শ্রীশ্রী ওড়াকান্দি ধাম মাহাত্ম্য (শ্রী ক্ষীরোদ রঞ্জন রায়)
শ্রীশ্রী ওড়াকান্দি ধাম-মাহাত্ম্য
- শ্রী ক্ষীরোদ রঞ্জন রায় লিখিত
- শ্রী উপেন পাগল (ছোট পাগল) কর্তৃক সংশোধিত
উৎসর্গ
হে ঠাকুর! হে হরিচাঁদ! হে দয়াল!
তব কৃপাবিন্দু বরিষণে
মম হৃদি কুঞ্জবনে
ফুটিয়াছে যেই পুষ্পরাজি।
ক'টি তার তুলে নিয়ে
রহিয়াছি দাঁড়াইয়ে
শ্রীপদে অঞ্জলি দিতে আজি।।
এ ক্ষুদ্র অঞ্জলি মম
লহ তুমি প্রিয়তম
সার্থক হউক এ জীবন।
বাহ্যস্মৃতি ভুলে গিয়ে
তোমা গত চিত্ত হয়ে
যেন সবে করয়ে কীর্তন।।
-- ক্ষীরোদ
গ্রন্থারম্ভ
যাশোমন্ত রূপে হরি হলেন প্রকাশ।
সফলা নগরে জন্ম ওড়াকান্দি বাস।।
কৈশরেতে গোচারণ রাখালের সনে।
কালসর্প ল'য়ে খেলে প্রফুল্লিত মনে।।
দাঁড়া বলে প্রভু যবে সর্পকে বলিত।
প্রণাম করিয়া এসে নিকটে দাঁড়াত।।
বিশ্বনাথ বলে হরি বল বিবরণ।
কালসর্প তব কথা শুনে কি কারণ।।
প্রভু বলে পূর্বজন্মে আছে দেখা চেনা।
যাহা বলি তাহা ওরা না শুনে পারে না।।
আমি কেলি করিতাম কালিন্দীর কূলে।
উহারা করিত কেলি সেই বিষ জলে।।
কালীয় দমন করি কালিদহে গিয়ে।
মম ঠাই মাথা নত করে সে লাগিয়ে।।
আমি হই পূর্ণব্রহ্ম ক্ষীরোদ বিহারী।
আমার সেবিকা হয় সেই বিষহরী।।
এইভাবে করে খেলা ক্ষীরোদব্ধিশায়ী।
যাহার মহিমা গুণে বলিহারি যাই।।
একদিন বিশ্বনাথ প্রাণে মরেছিল।
শ্রীহরি পরশ মাত্র তার প্রাণ পেল।।
কাদা পথে প্রভু যবে গমন করিত।
পদ নীচে পদ্মফুল ফুটিয়া রহিত।।
কোথায় বা ছিল পদ্ম কোথা হ’তে এলো।
নক্র পৃষ্ঠে চড়ি প্রভু বিল পার হ’ল।।
শ্রীদেবী করুণা তাহা করিল দর্শন।
আজ্ঞামতে একদিন এল দেবগণ।।
একদিন মহাপ্রভু লীলা খেলা ছলে।
রাম রূপ ধরি হীরামনে দেখা দিলে।।
হীরামন মন হরি নিলেন শ্রীহরি।
নব দূর্বাদল শ্যাম রাম রূপ ধরি।।
গোলকের মূর্তি হেরি মাতিল গোলোক।
হরি রূপে মন সপে হৃদয় পুলক।।
দারুব্রহ্ম জগবন্ধু দৈববাণী ছলে।
পাণ্ডা দিয়ে ওড়াকান্দি প্রসাদ পাঠালে।।
রাম শ্রীকৃষ্ণ গৌরাঙ্গ আর শ্রীনিবাস।
এক মুখে সেবা করি পরম উল্লাস।।
শিবনাথ ভবনাথ দুই পাণ্ডা দিয়ে।
প্রভু জন্য মিষ্টান্ন দিলেন পাঠাইয়ে।।
দিগ্বিজয় পণ্ডিত অদ্বৈত নাম ধারী।
পূর্বজন্মে ছিল যেই কেশব কাশ্মীরী।।
প্রভু ঠাই পরাজয় করিয়ে স্বীকার।
কিছুদিন অন্তে গেল আপনার ঘর।।
বিশ্বমাঝে জানাইল সেই মহামতি।
হরিচাঁদ রূপে এল শ্রীভারতী পতি।।
অনন্ত ক্ষীরোদশায়ী জগৎ ঈশ্বর।
