পরিশিষ্ট খণ্ডঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
পরিশিষ্ট খণ্ড
দ্বিতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
দ্বিতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
(জয় শ্রীসুধন্যচাঁদ সভ্যভামাত্মজ।
প্রেমানন্দে হরি গুরু শ্রীপতিচাঁদ ভজ।।)
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
স্বামী মহানন্দ পাগলের লীলা
পয়ার
বড় পাগল বলিয়া খ্যাতি শ্রীগোলোক।
যে কালে ভূলোক ছাড়ি গেলেন গোলোক।।
গোলোকের অঙ্গ হ’তে উঠে এক জ্যোতি।
জ্যোতির সহিত এক উঠিল শকতি।।
ধাইয়া উঠিল জ্যোতি গগন মণ্ডলে।
নামিতে লাগিল জ্যোতি দেখিল সকলে।।
জয়পুর তারকের বাড়ী দেহত্যাগ।
এ সময় তারকের কোলে মহাভাগ।।
সবে দেখে সেই জ্যোতি নিম্নগামী হয়।
দেখিতে দেখিতে জ্যোতি হ’য়ে গেল লয়।।
তারক দেখিল জ্যোতি পূর্বমুখ হ’ল।
নারিকেলবাড়ী গিয়া পতিত হইল।।
মহানন্দ শ্রীঅঙ্গেতে মিশিল সে জ্যোতি।
ছোট পাগল বলিয়া হ’ল তাঁর খ্যাতি।।
যেই দিন মহানন্দ করিল শ্রবণ।
করিল গোলোকচাঁদ লীলা সম্বরণ।।
শ্রবণেতে মহানন্দ নিরানন্দ চিত।
ঠিক না করিতে পারে কি কার্য উচিৎ।।
হইল উন্মনা যেন পাগলের ন্যায়।
হইয়া বিস্মৃতি ভাব ইতি উতি ধায়।।
ঘূর্ণবায়ু মত সদা করেন ভ্রমণ।
যেখানে যেখানে পাগলের আগমন।।
ভ্রমি সব ঘরে ঘরে করেন তালাস।
খুঁজিয়া না পেয়ে ক্রমে বাড়ে হা হুতাশ।।
অবশেষে করিলেন ফুকুরা গমন।
মধুমতী নদী কূলে ঠেকিল তখন।।
পাগলের বিরহেতে দহিতেছে কায়।
নদীজল দেখে হ’ল প্রফুল্ল হৃদয়।।
জ্বালা জুড়াইতে জলে ঝাঁপ দিয়া পড়ে।
দিল ঝাঁপ পেয়ে তাপ জল গেল সরে।।
নদী মধ্যে যতদূর হয় অগ্রসর।
জল শুষ্ক হ’য়ে যায় তপ্ত কলেবর।।
দেহ হ’তে দুই পার্শ্বে আড়ে পরিসর।
দুই হাত দেড় হাত জল দূরতর।।
আছাড়িয়া করে সদা হস্ত আস্ফালন।
জলস্তম্ভ মত উর্দ্ধে ধুম উদ্গীরণ।।
হেনকালে মূর্তিমন্ত হইয়া গোঁসাই।
গোলোক পাগল এসে দাঁড়ায় সে ঠাই।।
বলে বাপ ছাড় তাপ আমি যাই নাই।
জ্যোতি হয়ে তোর দেহে নিয়াছিরে ঠাই।।
এই আমি তোর দেহে করিনু প্রবেশ।
তুই রাজা হরিচাঁদ ভক্ত রাজ্য দেশ।।
চিরদিন তরে মম এই মনোসাধ।
কুটি নাটি কাটি দেশ করিবি আবাদ।।
পাগলে পাইয়া অগ্নি নির্বাপিত হ’ল।
পুনরায় নারিকেলবাড়ী চলে গেল।।
ভ্রমিত পাগল চাঁদ যেই যেই বাড়ী।
মহানন্দ ভ্রমে তথা লাহিড়ী লাহিড়ী।।
শালনগরের মধ্যে পালপাড়া গ্রাম।
তথায় বসতি তারাচাঁদ পাল নাম।।
ওঢ়াকাঁদি মতো সম্প্রদায় যত ছিল।
সবাকার নিমন্ত্রণ তথায় হইল।।
তারাচাঁদ ছোট পাগলের কাছে গিয়ে।
দিন ধার্য ক’রে এল আনন্দিত হ’য়ে।।
মতুয়ার ভীড় হ’ল পাগলের সঙ্গেতে।
তিন শত মতুয়া মিলিল একসাথে।।
সবে হরি হরি বলি বাহির হইল।
তরাইল বাজারে সকলে উপজিল।।
পাঁচবার খেয়াপার মতুয়া সকল।
নদীমধ্যে এপার ওপার হরিবোল।।
সে দিন বাজার পড়ে মেলা মিলেছিল।
গান সাঙ্গ হ’য়ে মেলা ভাঙ্গিয়া চলিল।।
একেত মেলার মাঠে ছিল গণ্ডগোল।
তাঁর সঙ্গে মিশে গেল সুধা হরিবোল।।
দোকানী পশারী যত দোকানে দোকানে।
সবে বলে হরি হরি ওই নাম শুনে।।
বাজারে বসতি বড় বড় মহাজন।
ঘরে ঘরে সবে করে নাম সংকীর্তন।।
মেলায় এসেছে লোক ফিরে বাড়ী যায়।
ঘাটে পথে তারা সবে হরিনাম লয়।।
পার হয় যত ম’তো খেয়াঘাটে রই।
অন্য নাম নাহি মুখে হরিনাম বই।।
মেলার অধ্যক্ষ যত তারা বলে একি।
ভেঙ্গেছিল মেলা কি পুনশ্চ হল নাকি।।
কেহ কেহ ঘুরিতেছে নাগর দোলায়।
ঘূর্ণমান হ’য়ে ভব নদীর গোলায়।।
তাহারা চাহিয়া দেখে ঘাটের দিকেতে।
মতুয়ারা হরি বলে প্রেমানন্দ চিতে।।
তারা সবে হরি বলে নাগরদোলায়।
অধে হরি উর্দ্ধে হরি তরঙ্গ গোলায়।।
ঝাঁকি লেগে দোলা ভাঙ্গে এই ভয় করে।
দোলা আলা লোক সব নামাইল পরে।।
ভূমিতে নামিয়া লোক হাতে দিয়ে তালি।
নদীর কিনারে যায় হরি হরি বলি।।
বেশ্যারা ছিলেন জলে স্নান করিবারে।
কেহ বা বাজারে কেহ কিনারে বা ঘরে।।
ওপারে এপারে হরিধ্বনি করে সব।
খেয়ানায় নদীমধ্যে উঠিয়াছে রব।।
তাহা শুনি বেশ্যাগণ বলে ধন্য ধন্য।
হরি হরি বলে তারা হ’য়ে জ্ঞানশূন্য।।
অশ্রুপূর্ণ শিবনেত্র হরিনাম লয়।
মধ্যে হুলুধ্বনি করে জয় জয় জয়।।
এই মতে পার হ’ল মতুয়ারগণ।
নাচিয়া গাহিয়া সবে করিল গমন।।
মেলার বাজারে হ’ল কিমাশ্চর্য লীলা।
রচিল তারকচন্দ্র পাগলের খেলা।।
স্বামীর শালনগর গমন।
পয়ার
হাসে গায় নাচে কাঁদে মতুয়ার দল।
কুন্দসী গ্রামেতে এসে উঠিল সকলে।।
শ্রীঅদ্বৈত দীননাথ কালাচাঁদ পাল।
তিন বাড়ী পরিপূর্ণ মতুয়ার দল।।
কতকাংশ চলে গেল জয়পুর গ্রাম।
তারকের বাড়ী ঘিরে করে হরিনাম।।
