চতুর্থ অংশ
মালসায় কবিগান
খুলনা জেলার মধ্যে মালসা গ্রামেতে।
জাগ্রত সে কালীমাতা বহু দিন হতে।।
নাম করা কালীবাড়ী ছিল এ ধরায়।
শত শত পাঠা বলি হইত তথায়।।
পূজার দিবসে সেই পাঠা বলি হয়।
পর দিন কবিগান হইত তথায়।।
মন্দিরেতে মানত করিত কত জন।
পূজার দিবসে তাহা করিত পালন।।
একদিন তারকের বায়না হইল।
কবিগান গাহিবারে তথায় চলিল।।
নৌকা যোগে দল বল সঙ্গেতে করিয়া।
পূজার দিবসে রাত্রি পৌছালেন গিয়া।।
নৌকা হতে সে তারক একেলা নামিয়া।
ছদ্ম বেসে মন্দিরেতে দেখিলেন গিয়া।।
শত শত ছাগমুন্ড তথায় রয়েছে।
ব্রাহ্মণেরা ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব করিতেছে।।
অজা রক্ত নালা বেয়ে নদীতে নেমেছে।
থাকে থাকে সেই রক্ত জমিয়া রহেছে।।
মনে মনে সে তারক ভাবিতে লাগিল।
শত শত প্রাণী বধি মাকে পুজা দিল।।
সন্তানের রক্ত দিয়ে পূজা যদি খায়।
জগত জননী বলে কেন তারে কয়।।
তাই ভেবে সে তারক পিছাইয়া এল।
মনে মনে দুঃখ পেয়ে নৌকায় আসিল।।
নৌকাতে দোঁহারগণ ছিল যত জন।
তাহাদের ডেকে ডেকে কহিল তখন।।
এই খানে গান করা দরকার নাই।
নৌকা বেয়ে চল মোরা দেশে চলে যাই।।
তাই শুনে কহিলেন সূর্য্যনারায়ণ।
হেন কথা বল তুমি কিসের কারণ।।
বায়না পেয়ে এসেছি গাহিবারে গান।
না করিয়া গান মোরা ফিরে যাব ক্যান।।
কত কষ্টে নৌকা বেয়ে আসিয়াছি হেথা।
না বলিয়ে ফিরে গেলে লোকে পাবে ব্যাথা।।
যদি তুমি যেতে চাও না করিয়া গান।
শেষ রাত্রে নৌকা বেয়ে করিব প্রস্থান।।
তারক বলেছে তুমি শুন মহাশয়।
এই খানে যদি থাকি হইবে সংশয়।।
কমিটিতে জানে যদি আসিয়াছি মোরা।
কোন মতে যেতে মোরে দিবে না তাহারা।।
তাই বলি মহাশয় কিছু দূরে যাও।
সেই খানে নৌকা বেধে সকলে ঘুমাও।।
তারপরে শেষ রাত্রে সকলে জাগিয়া।
নৌকা বেয়ে যাব মোরা দেশেতে চলিয়া।।
তাই শুনে সবে মিলে তাহাই করিল।
কিছু দুরে গিয়ে তারা নৌকাটি বাধিল।।
নৌকা পরে পাক করে করিল ভোজন।
তারপর সবে মিলে করিল শয়ন।।
আগা নায়ে সে তারক শয়ন করিল।
কালীমাতা এসে তার শিয়রে বসিল।।
পদ্ম হস্ত বুলাইয়া তারকের গায়।
ডাক দিয়া কালীমাতা তারকেরে কয়।।
শুন শুন শুন বাছা আমার বচন।
মাকে ফেলে চলে যাবে কিসের কারণ।।
মায়ের পরশ পেয়ে তারক জাগিয়া।
মাকে দেখে বসিলেন বিমুখ হইয়া।।
তাই দেখে কালীমাতা কহিল তখন।
কেন বাছা বিষাদিত হইলে এমন।।
তারক বলেছে মাগো বলি তব ঠাই।
তব মুখ দেখিব না মনে ইচ্ছা তাই।।
সন্তানেরে বলি দিয়া পূজা তুমি খাও।
সে কারণে তব মুখ দেখিব না আমি।।
সন্তানের রক্ত তুমি কর হে ভক্ষণ।
জগত জননী তোমা বলে কোন জন।।
তাই শুনে কালীমাতা কহিল তখন।
এই পূজা কোনদিন করি না গ্রহণ।।
ডাকিনী যোগিনী সদা এই পূজা খায়।
আমি কভু কোনদিন থাকিনা হেথায়।।
তারক বলেছে তুমি এই খানে রও।
বর্তমানে দেখিতেছি কেন মিথ্যা কও।।
তাই শুনে কালীমাতা বিনয়েতে কয়।
তব গান শুনিবারে এসেছি হেথায়।।
তুমি যদি চলে যাও না করিয়া গান।
কি করিয়া আমি বাছা জুড়াইব প্রাণ।।
তুমি বাছা নৌকা পথে করিলে গমন।
সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছি শুন বাছাধন।।
এই খানে আজি তুমি কবিগান গাও।
গান গেয়ে তুমি মোর পরাণ জুড়াও।।
তাই শুনে তারকের ঝরে আখি জল।
কালীমার পদে পড়ি বলে হরি বল।।
হেনকালে কালীমাতা হল অন্তর্ধান।
কেন্দে কেন্দে শ্রী তারক হল অজ্ঞান।।
ক্ষণেক চেতনা পেয়ে মনেতে ভাবিল।
দোঁহারগণেরে ডেকে কহিতে লাগিল।।
নৌকা ধয়ে চল সবে কালীবাড়ী যাই।
শেষ রাত্রে তথা গিয়ে ভোর গোষ্ট গাই।।
তাই শুনে কহিলেন সূর্য্য নারায়ণ।
উম্মাদের মত কথা কহ কি কারণ।।
সন্ধ্যায় কহিলে তুমি দেশে চলে যাব।
এই খানে কোন মতে গান না করিব।।
এখন কহিছ কেন কালীবাড়ী যাব।
তোমার মনের ভাব কেমনে বুঝিব।।
তাই শুনে সে তারক কহিল তখন।
একে একে কহিলেন সব বিবরণ।।
তাই শুনে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল।
কেন্দে কেন্দে তরী বেয়ে কালীঘাটে গেল।।
ভোর বেলা নৌকা হতে সকলে নামিল।
করিব খোলায় গিয়ে উপনীত হল।।
ঢোল কাশি বাজাইয়া ভোর গোষ্ট গায়।
তাই শুনে চারিদিকে জাগিল সবায়।।
চারিদিকে হতে লোক আসিতে লাগিল।
দেখিতে দেখিতে সেথা লোকারণ্য হল।।
ভোর গোষ্ট গেয়ে পরে আগমনী গায়।
তারপর গাহিলেন ভবানী বিষয়।।
সেই গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।
