রীতারকচান্দে।
কবিগান করে সাধু পরম আনন্দে।।
বহুস্থানে মান্য পেল বহুত উপাধি।
সুকবি বলিয়া নাম আছে নিরবধি।।
গুরুচাঁদ দিল আখ্যা ‘কবি গুণাকর।
রজত পদক দিল সঙ্গে উপহার।।
গ্রন্থকার জন্মভূমি বেতকাটা গ্রাম।
‘কবিরত্ন’ আখ্যা সেথা পেল গুণ ধাম।।
সুকবি রসিকলাল মুখোপাধ্যায়।
‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দিল মহাশয়।।
‘‘কবি চুড়ামণি’’ আর ‘‘কবি শিরোমণি।
রজত পদকে আখ্যা পাইলেন তিনি।।
এবে শুন গুরুচাঁদে দেখিল কি ভাবে?
নিজমুখে কবি যাহা বলিলেন সবে।।
মতুয়া চরিত্র গাঁথা সুধা হতে সুধা।
মহানন্দ বলে খেয়ে যায় ভবক্ষুধা।।
দেব দেবী করে পূজা গুরুচাঁদে মোর
ভক্ত শ্রীরাইচরণ গঙ্গাচর্না গাঁয়।
দয়াকরি গুরুচাঁদ তাঁর গৃহে যায়।।
হরিবর যেতে চায় প্রভু সন্নিধানে।
কিন্তু যেতে নাহি পারে পিতৃ আজ্ঞা বিনে।।
আনন্দ ভাবেন যদি যায় হরিবর।
গৃহে কভা না ফিরিবে সত্বর সত্বর।।
তাই যদি হরিবর কোথা যেতে চায়।
মনে সন্দ সে আনন্দ যেতে নাহি দেয়।।
প্রভুর অসাধ্য লীলা কে বুঝিতে পারে?
আনন্দের গৃহে কেহ পড়িলেন জ্বরে।।
আনন্দ বলিল ‘‘কেহ ওড়াকান্দী যাও।
বড়কর্তা গুরুচাঁদে সংবাদ জানাও।।
তিনি যে বিধান দিবে তাতে হবে মুক্তি।
মূল কথা করা চাই হরিচাঁদে ভক্তি।।
‘কে যায় কে যায় সবে বলাবলি করে।
কেহ বলে ‘‘পাঠাইয়া দাও হরিবরে।।’’
আনন্দে বলেন তাতে কাজ নাহি হবে।
ওড়াকান্দী গেলে হরে আর দুরে যাবে।।
অন্য কেহ যাও শ্রীঘ্র বিলম্ব না কর।
আমি বলি নীলমণি তুমি যেতে পার?
আনন্দের ছোট ভাই নাম নীলমণি।
দাদার আজ্ঞায় যাত্রা করিল তখনি।।
ওড়াকান্দী গিয়ে দেখে প্রভু বাড়ী নাই।
‘‘গিয়াছেন গঙ্গাচর্না’’ জেনে এল তাই।।
আনন্দ বলেন তবে ‘‘গঙ্গাচর্না যাও।
দেখ যদি গুরুচাঁদে সেইখানে পাও।।
তাতে নীলমণি বলে অমি পারিবনা।
এই ভাবে অস্বীকার করে সব জনা।।
অগত্যা আনন্দ তবে বলে হরিবরে।
যাবে যাও শীঘ্র কিন্তু এসো গৃহে ফিরে।।’’
আহা কি আনন্দ হল ভক্তের পরাণে।
নয়নের মণি হরি দেখিবে নয়নে।।
ত্রস্তগতি মহামতি গঙ্গাচর্না যায়।
মনোখেদে পড়ে কেদে প্রভুজীর পায়।।
আপনার কৃত গান পড়ে তার মনে।
ভাবে ভাবে ভাব যেন মিশে তার সনে।।
আমার গৌররূপে দেহ কায়,
ঘরে গুরজনার ভয়,
ফুকারিয়া কান্দিতে না পারি,
.....হরিবর সরকার
ভকতের ব্যথা প্রভু বুঝিলেন মনে।
ডাক দিয়া হরিবরে বলিল তখনে।।
‘‘কোন চিন্তা নাহি আর কর হরিবর।
আমিই বলিয়া দিব পিতাকে তোমার।।
সাধু সঙ্গে বাধা তেঁহ তোমাকে না দিবে।
মনের বাসনা তব পুরণ হইবে।।’’
হরিবর বলে কেন্দে ‘‘ওগো দয়াময়।
এসেছি বিধান নিতে পিতার আজ্ঞায়।।
প্রভু কয় দেখ চিন্তা তুমি নাহি কর আর।
গৃহে গিয়ে দেখি তুমি চলে গেছে জ্বর।।
অদ্য হেথা থাক সুখে কর নাম গান।।
কল্য তুমি নিজ গৃহে করিও প্রয়াণ।।
ফিরিবার পথে আমি দুর্গপুরে যাব।
তোমার পিতার ঠাঁই সকলি বলিব।।’’
প্রভুর বচনে তার চিত্ত শান্ত হল।
প্রেমানন্দে মেতে বলে হরি হরি বল।।
পর দিন চলিলেন আপন ভবনে।
গুরুচাঁদ রূপ সদা দেখে মনে মনে।।
গৃহে গিয়ে শুনিলেন সকলের ঠাঁই।
হরিবর গেলে অঅর জ্বর আসে নাই।।
ফুকারিয়া কান্দে সাধু ভাবে মনে মনে।
দেখেও চিনিনা আমি পরম রতনে।।
বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি যার চলে সর্ব্বস্থানে।
সামান্য মানুষ তাঁরে ভাবিয়াছি মনে।।
প্রভুর বচন সত্য নাহি হবে আন।
নিশ্চয় আসিবে হেথা প্রভু গুরুচাঁন।।
মাতা পিতা গৃহবাসী অন্যসব জনে।
ডাক দিয়া হরিবর বলিল তখনে।।
‘‘দয়া করে প্রভু মোরে দিল অজ্ঞা করি।
ফিরিবার পথে প্রভু আসিবে এ বাড়ী।।
খাদ্য দ্রব্য যাহা পার কর আয়োজন।
দয়া করে প্রভু যদি করেন ভোজন।।
সফল জীবন মোর হইবে তাহাতে।
দয়া করে কর সব তাহা ভাল মতে।।
আপনি খরিদ সাধু করিলেন দুগ্ধ।
দধি পাতে নিজে নিজে হয়ে ভাবে মুগ্ধ।।
গৃহবাসী অন্য সবে যোগ নাহি দেয়।
আসিবেন গুরুচাঁদ করেনা প্রত্যয়।।
হাটে গিয়ে হরিবর ফলমূল কিনে।
হেনকালে প্রভু এল তাহার ভবনে।।
আনন্দ বিনয় করে প্রভুজীর ঠাঁই।
প্রভু কহে ‘‘যারে চাই সেত বাড়ী নাই।।
এক কথা বলি আমি শুন মহাশয়।
হরিবরে বাঁধা তুমি দিওনা নিশ্চয়।।
সাধু সঙ্গ যদি করে তোমার নন্দন।
সেই গুণে মুক্তি পাবে বলিনু বচন।।
প্রভু যদি এই ভাবে বলিলেন কথা।
আনন্দ বসিয়া রহে হেঁট করি মাথা।।
মহাজ্ঞানী সে আনন্দ সুহ্ম বুদ্ধি রাখে।
প্রভুর বচন শুনি বলিল প্রভুকে।।
‘‘এই কথা বড় কর্তা বিশ্বাস না হয়।
কর্ম্মী বিনে কর্ম্মফল কেবা করে ক্ষয়?
সাধু সঙ্গ করে যদি পুত্র হরিবর।
তার কর্ম্মে ফল প্রাপ্তি হবেত তাহার।।
আমার উপায় তাতে কিবা হল বল?
জন্মাবধি কোন কর্ম্ম করি নাহি ভাল।।
আমার কর্ম্মের ফলে কার অধিকার?
কর্ম্মফল জানি তবে যার যার তার।।
নিতে চাও হরিবরে তারে তুমি লও।
আমার উপায় কিবা তাই বলে যাও।।
আনন্দের কথা শুনি তুষ্ট দয়াময়।
বলে যাহা বলি তাহা শুন মহাশয়।।
সুকর্ম্ম অকর্ম্ম ভবে চেনা বড় দায়।
কোন ভাবে কিযে হয় নাহি বোঝা যায়।।
নর হত্যা মহাপাপ শাস্ত্রে লিখিয়াছে।
বিশ্ববাসী সবে সেই নীতি শিখিয়াছে।।
যদি কেহ নরহত্যা করে কোন খানে।
রাজা তারে শাস্তি দেয় বাধিয়া পরানে।।
নরহত্যা দোষে দেখ নরহত্যা হয়।
কেবা পাপী কেন পাপী কার পাপ রয়?