কুন্দসীর তিন বাড়ী জুড়িয়া বসিল।
মাধ্যাহ্নিক স্নানাদি ভোজন সমাধিল।।
ভোজনের পরে দিয়া হরি হরি ভীড়।
আচমন করি সবে হইল বাহির।।
নাচিতে গাইতে সবে প্রেমেতে বিভোর।
উপনীত হ’ল পালপাড়া শালনগর।।
নামেতে মাতিয়া সবে বাহ্যজ্ঞান হারা।
বৈবর্ণ পূলক স্বেদ চক্ষে অশ্রুধারা।।
দিঘলিয়াবাসী মধুসূদন ঠাকুর।
চক্রবর্তী উপাধি ভজনে সুচতুর।।
তার এক পুত্র মাত্র অক্ষয় নামেতে।
ব্রহ্মত্ব ত্যজিয়া মিশিলেন অই মতে।।
ছিণ্ডিয়া গলার পৈতা দেন পরিচয়।
মতুয়া হ’য়েছি ওঢ়াকাঁদি সম্প্রদায়।।
শ্রীগুরু তারক চন্দ্র জননী সাধনা।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদে করি আরাধনা।।
প্রেমদাতা মহানন্দ চিদানন্দময়।
জয় ওঢ়াকাঁদি জয় ওঢ়াকাঁদি জয়।।
হরিবোলা সঙ্গে তিনি পালপাড়া গিয়া।
নামে প্রেমে কীর্তনেতে গেলেন মাতিয়া।।
কীর্তনের মাঝে গিয়া মনের আনন্দে।
মহানন্দ পাগলকে করিলেন স্কন্ধে।।
মহানন্দ অক্ষয়ের স্কন্ধেতে বসিয়া।
অস্থি সন্ধি কল যেন দিলেন ছাড়িয়া।।
এ রঙ্গ দেখিয়া প্রেমে উন্মত্ত সকল।
সবাকার মুখে মাত্র সুধা হরিবোল।।
ক্ষণ পরে সবে করে ঠাকুরকে স্কন্ধে।
বাহ্যহারা কে কারে কি করে প্রেমানন্দে।।
ব্রাহ্মণ কায়স্থ কুণ্ডু পাল ঝালো মালো।
নমঃশূদ্র সাহা সাধু একত্র হইল।।
মাতিয়া কীর্তনানন্দে প্রায় নিশি শেষ।
পাগলচাঁদের হ’ল অদ্বৈত আবেশ।।
কহিছেন তোরা আলি সে আমার কই।
যারে নেড়ে এনে আমি নাড়া নাম লই।।
যার জন্য করিলাম সাধ্য এতদূর।
অসাধ্য সাধন করি ব’সে শান্তিপুর।।
যার জন্য ফুল তুলসী ধাইল উজান।
কইরে আমার সেই পরাণের পরাণ।।
অক্ষয় ঠাকুর কহে শোন ওরে নাড়া।
ওঢ়াকাঁদি আসিয়েছে তোর সেই গোরা।।
তার দুই পুত্র গুরুচাঁদ উমাকান্ত।
তার প্রাণপুতলী করিছে লীলা অন্ত।।
দেহ ছেড়ে করেছেন গোলোকে গমন।
জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুচাঁদ জগত জীবন।।
তোর হরিচাঁদ গুরুচাঁদে মিশিয়াছে।
মানুষে মানুষ মেশা বর্তমানে আছে।।
বলিতে বলিতে কয় মুই শ্রীচৈতন্য।
অধরোষ্ঠ চক্ষুদ্বয় হ’ল রক্তবর্ণ।।
রোমকূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুণ্ডু উথলিল।
কণ্টক আকার কেশ লোম উর্দ্ধ হ’ল।।
দু’জনার মোহ প্রাপ্ত জ্ঞান নাহি আর।
মতুয়া সকলে হরি বলে অনিবার।।
দশা ভঙ্গ হ’ল প্রায় নিশি অবসানে।
করিল কীর্তন ক্ষান্ত সবে সুস্থ মনে।।
ভোজন হইল সব ভোরের সময়।
আচমন সময়েতে অরুণ উদয়।।
আরবার মাতিলেন নাম সংকীর্তনে।
গাইতে গাইতে সবে চলিলেন স্নানে।।
মধুমতী ভরট গোগের ঘাটে গিয়া।
জলকেলী করে সবে আনন্দে মাতিয়া।।
হরি হরি হরি বলি করে জলকেলী।
প্রেমাবেশে করে সবে জল ফেলাফেলী।।
জলকেলী করি শেষে ভিজা বসনেতে।
আসিলেন তারাচাঁদ পালের বাটীতে।।
দধি খদি চিঁড়া চিনি জল ফলাহার।
ফুল মহোৎসব সবে করে বার বার।।
শালনগরের মহোৎসবে এই লীলা।
গোলোক পুলক হেতু রায় বিরচিলা।।
সাহাবাজপুর রাখাল সঙ্গে পাগলের খেলা।
পয়ার
সাহাবাজপুর গ্রামে হ’ল নিমন্ত্রণ।
দল বল সহ করে পাগল গমন।।
তপস্বী পালের বাড়ী হবে মহোৎসব।
পুলকে চলিল মতুয়ার গণ সব।।
মধ্যাহ্ন সময় যাত্রা করিল সকলে।
হরি হরি বলি সবে প্রেমানন্দে চলে।।
সাত ভাগ হ’য়ে চলে মতুয়ারা সব।
জটকের বিল মধ্যে উঠে কলরব।।
বিলের কিনারা দিয়ে মতুয়ারা যায়।
জটকের বিলে খালে ডাঙ্গায় নৌকায়।।
যেখানে যে লোক সবে হরিগুণ গায়।
কেহ বলে বাবা হরিচাঁদ জয় জয়।।
কেহ বলে জয় জয় গুরুচাঁদ জয়।
কেহ বলে গোলোক চাঁদের জয় জয়।।
কেহ বলে জয় জয় মহানন্দ জয়।
কেহ বলে ওঢ়াকাঁদি ভক্তগণ জয়।।
কেহ কেহ বলে জয় জয় হরিপাল।
কেহ বলে জয় জয় পালের ময়াল।।
কহে বলে পাল ধন্য ক’ল হরিপাল।
কেশবপুর নিবাসী শ্রীগোলোক পাল।।
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম হরিশ্চন্দ্র পাল।
কেহ বলে হরিপাল পালের ভূপাল।।
মধ্যম দুর্গাচরণ অপরে প্রহলদ।
কনিষ্ঠ শ্রীগৌর পাল নামেতে উন্মাদ।।
চারি পুত্র সহ মাতোয়ারা হরিবোলা।
কেহ কেহ হরিপালে বলে হরিবোলা।।
হরিবোলা হ’য়ে হরি মাতাইল পাল।
সবে বলে হরিপাল পালের ভূপাল।।
এইভাবে সবাই দিতেছে হরিধ্বনি।
জটকের বিলে তার হ’ল প্রতিধ্বনি।।
হরিধ্বনি শুনা যায় গগন মণ্ডলে।
জ্ঞান হয় দেবগণে হরি হরি বলে।।
সকলে থামিল শুনি হরি হরি ধ্বনি।
তবু শূন্যে শুনা যায় হরি হরি ধ্বনি।।
শুনে প্রেমানন্দ চিত্ত মতুয়া সকলে।
লম্ফ দিয়া যেতে চায় দেবতার দলে।।
অক্ষয় ঠাকুর আর হরিশ্চন্দ্র পাল।
পূর্ণচন্দ্র অধিকারী মতুয়া মিশাল।।
গুরু গিরি করিতেন শিষ্য ছিল তার।
শিষ্য সহ মাতিলেন আনন্দ ওপার।।