কৃপা মাগি এবে আমি দীন হরিবর।।
---- শ্রী হরিবর সরকার
শ্রীধাম মাহাত্ম্য
মতুয়ার প্রেমতীর্থ ওড়াকান্দি ধাম।
সর্বতীর্থ সমাগম হেথা জানিলাম।।
গয়া, গঙ্গা, বারানসি, প্রয়াগ, পুষ্কর।
হৃষীকেশ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার আর।।
সর্বতীর্থ বিরাজিত প্রেম পারাবার।
উঠিছে প্রেমের তুফান যেন অনিবার।।
পূর্ব পূর্ব অবতার সব অংশ কলা।
শেষ লীলা ওড়াকান্দি পূর্ণ ষোলকলা।।
এই হেতু সর্বোত্তম তীর্থ ওড়াকান্দি।
প্রেম পুলকিত হৃদি থাকে নিরবধি।।
শ্রীধামের সুপবিত্র স্নানে মোক্ষফল।
হরিনামে উঠে সদা প্রেমের হিল্লোল।।
হেথা বারুণী সাগর নামে জলাশয়।
পুণ্যতোয়া বলি তারে ব্যাখ্যা দেয়।।
গঙ্গাস্নান আর মহাবারুণীর দিনে।
অন্তরঙ্গ ভক্ত ভাসে প্রেমের তুফানে।।
পাপী হয় পাপ মুক্ত শুদ্ধ দেহ মন।
পুণ্যকে করিয়ে তুচ্ছ পায় প্রেমধন।।
হরি পদে জন্ম নিয়ে দেবী সুরধনী।
ভ্রমিছে অনেক বর্ষ পতিতোদ্ধারিণী।।
পাতকীর পাপভার লইয়া আপনি।
পাপভারে প্রপীড়িতা পতিত পাবনী।।
পাপে জর্জরিতা হয়ে পাপ বিনাশিনী।
খুঁজিল অনেক বর্ষ দেব চিন্তামণি।।
খুঁজিতে খুঁজিতে আসি ওড়াকান্দি ধাম।
পাইয়াছে ব্যথাহারী হরি গুণধাম।।
হরিপদাশ্রয় দেবী করেছিল আশ।
পাইয়া বাঞ্ছিত পদ হেথা করে বাস।।
একদিন ঠাকুরের পদধৌত কালে।
গঙ্গাদেবী হরিপদ শিরে ল’ন তুলে।।
ভাসিয়া উঠিল গঙ্গা মকরবাহিনী।
শিরোপরে দাঁড়াইল প্রভু চক্রপাণি।।
অন্তরঙ্গ প্রিয় ভক্ত জানে এই তথ্য।
অব্যক্ত নিগূঢ় লীলা নাহি করে ব্যক্ত।।
বারুণী সাগর জলে জাহ্নবীর স্থিতি।
হেথা স্নানে পাপতাপে পাবে অব্যাহতি।।
‘মধুকৃষ্ণাত্রয়োদশ্যাং ওড়াকান্দ্যাং মহাযোগে
আবির্ভাবতি জাহ্নবী কামনা সাগস্থিতা।।
স্নানকারী হি বারুণ্যাং পুনর্জন্ম পারং গচ্ছেৎ
সর্ব পাপবিমুক্তঃসন মন্দিরে হরির্দনাৎ।।’
--- (কবি মধুসূদনকৃত গঙ্গাতীর্থ হইতে)
কামনা সাগর প্রতিষ্ঠাতা গুরুচাঁদ।
তটে বসি পায় ভক্তগণ প্রেমাস্বাদ।।
ভক্ত মধুপ যতেক করেন গুঞ্জন।
কামনা সাগরে স্নানে কামনা পূরণ।।
কামনায় স্নানে শ্রী মন্দির প্রদর্শন।
প্রদক্ষিণ করে সতী লভিতে নন্দন।।
নারিকেল কোলে করি সস্ত্রীক যে জন।
প্রদক্ষিণ করে যেবা ভক্তিযুত মন।।
ঠাকুরের কাছে শুনি উপদেশ বাণী।
শ্রীহরির পূজা করে সেই সে গৃহিণী।।
চিরবন্ধ্যা নারী লভে উত্তম নন্দন।
গুরুচাঁদ কৃপাযোগে পুরে আকিঞ্চন।।
কামনার বারি পানে ব্যাধি সেরে যায়।