আখি জলে ভেসে ভেসে শোনে সেই গান।।
কবির খোলায় যত শ্রোতাগণ ছিল।
আনন্দেতে আত্মহারা প্রেমেতে মাতিল।।
হেন দৃশ্য হল সেথা কহন না যায়।
প্রেমেরে তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
অলক্ষেতে বসে আছে কালীমাতা যিনি।
নয়ন জলেতে ভেসে গান শোনে তিনি।।
ওদিকেতে মন্দিরেতে পূজক ব্রাহ্মণ।
মা’র চোখে জল ঝরে দেখিল তখন।।
ঝর ঝর আখি জল ঝরিতে লাগিল।
তাই দেখে সে ব্রাহ্মণ মাটিতে পড়িল।।
কেন্দে কেন্দে কহিলেন মায়ের চরণে।
তারকের গান শুনে কান্দ সে কারণে।।
কান্দিয়া ব্রাহ্মণ গেল তারকের ঠাই।
পদে পড়ে কহিলেন শুনহে গোঁসাই।।
তব গান শুনে মাতা আখি জলে ভাসে।
এ জীবন ধন্য হই তোমার পরশে।।
তাই দেখে সে তারক ব্রাহ্মণে ধরিল।
বুকেতে ধরিয়া তারে আলিঙ্গন দিল।।
এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে।
শ্রোতাগণ সবে এসে পড়ে ধরাসনে।।
কেহ কেহ কালীমার মন্দিরেতে গিয়ে।
গড়াগড়ি যায় কেহ মাটিতে পড়িয়ে।।
নারী কি পুরুষ তাহে নাহি ভেদ জ্ঞান।
কেহ কার গায় পড়ে হতেছে অজ্ঞান।।
প্রেমের রঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
মাতৃ হারা শিশু যেন বেড়ায় কান্দিয়া।।
কেহ কেহ পড়ে গিয়ে তারকের পায়।
তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাসায়।।
তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল।
আধ আধ ভাষা দিয়া বলে হরি বল।।
বহু পরে প্রেমনিধি হইলেন শান্ত।
তাই দেখে সে তারক গান করে ক্ষান্ত।।
গান শেষে সে তারক হইল বিদায়।
দল বল সঙ্গে করে দেশ চলি যায়।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচলিীর ছন্দে।
তারকের ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
তারকচাঁদ পরশমণি
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
তারক চাঁদের গুণ করিব বর্ণন।।
পরশ পরশে যেন লৌহ সোনা হয়।
তারকের পরশেতে পশু বৃত্তি ক্ষয়।।
মানুষ মানুষ হয় তাহার পরশে।
চোর সাধু হয়ে যায় তাহার বাতাসে।।
তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন।
মধুর চরিত্র কথা শুন দিয়া মন।।
সত্যবাদি জিতেন্দ্রিয় পুরুষ রতন।
পরনারী মাতৃভাব সদা তার মন।।
হরিচাঁদ পদ যুগ্ম হৃদয় ধরিয়া।
দেশে দেশে কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।।
একদিন কবিগান গাহিবার তরে।
দল বল লয়ে চলে কালিয়া বাজারে।।
তিন দিন কবিগান হইবে তথায়।
নৌকা যোগে কালিয়াতে হইল উদয়।।
দলের দোঁহার ছিল সূর্য্য নারায়ণ।
কাঙ্গালী বেপারী আর ভোলা সনাতন।।
বিপক্ষের সরকার গোবিন্দ নামেতে।
নাম করা কবিয়াল বিখ্যাত জগতে।।
তাহার দলেতে ছিল সে মনমোহিনী।
অতি সুমধুর ছিল তার কন্ঠধ্বনি।।
বেশ্যা বৃত্তি ছিল তার পাপ কর্মে রত।
গান শুনে সবাকার হয় মনমত।।
কন্ঠস্বর ছিল তার অতি মধুময়।
সে কারণে কাবিগানে বিখ্যাত সে হয়।।
গোবিন্দ তাতীর দলে দোঁহারী করিত।
সুকন্ঠ গাইকা বলে দলেতে রাখিত।।
প্রথম দিনেতে কবি হইল তথায়।
তরকের গুণগান সব লোকে কায়।।
তাই শুনে চারিদিকে জনরব হলো।
জ্ঞানীগুণী যত লোক তথায় আসিল।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ আদি পণ্ডিত সমাজ।
হিংসা বৃত্তি নিয়ে তারা আসিলেন আজ।।
গোবিন্দ তাতীর দল গাহে যবে গান।
কোন কিছু না বলিল পণ্ডিতের গণ।।
তারক যখনেতে সেই আসরেতে গেল।
শত শত প্রশ্ন তারা করিতে লাগিল।।
তাই জেনে সে তারক শ্রীহরি স্মরিয়া।
সে কথার যব দিল সুন্দর করিয়া।।
এমন সুন্দর কথা শোনে নাই কেউ।
সুমধুর কথা শুনে ওঠে প্রেম ঢেউ।।
মহাভাব উথলিয়া কাব্য কথা কয়।
তাই দেখে শ্রোতাগণ করে জয় জয়।।
তারকের দেহ হতে জ্যোতি বাহিরায়।
তাই দেখে কত জনে পড়িলেন পায়।।
রামাগণে বাসা স্বরে উলুধ্বনি দেয়।
প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
জ্ঞানহারা প্রায় সেই পণ্ডিতের দল।
আধ আধ ভাষা দিয়ে বলে হরি বল।।
কেহ কেহ পড়িলেন তারকের পায়।
মাটিতে পড়িয়া কেহ গড়াগড়ি যায়।।
এই ভাবে প্রেম নিধি হইলেন শান্ত।
তারপর সে তারক গান করে ক্ষান্ত।।
জ্ঞানীগুণী শ্রোতাগণ একত্র হইয়া।
রজত পদক এক গঠিয়া আনিয়া।।
তাহাতে লিখিয়া দিল কবি রসরাজ।
তারকের গলে দিল পণ্ডিত সমাজ।।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
রমাগণে উলুধ্বনি দিলেন আসিয়া।।