ইহার মীমাংসা কিছু বলিব এখানে।
রাজার নাহিক পাপ শাস্তির বিধানে।।
শান্তিরক্ষা রাজধর্ম্ম শাস্ত্রের বচন।
শান্তির কারণে রাজা করেন শাসন।।
অশান্তি-আগুণ যদি জ্বলে কোন দুষ্ট।
শান্তি রক্ষা লাগি রাজা তারে করে নষ্ট।।
বিশ্বের কল্যাণ বটে তার মধ্যে রয়।
নরহত্যা দোষে রাজা তাতে দোষী নয়।।
এই কার্য্যে যে যে পালে রাজার আদেশ।
নরহত্যা দোষে স্পর্শ নাহি করে কেশ।।
বিশ্বের পালক যিনি রাজরাজেশ্বর।
সাধু-রীপী যত দেশ আছে ধরাপর।।
রাজার আদেশে তাঁরা শান্তি রক্ষা করে।
বিশ্ববাসী শান্তি পায় তাঁহাদের ধারে।।
সেই ব্রত নিতে চায় তোমার নন্দন।
তারে বাধা তুমি নাহি দিও কদাচন।।
তুমি বাধা নাহি দিলে তার ভয় নাই।
তাতে শুভ কর্ম্ম হবে আমি বলি তাই।।
‘‘করা বা করান ভাল’’ যত শুভ কাজ।
এই নীতি প্রচারিত সাধুর সমাজ।।
তোমার সাহায্যে যদি সেই হরিবর।
সাধু হতে পারে এই জাতির ভিতর।।
‘‘সাধ-করা’’ মূলে রবে তোমার সাহায্য।
সেই কর্ম্মফলে তুমি হবে বটে পূজ্য।।
শাস্ত্রী তুমি শাস্ত্রে তব বহু অধিকার।
কোন কথা শাস্ত্রমধ্যে করেছে প্রচার।।
‘‘বংশেতে সুপত্র যদি জন্মে একজন।
সেই বংশ উদ্ধার হয় তাহার কারণ।।’’
তাই বলি বাধা নাহি দিও হরিবরে।
তোমার মঙ্গল হবে বলি বারে বারে।।’’
প্রভুর বচন শুনি আনন্দ কান্দিল।
নত হয়ে প্রভুজীর চরণ বন্দিল।।
প্রভু বলে ‘‘আমি এবে গৃহে যেতে চাই।
কারে কি বলিব হরিবর বাড়ি নাই।।’’
এত বলি দয়াময় উঠিল নৌকায়।
হেনকালে এক নারী সেথা আসি কয়।।
‘‘দধি পেতে হরিবর রাখিয়াছে ঘরে।
মনে তাঁর ইচ্ছা ছিল দিতে তা তোমারে।।’’
প্রভু বলে ‘‘শীঘ্র আন খাব মাত্র তাই।
তোমরা আমার লাগি কিছু কর নাই।।’’
দধি খেয়ে প্রভু তবে বিদায় হইল।
রাউৎখামারে আসি বিশ্রাম করিল।।
হেনকালে হাট হতে এল হরিবর।
গৃহে গিয়ে শোনে বটে সব সমাচার।।
বিষম দুঃখেতে তার হৃদয় দহিল।
সঙ্গোপনে গৃহ হতে পালাইয়া গেল।।
মনে ভাবে যেই খানে হোক যত দূরে।
অবশ্য করিবে দেখা প্রভুর গোচরে।।
হেন কালে দেখা গেল রাউৎখামারে।
প্রভুর তরণী ভাসে ঘাটের উপরে।।
বালাদের ঘাটে তরী বাঁধা রহিয়াছে।
ধীরে ধীরে হরিবর এল তার কাছে।।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানে প্রভুজী উপরে।
এস্তগতি হরিবর গেল তথাকারে।।
গিয়া শোনে গৃহ মধ্যে প্রভু নিদ্রা যায়।
গান গায় হরিবর বসে বারান্দায়।।
যেই মাত্র গান শেষ করে হরিবর।
প্রভুজী বলেন কথা ঘরের ভিতর।।
‘‘গাও গাও আর গানগাও হরিবর।
গান ক্ষান্ত নাহি কর রাত্রির ভিতর।।’’
পরম আনন্দে গান করে মহাশয়।
অভুত অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিবারে পায়।।
গৃহমধ্যে দেখে যেন একটি জানালা।
সেখানে দাঁড়ায়ে আছে দ্বাদশী ললনা।।
কিবা সে রূপের আভা কহেন না যায়।
প্রতিমার মত সেথা দাঁড়াইয়া রয়।।
হরিবর মনে ভাবে কোন শ্রদ্ধা নারী।
প্রভুকে ব্যজন করে তাল বৃন্ত ধরি।।
পুনরায় গান করে পুনরায় চায়।
দেখে সেই নারী সেথা দাঁড়াইয়া রয়।।
এবার দেখিল শিরে স্বর্ণচূড়া বাঁধা।
মনে হয় ব্রজাঙ্গনা মানময়ী রাধা।।
বারে বারে তিন বার দেখে হরিবর।
তবুনা চেতনা জাগে হৃদয়ে তাহার।।
শুধু এই প্রশ্ন জাগে কেবা এই নারী।
দাঁড়ায়েছে কোন লাগি বুঝিতে না পরি।।
ঊষার কণক হাসি যবে দেখা দেয়।
সেই কালে গুরুচাঁদ তারে ডাকি কয়।।
‘‘গান ক্ষান্ত কর তুমি ওহে হরিবর।
শীঘ্র করি খুলে দাও ঘরের দুয়ার।।’’
অর্গল না ছিল বন্ধ ঘরের কপাটে।
হরিবর দ্বার খুলে তাতে অপকটে।।
দ্বার খুলে হরিবর দেখিলেন চাহি।
একা প্রভু গৃহমধ্যে আর কেহ নাহি।।
কোথাও জানালা নাহি কোথা কোন নারী।
একা প্রভু বসে খাটের উপরি।।
হতজ্ঞান হরিবর ভাবে মনে মনে।
‘‘নারী হস্তে সেবা নিতে প্রভুকে দেখিনে।।
রাত্রি কালে সেই কাল নাহি হল হুষ।
কিছুতে সে নারী নাহি হবেন মানুষ।।
দেবের দেবতা মোর প্রভু গুরুচান।
দেব দেবী সদা আসি করে তাঁর ধ্যান।।’’
এসব ভাবিয়া সাধু কান্দিতে লাগিল।
অন্তর্যাভামী গুরুচাঁদ তাঁহাকে কহিল।।
‘‘ভাগ্যগুণে অসম্ভব কিছু দেখা গেলে।
জ্ঞানী জনে সেই কথা কাহারে না বলে।।
যা’ দেখেছ ভাগ্যগুণে কারে নাহি কও।
প্রভাত হয়েছে এবে বাড়ী চলে যাও।।’’
দেব দেবী পূজা করে গুরচাঁদে মোর।
কাটিল না মহানন্দ তোর মায়া ঘোর।।
শ্রীগুরু-চরিত কথা সুধা হতে সুধা।
পিও সব ভক্তগণে যাবে ভব ক্ষুধা।।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের করুণায় দারুণ ব্যাধি মুক্তি
একবার হরিবর তারকের সাথে।
উপনীত হইলেন খুলনা জিলাতে।।
হালিস’র নামে গ্রামে উপস্থিত হয়।
যাদব মল্লিক বটে সেই সঙ্গে রয়।।
দৈবযোগে সন্ধ্যাকালে সেই হরিবর।
দারুণ বেদনা রোগে হইল কাতর।।
অসহ্য বেদনাভারে পাগলের প্রায়।
ইতি উতি ছুটাছুটি করিতেছে হায়।।
ক্ষণে ক্ষণে তারকের পদ ধরি কান্দে।
কোন কথা নাহি বলে সে তারক চান্দে।।
এই ভাবে সারা রাত্রি বহু কস্ট পেল।
প্রভাতে বেদনা কিছু উপশম হল।।
এক সাথে তিনজনে গৃহ পানে ধায়।
কান্দিয়া যাদব তবে তারকেরে কয়।।
‘‘দয়া করে হরিবরে ব্যাধি মুক্ত কর।
বেদনায় মনে হয় যেন মর-মর।।’’
তারক বলিল ‘‘ব্যাধি সারিবার নয়।
এক কাজ করে যদি ব্যাধি সেরে যায়।।
সে সব সম্ভব নয় শুধু বলাবলি।
বিশেষতঃ সেই কতা কেমনে বা বলি?
হরিবর বলে ‘‘প্রভু আজ্ঞা যদি হয়।
যাহা বল তাহা আমি করিব নিশ্চয়।।’’
গোস্বামী বলিল ‘‘হেন না বলিও আর।
তুমিত জান না বাপু সব সমাচার।।
আমি বলি মহানন্দে যদি থাক ভুলে।
এই রোগ নাহি আর হবে কোন কালে।।
কেমন হে হরিবর তাহা পারা যাবে?
তাতে বলি এই ব্যাধি আর না সারিবে।।
মহানন্দ অদর্শনে হয়েছে এ রোগ।
তাঁর সাথে বিরহের এই যোগাযোগ।।’’
হরিবর বলে কেন্দে ‘‘যদি প্রাণ যায়।
মহানন্দে ভুলে থাকা হবে না নিশ্চয়।।
মহানন্দ সঙ্গে মোর করেছে যে যোগ।
পরম বান্ধব মোর কিসের সে রোগ?’’
