মতুয়া দর্শন
শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ
মতুয়া মত সত্য পথ

দ্বিতীয় অংশ

ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু
চারিদিকে ভক্তগণ মাঝে হরিচাঁদ।
তারা গণ্য মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।।
এইভাবে বসে আছে হরি দয়াময়।
হেন কালে শ্রী তারক আসিল তথায়।।
তারকেরে ডাক দিয়া কহিল তখন।
শুন শুন শুন বাছা আমার বচন।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
আমি আসিয়াছি তাই জানাতে সবারে।।
লয়ে নারী ব্রহ্মচারী সত্য কথা কবে।
আমার যুগ ধর্ম পালন করিবে।।
বিবাহ কর হে বাছা গৃহস্থ সাজিয়া।
গৃহ কর্ম শ্রেষ্ঠ হয় দেখরে ভাবিয়া।।
তারক বলিছে প্রভু বিয়া না করিব।
বিবাহ করিলে আমি পাশ বদ্ধ হব।।
নারী লোভে অর্থ লোভে কামাসক্ত হয়ে।
নষ্ট হবে জীবন তোমাকে ভুলিয়ে।।
তারকের কথা শুনে বলে দয়াময়।
বিবাহ করিলে বাছা আমার কথায়।।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি বলি তাই।
আমাকে পাইবি তোর কোন চিন্তা নাই।।
তারক বলেছে মোরা টাকা কড়ি নাই।
কেনা বেচা করে হাটে সংসার চালাই।।
ঠাকুর বলেছে বাচা মন ঠিক চাই।
আমি দিব সব টাকা কোন চিন্তা নাই।।
সূর্য্য নারায়ণ আর সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
দুজনারে ডাক দিয়া হরিচাঁদ কয়।।
তোমরা দুজনে যাও ভাগুড়া গ্রামেতে।
(লাইন জ্ঞাপ হয়ে গেছে)
তাই শুনে কয়জনে করিল গমন।।
বিয়ে দিল তারকের ঠাকুরের মতে।
চিন্তামণি নামে কন্যা হল তার সাথে।।
সে সব বৃত্তান্ত লীলামৃত লেখা আছে।
নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।।
এই ভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
দাম্পত্য জীবনে তারা অতি সুখি হল।।
ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়।
দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে মন বুঝে লয়।।
একদিন সে তারক ভাবে মনে মন।
টাকা কড়ি হাতে নাই কি করি এখন।।
গৃহেতে তণ্ডুল নাস্তি মনেতে জানিয়া।
কি করিবে কোথা যাবে, না পায় ভাবিয়া।।
মনে মনে সে তারক ভাবিল হৃদয়।
বাকি মাছ কিনে লভ্য হইবে নিশ্চয়।।
লোহাগড়া হাটে যায় ঝাকা ডালা লয়ে।
মাছ কিনে বেচিবে সে কাটিয়ে কাটিয়ে।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
উপনীত হইল গিয়ে মাছ হাটেতে।।
এক দোকানেতে দেখে বড় এক মাছ।
তাই দেখে মনে মনে ভাবে রসরাজ।।
বড় এক রুই মাছ দেখিয়া নয়নে।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা জাগে তার মনে।।
মনে মনে ভাবিতেছে কবি রসরাজ।
হরি যদি খাইতেন এই রুই মাছ।।
মনে বাসনা মোর হইতো সফল।
ভাবনার সাথে সাথে ঝরে আখি জল।।
যাহার দোকানে এই রুই মাছ ছিল।
তাহার পিছনে গিয়া তারক দাড়াইল।।
সে মাছের খরিদ্দার ছিল বহু জন।
নয় শিকা মূল্য তারা কহিল তখন।।
তারক তথন গিয়ে দাড়াইল পাশে।
সে মাছের খরিদ্দার কেহ নাহি আসে।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
মাছের দোকান দার তারকেরে কয়।।
মাছ তুমি নিবে নাকি শুন ওরে ভাই।
তারক বলেছে মোর কাছে টাকা নাই।।
বাকি যদি দাও ভাই তবে নিতে পারি।
হাট শেষে দিব টাকা মাছ বিক্রি করি।।
তাই শুনে সে বেচারা কহিল তখন।
মাছ বেচে দিও টাকা সময় মতন।।
তারক বলেছে তুমি কত মূল্য লবে।
সে বলেছে তুমি নিলে পাঁচ শিকা দিবে।।
তখনি তারক চন্দ্র সেই মাছে নিয়ে।
বটি দিয়ে অর্ধ অংশ ফেলিল কাটিয়ে।।
মাথা সহ সেই ভাগ ঝাকা মধ্যে রাখি।
সাবধানে রাখিলেন ডালা দিয়ে ঢাকি।।
বাকি অংশ কেটে কেটে ভাগ সাজাইল।
এমন সময় এক খরিদ্দার এল।।
সে বলেছে আমি তব সব মাছ লব।
এক কথা বল তুমি কত মূল্য দিব।।
তারক বলেছে যদি সব মাছ নিবে।