তাই জেনে গোবিন্দের যতেক দোঁহার।
মনে মনে বিষাদিত তাদের অন্তর।।
গোবিন্দরে ডেকে বলে সে মনমোহিনী।
তারকের জয় গান চারিদিকে শুনি।।
আমাদের কন্ঠ ভাল সব লোকে কয়।
তবে কেন তারকের হয় জয় জয়।।
মোহিনীর কথা শুনে কহিল গোবিন্দ।
তারকের জয় গানে কেন কর সন্ধ।।
ব্রহ্মচারী মহাসাধু তারক গোঁসাই।
তারকের কোন দিন পরাজয় নাই।।
শক্তি যদি কোন দিন নষ্ট হয় যায়।
সেই দিন তারকের হবে পরাজয়।।
তাই শুনে মোহিনী ভাবে মনে মন।
তারকের শক্তি আমি করিব হরণ।।
আজি নিশি যাব আমি তারকের ঠাই।
পরীক্ষা করিব আমি কেমন গোঁসাই।।
গভীর রজনী দেখি মোহিনী চলিল।
যে ঘরেতে সে তারক ঘুমাইয়া ছিল।।
তারকের কোলে করে শুইল মোহিনী।
কাম শক্তি জাগাইতে চেষ্ঠা করে ধনী।।
তারকের দেহে যেই করিল পরশ।
ভাবের উদয় হয়ে হইল অবশ।।
তখন তারক চন্দ্র মা বলে ডাকিল।
এত দিন পরে মাগো মনেতে পড়িল।।
শিশু বেলা কোলে করে ঘামাতে আমায়।
আজ বুঝি মনে পড়ে এসেছ হেথায়।।
তই শুনে সে মোহিনী কান্দিতে লাগিল।
অনুরাগ ভরে শেষে কান্দিয়া কহিল।।
আমি যদি তব মাতা হই ধরা পরে।
আর বার মা বলিয়ে ডাক বাবা মোরে।।
এত যদি কহিলেন সে মনমোহিনী।
মা মা বলিয়া ডাকে কবি চূড়ামণি।।
তাই শুনে সে মোহিনী কান্দিতে লাগিল।
আমার জনম ধন্য মনেতে ভাবিল।।
বাৎসল্যেতে ভরপুর তাহার হৃদয়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
কেন্দে কেন্দে চলিলেন গোবিন্দের কাছে।
চরণে পড়িয়া শেষে কান্দিয়া বলেছে।।।
শুন শুন মহাশয় বলি তব ঠাই।
বিদায় কর হে মোরে দেশে চলে যাই।।
শুনিয়া গোবিন্দ বলে মোহিনীর ঠাই।
কেন তুমি চলে যাবে কহ মোরে তাই।।
মোহিনী বলেছে আমি কবি না গাহিব।
গৃহে থেকে আর আমি বাহিরে না যাব।।
এই মাত্র তারকের মা হয়েছি আমি ।
আমি যদি কবি গাই হবে বদনামি।।
জননী হইয়া যদি করি কবিগান।
প্রকারেতে তারকের হবে অপমান।।
তাই বলি মহাশয় চরণে জানাই।
বিদায় কর হে মোরে দেশে চলে যাই।।
তাই শুনে সে গোবিন্দ মনেতে ভাবিল।
শুনিয়া সকল কথা বিদায় করিল।।
বিদায় হইয়া শেষে দেশে চলে গেল।
তারকের পরশেতে হরি ভক্ত হল।
তারপর শুন এক আশ্চর্য্য ঘটনা।
হরিভক্ত নিকটেতে করিব বর্ণনা।।
তারকের গৃহে ছিল একটি বৃষভ।
পশু জাতি বলে তার পশুর স্বভাব।।
পশুদের ধর্ম আছে ধর্ম জ্ঞান নাই।
মানুষের সব আছে শ্রেষ্ট হয় তাই।।
বৃষভের নাম রাখে তারক গোঁসাই।
শম্ভু শম্ভু বলে তারে ডাকিত সদাই।।
ডাক দিলে কাছে এসে শ্রীঅঙ্গ চাটিত।
অবলা সেই পশু জাতি ভালবাসা দিত।।
একদিন গাভী আর বৃষভ সঙ্গেতে।
সে নবগঙ্গায় চলে স্নান করাইতে।।
অন্য এক গাভী ধায় ঋতুবতী হয়ে।
তাই দেখে সেই শম্ভু চলিলেন ধেয়ে।।
তাই দেখে শ্রী তারক দ্রুতগতি যায়।
শম্ভুকে কহিছে তিনি হস্ত দিয়ে গায়।।
তারকের পরশেতে কাম দুরে গেল।
তারকের সঙ্গে এসে নদীতে নামিল।।
তারপর স্নান করি গৃহতে চলিল।
পশু পাখী যেন তার অনুগত ছিল।।
এহেন পরশমণি আসিল জগতে।
চোর সাধু হয়ে গেল তার পরশেতে।।
অপুত্রকে পুত্র পায় তাহার কথায়।
নির্ধনের ধন হয় তার করুণায়।।
ভুত প্রেত মুক্তি পায় তার দরশনে।
মহা ব্যাধি মুক্তি হয় তাহার স্মরণে।।
এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
হিংসার প্রতিফল
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।।
পদুমা গ্রামেতে ছিল কাঙ্গাল ব্যাপারী।
তারক চান্দের দলে করিত দোঁহারী।।
তাহার জেষ্ঠ্য ভায়ের এক কন্যা ছিল।
উত্তম মণি নামেতে রূপে গুণে ভাল।।
পিতা মাতা কেহ নাই কাঙ্গালী পালিত।
কাঙ্গালীকে পিতৃজ্ঞানে সে মেয়ে ভাবিত।।
কন্যাসম সে কাঙ্গালী করিত পালন।
উত্তম বলিয়া তারে ডাকিত কখন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
নয় বর্ষ গত হলে তারে বিয়ে দেয়।।
বিবাহ হইল তার চালনা গ্রামেতে।
বিধিলিপি ছিল যাহা কে পারে খণ্ডাতে।
তৃতীয় বছরে তার স্বামী মারা গেল।
বিধবা হইয়া শেষে পদুমায় এল।।
শিশু বেলা যার পিতা মাতা মারা যায়।
তার দুঃখ সারে নাক সব লোকে কয়।।
এসময় সে কাঙ্গালী সে হইল প্রাচীন।
আজ মরে কাল মরে দেহ হল ক্ষীণ।।
উত্তম মণির দুঃখে কাঙ্গালী দুঃখিত।
জলে ভরে আখি দু’টি তাহাকে কহিত।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
সৎপথে থাক যদি কোন চিন্তা নাই।।
আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়।
