মতুয়াতত্ত্বে গুরু-শিষ্য সমাচার
মতুয়াতত্ত্বে গুরু-শিষ্য সমাচার
গুরুগিরি শব্দটা শুনলেই সকলের মনের অজান্তে ভেসে ওঠে পৈতাধারী, টিকিযুক্ত বামুনের ছবি, যারা শিষ্যে ছুলে অশুচি হয়ে যান, শিষ্যের রান্না করা খাবার খান না, নিত্য শুদ্ধ মানুষকে যারা কিনা চির অশুদ্ধ ভাবে, যে কিনা দীক্ষা দিয়ে শিষ্যকে শোষণ করে বেঁচে থাকে। এক এককথায় মন্ত্র বেঁচে খায়। এটা হল সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা। এই সামাজিক প্রেক্ষাপটেই পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন,
“শুদ্ধাচারী, বীজমন্ত্রী, নামে জপে মালা। একা একা যেতে চায় সমুদ্রেতে ভেলা।।
গুরুরূপে ব্যবসায়ী কাণে দেয় মন্ত্র। প্রাণহীন দেহ যেন জুড়ে অঙ্গে যন্ত্র।।
এসব সামান্য কূপ সবে ডুবে যা’বে। হরিপ্রেম প্লাবনেতে জীব মুক্তি পা’বে।।” অথবা
“প্রভু বলে তোর গুরু কায়স্থের ছেলে। নমঃশুদ্র ভেবে মোরে অবজ্ঞা করিলে।।
ঘৃণা মহাপাপ স্পর্শে পালের হৃদয়। সেই পাপে অগ্নিতাপ হীনতেজ হয়।।
ব্রহ্মতেজ বিষ্ণুতেজ অগ্নিতেজ জ্বলে। সব তেজ নষ্ট হয় আমাকে নিন্দিলে।।
গুরুকে না চিনে বেটা করে গুরুগিরি। অহংকারী গুরুকার্যে নহে অধিকারী।।”
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গুরুবাদ কি তাই! না। প্রকৃত গুরুবাদের কথা তাঁরই মুখে ঈশ্বর অধিকারীর সাথে আলাপকালে উঠে এসেছে,
“প্রভু হরিচাঁদ বলে শুন হে গোঁসাই। তুমি গুরু আমি শিষ্য ভিন্ন ভেদ নাই।।”
গুরুকে সনাতন শাস্ত্রে অনেক উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। তবে তা সাজা গুরু নয়, প্রকৃত বা সদ্গুরু। যেমন অশ্বিনী গোঁসাই তাঁর গানে বলেছেন, “কর্মসূত্রে হরি হলে বাম, গুরু রাখলে রাখতে পারে, যায়না পরিণাম। গুরু গোঁসাই হইলে বাম, হরিচাঁদ রাখতে পারে না।” অথবা গুরুর আত্মসমালোচনা করে তিনিই আবার লিখেছেন, “গুরুতত্ত্ব কয়ে ভারি গোঁসাই সেজেছ, গুরু কি ধন চিনলিনা মন, সে রসে তুমি নি তাই মজেছ।।”
এবার আসি মতুয়াদের গুরুবাদের কথায়। শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা, শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত বা অশ্বিনী গোঁসাই, তারক গোঁসাই রচিত গানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্টত দেখা যায় যে কোথাও গুরুবাদের বিরোধিতা করা হয়নি। যেসব বিরোধিতা দৃশ্যমান হয় তা সাজা গুরুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রকৃত বা সদ্গুরুর বিপক্ষে বা গুরুবাদের বিপক্ষে বলা হয়নি।
অন্যান্য যুগের চেয়ে বা অন্যান্য মতের চেয়ে মতুয়া মতে গুরুবাদ একটু ভিন্ন ধাঁচের। মতুয়াদের মধ্যে দুই ধরণের গুরুবাদ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম ধারাটি গতানুগতিক শাস্ত্রীয় ধারা, দ্বিতীয় ধারাটি নতুন যুক্ত হয়েছে এবং যুক্ত করেছেন স্বয়ং হরিঠাকুর। অন্যান্য অবতারেরা স্বয়ং তাদের গুরুর নিকট হতে দীক্ষা/মন্ত্র প্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ সান্দিপনি মুনির নিকট, শ্রীগৌরাঙ্গ ভারতী গোঁসাইয়ের নিকট দীক্ষামন্ত্র নিয়েছেন। কিন্তু এই হরি অবতারে দেখালেন ভিন্ন পথ। নিজে গুরুকে স্বীকার করলেন বটে, তবে মন্ত্রদীক্ষা নিলেন না। এ প্রসঙ্গে লীলামৃতের ভাষ্য,