মাছের মূল্য মোরে পাঁচ শিকা দিবে।।
তাহা শুনি খরিদ্দার পাঁচ শিকা দিয়ে।
বিদায় হইল তিনি সেই মাছ নিয়ে।।
এমন সময় এল পূর্ব মহাজন।
তারকেরে ডেকে বলে মধুর বচন।।
শুন শুন তারক মোর দাম দাও।
আমি এবে ঘরে যাব দেনা শোধ হও।।
অমনি তারক চন্দ্র পাঁচ শিকা দিল।
মূল্য লয়ে সে বেচারা বিদায় হইল।।
অমনি তারক চন্দ্র ভাবিতে লাগিল।
হরিচাঁদ ছবি খানি মনেতে জাগিল।।
প্রেমে পুলকিত চিত্ত কবি রসরাজ।
মনে ভাবে এই বুঝি ঠাকুরের কাজ।।
ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু হরি দয়াময়।
জানিয়া ভক্তের মন খেলা খেলায়।।
আনন্দেতে আত্মহারা ভাবেতে বিভোলা।
মস্তকে করিল সে, সে মাছের ডালা।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
প্রেমে গদ গদ চিত্তে লাগিল হাটিতে।।
চলেছেন রসরাজ ওড়াকান্দি পথে।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি কেহ নাই সাথে।।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে।
প্রেমে পুলকিত চিত্ত চলেছেন পথে।।
মনে ভাবে ওগো প্রভু তুমি দয়াময়।
কামনার ফল তুমি দিয়েছ আমায়।।
দয়া করে নিও প্রভু তোমার নিকটে।
হেন কালে উপনীত তারাইল ঘাটে।।
মধুমতি নদী তাহে খরস্রোত বয়।
খেয়াঘাটে খেয়া নাই কি হবে উপায়।।
রাত্রি কালে খেয়া নৌকা এপারে না থাকে।
সন্ধ্যা হলে নৌকা খানি পারেতে রাখে।।
পূর্ব পারে পাটনীর বাড়ী ঘর ছিল।
খেয়া তরী ঘাটে বেধে গৃহেতে রহিল।।
পশ্চিম কুলেতে বসে তারক রসনা।
ডাকি ডাকি কারিতেছে কেহ তা শোনে না।।
মনে মনে ভাবিতেছে ভক্ত চূড়ামণি
নিরাশা পাথারে কেনে ভাসালে তরণী।।
মনে বড় আশা ছিল কামনার ফল।
তোমাকে খাওলে হবে জীবন সফল।।
সে বাসনা আজি মোর না হল পুরণ।
বুঝিলাম দয়াময় আমি অভাজন।।
আমি অতি মুঢ় মতি ওগো দয়াময়।
সে কারণে খেয়া ঘাটে ঠেকিলাম দায়।।
এত ভাবি সে তারক কান্দিতে লাগিল।
হরিচাঁদ রূপ চিন্তা হৃদয়ে জাগিল।।
চক্ষু যদি বসিলেন নদীর কিনারে।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি নীরে।।
খেয়া ঘাটে বসে আছে সমাধির প্রায়।
মন পাখি উড়ে গেল ঠাকুরের পায়।।
একে ভীষণ শীত তাহে নদী কুল।
তারকের গায়ে শীত নাহি এক চুল।।
দিকে তে হরিচাঁদ প্রভু দয়াময়।
শয়ন করিয়া আছে কোমল শয্যায়।।
আচম্বিত শয্যা হতে নিদ্রা ভঙ্গ হল।
থর থর মহাপ্রভু কাপিতে লাগিল।।
ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু দয়াময় হরি।
তারকের গাত্র শীত নিজ দেহে ধরি।।
ছট ফট করিতেছে শয্যার উপরে।
তাহা দেখি শান্তিদেবী কহে ধীরে ধীরে।।
ওগো প্রভু কি হইল বল গো আমায়।
ছট ফট কেন কর ওগো দয়াময়।।
তাহা শুনি বলেছেন দয়াময় হরি।
শীতে ভীষণ জ্বালা সহিতে না পারি।।
হস্ত পদ ঠান্ডা হয়ে গিয়াছে আমারি
কহ কহ কহ প্রিয়ে কি করি এবার।।
তাহা শুনি শান্তি দেবী লেপ কাথা আনি।
ঠাকুরের দেহ পরে দিলেন তখনি।।
যত দেয় লেপ কাথা তত শীত বাড়ে।
তাহা দেখে শান্তি দেবী ডাকে গোলোকেরে।।
গোলক পাগল ছিল বাহির বাটিতে।
মায়ের ব্যাকুল স্বর শুনিল কানেতে।।
ব্যাস্ত হয়ে সে গোলক আসিল তথায়।
মহাপ্রভু কাপিতেছে দেখিবারে পায়।।
গোলোক বলেছে বাবা কি খেলা তোমার।
তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।।
তুচ্ছ শীত লাগি কেন কাঁপিতেছ তুমি।
সকল সহিতে পার ওগো বিশ্ব স্বামী।।
এত কেন উচাটন দেখি যে তোমায়।
কহ কহ কহ প্রভু ধরি তব পায়।।
গোলোকের বাক্য শুনে হরি চাঁদ বলে।
সকল সহিতে পারি নিজ অঙ্গে হলে।।
কিন্তু যদি ভক্ত অঙ্গে কোন কিছু হয়।
সে সব সহিতে নারি এই দুনিয়ায়।।
আমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি।
ভক্ত অঙ্গ যত কিছু নিজ দেহে ধরি।।
যদি কোন ভক্ত মোরে দেহ করে দান।
শীত গ্রীষ্ম সহ্য করি যদি যায় প্রাণ।।