এই ভাবে দিন যায় রোগ নাহি সারে।
ক্ষণকাল কমে যার ক্ষণকাল বাড়ে।।
গানের বয়না কত করিল খেলাপ।
একদিন বেদনার হল বড় দাপ।।
অসহ্য বেদনা তাপ সহ্য করা ভার।
লোক পাঠাইয়া দিল প্রভুর গোচর।।
বিধান বলিয়া দিল প্রভু গুরুচাঁন।
বিধান মানিয়া মাত্র রোগে শান্তি পান।।
মরিচ বাঁটিয়া গুড়া দিয়া পান্তাভাতে।
আদেশ করিল প্রভু সেই ভাত খেতে।।
পরদিনে সে বেদনা দ্বিগুণিত হল।
ভাব দেখে লোক গিয়ে প্রভুকে জানাল।।
প্রভু কয় ‘‘আর কোন জানি না বিধান।
সারুক মরুক তাহা জানে ভগবান।।’’
এই ভাবে চলে রোগ কমে আর বাড়ে।
একেবারে রোগ তারে নাহি যায় ছেড়ে।।
জীর্ণ শীর্ণ হল দেহ চেনা হল দায়।
মনে হয় বেশী দিন রবে না ধরায়।।
হেনকালে দুই জন মতুয়া সুজন।
দুর্গাপুর আসি তারা দিল দরশন।।
সকল বৃত্তান্ত তারা শুনিয়া চলিল।
যাত্রা কালে হরিবর তাদের বলিল।।
‘‘আমার রোগের কথা প্রভুকে না বল।
তাঁর কৃপা গুণে রোগ ক্রমে হবে ভাল।।’’
তারা যবে ওড়াকান্দী উপস্থিত হয়।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ কিছু নাহি কয়।।
দুইদিন পরে তারা তৃতীয় দিবসে।
বিদায় মাগিয়া চলে নিজ নিজ দেশে।।
হেনকালে প্রভু বলে ‘‘মোর কথা লও।
দুই জনে এক সাতে দুর্গাপুর যাও।।
দুর্গাপুরবাসী হরিবর সরকার।
দারুন বেদনা রোগে রয়েছে কাতর।।
তারে গিয়া বল আমি দিতেছি বলিয়া।
অদ্য হতে রোগ তার যাইবে চলিয়া।।
ব্যথা পায় তবু মোরে কহিতে না চাহে।
আমার জানিতে বাকী কিছু নাহি রহে।।
তারে গিয়ে বল যাবে দারুণ বেদনা।
বেঁচে যেন থাকে তার মরা’ত হবে না।।’’
প্রভুর বচন শুনি তারা দুই জন।
ভূমিতে লোটায়ে ধরে প্রভুর চরণ।।
বলে ‘‘ওগো দয়াময় তুল্য দিতে নাই।
তুমি যে কি তাহা মোরা বুঝিয়া না পাই।।
এত বলি দুই জনে বিদায় মাগিল।
অপরাহ্নে দুর্গাপুর উপস্থিত হল।।
এসে দেখে হরিবর হাঁটিয়া বেড়ায়।
রোগ-চিহ্ন যেন কিছু নাহি দেখা যায়।।
প্রেমে পুলকিত দোঁহে কহে হরিবরে।
‘‘কেমন তোমার রোগ গিয়াছে সেরে?
হরিবর বলে ‘‘ভাই অদ্ভুত ঘটনা।
অদ্য হতে দুরে গেল সকল বেদনা।।’’
আদ্য অন্ত সে বৃত্তান্ত তারা যবে বলে।
প্রেমানন্দ হরিবর ভাবে অশ্রু জলে।।
‘‘হো রে দয়াল’’ বলি পড়িল ধুলায়।
যারা কাচে ছিল তারা ধরিয়া উঠায়।।
প্রেমালাপে রাত্রি কাটে বসে একখানে।
প্রভাতে বিদায় তারা হইল দুজনে।।
তদবধি রোগে মুক্তি পেল হরিবর।
দয়া করে মুক্তি দিল দয়াল আমার।।
শ্রীগুরু-চরিত কথা সুধা হতে সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যাবে ভব ক্ষুধা।।
হরিবরের কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ
আদি পত্নী সহচারী পুত্র সহ গেল মরি
বিলাপ করিয়া সাধু লিখিলেন গ্রন্থ।
কিছুকাল পরে তার বিভা করে পুনর্ব্বার
ক্রমে ক্রমে হরিবর হইলেন শান্ত।।
কামিনী নামিনী ধনি পত্নীরূপে এল যিনি
ভক্তিমতী সে রমণী পতি-প্রিয়া অতি।
পত্র পেতে করে সাধ জন্মিল কৃষ্ণপ্রসাদ
অক্ষয়ের বরে জন্মে শুনি এ ভারতী।।
পরে জন্মে তিনকন্যা কনিষ্ঠা অতীব ধন্যা
সাবিত্রী নামেতে কন্যা সাবিত্রী সমান।
বুদ্ধিমতী অতিশয় দেশবাসী সবে কয়
হেন কন্যা যেবা পায় সেই ভাগ্যবান।।
বয়সে বালিকা মাত্র তবু জানে কত তত্ত্ব
বলিতেছি সেই সুত্র সাধুজন ঠাঁই।
প্রতিভাশালিনী অতি বহুগুণে গুণবতী
পতিপদে নিষ্ঠা রতি রাখিত সদাই।।
একদা প্রভাতকালে কয়জনে একদলে
মতুয়ারা হরিবলে গেল দুর্গাপুরে।
হরিবর বাড়ী নাই সাবিত্রী দেবীর ঠাঁই।
তাহারা জিজ্ঞাসে তাই অতি মৃদু সুর।।
‘‘পিতা তব গেল কোথা বল দেখি ওগো মাতা
কেন নাহি বল কথা, কর নাকি ভয়?’’
নীরবে শুনিয়া যায় নাহি কোন কথা কয়
পাদ্য অর্ঘ্য আনি দেয় ব্যস্ত অতিশয়।।
অন্য কথা সনাতন করেছেন আলাপন
সব করে নিরীক্ষণ দেখিলেন চোখে।
কিবা জানি কোন ছলে উত্তরে পড়েছে হেলে
গৃহখানি কোলে কোলে, পড়িয়াছে বেঁকে।।
সাধুভক্ত সনাতন চিন্তা করে সর্ব্বক্ষণ
ওড়াকান্দী বলে মনে সদা রয় তার।
সে গৃহের দশা দেখে হেলা উত্তরের দিকে
যেন ওড়াকান্দী মুখে করে নমস্তার।।
সনাতন হাসি কয় ‘‘একি কান্ড মহাশয়
ঘর কেন হেলে রয়, উত্তরে দিকে?’’
এই বাণী শুনি কানে প্রবীণার মত জ্ঞানে
চাহি সনাতন পানে সাবিত্রী বালিকে।।
বলে ‘‘সাধু শোন কথা শুধু কি গৃহের মাথা
আমাদের সব মাথা উত্তরেতে হেলা।
যত সাধু আসে যায় তাঁহাদের করুনায়
পিতা মোর আর দেয় দক্ষিণেতে পেলা।।’’
বালিকার মুখে শুনি এহেন মধুর বাণী
সনাতন মহাগুণী কান্দিয়া আকুল।
বলে ‘‘করি আশীর্ব্বাদ দয়া করি দিবে পদ
দয়াময় গুরুচাঁদ, ধন্য হবে কুল।।’’
ওড়াকান্দী পরে যায় সনাতন মহাশয়
গুরুচাঁদে সব কয় এ সব কাহিনী।
গুরুচাঁদ শুনি কয় ‘‘তুষ্ট আমি অতিশয়
যাতে সুখী সুখে রয় করিব এখনি।।
মতুয়ার যাহা ভাব এ নারীর সে স্বভাব
ভাবে যাতে মিশে ভাব সেই ভাব করি।
গোপাল সাধুর ধরে যদি বিয়া দেই তারে
তাতে বটে হতে পারে সুখী এই নারী।।’’
ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে কিসে বাধা হতে পারে
ডেকে কয় হরিবরে, শোন হরিবর।
সাবিত্রী তোমার কন্যা জানিলাম জ্ঞানে ধন্যা
স্বভাবেতে অতি পন্যা বুদ্ধিতে প্রখর।।
গোপালের পুত্র সাথে ইচ্ছা আছে মোর চিতে
এই কন্যা বিয়ে দিতে তুমি কিবা বল?’’
কেন্দে কয় হরিবর ‘‘দয়াময় মহেশ্বর
আমি অতি দুরাচার মহাদুষ্ট খল।।
গোপালের সাথে মোরে মিশাবে কেমন করে
তিনি কভু দয়া করে নেবে কি এ কন্যা?’’