শ্রীমুখের বাক্য ইথে নাহিক সংশয়।।
বারুণী প্রান্তর দক্ষিণের সরোবর।
শান্তি সাগর নামে খ্যাত ধরাপর।।
শান্তি সাগরের জল যেবা করে পান।
আর যেবা করে হেথা স্নান সমাপন।।
শান্তিমাতা কৃপা গুণে পুরে আকিঞ্চন।
নীরোগ শরীর হয় শান্তিপূর্ণ মন।।
অন্তিমেতে শান্তিমাতা পূর্ণ করে আশ।
শান্তিমার কৃপা গুণে শান্তি ধামে বাস।।
অস্থি দান শান্তিতে কামনায় তর্পণ।
ঠাকুরের পদে স্থান পায় সেই জন।।
আনিল গার্হস্থ্য ধর্ম ব্রহ্ম সনাতন।
তিলকাদি নাহি করে নাম পরায়ণ।।
করিবে গার্হস্থ্য ধর্ম ল’য়ে নিজ নারী।
গৃহে থেকে ন্যাসী, বানপ্রস্থী, ব্রহ্মচারী।।
হরিনাম মহামন্ত্র করিয়ে গ্রহণ।
ওড়াকান্দি বিনে নাহি তীর্থ পর্যটন।।
সবে দেয় পিতৃ অস্থি গঙ্গা নদী নীরে।
মতুয়ারা দেয় অস্থি শ্রী শান্তি সাগরে।।
শ্রীধামে পিণ্ড দিলে আত্মা মুক্ত হয়।
গয়াধাম হ’তে শ্রেষ্ঠ পূর্ব বাংলায়।।
বেদকাশী বারানসি, শিবের আবাস।
দ্বাদশ রুদ্রের আদি ওড়াকান্দি বাস।।
যখন শিবের পুত্র হন নারায়ণ।
গণপতি কোলে শিব করিল চিন্তন।।
এবে আমি ভগবানে বাৎসল্য করিব।
হরি অবতীর্ণ কালে এ ঋণ শোধিব।।
প্রতিজ্ঞা রক্ষিতে এবে ভোলা মহেশ্বর।
গুরুচাঁদ রূপে এল উড়িয়া নগর।।
ভক্ত সন্নিধানে প্রভু দিয়াছেন কথা।
ওড়াকান্দি পরিহরি যা যাব অন্যথা।।
(শ্লোক)
শ্রীধাম পরিত্যজ্যাহং কত্রচিদপিন গচ্ছামি
শান্তিব্দেব্যা সহতত্র বিরাজিতো যুগে যুগে।
শ্রীহরির বাক্য ছিল ভকতের মাঝ।
শান্তি সহ শ্রীধামেতে করিবে বিরাজ।।
ক্ষণমাত্র ওড়াকান্দি ছেড়ে নাহি যাব।
শ্রীগুরুচাঁদের মাঝে মিশিয়া রহিব।।
এই হেতু হরি হর সদা সর্বক্ষণ।
ওড়াকান্দি শ্রীধামেতে অধিষ্ঠান রন।।
গুরুচাঁদের মধ্যম পুত্র শ্রী সুধন্য।
সর্ব ঠাই দেখিয়েছেন পরম সৌজন্য।।
তৃণাদপী শ্লোকটির তাৎপর্য যাহা।
বর্ণে বর্ণে সুপ্রকাশ করেছেন তাহা।।
পূর্ব জন্মে ছিলেন রাজর্ষি জনক।
বহু পুণ্যে লভিলেন শ্রীগুরু জনক।।
কলিরে করিতে ধন্য লভিল জনম।
পবিত্র চরিত্র অতি হন নরোত্তম।।
শ্রীসুধন্যচাঁদাত্মজ শ্রীপতি ঠাকুর।
সুন্দর মূরতি খানি স্বভাব মধুর।।
সত্যভামা কান্ত যিনি প্রভু গুরুচান।
শ্রীপতিচাঁদেতে তিনি সদা অধিষ্ঠান।।
শ্রীপতিচাঁদের মুখে হরি কথা শুনে।
গুরুচাদ কথা কন হেন জাগে মনে।।
ঠাকুরের আসনের রাখিয়া সম্মান।
যোগ্যাসনে শ্রীপতিচাঁদের অধিষ্ঠান।।
রোগে শোকে প্রপীড়িতা হইয়া ধরায়।
শান্তি লভিবারে লোক ওড়াকান্দি যায়।।