আজি মোর প্রাণাধিক তারক রসনা।
মধুমতি কুলে বসে কান্দে মোর সোনা।।
পার হতে না পারিয়া রয়েছে বসিয়ে।
শীতের তাপেতে অঙ্গ গেছে ঠান্ডা হয়ে।।
তার দেহ মোর দেহ ভিন্ন কিছু নয়।
তার দেহে যত শীত আমাতে উদয়।।
শুনরে গোলোক তুমি মোর কথা লও।
তারকে আনিয়া মোর পরাণ বাঁচাও।।
সেই মোর প্রাণাধিক পোষা শুক পাখি।
জীবন চঞ্চল হয় তাহারে না দেখি।।
ঠাকুরর বাক্য শুনে গোলকে গোঁসাই
বলে বাবা চলিলাম কোন চিন্তা নাই।।
জয় হরি বল মন গৌর হরি বলে।
অন্ধকার রাত্রি সেথা একা একা চলে।।
চলেছেন ভক্ত বীর অনুরাগ ভরে।
দেখিতে দেখিতে গেল মধুমতী তীরে।।
খেয়া তরী ঘাটে বাঁধা দেখিতে পাইয়া।
আপনি চলিল সেই তরণী বাহিয়া।।
ওপারেতে গিয়ে সেই গোঁসাই গোলোক।
বারে বারে ডাকিতেছে তারক তারক।।
তারক বসিয়া ছিল সমাধির প্রায়।
গোলোক চাঁদের ডাক শুনিবারে পায়।।
তখনি তারক চন্দ্র চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে কেন্দে বলিতেছে আধ আধ ভাস।
কি লাগিয়া এলে দাদা কর হে প্রকাশ।।
তারকের বাক্য শুনে গোলোক বলেছে।
এই মাত্র ছিনু আমি ঠাকুরের কাছে।।
ঠাকুরের আজ্ঞা নিয়া এসেছি রে ভাই।
তোর মত হরিভক্ত জগতে নাই।।
তোর লাগি বাবা আজি ওড়াকান্দি বসে।
ছট ফট করিতেছে আখি জলে ভেসে।।
তারক তারক বলে ছাড়িতেছে হাই।
তাই দেখে তোকে নিতে এসছিরে ভাই।।
হরিচাঁদ পোষা পাখি তুই মোর সোনা।
ভক্তাধীন ভগবান এবে গেল জানা।।
তোর দেহে যত শীত ধরে ভগবান।
তারক তারক বলে হতেছে অজ্ঞান।।
চল তোকে লয়ে যাই ঠাকুরের কাছে।
তুই গেলে ঠাকুরের সব জ্বালা ঘোচে।।
তারক বলিছে দাদা কি কথা কহিলে।
বলিতে বলিতে তথা মুর্ছিত হইলে।।
মুখেতে নাহিক ভাষা কান্দে ফুকারিয়ে।
অমনি গোলোক চন্দ্র ধরিল জড়ায়ে।।
কোলে করে তারকেরে নৌকায় তুলিল।
সে মাছের ডালা শেষে মস্তকে করিল।।
নিজ তাতে শ্রী গোলোক বাহিলেন দাড়।
মুহুর্তের মধ্যে নদী হইলেন পার।।
তারকের কোলে করি চলিল অমনি।
মস্তকে মাছের ঝাকা আশ্চর্য্য কাহিনী।।
চলেছেন ভক্তবীর অনুরাগ ভরে।
হরিচাঁদ ছবি খানি রাখিয়া অন্তরে।।
যেদিন গন্ধমাদন আনে হনুমান।
তেমনি গোলোক চন্দ্র চলেছে ধীমান।।
মুহেুর্তেকে উতরিল ওড়াকান্দি গাঁয়
ঠাকুরের কাছে নিয়ে হইল উদয়।।
অমনি দয়াল হরি বাহু প্রসারিয়া।
তারকেরে বক্ষে ধরে কহিছে কান্দিয়া।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন।
তোরে না দেখিলে মোর বাঁচে না জীবন।।
তোরে বিনে জীবনে কোন শান্তি নাই।
তোর মত ভক্ত যেন যুগে যুগে পাই।।
পরশমণির স্পর্শ তারক পাইয়া।
চৈতন্য হইয়া কান্দে পদেতে পড়িয়া।।
দীন বিনোদ বলে ওপদ লাগিয়া।
জনম চলিয়া গেল কান্দিয়া কান্দিয়া।।
 
   তারকের স্তব
    (লঘু ত্রিপদী)
ওগো দয়াময়         হইয়া সদয়
করুণা করিলে মোরে।
গুণের মহিমা,         দিতে নারি সীমা
নাম নিলে আখি ঝরে।।
আমি অন্ধ জন        না জানি সাধন
তোমারি কৃপা গুণে
আসিয়া ধরায়,        চিনিনা তোমায়
ভুলিয়া মায়া বন্ধনে।।
তুমি দীনবন্ধু          করুণার সিন্ধু
পতিত পাবন হরি।
পতিত তারিতে       এলে অবনিতে
সাঙ্গ পাঙ্গ সঙ্গে করি।।
তুমি দর্প হারী,        মুকুন্দ মুরারী
প্রভু নিত্য নিরঞ্জন।।
তুমি চক্র ধারী        সুন্দর শ্রী হরি
ভকত নয়নমণি
অগতির গতি          তুমি শান্তি পতি
কন্যা তব ধরণী।।
অন্ধের নয়ন                     মহা উদ্ধরণ
তিমির বিনাশকারী।
মদন মোহন                    ভকত জীবন
দুষ্টের দমন হরি।।
তং হি পূর্ণব্রহ্ম        তুমি হে আব্রহ্ম
কৃষ্ণ কেশব শ্রী রাম।
দেব গদাধর           গৌরাঙ্গ সুন্দর
গুণময় গুণধাম।।
বিধাতার বিধি         তুমি গুণনিধি
সর্ব গুণের আধার।
অন্তিম কাণ্ডারী        দিতে পদতরী
ভব নদী কর পার।।