বিষয় সম্পদ যাহা দিলাম তোমায়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ হৃদয় ধরিয়া।
তারকেরে ভালবাস মনপ্রাণ দিয়া।।
হরিভক্তগণ যদি আসে তব ঘরে।
সেবা করাইবে সবে অতি সমাদরে।।
হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম লও।
চরিত্র পবিত্র রেখে জীবন কাটাও।।
এই ভাবে সে কাঙ্গালী কত বুঝাইল।
কিছু দিন পরে সে যে জীবন তেজিল।।
তারপর কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন সে তারক পাদুমায় এল।।
তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন।
মনপ্রাণ সপে দিয়ে করিত ভজন।।
উত্তম মণির ঘরে তারক আসিত।
দুই চারিদিন তথা আনন্দে থাকিত।।
নিস্কাম নিয়মে তারে ভালবাসা দিত।
ভালবাসা এড়াইয়া যেতে না পারিত।।
এ সময় উত্তমের বয়স যৌবন।
পচিশ ছাব্বিশ তার হবে অনুমান।।
এই ভাবে সে তারক আসিত যাইত।
পাড়া প্রতিবেশী তারা কত কি ভাবিত।।
যে যেমন লোক সেই তেমন বুঝিয়া।
যার যার মন কথা বেড়াত কহিয়া।।
পাষণ্ডী যতেক লোক ভাবিত সদাই।
কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।।
যুবতী মেয়ের সঙ্গে একি ব্যাবহার।
এক ঘরে শুয়ে থাকে কেমন বিচার।।
এই ভাবে কানাকানি করিত সকলে।
ছিল এক মাতুব্বর তার কাছে বলে।।
শুনিয়া সে মাতুব্বর ভাবে মনে মন।
কৌশল করিয়া তারে মারিব পরাণে।।
দুষ্ট লোক যত ছিল হয়ে একত্তর।
পরামর্শ করিলেন সেই মাতুব্বর।।
যেই দিন আসিবে সেই তারক গোঁসাই।
আমি গিয়ে বলিব সেই উত্তমের ঠাই।।
গোঁসাই এসেছে যদি মোর কথা লও।
আমাদের লয়ে তুমি হরিলুট দাও।।
মোর কথা শুনে সেই হরিলুট দিবে।
সেই দিন সবে মিলে সেখানে আসিবে।।
সেই খানে হরিনাম হইবে যখন।
হরিনামে মাতোয়ারা হইবি তখন।।
মাতোয়ারা হয়ে আমি দ্বীপ নিবাইব।
তারকের পিছে গিয়ে আমি লুকাইব।।
সেই ফাঁকে তোরা গিয়ে মুখে ঘুষি দিবি।
মাটিতে ফেলিয়ে তারে প্রহার করিবি।।
এই ভাবে পরামর্শ করিল সবাই।
কিছুদিন পরে এল তার গোঁসাই।।
তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন।
ভক্তিভরে ধোয়াইল যুগল চরণ।।
বসিতে আসন দিল গৃহ মধ্যে নিয়া।
সেবা করাইল তারে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
তাই যেনে পাষন্ডীরা কহিল তখন।
উত্তম মণির কাছে করিল বর্ণন।।
ভাল হল তব গৃহে আসিল গোঁসাই।
হরিলুট দাও যদি আসিব সবাই।।
তাই শুনে সে উত্তম তারকে জানায়।
হরিলুট দিতে বলে গ্রামের সবাই।।
তারক বলেছে তুমি হরিলুট দিবে।
ভাল কাজ কর তুমি আর ভাল হবে।।
তাই শুনে সে উত্তম তাহাই করিল।
বাতাসা কিনিয়ে এনে নিমন্ত্রণ দিল।।
নিমন্ত্রণ পেয়ে তারা সকলে আসিল।
তারকেরে সঙ্গে করি লুট সাজাইল।।
অন্তরেতে হিংসা নিয়ে আসিল সকলে।
বাহিরে সরল ভাষা হরি হরি বলে।।
সংকীর্তন করিতেছে সকলে মিলিয়া।
হরিনাম করে তারা মাতিয়া মাতিয়া।।
হেন কালে মাতুব্বর দ্বীপ নিভাইল।
তাই দেখে সে তারক অদৃশ্য হইল।।
হরি বলে ঘুষি মারে তারকে ভাবিয়া।
মাতুব্বরের নাকে মুখে লাগিল আসিয়া।।
নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল।
চারি দিক হতে সবে মারিতে লাগিল।।
অন্ধকারে কেহ কারে চিনিতে না পারে।
তালে তালে হরি বলে জোরে ঘুষি মারে।।
মার খেয়ে মাতুব্বর অজ্ঞান হইল।
কারে কারো হস্ত পদ ফুলিয়া উঠিল।।
এই ভাবে অন্ধকারে এই কান্ড হয়।
তারক বাহিরে এসে উত্তমেরে কয়।।
কেবা কার মাথা খায় তারক কহিল।
তাই শুনে উত্তমণি হাসিতে লাগিল।।
হরি বলে ঘরে বসে সোর গোল হয়।
অন্য লোক আলো জ্বেলে আসিল তথায়।।
তারা সবে ঘরে গিয়ে দেখিবারে পায়।
মোড়োলের দৃশ্য দেখে করে হায় হায়।।
কার কার হস্তপদ ফুলিয়া উঠেছে।
তারকেরে হিংসা করে কুফল ফলেছে।।
তাই দেখে সবে এসে পড়িলেন পায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেহ কেহ কেন্দ কেন্দে তারকেরে কয়।
ওগো বাবা কর ক্ষমা ধরি তব পায়।।
তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।
হরি বলে সে তারক ক্ষমা করে দিল।।
সেই হতে তারা সবে হরি ভক্ত হল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
তারকের সধনা
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
অপূর্ব ঘটনা এক করিব বর্ণন।।
নবগঙ্গা কুলে শোভে নামে কোলাগ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে নবকৃষ্ণ নাম।।
