পৃষ্ঠাঃ ৫৬১-৫৮০
“ঠাকুর যায় নাই”
দস্যুরা দেখিয়া বলে “ঠাকুর যায় নাই।”
হরিবর সরকার শুনিলেন তাই।।
রোগে ভোগে হরিবর মনে চিন্তা করে।
আর কেন এই বার যাই তবে মরে।।
প্রভুর নিকটে যবে দিল দরশন।
প্রভু বলে “হরিবর! যেওনা না এখন।।
আমি চলে গেলে তুমি এসে মম পরে।
তোমার যে বহু কাজ রয়েছে সংসারে।।”
কথা শুনি হরিবর অনেক কান্দিল।
সেই হ’তে আপনার হৃদয় বান্ধিল।।
কিছুকাল পরে প্রভু দেহ ছাড়ি যায়।
শুনিয়া সে হরিবর করে হায় হায়!
মনে ভাবে দয়াময় যবে গেছে চলে।
কি বলে থাকিব আর এই ভূমণ্ডলে।।
এত ভাবি এক দিন ধাম প্রতি চলে।
ঘৃতকান্দি উপস্থিত হ’ল সন্ধ্যাকালে।।
এক বাড়ী কিছুকাল করিয়া বিশ্রাম।
ধাম প্রতি চলিলেন সেই গুণধাম।।
দুরন্ত আঁধার মাঝে পথ চলা দায়।
কা’রা যেন আগে আগে কথা বলে যায়।।
অন্ধকার মধ্যে সাধু সাথী পেল বটে।
দ্রুত গতি আসিলেন তাদের নিকটে।।
দেখে দুই ব্যক্তি অগ্রে করে আলাপন।
করিতেছে ঠাকুরের গুণানুকীর্তন।।
একজনে বলিতেছে অপরের কাছে।
“গুরুচাঁদ যায় নাই ওড়াকান্দি আছে।।”
অপরে বলিল “তাহা বুঝিলে কেমনে?
উঠিয়া গিয়াছে তিনি দেখেছি নয়নে।।”
সঙ্গী বলে “শুন ভাই জানিতাম বটে।
এখনে বিশ্বাস কিন্তু নাহি করি মোটে।।”
কারণ বলিব যাহা শুন দিয়া মন।
অল্পকাল আগে যাহা সেই বিবরণ।।
তারাইল হাট হ’তে আসিতেছি ফিরে।
একা একা আসিতেছি ঘোর অন্ধকারে।।
বিল মধ্যে নামি একা করিতেছে ভয়।
হেনকালে শুনি কা’রা আগে কথা কয়।।
ত্রস্তে ব্যস্তে আসিলাম তা’দের নিকটে।
দেখিলাম দুই বেটা মুসলমান বটে।।
নিজ মনে আগে আগে তারা চলে যায়।
আমি যে পশ্চাতে আছি টের নাহি পায়।।
হেনকালে একজন কহিছে অপরে।
“ওরে ভাই বড় কর্তা যায় নাই মরে”।।
সঙ্গী তার হেসে বলে “তুই ত বেহুঁশ।
মরে যেয়ে ফিরে নাকি আসে রে মানুষ।।”
কর্তা মারা গেছে তাহা সকলেই জানে।
এ কথা বলিস নারে যেখানে সেখানে।।
কথা শুনে বলে তবে সেই মুসলমান।
“শোন ভাই বলি আমি চাক্ষুষ প্রমাণ।।
কর্তা মারা গেলে মোরা লোক দুই কুড়ি।
“ডাকাতি” করিব ভাবি ঠাকুরের বাড়ী।।
নিশুতি আঁধার রাতে যাই দলবলে।
বাড়ীর উত্তরে গিয়া বসেছি সকলে।।
মনে ভাবি এই পথে বাড়ীতে ঢুকিব।
মনোমত দ্রব্য যত লুণ্ঠন করিব।।
অগ্রণী হইয়া আমি উঠিব যখনে।
চেয়ে দেখি বড় কর্তা দাঁড়ায়ে সেখানে।।
আমারে ডাকিয়া বলে “আমি যাই নাই।
ডাকাতি করিতে এসে পাবি নারে ঠাই।।”
মনে মনে ভাবিলাম কি দেখিলাম চোখে।
ঘুরে ঘুরে আসিলাম পশ্চিমের দিকে।।
বাড়ীর উপরে যদি উঠিবারে যাই।
কর্তা পুনঃ এসে বলে “আমি যাই নাই”।।
এইভাবে সারারাত্রি ঘুরে চারিধারে।
যেথা যাই কর্তা এসে বাধা দিল মোরে।।
স্বচক্ষে দেখেছি ইহা কিছু মিথ্যা নয়।
অবশেষে পলাইয়া আসি নিজ গাঁয়।।
সেই কথা যেই দিন শুনিয়াছি কানে।
নিশ্চয় বুঝেছি কর্তা আছে নিজ স্থানে।।”
কথা শুনে হরিবর কান্দিয়া আকুল।
মনে মনে বলে “বাবা ভেঙে দিলে ভুল”।।
ভাবিয়াছি চলে বুঝি গেছ দয়াময়।
আজ দেখি কত ভুল করিয়াছি হায়।।
কান্দিতে কান্দিতে সাধু ওড়াকান্দি গেল।
যারে পায় তার কাছে সকলি কহিল।।
সকল শুনিয়া বলে প্রমথরঞ্জন।
“এই বাক্য আমি কিন্তু করি সমর্থন।।
কে কে কি কি দেখিয়াছে তাহা বলে নয়।
এই কথা বলি আমি তাঁহার কথায়”।।
আমারে বলিয়াছিল “তোমাকে না বলে।
হেথা হ’তে আমি কভু নাহি যাব চলে।।”
আমি জানি সে ঠাকুর মোটে যায় নাই।
হ’তে পারে কর্মদোষে দেখা নাহি পাই”।।
কথা শুনে হরিবর ভাবে মনে মন।
প্রমথরঞ্জন এই বটে কোন জন।।
তথা হ’তে বাড়ী গিয়ে রচিয়াছে গান।
পদ মাত্র লিখিলাম করিয়া সন্ধান।।
“আমার গুরুচাঁদ এসেছে ফিরে।
ভক্তজনের মনোরঞ্জন, প্রমথরঞ্জন মূর্তি ধরে।।”
- হরিবর সরকার
কোথা গেল কোথা গেল সেই গুরুচন্দ্র।
সেই তত্ত্ব নাহি পেল মূঢ় মহানন্দ।।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ তত্ত্বামৃত সার
বন্দনা
জয় জয় গুরুচাঁদ করুণা সাগর।
নরাকারে ধরাপরে নিজে মহেশ্বর।।
জয় মাতা সত্যভামা করুণা রূপিণী।
নারী সাজে ধরা মাঝে জগত জননী।।
কি লীলা করিলে দোঁহে নরে অগোচর।
তারিলে তাপিত জনে প্রসারী শ্রীকর।।
অমৃত মাখানো দৃষ্টি পড়েছে যেখানে।
পাহাড় গলেছে মরু ডুবেছে প্লাবনে।।
রাতুল চরণ রেখা পড়েছে যেথায়।
বিশুষ্ক মঞ্জরী সেথা কুসুমিত হয়।।
শঙ্কাহারী নাম তব যেখানে যে কয়।
নাম গুণে রণে বনে সর্বত্রেতে জয়।।
কাম জিনি রূপ যেবা নিত্য করে ধ্যান।
অকামনা প্রেমভক্তি সেথা অধিষ্ঠান।।
গুরুচাঁদ সত্যভামা বসা’য়ে যুগলে।
নিত্য যেবা করে পূজা হৃদি পদ্মদলে।।
জন্ম কর্মবন্ধ তার সব নষ্ট হয়।
কর্ম বন্ধ হ’য়ে পুনঃ আসে না ধরায়।।
জয়তু! জয়তু! গুরো! পতিত পাবন!
দীন মহানন্দে যাচে শ্রীপদ শরণ।।
তিনি কে ছিলেন?