ভকত লাগিয়া         বেড়াও কান্দিয়া
ব্যাথায় বেথিত হয়ে।
তুমি বিনে আর       কে আছে আমার
ফেল না পদে ঠেলিয়া।।
(পয়ার)
ভক্তি ভাবে স্তুতি করে তারক রসনা।
ঠাকুর বলে বাছা তুই মোর সোনা।।
পদ্ম হস্ত বুলায়েছে তারকের গায়
হেনকালে শান্তি মাতা আসিল তথায়।।
তারকেরে কোলে করি মাতা ঠাকুরাণী
ছল ছল আখি দুটি কহিতেছে বাণী।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন
বহু দিন হেরি নাক চাঁদ বদন।।
চাঁদ মুখে চুমু দেয় জগত জননী।
ধন্য ধন্য শ্রী তারক কবি চূড়ামণি।।
দেখরে নগর বাসী দেখরে চাহিয়া।
হেন ভাগ্য কার হয় জনম লভিয়া।।
ভক্ত আর ভগবান এমতি মিলন।
মনে হয় এই যেন বৈকুন্ঠ ভুবন।।
এই ভাবে ভক্ত আর হরি দয়াময়।
প্রেম সকরান্ধ পানে প্রফুল্ল-হৃদয়।। (মকরন্দ)
ধীরে ধীরে হরিচাঁদ কহিল তখন।
শুন শুন শান্তি দেবী আমার বচন।।
তারকের আনা মাছ কর হে রন্ধন।
বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে করিব ভোজন।।
তাই শুনি শান্তি দেবী করিল রন্ধন।
ভক্তের ভক্তির দ্রব্য হইল তেমন।।
রন্ধন করিয়া দেবী কহিল তখন।
সবাই বস রে খেতে হয়েছে রন্ধন।।
তাই শুনি হরিচাঁদ ভোজনে বসিল।
তারক গোলোকে দুই পাশেতে বসাল।।
ভক্ত আর ভগবানে করেছে ভোজন।
শান্তি মাতা অন্ন দেয় আনন্দিত মন।।
হরিচাঁদ বলে বড় সুন্দর রন্ধন।
এমন স্বাদের মাছ খাইনি কখন।।
তাই শুনি সে তারক ভাবে মনে মনে।
আজি মোর মনবাঞ্ছা হইল পূরণ।।
হরি হরি হরি বলে কান্দিছে তারক।
তাই দেখে হরি বলে নাচিছে গোলক।।
ভক্ত আর ভগবান এমতি মিলন।
হয় নাই হবে নাক তিন ভুবন।।
দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।।
 
তারকের ভ্রান্তি দুর
সেই হতে কিছুদিন ওড়াকান্দি রয়।
ঠাকুরের কর্ম করে হরি গুণ গায়।।
এই ভাবে দশ দিন গত হয়ে গেল।
নিজের বাড়ীর কথা মনে যে পড়িল।।
ভাবিলেন ঘরে মোর অর্থ কিছু নাই।
কিভাবে বাঁচিবে সবে মনে ভাবে তাই।।
ভাবিতে ভাবিতে তার ঝড়ে আখি জল।
অন্তরে জানিল তাহা পরম দয়াল।।
তারকের কাছে গিয়ে হরিচাঁদ কয়।
শুন শুন তারক বলি যে তোমায়।।
গৃহে চেল যাও তুমি ওহে বাছাধন।
ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।।
যে করে আমার চিন্তা তার চিন্তা নাই।
তার দৈন্য দশা আমি সকল ঘুচাই।।
তাই শুনি সে তারক প্রণমিল পায়।
ঠাকুরের পদধুলি লইল মাথায়।।
শান্তি মার পদ প্রান্ত প্রণাম করিয়া।
ছল ছল আখি দুটি কহিছে কান্দিয়া।।
তব চরণেতে মাগো এই ভিক্ষা চাই।
জনমে জনমে যেন ভুলিয়া নাই যাই।।
শান্তি মাতা কহিলেন শুন বাছাধন
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পুরণ।।
আশীর্বাদ লয়ে শিরে তারক সুজন।
ওড়াকান্দি হতে যাত্রা করিল তখন।।
পথে যেতে কত কিছু ভাবিতে লাগিল।
গৃহের সকল কথা মনেতে পরিল।।
ঘরেতে তণ্ডুল নাস্তি কি হবে উপায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
দশ দিন গত হল উপায় কি হবে।
অন্য বিনে মাতা মোর না খেয়ে মরিবে।।
যোগ্য পুত্র বেঁচে থেকে মায়ের মরণ
ধিক ধিক শত ধিক আমার জীবন।।
দশ মাস দশ দিন জঠরে ধরেছে।
নিজে না খাইয়ে মাতা কত কি করেছে।।
ইতি উতি কত কিছু ভাবিতে ভাবিতে।
জলে ভরা আখি দুটি লাগিল হাটিতে।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
লোহাগড়া বাজারেতে হইল উদয়।।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
গৃহের পিছনে গিয়া রহিল বসিয়া।।
তারকের মাতা বলে বধুমাতা ঠাই।
শুন শুন বধুমাতা তোমাকে জানাই।।
ওড়াকান্দি গেছে সে তারক আমার।
দশ দিন গত হল না জানি ব্যাপার।।
তারকের লাগি মোর পরাণ কেন্দেছে।
কি যেন কি হল নাকি মনেতে জেগেছে।।
চিন্তামণি বলে মাগো কোন চিন্তা নাই।
অদ্য কিবা কল্য আসে মনে জাগে তাই।।
ওড়াকান্দি হরিচাঁদ বড় দয়াময়।