শ্রীপতি করুণাসিন্ধু হ’য়ে কৃপাবশ।
ভকতজনের দুঃখ করেন বিনাশ।।
যে যাহা প্রার্থনা করে নিকটে তাহার।
প্রার্থনা পুরাণ প্রভু কৃপা পারাবার।।
শান্তির আধার তিনি মতুয়া জীবন।
পরশে সরস হয় কলুষিত মন।।
প্রেমের তুফান তুলে হরি আলাপনে।
ভাবের আবেশে ভাসে যত ভক্তগণে।।
জ্বালিল জ্ঞানের ভাতি গঠি বিদ্যালয়।
অন্ধজনে দিল আলো খঞ্জে কৃপা পায়।।
শ্রীপতি করুণাসিন্ধু খুলে দান ছত্র।
মৃত জনে দিল প্রাণ ঢালি সুধা পাত্র।।
জগত মঙ্গল লাগি কত কর্ম করে।
রেখে গেল যশগাঁথা এই ধরা পরে।।
শ্রীপতি নন্দন হয় নাম অংশুপতি।
হরি বংশে অবতংশ মতুয়ার পতি।।
জ্যেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ তিনি হ’ন পুত্রগণ মাঝে।
শ্রীহরি স্বরূপ বটে তার মাঝে রাজে।।
অসমাপ্ত ক্রিয়া পুনঃ করিতে সাধন।
ধরাধামে এল নামি সাধনের ধন।।
সৌম্য শান্ত মূর্তি খানি দিব্যরূপধারী।
তারিতে পতিত এবে এলরে কাণ্ডারী।।
মরি কি মধুর ভাব অপূর্ব সে কান্তি।
স্মরণে মরণ ঘুছে ছুটে যায় ভ্রান্তি।।
অকামনা প্রেম ভক্তি জাগে অনিবার।
মাধুর্যের ভাব লাগে পরশে তাহার।।
গুরুচাঁদ স্মরি আজ্ঞা যাকে দান করে।
আজ্ঞা অনুসারে তার শুভ ফল ধরে।।
রোগ শোক ভব ব্যাধি সব সেরে যায়।
অংশুপতি পদতলে লইলে আশ্রয়।।
শ্রীহরি মন্দির প্রেম সরোবর তীরে।
চতুর্দিকে সুবেষ্টিত রয়েছে প্রাচীরে।।
নিত্য হয় শ্রীমন্দিরে ভোগ নিবেদন।
ভক্তি ভরে আরতি করেন ভক্তগণ।।
প্রভুর প্রসাদ কণা সুধাতিক সুধা।
ভক্ষণে আনন্দ অতি মিটে ভব ক্ষুধা।।
ক্ষীরোদশায়ীর মূর্তি মন্দিরের মাঝ।
শান্তি হরি যুগলেতে করেন বিরাজ।।
মনের মানস যত জানালে হেথায়।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে হরি দয়াময়।।
সম্মুখেতে নটরাজের শ্রীনাট মন্দির।
কীর্তনে প্রমত্ত সেথা মতুয়া সুধীর।।
পূর্বেতে সাধন তলা আম্রবৃক্ষ মাঝে।
গুরুচাঁদ সত্যভামা মন্দির বিরাজে।।
গুরুচাঁদাত্মজাত্মজ শ্রীপতি ঠাকুর।
অতি নিষ্ঠাবান তিনি স্বভাব মধুর।।
এ মন্দির তার কীর্তি ঘোষে সর্বক্ষণ।
ঘোষিবে তাবৎ যাবৎ রহিবে ভুবন।।
এ মন্দিরে যেবা ব্যক্ত করে অভিপ্রায়।
গুরুচাঁদ কৃপা বলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।
ভগবতী মন্দিরেতে প্রতিটি বরষে।
আবির্ভূতা হন দেবী মনের হরষে।।
শরৎ কালেতে হয় মায়ের বোধন।
দূর দূরান্তর হতে আসে ভক্তগণ।।
মন্দিরের সম্মুখেতে ‘দরবার গৃহ’।
মহাপ্রভু বিরাজেন সেথা অহরহ।।