“অদিত্য বর্ণং পুরুষো মহাত্মম।।”—উপনিষদ
হরিচাঁদ বলে “আমি ক্ষীরোদ ঈশ্বর।
দেহ ছাড়ে গুরুচাঁদে করিলাম ভর।।”
নিজে জগদম্বা বলে “তিনি মম পতি।
আমার পূজায় নাই তাঁহার প্রণতি।।”
ভক্তশ্রেষ্ঠ সে তারক রসের সাগর।
বলে “হরি-গুরুচাঁদ! স্বয়ং মহেশ্বর।।”
শ্রীশশিভূষণ জানি তাঁহার নন্দন।
“প্লাঞ্চেট” যন্ত্রেতে তেহ করে নিরূপণ।।
একাদশ রুদ্র মধ্যে তিনি “রুদ্রেশ্বর”।
তাহাকে পুজিছে সদা দেব, যক্ষ, নর।।
হস্ত গণকের চক্রে উঠে গণনায়।
“রুদ্রপতি”, “রুদ্রেশ্বর” কৈলাস আলয়।।
প্রিয়ভক্ত যাদবের বাঞ্ছাপূর্ণকারী।
তিনি বলে “গুরুচাঁদ চতুর্ভুজধারী”।।
হরিবর বলে “তিনি দেবের দেবতা।
প্রেমময়ী রাধা যায় তিনি যান যেথা।।”
বিপিন গোস্বামী বলে “নবঘন-কায়”।
“ভকত রঞ্জন” তিনি দেবীচান কয়।।
নকুল গোস্বামী কহে “তিনি অন্তর্যামী”।
রমণী গোঁসাই জানে “লোকোত্তর স্বামী”।।
তারিণী ডাক্তার জানে “ভকতের বল”।
কুঞ্জ, মধু, বলে “দিতে পারে মোক্ষফল”।।
যজ্ঞেশ্বর বলে “তিনি স্বয়ং গদাধর”।
গঙ্গা দেবী পূজা করে “বলে প্রাণেশ্বর”।।
মীড লিখে রেখে গেল “মহাশক্তিধারী”।
অশ্বিনী গোঁসাই বলে “অকুল কাণ্ডারী”।।
লাট বলে “তিনি হ’ন নমঃকুল পতি”।
নমঃশূদ্র সবে বলে “অগতির গতি”।।
লিখিল মহাত্মা গান্ধী “গুরুর প্রধান”।
কহিল সুভাষচন্দ্র “পুরুষ মহান”।।
তার সঙ্গে নাহি অন্য সম্বন্ধ নির্ণয়।
পিতা মাতা, পতি পুত্র সবে “বাবা” কয়।।
তার গুণে শ্রীগোপাল বাধ্য নিরবধি।
মরা বাঁচে দেখে বলে “বিধাতার বিধি”।।
আর এক লীলা তার দেখে মহাত্মায়।
“তিনি সর্বব্যাপী” তাই শ্রীগোপাল কয়।।
নরদেহে যবে প্রভু ছিল ওড়াকান্দি।
ভক্তগণে গোপালের কাছে হল বন্ধী।।
একদা দুপুর বেলা ভোজন সময়ে।
আহারে বসিয়া সাধু ভাবিল হৃদয়ে।।
“ভোজন করিয়া শেষ আমি শীঘ্র যাই।
তামাক সাজিয়া দিব প্রভুজীর ঠাই।।
শীঘ্র করি শেষ করি আহার আপন।
বহির্বাটী পানে সাধু ধাইল তখন।।
দালানের মধ্যে প্রভু করেন বিশ্রাম।
স্বচক্ষে দেখিয়া এল সাধু গুণধাম।।
বহির্বাটী উপনীত হ’ল গদীঘরে।
দেখে প্রভু আছে শু’য়ে গদীর উপরে।।
আশ্চর্য মানিয়া সাধু দালানেতে গেল।
বিশ্রাম করিছে প্রভু স্বচক্ষে দেখিল।।
পুনরায় ছুটে এল সেই গদী ঘরে।
দেখিল রয়েছে প্রভু গদীর উপরে।।
প্রেমে পুলকিত চিত্তে তামাক সাজিল।
গদী ‘পরে প্রভু যেথা সেথা হুকা দিল।।
দুইটান দিয়া প্রভু হুঁকা দিল ফিরে।
হুঁকা নিয়ে গেল সাধু বাড়ীর ভিতরে।।
দালানেতে গিয়া হুঁকা প্রভু হস্তে দেয়।
দুই টান খেয়ে প্রভু আর নাহি খায়।।
পাগল হইয়া সাধু বাহিরে ছুটিল।
যেথা চায় দেখে প্রভু হাসে খল খল।।
উর্ধ অধঃ দশ দিকে দেখে প্রভুময়।
কাঁদিয়া পড়িল শেষে প্রভুজীর পায়।।
প্রভু বলে কি গোপাল! কান্দ কি কারণ।
ঘটন কারণ সব সেই জনার্দন।।”
গোপাল কান্দিয়া বলে “সর্বব্যাপী প্রভু।
তোমাকে বুঝিতে আর চাহিব না কভু।।”
এবে বলি কিবা বলে প্রমথরঞ্জন।
তিনি বলে “পিতামহ মানুষ রতন”।।
দীর্ঘদিন ইউরোপে কাটায়েছি কাল।
দেখে শুনে গেছে কেটে নয়নেরি জাল।।
শত শত নরনারী করেছি দর্শন।
দেখে শুনে আজ মোর ঠিক হ’ল মন।।
মনে মনে প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছি তাই।
“পিতামহ সমব্যক্তি এ ব্রহ্মাণ্ডে নাই”।।
দীন গ্রন্থকার এক করেছে দর্শন।
শ্রীগুরুচাঁদের কীর্তি বিপদভঞ্জন।।
প্রভুর চরিত্র লিখি হেন সাধ্য নাই।
যা করার গোপাল মোরে করিতেছি তাই।।
শত শত বিপদের দেখিয়া ভ্রুকুটি।
শ্রীগুরু চরিত লিখি বসে আমি খাটি।।
কোন পথে কোন ভাবে বিপদ পলায়।
সকল জানিতে মোর সাধ্য না কুলায়।।
জানিতাম গুরুচাঁদ পতিত পাবন।
এবে জানিলাম তিনি বিপদভঞ্জন।।
“শ্রীগুরু চরিত” তাই নাশে ভবভয়।
শ্রীগুরুচাঁদের এই আদি পরিচয়।।
তিনি কি করিলেন?
“ধর্ম সংস্থাপনার্থায় স্মভাববামি”
--- গীতা
আদি কাণ্ডে ধন্য প্রভু বড় দয়াময়।
ভিক্ষুক বালক রক্ষা করে কৃপাময়।।
এই কাণ্ডে করিলেন বিদ্যার অভ্যাস।
বাংলা শিখে আরবি শেখে মৌলোভীর পাশ।।
দশবর্ষ বয়সেতে পাঠ সমাপন।
গৃহে বসি শাস্ত্র গ্রন্থ করে অধ্যয়ন।।
দ্বাদশ বর্ষের কালে হ’ল পরিণয়।
ষষ্ঠবর্ষ নারী হ’তে প্রভু দূরে রয়।।
কঠোর সংযম শিক্ষা করে ভক্ত স্থানে।
সংসারের ভার প্রভু বহিলা আপনে।।
একুশ বর্ষের কালে জন্মিল নন্দন।
হরিচাঁদ রাখে নাম শ্রীশশিভূষণ।।
আদর্শ গৃহীর সাজে সাজিলেন প্রভু।
কোন কার্যে অলসতা নাহি করে কভু।।
গৃহীর পক্ষেতে ধন অতি প্রয়োজন।
প্রাণপণে করে প্রভু ধন উপার্জন।।
নৌকার চালান প্রভু বিদেশেতে দেয়।
পিতৃ-আজ্ঞামতে সব ব্যবসা চালায়।।
বাসিন্দা দোকান ঘর করিবারে চায়।
হেনকালে হরিচাঁদ দেহ ছেড়ে যায়।।
শক্তিরূপে হরিচাঁদ গুরুচাঁদে গেল।
“হরি-গুরুচাঁদতত্ত্ব” তারক কহিল।।
আপনারে ধরা দিতে প্রভু নাহি চায়।
গোস্বামী তারক আসি ঠেকাইল দায়।।
কারবার লাগি করে বাসিন্দা দোকান।
পুত্র কন্যা শিক্ষা নীতি অন্তরে প্রধান।।
আপনারে ঢাকে প্রভু ঐশ্বর্যের তলে।
ভাঙিল ভুলের চিন্তা গোলক পাগলে।।
রামভরতের সাথে ভাবালাপ করে।
নমঃশূদ্রে দিতে শিক্ষা প্রভু ইচ্ছা ধরে।।
আদি নমঃশূদ্র সভা দত্তভাঙ্গা গাঁয়।
জাতির লাগিয়া করে প্রভু দয়াময়।।
সেই সভা হ’তে হ’ল শিক্ষা আন্দোলন।
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে স্কুলের পত্তন।।
ওড়াকান্দি পাঠশালা করিল স্থাপন।
সেই হ’ল আদি শিক্ষা বীজের বপন।।
শ্রীশশিভূষণ তবে শিক্ষার উদ্দেশ্যে।
পিতার আজ্ঞায় চলে জয়পুর বাসে।।
রঘুনাথ সরকার পণ্ডিত সুজন।
প্রভুর ইচ্ছায় করে সেথা আগমন।।
মহাপ্রভু হরিচাঁদ পথ দেখাইল।
একদিন রঘুনাথ ওড়াকান্দি এল।।
আরম্ভ করিল প্রভু লগ্নী কারবার।
দেনায় পতিত জনে করেন উদ্ধার।।
শ্রীগিরীশ বসু আসি পরামর্শ করে।
“হাই স্কুল” করিবারে প্রভু বলে তারে।।
কুচক্রী ব্রাহ্মণ যত ফুকুরাতে বাস।
হিংসা করে নমঃশূদ্রে করে সর্বনাশ।।
বলে ক’য়ে গিরীশের মন ভাঙ্গি দেয়।
হাইস্কুল তার লাগি ফুকুরাতে যায়।।
দুঃখ পেয়ে নমঃশূদ্র একত্র হইল।
ওড়াকান্দি এম.ই. স্কুল স্থাপন করিল।।
প্রভুর প্রথম পুত্র শ্রীশশিভূষণ।
প্রধান শিক্ষক স্কুলে হইল তখন।।
জাতির উদ্ধার লাগি যাহা প্রয়োজন।
রাজশক্তি ধরিবারে প্রভু করে মন।।
শ্রীশশিভূষণে সেই উপদেশ দেয়।
সেই মর্মে শশি ফিরে হেথায় সেথায়।।
অক্ষয়ের সঙ্গে হ’ল আদি পরিচয়।
অক্ষয় রিপোর্টে সব মীডেরে জানায়।।
শশিবাবু ভীষ্মবাবু আদি কয়জন।
মীডের সঙ্গেতে গিয়ে করে আলাপন।।
ওড়াকান্দি মীড এল শ্রাবণ বেলায়।
ভীষ্মদেবে নাহি পেয়ে ফিরে যেতে চায়।।
স্বপ্ন ছলে কথা বলে শশিরে পাঠায়।
আসিল ডক্টর মীড প্রভুর আলয়।।
প্রভুকে দেখিয়া মীড মানিল বিস্ময়।
মনে মনে বলে “ইনি সামান্য ত’ নয়।।
আদি কাণ্ডে প্রভু সঙ্গে বাক্য দ্বন্দ্ব হয়।
সে সব না লিখিলাম গ্রন্থ বৃদ্ধি ভয়।।
ওড়াকান্দি এল মীড মিশন করিতে।
মনে মনে ইচ্ছা করে প্রভুকে ধরিতে।।
প্রভুর মনন তবে করিতে পরীক্ষা।
প্রভুর নিকটে মীড চাহে জমি ভিক্ষা।।
জমিদান করে প্রভু আনন্দিত চিতে।
রাজশক্তি দয়াময় ধরিলেন হাতে।।
গোপালপুরের দাঙ্গা হ’ল ভয়ঙ্কর।
ভয়ে নমঃশূদ্র সবে কাঁপে থর থর।।
ধান্য দূর্বা দিল অর্ঘ সে কমিশনারে।
সাহেব হইল সুখী নমঃশূদ্র ‘পরে।।
প্রভুর অপূর্ব কীর্তি জানি বটে ধন্য।
সাহেব ফিরিয়া এসে দিল তাঁরে মান্য।।
প্রভুকে বুঝিতে মীড বহু চেষ্টা করে।
ভবিষ্যতে বলে প্রভু মীডের গোচরে।।
তাহাতে মীসেস মীড “ধর্মপিতা” ডাকে।
মীড কি ধরিবে? প্রভু ধরিল তাহাকে।।
নমঃশূদ্র রাজকার্যে নহে অধিকারী।
প্রভু বলে “বল মীড উপায় কি করি?”
ছোটলাট ল্যান্সেলেটে মানপত্র দিল।
তার ফলে নমঃশূদ্র রাজকার্য পেল।।
আদি কাণ্ডে শশিবাবু সাব-রেজিস্টার।
শ্রীকুমুদ, রাধানাথ পেল পর পর।।
ওড়াকান্দি হাইস্কুল স্থাপিত হইল।
যত জমি নিজ হ’তে প্রভু সব দিল।।
ঊনিশ শ’ পাঁচ অব্দে বঙ্গ আন্দোলন।
প্রভুর বাক্যেতে শান্ত নমঃশূদ্রগণ।।
“চণ্ডাল” বলিয়া দেয় নমঃশূদ্রে গালি।
প্রভুর হইল ইচ্ছা গালি দিবে তুলি’।।
মীডকে কহিল “মীড উপায় কি বল?