তার কাছে গেলে পরে বিপদ না হয়।।
বিপদ ভঞ্জন হরি জগতে আসিল।
হরি নামে পাপ তাপ সকল নাশিল।।
আমাদের ভাগ্য ভাল পেয়েছি চরণ।
জনমের মত আজি লইনু শরণ।।
হেন কথা যখনেতে তারক শুনিল।
মায়ের চরণে এসে প্রণাম করিল।।
ছল ছল আখি দুটি কহিলেন বাণী
কি ভাবে বাঁচিয়া লে বল তাই শুনি।।
গৃহেতে তণ্ডুল নাস্তি গেলাম রাখিয়া।
কোন ভাবে কি খাইয়া রহিলেন বাঁচিয়া।।
দশ দিন গত হল আমি বাড়ী নাই।
চাউল কোথায় পেলে বল শুনি তাই।।
তারকের মাতা বলে কি কথা কহিলি।
হাট থেকে চাল কিনে তুই যে পাঠালি।।
সুন্দর বালক এক আসি হেথায়।
চাউল ডাউল দিয়া হইল বিদায়।।
সে বলিল তারক সে ওড়াকান্দি গেছে।
মোর কাছে চাল কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে।।
তারে কোন দিন আমি চোখে দেখি নাই।
ভাবিলাম তোর কাছে জিজ্ঞাসিব তাই।।
হেন বাক্য যখনেতে তারক শুনিল।
মায়ের চরণ ধরি কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই।
কারো কাছে চাল কিনে আমি দেই নাই।।
এমন বান্ধব কেবা আছে জগতে।
চাউল ডাউল দেয় বয়ে মস্তকেতে।।
আমি অতি মুঢ়মতি কোন গুণ নাই।
কেবা এই মহাজন মনে ভাবি তাই।।
হেন বাক্য যখনেতে তারক বলিল।
চিন্তামণি পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো স্বামী বলি তব ঠাই।
কেবা এসেছিল আমি তোমাকে জানাই।।
মনে পরে এসেছিল হরি দয়াময়।
তাহাকে দেখিয়া চক্ষু ফিরান না যায়।।
সুন্দর বালক রূপে এসেছিল হেথা।
হেন রূপ আমি আর দেখি নাই কোথা।।
আমি তারে জিজ্ঞাসিনু কোথা বাড়ী ঘর।
সে বলিল আমি থাকি বাজারের পর।।
ভাবের বাজারে থাকি মোট বয়ে খাই।
যে আমায় মোট দেয় তার বাড়ী যাই।।
আমাদের বোঝা তিনি মস্তকেতে করি।
ছদ্মবেশে এসছিল দয়াল শ্রী হরি।।
হেন বাক্য চিন্তামণি বলিতে বলিতে।
তারকের পদে পড়ে লাগিল কান্দিতে।।
তারক ঢলিয়া পল মায়ের চরণে।
শত বারী বহিতেছে তাহার নয়নে।।
দেখরে জগত বাসি দেখরে চাহিয়া।
কি ভাবে কি করে হরি ভক্তের লাগিয়া।।
যদি কোন ভক্ত তারে সব কিছু দেয়।
এই ভাবে হরি তার বাসনা পুরা।।
তাই বলি ভাই সব আর কিবা চাও।
শ্রীহরির শ্রীচরণে সব সপে দাও।।
কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
 
        ভক্তের  বাধ্য হরিচাঁদ
লাল চন্দ্র পুর গ্রাম খুলনা জেলায়।
কবিগান হবে সেথা জানিল সবায়।।
কালীকৃষ্ণ নামে এক জমিদার ছিল।
তার বাড়ী কবিগান বন্দোবস্ত হল।।
তারক গোঁসাই এল গান গাহিবার।
মথুর নামেতে এল অন্য সরকার।।
দুই দলে হবে সেথা কাব্য আলোচনা।
দলে দলে সবে এল শুনিতে বাসনা।।
বহু লোক এলা তথা গান শুনিবারে।
দুই দল উঠিলেন কবির আসরে।।
ভবানী বিষয় আর আগমনী হয়।
সখী সংবাদ কবি যে হয়ে গেল সায়।।
তারপর পাঁচালীতে গেল দুই জন।
গান শুনে আনন্দিত সবাকার মন।।
মথুর সাজিল গিয়ে কেশব কাশ্মীরী
তারকেরে সাজাইল শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।।
কেশব কাশ্মীরী শেষে কহিতে লাগিল।
তুমি নাকি ভগবান লোকে তাই বলে।।
তুমি যদি ভগবান বলি যে তোমায়।
হরি নামে মাতোয়ারা সকল সময়।।
দুটি কথা বলি তোমা শুন দিয়া মন।
বৃন্দাবনে তুমি যবে করিলে ভ্রমণ।।
হরি নামে মাতোয়ারা ঝরে দুটি আখি।
হেন কালে দুই হাতে পড়ে দুই পাখী।।
শুক আর সারী এই পাখী দুইজন।
দুই শ্লোক বলে তারা কিসের কারণ।।
শ্লোক দুটি বল আজি সবার মাঝ।
তবে আমি বুঝে লব তুমি রসরাজ।।
শ্লোকের অর্থ কিবা বল ভগবান।
প্রাণ ভরে শুনে আমি জুড়াইব কান।।
তারপর শ্রী তারক আসরেতে যায়।
শ্লোকের অর্থ কিবা খুঁজিয়া না পায়।।
ধামা চাপা দিয়ে বলে তারক গোঁসাই
হরি নামে মাতোয়ারা শুনিতে না পাই।।
তারপর সে মথুর আসরেতে যায়।
ব্যাঙ্গ করে তারকেরে কত যে কি কয়।।
তাই শুনে সে তারক বাহিরেতে গেল।
নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।।
নির্জনে বাসিয়া কবি ভাবে মনে মন
কোথা প্রভু হরিচাঁদ কি করি এখন।।
তোমার আদেশ নিয়া কবিগান গাই।
তোমার কৃপায় কোথা পরাজয় নাই।।
এবে তুমি বলে দাও কি হবে উপায়।
তোমার নামের বুঝি হয় পরাজয়।।
সাধন না জানি প্রভু ভজন না জানি।
বিপদে রক্ষা কর হরি গুণমণি।।
তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়।
তার কভু নাহি হয় হেন পরাজয়।।
মহাভাব উথলিয়া আখি দুটি ঝরে।
ওড়াকান্দি থেকে হরি জানিল অন্তরে।।
ভক্তের লাগিয়া আজি হরি দয়াময়।
কাগজেতে শ্লোক লিখে বাতাসে ভাসায়।।
বাতাসেতে ভেসে ভেসে সে কাগজ খানি।
তারকের মস্তকেতে পড়িল অমনি।।
তাই দেখে সে তার কাগজ ধরিল।
দুই শ্লোক লেখা আছে দেখিতে পাইল।।
মনে মনে ভাবিতেছে কবি রসরাজ।
ভক্ত বাঞ্ছাকল্পতরু তার এই কাজ।।
তখনি তারক চন্দ্র আসরেতে যায়।
শোক দুটি ব্যাখ্যা করি সবারে জানায়।।
কবির খোলায় যত শ্রোতাগণ ছিল।
আনন্দেতে আত্মহারা প্রেমেতে ভাসিল।।
(
শ্লোকের অর্থ)
যাহার সৌন্দর্য দেখে ললনা ভুলিল।
স্ত্তম্ভবিধায়িনী রাধা প্রেমেতে মজিল।।
যেই প্রভু গোবর্ধন করিল ধারণ
তাই দেখে জনগণ আনন্দিত মন।।
বিশ্বজন হিত লাগি মদন মোহন।
বিশ্বের মঙ্গল করে সেই কৃষ্ণধন।।
শ্রীরাধার প্রেম আর নত্তন কীর্তন
শ্রীকৃষ্ণের করিলেন চিত্ত আকর্ষণ।।
এত বলি শ্রীতারকে ব্যাখ্যা যে করিল।
শ্রোতাগণ সুখী হয়ে আনন্দে ভাসিল।।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
রমাগণে উলুধ্বনি দিলেন আসিয়া।।
গান শেষে সে তারক বাহিরেতে এল।
শত শত শ্রোতাগণ চরণে পড়িল।।
তারকের জয়গান করিতে করিতে।
শ্রোতাগণ চলে গেল যে যার বাটিতে।।
গান শেষে সব দল বিদায় হইল।
যার যার দেশে সবে গমন করিল।।
তারপর সে তারক ওড়াকান্দি যায়।
প্রণাম করিল গিয়ে ঠাকুরের পায়।।
কেন্দে কেন্দে সে তারক বলিল বচন।
সেই শ্লোকের কথা কহিল তখন।।
তারকের কথা শুনে হরিচাঁদ কয়।
ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইতে আসি ধরায়।।
তোর পরাজয় দেখে শ্লোক লিখিয়া।
পবনের কাছে আমি দেই পাঠাইয়া।।
হেন বাক্য হরিচাঁদ যখন বলি
তারক চরণে পড়ে কান্দিতে লাগিল।।
তারকের কান্না দেখে বলে দয়াময়।
আশীর্বাদ দিয়ে তারে করিল বিদায়।।
কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।
 
মতির ফাঁশি মুক্তি
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।।
কালিয়া থানার মধ্যে রায়পুর গ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে মতিচন্দ্র নাম।।
স্বাভাবিক ভাবে তার জীবন চলিত।
মাঝে মাঝে সেই গ্রামে তারক আসিত।।
তারকেরে ভক্তি করি জীবন কাটায়।
কৃষি কার্য্য করিতেন সেই মাহাশয়।।
একদিন সেই মতি জমি চষিবারে।
মাঠ মধ্যে চলিলেন হাল স্কন্ধে করে।।
সে জমির আর নিয়ে গোলমাল ছিল।
সেই দিন তার সঙ্গে কোন্দল বাঁধিল।।
দুই জন হাতা হাতি মারামারি করে।
ক্রোধ ভরে সেই মতি বাড়ী দেয় তারে।।
হালুয়া লাঠির বাড়ী মস্তকেতে দিল।
নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল।।
ছট ফঠ করি শেষে জীবন ত্যাজিল।
তাই দেখে সেই মতি ভয়ে পালাইল।।
মাঠ ভরা কৃষকেরা ছুটিয়া আসিল।
মরা শব লয়ে তারা থানায় চলিল।।
খুনি কেচ লিখে সেই দারগা তখন।
কোটেতে পাঠায় কেচ করিয়া যতন।।
শমন করিযা জারী মতিকে ধরিল।
হাত কড়া দিয়ে তারে জেলেতে পুরিল।।
জেলেতে থাকিয়া মতি ভাসে আখি জলে।
কি হইতে কি হইল মনে মনে বলে।।
সত্য সত্য স্বাক্ষী পেয়ে হাকিম তখন।
জজ কোর্টে পাঠাইল করিয়া লিখন।।
জজ বাবু স্বাক্ষী পেয়ে হুকুম করিল।
সে মতির ফাঁশি হয়ে রায়েতে লিখিল।।
ফাঁশির হুকুম হল শুনে মতি শেষে।
কান্দিতে লাগিল মতি আখি জলে ভাসে।।
পরিবারসহ কান্দে সে কথা শুনিয়া।