প্রভু কয় ‘‘চুপ থাক আমার বচন রাখ
যাহা বলি জেনে রাখ সাবিত্রী সুধন্যা।।’’
শুনিয়া প্রভুর বাণী প্রেমিকের শিরোমনী
করি জোড় করপাণি স্বীকার করিল।
কিছুদিন পরে তার মনে জানি সমাচার।
ওড়াকান্দী ধামোপর গোপাল আসিল।।
আসিল গোপাল সাধু চিত্তে ভরা প্রেম মধু
গুরুচাঁদ পূর্ণ বিধু বলিলেন তাঁরে।
‘‘তোমার পুত্রের তরে রেখেছি জোগাড় করে।
শ্রীহরিবরে ঘরে এক পুণ্যবতী।।
আমার বচন ধর তারে পুত্রবধু কর
বাধ্য তাতে হরিবর অতি হৃষ্টমতি।।’
প্রভু যদি বলে তাই গোপালের কথা নাই
হরিবরে বলে ভাই করি আলিঙ্গন।।
প্রভু দিন ঠিক করে সাধু আর হরিবরে
পরিণয় কার্য্য পরে করে সমাপন।।
কনিষ্ঠ পুত্রের নাম কাশীনাথ গুণধাম
করিতেন অবিরাম পিতার সেবন।
পিতা যাহা আজ্ঞা করে এস্ত্রে ব্যস্তে তাহা করে
কভু কোন দিন তরে করেনা লঙ্ঘন।।
বিবাহের এই সুত্রে কিছু কতা লিখি পত্রে
গোপালের জ্যেষ্ঠ পুত্রে সেই কন্যা দান।
পুণ্যবতী মহাসতী গুণবতী নিষ্ঠামতি
কেহ নহে ভাগ্যবতী তাহার সমান।।
নামেতে তপতী জানি ‘তোতা’ নামে আদরিণী
যেই ভাবে এল ধনি লহ্মীখালী বাড়ি।
পিতা তার ধনঞ্জয় মহাসাধু মহাশয়
গোপালের সঙ্গ পেয়ে সব দিল ছাড়ি।।
দুটি পুত্র আছে তাঁর চন্দ্রমণি জ্যেষ্ঠ তার
কনিষ্ঠ নবকুমার মহাগুণিশালী।
গোপালের করুনায় গুরুচাঁদ ধরা দেয়
তাই তাঁর সঙ্গে রয় সব কিছু ভুলি।।
চিরকুমারের বেশে এবে ভ্রমে দেশে দেশে
পবিত্র প্রেমের রসে দেহ মন ঘেরা।
গুরুচাঁদ অনুসঙ্গ সদা ছিল তাঁর সঙ্গ
প্রেমে তাঁর নাহি ভঙ্গ সকলের সেরা।।
কন্যাসাধ্য যে কনিষ্ঠা কনিষ্ঠা হইয়া শ্রেষ্ঠা
কতগুণ দিল স্রষ্টা তার মনে প্রাণে।
সরলা বালিকা প্রায় হাসি মুখে কথা কয়
সাধু মহাশান্তি পায় তারে গৃহে এনে।।
কাঞ্চন জননী দেবী নিস্কলঙ্কা পুন্যছবি
শ্রীগুরু গোপাল রবি দীপ্ত দিবাকর।
হরশীত কাশীনাথ তপতী সাবিত্রী সাথ
গৃহাশ্রম ধর্ম্মমত করিল প্রচার।।
জীবন সন্ধ্যার কালে এই কিরে ছিল ভালে
সতী তারা গেল চলে ফেলে গোপালেরে।
দীন মহানন্দ কয় গোপালের বেদনায়
পশুপাখী কান্দে হায় বৃক্ষপত্র ঝরে।।
হরিবরের নিষ্ঠা ভক্তি ও গ্রন্থ রচনা
বারুনীতে কত লোক যাতায়াত করে।
তারা সবে আহারাদি করে দুর্গাপুরে।।
অভূত অপূর্ব্ব লীলা গুরুচাঁদ করে।
অন্ধে দৃষ্টি প্রায় কত মৃতে প্রাণ ধরে।।
একবার হরিবর বারুণী সময়।
মহাদুঃখে ওড়াকান্দী হইল উদয়।।
প্রভুর নিকটে গিয়া কেন্দে কেন্দে কয়।
‘‘বল দয়াময় আমি কি করি উপায়।।
সাত পৈকা ধান্য মাত্র মোর গৃহে আছে।
এ দিকে বারুণী বটে আসিয়াছে কাছে।।
বহু লোক সমাগম হয় দুর্গাপুর।
তাঁদের সেবার কিবা করিব ঠাকুর।।’’
প্রভু বলে ‘‘চিন্তা নাহি কর হরিবর।
কারে খেতে নাহি তুমি দিও এইবার।।’’
হরিবর বলে ‘‘প্রভু মনেতে বোঝেনা।
মতুয়ারে খেতে নাহি দিলে ত হবেনা।।
আপনার কৃপাদৃষ্টি যদি আমি পাই।
যতেক আসুক লোক তাতে ক্ষতি নাই।।’’
প্রভু কয় ‘‘তবে শোন আমার বচন।
কি কাজ করিল সেই তারক সুজন।।
একবার অন্নাভাবে সেই মহাশয়।
আমার বাবার কাছে কেন্দে কেন্দে কয়।।
‘‘অন্নভাবে মারা প্রভু যাব এইবার।
অল্প দুটি ধান্য ছাড়া ধান্য নাহি আর।।’’
বাবা যেন সেই কথা শুনিলেনা কানে।
কিছু পরে চেয়ে বলি তারকের পানে।।
‘‘শুন হে তারক আমি বলি তব ঠাঁই।
কুমড়া আর মাছ পেলে পেমানন্দে খাই।।’’
তারক ভাবিল প্রভু কেন ইহা বলে।
নিশ্চয় উদ্দেশ্য কিছু অছে এর মুলে।।
এত ভাবি গৃহে চলি গেল মহাশয়।
হাতে তার অর্থ কড়ি কিছু নাহি হায়।।
গৃহ হতে ঘাটি এক লইল তখনে।
তাহা বান্ধা রেখে তবে কিছু কড়ি আনে।।
সেই কড়ি দিয়া পরে কুমড়া কিনিল।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাছ কিনিয়া আনিল।।
মৎস্য আর কুমড়া লয়ে এল ওড়াকান্দী।
বাবার চরণে পড়ে করে কান্দাকান্দি।।
বাবা বলে নাহি ভয় ঘরে চলে যাও।
যত ধন আছে তাহা বর্ষ ধরে খাও।।
বাবার কৃপায় দেখ কিবা ফল হলে?
সেই ধান সে তারক বর্ষ ধরে খেল।।
কিছুতে না ধান তার হল কিছু ক্ষয়।
প্রতিদিন খায় তবু যাহা তাই রয়।।
লহ্মী যাঁরে করে পূজা সেই যদি কয়।
চঞ্চলা অচলা হয়ে তার গৃহে রয়।।
কথা শুনে হরিবর কান্দিয়া আকুল।
বলে ‘‘বাবা বুঝিলাম এই বারে মূল।।
দৈবযোগে গৃহ হতে ঘাটি এনেছিল।
সেই ঘাটি হরিবর বান্ধা রেখে দিল।।
তাতে চারি আনা হল অর্থ পরিমান।
দু’পয়সা দিয়ে কুমড়া কেনে মতিমান।।
বহু চেষ্টা করে কোথা মাছ নাহি পেল।
মাছের বদলে কড়ি প্রভু হস্তে দিল।।
প্রভু কয় ‘‘আর ভয় নাহি হরিবর।
যাও যাও বাড়ী তুমি যাও হে সত্বর।।’’
বাড়ী এসে ধান্য মেপে দেখে মহাজন।
উনিশ পৈকার ধান হয়েছে গনণ।।
পূর্ব্বে যবে মেপেছিল সাত পৈকা হয়।
ওড়াকান্দ হতে এসে ধান্য বৃদ্ধি পায়।।
প্রেমেতে আপ্লুত হয়ে গড়াগড়ি যায়।।
হেন কালে এক শিষ্য আসিল বাড়ি।।
নাম তার হরিবর পারশুলা তথায়।।
দেহের ওজনে বটে অতিশয় ভারী।।
ডাক দিয়া হরিবরে বলে সেই জন।
‘‘দয়াকরে গুরুদেব করুন শ্রবণ।।
দুইমণ চাল আমি দিব মহোৎসবে।
আজ্ঞা যদি কর প্রভু এনে দেই তবে।।’’
কিবা কবে হরিবর কেন্দে কেন্দে সারা।
স্মরিয়া প্রভুর দয়া যেন জ্ঞান হারা।।
মহানন্দে তথাকারে মহোৎসব হল।
পরম সন্তুষ্ট চিত্তে সকলে খাইল।।
সঙ্গে সঙ্গে ওড়াকান্দী এল হরিবর।
প্রভুর চরণে পড়ে কান্দিল বিস্তার।।
প্রবুর করুণা ধন্য মনে ভাই তাই।
এমন দয়াল বন্ধু আর দেখি নাই।।
এই ভাবে হরিবর ওড়াকান্দী যায়।
এবে শোন কোন কার্য্য করে মহাশয়।।
প্রতি পালা গানে তার যতেক বায়না।
টাকা প্রতি তিন পাই রাখে জরিমানা।।
সেই অর্থ আনি দেয় প্রভুর নিকটে।
প্রতি বর্ষ বিশ ত্রিশ টাকা দেয় বটে।।
সদাশয় চিত্ত সাধু পরম উদার।
তারকের কৃপা ছিল তাহার উপর।।
কার্ত্তিক বৈরাগী নামে গঙ্গাচর্না বাসী।
গোলক পাগলে পেয়ে মত্ত হল আসি।।
তার পুত্র মহাকবি অশ্বিনী গোসাই।।
বড়ই দরিদ্র তিনি ছিল জানি তাই।।
তারকের আজ্ঞামতে সেই হরিবর।
কার্ত্তিকের অর্থ দান করিল বিস্তার।।
আমড়িয়া বাসী জানি সে নীল রতন।
একদিন হরিবরে বলিল বচন।।
দয়াময় গুরুচাঁদ বলিয়াছে কথা।
‘‘আজি যদি কেহ হায় থাকিত প্রণেতা।।
বাবার ‘‘দ্বাদশ আজ্ঞা’’ আর যত পাট।
সকল লিখিত বসে আমার নিকট।।
কত যে আনন্দ হতে বলিবার নয়।
এই ইচ্ছা পূর্ণ মোর বুঝি নাহি হয়।।’’
কথা শুনি হরিবর সুখী অতিশয়।
অন্তরের কথা কিছু তারে নাহি কয়।।
পরে গৃহে বসি তেঁহ করিল লিখন।
গ্রন্থ লয়ে ওড়াকান্দী করিল গমন।।
প্রভুর নিকটে গ্রন্থ পড়িয়া শুনায়।
গ্রন্থ শুনি গুরুচাঁদ সুখী অতিশয়।।
‘‘শ্রীমহাবারুনী’’ নামে গ্রন্থ একখান।
‘‘দ্বাদশ আজ্ঞা’র ছন্দে দ্বিতীয় প্রমাণ।।