চণ্ডালত্ব গালি গেলে পাই স্বর্ণফল।।”
ইতিপূর্বে “নমঃশূদ্র সুহৃদ” প্রকাশ।
করিলেন গুরুচাঁদ নিজে কীর্তিবাস।।
“সেন্সাস রিপোর্ট” নিতে মীড চাহে টাকা।
তালতলা খালে প্রভু হ’ল তবে বাঁকা।।
টাকা পেয়ে প্রভু তবে হৈল শান্ত মন।
তালতলা তীর্থ বলি হ’ল নিরূপণ।।
রিপোর্ট দেখিয়া মীড প্রভুকে জানায়।
নমঃকূলে বিধবার বিয়া দিতে হয়।।
ধর্ম কর্ম এক সঙ্গে করে সম্মিলন।
আদিতে ভক্তের এই পরীক্ষা গ্রহণ।।
বীর সাধু দেবী চাঁদ সাড়া দিল তায়।
স-শিস্য মিলিয়া বিয়া বিধবার দেয়।।
গোপাল সাধুর সঙ্গে হ’ল জানাজানি।
বিপিন আছিল সাথে সেই মত জানি।।
ফরিদপুরেতে হ’ল লাট দরবার।
নিমন্ত্রণ পেয়ে যান প্রভুজী সুন্দর।।
চণ্ডালত্ব মুছিবারে করে আন্দোলন।
দেশে দেশে এক হ’ল নমঃশূদ্রগণ।।
গেটের নিকটে গেল বহু “পিটিশন”।
লিখিল তাহাতে মীড প্রশংসা বচন।।
পুনরায় বঙ্গবাসী যত মিশনারি।
সাক্ষ্য লিখে পাঠাইল এক সঙ্গে করি।।
চণ্ডালত্ব গালি তা’তে মুছিয়া ফেলিল।
“নমঃশূদ্র সুব্রাহ্মণ” বলিয়া লিখিল।।
ঊনিশ শ’ বারো অব্দে দিল্লী দরবার।
“রূপার মেডেল” প্রভু পেল উপহার।।
লাট ডাকিলেন বলি “নমঃশূদ্র পতি”।
যার পরশনে জাগে নমঃশূদ্র জাতি।।
দেহত্যাগ করি চলে গেল সে সুরেন্দ্র।
“নমঃশূদ্র সুহৃদ” পরে হয়ে গেল বন্ধ।
খ্রিষ্টান হইবে বলে প্রভু করে ভাণ।
দেশবাসী সবে তা’তে বহু দুঃখ পান।।
চৌধুরী শ্রীবিশ্বেশ্বর হইল খ্রিষ্টান।
ফিরিয়া দাঁড়া’ল তবে প্রভু গুরুচান।।
ঊনিশ শ’ চৌদ্দ অব্দে বাধিল সমর।
রাজার সাহায্য করে প্রভু গুণাকর।।
খ্রিষ্টানের সঙ্গ ত্যাগ প্রভুজী করিল।
পুনরায় দশভুজা পূজারম্ভ হ’ল।।
“হরিলীলামৃত” গ্রন্থ মুদ্রণ কারণ।
বহু চেষ্টা করিলেন তারক সুজন।।
ভার দিয়া হরিবরে দেহ তেয়াগিল।
হরিবর বহু চেষ্টা পরেতে করিল।।
প্রভুর লীলার তত্ত্ব কে বুঝিল কবে?
কে জানে সে কোন ভাবে কা’রে কি সাজাবে?
আসিল গোপাল সাধু উদার পরাণ।
“লীলামৃত” ছাপিবারে অর্থ করে দান।।
গোপালে চিনিল ভাল প্রভু রসময়।
দয়া করে লক্ষ্মীখালী গেল দয়াময়।।
ইতিপূর্বে মাঝে মাঝে যায় ভক্তালয়।
বানীয়ারী চাঁদকাঠি দুই বার যায়।।
যেথা যায় সেথা কয় জাতির উন্নতি।
অপূর্ব শিক্ষায় দীক্ষা পেল এই জাতি।।
রথযাত্রা উৎসবের করে আয়োজন।
“জগবন্ধু” শক্তি প্রভু করে আকর্ষণ।।
তের শ’ পঁচিশ সালে শ্রীশশিভূষণ।
অকালে ত্যজিয়া গেল মরত ভুবন।।
তের শ’ ছাব্বিশ সালে মহাঝড় হয়।
শত শত নরনারী তা’তে মারা যায়।।
অন্নহীন জনে প্রভু অন্ন করে দান।
লাটমন্ত্রী গুরুচাঁদে জানায় সম্মান।।
নূতন শাসন নীতি আসিল ভারতে।
অসহযোগের পথে গান্ধী চলে তা’তে।।
ভারত ব্যাপিয়া চলে সুদৃঢ় আন্দোলন।
অনুন্নত জনে প্রভু করে নিবারণ।।
“দেশবন্ধু চিত্তবীর” লিখিলেন পত্র।
উত্তর দিলেন প্রভু তার ছত্রে ছত্র।।
পিছনে রয়েছে যারা তা’ দিগে বিশেষ।
ভ্রাতৃজ্ঞানে জাগাইতে দিল উপদেশ।।
চিরতরে মীড গেল এদেশ ছড়িয়া।
শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিল পত্রেতে লিখিয়া।।
“শ্রীহরি মন্দির” তবে হইল পত্তন।
খুলনা জিলায় নমঃশূদ্র সম্মেলন।।
দয়াময় গুরুচাঁদ তথা সভাপতি।
বহুত কহিল কথা নমঃশূদ্র প্রতি।।
খুলনা হইতে গৃহে ফিরে দয়াময়।
পদ্মবিলা দাঙ্গা হ’ল সামান্য কথায়।।
“যথা ধর্ম তথা জয়” প্রভু দিল ভীর।
ধর্মযুদ্ধে জয়ী হ’ল নমঃশূদ্র বীর।।
“দাঙ্গা মন্দ অতিশয়” প্রভু ডাকি বলে।
ভাই ভাই এক হও একভাবে চলে।।
গোপালগঞ্জেতে এল লাট মহোদয়।
স্বজাতি লইয়া প্রভু ‘মানপত্র’ দেয়।।
কলিকাতা বসে পড়ে প্রমথরঞ্জন।
বিলাত পাঠাতে তারে প্রভু করে মন।।
মুখ ফুটে নাহি বলে বিবাদের ভয়।
কমলাকান্তের কাছে সেই কথা হয়।।
তথাপি প্রস্তাব হ’লে পড়ে কিছু বাধা।
মেঝে বাবু কহিলেন কথা আধা আধা।।
প্রভুর যতেক ভক্ত মতুয়া উপাধি।
প্রভুর কর্মেতে তারা বাধ্য নিরবধি।।
ওড়াকান্দি এসে তারা সব কথা শোনে।
মন্ত্রণা করিল সবে বসে একস্থানে।।
(গ্যাপ)
বিলাতের যত ব্যয় তাহারা জোগা’বে।।
ভক্তের পরীক্ষা করে নিজে চক্রধর।
বলে “টাকা দিতে হ’বে চৌদ্দটি হাজার।।”
গোপাল দাঁড়া’য়ে বলে জোড় করি পাণি।
“সব টাকা আমি দিব ওহে গুণমণি”।।
সব মতুয়ারা বলে মোরা অংশীদার।
বিলাতে পাঠাতে চিন্তা নাহি কর আর।।
বিলাতে চলিয়া গেল প্রমথরঞ্জন।
সুধন্য কুমার পরে ত্যজিল জীবন।।
সর্বকর্ম ছাড়ি প্রভু আত্মতত্ত্বে রয়।
দিবারাত্রি “হরি কথা” কৃষ্ণ কথা কয়।।
প্রমথরঞ্জন দেশে ফিরিয়া আসিল।
কলিকাতা হাইকোর্টে ব্যবসা করিল।।
স্বয়ং সতী সত্যভামা জগত জননী।
জীবলীলা সাঙ্গ করি চলিলেন তিনি।।
প্রমথরঞ্জন করে শুভ পরিণয়।
হেনকালে বঙ্গদেশে ‘নির্বাচন’ হয়।।
পরিষদে সভ্য হ’ল প্রমথরঞ্জন।
ইচ্ছা করে যেতে প্রভু “নিজ নিকেতন”।।
পিতামহ পদে নিষ্ঠা প্রমথ রাখিল।
আশীর্বাদ ছলে প্রভু তারে শক্তি দিল।।
আসন সাজায়ে ঋতু বসন্ত আসিল।
পূর্ণ চন্দ্র গুরুচন্দ্র অস্তাচলে গেল।।
তিনি কি বলিলেন?
“ক্ষুরস্য ধারয়া নিশিত্যয়া, দুর্গমং পথস্তৎ কবয়োঃ
বদন্তিঃ নাহন্যো বিদ্যতে পন্থায়নায়”-উপনিষদ
এই খণ্ডে গুরুচাঁদ নীতিতত্ত্ব সার।
যাহা মান্য করে’ জীব লভিবে উদ্ধার।।
মানব-জীবন তত্ত্বে কি কি কথা কয়।
সে সব বর্ণিব আমি শ্রীগুরু কৃপায়।।
“আর্য সাধনার ভিত্তি মানব জীবনে।”
যুগ অনুসারে গড়’ গুরুচাঁদ ভণে।।
“গার্হস্থ্য আশ্রম শ্রেষ্ঠ” প্রভু কহে ডাকি।
“সামাল, সামাল, গৃহী” বলে থাকি থাকি।।
কিসে নষ্ট গৃহাশ্রম কিসে ভাল রয়?
জনে জনে ক্ষণে ক্ষণে প্রভু ডেকে কয়।।
“ব্যভিচারে গৃহ নষ্ট” প্রভু বলে তাই।
“ব্যভিচারী হ’লে তার আর রক্ষা নাই।।”
কা’রে বলে ব্যভিচার কিসে তাহা হয়?
দিবারাত্রি বলে প্রভু সকল সময়।।
নিজ নারী ভিন্ন অন্য নারীতে গমন।
মহাপাপী ব্যভিচারী সেই একজন।।
দিকে দিকে দেখি যাহা তা’তে দুঃখে মরি।
নাহি জ্ঞান লঘু গুরু কিংবা মাসী খুড়ী।।
পরনারী সঙ্গে যেবা করে ব্যভিচার।
কিছুতে নরকে তার নাহিক উদ্ধার।।
এই বটে একজন আছে অন্য আর।
নিজ ঘরে ব্যভিচারী প্রায় সব নর।।
“পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যাঃ শাস্ত্রের বচন।
অকারণ কর কেন নারীতে গমন?