হায় হায় কি হইল না পায় ভাবিয়া।।
সে মতির ফাঁশি হবে সকলে শুনিয়া।
যার যার মন কথা বেড়ায় বলিয়া।।
ফাঁশির হুকুম হল আইন ধারায়।
তিন সত্ত্বা মধ্যে তার এক সত্ত্বা পায়।।
কাউকে দেখিতে ইচ্ছা যদি থাকে মনে।
কোন দ্রব্য খেতে ইচ্ছা থাকে তার মনে।।
মানিতে ছাপাই স্বাক্ষী মনে যদি চায়।
মানিলে মানিতে পারে আইনেতে কয়।।
তাই শুনে সেই মতি মানিল ছাপাই।
আমার ছাপাই স্বাক্ষী তারক গোঁসাই।।
সেই ভেবে সেই মতি তারকে স্মরিয়া।
তারকের ছবি খানি হৃদয়ে ধরিয়া।।
আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে ছাড়ে হাই।
অন্তিমের ইচ্ছা আমি তোমাকে জানাই।।
সে মতির ইচ্ছা যাহা জজ বাবু শুনে।
নোটিশ লিখিয়া দিল পিওনের স্থানে।।
পিওন নোটিশ লয়ে তারকে জানায়।
তারক জানিয়া তাহা ভাবিল হৃদয়।।
লোক মুখে শুনিয়াছি খুনের ঘটনা।
কেমনেতে দিব স্বাক্ষী কিছু জানি না।।
মতি মোরে স্বাক্ষী মানে কী মনে ভাবিয়া।
কেমনেতে দিব স্বাক্ষী জজ কোর্টে গিয়া।।
ইতি উতি কতকিছু মনেতে ভাবিল।
স্বাক্ষীর তারিখ দিনে কোর্টে নাহি গেল।।
তারপর জজ বাবু শমন পাঠায়।
পিওন আসিয়া সেই শমন দেখায়।।
পিওন বলেছে তুমি শুন মহাশয়।
তারিখে নাহি গেলে বিপদ নিশ্চয়।।
কোর্টের অমান্য হবে স্বাক্ষী যায় জেলে।
শুন শুন মহাশয় আমি যাই বলে।।
এই কথা বলে তিনি করিল গমন।
তাই শুন রসরাজ ভাবে মনে মন।।
মতি মোরে ভক্তি করে চিরদিন জানি।
সত্য সত্য অপরাধি লোক মুখে শুনি।।
কি করিব কোথা যাব ভাবিয়া না পাই।
কোথা মোর হরিচাঁদ তোমাকে জানাই।।
তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়।
জীবনে মরণে তার নাহি কোন ভয়।।
হরিচাঁদ ছবিখান হৃদয়ে ধারিয়া।
নিশ্চিত শয়ন করে শ্রীহরি স্মরিয়া।।
স্বপনেতে সে তারক দেখিতে পাইল।
দয়াময় হরিচাঁদ কহিতে লাগিল।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
স্বাক্ষী দিতে চলে যাও নাহি কোন ভয়।।
যেই খানে তুমি যাবে সঙ্গে সঙ্গে রব।
তোমার মনে বাঞ্ছা আমি পুরাইব।।
স্বপনে দেখিয়ে সেই তারক সুজন।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া।
কোর্টের সমীপে গিয়ে রহিল বসিয়া।।
হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়।
কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।।
জজের জীবন কথা শুন দিয়া মন।
ঘটনা প্রবাহ আজ করিব বর্ণন।।
বিবাহ করেছে মাত্র সন্তান না হয়।
জজের রমনী কান্দে সেই বেদনায়।।
নিদ্রা যোগে সে রমনী দেখিতে পাইল।
হরিচাঁদ এসে তারে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন শুন মাগো বলি যে তোমায়।
তোমার লাগিয়া আমি এসেছি হেথায়।।
তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন।
আগামী সকালে এসে দিবে দরশন।।
জজ কোর্টে স্বাক্ষী দিতে আসিবে সে জন।
তাহার বরেতে হবে তোমার নন্দন।।
যদি তারে ভক্তি করি আনিবে হেথায়।
মন বাঞ্ছা পূর্ণ হবে তাহার দ্বারায়।।
হেন কথা হরিচাঁদ যখনে কহিল।
নিদ্রা ভেঙ্গে সেই নারী কান্দিতে লাগিল।।
স্বামীর চরণ ধরে কেন্দে কেন্দে কয়।
স্বপ্নের বৃত্তান্ত কথা সকল জানায়।।
তাই শুনে জজ বাবু আখি জলে ভাসে।
কিছু কাল মৌন হয়ে রহিলেন বসে।।
মনে মনে ভাবিলেন সত্য ঘটনা।
স্বাক্ষীর ঘটনা মোর নারী ত জানেনা।।
নিশ্চই স্বপনে এসে কহিলেন হরি।
তারকেরে আনিবারে করিব না দেরি।।
এত বলি দুই জন পুলিশ ডাকিয়া।
তারকেরে আনিবারে দিল পাঠাইয়া।।
পুলিশ দুজন গিয়ে খুঁজিতে লাগিল।
কোর্টের কাছেতে গিয়ে দেখিতে পাইল।।
মৌন হয়ে বসে আছে তারক সুজন।
তারকেরে দেখে তারা কহিল তখন।।
তার নাম কিবা হয় বল মহাশয়।
এই খানে বসে আছে কিসের আশায়।।
তারক আমার নাম কহিল তখন।
স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি শুন বিবরণ।।