প্রভুর আসন হেথা আছে বিদ্যমান।
যে আসনে বসিতেন প্রভু গুরুচান।।
আজিও মতুয়া বৃন্দ পুষ্প অর্ঘ দিয়া।
পুজেন হৃদয়ে প্রেম ভকতি লইয়া।।
তার পাশে দিব্যাসনে সুধন্য নন্দনে।
ভক্তমাঝে শোভা পেল অর্চিত চন্দনে।।
সুধা কণ্ঠে দিল ঢালি অমিয় ভারতী।
ভক্তগণ শান্তি লভে দিয়া পুজারতি।।
শ্রীপতির কর্মকাণ্ড হ’লে অবসান।
তব পার্শ্বে অভিষিক্ত অংশুপতি চাঁদ।।
ঠাকুরের মুখে শুনি তত্ত্ব আলাপন।
বাহ্য স্মৃতি হারা সবে ভাবেতে মগন।।
অন্তরঙ্গ ম’তো সঙ্গে করে প্রেম রঙ্গ।
রসালাপে উঠে কত ভাবের তরঙ্গ।।
সে প্রেম রঙ্গ মাঝে প্রেমময় হরি।
খেলিছে প্রেমের খেলা মুকুন্দ মুরারি।।
ওড়াকান্দি প্রেম বন্যা প্রেমের লহরী।
ধ্বনিত হয় যে সদা জয় শান্তি হরি।।
গোলকের মহাভাব ওড়াকান্দি ধামে।
মূর্ত হয়ে দেখা দিল শান্তি হরি নামে।।
হরিচাঁদ জন্মোৎসব করে ভক্তগণে।
প্রতি বর্ষে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী দিনে।।
কীর্তন অঙ্গনে হয় লোকারণ্য ময়।
হিল্লোলে কল্লোল উঠে প্রেম দরিয়ায়।।
হরি প্রেম তরঙ্গিণী কল কল নাদে।
প্রবাহিত হয় তথা পরম আহ্লাদে।।
হরিনাম ধ্বনি শূন্যে উঠে অনুক্ষণ।
নামামৃত পান করি জুড়ায় জীবন।।
মধুর মধুর ধ্বনি দিবস যামিনী।
দশ দিকে মুখরিত হরি নাম ধ্বনি।।
কাহারো দেহেতে অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার।
মহাভাবে মাতোয়ারা তুল্য নাই তার।।
কামনার উত্তরে রাস মণ্ডপ হয়।
রাস পূর্ণিমাতে শান্তি হরি শোভা পায়।।
রাস মঞ্চে উঠি যশোমন্তের নন্দন।
ক্ষীরোদের লীলা করে ল’য়ে ভক্তগণ।।
রাস মণ্ডপের পাশে রথের আগার।
তিনখানি রথ আছে তাহার ভিতর।।
কামনা সাগর তটে আছে রথ খোলা।
আষাঢ় মাসেতে মেলে রথযাত্রা মেলা।।
বহুস্থান হ’তে আসে যাত্রীরা হেথায়।
হরি ঠাকুরের মেলা প্রেমানন্দ পায়।।
শ্রীধামের রথ টান হইবে যখন।
তারপরে শ্রীক্ষেত্রের রথের চালন।।
এই রথ না চলিলে চলে না সেই রথ।
নিজ মুখে বলেছেন প্রভু জগন্নাথ।।
কামনার পশ্চিমে বিশাল প্রাঙ্গণে।
বারুণীর দোলোৎসব হয় এই স্থানে।।
ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমী আশ্বিনে অম্বিকা।
রাসযাত্রা শ্রীবারুণী দোল এক শাখা।।
গুরুচাঁদ জন্মোৎসব দোল পূর্ণিমাতে।
পূজা ও উৎসব করে মতুয়া বৃন্দেতে।।
নাম সংকীর্তন আদি লীলামৃত পাঠ।
কোন স্থানে ভক্তগণ মিলায়েছে ঠাট।।
শান্তি সত্যভামা বালিকা শিক্ষালয়।