সন্তানের বাঞ্ছা যদি কর নিজ মনে।
ঋতুকালে কর সঙ্গ নিজ নারী সনে।।
তার জন্যে শাস্ত্রে দেখ রয়েছে বিধান।
“রতিশাস্ত্র নাম তার শাস্ত্রের বিধান।।
রতিশাস্ত্রে জ্ঞান যার নাহি কোন দিন।
কিছুতে ঘোচে না তার চিত্তের মলিন।।
কৃষ্ণ বহু শিক্ষা কৈল সান্দিপনি স্থানে।
“রতিশাস্ত্র শ্রেষ্ঠ বলি কৃষ্ণ সেথা ভণে।।
কালাকাল দোষে কত ঘটে বিপর্যয়।
কেহ কানা কেহ খোঁড়া কেহ বোবা হয়।
অধিকাংশ জন্মদোষে জানিবে নিশ্চয়।।
“রতিশাস্ত্রে অজ্ঞ জনে সেই ফল পায়।
বিস্তৃত সেসব যদি জানিবারে চাও।
রতিশাস্ত্র গ্রন্থ মধ্যে পরিচয় লও।।
সংক্ষেপে যা’ বলি আমি শুন সর্বজন।
কি ভাবে চলিবে সদা নরনারীগণ।
ঋতুকাল ভিন্ন নাহি কর নারী সঙ্গ।
অন্যকালে নারী সঙ্গ গৃহ-ধর্ম ভঙ্গ।।
ঋতু আদ্যে তিনদিন কর পরিহার।
যত বেশী দিন যাবে তত উপকার।।
ষোড়শ দিনের মধ্যে শুভ একদিনে।
আনন্দে বিহার কর নিজ পত্নী সনে।।
পূর্ণিমা কি অমাবস্যা কিংবা রবিবার।
বৃহস্পতিবার ধর সঙ্গে সঙ্গে তার।।
সন্ধ্যা কিংবা প্রাতঃকালে কিংবা দিনমানে।
দেবালয়ে, ঘাটে, পথে অথবা শ্মশানে।।
দুঃখিতা পীড়িতা কিংবা শোকাকুলা জেনে।
সেই জনে এই কালে কিংবা এই দিনে।।
নারী সঙ্গ করিবারে রতিশাস্ত্রে মানা।
নরমাত্রে এই গুলি থাকা চাই জানা।।
সু-প্রশস্ত বুধবার জানিবে সকলে।
পতি সঙ্গে রবে সতী গাঢ় নিশাকালে।।
সু-পুত্র লাগিয়া দোঁহে মিলি পতি সতী।
আকুল পরাণে ডাক জগতের পতি।।
এই আচরণ ভিন্ন অন্য পথে চলে।
নিজ ঘরে ব্যভিচারী শাস্ত্রে তারে বলে।।
ঘরে ঘরে এই রূপে হয় ব্যভিচার।
ব্যভিচার হ’লে শোন কিবা ফল তার।।
ব্যভিচারে ধ্বংস নাশ শাস্ত্রের বচন।
ব্যভিচারে ধ্বংস হ’ল রাজা দশানন।।
যেই জন করে সদা ব্যভিচার পাপ।
পিতৃ-পুরুষেতে সদা তারে দেয় শাপ।।
ব্যভিচারী জনে কেহ বিশ্বাস না করে।
ব্যভিচার দোষে কত জীব দেখ মরে।।
লজ্জা ভয়ে ব্যভিচারী ভ্রূণহত্যা করে।
পাপের আগুন জ্বলে ব্যভিচারী ঘরে।।
সামাল! সামাল! তাই সামাল সবাই।
ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু আর রক্ষা নাই।।
ব্যভিচার দোষ হ’তে মুক্তি যদি চাও।
একমাত্র ঋতুকালে নারী পাশে যাও।।
কোন নীতি নিয়ে চলে যত ‘রাজ হংস’।
বর্ষ মধ্যে একদিনে রক্ষা করে বংশ।।
রাজহংস নীতি মানে যে পরমহংস।
ধর্মাত্মা পুণ্যাত্মা সেথা হয় অবতংস।।
আপন পত্নীরে রাখ এই ধর্মে অংশী।
পতি সাজ রাজহংস সতী রাজহংসী।।
মম পিতা হরিচাঁদ বলে যে ভারতী।
সেই নীতি মান তোরা যত সৎ সতী।।
“পর পতি পর সতী স্পর্শ না করিবে।
না ডাক’ হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।।”
কোন কথা বলেছিল দ্রুপদ নন্দিনী।
নারী পক্ষে সেই নীতি শ্রেষ্ঠ বলে মানি।।
অপরের পদে হাত কভু নাহি দেব।
অপরের উচ্ছিষ্ট দিলে তাহা নাহি খাব।।
কায়মনে বাক্যে কিংবা আহারে বিহারে।
পতি ভিন্ন স্পর্শ নাহি কর অন্য নরে।।
দৈনিক জীবন পথে যত নারী নর।
কিভাবে চলিবে বলি শুন অতঃপর।।
ব্রাহ্ম মুহূর্তের কালে শয্যা ছাড়ি দাও।
পতি পত্নী এক সঙ্গে হরিগুণ গাও।।
পতিরে প্রণাম করি কর প্রাতঃস্নান।
শ্রীহরি মন্দিরে পূজা কর অধিষ্ঠান।।
নর নারী প্রাতঃস্নান অবশ্য করিবে।
দেহ শুদ্ধি চিত্ত শুদ্ধি সকলি আসিবে।।
নরগণে গুরুজনে করিবে প্রণাম।
কোন ফল প্রাপ্তি নাহি গুরু হ’লে বাম।।
স্নান দানে শৌচাচারে সুসভ্য হইবে।
অপবিত্র ভাবে কেহ কভু না চলিবে।।
রাস্তাঘাট পায়খানা কর বন্দোবস্ত।
এ সব জিনিষ কিন্তু লাগিবে প্রশস্ত।।
লজ্জা বটে নারী পক্ষে একটি ভূষণ।
অনর্থক লজ্জা কিন্তু নিন্দার কারণ।।
বীর-মাতা হ’তে হ’লে হও বীরাঙ্গনা।
ব্যাঘ্র সিংহ দেখে যেন হৃদয় টলে না।।
সতীত্ব তেজেতে ঘেরা যার দেহ মন।
কামুক পশুরে ভয় করে না কখন।।
জননী সাজিয়া সবে কর শুভদৃষ্টি।
তোমারে দেখিয়া বিশ্বে হোক শান্তি বৃষ্টি।।
‘সুপাক’ নারীর পক্ষে অতি বড় গুণ।
গৃহস্থালি সর্বকর্মে সাজিবে নিপুণ।।
অবসর কালে কর ধর্মগ্রন্থ পাঠ।
ঘর দ্বারা বিছানাদি রাখ ফিটফাট।।
নর নারী যেবা হও মিথ্যা বলিবে না।
সত্য ভিন্ন ধর্ম বৃক্ষে ফল ফলিবে না।।
নরে করে সাধু পথে অর্থ উপার্জন।
অর্থ আয়ে মানামান ভেব না কখন।।
যথা তথা থাকে অর্থ তারে টেনে লও।
সৎ পথে ভিন্ন অন্য পথে নাহি চাও।।
বিদ্যা ভিন্ন মানবের গতি নাহি আর।
অজ্ঞ যেন নাহি থাকে তোমাদের ঘর।।
বালক বালিকা সবে শিক্ষা কর দান।
খাও বা না খাও সবে কর গে’ বিদ্বান।।
অলস লোকের তুল্য পাপী কেহ নাই।
“অলসের নাম চোর” শাস্ত্রে বলে তাই।।
কাজ করিলে ‘কাজী’কয়, না করিলে ‘পাজী’।
পাজী ছেড়ে রাজী হ’য়ে হও কাজে কাজী।।
কর্ম কা’রে বলে শোন সেই পরিচয়।
স্তরভেদে কর্ম দেখ তিন প্রকার রয়।।
সুকর্ম বলিয়া ব্যাখ্যা গীতা তারে করে।
জীবের কল্যাণ যাহা আনে ধরা’পরে।।
কুকর্ম বলিয়া ব্যাখ্যা গীতা যারে কয়।
জীবের মঙ্গলনাশী অশুভ নিশ্চয়।।
শুভ নষ্ট করে যাহা অমঙ্গল আনে।
অকর্ম অলস তাহা থাকে গৃহ কোণে।।
সুকর্ম করিতে সবে হও অগ্রসর।
কর্ম ভিন্ন কোথা নাহি মিলিবে উদ্ধার।।
সামাজিক নীতি সব শোন ভক্তজন।
‘জাতিভেদ’ প্রথা নাহি মানিবে কখন।।
জাতিভেদ কা’রে বলে বলিতেছি তাই।
জন্মগত সামাজিক ভেদ যাহা পাই।
মতুয়ার নীতি এই শোন সর্বজন।
কুলে, বংশে, ধনে, মানে হোক হীনজন।।
চরিত্রে পবিত্র যদি সেই ব্যক্তি হয়।
তার অন্ন খেলে দিলে দোষ নাহি তায়।।
লৌকিক সম্বন্ধে যদি আপন স্বজন।
চরিত্রেতে পবিত্রতা না করে রক্ষণ।।
তার সাথে বসা খাওয়া মতুয়ার নাই।
জাতিভেদ বলিলে ত’ এই অর্থ পাই।।
আর এক কথা আমি বলিব এখানে।
“শ্রীহরি মন্দির” গড়’ প্রতি জনে জনে।।
শ্রীহরি মন্দির শোন কিবা করে দান?
বলিতেছি আমি এক পুরাণ আখ্যান।।
রতি, মতি দুই ভাই ছিল এক দেশে।
এক সাথে দুই ভাই আছে বটে মিশে।।
রতি বড় মতি ছোট ঘরে দুটি বউ।
কোন কাজে কোন ভাবে দুঃখী নয় কেউ।।
কালে কালে সে রতির হ’ল ছেলেপিলে।
সে সব বালাই নাই মতির কপালে।।
রতির গৃহিণী ছিল দুষ্ট সরস্বতী।
মতির গৃহিণী কিন্তু অতি নিষ্ঠাবতী।।
পতি পত্নী দুইজনে উভয়ে সরল।
রতির গৃহিণী কিন্তু উঠাল গরল।।
মতিরে সকলে বলে ‘বলদা’ গোঁসাই।
মতির পত্নীরে ‘বলদী’ বলিত সবাই।।
সরল মতির কিছু যোগ্যতা না ছিল।
স্নেহবশে রতি তারে যতনে পালিল।।
রতির গৃহিণী তা’তে ভাবে মনে মন।
এগুলিকে খেতে আমি দেই কি কারণ?