রসনা তারক সঙ্গে এই চারিজন।
কতক মতুয়া আছে সঙ্গেতে মিলন।।
এক এক দলে লোক অন্যূন পঞ্চাশ।
সবে মিলে হরি বলে মনেতে উল্লাস।।
জটকের বিল মধ্যে গরু পালে পাল।
দশ বিশ গরু রাখে একেক রাখাল।।
কেহ কেহ বিল কূলে গরু বাঁধিয়াছে।
দলে দলে রাখালেরা খেলা করিতেছে।।
হরি বোল শুনে তারা আনন্দ হৃদয়।
কেহ কেহ হরি বলে দৌড়াইয়া যায়।।
দৌড়িয়া দৌড়িয়া মাঝে মাঝে মারে লম্ফ।
আনন্দে বসুধা নাচে যেন ভূমিকম্প।।
তার মধ্যে তারক রসনা বলে বোল।
এই ঠাই দাঁড়া দেখি মতুয়া সকল।।
আর ছয় দল রহিয়াছে ছয় ঠাই।
একদল মাঝখানে দাঁড়ায় সবাই।।
তারক কহিছে তোরা ছিলি বৃন্দাবনে।
গোচারণ করিতি সে গোপালের সনে।।
অন্য অন্য ঠাই যদি যেত ধেনু সব।
এক ঠাই হত শুনি শ্যাম বংশী রব।।
কানু গিয়া গোচারণে বাজাইত বেণু।
তোরা দিতি আবাধ্বনি নাচিত সে ধেনু।।
সেই কানু যশোদানন্দন দয়াময়।
এখন হইল যশোমন্তের তনয়।।
সেই যশোমন্ত সুত প্রভু হরিচাঁদ।
তোদের হৃদয় আছে তারে ধরা ফাঁদ।।
তোরা সেই চাঁদ সঙ্গে অনুসঙ্গী ছিলি।
প্রভু আগমনে তোরা সঙ্গে সঙ্গে এলি।।
একবার ব্রজভাবে দেরে আবাধ্বনি।
ব্রজবুলি বল সেই রাখালিয়া বাণী।।
স্থানে স্থানে পালে পালে ধেনু বৎসগণ।
তাহা দেখি ব্রজভাবে দ্রবীভূত মন।।
এই সেই বৃন্দাবন সেই গোবর্ধন।
খেলা করে এই সেই রাখালের গণ।।
উন্মত্ত রাখাল দিকে বলেছে তারক।
তোরা ত ব্রজেতে ছিলি ব্রজের বালক।।
ব্রজভাবে একবার বল হারে রে রে।
অদ্য তোরা সবে মিলে নাচ একত্তরে।।
তাহা শুনি রাখালেরা হল একত্তর।
রাখালেরা নৃত্য করে মতুয়া ভিতর।।
চৌদিকে মতুয়াগণ গোলাকার হ’য়ে।
নাচে গায় লম্ফ দেয় হরিধ্বনি দিয়ে।।
রাখালেরা প্রেমে মেতে বলে হরিবোল।
জলে হরি স্থলে হরি শূন্যে হরিবোল।।
মত্ত হ’য়ে প্রেমাবেশে কীর্তন ভিতরে।
তারক টানিয়া নিল অক্ষয় ঠাকুরে।।
পূর্ণচন্দ্র হরিপাল ধরাধরি করে।
বাঁকা হ’য়ে দাঁড়াইল আবাধ্বনি করে।।
শুনে আবাধ্বনি করে যতেক রাখাল।
তাহা শুনি নাচে সব গোধনের পাল।।
নাচিতে লাগিল বাঁধা গরু দড়ি ছিঁড়ে।
(এক লাইন গ্যাপ)
উচ্ছ পুচ্ছ নাচে গরু গলা করে লম্বা।
উর্দ্ধ কর্ণ মুণ্ড নেত্র করে হাম্বা হাম্বা।।
কতদূরে দৌড়ে গিয়া দাঁড়াইয়া কম্প।
তার মধ্যে কোনটা দৌড়িয়া মারে লম্ফ।।
তাহা দেখি সবে মিলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
নাচিছে মানুষ গরু একত্র হইয়া।।
পিছে ছিল মহানন্দ পাগলের দল।
দ্রুত বেগে উতরিল বলি হরিবল।।
নাচিছে মানুষ গরু তার মধ্যে দিয়া।
হাতে হাতে ধরাধরি চলেছে ধাইয়া।।
চলেছে দক্ষিণ দিকে জ্ঞান নাহি আর।
লম্ফ দিয়া জটকের খাল হ’ল পার।।
তাহা দেখি লম্ফ দিয়া পড়ে লোক সব।
রাখালেরা লম্ফ দিল মনেতে উৎসব।।
জলে পড়ি কেহ কেহ ঝাঁপাঝাঁপি করে।
সাঁতারিয়া সাঁতারিয়া কহে যায় পারে।।
অনুমান দুই রসি আড়ে পরিসর।
লম্ফ দিয়া মহানন্দ হয়ে গেল পার।।
জলেতে নামিয়া সবে হরিবোল দিয়ে।
ঝাঁপাইয়া সাঁতারিয়া গেল পার হয়ে।।
গভীর খালের মধ্যে চারি হাত বারি।
হরি বলে লম্ফে ঝম্পে সবে দিল পাড়ি।।
গোচরে যতেক গরু খাল কিনারায়।
দৌড়িয়া আসিয়া খাল পার হ’তে চায়।।
পাগল ওপারে থেকে কহিছে ডাকিয়া।
তোরা প্রেমানন্দ কর ওপারে থাকিয়া।।
থাক থাক বলে ঘুরে ঘুরাইল যষ্ঠি।
থামিল গরুর পাল তাহা করি দৃষ্টি।।
ওপারে নাচিছে গরু এপারে মানুষ।
পশু কি মানুষ সবে হারিয়েছে হুঁশ।।
কোলাকুলি ঢলাঢলি কাঁদাকাঁদি করি।
মাতুয়ারা মাতোয়ারা বলি হরি হরি।।
চারি পাঁচ জনে ধরে বাহু প্রসারিয়া।
তদ্রূপ রাখাল গণে ধরিয়া ধরিয়া।।
রাখালগণেরে সব দিলেন বিদায়।
উত্তর পারেতে গেল গো-পাল যথায়।।
গো-পাল শান্তায়ে নিল যতেক গো-পাল।
গো-পাল বাছিয়া নিল যার যে গো-পাল।।
এদিকে মতুয়াগণ হরিধ্বনি দিয়া।
সাহাবাজপুরে সব উতরিল গিয়া।।
কতকাংশ জয়পুর কতক কুন্দসী।
হরিনাম করে সবে প্রেম নীরে ভাসি।।
কতকাংশ রহিলেন সাহাবাজপুর।
মহানন্দ রহে আর অক্ষয় ঠাকুর।।
পূর্ণচন্দ্র অধিকারী হরিশ্চন্দ্র পাল।
তপস্বী পালের বাড়ী কীর্তন রসাল।।
অর্ধনিশি পর্যন্ত হইল সংকীর্তন।
ঘাটে পথে মাতিল পুরুষ নারীগণ।।
রামাগণে যায় সবে আনিবারে জল।
হুলুধ্বনি দেয় আর বলে হরিবল।।
স্ত্রী পুরুষ যেই জনে যেই কার্যে যায়।
চক্ষে জল ঝরে আর হরিনাম লয়।।
কীর্তন হইল সাঙ্গ বিশ্রামে সবায়।
দুই তিন পালেঙ্গায় কেহ বা পিঁড়ায়।।
প্রাঙ্গণে তপস্বী পাল আর হরিপাল।
হেনকালে দধি দিতে আইল গোয়াল।।
বাঁকস্কন্ধে হরি নাম করিতে করিতে।
দুই জন করে নৃত্য প্রাঙ্গণ মাঝেতে।।
হরিপাল ধরি তার বাঁক নামাইল।
মতুয়ারা সবে মিলি ভোজন করিল।।