তার হয় চারি পুত্র কন্যা দুই জন।
সাধনা নামেতে কন্যা অতি সু-শোভন।।
সর্বগুণে গুণান্বিতা জেষ্ঠ্যা সেই হয়।
মাধুর্য রসেতে ভরা তাহার হৃদয়।।
তারকেরে ভালবাসে মনপ্রাণ দিয়ে।
দৈব যোগে হল তার অন্যপাত্রে বিয়ে।।
পরদিন গেল তার স্বামীর ঘরেতে।
বিধাতার বিধি যাহা কে পারে খন্ডাতে।।
সর্পাঘাতে তার স্বমী সে রাত্রি মরিল।
বিধাবা হইয়া শেষে পিতৃ গৃহে এল।।
তাই দেখে তার পিতা বিষাদিত মন।
সাধনার দুঃখ দেখে ঝরে দুনয়ন।।
পিতার চোখেতে জল দেখিল যখন।
করপুটে সে সাধনা কহিল তখন।।
শুন তুমি ওগো পিতা আমার বচন।
বিধাতার বিধি যাহা কে করে খণ্ডন।।
এই দেহ মন প্রাণ দিয়েছি যাহারে।
আমার মনের মানুষ আছে ধরাপরে।।
তারকেরে মনপ্রাণ দিয়াছি সপিয়া।
দিবা নিশি কান্দে প্রাণ তাহার লাগিয়া।।
সে যাহা কহিবে আমি তাহাই করিব।
তাহার আদেশে আমি মনে শান্তি পাব।।
তাই শুনে তার পিতা তাহাই করিল।
তারকের কাছে গিয়ে সকল জানাল।।
শুনিয়া সকল কথা তারক গোঁসাই।
কোলা গ্রামে আসিলেন সাধনার ঠাই।।
দেখিয়া সাধনা দেবী পড়িলেন পায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
শুন তুমি রসরাজ চরণে জানাই।
তোমা বিনে এ জীবনে কোন শান্তি নাই।।
এ জীবনে শুখ শান্তি যা কিছু আমার।
আজ হতে সপিলাম চরণে তোমার।।
তারক বলেছে তুমি শুন দিয়া মন।
আমি যাহা বলি তুমি কর হে পালন।।
সত্য পথে চল সদা সত্য কথা কও।
হাতে কাম মুখে সদা হরিনাম লও।।
নিস্কাম নিয়মে তুমি ভালবাস মোরে।
মাধুর্য্যের পাত্র তুমি হও ধরা পরে।।
মনে প্রাণে টানাটানি সতত রাখিবে।
অলক্ষেতে সব কিছু জানিতে পারিবে।।
মাধুর্য্য রসেতে ভরা তারকের মন।
সাধনার সঙ্গে তাহা করিত যাজন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
মনে প্রাণে টানাটানি থাকিত সদয়।।
সাধনা সধনা করে অরোপে থাকিত।
তারক যেখানে আছে দেখিতে পাইত।।
তারক অরোপে তারে দেখিত নয়নে।
যার যার তার তার মনে প্রাণে টানে।।
এই ভাবে দুই জনে সাধনে তৎপর।
মনে প্রাণে মিলাইত প্রেমের বাজার।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন সাধনার পিতৃগুরু এল।।
ব্রাহ্মণ সে কুলগুরু আসিল বাড়ীতে।
সাধনা কে কহিলেন যতন করিতে।।
পিতার আদেশ শুনে সাধনা তখন।
গুরুদেবে সমাদরে করিল যতন।।
পাক পাত্র ধৌত করি আনিয়া তখন।
লেপিয়া পাকের ঘর করে আয়োজন।।
পাক করিবারে গুরু সে ঘরেতে গেল।
জল ছিটাইয়া গুরু পাক আরম্ভিল।।
পাক করে সেই গুরু ভোজন করিতে।
বারে বারে সাধনাকে লাগিল ডাকিতে।।
ডাক শুনে সাধনা সে আসিল নিকটে।
কি কারণে ডাকিতেছে কহে করপুটে।।
কামাতুর সেই গুরু লাগিল কহিতে।
প্রসাদ মাখিয়া তুমি দাও মোরে খেতে।।
এক গ্রাস তুমি মোর মুখে তুলে দাও।
তারপর যেথা ইচ্ছা সেথা চলে যাও।।
তাই শুনে সে সাধনা লাগিল ভাবিতে।
ঝর ঝর আখি দু’টি লাগিল ঝরিতে।।
তারকে স্মরণ করি পিতার বাক্যেতে।
একগ্রাস মুখে তুলি দিল ব্রাহ্মণ মুখেতে।।
এ সময় সে তারক কবির খেলায়।
কি করিলি ও সাধনা ডেকে ডেকে কয়।।
এত ভালবাসি তোরে হারে রে সাধনা।
কাম দেহ স্পর্শ করি দিলিরে যন্ত্রনা।।
সেই খানে দোঁহারেরা ছিল যত জন।
তার মধ্যে ডেকে বলে সূর্য্যনারায়ণ।।
হেন কথা কেন তুমি কহিলে গোঁসাই।
সাধনা সে কি করিল কহ মোরে তাই।।
তাই শুনে সে তারক কহিল তখন।
একে এসে কহিলেন সব বিবরণ।।
তাই শুনে সকলেতে আশ্চার্য্য হইল।
মনে মনে তারা সবে ভাবিতে লাগিল।।
গোবরা কাছারী বসে মোরা গান গাই।
সাধনা সে কি করিল দেখিল গোঁসাই।।
গান শেষে মোরা সবে কোলগ্রোমে যাব।
সত্য কিবা মিথ্যা হয় সকল জানিব।।
গান শেষে সকলেতে বিদায় হইল।
সবে মিলে কোলা গ্রামে উপনীত হল।।
সাধনার কাছে গিয়ে সকল শুনিল।
শুনিয়া সকলে তাই কান্দিতে লাগিল।।
কান্দিয়া সকলে এসে পড়িলেন পায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
সাধনা আসিয়া যেই প্রণাম করিল।
ক্রোধ ভরে সে তারক কহিতে লাগিল।।
আমাকে ছুয়োনা তুমি শুন হে সাধনা।
তব দেহ আর আমি স্পর্শ করিব না।।
হেন কথা বারে বারে তারক কহিল।
বজ্রসম সাধনার বুকেতে লাগিল।।
অমিন সাধনা দেবী ধুলাতে লুটায়।
বুক ভরা অভিমানে গড়াগড়ি যায়।।
সঙ্গে যারা কহে তারা তারকের ঠাই।
অবলারে ক্ষমা কর শুন হে গোঁসাই।।
তারক বলেছে আমি ক্ষমা করে দিব।
তার আগে সাধনাকে পরীক্ষা করিব।।
এক খন্ড অগ্নি পিণ্ড হস্তেতে করিয়ে।
একদন্ড থাকিবে সে এখানে দাড়ায়ে।।