পৃথক করিতে তাই করে আয়োজন।
রতি কিন্তু তা’তে রাজী হ’ল না কখন।।
দুষ্ট নারী শেষে করে কত চাতুরালী।
ক্রমে ক্রমে রতি কিন্তু গেল শেষে ভুলি।।
মতিরে পৃথক করে দিল তার ভাই।
ভাগে মতি পেল মাত্র এক বুড়া গাই।।
কুঁড়ে ঘরে পতি পত্নী রহে এক ঠাই।
সতীর গুণেতে দেখ কোন দুঃখ নাই।।
‘বলদী’ সরলা অতি পতি-নিষ্ঠাবতী।
পতিসুখ বিনা চিন্তা নাহি করে সতী।।
‘বলদা’ সরল দেখে জুটিল কুচক্রী।
তারা বলে “তোর পক্ষে এনে দেব ডিক্রী।।
আট আনা অংশীদার সম্পত্তিতে তুই।
তা’তে কিনা নাহি দিল এক তোলা ভুই।।
কোন ভয় নাই তোর মোরা আছি সঙ্গে।
দাদাকে দেখা’ব তোর ফেলিয়া তরঙ্গে।।
আমাদের সঙ্গে চল উকিলের বাড়ী।
চল চল লাগিবে না কোন টাকাকড়ি।।
‘বলদা’ ভাবিল ‘এ’ ৎ কথা মন্দ নয়।
দেখা যাক এই কাজে কি ফল দাঁড়ায়।।”
এত ভাবি সে ‘বলদা’ চলে তাড়াতাড়ি।
উপস্থিত হল এক উকিলের বাড়ী।।
দালালের সঙ্গে সায়ে উকিল তখন।
“পাঁচ শত টাকা লাগে” করে উচ্চারণ।।
‘বলদা’ বলিছে “আমি টাকা কোথা পাই!
বুড়া এক গরু ছাড়া আর কিছু নাই।।”
সকল দালালে বলে “এক কাজ কর।
যে কাগজ দেই তাহা হাতে নিয়ে ধর।।
এক টিপ মাত্র তুমি দাও এর পরে।
বাবুজী করিবে যাহা ভাল মনে করে।।”
‘বলদা’ হইলে দেখ তারে মারা দায়।
আপনি তাহারে রক্ষা করে দয়াময়।।
কি জানি কি ভাবি ‘বলদা’ বলিল তখনে।
“আজ থাক দেখি কাল কিবা হয় মনে।।”
এ কাজ করিতে গেছে বেলা গড়াইয়া।
এ দিকে সে ‘বলদী’ আছে পথেতে চাহিয়া।।
কোথা গেল প্রাণনাথ! প্রাণ উচাটন।
ঘরে কি বাইরে ‘বলদী’ ফেরে ঘন ঘন।।
হেনকালে দেখে দূরে আসিতেছে পতি।
পাদ্য অর্ঘ্য আনে শীঘ্র সেই নিষ্ঠাবতী।।
যখন আসিল ‘বলদা’ গৃহের মাঝারে।
‘বলদী’ ধোয়ায় পদ অতি যত্ন করে।।
আপন অঞ্চলে তার পদ মুছে দেয়।
বহু যত্নে দিল তেল যে ‘বলদা’র গায়।।
স্নান করি সে ‘বলদা’ সুস্থ যবে হ’ল।
ক্ষীর এনে সে ‘বলদী’ তারে খেতে দিল।।
আহারান্তে সে ‘বলদা’ করিল শয়ন।
‘বলদী’ করিছে তার চরণ সেবন।।
ধীরে ধীরে ‘বলদা’রে তার নারী কয়।
“বল দেখি এতক্ষণ আছিলে কোথায়?”
সরল লোকের মনে কোন গোল নাই।
‘বলদী’রে সব কথা খুলে বলে তাই।
‘বলদী’ বলিল “হেন কাজ নাহি কর।
আমি বলি এই কাজে তুমি আজ হার।।
আপনার বড় ভাই নিয়েছে বিষয়।
রাগ করে তাই নাকি কেড়ে নেয়া যায়?
কুচিন্তা ছাড়িয়া যাহা বলি কর তাই।
তোমাকে পশ্চিমে আমি পাঠাইতে চাই।।
সেইখানে কর তুমি যে কোন চাকুরী।
যাহা হ’বে তাহা দিয়ে চালাবেন হরি।।”
‘বলদা’ বলিছে “তুমি শোন মোর ‘বলদী’।
কথাবার্তা সব তুমি বল বটে জলদি।।
মনে কেন কর সেই এক কথা।
তোমার এ ‘বলদা’টির নাহি যে যোগ্যতা।।”
‘বলদী’ কহিছে “তুমি জান না গোঁসাই।
কত কাজ আছে যা’তে বেশী কষ্ট নাই।।
ছেলে মেয়ে রাখা কিংবা ঘরে দে’য়া ঝাট।
আসবাবপত্র সব রাখা ফিটফাট।।
এর জন্যে বড় লোকে রাখে দাসদাসী।
অল্প অল্প কাজ তা’তে কষ্ট নাই বেশী।।”
সতীর কথায় ‘বলদা’ সাহস করিল।
পরদিন যাবে বলে কথা ঠিক হ’ল।।
যাত্রাকালে সে ‘বলদী’ পদে পড়ে কয়।
“যেথা ইচ্ছা সেথা যাও নাহি কোন ভয়।।
কিন্তু এ মিনতি আমি চরণে জানাই।
মাসান্তে তোমারে দেখা যেন আমি পাই।।”
স্বীকার করিয়া ‘বলদা’ রওনা হইল।
তার দিকে চেয়ে সতী কতই কান্দিল।।
ঠাকুরের কাছে ‘বলদী’ কেন্দে কেন্দে কয়।
“আমার স্বামীকে রক্ষা করো দয়াময়।।
অবোধ সরল লোক নাহি চেনে পথ।
দয়া করে প্রভু তুমি থেক’ তার সাথ।।”
কতদূর গিয়ে ‘বলদা’ ভাবে মনে মন।
মিছামিছি শহরেতে যাব কি কারণ?
আমারে দেখিয়া কেহ চাকুরী না দিবে।
শুধু শুধু যেয়ে বল কোন ফল হ’বে?
এত ভেবে ‘বলদা’র মনে দুঃখ হ’ল।
কান্দিতে কান্দিতে ‘বলদা’ বনে চলে গেল।।
বনমধ্যে গিয়ে দেখে একটি মন্দির।
আপনার ভাবে আছে দাঁড়াইয়া স্থির।।
লোকজন কেহ নাই একেলা মন্দির।
কি যেন কি ভাব ধরে রয়েছে গম্ভীর।।
মন্দিরের মধ্যে ‘বলদা’ দেখিল ঢুকিয়া।
পূজার যতেক দ্রব্য রয়েছে পড়িয়া।।
‘বলদা’ ভাবিল “মোরে ডেকেছে শ্রীহরি।
শ্রীহরি মন্দিরে আমি করিব চাকুরী।।”
এত ভাবি সেইখানে সে বলদা তখন।
পূজার বাসন সব করিল গ্রহণ।।
নিকটে পুকুর ছিল গিয়া তার জলে।
পরিষ্কার করে সব অতি কুতূহলে।।
ধূপ দীপ জ্বালাইয়া দিল পুষ্পাঞ্জলি।
হরিকে ডাকিয়া বলে করে কৃতাঞ্জলি।।
“তোমার চাকুরী আমি করিব শ্রীহরি।
মাস গেলে দিও মোরে মাহিনার কড়ি।।”
অলক্ষ্যে হাসিল তাই দয়াল ঠাকুর।
সরল মনের কথা করিল মঞ্জুর।।
এইভাবে প্রতিদিন ‘বলদা’ গোঁসাই।
শ্রীহরি মন্দিরে পূজা করে এক ঠাই।।
মন্দির মার্জনা করে জলে ধৌত কড়ি।
মন্ত্র তন্ত্র নাহি শুধু বলে হরি! হরি!
প্রতিদিন প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করি।
পূজা করে সে ‘বলদা’ স্নানাহ্নিক সারি।।
স্নান সেরে এসে দেখে যেন কোন জন।
নানাবিধ ফল রেখে গিয়েছে কখন।।
পূজা সেরে সেই ফল করে সে ভক্ষণ।
সেই ফলে ক্ষুধা তার হয় নিবারণ।।
এইভাবে এক মাস গত হ’তে যায়।
শেষ দিনে সে ‘বলদা’ পূজাকালে কয়।।
“ওহে হরি! আজ মোর এক মাস হয়।
মাহিনাটা দিয়ে দাও ওহে দয়াময়।।
আর এক কথা আমি বলি তব ঠাই।
তব পদে তিন দিন আমি ছুটি চাই।।
সরলা অবলা মোর গৃহিণী ‘বলদী’।
তারে টাকা দিয়ে আমি ফিরিব যে জলদি।।”
পর দিনে সে ‘বলদা’ পূজা সাঙ্গ করি।
বাহিরে আসিছে মুখে বলে হরি হরি।।
হেনকালে এক ডাল এল নোয়াইয়া।
‘বলদা’র বুকের কাছে রহিল থামিয়া।।
সোনার মোহর এক তাতে ঝুলে রয়।
‘বলদা’ ভাবিল হরি মোরে কড়ি দেয়।।
সোনার মোহর ‘বলদা’ খসায়ে রাখিল।
হরি! হরি! হরি বলে গৃহেতে চলিল।।
এদিকে ‘বলদী’ সতী সারা মাস ধরে।
সর্বদা প্রার্থনা করে করজোড়ে করে।।
“আমার পতিরে রক্ষা কর দয়াময়।
না জানি আমার পতি রয়েছে কোথায়।।
চাকুরী করিয়া পতি যেন অর্থ পায়।
পাক বা না পাক টাকা সুস্থ যেন রয়।।”
মাস গত সতী নারী পথ পানে চায়।
হেনকালে সে ‘বলদা’ আসিয়া উদয়।।
পূজিয়া পতির পদ পরম পুলকে।
জিজ্ঞাসা করিল “প্রভু আছিলে ত’ সুখে।।”
‘বলদা’ বলিল তারে সব বিবরণ।
শুনিয়া ‘বলদী’র তবে ঝরিল নয়ন।।
অতঃপর পতি পত্নী সে মন্দিরে যায়।
দুইজনে পূজা করে মহাসুখে রয়।।
প্রতিমাসে পায় তারা সোনার মোহর।
পতি পত্নী দুইজনে নাহিক দোসর।।
বহু বিত্তশালী তারা হইল যখন।
প্রভুর আদেশে দেশে করিল গমন।।
তাই বলি ঘরে ঘরে গড় হে মন্দির।
সকাল সন্ধ্যায় হেথা নামে দাও ভীর।।
শ্রীহরি মন্দিরে পূজা করিবে কাহার?