নাম গানে মত্ত হ’য়ে নিশি পোহাইল।
প্রাতেঃ সবে জয়পুর গমন করিল।।
জয়পুর উত্তরিল সাধনার বাড়ী।
প্রেমে মত্ত সকলে করিছে দৌড়াদৌড়ি।।
কুন্দসী নিবাসী নাম দীননাথ পাল।
হরিনামে মত্ত হ’য়ে হ’য়েছে বেহাল।।
তার ছিল মহাব্যাধি নাসিকাগ্র ফুলা।
নাকের নীচে ফুলে বর্ণ হ’ল ধলা।।
মুখে চাকা চাকা দাগ রসপিত্ত দোষ।
ব্যাধিযুক্ত তার মনে সদা অসন্তোষ।।
তার নারী স্বপ্নে দেখে ব্যাধি হবে মাপ।
জয়পুরে তারকে ডাকিলে ধর্মবাপ।।
তারকে ডাকিল বাপ ব্যাধি সেরে গেল।
সেই হ’তে দীন পাল বড় ম’তো হ’ল।।
মানসিক ছিল তার মহোৎসব দিবে।
নিবেদিল পাগলের শ্রীপদ পল্লবে।।
গললগ্নীকৃতবাসে পাগলেরে কয়।
মহোৎসব দিতে হ’বে কুন্দসী আলয়।।
একখানি বাড়ী করিয়াছেন তারক।
দীনেপালে আছে সেই বাড়ীর রক্ষক।।
তারকের দাস আমি থাকি সেই ঠাই।
দয়া করি সেই বাড়ী চলুন গোঁসাই।।
তাহা শুনি পাগল চলিল সেই বাড়ী।
মতুয়ারা সবে ধায় করি দৌড়াদৌড়ি।।
মতুয়া একত্র দীননাথের বাটীতে।
কীর্তন করিছে সবে মহানন্দে মেতে।।
অক্ষয় ঠাকুর নাচে নাচে মহানন্দ।
মদন গোপাল হরি সবে মহানন্দ।।
তাহাদের পিছে পিছে নেচেছে তারক।
অই সে অদ্বৈত নাচে অন্তরে পুলক।।
নাচিতে নাচিতে মত্ত হ’ল দীনপাল।
ডেকে বলে পাগলের মুখ কেন লাল।।
হরি বলে হস্ত তুলে মুখ বিস্তারিল।
অমনি মুখেতে রক্ত উদ্গম হইল।।
তাহা দেখি সবে মিলে পাগলে ধরিল।
পাগলে মস্তকে করি নাচিতে লাগিল।।
মস্তকে থাকিয়া ক্ষণে ক্ষণে অঙ্গ ঝাঁকে।
ঝাঁকিতে হইয়া শূন্য চাঁদোয়ায় ঠেকে।।
শূন্য হ’তে পড়ে পুনঃ মাথার উপর।
এই ভাবে ছুটাছুটি করে বার বার।।
হরিপাল গিয়া শীঘ্র পাগলে ধরিল।
হরিপালের মস্তকে পাগল বসিল।।
লম্ফ দিয়া পাগল পড়িল ধরাতলে।
প্রেমাবেশে তথা হ’তে দৌড়াইয়া চলে।।
পিছে পিছে ধাইলেন অক্ষয় ঠাকুর।
হরিপাল কহে তবে যাও জয়পুর।।
তাহা শুনি দৌড়াইয়া চলিল তারক।
সঙ্গে সঙ্গে দৌড়িয়া যায় কত লোক।।
যতেক মতুয়া গণ চলিল ধাইয়া।
নামে গানে প্রেমে মত্ত নাচিয়া গাইয়া।।
দৌড়িয়া দৌড়িয়া কারু হ’ল ঘনশ্বাস।
মাধাই আবেশ হ’ল মদন বিশ্বাস।।
এক গোটা বাঁশ ধরি দক্ষিণ করেতে।
ভাঙ্গা এক হাঁড়ি ধরিলেন বাম হাতে।।
বলে হারে বেটা কোথা চলিলি ধাইয়া।
মাধারে ভাড়ায়ে কোথা যাবি পালাইয়া।।
কই তোর গোরা কই কই তোর নিতা।
কাঁধার আঘাতে তার ভেঙ্গে দিব মাথা।।
তাহা শুনি হরিপাল আগুয়ে দাঁড়ায়।
অই নিতা যায় বলি পাগলে দেখায়।।
তার সঙ্গে দেখাইল অক্ষয় ঠাকুরে।
অই সেই গোরা যায় কে ঠেকাবে ওরে।।
খাটিবে না জোর তোর নিতাইর ঠাই।
এসেছি আমরা তোর ভাঙ্গিব বড়াই।।
কামের কামনা মোরা করিয়াছি চূর্ণ।
পাপেরে তাড়িয়া দিনু না রাখিনু পুণ্য।।
আর কিরে মাধা তোর দস্যুত্ব রাখিব।
এই হরিনাম অস্ত্রে পাষণ্ড দলিব।।
জগৎ মাতাব বলি প্রতিজ্ঞা আছয়।
হইয়া জগৎ ছাড়া পালাবি কোথায়।।
মদন কহিছে ডেকে মাধাই আবেশে।
এত যদি দর্প তবে দাঁড়া কাছে এসে।।
দৌড়িলে দণ্ডিব তোরে দেখ দণ্ড হাতে।
দণ্ডের জীবন দণ্ড মাধার দণ্ডেতে।।
তাহা দেখি হরিপাল কহে পাগলেরে।
ঐ এল মদনা বেটা মাধারূপ ধ’রে।।
তাহা শুনি মহানন্দ ফিরিয়া দাঁড়ায়।
বলে মাধা হরি বল ধরি তোর পায়।।
মাধা বেশে মদনের অধরোষ্ঠ কম্প।
পাগলের সম্মুখে পড়িয়া দিল লম্ফ।।
দণ্ড ধরি এক বাড়ী পাগলকে হাকে।
হাঁড়ি ফেলাইয়া মারে পাগল মস্তকে।।
দণ্ড বাড়ী লাগিল না পাগলের গায়।
হাঁড়ির আঘাত লেগে হাঁড়ি ভেঙ্গে যায়।।
অক্ষয় ঠাকুর ধরে ভাঙ্গা হাঁড়ি কাঁধা।
লম্ফ দিয়া বলে তোর বাঁচা নাই মাধা।।
নিতাইয়ের অঙ্গে দণ্ড আহারে পাষণ্ড।
ছিণ্ডিব চক্রেতে তোর দু ভায়ের মুণ্ড।।
নিত্যানন্দ ভাবাবেশে কহে মহানন্দ।
চক্র ছাড়ি দে ওরে অক্ষয় প্রেমানন্দ।।
কোথা লাগে দণ্ড তোর হরি দণ্ডধারী।
ঘরে ঘরে মেগে খাবি প্রেমের ভিখারী।।
প্রেমাবেশে পিপাসে ধরিল আশা দণ্ড।
সেই দণ্ড তাহাও করিব আমি খণ্ড।।
তোর কি দণ্ডিতে হয় যেই তোরে দণ্ডে।
নামরস পশাও উহার মেরুদণ্ডে।।
সুধাখণ্ড দয়ারবি কর প্রকাশিত।
জ্ঞানান্যে হৃদয়াম্বুজে সিঞ্চ প্রেমামৃত।।
দাঁড়াল মদন মাধা যষ্ঠি দণ্ডবৎ।
নিম্নেতে দক্ষিণ হাত উর্দ্ধে বাম হাত।।
হস্তপদ টান লোম কেশ উর্দ্ধটান।
স্বেদ কম্প অশ্রু হর্ষ উত্তার নয়ন।।
তারকের হ’ল তথা জগাই আবেশ।
দন্তে ধরে এক গোছা তৃণ আর কেশ।।
লোটাইয়া প’ল গিয়া পাগলের পায়।
পাগল সে তৃণগাছি দন্তে ধ’রে লয়।।
উঠিয়া পাগল ধরে তারকের গলে।
তারক পড়িল মহানন্দ পদতলে।।
লোহাগড়া বাজার দক্ষিণে এই লীলে।
বন্দরের লোকে দেখে হরি হরি বলে।।
কলরব হরিবল বাজার ভিতরে।
দোকানে বাজারে বন্দরের ঘরে ঘরে।।