তাই শুনে সে সাধনা দ্রুতগতি গিয়ে।
তেতুলের কাষ্ঠ অগ্নি আনিল ধরিয়ে।।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
চক্ষু মুদি রহিলেন সেখানে বসিয়া।।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি জলে।
তারকের হস্তপরে অগ্নিতাপ জ্বলে।।
হাতে ঠোষা পড়ে তাই ফুলিয়া উঠিল।
অমনী তারক চন্দ্র কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে কেন্দে সে তারক সাধনারে কয়।
ফেলরে হাতের অগ্নি আর নাহি সয়।।
শুনিয়া হাতের অগ্নি ফেলাইয়া দিল।
অমনী তারক চন্দ্র বুকেতে ধরিল।।
সাধনাকে বুকে ধরে ছাড়িতেছে হাই।
তোমা হেন প্রাণ প্রিয়া কোথা গিয়ে পাই।।
তাই শুনে সে সাধনা কান্দিয়া ভাসায়।
তারকের পদধরী কেন্দে কেন্দে কয়।।
এ জীবন মন প্রাণ দিয়েছি তোমায়।
জনমে জনমে যেন পদে মতি রয়।।
হেন দশা হল সেথা কহন না যায়।
মাটিতে পড়িয়া সবে করে হায় হায়।।
সূর্য্যনারায়ণ আর কাঙ্গালী বেপারী।
তারকের পদে পড়ে যায় গড়াগড়ি।।
উঠিল প্রেমের বন্যা স্রোত বয়ে যায়।
প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
হরি হরি বলে সবে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে সবে সুস্থির হইল।।
তারপর সে সাধনা সান্তনা পাইয়া।
সবাইকে খেতে দিল আনন্দে মাতিয়া।।
সকলে আনন্দ ভরে করিয়া ভোজন।
যার যার দেশে সবে করিল গমন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
মাঝে মধ্যে সে তারক আসিত তথায়।।
এই ভাবে কোলাগ্রামে আসিত গোঁসাই।
দুই এক দিন থাকে সাধনার ঠাই।।
তাই দেখে গ্রাম্য লোকে ভাবিত সবাই।
কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।।
সধনা অসতী তাই সকলে ভাবিত।
এই ভাবে কানাকানি সবাই করিত।।
স্বজাতি ভোজন যদি কোন খানে হত।
পাক করিবারে সেথা সাধনা থাকিত।।
একদিন একবাড়ী স্বজাতি ভোজন।
সমাজের যত লোক হোল নিমন্ত্রণ।।
সামাজিক যত লোক আসিয়া তথায়।
এক ঠাই বসে তারা সবাকে জানায়।।
সাধনা করিলে পাক মোরা খাইব না।
চরিত্রহীনা নারী সে সকলের জানা।।
এই কথা যখনেতে সাধনা শুনিল।
সবার মধ্যোতে এসে কহিতে লাগিল।।
করো জোড়ে বিণয়েতে কহলি ভারতী।
এই গ্রামে যত নারী সব হয় সতী।।
আসিয়া করুক পাক বিনা ওড়োনেতে।
খালি হাতে পাক হবে দেখিব চক্ষেতে।।
তাই শুনে যত নারী আসিতে না চায়।
সাধনা কহিছে তবে কি হবে উপায়।।
আমি গিয়ে করি পাক বিনা ওড়োনেতে।
হরি বলে করি পাক সবার স্বাক্ষাতে।।
হেন কথা যখনেতে সাধনা কহিল।
তাই শুনে গ্রাম্য লোকে কহিতে লাগিল।।
উত্তপ্ত তেলের মধ্যে তব হস্ত দিয়া।
নাড়িয়া করিবে পাক দেখিব থাকিয়া।।
তাই যদি পার তুমি পাক কর গিয়া।
না পারিলে মোরা সব দিব দেখাইয়া।।
তাই শুনে সে সাধনা করিবারে পাক।
প্রাণভরে হরিচাঁদে দিল এক ডাক।।
তারকের ছবিখানি হৃদয়ে ধরিয়া।
নয়ন জলেতে ভেসে পাক করে গিয়া।।
চুলা জ্বালাইয়া দিয়া কেন্দে কেন্দে কয়।
কোথা মোর হরিচাঁদ রেখ রাঙ্গা পায়।।
তারক তারক বলে কান্দিতে কান্দিতে।
তপ্ত তেলে হাত দিয়া লাগিল নাড়িতে।।
ডাল তরকারি মধ্যে হাত দিয়া নাড়ে।
আগুনেতে সাধনার হাত নাহি পোড়ে।।
সাধনার অঙ্গ হতে জ্যোতি বাহিরায়।
তাই দেখে সব লোকে কান্দিয়া ভাসায়।।
মা বলিয়া সাধনারা চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই।
তোমাসম সতী নারী এ জগতে নাই।।
না জানিয়া তোমা প্রতি দোষ করিয়াছি।
সমোচিত ফল মোরা প্রত্যক্ষে পেয়েছি।।
কত কি বলেছি মাগো আগে না বুঝিয়া।
ক্ষমা কর ওগো মাতা সন্তান বলিয়া।।
এই ভাবে সবে এসে পদে ক্ষমা চায়।
নয়নের জলে সবে কান্দিয়া ভাসায়।।
তাই দেখে সাধনার দয়া উপজিল।
হাসি মুখে সে সাধনা ক্ষমা করে দিল।।
তারপর সে সাধনা রন্ধন করিয়া।
সবাই কে খাওয়াইল আনন্দে মাতিয়া।।
ভোজন করিয়া সবে কহিল তখন।
এমন স্বাদের খাদ্য খাইনি কখন।।
সেই হতে সাধনাকে মা বলে ডাকিত।
ছোট বড় সকলেতে ভকতি করিত।।
কোলাগ্রাম ধন্য হল সাধনার গুণে।
আনন্দে মাতিল যত হরিভক্তগণে।।
হরিভক্ত ছিল সেই লোচন গোঁসাই।
সাধনাকে মা বলিয়া ডাকিত সদিই।।
সে বস বৃত্তান্ত কথা লীলামৃতে আছে।
নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।।
সাধনার সাধনায় হরিভক্তগণ।
সাধনার গুণগান করেন কীর্তন।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