তারকের বিরচিত ‘‘মহাসংকীর্ত্তন’’।
তারমধ্যে হরিবর করেছে রচন।।
‘‘হরি লীলামৃত’’ গ্রন্থ মুদ্রণের কালে।
কি কি কার্য্য করে তাহা আসিয়াছি বলে।।
পরম প্রেমিক সাধু সুরসিক ভক্ত।
জন্মাবধি ওড়াকান্দী মতে অনুরক্ত।।
‘‘মতুয়া সঙ্ঘের’’ মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।
সংক্ষেপে জীবনী তাঁর করিনু লিখন।।
মতুয়া চরিত্র কথা সুধা হতে সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যাবে ভব ক্ষুধা।।
শ্রীমৎ গোস্বামী রূপচাঁদের জীবন কথা
পরম তেজস্বী সাধু রূপচাঁদ নাম।
খুলনা জেলার মধ্যে হুকড়াতে ধাম।।
তারক চাঁদের কৃপা হল তাঁর পর।
সাধুর চরণ করি শুভ নমস্কার।।
বার শত বাহাত্তর সালের প্রথমে।
নামিলেন রূপচাঁদ এই ধরাধামে।।
বাল্য হতে মহাশয় অতি বলবান।
দৈহিক শক্তির কেহ ছিলনা সমান।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম কৃষি কার্য়ে রত।
সেই কার্য্যে কেহ নাহি ছিল তার মত।।
দিনে দিনে দিন যায় সংসার মায়ায়।
হেন কালে ডাক তাঁরে দিল দয়াময়।।
শ্রীতারকচাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
যাঁর গুণে শক্তি শালী বহু ভক্ত পাই।।
হুকড়া আসরে গান রসরাজ করে।
মুগ্ধ হয়ে রূপচাঁদ দেখিলেন তাঁরে।।
কিবা সে মোহন রূপ মধুর বচন।
দেখামাত্র লয় হরে ধন জন মন।।
তারকে দেখিয়া চিত্ত ব্যকুল হইল।
দিবা নিশি তার রূপ ভাবিতে লাগিল।।
অসহ্য পীঢ়ন দাহ অন্তরে সদায়।
ইতি উতি ধায় সাধু শান্তি নাহি পায়।।
এই ভাবে ক্রমে ক্রমে ভাদ্র মাস এল।
চাষ বাস কার্য্য সব শেষ হয়ে গেল।।
অমনি ছুটিল সাধু জয়পুর পানে।
উপনীত জয়পুর হল একদিনে।।
কিভাবে কেমনে গেল কিছু নাহি জানে।
বিস্মিত তারক তাহাশুনিয়া শ্রবণে।।
উপযুক্ত পাত্র বুঝি প্রাণে দয়া হয়।
আপন কম্বল খানি দিল তার গায়।।
কম্বল তাহারে দিয়া তারক বলিল।
‘‘ঘরে গিয়ে রূপচাঁদ শুধু হরিবল।।’’
আজ্ঞা পেয়ে সাধু এল নিজ দেশে ফিরে।
দিবা রাত্রি ‘‘গোপী যন্ত্রে’’ হরিনাম করে।।
ভাব দেখি দেশবাসী বলে ‘‘একি কান্ড।
হরি হলে সাধু হবে রূপচাঁদ ভন্ড।।
নিন্দা কি বন্দনে সাধু কাণ নাহি দেয়।
গুরু বাক্য নিষ্ঠা রেখে হরিগুণ গায়।।
পূর্ব্ব ভাব সব ছেড়ে বলে হরিবল।
হরি হরি বলে তাঁর চক্ষে বহে জল।।
শত্রু মিত্র যায় সাথে হয় দরশন।
কেন্দে বলে সাধু তার ধরিয়া চরণ।।
‘‘আশীর্ব্বাদ কর যেন হরিভক্তি পাই।
হরি ভক্তি বিনা আর কিছু নাহি চাই।।’’
তাহা দেখি নিন্দুকেরা বলে পুনরায়।
‘‘এ কি আশ্চর্য্য কান্ড বল মহাশয়।।
এত নয় সে মানুষ, মানুষ হয়েছে।
না জানি কেমন ভাব মানুষ পেয়েছে।।’’
এইভাবে হরি নাম করে নিরন্তর।
দৈবচক্রে দেহে তাঁর হল মহাজ্বর।।
শুধু জ্বর নয় সাথে দেহে হল ক্ষত।
চুপে চুপে জ্বালা সাধু সহে অবিরত।।
কয় দিন পরে নাহি জানি কি কারণে।
গৃহ ছাড়ি রাত্রে সাধু যায় কোন খানে।।
তাঁর সতী নারী নাম ফুলমালা দেবী।
শুদ্ধা শান্তা ভক্তিমতী করুনার ছবি।।
স্বামীর উপরে তাঁর বহু স্নেহ রয়।
স্বামী সেবা লাগি ব্যস্ত রহে সর্ব্বদায়।।
স্বামীর বৈরাগ্য দেখি সতী ভাবে মনে।
স্বামী ভিন্ন এ জীবনে বাঁচিব কেমনে?
তই যবে রাত্রি ভাগে সাধু কোথা যায়।
স্বামীর সন্ধানে দেবী পিছে পিছে ধায়।।
দেখে সাধু লোকালয় ছাড়িয়া চলিল।
নিরালা ভিটার পরে উপস্থিত হল।।
তেলীভিটা নামে স্থান অতি ভয়ঙ্কর।
দিবসে যাইতে সেথা লোকে পায় ডর।।
খড়মিলি শয্যা করি বসি তার পরে।
‘‘গোপীযন্ত্র’’ নিয়ে সাধু হরি নাম করে।।
ফুলমালা দেবী সব দিখয়া নয়নে।
সংঙ্গা হারা হয়ে পড়ে স্বামীর চরণে।
অকস্মাৎ দৃষ্টিপাত সাধু যদি করে।।
ফুলমালা বলে তারে চিনিলেন পরে।
সংঙ্গা প্রাপ্তে ফুলমালা বলিছে কান্দিয়া।
‘‘কোথা তুমি যাবে নাথ আমারে ফেলিয়া।।
এসব বৈরাগ্য ভাব সব ছেড়ে দাও।
গৃহেবসে হরিবলে জগত মাতাও।।’’
সতীর বাক্যেতে সাধু গৃহেতে ফিরিল।
সেই হতে রোগ তার দুরে চলে গেল।।
রোগে মুক্ত হয়ে সাধু জয়পুর যায়।
কান্দিয়া পড়িল সেথা তারকের পায়।।
তারিক বলিল তারে ‘‘শোন রূপচাঁদ।
পূর্নব্রহ্ম ভগবান প্রভু গুরুচাঁদ।।
ওড়াকান্দী অবতীর্ণ জীবের কারণে।
শরণ লহ গো তুমি তাঁহার চরণে।।’’
রূপচাঁদ বলে প্রভু ‘‘কিছু নাহি জানি।
দয়া করে যা শিখাও তাই মাত্র মানি।।
আমার বলিতে প্রভু নাহি কিছু আর।
দয়া করে লহ মোর জীবনের ভার।।’’
তারক বলিল তবে ‘‘লইলাম ভার।
ওড়াকান্দী যাতায়াত কর এইবার।।
তারকের সঙ্গে সাধু যায় ওড়াকান্দী।
শ্রীগুরুচাঁদেরে দেখে উঠিলেন কান্দি।।
প্রভু কয় ‘‘হে তারক এই কোন বীর?
বৃহৎ উন্নত দেহ সু-উন্নত শির।।’’
তারক সংক্ষেপে তার দিল পরিচয়।
পরিচয় অন্তে প্রভু তাঁরে ডেকে কয়।।
‘‘মোর বাক্য রূপচাঁদ একবার লও।
শ্রীহরিচাঁদের নাম জগতে ছড়াও।।’’
সেই হতে ওড়াকান্দী করে যাতায়াত।
কখন একাকী কভু তারকের সাথ।।
অধিকাংশ কালে যায় জয়পুর গ্রামে।
ভৃত্য ভাবে রহে পড়ি তারকের ধামে।।
ভক্তি গুণে বাধ্য তাঁর বাড়িত পুলক।
যেই কালে সে তারক দেহ ছাড়ি যায়।।
বহুকাল রূপচাঁদ আছিল তথায়।।
প্রাণপনে সেবা তাঁর বহুত করিল।
তাঁর কোলে শুয়ে সাধু জীবন ত্যাজিল।।
তারকের শক্তি নাকি রূপচাঁদ পায়।
তাঁর যত শিষ্য তারা এই কথা কয়।।
বহু শক্তিধারী ছিল রূপচাঁদ স্বামী।
কিছু তার উপখ্যান বলি এবে আমি।।
জমিদারের অত্যাচার নিবারণ ও স্খুল স্থাপন
হুকড়ার জমিদার বাসাবাটী যার ঘর
বাগহাট শহরের কাছে।
জাতিকে কায়স্থ তারা বিদ্যা বুদ্ধি ধনে সেরা
নাগবংশ খ্যাতি বহু আছে।।
প্রজা যত হুড়কায় আদি বন্দোবস্ত লয়
জোৎ কবুলতি নাহি দিল।
তাই তারা জনে জনে জমি নিল অনুমানে
দশ স্থলে বিশ বিঘা হলে।।
বহু পরে তত্ত্ব তার জানিলেন জমিদার
উপায় নাহিক আর কিছু।
যদি কবুলতি দেয় তবে ত উপায় হয়
ধর প্রজা কর তারে নিচু।।
এ সব করিয়া সায় জমিদার মহাশয়
হুকুমাদি দিল নায়েবেরে।
‘‘চলে যাও হুড়কায় যদি কবুলতি দেয়
কিছু নাহি বলিও প্রজারে।।
যদি কথা নাহি শোনে ধরে এনে জনে জনে
কবুলতি করাবে কবুল।
জমা বৃদ্ধি করি দিবে জমি জমা মাপ হবে
তাতে ক্রুটি নহে এক চুল।।’’
নায়েব আসিয়া পরে এই কথা ঘরে ঘরে
জানাইয়া দিল অগ্রভাগে।
যেই শোনে সেই কয় এ কি কথা মহাশয়
কথা শুনে জ্বলে মরি রাগে।।
প্রজা সবে এক ঠাঁই হয়ে বলে শুন ভাই
এই কার্য্য কেহ না করিও।
খাল কেটে কুমীরকে নিজ ঘরে এনে ডাকে
সাধে সাধে কেহ না মরিও।।’’
সবে মিলে করে সায় নায়েবের কাছে কয়
‘‘কবুলতি নাহি দিব মোরা।।’’
নায়েব শুনিয়া তই বলে ‘‘আর রক্ষা নাই
এত বুদ্ধি কোথা পেলি তোরা?