তথা হ’তে চলিলেন তারকের ঘাটে।
তারকের নারী এল নবগঙ্গা তটে।।
তারকের ছিল যে পিস্তত ভ্রাতৃবধূ।
দেখে সুখে পান করে লীলাচক্র মধু।।
পাগল আসিয়া দুই বধূকে ধরিল।
পাগলের দুই পার্শ্বে দু’জন রহিল।।
দুইজনে পাগলে ধরিল সাপটিয়া।
পাগল দোঁহার স্কন্ধে দুই বাহু দিয়া।।
উতরিল তিনজনে তারকের বাড়ী।
তিনজনে একত্রে প্রাঙ্গণে রহে পড়ি।।
তাহা দেখি কীর্তনের লোক যত ছিল।
তারকের বাড়ী গিয়া কীর্তনে মাতিল।।
তিনজনে মধ্যে রাখি চৌদিকে ঘেরিয়া।
সংকীর্তন করে সবে ফিরিয়া ঘুরিয়া।।
ক্ষণে ক্ষণে ঘুরে যেন কুম্ভকার চাক।
উৎকলের কীর্তন যেমন বেড়াপাক।।
মধ্যেতে পাগলচাঁদ পড়িল ঢলিয়া।
দুই নারী পাগলের চরণ ধরিয়া।।
মাথার নাহিক বাস প্রেম উপলক্ষে।
ঘন ঘন কম্পে গাত্র বারিধারা চক্ষে।।
পাড়ার যতেক নারী আসিয়া অমনি।
কেহ হরিধ্বনি কেহ দেয় হুলুধ্বনি।।
কোন কোন নাগরী কীর্তন শুনে কাঁদে।
কোন নারী জল ঢালে সংকীর্তন মধ্যে।।
সেই জল কীর্তন মাঝারে হয় কাদা।
যেন সুরধনী ধারা প্রবাহিতা সদা।।
ক্রমে জল শুকাইয়া হয় গুড়া গোলা।
পুনঃ পুনঃ গগন মণ্ডলে উড়ে ধুলা।।
এইরূপ কীর্তন হইল বহুক্ষণ।
তারক ধরিল দুই বধূর চরণ।।
কাঁদিয়া কহেন মোর সার্থক জীবন।
আমি ধন্য হইলাম তোদের কারণ।।
প্রভু মহানন্দ ল’য়ে আনন্দ করিলি।
হরিচাঁদ প্রেম নীরে আমারে ভাসালি।।
অই ঠাই বসে শান্ত হইল সকল।
তথা বসি খাইল চাউল আর জল।।
গলে বস্ত্র করজোড়ে পাগলেরে কয়।
কুন্দসীর মহোৎসব নিরুৎসব ময়।।
তোমাবিনে নাহি হয় কোন মহোৎসব।
তব সঙ্গে এখানে আছে মহোৎসব।।
শুনিয়া পাগল শীঘ্র শীঘ্র যাত্রা কৈল।
পূর্বঘাটে এসে সবে জলেতে নামিল।।
কেহ কেহ ভেসে যায় কুন্দসীর ঘাটে।
দীননাথ পালের বাটীতে গিয়া উঠে।।
কেহ কেহ উঠে লোহাগাড়ার ঘাটেতে।।
সিক্ত বস্ত্রে যায় দীন পালের বাটীতে।।
দীননাথ বাটী হ’ল সাধুসেবা সব।
এইরূপ মহানন্দে আনন্দ উৎসব।।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত সুধাধিক সুধা।
তারক যাচিছে হেতু রসনার ক্ষুধা।।
স্বামী মহানন্দের ভক্তাশ্রমে ভ্রমণ।
পয়ার
বিকালে করিল যাত্রা কুন্দসী হইতে।
দীঘলিয়া আসিলেন সন্ধ্যার পরেতে।।
কেহ কেহ র’ল বেণী পালের আলয়।
যজ্ঞেশ্বর বাটীতে কেহ গিয়া রয়।।
বলাইর ভগ্নী লক্ষ্মী সাধনার শিষ্য।
সেই ঘরে কতক থাকিল হ’য়ে হর্ষ।।
কতক থাকিল ভীম বলাইর বাড়ী।
কতক থাকিল গিয়া গ্রাম আড়াবাড়ী।।
সেই খানে রাত্রিভোর নাম গান গেয়ে।
প্রভাতে করিল যাত্রা শ্রীহরি স্মরিয়ে।।
ঘসিবেড়ে গ্রামে ভাগ্যধর পাল ছিল।
তার বাড়ী কতক আসিয়া উতরিল।।
গোপীনাথ সাহা ছিল মতুয়া প্রেমিক।
ভাগ্যধর গুরু ভাবে বাসে প্রাণাধিক।।
সেই বাড়ী কেহ থাকে কেহ আর বাড়ী।
অষ্টাদশ ঘর পাল সব বাড়ী জুড়ি।।
সব বাড়ী বাড়ী বাল্য সেবা হইতেছে।
সব বাড়ী স্ত্রী পুরুষ নামে মাতিয়াছে।।
মাধ্যাহ্নিক সেবা দিল নামে বাবু রাম।
বিকালে সকলে পহুঁছিল শুক্তা গ্রাম।।
গোলোকচাঁদের বাটী হ’ল মহোৎসব।
সেই বাড়ী মহোৎসব করিতেছে সব।।
শুক্তাগ্রামে গোলোক পালের এক কন্যে।
দিলেন কতক ব্যয় মহোৎসব জন্যে।।
সে বাড়ীতে রাত্রি হ’ল নাম সংকীর্তন।
মহাভাবে মেতে হ’ল নিশি জাগরণ।।
দ্বিপ্রহর রাত্রে সব ভোজন করিল।
রাত্রি ভোর পুনশ্চ কীর্তন আরম্ভিল।।
হইতেছে নর্তন কীর্তন অতিশয়।
প্রেমে মেতে হইয়াছে জ্ঞানশূন্য প্রায়।।
পদ গায় প্রাণ হ’রে নিল নিল নিল।
আসিয়া অক্রুর মুনি প্রাণ হরে নিল।।
রে অক্রুর রথ রাখ হেরি কেলেসোনা।
পায় ধরি পদে পড়ি যত ব্রজাঙ্গনা।।
গান গায় বসে পালেঙ্গার চাক ঘরে।
কেহ চাক ঘুরায় কেহ বা টেনে ধরে।।
বৈশাখে পালের চাক কভু নাহি ঘুরে।
বেড়া হেলানেতে ছিলে ঘরের ভিতরে।।
এক ঠাই ছিল সেই চাক তিনখানা।
কীর্তন সময় দৃষ্টি করে কয় জনা।।
চক্র দেখে হ’ল ব্রজ ভাব উদ্দীপন।
বিস্মিত মূর্ছিত কেহ গায় আর জন।।
চণ্ডী গোস্বামীর পদ গায় কোন জনা।
রাখ রাখ অক্রুর নিওনা কেলেসোনা।।
যখন গায় অক্রুর প্রাণ নিল নিল।
প্রেমাবেশে কেহ কুম্ভ চক্রটি ধরিল।।
চাক দিয়া পাক দিল আলের উপরে।
রাখ রাখ বলি কেহ চাক টেনে ধরে।।
তাহা দেখি ঘূর্ণপাক পাগল ধরিল।
নিওনা বলিয়া চাকে মাথা পেতে দিল।।
মাথায় তুলিল চাক প্রেমেতে বিহ্বল।
অষ্টধারে বহিল যুগল চক্ষে জল।।
সে চাক চতুঃপার্শ্বে মস্তকে রাখিয়ে।
ঘুরাতে লাগিল চাক জড়াজড়ি হ’য়ে।।
এইরূপে ধরিলেন আর দুই চাক।
সবে বলে ওরে রথী রথ রাখ রাখ।।
হা কৃষ্ণ বলিয়া কেহ পড়িল ধরায়।
মূর্ছিত হইল কেহ চাকের নীচায়।।
পাগলের শির গিয়া ঠেকিয়াছে চাকে।
মাটি দিয়া ধুমা উঠে দেখে সব লোকে।।
তাহা দেখি সব লোক পড়িল হুতাশে।