ভেকের মুক্তি
শ্রীহরি স্মরিয়া আমি, গুরুচাঁদ পদে নমি
(লাইন জ্ঞাপ)
তারকের চরিত্র সুধা, মিটাইতে ভব ক্ষুধা
আশীর্বাদ কর ভক্তগণ।।
হরিভক্ত যত জন, বন্দি সবার চরণ
শ্রীচরণে করি নিবেদন।
হরিভক্ত কৃপাকরে, বসিয়া মস্তক ‘পরে
সঙ্গে থেকে করিও লিখন।
যশোহর জেলা পরে, নবগঙ্গা নদী তীরে
লক্ষ্মীপাশা গ্রামখানি ছিল।
লক্ষ্মীপাশা কালি বাড়ী, নাম ছিল দেশ জুড়ি
সে কারণে বিখ্যাত হইল।।
সেই গ্রামে একজন, পুকুর করে খনন
কুয়াতিরা মাটি কাটিতেছে।।
ছয় হাত মাটি তলে, দেখিতে পায় সকলে
ফোস ফোস শব্দ হইতেছে।
কিছু মাটি ফেলে দিল, সকলে দেখিতে পেল
শোয়া হাত পরিমাণ হবে।
বড় এক ভেক দেখি, সকলে ভাবিল একি
মনে মনে সকলেতে ভাবে।।
গায় দেখে চেট ভরা, বুঝিতে না পারে তারা
এত বলি ডাকিল সকলে।
জ্ঞানীগুণী ছিল যারা, আসিয়া দেখিল তারা
যে যেমন বোঝে তাই বলে।।
এক জন ডেকে কহে, এত কভু ভেক নহে
এত বড় ভেক কভু হয়।
অন্য প্রাণী হবে ভাই, মোর মনে জাগে তাই
ভাল করে দেখরে সবায়।।
একজন ডেকে কয়, ভেক ছাড়া কিছু নয়
সব কিছু ভেকের আকৃতি।
বহুদিন পড়ে রয়, তাই এত বড় হয়
না বুঝিয়া কহ যে অযুক্তি।।
এই ভাবে কত জন, করে সথো আগমন
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এল কত।
কহিলেন কত কথা, যুক্তিতে আসিল না তা।
কহে যত যার যার মত।।
সেই খানে ছিল যারা, সবে হল দিশেহারা
সুরেন্দ্র নামেতে একজন।
সে কহিল সকলেরে, এই কথা কহিবারে
পারে মাত্র তারক সুজন।।
এই কথা শুনি কানে, কহিল পণ্ডিতগণে
হেসে হেসে কহিল তখনে।
আদ্য মধ্য আছে কত, সবে হল থতমত
তারক সে পারিবে কেমনে।।
কাড়ার যাজির ছেলে, কবি গায় তাই বলে
হেন তত্ব ক্যামনে কহিবে।
শুনিয়ে সে ঘটনা, কোন মতে আসিবেনা
পার যদি আন গিয়ে সবে।।
একজন তথা গিয়ে, তারকেররে প্রণমিয়ে
কহিল সকল সমাচার।
শুনিয়া তারক তাই, কেমনে আমি যাই
আমি হই জাতিতে কাড়ার।।
মোর বিদ্যা বুদ্ধি নাই, সেথা পণ্ডিত সবাই
আমি হই ক্ষুদ্র একজন।
আমি সেথা নাহি যাব, কেন অপমান হব
বল গিয়ে আমার বচন।।
তাই শুনে চলে গেল, সব গিয়ে নিবেদিল
কহিল সে তারক গোঁসাই।
বড় বড় পণ্ডিতেরা, সেখানে রয়েছে তারা
বলিলেন পণ্ডিত সবাই।
তাই শুনে পণ্ডিতেরা, হাসিতে লাগিল তারা
হাসিয়া কহিল একজন।
আমাদের আছে জানা, সে কখন আসিবে না
তার দ্বারা হবে না কখন।।
সুরেন্দ্র শুনিয়ে তাই, কহিলেন আমি যাই
কেন আসিবে না সেই জন।
চলিলেন ধীরে ধীরে, গিয়ে সেই জয়পুরে
তারকের করিল বন্দন।
কহিলেন বিনয়েতে, চল বাবা মোর সাথে
চল তুমি লক্ষ্মীপাশা গায়।
তুমি যদি নাহি যোবে, এ জীবনে কিবা হবে
এ জীবন ত্যাজিব নিশ্চয়।।
হেন কথা শুনি কানে, কি যেন ভাবিয়া মনে
সুরেন্দ্রের সঙ্গেতে চলিল।
ঘটনার স্থলে গিয়ে, ভেকেরে দেখিল চেয়ে
সভা মধ্যে দাড়ায় কহিল।।
শুন শুন সভাজন, করি আমি নিবেদন
আমি হই কড়ারের ছেলে।
হরিচাঁদ পদ ভাবি, হৃদয়ে আঁকিয়া ছবি
এই তত্ত্ব আমি যাই বলে।।
কর্ম ফলে কত লোক, পায় তারা দিব্য লোক
কর্ম ফলে হয় রাজরাণী।
কর্ম ফলে রাজ্য হারা, অন্ধ খঞ্জ সবে তারা
কর্ম ফলে হয় ধনীমানী।।
মানব জনম ধরি, কেহ করে গুরুগিরি
কেহ কেহ শিষ্য হয়ে রয়।
পূর্ব জম্মে ভেক ছিল, গুরুগিরি করে ভাল
ব্রাহ্মণের ছেলে সেই হয়।।
বহু শিষ্য ছিল তার, করে গুরু ব্যাভিচার
ব্যাভিচারে মত্ত হয়েছিল।
নৌকা পথে চলে তারা, ডুবিল পাপের ভরা
কর্ম ফলে ভেক রূপী হল।।
চেট হল শিষ্য যারা, চেয়ে দেখ গায় ভরা
কর্ম ফল ফলিয়াছে ভাল।
তাই শুনে সেই ভেকে, ঠিক ঠিক ওঠে ডেকে
আখি জলে ভাসিতে লাগিল।।
ভেক ভাসে আখি জলে, তাই দেখি কেন্দে বলে
পেয়ারী নামেতে যেই ছিল।
শুনিতে বাসনা আজ, কহ তুমি রসরাজ
কিসে ভেক মুক্তি পাবে বল।।
শুনিয়া তারক কয়, হরি বলি রসনায়
শুন তাই কিসে মুক্তি পাবে।
হরিভক্ত দরশনে, হরি ভক্ত পরশনে
সর্বপাপ মুক্ত হয়ে যাবে।।
হেন কথা শুনে কানে, ভেক ভাবি মনে মনে
লাফ দিয়ে চরণে পড়িল।
তারকের পড়ি পায়, প্রাণ পাখি উড়ে যায়
চেটগণ পরাণ তেজিল।।
হেন দৃশ্য চোখে হেরি, সবে যায় গড়াগড়ি
তারকেরে চরণে লুটায়।
ধনীমানী ছিল যারা, সবে হয়ে আত্মহারা
নয়নের জলে ভেসে যায়।।
ভক্তি রসে মাতোয়ারা, নয়নে বহিছে ধারা
তারকের করে জয়গান।
ভেকেরে ধরিয়া তুলে, ফেলে দিল গঙ্গা জলে
সাঙ্গ ভেক মুক্তির আখ্যান।।
হরি ভক্ত যারা যারা, প্রেম রসে মাতোয়ারা