কিসে হলি রাজা রঘু? ভিটায় চরাব ঘুঘু
দুষ্ট গরু চাহিনা গোহালে।
এখনো রয়েছে রাজা উচ্ছন্ন করিব প্রজা।
দেখি পানি কোন পথে চলে?’’
নায়েবের কথা শুনি মনে মনে শঙ্ক গণি
প্রজা সহ গৃহে ফিরে গেল।
সে দিনের নীতি যাহা প্রজার বিপক্ষে তাহা
বলবান জমিদার ছিল।।
প্রজা সবে এক সাথে যুক্তি করে নানামতে
কি উপায় হবে বা এখানে?
সীতানাথ নামে জানি ডাক্তারী করেন তিনি
ধন্য তিনি ধনে জনে দানে।।
শুন তাঁর পরিচয় ‘‘দানবীর আখ্যা পায়।
বহু দা করে বহু স্থানে।
খুলনা সভার কালে সীতানাথ দলেবলে
কার্য্য সেথা করে রাত্রি দিনে।।
মিলিয়া সবার সাথে ডেকে বলে সীতানাথ
‘‘আমাদের শক্তি কিছু নাই।
ইংরেজ দেশের রাজা অতিশয় মহাতেজা
এই কার্য্যে সে-সাহায্য চাই।।
যত জমিদার রয় সকলে রাজাকে ভয়
মনে প্রাণে করে সব জানে।
আমার পরাণে কয় পাই যদি সে-আশ্রয়
ব্যাধি দুর হবে একদিনে।।
এ কার্য্য সাধিতে হলে বলি আমি সভাস্থলে
মতুয়ারা পারে তা করিতে।
জানি আমি ওড়াকান্দী সাহেবে করেছে বন্দি
ঠাকুর শ্রীগুরুচাঁদ হাতে।।
কথা মুনি সবে কয় ‘‘ধন্য মুক্তি মহাশয়
রূপচাঁদ মতুয়ারে ডাক।
সব কথা বল তারে বল তারে জোর করে
‘‘আমাদের কথা তুমি রাখ।।’’
যুক্তি করি প্রজাগণে রূপচাঁদে ডেকে আনে
রূপচাঁদ আসিল সভায়।
শুনিয়া সকল কথা হেঁট করে রেখে মাথা
পরে কথা গোস্বামীজী কয়।।
‘‘দেশের মঙ্গল তরে তোমাদের বাক্য ধরে
ওড়াকান্দী আমি চলে যাই।।
গুরুচাঁদ দয়াময় যদি তাঁর ইচ্ছা হয়
আমি বলি শঙ্কা কিছু নাই।।’’
কথাতে হইয়া রাজী চলিলেন গোস্বামীজী
উদয় হইলা ওড়াকান্দী।
শ্রীগুরুচাঁদের হেরে ভাসিয়া নয়ন নীরে
কহিতে লাগিলা কান্দি কান্দি।।
যত কিছু সমাচার মালেকের অত্যাচার
নিবেদন করিল চরণে।
গুরুচাঁদ শুনি কয় ‘‘রমণি নাহিরে ভয়
সাহেবের ডাকিব এখানে।।
ডক্টর মীডেরে ডাকি বলিলেন কমলাখি
‘‘শোন মীড আমার বচন।
মম ভক্ত এই জন রূপচাঁদ মহাজন
দেশে তার বড় অঘটন।।
অত্যাচারী জমিদার করিতেছে অত্যাচার
সহায় সম্বল কেহ নাই।
এর কিছু প্রতীকার, কর তুমি এই বার,
এই কথা বলি তব ঠাঁই।।
প্রভুর বচন শুনি, সাধু মীড গুণমণি,
বলে ‘‘কর্তা কোন চিন্তা নাই।
সব মিশনারী মিলে এক সাথে দলেবলে
হুকড়াতে মোরা সবে যাই।।’’
গুরুচাঁদ শুনে তাই বলে ‘‘রমণী গোসাই
শীঘ্রগতি চলে যাও দেশে।
এই শুভ সমাচার বল গিয়ে ঘরে ঘর
যা শুনিলে সাহেবের পাশে।।’’
রূপচাঁদ গৃহে যায় সবে সমাচার কয়
শুনি সবে হল আনন্দিত।
মীড হেথা নানা স্থানে ডাকি মিশনারীগণে
সব কথা জানাল ত্বরিত।।
সবে মিলে খুলনায় পরে গেল হুকড়ায়
বারজন সাহেবের দল।
নায়েব কি জমিদার ভয়ে কাঁপে থর থর
বাক্যহারা দেহে নাহি বল।।
করিলেন পলায়ন যত অত্যাচারীগণ
দেশবাসী করে জয়ধ্বনি।
পাঠশালা করি তায় সাহেবেরা চলি যায়
শান্তি পেল রূপচাঁদ গুণী।।
জলে-ডোবা বালকের প্রাণদান
হুড়কা গ্রামেতে বাস নাম অভিরাম।
সহজ সরল লোক সেই গুণধাম।।
এক পুত্র তার ঘরে বড়ই দুরন্ত।
কোন ভাবে সে বালক নাহি হয় শান্ত।।
একদা মধ্যাহ্ন কালে সকলে নিদ্রিত।
হেন কালে কাল আসি হল উপস্থিত।।
হাঁটিতে হাঁটিতে শিশু জলে গিয়া পড়ে।
সাঁতার জানেনা তাই সেথা ডুবে মরে।।
রূপচাঁদ গোস্বামীজী আপনার ঘরে।
এক মনে গুরুরূপ আরোপেতে হেরে।।
গুরুরূপ আরোপেতে যারা মত্ত রয়।
দুরদৃষ্টি শক্তি তারা অনায়াসে পায়।।
সেই শক্তি বলে সাধু দেখিল ঘটনা।
তরণী পাগলে তাহা করিল রটনা।।
ত্রস্তে ব্যস্তে দুইজনে সেইখানে যায়।
তরণী পাগল তবে বালকে উঠায়।।
গোস্বামীজী অভিরামে ডাকে ঘনে ঘন।
ডেকে বলে ‘‘বাপু! তুমি মানুষ কেমন?
অচেতন থাক ঘুমে কোন দিক নাই।
জলে পড়ে পুত্র মল ফল দেখ তাই।।’’
অভিরাম কান্দে ধরে গোস্বামী-চরণ।
‘দয়া করে পুত্রে মোর দেহ গো জীবন।।’’
গোস্বামী বলিল ‘‘আমি কিসে দেব প্রাণ?
প্রাণদাতা একমাত্র প্রভু হরিচান।।
মনে প্রাণে ডাক তাঁরে যদি মুক্তি চাও।
জাগিলে জাগিতে পারে এই ডোবা নাও।।’’
সবে মিলে কাঁদাকাঁদি করিছে বসিয়া।
হেনকালে রূপচাঁদ কহিল ডাকিয়া।।
‘‘বালকের দেহ কেহ স্পর্শ না করিও।
দুরে বসে হরি বলে সকলে কান্দিও।।
গোস্বামীজী নিজে গেল শবের নিকটে।
ধরিল বারক চাপি নিজ করপুটে।।
হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, বলে তার স্বরে।
বালকের গলা হতে জল পড়ে সরে।।
সবটুকু জল যবে বাহির হইল।
অমনি বালক তবে নিঃশ্বাস ছাড়িল।।
অদ্ভুত ঘটনা দেখি যত নরনারী।
উচ্চকন্ঠে সবে শুধু বলে হরি হরি।।
গোস্বামীর শক্তি দেখি আশ্চর্য্য মানিল।
দন্ডবৎ করে সবে চরণে পড়িল।।
অভিরাম. অবিরাম. পড়ে চরণেতে।
বলে ‘‘তুমি গুরুমোর হলে আজ হতে।।’’
রূপচাঁদ গোস্বামীর মহিমা বাড়িল।
দিনে দিনে যশ গেল দেশ দেশান্তরে।।
মুক্তি পেত বহু রোগী আসে তাঁর ধারে।।
মতুয়া চরিত্র কথা সুধাধিক সুধা।
মহানন্দ বলে খেলে যায় ভবক্ষুধা।
যঞ্জেশ্বরের মৃগী রোগ মুক্তি
জিলা হল যশোহর মামুদপুরেতে ঘর
যঞ্জেশ্বর বলে নাম জানি।
ধরে তারে অপস্মারে ‘‘মৃগী’’ বলে লোকাচারে
দুঃখে কান্দে দিবস রজনী।।
ওঝা বৈদ্য কবিরাজ ঔষধে না করে কাজ
দিনে দিনে হতেছে হতাশ।
কিবা করে কোথা যায়? সদা করে হায়, হায়,
কোন কিছু না করে বিশ্বাস।।
হেনকালে শোনে নাম, রূপচাঁদ গুণধাম
অন্য নাম রমণী গোঁসাই।।
হরিচাঁদ নাম গুণে সারিয়াছে কত জনে
ওঝা বৈদ্য যাহা পারে নাই।।
একথা শুনিল যবে যজ্ঞেশ্বর বসে ভাবে
কোথা গেলে দেখা পাব তাঁর।
একে আমি চির-রুগী রোগ তাতে হল ‘মৃগী’
হেঁটে যেতে সাধ্য নাহি আর।।
বুঝিলাম কর্ম্ম ফলে অকালে মরণ ভালে
জীবনের আশা কিছু নাই।
ভালে যদি এই লেখা তবে কেন বসে-থাকা
হুড়কাতে একা একা যাই।।
এই ভাবে যজ্ঞেশ্বর হল ক্রমে অগ্রসর
উপনীত হল হুড়কায়।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানে রূপচাঁদ কোনখানে
এসে কেন্দে পড়ে তার পায়।।
কেন্দে কেন্দে সব কয় গোস্বামীর দয়া হয়
বলে ‘‘তুমি থাক’’ মোর সাথে।
হরি যদি দয়া করে এ রোগ সারিতে পারে
তাঁরে তুমি ডাক এক চিতে।।’’
তদবধি যজ্ঞেশ্বর নাহি দেয় অবসর
নিরন্তর করে হরি নাম।
রোমজাইপুর গ্রামে সেই কথা বলি ক্রমে
মহোৎসবে গেল গুণধাম।।
যজ্ঞেশ্বর সাথে রয় সদাহরি হরি কয়
নাহি ছাড়ে গোস্বামীর সঙ্গ।
দুই দিন পরে তায় গোস্বামীজী গৃহে-ধায়
মহোৎসব করিলেন ভঙ্গ।।
মঙ্গলা নদীর কুলে যজ্ঞেশ্বর হেলে দুলে
করিতেছে সুধা হরিনাম।
অকস্মাৎ গোস্বামীজী কোন ভাবে কিবা বুঝি
বলে ‘‘আমি জলে নামিলাম।।’’
ভয় পেয়ে যজ্ঞেশ্বর বলে ‘‘কর্ত্তা খরতর
বেগ দেখি এ নদীর জলে।।’’
এই কথা যবে কয় বল আর কোথা যায়?