চমকিত হ’য়ে বলে ধুমা উঠে কিসে।।
চাকা ধরি পালেরা লইল পালেঙ্গায়।
মূর্ছাপ্রাপ্ত যারা তাহাদের ধরে লয়।।
সবে দেখে পাগল পড়িয়া ধরণীতে।
ধুম্র উঠিতেছে পাগলের অঙ্গ হ’তে।।
বাড়ীপরে পালেঙ্গা পশ্চিমের পোতায়।
সেই ঘরে যাদব পাগলে ধরি লয়।।
সনাতন নবীন বসু ছিলেন তথায়।
তাহারা পাগলে ধরিলেন সে সময়।।
ধুমা কেন উঠিতেছে পাগলের গায়।
দাহ হ’য়ে পাছে বা পাগল মারা যায়।।
তোরা সব থাকরে উপায় আর নাই।
দক্ষিণ পালেঙ্গাতে পাগলে ল’য়ে যাই।।
পাগলে তদ্রূপ দেখি সবার হুতাশ।
সেই ঘরে ল’য়ে যেতে করি অভিলাষ।।
এতশুনি সর্বজনে পাগলে তুলিল।
দক্ষিণ পালেঙ্গা ঘরে ধরিয়া লইল।।
অনর্গল ধুমা উঠে পাগলের গায়।
লোমকূপে ধুমা উঠে ছিদ্র কণ্ডু প্রায়।।
লোমকূপে ছিদ্র সব বিকশিত হ’য়ে।
ধুমা উঠিতেছে শূন্যে বেগেতে ধাইয়ে।।
ক্ষণে ধুমা উঠে হয় অন্ধকারময়।
ক্ষণে পাগলের অঙ্গ লক্ষ্য নাহি হয়।।
লোম উর্দ্ধ কেশ উর্দ্ধ নেত্র উর্দ্ধ শ্বাস।
ন ভূত, ন ভবিষ্যতি, ভাব অপ্রকাশ।।
মুখমধ্যে রক্তিম বরণ যায় দেখা।
মুখের উপরে উঠে অনলের শিখা।।
ঘরের মধ্যেতে আর ঘরের চৌদিকে।
হরি হরি হরি বলে নাচে গায় লোকে।।
পাগল বৈবর্ণ অঙ্গ ধুম্র সম্বরিল।
আস্তে ব্যাস্তে ত্রস্তে পাগলেরে কোলে নিল।।
তৈল মেখে পাগলেরে করাইল স্নান।
করা হ’ল সকলের সেবার বিধান।।
যবে পাগলের হ’ল সম্বিত বিধান।
সবে মৃতদেহে যেন পুনঃ পেল প্রাণ।।
প্রেমময় পাগলের অলৌকিক কাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
পাগলের চাপলিয়া গ্রামে যাত্রা।
পয়ার
নামেতে কাঙ্গালী পাল সাধু শুদ্ধ মতি।
চিরদিন শুক্তাগ্রামে করেন বসতি।।
বিকালে তাহার বাটী হ’ল মহোৎসব।
রহিলেন সেই বাড়ী মতুয়ারা সব।।
সেই বেলা ভরি হ’ল নাম সংকীর্তন।
অর্ধ নিশি পর্যন্ত নাহিক নিবারণ।।
সবে ক্ষান্ত প্রেম শান্ত সংকীর্তন সায়।
সব সাধু ভোজন হইল সে সময়।।
প্রাতেঃ উঠি চলিলেন চাপলিয়া গ্রাম।
সেই গ্রামে সাধু অতি শুকচাঁদ নাম।।
সেই বাড়ী যাত্রা কৈল নাম প্রেমাবেশে।
মতুয়ারা মাতোয়ারা নাচে কাঁদে হাসে।।
সেই শুক্রাগ্রামে একজন দ্বিজ ছিল।
সংকীর্তনকালে বড় তর্ক আরম্ভিল।।
পাগল ছিলেন বসি পালেঙ্গার ঘরে।
শ্রীনবীন বসু গিয়া কহে পাগলেরে।।
এক বেটা ব্রাহ্মণ এসেছে এ বাটীতে।
কুতর্ক করেছে সেই কীর্তন স্থানেতে।।
তাহা শুনি পাগল হইল ধাবমান।
সংকীর্তন মাঝে স্বামী মহানন্দ যান।।
অমনি বহিল বন্যা কীর্তন প্রাঙ্গণে।
ঝঞ্ঝাবাত যেমন বহিল রম্ভাবনে।।
যে স্থলে যে ছিল কারু আর বাক্য নাই।
হরি বলে গড়াগড়ি দিতেছে সবাই।।
সেই বিপ্র হ’য়ে ক্ষিপ্র গড়াগড়ি যায়।
উন্মত্ত হইয়া পড়ে পাগলের পায়।।
পাগলে আগুলে দ্বিজ রাখিতে না পারে।
জড়াইয়া ধরিলেন অক্ষয় ঠাকুরে।।
দুই দ্বিজ জড়াজড়ি গড়াগড়ি যায়।
দৌড় দিয়া কীর্তন ছাড়িয়া বাহিরায়।।
কদর্য উচ্ছিষ্ট স্থান নামেতে আদাড়।
গড়াগড়ি যায় বিপ্র তাহার উপর।।
সেই কথা পথে এসে হ’ল আন্দোলন।
কি মাহাত্ম্য পাগলের চরণে ব্রাহ্মণ।।
মদন বিশ্বাস পূর্ণচন্দ্র অধিকারী।
দোঁহে করে আন্দোলন ন্যায় পথ ধরি।।
আগে করে কুতর্ক জাতির কথা কয়।
সে জাতিতে এসে শেষে চরণে লোটায়।।
তারক বলিল অই দেমাকী ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণ রূপেতে ওরা শুক্রাচার্যগণ।।
গ্রন্থে বলে চাঁদকাজী নোয়াইল মাথা।
এত হিন্দু ব্রাহ্মণ লুকা’য়ে যা’বে কোথা।।
বলিতে বলিতে প্রেম আবেশ তখন।
গান ধরি দিল কোথা পালাবি যবন।।
শ্রীগৌরাঙ্গ এল সেজে আয় কাজী আয়।
কা’ল ভেঙ্গেছি খোল আজ যাবি কোথায়।।
সবে মিলে গায় বোল অঙ্গে উঠে কম্প।
কোথা যাবি বলিয়া কেহ বা মারে লম্ফ।।
কেহ কেহ বীর দর্প যষ্ঠি ঘুরাইয়া।
কেহ করে বীরদর্প যষ্ঠি দেখাইয়া।।
বাবরা গ্রামেতে যত বসতি যবন।
অই রূপ ভাব তারা করি দরশন।।
বাড়ীর বাহিরে মাঠে ঘাটে ছিল যারা।
বাড়ীর মধ্যেতে গিয়া পলাইল তারা।।
তিন মিয়া এসে ধেয়ে আগুলিল পথে।
সবিনয় বলে মোর বাড়ী হবে যেতে।।
মতুয়ারা বলে যদি বল হরিবোল।
তবে তোমাদের বাড়ী যাইব সকল।।
তাহা শুনি তিন মিয়া বলে হরিবোল।
দৌড়ে গিয়া পাগল তাদের দিল কোল।।
পাগলে লইয়া গেল বাড়ীর ভিতর।
পাড়ার মিয়ারা যত হ’ল একত্তর।।
বাড়ীর উপরে গিয়া ঘুরিছে পাগল।
তাহা দেখি মিয়ারা বলিছে হরিবোল।।
তাহা দেখি মতুয়ারা সেইভাবে মেতে।
হরি বলে নাচিতে লাগিল নানা মতে।।
লাফাইয়া উঠিলেন বাড়ীর উপর।
মতুয়ারা মিয়ারা হইল একতর।।
বিবি সাহেবেরা সবে এল দেখিবারে।
তাহারাও সঙ্গে সঙ্গে হরিনাম করে।।
কে কারে কি করে কেহ বুঝিতে না পারে।
বড় ভীড় গোলমাল বাড়ীর উপরে।।