শুন সবে বলি আমি সেই সমাচার।।
বিশ্ব ভরে’ এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।
মম পিতা হরিচাঁদ ক্ষীরোদ ঈশ্বর।
দয়া করে এ জগতে হ’ল অবতার।।
দলিত পীড়িত যত পতিত মানব।
তাঁর কৃপাগুণে রক্ষা পাইয়াছে সব।।
তাঁর পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।
শ্রীহরি মন্দিরে তাঁর মূরতি সাজাও।।
“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” সর্ব শাস্ত্রে কয়।
সদভাবে কর সবে সাধু ব্যবসায়।।
বিবাহ শ্রাদ্ধেতে সবে কর ব্যয় হ্রাস।
শক্তির চালনা সবে রাখ বারমাস।।
আত্মরক্ষা শক্তি সবে অবশ্য রাখিবে।
অগ্রভাগে কভু কা’রে আঘাত না দিবে।।
কেহ যেন নাহি হও ‘গোলামের জাতি’।
চিরকাল হাল-গরু থাকে যেন সাথী।।
হাল-গরু ছাড়া কিন্তু বুদ্ধি সর্বনাশা।
সকলের রক্ষাকর্তা হাল-চষা চাষা।।
শক্তি না দেখিলে কেহ করে না সম্মান।
শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান।।
সহজ জীবন পথে চলিবে সকলে।
দুর্বলতা থাকে কিন্তু বিলাসিতা কোলে।।
গড়া-সিদ্ধ চাল খেয়ে চাটায়ে শয়ন।
সে বীর্যে জন্মিবে ধ্রুব তেজস্বী নন্দন।।
ধনহীন বিদ্যাহীন যারা এই ভবে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা শান্তি নাহি পাবে।।
আত্মোন্নতি অগ্রভাগে প্রয়োজন তাই।
বিদ্যা চাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই।।
দুর্বলে সবলে যদি করিবে মিলন।
সবলে বাড়িবে বলে দুর্বলে মরণ।।
স্বল্প নিদ্রা মানবের সুখের কারণ।
মৃত্যুজয়ী এই ভবে ‘অতন্দ্র যে জন’।।
নিশাকালে খণ্ড-হস্তে উগ্রচণ্ডা ধায়।
নিদ্রায় অবশ যেবা তারে করে ক্ষয়।।
‘অতন্দ্র’ যেজন আছে বীরের স্বভাবে।
উগ্রচণ্ডা তারে পূজা করে নম্র ভাবে।।
ভেকধারী বৈরাগীরে ভিক্ষা নাহি দিবে।
ভিক্ষা দিলে ব্যভিচার বাড়িয়া চলিবে।।
দীক্ষা, শিক্ষা, কোন কিছু নাহি প্রয়োজন।
হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বক্ষণ।।
ব্রাহ্মণ কি অধিকারী দীক্ষা গুরু যারা।
ফাঁকি দিয়ে প্রণামীর টাকা নেয় তারা।।
অজ্ঞান আঁধার যিনি করিবে উজ্জ্বল।
তিনি গুরু তাঁর কাছে আছে মোক্ষফল।।
দীক্ষা ত স্বীকৃতি মাত্র ‘হব আমি ভাল’।
‘হব ভাল, র’ব ভাল, ক’ব আমি ভাল’।।
ভাল কারে বলে বাপু কিসে ভাল হয়?
“ভাল হলে ভাল হবে মোর পিতা কয়।।”
মনে যাহা বলে ইহা মোটে ভাল নয়।
সেই কার্য কোনক্রমে কর না নিশ্চয়।।
গুরু নামে গুরু বিত্ত করিয়া গ্রহণ।
আত্মসাৎ করে যদি কোন অভাজন।।
আপনি ঈশ্বর যদি থাকেন সহায়।
তথাপি পতন তার জানিও নিশ্চয়।।
যত বড় সাধু কিংবা গুরু হন তিনি।
যত হোক বড় বড় কথার গাঁথুনি।।
ছিদ্র পাত্রে জল বিন্দু যথা নাহি রয়।
সাধুত্ব, গুরুত্ব, তার মহাপাপে ক্ষয়।।
অধিক কি কব গুরু বিত্ত অপহারী।
গণ্য করি গুরু পত্নী অপহরণকারী।।
সামাল! সামাল! তাই মতুয়ারগণ।
‘হাজৎ’ কখনও কেহ কর না হরণ।।
মতুয়ার পক্ষে কোন পূজা পর্ব নাই।
শ্রীহরি মন্দিরে নিত্য পূজা করা চাই।।
মতুয়ার এক গুরু ভিন্ন গুরু নাই।
ওড়াকান্দি প্রভু যিনি ক্ষীরোদের সাঁই।।
মধ্যস্বত্ব জমিদারী ধর্মক্ষেত্রে নাই।
ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ কর না গোঁসাই।।
যিনি ধরে আনে দলে তাঁর ‘ধরা’ হয়।
ঠাকুরের কাছে গেলে তারে ‘মরা’ কয়।।
‘ধরা’ ‘মরা’ দুই কথা দুই ভাবে রয়।
‘মরা’ হ’তে ‘ধরা’ কভু শ্রেষ্ঠ নাহি হয়।।
কত জনে বড় হয় কহিয়া দোঁহাই।
বিদ্রোহী সাজিয়া দেখ আর পাত্তা নাই।।
এক দ্বীপ হ’তে বহু দ্বীপের জনম।
মূল দ্বীপ তবু সদা করিবে পূজন।।
নেড়া নেড়ী বৈরাগীর ধর্ম এই নয়।
নারী দিয়ে অঙ্গ সেবা হবে ধর্ম ক্ষয়।।
তেল ঘষা, অঙ্গ সেবা মহা ব্যভিচার।
স্পর্শই করিতে মানা তেল ঘষা তাঁর!
পরনারী মাতৃজ্ঞানে দূরেতে থাকিবে।
পরিহাস বাচালতা কভু না করিবে।।
মদ, গাজা নাহি খাবে করিবে না চুরি।
তাস, দাবা, জুয়াখেলা সব দাও ছাড়ি।।
হরি বলে ডঙ্কা মার শঙ্কা কর কারে?
শ্রীহরি সহায় হয়ে সাথে সাথে ফেরে।।
পর দোষ ছেড়ে সদা নিজ দোষ কও।
আত্মগুণ ফেলে রেখে হরিগুণ গাও।।
পবিত্র চরিত্রে যেথা রহে নরনারী।
সত্য কথা সত্য ভাব রয়েছে প্রহরী।।
শ্রীহরি মন্দিরে যেথা নিত্য সংকীর্তন।
ধন্য সতী সদা করে পতির পূজন।।
ঘর দ্বার পরিষ্কার আশ্রমের প্রায়।
‘পুণ্যতীর্থ’ বলি তারে সাধু জনে কয়।।
সেই তীর্থে বাস করে লক্ষ্মী নারায়ণ।
বেদের বচন ইহা না হবে লঙ্ঘন।।
পবিত্রতা, সত্যবাক্য, মানুষে বিশ্বাস।
তিন রত্ন যার আছে হরি তার বশ।।
শ্রীহরি এনেছে ইহা বিশ্বের দুয়ারে।
বিশ্ব ভরে’ এই ভাব হোক ঘরে ঘরে।।
সে ধর্ম যাজন যেবা করে মনে প্রাণে।
দেবের দুর্লভ শান্তি লভে একদিনে।।
সর্বতত্ত্ব মূলে এক তত্ত্ব জান সার।
“যথা ধর্ম তথা জয়” কথা নাহি আর।।
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদের ভবিষ্যৎ বাণী
পঞ্চাশ বছর পূর্বে গুরুচাঁদ কয়।
ভোট দিয়ে সব কাজ হইবে নির্ণয়।।
ভোটে রাজা প্রজা হবে পৃথিবী ভরিয়া।
ক্রমে ক্রমে সেই বাক্য এসেছে ফলিয়া।।
একদিন ডাকি বলে সে মধুসূদনে।
ঘৃতকান্দিবাসী যিনি সর্ব লোকে জানে।।
“শোন মধু! শোন কুঞ্জ! যাহা দেখা যায়।
‘অবতার’ যেইখানে আসি জন্ম লয়।।
শহর বন্দর সেথা হয় কালে কালে।
এই দেশে যাহা হবে যাই আমি বলে।।
আমি যেন দেখিলাম ঘৃতকান্দি হ’তে।
রাজপথ সমপথ গেছে পশ্চিমেতে।।
তার দুই ধারে যেন বিচিত্র শোভায়।
দালান, মন্দির কত দাঁড়াইয়া রয়।।
মনে হয় কি যেন কি সফলাডাঙ্গায়।
আশ্চর্য হইবে লীলা বাবার দয়ায়।।”
আর দিন কত ভক্তে প্রভু ডেকে কয়।
(গ্যাপ)
“শ্রীহরির বংশে ভগবান অবতীর্ণ হয়।
সেই বংশে ‘রাজশক্তি’ আসিবে নিশ্চয়।।”
মথুরায় জন্মে কৃষ্ণ দেবকী উদরে।
কংস ভয়ে পলাইয়া গেল ব্রজপুরে।।
করিল মধুর লীলা কৃষ্ণ দয়াময়।
“শত গোলকের তুল্য বৃন্দাবন” কয়।।
অনায়াসে রত্ন পেলে যা’ ঘটে কপালে।
রত্ন নিয়ে ছিনিমিনি করে সবে মিলে।।
দড়ি আনি নন্দরাণী বান্ধে কৃষ্ণধনে।
কৃষ্ণকে পাঠায় নন্দ বনে গোচারণে।।
গরবিনী রাধারাণী মানে’ সীমা নাই।
রাখালে রাখাল ভেবে ডাকিল ‘কানাই’।।
পদ সেবে লক্ষ্মী যার ব্রহ্মা করে ধ্যান।
ব্রজবাসী নরজ্ঞানে করে অপমান।।
গোকুল কান্দায়ে গেল কৃষ্ণ মহাতেজা।
মথুরায় নিজ ঘরে হ’ল মহারাজা।।
লোকাচারে লোকে তাই বলে সর্বদায়।
“রাজকন্যা বলে প্যারী (অত) মান ভাল নয়।।”
সফলানগর হ’তে জমিদার ভয়।
ওড়াকান্দি হরিচাঁদ হইল উদয়।।
আশ্চর্য মধুর লীলা সেইখানে হয়।
তীর্থ শ্রেষ্ঠ ওড়াকান্দি সর্বজনে কয়।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ ছিল ধামেশ্বর।
ওড়াকান্দিবাসী জনে কত অহংকার!
যাহা কিছু ওড়াকান্দি শুভ কাজ হয়।
শ্রীগুরুচাঁদের হস্ত তার পাছে রয়।।
ক্রমে দেখ ওড়াকান্দিবাসী যত নর।
প্রভুর সঙ্গেতে বাদ করে নিরন্তর।।
শতবার ক্ষমা প্রভু করিল সবারে।
অভিশাপ দিলা শেষে ব্যথিত অন্তরে।।
একদা প্রভাত কালে আসি গদী ঘরে।
জিজ্ঞাসা করিল প্রভু অতি ক্রোধভরে।।
“ওড়াকান্দিবাসী কেহ আছ কি এখানে?
আমি যাহা বলি তাহা রাখ’ সবে শুনে।।”
নিয়তির খেলা দেখ অকাট্য কেমন!
ওড়াকান্দিবাসী কেহ ছিল না তখন।।
একমাত্র বড় বাবু প্রমথরঞ্জন।
নীরবে বসিয়া শোনে প্রভুর বচন।।
লোকাচারে চোখে প্রভু দৃষ্টি নাহি ধরে।
হাতে ধরে তাই কেউ সাথে সাথে ফিরে।।
বারে বারে তিন বার প্রভু ডেকে কয়।
“ওড়াকান্দিবাসী কেহ আছ কি হেথায়?”