গুরুচাঁদ আদেশেতে শ্রীপতি কৃপায়।।
ইহা সুপ্রতিষ্ঠিত নারী শিক্ষার তরে।
জ্ঞানের বর্তিকা জ্বলে প্রতি ঘরে ঘরে।।
উচ্চ শ্রেণির বিদ্যালয় করিয়া স্থাপন।
করিলা শিক্ষার পথ শ্রীহরি নন্দন।।
অশিক্ষিত জীবগণে দিতে শিক্ষা দান।
জীবের কল্যাণ তরে এসব বিধান।।
চণ্ডাল বলিয়া আখ্যা যে জাতির ছিল।
কৃপা করি গুরুচাঁদ সে দুঃখ নাশিল।।
অমৃত কাননে বসি ভক্ত বালাগণ।
বন মহোৎসব করে হ’য়ে হৃষ্ট মন।।
হরিণ হরিণী সেথা করে বিচরণ।
তৃণাহাড় ভুলি করে প্রভুর অন্বেষণ।।
চাতক চাতকী যেন কাহার লাগিয়া।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকে উড়িয়া উড়িয়া।।
চকোর চকোরী ভুলি খাদ্য অন্বেষণ।
শ্রীধাম ঘেরী উড়ে প্রফুল্লিত মন।।
কাহারে খুঁজিয়া সবে ডাকিয়া ডাকিয়া।
যেন তারে পেয়ে উঠে আনন্দে মাতিয়া।।
নিম্নমুখী শাখী শাখা শ্রীধামেতে যেন।
হরি পদরজ পেতে ভাব খানি হেন।।
পত্র নেড়ে তরু রাজি করে হরিনাম।
মলয় বহিছে মন্দে ভেবে পরিণাম।।
ধরণী হইল ধন্য পেয়ে ভবারাধ্য।
শ্রীধামেতে আছে চিহ্ন হরি পাদপদ্ম।।
ক্রুর জাতি কালসর্প ভুলিয়া স্বভাব।
হরিভক্ত সঙ্গ গুণে পায় সেই ভাব।।
প্রেম তীর্থ ওড়াকান্দি শান্তি হরি ধাম।
প্রেমের হিল্লোল তথা বহে অবিরাম।।
চারিদিক মুখরিত নামের ধ্বনিতে।
ভক্তগণ ভাসে সদা নামের স্রোতেতে।।
এ বড় পবিত্র ক্ষেত্র প্রেমের নগর।
হেথা আগমনে হয় বিশুদ্ধ কলেবর।।
কুণ্ড তীরে আছে এক কদলীর বন।
কদলী কাননে হনু রহে সর্বক্ষণ।।
বনচারী পুষ্পোদ্যান গৃহের পশ্চিমে।
বৃন্দাবন সম উহা ওড়াকান্দি ধামে।।
এইখানে মহাপ্রভু ভক্তগণ সঙ্গে।
ব্রজের নিগূঢ় খেলা খেলিতেন রঙ্গে।।
প্রতিটি উৎসবে হেথা আসি ভক্তগণ।
প্রেমানন্দে করে হরি নাম সংকীর্তন।।
কীর্তন অঙ্গনে সব ভক্তগণ মিলি।
বারুণীর উৎসবেতে করে প্রেম কেলী।।
উদ্যানের পশ্চিমেতে প্রশস্থ প্রাঙ্গণ।
দুই দিকে গৃহ সারি অতি সুদর্শন।।
শ্রীহরি মন্দিরের পশ্চিমের পার্শ্বেতে।
শ্রীপতি স্মৃতি আঠার নালার পূর্বেতে।।
‘শশী, সুধন্য, সরলা, সুবলা, ভগবতী’।
কামনা সাগর পূর্ব-দক্ষিণে ঐ স্মৃতি।।
স্মৃতি মন্দিরেতে নিত্য পূজা করে তথা।
শুনিলে শ্রীধাম গীতি ঘুচে মন ব্যাথা।।
হরি হর দুইজন হয়ে একত্তর।
পতিত পাবন হ’য়ে করিল উদ্ধার।।
লীলা সম্বরণ কালে হরি-গুরুচাঁদ।
বলেছেন ভক্তগণে ত্যজ হে বিষাদ।।
ওড়াকান্দি ধাম হয় নিত্য বৃন্দাবন।
মুহূর্ত শ্রীধাম ত্যজি না যাব কখন।।