বেত্রাঘাত করে পৃষ্ঠ স্থলে।।
গোস্বামীর বেত্রাঘাত হল যে বজ্রাঘাত
যজ্ঞেশ্বর পড়িল ভূতলে।।
মহাভাবে সে গোস্বামী তখনি নদীতে নামি
ঝাঁপ দিল মঙ্গলার জলে।
তাই দেখে যজ্ঞেশ্বর ঘুচে গেল অন্ধকার
পিছে ঝাঁপ দিল হরি বলে।।
কুলে কুলে ভরা নদী আকারে যে জলধি
হাঙ্গর কুম্ভীর কত আছে।
কোন দিকে লক্ষ্য নাই ভেসে চলে সে গোঁসাই
জলজন্তু নাহি আসে কাছে।।
কিছু পরে সাঁতারিয়া উঠিলেন কুলে গিয়া
বলে ‘‘জোরে আর যজ্ঞেশ্বর।
এদিকেতে যজ্ঞেশ্বর অতি শ্রান্ত কলেবর
ওঠে গিয়া কুলের উপর।।
গোস্বামী হাসিয়া কয় ‘‘আয় মোর কাছে আয়
আয় বাছা কত দুঃখ পেলি।
তোর যে রোগের দায় তাতে মন ব্যস্ত রয়
আজ কিন্তু রোগ গেল চলি।।’’
রোগ নাহি এল আর বেঁচে গেল যজ্ঞেশ্বর
মহতের কৃপা পেয়ে ধন্য।
এই ভাবে কতজন দিবা রাত্রি সর্ব্বক্ষণ
তার কাছে আসে মুক্তি জন্য।।
সে সব লিখিতে গেলে গ্রন্থ বহু বেড়ে চলে
অল্পে অল্পে তাই ক্ষান্ত করি।
এই কথা বলা যায় যদি গ্রন্থ লেখা হয়
গ্রন্থ হতে পারে ভুরি ভুরি।।
অসীম ক্ষমতাশালী যত মতুয়া মন্ডলী
মহাশক্তি ধরে প্রতি জনে।
তাঁহাদের লীলা খেলা লেখে যদি সারা বেলা
শেষ নাহি হবে কোন ক্ষণে।।
তবু কিছু বিবরণ আমি করিব লিখন
যথাসাধ্য সংক্ষেপেতে হয়।
দিগরাজ তার ঘর ব্রহ্মকুলে জন্ম তার
ভুপতি নামেতে সেইজন।
বহু রোগে ভুগে পরে আসিয়া গোঁসাইর ধারে
শুরু বলে করিল বরণ।।
তাতে রোগে মুক্তি পায় সেই হতে সর্ব্বদায়
গোঁসাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে রয়।
ত্যজি কুল ত্যজি মান গুরু পদে মন প্রাণ
সমর্পণ করে শান্তি পায়।।
নির্ম্মল কুমার নামে নগরকান্দী গ্রামে
ভক্তিমান একটি বালক।
রূপচাঁদে ছোখে দেখে গুরু বলে মান্য রাখে
পাশ করে হইয়া পুলক।।
সুকঠিন ধর্ম্মপথ বড় দুঃখে যাতায়াত
সাধকের হয় করিবারে।
তেলিহাটি একবার বিপদ হইল তার
গুরুচাঁদ রক্ষা করে তারে।।
হাতে নিয়ে ‘‘গোপীযন্ত্র’’ হরি নাম মহামন্ত্র
যবে স্বামী করে উচ্চারণ।
কিবা নর কিবা নারী সদা ফেলে অশ্রু বারি
ধ্বনি শুনে মন উচাটন।।
লীলামৃত গ্রন্থখানি ছাপিলেন পুনঃ তিনি
দান ধর্ম্মে চিত্ত ছিল খোলা।
যেম্নি পতি তেম্নি সতী অতিশয় নিষ্ঠাবতী
পত্নী তাঁর দেবী ফুলমালা।।
ভ্রাতুস্পুত্র শ্রীযতীন্দ্র খুল্লতাতে করে মান্য
তার মতে তার পথে চলে।
নাম ধর্ম্ম পরচার কোথা করে সাধুবর
সেই কথা বলি কুতুহলে।।
মতুয়া চরিত্র গাঁথা, পরম পবিত্র কথা
সুধা হতে অতি সুধাময়।
তরিতে এ ভবনদী পান কর নিরবধি
দীন মহানন্দে তাই কয়।।
গোস্বামীর মতুয়া ধর্ম্ম প্রচার ও তিরোধন
হরিনাম-ধর্মে মত্ত রমণী গোঁসাই।
দুঃখী তাপী তার কাছে সদা ছোটে তাই।।
রোগে শান্তি মনে শান্তি পায় নারী নরে।
দিনে দিনে নাম গেল দেশ দেশান্তরে।।
সদর খুলনা মধ্যে বসুর আবেদে।
গোস্বামীরে নিল ভক্ত পরম আহলাদে।।
ভক্ত গৃহে হরিনাম করে গুণধাম।
সাথে সাথে নরনারী করে হরিনাম।।
তার্কিক ব্রাহ্মণ এক আসিয়া সেখানে।
বৃথা তর্কে হার মানে গোস্বামীর সনে।।
রুদ্ধ ক্রোধে সেই দৃষ্টি করে কৃমন্ত্রণা।
গোস্বামীকে দিতে চায় বিষম যন্ত্রণা।।
হরি যারে রক্ষা করে তারে কে বা মারে।
গোস্বামীকে দেখে যত দুষ্ট গেল সরে।।
মাট ভাঙ্গা, দেবী তলা, বয়ার ভাঙ্গায়।
দিনে দিনে গোস্বামীর বহু শিষ্য হয়।।
উঠিল নামের ঢেউ এই সব দেশে।
ক্রমে ক্রমে চলে ঢেউ প্রেমের বাতাসে।।
সাতক্ষীরা মহাকুমা মধ্যে বহু স্থানে।
গোস্বামীকে নিল সঙ্গে কীর্ত্তি কথা শুনে।।
সদর খুলনা মধ্যে লবণগোলায়।
বিহারী সদ্দার নামে অতি মহাশয়।।
রূপচাঁদে দেখি তার মন ভুলে গেল।
গুরুত্বে বরণ করে শ্রেষ্ঠ শিষ্য হল।।
মোল্লাহাট থানা মধ্যে আছে বহু গ্রাম।
বহু স্থালে যায় সেই সাধু গুণ ধাম।।
শিবপুর, জয়ডিহি, শিয়ালীর গাঁয়।
নগরকান্দীর গ্রামে গোস্বামীজী যায়।।
যশোহর মধ্যে তেঁহ যায় বহু স্থালে।
শুলটীয়া, গাছবাড়ী, গ্রামে সদা চলে।।
কামার গ্রামেতে প্রায় করে যাতায়াত।
প্রচার করিল সাধু ওড়াকান্দী মত।।
ওড়াকান্দী গ্রাম মধ্যে কেতুরাম দাস।
রূপচাঁদে গুরু বলে করিল বিশ্বাস।।
তের শত সাইত্রিশ সনে একবার।
দাসেরা করিল বটে মন্দ্র ব্যবহার।।
বারুনীতে ‘‘সার্কাসের’’ দল যেতেছিল।
কাঙ্গালী দাসের চক্রে তারা বাধা পেল।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞা দিল রূপচাঁদ যায়।
পরে সেই গোলমাল সুমীমাংসা হয়।।
এই ভাবে দেশে দেশে করেন ভ্রমণ।
যেথা যায় সব খানে কহেন বচন।।
‘‘ওড়াকান্দী হরিচাঁদ পূর্ণ অবতার।
এবে গুরু-চাঁদে আছে ত্যজি কালেবর।।
সেই পদে মনে প্রাণে লহরে শরণ।
আর না আসিবে হেন মানুষ রতন।।’’
তার চেষ্টা ফলে দেখ অতি অল্পকালে।
বহু লোক আসিলেন মতুয়ার দলে।।
ক্রমে এল তেরশত আটত্রিশ সাল।
গোস্বামী ছাড়িল দেহ সকাল সকাল।।
শিষ্যগণে ডাকি বলে ‘‘পোড়ায়োনা দেহ।
কলা ভেলা পরে হবে মোর শেষ গেহ।।’’
স্বতেজে স্বজ্ঞানে সাধু বসি পদ্মাসনে।
ত্যাজিল নশ্বর দেহ জ্যোতিঃ বিকীরণে।।
শেষ ইচ্ছা মতে দেহ জলে ভাসাইল।
ভক্ত সবে বহু দুঃখে অনেক কান্দিল।।
ভকত চরিত্র কথা সুধা হতে সুধা।
কবি কয় খেলে দুর হবে ভব ক্ষুধা।।
শ্রীমৎ বিপিন চাঁদ গোস্বামী জীবন কথা
ধন্য শ্রীবিপিন চন্দ্র গোস্বামী সুজন।
ওড়াকান্দী ভক্ত মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।।
বরিশাল জিলা মধ্যে কেনুভাঙ্গা গ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে সাধু গুণধাম।।
তালুক বলিয়া গ্রাম ছিল বটে কাছে।
বর্ত্তমানে মধুমতী নদী-গর্ভে গেছে।।
সেই গ্রামে জন্ম নিল সেই মহাশয়।