উত্তর না পেয়ে প্রভু ক্রোধভরে কয়।
“নাই কেহ থাকিবে না কিছুও হেথায়।।”
সহসা করিল চিন্তা প্রমথরঞ্জন।
ওড়াকান্দিবাসী বটে আমি একজন।।
উর্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে ধরিয়া চরণ।
“বলে ওড়াকান্দিবাসী আমি একজন।।”
হাসিয়া বলিল প্রভু “প্রমথ দা নাকি?
তোরে আর একেবারে নাহি দেব ফাঁকি।।
এক মুঠা খেতে দাদা অবশ্য পাইবে।
শ্রীহরিচাঁদের প্রতি ভরসা রাখিবে।।”
তিনি কি গড়িলেন?
“বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি”
“মতুয়া-আত্মভোলা বীর সাধু।”
শ্যামল বাংলার কোলে
বাঁধিয়া প্রেমের জালে
ঘরে ঘরে বাজে তাঁর
ডঙ্কা শিঙ্গা রোল।
বলরে হরিবোল!
আনন্দের শিহরণ,
নাচে বুকে ঘন ঘন
মরা প্রাণে জেগে ওঠে,
আনন্দেরি দোল!
বলরে হরিবোল!
এনে সঞ্জীবনী সুধা
মিটা’ল প্রাণের ক্ষুধা,
জেগে ওঠে গুরুভক্ত
মতুয়ার দল।
বলরে হরিবোল!
প্রেমে আঁখি ছল ছল
বুকে শক্তি দেহে বল
বজ্রসম রুদ্র পুনঃ
কুসুম-কোমল।
বলরে হরিবোল!
হরিপ্রেমে মাতোয়ারা
গুরুপদে রহে মরা
কীর্তনের কালে ধরা
করে টলমল।
বলরে হরিবোল!
ব্যথিতের বেদনায়
গলে যায় করুণায়
তার দুঃখে দুঃখী সেজে
ফেলে অশ্রু জল।
বলরে হরিবোল!
নারী জাতি জানে মাতা,
শ্রদ্ধায় নোয়ায় মাথা
নতশিরে দেখে মাত্র
চরণের তল।
বলরে হরিবোল!
নারীর সম্মান লাগি,
হ’তে পারে সর্বত্যাগী
দিতে পারে পলকেতে
ধরা রসাতল।
বলরে হরিবোল!
সে জানে দেবতা নাই
মানুষে মানুষ পাই
মানুষ সবার শ্রেষ্ঠ
মানুষেই বল।
বলরে হরিবোল!
সরল অকুতোভয়
মরণেতে নাহি ভয়,
হরি গুরুচাঁদে জানে
পথের সম্বল।
বলরে হরিবোল!
আপনার বুক চিরে,
প্রমথরঞ্জনে ধরে
মতুয়ার করে করে
দিল সিদ্ধি ফল।
বলরে হরিবোল!
করিলেন লীলাসাঙ্গ
গড়িয়া মতুয়া-সঙ্ঘ
প্রমথরঞ্জন বলে
এস হে সকল।
বলরে হরিবোল!
জীবনের কুরুক্ষেত্রে
‘অনন্ত বিজয়’ পত্রে
প্রথম দিতেছে বাণী
অভয় সকল।
বলরে হরিবোল!
মতুয়ার মহাসঙ্ঘ
বলিতেছি সে প্রসঙ্গ
কোন কোন দেশে আছে
কোন মহাবল।
বলরে হরিবোল!
অপার্থিব প্রেমাবদ্ধ দম্পতীর একসঙ্গে দেহত্যাগ
কানাই ঠাকুর নামে তালেশ্বর গাঁয়।
বাগহাট থানা মধ্যে খুলনা জিলায়।।
হেমন্তকুমারী নামে সাধ্বী পত্নী তার।
অপার্থিব প্রেমে বদ্ধ এই নারী নর।।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে দৃঢ় নিষ্ঠা রাখে।
পতি পত্নী সর্বদায় একসঙ্গে থাকে।।
পুত্র-কন্যা-হীন দেখি প্রভু বলে তাকে।
(গ্যাপ)
“সন্তান বলিয়া তোরা পোষ এক পাখী।।”
শালিকের বাচ্চা এক রাখিল পুষিয়া।
হরি বলে দিন কাটে নিরালে বসিয়া।।
নরদেহে গুরুচাঁদ করিলেন ত্যাগ।
দম্পতী সংসারে তা’তে হ’ল বীতরাগ।।
ভক্ত কি অভক্ত যার সকলের যাত্রী।
বিরহ বেদনা দিয়ে বেড়াইল ঘুরি।।
সর্বস্ব বেচিয়া কিছু অর্থ হাতে হ’ল।
আশ্রয়ে রাখিয়া এক দুষ্ট তাহা নিল।।
অর্থ নিয়া পরে দোঁহা তাড়াইয়া দেয়।
চৈত্র মাসে লক্ষ্মীখালী হইল উদয়।।
সরল সহজ দেখি দম্পতীর প্রাণ।
দয়া করি শ্রীগোপাল দিল দোঁহে স্থান।।
জ্যৈষ্ঠ মাসে এক সঙ্গে উভয়ের জ্বর।
একসঙ্গে আসে ছাড়ে নাহি ভাবান্তর।।
সপ্তম দিবসে দেখ জ্বর বৃদ্ধি হ’ল।
হরি বলে সে কানাই জীবন ত্যজিল।।
সংবাদ জানিয়া বলে হেমন্তকুমারী।
“চলে গেলে প্রাণনাথ কিসে প্রাণ ধরি?”
শয্যা ত্যাগ করি দেবী হাঁটিয়া চলিল।
পতির চরণ তলে শয়ন করিল।।
কেন্দে কেন্দে বলে দেবী “ওগো প্রাণেশ্বর।
আজ কেন ছেড়ে যাও দাসীকে তোমার?
চিরকাল দয়া করে রাখিয়াছ সাথে।
দাসীরে ছাড়িয়া একা হও কোন পথে?
অপরাধ হয়ে থাকে দয়া করে ক্ষম।
দাসীকে লহ গো সাথে ওগো প্রিয়তম।।”
তৃষ্ণার্ত হইয়া দেবী জল খেতে চায়।
একটি ডাবের জল তারে এনে দেয়।।
কেন্দে কেন্দে জলপান সে সতী করিল।
পতির বামেতে এসে আপনি শুইল।।
সতীর প্রার্থনা কভু ব্যর্থ নাহি হয়।
পতিশোকে সতী নারী দেহ ছেড়ে যায়।।
ধন্য সতী! ধন্য পতি! ধন্য ব্যবহার।
সতীর চরণে করি কোটি নমস্কার।।
“প্রেম প্লাবনে ভক্ত-তরঙ্গ”
অনন্ত-সায়ারে হরি অনন্ত-শয়নে।
কাঁপিল ক্ষীরোদ সিন্ধু ধরার ক্রন্দনে।।
আদরিনী কন্যা ধরা ডাকে বারে বার।
‘ত্রাহি’ ‘ত্রাহি’ বিশ্বনাথ! পারি না যে আর।।
পাপ-দাবানলে অঙ্গ যেতেছে পুড়িয়া।
শান্তি দাও শান্তিপতি! ধরাতে নামিয়া।।
বিন্দু মাত্র ক্ষীরসিন্ধু কাঁপিয়া উঠিল।
ডুবিল তাপিতা ধরা প্লাবন ছুটিল।।
অনন্ত ক্ষীরোদ সিন্ধু সৃজন মেখলা।
ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র বিন্দু ধরণী একেলা।।
সম-ভার কেন্দ্রে বিশ্ব রাখি তুলা দণ্ডে।
অচিন্ত অব্যয় শক্তি দেখে প্রতি দণ্ডে।।
প্রতি বিন্দু সমেস্থিতঃ সৃষ্টির মাহাত্ম।
অসমে শাসিয়া সম করিছে প্রভুত্ব।।
অসম ধরার বুকে আনে হাহাকার।
কাঁপিল ক্ষীরোদ সিন্ধু ছুটিল জোয়ার।।
বিশ্ব-শান্তি নরাকারে করে মহারণ।
অসম নাশিনী ছোটে প্রেমের প্লাবন।।
তরঙ্গ আকারে তাহে কোটি ভক্তগণ।
সংক্ষেপে করিব আমি সে সব বর্ণন।।
করুণা করিয়া গুরু! হৃদয় কন্দরে।
দেখা দাও দয়াময়! স্নিগ্ধ মূর্তি ধরে।।
প্রেমের প্লাবন ছোটে ওড়াকান্দি হ’তে।
দেশে দেশে চলে স্রোত নানাবিধ পথে।।
নরদেহ হরিচাঁদ দিলেন ছাড়িয়া।
শক্তিরূপে গুরুচাঁদ রহিল বেড়িয়া।।
অজ্ঞ যারা তারা ভাবে “বন্যা বুঝি নাই”।
জানিল প্রকৃত তত্ত্ব তারক গোঁসাই।।
“পিতা-পুত্র অভিন্নত্মা” করিল প্রচার।
দ্বিতীয় প্লাবনে ঢেউ প্রথমে তাঁহার।।
গোলকের শক্তি পেল স্বামী মহানন্দ।
গুরুচাঁদে পূজা করে জানি পূর্ণব্রহ্ম।।
দ্বিতীয় তরঙ্গে বেগ দিল মহানন্দ।
ধাইল কলির জীব দূরে গেল সন্দ।।
যশোহরে হরিপাল পালের প্রধান।
বাদাবনে গিয়ে পেল তত্ত্বের সন্ধান।।
ওড়াকান্দি এসে দেখে প্রেমের প্লাবন।
জাতিকুল মান ফেলে ডুবিল তখন।।
কত যে করুণা প্রভু তাহারে করিল।
ধন জন দিনে দিনে বাড়িয়া চলিল।।
‘জাতি’ ‘জাতি’ তুচ্ছ কথা হরিভক্তি সার।
দেশে দেশে হরিপাল করিল প্রচার।।
“এমন মানুষ আমি দেখিয়াছি চোখে।
তাঁহারে দেখিলে আর গর্ব নাহি থাকে।।”
তার দেশে যত ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।
এই বাক্যে তারা সবে বুঝে বিপরীত।।
তারা বলে “সে মানুষে আন মোরা দেখি।
আমাদের গর্ব কিছু নাশ হয় নাকি।।”
তাই বুঝি হরিপাল হয়েছে পাগল।
তাই বুঝি তার ঘরে খাও অন্ন জল।।
ব্রাহ্মণের কূটচক্রে সেই হরিপালে।
বাদ দিল স্বজাতিরা মিশি এক দলে।।
কায়স্থ নবীন বসু খালাসিয়া বাস।
তারকেরে গুরু বলে করেন বিশ্বাস।।
ওড়াকান্দি এসে পরে মতুয়া হইল।
তার যত স্বজাতিরা তারে বাদ দিল।।
মনোদুঃখে দুইজনে গেল ওড়াকান্দি।
প্রভুর চরণে গিয়ে পড়িলেন কান্দি।।
তারা কয় “দয়াময়! যদি একবারে।
দয়া করে যাইতেন সে কেশবপুরে।।
আমাদের দুঃখ ভার নিশ্চয় কমিত।
আপনারে দেখে পাপী দমন হইত।।”
ভক্ত দুঃখে দুঃখী প্রভু বলে “বাধা নাই।
মহোৎসব আয়োজন করা কিন্তু চাই।।
আনন্দে ছুটিল তারা সে কেশবপুরে।
মহোৎসবের লাগি তারা আয়োজন করে।।
বিরোধী পণ্ডিতবর্গে দিল সমাচার।
দলে দলে পণ্ডিতের আসিল বহর।।
ভাবিছে পণ্ডিত সবে যার যার মনে।
‘হেস্ত-নেস্ত’ আজ কিছু করিব এখানে।।
এদিকে প্রভুজী তবে চলিল নৌকায়।
শ্রীবিধু চৌধুরী তার সঙ্গে সঙ্গে রয়।।
নৌকা নিয়ে ঘাটে যাওয়া বড়ই কঠিন।
বাহুড়িয়া যেতে হলে লাগে একদিন।।
প্রভু কয় বিধু তুমি হেথা হতে যাও।
আমার সকল কথা হরিপালে কও।।
আমি নাহি যাব সেথা নৌকা পথে ঘুরি।
পারে যদি হেথা হতে নিক তার বাড়ী।।
আজ্ঞা পেয়ে বিধু গিয়ে সেথা উপস্থিত।
দেখিল বিরাট সভা অসংখ্য পণ্ডিত।।
স্মৃতি তীর্থ স্মার্ত্তারত্ন তর্ক পঞ্চানন।
বসিয়াছে সভা করে সেথা জনে জন।।
তার মধ্যে খাট দিয়া খাটের উপরে।
করেছে আসন এক বিচিত্র আকারে।।
“প্রভুর আসন” তাহা হরিপাল কয়।
বিধুর অন্তরে তাতে লাগে মহা ভয়।।
মনে ভাবে আজ বুঝি হবে অপ্রস্তুত।
বিশেষতঃ চারিদিকে পণ্ডিতের যুথ।।
কি জানি কি আছে ভাগ্যে আজিকার দিনে।
আমি ত’ মনেতে মোটে সাহসী হইনে।।
যা’ হোক তা’ হোক বিধু বলে সমাচার।
হরিপাল বলে তা’তে চিন্তা কিবা আর।।
বিধুকে বলিল “অগ্রে চলুন আপনি।
লোকজন নিয়ে আমি আসিব এখনি।।”
ত্র্যস্তেব্যস্তে বিধু গিয়া প্রভুজীরে কয়।
“কর্তা! হেথা যাওয়া আজ মোটে ভাল নয়।।”
সকল বৃত্তান্ত বিধু বলিল খুলিয়া।
কথা শুনে প্রভু তবে বলিল রাগিয়া।।
“ভীরু পুরুষের মত কথা কেন কও?