“কিছু অন্তরেতে রামকান্তে ল’য়ে যেত। দুই প্রভু একাসনে নির্জনে বসিত।।
রামকান্তে বলিতেন তুমি মম গুরু। যুগে যুগে তুমি মোর বাঞ্ছাকল্পতরু।।”
এই প্রকার গুরুকে অনেক মতুয়া গোঁসাই ভাব গুরু বা উপদেষ্টা গুরু বলে থাকেন। এতে দীক্ষা মন্ত্রের প্রয়োজন নাই। গুরুকে গুরুরুপে মান্য করলে তথা ভক্তিশ্রদ্ধা করলেই গুরুর কাজ হয়। যাকে এই প্রকারের শিষ্যকে উপদিষ্ট বা আদিষ্ট শিষ্য। শুধু নিজের ক্ষেত্রে নয়, ভক্তের ক্ষেত্রেও এই প্রকার দীক্ষার কথা হরিঠাকুর বলেছেন। সকলে স্মরণ করে দেখুন দশরথ পাগলকে দেয়া ঠাকুরের নির্দেশের কথা,
“তৈলকুপী আখড়ায় চলে যেও তুমি। তথা আছে লোকনাথ নামেতে গোস্বামী।।
যে ধর্ম জানায় তুমি করিবে সে ধর্ম। সেই সে পরম ধর্ম তিন প্রভু মর্ম।।”
হরিঠাকুরের পরে গুরুচাঁদ ঠাকুরও প্রকৃত গুরুবাদের পক্ষেই কথা বলেছেন। তিনি নিজে তারক গোঁসাইকে আজ্ঞা দিয়েছেন দীক্ষা দেয়ার জন্য। হরিবর ও মনোহর সরকারকে দীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে গুরুচাঁদের নির্দেশ ছিল।
“গুরুচাঁদ আজ্ঞামতে শ্রীতারক গুরু। মহানন্দ শ্রীতারক বাঞ্ছা কল্পতরু।।”
এমনকি তারক গোঁসাই নিজেও মৃত্যুঞ্জয় গোঁসাইকে উপদেষ্টা গুরু মানতেন।
“উপদেষ্টা গুরু বলি মানিল তারক। তাহা দেখি এদেশে মাতিল বহুলোক।।”
হরিঠাকুরের এই নতুন দীক্ষাতত্ত্বকে আত্মিকরণ করে মতুয়াদের মধ্যে ‘ধরা-মরা’ ধারা গড়ে উঠেছে। এই তত্ত্বে ভক্ত ভক্তকে আশ্রয় করে হরি প্রাপ্ত হয়। যাকে ধরে হরিকে জানতে পারা যায় তাকে বলা হচ্ছে ‘ধরা’ আর এই ‘ধরা’ কে যে হরিনাম প্রাপ্ত হচ্ছে অর্থাৎ হরিনামে মরেছে বা মসগুল হয়েছে তাকে বলা হচ্ছে ‘মরা’। এই ধরা-মরা’র তত্ত্বে দীক্ষামন্ত্র দেয়ার কথা নাই।
শাস্ত্রের বিধানমতে সদ্গুরু দেখে দীক্ষা নিতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সদ্গুরু বাছাই করা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। তাই এই সহজ পদ্ধতি। সবশেষে ছোট একটি কাহিনী বলে শেষ করি। আমার এলাকায় এক ভক্ত আছে। সে সব কাজে ‘জয় তারক’, ‘জয় তারক’ বলে। কোথাও যেতে হলে, কোন পূজা করতে হলে, কোন মহোৎসবে গেলেও সে এই বুলি বলে। আমি তাকে একবার জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাম না নিয়ে ‘জয় তারক’, ‘জয় তারক’ বল কেন? সে আমাকে বলে, আমি যে তারক গোঁসাইকে গুরু মানি, তাঁর আদর্শ মেনে চলার চেষ্টা করি, তাঁর মাধ্যমেই আমি হরিকে খুঁজি, সে আমার গুরু। এই হল উপদেষ্টা-আদিষ্ট বা ধরা-মরা’র গুরুতত্ত্ব।
দীক্ষা নিবেন। সদ্গুরু খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। আপনার আশেপাশের বা পূর্বের যে কোন মহাপুরুষ, যাকে আপনার আদর্শ বলে মনে হয়, তাকে গুরুরুপে বরণ করে নিন। তাঁর আদর্শে জীবনে গড়ে তুলুন। দীক্ষামন্ত্র নিতেই হবে তা নয়, মন্ত্র ছাড়াই দীক্ষা নিন। হরিনামে মেতে উঠুন। হরিই উপায় করবেন। হরিবোল।