তাই শুনি পুলিশেরা কহিল তখন।
জজ বাবু ডাকিতেছে তোমারে এখন।।
জজের আদেশে মোরা আসিয়াছি নিতে।
এখন যাইতে হবে আমাদের সাথে।।
তারক বলেছে আমি এই খানে রব।
ডাক হরে স্বাক্ষী দিয়ে গৃহে চলে যাব।।
পুলিশ বলেছেতুমি বোকা মন্দ নও।
জজ বাবু ডাকিতেছে বুঝিতে কি পাও।।
তারক বলেছে আমি বুঝি না কখন।
হোক সে জজ বাবু যাব না এখন।।
তাই শুনে পুলিশেরা হইল বিদায়।
জজের কাছেতে গিয়ে সকল জানায়।।
তারক বলিল আমি এই খানে রব।
হোক সে জজ বাবু আমি না যাইব।।
তাই শুনে বলিতেছে জজের রমনী।
ছল ছল আখি দুটি কহিছে তখনি।।
স্বামীর চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।
শুন তুমি ওগো স্বামী বলি যে তোমায়।।
সে মানুষ আনিবারে কর হে গমন।
কেন্দে কেন্দে সে রমনী কহিল তখন।।
তাই শুনে দুই জন গমন করিল।
তারকের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।।
তারকের পদে পড়ে কেন্দে কেন্দে কয়।
আমাদের গৃহে চল ধরি তব পায়।।
কান্না দেখে কহিলেন তারক গোঁসাই
স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি কেমনেতে যাই।।
তাই শুনে জজ বাবু কান্দিয়া বলেছে।
গত রাত্রে তব স্বাক্ষী হইয়া গিয়াছে।।
দয়া করে চল বাবা আমাদের ঘরে।
বলিতে বলিতে তার আখি দুটি ঝরে।।
কেন্দে কেন্দে দুই জনে পড়িল ধরায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।
দুজনার ধরে তুলে কহিতে লাগিল।।
চল চল জজ বাবু তব ঘরে যাই।
বিলম্ব সহিতে নারি তোমাকে জানাই।।
এত বলি চলিলেন জজের বাসায়।
কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণ ধোয়ায়।।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।
আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে কেন্দে কয়।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি অপূর্ব মুরতী।
শিয়রে বসিয়া মোরে কহিল ভারতী।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
তব ঘরে পুত্র কন্যা দেখিতে না পাই।।
তোমার মঙ্গল লাগি আসিয়াছি হেথা।
তব গর্ভে পুত্র হবে শুন সেই কথা।।
তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন।
তোমাদের কোর্টে এসে দিবে দরশন।।
তারে যদি ঘরে এনে করিবে যতন।
তার বরে তব গর্ভে হইবে নন্দন।।
তাই বলি ওগো বাবা চরণে জানাই।
তোমার বরেতে যেন পুত্র ধন পাই।।
কান্না দেখে তারকের দয়া উপজিল।
মস্তকেতে হস্ত দিয়ে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
তব গর্ভে ছেলে হবে কোন চিন্তা নাই।।
এই বাক্য যখনেতে তারক বলিল।
কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণে পড়িল।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
জজ বাবু পড়িলেন তারকের পায়।।
এই ভাবে ভক্তি স্তুতি করিতে করিতে।
তারক বুঝায় শেষে বিশুদ্ধ ভাবেতে।।
ভাবাবেশে সেই নারী রন্ধন করিয়া।
ভোজন করায় শেষে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
প্রাণভরি সে তারক ভোজন করিল।
বলে কয়ে সেই দিন গৃহেতে চলিল।।
পরদিন জজ বাবু কোর্টেতে উদয়।
নজর পড়িল গিয়ে রায়ের খাতায়।।
ভাল করে লক্ষ করে দেখিবারে পায়।
নিজের হাতের লেখা খাতা পাতায়।।
খালাস পেয়েছে মতি দেখিতে পাইল।
ছাপাই স্বাক্ষীর পরে খালাস হইল।।
তাই দেখে জজ বাবু ভাবিল হৃদয়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
মতিকে বাহির করি বুকেতে ধরিয়া।
মিনতী করিল কত কান্দিয়া কান্দিয়া।।
মতিকে বিদায় করি গৃহেতে চলিল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।

শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন। হরিবোল।
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free