পরশনে সর্বপাপ ক্ষয়।
কান্দিযা বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
অধমের কি হবে উপায়।।
স্বপনে তারক চাঁদ
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
তারক চাঁদের কথা করিব বর্নণ।।
তারকের নাম নিলে শমন পালায়।
তাহার স্মরণে হয় সর্ব ব্যাধি ক্ষয়।।
তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন।
আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।।
যশোহর জেলা মধ্যে মাগুরার কাছে।
দোয়ানী নামেতে গ্রাম সেই খানে আছে।।
সেই গ্রামে বাস করে শ্রী নকুল নাম।
সরল হৃদয়খানি ভক্ত গুণধাম।।
তাহার রমণী ছিল নামে লক্ষ্মী দেবী।
মনেতে আনন্দ পায় স্বামী পদ সেবী।।
সর্বগুণে গুণান্বিতা লক্ষ্মী দেবী হয়।
সে নকুল সদা ভাসে আনন্দ দোলায়।।
জমা জমি যাহা কিছু ছিল যে তাহার।
ভালভাবে চলে যেত তাহার সংসার।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
লক্ষ্মীর গর্ভেতে এক পুত্র জনমিল।।
সে গ্রামের চারিপাশে যত গ্রাম আছে।
তারক গোঁসাই এসে গান করিতেছে।।
কবিগান করে সেথা তারক গোঁসাই।
তারকের গুণগান করিত সবাই।।
জ্ঞানীগুণী যারা ছিল শুনি তার গান।
প্রাণভরে শুনে তারা জুড়াইত কান।।
তাই শুনি লক্ষ্মী দেবী মনেতে ভাবিয়া।
তারকে হেরিব আমি কেমন করিয়া।।
তারকের নাম গুণে ঝরে আখি জল।
কেমনে হেরিব আমি চরণ যুগল।।
উদ্দেশে তারক পদে প্রণাম জানায়।
নামগুণে হৃদয়েতে প্রেমের উদয়।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
দৈব যোগে ছেলেটির রোগ দেখা দিল।।
প্রাণাধিক সেই ছেলে ভালবাসে তারা।
প্লিহা জ্বরে ক্রমে ক্রমে হল জীর্ণ জ্বরা।।
পাড়া গায় ডাক্তার ছিল না তখন।
ঝাড়া পোছা মুষ্টি যোগ করে সর্বক্ষণ।।
আজ মরে কাল মরে অস্থি চর্ম সার।
জীবনের আশা ছেড়ে দিল যে এবার।।
মনে মনে লক্ষ্মী দেবী তারকে স্মরিয়া।
এই ভাবে সেই নারী বেড়াত কান্দিয়া।।
একদিন স্বপনেতে দেখিতে পাইল।
তারক আসিয়া তার শিয়রে বসিল।।
হাসি মুখে সে তারক কহিল তখন।
আসিব তোমার ঘরে মোরা কয় জন।।
আগামী সকালে তুমি করিবে রন্ধন।
তব ঘরে ভোজন করিব চারি জন।।
স্বপনে দেখিয়া লক্ষ্মী প্রভাতে জাগিয়া।
স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল কান্দিয়া।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি মানুষ রতন।
মস্তকেতে উভ ঝুটি সুন্দর গঠন।।
মুখ ভরা শছতার প্রেমের মুরতী।
মম ঘরে আসিবেন হইয়া অতিথি।।
চারিজন খাব মোরা আমাকে বলেছে।
পাক করা অনুমতি চাই তব কাছে।।
নকুল বলেছে তুমি দেখেছ স্বপন।
তব মনে যাহা ইচ্ছা কর হে পালন।।
তাই শুনে সেই লক্ষ্মী রন্ধন করিল।
হেন ক্ষণে তিন জন তথায় আসিল।।
তারক কাঙ্গালী আর সূর্য্যনারায়ণ।
তাই দেখে সেই লক্ষ্মী ভাবে মনে মন।।
স্বপনেতে কহিয়াছে চারিজন কথা।
আসিয়াছে তিন জন আর জন কোথা।
স্বামীর চরণে গিয়ে কেন্দে কেন্দে কয়।
স্বপনে দেখেছি যারে এসেছ হেথায়।।
হেন কথা সেই মেয়ে বলিতে বলিতে।
তারকের পদধরি লাগিল কান্দিতে।।
তাই দেখে সে নকুল চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
তারক ধরিয়া তুলে কহিল তখন।
বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে করিব ভোজন।।
তাই শুনে সেই মেয়ে উঠিয়া দাঁড়াল।
ছল ছল আখি দু’টি কান্দিয়া কহিল।।
স্বপনে বলেছ তুমি পাক করিবারে।
রন্ধন করিয়া আমি রাখিয়াছি ঘরে।।
এত বলি সেই মেয়ে কান্দিয়া কান্দিয়া।
ভোজনের ঠাই করে আসন পাতিয়া।।
তিনটি আসন পেতে করে দিল ঠাই।
তাই দেখে কহিলেন তারক গোঁসাই।।
আর এক খানি পিড়ি আনিয়ে পাতাও।
ঘরে আছে তব ছেলে তাহারে বসাও।।
এক সঙ্গে চার জন ভোজন করিব।
তার দেহে যত রোগ আমি নিয়ে যাব।।
তাই শুনে দুই জনে কান্দিয়া ভাসায়।
মৃতপ্রায় সেই ছেলে আনিয়া বসায়।।
লক্ষ্মী দেবী অন্য দেয় হরষিত মন।
আনন্দে ভোজন করে সেই চার জন।।
মুখে রুচি পেয়ে সেই ছেলেটি খাইল।
সবাই সমান খেল সকলে দেখিল।।
সেই হতে সে ছেলের রোগ দুরে গেল।
হরিবলে সেই ছেলে নাচিতে লাগিল।।
তাই দেখি স্বামী স্ত্রী কান্দিয়া ভাষায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
তারক বলেছে মাগো মন খাটি চাই।
হরিচাঁদের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।।
সেই হতে তারা সবে হরিভক্ত হল।
এ দীন বিনোদ বলে হরি হরি বল।।