বার শ’ বিরাশী জানি সাল পরিচয়।।
পিতৃ পরিচয় এবে করিব প্রকাশ।
শ্রীবিষ্ণু চরণ নামে উপাধি বিশ্বাস।।
হিমালা নামেতে দেবী গর্ভে ছিল স্থান।
চারি ভাই গোস্বামীরা সবে গুণবান।।
খুলনা জিলার মধ্যে গ্রাম উজলপুর।
রাজচন্দ্র মাঝি যাঁর সম্মান প্রচুর।।
তস্য পত্নী ছিল বটে অতি ভক্তিমতী।
হরিচাঁদে মানে বলে জগতের পতি।।
পঞ্চ পুত্র একে একে সবে মারা গেল।
কোন জনে সেই দেবী ঔষধ না দিল।।
‘‘যা’’ করে ঠাকুর তাতে কোন দুঃখ নাই।
ঠাকুরের বাক্য ফেলে ঔষধ না খাই।।
এত তেজস্বিনী ছিল সেই ভক্তিমতী।
তাঁর কন্যা গোস্বামীর মাতা ভাগ্যবতী।।
গোস্বামীর পিতামহ নাম মনুরাম।
দেশ মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অতি গুণধাম।।
‘‘তালুকের মনুরাম’’ এক ডাকে চেনে।
‘‘প্রাচীন বনেদি ঘর’’ কহে সর্ব্ব জনে।।
গোলক পাগল যিনি মহা ভাবময়।
তালুকের এই বাড়ী একবার যায়।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ তেরশত সালে।
তালুকেতে একবার যান কুতুহলে।।
পরে যবে ওড়াকান্দী হাইস্কুল হল।
সে সময়ে দয়াময় তালুকেতে গেল।।
উন্মাদিনী মধুমতী কিছু নাহি মানে।
অল্পকালে তালুকেরে নিল গর্ভে টেনে।।
তার পরে করে বাস কেনুভাঙ্গা গাঁয়।
অদ্যাবধি সেইখানে গোস্বামীজী রয়।।
বাল্যকালে নিজ দেশে পড়ে পাঠশালে।
প্রাথমিক শিক্ষা লাগি পাটগাতী চলে।।
ব্রাহ্মণ বাড়ীতে থাকি করে অধ্যয়ন।
অল্প দিনে প্রাথমিক হল সমাপন।।
উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা লভিবার আশে।
খুলনা জিলার মধ্যে ডিংসীপাড়া আসে।।
‘‘গড়গড়ি’’ বলি কয় বংশেতে ব্রাহ্মণ।
সেই গৃহে গোস্বামীজী করে আগমন।।
পাঠশেষে করি করে বস্ত্র ব্যবসায়।
ব্যবসায় উপলক্ষ্যে নানা দেশে যায়।।
পাটগাতী গ্রামে ঘর মন্ডল উপাধি।
ধনবান মান্যবান তারা নিরবধি।।
শ্রীচন্দ্র কুমার নামে সেই বংশে যিনি।
বিপিনের ভগ্নী বিয়া করিলেন তিনি।।
এদিকে প্রভুর পুত্র সুধন্য কুমার।
মন্ডল বংশেতে হয় পরিনয় তাঁর।।
সেই সুত্রে ঠাকুরের সঙ্গে কুটুম্বিতা।
বিপিন রাখিত মনে সেইসব কথা।।
গউর বিশ্বাস নামে পন্ডিত সুজন।
বিপিনের গৃহে বাস করিত সেজন।।
নিবাস ফলসী গ্রাম ওড়াকান্দী কাছে।
সেই গ্রামে বিপিনের যাতায়াত আছে।।
একবার চৈত্রমাসে সেই গ্রামে যায়।
ওড়াকান্দী গেল পরে বারুণী সময়।।
সংক্রান্তীর দিনে হল বারুণী উৎসব।
সে ভাব নাহিক এবে বারুনীর ভাব।।
অল্প সংখ্যা লোক হত উৎসবেরে কালে।
দিনমাত্র বারুণীর মহামেলা মেলে।।
বিপিন চলিল সেথা কুটুম্বের বেশে।
প্রণাম করিতে গেলে ঠাকুরের পাশে।।
বিপিনের পরিচয় লইল ঠাকুর।
আনন্দ প্রকাশ প্রভু করিল প্রচুর।।
যত্ন করে জলয়োগ করাইল তারে।
বিপিন ফিরিয়া তবে আসিলেন ঘরে।।
সে সময়ে ঠাকুরের শিরে দীর্ঘ কেশ।
কটী-বিলম্বিত তাহা মনোহর বেশ।।
বিপিনের প্রাণে প্রশ্ন জাগে বারে বার।
দীর্ঘ কেশ রাখে কেন মাথার উপর।।
দীর্ঘকেশ রাখে কেন বুঝিনা ব্যাপার।।
যতবার এই কথা চিন্তা করে মনে।
মন হয় প্রভু যেন প্রাণ ধরে টানে।।
তাঁর চিন্তা লাগে ভাল শয়নে স্বপনে।
রূপ যেন আছে ঘিরে তার দুনয়নে।।
মনে মনে এই ভাব কাহারে না কহে।
চলে ফেরে কাজ করে চুপ করে রহে।।
এর পূর্ব্বে মাতিলেন শ্রীদেবীচরণ।
সম্পর্কেতে বিপিনের মামা সেই জন।।
গঙ্গাচর্না গ্রামে বাস মদন বিশ্বাস।
গুরুবলে দেবীচাঁদ যান তাঁর পাশ।।
আদি বীজ শ্রীমদন করিল বপন।
তারকের সঙ্গে গুণে শক্তি জাগরণ।।
শ্রীতারক দেবীচাঁদে নিল ওড়াকান্দী।
বর্ণনা করেছি পূর্ব্বে সেই সব সন্ধী।।
এবে মুন কি করিল বিপিন গোঁসাই।
একদিন জিজ্ঞাসিল দেবীচাঁদ ঠাঁই।।
‘‘আচ্ছা মামা সত্য করে বল মোর ঠাঁই।
ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ কেমন গোঁসাই?
এমন সুন্দর রূপ ফুলের মতন।
লম্বা চুল রাখে শিরে বল কি কারণ?’’
এ সময়ে বিপিনের শুন পরিচয়।
মাঝে মাঝে যাত্রা গানে করে অভিনয়।।
অভিনয়ে ছিল তাঁর বহু নিপুনতা।
প্রশংসা করিয়া সবে বলে তার কথা।।
প্রশ্ন শুনি দেবীচাঁদ মধুর হাসিল।
স্তব্ধ হয়ে ক্ষণ পরে কহিতে লাগিল।।
‘‘ওরে ভোলা সারা বেলা কিখেলা খেলিলি?
কিবা অভিনয় তুই জীবনে করিলি।।
ওড়াকান্দী গুরুচাঁদে চিনিবারে চাস।
চিনিবি যে সেই চোখ কোথা তুই পাস?
তুই সেথা গিয়াছিলি কুটুম্বের বেশে।
কুটুম্বের সাধ্য নাই চেনে হৃষীকেশে।।
সে যে কি পরম রত্ন কি বলিব তোরে।
একবার দেখে ভোলা যায় কি রে তারে?
বল দেখি সত্য করে ওরে বাছাধন।
যেই হতে গুরুচাঁদে করিলি দর্শন।।
জাগে কিনা জাগে সেই সদা তোর প্রাণে?
হেন কেহ জাগে নাকি কভু কোন খানে?
দেখা মাত্র অগোচরে হরে যেঁই মন।
বল দেখি সে মানুষ গোঁসাই কেমন?
চিনিতে কি চাস তুই গুরুচাঁদে মোর?
জেগেছে কি সেই ইচ্ছা আজ প্রাণে তোর?
ইচ্ছা যদি জেগে থাকে তবে চলে আয়।
আর কত রবি মত্ত অসার খেলায়।।’’
এই ভাবে দেবীচাঁদ বলিল বচন।
কথা শুনি বিপিনের ঝরিছে নয়ন।।
কেন্দে কয় ‘‘দয়াময়! আর কথা নাই।
দয়া করে শ্রীচরণে দেহ মোর ঠাঁই।।
এতকালে গেছে কাল করে অভিনয়।
বুঝিলাম ধর্ম্ম ছাড়া কেহ কার নয়।।
এতদিন তোমা মনে ভাবিয়াছি মামা।
অপরাধ যা করেছি কর আজি ক্ষমা।’’
এত বলি গোস্বামীর চরণে পড়িল।
দয়া করে গোস্বামীজী তারে কোলে দিল।।
সেই হতে বিপিনের গতি ফিরে গেল।
দিবানিশি নামে মত্ত বলে হরিবল।।
পরে স্বামী দেবীচাঁদ তারে সাথে করে।
উপনীত হইলেন প্রভুর গোচরে।।
ওড়াকান্দী এসেছিল পূর্ব্বে যে বিপিন।
সেদিনের সে বিপিন নহে সে বিপিন।।
একবস্ত্র দীন বেশে চক্ষে জল ধারা।
বেশভূষা যত কিছু দফারফা সারা।।