স্বীয় বাক্য রক্ষা হেতু হরি আর হর।
উভয়েই বিরাজেন হেথা নিরন্তর।।
এই হেতু সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ ওড়াকান্দি।
প্রেমে মেতে ভক্তগণ করে কাঁদাকাঁদি।।
চারিযুগ লীলারস করিয়া মৈথুন।
ওড়াকান্দি প্রেম সিন্ধু অসীম নির্গুণ।।
সিন্ধু হ’তে এক বিন্দু যে করেছে পান।
ধরাধামে কেহ নাই তাহার সমান।।
এইখানে আজিও বাজে মোহন বাঁশি।
শ্রীপদে নুপুর বাজে ফুটে পদ্মরাজি।।
রত্নডাঙ্গা বিলে আছে রত্ন সিংহাসন।
কস্তূরী কুসুম সাজে তেমনি সাজন।।
তেমনি রাখালগণে গোধন চরায়।
আবাধ্বনি দিয়া গাভী বৎসটি ফিরায়।।
উচ্চ পুচ্ছ করি গাভী নাচার তেমন।
সঙ্গেতে নাচিয়া তায় ফেরে বৎসগণ।।
আজিও রাখাল রাজা আসিয়া হেথায়।
রাখালের সঙ্গে রঙ্গে গোধন চরায়।।
প্রেমের ঠাকুর সেই হরি দয়াময়।
ভাবের ভাবুক হ’লে দরশন পায়।।
যে তাহারে ভাবিতে পারে পায় তাহারে।
অন্তরঙ্গ ভক্ত বিনে বুঝিতে না পারে।।
সাধু সঙ্গে অনুক্ষণ যেবা করে বাস।
অবশ্যই হয় তার পূর্ণ অভিলাষ।।
সাধন ভজন হীন আমি অভাজন।
শ্রীধামের ধূলিকণা মাখি সর্বক্ষণ।।
ভক্ত পদরজ মিশে আছে যে ধুলিতে।
পারি যেন সেই ধুলি মাখিতে অঙ্গেতে।।
মতুয়া চরণ প্রান্তে এই নিবেদন।
পদরেণু দানিবেন মতুয়া সুজন।।
শ্রীধামের ধুলি যেন মাখি নিজ অঙ্গে।
আনন্দে মিলিতে পারি ভক্তগণ সঙ্গে।।
প্রভুর ইচ্ছায় এই শ্রীধাম মাহাত্ম্য।
অযোগ্য এ দাস হ’তে হ’ল লিপিবদ্ধ।।
যদিও অযোগ্য আমি এই ধরাতলে।
তবুও সার্থক হস্ত তব কৃপা বলে।।
শ্রীধাম মাহাত্ম্য কথা করিয়া বর্ণন।
সার্থক হইল আজি মানব জীবন।।
শ্রীধাম মাহাত্ম্য যেবা করিবে পঠন।
আর যেবা ভক্তিভাবে করিবে শ্রবণ।।
উভয়ের দেহ হবে নিষ্পাপ নির্মল।
হৃদয়ে জাগিবে ভক্তি চিত্ত অচঞ্চল।।
যেবা পড়ে যেবা শুনে আর যেবা গায়।
কৃপা করি হরি তারে দেন পদাশ্রয়।।
হরি পদাশ্রয় জীবে পায় মহাশক্তি।
ঘুচে যায় এ সংসারে সব মহাভ্রান্তি।।
ব্রহ্ম সাযুজ্য পদ এ মহান মিলন।
দেহান্তর কালে পায় প্রিয় ভক্তগণ।।
শ্রীধাম মাহাত্ম্য হয় যেথায় কীর্তন।
জানিবেক সেই গৃহ শান্তি নিকেতন।।
শান্তি দেবী সহ হরি আনন্দ অন্তরে।
সে গৃহে করুণা সিন্ধু সতত বিহারে।।
ধর্মে ধর্মে পরিপূর্ণ হবে সে আলয়।
বিদ্বান সৎ পুত্র আসি জন্মিবে নিশ্চয়।।
শ্রীধাম মাহাত্ম্য কথা যে করে পঠন।
অন্তিমে পাবে সে জন শ্রীহরি চরণ।।
শ্রীশ্রীহরিশ্চন্দ্রায় সমর্পনায় অস্তু।