হাঁক দিয়া পাগল আইলেন বাহিরে।
জয় হরি গৌরহরি বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
শেষে আর যত সাধু বাড়ীপরে ছিল।
কিছুক্ষণ পরে সবে বাহির হইল।।
একতর মতুয়ারা হইল সকল।
শুনিতেছে মিয়া বাড়ী হরি হরি বোল।।
কিছুকাল পরে তাহা হ’ল সম্বরণ।
পুনরায় মতুয়ারা জুড়িল কীর্তন।।
গীত
আমার গৌরাঙ্গ এল সেজে আয়রে কাজী আয়
কাজী আয় কাজী আয় কাজী আয় কাজী আয়
কা’ল ভেঙ্গেছিস খোল করতাল
আইজ যাবি কোথায়।।
আমরা ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব মানিনে
তুই লাগিস কোথায়।।
পয়ার
গাইতে গাইতে পদ যায় চাপলিয়ে।
জ্ঞান হয় যেন যায় ভূমিকম্প হ’য়ে।।
চাপলিয়া গ্রামবাসী যত লোক ছিল।
শুকচাঁদ মণ্ডলের বাড়ীতে আসিল।।
স্ত্রী পুরুষ বাল্য বৃদ্ধ বারো আনা প্রায়।
গ্রামের যতেক হিন্দু আইল তথায়।।
এ দিকে মতুয়া চলে দুই ভাগ হ’য়ে।
এক ভাগ বাড়ীপর উঠিলেন গিয়ে।।
বাড়ীর উপরে গিয়া বলে হরি বোল।
প্রেমানন্দে মহানন্দ নাচিছে কেবল।।
মতুয়ারা যত ছিল বাড়ীর উপরে।
তাদের পাগল বলে তাড়া উহাদেরে।।
বাড়ীর নীচায় যারা করে হই হই।
উঠিতে পারে না যেন সবাকারে কই।।
গ্রামবাসী যারা বাড়ী পরে হরি বলে।
সবলোকে মহানন্দ তাড়াইয়া দিলে।।
হাঁড়ি কাঁধা ইটা চেঙ্গা আনিয়া সত্বর।
বলে তোরা ইহাদিকে ইহা ফেলে মা’র।।
কোনমতে ইহাদিকে উঠিতে না দিবি।
ওরা যদি বাড়ী ওঠে তোরা মা’র খাবি।।
পূর্ণচন্দ্র অধিকারী উঠিল অগ্রেতে।
দুই চারি ঢিলা ঘায় নামিল নিম্নেতে।।
পাগল কহিছে না উঠিস বাড়ীপর।
কি করিবি তোদেরে বা কেটা করে ডর।।
প্রাণ ভয় থাকে যদি প্রাণ লয়ে পালা।
এদেশেতে খাটিবে না হই হই বলা।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক সে পদুমা নিবাসী।
বাড়ীর নিকটে সেও উত্তরিল আসি।।
সে পূর্ণ অধিকারীর করেতে ধরিয়া।
বাড়ীর উপরে পড়ে এক লম্ফ দিয়া।।
ত্রেতা যুগ হ’তে যেন আইল বানর।
তেমনি লাফিয়া পড়ে বাড়ীর ভিতর।।
শ্রীহরিপাল তারক অক্ষয় ঠাকুর।
বাড়ী প’রে বলে নেড়ে যাবি কতদূর।।
মারামারি দেখি মার খাইতে এলাম।
মরি যদি ফিরিব না দিব হরিনাম।।
ঘরে পরে করে ধ’রে হরিনাম দিব।
শ্রীহরিচাঁদের প্রেম ফিরায়ে কি নিব।।
ঝাঁকে পড়ে কাঁধা চাড়া চেঙ্গা আর ইট।
মার মার বলিয়া পাতিয়া দিল পিঠ।।
দুই দিকে নাচিছে পাগল মহানন্দ।
মার মার মার বলি পরম আনন্দ।।
বাড়ীর উপরে এল মার মার মার।
ভয় নাই যারে পাই তারে ধরি মার।।
মার মার কোথাকার ছার হরিবোলা।
হরিবোলা মারিয়া হ’বরে হরিবোলা।।
হরিবোলারা উঠিল বাড়ীর উপর।
মেশামেশি দুই দলে হ’ল একত্তর।।
আর মারামারি নাই নাই গণ্ডগোল।
এ দলে ও দলে মিলে বলে হরিবোল।।
যাদব মল্লিক বলে জয় জয় জয়।
হরিচাঁদ জয় শ্রীগোলোকচাঁদ জয়।।
গুরুচাঁদ জয় জয় জয় হীরামন।
জয় জয় হরিচাঁদ পতিত পাবন।।
জয় জয় দশরথ ভক্তগণ জয়।
জয় যত হরিবোলা জয় মৃত্যুঞ্জয়।।
হরি বলে পড়ে ঢলে যাদব মল্লিক।
মতুয়ারা মাতোয়ারা নাই দিগ্বিদিক।।
কোলাকুলি ঢলাঢলি প্রেম আলিঙ্গন।
কেহ কেহ যায় মোহ ধুলায় পতন।।
ধুলায় ধূসর কেহ যায় গড়াগড়ি।
লম্ফ ঝম্ফ গাত্র কম্প প্রেমে হুড়াহুড়ি।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক পড়িয়া ভূমিতলে।
পাগলের পদ ধরি হরি হরি বলে।।
সংকীর্তন মধ্য হ’তে পাগল উঠিল।
লম্ফ দিয়া পশ্চিমের ঘরে প্রবেশিল।।
শান্ত নামে এক কন্যা মত্তা হরিনামে।
সতী সাধ্বী সুচরিত্রা শুদ্ধা ভক্তি প্রেমে।।
পাগলের প্রতি তার দৃঢ় ভক্তি রয়।
চারি ভাই তাহাদের নির্মল হৃদয়।।
নিবারণ শীতল কার্ত্তিক রতিকান্ত।
সাধু মহাজন প্রতি ভকতি একান্ত।।
তারকের শিষ্যপুত্রী সুমতী শ্রীমতী।
পাগলকে ধরিলেন সেই গুণবতী।।
শুকচাঁদ কানাই নিমায় কয় ভাই।
নাচিছে কীর্তনে আনন্দের সীমা নাই।।
তাহাদের ভগ্নী ধনী বসন্ত নামিনী।
হরি বলে পাগলে ধরিল সেই ধনী।।
পাগল তখনে দুই বাহু প্রসারিয়া।
সেই দুই মেয়েকে ধরিল সাপুটিয়া।।
অজ্ঞান হইয়া দোঁহে ঢলিয়া পড়িল।
যেন ভাদ্রে বান ডেকে ভাসাইয়া নিল।।
পূর্ণ অধিকারী হরিপাল পড়ে তথি।
মূর্ছা প্রাপ্তে পড়িল অক্ষয় চক্রবর্তী।।
কে কারে কি করে পড়ে কেবা কার গায়।
কি সুখ বাড়িল শুকচাঁদের আলয়।।
মদন বিশ্বাস এক পদ ধরি এল।
নিল প্রাণ নিলরে গৌরাঙ্গরূপে নিল।।
গৌরাঙ্গ দাঁড়ায়ে অই সুরধনী কূলে।
চল গো সজনী চল যাই গো সকলে।।
জল আনা ছল করি চল ন’দে বাসী।
জল আনা ছলেতে গৌরাঙ্গ দেখে আসি।।
এতেক বলিয়া কক্ষে লইল কলসী।
চল গিয়া গৌরাঙ্গ চরণে হই দাসী।।
সবে মিলে হ’ল যেন উন্মত্ত পাগল।
নর নারী বাল্য বৃদ্ধ বলে হরি বোল।।