সিংহ-শিশু হয়ে কেন ভেড়া বনে যাও?
মোদের সহায় আছে আপনি শ্রীহরি।
এ বিশ্ব জগতে মোরা কারে শঙ্কা করি।।”
হেনকালে হরিপাল বহু লোক সাথে।
উপস্থিত হইলেন প্রভুর সাক্ষাতে।।
প্রভু কয় “কোন ভাবে যাবে এই তরী?”
হরিপাল বলে “প্রভু কিসে শঙ্কা করি”।।
তখনি সকলে তরী ধরে হাতে হাতে।
সকলের স্কন্ধে তরী চলে শুষ্ক পথে।।
মুহূর্তে সংবাদ গেল সভার ভিতরে।
“শ্রীগুরুচাঁদের তরী আসে শূন্য ভরে।।”
আশ্চর্য মানিয়া তবে পণ্ডিতেরা কয়।
“এইরূপ কাণ্ড নাহি কভু শোনা যায়।।
যার তরী শূন্য ভরে উড়ে যেতে পারে।
সে জন সামান্য নহে পৃথিবী ভিতরে।।”
হেনকালে তরী নিয়ে উপস্থিত হ’ল।
কাণ্ড দেখি বিশ্ববাসী আশ্চর্য মানিল।।
সভা স্থলে প্রভু যবে করিল প্রবেশ।
সকলে চাহিয়া দেখে অপরূপ বেশ।।
আপন আসনে প্রভু আপনি বসিল।
আসনের রূপ যেন দ্বিগুণিত হ’ল।।
কোন কোন পণ্ডিতেরা ভাবিল অন্তরে।
আসনে বসিতে প্রভু ডাকিবে তাদেরে।।
আসনে বসিলে প্রভু তারা ভাবে মনে।
আসনে বসিতে যেন শঙ্কা হয় কেনে।।
এত যে পণ্ডিত ছিল তর্ক বান নিয়ে।
সব তর্ক থেমে গেল প্রভুকে দেখিয়ে।।
ধীরে ধীরে প্রভু তবে বলে বহু কথা।
পণ্ডিতেরা সায় দিয়ে ঘন নাড়ে মাথা।।
মহানন্দে মহোৎসব হ’ল সমাপন।
অবশেষে বলিলেন পণ্ডিতেরগণ।।
“যার তরী শূন্য ভরে উড়ে যেতে পারে।
শ্রেষ্ঠ গুরু বটে তিনি শাস্ত্রের বিচারে।।
তার অন্ন-অন্ন নহে সী মহাপ্রসাদ।
সে মহাপ্রসাদ খেলে নাহি হয় বাদ।।”
অনর্থক হরিপালে বাদ দেয়া হ’ল।
বুঝিলাম হরিপাল শতগুণে ভালো।।
এত বলি পণ্ডিতেরা হ’য়ে কুতূহলী।
প্রভুকে প্রণাম করে হ’য়ে কৃতাঞ্জলি।।
শ্রীতারক মহানন্দ আর হরিপাল।
তিন ঢেউ একসঙ্গে ডুবাল ময়াল।।
মহানন্দ পাগলের ভাই একজন।
দশরথ নাম তার অতি মহাজন।।
তার পৌত্র মাধবেন্দ্র রহে ওড়াকান্দি।
শ্রীগুরুচাঁদের কৃপা করে তারে বন্দী।।
হরিপাল মাতাইল পালের ময়াল।
শালনগর বাতাসী ছিল যত পাল।।
শশধর পাল তার ভগিনী কুসুম।
বারুণী মিলায় তারা চোখে নাহি ঘুম।।
শ্রীগুরুচাঁদের আজ্ঞায় মিলায় বারুণী।
শ্রীহরি মন্দিরে সেবে দিবস রজনী।।
অমূল্যরতন পাল বাড়ী নড়াগাতী।
বড় ঠাকুরাণী যারে করিলেন সাথী।।
শ্রীহরিপালের পত্নী বড় ঠাকুরাণী।
ওড়াকান্দি যাতায়াত সদা করে তিনি।।
পুত্ররূপে সে অমূল্য সাথে সাথে ধায়।
প্রতি উৎসবের কালে ওড়াকান্দি যায়।।
চিন্তারাম নামে সাধু কামারের গ্রাম।।
যার গৃহে গিয়াছেন প্রভু গুণধাম।।
শালনগর গ্রামে বাস নামে রসমতি।
শ্রীগুরুচাঁদের পদে যার নিষ্ঠা অতি।।
পতি তার চন্দ্রকান্ত বিশ্বাস সুজন।
বিদ্যাধর গ্রামে বাস করিত সে জন।।
দেহ অন্তে তার সতী রসমতি ধনি।
পিতৃগৃহে আসিলেন সেজে কাঙ্গালিনী।।
দুই পুত্র কোলে দেবী পিতৃ গৃহে রয়।
শশী নামে ভ্রাতা তার অতি মহাশয়।।
শ্রীগুরুচাঁদের নামে করে ঠাকুরালী।
দিবানিশি মুখে তার হরি হরি বুলি।।
ভ্রাতা ভগ্নি এক সঙ্গে ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা রাখে অতিশয়।।
প্রভুর আজ্ঞায় পরে দেবী রসমতি।
শ্রীহরি মন্দির গড়ে করিয়া ভকতি।।
গুরুচাঁদ কৃপাগুণে বহু রোগী সারে।
‘হাজৎ’ আনিয়া দেয় প্রভুর গোচরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীউপেন্দ্র অতি ভক্তিমান।
কনিষ্ঠ নগেন্দ্র ভক্ত দাদার সমান।।
তারক চাঁদের ঢেউ লাগিল কোথায়?
ক্রমে ক্রমে বলি শোন সেই পরিচয়।।
মহানন্দ শ্রীতারক একসঙ্গে মেলা।
এক সঙ্গে প্রায় দোঁহে করে সব লীলা।।
তা’তে দেখি শ্রীতারক যারে যারে ধরে।
মহানন্দ সর্বস্থলে তারে দয়া করে।।
পদুমা নিবাসী যিনি যাদব মল্লিক।
হরিচাঁদ পদে যার দৃষ্টি ছিল ঠিক।।
লোহারগাতীর গ্রামে শ্রীযাদব ঢালী।
পূর্বে লিখিয়াছি যার ধন্য কার্যাবলী।।
তারকচাঁদের পদে আত্মসমর্পণ।
মহানন্দ করে দয়া তাঁহার কারণ।।
হরিলীলামৃত গ্রন্থ করাঙ্কিত করে।
গোস্বামীজী মহানন্দ এল তার ধারে।।
শিরে পদ রাখি তারে আশীর্বাদ দিল।
কেন্দে কেন্দে সে যাদব আকুল হইল।।
মহানন্দ শ্রীতারক হ’লে অন্তর্ধান।
পূর্বাপর শ্রীযাদব ওড়াকান্দি যান।।
গুরুচাঁদ অন্তে এবে প্রমথরঞ্জন।
মতুয়ার মহাসংঘ করেছে গঠন।।
শ্রেষ্ঠ এক স্তম্ভ তার যাদব গোস্বামী।
নতশিরে গোস্বামীর চরণেতে নমি।।
শ্রীকার্ত্তিক, গণপতি দুই পুত্র তার।
গণপতি বিয়া কৈল ঘৃতকান্দি পর।।
শ্রীরাধাচরণ মৃধা কুমুদের পিতা।
গণপতি হয় বটে তাঁহার জামাতা।।
প্রমীলা নামেতে কন্যা সরলা সুমতি।
প্রভুর আজ্ঞায় বিয়া করে গণপতি।।
মহানন্দে দেখে মত্ত হল হরিবর।
কবিরত্ন, কবিশ্রেষ্ঠ উপাধি যাঁহার।।