কেহ কেহ উঠে গিয়া বসিল গৃহেতে।
কেহ নৃত্য করে অন্তঃপুর প্রাঙ্গণেতে।।
প্রেমাবেশে বাল্য বৃদ্ধ যুবা নর নারী।
সবে মিলে অম্লান অন্তরে ধরাধরি।।
স্ত্রী পুরুষ ধাবমান হ’ল একত্রেতে।
এক এক জন পাত্র লইল কক্ষেতে।।
কেহ ধায় এলোকেশে কেহ ঘোমটা টানে।
পুরুষে ঘোমটা দেয় কোঁচার বসনে।।
দুপুরের মধ্যেতে কেহ হ’তে নারে স্থির।
বাহির বাটীতে সব হইল বাহির।।
মতুয়ারা রামাগণে ধরিয়া ধরিয়া।
বাড়ীর উপরে সবে রাখে ঠেকাইয়া।।
কতক মতুয়াগণ বাড়ীদিকে ধায়।
নিবারণ শীতলের বাটীতে উদয়।।
কেহ কয় গঙ্গাতীরে উদয় অরুণ।
কেহ কয় অরুণের চরণে বরুণ।।
কেহ কয় তবে জল নিতে হ’ল ভাল।
গৌরাঙ্গ অরুণ পদে বরুণ পড়িল।।
তরুণ অরুণ সঙ্গে চন্দ্র যোগাযোগ।
কেহ বলে এই সেই পুস্পবন্ত যোগ।।
কেহ বলে তার মধ্যে গঙ্গা সুরধনী।
কেহ বলে এই যোগ যোগ চূড়ামণি।।
কেহ বলে ভাসিয়া গেলাম অশ্রুজলে।
কেহ বলে দেখা কি পাইব গঙ্গাকূলে।।
কেহ বলে নাহি পেলে জাহ্নবীর কূলে।
কেহ বলে তবে দাসী হইবি কি ছলে।।
কেহ কেহ তুলে নিজ কক্ষেতে কলসী।
কেহ বলে হইব গৌরাঙ্গপদে দাসী।।
কেহ পিত্তলিয়া কুম্ভ করিয়াছে কক্ষে।
কেহ নাচে মেটে কুম্ভ ক্ষপরে রেখে।।
কেহ বাহিরের কুম্ভ পূর্ণ কিংবা খালি।
কেহ তার একটা লইল কক্ষে তুলি।।
কেহ বলে ক্ষান্ত না করিও সংকীর্তন।
কেহ বলে ধর ওই গৌরাঙ্গ চরণ।।
কেহ নাচিয়া গাইয়া চলেছে কাঁদিয়া।
কেহ কার গায় পড়ে হেলিয়া দুলিয়া।।
কেহ যায় স্নানে কালীগঙ্গা মরানদী।
কেহ সেই ঘাটে গিয়া করে কাঁদাকাঁদি।।
কেহ কেহ বলিতে সকলে ঘাটে গেল।
কেহ বলে কে গো এই বর্ণ যেন কালো।।
কেহ বলে গোরা ছবি প্রাতঃ রবি প্রায়।
কেহ বলে কালশশী তাতে মিশি রয়।।
কেহ বলে কাল গৌর মাঝেতে দাঁড়ায়।
কেহ কেহ বলে অই বাঁশী করে লয়।।
কেহ বলে কাল গোরারূপ জলের ছায়ায়।
কনক কমল কাল কমলে উদয়।।
কাল জলে কাল জ্বলে দেখ গো কেমন।
নিলাজ হেমাব্জ মাঝে হ’য়েছে মিলন।।
জলে জ্বলে জলদধ দেখে সখীগণ।
জলে যাই হেরি রাই শ্যামের মিলন।।
একা আমি আমি তোরা না নামিস কেউ।
দেখ রূপ জ্বলে জলে দিওনা লো ঢেউ।।
একা আমি ধরে আমি শ্যাম জলধর।
নামিলে হারাবি জলে পাবি না অধর।।
আমি ধরি বলে জলে নামিল সকল।
বলে কই রাই কই সে নীলকমল।।
জলে নামি করে সবে শ্যাম অন্বেষণ।
ডুব দিয়া মহানন্দে করে দরশন।।
কেহ বলে রাই শ্যাম করে জলকেলি।
জলে নামি করে সবে জল ফেলাফেলি।।
কেহ বলে গঙ্গাজল সেচে দিব ফেলে।
জলধর লুকায়েছে কালীগঙ্গা জলে।।
কেহ বলে আর কত কাঁদিবি আকুলে।
কেহ বলে জলে জ্বলে চল যাই কূলে।।
কেহ বলে কুল গেল বিরজার কুলে।
কেহ বলে কুল কালা কাজ কি গো কুলে।।
কেহ বলে কুলে জ্বেলে দিয়াছি অনল।
কেহ বলে জল ঢেলে কর গো শীতল।।
কেহ বলে ভাসা কুল কুলে দিয়া জল।
কেহ বলে কুল সাথে যা’বে কার বল।।
কেহ বলে কুল ধুয়ে খাবি নাকি জল।
কেহ বলে কুল যাক কূলে যাই চল।।
এতেক বলিয়া সবে চলিলেন বেগে।
হরিপাল অক্ষয় ঠাকুর চলে আগে।।
জয় হরিধ্বনি করে যত রামাগণে।
তীরে এসে হুলুধ্বনি দিল সর্বজনে।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক ধেয়েছে পাছে পাছে।
গাছবাড়িয়ার রামধন চন্দ্র নাচে।।
মদন বিশ্বাস বলে চল চুপে চুপে।
টের পেলে গুরুজন উঠিবেন ক্ষেপে।।
এরূপেতে অপরূপ প্রেমের তরঙ্গ।
পাগল সাঁতারে প্রেম সংকীর্তন ভঙ্গ।।
স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ হইলেন সব।
নিবারণ বাটী হ’ল চিঁড়া মহোৎসব।।
অন্নভোজ করে সবে শুকচাঁদ বাড়ী।
পাগলে ধরিল শুকচাঁদের মা বুড়ি।।
অক্ষয় ঠাকুর আর পাগলকে ল’য়ে।
দুজনকে ভুঞ্জাইল কোলে বসাইয়ে।।
পশ্চিমের ঘরে সবে বসিয়া নিভৃতে।
তারকে ডাকিয়া আনাইল নিকটেতে।।
অক্ষয় ঠাকুরে করাইতে উপদিষ্ট।
বলিলেন তারকেরে তুমি হও ইষ্ট।।
তারক কহেন ইহা আমি নাহি পারি।
উপদিষ্ট হউন ব্রাহ্মণ এক ধরি।।
অক্ষয় কাঁদিয়া কহে ব্রাহ্মণে কি কাজ।
অংশ অবতার তুমি ইষ্ট দ্বিজরাজ।।
আমি যার পিপাসিত তাই যদি পাই।
যার ঠাই পাই তাই নিব তার ঠাই।।
মোর প্রশ্নোত্তর দেন সব মহারথী।
গুরু কোন জাতি হয় মন্ত্র কোন জাতি।।
শুকদেব হাঁড়ির নিকটে মন্ত্র নিল।
শুকপাখী ছানা তবু বিপ্র আখ্যা পেল।।
পাগল তারকে কহে হরি সহকারী।
পারিবা না এই কার্য যদি আজ্ঞা করি।।
পাগল কহেন আজ্ঞা দিলাম তোমায়।
তারক কহিল অসম্ভব কিছু নয়।।
কর্ণমূলে মহামন্ত্র করিলেন দান।
পাইয়া চিন্ময়ী শক্তি হ’ল শক্তিমান।।
প্রেমানন্দে ঢলাঢলি হইল সকল।
জয়ধ্বনি করি সবে বলে হরিবোল।।
স্বীয় স্বীয় স্থানে সব গমন করিল।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত তারক রচিল।।